পৃথা – ৯

রাজা কুন্তিভোজ সুধা-ধবলিত এক প্রাসাদ দুর্বাসার বাসের জন্য দিলেন। মহর্ষি খাবেন ভিক্ষা করে। কিন্তু থাকবেন সুধা-ধবলিত- প্রাসাদে রাজকন্যার সেবা নিয়ে! কুন্তী প্রস্তুত হয়ে মহর্ষির সেবা শুরু করলেন। দুর্বাস। কখনও বলে বেরোতেন, তিনি অপরাহ্ণে ফিরবেন। কিন্তু ফিরতেন অধিক রাত্রে। আবার যেদিন বলে বেরো- তেন, ফিরবেন অধিক রাত্রে, সেদিন ভোরবেলা ফিরে আসতেন। কিন্তু দেখতেন, কুত্তী সর্বদাই তাঁর পছন্দমতো ভোজ্য সায়ন আসন ইত্যাদি নিয়ে সেবার জন্য প্রস্তুত আছেন।

এসব ছাড়াও, দুর্বাসা কুন্তীকে নানারকম ধিক্কার দিতেন। খাবারের নিন্দা করতেন। অপ্রিয় কথায় গালাগালি দিতেন। কুন্তী একটুও রাগ করতেন না। জানতেন, এমন মহর্ষির সেবা করে, তিনি যে-ফল পাবেন, তার তুলনা নেই। তিনি শিষ্যের (শিষ্যা নন) মতো, পুত্রের ( কন্যা নন ) মতো, ভগিনির মতো দুর্বাসার সেবা করেছেন। কুন্তিভোজ প্রত্যহ সকাল সন্ধ্যায় কুন্তীকে জিজ্ঞেস করতেন, “পুত্রি। ব্রাহ্মণ কি তোমার সেবায় পরিতুষ্ট হচ্ছেন?”

কুন্তী উত্তরে হেসে বলতেন, “ব্রাহ্মণ যারপরনাই আনন্দিতহচ্ছেন।” কিন্তু কুন্তী এমন একজন মহর্ষির সঙ্গে কী আচরণ করতেন, আর মহর্ষিই বা কেন এত আনন্দিত হতেন, তার কিছুই বলা যায় না।

“…তমহং পর্য্যতোষয়ম্।
শৌচেন ত্বাগসস্ত্যাগৈঃ শুদ্ধেন মনসা তথা
কোপস্থানেস্বপি মহৎস্বকুপন্ন্য কদাচন।”

কুন্তী বলছেন –অনপরাধী হয়ে, শুচিতার দ্বারা শুচিসিদ্ধ চিত্তে আমি মহর্ষি দুর্বাসাকে পরিতুষ্ট করেছিলাম। বিশেষভাবে ক্রুদ্ধ হবার ব্যাপারেও আমি কখনও ক্রুদ্ধ হই নি।

.

কুন্তিভোজের রাজত্ব হর্ষনদীতীরে বুন্দেলখণ্ডে।

দুর্বাসা প্রায় এক বছর কুন্তীর সেবা গ্রহণ করে, সুখী হয়ে চলে যাবার সময়, তাঁকে বর দিতে চাইলেন। বললেন, “তোমার পরি – চর্যায় আমি পরম পরিতুষ্ট হয়েছি। তুমি আমার কাছে অনন্য দুর্বল বর প্রার্থনা কর।”

কুন্তী বললেন, “আপনিও আমার পিতা যখন সুখী হয়েছেন, তখন আর আমার বরে কী প্রয়োজন?”

কিন্তু দুর্বাসা ছাড়লেন না। তিনি কুন্তীকে বর দিলেন, “… তুমি না চাইলেও, আমি তোমাকে দেবগণকে আহ্বান করার জন্য মন্ত্র প্রদান করছি। গ্রহণ কর। এই মন্ত্রের দ্বারা তুমি যে-কোনো দেবতাকে আহ্বান করবে, তিনি সকামী বা অকামীই হোন, মন্ত্র প্রভাবে ভৃত্যের ন্যায় তোমার বশবর্তী হবেন।”

কুন্তী আর আপত্তি করতে পারলেন না। দুর্বাসা তাঁকে অথর্ববেদ- বিহিত মন্ত্র সব দান করলেন। কিন্তু হঠাৎ এমন একটি বর কেন দুর্বাসা তাঁকে দিলেন? আরও অনেক প্রকারের বর তিনি কুন্তীকে দিতে পারতেন। দেবতাদের ভৃত্যের মতো আহ্বান করার শক্তিযুক্ত বর দান করার অর্থ কী?

এখানে এস, ইতিবৃত্তের পাতায় আমি সত্যের সন্ধানে লিপ্ত হচ্ছি। তার আগে, ইতিবৃত্তে প্রক্ষিপ্ত অলৌকিক সংবাদে, ব্রাহ্মণের বিচিত্র মতিগতির কথা কিছু বর্ণনা করতে চাই। কারণ এঁরাই আমাদের প্রাচীন ইতিবৃত্তকে, ব্রাহ্মণ্য মহিমার দ্বারা ( মূর্খতা! ) এমন ভাবে মিথ্যায় আচ্ছন্ন করে রেখেছেন, যাতে সত্য কখনও প্রকাশ না পায়। আর ব্রাহ্মণরা যে কী ভয়াবহ শক্তিশালী ছিলেন, তার প্রমাণের জন্য যা মনে এসেছে, তাই লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। অথচ আমরা জানি, ব্রাহ্মণ কোনে! জাতি ছিলেন না। প্রতিভা জ্ঞান ও তপোবলে, জারজ পুরুষও ব্রাহ্মণত্ব লাভ করতেন।

অলৌকিকত্বের প্রমাণ স্বরূপ,ঋষি দীর্ঘতমার এক দীর্ঘ কাহিনী, কুন্তীর কারণে, এক ব্রাহ্মণ তুলে ধরেছেন। আমি সংহিতা যুগে বিচরণের সময়, দীর্ঘতমাকে দর্শন করেছি। তাঁর গো-গণের ন্যায় উন্মুক্ত স্থানে যখন তখন মৈথুন কার্যে লিপ্ত হওয়ায় আশ্রমের মুনি ঋষিরা তাঁর প্রতি বিরক্ত হয়ে আশ্রম থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী প্রদ্বেষীও তাঁর প্রতি বিশেষ রুষ্ট হয়েছিলেন। দীর্ঘতমা ছিলেন অন্ধ। প্রদ্বেষীর গর্ভে তাঁর অনেকগুলো পুত্র হয়েছিল। তাঁর প্রতি বিরক্ত হয়ে প্রদ্বেষী ও তাঁর পুত্রগণ, দীর্ঘতমাকে ভেলায় করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।

দীর্ঘতমা ভাসতে ভাসতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যান। বলি নামে এক রাজা ছিলেন। অসাধারণ ধার্মিক। তিনি গঙ্গায় স্নান করতে এসে মুনিকে ভেলায় ভেসে যেতে দেখে, নিজের গৃহে নিয়ে আসেন। এবং তিনি যে ভগবান দীর্ঘতমা, দেখেই চিনতে পারলেন। বলি ছিলেন অপুত্রক! তিনি দীর্ঘতমাকে অনুরোধ করলেন, তাঁর ভাষা- দের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করার জন্য। দীর্ঘতমা সম্মত হলেন। রাজা বলি তাঁর পট্টমহিষী সুদেষ্ণাকে ঋষির নিকট গমন করতে বললেন। সুদেষ্ণা দেখলেন, ঋষি অন্ধ ও বৃদ্ধ। তখন তিনি নিজে না গিয়ে এক শূদ্রা পরিচারিকাকে পাঠিয়ে দিলেন। সেই দাসীর গর্ভে দীর্ঘতমা, জেনেশুনেই এগারোটি পুত্রোৎপাদন করলেন, পুত্ররা যখন সবাই অধ্যয়নরত হয়েছে, রাজা বলি খুবই খুশি হলেন। কিন্তু দীর্ঘতমা বললেন, “এরা তোমার ক্ষেত্রে, হয় নি। শূদ্রাযোনিতে আমি এদের উৎপন্ন করেছি। সুতরাং এরা আমারই পুত্র। আমাকে অন্ধ আর বৃদ্ধ দেখে, তোমার মহিষী সুদেষ্ণা আমার কাছে আসেন নি।”

রাজা বলি সে-কথা শুনে খুবই দুঃখিত হলেন। সুদেষ্ণাকে নানা রকম অনুনয়পূর্বক, দীর্ঘতমার কাছে পাঠাতে সক্ষম হলেন। দীর্ঘ- তমা সুদেষ্ণাকে ভোগ করলেন না। তাঁর গায়ে হাত বুলিয়েই বলে দিলেন, “তোমার অত্যন্ত তেজস্বী পাঁচ পুত্র হবে। তারা অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুণ্ড্র ও সুহ্মা বলে পরিচিত হবে। তাদের নামানুসারে অঙ্গ বঙ্গাদি দেশ প্রসিদ্ধ হবে।” …

অতএর ব্যাপারটা কী? ব্যাপারটা হলো, দেবতা, ঋষিগণ যে-ভাবে পুত্র উৎপাদন করেন, তা লৌকিক বিধি নয়। তা দিব্যবিধি। এরূপ দিব্যবিধিতে কোনো রূপ দোষের বা পাপের সম্ভাবনা নেই। কারণ, অনেক তির্যক যোনিতে সর্বদা এরূপ জন্ম ঘটেছে। যেমন, কচ্ছপ, ময়ূরী, বলাকা, এরা পুরুষ সম্বন্ধ ব্যতিরেকেই গর্ভ ধারণ করতে পারে।

তা তো বুঝলাম। কিন্তু কচ্ছপ, ময়ূরী তো মানবী নয়। এ বিষয়ে আমি ইতিপূর্বেই জেনে এসেছি, দেব-দানব মানব, যে কোনো জাতির মানুষের, নরনারীর দৈহিক মিলন সম্ভূত ছাড়া সম্ভব না।

এইসব অবাস্তব অলৌকিকতায় বিশ্বাসী পণ্ডিতবর্গের প্রতি অভি- যোগ করা প্রহসন মাত্র। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন, ঋষি স্ত্রী- লোকের গায়ে হাত স্পর্শ করলেই, স্ত্রীলোকটি সন্তান সম্ভবা হয় কুম্ভীর সঙ্গে সূর্যের সহযোগিতায় কর্ণের জন্মও সেই রকমই এঁরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। আর সেই সূর্য যে আকাশ থেকেই নেমে এসেছিলেন, সে-বিষয়েও এইসব পণ্ডিতের মনে কোনো সন্দেহ নেই। হে সূর্য!তুমি আকাশ থেকে নেমে, একবার এই সব পণ্ডিতের দেহ স্পর্শ করে যাও।

একমাত্র, এই কারণেই, কুন্তী যখন কুমারী অবস্থায় রজস্বলা হলেন, তখন খুবই লজ্জিতা হলেন। অনন্তর তিনি প্রাসাদ মধ্যে রমণীয় শয্যায় উপবেশন পূর্বক সূর্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। দেখলেন, কবচ কুণ্ডল যুগল মণ্ডিত দিব্য জ্যোতি সূর্যদেব। তখনই ব্রাহ্মণের সেই মন্ত্রের কথা তাঁর মনে পড়লো। তিনি সেই মন্ত্রের দ্বারা সূর্যকে আহ্বান করলেন। করে ফ্যাসাদে পড়ে গেলেন। কারণ, সূর্য সত্যি এসে উপস্থিত হলেন। বললেন, “হে কল্যাণি, আমি মন্ত্র প্রভাবে, তোমার নিতান্ত অধীন হয়ে আগমন করেছি। বলো, আমাকে কী করতে হবে।”

কুন্তীর কী দুরবস্থা! সূর্য যতই তাঁকে বর দিতে চান, তিনি কিছুতেই তা গ্রহণ করতে পারছিলেন না। কিন্তু সূর্য পরিষ্কারই বলে দিলেন, আমি জানি, তুমি কবচ-কুণ্ডলমণ্ডিত, আমার ন্যায় সন্তান উৎপাদন করাই তোমার অভিলাষ। তুমি সম্মতি দিলেই আমি সেই অভিলষিত পুত্র উৎপাদন করবো।

কুন্তী দেখলেন, এ ভারি গর্হিত কাজ। বাবা মা জানবেন না। অথচ আমার সন্তান হবে। তখন কী করবো? সূর্য বললেন, “তোমার কন্যকাবস্থা নষ্ট হবে না। তুমি যেমন সন্তান চেয়েছো, সেই রকমই আমি উৎপাদন করব। আর তুমি যে কবচকুণ্ডলসহ বীর সন্তান চেয়েছে, তাই আমি দান করবো।”

কুন্তী সম্মত হলে, সূর্যদেব তাঁর নাভিদেশ স্পর্শ করা মাত্র, তিনি তেজঃপ্রভাবে অচেতন হয়ে শয্যাতলে পড়ে রইলেন। এবং সূর্যদেব স্বীয় তেজঃপ্রভাবে কুন্তীকে মোহিত করে, যোগ বলে গর্ভাধান করলেন। কিন্তু তাঁর কন্যকাবস্থা দূষিত করলেন না।

বলাবাহুল্য, এই অলৌকিক, অবাস্তব, মিথ্যা কাহিনী আর যারাই বিশ্বাস করুন, বাস্তব ইতিবৃত্তে যাঁরা বিশ্বাসী, এবং প্রকৃতই নারীর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করেন, তাঁদের মধ্যেও নানা কৌতূহল ও ইচ্ছা জাগে, অথচ তার জন্য তাঁরা সমস্ত রকম দায় দায়িত্ব গ্রহণের দ্বারা, নিজেদের বৈশিষ্ট্যকে প্রতিষ্ঠা করেন। নারীকে যারা নিতান্ত দেহ শুচিতার বিচারে কেবল পুত্রোৎপাদনের যন্ত্র মনে করেন, তারাই ঐসব অলৌকিক অসম্ভব অবাস্তব ব্যাপারকে লোক মধ্যে প্রচার করে, মানুষকে সত্য সন্ধানে বঞ্চিত করেন।

এখন, ইতিবৃত্তের ধুলাচ্ছন্ন পাতার অন্তরালে, কুম্ভীর সেই আরাধ্য পুরুষটিকে কেমন করে আবিষ্কার করা যায়? কুম্ভী চরিত্রের দ্বারা, আমি মোহিত। আমি দেখছি, শৈশবের সেই বালিকা, তাঁর তারুণ্যে এসেই, এমন এক তেজঃপুঞ্জপূর্ণ তপস্বীর, সমস্ত রকম স্বেচ্ছাচারী ব্যবহারেও অসুখী হন নি, রাগ করার যথেষ্ট কারণ থাকলেও, রাগ করেন নি, এবং যিনি কুন্তীর কাছে রাত্রে, ভোরে, সন্ধ্যায় যখন খুশি আসতেন, কখনও গঙ্গাজল দিতেন, নিন্দা করতেন, তবু কুম্ভী তাঁর বাধ্য থাকতেন, এ সবই কি কুম্ভীর বাল্য থেকে প্রাপ্ত, দুঃখের মধ্য থেকে, নতুন জীবনকে জানার ধৈর্য ও সাহসের পরিচয় না?

আমি তো দেখছি, দুর্বাসাকে যে যাই বলুন, অন্তরে তিনি মোটেই কোপন স্বভাব ছিলেন না। বরং মধুরভাষী ছিলেন। দেখতেও ছিলেন, অসাধারণ তেজবহ্নি স্বরূপ সুপুরুষ। পরাশরের তুলনায় তিনি আরও অনেক বেশি গুণসম্পন্নই দেখছি। পরাশয় যদি সত্য- বতীকে গর্ভবর্তী করে কন্যকাবস্থা দূষিত না করে থাকেন, ইনিই বা কুন্তীর কন্যকাবস্থা দূষিত করবেন কেন?

কুন্তিভোজ রাজার গৃহে, দুর্বাসার প্রথম আবির্ভাবই যেন একটি সংকেত দেয়, তিনি কুন্তীর সেবা পাবার জন্যই এসেছিলেন। এবং তিনি কুন্তীভোজকে দিয়ে এমন সব কথা আদায় করে নিয়েছিলেন, স্বভাবতঃই মনে হয়, তাঁর মনে কোনো অভিসন্ধি ছিল। থাকলেও তা তেমন অপরাধের কিছু না। দুর্বাসার নিশ্চয়ই এমন কোনো গুণাবলী ছিল স্বয়ং কৃষ্ণও পরে এই মহর্ষির তুষ্টি বিধানের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।

দুর্বাসার মতো বহ্নিকান্তিমান পুরুষকে দেখে মুগ্ধ হওয়া কি খুবই আশ্চর্যের? তিনি বৃদ্ধ বা কুরূপ ছিলেন না। কুন্তীও আর দশটি কন্যার মতো, মনের দিক থেকে সাধারণ কন্যা ছিলেন না সূর্যদেবের মুখ দিয়ে কুন্তীকে বলানো হয়েছে, “তোমার পিতামাতা অন্যান্য গুরুজন তোমার প্রভু নহেন।” তা যে ছিলেন না, দুর্বাসা আগেই সেবার দায়স্বরূপ,কুন্তীর প্রতি যথেচ্ছাচারের বিষয়টি স্থির করে নিয়েছিলেন।

অতঃপরেও যদি, দুর্বাসাকেই সেই পুরুষরূপে আমি গ্রহণ করি, তাহলে, স্বর্গের বাজা সূর্যকেই আমি এই ভারতের অশ্বনদীর তীরে, ( অধুনা বুন্দেলখণ্ডে ) ভ্রমণ করতে দেখতে পাচ্ছি? স্বৰ্গলোক থেকে, এই মর্ত্য ভারতে, সর্বদাই দেবতা ও মানুষ জাতির যাতায়াত ছিল। আমি আমার ইতিবৃত্তের ভ্রমণে স্বর্গ থেকে আগেই ঘুরে এসেছি। স্বৰ্গলোক অতীব স্বাস্থ্যকর বলে, বেদে এই দেশসমূহকে ‘অমৃতভূমি’ বলা হয়েছে? এবং অধিবাসীরাও স্বাস্থ্যবান, দীর্ঘায়ু ছিলেন।

যদিও ইতিহাসের অপরিচ্ছন্ন অস্পষ্টতায়, আমি বাস্তব দৃশ্যটি দেখতে পাচ্ছি না, তথাপি আমি যেন কুন্তীর অন্তরের মধ্যে দুর্বাসাকেই অঙ্কিত দেখছি। কিন্তু ইতিহাস এ বিষয়ে এমনই নীরবতা অবলম্বন করেছে, আমি সুস্পষ্ট রূপে কিছুই দেখছি না।

এই অবস্থায়, আমি স্বর্গলোকের এক রাজ্যের অধিপতি সূর্যকে অশ্বনদীর তীরে দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি, ধাত্রী ও সখীগণ সহ কুন্তীও সেখানে বিচরণ করছিলেন! সহসাই দুজনের সঙ্গে চারি চক্ষের মিলন। চক্ষের মিলনই তাঁদের দেহ মিলনে আকৃষ্ট করলো। কিন্তু কুন্তী তখন রজস্বলা কুমারী। পরস্পরের মধ্যে মিলনে, সন্তান জন্ম অবশ্যম্ভাবী। অথচ দুজনেই তখন দুজনের প্রতি প্রেমাবিষ্ট। স্বভাবতঃই ধাত্রী ও সখীদের সাহায্যেই, কুন্তী রাজা সূর্যকে রাজ- অন্তঃপুরে নিয়ে গেলেন।

কুন্তীর সঙ্গে, কুমারী অবস্থায় যাঁর মিলন হয়েছিল, তা যে অন্তঃপুরেই হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সমস্ত ঘটনাটিকে এমন রূপ দেওয়া হয়েছে যে, কুন্তী তাঁর রমণীয় প্রাসাদেরশয্যায় উপবেশন- পূর্বক নবোদিত সূর্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করামাত্র, সূর্যের কবচকুণ্ডল- যুগল মণ্ডিত দিব্যমূর্তি দর্শন করলেন। দুর্বাসাও ছিলেন সুধাধবল প্রাসাদে। স্বর্গ রাজ্যের অধিপতি সূর্য হয়তে। কুন্তী রূপৈশ্বর্যের কথা শুনেই, কুন্তিভোজ রাজার রাজ্যে এসেছিলেন। সাক্ষাৎ যদি ধরে নেওয়া হয়, অশ্বনদীর তীরেই হয়েছিল, এবং সেখানেই দুজনে দুজনাকে দেখে মুগ্ধ হন, তাহলেও, কুন্তীর সেই সাহস ছিল, প্রেমিককে তিনি অন্তঃপুরে নিয়ে যাবেন।

আমি ইতিপূর্বেই দেখেছি, কুন্তীর প্রতি সকলেই তুষ্ট। বলছেন, স্বয়ং রাজা কুন্তিভোজ। এমন কি প্রাসাদের দাসদাসী ভৃত্যসকলও তাঁর প্রতি আকৃষ্ট ছিল। অতএব, কুম্ভীর পক্ষে রাজা সূর্যকে অন্তঃপুরে নিয়ে যাওয়া কিছুমাত্র অসুবিধা ছিল না। সেখানে প্রাসাদের ভিতরে, রমণীয় শয্যায়, আহারে ব্যসনে ভূষণে পরস্পরে মধ্যে প্রেম গাঢ়তর হয়েছিল। দুজনে প্রাসাদ মধ্যে কতোদিন কাটিয়েছেন, এক্ষেত্রে তার কোনো হিসাব পাওয়া কঠিন!

আমি জানি, ইতিবৃত্তের এই অধ্যায়টিকে অনেকেই সংশয়ের চোখে দেখবেন অথচ দেখার কোনো কারণ নেই। আকাশের সূর্য যে মানুষের বেশে নেমে আসতে পারে না, যে-কোনো জীবই তা অনুমান করতে পারে। কিন্তু আমি একটা বিষয় ভেবে বিস্মিত হচ্ছি। মুনি পরাশর বা দুর্বাসা, যাঁরা ছিলেন তাঁদের তপোবলে অসাধারণ ব্যক্তি, যাঁদের ক্ষমতা ছিল অসীম, যাঁরা অবিবাহিতা কন্যাদের রমণ করেও তাদের কন্যকাবস্থা দূষিত করতেন না, তাঁরা কি সেই কন্যাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন বন্ধ করার কৌশল অবগত ছিলেন না। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা কি এক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারতেন না? তাহলে তো কোনো সংকটই থাকতো না। এর দ্বারা এটিই প্রমাণ হয়, দেহ মিলনে সন্তান উৎপাদন বন্ধ করার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। অথচ সংহিতা যুগে, কন্যারা বা ঋষি পত্নীরা যদৃচ্ছ পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতো, তখন বিধান ছিল, ঋতুকালে ষোলদিন পরে, মিলনে কোনো দোষ হতো না। এর একটাই অর্থ। ঋতুকাল থেকে ষোলদিন পরে, পুরুষ মিলনে, নারীর সন্তানসম্ভবা হবার ভয় থাকতো না।

বিষয়টি ভাবতে অবাক লাগে। সেই সংহিতা যুগেও মানুষ জানতে। – স্ত্রী জরায়ুতে, ঋতুকালে যে ডিম্বানুর আবির্ভাব ঘটতো, ঋতু স্নানের দশ দিনের আগেই ডিম্বানুটির মৃত্যু ঘটে। অতএব, তারপরে পুরুষের শুক্রকীট জরায়ুতে প্রবেশ করলেও, ডিম্বানুর সঙ্গে মিলিত হতে পারে না বলেই সন্তান ধারণেরও কোনো উপায় নেই সংহিতা যুগেই যখন মানুষ এ বিষয়ে জানতো তখন পৌরাণিক কালের মুনি-ঋষিরা কি জানতেন না? জানতেন। সম্ভবতঃ তাদের কন্যারমণের অভিপ্রায় ছিল, সন্তান জন্মদানই। সেদিক থেকে, যে দুজন কানীন পুত্রের কথা এই মুহূর্তেই মনে পড়ছে, আমাদের প্রাচীন ইতিবৃত্তে, তাঁরা বিশাল ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। একজন কুম্ভীর কানীন পুত্র কর্ণ।

সংহিতা যুগের কন্যারা (কুমারী) স্বতন্ত্রা ছিলেন, এবং যদৃচ্ছ। পুরুষ- সঙ্গ করতে পারতেন, এ চিত্র আমি আগেই দেখে এসেছি। তখন তা সমাজে প্রচলিত ছিল। গোপন করার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে, নতুন যুগে, কুমারীর গর্ভাধান সমাজে দোষণীয় বলে গণ্য হতো। কুন্তীর গর্ভবতী হওয়া তারই প্রমাণ।

কুমারী অবস্থায় পুরুষের যৌন সাহচর্য ভোগ করার সাহস তাঁর ছিল। আমি আগেই দেখেছি, অন্যান্য কন্যাদের তুলনায়, তাঁর শৈশবটাই শুরু হয়েছিল ভিন্ন ভাবে। দেখতেও ছিলেন বিশেষ রূপশালিনী। এই সংবাদটি নানা দিকে প্রচারিতও ছিল। কুম্ভীর নিজেরও, দেহ মিলনের আকাঙ্ক্ষা বিষয়ে যথেষ্ট কৌতূহল ছিল। ইতিবৃত্তের অস্পষ্টতায়, যা আমি চাক্ষুষ করতে পারছি না, তা হলো তাঁর সেই প্রিয় সূর্যসম ব্যক্তিটি কে? স্বয়ং দুর্বাসা? অথবা স্বর্গ- রাজ্যের এক অধিপতি সূর্য? আমার নিজের মনে একটি বিশ্বাস, নানা কারণেই জন্মেছে। কুন্তীর সেই পুরুষ স্বয়ং দুর্বাসাই ছিলেন। নানা যুক্তি দিয়েও এই সিদ্ধান্তেই আসতে হয়। এবং এই সিদ্ধান্তে আসার, অনেক সংকেতও ঘটনার মধ্য দিয়ে পাচ্ছি।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে কুন্তীর প্রাতঃস্মরণীয়া হবার কী কারণ আছে?

এই প্রশ্নের সামনে এসেই আমাকে ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টি দিতে হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে কুত্তী সবেমাত্র যৌবন লাভ করেছেন। আর তেজবহ্নিসম সুপুরুষ তাঁর প্রতি প্রসন্ন। দুর্বাসার মতো ব্যক্তি যে তাঁর প্রতি আসক্ত, এটাও একটা রমণীসুলভ বড় গুণ। কিন্তু ভবিষ্যতেই আমরা জানতে পারবো এ ঘটনার জন্য কেন তিনি প্রাতঃস্মরণীয়া ভারতীয় রমণীগণের মধ্যে গণ্যা হয়েছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *