খেলা শারদীয় সংখ্যা ১৯৮২

খেলা শারদীয় সংখ্যা ১৯৮২

সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার মহৎ স্বপ্নে যখন ভারতবর্ষের বেশ কিছু অংশ উত্তাল, স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল সৃষ্টির একটা ছবি যখন অন্তত আপাতদৃষ্টিতে উপস্থিত, তখনই ওই অল্পবয়সেই আমার ভেতরে আগুন অথবা আগুনের স্বপ্নটা নিভতে শুরু করে।

সংগ্রামের সর্বোচ্চ নেতা আমার সদিচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়েও যথাসময়েই বলে দিতে পেরেছিলেন, অত কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। শিলিগুড়ির ছোট্ট বাড়িটায় বসে কথাগুলো শুনতে তখন ভাল লাগেনি। পরে বুঝেছি, সত্যি কথা শুনতে কম সময়ই ভাল লাগে।

তাহলে কী করা যায়? আমলা হওয়ার ইচ্ছায় মাসখানেক খেটেখুটে কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দেওয়া গেল। শেষ পর্যন্ত বাদ সাধলেন স্পোর্টিং মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং তাঁর পুলিস প্রশাসন। তখনকার হোম সেক্রেটারি বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায় আমাকে একটু-আধটু স্নেহ করতেন। তিনি একটা রাস্তা খুঁজে বার করার ইঙ্গিত দিলেন। মন সায় দিল না। বিপ্লবী হওয়ার সামর্থ্য নেই, সিদ্ধার্থ রায় জানিয়ে দিলেন আমলা হওয়ার মতো দেশপ্রেমও নেই। তাহলে?

ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার জেনারেল ম্যানেজার (তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার) কে এল রায় একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী কোম্পানিতে চাকরি জুটিয়ে দিলেন। সেলস এগজিকিউটিভের চাকরি। কোম্পানির প্রাণপুরুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাকে ভারতবর্ষের অনেক বড় শহরে নিয়ে গেল। বছর দুয়েকের চেষ্টায় একটা ভাল লিফট পেয়ে যখন ভাবতে শুরু করেছি যে এটাই আমার লাইন, তখন অঘটনটা ঘটল। কিন্তু অঘটনেরও একটা পটভূমিকা থাকে। সেই পটভূমিকাটুকু পেশ করে ফেলাই প্রথম কাজ।

ছিয়াত্তরের এপ্রিলে একটা ফিল্ম ট্যাবলয়েডের সম্পাদক বললেন, তিনি কিছুটা অংশ খেলার জন্য ছেড়ে দিতে চান। দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হবে। ততদিন পর্যন্ত ইতস্তত যতটুকু লেখালেখি চলছিল, তা প্রধানত লিটল ম্যাগাজিনে, ক্রীড়াসাংবাদিকতার সঙ্গে যার কোনওরকম সম্পর্ক ছিল না।

রাজি হয়ে গেলাম। ট্রান্সফর্মার কোম্পানির চাকরিতে ফাঁকি দেওয়ার দরকার হয়নি। বরং অন্য সুবিধা পাওয়া গেল। কোম্পানির হয়ে বাইরে যেতে হত মাসে অন্তত একবার। পাটনা, গুয়াহাটি, ইম্ভল, শিলং, দিল্লি, পাতিয়ালা, লক্ষ্ণৌ, মুম্বই— আরও কত জায়গায় ভাল ভাল হোটেলে শুয়ে বসে চিন্তা করার প্রচুর সময় পেয়ে গেলাম। কাজ তো বিকেল পাঁচটার আগেই শেষ। তারপর? একলা সিনেমা দেখা আসে না। পেপারব্যাক ট্রেন আর প্লেনেই ভাল। সেলসের লোক হিসেবে মাঝে মধ্যে মাঝারি মাপের কিছু রুই-কাতলাকে অবশ্য অনিচ্ছুক আপ্যায়ন করতে হত সন্ধের পর, যাকে বলে ওকুপেশনাল হ্যাজার্ড।

‘চিত্রজগৎ’ মাসিক পত্রিকা, আমার কাজ বড় জোর দেড় দিনের। তাই ওই ছিমছাম হোটেলগুলোর বিছানার বালিশ খেলার পত্রিকা সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার ক্রমাগত সঙ্গী হতে লাগল। খবরের কাগজের অর্ধেক মাপের পত্রিকা, তার শেষ পৃষ্ঠা বরাদ্দ ছিল খেলার জন্য। তাতে থাকত একটা বড় ইন্টারভিউ, একটা লেখা এবং টুকরো খবরের একটা চুরমুরে ফিচার। বলা বাহুল্য, নামে বেনামে সবই আমার।

এক সংখ্যায় গোপাল বসুর ওপর একটা লেখা পড়ে মতি নন্দী খুব প্রশংসা করলেন। এবং সেইদিনই আনন্দবাজার অফিসে এমন একজনের সঙ্গে আলাপ হল, যিনি পরবর্তী সময় আমাকে আমূল প্রভাবিত করলেন। মুকুল দত্ত বললেন, ‘একদিন বাড়িতে এস।’

‘তিনটে জিনিস দরকার, বুঝলে। নিউজ সেন্স, লেখার ক্ষমতা আর নিষ্ঠা। না হলে ভাল সাংবাদিক হওয়া যায় না।’

সাংবাদিকতাকে পেশা করার কথা তখন ভাবিনি। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু হয়, ওই আর কি। তবু মুকুলদার কথাগুলো কানে গেঁথে গেল।

সাতাত্তরের মার্চে আমার অফিসের ঠিকানায় চিত্তরঞ্জন বিশ্বাসের (চিরঞ্জীব) একটা চিঠি এল। দেখা হতেই জানালেন, বাংলা ভাষায় সে-ই প্রথম পূর্ণাঙ্গ খেলার পত্রিকা প্রকাশিত হতে চলেছে। শ্যাম থাপার ওপর কভার স্টোরি আমাকেই করতে বলা হল, কারণ শ্যামের সঙ্গে ততদিনে আমার ঘনিষ্ঠতা প্রবল। পয়লা মে ‘খেলার আসর’ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল। কভারে বন্ধু প্রদীপ সোমের তোলা ঝকঝকে ছবি। প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়েছিল বোধহয় পাঁচ হাজার, বাজারে আসার ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই সব শেষ।

খেলার আসরের দ্বিতীয় সংখ্যার প্রিন্ট অর্ডার ছিল দশ হাজার। এবার প্রচ্ছদে উলাগানাথন। কভার স্টোরি আমারই। তৃতীয় সংখ্যা থেকেই, যতদূর মনে পড়ছে, খেলার আসর অফসেটে চলে এল। প্রচার-সংখ্যা কুড়ি-পঁচিশ হাজার। লতিফুদ্দিনের ওপর কভার স্টোরিটাও আমাকেই করতে বলা হল।

খেলাধুলোর পত্রিকার জন্য এমন একটা ফাঁকা জায়গা পড়ে রয়েছে, এটা যাঁরা উপলব্ধি করে প্রথম কাজে নেমেছিলেন, বাংলার ক্রীড়ামোদীদের তাঁদের কাছে অবশ্যই কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এই নতুন উদ্যোগের সঙ্গে নিজেকে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত রাখতে পেরে ভালও লাগছিল। পরে শুনেছি, প্রথম তিনটি সংখ্যারই প্রচ্ছদকাহিনী একজন নবাগতকে লেখার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল মতি নন্দীর পরামর্শে।

সাতাত্তরের গোড়ায় আরও একটা ঘটনা ঘটল। জানুয়ারিতে পাটনায় সন্তোষ ট্রফির শেষের দিকে খেলা চলছিল। অফিসের কাজে ঠিক তখনই আমি পাটনায়। আমার হোটেল দাই-ইচি থেকে প্রিন্সেস হোটেল বলতে গেলে পাথর ছোঁড়ার দূরত্বে। সেখানে বাংলার ফুটবলাররা ছিল। শ্যাম তো আমার বন্ধু ছিলই, পাটনায় শ্যামের রুমমেট প্রদীপ চৌধুরির সঙ্গেও বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। চিন্ময়-শ্যামল-রতনরাও ছিল। ইস্টবেঙ্গলের তখনকার দুই জবরদস্ত কর্মকর্তা জীবন চক্রবর্তী ও পল্টু দাস হাজির শ্যাম থাপার মোহনবাগানে যাওয়া রোখার জন্য। ওঁরা দুজন বললেন, ‘শ্যাম যাচ্ছে না, লিখে নিতে পারেন।’ সেদিনই শ্যাম বলল, ‘আমি মোহনবাগানে যাচ্ছিই, তুমি ওদের বোলো না কিন্তু।’ তারপর দারুণ নাটক। একটা ভাল লেখার মশলা পেয়ে গেলাম।

কাছাকাছি রাজস্থান হোটেলে উঠেছিলেন মুকুল দত্ত। একদিন সকালে হঠাৎই বললেন, ‘জানো অশোক, মে মাসেই দেশ অফসেটে চলে যাচ্ছে। একটা করে খেলার লেখা থাকবে, আমার নিয়মিত লেখাটা ছাড়াও। অফসেটের প্রথম সংখ্যায় এবারের মোহনবাগান টিম নিয়ে চুনী লিখবে। দ্বিতীয় সংখ্যায় ইস্টবেঙ্গল টিম নিয়ে তুমি লেখ। অমল দত্তর সঙ্গে তোমার রিলেশন ভাল। তোমার ওপর আমার কনফিডেন্স আছে, দলবদল শেষ হওয়ার পর লেখাটা তৈরি করে ফেলবে।’

‘খেলার আসরে’র আবির্ভাব সাতাত্তরের পয়লা মে, ‘দেশে’ আমার লেখা প্রথম বেরোল ওই মাসেরই মাঝামাঝি। তারপর একের পর এক অনেক লেখা। দ্বিতীয় লেখার বিষয় ছিল শ্যাম আর উলাগার দলবদলের গল্প। গল্প নয় নাটক।

‘দেশে’ পরপর কিছু লেখা প্রকাশিত হওয়ায় একটা ব্যাপার ঘটল। অফিসের কাজে বাইরে গিয়ে বুঝলাম, প্রবাসী বাঙালিরা আমার নামটা অল্পস্বল্প জেনে ফেলেছেন। ভাল তো লাগতই, কিন্তু ভাবিনি, একদিন ক্রীড়াসাংবাদিকতা আমার পেশা হয়ে যাবে।

আটাত্তরের প্রথম দিকে সম্পাদক কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘আনন্দমেলা’য় নিয়মিত লিখতে বললেন। ছোটদের জন্য লেখা, বলতে গেলে একটা সম্পূর্ণ নতুন ফ্রন্ট খুলে গেল।

এই সব খেলার লেখাটেখার সঙ্গে থাকতে থাকতে কিছু চিন্তাভাবনা জমতে লাগল। চিন্তাভাবনা অবশ্য ছিয়াত্তরেই শুরু হয়ে গিয়েছিল।

খেলার আসরে লিখলেও পত্রিকা পরিচালনা বা সম্পাদনার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না। চিত্তদা বা অতুলদা (মুখার্জি) লিখতে বলতেন। লিখতাম। মাথায় ঘুরছিল একটা নতুন খেলার পত্রিকার চিন্তা। একদিন নামী ফটোগ্রাফার মনোজিৎ চন্দ বললেন, ‘একটা নতুন খেলার পত্রিকা বেরোতে পারে। জর্জ টেলিগ্রাফের প্রদ্যুৎ দত্ত করছেন। আমি কয়েকজনকে বলেছি, তুমিও এলে খুব ভাল হয়।’

তারিখটা মনে নেই, তবে মিটিংটার কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। শান্তিনিকেতন বিল্ডিংয়ের এগারো তলায় বেশ জমজমাট মিটিং। প্রদ্যুৎ দত্ত, মনোজিৎ চন্দ, আনন্দবাজারের প্রাক্তন ডেপুটি অ্যাডভার্টাইজমেন্ট ম্যানেজার ইন্দুভূষণ রায় ছাড়াও হাজির কলকাতার দৈনিক পত্রিকার কয়েকজন রিপোর্টার। আধঘণ্টা আমি চুপচাপ আলোচনা শুনেছিলাম। দৈনিকপত্রের তিনজন রিপোর্টার বক্তব্য শুরু করেছিলেন এই বলে যে, ডেইলি পেপারে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি….।

এই একটা ব্যাপার আগে এবং পরেও বহুবার লক্ষ্য করেছি। দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টাররা এমন ভাব দেখান, যেন তাঁরাই আসল লোক, স্পোর্টস ম্যাগাজিন একটা ফালতু ব্যাপার।

প্রদ্যুৎ দত্তকে সেই প্রথম দেখলাম। তিনি ঠিক কী ধরনের কাগজ করতে চাইছেন, জানতাম না। আধঘণ্টা নীরব শ্রোতা থাকার পর মুখ খুললাম, ‘প্রথমেই বুঝে নেওয়া দরকার যে ভাল স্পোর্টস ম্যাগাজিন করার জন্য খবরের কাগজে কাজ করার অভিজ্ঞতাটাই যথেষ্ট নয়। থাকলে অবশ্য ভাল কথা। খেলার আসর প্রতিষ্ঠিত কাগজ। দারুণ কিছু ভাবতে বা করতে না পারলে নতুন কাগজ করে কোনও লাভ নেই। আরও মনে রাখতে হবে, কাগজে কখনই ‘অনুরোধের আসর’ বসানো চলবে না। কারও অনুরোধে নয়, শুধুমাত্র পত্রিকার প্রয়োজনেই লেখা ছাপতে হবে। আর, এটা কোনও অ্যামেচারিশ ব্যাপার নয়। কমার্শিয়াল দিক দিয়ে কাগজটা যেন অল্পদিনের মধ্যেই দাঁড়িয়ে যায়, সেটাও দেখতে হবে।’

প্রথম দিকে কেউ কেউ বলেছিলেন, প্রথম সংখ্যা পাঁচ হাজার কপি ছাপা যেতে পারে। আমি বক্তব্য শেষ করলাম: ‘প্রথম সংখ্যা অন্তত দশ হাজার কপি ছাপা যায়, এমন কাগজ না করতে পারলে কাজে নেমে লাভ নেই।’

আমার কথা শেষ হওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তিনজন খবরের কাগজের রিপোর্টার প্রায় একযোগে ঘোষণা করলেন, ‘আমরা তো ডেইলি পেপারে আছি, মাঠে যেতে হবে, হকি খেলা আছে, এখন আসি।’

খুব ভালভাবেই কথাগুলো বলা হয়েছিল। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হল, ওয়াকআউট।

প্রদ্যুৎ দত্ত এতক্ষণ শুনে বড় জোর সাড়ে তিনটে কথা বলেছিলেন। ঘর একটু ফাঁকা হতেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি ভাল কাগজই করতে চাই। আপনি শুধু বলুন, এখনকার ভাল চাকরি ছেড়ে আমার কাগজ চালানোর চাকরি নিতে পারবেন?’

সামান্য মেঘে বজ্রপাত। অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন। কিন্তু আমি খুব সহজভাবেই বলে ফেললাম, ‘হোয়াই নট?’

উনিশশো আটাত্তরের মার্চের শেষের দিকে ক্রীড়াসাংবাদিকতাকে পেশা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, প্রদ্যুৎ দত্তর অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের সামনে পড়ে গিয়ে। শান্তিনিকেতন বিল্ডিংয়ের অফিসে আমার জন্য একটা ছোট্ট চেম্বার তৈরি হয়ে গেল। পয়লা এপ্রিল সকাল দশটায় অফিসে পৌঁছে গেলাম। অফিসে আসার আগে দেখা করেছিলাম মুকুল দত্ত আর শৈলেন মান্নার সঙ্গে। মুকুলদা খবরটা শুনে বলেছিলেন, ‘আমি জানতাম’। মান্নাদাও খুব খুশি হলেন। প্রথম দিনই সময় করে আমার নতুন অফিসে এসেছিলেন সুকুমার সমাজপতি।

দিন কয়েকের মধ্যেই ছোট্ট ঘরটা শিল্পী হরিমোহন বাগলিকে ছেড়ে পাশের বড় ঘরে চলে এলাম। লাল টেলিফোন, রিভলভিং চেয়ার, বিরাট টেবিল। সব ঠিক আছে, শুধু দুটো ব্যাপারে কিছুই ঠিক নেই। এক, কোথায় ছাপা হবে। এবং দুই, কারা আমার সঙ্গে কাজ করবে। কবে কাগজ বেরোবে এবং কত দাম হবে, তাও ঠিক হয়নি।

প্রদ্যুৎ দত্ত অবশ্য বললেন, ‘বিপ্লব তোমাকে সাহায্য করবে।’ বিপ্লব দাশগুপ্তকে মোটামুটি চিনতাম, রানিং কমেন্ট্রি করার সূত্রে। ভাল ছেলে। বিপ্লব বলল, ‘অশোকদা, আমি জান লড়িয়ে দেব, তুমি শুধু বলবে কী করতে হবে!’

শেষ পর্যন্ত একটা প্রেসও ঠিক হয়ে গেল— দীপ্তি প্রিন্টিং। দেবীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় খুব উৎসাহ দেখালেন। কাজ শুরু হল। গোটা তিনেক প্যাড নষ্ট হল প্রথম সংখ্যার স্কিম, সম্ভাব্য লে-আউট ইত্যাদির ব্যাপারে। একটা-দুটো করে লেখা প্রেসে যেতে লাগল। সে এক এলাহি ব্যাপার। প্রদ্যুৎদার ব্রডওয়ে পাবলিসিটির জিপে চড়ে আমি, বিপ্লব আর হরিমোহন প্রায় রোজ দুপুরে উল্টোডাঙায় প্রেসে যাই আর শুনি যে আগের দিন দেড় পৃষ্ঠা কম্পোজ হয়েছে।

প্রথমে ঠিক ছিল পয়লা বৈশাখ ভাল দিন, ওই দিনই প্রথম সংখ্যা বেরোবে। তারপর মে দিবসকে বাছা হল। কিন্তু কাজ এগোচ্ছিল ঢিমেতালে। একদিন তাই প্রদ্যুৎদাকে বলেই ফেললাম, ‘বিপ্লব ভাল ছেলে, কিন্তু বড্ড অলস। ওকে নিয়ে কিছু করে ওঠা মুশকিল।’

আমার কথা শুনে বিপ্লব, কী আশ্চর্য একটুও রাগল না। দুঃখও পেল বলে মনে হল না। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘সরি অশোকদা, এবার দেখবে, আমি লড়ে যাব।’ সত্যিই লড়ে গেল। পরবর্তী সাড়ে বাইশ মাসে বিপ্লবকে একবারও ‘অলস’ বলতে হয়নি। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে ওর মতো ছেলে পাওয়া কঠিন।

আস্তে আস্তে প্রেসও বিপ্লবের মতোই সক্রিয় হয়ে উঠল। পয়লা জুন প্রথম সংখ্যা বেরোবেই, এরকম একটা আশ্বাস পাওয়া গেল।

ফ্লুরিজ-এ বসে মুকুল দত্ত বললেন প্রদ্যুৎ দত্তকে, ‘একটু বড় চিন্তা না করতে পারলে কিছুই করতে পারবেন না। অশোক খাটছে, আমার বিশ্বাস ও পারবে। আপনি নিশ্চিন্তে এগিয়ে যান।’

সেদিনই অনুরোধ করলাম, ফুটবলের নিয়মকানুন নিয়ে একটা লেখা প্রথম সংখ্যা থেকেই শুরু করতে হবে। মুকুলদা রাজি হয়ে গেলেন। ‘রেফারি’ ছদ্মনামের আড়ালে যে তিনিই আছেন, লেখা পড়ে ময়দানের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সেটা বুঝতে একটুও অসুবিধা হল না।

প্রথম সংখ্যার বিজ্ঞাপন আনন্দবাজার আর যুগান্তরে প্রকাশিত হল। হইহই ব্যাপার। লিখছেন: চুনী গোস্বামী, রেফারি, অমল দত্ত, মতি নন্দী, শৈলেন মান্না, অরুণ ঘোষ, সুকুমার সমাজপতি, টি এ রহমান, শান্ত মিত্র, জয়ন্ত চক্রবর্তী, সুপ্রিয় সেন, বিপ্লব দাশগুপ্ত, ফাইটার এবং অশোক দাশগুপ্ত।

এবং অশোক দাশগুপ্ত! এটা শিখেছিলাম কলেজে পড়ার সময়েই অর্থনীতির এক দুঁদে অধ্যাপকের কাছ থেকে, যিনি একই সঙ্গে নানারকম প্রগতিশীল সংগঠন এবং পত্রপত্রিকা চালাতেন। এত নামকরা লেখক পেয়েছিলাম, কারণ আগের দেড় বছরে খেলার মাঠের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলাম।

‘খেলার কথা’য় আমার সঙ্গে ছিল শুধু বিপ্লব। শিল্পী হরিমোহন। আর একজন এগিয়ে এলেন। দুর্ধর্ষ লেখা এবং মৃদু পরামর্শ নিয়ে। সুপ্রিয় সেনের সঙ্গে আমার আলাপ অনেক আগে, যেহেতু তাঁর কোম্পানির সঙ্গে আমাদের কোম্পানির একটা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল।

সাতাত্তরের ডিসেম্বরে আমাদের একসঙ্গে গুয়াহাটি, শিলং আর ইম্ভল যেতে হয়েছিল। ইম্ভল যাওয়ার প্লেনে চড়ার অপেক্ষায় গুয়াহাটি এয়ারপোর্টের রেস্তোরাঁয় বসে আছি, হঠাৎ সুপ্রিয় সেন বললেন, ‘আমার পেছনে যে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে, তাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তাকে আমি চিনি। নাম— প্রণব সরকার। দেখা হয়নি অন্তত বিশ বছর।’

তাকিয়ে দেখি, লম্বা সুদর্শন এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন। তিনি পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। সুপ্রিয়দা ডাকলেন— ‘প্রণব!’ ভদ্রলোক চকিতে ঘুরলেন, আমাদের টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে প্রায় আধ মিনিট তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও স্মৃতিশক্তির চর্চা করে জিজ্ঞেস করলেন— ‘সুপ্রিয়দা?’

সুপ্রিয়দা মোলায়েম হেসে বললেন, ‘চিনতে পারছ তাহলে।’ ভদ্রলোক ঝপ করে পাশের চেয়ারে বসলেন। যাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসছিলেন, তাঁকে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ‘বিদায়’ বললেন। এবং তারপর: ‘আপনাকে চিনব না সুপ্রিয়দা? যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে আপনার লেখা নাটকের আমি হিরো ছিলাম না?

পরবর্তী ছত্রিশ ঘণ্টায় ভদ্রলোক সুপ্রিয়দাকে ছেড়েছিলেন ঘণ্টা চারেকের জন্য, যখন আমরা দুজন কোম্পানির কাজে গুয়াহাটিতে ব্যস্ত ছিলাম। গুয়াহাটি এয়ারপোর্টের রেস্তোরাঁয় ওই টেবিলে বসেই সুপ্রিয়দা আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, ‘বৎস, আমিও লিখতাম।’

৭৮-এর এপ্রিলে সুপ্রিয়দাকে তাই বললাম, ‘তাহলে আবার লিখুন।’ এবার আর সুপ্রিয়দা খোশমেজাজে ‘বৎস’ সম্বোধন করলেন না, আমার কথায় যেন ষড়যন্ত্রের আভাস পেলেন। একটা সরু সুদৃশ্য জাপানি সিগারেট দিয়ে আমাকে অন্য প্রসঙ্গে নিয়ে যেতে যাওয়ার চেষ্টা যখন ব্যর্থ হল, বলে ফেললেন— ‘নিশ্চয় লিখব অশোক। কিন্তু আমি তো মাঠের কাউকে চিনি না। কী লিখব? কাকে নিয়ে লিখব?’

সুপ্রিয়দা জীবনের প্রথম খেলার লেখা লিখলেন— ‘কী করছেন এখন অমল দত্ত?’ অমল দত্তর সঙ্গে দেখা বা কথা বলার দরকার হয়নি। আমি তথ্য দিয়েছিলাম, তার থেকেই অনবদ্য লেখা তৈরি করেছিলেন সুপ্রিয় সেন। অমলদার সঙ্গে সুপ্রিয়দার আলাপ হয় ওই লেখা প্রকাশের মাস দেড়েক পরে।

উনিশশো আটাত্তরের ৩১ মে। সকাল থেকেই সে কী প্রবল কর্মব্যস্ততা। ভেতরের বত্রিশ পৃষ্ঠা ছাপা শেষ হল সেদিনই সকালে, রাতে ছাপা শেষ হবে কভার, ছাপা হতে হতেই বাঁধাই চলবে, পরদিন সকালে ‘খেলার কথা’র প্রথম সংখ্যাকে দিনের আলো দেখাতে হবে।

সন্ধে সাতটার মধ্যে আমি আর বিপ্লব প্রেসে পৌঁছে গেলাম। সুপারভাইজার নিতাইবাবু পরপর দু’কাপ চা খাওয়ালেন। কিন্তু পরদিন ভোরে কাগজ বেরবে এমন আশ্বাস দিতে গিয়ে দু’বার হোঁচট খেলেন।

রাতে কভার ছাপা যখন সবে অর্ধেক এগিয়েছে, লোডশেডিং হয়ে গেল। নিতাইবাবু শোকাপ্লুত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন: ‘আর কিছু করার নেই।’ রাত তখন সাড়ে বারোটা। দীপ্তি প্রিন্টিংয়ের দোতলায় অফিসঘরে বসে আমি ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের যাবতীয় টেলিফোন বাজাতে শুরু করলাম। বিপ্লব প্রবল বেগে গাইড খুঁজে সব নম্বর সরবরাহ করে গেল। শেষ পর্যন্ত নিতাইবাবুই বুদ্ধি দিলেন, ‘চলুন, লোকাল পাওয়ার স্টেশনে গিয়ে খোঁজ নিই।’ অনেক ডাকাডাকি করেও কাউকে পাওয়া গেল না। পেলেই বা কী হত?

প্রেসে ফিরে মনের দুঃখে আর-একটা সিগারেট ধরিয়েছি, এমন সময় কী আশ্চর্য, এসে গেল— বিদ্যুৎ! কিন্তু আবার চলে গেল ঘণ্টাখানেক বাদে। আবার এল!

রাত সাড়ে তিনটেয় শ্রীচন্দ্র পারিজা এলেন বড় ভ্যান চালিয়ে। শ্রীচন্দ্রবাবু তখন আনন্দবাজারের ডিস্ট্রিবিউটর। খেলার কথার ডিস্ট্রিবিউটর হয়েছিলেন প্রথম সংখ্যা থেকেই। তাঁকে বলা হল, ‘এখন কাগজ দিতে পারছি না, আটটা নাগাদ পাবেন।’

ভোর সাড়ে চারটেয় প্রথম একশো কপি বাঁধাই হয়ে কাটিং মেশিনে রাখা হল। ওপরের দুটো কপি আমি আর বিপ্লব আদর করে তুলে নিলাম। আর এক কাপ চা খেয়ে যখন রাস্তায় বেরলাম, শহর জাগতে শুরু করেছে। উল্টোডাঙা বাজারের কাছে একজন হকারের কাছ থেকে আনন্দবাজার কিনে গোগ্রাসে সেদিনের সবচেয়ে বড় খবরটা পড়ে নিলাম— খেলার কথার প্রথম সংখ্যা আজ প্রকাশিত হচ্ছে।

ট্যাক্সি নিয়ে সোজা যোধপুর পার্কে প্রদ্যুৎদার বাড়ি। প্রদ্যুৎদার সেদিনই বাড়ি পাল্টে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে নতুন ফ্ল্যাটে আসার কথা। আমার হাত থেকে খেলার কথার প্রথম সংখ্যার প্রথম কপিটা নিয়ে কভার দেখলেন, পাতা ওল্টালেন অন্তত তিন মিনিট। তারপর বাড়িয়ে দিলেন উষ্ণ হাত— ‘কনগ্রাচুলেশনস অশোক, দারুণ কাগজ।’

বিপ্লবকে নিয়ে ফিরে এলাম বালিগঞ্জে আমার হোটেলে। স্নান-খাওয়া সেরে, একবার ‘খেলার কথা’ অফিসের বুড়ি ছুঁয়ে আনন্দবাজারে শ্রীচন্দ্র পারিজার ঘরে পৌঁছলাম দুপুর দেড়টায়। শ্রীচন্দ্রবাবু বললেন, ‘সব শেষ! আপনারা মাত্র দশ হাজার ছাপলেন কেন?’

হাওয়ায় ভেসে— ক্যামাক স্ট্রিটে ‘খেলার কথা’ অফিসে। প্রদ্যুৎ দত্ত মিটিমিটি হাসছেন। সব কাগজ বিক্রি হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে গেছেন। আগে থেকেই মশলা ধোসা আর মিষ্টি আনিয়ে রেখেছিলেন। কোনওটাই পারতপক্ষে খাই না শুনে দুঃখ পেলেন।

টেলিফোনে অভিনন্দন জানালেন পরপর চারজন— আনন্দমেলার সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শান্ত মিত্র, সুকুমার সমাজপতি এবং মুকুল দত্ত। মুকুলদা অবশ্য বললেন, ‘অনেক ইমপ্রুভ করতে হবে, তবু শুরুটা ভালই।’

সম্ভাব্য লেখকসূচি জানিয়ে খেলার কথা প্রকাশের প্রথম বিজ্ঞাপন আনন্দবাজার ও যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছিল কিছুদিন আগে। সেইদিন থেকেই সম্ভাব্য পাঠকদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু টেলিফোন আসা শুরু হল। এক কিশোর জানতে চাইল, ‘দাদা, কভারে কার ছবি থাকছে?’ আমি বললাম, ‘সুরজিৎ সেনগুপ্ত’। সেইদিনই রাতে এইসব টেলিফোনের কথা শুনে মতি নন্দী আমাকে বললেন, ‘খবরদার, ওসব প্রশ্নের জবাব দিও না। তোমাদের স্কিম জেনে নেবার জন্য এটা রাইভাল পেপারের ফাঁদও হতে পারে।’ ঠিক বিশ্বাস করিনি। তবে, আর ও-ধরনের প্রশ্নের জবাবও দিইনি কোনওদিন।

প্রথম বিজ্ঞাপন প্রকাশের পরদিন সকাল সাড়ে নটা নাগাদ লিফটে ওঠার আগে অভ্যাসবশে লেটার বক্সের কাছে গেলাম। ছোট্ট লেটার বক্স উপচে অসংখ্য চিঠি। পকেটেই চাবি থাকত। চিঠির বান্ডিলের দিকে ভাল করে তাকালামই না। অফিসে নিজের চেম্বারে না পৌঁছনো পর্যন্ত— সাসপেন্স।

অধিকাংশ চিঠিই মফঃস্বল শহরের এজেন্টদের। তাঁরা ‘খেলার কথা’ বিক্রির দায়িত্ব নিতে চান। এক-একটা জায়গা থেকে চারজন পর্যন্ত আবেদন করেছেন। তিনদিনের মধ্যে এজেন্টদের চিঠিতে অফিস ভরে গেল। কাগজ তখনও ছাপা শুরু হয়নি, তবু সাড়া পড়ে গেল ‘খেলার কথা’ অফিসে। আমরা জানতাম প্রথম সংখ্যা বাইরে বেশি পাঠানোর সময় নেই। তার ওপর, কেউ ভাবেননি যে নতুন কাগজের জন্য আগে থেকে সার্কুলেশনের কিছু লোক রাখা দরকার। শুধু কয়েক শো এজেন্ট নয়, অসংখ্য সম্ভাব্য গ্রাহকের চিঠিও এল। উৎসাহের তোড়ে মাস দেড়েক সার্কুলেশনের গোটা কাজটাই আমি করলাম— মানে, অফিসিয়াল কাজের দিকটা। ইন্দুভূষণ রায় আলাপ করিয়ে দিলেন আনন্দবাজারের সার্কুলেশন ম্যানেজার মদন মিত্রের সঙ্গে। তিনি আন্তরিক সাহায্য করলেন। তখন কে জানত, একদিন অন্য একটি দৈনিকপত্রে তিনি জেনারেল ম্যানেজার (পরে সম্পাদক) হয়ে আসবেন, আমি স্পোর্টস এডিটর।

আনন্দবাজারের জেনারেল ম্যানেজার অরূপকুমার সরকার এবং চেয়ারম্যান কানাইলাল সরকারের সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দিলেন ইন্দুভূষণ রায়। অরূপবাবু বললেন, ‘খেলার পত্রিকা ভালই চলবে মনে হয়, কিন্তু মুশকিল হল, মোটেই বিজ্ঞাপন পাবেন না। খেলার কাগজ করলে, লো কস্টিং-এই করতে হবে।’

শুধু পত্রিকা সম্পাদনা নয়, সব ব্যাপারেই আমাকে ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়তে হল। ‘ভীষণ’ শব্দটা ভেবেচিন্তেই ব্যবহার করছি। এজেন্ট এবং পাঠকপাঠিকাদের সব চিঠি পড়তাম। এজেন্টদের চিঠির জবাব দিয়ে বিপ্লবকে সেইমত ব্যবস্থা নিতে বলতাম। চিফ ডিস্ট্রিবিউটর শ্রীচন্দ্র পারিজার সঙ্গে পত্রিকার হয়ে যাবতীয় কথাবার্তা বলতে হত। প্রায় সব লেখা দেখেশুনে প্রেসে পাঠাতে হত। বত্রিশ পৃষ্ঠারই প্রুফ একা দেখতাম। আর্টিস্ট হরিমোহন লে-আউট করার আগে প্রত্যেক পৃষ্ঠা নিয়ে ওর সঙ্গে বসতাম। এজেন্টরা এলে কথা বলতাম। কাগজ কেনা এবং পত্রিকা ঠিকমত সব জায়গায় যাচ্ছে কিনা, সেসবও আমাকেই খোঁজ নিতে হত। সব দেখেশুনে সুপ্রিয় সেন মন্তব্য করেছিলেন, ‘দি গ্রেটেস্ট ওয়ান ম্যান শো অন দ্য আর্থ!’

দ্বিতীয় সংখ্যা ছাপা হল বাইশ হাজার। তৃতীয় সংখ্যা তিরিশ হাজার। এবং আমাদের নিজেদেরও চমকে দিয়ে সপ্তম সংখ্যার প্রিন্ট অর্ডার হল চুয়াল্লিশ হাজার।

প্রথম মাস দুয়েক সঙ্গে বিপ্লব ছাড়া আর কেউ ছিল না। তারপর দুজন রিপোর্টারকে নেওয়া হল। মুকুল দত্ত পাঠালেন একটা ছোট্টখাট্ট ছেলেকে। ওকে পাটনায় দেখেছিলাম বটে। এর মধ্যেই একটা ছোট খেলার পত্রিকায় ভয়ঙ্কর কিছু লেখা আর ইন্টারভিউ ছেপে হইচই বাধিয়েছে। বিপ্লব অবশ্য ছেলেটিকে ভালমতই চিনত। এবং কী আশ্চর্য, এই ছেলেটির প্রথম দেড় মাস বিপ্লবের প্রথম দিকের মতই নিদারুণ হতাশ করেছিল। একদিন বলেই ফেললাম, ‘সরোজ, জার্নালিজম যদি করতেই হয়, বিশেষত স্পোর্টস ম্যাগাজিন, এই আলগা উদাস ভাবটা ছাড়ো। তোমাকে নিয়ে কাজ করতে আমার একটুও ভাল লাগছে না।’

মনের দুঃখেই কিনা কে জানে, পরদিন সরোজ অফিসে এল না। বিপ্লবকে বললাম, ‘আমার বকুনি সহ্য হল না, কেটে পড়ল বোধহয়। ভালই হয়েছে, অন্য ভাল ছেলে নিতে হবে এবার।’

কিন্তু সরোজ চক্রবর্তী হাজির একদিন ফ্রেঞ্চ লিভের পর। মনে হল আমি যে কিছু বলেছি, তা ভুলে গেছে! ঠিক মনে পড়ছে না, ওকে লাইনে আনার জন্য আমাকে পাঁচ থেকে আটবার কড়া বকুনি দিতে হয়েছিল।

এক বছরের মধ্যে সরোজ নিজেকে অদ্ভুতভাবে পাল্টে নিল। এমনিতে একইরকম, কিন্তু খবরের পেছনে ছোটার ব্যাপারে অস্বাভাবিক জেদ ওকে পেয়ে বসল। এই জেদ ছাড়া ভাল রিপোর্টার হওয়া যায় না।

সরোজের কষ্টসহিষ্ণুতাও তুলনাহীন। একবার বোধহয় ডুরান্ড কভার করতে যাওয়ার সময় ট্রেনে রিজার্ভেশন পায়নি। প্রায় গোটা পথই নাকি বাথরুম (টিকিট একজামিনার আসার সময়) আর করিডরে কাটিয়ে দিয়েছিল। দুশো টাকায় বরদলুই ট্রফি কভার, তিনশোয় ডুরান্ড কভার, চারশোয় রোভার্স কভার— এসব সরোজের পক্ষেই সম্ভব ছিল। এবং সেখানেই আমার ভয়, ওর তেজ আর জেদটা না ঘুমিয়ে পড়ে! সরোজের মতো ভাল রিপোর্টার পাওয়া অবশ্যই কঠিন। ওর মতো কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলেও সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

প্রসূন পাঠিয়েছিল একটি ছেলেকে, যার একটা বিপ্লবী রাজনীতির ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। নীরব রায় অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারত। কিছু নতুন চিন্তাও হাজির করত। রিপোর্টার হিসাবে ওর প্রথম কাজটাই ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। পুজোর আগে ‘খেলার কথা’র একটা বিশেষ সংখ্যা বেরিয়েছিল প্রথম বছরেই। তার কাজে এত ডুবে গেলাম যে শ্রীনগরে সন্তোষ ট্রফির আসরে হাজির থাকার ইচ্ছা ত্যাগ করতে হল। নীরব গেল। আনকোরা রিপোর্টার, প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট— ন্যাশনাল ফুটবল। দারুণ ভাল কাজ করে এসেছিল নীরব। লেখাটা একটু সাজিয়ে নিয়েছিলাম আমি, যা সম্পাদকের কাজ। কিন্তু লেখাটাকে সফল করেছিল নীরবের আন্তরিকতা।

তারপর আর একজনও এল— রতন ভট্টাচার্য, যার সঙ্গে ঢাকুরিয়া ব্রিজের ওভারব্রিজে বসে জীবনের প্রথম এক হাজার সিগারেটের অন্তত এক তৃতীয়াংশ পুড়িয়েছি। দুজনে একসঙ্গে লাইন দিয়ে অনেক ফুটবল ম্যাচ দেখেছি, লাগাতার ক্যারম খেলে আঙুল ব্যথাও করেছি প্রচুর। কিছুটা আকস্মিকভাবেই ও ‘খেলার কথা’য় এল। সেই থেকে আমাদের সঙ্গেই আছে। খেলোয়াড়দের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ, বেশ ভাল নিউজ সেন্স এবং নিষ্ঠা— এগুলিই রতনের প্লাস পয়েন্ট। মাইনাস পয়েন্ট? একটু বেশি ঝাল খেলেই পেটখারাপ ও কাজের ক্ষতি।

‘খেলার কথা’র প্রথম সংখ্যা থেকেই অমল দত্তকে পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর ‘আধুনিক ফুটবল’ ধারাবাহিক রচনাটি যথেষ্ট সমাদর পেল। আর একটি ধারাবাহিক রচনা— শৈলেন মান্নার আত্মজীবনী ‘মাঠই জীবন’। এক বিরাট ফুটবলারের বিনম্র স্মৃতিচারণ। এমনভাবে লিখে গেলেন যেন তাঁর সময়ের বটবৃক্ষদের পাশে তিনি ছিলেন নেহাতই এলেবেলে ছোটমাপের গাছ। একটু বয়স্ক পাঠকেরা বললেন, ‘মান্নার লেখা মান্নার মতই, বড্ড বেশি ভদ্র।’

আন্তর্জাতিক ফুটবলের একেবারে টাটকা সব খবর ‘খেলার কথা’র পাঠক পাঠিকাদের কাছে পৌঁছে দিলেন জি সি দাস। ব্যবসার সূত্রে তাঁকে বছরের অর্ধেকের বেশি সময় কাটাতে হয় ইউরোপের বিভিন্ন শহরে এবং ব্যবসার বাইরে তাঁর একটাই উৎসাহ— ফুটবল খেলা দেখা। বিশেষত পশ্চিম জার্মানির ফুটবলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এতই ঘনিষ্ঠ যে পল ব্রাইটনারের মতো সুপারস্টারও তাঁকে চেনেন। বিদেশ থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে তিনি রিপোর্ট পাঠান। যখন দেশে ফেরেন, সঙ্গে থাকে অনেক খবর আর ছবি। এবং কী মধুর, দামি সিগারেট, লাইটার ইত্যাদি।

‘খেলার কথা’য় ফটোগ্রাফার হিসেবে প্রথম থেকেই ছিল প্রদীপ সোম আর জয়ন্ত শেঠ। তারপর জয়ন্তর ভাই শ্রেণিক এল। পি কে চৌধুরিও এলেন। আর এলেন শান্তি সেন। মেটাল বক্সে চাকরি করেন। ছবি তোলার ভয়ঙ্কর নেশা ভদ্রলোককে মাঠে টেনে আনল। সেই যে এলেন, আর বেরোতে পারলেন না। একটাই দোষ, বড্ড বেশি ভদ্র। হয়ত একটা ছাপা হবে, তুলে ফেললেন চল্লিশটা ছবি। ফুটবলারদের সঙ্গে শান্তি সেনের অন্তরঙ্গতাও দেখার মতো। শ্যামল ঘোষ বা চিন্ময় বা বিদেশের বিয়ে, গৌতমের বোনের বিয়ে, শিবাজীর ছেলের জন্মদিন, পি কে ব্যানার্জির মেয়ের জন্মদিন— কোনও উৎসবই যেন শান্তি সেনের ছবি তোলা ছাড়া সম্পূর্ণ হতে চাইত না।

‘খেলা কথা’র শুরু থেকেই ফুটবলারদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। দুটো কারণ এর পেছনে কাজ করেছিল। প্রথমত, অন্তরঙ্গ স্পোর্টস ম্যাগাজিনের প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রয়োজনে জনপ্রিয় ফুটবলারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জরুরি ছিল। এবং দ্বিতীয়ত, ওই আটাত্তরেই ফুটবলাররা একটা বড় সঙ্কটে পড়ল। ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট ফুটবলারদের অস্বস্তির মধ্যে ফেলল এবং সেই সুযোগটা কিছু পত্রপত্রিকা নিতে চাইল। যে মধ্যবিত্ত যুবকেরা কঠিন সংগ্রাম ও সাধনার পর ফুটবল খেলে কিছুটা সমৃদ্ধি পরিবারে এনে দিচ্ছে, তাদের বিপদে ফেলার জন্য দু-তিনজন লেখক উঠে পড়ে লাগলেন। মোহনবাগানের ফুটবলাররা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন— কোনও পত্রিকায় ইন্টারভিউ বা ছবি দেবেন না। ‘সানডে’ পত্রিকার একটা সংখ্যা দুমড়ে মুচড়ে আমার হাতে দিয়ে মহম্মদ হাবিব বলেছিলেন, ‘আমরা এত মেহনত করে ফুটবল খেলে গেলাম, এই তার ইনাম?’

তারপর সুরজিতের সঙ্গে কথা বললাম। কথা বললাম প্রসূন আর শ্যামের সঙ্গেও। আনন্দবাজার গোষ্ঠীরই ‘দেশ’ পত্রিকায় আমার একটি লেখা প্রকাশিত হল— ‘ফুটবলারদের বিরুদ্ধে’। এক সাংবাদিক বন্ধু যিনি ফুটবলারদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগার দলে প্রবলভাবেই ছিলেন, ওই লেখাটির নাম দিলেন ‘ক্যালকাটা ফুটবলার্স ম্যানিফেস্টো’।

এর মধ্যে এক সংখ্যায় শুরু হল ‘ফুটবলারের কলম’। প্রথমে সুরজিৎ সেনগুপ্ত। তারপর অন্যরাও এল।

ফুটবলারদের মধ্যে আমার প্রথম ঘনিষ্ঠতা হয় শ্যাম থাপার সঙ্গে, উনিশ শো ছিয়াত্তরে। সাতাত্তরে মোহনবাগানে গিয়ে প্রথম দিকে খেলতে পারছিল না। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল লিগ ম্যাচের আগের দিন জেনে গিয়েছিল, প্রথম টিমে নেই। উদভ্রান্ত ও হতাশ শ্যাম সেদিন স্কুটারে অন্তত তিরিশ কিলোমিটার ঘুরেছিল প্রচণ্ড গতিতে, পেছনে আমি। আমি বলেছিলাম, ‘শ্যাম তুমি মোহনবাগানেরও হিরো হবে, দেখে নিও।’

শিল্ড ফাইনালে ওর গোল মোহনবাগানকে এক অভূতপূর্ব ফাইট ব্যাকের রাস্তায় এনে দিল। ত্রিমুকুট, লিগ হারানোর পরেও। রোভার্সে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে দুটি গোলই শ্যামের। আটাত্তরে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল লিগ ম্যাচে শ্যাম দুর্দান্ত ব্যাকভলিতে গোল করতেই এক সমবয়সী সাংবাদিক বন্ধু বলেছিলেন, ‘তোমার শ্যাম তো কাঁপিয়ে দিল।’ হ্যাঁ, আমার শ্যাম।

সুরজিতের সঙ্গে আলাপ ওই ছিয়াত্তরেই। চিত্রজগতের পক্ষ থেকে ওকে বলেছিলাম, ‘আগামী রবিবার আপনার বাড়িতে আমাদের ফটোগ্রাফার যাবে, কিছু ঘরোয়া ছবি তোলার জন্য।’ দুর্বোধ্য হাতের লেখায় কসবার বাড়ির (নাকি কাঁকুলিয়ায় সুরজিতের শ্বশুরবাড়ির?) ঠিকানা লিখে নিল প্রদীপ সোম। তার আগে আমাকে বেশ কষ্ট করতে হল সুরজিৎকে এই ধরনের ঘরোয়া ছবির ব্যাপারে রাজি করাতে।

যখন আমি নেহাতই শখের সাংবাদিক, তখন প্রদীপ সোম আমাকে যে হারে সহায়তা করেছে, তার তুলনা নেই। আমি মাঠ-ময়দানে গেলেই ও সঙ্গে থাকত। প্রদ্যুৎ দত্ত নাম দিয়েছিলেন ‘বাঁয়া তবলা’! কিন্তু প্রদীপ ওই রবিবার সুরজিতের বাড়ি গেল না। আমার তো যাওয়ার কথাই ছিল না।

তখনও সুরজিতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়নি। পরে একদিন ইস্টবেঙ্গল টেন্টে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলাম। প্রদীপও জানাল, কেন সেদিন যেতে পারেনি। সুরজিৎ কিছুই বলল না। কিন্তু ব্যাপারটা যে ওর ভাল লাগেনি, বুঝতে অসুবিধা হল না।

সাতাত্তরের জানুয়ারিতে ছিয়াত্তরের সন্তোষ ট্রফির আসর বসল পাটনায়। সুরজিৎ ক্যাপ্টেন। আমি পাটনা পৌঁছেই প্রিন্সেস হোটেলে। এবং হোটেলে ঢুকেই— ‘কোথায় শ্যাম?’

সেদিন বিকেলে বাংলার খেলা। শ্যাম ওর প্রিয় জিনিস ঘুমে ডুবে ছিল অথবা ডোবার চেষ্টা করছিল। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল না। বাইরেই দেখা সুরজিতের সঙ্গে। দায়িত্বশীল অধিনায়ক বললেন, ‘শ্যাম বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি দেখছি।’ সুরজিতের মুখে আমার নাম শুনেই ধড়মড় করে উঠে বসল শ্যাম, ঘুম বিতাড়িত হল ঘণ্টা দেড়েকের জন্য।

পাটনাতেও সুরজিতের সঙ্গে তেমন বন্ধুত্ব হল না। বরং চিন্ময়, প্রশান্ত, বিদেশ, রতন দত্ত, শ্যামল ঘোষ, রঞ্জিত মুখার্জির সঙ্গে তখন অনেক ঘনিষ্ঠতা।

সাতাত্তরের এপ্রিলের এক সন্ধ্যায় হঠাৎই আমি আর সুরজিৎ একান্তে কথা বলি টানা তিন ঘণ্টা। হঠাৎ দেখা, তারপর আড্ডা। ওই তিন ঘণ্টাই আমাদের দুজনকেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল, অতঃপর সপ্তাহে অন্তত দুদিন আমাদের দেখা করতেই হবে, পারলে সাত দিন। তারপর থেকে, গত সতের বছরে আমার কোনও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত সুরজিতের সঙ্গে কথা না বলে নিইনি। সুরজিৎও নেয়নি।

একটা ব্যাপারে অবশ্য জোর মতভেদ হয়। ‘মহম্মদ হাবিব সমীপেষু’ লেখাটি একই সঙ্গে প্রচণ্ড প্রশংসা এবং সমালোচনা কুড়িয়েছিল। ফুটবলারদের মধ্যে দুজন প্রতিবাদ করেছিল। সুরজিৎ সেনগুপ্ত এবং সুভাষ ভৌমিক। চার-পাঁচজন বিখ্যাত ফুটবলার লেখাটির জন্য আমায় আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছিল। তাদের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে ওই ‘সমীপেষু’ জাতীয় একটি লেখার ইচ্ছা মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করেছে। না, লেখা হয়নি।

সুভাষ ভৌমিকের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূচনা শান্ত মিত্রর অফিস চেম্বারে। আগে মুখচেনা ছিল বড জোর। সেদিন ওর বক্তব্যের একটাই বিষয়বস্তু ছিল— মহম্মদ হাবিব। সুভাষ বলেছিল, ‘আমাদের মতো ফুটবলার দেশে অনেক আছে, থাকবে। মহম্মদ হাবিব ওই একজনই। আপনার লেখাটায় ধার ছিল, কিন্তু আমার পক্ষে একটুও একমত হওয়া সম্ভব নয়।’

সেই শুরু। ‘আপনি’র খোলস ছাড়তে সময় লেগেছিল এক মাস। এখনও হাবিব মাঝে মধ্যে ফিরে আসেন আমাদের আলোচনায়। একজন সমসাময়িক ফুটবলারের প্রতি এমন শ্রদ্ধা আর দেখিনি।

ব্যক্তিগত বন্ধুর তালিকায় প্রদীপ চৌধুরির নাম যুক্ত হল উনিশশো ঊনআশিতে, যখন ওর ফ্ল্যাটের কাছাকাছি ছিলাম, প্রায় দেড় বছর। সস্ত্রীক প্রদীপ, সুভাষ আর আমি— ছয়জনে মিলে গভীর আড্ডায় বহু সন্ধ্যাকে গভীর রাতের দিকে নিয়ে যাওয়া গেছে।

প্রসূন আর সুব্রতর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার শুরু আটাত্তরে, মোহনবাগান ফুটবলারদের তথাকথিত প্রেস বয়কটের সময়টায়। ওই বছর ইস্টবেঙ্গলের ক্যাপ্টেন সুরজিৎ, মোহনবাগানের প্রসূন। ‘খেলার কথা’র প্রথম সংখ্যায় দুজনের ইন্টারভিউ একসঙ্গে একটা লেখায় ধরলাম— ‘এক টেবিলে দুই ক্যাপ্টেন’। প্রথম থেকেই চিন্তা ছিল, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল রেষারেষির মধ্যে একটা সুস্থতার হাওয়া ছড়িয়ে দিতে হবে। ওদের দুজনের বন্ধুত্বকে হাইলাইট করার সিদ্ধান্তটাও সেই চিন্তা থেকে এসেছিল। ইস্টবেঙ্গল টেন্টে এক সকালে প্রসূন বেড়াতে এলে কয়েকটা ছবিতে দারুণভাবে তা ধরে রেখেছিল প্রদীপ সোম।

সুব্রতর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় উনিশশো ঊনআশির ন্যাশনালে কোয়েম্বাটোরে। রাত দেড়টা- দুটো বেজে যেত, সুব্রত অন্তরঙ্গ হয়ে উঠত কথায় আর গানে। বাইরের রুক্ষতার আড়ালে একটা নরম মনের খবর তখনই পেয়েছিলাম।

মানিকজোড় ভাস্কর-চিন্ময়ের সঙ্গে কখনই ‘বন্ধুত্ব’ হয়নি। তবে, সুরজিতের মতই দাদা হিসেবে ভাস্করের হাতে আদরের মার খেতে হয়েছে প্রচুর। এবং চিন্ময়ের অবিরাম টিপ্পনীর টার্গেট। আমি আর সুরজিৎ একসঙ্গে থাকলে অবশ্য চিন্ময়ের খুবই অসুবিধে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতজোড় করে বলত, ‘একসঙ্গে দুজনের সঙ্গে পারব না।’ ভাস্করের পেছনে বেশি লাগা সম্ভব ছিল না, প্রাণের ভয় কার নেই!

মোহনবাগানের মানিকজোড় মানস-বিদেশকেও ভাল লাগে প্রথম থেকেই। শিবাজী ব্যানার্জির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে কটক-রাউরকেল্লার ন্যাশনালে। প্রশান্ত ব্যানার্জির বিরুদ্ধে কড়া কথা লিখেছিলাম ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখায়। আদর্শ খেলোয়াড়ের মতই ব্যাপারটা নিয়েছিল প্রশান্ত। সাতাত্তরের ইস্টবেঙ্গল টিমের শ্যামল ব্যানার্জি, রতন দত্ত, রমেন ভট্টাচার্য, সত্যজিৎ মিত্র, উলাগানাথন, রণজিৎ মুখার্জি— প্রত্যেককেই নিজের লোক মনে হত, মনে হয়।

শ্যামল ঘোষ আর সমরেশ চৌধুরি গভীর বন্ধু হলেও দুজনের মধ্যে মিল কম। শ্যামল সম্পর্কে প্রথম এবং শেষ কথা— ‘ভাল ছেলে’। পিন্টুর রসিকতাটাই সব কিছু ছাপিয়ে যায়। পিন্টুর রসিকতার অন্তত একশো একটা গল্প আমি জানি। সুযোগ পেলে একদিন শোনাব। আর শ্যামল ঘোষ? আমার তো ওর প্রশিক্ষণে থাকা ফুটবলারদের ভাগ্যবান মনে হয়, এমন আদর্শ ফুটবলারকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে গেছে। শ্যামলের মতো আর একটা ছেলে কলকাতা ময়দানে কবে আসবে?

তারপর কলকাতার অধিকাংশ ফুটবলারের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। ধীরে ধীরে সম্পাদকের টেবিলে এবং চেয়ারে আটকে যাওয়ায় এই দায়িত্বটা পরের দিকে তরুণতর সহকর্মীদেরই নিতে হচ্ছে। বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যর সঙ্গে প্রথম কথা বললাম রাউরকেল্লায়। ন্যাশনালের সময়। কার্তিক, অলোকের সঙ্গে প্রথম কথা বললাম অনেক পরে বাঙ্গালোর ক্যাম্পে, ব্রেকফাস্টের টেবিলে।

ক্রিকেটারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পেছনে কিন্তু এক বিন্দু পরিকল্পনা ছিল না। আটাত্তরের এক জুলাই সন্ধ্যায় কাস্টমস টেন্টে বসে সম্বরণ ব্যানার্জি জানাল, ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তারা কী কী অন্যায় করেছেন, কেন ওদের ক্লাব ছাড়তে হতে পারে। সম্বরণের সঙ্গে ছিল বরুণ বর্মন। সেই জল অনেকদূর গড়াল।

একদিন সম্বরণই বলল, ‘আপনারা কলকাতার ক্রিকেটকেও ভালভাবে পাঠক-পাঠিকাদের সামনে আনছেন না কেন?’ চিন্তাটা বেশ কিছুদিন ধরেই মাথায় ঘুরছিল। অতঃপর কলকাতার ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করার কাজে নেমে গেলাম। সম্বরণ আর পলাশ এই কাজে খুব সাহায্য করল।

পলাশ নন্দীকে আমার মনে হয় শ্যামল ঘোষের ক্রিকেট সংস্করণ। এত বড় ব্যাটসম্যান, এক কণা অহঙ্কার নেই। তবে, তেজ-জেদ শ্যামলের দশগুণ। আর সম্বরণের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল ওর উৎসাহ, যেটা নিজের টিমে ও দারুণভাবে ছড়িয়ে দিতে পারে। বরুণ বর্মন, শ্রীমন্ত ব্যানার্জি, মলয় ব্যানার্জি ও প্রদীপ পাণ্ডের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। প্রথম আলাপের দিনই পার্স থেকে গাভাসকারের ছবি বার করে কপালে ঠেকিয়ে প্রদীপ পাণ্ডে বলেছিল, ‘আমার গুরু’।

গোপাল বসুর নামটা আলাদাভাবে বলা উচিত। এমন ভদ্র, হৃদয়বান ও বুদ্ধিমান ক্রিকেটার ভারতবর্ষে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এখনও পর্যন্ত গোপালের মুখ দিয়ে কোনও ক্ষোভের কাহিনী টেনে বার করতে পারেননি কোনও সাংবাদিক। যোগ্যতা ও ফর্ম থাকা সত্ত্বেও যেভাবে ওকে টেস্ট ক্রিকেটের দরজা থেকে একদিন ছিটকে চলে আসতে হয়েছিল, তা দুরন্ত লেখার বিষয়বস্তু হতে পারে। গোপাল মুখ খোলেননি সেভাবে। ভালই হয়েছে। সাবজেক্টটা হয়ত আমার জন্য রাখা আছে। লক্ষ্য রাখতে হবে, লোহাটা কখন লাল হয়।

ক্রিকেটারদের ব্যাপারে সব অভিজ্ঞতাই অবশ্য মধুর নয়। সাতাত্তরে ইস্টবেঙ্গলের একটা ম্যাচ দেখেছিলাম, উইকেট বরাবর রোলারের বাঁদিকে বসে। রোলারটার ওপর এবং ঠিক ডানদিকে বসে ও দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে দেখতে কথা বলছিল ইস্টবেঙ্গলের তিনজন ক্রিকেটার। একজনের মুখ থেকে যে ভাষা অনর্গল বেরিয়ে আসছিল, কলকাতার কুখ্যাত কোনও ফুটবলারের মুখেও এমন ভাষা কেউ কখনও শুনেছে কিনা সন্দেহ। ওই ক্রিকেটারটি জোনাল ক্রিকেট পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ভাগ্যিস আর ওঠেনি। ওই ভাষার ছিটেফোঁটাও কানে গেলে মনঃসংযোগ নষ্ট হতই এবং সানি গাভাসকার চৌত্রিশটা টেস্ট সেঞ্চুরি পেতেন না।

‘খেলার কথা’র এক বিশেষ ক্রিকেট-সংখ্যার কথা বিশেষভাবেই উল্লেখ করা দরকার। ওই সংখ্যার চারটি দুরন্ত ছড়া লিখেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অমিতাভ চৌধুরি এবং পূর্ণেন্দু পত্রী। প্রেমেন্দ্র মিত্রর ছড়াটির নাম ছিল ‘খেলার কথা’।

খেলার কথার প্রথম বছরেই একটা লড়াই শুরু হয়ে যায়। লড়াইটা এত দীর্ঘস্থায়ী হবে তা অবশ্য প্রথম দিকে বোঝা যায়নি। সাতাত্তরে ইস্টবেঙ্গল ফুটবল এবং ক্রিকেট লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল অমল দত্ত আর সুজিত বসুর প্রশিক্ষণে। নবনির্বাচিত কর্মকর্তারা এসেই এই দুজনকে খারিজ করেছিলেন। আটাত্তরের মরসুম যখন মাঝপথে, শিল্ড শুরুর আগেই জানা গেল, পরের মরসুমের জন্য অনেক বাইরের ফুটবলার আনার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেছে। ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলাররা যখন ব্যাঙ্কক পোর্ট অথরিটি এবং যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে গুয়াহাটিতে বরদলুই ট্রফি তুলছে, পাঞ্জাবের গুরদেব সিং কলকাতার গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে দু- চারদিন থেকে গেলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের পয়সায়। একে একে আরও অনেক নাম ঘোষিত হল। কেন ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তারা এমন করলেন? এক কর্মকর্তা বললেন, ‘সহজ ব্যাপার, ট্রফি পাওয়ার জন্য।’

উনিশশো আটাত্তরের ওই বরদলুই ট্রফি থেকেই কর্মকর্তারা কিছু সমস্যার মধ্যে পড়ে গেলেন। দারুণ খেলে ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল জিতল ৪-২ গোলে। সুরজিৎ আর মিহির দুটি করে গোল করল। শিল্ডে দারুণ লড়ে ইস্টবেঙ্গল শেষ মুহূর্তের গোলে হার মানল, সোবিয়েত রাশিয়ার আরারাতের কাছে। এবং ডুরান্ডের ফাইনালে তুলনাহীন সুরজিতের নেতৃত্বে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয় (৩-০)।

ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তারা এটা ভাবতেই পারেননি। এই অবস্থায় সুরজিৎদের আদর করে ধরে না রাখলে সমর্থকদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়, আবার বাইরের ফুটবলারদের আনার সিদ্ধান্তও পাকা। ট্রফি পাওয়ার জন্য বাইরের ফুটবলারদের আনার যুক্তি আর ধোপে টিকছিল না। আসল কারণটা জানা গেল কয়েকদিন বাদে।

নাকতলায় সুপ্রিয় সেনের বাড়িতে বসে ইস্টবেঙ্গলের ট্রেজারার হরিপদ দাস অনেক কথার মাঝখানে হঠাৎ বলে ফেললেন, আসলে কলকাতার বেড়ে-যাওয়া ফুটবলারদের ‘টাইট’ দেওয়ার জন্যই বাইরের ফুটবলারদের আনা হচ্ছে। ওরা প্রচুর টাকা নেবে, খেলবে, দেশে ফিরে যাবে। ক্লাবের প্রতি ভালবাসার কথা বলে কোনওরকম প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।

প্রথম থেকেই বলে এসেছি, অন্য রাজ্য থেকে ফুটবলাররা আসুক, আমরাও তা চাই। কিন্তু কলকাতার ছেলেদের ‘টাইট’ দেওয়ার জন্য অত বেশি সংখ্যায় ফুটবলার আমদানি করা অন্যায়। কেউ কেউ ব্যাপারটা বুঝতে চাইলেন না। আমার ‘কেন এত বাইরের ফুটবলার?’ লেখাটি পঞ্চাশের দশকের এক বিখ্যাত ফুটবলারকে পড়িয়েছিলাম। তাঁর বক্তব্য জুড়ে দিয়ে এই ভাবে লেখাটি শেষ করা হয়েছিল: ‘তোমার এই লেখাটি বাঙালি সঙ্কীর্ণতায় ভরা, এ কথা অস্বীকার করতে পার?’

‘না, অস্বীকার করি না, বরং প্রার্থনা করি, এই সঙ্কীর্ণতা যেন আমার কলমের ডগায় চিরকাল লেগে থাকে।’

লড়াইটা চলছিল, ভয়ানক সঙ্ঘর্ষ শুরু হল ঊনআশির দলবদল শেষ হতেই। ইস্টবেঙ্গলের অকৃতজ্ঞ কর্মকর্তারা পিন্টু চৌধুরিকে বিতাড়িত করলেন। বিনা পারিশ্রমিকে ক্লাবের সেবা করতে চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হল সাতবারের লিগ বিজয়ী টিমের অপরিহার্য ফুটবলার।

পিন্টু যেদিন মহমেডান স্পোর্টিংয়ে সই করল, সেদিন বিকেলে প্রেসে আমার লেখা পাঠানোর কথা। পাকা খবরটা আগের দিনই পেয়েছিলাম। তাই দুপুর সাড়ে এগারোটা নাগাদ ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার হেড অফিসে গেলাম পিন্টুর সঙ্গে কথা বলে নেওয়ার জন্য। দলবদলের ওপর লেখা, পিন্টুর বক্তব্য থাকা দরকার। ওকে পাওয়া গেল না। অপেক্ষা করা সম্ভব নয়, কারণ সেইদিন বিকেলেই লেখা পাঠাতে হবে। শ্যামল (ঘোষ) বলল, ‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন, পিন্টু অফিসে ফিরবেই। আপনাকে ওর অনেক কিছু বলার আছে।’

পলাশ নন্দীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। পিন্টু ফিরল। এবং তারপর ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে যে ইন্টারভিউ দিয়েছিল, তা একই সঙ্গে আমার এবং আমাদের পত্রিকার ভাগ্যকে অনেকটা নতুন খাতে নিয়ে গেল। বিপ্লবকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে লেখা শেষ করেছিলাম। বিপ্লব বিকেলে লেখাটা প্রেসে পৌঁছে দিয়েছিল। আমি একটা করে পৃষ্ঠা নিয়ে প্যাড থেকে খুলে পেপারওয়েটের নিচে রাখছিলাম, বিপ্লব পড়ে যাচ্ছিল। শেষের দিকে ওর আগ্রহ এত বেড়ে যাচ্ছিল যে এক সঙ্গে তিন পৃষ্ঠা লিখে ফেললেই যেন ভাল হয়।

সেই সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দারুণ ব্যাপার। একদিনে ওই লেখার এবং পিন্টুর সমর্থনে তিনশো তিয়াত্তরটি চিঠি এল। তারপর— আরও অনেক। ওই চিঠির পাহাড়ের কিছু অংশ যখন মাস তিনেক পর পিন্টুর হাতে তুলে দিয়েছিলাম, পিন্টু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এত লোক আমাকে ভালবাসে?’

ক্রীড়াসাংবাদিকতার পাঁচ বছরে যতটুকু জনপ্রিয়তা অর্জন করা গেছে, আমার ধারণা তার অর্ধেকই এসেছিল ওই একটি লেখা থেকে। লেখার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে পেরেছিলাম। হয়ত।

ওই একটি লেখা এক ধাক্কায় ‘খেলার কথা’র প্রচার সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারে নিয়ে গেল। অল্পদিনের মধ্যেই অনিবার্য কারণে পত্রিকার দাম বাড়ল। কী আশ্চর্য, বিক্রিও বাড়ল।

এবং, ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসলেন। আগে ওঁরা ভাবতে পারেননি, একটা পাক্ষিক পত্রিকা এত জ্বালাতে পারে। বন্ধু ভাষ্যকার শিবাজী দাশগুপ্ত মারফত কিছু সন্ধি প্রস্তাব এল। তারপর, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য মহান কর্মকর্তারা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললেন।

ওঁরা দুয়ে দুয়ে চার করে ফেললেন। ডাঃ নৃপেন দাসকে শ্রদ্ধা করতাম। এবং ডাক্তারদার দুই একান্ত অনুগামী জীবন চক্রবর্তী এবং পল্টু দাসের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা সাতাত্তর থেকেই। কলকাতা ময়দানের হালচাল বুঝতে এবং বেশ কিছু ভেতরের খবর দিয়ে বিশেষত জীবন চক্রবর্তী সাংবাদিক জীবনের প্রথম পর্বে যেভাবে সাহায্য করছিলেন, তা কোনওদিনই ভুলতে পারব না। কিন্তু, ওঁদের জানিয়ে দিয়েছিলাম, নতুন কমিটি ভাল কাজ করলে আমাদের পত্রিকা তাকে অবশ্যই স্বীকৃতি দেবে। ইস্টবেঙ্গলের কিছু বিচিত্র কর্মকর্তা বললেন, পিন্টুর ব্যাপারে বা অন্য ব্যাপারে আমার সমালোচনার একটাই কারণ, ডাঃ দাসের গোষ্ঠীকে সরিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় আসছেন, তাঁদের সহ্য করতে পারছি না। তারপর তিন বছর ধরে অসংখ্য লেখায় নিশীথ ঘোষ এবং তাঁর অনুচরদের কীর্তিকাহিনী তুলে ধরলাম। ওঁদের সৌজন্যে লিখে গালাগালি দেওয়ার আর্টটা মোটামুটি রপ্ত হয়ে গেল।

উনিশশো আশির ফেব্রুয়ারিতে সুরজিৎ এবং ইস্টবেঙ্গলের আরও সাত ফুটবলার ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিল। ডেভিড উইলিয়ামের ক্লাব ছাড়ার কোনও কথা ছিল না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ডেভিড সুরজিতের কাছে গিয়ে বলে, তুমি যেখানে আমিও সেখানেই খেলব।’

‘সে কী, তুমি তো ট্রেজারার হরিপদ দাসের লোক।’

‘বাজে কথা। এ ম্যান ক্যান নট হ্যাভ টু মাস্টার্স। আমি তোমার লোক।’

সুরজিৎদের বিরুদ্ধে নানারকম অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলল। আমার দুই সহকর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। প্রতিবাদে ‘খেলার কথা’ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাল অফার নিয়ে এগিয়ে এলেন দীপ্তি প্রিন্টিং-এর দেবীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়। বিপ্লব আর নীরব থাকল। সরোজ আর রতনকে নিয়ে ‘খেলার কাগজ’ শুরু করলাম। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল ১ এপ্রিল, ১৯৮০।

নতুন পত্রিকায় ইস্টবেঙ্গলের অদ্ভুত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা বজায় থাকল। ‘খেলার কথা’ কর্তৃপক্ষ খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছিলেন, অতঃপর পত্রিকার আমূল পরিবর্তন ঘটানো হবে। সেইদিনই আনন্দবাজারের খেলার পাতার অন্যদিকে আর একটি বিজ্ঞাপন বেরোল— খেলার কাগজ-এর প্রথম বিজ্ঞাপন। তার পরের এক বছরে কী ঘটেছে, খেলার পত্রিকার পাঠকপাঠিকা মাত্রই জানেন।

উনিশশো আশির গোটা মরসুম ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তারা আমাদের বিপদে ফেলার জন্য নানারকম চেষ্টা করে গেলেন। ঊনআশিতে পিন্টু চৌধুরি সংক্রান্ত লেখার সূত্রে মামলা করার হুমকি দিয়ে উকিলের চিঠি পাঠিয়েছিলেন হরিপদ দাস। ‘এক সপ্তাহের মধ্যে দুঃখপ্রকাশ না করলে মামলা করতে বাধ্য হব।’

কয়েক সংখ্যা বাদে দুঃখপ্রকাশ করলাম, দুঃখপ্রকাশ না করা সত্ত্বেও হরিপদ দাস-রা মামলা করলেন না বলে! নিশীথ ঘোষ নাকি মামলার ব্যাপারে একটুও উৎসাহ দেননি, সাহায্য করেননি।— হরিপদবাবু আমার এক বন্ধুর কাছে দুঃখ করে বললেন।

এই সময়ে আমাদের সঙ্গে আন্তরিক সহযোগিতা করেছিলেন তখনকার ফুটবল সম্পাদক পরেশ সাহা। পরেশবাবু প্রকাশ্যেই বলতেন, ‘কলকাতার ছেলেদের বাদ দিয়ে কিছু হবে না।’ সুরজিৎদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে (প্রকাশ্যে অবশ্য অন্য বাজে কথা বলা হয়) তাঁকে ফুটবল সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। উনিশশো আশির গোড়া থেকেই পাদপ্রদীপের আলোয় দারুণভাবে এসে গেলেন সহ-সম্পাদক অরুণ ভট্টাচার্য। প্রথমে গুরদেব-মনজিৎ-হরজিন্দার তারপর মজিদ-জামশিদ-খাবাজিকে ট্যাঁকে রেখে চাপ সৃষ্টির রাজনীতির খেলা তিনি ভালই খেলছিলেন। যে পি কে ব্যানার্জি সেবার ইস্টবেঙ্গলকে ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচালেন, তাঁর বিরুদ্ধেও চক্রান্ত করতে অরুণবাবু দ্বিধা করলেন না। আমরা পি কে-র পক্ষে দাঁড়ালাম।

পি কে-র পক্ষে অবশ্য আমরা এর আগে এবং পরেও দাঁড়িয়েছি। ভারতীয় ফুটবল দলের দায়িত্ব নেওয়ার পরও যেসব অসুবিধায় তাঁকে ফেলা হয়েছে, আমরা তার স্বরূপ উদঘাটন করেছি। যথাসাধ্য লড়েছি। উনিশশো আশিতেই আনন্দমেলায় পি কে-র আত্মজীবনী ‘উইং থেকে গোল’ প্রকাশ শুরু হয়। পি কে-র বক্তব্যকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার দায়িত্ব আমাকেই দিতে চান ‘আনন্দমেলা’র সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। এত কাজের চাপ সত্ত্বেও রাজি হয়েছিলাম দুটি কারণে। এক, নীরেনদা বলছেন। এবং দুই, পি কে-র ব্যক্তিত্ব আমায় এতই টানে যে এমন একটা বড় কাজে তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে থাকার সুযোগ ছাড়তে চাইনি। প্রদীপদার বক্তব্য প্রথম দিকে নোট করতাম, পরে টেপরেকর্ডারের সাহায্য নিই। যা বলেন, তারপর আমার বিশেষ কিছু করার থাকত না। বলতে পারেন আমি পি-কে-র আত্মজীবনীর সম্পাদক।

উনিশশো আশিতে ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আমার এবং আমাদের যখন তুমুল লড়াই, সল্টলেকে নির্জন সন্ধ্যায় আমি আর পি-কে মুখোমুখি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তখন এমন অনেক কথা পি কে বলেছেন, যা ছেপে ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তাদের বিপদে ফেলে দেওয়া যেত। কিন্তু প্রদীপদাকে একবারও অস্বস্তিতে ফেলিনি।

একাশিতে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে অন্য ঝড় উঠল— শান্ত মিত্র বনাম মজিদ চক্র। এবারও যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম সারিতে আমরাই। তবে একথা বলে নেওয়া উচিত যে ততদিনে ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তারা সামান্য ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

মজিদ-খাবাজির হালচালে এবং অরুণ ভট্টাচার্যের প্যাঁচে নিশীথ ঘোষও তখন নাজেহাল। কিন্তু প্রকাশ্যে সে কথা স্বীকার করার অথবা পাল্টা কোনও ব্যবস্থা নেবার সাহস তাঁর ছিল না।

মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের পরদিন আনন্দবাজারে যখন কোচ শান্ত মিত্র মজিদের হাতে অপমানের এবং ইরানিদের অসহযোগিতার কথা লিখলেন, নিশীথ ঘোষ-সহ ইস্টবেঙ্গলের সব কর্মকর্তারই প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল: ‘মাথা গরম করে এমন কথা বলা বা লেখা শানুর (শান্ত মিত্র) উচিত হয়নি।’ মজিদের অন্যায়ের কথা অবশ্য ব্যক্তিগত কথাবার্তায় তাঁরা স্বীকার করলেন।

শান্ত মিত্র ইস্টবেঙ্গলে খেলেছেন আট বছর, সত্তরে অধিনায়ক ছিলেন। তাঁর সময়ে ইস্টবেঙ্গল চারবার লিগ পেয়েছে। ইস্টবেঙ্গল সদস্য-সমর্থকদের বড় অংশের সমর্থন কিন্তু শান্ত মিত্রের দিকে থাকল না। তাঁরা থাকলেন মজিদের দিকে, যিনি দুই বছর ইস্টবেঙ্গলে থেকে লিগ দিতে পারেননি, কিন্তু মদ্যপান করে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে প্র্যাকটিস করতে আসার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন।

শান্ত মিত্র সম্পর্কে কিছু অভিযোগ কলকাতা ময়দানে চালু আছে। যথা: তিনি খুব ধুরন্ধর লোক। (আসলে বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের গায়ে এই ধরনের লেবেল সেঁটে দিয়ে তৃপ্তি পান অপেক্ষাকৃত অল্পবুদ্ধির মানুষরা।) তাঁর সংগঠন ক্ষমতা অসাধারণ। এবং তিনি যে পরিচিতদের যে-কোনও সমস্যার সমাধানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েই রেখেছেন, একথাও সাধারণভাবে স্বীকৃত। প্রথম থেকেই শান্ত মিত্র অবশ্য একটি বিতর্কিত নাম। এবং ময়দানের বিতর্কিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হত খুব তাড়াতাড়ি।

আমারও ধারণা, বড় ম্যাচের পরের দিনই অমন বক্তব্য শান্ত মিত্র প্রকাশ্যে না রাখলে ভাল হত। শান্ত মিত্র একথা পরে স্বীকারও করেছেন। কিন্তু, এইসঙ্গে একথাটাও বলে রাখা দরকার যে, তিনি একচুলও বাড়িয়ে বা বানিয়ে বলেননি।

অতঃপর শান্ত মিত্র যা করেছেন বা বলেছেন, আগে আমাদের দুজনের মধ্যে আলোচনা করে নেওয়া হয়েছে। গভীর রাতেও টেলিফোন বেজেছে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে কোয়ালিটি অথবা ওয়েসিসের ঠাণ্ডা নির্জনতায়। এই সময়টায় সুভাষ ভৌমিকও শান্ত মিত্রর সঙ্গে দারুণভাবে ছিল। লড়াইটা জমার মুখে ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তারা সন্ধির ভঙ্গিতে বললেন, শান্ত মিত্র ঠিকই বলেছেন, দোষ মজিদেরই, কিন্তু মরসুমের মাঝখানে কিছু করলে পরের ট্রফিগুলোয় আর কিছুই করা যাবে না। ইস্টবেঙ্গলের আঠার বছরের সুখদুঃখের সঙ্গী শান্ত মিত্রর পক্ষে এই যুক্তিটিই যথেষ্ট ছিল।

শান্ত মিত্র তাঁর অফিসে এক ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন একদিন, ‘হয়ত নাম শুনেছেন, ইনি সুবীর ঘোষ। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’

সুবীর ঘোষ পরপর কয়েকদিন এলেন। ফুটবল সম্পাদক প্রশান্ত ঘোষও এলেন। সুবীরবাবু অনেক কথার মধ্যে কয়েকটা কথা বেশি করে বললেন: ‘দাদাও (নিশীথ ঘোষ) বুঝছেন, বিরাট ভুল হয়ে গেছে। বাইরের ফুটবলারদের মাথায় তুলতে গিয়ে তিন বছরে ক্লাবের অনেক সর্বনাশ হয়ে গেছে। সামনের বার আমরা ঘরের ছেলেদের নিয়েই টিম করব। আপনি সহযোগিতা করুন।’

আমি কীভাবে সহযযোগিতা করব? ওঁরা বললেন, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের বিরুদ্ধে অবিরাম সমালোচনা বন্ধ করলেই সহযোগিতা করা হবে। বিরাশিতে ঘরের ছেলেদের গুরুত্ব না দিলে আবার আক্রমণ করতে তো বাধা নেই— এই যুক্তি ওঁরা দিলেন। শান্ত মিত্রও বললেন, ‘আমাকে হয়ত চলে যেতে হল, কিন্তু ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে আমার সংগ্রামের পর একটা পরিবর্তন আসছেই। সামনের বছর বাইরের ফুটবলারদের মাথায় তোলা হবে না, এটা লিখে নিতে পারেন।

ওদিকে সহ-সম্পাদক অরুণ ভট্টাচার্য এবং তাঁর অনুচররা ক্লাবের দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারছিলেন না। ওঁদের বিরুদ্ধে আমাদের সমালোচনা অবশ্যই অব্যাহত থাকল। এবং একথাও পাশাপাশি বলে গেলাম যে, তিন-চার বছরের অধ্যায়ের যাবতীয় দায় অরুণ ভট্টাচার্যের ঘাড়ে চাপিয়ে নিশীথ ঘোষ নিষ্কৃতি পেতে পারেন না, কেননা তিনিই সাধারণ সম্পাদক, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সবচেয়ে ক্ষমতাবান কর্মকর্তা।

খবর নিয়ে জানা গেল, ভাস্কর-চিন্ময়-প্রশান্ত-মিহিরদের সঙ্গে কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়েছে, ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তারা বিরাশিতে সত্যিই ঘরের ছেলেদের গুরুত্ব দিয়ে টিম করছেন। অমল দত্তকে কোচ হিসেবে ফিরিয়ে এনে আটাত্তরের আর একটা অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্তও করা হল। কিন্তু শ্যামল ঘোষকে সসম্মানে ফিরিয়ে আনা হল না কেন?

শুধু ওপরের প্রশ্নটি নয়, অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয় আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে একথা সত্যি যে আটাত্তরের মাঝপথে যে লড়াই হয়েছিল, তা শেষ হয়ে যায়। আমরা জিতেছি, কেননা আমাদের বক্তব্য মেনে নিতে হয়েছে। ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তারাও জিতলেন, কারণ আমাদের বক্তব্য মেনে নেওয়ার ফলে চার বছর বাদে ইস্টবেঙ্গল লিগ পেল।

‘খেলার কাগজ’ পত্রিকার দুজন রিপোর্টার দরকার, সরোজ ও রতন ছাড়াও। মনীশ মৌলিক লিখত ‘খেলায় কথা’য়। লেখার হাত মন্দ নয়, ওকে নেওয়া হল। আর একজন?

মুকুল দত্তর বাড়িতে এক দুপুরে ভয়ানক খাওয়া-দাওয়ার পর আধশোয়া হয়ে গল্প করছি, হঠাৎ একটা ম্যাগাজিনের নিচে কিছু লিফলেট নজরে পড়ল। পাড়ায় দুর্গাপুজোর ব্যাপারে বোধহয় কিছু মতপার্থক্য ঘটেছে, একপক্ষের তীব্র আক্রমণমুখর বক্তব্য ওই লিফলেটে। বৌদি (মুকুলদার স্ত্রী) বললেন, ‘ওটা পাপুর লেখা।’

পাপু ওরফে পার্থ ওরফে ধীমান দত্ত তখন কুড়ি ছোঁয়নি। প্রেসিডেন্সি কলেজে স্ট্যাটিসটিক্সে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলে কী হবে, ওর মন পড়ে থাকে খেলার মাঠে। সুনীল গাভাসকারের জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে ধীমান, কিন্তু স্ট্যাটিসটিক্সের জন্য কিছু সময় দিতেও আপত্তি। ওর লেখা দেখে বুঝলাম, ঝাঁঝ আছে প্রচুর। একটু অন্য মশলা পড়লে আমাদের কাগজের কাজে আসবেই। মুকুলদাকে বললাম, ‘আপনার ছেলেকে নিচ্ছি।’

ধীমান খাটতে পারে প্রচণ্ড, লিখতে পারে খুব বেশি, কিন্তু সিগারেট খায় তার চেয়েও বেশি। ওর নিউজ সেন্সও অসাধারণ। শুধু একটাই দোষ। সাধারণভাবে আমরা যাকে সৌজন্য বলি, সেটা ওর ধাতে নেই। অনেকেই সে কারণে মর্মাহত হয়। অন্যের কথা কী বলব, মাঝে মধ্যে আমারই খারাপ লাগে। সাংবাদিকতা করতে এসে আর একটা বড় দোষ অবশ্য ধীমান কাটিয়ে ফেলেছে। এখন আর ও নিজের প্রিয় ক্লাবের অন্ধ সমর্থক নয়।

ঢাকুরিয়ার এক ভদ্রলোকের গল্প রতনের মুখে প্রায়ই শুনতাম, যিনি ক্রিকেটের প্রখর বোদ্ধা, ক্রিকেট বিষয়ে তর্কবিতর্কে চব্বিশ ঘণ্টাই কাটিয়ে দিতে পারেন। তিনি নাকি লিখতে চান। একদিন ‘খেলার কাগজ’ অফিসে এলেন একটি লেখা এবং দুটি স্কেচ নিয়ে। খুব ভাল লেখা, পরের সংখ্যাতেই ছাপা হল। এবং সেই থেকে আমাদের নিয়মিত লেখক হয়ে গেলেন অলক চট্টোপাধ্যায়। তাঁর চিত্র-প্রতিভা পরখ করে দেখার সুযোগ অবশ্য আমাদের হয়নি।

দেখা গেল, যা শুনেছিলাম তা মিথ্যা নয়। অলক চট্টোপাধ্যায় সত্যিই ক্রিকেট-পাগল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একলা বসে লোকাল ক্রিকেট দেখেন। পাগল নয় তো কী?

খুব গুছিয়ে কাজ করেন। আন্তরিকতা আছে। কিন্তু একটি মহৎ দোষ, বড্ড ধীরে লেখেন। আমরা তাঁর নাম দিলাম— ‘বয়কট’। ‘খেলার কাগজে’ ই আমরা লেখক হিসেবে পেলাম অশোক রায় ও জ্যোতিপ্রকাশ মিত্রকে। শিবাজী দাশগুপ্ত আর প্রদীপ নাগ সঙ্গে ছিলেন ‘খেলার কথা’র সময় থেকেই।

শিবাজী যদি কথা দেয় সোমবার লেখা দেবে, মঙ্গলবার হয়ে গেলেই আমি ভাবতে বাধ্য হই ওর কি অসুখ করল? ওর বড় গুণ, (না কি দোষ?) একটুও আত্মসচেতন নয়। ও যে ভারতবর্ষের সেরা ফুটবল ভাষ্যকার, সেটা হাবভাবে কখনই প্রকাশ করে না। বিশাল চেহারা নিয়ে যখন অফিসে আসত, খুব ভাল লাগত। শুধু একটা দুশ্চিন্তা। দুর্বল চেয়ারটির জন্য।

প্রদীপ নাগ প্রথম শ্রেণীর রেফারি। আগরপাড়া স্কুলের এই মাস্টারমশাইয়ের এত ডিপ্লোমা যে সব লিখলে লেটার হেডের এক পৃষ্ঠায় কুলোবে না। লেখার মধ্যে একটা ফোর্স সবসময়েই থাকে। ফলে ওঁর যে-কোনও বিষয়ের ওপর লেখাই পাঠকদের শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেত।

খেলার কাগজে আরও দুটি নতুন ছেলের কাজ আমরা পেলাম— নির্মলকুমার সাহা এবং দেবাশিস দত্ত। দুজনেই প্রচণ্ড পরিশ্রমী ও আন্তরিক। ক্রীড়া-সাংবাদিকদের মধ্যে হাতের লেখার কম্পিটিশন হলে ফার্স্ট প্রাইজ পাবে নির্মল। মুক্তোর মতো লেখা, তার মধ্যে একটিও বানান ভুল নেই। এমন কপি সবাই জমা দিলে সম্পাদকের কাজটা অর্ধেক সহজ হয়ে যায়। সরোজ নির্মলকে এনেছিল একদিন, নির্মল এনেছিল একটা লেখা। হাতের লেখা আর নির্ভুল বাংলা দেখে সেদিনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, এই ছেলেটিকে হাতছাড়া করা চলবে না।

দেবাশিস দত্ত তখনও সেন্ট পলসের ইংরেজি অনার্সের ছাত্র। একেবারেই রোগা, কিন্তু মাঠ-ময়দান চষে ফেলার ব্যাপারে ওর জুড়ি নেই। খেলার জগতের কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তি কলকাতায় পদার্পণ করলেন অথচ দেবাশিস তাঁর একটা ইন্টারভিউ নিল না, এমন ঘটনা কদাচিৎ ঘটে। লান্স গিবস তিনবার ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর বলেছিলেন, ‘কাল হোটেলে এস ভোর পাঁচটায়।’

দেবাশিসের বাড়ি হাওড়ায়, সেখান থেকে সার্কুলার রোডে হোটেল হিন্দুস্থানে কী করে পৌঁছেছিল ভোর পাঁচটায়, কখনও জিজ্ঞেস করিনি। তবে গিবস সাহেব চমৎকৃত হয়ে একটা রঙিন গেঞ্জি উপহার দিয়েছিলেন। দেবাশিসের সৌভাগ্য গেঞ্জিটি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে চিরকাল ওর কাছে থেকে যাবে, কারণ ওই গেঞ্জি একসঙ্গে তিনজন দেবাশিসও গায়ে দিতে পারবে কিনা সন্দেহ।

খেলার কাগজে আর একটি ছেলেকে এনেছিল সরোজ— শিবু। ছবির নিচে অবশ্য ওর নাম দারুণ স্মার্ট, এস এস কাঞ্জিলাল। ভাল ছবি তোলে, তবে ছেলেটা আরও ভাল। ফুটবল ম্যাচের রিপোর্ট লেখার আগে আমাদের রিপোর্টাররা সবসময় শিবুর সঙ্গে কথা বলে নিত। জিজ্ঞাসা করে, ‘শিবু, আজ কে কে ভাল খেলল?’ শিবু হয়ত বলল, ‘মজিদ আর দেবাশিস রায়।’ এর পরের প্রশ্ন, ‘কে কে জঘন্য খেলল?’ শিবুর জবাব হতে পারে, ‘মইদুল আর জামশিদ।’ এই দুটি জবাব শোনার পর আমাদের রিপোর্টাররা নিশ্চিত হয়ে যায় মজিদ আর দেবাশিস নিঃসন্দেহে জঘন্য খেলেছে, ভাল খেলেছে মইদুল আর জামশিদ। শিবুর ভূমিকা এক্ষেত্রে অনেকটা বলতে গেলে কলকাতার আবহাওয়া অফিসের মতো— যা বলা হয়, উল্টোটা ধরে নিলেই হল।

ফটোগ্রাফার জহর রায়ও এলেন খেলার কাগজে। গম্ভীর এবং দায়িত্বশীল। সরকারি চাকুরে, অবসর সময়টা কাটে খেলার ছবি তুলেই।

খেলার কথার সময় থেকেই ছবি ও ছড়ার পরিচয় গুপ্ত ছিলেন, খেলার কাগজেও থাকলেন।

আগেই বলেছি, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে লড়াই খেলার কাগজেও চালু ছিল। বাংলা দল নির্বাচন নিয়ে আই এফ এ-র নির্বাচকরা যে অন্যায় করছিলেন, তার বিরুদ্ধে লড়াইটাও কম উল্লেখযোগ্য নয়। ভূতনাথ বিশ্বাসের মতো কিছু বিচিত্র নির্বাচক উনিশশো আশির সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা দল থেকে সুব্রত, প্রসূন আর চিন্ময়কে বাদ দিয়ে দিলেন। আক্রমণের বর্শা প্রধানত উদ্যত হল সম্পাদক অশোক মিত্রর দিকে। একের পর এক লেখায় অশোক মিত্র এবং নির্বাচকরা আক্রান্ত হলেন। একটি লেখা নিয়ে খুব হইচই হল— ‘অশোক মিত্র এবং ভূতের নৃত্য’।

একাশির সন্তোষ ট্রফি শুরু হওয়ার আগে একদিন ঠাণ্ডা রেস্তোরাঁয় বসে অশোক মিত্র বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ ছিল না, তাই শানুকে বলেছিলাম। গত বছর আপনি আমার বিরুদ্ধে কত কী লিখলেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার কিছু করার ছিল না। যা করার সিলেকশন কমিটিই করেছে। এবার কোনওরকমে অন্যায় যাতে কারও ওপর না হয়, সেটা প্রথম থেকেই দেখছি। আপনারা সকলে সহযোগিতা করুন, বাংলা আবার সন্তোষ ট্রফি নিয়ে ফিরবেই।’

শান্ত মিত্র কোচ হলেন, সুব্রত ক্যাপ্টেন। বাংলা ত্রিচুর থেকে সন্তোষ ট্রফি নিয়ে ফিরল। বাংলার সাফল্যে আনন্দিত হওয়া ছাড়াও আমরা অন্য একধরনের তৃপ্তি পেলাম, সেটা সত্যের খাতিরে স্বীকার করে নেওয়া উচিত।

ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় আসার আগে থেকেই অমল দত্তর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। কোনও কোনও বন্ধু সাংবাদিক একসময়ে আমার গায়ে ‘অমল দত্তর লোক’— এই লেবেল সেঁটে দিয়েছিলেন। খুব কম লেখেন অমলদা, তাঁর কাছ থেকে লেখা আদায় করার ব্যাপারে আমার কোনও জুড়ি নেই, এটাও অনেকের জানা ছিল। সকলেই সুতরাং চমকে গেলেন ‘অমল দত্ত যদি ভেবে দেখেন’— লেখাটি পড়ে। অমলদার প্রতি যাবতীয় শ্রদ্ধা জানানোর পর তাঁকে খোলাখুলি আক্রমণ করেছিলাম, একের পর এক যুক্তি ও দৃষ্টান্তের সাহায্যে।

অমল দত্ত ঘনিষ্ঠদের কাছে বললেন, ‘এমনিতে প্রিয়জনদের সঙ্গে আমরা কেউই রেখেঢেকে কথা বলি না। অশোক কি এসব কথা ছেপে সৎ-সাংবাদিকতা করল?’

আহতও হলেন খুব। তারপর মহমেডান স্পোর্টিং ছেড়ে তিনি ওড়িশায় গেলেন রাজ্য দলের কোচ হিসেবে। কটকে দুজনের মধ্যে একটা কথাও হল না। কলকাতায় একটা বড় কাগজে প্রকাশিত হল, অমল দত্ত কটকে বাংলা বিরোধী হাওয়া ছড়াচ্ছেন। আমি তার প্রতিবাদ করলাম।

ওড়িশা থেকে ফিরে এলেন কলকাতায়। ঠিক কী করছেন তখন, জানতাম না। একদিন সকালে স্টেটসম্যানের ‘পারসোনাল’ কলমে দেখলাম, ফুটবল কোচ অমল দত্ত বিজ্ঞাপন দিয়েছেন।

দিন তিনেক পরেই বাগুইহাটিতে অমল দত্তর বাড়িতে গিয়ে আজকাল আর খেলার কাগজে লেখার প্রস্তাব দিলাম। সব মিলিয়ে মাসে আমরা সাতশো টাকা দিতে পারি, তা-ও বললাম। গোয়া যাওয়ার আগে পর্যন্ত অমলদা লিখলেন।

ভাগ্যিস অমল দত্ত কখনও শুধুমাত্র লেখাকে পেশা করেননি। তাহলে হয়ত আমাদের মতই প্রত্যহ পাতা ভরানোর দাসত্ব করতে করতে খুবই সাধারণ হয়ে যেতেন। খুব ভেবেচিন্তে লেখেন, ভাষার ব্যবহারেও অত্যধিক সতর্ক, ‘চলন্তিকা’ থাকে হাতের কাছেই। নানা ব্যাপারে অমল দত্তর সঙ্গে আমাদের মতবিরোধ এখনও আছে, হয়ত থাকবেও। তবু সামনে গেলে অমলদা মতবিরোধ ভুলে যান। কতদিন যাবেন তা অবশ্য জানি না।

আকাশবাণী আর কলকাতা দূরদর্শনের খেলার প্রোগ্রামের এবং জঘন্য ধারাভাষ্যের বিরুদ্ধে আক্রমণও শুরু করা হয়েছিল ‘খেলার কথা’তেই। বাবুরাম সাপুড়ে এবং ল্যান্সনায়েক বিভূতি পাল— এই দুই ছদ্মনামের আড়ালে থেকে হুল ফোটানোর কাজটা করে যাচ্ছিলাম যথাক্রমে আমি এবং সুপ্রিয় সেন। খেলার কাগজে এসে আক্রমণটা সরাসরি করা হল।

এক দুপুরে অফিসে পৌঁছে দেখি, টেবিলের ওপর আকাশবাণীর একটি চিঠি। কলকাতার স্টেশন ডিরেক্টর দিলীপ সেনগুপ্ত আমার সঙ্গে বাংলা ধারাভাষ্য এবং অন্যান্য প্রোগ্রাম নিয়ে কথা বলতে চান। পরের সপ্তাহে গেলাম। কেটে কেটে বক্তব্য রাখলাম। তিনি বললেন, ‘একদিনে সব সমস্যার সমাধান হবে না, কিন্তু আমরা অবশ্যই আপনার সমালোচনা ও প্রস্তাব মাথায় রাখব।’

দূরদর্শনের খেলাধুলো বিভাগের তখনকার ভারপ্রাপ্ত এগজিকিউটিভ বিশ্বনাথ দাসের ভাই শম্ভু আমার কলেজ-বন্ধু। বিশুদাকে তাই চিনি অনেকদিন থেকেই। কিন্তু দূরদর্শনের জঘন্য সব প্রোগ্রাম এবং অযোগ্য-সমাদরের ঘটা দেখে চুপ করে থাকা সম্ভব হয়নি।

উনিশশো বিরাশির মাঝামাঝি সময়ে এসে বুঝলাম, আকাশবাণী বা কলকাতা দূরদর্শন কর্তৃপক্ষ পথ বদল করবে না। এমন একটা কথাও রটিয়ে দেওয়া হল যে রেডিও আর টেলিভিশনে আরও বেশি প্রোগ্রাম পাওয়ার জন্যই অশোক দাশগুপ্তরা এত সমালোচনা করছে।

খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে আজকালে একটা বড় লেখায় ঘোষণা করলাম, আর কখনও রেডিও বা টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করব না। তার আগে সি এ বি-র জয়ন্তী উৎসবের দুটি ম্যাচের ধারাবর্ণনা দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, ফুটবল লিগের একটা ম্যাচের কন্ট্রাক্ট ফর্মও ফিরিয়ে দিলাম। এবং তারপরেই ওই লেখা। এর পরে তো আর কেউ বলতে পারবে না যে আরও বেশি প্রোগ্রাম পাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছি বা সমালোচনা করছি।

গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একদিন বললেন, ‘অশোক, গৌর তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, একবার দেখা কর।’

‘কেন?’

‘আজকালের স্পোর্টস এডিটরের চাকরিটা করবি?’

‘হঠাৎ?’

‘গৌর আমায় জিজ্ঞেস করছিল, স্পোর্টসের ভাল লোক কোথায় পাওয়া যাবে। আমি বললাম, দায়িত্ব দেওয়ার মতো একজনকেই আমি চিনি। তোর কথা বললাম, তোর সঙ্গে আলাপ না থাকলেও গৌর তোর ‘দেশ’-এর লেখাগুলো পড়েছে। ইচ্ছা থাকলে কালই চলে যা।’

‘কিন্তু নীরেনদা আমার পক্ষে তো একা কোথাও যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। আমার গোটা টিমকে কি আজকালে নেবে?’

‘আগে দেখা কর গৌরের সঙ্গে।’

দিন সাতেক পর গৌরদার বাড়িতে হাজির হলাম। তাঁর গায়ে নানা রঙের পাড়ের আর ছিট কাপড়ের তৈরি বিচিত্র কাঁথা বা চাদর। বললেন, ‘আমরা কিন্তু একেবারে অন্যরকম কাগজ করতে চাই। ছেলের মুখে শুনেছি, তুমি অন্যরকম লেখাই লেখার চেষ্টা কর। আমাদের কাগজের লেখার কথা হওয়া চাই খুব ঝরঝরে। আমহার্স্ট স্ট্রিটের লাহা-বাড়িতে আজকাল অফিসে কালই একটা অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়ে যেও। টাকাপয়সা ভালমতই চাইবে, আমি চাই আর্থিক চিন্তায় যেন কখনও বিব্রত না হতে হয়।’

খেলার কাগজের গোটা টিমটাই আজকালে এল, অবশ্য সবাই ফুলটাইমার হিসেবে নয়। খেলার কাগজও চালু থাকল। আমার লেখা এবং পরামর্শ থাকল। সম্পাদক করা হল সরোজ চক্রবর্তীকে। মাস কয়েক পরে আজকাল প্রকাশন থেকে খেলার পত্রিকা করার প্রস্তাব উঠল। এক জায়গা থেকেই দুটো কাগজের কাজ হলে কাজ অনেক কমতে বাধ্য। আর, আজকালে ওই অল্পদিনের মধ্যেই এত জড়িয়ে গেছি যে অন্য কোনও জায়গায় কিছু করার ইচ্ছা চলে যাচ্ছিল। যাই হোক, মাঝ থেকে সরোজ বেচারার এডিটর থাকার মেয়াদ অকালে শেষ হল!

ডেইলি পেপারের কাজ বড় কঠিন, এইরকম হাবভাব যাঁরা দেখাতেন, তাঁরা অল্পদিনের মধ্যেই হতাশ হলেন। ভেবেছিলেন, ‘খেলার কাগজ’ওয়ালারা কঠিন কাজটা করতে হিমশিম খেয়ে যাবে। আমরা কিন্তু ঠিক একমাস প্রস্তুতির জন্য নিয়েছিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যেই অনেকে বললেন, আজকালের খেলার পাতা ভাল হচ্ছে। কেউ কেউ প্রথম দিকে ম্যাগাজিনের গন্ধ পেলেন অবশ্য।

ডেইলি পেপারে অবশ্য অন্য এক ধরনের রোমাঞ্চ আছে। ঠিকঠাক কাজ শুরু সন্ধের মুখে। অন্তত রাত দশটা পর্যন্ত তুমুল ব্যস্ততা। টেলিপ্রিন্টারে খবর আসে দেশবিদেশ থেকে। হঠাৎ খবর আসে লেন্ডলকে হারিয়ে দিয়েছেন বিজয় অমৃতরাজ, ম্যাকেনরো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হেরেছেন টিম গুলিকসনের কাছে। কাউন্টি ক্রিকেটের কপি তৈরি করতে করতেই একজন আর একজনকে প্রশ্ন করি, ইংল্যান্ড এরপরেও ফাউলারকে নিচ্ছে না কেন? এক সপ্তাহ বাদেই রয়টারের কপির প্রথম লাইন: গ্রেম ফাউলার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ টেস্টে খেলার ডাক পেলেন। ম্যাগাজিনে অপেক্ষা করা যায়, কিন্তু এখানে যথাসম্ভব খবর তুলে আনতে হবে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই। ফুটবল, হকি আর ক্রিকেটের দলবদলের আগাম খবর দিয়েই ক্লান্ত হলে চলবে না, গড়াপেটা খেলার ফলাফলও আগেভাগে জানিয়ে দিলে ভাল হয়। একটি খবরও যেন আমরা মিস না করি। খেলার মাঠের সব খবর সবার আগে আজকালে প্রকাশিত হওয়া চাই। এইসব কথা মাথায় রেখে সবাই মিলে এতই কাজে ডুবে গেলাম যে কয়েকদিন বাদেই মতি নন্দী বললেন, ‘তোমরা অন্য কাগজের রিপোর্টারদের কাজ বাড়িয়ে দিয়েছ।’

অচিন্ত্য পাল এবং সোনালী শিবিরের অন্য ফুটবলারদের দুর্ঘটনার খবর আমরা আগে পাইনি। রেডিওয় ছোট্ট খবর পাওয়া গেল রাত আটটার সামান্য আগে। সেদিন সকাল থেকেই অঝোরে বৃষ্টি, রাত আটটায় আমহার্স্ট স্ট্রিটে জল কোমর ছাড়িয়ে গেছে।

স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টে সেদিন লোকও কম। আমি মিনিট খানেক বাদে মাথা নিচু করে চিন্তা করার পর মুখ তুলতেই দেখি নির্মল ছাতা নিয়ে বেরোবার জন্য তৈরি। বললাম, ‘সোনালী শিবির ক্লাবে এত জল ভেঙে হেঁটেই যেতে হবে। অন্তত একটা ছবি নেবে। লেখা তোমার নামে যাবে, শুধু হেডিংটা দিয়ে যাচ্ছি। ‘সোনালী শিবির সোনা হারাল’।

রাত দশটা নাগাদ রিকশয় চেপে বিবেকানন্দ রোডে গাঙ্গুরামের দোকানের দিকে এগোচ্ছি, কারণ আমার গাড়ি বাঁচার জন্য রয়েছে সেখানেই। বাইরে লোডশেডিং। অফিস থেকে কিছু দূরেই পেয়ে গেলাম নির্মলকে, ছাতা বৃষ্টি রুখতে পারছে না, ওর প্রায় বুক সমান জল, কিন্তু বাঁ-হাতে তুলে ধরা আছে নোটবই আর তার মধ্যে অচিন্ত্যর ছবি। সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, নির্মলের উত্তোলিত হাতে যেন নোটবই নেই, আছে আত্মনিবেদিত ক্রীড়া-সাংবাদিকতার মহান পতাকা।

আজকালের প্রথম দিকের খেলার পৃষ্ঠাতেই সল্টলেক শিবির নিয়ে আমার লেখা ছিল। খেলার কাগজেই ওই তেল চিটচিটে দেশপ্রেমিকতার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়েছিল। আজকালে এসে প্রশস্ততার মঞ্চ পাওয়া গেল। পরবর্তী কালে স্বয়ং পি কে ব্যানার্জি বলেছেন, আজকাল আর খেলার কাগজ না থাকলে সল্টলেক শিবির ত্যাগী খেলোয়াড়রা অসম্মানের ভূমিশয্যা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পেত না।

খেলোয়াড়দের দিয়ে লেখানোর ব্যাপারটা প্রথমে আনন্দবাজারই শুরু করেছিল। কিন্তু শুধুমাত্র প্রাক্তন খেলোয়াড়দেরই লিখতে বলা হত। আমরা বর্তমান খেলোয়াড়দের দিয়ে লেখানোর রাস্তা নিয়েছিলাম খেলার কথার সময় থেকেই। ঊনআশির আরব সফরের পর লেখা সুরজিৎ সেনগুপ্তর ‘ফুটবলারের ডায়েরি’ উন্নাসিকদেরও মুগ্ধ করল। এখন সুরজিতের ম্যাচ রিপোর্ট যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে। ছোটদের ফুটবল খেলা শেখানোর জন্য ‘খেলার কাগজে’ ধারাবাহিকভাবে লিখেছিল ‘এসো আমরা ফুটবল খেলি’। প্রথম ইনস্টলমেন্ট পড়েই সুভাষ ভৌমিক বলেছিল, ‘ছোটবেলায় যদি আমাকে কেউ এত সহজ করে আধুনিক ফুটবল খেলতে শিখিয়ে দিত।’

সুরজিৎ ছাড়াও আজকালে ম্যাচ রিপোর্ট করেছে সুব্রত, প্রসূন, শ্যাম, হাবিব, সুধীর আর ভাস্কর— খেলার মাঠ থেকেই। দেখতে দেখতে ব্যাপারটা তো চালু হয়ে গেল।

সুনীল গাভাসকারকে আমরা পেয়েছি হঠাৎ। শ্রেণিক শেঠ শুধু ভাল ফটোগ্রাফার নয়, টেস্ট ক্রিকেটারদের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতাও ছিল দারুণ। ও বলল, ‘গাভাসকার তো আনন্দবাজারে লিখবে, আজকালে কাউকে দিয়ে লেখাতে চান?’

বোম্বাইয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টের আগের দিন শ্রেণিক আর ধীমান কিরমানির সঙ্গে কথা বলল। আমি টেলেক্সে জানালাম, ‘ঠিক আছে।’

বোম্বাই থেকে ফিরে এসেই শ্রেণিক বলল, ‘সুনীল মনে হচ্ছে আনন্দবাজারের ওপর খুব সন্তুষ্ট নয়, চেষ্টা করলে আমরা পেতে পারি।’

কলকাতা টেস্ট শুরু হওয়ার আগের দিন আমি আর শ্রেণিক গ্র্যান্ড হোটেলে সুনীলের সঙ্গে কথা বললাম। এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়ে গেল। সেই বিরাট ইন্টারভিউ প্রথম দিনের পর বেরতেই ময়দান সরগরম। চা-বিরতির সময় এবং খেলা শেষ হওয়ার পর প্রশ্নগুলো তৈরি করেছিলাম আমি আর অলক চট্টোপাধ্যায়। কোনও ফাঁক ছিল না। ওই ইন্টারভিউয়ের পাশে আনন্দবাজারে সানির নিজের লেখা বড়ই সংক্ষিপ্ত ও অসম্পূর্ণ মনে হল। দ্বিতীয় দিনেই গাভাসকারের লেখা আনন্দবাজারে প্রথম পৃষ্ঠার একেবারে নিচে নেমে এল। এবং মাদ্রাজ টেস্ট থেকেই সুনীল গাভাসকার আমাদের লোক।

তারপর থেকে ভারতীয় দলের বেশ কিছু ক্রিকেটারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক, কলকাতার ফুটবলারদের সঙ্গে যেমন, তেমনই ঘনিষ্ঠ। ভারতীয় শিবিরের ইনসাইড স্টোরিও তাই তুলে আনা সম্ভব হচ্ছে। সানিকে কাছে থেকে যত দেখেছি, ততই অবাক হয়েছি। নিন্দা বা কুৎসাকে অগ্রাহ্য করার এত শক্তি ও কোথা থেকে পেল? কিছু ব্যক্তি রটিয়ে থাকেন সানি দাম্ভিক। ওঁদের সবচেয়ে নরম করে বললেও বলতে হয়— ‘মিথ্যাবাদী’।

ক্রিকেট রিপোর্টিং প্রসঙ্গে আর একজনের কথা খুব বেশি করে বলতে চাই। ইংল্যান্ড থেকে পর পর দুবছর বেশ কিছু ম্যাচ রিপোর্ট পাঠিয়েছেন গোপাল বসু। রাত দুটোর আগে টেলেক্স না আসায় একদিন বাদে বাদে ছেপে যেতে হয়েছে। ফুরফুরে ইংরেজিতে সে যে কী দুর্দান্ত ম্যাচ রিপোর্ট— বোঝাতে পারব না। অনুবাদ করতে করতেই মনে হয় কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে। একাশিতে ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় টেস্টের শেষ দিনের আগে এক অপ্রত্যাশিত ভবিষ্যদ্বাণী ছিল ওর লেখায়। ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গিয়েছিল, কিন্তু আমরা তো একদিন বাদে বাদে ওর লেখা ছাপছিলাম, তাই ওই অংশটা লেখায় দেওয়াই যায়নি। ‘বথামের টেস্ট’ নামে খ্যাত ওই হেডিংয়ে টেস্টের শেষ দিনে উইলিস একা আটটা উইকেট তুলে নিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে। আগের দিন গোপাল লিখেছিল, ‘পিচ যা দেখছি, কাল উইলিসকে খেলার সাধ্য অস্ট্রেলিয়ার নেই!’

গত চার বছরে পাঠকপাঠিকাদের চিঠি পেয়েছি অসংখ্য। অধিকাংশই অপাত্রে প্রশংসা। কিছু ভয়ঙ্কর সমালোচনা, এমন কী হাস্যকর হুমকিও এসেছে। উনিশশো আশিতে এক ইস্টবেঙ্গল সমর্থক প্রকাশ্য রাজপথে ‘লাশ ফেলে দেওয়ার’ প্রস্তাব রেখেছিলেন। লামডিং-এর এক ক্রীড়ানুরাগী আটাত্তরের বরদলুই ফাইনালের পর লিখেছিলেন, আসামে নামলেই আমাকে আর সুরজিৎকে খুন করে ফেলা হবে। আগে অন্তত বিশবার আসামে গেছি। কে জানে প্রাণের ভয়েই হয়ত তারপর আর আসাম যাওয়া হয়নি!

একবার চন্দননগরের একটি স্কুলের মেয়ে সম্পাদক মারফত প্রসূন ব্যানার্জির কাছে অনুরোধ পাঠিয়েছিল, ও যেন আর কখনও ‘চকরাবকরা’ শার্ট না পরে। সবচেয়ে স্মরণীয় চিঠি অবশ্য পেয়েছিলাম পুরুলিয়ার একটি স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্রদের কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার সারমর্ম লিখে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছিল। কারণ পরীক্ষায় সেটা আসতে পারে এবং আমার বাংলা নাকি খুব ভাল!

বিশ্বাস করুন এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি আমার ঘটে আছে যে, আমার মতো এলেবেলে সাংবাদিকের ডায়েরির কোনও মূল্যই নেই। কিন্তু সচেতন ক্রীড়ানুরাগীরাও মানবেন, গত কয়েক বছরে বাংলা ভাষায় ক্রীড়া-সাংবাদিকতার বিরাট পালাবদল ঘটে গেছে। এই বদলটা কেউ কেউ ভালভাবে নেননি। ইনসাইড স্টোরির গন্ধে নাক কুঁচকেছেন অনেকেই। কিন্তু পরিবর্তনের জলতরঙ্গ রুদ্ধ করার সাধ্য কারও হয়নি। এই পরিবর্তনে, সত্যের খাতিরে সোজাসুজিই বলে ফেলতে হয়, আমাদের একটা আন্তরিক ভূমিকা থেকেছে। এই পরিবর্তনের সহযোদ্ধা হিসেবে তপন ঘোষ (স্ট্রাইকার) এবং রূপক সাহার নামও উল্লেখ করে রাখতে চাই।

ময়দানের কিছু বাস্তুঘুঘু ও ক্রীড়ামোদীদের একটা উন্নাসিক অংশ একসময় রটাতেন যে, এইসব খেলার পত্রিকায় বানিয়ে বানিয়ে গল্প ফাঁদা হয়, একে সাংবাদিকতা বলে না। কাকে সাংবাদিকতা বলে ভাগ্যিস সেটা শেখানোর চেষ্টা করেননি।

কিছুদিন পরেই ওসব বক্তব্য আর শ্রোতা পেল না। সকলেই বুঝলেন আমরা বরং ভিতরের আসল খবরটা বার করে এনে ময়দানি গুজবের অবসান ঘটাচ্ছি। আমাদের খবরের উৎস যখন খাঁটি, গল্প বানানোর দরকার কোথায়? আসলে এইসব ইনসাইড স্টোরি দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের খুব বিপদে ফেলল। প্রথমে তাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য, কুৎসা রটনা। শেষে অবশ্য এইসব বানিয়ে বানিয়ে গল্প লেখার কাগজের কাছে তাঁদেরও ছুটে আসতে হল, নিজেদের বক্তব্য ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরার জন্য। আমরা অতি নগণ্য ব্যক্তি, শুধু আন্তরিকতার জোরে লড়েছি এবং একবারও মাথা নিচু করতে হয়নি আমাদের।

শুধু খবর দেওয়া নয়, তাকে ব্যাখ্যা করা এবং প্রয়োজনে অন্যায়ের প্রকাশ্য প্রতিবাদ করার লাইন যে বাংলাভাষাভাষী ক্রীড়ামোদীদের কাছে অনেকটাই স্বীকৃতি পেয়ে গেছে, তাতে একটা যুদ্ধজয়ের আনন্দ আমরা অবশ্যই অনুভব করি। এই যুদ্ধের একজন গোলন্দাজের ডায়েরি যদি ক্রীড়ানুরাগীদের কাছে পাঠযোগ্য বিবেচিত না হয়, সেজন্য আমার অক্ষমতাই দায়ী।

আর বিশেষ গর্বের কিছু নেই। এত আন্তরিকতা নিয়েও অনেক কিছুই তো এখনও করা গেল না।

আজ থেকে তিরিশ বছর আগের সংবাদপত্র খুলে বসুন। একদিনের নয়, কয়েকদিনের। দেখবেন, ক্রিকেট রিপোর্টিং মোটেই ভাল লাগছে না। কারণ আপনি এখনকার চমৎকার ক্রিকেট রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু ফুটবল রিপোর্টিং নিশ্চয় চেনা চেনা লাগবে। চলতি ক্রিয়াপদের ব্যবহার ছাড়া আর যা এসেছে তা শুধু ছিমছাম ভাষার কারিকুরি। ফুটবল ম্যাচের চুলচেরা বিশ্লেষণ তখন হত না, এখনও হয় না বললেই চলে। বিশ্লেষণ যদি বা মাঝেমধ্যে হয়, অনধিকারীর হাতে পড়ে তা শুধু প্রবল অট্টহাস্যই জাগায়, বাংলাভাষায় ফুটবল লেখাকে এক ইঞ্চিও এগিয়ে দেয় না।

মাত্র কয়েক বছরে একাধিক লেখার পত্রিকার হাজার হাজার বিক্রীত কপি বাংলার ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে পৌঁছে গেল। বেশ কিছু নতুন লেখক এসে গেলেন। সকলেই যোগ্য নয়, তবে কেউ কেউ তো বটেই এবং সবচেয়ে বড় কথা, শুধুমাত্র বিকালে মাঠে খেলা দেখেই ক্রীড়াসাংবাদিকতা বিশেষত ফুটবল লেখার দিন শেষ হয়ে গেল। নতুন হাওয়ার লেখকদের আন্তরিকতা এবং পরিশ্রম জনসমক্ষে তুলে আনল অতীতের অনেক বিখ্যাত খেলোয়াড়ের অধুনা বিস্মৃত জীবনকে, উদ্ঘাটিত হল ময়দানের অনেক অন্যায় ও দুর্নীতির স্বরূপ।

সব হল, কিন্তু ফুটবল খেলা দিয়ে লেখার কোনও উন্নতি হল না। আমাদের পূর্বসূরিদের তুলনায় আমরা আরও স্মার্ট হেডলাইন দিতে পারি। ভাষার প্যাঁচে ছয়কে নয় করে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু খেলাটাকে সহজে বিশ্লেষণ করে পাঠকপাঠিকাদের সামনে তুলে ধরতে পারি না। যে যাই বলুন, এ জন্য অংশত দায়ী অগ্রজ ক্রীড়াসাংবাদিকরা, যাঁরা ফুটবল খেলাকে বছরের পর বছর বিশ্লেষণ-বিমুখ করে রেখেছেন।

যে বরেণ্য ক্রীড়াসাংবাদিক আমাকে যৎসামান্য ‘মানুষ’ করেছেন, সেই মুকুল দত্তকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি বাংলা ক্রীড়াসাংবাদিকতায় অনেক অভিনবত্ব আনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ফুটবল লেখাকে আরও বিশ্লেষণমুখী করে তোলার দিকে আগ্রহ দেখাননি কেন?’ মুকুল দত্ত সহাস্যে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমরা যা পারিনি, তোমরা তা পারবে, এই বিশ্বাস যখন আছে, ও নিয়ে আর দুঃখ করি না।’

বিশ্বাস তো আছে, কিন্তু আমরা কি সেই বিশ্বাসের যোগ্য? এই প্রশ্নের জবাব আপনারাই না হয় দেবেন, বছর দশেক পরে। এই দশ বছরে আমরা চেষ্টা করে দেখি, কিছু করা যায় কি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *