খেলা শারদীয় সংখ্যা ১৯৮৬
বয়স যখন বছর পাঁচেক, আমার মা মারা যান। তার আগে থেকেই, সেই থেকে তো আরও বেশি, এক নম্বর বন্ধু ছিলেন বাবা। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ সময়েই তিনি থাকতেন প্রবাসে। মাঝে মাঝে যখন ফিরতেন, আমার দুনিয়া ভরে যেত নানা রঙে। চলে যাওয়ার পরই প্রতীক্ষা শুরু; বাবা, তুমি কবে আসবে? ডাক-ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনও ধারণাই হয়নি, চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন সালের শিশুরা এইরকমই ছিল। রোজ সকালে বাবাকে একটা চিঠি লিখতাম, খাতার পাতা ছিঁড়ে। এ জন্য বড়দার গাঁট্টাও ছিল নিয়মিত। খাতা ছেঁড়া এবং চিঠি লেখা বন্ধ হয়নি তবু। গভীর গোপন সে-সব চিঠিতে আকুল প্রার্থনা থাকত বারবার— বাবা, তুমি এস। তাড়াতাড়ি। লুকিয়ে, যেন গোপন প্রিয়জনকে লিখছি, সেই চিঠি গুঁজে রেখে আসতাম বাড়ির কাছের মাঠের কোনও গর্তে, নালার ধারে, আশপাশের পোড়ো কোনও বাড়ির দেওয়ালের ফোকরে। বিশ্বাস ছিল, চিঠি পৌঁছোবেই বাবার কাছে। বাবা এসেও যেতেন একদিন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেনও, ‘তোর সব চিঠি আমি পেয়েছি।’
বয়স বাড়লে মানুষ নিশ্চয় পাল্টায়। তবু সবটুকু কি আর পাল্টায়? তাই, সাড়ে তিন ঘাটের জল খেয়ে আটাশ বছর বয়সে ক্রীড়া-সাংবাদিকতা শুরু করার সময়েও একই হাস্যকর আশা কাজ করল। পাঠক-পাঠিকাদের হৃদয়ে আমি পৌঁছোবই, এই দুরাশা নিয়ে লেখার পর লেখা গুঁজে দেওয়া শুরু হল। বাবার মতোই অশেষ প্রশ্রয়ে কেউ কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে জানালেনও যে, আপনি আমাদের হৃদয়ে পৌঁছেছেন। কিন্তু পৌঁছানো আর হল কোথায়? শুধু আকুল চেষ্টাটুকুই সত্যি। আমার দিক থেকে গর্ব যদি কিছু থাকে, তা হল এই চেষ্টার। আকুলতার। খেলা-অনুরাগী প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা, আপনাদের প্রশ্রয় এই অযোগ্য লেখক আর চায় না। প্রশ্রয় মানুষকে ভুল দিকে ঠেলে দেয়। যে যা নয়, তাকে তাই ভাবতে শেখায়। প্রশ্রয়ের জন্য ধন্যবাদ। এতদিন ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় এই উটকোকে সহ্য করার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এই সত্যকে আর এড়িয়ে যেতে চাই না যে, যেখানে পৌঁছানোর ছিল, যতটুকু পৌঁছানোর ছিল, হয়নি, পারা যায়নি। এই ডায়েরির শেষ পর্বেও সুতরাং তেমন কোনও উচ্চাশা নেই। শুধু যা মনে হয়, তা বলব। লিখব।
মেক্সিকো থেকে ফিরে বি এন আর টেন্টে এফ ডব্লু এ-র সভায় ঢুকেই সুভাষ ভৌমিক প্রশ্ন তুলল: অরিত্র নন্দীকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হল কেন? অরিত্র একে ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার, তার ওপর নাকি যথেষ্টই অবস্থাপন্ন, তবে কেন ইংল্যান্ড যাওয়ার খরচ তুলতে এফ ডব্লু এ ওকে টাকা দিল? ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যেতে অরিত্রর দরকার ছিল তিরিশ হাজার টাকা। হাতে সময় ছিল না। বলরামদা অরিত্রর কথা বলেছিলেন সুরজিৎকে। সুরজিৎ আমাকে টেলিফোন করে। ট্রেজারার শান্ত মিত্রর সঙ্গে কথা বলে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং অরিত্রর হাতে পাঁচ হাজার টাকার চেক তুলে দেয় সুরজিৎ। বলতে গেলে ফাঁকা চায়ের কাপে তুফান তুলল সুভাষ ভৌমিক: ‘মিটিং না করে অরিত্র নন্দীকে টাকা দেওয়া হল কেন?’ কারণ: এক, বেশি নিয়ম দেখালে এফ ডব্লু এ-র মতো সংগঠন চলত না, চলে না। দুই, আমাকে টেলিফোন করাটা বাহুল্য মাত্র, যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে সুরজিৎ ট্রেজারার শান্ত মিত্রর সঙ্গে কথা বলেই এমন জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এবং তিন, এফ ডব্লু এ-র কাজ ইদানীং সুরজিতের ঘাড়ে এতটাই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ও যদি কোনও ব্যাপারে একাই সিদ্ধান্ত নেয়, আপত্তি তোলার নৈতিক অধিকার কারও নেই, সুভাষ ভৌমিকের নেই, আমার নেই, শৈলেন মান্নারও নেই। বি এন আর টেন্টে ওই সভায় আমি ছিলাম না। এফ ডব্লু এ-র দু বছরের ইতিহাসে এই প্রথম। এইরকমই চলবে। নতুন কাজটা এমনই বিচ্ছিরি দাঁড়িয়েছে এখন। ভৌমিক ওই প্রশ্নটা খুব জোরের সঙ্গে বারবার তুলতেই সুরজিৎ বলে ফেলল: ‘আমি কোনও ভুল করিনি। হ্যাঁ, এফ ডব্লু এ-র ব্যাপারে অশোক দাশগুপ্ত, শান্ত মিত্র, সুরজিৎ সেনগুপ্ত যে ডিসিশন নেবে, তা-ই হবে।’ আসলে সুরজিৎ দুটো কথা বলতে চেয়েছিল। এক, ট্রেজারার এবং অশোক দাশগুপ্তর সঙ্গে কথা বলে এরকম ছোটখাট ডিসিশন একজন অ্যাক্টিভ জয়েন্ট সেক্রেটারি নিতেই পারে। এবং দুই, এফ ডব্লু এ-র কাজ তোমরা কে কতটা করছ? ভৌমিক সুরজিতের কথা শুনেই উত্তেজিত হয়ে বলে: হু ইজ সুরজিৎ সেনগুপ্ত? হু ইজ শান্ত মিত্র? হু ইজ অশোক দাশগুপ্ত? একটা অর্গানাইজেশনের ডিসিশন কেন মিটিং করে নেওয়া হবে না? এর পর ভৌমিক তীর বেগে বি এন আর টেন্টের গেটের দিকে হাঁটা লাগায়। ওই গেট দিয়ে ঢুকছিলেন এমনিতে ভাল কিন্তু সেদিনের জন্য একটু হাস্যকররকম সত্যানুসন্ধানী এক সাংবাদিক, যাঁকে এফ ডব্লু এ-র একটি সাব কমিটিতে রাখা হয়েছে। উত্তেজিত ভৌমিক তখনও গজগজ করছিল, তা থেকে একটি গরম বেগুনি বা খবর তুলে নিয়ে পরদিন তাঁদের কাগজে একটা নিউজ আইটেমও ছেপে দেন: ‘যুগ্ম সম্পাদক সুভাষ ভৌমিক ক্ষুব্ধ’। অবশ্য, কিছু কাগজ এফ ডব্লু এ-কে তুলে দেওয়ার জন্য এমন খবর যতই ছাপুক না কেন, এটা তো ঘটনাই যে ভৌমিক সেদিন ক্ষুব্ধ ছিল। সেই ক্ষোভের এবং সভার খবর দুই সহকর্মী ওই রাতেই যখন আমাকে বলতে আসে, বিশেষ শুনতে চাইনি। ওই যে বিচ্ছিরি চাকরিটার কথা বলছিলাম না? শোনার সময় ছিল না। তার পর দিন তিনেক ধরে দু-তিন মিনিটের ইনস্টলমেন্টে ব্যাপারটা শুনলাম। মন খারাপ? না, বিশেষ নয়। সময় ছিল না মন খারাপ করার। কয়েক দিন পরেই এফ ডব্লু এ-র ট্রেনিং ক্যাম্পের উদ্বোধন হল রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে। শুধু কাজের চাপে নয়, হঠাৎই খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেখানেও যাওয়া হল না। অনেক রাতে শুনলাম, সুভাষ নাকি আমাকে বারবার খুঁজেছে এবং শেষ পর্যন্ত শান্ত মিত্রর হাতে তুলে দিয়েছে রেজিগনেশন লেটার। এবার একটু খারাপ লাগল। খারাপ লাগার সময় হল। ভাবলাম, সুভাষকে একটা চিঠি দেব। নতুন কমিটি তৈরির সময় তো এসেই গেছে। এখন রিজাইন করে কী হবে? কত শকুন তো বসেই আছে, এই নিয়ে এফ ডব্লু এ-র বদনাম করতে করতে খানিক চানাচুর খাবে, দু’লাইন লিখে ভাববে এফ ডব্লু এ বোধহয় এরপর উঠেই যাবে। এক, দুই, তিন,… সাত দিন কেটে গেল। চিঠি আর লেখা হল না। ওই বিচ্ছিরি চাকরি আর সময়ের গল্প! অষ্টম দিনে প্রতিজ্ঞা করে বসলাম, চিঠিটা লিখবই। শুরু করলাম: প্রিয় সু…। তখনই হঠাৎ মনে হল, চিঠিটা কেন লিখছি? সুভাষ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু ও তো অযৌক্তিক কথা বলেছে। আমার সঙ্গে একটাও কথা না বলে রেজিগনেশন লেটার দিয়েছে। শুধুমাত্র কিছু ঈর্ষাজর্জর শকুনের কথা ভেবে সুরজিতের নির্ভুল সিদ্ধান্তের পক্ষে শতকরা একশো ভাগ দাঁড়াতে দ্বিধা করব কেন? চিঠিটা লিখলাম না।
কয়েক দিন বাদে মোহনবাগান মাঠে সেই বিখ্যাত গন্ডগোল। গ্যালারি থেকে কিছু লোকের জঘন্য গালিগালাজে ক্রুদ্ধ সুভাষ ভৌমিক…। তিয়াত্তরের শিল্ড ফাইনালে পিয়ং ইয়ং-এর বিরুদ্ধে গোল এবং ছিয়াশিতে মোহনবাগান গ্যালারিতে কিছু নোংরা জিভওয়ালা লোককে মারধর— এই দুটিই আমার মতে সুভাষ ভৌমিকের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় কাজ। বুকের পাটা আছে ভৌমিকের। এরকম পরিস্থিতিতে আরও অনেকেই পড়েছেন। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল জনতার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর মানসিকতা ক’জনের থাকে? তবু, নিজের হাতে আইন তুলে নিলে, বাধ্য হয়ে নিতে হলেও, কিছু দাম দিতে হয়, কিছু ঝামেলায় পড়তে হয়। পরদিনই এফ ডব্লু এ-র যুগ্মসচিব সুরজিৎ সেনগুপ্ত আর-এক যুগ্মসচিব সুভাষ ভৌমিকের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একসঙ্গে লালবাজারে পুলিস কর্তাদের সঙ্গে কথা বলল। সুরজিৎ দ্বিধাহীন গলায় জানাল, ওই পরিস্থিতিতে সুভাষ ভৌমিক যা করেছে, তার চেয়ে ভাল কাজ আর হয় না। এটাকেই আমরা বলি ‘এফ ডব্লু এ স্পিরিট’। হাজার খুচরো ঘটনা আমাদের গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলে যায়, মনোমালিন্য ধুয়েমুছে কোথায় উধাও হয়, বিশেষ পরিস্থিতিতে আমরা এক হয়ে দাঁড়াই। আমরা, যারা ময়দানের দুর্নীতি আর গন্ডগোলের বিরুদ্ধে লড়ে যাই। আমরা, যারা এফ ডব্লু এ নামে সংগঠনটি তৈরি করেছি। এই স্পিরিট যতদিন আছে, সুভাষ ভৌমিক বা অন্য কারও রেজিগনেশন লেটার জমা পড়লেও চাপা পড়বে। ময়দানের শয়তানেরা খারাপ কিছু করার আগে অন্তত দেড়বার ভাববে। এটা ঘটনা যে, তারপর এফ ডব্লু এ ট্রেনিং ক্যাম্প ছাড়া বড় কোনও কাজে হাত দিতে পারেনি। একটা বড় কারণ, এই উটকো সাংবাদিকের নিজের পেশার জালে দ্বিগুণ জড়িয়ে যাওয়া। সুরজিৎকে অনেক বেশি সাহায্য করতে পারত যে ছেলেটি, সেই পল্লব বসু মল্লিকেরও জড়িয়ে পড়তে হল চিকিৎসকের পেশায়। আপাতত আমাদের ভাবনা, সুরজিৎকে সাহায্য করার মতো একটা টিম কীভাবে তৈরি করে দেওয়া যায়। কানাইয়ান দুর্দশায় না পড়লে, সেই করুণ কাহিনী পল্লব তুলে না আনলে, সেই কাহিনীতে শৈলেন মান্না, তুলসীদাস বলরাম, পি কে ব্যানার্জি, অরুণ ঘোষরা আলোড়িত না হলে এফ ডব্লু এ-র জন্ম হত না। এই বাক্যটির মধ্যে আমি মাত্র একটি নামই ব্যবহার করব; সুরজিৎ সেনগুপ্ত না থাকলে এফ ডব্লু এ এভাবে বেঁচেই থাকত না। আমরা অনেকেই অনেক কিছু করেছি, কিন্তু মূল বোঝাটা সুরজিতের মাথায় রেখেই।
‘এফ ডব্লু এ স্পিরিট’! খানিক আগে কথাগুলো লেখার সময় আমার হাত কিন্তু একটু কেঁপেও ছিল। কারণ, ঘটনা যেমন এই যে, আমরা কয়েকজন এই ‘স্পিরিট’কে মাথায় রাখি, অনুভব করি, ঘটনা তো এটাও যে, মূলত যাদের জন্য এবং যাদের নিয়ে এই সংগঠন, তাদের মধ্যে অধিকাংশ এখনও শোচনীয়ভাবে এই হাওয়ার বাইরে। এফ ডব্লু এ-র জন্য সত্যিই গর্বিত, এফ ডব্লু এ-র জন্য সত্যিই ভাবে বা ভাবেন, এমন ফুটবলারের সংখ্যা দু’হাতের আঙুলেই গুনে ফেলা সম্ভব। ইস্টবেঙ্গলের এক ফুটবলার জানতে চেয়েছিল আমাদের সরোজ চক্রবর্তীর কাছে: ‘এফ ডব্লু এ-র মেম্বার কি হতেই হবে?’ মোহনবাগানের এক বড় ফুটবলার কলকাতায় এফ ডব্লু এ-র ম্যাচের দিনই এক মফসসল শহরে ভাড়া খেলার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল (পারেনি)। মহমেডানের এক ফুটবলার আমাদের এক কর্মীকে বলেছিল, ‘আমি এফ ডব্লু এ-র মেম্বার, কিন্তু সঞ্জীব ইস্যুতে ক্লাব অফিসিয়ালদের সঙ্গে আমাকে থাকতেই হবে।’ তিনটি ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ফুটবলার দুঃখ প্রকাশ করেছে বটে, কিন্তু এই দুঃখ প্রকাশের চেয়ে ঢের বেশি আন্তরিক ছিল তাদের প্রাথমিক আপত্তিকর আচরণ বা কথাবার্তা!
সঞ্জীবের হয়ে মহমেডান স্পোর্টিংয়ের কাছে দাবিপত্রে এক প্রবীণ কোচ সই দিতেই চাইছিলেন না, যদি কর্মকর্তারা চটে যান। ইনি এফ ডব্লু এ-র এক সহ-সভাপতি। অন্য এক সহ-সভাপতি সভায় আসার সময় না পেলেও পদে থাকতে চান সরাসরি, এবং একই সঙ্গে এই রটনায় প্রচ্ছন্নভাবে অংশ নেন যে, এফ ডব্লু এ ঠিকভাবে চলছে না। এক সহ-সভাপতি শুধুমাত্র এ জন্যই এফ ডব্লু এ-র সভায় আসতেন না যে, তাতে তাঁর মোটরবাইকে দু’লিটার পেট্রল খরচ হবে। কিছু ফুটবলারের কথাবার্তা শুনে আমাদের মাঠের রিপোর্টাররা বলল, ‘অশোকদা, মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা যেন শুধু ‘আজকাল’ আর ‘খেলা’র। অনেকে যেন শুধু তুমি অনুরোধ করছ বলেই এফ ডব্লু এ ম্যাচ খেলছে বা এফ ডব্লু এ-র ব্যাপারে থাকছে। এটা যেন তোমার কাজ।’ সুরজিতেরও একই অভিজ্ঞতা। ‘ও, সুরোদা বলছ ঠিক আছে। বিশুদা বলছ, তবে খেলছি।’ এইরকম আর কী। ফুটবলারদের সংগঠন গড়ার কাজে নিজেদের যৎসামান্য নিয়োজিত করার সময় এই দুরাশায় থাকিনি যে, কলকাতার ফুটবলাররা রাতারাতি সব সঙ্কীর্ণতার ওপরে চলে যাবে। আমরা নিজেরাই কি সব সময় পারি সঙ্কীর্ণতার ওপরে উঠতে? তবু এটুকু আশা ছিল, একটা সঙ্ঘবদ্ধতা আসবে, সংগঠনকে নিয়ে গর্বিত হওয়ার মানসিকতা আসবে। বড় কোনও ঘটনা ঘটলে ফুটবলারদের একজোট করা হয়ত কিছুটা সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু স্বাভাবিক সঙ্ঘবদ্ধতা কোথায়? কোথায় সেই বস্তুটি, যাকে আমরা বলছি ‘এফ ডব্লু এ স্পিরিট’?
ময়দানের ধান্দাবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফুটবলারদের লড়াইটা আমরা শুরু করেছিলাম আট বছর আগে। এই আট বছরে নানা মুখে এ-সব প্রশ্ন তো আমরা শুনেছিই: মশাই, ফুটবলারদের কি কোনও দোষ নেই? আচ্ছা, শুধু কর্মকর্তারাই শয়তান, আর ফুটবলাররা সব ধোয়া তুলসীপাতা? ফুটবলাররা রেফারিদের ঘুষি মারলে আপনারা চুপ, এক ক্লাবের কাছ থেকে অ্যাডভান্স নেওয়ার পর বেশি টাকা পেয়ে অন্য ক্লাবে সই করলেও আপনাদের কলম বোবা, তা, আপনারা কি ফুটবলারদের উকিল? —হ্যাঁ, এ কথা সত্যি যে গত কয়েক বছরে আমরা ফুটবলারদের উকিলের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কিন্তু একই সঙ্গে দুটো কথা বলা দরকার। এক, ময়দানে বহুকাল ধরে ফুটবলারদের বিরুদ্ধে এত অন্যায় অবিচার হয়েছে যে তাদের হয়ে একতরফা লড়াই চালু করাটাই জরুরি ছিল। দুই, এই ওকালতির জন্য আমরা কোনও পারিশ্রমিক নিইনি! বরং অনেক ঝুঁকি মাথা পেতে নিয়েছি। দু’দিক দিয়ে আমরা সফল। প্রথমত, ফুটবলারদের বিরুদ্ধে অন্যায় অবিচারের ছুরি শানানোর আগে, কর্মকর্তাদের এখন দ্বিধায় থাকতে হয়। দ্বিতীয়ত, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমরা সচেতন ক্রীড়ামোদীদের সমর্থন পেয়েছি। জনপ্রিয় হয়েছে আজকালের খেলার পাতা, ‘খেলা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত এক নম্বর খেলার পত্রিকার আসনে।
জানি, সব ফুটবলার ধোয়া তুলসীপাতা নয়। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ফুটবলারদের আচরণের সমালোচনাও করেছি আমরা। তবু মূলত আমরা আগের জায়গাতেই থেকে গেছি। ধুরন্ধর কর্মকর্তারা এখনও এত দুর্বল হননি যে আমাদের তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ হয়ে যেতে হবে। দুঃখিত, অপ্রিয় কর্মকর্তাবৃন্দ!
আমি একটি বালককে চিনি, যে এমনিতে সব রকম কুসংস্কারের বাইরে থাকতে চায়। সামান্য দু-একটি কুসংস্কার সে ছাড়তে পারেনি। তার মধ্যে একটি হল, টেস্টে যখন গাভাসকার ব্যাট করবেন, তখন সে মাঠেই থাকুক, বা রেডিও শুনুক, বা টিভি দেখুক, একটি বলও মিস করবে না। মিস করলে, ওই সময়টাতেই গাভাসকার নাকি আউট হয়ে যেতে পারেন! (এক গাভাসকার-পাগলকে চিনি যার বদ্ধমূল ধারণা, সেঞ্চুরি করার জন্য গাভাসকারকে একবার ছাব্বিশের স্টেশন ছুঁয়ে যেতেই হবে। সানি পঁচিশে এলেই সে প্রার্থনা করতে থাকে, যেন সিঙ্গল হয় এর পর, বাউন্ডারি নয়, অন্য কিছু নয়!) তিরাশিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে কানপুর টেস্টে দু’ইনিংসেই গাভাসকার ব্যর্থ হওয়ায় বালক নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করে। দু’ইনিংসেই গাভাসকারের ব্যাটিং শুরু করা এবং সঙ্গে সঙ্গে আউট হয়ে যাওয়ার সময় সে রেডিও বা টেলিভিশনের কাছে ছিল না। সুতরাং, যখন দিল্লি টেস্টের প্রথম দিন গাভাসকার ব্যাট করতে নামলেন, বালকের দৃঢ় সিদ্ধান্ত, গাভাসকারের ব্যাটিংয়ের একটি বলও মিস করবে না। বাথরুম নয়। পাশের ঘরে গিয়ে টেলিফোন ধরা নয়। লোডশেডিং যদি হয়, পাশে ট্রানজিস্টর মজুত। গাভাসকার সেদিন স্যার ডনের সেঞ্চুরির রেকর্ড ছুঁতেই বালকের কুসংস্কার প্রশ্রয় পায়। বালকের নাম … দাশগুপ্ত। বয়স তখনই পঁয়ত্রিশ।
এটা ঘটনা যে, সুনীল গাভাসকারের সঙ্গে কাজের কথা বলার জন্য বহুবার আমাকে বসতে হয়েছে। বালক উধাও, তখন হয়ে যেতেই হয় অভিজ্ঞ কাজের লোক। ইন্টারভিউ নেওয়া তো আড্ডা মারার মতোই মজার ব্যাপার। কিন্তু চুক্তির মতো গম্ভীর বিষয়েও ঢুকতে হয়েছে, হয়। তখন ওই বালককে আসতে দিলে মুশকিল। সুনীল গাভাসকারের সামনে আমি একজন সাংবাদিক, মাঝারি ঘনিষ্ঠতার বন্ধু, একটি নিউজ পেপার হাউসের একজিকিউটিভও বটে। কিন্তু আড়ালে আপাদমস্তক ফ্যান। সানি পঞ্চাশটা রান করলে সেদিন, পর দিনও মনটা ফুরফুরে থাকা। সেঞ্চুরি করলে সাতদিন হাওয়ায় ভাসা। ব্যর্থ হলে সব খাবার, সব গল্প, সব কাজ, প্রিয়জনের সান্নিধ্যও তেতো। গড়িয়াহাট মোড় থেকে দেড়শো মিটার উত্তরে একটি ট্রানজিস্টর আমি এই কারণে আছড়ে ভেঙেছিলাম যে, পাকিস্তানে গাভাসকার আউট হয়েছিলেন সেঞ্চুরির মুখে এসে, স্পষ্টতই আম্পায়ারের চক্রান্তে। এরকম গাভাসকার-পাগল বাঙালির সংখ্যা নিশ্চয় কয়েক হাজার। আমি তাদের একজন হিসেবে যতখানি গর্বিত, ততখানি আর কোনও কারণেই নয়।
ভারতের সাম্প্রতিক অস্ট্রেলিয়া সফর চলার সময় মানব মজুমদার গভীর রাতে সিডনি থেকে টেলিফোনে যা বললেন, তাতে চমকে না উঠে উপায় ছিল না। সবে বত্রিশ নম্বর সেঞ্চুরি করেছেন গাভাসকার, আর কী বলছেন মানব মজুমদার! উনি শুরু করলেন এইভাবে : ‘খুব ভাল খবর আছে!’ কী খবর? মানববাবু বললেন, ‘সুনীল আজ ডিনারে আমাকে জানিয়েছে, ও জীবনের শেষ টেস্ট খেলে ফেলেছে। খবরটা এক্সক্লুসিভ। আর কারও পাওয়ার চান্স নেই।’ অস্ট্রেলিয়ায় তখন রাত প্রায় চারটে। ‘স্কুপ’ করার উত্তেজনায় আনন্দে মানব মজুমদারের গলা কাঁপছিল। আমার কাঁপছিল বুক। ভাল খবর? হ্যাঁ, একদিক দিয়ে, খবরের কাগজের দিক দিয়ে এটা বি-রা-ট খবর, সুতরাং ভাল খবর অবশ্যই। কিন্তু গাভাসকার আর খেলবেন না? আমার ঘরে কাউকে না ডেকে ধীর পায়ে স্পোর্টস রুমে ঢুকলাম। প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ ঘোষিত হল যেন! অলক চট্টোপাধ্যায় আমূল ক্রিকেটরসিক, আমার মতোই গাভাসকার-পাগল ধীমান আর দেবাশিস। প্রথম ঘোর কাটল ধীমানেরই। বলল, ‘তা হলে আপনাকেই লিখতে হচ্ছে কিন্তু।’ ভারতীয় ক্রিকেটের একটা অধ্যায়ের সমাপ্তিরেখা টানা হয়েছে সিডনিতে, যেন সেই সুদূর রেখার দিকে তাকিয়ে ছিলেন ক্রিকেটমগ্ন অলক চট্টোপাধ্যায়। দার্শনিকসুলভ নির্লিপ্ততায় আমার টেবিলে রাখলেন প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান। শোকাবহ পরিবেশে লেখা তৈরি এবং শেষ হল। পরে দেখা গেল, খবরটা ভুল। গাভাসকার টেস্ট ক্রিকেটে থাকলেন।
কিন্তু আমার এবং আমাদের প্রায় এক দশকের ক্রীড়াসাংবাদিক জীবনের সবচয়ে বড় ভুলটা কেন হল, কীভাবে হল? তিন মিনিট কথা হয়েছিল মানব মজুমদারের সঙ্গে, সিডনিতে গিয়ে তো আর খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব ছিল না, বসেও থাকা যায় না অত বড় খবর পেয়ে। তখনও মদন মিত্র আজকাল সম্পাদক। লেখাটা শুরু করার আগেই কথা হয়ে গেল প্রথম পাতায় লিড হবে। বললাম, ‘সানি বলেছেন মানব মজুমদারকে, কিন্তু পরে যদি দেখা যায় খবরটা ঠিক নয়? ‘টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছেন সানি গাভাসকার’— এই হেডলাইনের শেষে কি জিজ্ঞাসাচিহ্ন জুড়ে দেব?’ মদনদা পরামর্শ দিলেন, ‘তাতে বিশেষ লাভ নেই। খবরটা যখন আমরা ছাপছিই, জিজ্ঞাসাচিহ্ন দিলেও একই কথা।’ জিজ্ঞাসাচিহ্ন রাখা হল না।
কিছুদিন পর কলকাতায় এলেন মানব মজুমদার। সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের ডোবালেন কেন? বিষণ্ণ হেসে মানববাবু গল্পটা বললেন : ‘সিডনিতে সেই রাতে ডিনার টেবিলে সুনীলের মুখোমুখি ছিলেন মানব মজুমদার। গাভাসকার পরিষ্কার বলেন, ভাবছেন আর একটিও টেস্ট খেলবেন না, সিরিজ শেষ হলেই ঘোষণা করবেন, বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি আছে— সফর করার সময় কেউ অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে পারবে না। ঘোষণা করার আগে একবার বাবা মনোহর গাভাসকারের অনুমতি নিতে হবে। সানি কিন্তু মানববাবুকে স্পষ্টভাবেই আর একটি কথাও বলে : ‘খবরটা যেন তখনই ছেপে না দেওয়া হয়।’ সানির দ্বিতীয় বক্তব্যটি মানব মজুমদার শুনেও শোনেননি। এত বড় একটা স্কুপ পেটে রেখে ঘুমোতে পারে কোনও সাংবাদিক? রাত জেগে সিডনির ভোরের মুখে কলকাতার লাইন পেলেন। কয়েক ঘণ্টা বাদেই আমাদের ‘বৃহত্তম ভুল’ পৌঁছে গেল লক্ষ লক্ষ বাড়িতে। বেশ কয়েকদিন পর, লজ্জিত হতে হতেও আমরা বুঝলাম, কোনও উপায় ছিল না। এমন কথা স্বয়ং গাভাসকারের মুখে শুনে খবর না-পাঠিয়ে পারে কোনও সাংবাদিক? এমন খবর পেয়েও না-ছেপে পারে কোনও সম্পাদক?
আরও অনেক পরে এ ব্যাপারে সুনীলের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। সানির বক্তব্য, ‘আগেও দু-একবার সরে যাওয়ার কথা ভেবেছি। ভাবনার কথা তো বন্ধুবান্ধবকে বলতেই পারি। মানবকে বলেছিলাম বন্ধু হিসেবেই, সাংবাদিক হিসেবে নয়। ওটা কোনও ঘোষণাও ছিল না। যদি সিদ্ধান্তই হত, আমি কেন পরিষ্কার বলে দিলাম যে খবরটা যেন তখনই ছাপা না হয়? মানব ঝুঁকি নিল। ও আমার অনুরোধ না রাখায় রাগ করছি না। আফটার অল ও জার্নালিস্ট। খবরটা চেপে রাখতে পারেনি। কিন্তু, ঝুঁকিটা যখন নিয়েছেই তার দায়িত্ব ওকে নিতেই হবে, তোমাদেরও নিতে হবে।’ (পরে অবশ্য সানির অবসরের খবর লন্ডন থেকে প্রথম করে আমাদেরই দেবাশিস দত্ত।)
গুরুতর অসুস্থ মোহনবাগান সচিব ধীরেন দে-র আরোগ্য কামনা করে ফুলের তোড়া পাঠালাম। বিছানায় উঠে বসার মতো সুস্থ হয়েই তিনি টেলিফোন করলেন আমার বিছানায়। হ্যাঁ, খুব সকাল, তখনও বিছানায়। ঘুমচোখে শুয়েই ধরলাম। অপ্রত্যাশিত গলা। ধীরেন দে বললন, ‘আমি কৃতজ্ঞ, এই শুভেচ্ছার জন্য।’ দু-চার মিনিট ‘ভাল থাকুন, কাজকর্ম কেমন চলছে’ ইত্যাদি হল। দিন তিনেক পর সমীর রায়চৌধুরি মোহনবাগান ক্লাবের দুটি কমপ্লিমেন্টারি কার্ড নিয়ে এলেন, ধীরেন দে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই কার্ড দুটি কিন্তু কিছুটা অভদ্রভাবেই ফেরত পাঠাতে হল। সেই ফুটবল মরসুমের প্রথম দিকে মোহনবাগান কর্তারা নোটিস টাঙিয়ে এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন যে, ক্লাবের ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে ও পরে বেশ কিছুক্ষণের জন্য টেন্টে কোনও সাংবাদিককেও ঢুকতে দেওয়া হবে না। এই নোটিসটিকে আমরা প্রচণ্ড অপমানজনক মনে করি। মোহনবাগান ক্লাবকে একটি চিঠি দিয়ে জানাই, অপমানজনক সিদ্ধান্ত ও বিজ্ঞপ্তির প্রতিবাদে আমাদের কোনও রিপোর্টার বা ফটোগ্রাফার মোহনবাগান টেন্টে ঢুকবে না। মোহনবাগান ক্লাবের সহকারী সচিব শৈলেন মান্না বারবার বুঝিয়েছেন, ব্যাপারটাকে এভাবে নেওয়ার কিছু নেই। স্বয়ং ধীরেন দে খবর পাঠিয়েছেন, ওই নোটিস দেওয়া হয়েছে তাঁর অসুস্থতা এবং অনুপস্থিতির সময়ে। তিনি থাকলে এমন নোটিস কিছুতেই পড়ত না। তবু, যেহেতু ওই সিদ্ধান্ত বদলের ঘোষণা লিখিতভাবে করা হয়নি, আমরাও মোহনবাগান টেন্ট বয়কটের সিদ্ধান্তে অবিচল। এমনিতে প্রবীণ ধীরে দে-র সৌজন্যের অভাব নেই। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নাকি আমাকে খুবই পছন্দ করেন, অন্তত বলেন তো বারবার এ কথাই। কিন্তু আমার বা আমাদের আড়ালে তাঁর কাছে জানতে চান, আজকাল বা খেলা কেমন কাগজ? উনি নিশ্চিতভাবে বলবেন, ‘বাজে, খুব খারাপ। শুধু গরম গরম খবর ছাপে আমার নামে!’
ইস্টবেঙ্গলের সাধারণ সম্পাদক নিশীথচন্দ্র ঘোষ তাঁর ময়দানি জীবনের স্মৃতিকথা লিখলে, সবচেয়ে বড় কর্কশ অধ্যায়টি নিশ্চয় আমার এবং আমাদের নিয়েই লিখতেন। নিশীথ ঘোষের কথা থাক। ইস্টবেঙ্গলের যে কর্মকর্তারা আমাদের রিপোর্টারদের সঙ্গে হেসে কথা বলেন, মুখে কৃতজ্ঞতা স্বীকারও করেন, আড়ালে তাঁদের মুখেও খুব ভাল কথা শুনবেন না। আর তাই, কী মোহনবাগান, কী ইস্টবেঙ্গল— দুই গ্যালারিরই প্রেসবক্স সন্নিহিত অসভ্য অংশের চিৎকারের একটা বড় টার্গেট আজকাল, খেলা। আজকাল আর খেলা বড় বেশি অপ্রিয় খবর ছেপে দেয় কিনা। দলে কত দলাদলি, কোন অযোগ্য ফুটবলারকে মোটা টাকা দিয়ে কোন যোগ্য ফুটবলারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, লিগের শেষ দিকে কীভাবে কিনে নেওয়া হচ্ছে ম্যাচ— এ-সব সত্যিই খুব খারাপ খবর।
আর মহমেডান কর্মকর্তারা? ইব্রাহিম আলি মোল্লা সব সময় মিথ্যা কথা বলেন না। তিনি বলতেন, ‘খবর সবাই ছাপে, কিন্তু আপনারা একদম ড্যামেজ করে দেন।’ সত্যিই তাই। ‘মহমেডান স্পোর্টিং সঞ্জীব ভট্টাচার্যকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে বরখাস্ত করেছে’— অন্য কাগজ শুধু এটুকু ছাপে। আজকাল একের পর এক রিপোর্ট আর লেখা ছেপে চলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য। যে শিবাজি ব্যানার্জিকে একবার মাথায় তুললেন অসহায় মহমেডান কর্মকর্তারা, আগের বছর তাঁরাই শিবাজিকে দশবার ঘুরিয়ে পঁচিশ বার মিথ্যা কথা বলে শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। খেলা ছাড়া কেই বা সেই মিথ্যাচারের কাহিনী ছাপার অক্ষরে তুলে আনত? মজিদের ভিজে মাঠে খেলার বড় স্টাডের বুট নেই, মহমেডান ফুটবলাররা প্র্যাকটিসের পর খাবার পর্যন্ত পাচ্ছেন না, এ-সব খবর যারা ছাপে, তারা কি ভাল হতে পারে? তাই সামনে হেঁ হেঁ, কিন্তু আড়ালে মোল্লা সমেত মহমেডান কর্মকর্তারাও অ্যান্টি আজকাল, অ্যান্টি খেলা। আমরা সত্যি সত্যিই ঠিক পথে আছি কিনা তা বোঝার একটা রাস্তা জানা হয়ে গেছে। এই কর্মকর্তারা যদি কখনও আড়ালে আমাদের প্রচণ্ড প্রশংসা করতে থাকেন, বুঝতে হবে আজকাল, খেলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে, ভুল পথে চলছে।
এই যে আমরা বড় তিনটে ক্লাবের অবিচার, মিথ্যাচার এবং দুর্নীতিকে দিনের আলোয় নিয়ে আসার কঠিন কাজটা বছরের পর বছর করে গেলাম, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যা অন্যরা করল না, এই পরিস্থিতিতেও অনেকে অদ্ভুত একটা কথা বলে চলেন : আপনারা শুধু বড় ক্লাবের কথা লেখেন কেন? ছোট, মাঝারি ক্লাবেও রয়েছে ছোট, মাঝারি মাপের দুর্নীতি। তা হলে কি বড় ক্লাবের বদলে এ-সব জায়গাতেই আমাদের আলো ফেলা উচিত ছিল?
জুনিয়রদের আমরা দেখি না? কে দেখে? কত উদীয়মানকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করায় আমাদের সমালোচনা হয়েছে! এক মরসুমে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, তিন বড় টিমের সব ম্যাচের রিপোর্টের সঙ্গে থাকবে প্রতিপক্ষ ছোট টিমের সেরা খেলোয়াড়ের ছবি। আমরা জুনিয়রদের দেখি না?
শুধু ফুটবল নিয়ে থাকার অভিযোগও বারবার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। নিন্দুকরা শুধু ফুটবল না বলে, বলেন, ‘আজকাল’-‘খেলা’ শুধু ফুটবল, ক্রিকেট নিয়েই হইচই করে। শুধু নিন্দুকরা নয় অবশ্যই। উনিশশো আশিতে মস্কো অলিম্পিক দলে রীতা সেনের জায়গা হল না। অলিম্পিক দেখতে গেল রাজ্য সরকারের খরচে প্রতিনিধিদল, তাতেও রীতা সেনকে নেওয়া হল না। ‘খেলার কাগজ’-এ প্রচ্ছদে রীতার ছবি ছেপে প্রতিবাদ করলাম যথাসাধ্য। ক্রীড়া দপ্তরের উপসচিব অশোক ভট্টাচার্যর সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া করে এলাম, রীতার সঙ্গে রাইটার্সে গিয়ে। ব্যাপারটা নিয়ে একাধিক লেখা ছাপা হল। সেই রীতাই বছর দেড়েক পর আমাদের নির্মলকুমার সাহাকে বললেন, ‘আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন কেন, আপনারা তো শুধু ফুটবলারদের মাথায় তোলেন’!
চেহারা, চরিত্র অনেকেরই জানা হল এই পেশায় থেকে। অকৃতজ্ঞদের তালিকা তৈরি করতে গেলে কলমের কালি ফুরোবে নিশ্চিতভাবে। কিন্তু, আমরা শুধু ভালটুকুই মনে রাখতে চাই। ভালর পাল্লাই অনেক বেশি ভারি। শান্তি মল্লিক ‘অর্জুন’ হলে তাই নির্মলকে দিল্লিতে যেতেই হয় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে। ‘অর্জুন’ পুরস্কার হাতে আমাদের অফিসে তাই শিশুর উচ্ছ্বাসে ছুটে আসে দুর্দান্ত দিব্যেন্দু বড়ুয়া। একের পর এক মর্মস্পর্শী লক্ষ্যভেদী প্রতিবেদন লিখে তাই নির্মল দেখিয়ে দেয়, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে যখন কয়েকজন ভাগ্যবানকে মেক্সিকো পাঠাচ্ছে রাজ্য সরকার, ঠিক তখনই এই রাজ্যের খেলার জগতে কত সম্ভাবনাময় কুঁড়ি শুকিয়ে যাচ্ছে জলের অভাবে। ভাল কিছু করার আনন্দই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। এই বিশ্বাস তরুণ সহকর্মীদের দিকে তাকিয়ে অবশ্যই রাখা যায়। ‘কিছু করুন, মাননীয় ক্রীড়ামন্ত্রী মহোদয়’ সিরিজের কিছু লেখা আজকালে প্রকাশিত হওয়ার পরই অনেক ক্লাবের সংগঠকরা আসতে থাকেন, তাঁদের অনুষ্ঠানে নির্মলকে নেওয়ার জন্য। নির্মল এতটাই হইহই-বিমুখ যে খেলার বার্ষিক আউটিংয়েই জোর করে নিয়ে যেতে হয়। যদি কখনও কোনও ক্লাবের সংগঠক নির্মলকে তাঁদের অনুষ্ঠানে যেতে রাজি করাতে পারেন, দয়া করে আমাকে একটা খবর দেবেন। দর্শক হিসেবে হাজির থাকার চেষ্টা করব।
প্রায় দশ বছরের ক্রীড়া-সাংবাদিক জীবনে আমি কখনও কোনও পাঠক বা পাঠিকার চিঠির জবাব দিইনি। এই কারণে নয় যে চিঠিগুলোকে উপেক্ষা করেছি। ঠিক উল্টো। এই যে হাজার হাজার চিঠি টেবিলের ওপর অপেক্ষা করেছে, প্রত্যেকটিই পড়েছি। নানারকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেমন ক্রীড়ামোদী পাঠক-পাঠিকাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছি, পাঠক-পাঠিকাদের এই সব চিঠিও দিনের পর দিন প্রভাবিত করে গেছে আমাকে, অর্থাৎ আমাদের সবাইকেই! এই সব চিঠি আমাদের বুঝিয়েছে, অধিকাংশ পাঠক-পাঠিকা কী চান। আমরা কোথায় ভুল করছি অথবা বাড়াবাড়ি। সব বক্তব্যই যে গ্রহণযোগ্য তা নয়, কিন্তু সব সময়েই পাঠক-পাঠিকাদের ভাবনার হাওয়া আমাদের গায়ে লেগেছে। শুনেছি, অনেক সম্পাদক বা লেখক তাঁদের কাছে লেখা পাঠক-পাঠিকাদের চিঠিপত্রের নিয়মিত জবাব দেন। উটকো হয়েও চূড়ান্ত প্রশ্রয় পেয়েছি তা তো জানেনই। উত্তর দিলে হয়ত দিতে হত অন্তত তিন-চার হাজার চিঠির। তাতে যতটা সময় খরচ হত, ততটা সংযোগ ঘটত না নিশ্চয়, যে সংযোগ খেলাকে টেনে নিয়ে গেছে অপ্রতিহত গতিতে। ‘খেলা’র চেয়ে বড় পত্রিকা দেশেবিদেশে অনেক আছে, কিন্তু আর কোনও পত্রিকার সম্পাদকীয় কর্মীদের সঙ্গে পাঠকসমাজের এত মানসিক যোগ আছে কি?
নেই। তবে এতেও কোনও সন্দেহ নেই যে, ফলটা সব সময় ভাল হয়নি। হয়ত খুব কাজের দিন। অফিসে ঢুকে সবে বসেছি। স্নায়ু টানটান। সকলে মিলে কয়েক ঘণ্টা দারুণ কাজ করতে হবে। একটি চিঠি খুললাম। এক রাগী, না, রাগী বলে অযথা পালিশ লাগিয়ে লাভ নেই, এক অসভ্য পাঠক অথবা অ-পাঠক স্রেফ গালাগালি দিয়ে চিঠি লিখেছেন। আমরা খুব খারাপ, আমরা শুধু ব্যবসা করি, আমরা এটা, আমরা সেটা। অন্য যে-কোনও পত্রিকার সম্পাদক হলে ওই নোংরা চিঠিটা অগ্রাহ্য করত, কিন্তু ‘খেলা’র সম্পাদকের পক্ষে তো তা সম্ভব নয়। মনটা বড় বেশি খারাপ হয়ে গেল। হাজার হাজার পাঠকের প্রশংসা, প্রশ্রয়ের কথা তখন মনে থাকল না। মনে হল, কী দরকার এত খেটেখুটে কাগজ করার? একটা চমৎকার বিকেল, কাজে কাজে উদ্বেল হয়ে ওঠার কথা, বিস্বাদ হয়ে গেল। বিশ্বাস করুন, একবার এমনও মনে হল যে আর লিখবই না। পরের কয়েক ঘণ্টা কাজ হল বটে, তাতে মন থাকল না। কে এই অসভ্য মানুষটি যিনি অকারণে গালাগালি দিয়ে এত কষ্ট দিয়ে গেলেন? চিনি না, জানি না। কিন্তু মুশকিল হল এই যে, উপেক্ষাও করতে পারি না। চিঠি তো লিখেছেন একজন ক্রীড়ামোদীই, যিনি ‘খেলা’র একজন পাঠকও বটে। অভ্যেসটাই যে খারাপ হয়ে গেছে, সব চিঠিকে গুরত্ব দেওয়ার। আর-দশটা ভাল চিঠি ভুলতে দশ মিনিট লাগে, একটা খারাপ কথা ভুলতে লেগে যায় সারাদিন, অথবা তারও বেশি।
আমার তরুণ সহকর্মীরা কি একজন অভদ্র পাঠক বা অ-পাঠকের চিঠিকেও এতখানি গুরুত্ব দেবে? জানি না। তবে এটুকু জানি, ভালমন্দ যা-ই করে থাকি না কেন, আমরা একসঙ্গেই করেছি। আপনাদের এই উটকো সম্পাদকের দশটা দোষের হাওয়া যেমন ওদের গায়ে লাগার কথা, এক-আধটা গুণও একই ভাবে থেকে যাবে নিশ্চয়।
ডায়েরির এই পর্বের বিজ্ঞাপনের খসড়া পেতে ধীমানদের অপেক্ষা করতে হয়েছে পাক্কা দু’সপ্তাহ। অশেষ তাগাদার পর যখন পেল, ঠিক তিন মিনিট পর তীরের মতো ঘরে ঢুকল: ‘কী লিখেছেন, পঞ্চম ও শেষ পর্ব?’ হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা, উটকো সাংবাদিকের তুচ্ছ ডায়েরির সৌভাগ্যবশত এটাই শেষ পর্ব। ক্রীড়া-সাংবাদিকতা আমাকে দিয়েছে সুনীল গাভাসকার, প্রকাশ পাড়ুকোনের মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের সুযোগ, সুরজিৎ সেনগুপ্তর মতো অভিন্নহৃদয় বন্ধু, শ্যাম-সুভাষ-গোপাল বসুর মতো দুর্দিনেরও সঙ্গী, আমার তরুণ সহকর্মীদের মতো সহযোদ্ধা। আর, সবচেয়ে আগে যা বলার কথা, প্রশ্রয় পেয়েছি হাজার হাজার সচেতন পাঠক-পাঠিকার— কোনও যুক্তিতেই যাঁদের আমার গুণগ্রাহী হওয়ার কথা ছিল না।
অহঙ্কার? বেশ, তবে তাই। হ্যাঁ, এটা ঘটনা যে খেলার মাঠে দশ বছরে আমরা একটা নাড়া দিয়ে গেছি। ময়দানের সুখী অচঞ্চল নৌকোয় দরকার ছিল একটা বিপজ্জনক ঝাঁকুনির, যাত্রীদের জাগিয়ে রাখার জন্য। হাজার অন্যায়ের দার্শনিক প্রশ্রয়দাতা ক্রীড়া-সাংবাদিকতার বটগাছেরও প্রাপ্য ছিল একটা নির্মল ঝাঁকুনি, সে ঝাঁকুনি দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা আমরা করেছি। এই বটগাছতলায় শায়িত অনেক বিখ্যাত শুষ্ক পত্রপুষ্প। অচিরেই শুকনো পাতার ভিড়ে আর-একটি সংযোজন ঘটবে। একটু অন্যরকম। শুকনো হতে হতেও সামান্য ভিজে থাকার ইচ্ছা। অনুগ্রহ করে পাতাটিকে পায়ে মাড়িয়ে যাবেন না। শুকনো পাতারও চোখ থাকে। সেই চোখ নতুন পাতায় ভরা গাছকে দেখতে চায়।