পরিশিষ্ট – সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তর একান্ত অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকার

পরিশিষ্ট – সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তর একান্ত অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকার

পরিশিষ্ট

১০ বছর পরে—

উটকো সাংবাদিকের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত ও গৌতম ভট্টাচার্য ফেব্রুয়ারি ২০০৪-এ ‘খেলা’র বিশেষ সংখ্যায়। সাক্ষাৎকারটি এখানে মুদ্রিত হল।

সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তর একান্ত অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকার

‘স্টিভ ওয়ার বাড়িতে আগুন নেভাতে ছুটল গ্লেন ম্যাকগ্রাথ— এই কাহিনী বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গ হওয়া উচিত’

সুরজিৎ: কলকাতা ফুটবল কি এখন তোমাকে সেভাবে আকর্ষণ করে? যদি না করে তাহলে তার কারণ কি বিশ্ব ফুটবলের কাছে চলে আসা?

অশোক: না, কলকাতা ফুটবলেরও খবর রাখি। সেভেন্টিজে যতটা উৎসাহ ছিল তা হয়ত আর এখন নেই। কিন্তু যেটা রাখি সেটা সাধারণ সমর্থক হিসেবে যতটা রাখার, ততটাই। তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। এখানকার ফুটবল দেখতে খারাপ লাগছেটাগছে এ-সব আমার মনে হয় না। এটা আমার মেন্টাল সেট-আপের মধ্যেই আছে যে, এটা তো অন্য জিনিস। একটার জন্য আর একটা দেখব না, এমন কিছু নয়।

সুরজিৎ: আমি মাঝে মাঝে যখন মাঠে যাই, জনতার মুখে শুনি, দূর এই ফুটবল আর দেখতে ইচ্ছে করে না। এখন আর সেরকম ফুটবল হয় না। এরা মাঠে যায়। কিন্তু গিয়ে বলতে ছাড়ে না।

গৌতম: আপনার লেখায় প্রথম খুব বড় করে এল— হৃদয়। আগে যাঁরা, তাঁদের এতটা এরকম ছিল না তো?

অশোক: আমি এদের হৃদয়হীন বলব না। হৃদয় তো নিশ্চয়ই ছিল। তবে আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটিটাই ছিল হৃদয়। গৌতম, তুমিই বোধহয় একটা লেখায় লিখেছিলে, আমার এক হাতে থাকত কলম, আরেক হাতে পাঠকের হৃদয়। এটা কিন্তু একদম ফ্যাক্ট। মানে আমি সব সময় এটা করি। আজও যখন পলিটিক্যাল লেখা লিখি, সব সময় অন্তত পাঁচ-সাতজন পাঠকের কথা ভাবি। সে বকবে কিনা, সে রাগবে কিনা ভাবি— সে কোন দিকে, ভাবার দরকার হয় না। সেই জায়গায়— এই যে ভাবনা, সেখানেও কোথাও একটা সেরিব্রাল দিক আছে।

গৌতম: এখানে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই।

সুরজিৎ: হ্যাঁ, হ্যাঁ প্লিজ।

গৌতম: এই যে পাঠকের কথা ভাবা, এটা কি খুব সচেতনভাবে? মানে আপনার আগে মতি নন্দীর লেখা আমরা গোগ্রাসে গিলতাম। গিলে মুগ্ধ হতাম। কিন্তু মতি নন্দীর লেখা পড়ে মানুষ মতি নন্দীর সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করা যেত না। মনে হত একে অসম্ভব শ্রদ্ধা আর সম্মান করা যায়। নিজের লোক বলে ভালবাসা যায় না। আপনি যখন এলেন, প্রথম মনে হল এই অবয়বটাও অচেনা। কিন্তু এ আমাদের ভালবাসে। পাঠকের সঙ্গে এই সেতু তৈরি কি খুব সচেতনভাবে করা?

অশোক: মতি নন্দীর কথাই যখন হচ্ছে তখন বলি। উনি বেসিক্যালি একজন বড় গদ্য লেখক। অজয়দা বড় প্লেয়ারও। স্পোর্টিং ইউনিয়নে খেলেছেন, পঙ্কজ রায়ের পাশে খেলেছেন। মুকুল দত্ত স্পোর্টসের বই নিয়ে থাকতেন। খেলার পাতায় ডুবেই থাকতেন। মতিদাও তো স্টার স্পোর্টিংয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। এঁদের পাশে আমি বোধহয় একেবারে সাধারণ পাবলিক হিসেবে আলাদা থাকতে পেরেছি। যাকে বলে মাঠের পাবলিক।

অনেকে জিজ্ঞেস করে, এই যে সাকসেস, আমি বলি দুটো কারণ। এক, আমার কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না যখন আমি ‘আজকাল’-এর দায়িত্ব নিয়েছিলাম। অভিজ্ঞতাহীনতা একটা বড় ব্যাপার। ভুল কোনও অভিজ্ঞতা তো আর নেই আমার। ঠিক নেই— ভুলও নেই।

তা ছাড়া সব সময় মনে করেছি রিডারের পাশে বসে আছি। ও আমার চেয়ে কম জানে না। আমিও ওর চেয়ে কম জানি না। আর লিখতে লিখতে কোনও জায়গায় যখন পৌঁছোই তখন মনে হয়, এই তো। আমার এই জায়গাটা আসছে। অনেকে বলে আবেগ। আমি না। সুভাষ ভৌমিকের সঙ্গে একবার মারাদোনা নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল। ও লিখল, আমিও লিখলাম। আমার কথা হল, আবেগটা কোথা থেকে আসছে? আবেগ বুদ্ধি থেকেই আসছে। এটা তো বিযুক্ত কোনও ব্যাপার নয়। বুদ্ধিই তো আমাকে বলে দিচ্ছে যে তুমি হৃদয় নিয়ে যাও। লেখালেখির ক্ষেত্রে সেই জায়গাটা সচেতন নয়। আপনা-আপনাই আসছে। এবার সেটা করতে গিয়ে মনে হল, আর এতভাবে মানুষের মন পাওয়া যায়! একটা লেখাকে আমি আমার ‘ল্যান্ডমার্ক’ বলি। পিন্টু চৌধুরিকে যখন তাড়িয়ে দিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। আমার ম্যাগাজিন তখন বিক্রি হত বত্রিশ হাজার। সেই সংখ্যা বিক্রি হল বাষট্টি হাজার। তিনবার কাগজ ছাপতে হয়েছিল। কেন? কেন? আমি যখন লেখাটা পড়ি তখন নিজেরই বাংলাটা পড়ে লজ্জাটা লাগে। তবু কোথাও নিশ্চয়ই ছুঁতে পেরেছিলাম। নইলে…।

গৌতম: বিশ্লেষণ করতে গেলে মনে হয় আপনার স্টাইলটাই একটা বিশাল ধাক্কা ছিল, যাতে পাঠক হিসেবে আমরা হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলাম।

একটা উদাহরণ দিচ্ছি। একাশিতে মোহনবাগান সমর্থকদের ক্ষোভ নিয়মিত বর্ষিত হচ্ছে কোচ অরুণ ঘোষের দিকে। ক্ষোভের কারণ, নিয়মিত মিহির বসুকে খেলিয়ে খেলিয়ে ফ্রান্সিস ডিসুজাকে মাঠের বাইরে রাখা। সবাই জেনেই গেছে মিহির যেহেতু কোচের ব্যক্তিগত ফেবারিট, তাঁর প্রতি নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব করছেন কোচ।

এবার ‘খেলার কাগজ’ বা ‘খেলার কথায়’ আপনার লেখা শুরু হচ্ছে এভাবে: অরুণ ঘোষ যাঁকে শেষ দুপুরের মোহনবাগান টেন্টে সযত্নে শারীরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন তিনি অবশ্যই মিহির বসু। মিহির কোচের প্রিয়তম, তাঁকে তো কোচ বাড়তি খাতির করবেনই। এবং প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা। লেখার ঠিক এই জায়গায় এসে আপনাদের ভুল পথে পরিচালিত করার জন্য মার্জনা চাইছি। অরুণ ঘোষ যাঁকে সযত্নে তৈরি করাচ্ছিলেন তাঁর নাম মিহির বসু নয়, ফ্রান্সিস ডিসুজা। অরুণ ঘোষ সম্পর্কে এমন অনেক মিথ্যে রটনার স্কুপ ভেঙে দেওয়া যেত, যদি মানুষটা একটু মুখ খুলতেন।

স্টাইলটা কী অভাবনীয়! পাঠককে যেন ইনসাইড দেখিয়ে আউটসাইড ডজ করে ফেলা। আপনার আগেও বাংলা ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় আমরা ভাষা দেখেছি। কিন্তু চমক আর এতরকম ভ্যারিয়েশন দেখিনি।

সুরজিৎ: আর একটা লেখা তুমি লিখেছিলে মনে আছে বেচু দত্তরায় মারা যাওয়ার পরে। তুমি লিখেছিলে, মারা যাওয়ার পরে কাউকে তো খারাপ কথা বলতে নেই। সুতরাং আজ ভাল কথাই শুধু বলব বলে শুরু করে সমানে শুধু খারাপ কথা। অথচ ভালর মোড়কে বলছ। বলে বলছ, একে ভাল এ জন্যই বলছি, যে শিষ্যদের তিনি রেখে যাচ্ছেন তাঁরা আরও খারাপ। বলে আবার শেষ করছ এইভাবে যে, একদিন স্পোর্টিং ইউনিয়ন মাঠে কাঠফাটা রোদে দেখলাম ছাতা মাথায় খেলা দেখছেন বেচু দত্তরায়। আজকের কোনও কর্মকর্তা, তাঁরা যখন কোনও পদে থাকবেন না, এভাবে কি ছাতা মাথায় কাঠফাটা রোদে ময়দানে বসবেন? বেচু দত্তরায় সম্পর্কে শেষ কথা— তিনি খেলাটা ভালবাসতেন।

