পৃথা – ১৩

১৩

যুধিষ্ঠিরের জন্ম-ইতিহাস আমি প্রত্যক্ষ করলাম। কুন্তী ভেবেছিলেন পাণ্ডু একটি পুত্র পেয়েই সুখী হবেন। কারণ তাঁর প্রয়োজন ছিল, নিজের ক্ষেত্রে, সন্তান লাভ করা। কিন্তু আঁতুড়ে যুধিষ্ঠিরকে দেখা মাত্র তাঁর আর একটি পুত্র লাভের আকাঙ্ক্ষা হলো।

এ ক্ষেত্রে, আমাকে ইতিবৃত্তের পথসন্ধানে নতুন করে যাত্রা করতে হবে। ভারত ইতিহাসের এক আদি অধ্যায়ে দেখছি, পাণ্ডবগণ, পাঁচজন বিভিন্ন ইন্দ্রের দ্বারা উৎপন্ন হয়েছিলেন। এই পাঁচজন ইন্দ্রের মধ্যে প্রথমের নাম বিশ্বভূক। দ্বিতীয় ভূতধামা। তৃতীয় শিবি। চতুর্থ শাস্তি। পঞ্চম তেজস্বী।

অথচ আশ্রমবাসিক পর্বে দেখছি, যুধিষ্ঠির ধর্মের অংশে জন্ম পরিগ্রহ করেছেন। মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেন বায়ু দ্বারা উৎপন্ন হয়েছেন। অর্জুনের ক্ষেত্রে দেখছি অন্য কথা। ইন্দ্রের পরিবর্তে, পুরাতন নর ঋষির দ্বারা উৎপন্ন হয়েছে। নকুল ও সহদেবকে চিরাচরিত সেই অশ্বিনীকুমারদ্বয় দ্বারাই উৎপন্ন বলা হয়েছে। কিন্তু ইন্দ্রের পরিবর্তে অর্জুনের জন্মদাতা পুরাতন ঋষি নর হলেন কেন?

এক আধুনিক ইতিবৃত্তে দেখছি, অগ্নি-পুরাণের বর্ণনায় পঞ্চ পাণ্ডব উত্তর হিমালয়ের শক জাতীয় ঋষিদের দ্বারা সমুৎপাদিত হয়েছিলেন।

ভারত ইতিহাসেই দেখছি, ঋষি নর ও নারায়ণের আশ্রম গন্ধমাদন পর্বতে অবস্থিত ছিল। পাণ্ডবগণ সেই আশ্রমে মাঝে মাঝে কালা- তিপাত করতেন। দেখছি, মহাত্মা নর ও নারায়ণ ঋষি অসাধারণ তেজস্বী বুদ্ধিমান ও মহাপরাক্রমশালী। স্বর্গ বা ব্রহ্মলোকে যখনই অসুররা আক্রমণ করে অত্যাচার করতো, তখনই এঁরা গন্ধমাদন থেকে সেখানে গিয়ে অসুরদের যুদ্ধে পরাজিত করে বিতাড়িত করতেন। দেবতাদের অশেষ সাহায্য করতেন। অর্জুন, অসুরদের সঙ্গে ইন্দ্রের যুদ্ধে, স্বর্গে গিয়ে, শতসহস্র পৌলমবংশীয় ও কালকঞ্জ- বংশীয় শত্রুদের নিধন করেছিলেন। সেই যুদ্ধে তিনি জম্ভাসুরকেও নিহত করেছিলেন। নারায়ণ মূর্তি কৃষ্ণ ও অর্জুনের সঙ্গে খাণ্ডবদাহের সময় বহুতর প্রাণী বধ করেছিলেন। এই কৃষ্ণই সেই নারায়ণ। এই অর্জু নই সেই নর। নারায়ণ ঋষি বহুত্তর গুণে, নর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন।

সহসা। এই নর নারায়ণের কাহিনীটি কেন যে এখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে, বোঝা যায় না। এটি একটি প্রক্ষিপ্ত ঘটনা বলেই মনে হয়। তবে উত্তর হিমালয়ের শকজাতীয় ঋষিদের দ্বারা পঞ্চপাণ্ডব উৎপন্ন হয়েছিলেন, আধুনিক ঐতিহাসিক বিষয়টির প্রাচীর ইতিবৃত্তের কোনো সংকেত দিতে পারেন নি।

পাঁচজন ইন্দ্রের দ্বারা পঞ্চপাণ্ডব সমুৎপাদিত হয়েছিলেন। ভারত কথার মধ্যে এটিও প্রক্ষিপ্তই মনে হয়। একজন ইন্দ্রের শাসনকাল কম করে, বিশ বছর ধরলেও পাঁচজন ইন্দ্রের শাসনকাল একশে। বছর হয়। পাণ্ডবদের জন্ম হয়েছিল চার বছরে। ইতিহাসেই প্ৰমাণ রয়েছে, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, তিন জনেই, পর পর তিন বছরে জন্মেছিল। চতুর্থ বছরে যমজ নকুল ও সহদেব। অতএব পাঁচজন ইন্দ্রের দ্বারা পাণ্ডবদের জন্মের কথা সত্যি নয়।

যুধিষ্ঠিরের জন্মের পরে, পাণ্ডু আর একটি বলশালী পুত্রোৎপাদনের জন্য কুন্তীকে অনুরোধ করলেন। বলশালী পুত্র উৎপাদনের অনু- রোধ করলেন এই কারণে, প্রথম পুত্রটি ধর্মের অংশে জন্মেছে। স্বভা- বতই একজন যোদ্ধা বলশালী সন্তানের প্রয়োজন পাণ্ডু অনুভব করলেন।

কুম্ভীও পাণ্ডুর অভিপ্রায় মনে মনে অনুমোদন করলেন। এখানে, ইতিবৃত্তের পুরাতনধারাটিকেই অনুসরণ করতে হচ্ছে। শতশৃঙ্গ পর্বতে অনেক বিদ্বান বিচক্ষণ নানা বিদ্যায় পারদর্শী ঋষিরা ছিলেন। তাদেরও কুন্তীর প্রতি যথেষ্ট আকর্ষণ ছিল।

প্রচলিত উপাখ্যান অনুযায়ী, কুম্ভী বলশালী পুত্রের জন্য বায়ুকে আহ্বান করেছিলেন। এবং সেই বায়ু ‘মৃগারোহণপূর্বক’ আগমন করেছিলেন! মহাবল বায়ুর মতো একজন দেবতা ব্যক্তি হরিণের পিঠে চেপে আসেন কেমন করে?

যেহেতু ক্ষেত্রজপুত্র সেই সময়ে অপ্রচলিত, অতএব জন্মদাতা পিতার পরিচয় গোপন করা হয়েছে। যেমন হয়েছে, পরবর্তীকালেও, দ্রৌপদী আর শিখণ্ডির ক্ষেত্রে। পাণ্ডবদের তো তবু ক্ষেত্রজ পুত্রবলা হয়েছে। দ্রৌপদী যেহেতু যজ্ঞস্থল থেকে আবির্ভূত হয়েছিল, সেজন্য তাঁর আর এক নাম যাজ্ঞসেনী।

যাই হোক, আমি কুন্তীর জীবনের বাস্তব ইতিহাসকে অনুসন্ধান করতেচাই। আমি আগেই দেখেছি, ভৌম-স্বর্গলোকে বিভক্ত রাজ্য- গুলোতে এক একজন অধিপতি ছিলেন। বায়ুএকজন সেই রকমই স্বর্গলোকের রাজ্যের রাজা। এখানে এসেই ইতিহাসের ধুলাচ্ছন্ন পাতা দৃষ্টিকেও আচ্ছন্ন করে। শতশৃঙ্গেরই কোনো অমিত বলশালী ঋষিই কি ভীমের পিতা? অথবা, কুন্তী কোনো অনুচরকে স্বর্গলোকে বায়ুর কাছে পাঠিয়ে তাঁকে আহ্বান করেছিলেন?

কর্ণ ও যুধিষ্ঠিরের জন্মের ইতিহাস অনুযায়ী, সম্ভবতঃ শতশৃঙ্গের কোনো অমিতবলশালী, বিদ্বান ঋষিকেই কুম্ভী আহ্বান করেছিলেন। কারণ স্বর্গলোকের পথের যে বর্ণনা পাই, দ্রুতগামী রথে এলেও, অনেকদিন সময় লেগে যাবার কথা। তা ব্যতিরেকে, পথ যে তেমন প্রশস্ত ছিল, এমন নয়। বরং অত্যন্ত দুর্গমই ছিল। অশ্বারোহণে এলেও, অনেক দিন লেগে যেতো। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের জন্মের এক বছর পরেই ভীমের জন্ম হলো। যুধিষ্ঠিরের জন্মের পর। মাত্র দুমাস কিছু- দিন সময় পরেই কুন্তী আবার গর্ভবর্তী হয়েছিলেন।

অবশ্য অনুচর পাঠিয়ে, বায়ুকে আহ্বান করলে, শতশৃঙ্গ পর্ব পৌঁছুতে ছ মাস কিছুদিনে হয়তো সম্ভব ছিল। তবে, কুম্ভী ইতি- পূর্বে, অপরিচিত অজ্ঞাত পুরুষের সঙ্গে সহবাস করেন নি। দুর্বাসা বা বিদুর উভয়ের সঙ্গেই তাঁর পরিচয় ছিল। দুর্বাসার সেবা করেছিলেন এক বৎসর।

এই প্রচ্ছন্নতার মধ্য দিয়েই, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনেরও সম্ভবতঃ কোনো বিশিষ্ট ঋষিপুরুষের, যিনি ব্রাহ্মণ পরশুরামের মতোই ছিলেন অস্ত্র- বিদ্যাবিশারদ, ঔরসে জন্ম হয়েছিল। কুন্তী যাকে শতশৃঙ্গ পর্বতেই দেখেছিলেন। ইন্দ্রকে আহ্বান করার বিষয়টি আমি সম্পূর্ণ কল্পনা জ্ঞানে অস্বীকার করতে চাই না। কেন না, এ কথা সত্যি, কুন্তীর রূপ সততা ব্যক্তিত্ব সকল শ্রেষ্ঠ মানুষ ও দেবতাকেই আকর্ষণ করতো। কিন্তু পরবর্তীকালে, পাণ্ডুর মৃত্যুর পরে, শতশৃঙ্গের ঋষিরা যে ভাবে পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্রদের হস্তিনায় পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন, তার মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সংকেত রয়েছে। শতশৃঙ্গে বিদ্বান, ধীর, শ্রেষ্ঠ ঋষিগণ পাণ্ডবদের হস্তিনায় পৌঁছে দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন বোধ করেছিলেন।

পাণ্ডু যখন ( অভিশপ্ত হবার পর? ) শতশৃঙ্গ পর্বতে গিয়েছিলেন তখনই তাঁর মনে ক্ষেত্রজ পুত্র লাভের আকাঙ্ক্ষ| জাগে। ইতিবৃত্তে দেখেছি, তিনি এমন সব পুত্র চেয়েছিলেন, যারা সব দিক দিয়েই রাজসিংহাসনে বসবার ও রাজ্য-শাসনের উপযুক্ত হবে। এ আকাঙ্ক্ষা কি তাঁর মনে আপনা থেকেই এসেছিল? অথবা শতশৃঙ্গের দূরদ্রষ্টা ঋষিরাই এ আকাঙ্ক্ষ। জাগিয়ে দিয়েছিলেন?

শতশৃঙ্গ পর্বতে যখন পাণ্ডবগণের জন্ম হচ্ছিল, হস্তিনায় কি সে- সংবাদ পৌঁছেছিল? বোধহয় না। ভীম যেদিন জন্মায়, সেই দিনই দুর্যোধনও জন্মেছিল।

ইতিবৃত্তে একটি বিষয় নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। পাণ্ডুর মৃত্যুর পরে, সতেরোদিন ধরে তাঁর ও মাদ্রীর মৃতদেহ কি ঋষিরা হস্তিনায় নিয়ে গিয়েছিলেন? সতেরোদিন কিছুটি মৃতদেহ অবিকৃত, দুৰ্গন্ধহীন বহনযোগ্য থাকতে পারে? অথবা, ঋষিগণ পাণ্ডু ও মাদ্রীর অস্থিখণ্ড নিয়ে, কুম্ভ। এ পাণ্ডবগণসহ হস্তিনায় গিয়েছিলেন?

সেটাই স্বাভাবিক। এবং হস্তিনায় ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র বা সাধারণ নাগরিকগণ পাণ্ডবদের জন্মের কোনো কথাই জানতেন না। ঋষিগণের সঙ্গে পাণ্ডবগণ যখন হস্তিনায় গিয়েছিল, তখন যুধিষ্ঠিরের বয়স ১৬। ভীম—১৫। অর্জুন—১৪। নকুল ও সহদেব—১৩। এইসব ক্ষেত্রজ ক্ষত্রিয় পুত্রদের, নিয়মানুযায়ী এগারো বছর বয়সেই উপনয়ন হয়ে গিয়েছিল। পাণ্ডু বেঁচে থাকতে,কেন হস্তিনায় পুত্রদের জন্মের খবর দেওয়া হয় নি, এটি রহস্যময়। কারণ, ভীষ্ম ও অন্যান্য রাজপুরুষগণ ও হস্তিনার নাগরিক অধিবাসীবৃন্দ সকলেই সেই দৃশ্য দর্শন করে বিস্মিত হয়েছিলেন। এমন কি কুরু বংশের পুরুষ ও মহিলারা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

শতশৃঙ্গ পর্বতের একজন প্রধান ঋষি অন্যান্য ঋষিদের অনুমতি নিয়ে পাণ্ডু ও মাদ্রীর বিষয় বলেছিলেন, এবং পাণ্ডবগণের জন্মকাহিনী বিবৃত করেছিলেন।

প্রধান ঋষি যখন সমুদয় বিষয় বলেছিলেন, আর কুরু বংশের রাজ- পুরুষগণ ও মহিলারা অবাক স্তব্ধ হয়ে তা শুনছিলেন, ভীষ্ম তখন উপস্থিত হস্তিনার জনসাধারণের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করছিলেন। লক্ষ্য করে দেখেছিলেন, প্রজাবৃন্দ সকলেই ঋষি-বাক্য বিশ্বাস করছে। তারা পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ সন্তানদের কুরুবংশীয় রাজ-অধিকার মেনে নিয়েছিল।

ভীষ্ম তা লক্ষ্য করে, তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি শতশৃঙ্গ পর্বতের ঋষিদের শুশ্রূষা ও পাদবন্দনার আয়োজন করার ব্যবস্থা করেছিলেন। গ্রহণ করেছিলেন পাণ্ডু ও মাদ্রীর অস্থিখণ্ড। বিদুরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, অস্থিখণ্ড দাহ করে, পিত্তাদি ও শ্রাদ্ধকাৰ্য সম্পাদনের ব্যবস্থা করতে। পাণ্ডবগণকে রাজপুত্রের মর্যাদায় গ্ৰহণ করে, কুম্ভীকে মহারানীরূপে আহ্বান করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বস্তুতপক্ষে,ভীষ্মইতিহাসের এক সংকটময় মুহূর্তকে, তাঁর রাজনীতি জ্ঞানের দ্বারা অতি সাবধানতার সঙ্গে মিটিয়ে দিতে পেরেছিলেন। পাঁচটি পিতৃপরিচয়হীন বালককে নিয়ে ঋষিরা যে ভাবে এসেছিলেন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারতো, ষোল সতেরো বছরের মধ্যে কেন রাজপরিবারকে এসব জানানো হয় নি। প্রজাবৃন্দের দিকে তাকিয়ে, এবং বিশেষতঃ কুন্তীর ও বিদুরের মুখ দর্শন করে, ঋষিদের বিশ্বাস করাই শ্রেয়, মনে করেছিলেন। তা ব্যতিরেকে, পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্রদের গ্রহণে কোনো বাধাও ছিল না।

ইতিবৃত্তের নবদিগন্ত উন্মোচিত হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *