পৃথা – ১

‘যুদ্ধের শেষ সেনাপতি’ আখ্যায়িকায়, আমার যাত্রাপথের বিবরণ ও সময়ের কথা বলেছিলাম। এবারও আমার যাত্রা সেই প্রাচীন- তর ইতিহাসের পথে। আমার সন্ধানের লক্ষ্য এক ঐতিহাসিক রানীর ইতিহাসের পথ ও ঐতিহাসিক রানী, এই কথায় কেউ কেউ আপত্তি করতেপারেন। কারণ আমাদের পুরাণ যে আমাদেরই জাতীয় ইতিবৃত্ত, এ বিষয়ে অনেকের সংশয় থাকতে পারে। কিন্তু আমি দেখেছি, আমাদের প্রাজ্ঞ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পণ্ডিতগণ, পুরাণের বিবিধঅলৌকিক আবরণ মুক্ত করে, ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্বর্গ যে কোনো আকাশের মহাশূন্যে অবস্থিত স্থান নয়, একান্ত- ভাবেই মানুষের নানা নামের জাতির যাতায়াতের পথেই একটি সুন্দর স্বাস্থ্যকর প্রাচীন পাদভৌম স্থান, তা এখন আর কারোর অবিদিত থাকা উচিৎ নয়। তবে স্বৰ্গ স্থানটি ঠিক কোথায় ছিল, অথচ এখন আর সেই নামে স্থানটিকে চিহ্নিত করা হয় না, তা নিয়ে পণ্ডিতবর্গের মধ্যে কিছু বিতর্ক আছে। থাকাই স্বাভাবিক। পুরাণের ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে কেউ আমাদের ইলাবৃতবর্ষকে স্বৰ্গ নামে অবহিত করেছেন। ইলাবৃতবর্ষ ছিল দেবতা নামে জাতির মানুষদের বাস। স্থান নির্ণয় করতে গিয়ে কোনো পণ্ডিত নিৰ্দিষ্ট করেছেন, পূর্ব তুর্কিস্থানের এক বৃহৎ জনপদকে। আবার অন্যত্র অন্য পণ্ডিত স্বর্গের স্থান নির্দেশ করতে গিয়ে, একটি পথের বর্ণনা করেছেন। পঞ্চপাণ্ডব যখন স্বর্গ গমন করেন তখন তাঁরা যে-পথে গিয়েছিলেন, মহাহিমগিরি তাঁদের অতিক্রম করতে হয়েছিল। এই মহাহিমগিরি হচ্ছে হিমালয়। তারপর মহাবালুকার্ণব। এই মহা-বালুকার্ণব তিব্বতের বিশাল মরুভূমি, গবী। গবী মরুভূমি অতিক্রম করে, তাঁরা মেরু পর্বতে উঠেছিলেন। এই মেরু পর্বতেই, যুধিষ্ঠির ভিন্ন, দ্রৌপদী সহ আর সবাইকে কালগ্রাস করে। এই মেরু পর্বতই বর্তমানের ‘আলটাই’ পর্বত। এই আলটাই পর্বতের ওপরেই অবস্থিত ছিল স্বর্গ নামক জনপদ। যে-জনপদের অধিবাসীরা জাতিতে ছিলেন দেবতা।

স্বর্গ রাজ্যের যিনি রাজা বা পালক হতেন, তাঁকে বলা হতো ইন্দ্ৰ। স্বর্গের দেবতাদের সঙ্গে অস্থরদের যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকতো। অথচ পরিচয়ের দিক থেকে দেবতা আর অসুরগণ ছিলেন বৈমাত্রেয় ভাই। ঋষি কশ্যপের এক পত্নীর নাম অদিতি। এর গর্ভে জন্মে- ছিলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, সূর্য (আকাশের নয়), ইন্দ্র এবং আরও কেউ কেউ। এঁদের মধ্যে ব্রহ্মা ছিলেন জ্যেষ্ঠ। ইন্দ্র কনিষ্ঠ। চন্দ্র ছিলেন কশ্যপের খুড়ামহাশয়ের পুত্র, অতএব অদিতির গর্ভজাত সন্তান ব্রহ্মা ইত্যাদিদের তিনি ছিলেন খুল্লতাত।

কশ্যপ আরও একজনকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর নাম দিতি এই দিতির গর্ভজাত সন্তানদের বলা হতো অসুর। অসুরদের গোষ্ঠীকে কেন যে দুর্দান্ত প্রকৃতির বলা হয়েছে, আমি তার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। তবে এই বৈমাত্রেয় ভাইদের পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো ছিল না। দেবতারা আগে জন্মে- ছিলেন। তাঁরা স্বর্গ নামক সুন্দর স্বাস্থ্যকর স্থানটি দখল করে নিজেদের রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু বৈমাত্রেয় ভ্রাতৃগোষ্ঠী অসুরদের তাঁরা মোটেই সহ্য করতে পারেন নি। অতএব, নিজেদের প্রবল শক্তির দ্বারা তাঁরা বৈমাত্রেয় ভাইদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। অসুররা বাধ্য হয়েই, চলে গিয়েছিলেন দুরবর্তী ‘মন্দ’ নামক প্রদেশে। “মন্দ” রাজ্যস্বর্গ থেকে ছিল কিছুটা নিকৃষ্ট প্রকৃতির অসুররা এটা ভালো মনে মেনে নিতে পারেন নি। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে তাঁরা রাগে ফুঁসতেন। আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রায়ই স্বর্গ আক্রমণ করতেন। যুদ্ধে কখনও দেবতাদের জয় হতো। কখনও অসুরদের। অসুররা অনেক সময়েই যুদ্ধে জিতে, স্বর্গে দখল কায়েম রাখতেন।

স্বর্গের দেবতাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ব্রহ্মা বাস করতেন, মেরুপৰ্বত অতিক্রম করে, সেই উত্তর কুরুবর্ষে। আধুনিক কালে সেই কুরুবর্ষ এখন রাশিয়ার সাইবেরিয়া। ব্রহ্মা সেখানে সপারিষদ বাস করতেন বলে, ভারতীয় ইতিহাসের ঊষালগ্নে সেই স্থানকে সবাই ব্রহ্মলোক বলে জানতো। এই ব্রহ্মা সম্পর্কে আমাদের মনে কিছু ভুল ধারণার সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ইনি নাকি দেবমানব ও প্রাণীর সৃষ্টিকর্তা ছিলেন। এটিই হলো ইতিবৃত্তের বিকৃতি। অথবা, ব্রহ্মার জ্ঞান ও দূরদর্শিতার জন্য, তাঁকে সৃষ্টিকর্তা বলে, একটি আবরণ টেনে দেওয়া হয়েছে। আসলে, ব্রহ্মা ছিলেন দেবতাদের সর্ব জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। জগৎ সংসার সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল অনেক বেশি। তাঁর কাছে বহুত্তর জাতির অধিবাসীরা, নানান সংকটে ও বিপর্যয়ে পরামর্শ নিতে আসতেন।

স্বর্গের থেকেও কুরুবর্ষ ছিল অধিকতর স্বাস্থ্যকর স্থান। এখানে ছ’মাস দিন ছ’মাস রাত্রি। এই কারণে অনেকেই ব্ৰহ্মলোক সম্পর্কে এক আশ্চর্য কল্পনাময় প্রচার করেছিল। ব্রহ্মলোকের বছর এক দিন ও একরাত্রি। ব্রহ্মলোক যেন এমনই অলৌকিক স্থান, এবং ব্রহ্ম। এমন একজন দেবতা, তাঁর এক বছর এক দিন ও এক রাত্রি। কিন্তু এ যুগের মানুষ জানেন, সাইবেরিয়াতে ছ’মাস দিন ছ’মাস রাত্রি। আগস্ট সেপ্টেম্বরে যাঁরা রাশিয়ার আধুনিক শহর লেনিন- গ্রাডে যান, তাঁরা রাত্রের অন্ধকার দেখতে পান না। দরজা জানালার পর্দ। টাঙিয়ে, ঘরে আলো জ্বেলে, রাত্রি তৈরি করতে হয়। জ্ঞানই অতীত ও বর্তমানের মানুষের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। জ্ঞানই সকল শক্তির উৎস। আর এই জ্ঞানকে আয়ত্ত করতে হয়েছে বহুবিধ চর্চার দ্বারা। সেই মহাকালের কালবিন্দু গণনার সময়ের আগে থেকে।

ব্রহ্মা তাঁর পারিষদদের নিয়ে সেই জ্ঞানেরই চর্চা করেছেন। স্বাস্থ্য- কর স্থানে, তিনি ছিলেন দীর্ঘজীবি। এখানে আর একটি ঐতি- হাসিক সত্যও আমাকে ইতিহাসের ধূলিকণা সরিয়ে জেনে নিতে হচ্ছে। সেই সত্য হলো, কুরুবর্ষে বা ব্রহ্মলোকের যিনি প্রধান ও পালক হতেন, তিনিই ব্রহ্মা নামে পরিচিত হতেন। অতএব, ব্রহ্মাও একজন কেউ ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাসের জীর্ণ পাতার ধুলো উড়িয়ে একটি সন্ধান পাচ্ছি না। স্বর্গে কতোজন ইন্দ্র রাজত্ব করেছিলেন? কতোজন ব্রহ্মা রাজত্ব করেছেন কুরুবর্ষে? তার কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ আমাদের পুরাকালে যে- ভাবে সুতগণ ইতিহাসকে ধরে রাখতেন, তাতে এই হিসাব পাওয়া উচিত ছিল।

আমাকে ইতিহাসের পথ ধরে, আবার একটু পিছনে ফিরতে হচ্ছে। অর্থাৎ স্বর্গ আর দেবতাদের যে-রাজ্য ও রাজত্বের ইতিহাস পেয়েছি, তাকে আবার একটু নতুন করে দেখে নিই। তা হলে, ইতিহাসের যে-লগ্নে, যে-মহারানীর সন্ধানে চলেছি, তার স্থান- কালের ভিতটা শক্ত হবে।

স্বর্গলোকে সব মানুষ ও প্রাণীই যাতায়াত করতে পারতো, এ আমি দেখেছি। যদিও স্বর্গলোকের মধ্যে অবস্থিতি করেও, রাজ্য- গুলো বিভক্ত হয়ে ছিল, সে জন্য নামও রাখা হয়েছিল আলাদা আলাদা। আর এই রাজ্যগুলোর এক একজন অধিপতি ছিলেন। সেই সব অধিপতিদের যে-নামে পরিচয় পাচ্ছি, আসলে সেগুলো তাঁদের নাম নয়। বরং বলা যায় বংশানুক্রমিক উপাধি।

বহ্মা বা ইন্দ্রের কথা আছে বললেও, আমি আবার নতুন করে ইতিহাসের পাতাটিকে মেলে ধরি। স্বর্গলোকের বিভিন্ন রাজ্যের অধিপতিরা ছিলেন জাতিতে দেবতা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, সূর্য, যম, চন্দ্র, ইন্দ্র, বায়ু, বরুণ। দেখছি এঁদের প্রধান দেবতা বলা হয়েছে। নামগুলো সবই বংশানুক্রমিক, বা যখনি যিনি নেতা হয়েছেন, তিনিই সেই সব ভিন্ন ভিন্ন উপাধি গ্রহণ করতেন। আর তাঁদের নামানুসারেই রাজ্যের নাম হতো,ব্রহ্মালোক, বিষ্ণুলোক, সূর্যলোক, যমলোক, চন্দ্রলোক। বরুণ কি ছিলেন সমুদ্রতীরবর্তী রাজ্যের অধিপতি? সাগরতলবাসী জলদেবতা হলে, তাঁকে এই গ্রহের নিম্নভাগে দেখতে হয়।

যমও একজন দেবতা। অর্থাৎ দেবতা জাতির মানুষ। যমকে বলা হতো, নিয়মনিষ্ঠ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। ইনি ছিলেন সূর্যের পুত্র। সূর্যের দুই পুত্র। যম আর মনু। কিন্তু ইনি সূর্যলোকের কোন্ বা কতো সংখ্যক অধিপতি, ইতিহাসের ধূলাবরণ সরিয়ে, সেই নির্দিষ্টব্যক্তি- টিকে খুঁজে পাচ্ছি না। তবে সূর্যের সুয়োরানী আর দুয়োরানীর মধ্যে সুয়োরানীর ছেলে হলেন মনু। দুয়োরানীর ছেলে হলেন যম। এখানেও দেখছি, ইতিহাসের সঙ্গে রূপকথার একটা ক্ষীণ যোগাযোগ রয়েই গিয়েছে। অতএব, সুয়োরানীর ছেলে, মনু পেয়ে- ছিলেন স্বর্গরাজ্যের একটি ভালো অংশ। আর যমের কপালে জুটেছিল, স্বর্গের দক্ষিণ প্রান্তের খুব খারাপ স্থান জলাভূমি। যে- রাজ্যের নাম ছিল নরক।

কিন্তু যম তার জন্য দুঃখিত ছিলেন না। ইতিহাসে দেখছি, তাঁকে বলা হয়েছে পরম ধার্মিক, এবং সুশাসক। তিনিই প্রথম, গুরুতর অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের প্রবর্তন করেছিলেন। সেই থেকে নরকের অধিপতি মাত্রই ‘মৃত্যুকারী’ বলে পরিচিত হতেন। কিন্তু আধুনিককালে, একশ্রেণীর মিথ্যুক যেমন নরকের পরিকল্পনা করেছে, সেখানে প্রলোকগত জীবের পাপ-পুণ্যের দণ্ডদাতা রূপে যমকে দেখিয়েছে, তার মধ্যে বিন্দুমাত্র সত্য নেই। যম, এবং যম- লোকের অধিপতি সকল যমেরই, মৃত্যু হয়েছে মানুষের মতো। যেহেতু তিনি মৃত্যুদণ্ডের প্রবর্তন করেছিলেন, সেই হেতু তাঁকে ঐভাবে কল্পনা করা হয়েছে। তা ছাড়া, তাঁর রাজ্যের নাম ছিল নরক। নিকৃষ্ট জলাভূমি। সেই কারণেই,অনেকে যমকে নিয়ে নরক গুলজার করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *