পৃথা – ৮

যদু বংশীয় শূরের পুত্রের নাম বসুদেব। কন্যার নাম পৃথ।। অল্প বয়সেই দেখছি, পৃথা খুবই সুন্দরী। অংসাবতরন অধ্যায় হতে জানা যায়, সিদ্ধিদেবীর অংশে পৃথার জন্ম।

শূরের পিসতুতো ভাইয়ের নাম ছিল কুন্তিভোজ। এঁর কোনো সন্তানাদি ছিল না! কুন্তিভোজ ছিলেন অশ্বনদীর তীরবর্তী রাজ্যের রাজ।। তিনি শূরের নিকট একটি সন্তান প্রার্থনা করলে, শূর তাঁর কন্যা পৃথাকে কুন্তিভোজের কন্যা রূপে দান করেন। এই ঘটনাটির দ্বারা প্রমাণ হয়, সেইকালে কন্যাকেও দত্তক রূপে গ্রহণ করা হতো। রাজা কুন্তিভোজের পালিতা কন্যা বলেই, পরে পৃথার নামকরণ হয় কুন্তী। কুন্তীর যৌবনকালের একটি বর্ণনায় পাচ্ছি, তিনি ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। দীর্ঘনয়না, রূপ-যৌবন- শালিনী, স্ত্রী-সুলভ গুণবতী, গম্ভারস্বভাবা, মহাব্রতা ও ধর্মশীল।। অনেক নৃপতিই সেই তেজস্বিনী নারীকে পত্নীরূপে পাবার জন্য বিশেষ উৎসুক ছিলেন।

পৃথা কি রাজা কুন্তিভোজের পালিতা কন্যা হিসাবে সুখী হয়েছিলেন? কখনও হন নি। বরং তাঁর অল্প বয়সে মনের দিক থেকে এই ঘটনা অত্যন্ত দুঃখের হয়েছিল। তিনি সারা জীবনে কখনও ভুলতে পারেন নি তিনি তাঁর নিজের পিতামাতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। শিশুর মনস্তত্ত্বের দিক থেকে বিষয়টিকে দেখছি, পৃথারাজা কুন্তিভোজ গৃহে পালিত হবার সময়, সর্বদাই মনমরা হয়ে থাকতেন। অথচ অল্প বয়স থেকেই বুদ্ধিমতী ছিলেন। মনের দুঃখের কথা তিনি রাজ- পরিবারের জ্যেষ্ঠদের কখনও জানতে দিতেন না।

পৃথার বাল্যের ধাত্রীগণ ব্যতিরেকেও ছিলেন অনেক সখী। কিন্তু কুন্তী যে সখীদের সঙ্গে নিতান্ত বালিকা ভাবে চঞ্চলতা প্রকাশ করতেন, এমন দেখা যেতো না। বরং শিশুকালেই যেহেতু তিনি পিতৃমাতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, সেইহেতু তাঁর মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য দেখা গিয়েছিল। সেটি হলো, তাঁর অনন্য মনোভাব।

কুন্তী যে দেখতে অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন, সে তো আমি দেখছিই। তিনি সখীদের সঙ্গে নানা রহস্যালাপ করলেও তাঁর চরিত্রে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, তিনি সহজে নিজের রসসিক্ত মনকে সকলের সামনে খুলে ধরতেন না। তাঁর চরিত্রের কথা নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হলেও, তিনি যে ক্রমেই একটি জটিল চরিত্রের নারী হয়ে উঠেছিলেন, তার প্রথম প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাঁর প্রথম যৌবনেই। অথচ অন্যান্য বিশেষণে ভূষিত করে, তাঁর চরিত্রের জটিলতার দিকটিই নানাভাবে আবৃত করে রাখা হয়েছে।

শৈশবে মনের গোপন দুঃখই অন্য কন্যাদের তুলনায়, ভিন্নতর করে তুলেছিল। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরেও, কুন্তী অনেক বয়সে, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র কৃষ্ণকে বলেছিলেন, ‘আমি দুর্যোধনকে বা নিজেকে দোষ দিই না। আমার পিতাকেই আমি নিন্দা করি। বদান্যরূপ প্রখ্যাত ব্যক্তি যেমন নিজের ধন অপরকে অক্লেশে বিলিয়ে দেন, আমার পিতাও সেইরকম আমাকে কুন্তিভোজের কন্যারূপে সমর্পণ করেছিলেন। আমি শৈশবে যখন কন্দুকক্রীড়া (পুতুল লাটিম ইত্যাদি খেলা ) করতাম, তখনই তোমার পিতামহ, আমার পিতা, তাঁর সখা রাজা কুন্তিভোজের হাতে আমাকে দত্তক কন্যা রূপে সম্প্রদান করেন। হে পরন্তপ, (কৃষ্ণ) সেই আমি পিতার দ্বারা পিতৃস্নেহে বঞ্চিত…

কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের পরে, সেই বয়সেও পৃথা তাঁর পিতৃস্নেহে বঞ্চনার কথা তুলতে পারেন নি। শৈশবে যে তাঁর মনে, সেই ঘটনা, তাঁর চরিত্রকেই অনন্যতা দান করেছিল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

পৃথাকে দত্তক কন্যা রূপে লাভ করার পরে, রাজা কুন্তিভোজ আর অনপত্য ছিলেন না। তাঁর সন্তানাদি হয়েছিল। অতএব, কুন্তীই তাঁর একমাত্র সন্তান ছিলেন না

রাজা কুন্তিভোজের কাছে, অনেক মুনি ঋষিরা আসতেন। রাজা তাঁদের অভ্যর্থনা করতেন। এবং কুন্তীকে তিনি সেই সব মুনি ঋষিদের সেবায় নিযুক্ত করতেন। ইতিবৃত্তের ক্ষেত্রে, এমনভাবে এই সেবার বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে, যেন দুর্বাসা ব্যতিরেকে আর কোনো মুনি ঋষিকে, কুন্তীর সেবা করতে হয় নি, ঘটনা তা না। রাজা কুন্তিভোজ তাঁর এই দত্তক কন্যা কুন্তীকে মুনি ঋষি মহাপুরুষদের সেবায় নিযুক্ত করতেন।

কুন্তী যখন যৌবনে পদার্পণ করলেন, তখনই রাজা কুন্তিভোজের গৃহে আবির্ভূত হলেন মুনি দুর্বাসা। কিছু স্থুল বুদ্ধি বা মতলবী ব্যক্তি, দুর্বাসার উপস্থিতির সময়ে, কুন্তীকে নিতান্তই বালিকা বলে বর্ণনা করেছেন। অথচ স্বয়ং দুর্বাসার ‘দেবী!” বা ‘চারুহাসিনী’ এরকম বহুতর সম্বোধনেই বোঝা যায়, কুন্তী ‘তখন যৌবনে পদার্পণ করেছেন।

দুর্বাসা সহসা কুন্তিভোজের গৃহেই বা আগমন করলেন কেন। রাজা তো ভারতের নানা স্থানে অনেক ছিলেন। কুন্তিভোজের কাছেই বিশেষ করে এলেন কেন? এই মহর্ষি দুর্বাসা দেখতে অবশ্য সুপুরুষ ছিলেন। তীব্র তেজস্বী, মহাদীর্ঘকায়, শ্মশ্রুদণ্ড-জটাজুটধারী অতি সুন্দর ও সুদর্শন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তপস্যার তেজে প্রজ্বলিত, তপধ্যায়- শীল, মধুরভাষী মহাতপস্বী। অনেক বর্ণনার মধ্যে একটি যেমন পাওয়া যায়, তেমনি একটি বিশেষ প্রচার ছিল, মহর্ষিটি ভারি কোপন স্বভাবের ব্যক্তি। আর এ প্রচারটা এমন ভাবেই করা হয়েছিল, তাঁর দর্শন মাত্র, আগেই লোকের মনে হতো, কী জানি কী ভুল করে বসবো। তারপর অভিশাপে শাস্তি ভোগ করতে হবে।

দুর্বাসা কেন কুন্তিভোজের গৃহেই সহসা একদিন আগমন করলেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। সম্ভবতঃ দুর্বাসা জানতেন, কুন্তিভোজের গৃহে একটি পরম রূপসী কন্যা আছে, এবং সে নাকি মুনি ঋষিদের সেবায় বিশেষ যত্নশীল।। অতএব তাঁর মতো একজন পরম রূপবান, সূর্যসদৃশ তেজস্বী মহর্ষিই বা কেন কুন্তীর সেবা গ্রহণ করবেন না? সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, তিনি রাজা কুন্তিভোজের কাছে এসে প্রথমেই বললেন, “হে মহারাজ কুন্তিভোজ, আমি ভিক্ষা গ্রহণ করে তোমার গৃহে কিছুদিন থাকতে ইচ্ছা করি। কিন্তু আমি যখন তোমার গৃহে বাস করব, তখন তুমি বা তোমার অন্য কোনো লোক, আমার অভিপ্রায়ের বিপরীত কোনো আচরণ যেন না করে। এতে যদি তুমি সম্মত হও, তা হলে আমি কিছুকাল তোমার গৃহে বাস করবো। তবে আমার ইচ্ছানুসারে। কিন্তু সব সময়ে যেন, আমার গৃহে শয্যা, আসন প্রভৃতি ব্যবহার্য বস্তু সুশৃংখল ভাবে প্রস্তুত থাকে। এর কোনো অন্যথা যেন না হয়।”

দুর্বাসার এসব কথা থেকে মনে হয়, তিনি আগে থেকেই কিছু ভেবে এসেছিলেন। অন্যথায় যেথানে তাঁকে একবার ‘মধুরভাষী বলা হচ্ছে সেখানে এমন শপথ গ্রহণ করানোর কারণ কী?

কোনো সন্দেহ নেই, কুন্তীর রূপ মাধুর্যের কথা ঋষি মুনির সেবার কথা তিনি পূর্বেই অবগত ছিলেন, পরে তাঁর মতো কোপন স্বভাবের লোকের স্বভাবতই মনে হতে পারে, সাধারণ মুনি ঋষিরা যদি সেই অপরূপ কন্যার সেবা পেয়ে থাকে আমি কেন পাবো না? এবং আমার পাওয়া হওয়া চাই সকলের থেকে অনেক বেশি ও ‘বিশিষ্ট’। কুন্তিভোজ নিজেই দুর্বাসার কথা শুনে মনে মনে ভাবছেন, “এই মহর্ষি দুর্বাসা যথেচ্ছাচারী ও কোপন স্বভাব, তাঁকে গৃহে রেখে, তাঁর অভিপ্রায় অনুযায়ী সেবা করা অতি কঠিন কাজ।”… সব জেনেও তিনি কুন্তীর কথাই দুর্বাসাকে বলেছিলেন, “হে মহর্ষি, আমার পৃথা নানে যশস্বিনী কন্য। আছে। যে আপনার সেবা করবে। আমার মনে হয় আমার সেই কন্যার শীলবৃত্ত দ্বারা আপনি সন্তুষ্ট হবেন।”

দুর্বাসাকে ঐ সব বলে, অন্তঃপুরে এসে কুন্তীকে বোঝালেন, “বৎসে! এক মহাতপস্বী ব্রাহ্মণ আমার গৃহে বাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।…আমি একমাত্র তোমার প্রতিই নির্ভর করে, তাঁর সেবার ভার নিয়েছি। …তুমি সর্বদা একাগ্রচিত্ত হয়ে এই মহর্ষির আরাধনা করবে। আমি তোমার বাল্যকাল থেকেই, তোমার অসা- ধারণ সেবার মনোভাব অবগত আছি। ব্ৰাহ্মণগণ, গুরুবর্গ, বন্ধুবৰ্গ, মিত্রবর্গ, সম্বন্ধিবর্গ এবং মাতৃবর্গ, এমনকি দাসদাসীগণের প্রতিও তোমার অসাধারণ সানুকম্প দৃষ্টি আছে।…হে শোভনাঙ্গী! তোমার সাধ্বিবৃত্তির জন্য সমস্ত ভৃত্যজনও তোমার প্রতি আকৃষ্ট।”… এত কথা বলে, কুন্তিভোজ কুন্তীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, “দুস্কুলে সম্ভূত কন্যারা প্রায়শঃ বালস্বভাব প্রযুক্ত, বিপরীত আচরণকারিণী হয়ে থাকে। হে পৃথে, তুমি শ্রেষ্ঠ রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেছ, এবং তোমার দেহ সৌন্দর্যও অসাধারণ। তুমি বংশ-রূপ-গুণ, এই সমস্ত দ্বারা শোভিত।…হে কল্যাণি! এই মহাতপস্বী কোপন স্বভাব ব্রাহ্মণকে সেবায় সন্তুষ্ট করতে পারলে, তুমি বহু কল্যাণ লাভ করতে পারবে।”

কুন্তী কী দুর্বাসাকে আগে দেখেছিলেন? নাম নিশ্চয়ই শুনেছিলেন। তিনি রাজাকুস্তিভোজের কথায় অনায়াসেই সেই সম্মতি দিয়েছিলেন। এমন কি, তিনি পালক পিতাকে এমন কথাও বলেছেন, “আমি যখন এই ব্রাহ্মণের সেবায় রত হব, তখন উনি যদি নিয়ম রক্ষা না করে, ভোরবেলা, সন্ধ্যাবেলা গভীর রাত্রে, যখন খুশি আগমন করলেও আমি একটুও রাগ করবো না। উনি কোনো নিয়ম না মানলেও, আমি কখনও ওঁর সেবা ছেড়ে অন্যত্র যাবো না। আমি যা করলে উনি সন্তুষ্ট হবেন, আমি তাই করবো। আপনি ব্রাহ্মণকে যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমি তা পালন করবো।” দুর্বাসাকে বলা হয়েছে, প্রজ্বলিত বহ্নিস্বরূপ। (সূর্য?) এঁর পরিচর্যা করা আর আগুনের মধ্যে প্রবেশ করা, একই কথা। একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই এই কোপন স্বভাব মহর্ষিকে সার্থক সেবা করতে পেরেছিলেন। কৃষ্ণকে তিনি কিছুতেই বিব্রত বা ক্রুদ্ধ করতে পারেন নি।

কুন্তীর কাছে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা শুনে তাঁকে দুর্বাসার কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এই আমার কন্যা। চিরকালই সুখে লালিতা। যদি কোনো অপরাধ ঘটে, আপনি ক্ষমা করবেন।’

দুর্বাসা বললেন, “তথাস্তু!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *