নুনের মতো ভালবাসা
অনেক অনেক বছর আগে এক দেশে এক রাজা ছিলেন। রাজার কোনো ছেলে নেই শুধু সাত মেয়ে। রাজা সাত মেয়েকেই খুব ভালবাসেন। তবে ছোট মেয়ে পারভীনকে সবার থেকে একটু বেশি ভালবাসেন। অন্যান্য মেয়েদের চেয়ে পারভীন যেমন সুন্দরী তেমনি বুদ্ধিমতীও। তাই রাজা সব সময় তাকে কাছে কাছে রাখেন। ভবিষ্যতে তার উপর রাজ্য শাসনের ভার দেবেন ভেবে তাকে সমরবিদ্যাও শিক্ষা দিয়েছেন।
ছোট মেয়ের প্রতি বাবার বেশি ভালবাসা দেখে অন্য ছয় মেয়ের মনে খুব কষ্ট।
রাজা তাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ছোট মেয়েকে কেন বেশি ভালবাসেন জানাবার জন্য একদিন সাত মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা আমাকে কে কি রকম ভালবাস বল।
বড় মেয়ে বলল, আমি তোমাকে নিজের জীবনের থেকে বেশি ভালবাসি।
মেজ মেয়ে বলল, পৃথিবীতে যত সৌন্দর্যময় জিনিস আছে তাদের চেয়েও তোমাকে বেশি ভালবাসি।
সেজ মেয়ে বলল, মা তোমাকে যতটা ভালবাসে তার চেয়েও বেশি ভালবাসি।
নসেজ মেয়ে বলল, তুমি রাজ সিংহাসনকে যতটা ভালবাস, তার থেকে বেশি আমি তোমাকে ভালবাসি।
পঞ্চম মেয়ে বলল, তোমার প্রতি রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের ভালবাসা একত্রে করে যদি এক পাল্লায় দাও, আর তোমার প্রতি আমার ভালবাসা অন্য পাল্লায় দাও, তা হলে আমার ভালবাসার পাল্লা ভারি হবে।
ষষ্ট মেয়ে বলল, বর্ষাকালে পরিস্কার আকাশে পূর্ণিমা রাতের চাঁদের আলোর মতো আমি তোমাকে ভালবাসি।
রাজা বললেন, আমার প্রতি তোমাদের ভালবাসার কথা শুনে খুব খুশি হয়েছি। এবার শোনা যাক পারভীনের কথা। দেখি সে আমাকে কতটা ভালবাসে।
পারভীন কোনো ভণিতা না করে সরাসরি বলল, আমি তোমাকে নুনের মতো ভালবাসি।
সব থেকে বেশি যাকে ভালবাসেন, যার হাতে ভবিষ্যতে রাজ্য শাসনের ভার তুলে দিবেন ভেবে রেখেছেন তার ভালবাসার কথা শুনে রাজা যেমন দুঃখ পেলেন তেমনি রেগেও গেলেন! রাগের চোটে
অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না।
পারভীনের বড় ছয় বোন তখন হো হো, হি হি করে হাসতে লাগল।
রাজা পারভীনকে তখন কিছু বললেন না। কিছুদিন পর তাকে অনেক দূরে এক জঙ্গলে বনবাস দিলেন।
পারভীন দুঃখ পেলেও কি আর করবে, বাবার লোকজন যে ঘর করে দিয়ে গিয়েছিল তাতেই বাস করতে লাগল। তারা খাবার যা দিয়ে গিয়েছিল তা কিছুদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে বনের ফল-পাকড় খেয়ে কোনো রকমে দিন কাটাতে লাগল।
ঐ রাজ্যের পাশে আর এক রাজ্য ছিল। সে রাজ্যের রাজার দুই ছেলে। বড় রাজকুমার বাবার সঙ্গে রাজকার্য পরিচালনা করে। ছোট রাজ কুমার পারভেজের শীকার করার খুব সখ। সে শুধু বনে-জঙ্গলে পশু পাখি শীকার করে বেড়ায়।
একদিন পারভেজ রাজ্যের শেষ সীমানার জঙ্গলে শীকার করতে গিয়ে একটা সুন্দর হরিণ দেখতে পেয়ে যেই তীরের নিশানা ঠিক করল তখনই হরিণটা টের পেয়ে ছুটতে লাগল। পারভেজও তার পিছনে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
হরিণটা ছুটতে ছুটতে এক সময় অন্য রাজ্যের জঙ্গলে ঢুকে গেল। পারভেজও তার পিছন পিছন ঐ জঙ্গলে ঢুকে গেল। তারপর হরিণটাকে আর দেখতে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে পথ হারিয়ে ফেলল। তখন সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটা গাছ তলায় ঘোড়া থেকে নেমে বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
তার সঙ্গে নিরাপত্তার জন্য যে সব সেপাইরা ছিল তারা অনেক পিছনে পড়ে গিয়েছিল। তাই পারভেজ যে হরিণের পিছু নিতে গিয়ে অন্য রাজ্যের জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে তা তারা জানতে পারল না। তাই তারা যখন অনেক খোঁজা-খুঁজি করেও রাজপুত্রকে পেল না তখন বাধ্য হয়ে ফিরে গেল।
ঐ জঙ্গলেই পারভীনকে তার বাবা বনবাস দিয়েছিলেন। পারভীন সেদিন ফল-পাকড়ের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে একটা গাছতলায় দামী পোষাক পরা এক সুন্দর যুবককে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে খুব অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, রাজপুত্রের মতো এত সুন্দর যুবক এখানে এল কি করে? আবার ভাবল, সে স্বপ্ন দেখছে না তো? নিজের গায়ে চিমটি কেটে বুঝতে পারল, স্বপ্ন নয় বাস্তব। আবার ভাবল, তা হলে কি কোনো দেশের রাজপুত্র পথ হারিয়ে এখানে বিশ্রাম নিচ্ছে? জাগাবার জন্য যেই এগিয়ে গেল তখনই পারভেজের ঘুম ভেঙ্গে গেল।
চোখ মেলে সামনে অপরূপ সুন্দরী একটা মেয়েকে দেখে খুব অবাক হয়ে ভাবল, এই গভীর জঙ্গলে মেয়েটি এল কি করে? তাড়াতাড়ি উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, কে তুমি? তোমার কি ভয় ডর নেই?
পারভীন খুব চালাক মেয়ে। মৃদু হেসে বলল, আমি যেই হই না কেন, আগে বল, তুমি কে? আর এখানেই বা এসেছ কেন? তোমারও কি ভয় ডর নেই? এই গভীর জঙ্গলে কেউ এভাবে ঘুমায়? জঙ্গলের হিংস্র পশুরা যদি তোমাকে খেয়ে ফেলত?
পারভেজ বুঝতে পারল, এ সাধারণ মেয়ে নয়। বলল, আমি অমুক দেশের রাজপুত্র। হরিণ শীকার করতে এসে একটা হরিণের পিছনে ছুটতে ছুটতে কখন যে এই জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি জানতে পারি নি। ছুটতে ছুটতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
পারভীন জিজ্ঞেস করল, তোমার সঙ্গে সেপাইরা ছিল না?
রাজপুত্র পারভেজ বলল, হ্যাঁ ছিল। তারা আমার অনেক পিছনে পড়ে গিয়েছিল। খুঁজে না পেয়ে হয়তো ফিরে গেছে। তারপর আবার বলল, এবার তোমার পরিচয় বল?
পারভীন বলল, আমি এই রাজ্যের রাজার ছোট মেয়ে। আমাদের কোনো ভাই নেই। শুধু সাত বোন। তারপর কেন এই জঙ্গলে বাস করছে বলে বলল, এখান থেকে কিছু দূরে আমার ঘর। ফল-পাকড়ের খোঁজে এদিকে এসেছিলাম। তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমার ঘরে গিয়ে কিছু খেলে ক্লান্তি দূর হবে।
পারভেজের তখন ক্লান্তি কিছুটা দুর হলেও পেটে প্রচন্ড ক্ষিধে তাই আর কিছু না বলে পারভীনের সঙ্গে তার ঘরে এল। খাওয়ার পর গল্প করতে করতে পারভেজ বলল, এই জঙ্গলে এভাবে থাকলে একদিন না একদিন কোনো হিংস্র প্রাণী তোমাকে খেয়ে ফেলবে। তারচেয়ে তুমি আমার সঙ্গে আমাদের রাজ্যে চল। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। রাজ্যে ফিরে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করব।
পারভেজকে পারভীনেরও খুব পছন্দ হয়েছে। বলল, আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি; কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।
পারভেজ বলল, তোমাকে পাওয়ার জন্য শুধু একটা নয়, হাজারটা শর্ত থাকলেও আমি মেনে নেব। বল, কি তোমার শর্ত?
পারভীন বলল, বিয়ের পর এখানে একটা রাজমহল তৈরি করে আমরা দু’জনে বাস করব।
পারভেজ শর্তে রাজি হয়ে তাকে নিজের রাজ্যে নিয়ে গিয়ে মা- বাবাকে পারভীনের পরিচয় ও তার শর্তের কথা বলে বিয়ের কথা জানাল।
সেপাইদের মুখে ছেলে হারিয়ে গেছে শুনে রাজা-রানী মনে করেছিলেন, তাকে কোনো হিংস্র প্রাণী খেয়ে ফেলেছে। তাই তারা ছেলের শোকে কাতর ছিলেন। ছেলে ফিরে এসেছে দেখে খুব খুশি হলেন। আর পারভীনকে দেখে ও তার দুঃখের কাহিনী শুনে পারভীনের উপর তাদের মায়া হল। তারা খুব ধুমধামের সঙ্গে তাদের বিয়ে দিলেন। তারপর পারভীনের শর্ত অনুযায়ী সেই জঙ্গলে রাজমহল বানিয়ে দিলেন। সেখানে পারভীন ও পারভেজ সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে লাগল।
এদিকে পারভীনের বাবা একে একে ছয় মেয়ের বিয়ে দিলেন। একদিন রানী রাজাকে বললেন, তুমি যে ছোট মেয়ে পারভীনকে বনবাসে দিয়ে এলে, এতদিনে তাকে বনের হিংস্র পশু খেয়ে ফেলেছে, না বেঁচে আছে একবারও খবর নিলে না। ছয় মেয়ের তো বিয়ে দিলে, এবার একবার অন্তত তার খোঁজ নিতে তুমি নিজে যাও। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুমি বাবা হয়ে তাকে ভুলে থাকতে পার; কিন্তু আমি যে মা, ছেলেমেয়েরা যতই অন্যায় করুক মায়েরা তাদেরকে ভুলতে পারে না।
রাজাও যে পারভীনের কথা ভুলে গেছেন তা নয়। তাকে ফিরিয়ে আনার কথা ইতিমধ্যে অনেক বার চিন্তা করেছেন। কিন্তু রাজ্যময় কথাটা রটে যাওয়ার পর বনবাস দেয়া মেয়েকে ফিরিয়ে আনা যায় না। তাই মনের কষ্ট মনে চেপে রেখেছিলেন। এখন রানীর কথা শুনে ও
তাকে কাঁদতে দেখে মেয়েকে দেখার জন্য তার মনও ব্যাকুল হয়ে উঠল। বললেন, কালই আমি সৈন্য সামন্ত নিয়ে মেয়ের খোঁজে যাব।
পরের দিন রাজা যে সব সৈন্য সামন্ত পারভীনকে বনবাসে রেখে এসেছিল তাদের নিয়ে সেই জঙ্গলে রওয়ানা দিলেন।
জঙ্গলে যেখানে সৈন্যরা পারভীনকে রেখে এসেছিল, সেখানে চিহ্ন হিসাবে একটা লম্বা লোহার খুঁটি গেড়ে এসেছিল। জঙ্গলে ঢুকে সেই লোহার খুঁটির কাছে গিয়ে সৈন্যরা খুব অবাক হল। লোহার খুটি ঠিক আছে; কিন্তু তার পাশে বিরাট এক রাজমহল।
রাজাও রাজমহল দেখে অবাক হয়েছেন। সেনাপতিকে জিজ্ঞেস করলেন, এই জঙ্গলে রাজমহল এল কোথা থেকে?
সেনাপতি বলল, হুজুর, আমরাও তো সে কথা ভেবে অবাক হচ্ছি। আপনি অপেক্ষা করুন, আমি গেটের পাহারাদারদের কাছ থেকে জেনে আসি।
কিছুক্ষণ পরে সেনাপতি ফিরে এসে বলল, পাশের রাজ্যের এক রাজপুত্র আপনার ছোট কন্যাকে বিয়ে করে এখানে বাস করছে।
রাজা শুনে খুব খুশি হয়ে সেনাপতিকে বললেন, তুমি গিয়ে পাহারাদারকে আমার পরিচয় দিয়ে বল, আমি আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
পারভীন ও পারভেজ খবর পেয়ে রাজার কাছে এসে কদমবুসি করল। তারপর পারভীন বাবার সঙ্গে পারভেজের পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর সবাইকে রাজমহলের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে বাবুর্চিদের ডেকে খানা পিনার ব্যবস্থা করতে বলে বলল, সব খাবার আন্না পাকাবে। অর্থাৎ নুন দেবে না। অবশ্য নুন দেয়া খাবারও আলাদা রান্না করবে। যাতে মেহমানরা না খেয়ে উঠে না যায়।
সৈন্য সামন্তসহ রাজা খেতে বসেছে। দাস-দাসীরা খাওয়ালেও পারভীন ও পারভেজ তদারকি করছে।
পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কাবাব, মাছের কালিয়া ছাড়াও আরো অনেক পদের খানা তৈরি হয়েছে। সবাই খাওয়া শুরু করে বুঝতে পারল, কোনোটাতেই এক চিমটি নুনও দেয়া হয় নি। সব খাবার আন্না। বিভিন্ন পদের এত ভালো ভালো খাবারে নুন না দেয়ায় সব খাবারই বেস্বাদ লাগছে। তাই কেউ সেই খাবার খেতে পারল না।
রাজা সব খাবারে নুন না দেয়ার কারণ বুঝতে পেরে পারভীনকে বললেন, এখন বুঝতে পারছি, কেন তুই বলেছিলি আমাকে নুনের মতো ভালবাসিস। আমি সেদিন তোর কথার অর্থ বুঝতে না পেরে তোকে বনবাস দিয়ে ভীষণ ভুল করেছি। তারপর মিনতি ভরা কণ্ঠে বললেন, তুই আমাকে মাফ করে দে মা
রাজা থেমে যেতে সৈন্য-সামন্তরাও বলল, হ্যাঁ মা, সেদিন আমরাও তোমার কথার মূল্য বুঝি নি। তাই রাজা হুজুরের কথা মতো আমরা তোমাকে এখানে বনবাস দিয়ে যাই। আমাদেরকেও তুমি মাফ করে দাও। নুন যে মানুষের কাছে এত প্রিয় ও মূল্যবান তা আমরা আজ বুঝতে পারলাম। রাজ্যে ফিরে গিয়ে নুন যে মানুষের কত প্রিয় ও মূল্যবান, তা প্রচার করে দেব। তারপর রাজা ও সৈন্য-সামন্তরা খাওয়া উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সবাইকে উঠতে দেখে পারভীন বলল, আপনারা উঠবেন না, বুসন।
সবাই বসার পর আবার বলল, আপনারা আজ আমার মেহমান।
মেহমানকে না খাইয়ে বিদায় করলে আল্লাহ আমাদের উপর অসন্তুষ্ট হবেন। তারপর বাবুর্চিদের সমস্ত আন্না খানা তুলে নিয়ে যেতে বলে নুন দেয়া খানা নিয়ে আসতে বলল।