১০
কুন্তী গর্ভবতী হলেন। যার অনিবার্য ফল, সন্তান জন্মাবেই। সেই সন্তানকে তিনি হত্যা করতে পারেন না। তেমনি নিষ্ঠুর রমণী তিনি ছিলেন না তবে তাঁর গর্ভধারণ বিষয়ে একজন মাত্র ধাত্রীই সব অবগত ছিলেন, তা সত্যি নয়। ধাত্রী, সখী, এবং বিশেষ বিশেষ অনুচররা তাঁর এই গর্ভধারণের বিষয় জানতো। তার প্রমাণও আমরা পাচ্ছি।
সমস্ত ঘটনাটি এ ভাবে ব্যক্ত হয়েছে: “যথাকালে কুন্তি কনকোজ্জ্বল কুণ্ডল ও বর্মধারী, সিংহনেত্র ও বৃষস্কন্ধ এক পুত্র প্রসব করলেন। ধাত্রীর সঙ্গে মন্ত্রণা করে, লোকলজ্জ। ভয়ে মধুচ্ছিষ্টবিলিপ্ত অতি বিস্তীর্ণ ও আচ্ছাদন সম্পন্ন এক মঞ্জুষা, অর্থাৎ কাষ্ঠপিঞ্জর মধ্যে সেই পুত্রকে সংস্থাপনপূর্বক, কাঁদতে কাঁদতে অশ্বনদীতে নিক্ষেপ করলেন। এবং পরে তিনি সহজাত কবচ দ্বারা পুত্রকে অনায়াসে চিনতে পারবেন, এ বিষয়ে কথঞ্চিৎ সান্ত্বনা লাভ করলেন। মঞ্জুষা মধ্যগত বালক প্রবাহবেগে, অশ্বনদী, চর্মন্বত, যমুনা ভাগীরথী স্রোতস্বতীতে বাহিত হয়ে সূত রাজ্যের অন্তর্বর্তী চম্পা নগরীতে উপস্থিত হলো।
পুত্রকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে, কুন্তী নানা কথা বলতে ক্রন্দন করে ছিলেন। তবে সে-সব ক্রন্দনের ভাষা বাদ দিয়ে, তিনি যে প্ৰাৰ্থনা করেছিলেন, তা হলো, “বৎস? অন্তরিক্ষগত, পৃথিবীতে, এবং দেবলোকগত প্রাণিগণ হতে তোমার মঙ্গল হোক। জলচর প্রাণি- গণও তোমার কল্যাণ করুন। তোমার যাত্রপথ মঙ্গলযুক্ত হোক। কেউ যেন তোমাকে হিংসা না করে। পরিরাজ বরুণদেব ও অন্তরিক্ষ পতি পবনদেব তোমাকে রক্ষা করুন। তোমার পিতা ভাস্করদেব তোমাকে সর্বত্র রক্ষা করুন। আদিত্য, বন্ধ, রুদ্র, সাধ্য, মরুৎ এবং দিকপতিগণ তোমার কল্যাণ বিধান করুন। তোমার সহজাত দিব্য কবচ ও কুণ্ডল দেখে, আমি যেন পরেও তোমাকে চিনতে পারি। হে দেবকুমার, যে-নারীতোমাকে স্তনপান করাবেন, তাঁর সৌভাগ্যের সীমা নেই। তোমার ন্যায় পদ্মপলাশ-লোচন শিশুকে যিনি কোলে নেবেন, যেভাগ্যবতী যৌবনে হিমাচলবাসী সিংহের ন্যায় বিক্রমশালী, তোমাকে নিজের পুত্র বলে পরিচয় দেবেন, না জানি তিনি কতোই পুণ্যবতী।”
কোনো সন্দেহ নেই, কুন্তীর জীবনে, এই সন্তান ধারণ যেমন সুখের হয়েছিল, সন্তানটিকে সামাজিক কারণে ত্যাগ করাও ততোধিক দুর্ভাগ্যের কারণ হয়েছিল। কন্যা বলে, সেই তিনি প্রথম পুত্রের জননী প্রিয়তম সেই পুত্রকেই তাঁকে ত্যাগ করতে হলো। এটি তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা করুণ একটি বিষয়।
অতঃপর সাধারণভাবে যা জানানো হচ্ছে, তা হলো মঞ্জুষাটি ভাসতে ভাসতে গঙ্গায়, চম্পানগরীতে উপস্থিত হলো। সেই সময়ে অধিরথনামা সূত, পত্নী রাধাকে নিয়ে গঙ্গার ধারে গমন করেছিলেন। তাঁদের চোখে পড়ল সেই মঞ্জুষা। রাধা দেখলেন, সেই মঞ্জুষা ভাসতে ভাসতে, তাঁর কাছে এসে পড়লো। ঐ মঞ্জুষা কুমকুম, দূর্বা ইত্যাদি রক্ষাদ্রব্যে সর্বাঙ্গ বিভূষিত ছিল। অধিরথ সূত পত্নী রাধা কৌতূহল দমন করতে পারলেন না। তিনি মঞ্জুষাটি হাত দিয়ে ধরে, স্বামীকে ডেকে বললেন, “তুমি একবার এখানে এসে এই মঞ্জুষাটি প্রত্যক্ষ কর। এটি দেখে আমার মন কেমন চঞ্চল হচ্ছে।”
অধিরথ রাধার কথায় নিজেও কৌতূহলিত হয়ে, কাছে গিয়ে, মঞ্জুষাটি তীরে তুলে নিয়ে এলেন। দেখলেন, মঞ্জুষাটি মোম কুমকুম দুর্বা ইত্যাদি দ্বারা এমনভাবে আচ্ছাদিত রয়েছে, তাঁকে যন্ত্রের সাহায্যে সেটি উন্মুক্ত করতে হলো। অতি সাবধানে মঞ্জুষা উন্মুক্ত করে, দেখা গেল, তার মধ্যে এক অচিরপ্রসূত শিশু শয়ান রয়েছে। শিশুটি অপূর্ব রূপলাবণ্যসম্পন্ন, তরুণ অরুণ হেমবর্মধারী কুন্তল যুগল বিভূষিত, সেই শিশুকে দেখে অধিরথ যৎপরোনাস্তি বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন। তাঁর অপেক্ষাও, তাঁর রূপসী উত্তম যৌবনসম্পন্না রানী রাধা এতাবৎকাল অপুত্রবতী রয়েছেন। অধিরথ রাধাকে বললেন, “প্রিয়ে আমি এমন অদ্ভুতরূপলাবণ্যযুক্ত শিশু কদাপি দর্শন করিনি। মনে হচ্ছে, শিশুটি দেবপুত্র। দেবগণ আমাদের অনপত্য দেখে, অনুগ্রহ করে, পুত্রটি দান করেছেন। এই নাও, এই পুত্র অদ্য হতে তোমার। তোমার ক্রোড়েই সে পূর্ণ-চন্দ্রের মতো বর্ধিত হবে।” অধিরথের হাত হতে, রাধা অতি উৎফুল্ল ও স্নেহবিগলিত প্ৰাণে শিশুটিকে আপন ক্রোড়ে গ্রহণ করলেন। এবং উভয়ে গৃহে ফিরে এলেন। শিশুটিকে উভয়ে ভরণ-পোষণ করতে লাগলেন। অতঃপর কিন্তু অধিরথেরঔরসে, রাধার গর্ভে তাঁদের কয়েকটি পুত্রও জন্মালো। কিন্তু ব্রাহ্মণেরা সেই মঞ্জুষার শিশুকে বসু ( স্বর্ণ ) রূপ কবচ ও কুন্দলদ্বয় সংযুক্ত দেখে, প্রথমে নাম রাখলেন, বসুষেন। কিন্তু বসু- যেন নাম নিয়েও, শিশুটি সূতপুত্র নামেই বেশি পরিচিত হতে লাগলো। এই শিশুর অপর নাম ‘বুষ’ও রাখা হয়েছিল।
.
এত সব ঘটনার মধ্যে, ইতিহাস আমাদের সামনে, সামান্য একটি ঘটনা উল্লেখ করে, প্রকৃত ঘটনার সমস্ত বাস্তব রহস্য উদ্ঘাটন করে দিয়েছে। অধিরথের গৃহে, নিজের সেই শিশুপুত্রটি কেমন ভাবে মানুষ হচ্ছে, কুন্তী চর প্রমুখাৎ সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হতে লাগলেন।
কুন্তী তাহলে চর প্রমুখাৎ সকল সংবাদই অবগত ছিলেন? এবং পুত্রটি সুদূর বুন্দেলখণ্ড থেকে, অশ্বনদী, চর্মস্বতী, যমুনা ও গঙ্গা তীরে, অধিরথ সূতের রাজ্যান্তবর্তী চম্পানগরীতে (অধুনা ভাগলপুর ) উপস্থিত হয়েছে, সে-সংবাদও কুন্তীর জানা ছিল!
ইতিবৃত্তে বিশ্বাসী, বিবিধ নামে মানব জাতিগণের বিশ্বাস অনুযায়ী, যেমন আকাশাস্থিত সূর্য নেমে এসে কুন্তীকে গর্ভবতী করতে পারে না,তেমনি কুম্ভীর বাস্তব বুদ্ধি, দূরদর্শিতা ও পুত্র স্নেহের কথা যদি আমরা মনে রাখি, তবে একথা বিশ্বাস করতেই হবে, তিনি গর্ভ ধারণ করার সময় থেকেই, পুত্রটিকে রক্ষা করবার বিষয়ে নানান চিন্তা করেছেন। এবং সেই চিন্তার মধ্যে, অনেক গোপনীয়তা তাঁকে অবলম্বন করতে হয়েছে, এ কথা সত্য। কিন্তু কোনো অলৌকি- কতার আশ্রয় তিনি নেন নি।
প্রথমেই আমাদের চোখে পড়ে, মঞ্জুষাটি যে-ভাবে নিশ্ছিদ্র রুদ্ধ করা হয়েছিল, যেটি অধিরথকে যন্ত্র দ্বারা অত্যন্ত সাবধানে খুলতে হয়েছিল, এরকম নিশ্ছিদ্র কোনো আধারে, কোনো শিশু সেই দীর্ঘপথ অনাহারে আসা কি সম্ভব? ভগবান দিবাকরের কৃপায় সবই সম্ভব, এ বিশ্বাস যাঁদের আছে, তাঁরা সে-বিশ্বাস নিয়ে থাকুন। তাঁদের সেই স্বাধীনতা আছে। কিন্তু যেখানে প্রত্যক্ষ যুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের সামনে উন্মুক্ত রয়েছে, সেখানে আমি কেন অকারণ অলৌকিক পথে যাবো?
যুক্তির প্রশ্ন তুলতে গেলে, মঞ্জুষাটি যেমন ভাবে তৈরি হয়েছিল, তা অন্য লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য ছিল। কিন্তু সেই সুদূর শত যোজন জলপথ অতিক্রম করার সময়, চারটি নদী তীরবর্তী কোনো মানুষেরই মঞ্জুষাটি দৃষ্টি আকর্ষণ করলো না? তা ব্যতিরেকে, তীরের মানুষের কথা বাদ দিলেও, নদীপথেও কি তখন নৌকাযোগে মানুষের যাতায়াত ছিল না?
মঞ্জুষা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থই বা কী? মঞ্জুষা – অর্থাৎ কাষ্ঠপিঞ্জর। কাষ্ঠপিঞ্জর তো এক্ষেত্রে নৌকারই নামান্তর।
এসব যুক্তিরও ঊর্ধ্বে, “কুন্তী চর প্রমুখাৎ স্বীয় পুত্রের সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হলেন।” এ কথার একটিই অর্থ, তিনি তাঁর শিশুপুত্রটিকে, একান্তই ভাগ্যের হাতে জলে ভাসিয়ে দেন। বরং দীর্ঘকাল চিন্তার পরে, একটি বিষয়ই পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে কুন্তীর নিজের উদ্যোগে সদ্যোজাত শিশুকে অত্যন্ত সাবধানে যত্নের সঙ্গে অধিরথের নিকট পাঠানো হয়েছিল। কুম্ভী যেমন পুত্রবৎসল ছিলেন, তাঁর পক্ষে এটা করাই সম্ভব ছিল। তাছাড়া, আমি আগেই দেখেছি, দাসদাসী, ভৃত্যসকল তাঁর অত্যন্ত অনুগত ছিল। লোকবলও তাঁর ছিল। বিনা তত্ত্বাবধানে, নিশ্ছিদ্র একটি মঞ্জুষা মধ্যে, সদ্যোজাত শিশুকে জেনে শুনে তিনি একলা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন নি।
অধিরথ ছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের সখা। ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে পরিচয় সূত্রেই, রাজা কুন্তিভোজের সঙ্গে অধিরথেরও পরিচয় হবার সুযোগ থাকতেই পারে। আর কুন্তিভোজের সঙ্গে যদি অধিরথের পরিচয় ঘটে থাকে, তাহলে কুন্তীর সঙ্গে নিশ্চয়ই তাঁর পরিচয় হয়েছিল। এ সূত্রকে কল্পনা করার প্রয়োজন হয় না। বরং ইতিবৃত্তের ক্ষেত্রে বিবেচনা করলে এই পরিচয়ের ঘটনাটিই অতি বাস্তব হয়ে ওঠে।
কুন্তী যে দিন থেকে গর্ভবতী হয়েছিলেন, সেই দিন থেকেই তিনি ভবিষ্যতের সন্তানটিকে বাঁচাবার সমস্ত রকম কৌশলের কথা ভেবে- ছেন। গর্ভধান মানেই, তিনি তখন নিজেকে অন্তঃপুরের মধ্যে যতোটা সম্ভব গোপন রেখে চলেছেন। কিন্তু তাঁর কাজ তিনি বন্ধ রাখেন নি। তাঁর মনে পড়েছিল, অধিরথ সূতের পত্নী রাধার কথা, যার কোনো সন্তান ছিল না অথচ সন্তানের বিশেষ আকাঙ্ক্ষা ছিল। কুন্তী গৃহমধ্যে নিশ্চেষ্ট বসেছিলেন না। এবং ঠিক সেই বিশেষ ‘দিনটিতেই চম্পানগরীর গঙ্গার ধারে, অধিরথ তাঁর পত্নী রাধাকে নিয়ে ভ্রমণ করতে আসেন নি। কুন্তী চরের মারফৎ পূর্বেই সমস্ত কথা লিপিবদ্ধ করে, পূর্বের পরিচয়ের সুযোগ নিয়ে, পত্র পাঠিয়েছিলেন। পত্রটি তিনি রাধার উদ্দেশ্যেই লিখেছিলেন, এবং তাঁর মতো বুদ্ধিশালিনী যুবতী পত্রের উত্তরও প্রত্যাশা করেছিলেন। রাধার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেলে, কুন্তী কদাচ তাঁর সদ্যো- জাত পুত্রকে চম্পানগরীতে পাঠাতেন না।
চরের মারফৎ সংবাদের পরেই, কুন্তী পরবর্তী করণীয় কাজগুলো সমাপ্ত করেছিলেন। বিশিষ্ট কারিগর দিয়ে, তিনি যে মঞ্জুষাটি তৈরি করিয়েছিলেন, সেটি যতোটা ছোট করে দেখানো হয়েছে, ততোটা ছোট আদৌ ছিল না। কাষ্ঠপিঞ্জরটি আসল নৌকাই ছিল। কিন্তু কারিগরীর দ্বারা তার গঠনে নিশ্চয়ই বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। নিশ্ছিদ্র কোনো আধারে শিশুটিকে রাখা হয়নি। মঞ্জুষাটি আদৌ জনহীন ছিল না। চালক তো ছিলই। এই চালকের ওপরই দায়িত্ব ছিল, শিশুটিকে সময় মতো খাওয়ানো ও দেখা-শোনা করা। পানীয় জল মধু ইত্যাদি ব্যতিরেকেও তীরবর্তী অনুগামী চরের কাজ ছিল, পথিমধ্যে জনপদ হতে দুগ্ধ সংগ্রহ করা।
একজন অনুচরই যে তীরে তীরে মঞ্জুষাটির অনুসরণ করেছে, তাও না। নতুন অনুচর আসা মাত্র পুরনো অনুচর গিয়ে, সংবাদের প্রতীক্ষায় সদা সশংকিতা কুম্ভীকে গিয়ে সংবাদ দিত। এই ভাবেই কুন্তী তাঁর সদ্যোজাত প্রিয় পুত্রটিকে লালন-পালনের জন্য অধিরথের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। এবং ভবিষ্যতে পরিচয়ের সুবিধার জন্য, অভি জ্ঞানস্বরূপ কুণ্ডল ও কবচ সঙ্গে দিয়ে দেন। ধারণ করিয়ে দেন নি। কারণ, কর্ণ বড় হয়ে, সেই কবচকুণ্ডল ধারণ করতেন। এর একটাই অর্থ, কুন্তী কর্ণের যৌবনের দেহ অনুমান করেই, কবচকুণ্ডল যুগল তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন, এবং এই কবচকুণ্ডলের কথাও অধিরথ ও রাধাকে পূর্বেই জানানো হয়েছিল। কারণ পরে আমি দেখছি, কবচকুণ্ডলের ঐ দিব্যলক্ষণ দ্বারা, কুস্তী স্বীয় পুত্র কর্ণকে রঙ্গভূমিতে চিনতে পারেন। কর্ণকে দুর্যোধন কর্তৃ ক রঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করায়, পরম স্নেহে, গোপনে, মনে মনে অত্যন্ত প্রীতিলাভ করছেন। কর্ণের জন্মকে কেন্দ্র করে, একটা গোপনীয়তার আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিল। সময়টা আর সংহিতা যুগ ছিল না। অতএব, স্বতন্ত্র হলেও, কোনো কুমারী কন্যা যদৃচ্ছা পুরুষে আসক্ত হতে পারতো না। তবে ঘটনাটা সেই সংহিতা যুগের কন্যাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। পৌরাণিক কালে আর তা সম্ভব ছিল না বলেই, কুন্তীকে তাঁর সদ্যো জাত শিশুকে লালন-পালন করার জন্য, লোকসমাজে অপ্রকাশিত রাখার বিশেষ চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তা কতোটা কার্যকরী হয়েছিল!
অধিরথের কথা এখানে ছেড়েই দিচ্ছি। তিনি সবই জানতেন দেখছি, ব্যাসদেব, ভীষ্মদেব, বাসুদেব, এঁরা তিনজনেই বিশেষ ভাবে সমস্ত বিষয়টি পরিজ্ঞাত ছিলেন। তবে বাসুদেব নিশ্চয়ই পরে জেনেছিলেন। কারণ, তিনি কর্ণের পরে জন্মেছেন। কিন্তু অল্প বয়সেই, নিজের দূর- দৃষ্টির দ্বারা অবগত হয়েছিলেন।
কর্ণের জন্ম-রহস্য সম্বন্ধে জনশ্রুতিও কিছুটা প্রচলিত ছিল, এটা প্রায় সুনিশ্চিত। দুর্যোধন কর্ণের জন্ম-রহস্য সম্পর্কে কিছু জানতেন কিনা, মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও, স্পষ্টই বলেছেন, “যেমন, হরিণীর গর্ভে বাঘের জন্ম হওয়া একান্তই অসম্ভব, কবচ ও কুণ্ডল- ধারী সর্বলক্ষণ সংযুক্ত সূর্যসঙ্কাশ মহাবীর কর্ণও তদ্রূপ সামান্য ব্যক্তির ঔরসে বা সামান্য নারীর গর্ভে জন্মান নি।
.
এই দুর্যোধন আর এক জায়গায় মদ্ররাজ শল্যকে বলেছেন, “যদি কর্ণের কিছুমাত্র দোষ থাকতো, তা হলে মহর্ষি পরশুরাম কখনোই তাঁকে দিব্যাস্ত্রজালসকল দান করতেন না। এই জন্যেই আমি কর্ণকে সূতোকুলোদ্ভব বলে বিবেচনা করি না। আমি মনে করি, ইনি ক্ষত্রিয়কুলপ্রসূত দেবকুমার, মহৎ গোত্র সম্পন্ন। উনি কখনোই সূত কুল সম্ভূত নন।”
দুর্যোধনের এসব দৃঢ়বাক্য থেকে মনে হয়, তিনি কর্ণ-জন্ম-রহস্য সম্পর্কে হয়তো কিছু জানতেন। স্বয়ং পরশুরাম যদি তাঁকে কিছু নাও বলে থাকেন, দ্রোণাচার্য বলতে পারেন। কারণ, দ্রোণকে পরশুরাম অতি ভয়ংকর অস্ত্রসকল দান করেছিলেন। দুর্যোধনের কথায় এক জায়গায় বলা হয়েছে, কর্ণ ‘ক্ষত্রিয়কুল প্রসূত দেব- কুমার’। তাঁর এ ধারণায়,এটাই যেন প্রমাণ হয়, স্বর্গরাজ্যের অধি- পতি সূর্যের ঔরসেই কর্ণের জন্ম হয়েছিল।
যুধিষ্ঠিরের মনেও কর্ণকে নিয়ে নানারকম সন্দেহ ছিল। কর্ণ অর্জুনের হাতে নিহত হবার পর, তিনি এই মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন, “দ্যূতক্রীড়ার সময়ে মহাবীর কর্ণ দুর্যোধনের পক্ষ নিয়ে আমাকে অনেকানেক কটুবাক্য বলেছিলেন। কিন্তু আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে কোনোখারাপ কথা বলতে পারিনি। আমার মনে প্রচণ্ড রাগ হতো। তখন তাঁর পায়ের দিকে তাকালে, আমার সমস্ত রাগপড়ে যেতো। কারণ, ঐ মহাবীরের পা দুটি, আমার মা কুম্ভীরচরণ যুগলের মতো দেখতে ছিল। আমি চরণযুগলের এই সাদৃশ্যের আগে অনেকবার জানবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনো দিনই তার সন্ধান পাই নি।” শুধু তা-ই না। যুধিষ্ঠিরও সকলের মতোই শুনেছিলেন, কর্ণসুতো- কুলোদ্ভূত। কিন্তু কর্ণকে সহজাত কবচ ও কুণ্ডলধারী দেখে, মনে করতেন, ঐ ব্যক্তিকে যুদ্ধে হত্যা করা অসম্ভব। এমনভয়ও পেয়ে- ছিলেন, তেরো বছর কর্ণের কথা ভেবে, ভালো করে ঘুমোতেও পারেন নি। আসলে তাঁর মনে একটি বিশেষ সন্দেহ ছিল, কৰ্ণ আদপেই একজন সূতোকুলোদ্ভূত সন্তান নন। এবং লোকসমাজে প্রকাশ না করলেও, কর্ণের চরণযুগলের সঙ্গে নিজের জননী কুন্তীর চরণযুগলের বিস্ময়কর সাদৃশ্য লক্ষ্য করে যে-সন্দেহ তাঁর মনে উদিত হতো, নিজের জননী সম্পর্কে তেমন সন্দেহ করা পাপ বলে মনে করতেন।
ইতিহাসের পথপরিক্রমায়, আমি কুন্তীর জীবনের কন্যকাবস্থার সবই প্রত্যক্ষ করলাম। কেবল অস্পষ্টতা থেকে গেল একটি বিষয়ে। যদিও ইতিহাসের সংকেত মতো, দুর্বাসাকেই আমি কর্ণের পিতা বলে মনে করি। স্বর্গ রাজ্যের সূর্যের সঙ্গে কুম্ভীর সাক্ষাতের কোনো ইঙ্গিত পাই নি। সেইদেবরাজ সূর্যের রূপেরওকোনো বর্ণনা নেই। অথচদুর্বাসাররূপের বর্ণনায় বারেবারেই এই গ্রহের সূর্যের ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যেমন,শেষবারের মতো, দুর্বাসার রূপের আর একটি বর্ণনা আমি দিচ্ছি : রূদ্রস্বরূপ দুর্বাসার দেহপ্রভা গ্রীষ্মকালীন মধ্যাহ্ন মার্তণ্ডের ন্যায় জাজ্জ্বল্যমান থাকতো এবং তিনি প্রতপ্ত সুবর্ণসদৃশ জটাভারে সুশোভিত ছিলেন।
দুর্বাসার রূপেরএবর্ণনাথেকে, তাঁকে সূর্য-সদৃশ পুরুষই বলতে হয় আমি কুন্তীকেও দেখেছি, তিনি সেই সূর্য-সদৃশ রূপবান ঋষিকে সেবা করে নিজে সুখী ছিলেন। দুর্বাসাকেও সুখী করেছিলেন। তারই পরিণতিস্বরূপ, কর্ণের মতো পুত্রলাভ। আমি ইতিমধ্যেই অনেক- বারই দেখেছি, কুন্তী কন্যকা জীবনে দৈহিক সুখ যেমন ভোগ করে ছেন, সন্তান ত্যাগ করতে গিয়ে, ততোধিক দুঃখ পেয়েছেন।
কুন্তীর নারী জীবনের বৈচিত্র্যও এটাই। যে পঞ্চকন্যাকে নিয়ে আমাদের ইতিহাস শ্রদ্ধার সঙ্গে গর্ববোধ করেছে, তাঁদের মধ্যে কুন্তীর জীবনই যেন সর্বাপেক্ষা জটিল ও দুঃখী। এখন আমি কুম্ভীর জীবনের সেই অধ্যায়ে যাত্রা করবো