গৌতম: লেখাগুলো শেষ হচ্ছে ছোটগল্পের মতো— তীব্র চাবুক মেরে।

অশোক: আসলে গৌতম, এই জায়গাটা বুঝতে হলে আমার মনে হয় আমাদের বছর তিরিশ-চল্লিশ পেছনে যেতে হবে। কী ছিল তখন সব কাগজগুলোর খেলার পাতা? যার কিছু হত না, তাকে বলা হত যাও স্পোর্টসে গিয়ে কাজ কর। স্পোর্টস জার্নালিস্টরা নিজেদের ভীষণ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করতেন। একটা কথা বলব যে, ব্যক্তি হিসেবেও যদি কথা বলি তার ভেতর একটা মজা আছে। এই মজাটা যে সাহিত্যের কারণেই করতে হবে, তার কোনও মানে নেই। মনে হয় আগে অনেকের ক্ষেত্রে যেটা সমস্যা হয়েছে সেটা হল কনফিডেন্সের অভাব।

এই যে গৌতম তুমি বলছ না আউটসাইড দেখিয়ে। আরে এই যে বলটা নিয়ে আমি যাব জমা না দিয়ে, তার জন্য তো কনফিডেন্স লাগে। আগে যাঁরা ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় ছিলেন তাঁরা বোধহয় এটাকে খুব বড় পেশা মনে করতেন না। মতি নন্দী জানেন তিনি মস্ত বড় গদ্যকার। মাঝে মাঝে লিখছেন এই খেলাটেলা পেশাগত কারণে লিখতে হয় বলে। মুকুল দত্ত মনে করতেন, ওই পাতা গুছিয়ে আনছেন, লাইব্রেরি থেকে তথ্য নিয়ে আসছেন, পাতাকে উন্নত করেছেন, ইটস ওকে। অজয় বসু? স্ট্রেট কাট। যেখানে শুরু করেছেন, সেখান থেকেই শেষ করে দিলেন। সোজা চলে যাচ্ছেন, ধাক্কা লাগলে লাগল।

গৌতম: বৃহত্তর ছবিটা নিয়ে কেউ সেভাবে ভাবেনি?

অশোক: ভাবেনি কী, চেষ্টাই তো করেনি! চেষ্টা করলে হত না বলছি না। তুমি যদি বল ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় লেখা— অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, শঙ্করীপ্রসাদ বসু। কী অসাধারণ সব লেখা লিখেছেন! কিন্তু এঁরা তো দু’দিনের। লিখলেন, লিখে চলে গেলেন। এই পেশায় থেকে লেখাটা ভাল করব সেটা আর ক’জন চেষ্টা করলেন?

সুরজিৎ: এখন তো তুমি সরাসরি ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় নেই। খেলার সঙ্গে ইনভলভমেন্ট কতটা অবশিষ্ট আছে?

অশোক: সরাসরি না থাকলেও আমি যা খবর রাখি, খেলার খবর পড়লে আমার যা রি-অ্যাকশন হয়, আমার যা ইন্টারেস্ট আছে সেটা তো বদলায়নি। প্রত্যেক দিন সকালে একা বসে কাগজ পড়ি আর প্রত্যেকটায় একটা একটা করে কমেন্ট দিই মনে মনে। দারুণ, হবে না, বাজে কথা, পারিস বাবা— এরকম। সেই জায়গাটা থেকে এখনও আমার স্পোর্টস পেজে প্রচণ্ড ইন্টারেস্ট। অনেকে গান ভালবাসে। গান শুনে দারুণ তৃপ্তি পায়। আমিও পাই। তবু গান মনে রেখেও আমার কাছে খেলার চেয়ে বড় কিছু নেই। যখন টিভিতে ক্রিকেট দেখি, ফুটবল দেখি, তখন সত্যি সত্যি মনে হয়, জীবনে আর কিছু দরকার নেই।

আর খেলার লেখার কথায় যদি ফিরে যাই তাহলে সেই একটা কথাই বলব— কনফিডেন্স ইজ দ্য কি। আমি বাংলাটা ঠিক কিনা এই অবধি খুব খুঁতখুঁতে থেকেছি। কিন্তু তার বাইরে কনফিডেন্স কখনও হারাইনি। একবার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে টার্নিং পয়েন্ট কথাটা ব্যবহার করেছিলাম। তার পরে আমি দেখেছি কথাটা অনেকবার ব্যবহার হয়েছে। অনেকে করেছে। পরে আমি দেখেছি আদবানির একটা অসাধারণ লেখা আছে। তার নাম ‘টার্নিং পয়েন্ট’। সেই ১৯৭৭ সালে লেখা। মোরারজি দেশাই আর জগজীবন রামের একটা ডায়লগ তুলে দিয়ে উনি লিখছেন, ওই একটা কথা না বলা হলে ভারতের ইতিহাস বদলে যেত। কী সাঙ্ঘাতিক!

গৌতম: এই যে বিভিন্ন ফর্মে লেখাকে ভাবতেন, কখনও চমক, কখনও রাগ, কখনও রোমান্টিকতা, কখনও প্রতিবাদ— এটা কি আপনার মধ্যেই বিভিন্ন রকম আবেগ খেলা করত?

অশোক: হ্যাঁ, করত। সেটারই…

গৌতম: বিচ্ছুরণ।

অশোক: আর একটা জিনিস সব সময় মাথায় রাখা যে, আই হ্যাভ টু বি ডিফারেন্ট। ভুল তো হতেই পারে। কিন্তু তোমাকে আলাদা হতে হবে।

গৌতম: আর একটা ব্যাপার আপনার লেখায় খুব পাওয়া যেত যে, এটা যেন ময়দানের বাইরে স্বাভাবিক জীবন থেকে উঠে আসা একটা লোক বলছে। মুকুল দত্ত বা অজয় বসুর লেখায় ভীষণ ময়দানি গন্ধ পাওয়া যেত। মতি নন্দী সাহিত্যিক। কিছুতেই সাধারণ মানুষ নন। আপনার লেখাতেই প্রথম সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টটা ধরা পড়া শুরু হল।

অশোক: এর জন্য তো আমায় অভিনয় করতে হয়নি। আমি তো সাধারণই।

আমি তোমায় আবার বলছি, কনফিডেন্স ইজ দ্য কি। ভুলভাল কনফিডেন্স নয় যে, বড় ম্যাচে নেমেই গোল করে দেব। তা নয়। তবে একবার যখন পাঠকের কাছে চলে গেছি, তখন আমি তাকে ছাড়ব না। গাল টিপে দেব, মাথা নেড়ে দেব, নাক ধরে টানব— সে তখন আমার।

এই কাছে যাওয়াটা জেনুইনলি সম্ভব, কারণ স্পোর্টস জিনিসটাই অন্যরকম। তার স্বাদটাই আলাদা। স্টিভ ওয়া বড় না সৌরভ গাঙ্গুলি বড়, এটা নিয়ে কোনওদিন মারপিট হবে না। কিন্তু সি পি এম ভাল না বি জে পি ভাল, তা নিয়ে মারদাঙ্গা হতে পারে। অর্থাৎ এমন একটা জিনিস নিয়ে খেলার লেখায় তুমি লোকের কাছে পৌঁছোচ্ছ, যেখানে তোমার ব্যক্তিগত বা আদর্শগত কোনও তাগিদ নেই।

গৌতম: রাজনৈতিক লেখায় আপনার পাঠক তৈরিই রয়েছে। বামফ্রন্টপক্ষীয় লিখলে বামফ্রন্ট সমর্থকরা খুশি হবে। দক্ষিণপন্থী থাকলে কংগ্রেস আনন্দ প্রত্যাশা করবে। কিন্তু খেলায়, এই যে কোনও সীমানা নির্দিষ্ট না থাকা অবস্থায় নতুন পাঠক তৈরি করা, যাদের আপনার লেখাটা পড়ার আগে পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনও মতামতই তৈরি ছিল না, সেটা কি অনেক বেশি রোমাঞ্চকর নয়?

অশোক : মারাত্মক তফাত। মারাত্মক তফাত। খেলার লেখাগুলো লিখে যে আনন্দ পাওয়া যেত বা গত ফুটবল বিশ্বকাপের সময়ও যা পেয়েছি, সেই আনন্দ কোনও রাজনৈতিক লেখা আমায় দিতে পারবে না! জীবনে দিতে পারবে না। কোনওদিন দিতে পারবে না!

গৌতম : এই পর্যন্ত তো গেল এককভাবে সাংবাদিক আপনি। এরপর আসছি ক্যাপ্টেন অশোক দাশগুপ্ততে।

আপনি যখন ক্রীড়া-পত্রিকা এবং তারপর সংবাদপত্রে অধিনায়ক হিসেবে এলেন, অদ্ভুত একটা পরিশ্রমের জমানা শুরু হয়ে গেল। যে টিমটা আগে কখনও কেউ দেখেনি। যার প্লেয়াররা যেভাবে ফুটবল-ক্রিকেট খেলে, মাঠে পারফর্ম করে, সেভাবেই সাংবাদিকতা করতে শুরু করল। যেভাবে একটা লোক মাঠে ড্রিবল করে, সেভাবে ড্রিবল করছে। যেভাবে একটা লোক মাঠে ট্যাকল করে, সেভাবেই ট্যাকল করছে। এই যে পারফরমেন্সের সংস্কৃতি আমদানি করলেন, সেটা কীভাবে এল?

অশোক : সেটা এল মানে প্রথম কথা ফরচুনেট আমি— কিছু ভাল ছেলে বোধহয় পেয়েছিলাম। কিন্তু এখনও আমার সঙ্গে কাজ করতে গেলে যেটা হয়, একটা টিম কনসেপ্ট তৈরি থাকে। সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্ব যেটা বলছ না, সেটা সৌরভের যদি ১০ থাকে, আমারও এক-দেড় ছিল। ছোটবেলা থেকেই একটু লিডার-ভাব।

দু’নম্বর হল, আমি যাদের সঙ্গে কাজ করেছি তাদের বলেছি, তোমাদের দায়িত্বও আমার। আমি যদি একটা মাছ খেতে পাই, তুমিও অন্তত আধখানা মাছ খেতে পাবে। এরকম কখনও হবে না, আমার সঙ্গে একবার যে এসে পড়েছে তার জীবনধারণের কোনও অসুবিধে হবে। তা হলে তুমি খাটবে না কেন?

তা ছাড়া তুমি কে? এই যে পি কে ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলছ, চিফ মিনিস্টার, প্রাইম মিনিস্টারকে কাছ থেকে দেখছ, রিচার্ড হেডলির ইন্টারভিউ করছ। কে আমরা কে? ফালতু লোক— রাস্তার বাইরে থেকে খেলা দেখতাম। আমরা কে? আমরা এক্সট্রা অর্ডিনারি লোক নই। আমরা সাধারণ লোক কিন্তু ডিল করি এক্সট্রা অর্ডিনারি লোকেদের সঙ্গে। তাই বলি ভালবাসো। কাজটাকে ভালবাসো। যদি তোমার ভেতর থেকে এটা না-ই থাকে যে স্টিভ ওয়া-র সঙ্গে আলাপ থাকাটাই ভাগ্যের কথা, তা হলে তো তুমি লিখতেই পারবে না। তুমি যখন স্পোর্টস জার্নালিজম করবে, পাঁচটা লোক মন দিয়ে পড়বে তোমার লেখা, তখন তুমি কেন মন দিয়ে কাজ করবে না? তোমায় মন দিয়ে করতে হবে। করতেই হবে।

গৌতম : আপনার কি বিশেষ কোনও ভোকাল টনিক ছিল?

অশোক : বেশির ভাগটাই বকাঝকা। অথবা রেগে কথা না বলা।

গৌতম : আপনার নেতৃত্বে এই যে সরোজ চক্রবর্তী ট্রেনের প্যাসেজে শুয়ে কভারেজে চলে গেল। দেবাশিস দত্ত ভাই মারা যাওয়ার খবর শুনেও টেস্ট ম্যাচ লিখল। পার্থ রুদ্র প্রিয়জন হারানোর শোক ভুলে কাজে নেমে পড়ল।

এই যে হারতে-না-চাওয়া স্পিরিটটা টিমের মধ্যে কি খেলার মাঠ থেকে এনেছিলেন?

অশোক : হয়ত। হয়ত তাই। দুটো জিনিস দরকার হয়। একটু বুদ্ধি আর পরিশ্রম। আমি এখনও তো রিপোর্টিংকে বলি, কেন খবরটা পেলে না? কী হয়েছে, কী হয়নি— আমার জানার দরকার নেই। সোজা কথা বল, পেয়েছ কি পাওনি?

গৌতম : এই যে কখনও হারতে-না-চাওয়া, এটা কি নিছকই আপনার সাংবাদিক-জীবনের ছবি? নাকি ছোটবেলার কোনও অবচেতন ঘটনা থেকে উঠে আসা? কোথা থেকে উঠে আসে এই লড়াই?

অশোক : হৃদয় থেকে আসে। কিন্তু সেই আবেগকে পরিচালনা করে বুদ্ধি। খেলা নিয়ে লিখতে এসে দেখলাম, আরে, এত লোকের ভালবাসা পাওয়া যায়, কত কিছু চেঞ্জ করা যায় এবং কোনও জায়গায় আপসও করতে হয় না— এর চেয়ে ভাল কী হতে পারে?

টিম? এরা সবাই জানে আমার মতো একই সঙ্গে বকুনি আর মিষ্টি ব্যবহার আর কখনও পায়নি।

গৌতম : ১৯৮২-৮৫ আপনার নেতৃত্বে আজকাল-এর যে স্পোর্টস টিমটা ছিল সেটাই কি সর্বকালের সেরা?

অশোক : পরিশ্রমী টিম। আমি খুব স্যাটিসফায়েড টিমটা সম্পর্কে, এটুকু বলতে পারি। এই টিমে নির্মল, নির্মলকুমার সাহার নামটাও আমি আলাদাভাবে বলতে চাই।

গৌতম : আপনাকে যদি বলা হয় সর্বকালের সেরা স্পোর্টস ডিপার্টমেন্ট বেছে দিন, কী টিম করবেন?

অশোক : শুধু বাংলা থেকে?

গৌতম : হ্যাঁ। বাংলা ভাষায় যাঁরা অ্যাদ্দিন ক্রীড়া-সাংবাদিকতা করেছেন, সেখান থেকে।

অশোক : ছবির ব্যাপারটা যদি ধরো, অবশ্যই সুমন চট্টোপাধ্যায়। গৌতম তুমিও প্রথমেই টিমে থাকবে। আর কে? হ্যাঁ, ক্রিকেটের জন্য দেবাশিস। টেনিসে অরূপ বসু। নির্মল, অরুণ, পার্থ রুদ্র। অতি অবশ্যই ধীমান।

গৌতম : পল্লব বসুমল্লিক?

অশোক : হ্যাঁ, পল্লবকে রাখব। কিন্তু, অন্য ক্ষেত্রে ও তো দুর্দান্ত সাংবাদিকতা করছে। ফুটবলের জন্য রূপক সাহা। রূপক ফুটবলে কিছু কিছু লেখা সত্যিই ভাল লিখেছিল।

গৌতম : রূপায়ণ থাকবে না?

অশোক : চমৎকার লেখে। রূপায়ণের সঙ্গে আমি কাজ করিনি। অনেক পরে এসেছে, ঠিকমতো আলাপই নেই। যাদের সম্পর্কে খুব ভালরকম জানি-চিনি তাদের ‘জাজ’ করাটা সুবিধে।

গৌতম : মতি নন্দী?

অশোক : তুমি যদি আমাকে স্পোর্টস এডিটর হিসেবে রাখো, তা হলে মতিদা…। যে-কোনও একজনকে বাছতে হবে।

গৌতম : মতিদার সাপ্তাহিক কলম নেওয়া যেতে পারে।

অশোক : দারুণ।

গৌতম: বাংলা ক্রীড়া-সাংবাদিকদের অনেকের মনে হয়েছে, পরবর্তী দশ-কুড়ি বছরে ইংরেজি বা বাংলা স্পোর্টস জার্নালিজম রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে কীভাবে চলবে, তার ভিত আপনার টিমটাই গড়ে দিয়েছিল।

অশোক : এটাকে যদি পরিশ্রম বলো, এগিয়ে চলার জন্য লড়াই বলো, তা হলে ঠিক আছে। কিন্তু আমার দুঃখের কথাটাও বলা দরকার। তা হল, আমার এই টিম বাংলা নিয়ে ভাবেনি। ল্যাঙ্গুয়েজের দিকে নজর দেয়নি। এই টিমটার মধ্যে অলক চট্টোপাধ্যায় এক ধরনের ভাল বাংলা লেখেন। কিন্তু সেটাকে তো আর মেইন স্ট্রিম বলব না। ধীমান দিনদিন যেটা হয়ে গেছে সেটা হল ম্যানেজার। খবর করানো, পাতা তৈরি করা, প্রাোডাকশন ম্যানেজ করা— এই সব। প্রাণপণে করে। লেখার চেষ্টা সেই অর্থে করেনি।

বাংলাটা নিয়ে কত বলেছি। হয়নি। ওই রকম লড়াইয়ের সঙ্গে যদি বাংলাটা ‘ম্যাচ’ করাতে পারতাম। হল না।

গৌতম : আপনি কি বলেছিলেন, তোমরা এদিকে চোখ দিচ্ছ না?

অশোক : বলেছিলাম। এক-আধজনকে। বলে কী আর হয়! কিছুই না তো। সহজ করে লেখো শুরুতে। তারপর একটা স্টাইল আপনা থেকেই তৈরি হয়ে যায়। লিখতে লিখতে স্টাইল তৈরি হয়। এই যে হল না, তার অনুশোচনাটা আমার আজও হয়।

গৌতম : কিন্তু একই সঙ্গে কি প্রচণ্ড তৃপ্তিও হয়নি যে অখ্যাত, নতুন উঠে আসা কাগজের খেলার পাতাটা গোটা দেশের ক্রীড়া-সাংবাদিকতার রূপরেখাটাকেই বদলে দিয়েছে?

অশোক : মতি নন্দী ‘আজকাল’-এর এক বছর পূর্তিতে একটা মন্তব্য লিখিতভাবে রেখে ছিলেন যে, আজকাল অন্য সব কাগজের স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের কাজ বাড়িয়ে দিয়েছে।

কেউ যেত না তো তখন। সকালবেলা আবার বেরোতে হবে কেন? বিকেলবেলা জার্নালিস্ট টেন্টে গেলেই তো সব পাওয়া যাবে। তো আমরা করে দেখিয়েছি। ওই যে বললাম, আমার অভিজ্ঞতার অভাব। মতিদা কী করেছেন, মুকুলদা কী করেছেন— তাকাইনি তো। আমি জানি, আমাকে কী করতে হবে। এবং সেই জায়গায় আমরা কাজ করেছি তো বটেই। সেদিক দিয়ে টিম নিয়ে আমি খুব প্রাউড আর বিশেষভাবে দেখলে আই অ্যাম স্যাড যে বাংলাটা পাইনি। ধীমানটাই সবচেয়ে ভাল ছিল আমাদের মধ্যে। ও মেরে দিতে পারে, ফাটিয়ে দিতে পারে। যাকে বলে বক্সার রাইটার। কিন্তু তার বাইরে গেল কোথায়?

যেটা গৌতম তুমি লিখছ বা স্পোর্টসে না থেকেও অনিন্দ্য লিখছে, এগুলো পড়ে মনে হয় আমিই লিখছি মাঝেমধ্যে। ঠিক মনে হয়, আরে আমি তো এটাই লিখতাম। এরকম আমার ছেলেদের লেখা পড়ে মনে হয় না। যখন অ্যাটাক করছে তো দারুণ অ্যাটাক করছে। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন চিমটি কাটলেই চলে, তখন ঘুসি কেন! নিয়মিত লেখার চেষ্টাই করেনি। অ্যাজ এ স্পোর্টস এডিটর ধীমান ইজ ব্রিলিয়ান্ট। কিন্তু লেখাটা সেভাবে নেই।

গৌতম : প্রতিদ্বন্দ্বী খেলার লোক হয়েও একটা কথা না বলে পারছি না। ‘আজকাল’-এর এখনকার খেলার পাতা যে ঢঙে চলে বা সুরজিৎ সেনগুপ্ত দায়িত্ব নেওয়ার আগে ‘খেলা’ যেমন ছিল, তা অনেকটাই কিন্তু সেই অশোক দাশগুপ্ত সৃষ্ট পুরনো ছাঁচ।

এত বছর পর তা কি অনেকটাই প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি? মানে লয়েড চারজন ফাস্ট বোলার নিয়ে ম্যাচ জিততেন বলেই যেন অস্ট্রেলিয়া তার অন্ধ অনুকরণ করছে।

অশোক : ঠিকই। চেঞ্জ তো প্রতি বছরে করা উচিত। সম্ভব হলে প্রতি মাসে।

গৌতম : তা হলে সেই ১৯৮৫-র নকশা ২০০৪-এ ফলো করা হয় কেন?

অশোক : হয়, কারণ বেটার কিছু করা যায়নি। আবার কী। এটা একটা কারণ। ‘কল্লোল’ যখন চারশো রজনী চলছে আমি আর শৈবাল মিত্র একদিন উৎপল দত্তের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন কলেজে পড়ি আমি। বাচ্চা ছেলে। তবু মনে আছে উৎপল দত্তকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কল্লোল আর কতদিন চালাবেন? উনি বললেন, ‘দ্যাখো তরুণ বন্ধু, তিন-চারটে নাটক আমার রেডি আছে। কালকেই নামিয়ে দিতে পারি। কিন্তু সেটা তিনদিন চলবে কিনা আমি জানি না। এটা চলছে তো, আর সহজে চেঞ্জ করতে চাই না।’

আমার যেমন কিছু গুণ আছে, বড় দোষ হল আমার আশপাশে কোনও ইনোভেটিভ ব্রেন তৈরি হওয়া কঠিন। আমি এত পজিটিভ। মানে অন্যরকম কিছু করতে যাচ্ছে কেউ— সে ঘাবড়ে যাবে। ভয়ই পাবে। আমার উপস্থিতিটাই অনেক সময় মনে হয় আমার সহযোগীদের ক্ষতি করে দেয়।

সুরজিৎ : সম্পাদক বা সাংবাদিক হিসেবে নয়। নিছক পাঠক হিসেবে কী ধরনের ক্রীড়া-সাংবাদিকতা তুমি অপছন্দ কর?

অশোক : প্রথম কথা লেখা। আমি মনে করি আমার যে লোক লিখতে গেছে, সে অস্ট্রেলিয়া হোক বা ইংল্যান্ড থেকে, দিল্লি হোক বা দেরাদুন, সে সাতটা কপি দেবে কেন? দু-চারটে খুচরো কপি থাকতে পারে। কিন্তু একটা মেজর কপি থাকবে। যেটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। যেটা পড়াবে। যেটা গৌতম লেখে। এটা অনেকবার বলেছি ধীমানকে। আমি একটা লেখা পড়তে চাই। খবর একটা হতে হবে। আমার আজকাল-এর ছেলেরা এখনও মেশাতে শেখেনি। সব সময় খালি ভাগ, ভাগ, ভাগ, ভাগ। দ্যাটজ হোয়াট আই ডোন্ট লাইক।

টু হচ্ছে ল্যাঙ্গুয়েজ। ল্যাঙ্গুয়েজে বলছিলাম না জোর করে স্টাইল আনা যায় না। স্টাইল তৈরি হয়নি। ‘আজকাল’-এর লেখা পড়ে মাঝে মাঝে মনে হয়, সব একই লোক লিখছে যেন। তা তো লিখছে না।

গৌতম : ‘আজকাল’-এর খেলার পাতায় কি তার মানে একটা কল্লোল যুগ দরকার? যে যুগের লেখকরা আপনাকে অগ্রাহ্য করে লেখালেখি শুরু করবে নতুনভাবে?

অশোক : সমস্যা হল রবীন্দ্রনাথকে অগ্রাহ্য করা অনেক সহজ ছিল। উনি তো একজন ইন্ডিভিজুয়াল ছিলেন। আমাকে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। আমি তো এই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর-এডিটর! ইচ্ছে থাকলেও অগ্রাহ্য করা যাবে না!

অগ্রাহ্য করা বলব না। আমি বলব এক্সটেন্ড করতে চাইলেও হত। এক্সটেন্ড তো করা যায়। এত কথা হচ্ছে তো? গৌতম ভট্টাচার্য ছেড়ে দাও। কিছু কিছু ফুটবল রিপোর্টিংয়ে রূপক সাহা। এর বাইরে বাংলার কাগজে গত কুড়ি বছর কী হয়েছে? সব কাগজ পড়ছি তো। সেই একই কথা। একই এক্সপ্রেশন। শুধু টেস্টের টিকিটের সময় স্পোর্টসের লোকেদের কথা মনে পড়বে কেন? স্পোর্টস একটা কাগজকে অনেকখানি নিয়ে যেতে পারে এই কনফিডেন্সটা কোথায়? সেই জায়গা থেকে তো করতে হবে।

সুরজিৎ : পাঠকের কোয়ালিটি কি কিছু চেঞ্জ হয়েছে বলে মনে হয়? এখন যেমন অনেক বেশি মতামত-নির্ভর লেখার চল হয়েছে। একটা ট্রেন্ড এসে গেছে।

অশোক : শোনো— সরোজ চক্রবর্তীকে বলেছিল একবার একটা বাসে। ১৯৮৪ হবে। ‘আজকাল’ পড়ছিল। সরোজকে চিনত না। তো নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করছে, ওই যে ব্যাটা সরোজ চক্রবর্তী! এ ও-ই বলল, ও এই-ই বলল। তো তুই কী বললি?

লেখার কথা বললে ইউ মাস্ট এক্সটেন্ড ইওরসেলফ। তোমার লেখায় কার্ল মার্কস আসতে পারে, রবীন্দ্রনাথও। তোমায় জানতে হবে কী করে ব্যবহার করতে হবে। এই তো গৌতম আমায় ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলের পর বলল, ‘অশোকদা, আপনার লেখাগুলো এত ভাল হয়েছে যে আমি ফোন করতে গিয়েও করিনি। অনেক ফোন নিশ্চয়ই এমনিতেই আসবে ধরে নিয়ে।’

কীসের ভাল? আমি তো প্রথম দিন লেখা শুরু করার পর রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর তাকাইনি। প্রত্যেকটা লেখার সঙ্গে ভাবছি, এর সঙ্গে কি রবীন্দ্রনাথ নেই? আছে। শেষ লেখার লাস্ট দুটো লাইনও রবীন্দ্রনাথ। এটাই তো কথা। আমি খেলার লেখা লিখছি বলেই যে ইস্টবেঙ্গল টেন্টে গিয়ে বসে আছি তা তো নয়। খেলা লিখছি বলে মোটেই লিমিটেড হচ্ছি না। আই ক্যান গো টু এনি প্লেস। এনি হোয়ার।

সুরজিৎ : স্পোর্টস জার্নালিজম কি রাজনৈতিক সাংবাদিকতার সামনে অনেক সময়ই যথেষ্ট কুণ্ঠিত হয়ে পড়ে না?

অশোক : কেন হয়? আমি তো সেটাই বুঝতে পারি না। হওয়া তো উচিত নয়। পলিটিক্যালে এমন কী আছে? এই যে বিধানসভা নির্বাচনের সময় আমি চাইনি বামফ্রন্টের চেয়ে আরও বাজে কেউ ক্ষমতায় আসুক। উইথ অল মাই লিমিটেশনস (অ্যান্ড রিজার্ভেশনস অ্যাবাউট লেফট ফ্রন্ট) লড়ে গেলাম। এক মাস উইথ অল মাই মাইট লড়লাম। বলা যায় একজন ভাল উকিলের ভূমিকায় লড়লাম উইথ প্যাশন।

কিন্তু সেটা তো একটা স্পেল। এই যে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের বেসরকারীকরণ হতে দিলাম না জ্যোতিবাবুর আমলে। করতে দিলাম না তো। উই ডিড ইট। অনেকগুলো এমন খুচরো আছে যেখানে উই ডিড ইট। কিন্তু ভাবতে খারাপ লাগে, খেলা কী সেটা আমাদের সমাজে বা পৃথিবীতে— বুঝতে না পারা। এই যে স্টিভ ওয়া-র বাড়িতে আগুন নেভাতে ছুটল গ্লেন ম্যাকগ্রাথ— এই কাহিনী তো বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গ হওয়া উচিত! শুধু ওইটা নিয়েই তো একটা উপন্যাস লেখা উচিত। কোথায় আছে? জওহরলাল নেহরুর বাড়িতে আগুন নেভাতে ছুটছেন বল্লভভাই প্যাটেল বাপের জন্মে হবে না! সম্ভবই না! শুধু স্পোর্টস এটা করতে পারে। আবার বলছি, শুধু স্পোর্টসই এটা করতে পারে!

সুরজিৎ : আমরা প্রায়ই একটা কথা শুনতে পাই, ভাল লোকেরা স্পোর্টসে আসছে না।

অশোক : আসছে। হয়ত সেই কনফিডেন্স নিয়ে কাজ করছে না।

সুরজিৎ : আমার বারবারই মনে হয় রাজনৈতিক সাংবাদিকতা বা সাধারণ সাংবাদিকতা থেকে তৈরি সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ সামাজিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা আছে, ক্রীড়া সাহিত্যের সেটা নেই। কেন সমাজ সেই স্বীকৃতিটা দেবে না?

অশোক : কীসের স্বীকৃতির দরকার? তুমি একটা জেলায় গিয়ে দ্যাখো না, একটা কাগজের পলিটিক্যাল কমেন্টেটর আর মোটামুটি ভাল স্পোর্টস জার্নালিস্ট পাশাপাশি নিয়ে দাঁড় করাও না। তুমি দেখবে যে স্পোর্টসের ছেলেকে লোকে বেশি চিনবে।

কিন্তু দুঃখ হয় যখন দেখি, আমি যে কাজটা করছি সেটা যে কারও চেয়ে ছোট নয়, কারও চেয়ে কম নয়, এই বোধটাই বেশিরভাগ স্পোর্টস জার্নালিস্ট দেখায় না।

সুরজিৎ : আমি সামাজিক স্বীকৃতির প্রশ্নটাতেই আবার ফিরছি। আমরা কি দেখতে পারি না যে সে সামাজিকভাবে পুরস্কৃত হচ্ছে? পুরস্কার তো একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো জিনিস নয়।

অশোক : কী পুরস্কার? পুরস্কার দিয়ে কী পাবে?

সুরজিৎ : এটাকে একটা সাহিত্যের মর্যাদা দেওয়া। ক্রীড়া-সাংবাদিকতাকে একটা ইজ্জত দেওয়া।

অশোক : তার আগে এটাকে তো সাহিত্যের স্তরে তুলতে হবে। সাহিত্য করতে হবে তো আগে। ডিড ইউ ট্রাই দ্যাট? ডিড ইউ ট্রাই? করিনি তো। আমাদের সব খবরের কাগজ খেলাকে ‘ট্রিট’ করেছে প্রথমে ‘ফিলার’— জায়গা ভরাবার উপায় হিসেবে। তারপর রেভিনিউ বাড়াতে। নাথিং এলস!

গৌতম : এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই।

অশোক : বলো।

গৌতম: শুধু সাহিত্যধর্মী লেখাই কেন সাহিত্যের মর্যাদা পাবে? যদি আজকালে দেবাশিস দত্ত বা পল্লব বসুমল্লিক দশটা ভাল খবর করে থাকে, তা হলে সেগুলো পুরস্কৃত হবে না কেন? সেগুলোও তো সমানভাবে পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্য। তার জন্য সত্যিই কোনও পুরস্কার থাকবে না কেন?

অশোক: সেই পুরস্কারটা কে দেবে?

গৌতম: যে কেউ দিতে পারে। কিন্তু কোথাও একটা সমাদর হওয়া উচিত।

অশোক: সে নিশ্চয়ই নিজের সংগঠনে স্বীকৃতি পাচ্ছে।

গৌতম: আমার বক্তব্য হচ্ছে সাংবাদিকরা যখন শুধুই সাংবাদিক ছিলেন তখন তাঁদের দেখার যে মাপকাঠি ছিল, তা এখনও একইরকম থাকবে কেন? এখন তো একজন পেশাদার ক্রিকেটার বা ফুটবলারের মতোই সাংবাদিকও পারফর্মার। এখন কি তাদের বিচারের ধরনটা সামাজিকভাবে আরও উন্নত হওয়া উচিত নয়?

অশোক: উচিত তো? কিছুটা হয়েছে— এক নম্বর। তা ছাড়া প্রথম স্বীকৃতিটা তো পেতে হবে। সেটা বাড়িতে পেতে হবে। তারা কিন্তু সেই স্বীকৃতিটা পায়। স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের ছেলেদের এই কদর পঁচিশ বছর আগে ছিল না। আমি আনন্দবাজারে দেখেছি, সেই সময় স্পোর্টসে অন্য ডিপার্টমেন্টের লোকেরা আসত শুধু টেস্টের টিকিট নিতে। আজকে তা নয়। আজ একেবারে সমান সমান।

তুমি বলছ স্বীকৃতি! আরে অরুণ সেনগুপ্ত যে ভাল ফুটবল রিপোর্টার, এটা জানার জন্য কোনও প্রাইজের দরকার নেই তো! এই যে সুমন চট্টোপাধ্যায় দারুণ ছবি তোলে, সে আমার কাগজে এখন নেই বলে ভুলে যাব নাকি? ডেকে হয়ত কিছু দেয় না কিন্তু প্রসেসটা তো থেকেই যায়। গভর্নমেন্টের পাঁচটা লোক কি প্রাইজ দিল, তাতে কিছু ম্যাটার করে না। আমি বিশ্বাস করি সাংগঠনিক স্বীকৃতিতে। তুমি সে সংগঠনের হয়ে কাজ করছ, সে তোমায় যথেষ্ট স্বীকৃতি দিল কি না? দ্যাট ইজ ভেরি ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট। দুই হচ্ছে তোমার সমান্তরাল বা প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন যথেষ্ট স্বীকৃতি দিচ্ছে কি না? সেটাও মনে করা যাক দিচ্ছে।

এবার পুরস্কার। সামাজিক ক্ষেত্রে যদি বলি, বইমেলার উদ্বোধন করা, কোনও স্পোর্টস জার্নালিস্টকে কেউ ডাকবে না। ডাকবে না তার কারণ, স্পোর্ট জার্নালিস্টরা চেষ্টা করে? তারা কি বিশ্বাস করে যে আমরা আর পাঁচজন লেখক-সাংবাদিকের সঙ্গে একই নৌকোয়? আমার তো মনে হয়, দু-তিনটে ব্যতিক্রম বাদ দিলে করে না।

গৌতম: আমি একটা কথা বলছি অশোকদা। মনে করা যাক মারাদোনার ছবি তোলা। পেলের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে পারা। বা ব্র্যাডম্যানের বাড়ি ঢুকে পড়া। এই কাজগুলো কোনও অংশে একটা অসাধারণ গোল, একটা ট্যাকল, একটা সেঞ্চুরি বা পাঁচ উইকেটের চেয়ে কম? আমার তো মনে হয়, একই রকম কঠিন। কিন্তু সেটা স্বীকৃতি হবে না কেন?

অশোক: ঠিকই। কঠিন। তবে হয় কী, সুধীন দত্ত একটা কথা বলেছিলেন, দু’ধরনের প্রতিভা হয়। একটা কারয়িত্রী প্রতিভা, আরেকটা ভাবয়িত্রী প্রতিভা। একটা প্রতিভা আছে কাজ করছে। আমি যদি না বুঝি, তা হলে আমার কাছে কোনও মানে নেই। যেমন, বড়ে গুলাম আলি। আমি যদি না বুঝি বড়ে গুলাম কে, তা হলে তো তাঁর প্রতিভার মাপটা ধরতেই পারব না। আলটিমেটলি ডিরেক্ট পারফরমেন্স তো সব সময় ওপরে থাকে।

তুমি যদি আমায় জিজ্ঞেস কর, প্যাট্রিক ইগার যদি ফটোগ্রাফিতে একশোয় একশো পেয়ে থাকেন, আমার সুমন চট্টোপাধ্যায় কেন একশোয় পঁচাত্তর পাবে না, আমার কাছে ক্লিয়ার নয়। নয় এবং সেজন্যই আমার কাছে না থাকেলেও ভালবাসি। সুমন বিদেশে যাওয়া মানেই আমি জানি ও যতই এজেন্সিটেজেন্সি হোক, দু-তিনটে এমন ছবি দেবে যা আর কেউ পারবে না। ওই যে মারাদোনা ক্যাম্বিস বলটা নিয়ে ড্রিবল করছে।

সুরজিৎ: গ্রেট ওয়ার্ক অফ আর্ট।

গৌতম: সুরজিৎদার কোরিয়ার গোলটার মতোই তো ব্যাপার। তা হলে সামাজিক স্বীকৃতি নেই কেন?

অশোক: ইয়েস, ইয়েস, ইয়েস। নিশ্চয়ই। সমাজ দেবে। কিন্তু তার আগে তোমার চলনে বলনে ব্যবহারে কোথাও তো একটা কনফিডেন্সের ছাপ থাকবে! আমরা নিজেরাই তো নিজেদের সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল নই, তো তা হলে অন্য লোক কী করে সম্মান করবে? পারফর্মারদের আমি নিশ্চয়ই প্রণাম করব। কিন্তু ভাই আমি যখন নিজের কাজ করব, তখন আমি কিন্তু কিছু কম নই। স্পোর্টস জার্নালিস্ট এবং পলিটিক্যাল জার্নালিস্টদের একটা অংশকে আমি দেখেছি চাকরের মতো আচরণ করতে। ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে। তবে কম। দ্যাখো বাবা, তুমি যদি নিজেকে বড় না ভাবো, কেউ তোমায় বড় করবে না।

আরে আমাকে তো বাধ্য হয়ে ‘আজকাল’ সংগঠনের সামনে রেখেছে। দ্যাটস অ্যা ডিফারেন্স স্টোরি। কোনও কাগজ স্পোর্সের লোকটাকে একদম সামনে রাখছে? রাখছে না তো। আমার এই অ্যাডভান্টেজটা ভুলে যেও না। আমি আমার কেরিয়ারের আগাগোড়া লিড করার সুযোগ পেয়েছি।

সুরজিৎ: স্পোর্টস এখন এত জনপ্রিয়। তা হলে বিভিন্ন কাগজে স্পোর্টসের লোকেদের সামনে নিয়ে আসছে না কেন?

অশোক: কারণ, কাগজ যাঁরা চালান, তাঁরা মূলত কেউ স্পোর্টস জার্নালিস্ট নন। স্পোর্টস সম্পর্কে তাঁদের আগ্রহটা খুবই কম। স্পোর্টস যে একেবারে আলাদা একটা জীবনদর্শনকে রিপ্রেজেন্ট করে, তাতে ওঁদের বিশ্বাস নেই। অদ্ভুত একটা মাইন্ড সেট কাজ করে যে, তুমি যখন কাগজ চালাচ্ছ, তুমি যখন পলিটিক্যাল কমেন্টেটার, তখন তুমি স্পোর্টসের লোক কী করে হতে পার? স্পোর্টসের লোক তো হাফ প্যান্ট পরে মাঠে ঘোরে!

গৌতম: একটু অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছি। আপনি যখন ক্রীড়া-সম্পাদক হিসেবে ময়দানে অবতীর্ণ হলেন, প্রতিবাদের একটা মশাল আপনার টিমের হাতে দেখা যেত। পরবর্তীকালে সেই প্রতিবাদী বৈশিষ্ট্যটা অনেক থিতিয়ে গেল। পরবর্তীকালে আমাদের মতো যারা ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় এসেছে, তাদের কারও কারও সম্পর্কে বলা হয়েছে, এরা আর প্রতিবাদী ঐতিহ্যটা বাঁচিয়ে রাখল না।

আপনি কি মনে করেন সমালোচনাটা ন্যায্য? নাকি আমাদের সঙ্গে একমত হবেন যে, ময়দানের প্রেক্ষিতটাই বদলে গিয়েছে? বৃহত্তর ইস্যু নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আন্দোলন করার জন্য আপনি সুরজিৎ সেনগুপ্তকে পেয়েছিলেন। এখন তেমন লোক কোথায়? সেখানে দোষটা কি সাংবাদিকের? না প্লেয়ারের?

অশোক: এটা বোধহয় সুরজিতেরও একটা প্রশ্ন ছিল। যাদের নিয়ে তুমি প্রতিবাদ করছ, সেটা আছে কিনা। এটা যে পাল্টে গেছে, তাতে সন্দেহ রাখার কোনও জায়গা নেই। প্রতিবাদের জায়গাটা পড়ত বেশি টিনএজাররা। একটু বয়স্করাও। যাদের সেই মনটা আছে। আমিও তো সেরকমই ছিলাম। তখনও আর এদিক-ওদিক তাকাইনি। তখন চলে গেছি।

তারপর আস্তে আস্তে যখন মানুষের বয়স বাড়ে, সে নিজের আশিটা ঠিক-এর সঙ্গে কুড়িটা ভুলও দেখতে পায়। আজকে আমি বলব, কেউ যদি সব ব্যাপারে প্রতিবাদ করে, সে ভুল করবে।

তবে আজকের দিনেও— প্রতিবাদের দাম আছে, গুরুত্ব আছে। শুধু সুরিজৎরা নেই বলেই অল আউট প্রতিবাদ সম্ভব নয়— তা আমি বলব না। আসলে যারা পড়ছে, সেই রিডারশিপের ধরনটাও অনেক বদলে গিয়েছে। এখনকার জার্নালিস্টরা প্রতিবাদ করার যোগ্য নয় আমি বলব না। আসলে সেই সময়টায় প্রতিবাদ করা গিয়েছিল, দ্যাট অলসো ক্লিকড। প্রতিবাদ করে তো কাজও হয়েছে। এই যে ১৯৮১-৮২ থেকে গড়াপেটা নিয়ে আমরা এত লিখলাম। তারপর নিয়ম তো পাল্টেছে। এখন যে-কেউ একটা বড় সিদ্ধান্ত নিক, তাকে ভাবতে হয় কী হবে কালকে? কাগজ কী লিখবে? কই আগে তো ভাবতে হত না।

আমি বলছি গৌতম, আজ থেকে কুড়ি-তিরিশ বছর আগে সাংবাদিকদের কীভাবে কর্মকর্তারা ট্রিট করত জানো? নিজের অফিসের কর্মচারীর মতন। একেবারে কর্মচারীর মতো। অফিসিয়ালরা সব সময় ওপরে। আজ চাকা ঘুরেছে সন্দেহ নেই। আজ সাংবাদিকরা সমানে সমানে তো বটেই, কোনও কোনও সময় স্পোর্টস অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের ওপরে থাকছে। মানে আমি এটা করছি, আপনি একটু দেখুন— এই আলোচনাটা কেন করছে? আজ সুব্রত দত্ত আলোচনা করছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে, ভৌমিকের ব্যাপারে আমি কী করব? ডালমিয়া আলোচনা করছেন, এটা করলে কেমন হয়? কেন করছেন— না দেখে নিচ্ছেন। সমালোচনাটা যাতে ততটা না হয়। এইটা ছিল না আগে।

ব্যাপারটা চেঞ্জ করে গিয়েছে। আর তা যদি চেঞ্জ করে থাকে, আমার রোলটাই বা চেঞ্জ হবে না কেন? একটু ধাক্কা দিলেই যদি এখন কাজ হয়, শুধু শুধু লাথি মারতে যাব কেন?

গৌতম : কিন্তু লাথির তখন প্রয়োজন ছিল। নইলে শুনতই না!

অশোক: এগজ্যাক্টলি। নইলে শুনতই না। এখন দরকার হয় না তো। একটা হাত তুললেই যদি কাজ হয়, সঙ্গে পা-টা তুলতে যাবে কেন?

সুরজিৎ: সব ক্ষেত্রেই কি হাত তুললে কাজ হয়?

অশোক: কোনও কোনও ক্ষেত্রে হবে না। তখন মারতে হবে। কিন্তু খুব রেয়ারলি সেটা করতে হবে। তখন রোজ দরকার হত। প্লাস, ভুলে যেও না, তখন নতুন খেলার পত্রিকা করছি, নতুন কাগজে ঢুকেছি— তখন আমার আইডেনটিটিই ছিল প্রাোটেস্ট। কিন্তু একটা সংগঠনের বয়স বাড়ে। ব্যক্তিরও বয়স বাড়ে।

আজ মনে হয়, যা-ই হয়ে থাক, কমছে তো। চুরি তো কমবে না, ডাকাতি তো শেষ হবে না, খুন তো বন্ধ হবে না, কিন্তু কমাতে তো হবে। পুলিসিং মানেই তো তাই। অপরাধ তুমি নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না, কমাতে পারবে। সেটা তো করেছি আমরা।

গৌতম: অতীতে আপনার লেখার একটা ধরন ছিল, বিভিন্ন ব্যক্তির মূল্যায়নের ব্যাপারে সোজাসুজি পছন্দ অথবা বর্জন। হয় সে প্রচণ্ড ভাল বা প্রচণ্ড খারাপ। মধ্যবর্তী কোনও স্টেশন নেই। লেখাগুলোও খুব জনপ্রিয়ও হত।

আজ এখন রাজনৈতিক বা অন্য লেখাতেও সব দিক দেখেশুনে ব্যালান্স করেন বা একই ব্যক্তির মধ্যে ‘ভাল’ আর ‘খারাপ’ খুঁজে পান, তখন অতীতের লেখাগুলোকে কি কিঞ্চিৎ একপেশে মনে হয়?

অশোক: এটা দু’ভাবে বলতে হবে। মনে কর একটা থার্ড ক্লাস কাজ করেছে সুরজিৎ সেনগুপ্ত। তখন কিন্তু সুরজিতের গুণ নিয়ে ভাবলে হবে না। ডান হাতে, বাঁ হাতে মারতে হবে। কিছু করার নেই।

ব্যালেন্সিংয়ের প্রবলেম হচ্ছে, মনে করা যাক, আমি ‘এ’ বা ‘বি’ বা জগমোহন ডালমিয়াকে অ্যাটাক করছি। এবার দশটার মধ্যে তাঁর দুটো গুণও আছে তো। এবার এই দুটো গুণ বলার জন্য তো তিনশো লোক আছে। আমি আর সেই তিনশো লোকের ভিড়ে যাই কেন? লেখার জন্য পার্সোনালি আমি সিনিয়র হিসেবে যেটা অ্যাডভাইস করব তা হল, এক-এক লেখার জন্য এক-এক রকম স্ট্র্যাটেজি রাখো। তার কোনওটা ব্যালেন্সড হতে পারে, কোনওটা হয়ত ব্যালেন্সড হল না, কোনওটায় হয়ত ঘুসি মারতে মারতে শেষ অবধি যাব। সেখানে কোনও কম্প্রোমাইজ নেই। সেখানে আমার একটাই কাজ। পরের দিন যেন শুয়ে পড়ে।

ভ্যারিয়েশনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, যেটা গৌতম তুমি একদম শুরুতে বলেছিলে। আমি সেদিন সুরজিৎকে আমার জ্যাঠামশাইয়ের গল্প বলছিলাম। উনি নাটকটাটক দেখতেন। বলতেন, আমি যে দুজনেরই ‘শাহজাহান’ দেখেছি। অহীন্দ্র চৌধুরি আর শিশির ভাদুড়ি। দুজনেই দারুণ। তফাত হল আমি দশ দশ দিন দেখেছি। অহীন্দ্র চৌধুরি যেভাবে জাহানারা ডাকেন— দশ দিন, ওই গোটাটাই একই রকম। শিশির ভাদুড়ির শাহজাহান এক-এক দিন এক-এক রকম। কোনওদিন কমিক। কোনওদিন ট্র্যাজিক। কোনওদিন নর্মাল। সেরকম লেখকেরও রেঞ্জ থাকা উচিত। সেদিক দিয়েই বলছি আমি বড় লেখকটেখক নই। তবে লেখকদের নিশ্চয়ই রিপ্রেজেন্ট করি। আমি মনে করি নানারকম যেতে হবে লেখককে। কোনও সময় মজা। কোনও সময় রাগ। আমাকে এক-এক সময় এক-এক রকম করতে হবে। কোনও কোনও সময় কি একপেশে হইনি? বহু ক্ষেত্রে হয়েছি। বহু ক্ষেত্রেই তো উকিলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। উল্টো দিকটা ভাবিনি। আজ সত্যি কথা বলতে কী, অসুবিধে হয়। তুমি যেটা বলছিলে, লিখতে গিয়ে ব্যালেন্সের কথা মনে হয়।

তুমি যেটা করেছিলে আর একটু করো যে স্টিভ ওয়া শুধু ক্রিকেটার নয়। এ লোকটা ভীষণভাবে আমাদের আপলিফট করতে পারে। এই জায়গাগুলো আরও তুলে ধরো তোমরা। এই যে লিয়েন্ডার আর মার্টিনা পার্টনার। বিশাল এজ-ডিফারেন্স। সেই অর্থে গোদা বাংলায় প্রেমের কোনও ব্যাপার নেই। থাকতে পারে না। কিন্তু কী র্যাপো। হারার পর ছবিটা দেখেছ? আরে জিতলে তো সবাই করে! হারার পর দেখেছ? চোখে জল আসবে। হারার পর দাঁড়িয়ে আছে শুধু দ্যাখো! আমার তো লিয়েন্ডার পেজ সম্পর্কে খুব গর্ব হয়। বলো না, এত লোক থাকতে মার্টিনা কেন লিয়েন্ডারকেই বাছল? দিদি, মাসি না মা— কী জানি না। যদি দিদিও হয়— কী কেমিস্ট্রি দেখেছ? এরকম একটা সম্পর্ক স্পোর্টস ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। কেউ পারে না। নোবডি। পৃথিবীর দুটো ভিন্ন দেশের লোক। একে অপরকে সেভাবে জানে না, চেনে না। কিন্তু কীভাবে মিশছে! প্রথমে ভাল লাগে, তারপর চোখে জল আসে। মনে রেখো, যে লোকটা দারুণ হাড্ডাহাড্ডি লড়ে জেতে সে কিন্তু কাঁদেও। জয়ীর আমরা হাসিই দেখি। কিন্তু তার আড়ালে কান্নাও থাকে। কী বলব। আবার সেই লোকটার কথা বলতে হয়। বারবার ওকে টানা ছাড়া উপায় নেই— স্টিভ ওয়া। স্টিভ ওয়া শুধু হাসে না কিন্তু। যখন বাড়ি ফিরে যায়, যে লোকটা লড়ে হেরেছে তাঁর জন্য কাঁদেও। জিম করবেট যতবার বাঘ মেরেছে, প্রতিবার তাঁর শিকারের জন্য একটু কেঁদেছে।

আমি তো অবসর নিয়ে যদি কোথাও চলে যাই, গিয়ে নির্জনে কাটাইও, খেলা ছাড়তে পারব না। সব খেলা আমি দেখি আর ভালবাসি। রাগবিটা শুধু নিতে পারছি না। আগে না-দেখা খেলা যত দেখি সে বউলিং হোক কী বিলিয়ার্ডস, দারুণ লাগে। এখন যেন আরও বেশি করে বুঝি যে, একটা ক্যারেক্টার খেলার মাধ্যমে যত উঠে আসে, সেটা আর কিছুতে আসে না।

সুরজিৎ: কিছু লোক ক্রীড়া-সাংবাদিকতা আর তাদের পেশাকে সামলে রাখছে। স্বীকার করে নিচ্ছে তাদের অবদান। কিন্তু সার্বিকভাবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা এখনও তৈরি হয়নি। এটাও কি কোনও কাজ নয় যে সামাজিকভাবে অবদানটা আরও উন্নত করা?

অশোক : দ্যাখো— ওই যে গৌতম বলল না, মারাদোনার যে অত ভাল ছবি তুলেছে সে-ও তো দারুণ পারফর্ম করছে। সেও তো ইকোয়েল কাজ করছে। ইকোয়েল করলেও হয় কী, মূল একটা তফাত থেকে যায়। এই ডিফারেন্সটুকু তোমায় মেনে নিতে হবে। তোমার পটলের দোরমা খেতে ভাল লাগে। এবার কেষ্ট সেটা করে দিল। তাতে কী হল? কেষ্ট রিটায়ারস উইথ দ্যাট দোরমা। কিছু করার নেই। সেই স্বীকৃতি কেষ্ট পাবে না। রিসেন্টলি একটা অনুষ্ঠানে বিমান বসু ছিলেন। সেখানে যেতে হয়েছিল, অজিত পাণ্ডের গানের ক্যাসেট বেরোবে বলে। বিমানদা প্রিসাইড করছিলেন, এবার বললেন মাননীয় মন্ত্রী অমুক। আমি বললাম, মন্ত্রীরাই শুধু মাননীয়? আর কেউ মাননীয় নয়? মন্ত্রী কেন মাননীয়, অন্যেরা কেন নয় আমি বুঝতে পারলাম না। আমি বিমানদাকে বলেছি, এর পর থেকে আমি থাকলে অন্তত মন্ত্রীদের মাননীয় বলবেন না। আর যদি বলেন, আমাকে বলবেন!

সুরজিৎ: তোমার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে। তা হল, সাতাত্তর সালে তুমি ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় এলে। এসেই চুরাশি সালে উটকো সাংবাদিকের ডায়েরিতে লিখে ফেললে, দশ বছরের বেশি ক্রীড়া-সাংবাদিকতা করবে না। করলে না। সাতাশিতে চলে গেলে বৃহত্তর ক্ষেত্রে। এই দশ বছরের হিসেব কোথা থেকে এল? কেন এল? আর যদি এসে থাকে, তাতে কি মনে হয় পরবর্তী প্রজন্মের ক্রীড়া-সাংবাদিকদের কনফিডেন্সে কোথাও ঘা লাগল?

অশোক : দশ বছর এজন্যই যে, আট-সাত-নয়-এগারো বলা যায় না তো। তাই দশ। বেসিক্যালি আমি জানি এর বেশি করা যাবে না। মানে এর বেশি ভাল লাগবে না। সেই হিসেবে ছিয়ানব্বইতে আমার সাংবাদিকতাই ছেড়ে দেওয়ার কথা।

সো আই টুক অ্যা ব্রেক। ‘নবজাগরণ’ সংগঠনের কাজ শুরু করে দিলাম। আসলে একটা স্পোর্টস জার্নালিস্ট যখন বড় হবে, যখন তার মন-চোখ সব খুলতে থাকবে, তখন সে কিছুতেই শুধু স্পোর্টসে পড়ে থাকতে চাইবে না। থাকতে পারে না। কোথাও একটা তাকে যেতে হবে। তবে একই সঙ্গে বলছি, স্পোর্টের মতো ব্যাপার হয় না।

যদি ইনসপিরেশন বলো, ইয়েস আই গেট ইনসপিরেশন। যখন স্টিভ ওয়াকে দেখি— একটা লোক যাচ্ছে তার ভালবাসা আছে! হৃদয় আছে! রাগ আছে! সৌরভ আর স্টিভ দু’ধরনের ক্যাপ্টেন। দুজনকেই ভাল লাগে। একজন এক্সপ্রেসিভ। আর-একজন নয়। এই যেটা স্পোর্টস দিতে পারে আর কী পারে বলো তো? জন ম্যাকেনরো আর বিয়র্ন বর্গ যখন ফাইনাল খেলছে, পৃথিবীর দু’ধরনের মানুষকে রিপ্রেজেন্ট করছে। একটা এক্সট্রোভার্ট, আরেকটা ইন্ট্রোভার্ট। যে-কোনও খেলা দেখতে গেলেই সাধারণত একটা সাপোর্ট করার ইচ্ছে হয়, এটা এমন একটা ম্যাচ যে বুঝেই পাচ্ছি না কাকে সাপোর্ট করব। এক-একবার মনে হচ্ছে, যা হয় হোক। পৃথিবীর কোনও রাজনীতে এটা করবে না। কোনও কিছু পারবে না। অথচ স্পোর্টসটা যে এত বড় জিনিস তা কি সাংবাদিকরা নিজেরা বোঝে? তারা কি বিশ্বাস করে? আই থিঙ্ক, নো। একশো জনের ভেতরে সত্তর জন স্পোর্টস জার্নালিস্ট বিগলিত হয়ে যাবে যদি তাদের বলা হয় কাল থেকে তুমি পলিটিক্যাল জার্নালিজম করবে। কেন? হোয়াই? আমার তো মনে হয় স্টিভ ওয়ার সঙ্গে গৌতমের আলাপ ততটাই সৌভাগ্যের, যতটা আব্রাহাম লিঙ্কনের সঙ্গে এখানকার কোনও সাংবাদিকের আলাপ থাকলে বলা যেত। ব্র্যাডম্যানকে গৌতম আর দেবাশিস একবার মিট করেছে। সেটায় যতটা আনন্দ, আমার লিঙ্কনকে মিট করা থাকলে ততটুকুই আনন্দের হত।

গৌতম: ক্রিকেট বলুন, ফুটবল বলুন, আই টি বলুন, বিজ্ঞান বলুন— সবেতেই লেভেলটা উঠেছে। আরও উন্নত হয়েছে। বাংলা ক্রীড়া-সাংবাদিকতার যে মডেলটা আশির দশকের গোড়ায় আপনি তৈরি করেছিলেন সেই লেভেলটাও কি আরও উন্নত হয়েছে?

অশোক: এক্সটেনশন হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সেরিব্রাল সাইডটা আরও বেশি করে আসেনি।

গৌতম: তেমন কী থাকতে পারত সেই সাইডটার?

অশোক: সেরিব্রাল সাইড আসা উচিত ছিল আরও। আমি খালি দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছি কেন? খালি দৌড়োলে তো একসময় হাঁপিয়ে মরে যাব। একটু থামো— ভাবো। কোনটা খবর, কোনটা খবর নয়, সেটা ভাবো। তা নয়, খালি কে কী বলল। যে-ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর হচ্ছে আমার সরোজ চক্রবর্তী। একটা জায়গায় তো নিয়ে যেতে হবে। কেন আমি নিয়ে যাব না!

সরোজ, অরুণ সেনগুপ্ত এরকম কয়েকজন আছে যাদের আমি মনে করি টিমের মধ্যে নিজের কাজটা করার জন্য এদের স্যালুট করা উচিত। বাজার থেকে এত এত মাল নিয়ে এসেছে যে রাঁধুনির রান্না করতে কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু এরপর আরও ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করেনি কেন?

গৌতম: কেন করবে? একটা ভাল ট্যাকলারকে একইসঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে ভাল ড্রিবলার হতে হবে কেন? কাম্পাইয়া ভাল ড্রিবল করতেন না কেউ তো বলেনি।

অশোক: প্রশ্ন থাকছে। নানা প্রশ্ন থাকছে। প্রথমত ওরা এই বলল তো বুঝলাম। তুই কী বললি? তা ছাড়া শুধু নিজের কথা ভাবলে হবে না তো। স্পোর্টসকে উন্নত করে একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে হবে। তুমি গৌতম এই যে মাঝে মাঝে লেখ, খেলার বাণিজ্যিকীকরণ, খেলাটা এখন আর খেলা নেই— মনে হয় বাড়াবাড়ি করো। কিন্তু আবার যখন তুমি সিডনির শেষ তিন দিনের স্টিভ ওয়া লিখলে, ওই লেখাগুলোই স্পোর্টস জার্নালিজমকে এগিয়ে দেয়। দশটা খবর এগিয়ে দেয় না।

সুরজিৎ : যে কথাটা গৌতম বলল, আমি কিন্তু একমত। ভাল টিমে ট্যাকলারের প্রয়োজন আছে।

অশোক : বিরাট, বিরাট প্রয়োজন আছে।

সুরজিৎ : কিন্তু পুজোটা ড্রিবলাররাই পেয়ে থাকে।

অশোক : ঠিকই। আমি পুজো পেলাম কেন? আমি কবে ট্যাকল করলাম?

সুরজিৎ : আমি তোমার একটা লেখার কথা আমৃত্যু ভুলতে পারব না। ক্রীড়া-সাংবাদিকতা তো বটেই, ভারতবর্ষের ক্রীড়া-সাহিত্যেও অতুলনীয়। এক অখ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানের ডায়েরি। একটা বিশ্বকাপ জেতা হয়ে গেল, সারা দেশ নাচছে-গাইছে। কত খবর। কত ঘটনা। কত কিছু। সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়ে তুমি ওই একটা মাঠের মধ্যে শুয়ে থাকা লোককে নিয়ে লিখলে যা একটা বিস্ময় হয়ে থাকল। মতিদা এখনও আছেন, তবু সেভাবে নেই। কিংবদন্তি ক্রীড়া-সাংবাদিকদের মধ্যে একমাত্র তোমাকেই পাচ্ছি। এই যে তোমায় ব্যস্ততার মধ্যেও বারবার লিখতে বলা তার কারণ হচ্ছে একজন হিরোকে সামনে রেখে স্পোর্টস জার্নালিজম কোথায় যেতে পারে, সে সম্পর্কে একটা ভাবনা অন্তত যাতে তৈরি করা যায়।

অশোক : শোনো সুরজিৎ, কিংবদন্তি শব্দটা একেবারে ঢপের কথা। মানুষ মারাটারা গেলে বলা হয়। জীবিত মানুষ সম্পর্কে বলছি তার কারণ যথেষ্ট শিক্ষিত নই, হাতের কাছে এর চেয়ে ভাল শব্দ আর পাচ্ছি না বলে। কিংবদন্তি শব্দটা কথার কথা নয়। সুবোধ ঘোষের একটা বই আছে ‘কিংবদন্তীর দেশে’। ওটা পড়লে বুঝবে জীবিত বা মৃত কোনও মানুষের পক্ষেই প্রায় কিংবদন্তি হওয়া সম্ভব নয়। ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যান, ফুটবলে ডি স্টেফানো— এক-আধবার হতে পারে।

আর যে লেখাটার কথা তুমি বলছ। খেলার দিন রাতে ধরেই নিয়েছিলাম হারবে। ‘আজকাল’ অফিসে গিয়ে একটা লিখলাম যেটা রিপোর্টিং ছিল। ‘অখ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানের ডায়েরি’ তখনও হয়নি। ওই ইমিডিয়েট এফেক্ট-এ হতেও পারে না। ওটা আফটার এফেক্ট। কেন লেখাটা? ইট কেম টু মি, ওইরকম একটা ক্রিকেটপ্রেমী দেশ হেরে গেল। আমার তো মনে হয় পৃথিবীর পক্ষে, ক্রিকেট খেলাটার পক্ষে ঘটনাটা খুব খারাপ হয়েছিল। ওদের ম্যাচটা এইভাবে ছুঁড়ে দেওয়া। টানা তিনবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপ জিতলে, মনে হয় না ওদের দেশের এত বেশি উঠতি অ্যাথলিট বাস্কেটবলে চলে যেত! প্রথম দিন তো ইন্ডিয়ার জয়। তারপর দু-তিনদিন পরে কেমন একটা অন্য চিন্তা, অন্যরকম অনুভূতি হল যে কী হতে পারে দেশটার ওপর এফেক্ট! মনে হল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটল। অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য দল জিতে গেল। কষ্টটা এল একেবারে ওই জায়গা থেকে। এই লেখাগুলো বোধহয় একটা বিশ্বাস থেকে আসে যে, নাথিং ইজ গ্রেটার দ্যান দ্য গেম।

সুরজিৎ : শুধু খেলার লেখা নিয়েই কথা হচ্ছে। এ ছাড়া এখন হিং টিং ছট-এ বাবুরাম সাপুড়ে আরও অন্যান্য বিষয় নিয়ে এসেছে। বৃহত্তর বৃত্তে গিয়ে তোমার নেপথ্য ভাষণ জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছে। বেশ কিছুদিন যাবৎ তোমার কলম থেকে আমরা গোয়েন্দা সিদ্ধার্থ সেনও পেয়েছি। পাচ্ছি। এগুলোর মধ্যে কোনটা লিখে বেশি আনন্দ পাও? পাঠক হিসেবেই বা কোনটা পড়তে বেশি পছন্দ করবে?

অশোক : অবশ্যই সিদ্ধার্থ সেন। তার কারণ, এই লেখায় একই সঙ্গে সিরিয়াসনেস, মজা, ভ্রমণ, বুদ্ধি, নলেজ— সব মিলেমিশে আছে। রহস্য বা তার সমাধান নিয়ে লেখা হয়ত খুব সহজ নয়। কিন্তু নিজের বুদ্ধির ভাঁড়ার থেকে ক্রমাগত হাতড়ে হাতড়ে জিনিসপত্র উদ্ধার করে সেগুলো সাজাতে ভাল লাগে। আমার কিশোরদের জন্য লেখা ভাল কিছুই পড়তে দারুণ ভাল লাগে। ‘হ্যারি পটার’ অবসর পেলেই পড়তে থাকি। ইচ্ছে আছে, যদি কখনও সুযোগ পাই, হ্যারি পটার নিয়ে কাজ করব।

সুরজিৎ : আর একটা কৌতূহল মেটাও। আমি জানি, তবু সকলকে জানাতে ইচ্ছে করছে। নানা বিষয়ে যে-সব আক্রমণাত্মক লেখা তোমার কলম থেকে বেরোয়, সে-সব আক্রমণ অতি মারাত্মক হলেও আক্রমণের লক্ষ্য যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে তোমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভাল থাকে কী করে?

অশোক : কারণ খুব সহজ। আক্রমণ কোনও ব্যক্তিকে তো আমার কলম করে না। আক্রমণ করে সেই ব্যক্তির কাজকে। প্রশংসা করলেও সেই ব্যক্তিকে নয়, তাঁর কাজকে, তাঁর মনুষ্যত্বকে। ‘পার্সোনাল গ্রাজ’ থেকে কারও বিরুদ্ধে কোনও কথাই কখনও বলিনি। মমতার (ব্যানার্জি) সঙ্গে দেখা হলে বলে ‘অশোকদা’ শুধু আমার দোষই দেখেন! আমি ওঁর নাক মুচড়ে দিই। মমতার মতের বিরুদ্ধে, কাজের বিরুদ্ধে লিখি, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে খুবই ভাল সম্পর্ক। জগমোহন ডালমিয়া মেয়ের বিয়েতে নেমন্তন্ন করার সময় বলেছিলেন, ‘অশোকবাবু আসবেন তো?’ আমি বলেছিলাম, আপনার কাজের শতকরা নব্বই ভাগের আমি বিরোধী, সে কথা লিখি, লিখবও। কিন্তু আপনার মেয়েকে আশীর্বাদ এবং আপনার জন্য শুভেচ্ছা থাকবে যে, জীবনের এই জায়গায় যেন আপনি সর্বদাই সুখী থাকেন।

সুরজিৎ : তোমার কাছে আরও অনেক প্রশ্ন আছে— আমার খেলার পাঠকদেরও। একই সাক্ষাৎকারে সব কথা বলে দিতে পারব না। তুমি সম্পাদক হিসেবে অতটা জায়গাই আমাদের দেবে না। কিন্তু একটা অনুমতি কি পাব?

অশোক : কী?

সুরজিৎ : তোমার ছবি ছাপার অনুমতি?

অশোক : না।

সুরজিৎ : তোমার কাগজে কখনই তোমার কোনও ছবি ছাপতে অনুমতি দাও না, জানি। কেন?

অশোক : নীতিগতভাবে আমার মনে হয়, কোনও কাগজেই সম্পাদকের কোনও ছবি ছাপা উচিত নয়। এই বিশ্বাস আছে বলে নিজের কাগজে সেটা প্রয়োগ করতে পারি। আমার পাঠকরা বুঝতে পারেন, খেলার পাঠক তো জানেন-ই— আমার লেখাই আমার ছবি, আমার আসল রূপ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *