ওসমান ডাকাত

ওসমান ডাকাত

আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে ভারতের পশ্চিমবাংলার হাওড়া জেলার হাঁটুরে নপাড়া গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে ওসমান ডাকাতের জন্ম। তখন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান মিলে একটা দেশ ছিল। ইংরেজরা সে সময় গোটা ভারত শাসন করত। তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠশালার প্রচলন ছিল। ওসমান ছোটবেলা থেকে খুব দুরন্ত ধরণের ছেলে ছিল। ভয়-ডর কাকে বলে জানত না। খুব বুদ্ধিমানও ছিল। তার বাবা আজম খান অল্প শিক্ষিত ছিলেন। তিনি ছেলেকে পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। ভালো ছাত্র হলেও ওসমানের পড়াশোনা করতে মন চাইত না। তাই প্রায় পাঠশালায় না গিয়ে পাড়ার যে সব ছেলেরা পাঠশালায় যেত না তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করত। এজন্য তাকে পাঠশালার পন্ডিত মশায়ের কাছে ও বাড়িতে বাবার কাছে প্রায় মার খেতে হত। এভাবে দু’বছর কেটে যাওয়ার পর একদিন অন্য পাড়ার একজনের ডাব চুরি করার সময় ধরা পড়ে। লোকটা ওসমানকে ধরে নিয়ে এসে তার বাবার কাছে নালিশ করে। সেদিন আজম খান ছেলেকে খুব মারধর করার সময় বললেন, নিজেদের কত ডাব গাছ রয়েছে, আর তুই কি না অন্য লোকের ডাব চুরি করতে গেছিস? ঐ ঘটনার পর ওসমান একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। বাপ চাচারা অনেক খোঁজা-খুজি করেও তাকে পেলেন না।

তারপর প্রায় বিশ বছর পর যখন সে ফিরে এল তখন তার বাবা আজম খান মারা গেছেন। আজম খানের বিষয় সম্পত্তী ভালই ছিল। তাতেই তাদের সংসার বেশ ভালোভাবে চলে যেত। এতদিন পর ছিলেকে ফিরে পেয়ে তার মা আয়েশা খাতুন খুব খুশি। খুব ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দিলেন।

ওসমান বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ডাকাতদের হাতে পড়ে। ডাকাত সর্দার তাকে ছেলের মতো মানুষ করার সাথে সাথে ডাকাতিও শেখায়। ওসমান ছ’ফুট লম্বা। ছিপছিপে ধরণের শরীর হলেও গায়ে ছিল ভীষণ শক্তি। দলের কেউ তার সঙ্গে শক্তিতে পারত না। তার উপর সে ছিল বুদ্ধিমান। তাই সর্দার মারা যাওয়ার আগে তাকে সর্দার করে এবং সর্দার মারা যাওয়ার পর বাড়িতে ফিরে আসে।

বাড়িতে এসে বিয়ে-শাদি করলেও ডাকাতি ছাড়ে নি। তবে নিজেদের গ্রামে অথবা আশে-পাশের গ্রামে সে ডাকাতি করত না। দলের লোকেরা বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে ধনী লোকদের খোঁজ নিয়ে এসে জানাবার পর ওসমান ডাকাত তাদের চিঠি দিয়ে জানাত, “তারা অমুক দিন রাতে তাদের বাড়িতে ডাকাতি করবে”। শুধু তাই নয়, চিঠিতে ধনী অনুযায়ী পঞ্চাশ হাজার অথবা একলক্ষ টাকা রেডি রাখার কথাও উল্লেখ করে লিখত, টাকা রেডি রাখলে কারো উপর অত্যাচার করা হবে না। আর যদি রেডি করে রাখা না হয় অথবা টাকা কম হয় অথবা থানায় বা গ্রামের লোকজনদের নিয়ে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তা হলে বাড়ির সবাইকে যমালয়ে পাঠিয়ে দেবে। পশ্চিমবাংলার ধনী ও জমিদাররা ওসমান ডাকাতের ভয়ে কম্পমান ছিল। পুলিশরা তাকে ধরার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে; কিন্তু পারে নি। আর পারবেই বা কি করে? তাকে তো কেউ চেনে না। তার ঠিকানাও জানে না। চিঠিতে শুধু তার দস্তখত থাকত। তাই সবাই তাকে ওসমান ডাকাত নামেই জানে। যাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে তাদের কাছে পুলিশরা জেনেছে ওসমান ডাকাত খুব লম্বা, স্বাস্থ্য খুব ভালো। গায়ের রং কালো কুচকুচে এর বেশি তার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারে নি।

ওসমান যে ডাকাতের সর্দার এবং বিভিন্ন গ্রামে ডাকাতি করে, একথা তার গ্রামের লোক কেউ জানত না। কারণ সে গ্রামের লোকজনের কাছে সুফি সেজে থাকত। আর গরিবদের নানাভাবে সাহায্য করত। এমনকি তার মা ও বৌ-ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত জানত না। তবে তার বৌ পরে জানতে পারে এবং একদিন স্বামীকে ডাকাতি ছেড়ে দেয়ার কথা বলে।

ওসমান ডাকাতি করলেও কখনও যেমন কাউকে খুন করে নি, তেমনি কোনো মেয়েমানুষের গায়ে হাত নিজেও দেয় নি আর দলের কাউকেও দিতে দেয় নি। বৌ ডাকাতি ছেড়ে দেয়ার কথা বলতে বলল, আমি তো নিজের জন্য ডাকাতি করি না। দলের লোকজন খুব গরিব। তাদের জন্য ও অন্যান্য গরিবদের সাহায্য করার জন্য করি।

বৌ বলল, আল্লাহ আমাদের যা কিছু দিয়েছেন তা থেকে গরিবদের সাহায্য করো। অন্যের ধন ডাকাতি করে গরিবদের দিলেও আল্লাহর কাছে তুমি দোষী এবং দেশের মানুষের কাছেও দোষী। কথায় আছে না, “চোরের দশদিন আর গেরোস্তের একদিন”? তাই বলছি, একদিন না একদিন তুমি ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়বেই। তখন কি হবে? গ্রামের লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবে?

ডাকাতি করে করে ওসমানের দীল শক্ত হয়ে গিয়েছিল। বৌ-এর কথা শুনে রেগে উঠে বলল, আমার কি হবে না হবে তোকে ভাবতে হবে না। তুই আমার বৌ। বৌয়ের মতো থাকবি। আমার ব্যাপারে নাক গলাবি না। নাক গলালে মেরে ভুত বানিয়ে ফেলব।

বৌ স্বামীর মেজাজ ভালোভাবেই জানে। তাই ভয়ে ভয়ে বলল, আমাকে না হয় মেরে ভুত বানাবে; কিন্তু তোমার দুটো ছেলেমেয়ে রয়েছে। তাদের যখন লোকে বলবে তোদের বাপতো ডাকাত তখন তারা তোমাকে কি ভাববে? ছেলেমেয়েদের কথাও চিন্তা করবে না?

কথাটার উত্তর দিতে না পেরে ওসমান ডাকাত খুব রেগে গিয়ে বৌকে মারতে মারতে বলল, যারা আমাদের ছেলেমেয়েদের ঐ কথা বলবে তাদের কল্লা কেটে দেবো না? আর কোনো দিন যদি আমাকে উপদেশ দিস, তা হলে সেদিন তোকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেব। সেখানে ছেলেমেয়ে দুটো ঘুমিয়ে ছিল। বাপের উঁচু গলা ও মায়ের কান্না শুনে তাদের ঘুম ভেঙ্গে যেতে তারাও ভয়ে কান্না জুড়ে দিল।

ওসমান ডাকাত তাদেরকে দাবড়ী দিয়ে চুপ করতে বলে বৌকে ছেড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠের ধারে এসে রাগ সামলাবার জন্য অনেকক্ষণ বসে রইল। নিশুতী গভীর রাত। পঞ্চমীর চাঁদ অনেক আগে ডুবে গেছে। চার;িকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটা রাতজাগা পাখি তাদের বাগান বাড়ির গাছে ডানা ঝাপটিয়ে ডেকে উঠল। কাছাকাছি কয়েকটা শেয়াল একসংগে হুক্কা হুয়া শব্দে ডেকে উঠতে গ্রামের কুকুরগুলোও ঘেউ ঘেউ করে উঠল। শিয়ালগুলো তখন থেমে গেল। এসব কিছু ওসমানের কানে গেল না। সে তখন ভাবছে, গতকাল তার দলের একজন খবর দিয়ে গেছে, কলকাতার কাছাকাছি বাঁকড়ার এক জমিদার বাড়িতে ডাকাতি করার জন্য। তার হাতে সে চিঠিও পাঠিয়ে দিয়েছে জমিদারকে দেয়ার জন্য। হঠাৎ তার বিবেক বলে উঠল, বৌকে যে মারধর করলি, সে তো কোনো অন্যায় কথা বলে নি। তুই নিজেই চিন্তা করে দেখ, তুই যা করছিস তা কি ঠিক? ঠিক নয়। কারণ অন্যের ধন ডাকাতি করে এনে গরিবদের সাহায্য করলেও তা পাপ। আর পাপ কাজের পরিনাম কোনো দিন ভালো হয় না। সাগরও যেমন শুকায় না পাপও তেমনি লুকায় না। জীবিত অবস্থায় যদি পাপ প্রকাশ নাও হয়, মরে যাওয়ার পর তা প্রকাশ হবেই। তা ছাড়া তুই মুসলমান। পরকালে আল্লার কাছে মুখ দেখাবি কি করে? শেষে ভেবে ঠিক করল, এটাই তার শেষ ডাকাতি। এরপর আর কোনোদিন ডাকাতি করবে না। বাঁকড়ার জমিদার বাড়িতে যাওয়ার সময় সেকথা বৌকে জানিয়ে গেল।

বাঁকড়ার জমিদার ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ। তিনি চিঠি পেয়ে থানায় গিয়ে বড় দারোগার কাছে চিঠিটা দিয়ে বললেন, আপনারা যদি ওসমান ডাকাতকে ধরতে পারেন, তা হলে আমি দশ হাজার টাকা বখশীষ দেব।

তখনকার দশ হাজার টাকা কম নয়, এখনকার এক লক্ষ টাকার চেয়েও বেশি। দারোগা অনেক পুলিশ নিয়ে নির্দ্দিষ্ট দিনে জমিদার বাড়ির চারপাশে ওৎ পেতে রইল ওসমান ডাকাতকে ধরার জন্য।

জমিদার বাড়িটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সদরের দিকে একটা মাত্র লোহার গেট। অবশ্য পিছনের দিকে একটা ছোট গেট আছে, সেটা ও লোহার এবং সব সময় বন্ধ থাকে। তাই বাড়ির ঐদিকের বাইরে ও ভিতরে ছোট বড় নানারকম গাছপালা হয়ে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। সেই গেটের কথা বাড়ির লোকজন ও চাকর চাকরানীরা ছাড়া বাইরের কেউ জানে না।

ওসমান ডাকাতের ডাকাতির পদ্ধতি ছিল, যে বাড়িতে ডাকাতি করবে, তার দলের একজন সেই বাড়ির একজন চাকরের সংগে বন্ধুত্ব করে সব খবরাখবর নিয়ে ওসমান ডাকাতকে জানাবে এবং ডাকাতি করার আগের দিন চাকরের সংগে থাকবে। তারপর সর্দারের সংকেত পেয়ে গেট খুলে দেবে।

জমিদার বাড়িতেও ওসমান ডাকাত ঐ পদ্ধতিতে দলবল নিয়ে বাড়ির পেছনের দিকের ছোট গেটের কাছে এসে সংকেত দিল। লোকটা চাকরের মুখে গামছা পুরে দিয়ে হাত পা বেঁধে রেখে বাড়ির পিছনের দিকের গেট খুলে দিল।

দারোগা যে পুলিশ নিয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে, তা জমিদার বাবুর বাড়ির সবাই জানে। তাই তারা রাত বারটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু জমিদার ঘুমালেন না। তিনি বন্দুক নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠে সদর

গেটের দিকে লক্ষ্য রাখলেন। তিনি চিন্তাও করতে পারেন নি পেছনের গেট দিয়ে ডাকাতরা আসবে।

দলের লোকটা গেট খুলে দিয়ে সর্দারকে পুলিশের কথা ও জমিদার বাবুর ছাদে থাকার কথা জানিয়ে দিল।

ওসমান ডাকাত রেগে গিয়ে সবাইকে বলল, তোমরা শুধু টাকা পয়সা ও সোনাদানা নেবে। যারা দিতে চাইবে না, তাদেরকে আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলবে। কিন্তু কাউকে খুন করবে না। আমি জমিদারকে শায়েস্তা করার জন্য ছাদে যাচ্ছি।

পুলিশদের সংগে জমিদারের কথা ছিল, যদি ডাকাতরা কোনোভাবে বাড়িতে ঢুকে পড়ে, তা হলে জমিদার দু’তিনটে উড়ো ফায়ার করবেন আর গেটের কাছে যে চাকর থাকে, সে গেট খুলে দেবে। তখন পুলিশরা ডাকাতদের ধরার চেষ্টা করবে।

ঘরের লোকজনদের আর্তচিৎকার শুনে জমিদার বুঝতে পারলেন, ওসমান ডাকাত দলবল নিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। তাই তিনি তিনবার উড়ো ফায়ার করলেন। পুলিশরা বন্দুকের শব্দ পেয়ে সদর গেটের কাছে এসে বন্ধ দেখে চিৎকার করে খুলে দিতে বলল। কিন্তু কে খুলবে? যে খুলবে তাকে তো ডাকাতদের একজন বেঁধে রেখে গেছে।

পুলিশদের চিৎকার ও চাকর গেট খুলছে না দেখে জমিদার নামার জন্য সিড়ির কাছে যখন এলেন তখন একজনকে উঠে আসতে দেখে ভাবলেন, নিশ্চয় ওসমান ডাকাত। সংগে সংগে বন্দুক তুললেন ফায়ার করার জন্য।

ওসমান ডাকাত ভাবল, তার আর নিস্তার নেই। তাই নিজের জান বাঁচানোর জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও জমিদার ফায়ার করার আগেই সে ফায়ার করল। জমিদারের বুকে গুলি লাগতেই বাবারে বলে ধড়াস করে পড়ে মরে গেলেন। ওসমান ডাকাত নির্বিঘ্নে ডাকাতি করে পেছনের দরজা দিয়ে চলে গেল।

দারোগা সাহেব যখন বাড়ির পিছনের দিকেও পুলিশ রাখার কথা বলেছিল তখন জমিদার বাবু দরকার নেই বলে বলেছিলেন, ওদিকে একটা ছোট গেট থাকলেও ভিতরে বাইরে জঙ্গলে ভর্তি। তা ছাড়া ঐ গেটের কথা বাড়ির লোকজন ও চাকর চাকরানী ছাড়া বাইরের কেউ জানে না।

পুলিশরা সদর গেট কেউ খুলছে না দেখে নিজেরা অনেক্ষণ খোলার জন্য চেষ্টা করল; কিন্তু পারল না। হঠাৎ দারোগার বাড়ির পিছনের ছোট গেটের কথা মনে পড়তে সবাইকে নিয়ে সেদিকে গেল। জঙ্গলে ভর্তি থাকায় সেই গেট খুঁজে পেতে অনেক দেরি হল। যখন তারা বাড়ির ভেতরে ঢুকল, তার আগেই ওসমান ডাকাত দলবল নিয়ে চলে গেছে।

এতদিন ওসমান ডাকাতের অনেক ডাকাতির কথা বিভিন্ন থানায় ডাইরী থাকলেও কোথাও খুনের কথা লেখা নেই। তাই এবারে জমিদারকে খুন করার ফলে তাকে ধরার জন্য পুলিশ মহলে ভীষণ তোলপাড় শুরু হল। এমন কি সরকার থেকে ঘোষণা করা হল ওসমান ডাকাতকে জীবিত অথবা মৃত ধরে দিতে পারলে একলক্ষ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে।

প্রায় বছর খানেক ওসমান ডাকতকে ধরার জন্য পুলিশরা অনেক চেষ্টা করল; কিন্তু তাকে ধরাতো দুরের কথা, তার বাড়ির ঠিকানা পর্যন্ত কেউ জানতে পারল না।

তখন ইংরেজরা ভারতের শাসনকর্তা। তাদের কানে কথাটা পৌঁছালে তারা উত্তর প্রদেশের শরীফ নামে এক জাঁদরেল দারোগাকে বাঁকড়ার থানার দারোগা করে পাঠাল ওসমান ডাকাতকে ধরার জন্য।

শরীফ দারোগা একজন পাক্কা মুসলমান। লম্বা চওড়া পেটাই শরীর। বয়স চল্লিশের মতো। ফর্সা টকটকে। বাবরী চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি। ডিউটির সময় মাথায় হ্যাট থাকলেও অন্য সময় কাপড়ের গোলটুপি থাকে। তাকে ছোট বড় সবাই যেমন শ্রদ্ধা করে, তেমনি ভয়ও পায়।

শরীফ বাঁকড়ায় জয়েন করে ওসমান ডাকাতের ফাইলপত্র ও তার চিঠি পড়ল। তারপর পশ্চিম বাংলায় যত জায়গায় ডাকাতি হয়েছে সে সব জায়গায় থানাতে গিয়ে তার নামের ফাইলপত্র ও চিঠি পড়তে লাগলেন। তখন রাস্তা ঘাট ও যানবাহনের এত সুযোগ সুবিধা ছিল না। তাই শরীফ দারোগা ঘোড়ায় চড়ে সব জায়গায় যাতায়াত করতেন। সেই সাথে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ওসমান নামে যত লোককে পেয়েছেন তাদের চার পাঁচ লাইন করে লেখা জোগাড় করতে লাগলেন। একদিন বাগনান থানায় এসে যখন শুনলেন, এই থানায় ওসমান ডাকাতের নামে ডাকাতির কোনো কেস নেই তখন শরীফ দারোগার সন্দেহ হল, এখানকার কোনো গ্রামেই ওসমান ডাকাতের বাড়ি। তারপর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তাকে বাগনান থানায় বদলী করার আবেদন করলেন। ম্যাজিস্ট্রেট তার আবেদন মঞ্জুর করলেন।

বাগনান থানায় বদলী হয়ে আসার পর ওখানেও ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে ওসমান নামে লোকের খোঁজ করতে লাগলেন এবং ঐ নামে যত লোক পেলেন তাদের হাতের লেখাও নিলেন।

বাগনান থানায় ওসমান ডাকাতের দলের অজিত নামে একজন আরদালী ছিল। সে ব্যাপারটা ওসমান ডাকাতকে জানিয়ে দিল। ওসমান ডাকাত গ্রাম ছেড়ে মেদনীপুরে তার দলের একজনের বাড়িতে চলে যাওয়ার মনস্থ করল।

বলা বাহুল্য পশ্চিম বাংলার সব জেলাতেই তার দলের কেউ না কেউ ছিল।

শরীফ দারোগা যখন হাঁটুরে নপাড়া গ্রামে এসে ওসমান নামের লোকের খোঁজ করতে লাগলেন তখন সবাই ওসমান খাঁনের গুণাগুণ করে তার বাড়ি দেখিয়ে দিল।

ঐদিন বিকেলে ওসমান ডাকাত বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিল; কিন্তু শরীফ দারোগা বেলা এগারোটার সময় তার সদরে গিয়ে হাজির হলেন।

ওসমান ডাকাত খবর পেয়ে এতটুকু ভয় পেল না। সদরে এসে শরীফ দারোগার সংগে সালাম বিনিময় করে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করল।

শরীফ দারোগা বললেন, আমি কারো বাড়িতে খাই না। তারপর আলাপ করতে করতে এক সময় কাগজ কলম বের করে তার নাম, তার বাবার নাম ও ঠিকানা লিখে দিতে বললেন।

থানার আরদালী অজিত শরীফ দারোগা ওসমান ডাকাতের খোঁজে এসেছেন জেনেছে। কিন্তু তিনি যে ওসমান নামের লোকের হাতের লেখা নিচ্ছেন, তা জানে না। তাই সে কথা জানাতে পারে নি। তা ছাড়া অপরাধীরা যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, যখন ধরা পড়ার সময় হয় তখন তার বুদ্ধি লোপ পায়। ওসমান ডাকাতের বেলায়ও তাই হল। নাম ঠিকানা লিখে কাজগটা ফেরৎ দেয়ার পর তার মনে হল, কাজটা ঠিক হল না, অন্য কাউকে দিয়ে লেখানই ঠিক ছিল।

শরীফ দারোগা মুখের দিকে তাকিয়ে যেন তার মনের ভাব বুঝতে পারলেন। মৃদু হেসে বললেন, কারো সংগে আলাপ করলে তার হাতের লেখা নেয়া আমার হবি। তারপর তার পারিবারিক খোঁজ খবর নিয়ে থানায় ফিরে এসে ওসমান খাঁর হাতের লেখাটা পরীক্ষা করার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন।

শরীফ দারোগা চলে যাওয়ার পর ওসমান ডাকাত খুব চিন্তায় পড়ে গেল। তার মনে হল, ডাকাতি করার জন্য যে সব বাড়িতে চিঠি দিয়েছে, শরীফ দারোগা হয়তো সেই সব চিঠি জোগাড় করেছে এবং হাতের লেখা মেলাবার জন্য আমার হাতের লেখা নিল। কথাটা মনে হতে তার খুব আফশোস হল, কি মারাত্মক ভুল সে করে ফেলেছে। যদি সকালেই মেদনীপুর চলে যেত, তা হলে এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হত না। এখন গা ঢাকা দেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই ভেবে মেদনীপুরে তার সাগরেদের বাড়ি চলে গেল।

এদিকে দু’দিন পর কলকাতা থেকে রিপোর্ট এল ওসমান খাঁর হাতের লেখা আর ওসমান ডাকাতের হাতের লেখা এক। রিপোট পেয়ে শরীফ দারোগা গোপনে থানার একজনকে পাঠালেন ওসমান খাঁন বাড়িতে আছে কিনা জানার জন্য।

লোকটা ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে খোঁজ নিয়ে এসে জানাল, সে বাড়িতে নেই।

কোথায় গেছে জানার জন্য লোকটাকে খোঁজ নিতে বললেন শরীফ দারোগা। আরো বললেন, যতদিন না ফিরে আসে ততদিন তোমাকে এই ডিউটি করতে হবে।

প্রায় দু’আড়াই মাস পরে একদিন লোকটা জানাল, ওসমান খাঁন আজ দুপুরে বাড়িতে এসেছিল, বিকেলে আবার চলে গেছে। শরীফ দারোগা ঐদিন থেকে তার সংগে আরো একজন লোককে ওসমান খাঁর বাড়ির দিকে গোপনে চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখার জন্য পাঠালেন।

তিন দিন পর তাদের একজন এসে জানিয়ে গেল, রাত একটার সময় ওসমান খাঁনের বাড়ি থেকে একটা আলো কবরস্থানের দিকে যেতে দেখেছে। ভয়ে তারা কাছে যেতে পারে নি।

ঐদিন রাত সাড়ে বারটার সময় ঐ দু’জন লোককে সংগে নিয়ে শরিফ দারোগা কবরস্থানের রাস্তার পাশে আত্মগোপন করে রইলেন। ঠিক একটার সময় দেখলেন কালো জামা কাপড়পরা দশ বারো বছরের একটা মেয়ে এক হাতে হারিকেন ও পানির জগ, অন্য হাতে গামছায় বাঁধা কিছু নিয়ে কবরস্থানের দিকে যাচ্ছে।

তাই দেখে সংগের দু’জন খুব ভয় পেল। তাদের একজন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, পালিয়ে চলুন স্যার, দেখছেন না ওটা জিন।

শরীফ দারোগা তাদের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, তোমরা এখানে অপেক্ষা কর, জিনটা কোথায় যায় কি করে আমি দেখে আসছি। আর শোন, আমি হুইসেল বাজালেই তোমরা আলো লক্ষ্য করে ছুটে আসবে। আমার ধারণা মেয়েটি ওসমান খাঁনের। সে বাবার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে। কথা শেষ করে তিনি হারিকেনের আলো লক্ষ্য করে এগোলেন।

করবস্থানের ধারে এসে দাঁড়িয়ে দেখলেন, মেয়েটি কবরস্থানের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে কিছু যেন বলল। একটু পরে একটা কবর থেকে একজন লোক উঠে এসে মেয়েটির হাত থেকে গামছায় বাঁধা পোটলা নিয়ে খুলে খেতে আরম্ভ করল। শরীফ দারোগা যা অনুমান করেছিলেন, তার উপর নির্ভর করে খুব সাবধানে পা ফেলে আরো কাছে গিয়ে ওসমান খাঁকে চিনতে পারলেন। খাওয়ার পর ওসমান ডাকাত যখন কবরে ঢুকে গেল এবং মেয়েটি ফেরার উপক্রম করল তখন কবরের কাছে গিয়ে পিস্তল তাক করে বললেন, ওসমান খাঁন বেরিয়ে আসুন। তারপর বাঁশি বাজাল।

মেয়েটিকে জিন মনে করে পুলিশ দুটো ভয় পেলেও শরীফ দারোগার শেষের কথা শুনে ভয় অনেকটা কমে গিয়েছিল। বাঁশির আওয়াজ শুনে তারা ছুটে এগিয়ে এল।

শরিফ দারোগার কথা শুনে মেয়েটি চমকে উঠে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আর ওসমান খাঁন বুঝতে পারল, এখন পালাবার চেষ্টা করলে পিস্তলের গুলিতে প্রাণ হারাতে হবে। তবু কিছুক্ষণ চিন্তা করতে লাগল, এখন কি করবে? ধরা দেবে, না পালাবার চেষ্টা করবে?

ততক্ষণে পুলিশ দুটো পৌঁছে গেল। শরীফ দারোগা হুঙ্ককারের স্বরে আবার বললেন, কবর থেকে বেরিয়ে আসুন, নচেৎ গুলি করতে বাধ্য হব।

ওসমান খাঁন কবর থেকে বেরিয়ে আসতেই পুলিশ দুটো তার হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দিল।

তারপর হাওড়া কোর্টে ডাকাতি ও খুনের আসামী হিসাবে অনেক দিম মামলা চলল। মামলায় ওসমান ডাকাতের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হল।

যেদিন রায় হল সেদিন কোর্টে লোকেলোকারণ্য। ওসমান ডাকাতকে একনজর দেখার জন্য সারা পশ্চিমবাংলা থেকে লোক এসেছে। পুলিশ তাদেরকে সামাল দিয়ে রাখতে পারছে না।

কোর্টে রায় ঘোষণা হওয়ার পর লম্বা চওড়া এক পাঞ্জাবী শিখ ওসমান ডাকাতকে লক্ষ্য করে হিন্দিতে বলল, ইয়েতো বাঙ্গালী আদমী। মীরচী আওর পিঁয়াজসে পান্তা খাতা হ্যায়। ইসকা বদনমে কেয়া ত্যাকত হ্যায়। এইসা দুবলা পাতলা আদমীকো পুলিশলোক ইতনা দিন পাকড়নে নাসাকা?

পাঞ্জাবী শিখের কথা শুনে ওসমান ডাকাত জজের কাছে আবেদন করল, ঐ পাঞ্জাবী শিখের সংগে পাঞ্জা লড়ার জন্য।

জজ তার আবেদন মুঞ্জুর করে পাঞ্জাবী শিখকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি পাঞ্জা লড়তে রাজি আছেন?

পাঞ্জাবী শিখ তাচ্ছিল্লের সংগে বলল, ভেতো বাঙ্গালী কা সাথ কেয়া পাঞ্জা লড়েঙ্গে? উসকা আঙ্গুলী চুরচুর হো যায়েগা। ঠিক হায় আপকা মর্জি।

জজ লোকজনদের পাঞ্জা লড়ার ব্যবস্থা করে দিতে বললেন। একটা টেবিলের দু’পাশে দু’জনে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর কুনুই রেখে একে অপরের পাঞ্জা ধরার সাথে সাথে ওসমান ডাকাত পাঞ্জাবী শিখটার পাঞ্জা ধরে এমন চাপ দিল যে, তার হাতের আঙ্গুলগুলো মটমট শব্দে ভেঙ্গে গেল। আর পাঞ্জাবী শিখটা কাতরে উঠে বলল, জিওরামজী কা কসম, পান্তা ও মরিচ খানে ওয়ালা কা বদনতমে ইতনা তাকাত হোতা হ্যায়, ইয়ে মুঝে মালুম নেহী থা।

কোর্টের সমস্ত লোকজন ওসমান ডাকাতের শক্তি দেখে বাহবা দিতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *