জোঁকা

জোঁকা

সেলিমদের গ্রাম থেকে প্রায় এক মাইল দূরে মাঠের মাঝখানে একটা পুকুর। প্রায় একশ বছর বেশ বড় পুকুর আছে। পুকুরটার নাম নতুন আগে কাটান হলেও এখনও সেই পুকুরকে আশপাশের গ্রামের লোকজন কেন নতুন পুকুর বলে, তা কেউ বলতে পারে না। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, এতকাল আগের কাটান পুকুর ভরাট না হয়ে গভীর রয়ে গেছে। ছেলেবেলায় ছোট চাচার মুখে সেলিম শুনেছিল, ঐ পুকুরে জোঁকা আছে। জোঁকা নাকি একবার জমিদার বংশের একজনকে স্বপ্নে তার ছোট ছেলেকে ভোগ চেয়েছিল। অর্থাৎ ছেলেটাকে এক দুপুরে ঐ পুকুরের পানিতে ফেলে দিতে হবে। আরো বলেছিল, যদি তোর ঐ ছেলেকে ভোগ না দিস, তা হলে ঐ পুকুরে তোদের বংশের যে নামবে সে আর উঠে আসবে না। সেই থেকে জমিদার বংশের লোকেরা ঐ পুকুরের ধারে কাছে যায় না। কথাটা গোপন থাকে না। আশপাশের গ্রামের লোকজন জেনে যায় এবং তারাও ভয়ে কেউ ঐ পুকুরের ধারে কাছে যায় না। সেলিম যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন পাড়ার সমবয়সি চার-পাঁচজনকে নিয়ে একদিন সেই পুকুর দেখতে গিয়েছিল।

পুকুরের চারদিকের পাড় বেশ চওড়া। কোনো ফল-পাকড়ের গাছ নেই। ছোট ছোট জঙ্গলী গাছে ভর্তি। পুকুরের পানি কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ। পাড়ের কাছে ও দূরে অনেক শালুক গাছ। পুকুরের পানির দিকে তাকাতে গা ছম ছম করে উঠেছিল। পুকুরটার উত্তর পাশে খাল। খালের উত্তর পাড়টা ইউনিয়ন বোর্ডের বেশ চওড়া রাস্তা। সেলিমদের দেখে একজন পথিক হাঁক দিয়ে বলেছিল, এই ছেলেরা, তোমরা ওখানে কি করছ? পুকুরের পানিতে যেন কেউ নেম না। জান না, ঐ পুকুরে জোঁকা আছে? নামলে টেনে নিয়ে যাবে।

বড় হওয়ার পর অনেকবার পাড়ার ছেলেদের নিয়ে ঐ পুকুর পাড়ে গিয়ে আড্ডা দিয়েছে সেলিম। তখন দেখেছে গ্রীষ্মকালে রাখালরা গরু চরাবার সময় গরুদের পানি খাওয়াতে ও রাখালদের হাঁটু পানিতে নেমে পানি খেতে। একদিন সেলিম একটা রাখালকে পানি খেতে দেখে জিজ্ঞেস করল, তুমি যে পুকুরে নেমে পানি খাচ্ছ, এতে তো জোঁকা আছে? তোমার পা ধরে যদি টেনে নিয়ে যায়?

রাখালটা পাড়ে উঠে এসে বলল, আমিও সে কথা জানি। যারা পুকুরটা কাটিয়েছিল, তাদের বংশের কেউ নামলে জোঁকা তাকে নিয়ে যাবে, অন্য কেউ নামলে নেবে না। তবে ভয় যে একদম করে না তা নয়। কিন্তু কি করব? বাড়ি অনেক দূরে তেষ্টা নিয়ে বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে পুকুরে নামতে হয়। তা ছাড়া বাড়িতে পানি খেতে গেলে গরু হারিয়ে যাবে। তখন যার গরু তাকে কি জওয়াব দেব?

সেলিম বলল, কিছুতে করে বাড়ি থেকে পানি আনতে পার না? রাখালটা বলল, কিসে করে আনব? কলসী নিয়ে তো মাঠে গরু চরান যায় না।

সেলিমের ছোট চাচা যখন বলেছিলেন ঐ পুকুরে জোঁকা আছে, তখন সেলিম জিজ্ঞেস করেছিল? জোঁকা কি জিনিস?

ছোট চাচা বলেছিলেন, জোঁকা হল জিন। আল্লাহ মানুষকে মাটি দিয়ে তৈরী করেছেন। আর জিনকে আগুন দিয়ে। জিনেরা যেমন ডাঙ্গায় বাস করতে পারে, তেমনি পানিতেও বাস করতে পারে। তারা বড় বড় তামার পাতিলে কাঁচা টাকা রেখে সেগুলো কোনো বড় পুকুরে বা দিঘীর তলায় লুকিয়ে রাখে। তাই বড় হয়ে অনেক সময় একা ঐ পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে বসে ছোট চাচার কথাগুলো চিন্তা করত সেলিম।

তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। সেলিমদের গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে সাধু খাঁ নামে একজন লম্বা-চওড়া খুব শক্তিশালি লোক ছিল। তার সাত ছেলে, সাত মেয়ে। ছেলে-মেয়েরাও বাবার মতো লম্বা-চওড়া ও শক্তিশালী। ছেলেদের মধ্যে আবুল সবার বড়। সব ভাইয়েদের মধ্যে সে ছিল খুব দুরন্ত। সাধু খাঁ মারা যাওয়ার পর ভাইয়েদের সঙ্গে বাস্তু নিয়ে মনোমালিন্য হতে আবুল স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে ঐ নতুন পুকুর পাড়ে এসে ঘর-বাড়ি করে বাস করতে থাকে। সেলিম তখন স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় থাকলেও দু’তিন বছর অন্তর অন্তর দেশের বাড়িতে বেড়াতে যেত। কিন্তু আবুল যে নতুন পুকুর পাড়ে ঘর-বাড়ি করে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাস করছে জানতে পারে নি। ১৯৯৬ সালে সেলিম একা গিয়ে প্রায় মাস খানেক গ্রামের বাড়িতে ছিল। সে সময় ওর চাচাত ভাবি, সে আবার ওর বড় মামার মেয়ে। তার সঙ্গে গল্প করতে করতে নতুন পুকুরের কথা উঠতে ভাবি বলল, তুমি জান না, আবুল মামা অনেক বছর হল স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে সেখানে বাস করছে। নতুন পুকুরে দমকল বসিয়ে পানি ছিঁচে মাছ ধরে বিক্রি করে পাড় মেরামত করেছে, নানারকম ফল-পাকড়ের গাছও লাগিয়েছে। সে সব গাছ এখন ফলছে। সাধু খাঁকে পাড়া সুবাদে সেলিম নানা ও তার ছেলেদের মামা বলত। সব ভাইয়েদের মধ্যে আবুল মামা সেলিমকে ভীষণ স্নেহ করত।

ভাবির কথা শুনে সেলিম খুব অবাক হয়ে ভাবির মুখের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

সেলিমের অবস্থা দেখে ভাবি মৃদু হেসে বলল, খুব অবাক হয়েছ না? শুনে আমরাও খুব অবাক হয়ে একদিন দেখতে গিয়েছিলাম।

সেলিম বলল, ঐ পুকুরে তো জোঁকা আছে! যে পুকুরে জোঁকা থাকে, তার পানি তো ছেঁচা যায় না। আবুল মামা ছিঁচল কি করে?

ভাবি বলল, আমি সে কথা তোমার ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতে অনেক কিছু বলেছিল। অত কথা আমার মনে নেই। তোমার ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিও।

সেলিম ভাইয়াকে জিজ্ঞেস না করে পরের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে আবুল মামার কাছে সব কিছু জানার জন্য রওয়ানা হল। সেখানে পৌঁছে পুকুর পাড়ের পরিবেশ দেখে আর একবার অবাক হল। দক্ষিণ দিকের পাড় ছাড়া তিন দিকের পাড়ে অনেকগুলো ঘর-বাড়ি। মাটি ফেলে পাড়গুলো অনেক চওড়া করা হয়েছে। তিন পাড়ে তিনটে গোয়াল ঘর। গোয়াল ঘরের সামনে গরু-ছাগল বাঁধা। প্রত্যেক ঘরের সামনে অনেক খানি করে উঠোন। আবুল উঠোনে বাঁশের ঝুড়ি বনুছিল। সেলিম কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, আমাকে চিনতে পারছেন মামা?

প্রায় বিশ বছর পর আবুল মামাকে সেলিম চিনতে পারলেও তাকে চিনতে আবুলের একটু সময় লাগল। হাতের কাজ বন্ধ করে সালামের উত্তর দিয়ে সেলিমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি আফ্রিদা বুবুর ছেলে সেলিম না?

হ্যাঁ মামা, আমি সেলিম।

আবুল মামা সামনে একটা টুল দেখিয়ে বসতে বলে উৎফুল্ল কণ্ঠে বেশ উঁচু গলায় বলল, এই তোমরা কে কোথায় আছ, তাড়াতাড়ি এখানে এস, ঢাকা থেকে আমার এক ভাগ্না এসেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে সব ঘর থেকে ছেলে, মেয়ে, জামাই ও নাতি নাতনিরা এসে সেলিমের চারপাশে দাঁড়িয়ে কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

আবুল মামা সবার সঙ্গে সেলিমের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, জান সেলিম, আমি তোমাদের ঘরে গিয়ে আফ্রিদা বুবুর কাছে তোমার খবর নেই। তুমি দু’তিন বছর ছাড়া কয়েক দিনের জন্য এসে চলে যাও, সে কথাও জানি। মনে করেছিলাম, আমাদের কথা তুমি ভুলেই গেছ।

সেলিম বলল, আপনার কথা ভুলি নি মামা। পনের বিশ দিনের ভিসা নিয়ে আসি, সবার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া হয়ে উঠে না।

কবে এসেছ?

পরশু দিন।

এবারে কতদিন থাকবে?

এক মাসের ভিসা নিয়ে এসেছি। কাল ভাবির কাছে শুনলাম, আপনি অনেক বছর আগে এখানে এসে বাস করছেন। পুকুরও কাটিয়েছেন। এই পুকুর সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে অনেক কথা শুনে এসেছি। তাই আপনার কাছে সবকিছু জানার জন্য এলাম।

আবুল মামা হেসে উঠে বললেন, তুমি যা শুনেছ আমিও তা শুনেছি। তবে বিশ্বাস করি নি। তারপর মামিকে উদ্দেশ্য করে বলল, সেলিমকে কিছু খেতে দাও।

সেলিম বলল, নাস্তা খেয়ে এসেছি, এখন কিছু খাব না। ফিরে যাওয়ার সময় না হয় কিছু খাব। এখন বলুন, এখানে এসে যে বসবাস করছেন, কোনো রকম অসুবিধা হচ্ছে না? তা ছাড়া পুকুর কাটানোর ব্যাপারটা শুনেও খুব অবাক হয়েছি।

আবুল মামা সবাইকে চলে যেতে বলে ঝুড়ি বোনার কাজ শুরু করে বলল, সে সব অনেক কথা, বলতে অনেক সময় লাগবে।

সেলিম বলল, যতই সময় লাগুক আপনি বলুন।

আবুল মামা বলতে শুরু করল, তুমি বোধ হয় তখন বাংলাদেশে চলে গেছ। আমি প্রথমে এখানে একটা বেড়ার ঘর করে তোমার মামি ও দু’টো ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতে লাগলাম। আর বন জঙ্গল কেটে তরিতরকারীর চাষ করতাম। বর্ষাকালে খালে পাটা মেরে মগরী ও বড় বড় পাং বসিয়ে মাছ ধরে প্রচুর আয় করতাম। একবার শীতকালে যখন খালের পানি একদম কমে গেল তখন একদিন জিওল মাছ ধরার জন্য পালা দিলাম। রাত বারটার সময় তোমার মামিকে নিয়ে এসে দেখি, পালাতে প্রচুর জিওল মাছ লাফিয়ে পড়েছে। আমি বড় বালতি নিয়ে এসেছিলাম। সেটা মাছে ভরে যেতে তোমার মামিকে বললাম, তুমি এখানে থাক, আমি মাছটা রেখে আসি। তোমার মামি বলল, এত রাতে একা এখানে থাকতে আমার খুব ভয় করবে। আমিও তোমার সঙ্গে যাই। সে দিন ছিল পূর্ণিমার রাত। বললাম, কিসের ভয়? ঐতো ঘর দেখা যাচ্ছে। আমি যাব আর আসব। তারপর আমি মাছের বালতি নিয়ে ঘরে বড় গামলায় পানি দিয়ে মাছগুলো তাতে ঢেলে একটা টিন চাপা দিচ্ছি, এমন সময় তোমার মামির ভয়ার্ত চিৎকার একবার শুনতে পেলাম। আমি দৌঁড়ে এস দেখি, তোমার মামি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তাকে পাঁজাকোলা করে ঘরে নিয়ে এসে মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছিল বলতো? বলল, তুমি চলে যেতে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর পালার দিকে তাকিয়ে দেখি বিরাট দৈত্যের মতো কে একজন খালের দু’পাশে দু’পা রেখে নিচু হয়ে হাত দিয়ে পালা থেকে মাছ তুলে তুলে খাচ্ছে। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠি। তারপর কি হয়েছে জানি না। বললাম, কই, আমি গিয়ে তো কিছুই দেখলাম না। অবশ্য তোমার চিৎকার আমি শুনেছি। ঠিক আছে, তুমি ঘরেই থাক। আমি খাল পাড়ে যাই। তোমার মামি তো কিছুতেই যেতে দেবে না। শেষে সে ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি যাই। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত তোমার মামি কিছুই দেখে নি। আর আমিও কোনো কিছুই দেখি নি।

সেলিম জিজ্ঞেস করল, গোসল করেন কোথায়?

কেন? ঐ পুকুরে। অবশ্য বছর দুই তোমার মামি পুকুরে নেমে গোসল করে নি। ঘাটে বসে বাটি ডুবিয়ে নিজে গোসল করেছে আর ছেলেমেয়েদেরকেও করিয়েছে। এখন তো সবাই পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করে।

সেলিম আবার জিজ্ঞেস করল, পুকুর কাটালেন কি করে? শুনেছি, যে পুকুরে জোঁকা থাকে, সে পুকুরের পানি নাকি ছিঁচে শেষ করা যায় না?

আমিও শুনেছি; কিন্তু বিশ্বাস করি নি। তাই চিন্তা করলাম, বহুকাল আগের কাটান পুকুর, নিশ্চয় প্রচুর নানা পদের বড় বড় মাছ আছে। পুকুরটা ছিচেঁ মাছ বিক্রি করে পুকুর কাটিয়ে পাড় বাঁধব, নানা রকম গাছপালা লাগাব। চিন্তা করলে তো হবে না, পুকুরটা ছিঁচতে অনেক টাকা লাগবে। তখন টাকা পয়সা তেমন আমার ছিল না। তাই ইচ্ছা থাকলেও উপায় ছিল না। এই তো মাত্র বছর পাঁচেক আগে আল্লাহ আমার আশা পূরণ করেছে। ততদিন আরো ছেলেমেয়ে হয়েছে। নাতি নাতনি হয়েছে। ছেলে ও জামাইদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে একদিন চারপাড়ে চারটে দমকল বসিয়ে পানি ছিঁচতে শুরু করলাম। প্রথম দিন সকাল থেকে রাত বারটা পর্যন্ত দমকল চালিয়ে দেখি প্রায় তিন হাত পানি কমে গেছে। ভাবলাম, এবার মেশিন বন্ধ রাখি। কাল সকাল থেকে আবার চালাব।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, যতটা পানি কমে ছিল, ঠিক ততটা আবার ভরে গেছে। তিন দিন দমকল চালিয়ে একই রকম হতে দেখে আমারও শোনা কথার উপর বিশ্বাস জন্মাল। কি করব না করব ভেবে একদিন দমকল বন্ধ রাখলরাম। ঐ দিন রাতে স্বপ্নে দেখলাম, কে যেন একজন আমাকে বলছে, বছরের পর বছর ছিঁচলেও তুই পুকুর শুকাতে পারবি না। যদি আমার কথা শুনে সেই মতো কাজ করিস, তা হলে তোর ইচ্ছা পূরণ হবে।

বললাম, কি করতে হবে বলুন, আমি করব।

কাল সকালে আধ মন ভালো রসগোল্লা পুকুরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলবি। তারপর দমকল চালাবি। চব্বিশ ঘন্টা চালিয়ে বন্ধ করে দিবি। দেখবি অনেকটা পানি কমে গেছে। তখন দক্ষিণ পশ্চিম কোনে পানির কিনার ধরে বিশ ফুট লম্বা ও দশ ফুট চওড়া ইটি দিয়ে গেঁথে পাকা চৌবাচ্চা করবি। তারপর যখন দেখবি চৌবাচ্চা আপনা থেকে পানিতে ভরে গেছে তখন দম কল চালাবি। আর শোন, দমকল এক মিনিটও বন্ধ রাখবি না। পাঁচ দিন পাঁচ রাত এক নাগাড়ে চললে পুকুর শুকিয়ে যাবে। মাছ ধরার পর যদি পুকুরের পাঁক দিয়ে পাড় মেরামত করতে চাস করবি। তারপর একদিন রাত বারটার সময় ঐ চৌবাচ্চার পুকুরের দিকের দেয়াল ভেঙ্গে দিলে পানিতে পুকুর ভরে যাবে।

স্বপ্নটা দেখার পর ঘুম ভেঙ্গে গেল। তারপর আর ঘুম হল না। বাকি রাতটুকু জেগে কাটালাম। সকালে ফজরের নামায পড়ে বাজারে গিয়ে আধমণ রসগোল্লা কিনে এনে পুকুরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেললাম। তারপর চারটা দমকল স্টার্ট দিলাম। চব্বিশ ঘন্টা পর সব দমকল বন্ধ করে দিলাম। দেখলাম, পানি অনেকটা কমেছে। তখন রাজ মিস্ত্রি এনে পুকুরের দক্ষিণ পশ্চিম কোনে বিশ ফুট লম্বা ও দশ ফুট চওড়া চৌবাচ্চা করলাম। তারপর সেটা পানিতে ভরার অপেক্ষায় রইলাম। পরের দিন সকালে চৌবাচ্চা পানিতে ভরে রয়েছে দেখে চারটে দমকল আবার চালিয়ে দিলাম। একটানা পাঁচ দিন পাঁচ রাত দমকল চলার পর পরের দিন বেলা বারটার দিকে পুকুরের পানি একেবারে কমে গেল। সব ছেলেমেয়ে ও জামাইদের নিয়ে মাছ ধরতে শুরু করলাম। বড় বড় রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবোস, চিতল, বোয়াল ও ভেটকী মাছ প্রায় সাত আটমণ হল! সেগুলো বাগনানে মাছের আড়তে পাঠিয়ে দিলাম বিক্রি করা জন্য। তারপর শিঙ্গি, মাগুর, কই, সোল মাছও প্রায় একমন ধরা হল। রাত হয়ে গিয়েছিল বলে সেগুলো বড় বড় গামলায় জিলিয়ে রেখে বান ও পেকাল মাছ ধরার জন্য দু’টো হ্যাসাক লাইটের ব্যবস্থা করলাম। রাত বারটা পর্যন্ত প্রচুর বান, প্যাকাল ধরে সবাই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। গোসল করে খেয়েদেয়ে পশ্চিম দিকের পাড়ে খেজুর পাটি বিছিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার সময় বড় ছেলে আলিকে বললাম, তুই জেগে থাক, আমরা কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিই। ফজরের সময় আমাদের জাগাবি। নামায পড়ে বান, প্যাকাল মাছ আবার ধরব। তখন না হয় তুই ঘুমাস।

মেয়েরা ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরের ভিতর ঘুমাল। আর আমরা ঘরের বাইরে পুকুর পাড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত সাড়ে তিনটের সময় আলির আর্তচিৎকারে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আলি আমাদের কাছ থেকে একটু দূরে একটা জল চৌকিতে বসে ছিল। আর হ্যাসাক লাইট দু’টো দু’পাশের পাড়ে জ্বলছিল। চিৎকার শুনে আলির দিকে তাকিয়ে দেখি, জল চৌকিতে আলি বসে নেই। তাড়াতাড়ি করে সে দিকে গিয়ে দেখি, আলি দক্ষিণ পূর্ব কোনের অল্প দূরে লম্বা হয়ে পড়ে আছে। কাছে এসে নাম ধরে ডেকে সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত রেখে নাড়া দিয়ে বুঝতে পারলাম অজ্ঞান হয়ে গেছে।

ততক্ষণে অন্য ছেলেরা ও জামাইরা এসে গেছে। তাদেরকে আলির অজ্ঞান হওয়ার কথা বলে মাথায় পানি ঢালতে বললাম।

কিছুক্ষণ পানি ঢালাল পর আলির জ্ঞান ফিরে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছিল? তুই অমন করে চিৎকার করে উঠেছিলি কেন?

আলি কিছুক্ষণ সবাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমারও ঘুম পাচ্ছিল। তাই বেশ কিছুক্ষণ হাঁটা হাঁটি করে এসে জল চৌকিতে বসে পুকুরের দিকে তাকাতে দেখতে পেলাম, খানা বাড়িতে যেরকম তামার বড় বড় ডেগচীতে রান্না হয়, সে রকম একটা ডেগচী কাদা ফুঁড়ে বেরিয়ে দক্ষিণ পূর্ব দিকের পাড়ের কোন দিয়ে উঠে চলে যাচ্ছে। প্রথমে আমার মনে হল, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? ভালো করে চোখ রগড়ে আবার পুকুরের দিকে তাকালাম, দেখি ঐ রকম আর একটা ডেগচী আগেরটার মতো ঐ একই দিকে চলে যাচ্ছে। এভাবে আরো একটা ডেগচী চলে যেতে দেখে ভাবলাম, ডেগচী তো আর নিজে নিজে চলে যেতে পারে না, নিশ্চয় লোকজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল, আমি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সেই সময় পাশের গ্রামের লোকজন এসে বান, প্যাকাল মাছ ধরে ডেগচীতে ভরে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ভালো করে তাকিয়েও কোনো লোকজন দেখতে পেলাম না। তবু আমি পা পা করে এগিয়ে গেলাম; কিন্তু লোকজন তো দূরের কথা তিনটে ডেগচীও নেই। হঠাৎ দৈত্যের মতো বিকট চেহারার একজনকে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে আমার দিকে আসতে দেখে ভয়ে আমি চিৎকার করে উঠি। তারপর কি হয়েছে জানি না।

তখন আমার দাদির কথা মনে পড়ল, “দাদি একদিন বলেছিল এই নতুন পুকুরে ও রায় দিঘীতে জোঁকা আছে। জোঁকারা পাঁকের ভিতর ডেগচীতে করে ধনদৌলত লুকিয়ে রাখে। আরো বলেছিল, জোঁকা হল জিন। জিনেরা পানির নিচেও যেতে পারে।”

এখন আলির কথা শুনে বুঝতে পারলাম, জিনেরা তাদের ধনদৌলতের ডেগচী তুলে নিয়ে রায় দিঘীতে চলে গেছে। রায় দিঘীর কথা এজন্য মনে হল, এখান থেকে ঐ দিঘী এক মাইল দক্ষিণে। তখন সবাইকে দাদির মুখে শোনা কথা বলে বললাম, আলি যদি ডেগচী দেখার জন্য ঐদিকে না যেত, তা হলে জিন ওকে ভয় দেখাত না। তারপর আমরা কেউ আর ঘুমালাম না। ফজরের সময় হতে নামায পড়ে পুকুরের ঐ কোনের দিকে গিয়ে ডেগচীগুলো পাঁকের উপর দিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট দাগ দেখতে পেলাম। সবাইকে বললাম, আলি যা দেখেছে তা সত্য। তবে এখন আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই বলে আমি প্রথমে পুকুরের কাদায় নেমে প্যাকাল মাছ ধরতে শুরু করলাম। আমার দেখাদেখি সবাই আবার মাছ ধরতে নামল। প্রায় সারাদিন মাছ ধরলাম। বিকেলের দিকে গত কালের ধরা জিলোনো জিওল মাছ ও আজকের ধরা মাছ মিলিয়ে প্রায় তিন মণ হল। ঘরে খাওয়ার জন্য আধমণের মতো রেখে সব মাছ আড়তে বিক্রি করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে প্রায় একমাস পুকুরের পাঁক তুলে চারদিকের পাড় মেরামত করি ও পাড়ের উপরে ফেলি। তারপর একদিন রাত বারটার সময় চৌবাচ্চার পুকুরের দিকের দেয়াল ভেঙ্গে দিলাম। সকালে উঠে সবাই দেখলাম পানিতে পুকুর ভরে গেছে।

তারপর মামা মামিকে ডেকে সেলিমকে নাস্তা দিতে বললেন।

সেলিম নাস্তা খেতে খেতে বলল, আশপাশের গ্রাম তো এখান থেকে এক মাইল দূরে। ঐ এক মাস পানি কোথায় পেলেন?

আবুল মামা বলল, ঐ চৌবাচ্চা থেকে বালতিতে করে পানি তুলে সবাই গোসল করেছি, খেয়েছি ও কাপড়-চোপড় ধোয়া-ধুয়ী করেছি।

এটা খুব আশ্চার্য ঘটনা, তাই না মামা?

হ্যাঁ, খুব আশ্চার্য ঘটনা। তবে রায়দিঘী কাটানর ঘটনা আরো আশ্চার্যজনক।

অবাক কণ্ঠে সেলিম বলল, রায়দিঘীও কাটান হয়েছে?

তবে আর বলছি কি?

ঘটনাটা বলুন না মামা শুনি।

আবুল মামা বলতে শুরু করল, রায়দিঘী যে কয়েকশ একর জায়গা নিয়ে তা তো তুমি জান। দিঘীটার পশ্চিম পাড় ছাড়া বাকি তিন দিকে প্রচুর লোকজন বাস করে। তারা ঐ দিঘীর পানি সব রকমের কাজে ব্যবহার করে। কতকাল আগে কে দিঘীটা কাটিয়েছিল, তা কেউ বলতে পারে না। দিঘীর মাঝখান দিয়ে প্রায় তিন ভাগ চর পড়ে গিয়েছিল। বছর তিনেক আগে সরকার মাছ চাষ করার জন্য দিঘীটা কাটাবার টেন্ডার আহবান করে। কিন্তু এত বড় দিঘী কাটাতে কত কোটি কোটি টাকার দরকার? তাই কেউ টেন্ডার সাবমিট করল না। শেষে সরকার নিজে কাটাবার ব্যবস্থা করে ঠিকাদার নিযুক্ত করল। ঠিকাদার যখন আট দশটা দমকল বসাল পানি ছেঁচার জন্য তখন সেও আমার মতো স্বপ্ন দেখল। তবে তাকে পাঁচমণ মিষ্টি দিঘীর পানিতে ফেলতে বলেছিল। আর দিঘীর পূর্বদিকের পাড়ের কিনারে পঞ্চাশ ফুট লম্বা ও ত্রিশ ফুট চওড়া পাকা চৌবাচ্চা করতে বলেছিল। দিঘীটা কাটাতে প্রতিদিন পাঁচশ লোক কাজ করত। কাজ শেষ করতে সময় লেগেছিল প্রায় দেড় বছর। তিন পাড়ের মানুষ ঐ পঞ্চাশ ফুট লম্বা ও ত্রিশ ফুট চওড়া চৌবাচ্চার পানি দেড় বছর ব্যবহার করেছে। দিঘী কাটার পর কাজ যেদিন শেষ হল। তার পরের দিন সকালে অবাক হয়ে সবাই দেখল, চৌবাচ্চা নেই; আর পুরো দিঘীতে পানি থৈ থৈ করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *