দুই বন্ধু

দুই বন্ধু

সাদিক আর হাফিজ দুই বন্ধু। তারা একই স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। হাফিজ গ্রামের সব থেকে ধনী জমিরুদ্দিনের একমাত্র ছেলে। আর সাদিক গ্রামের সব থেকে গরিব জয়নালের একমাত্র ছেলে। আর্থিক অবস্থার দিক থেকে তাদের দু’জনের মধ্যে আসমান জমিন তফাৎ থাকলেও মনের দিক দিয়ে গভীর সম্পর্ক। সারাদিন মানিকজোড়ের মতো একসঙ্গে থাকে। এমনকি রাত দশটা এগরটা পর্যন্ত একসঙ্গে পড়াশোনা করে। শুধু ঘুমাবার সময় যে যার ঘরে ঘুমায়।

প্রথমে কিন্তু সাদিক গরিব লোকের ছেলে বলে হাফিজ তাকে ঘৃণা করত। একই ক্লাসে পড়লেও তার সঙ্গে মেলামেশা করাতো দূরের কথা, কথাও বলত না। এমনকি একদিন বন্ধুদেরকে নিয়ে তাকে মেরেও ছিল।

সাদিক খুব ভালো ছাত্র। প্রাইমারীতে বৃত্তি পেয়েছে। প্রাইমারী পাশ করার পর আর্থিক কারণে জয়নাল ছেলেকে আর পড়াতে চায় নি। সাদিক হাই স্কুলে পড়ার জন্য খুব কান্না কাটি করতে থাকে। তার মা জোহরা বিয়ের সময় মা-বাবার দেয়া একজোড়া সোনার কান ফুল বিক্রি করে ছেলেকে হাই স্কুলে ভর্তি করে।

সাদিক প্রথম দিন ক্লাসে গিয়ে দেখল, অন্যান্য সব ছেলেরা নতুন জামা কাপড় পরে এসেছে। নিজের পুরানো আড়ময়লা জামা কাপড়ের কথা চিন্তা করে সামনের বেঞ্চে জায়গা থাকা সত্ত্বেও পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসল। লক্ষ্য করল, অন্যান্য বেঞ্চে ছেলেরা পাশাপাশি বসলেও তার পাশে কেউ বসল না। শেষে যারা এল তাদের মধ্যে দু’জন অন্য কোনো বেঞ্চে জায়গা না পেয়ে তার বেঞ্চে বসলেও দুরত্ব রেখে বসল।

সাদিক ওর মায়ের গায়ের রং পেয়েছে। জয়নাল শ্যামবর্ণ হলেও জোহরা টকটকে ফরসা। তবে গায়ের রং মায়ের মতো পেলেও স্বাস্থ্য বাবার মতো। এই বয়সেই তাকে বেশ বড় দেখায়। জয়নাল মূর্খ হলেও জোহরা প্রাইমারী পাস এবং খুব বুদ্ধিমতী ও ধার্মিক মেয়ে। তার সংস্পর্শে এসে জয়নালও ধার্মিক হয়ে গেছে। আর একমাত্র ছেলে সাদিককেও ধর্মের পথে চালিয়ে মানুষ করছে। টিচাররা কয়েকদিন ক্লাস নিয়ি বুঝতে পারল, সাদিক খুব মেধাবী ছাত্র। কোনো দিন যেমন স্কুল কামাই করে না, তেমনি লেট করেও স্কুলে আসে না। আর ক্লাসের পড়া ও হোমটাস্ক ঠিকমতো করে আসে। তাই কিছুদিনের মধ্যে সব টিচাদের কাছে সে প্রিয় পাত্র হয়ে উঠল।

একদিন ক্লাস টিচার শফিক স্যার রোলকল করার পর সাদিককে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি পিছনের বেঞ্চে বস কেন? সামনের বেঞ্চে বসতে পার না?

সাদিক কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

শফিক স্যার অন্য গ্রামের মানুষ। এই কিছুদিন হল এখানে জয়েন করেছেন। তিনি সাদিকের বাবার আর্থিক অবস্থার কথা জানেন না। তাই সাদিককে চুপ করে থাকতে দেখে আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এরকম পুরান ময়লা জামা কাপড় পরে স্কুলে আস কেন? তোমার নতুন জামা কাপড় নেই?

জমিরুদ্দিনের ছেলে হাফিজ ফাষ্ট বেঞ্চে বসে। সেও ভালো ছাত্র, স্বাস্থ্যও ভালো। তার বাবা স্কুলের কমিটির সেক্রেটারী। তাই ক্লাসের সব ছেলেরা তাকে ভয় করে। সে স্কুল দেরি করে এলেও তার জায়গায় কেউ বসতে সাহস করে না। এমনকি যে দিন স্কুলে আসে না, সে দিনও তার জায়গায় কেউ বসে না। আজ সে স্কুলে আসে নি।

শফিক স্যার সাদিককে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন, তোমার বই খাতা নিয়ে এসে এখানে বস বলে ফার্স্ট বেঞ্চে হাফিজের জায়গার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখালেন।

সাদিক বই খাতা নিয়ে এসে হাফিজের জায়গায় বসল।

শফিক স্যার ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাকে বললেন, তুমি প্রতিদিন এখানে বসবে।

হাফিজের পাশে সব সময় আবিদ বসে। আবিদও অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। শফিক স্যার চলে যাওয়ার পর সে সাদিককে বলল, আজ এখানে বসেছিস বস, কাল হাফিজ এলে তাকে জায়গা ছেড়ে দিবি। নচেৎ তোর বারটা বাজিয়ে দেবে।

সাদিক বলল, এটা স্কুল; যে আগে আসবে সে তার ইচ্ছামতো জায়গায় বসবে। হাফিজ যদি কাল আমার আগে আসে, তা হলে সে এখানে বসবে। আর আমি যদি আগে আসি, তা হলে আমি এখানে বসব। তা ছাড়া শফিক স্যার তো আমাকে প্রতিদিন এখানে বসতে বললেন।

তোর জামা কাপড় থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, বলে আবিদ অন্য বেঞ্চে গিয়ে বসল।

পরের দিন হাফিজ এসে সাদিককে তার জায়গায় দেখে রেগে উঠে বলল, তুই তো লাষ্ট বেঞ্চের ছেলে; আজ ফার্স্ট বেঞ্চে আমার জায়গায় বসেছিস যে? যা লাষ্ট বেঞ্চে গিয়ে বস। জানিস না, এটা আমার জায়গা?

সাদিক বলল, গতকাল শফিক স্যার আমাকে প্রতিদিন এখানে বসতে বলেছেন।

হাফিজ বলল, গতকাল আমি আসি নি, তাই এখানে ফাঁকা দেখে শফিক স্যার তোকে বসতে বলেছেন। লাষ্ট বেঞ্চে না বসতে চাইলে অন্য যে কোনো বেঞ্চে গিয়ে বস।

হাফিজ থেমে যেতে আবিদ বলল, ওকে আমি গতকালই এখানে বসতে নিষেধ করেছিলাম। বলল, এটা স্কুল, যে আগে আসেব, সে তার ইচ্ছামতো জায়গায় বসবে। তারপর বলল, দেখ না, ওর জামা- কাপড় থেকে কেমন দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।

সাদিক আর কিছু না বলে বই খাতা নিয়ে লাষ্ট বেঞ্চে যেখানে এতদিন বসেছে সেখানে গিয়ে বসল।

ঘন্টা বাজার পর শফিক স্যার ক্লাসে এসে রোলকল করার পর সাদিককে বললেন, তোমাকে কাল ফার্স্ট বেঞ্চে যেখানে বসতে বলেছিলাম, সেখানে বসনি কেন? আসতে দেরি করেছ বুঝি?

সাদিক কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

শফিক স্যার অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বললেন, কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন?

সাদিক তবু চুপ করে রইল।

শফিক স্যার যেন কিছু অনুমান করতে পারলেন। বললেন, তোমাকে কি কেউ ফার্স্ট বেঞ্চে বসতে নিষেধ করেছে?

সাদিক জানে হাফিজ বড় লোকের ছেলে। তার বিরুদ্ধে কিছু বলা ঠিক হবে না। তাই চুপ করেই রইল।

এবার শফিক স্যার খুব রেগে গেলেন। রাগের সঙ্গে বললেন, তোমার এত সাহস, আমার একটা কথারও উত্তর দিচ্ছ না? তারপর বেত হাতে তার দিকে এগিয়ে এলেন।

সাদিকের পাশে আসিফ বসেছিল। শফিক স্যার যখন সাদিককে মারার জন্য কাছে এলেন তখন সে বলল, আপনি গতকাল যেখানে ওকে বসতে বলেছিলেন ওতো আগে এসে সেখানেই বসেছিল। হাফিজ পরে এসে ওকে তুলে দিয়ে এখানে বসতে বলেছে।

শফিক স্যার হাফিজের কাছে গিয়ে বললেন, আসিফ যা বলল, তা কি সত্য?

হাফিজ কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

শফিক স্যার খুব রাগের সঙ্গে বললেন, কথা বলছ না কেন? আসিফ কথাটা বলে দিতে হাফিজ তার উপর রাগে ফুলছিল, স্যারকে রেগে যেতে দেখে বলল, হ্যাঁ, সত্য।

শফিক স্যার জানেন, হাফিজ স্কুল মেক্রেটারীর একমাত্র ছেলে। তাকে মারা ঠিক হবে না। তাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাগ সামলে নিয়ে বললেন, যাও, তুমি লাষ্ট বেঞ্চে সাদিকের সিটে গিয়ে বস। তারপর সাদিককে বললেন, এখানে এসে বস।

হাফিজ রাগে ফুলতে ফুলতে পিছনের সিটে আসার পর সাদিক ফার্স্ট বেঞ্চে গিয়ে বসল।

শফিক স্যার সব ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা আর কখনও কেউ এরকম ঘটনা করবে না। প্রথমবার বলে হাফিজকে ক্ষমা করে দিলাম। পরে যদি তোমাদের কেউ এরকম ঘটনা কর, তা হলে সেদিন কঠিন শাস্তি দেব।

ছুটির পর ঘরে ফেরার সময় সাদিক আসিফকে বলল, তুই কেন স্যারকে কথাটা বলতে গেলি? হাফিজ তোর উপর খুব রেগে আছে। আমার তো ভয় করছে, তোকে না হাফিজ মারে।

আসিফ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। দেখতে সুন্দর হলেও খুব রোগা। সাদিকের কথা শুনে বলল, না বললে যে স্যার তোকে মারত, তাই বলেছি। আর তুই-ই বা কি? স্যারকে সত্য কথাটা বলতে পারছিলি না কেন?

আবিদ ও হাফিজ তিন চারজন ছেলের সঙ্গে ওদের আগে আগে যাচ্ছিল। ওদেরকে পিছনে আসতে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। কাছে এলে হাফিজ আসিফকে বলল, তুই কথাটা স্যারকে বললি কেন?

আসিফ বলল, না বললে যে, সাদিক স্যারের হাতে মার খেত।

হাফিজ বলল, মার খেলে খেত, তাতে তোর কি? তুই বলতে গেলি কেন?

বারে, যা সত্য তাই বলেছি। তাতে কি হয়েছে?

কি হয়েছে? দাঁড়া মজা দেখাচ্ছি বলে বই খাতার ব্যাগ মাটিতে রেখে তাকে কিল ঘুষি মারতে লাগল।

সাদিক আসিফকে রক্ষা করার জন্য হাফিজকে ধরে বলল, ওকে মারছিস কেন? দোষ তো তুই করেছিস।

হাফিজ এবার আসিফকে ছেড়ে দিয়ে সাদিককে মারতে মারতে বলল, শালা কামলার পোলা, তোর জন্য আজ ক্লাসে আমাকে অপমান হতে হয়েছে। তোকেও মেরে তক্তা বানিয়ে দেব।

দু’জনেই স্বাস্থ্য ও শক্তিতে সমান। তাই হাফিজ সাদিকের সঙ্গে যখন পেরে উঠল না তখন সঙ্গের ছেলেদের বলল, কিরে, তোরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? শালা কামলার পোলাকে শায়েস্তা করে দে।

আবিদ ও সঙ্গের ছেলেগুলো হাফিজের কথা শুনে সাদিক ও আসিফকে মারতে লাগল।

এমন সময় সেই পথ দিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব দু’জন লোকের সঙ্গে যাচ্ছিলেন। তারা তাদের মারামারি থামিয়ে দিলেন।

তারপর চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, তোমরা স্কুলে লেখাপড়া করছ, মারামারি করা তোমাদের উচিত নয়। কোনো ব্যাপারে মনোমালিন্য হলে স্কুলের টিচারের কাছে জানাবে। আর কোনো দিন মারামারি করবে না। লোকজন দেখলে কি বলবে? যে যার ঘরে চলে যাও।

আসিফের চেয়ে সাদিক বেশি মার খেয়েছে। পুরোন জামার কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে।

ঘরে এলে তার মা জোহরা অবস্থা দেখে ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, তোর অবস্থা এমন কেন? জামাটাও দেখছি কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। নিশ্চয় কারো সঙ্গে মারামারি করেছিস? তোকে না কতবার বলেছি, কখনো কারো সঙ্গে ঝগড়া বা মারামারি করবি না?

মার খেয়েছে সে জন্য সাদিকের কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু জামা ছিঁড়ে গেছে দেখে যেমন খুব দুঃখ পেয়েছে, তেমনি মা বকবে ভেবে ভয়ও পেয়েছে। মায়ের কথা শুনে ছলছল চোখে স্কুলের ও পথের ঘটনা বলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে লাগল।

জোহরা জানে, তার ছেলে কখনো মিথ্যে কথা বলে না। তাই ঘটনা শুনে . একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, কি করব বল? আল্লাহ আমাদেরকে গরিব করেছে। বড় লোকদের অনেক অত্যাচার তাই নীরবে সহ্য করতে হয়। জামাটা খুলে দে, ধুয়ে দেই। রাতে সেলাই করে রাখব।

সাদিক মনে করেছিল জামা ছিঁড়ে গেছে দেখে মা খুব বকবে। কিন্তু মা তা করল না দেখে ভয়টা কেটে গেল। বলল, আব্বাকে একটা নতুন জামা কিনে দিতে বলবে। এই জামা পরে স্কুলে যাই বলে ক্লাসের ছেলেরা টিটকারী করে।

আর একটা দীর্ঘশ্বাস জোহরার বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছিল। তা চেপে রেখে বলল, কালই তোর আব্বা বলছিল, সাদিকের জামাটায় অনেক সেলাই পড়েছে। একদিন গঞ্জে গিয়ে একটা জামা কিনে নিয়ে আসতে হবে।

সাদিক উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, সেই সাথে একটা পায়জামাও আনতে বলো। এটাতেও অনেক সেলাই পড়েছে বলে পরে থাকা পায়জামাটা দেখাল।

জোহরা বলল, ঠিক আছে, বলব। এখন যা, ঘাট থেকে হাত মুখে পানি দিয়ে আয়, আমি ততক্ষণে তোর ভাত বাড়ছি।

পরের দিন স্কুলে যাওয়ার পথে আসিফকে পথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাদিক বলল, কিরে, দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? স্কুলে যাবি না?

আসিফ বলল, তোর জন্য অপেক্ষা করছি। তারপর দু’জনে যেতে যেতে আসিফ বলল, আমি হাফিজের নামে শফিক স্যারের কাছে বিচার দেব, তুই দিবি না?

সাদিক বলল, না, আর তোকেও দিতে নিষেধ করছি।

আসিফ বলল, কেন বলতো?

সাদিক বলল, বিচার দিলে শফিক স্যার হাফিজ ও তার সঙ্গে যারা ছিল তাদেরকে মারবে। আমি মাকে সব কথা বলেছি। মা বলল, তোরা যেন আবার স্যারের কাছে ওদের বিরুদ্ধে নালিশ করিস না। করলে ওরা তোদের উপর আরো রেগে গিয়ে প্রতিশোধ নেবে। জানিস তো হাফিজের বাবা বড় লোক আর আমরা হলাম গরিব। ওদের সঙ্গে আমরা পেরে উঠব না।

আসিফ বলল, ঠিক আছে, তুই যখন নিষেধ করছিস তখন আর বলব না।

এ বছর ফাষ্ট হয়ে সাদিক ক্লাস সেভেনে উঠল। হাফিজও খুব মেধাবী। তার উপর সে দু’জন মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়ে। ক্লাসের সব ছাত্ররা জানত হাফিজই ফাস্ট হবে। সেকেন্ড হতে অনেকে তাকে বলল, তোকে একটা কামলার ছেলে হারিয়ে দিল।

ফার্স্ট হতে পারে নি বলে এমনিই হাফিজ সাদিকের উপর রেগেছিল। এখন ছেলেদের কথা শুনে তার উপর আরো রেগে গেলেও তাদের কথার কোনো উত্তর দিল না। ঘরে এসে বাবার হাতে প্রোগ্রেস রিপোর্ট দিয়ে বলল, টিচাররা ইচ্ছা করে আমাকে সেকেন্ড করেছে।

জমিরুদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, ফার্স্ট কে হয়েছে?

হাফিজ বলল, জয়নাল কামলার ছেলে সাদিক!

জমিরুদ্দিন বললেন, সাদিক কামলার ছেলে হলেও নিশ্চয় তোমার থেকে ভালো পড়াশোনা করে। তাই ফার্স্ট হয়েছে। এবার থেকে তুমি সাদিকের চেয়ে ভালো পড়াশোনা কর, তা হলে সামনের বছর ফার্স্ট হতে পারবে।

হাফিজ বলল, সে কথা তোমাকে বলে দিতে হবে না। আমিও দেখে নেব, সামনের বছর সাদিক কেমন করে ফার্স্ট হয়।

জমিরুদ্দিন বললেন, কথাটা ঠিক বললেও মনে হচ্ছে তুমি সাদিকের উপর খুব রেগে আছ? ওটা ঠিক না। ক্লাসের মধ্যে যারা ভালো ছেলে তারা গরিবের ছেলে হোক আর বড় লোকের ছেলে হোক, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হয়। তুমি সাদিকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে। কামলার ছেলে বলে ঘৃণা করবে না। মনে রাখবে, গরিবদের ঘৃণা করলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।

হাফিজ বলল, বাবা, তুমিই তো গরিব ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করতে নিষেধ করেছ? এখন আবার তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে বলছ কেন?

জমিরুদ্দিন বললেন, যে সব গরিবের ছেলে স্কুলে যায় না, রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, তাদের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করেছি। আর শোন, ক্লাসের মধ্যে এক থেকে দশ পর্যন্ত যাদের রোল নাম্বার তাদের সঙ্গে মেলামেশা বা খেলাধুলা করবে। আর তুমি তাদের কারো ঘরে যাবে না। বরং তাদেরকে তোমার ঘরে আসতে বলবে। কারণ তুমি তাদের ঘরে গেলে তাদের মতো হয়ে যাবে। আর তারা তোমার ঘরে এলে তোমার মতো হয়ে যাবে। এ কথাটাও সব সময় মনে রাখবে।

হাফিজ বলল, জি, মনে রাখব।

এক ছুটির দিন দুপুরে হাফিজ চার পাঁচটা ছেলের সঙ্গে তাদের বাগান বাড়ির বড় পুকুর থেকে শালুক তুলে খাচ্ছিল। খাওয়া শেষ হতে হাফিজ বলল, আমরা সাঁতার কেটে পুকুরের ও পারে যাব। যে প্রথমে গিয়ে পৌঁছালে তাকে সবাই মিষ্টি খাওয়াবে। সবাই রাজি হয়ে সাঁতার কেটে পুকুরের ওপারে যেতে লাগল। হাফিজ সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল। তীরের কাছাকাছি গিয়ে লুঙ্গি খুলে পায়ে জড়িয়ে যেতে ডুবে যাবার উপক্রম হতে চিৎকার করে বলল, তোরা আমাকে বাঁচা, আমার পায়ে লুঙ্গী জড়িয়ে গেছে।

বড় পুকুর সাঁতরে পার হতে গিয়ে হাফিজের সঙ্গী সবাই হাঁপিয়ে গেছে। তারা হাফিজের কাছে না গিয়ে তীরে বুক পানিতে এসে হাঁপাতে লাগল। হাফিজ তখন একবার ডুবছে আর একবার ভেসে উঠছে।

ঐ পুকুরের পাড়ঘেঁসে সরকারী রাস্তা। সাদিক ঐ রাস্তা দিয়ে মাঠে গরু ছাগলকে পানি খাওয়াতে যাচ্ছিল। হাফিজের অবস্থা দেখে ও চিৎকার শুনে লুঙ্গী মালকাছা মেরে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুকুরে। তারপর হাফিজকে ধরে তীরের কাছে নিয়ে এল।

হাফিজের তখন অবস্থা কাহিল। সবাই মিলে তাকে পাড়ে তুলে নিয়ে এল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হাফিজ সঙ্গিদের বলল, তোরা বন্ধু হয়েও কেউ আমার সাহায্যে এগিয়ে এলি না। আর সাদিক বন্ধু না হয়েও আমাকে সাহায্য করল। ও যদি আজ সাহায্য না করত, তা হলে হয়তো এতক্ষণে ডুবে মরে যেতাম।

বন্ধুরা বলল, আমরা নিজেরাই তখন দীর্ঘক্ষণ সাঁতরে হাঁপিয়ে পড়েছি। তোকে সাহায্য করব কি করে?

ঘটনাটা হাফিজের মনে গভীরভাবে দাগ কাটল। তারপর একদিন সাদিককে ঘরে নিয়ে এসে বাবাকে সাঁতার কাটার ঘটনা বলে বলল, ও সেদিন সাহায্য না করলে হয়তো আমি ডুবে মরেই যেতাম।

জমিরুদ্দিন সাদিকের জামা কাপড় দেখে বুঝতে পারলেন, গরিবের ছেলে। তাই তাকে দু’শো টাকা দেয়ার সময় বললেন, তুমি আমার ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছ, তাই এটা তোমাকে পুরস্কার হিসাবে দিলাম। সাদিক টাকাটা না নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে হেঁটে চলে যেতে লাগল।

জমিরুদ্দিন বেশ অবাক হয়ে ডাকলেন, এই ছেলে, চলে যাচ্ছ কেন? টাকাটা নিয়ে যাও।

সাদিক ওনার কথা শুনতে পেয়েও চলে গেল। জমিরুদ্দিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,ছেলেটাকে তুমি চেন?

হাফিজ বলল, ও আমাদের গ্রামের জয়নাল কামলার ছেলে সাদিক। আমরা একই ক্লাসে পড়ি। ঐ তো এ বছর আমাদের ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে। তারপর স্কুলে অপমান হওয়ার ও বন্ধুদের নিয়ে তাকে মারার কথাও বলল।

সব শুনে জমিরুদ্দিন আরো অবাক হয়ে বললেন, তাই না কি? সে কথা আগে বলবি তো? তারপর এক দিন জয়নাল ও তার ছেলেকে একজনকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন।

জয়নাল লোকটাকে একটু পরে যাচ্ছি বলে বিদায় করে ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, তুই কারো কোনো ক্ষতি করেছিস না কি?

সাদিক বলল, না আব্বা, আমি কারো কোনো কিছু ক্ষতি করি নি। তা হলে জমিরুদ্দিন তোকে নিয়ে আমাকে ডেকে পাঠাল কেন? নিশ্চয় তুই কোথাও কিছু করেছিস?

প্রতিবাদ করে সাদিক বলল, বললাম তো কোথাও কারো কোনো ক্ষতি আমি করি নি।

সেখানে জয়নালের বৌ জোহরা ছিল। সে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি ওকে বকছ কেন? সাদিক কি আমাদের তেমন ছেলে; যে কারো ক্ষতি করবে?

মা থেমে যেতে সাদিক হাফিজকে সাহায্য করে বাঁচাবার ও হাফিজের বাবার ওকে দু’শ টাকা দিতে যাওয়ার কথা বলে বলল, আমি টাকা না নিয়ে চলে আসি।

স্বামী কিছু বলার আগে জোহরা বলল, খুব ভালো করেছিস। তারপর স্বামীকে বলল, এবার গিয়ে দেখ, কেন উনি তোমাকে ডেকেছেন।

জমিরুদ্দিন বৈঠকখানায় কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। জয়নাল সাদিককে সঙ্গে করে নিয়ে এসে সালাম দিল।

জমিরুদ্দিন সালামের উত্তর দিয়ে বেঞ্চে বসতে বলে লোকজনদের বিদায় করলেন। তারপর একজন কাজের লোককে বললেন, হাফিজকে এখানে আসতে বল। হাফিজ আসার পর জয়নালকে বললেন, তোমার ছেলে একদিন আমার ছেলেকে পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছে। তাই তাকে আমি বকশিস হিসাবে দু’শ টাকা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে না নিয়ে চলে যায়। তাই আজ তাকে কঠিন শাস্তি দেব। এখন তুমি কি কিছু বলবে?

জয়নাল ছেলের মুখে দু’শ টাকা দেওয়ার কথা শুনে ভেবেছিল, আজ হয়তো আরো বেশি টাকা দেবে বলে ডেকে পাঠিয়েছে। এখন কঠিন শাস্তি দেয়ার কথা শুনে ভয় পেয়ে কি বলবে না বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল।

জয়নাল যে তার কথা শুনে ভয় পেয়েছে জমিরুদ্দিন তার মুখের অবস্থা দেখে তা বুঝতে পারলেন। বললেন, তুমি যখন কিছু বলছ না তখন আমিই বলি সাদিক হাফিজকে বিপদে সাহায্য করে প্রকৃত বন্ধুর মতো কাজ করেছে। তাই আজ থেকে ওরা একে অপরের বন্ধু। ছেলের বন্ধু ছেলের মতো। তার উপর সাদিক খুব ভালো ছাত্র। তাই আজ থেকে সাদিকের লেখাপড়ার সমস্ত খরচ আমি দেব। এমন কি তার জামা কাপড় পর্যন্তও। কথা শেষ করে ছেলেকে বললেন, যাও সাদিককে জড়িয়ে ধরে সেদিন ওকে মারার জন্য মাফ চেয়ে বন্ধু হয়ে যাও।

হাফিজ সাদিককে জড়িয়ে ধরে মাফ চেয়ে বলল, আজ থেকে আমরা বন্ধু। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন বন্ধু হয়ে থাকব।

জমিরুদ্দিন আমিন বলে বললেন, আল্লাহ ওদের বন্ধুত্বকে তুমি কবুল কর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *