খেলা শারদীয় সংখ্যা ১৯৮৩

খেলা শারদীয় সংখ্যা ১৯৮৩

— আমি গৌরকিশোর ঘোষ বলছি। দেবাশিস, দেবাশিস দত্তকে একবার দাও।

রাত পৌনে একটা। আবার গৌরদা? থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দেবাশিস টেলিফোন ধরল। ঘণ্টাখানেক আগেই গৌরদা আজকাল অফিস ছেড়ে বাড়ির দিকে গেছেন। দেবাশিস আজকালের খেলার পৃষ্ঠার মেক-আপ করছিল। আর্টিস্ট এবং দেবাশিস কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে, শুধু দু-একটা কপি পাওয়া বাকি। একাশির উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন জন ম্যাকেনরো তার পরেই একটা ছোট্ট টুর্নামেন্টে হেরেছেন, সেই অঘটনের খবরটা পরদিনের কাগজে যাওয়া চাই। আর, শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ভারত সফর হচ্ছে, এই খবরটা বড় করে থাকার কথা।

তখন পরপর কয়েকদিন আজকাল দেরিতে বেরনোয় হকাররা বিক্ষোভ জানাচ্ছিলেন। সম্পাদক গৌরকিশোর ঘোষ এবং জেনারেল ম্যানেজার মদন মিত্র স্বভাবতই সেজন্য চিন্তিত। মদনদা অনেক আগে থেকেই সব পৃষ্ঠার খবর নিচ্ছিলেন, তাড়া দিচ্ছিলেন। গৌরদার মঞ্চে আবির্ভাব রাত সাড়ে এগারোটায়। প্রথম পৃষ্ঠার কাজও শেষ হয়নি, কিন্তু গৌরদার চোখ প্রথমেই খেলার পৃষ্ঠার দিকে গেল। সেদিন রাত্রে আমাদের সবচেয়ে অল্পবয়সী রিপোর্টারের ডিউটি। সবে আজকালে এসেছে, গৌরদা তখনও ওকে চিনতেন না।

— তুমি কে?

— আমি দেবাশিস, স্পোর্টস-এর লোক।

— বাজে কথা বলবে না, আমি সবাইকে চিনি, তোমাকে তো কখনও দেখিনি।

মদনদা বোঝালেন, দেবাশিস সত্যিই স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের লোক। এবং তারপর গৌরদা আবার— এখনও পেজ মেক-আপ হয়নি কেন?

— এই তো ইংল্যান্ড ক্রিকেট টিমের আসার খবরটা আসছে, গভর্নমেন্ট পারমিশন দিয়েছে। আর, ম্যাকেনরো হেরে গেছেন, ওই খবরটা যাবে।

— রোজ কাগজ দেরিতে বেরোচ্ছে, জানো না? বেশি রাতে যে সব খবর আসবে, দেওয়ার দরকার নেই। বেশি ছবি দেবে, ছবি। ইংল্যান্ড আসবে, কিন্তু এটা কী হেডিং? ফেলে দাও। হেডিং দাও— এম সি সি আসছে, সর্বত্র উল্লাস।

কোণঠাসা দেবাশিসের এ কথা বলার মতো অবস্থাও তখন ছিল না যে, সফররত ইংল্যান্ড দলকে এম সি সি বলার রীতি কয়েক বছর আগেই তুলে দিয়েছে খোদ এম সি সি।

গৌরদা তারপর বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, ‘ম্যাকেনরো ট্যাকেনরো কিছু আর যাবে না, সময় নেই, ছবি আনো, তাড়াতাড়ি।’ দেবাশিস দৌড়ে স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টে গিয়ে কিছু ছবি নিয়ে এল। ওপরের দিকেই শ্বেতকায় ও কৃষ্ণকায় দুই অ্যাথলিট পাশাপাশি দৌড়চ্ছেন, এমন একটি ছবি ছিল। গৌরদা বললেন, এইটা যাবে। ক্যাপশন— ‘খেলার মাঠে বর্ণবৈষম্য নেই’।

আমি যেভাবে লিখলাম ব্যাপারটা এত সহজভাবে ঘটেনি। গৌরদা খুব উত্তেজিত ছিলেন, যা দেবাশিসকে তটস্থ এবং মদনদাকে চিন্তিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। মদনদার চিন্তার কারণ, গৌরদার হার্টের অবস্থা।

গৌরদা চলে গেলেন। দেবাশিস মাথায় হাত দিয়ে ভাবছে, কী ঘটে গেল, এমন সময় গৌরদার ওই টেলিফোন।

— আমি দেবাশিস বলছি।

— তোর কাজ শেষ হয়ে গেছে? — গৌরদা খুব দ্রুত ‘তুই’-এ আসতে পারেন।

— হ্যাঁ।

— তাহলে ঘুমিয়ে পড়। কোনও চিন্তা নেই।

— আচ্ছা।

— হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পড়, কোনও চিন্তা নেই।

দেবাশিস অবশ্য সেদিন আর ঘুমোতে পারেনি। নিউজের সুমন চ্যাটার্জি এবং আরও কয়েকজন ওকে বোঝাল, গৌরদা এরকমই মানুষ, দুঃখ করার বা চিন্তা করার কিছু নেই।

আজকাল প্রকাশিত হওয়ার দিন পনের আগে গৌরদা কী যেন একটা তুচ্ছ কারণে ধীমান দত্তকে খুব বকলেন। ধীমান আমাকে বলল, এরপর আর ওর পক্ষে আজকালে চাকরি করা সম্ভব নয়। গৌরদা যখন বকেছিলেন, আমি অফিসে ছিলাম না। ধীমানকে বললাম, ‘চাকরি ছাড়ার কথা আসছে কেন? তোমার যদি সত্যিই অপমান হয়ে থাকে, আমিও তোমার সঙ্গে আছি।’

গৌরদাকে ধীমানের কথা বললাম। আজকাল সম্পাদক একটিও কথা না বলে আমার সঙ্গে অফিসের মাঝখানের বাঁধানো উঠোনে বেরিয়ে এলেন, একবার থমকে দাঁড়ালেন এবং অবাক হয়ে বললেন, ‘সেকি!’

এবং তারপর সোজা খেলার ঘরে। ধীমানের পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘ছিঃ ধীমান। আমি তোমাদের এডিটর, তোমরা আমার ছোট ভাই। আমি তোমাদের বকতে পারব না? আমার বকুনির জন্য চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছ? তাহলে তুমি কী করে ভাল সাংবাদিক হবে?’

গৌরদার কথায় যে গভীর আন্তরিকতা ছিল, তা ধীমানের মতো শক্ত ছেলেকেও স্পর্শ করল। গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে কাজ করার সময় আমাদের ভাল লেগেছে, কিন্তু লড়াইও করতে হয়েছে প্রচুর। কোনও খেলার খবর প্রথম পাতায় আনার জন্য অথবা বেশি জায়গা পাওয়ার জন্য আমাদের অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হত। তাতেও যে সব সময় ভাল ফল হত, তা অবশ্য নয়।

একবার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ নিয়ে আজকালে চার-পাঁচটা লেখা থাকার কথা। স্পোর্টস-এর ঘরে সরোজ, ধীমানরা লেখা তৈরিতে ব্যস্ত, আমি আর সুরজিৎ ম্যাচ রিপোর্ট লিখছি অন্য একটা ঘরে। হঠাৎ গৌরদা এসে বললেন, ‘কাল রবিবার অশোক, প্রচুর বিজ্ঞাপন, তোমাদের পাতায় অনেক বিজ্ঞাপন দিতে হবে, এমনিতে মেলা পলিটিক্যাল নিউজ আছে, শুধু মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল করলেই তো আর হবে না। খেলা নিয়ে দুটোর বেশি লেখা যাবে না, তোমার লেখা আর তার সঙ্গে যে- কোনও একটা।’

প্রায় এক নিঃশ্বাসে এতগুলি কথা বলে গৌরদা একেবারে অফিস থেকেই বেরিয়ে গেলেন। এই ঝড়ের মধ্যেও সুরজিৎ কিন্তু লেখা থামায়নি। গৌরদা চলে যেতেই শুধু আমার দিকে একবার তাকিয়েছিল। কয়েক মিনিট পরে নিউজ রুম থেকে সুমন চ্যাটার্জি ইন্টারকম-এ বলল, ‘খেলার সব লেখাই নিতে হবে অশোকদা, গৌরদাও আর আসবেন না, আমি তোমার পাতা থেকে বিজ্ঞাপন তুলে দেব।’

পরদিনের আজকাল সকলের প্রশংসা পেল। গৌরদা সন্ধের সময় আমাকে বললেন, ‘আজকের খেলার পাতার প্রশংসা সবাই করছেন। আমি কিন্তু এখনও মনে করি, একটা ম্যাচ নিয়ে এতখানি জায়গা খরচ করা উচিত নয়।’

ধীরে ধীরে গৌরদা আমাদের ব্যাপার-স্যাপার মেনে নিলেন, কিন্তু মন থেকে নয়। এমনকি সুনীল গাভাসকারকে নেওয়ার ব্যাপারে আমাদের ‘বাড়াবাড়ি’ও তাঁর ভাল লাগেনি। তবু গৌরকিশোর ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধা কখনও কমেনি। গৌরদার একটা কথা যেন মন্ত্রের মত কাজ করে : ‘আমরা সাংবাদিক, কেউকেটা কিছু নই, খুবই সাধারণ লোক। কিন্তু আন্তরিকতা থাকলে, পরিশ্রম করে তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে অসাধারণ বড় বড় লোকেদেরও আমরা টলিয়ে দিতে পারি। আমরা নিজেরা সাধারণ হলেও, আমাদের কাজ বা লেখা অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে।’

আজকাল প্রকাশিত হওয়ার আগে আর একটি ঘটনায় অসাধারণ গৌরকিশোর ঘোষকে চিনেছিলাম। আমি ততদিনে স্পোর্টস এডিটর হিসেবে যোগ দিয়েছি এবং সহকর্মী হিসেবে কাকে কাকে শুরু থেকে নেওয়া যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি, গৌরদার সঙ্গে কথাবার্তাও বলছি। হঠাৎ একদিন শুনলাম, অজয় বসু যুগান্তর থেকে আমাদের কাগজে চলে আসতে পারেন। আজকালের কর্ণধাররা তখনও নিশ্চিত নন, একটি দৈনিকপত্রের স্পোর্টস এডিটর হিসেবে আমি দাঁড়াতে পারব কি না। এটা তো সত্যি যে এর আগে কোনও দৈনিকপত্রেই কাজ করিনি। খবরের কাগজে বেশ কয়েক বছর কাজ না করলে, স্পোর্টস এডিটরের চাকরি করা কি সম্ভব? এইসব চিন্তাই হয়ত অজয় বসুর সঙ্গে কথাবার্তাকে অনেকটা এগিয়ে নিল। শেষ পর্যন্ত একদিন আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হল, ‘অজয় বসুকে পেলে কেমন হয়?’ আমি বললাম, ‘আগে আমার জানা দরকার, তিনি কী হিসেবে আসবেন। অজয় বসু আমাদের কাগজে লিখবেন, খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু যেহেতু তিনি প্রবীণ ও শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক, আমার মাথার ওপর তাঁকে বসিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলে, আমি এই চাকরি করতে পারব না। অজয় বসু নিঃসন্দেহে বড় সাংবাদিক, কিন্তু আমি অন্য ধরনের সাংবাদিকতা করতে এসেছি।’

আমি আবার বললাম, অজয় বসুর মতো শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক লিখলে আজকালের খেলার পৃষ্ঠা সমৃদ্ধই হবে। তবে একটাই শর্ত, ওই লেখা আমরা বক্স করে ছাপব এবং ওই বক্সের বাইরে পৃষ্ঠার বাকি অংশে আমারই নেতৃত্ব থাকবে। এমনকি অজয়দার কোনও বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হতে পারলে, আমার পাল্টা বক্তব্যও পরে প্রকাশ করব।

প্রাথমিকভাবে কথা হল, আজকালের রবিবাসরের খেলার পাতাটির সম্পাদনা করতে পারেন তিনি, লিখতে পারেন মাঝেমাঝেই একটি করে বিশেষ রচনা— সাধারণ খেলার পাতায় এবং তাঁর পক্ষে উপযুক্ত একটি উঁচু পদও দেওয়া হতে পারে। এ সবে আমার আপত্তির কোনও প্রশ্ন ছিল না। অজয়দাকে আজকালে পেলে খুবই ভাল হত। কিন্তু, কারও নেতৃত্বে থেকে ক্রীড়াসাংবাদিকতা করার ইচ্ছা ছিল না। ভাল-খারাপের বিচার পরে হবে, নিজের ধারণা এবং বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করার সুযোগই আমার প্রথম শর্ত ছিল। এখনও আছে। পরে, অনেক পরে অবশ্য লেখক হিসাবে অজয়দাকে আমরা পেয়েছি এবং গ্রহণ করেছি শ্রদ্ধার সঙ্গেই।

গৌরকিশোর ঘোষ আজকাল ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমরা সকলেই দুঃখিত হয়েছিলাম। শেষ যেদিন আজকাল অফিসে এলেন, নিজের ঘরে ডেকে সাংবাদিকতা সম্পর্কে সহজ সরল কিছু কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন। কোনওরকম তিক্ততা ছিল না। গৌরদার বিদায়ে দুঃখিত হলেও, স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই, মদন মিত্র পরবর্তী সম্পাদক হওয়ায় খেলার পাতা দিগন্ত জয়ের সুযোগ পেল।

কথাটা খোলাখুলিই বলে ফেলা যাক। গৌরদা খেলাধুলোকে খবরের কাগজে গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। যাঁদের চেষ্টায় খেলার পাতা নিয়ে এর মধ্যেই বডকিছু ভাবা যাচ্ছিল, তাঁদের মধ্যে একজন— জেনারেল ম্যানেজার মদন মিত্র। নতুন সম্পাদক হিসেবে মদনদার নাম ঘোষিত হওয়ায়, সুতরাং স্বস্তির নিঃশ্বাস গোপন করা যায়নি।

গৌরদা থাকার সময়ই ‘খেলা’ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আজকালের স্পোর্টস এডিটরই ‘খেলা’র এডিটর এই ব্যাপারটা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। তাঁর বক্তব্য ছিল, একজনের পক্ষে এই দুটি গুরুদায়িত্ব একসঙ্গে পালন করা সম্ভব নয়। এর ফলে, হয় আজকালের খেলার পাতা নয়ত ‘খেলা’ অবহেলিত হবে। অন্যরা বোঝালেন, অশোক তো অন্য একটা খেলার পত্রিকা আগে থেকেই চালাচ্ছে, ওর অসুবিধা না হলেই হল। এক্ষেত্রেও গৌরদা কিছুটা অনিচ্ছার সঙ্গেই রাজি হলেন। আসলে, গৌরদা চাইতেন না, আজকালের কোনও কর্মীর মন অন্য কোথাও বা অন্য কোনও দিকে যাক। পাক্ষিক ‘খেলা’ পরে সাপ্তাহিক হল। কাজ অনেক বাড়ল। সঙ্গীদের নিয়ে আমি আরও কিছুটা তৈরি হতে পারলাম।

কাজ বেড়ে যাওয়ার ধাক্কা সত্যিই প্রবলভাবে এল ‘খেলা’ সাপ্তাহিক হওয়ার সময়। উনিশশো আটাত্তর থেকে খেলার পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত আছি, কিন্তু কোনও পত্রিকাই সাপ্তাহিক ছিল না। দৈনিকপত্রের সঙ্গে সাময়িকপত্রের, বিশেষত নিউজ ম্যাগাজিনের তফাত এই যে, প্রত্যেক সংখ্যাকেই আকর্ষণীয় করে তোলার টেনশন নিয়ে চলতে হয়। আজকালের খেলার পাতা মোটামুটি জনপ্রিয়, খেলার মাঠের বড় কোনও ঘটনা এলে নিজেদের নিঙড়ে দিতে হয় অবশ্যই। কিন্তু সাতদিন নিতান্ত সাদামাঠা পাতা হলেও ক্ষতি নেই, কাগজের বিক্রি তাতে এক কপিও কমে না। ‘খেলা’র ক্ষেত্রে আমরা জানি, পর পর তিনটি সংখ্যা নিষ্প্রাণ হলেই বিপদ। পনের দিনে একটি আকর্ষণীয় পত্রিকা প্রকাশই বেশ কঠিন। সাতদিনে এসে কাজটা দ্বিগুণ কঠিন হয়ে গেল। অনেকে অভিমত দিলেন, সাপ্তাহিক হলে খেলার বিক্রি অনেক কমে যাবে। এই চ্যালেঞ্জটারই দরকার ছিল। আজকাল কর্তৃপক্ষকে কথা দিলাম, সাপ্তাহিক হওয়ার পর খেলার প্রচারসংখ্যা কমবে না, বরং বেশ কিছুটা বাড়বে। সেই মতোই আমরা প্রস্তুতি নিলাম। প্রত্যেকের কাজের সময় বাড়ল। কিন্তু প্রত্যেকেই খুশিও হল, যখন দেখা গেল, সাপ্তাহিক হওয়ার পর খেলার বিক্রি বেড়ে গেছে। ঝকঝকে প্রচ্ছদ, ভাল লে-আউট, নতুন কিছু ফিচার এবং প্রত্যেক সংখ্যায় অন্তত একটি অপ্রত্যাশিত ভাল লেখা— এই ছিল রসদ।

খেলার সম্পাদক হিসাবে দু-তিনটি বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। তার নেপথ্যকাহিনী পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পেশ করতে চাই, শুধু গল্প শোনানোর জন্য নয়।

আমাদের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম, কারণ ইতিমধ্যে আমরা একই সঙ্গে দৈনিকপত্র এবং খেলার পত্রিকার লোক। কিন্তু সাধারণভাবে দৈনিকপত্রের বাবু রিপোর্টাররা খেলার পত্রিকার মেঠো রিপোর্টারদের কিছুটা অবজ্ঞার চোখে দেখার অসুখে এখনও ভুগছেন। আজকালের স্পোর্টস এডিটর হলেও যেহেতু আমি মূলত খেলার পত্রিকার শিবিরের লোক, এই মনোভাবকে কখনও পাল্টা অবজ্ঞা, কখনও যুক্তি দিয়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছি।

তিরাশির জানুয়ারির মাঝামাঝি একদিন, ‘খেলার আসর’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অতুল মুখার্জি দুপুরে আমাদের অফিসে টেলিফোন করে বললেন, অশোক, তুমি কি বেঙ্গল টেবল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের সুভেনিয়ারটা দেখেছ?

— না। কেন?

— এই সুভেনিয়ারে প্রকাশিত একটা লেখায় মতি নন্দী খেলার সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিকগুলিকে ‘নির্বোধ ও রুচিহীন’ বলেছেন। তুমি একবার পড়ে দেখ, ভাব কী করা যায়। আমরা উকিলের চিঠি দিচ্ছি।

আমি বললাম, আগে এ সব কথা গায়ের জ্বালা মেটাতে আড়ালে আবডালে বলা হত, এবার তা হলে ছাপার অক্ষরে এসে গেল। অতুলদা, দরকার হলে একসঙ্গে কোর্টে যেতে রাজি আছি। তবে, আমি জবাবটা লিখেই দিতে চাই। ওই সুভেনিয়রটা আনিয়ে নিচ্ছি।

মতি নন্দী লিখেছিলেন, ‘চ্যাম্পিয়নকে বাচ্চা বয়স থেকেই খেলায় আগ্রহী হতে হবে এবং খেলায় নামতে হবে। নামার সুযোগ নেই। প্রাকৃতিক কারণেই বাচ্চাদের আগ্রহটা থাকে। অবশেষে খেলার ইচ্ছা মেটায় প্রক্সি দ্বারা, গ্যালারিতে হাত-পা ছুঁড়ে তারা খেলে যায়, আগ্রহ মেটায় রুচিহীন, নির্বোধ খেলার সাপ্তাহিক ও পাক্ষিকগুলি পাঠ করে।’

স্পষ্ট টার্গেট খেলা, খেলার আসর ইত্যাদি। এই পত্রিকাগুলো ক্রীড়ামোদীদের মধ্যে যে প্রভাব ফেলতে পেরেছে, দৈনিকপত্রের অনেক ভারে কেটে যাওয়া নক্ষত্র এতকাল তা করতে পারেননি। স্বীকৃতির বদলে এল ঈর্ষা।

খেলার পত্রিকার আন্দোলনের একজন সৈনিক হিসেবে এই ঈর্ষাপীড়িত আক্রমণের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলাম (‘নির্বোধ ও রুচিহীন’; খেলা ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩ সংখ্যা)। পাল্টা আক্রমণে মুখর এই লেখাটি অধিকাংশ পাঠক-পাঠিকার সমর্থন পেল। কেউ কেউ অবশ্য ভিন্নমতও পোষণ করলেন। মতি নন্দীর মতো প্রতিভাবান লেখক এবং প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে লেখার সময় আমি একবারও দ্বিধাগ্রস্ত হইনি, কারণ তিনি অন্যায় আক্রমণ করেছিলেন এমন একটি বিষয়ে, যা আমার জীবন। সাংবাদিক বা লেখক হিসেবে আমি অতি সামান্য, কিন্তু আমাদের পত্রিকা বা সাধারণভাবে সব খেলার পত্রিকাকে ‘নির্বোধ ও রুচিহীন’ বলে পার পেয়ে যাবেন শ্রেষ্ঠ লেখক হয়েও অতি সাধারণ সাংবাদিক মতি নন্দী, তা মেনে নিতে পারিনি। ক্রীড়া-সাহিত্যিক হিসেবেও মতি নন্দী শ্রদ্ধেয় হয়ে থাকবেন, কিন্তু ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় তিনি নতুন কোনও দিগন্ত খুলে দিতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। তাহলে, কোন অধিকারে তিনি পরিশ্রমী এবং আন্তরিক তরুণ সাংবাদিকদের রক্ত ও পরিশ্রমে গড়া খেলার পত্রিকার আন্দোলনের দিকে এমন অবজ্ঞা ছুঁড়ে দিলেন?

লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিন পরেই খেলার আসর থেকে অতুলদা আবার টেলিফোন করলেন: ‘অশোক তোমার লেখাটা পড়েছি, তবে এদিকে একটা ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। বেঙ্গল টেবল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনকে যে উকিলের চিঠি দিয়েছিলাম, তার জবাব পেয়েছি। আমি সব চিঠির কপি তোমার কাছে পাঠাচ্ছি।’

ভারত-পাকিস্তান শেষ টেস্টের খেলা টেলিভিশনে দেখার ফাঁকে ফাঁকে অফিসের খুচরো কাজ করছিলাম, খেলার আসরের এক কর্মী চিঠি দুটির কপি নিয়ে এলেন। উকিলের চিঠি যেমন হয়, তেমনই। তবে বেঙ্গল টেবল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের চিঠিটি বেশ মজাদার। বক্তব্য: আমরা সাংবাদিকদের লেখা সুভেনিয়ারে ছেপেছি সরাসরি, কোনও রকম এডিট করা হয়নি। তাই কোনও লেখার বক্তব্যের ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব নেই। তা ছাড়া আমাদের মনে হয়, ওই লেখায় আপনাদের কাগজকে কটাক্ষ করা হয়নি, বাজারে অন্য অনেক কাগজ তো সত্যিই ওই রকম, তাই হয়ত লেখা হয়েছে।

আর একটি চিঠিও তখনই পেলাম। অতুলদা লিখে জানিয়েছেন: বেঙ্গল টেবল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন চিঠিটার সঙ্গে সন্ধির চিহ্ন হিসেবে একটা ‘টাই’-ও পাঠিয়েছেন!

সন্ধি হয়ে গেল। খেলার আসরের সঙ্গে বি টি টি এ-র। কিন্তু আমার মনে কিছু প্রশ্নও থেকে গেল। এক, প্রতিবাদটা বি টি টি এ-র প্রকাশনার বিরুদ্ধে না মতি নন্দীর লেখার বিরুদ্ধে? বি টি টি এ-র চিঠিতে মতি নন্দীর লেখার বক্তব্য কি পাল্টে গেল? দুই, বি টি টি এ-র কর্মকর্তা যে বলছেন খেলার আসরকে উদ্দেশ্য করে কিছু লেখা হয়নি, একথা তাঁরা কী করে জানলেন বা বুঝলেন, লেখার ক্ষেত্রে তাঁদের যখন কোনও দায়িত্বই নেই? তিন, খেলার আসরকেও যদি কটাক্ষ করা না-ই হয়ে থাকে, খেলাধুলোর পাক্ষিকের সঙ্গে সাপ্তাহিকের কথাও মতি নন্দী লিখবেন কেন? প্রতিষ্ঠিত খেলার পত্রিকাগুলির মধ্যে তখনও পর্যন্ত খেলার আসরই একমাত্র সাপ্তাহিক ছিল। চার, অন্য খেলার পত্রিকাগুলিকে আক্রমণ করা হয়েছে এমন বক্তব্যই বা খেলার আসরের সম্পাদক মেনে নিলেন কেন? ব্যাপারটা যদি সম্পূর্ণভাবে তাঁদের পত্রিকারই ব্যাপার হয়, তা হলে অতুলদা আমাকে টেলিফোন করেছিলেন কেন?

বিরাশির উত্তর কোরিয়া সফর থেকে ফেরার পর সুব্রত ভট্টাচার্য একদিন জানায়, ‘অরুণ ঘোষের বিরুদ্ধে আমার অনেক কিছু বলার আছে।’ দ্বিতীয় দিন সুব্রতর বক্তব্য ছিল: ‘ইন্ডিয়া টিমের ব্যাপারে সব সমালোচনা প্রদীপদাকে হজম করতে হচ্ছে, কিন্তু অরুণ ঘোষের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলছে না। আরও অনেক ব্যাপারে অনেক কিছু আমি বলতে চাই।’

বিতর্ককে এড়িয়ে চলার নিরাপদ রাস্তায় আমরা কোনওদিনই চলতে চাইনি। ভারতবর্ষের একজন প্রথম সারির ফুটবলার যদি জাতীয় দলের সহযোগী কোচের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে চায়, আপত্তির কারণ থাকতে পারে না, অন্তত আমাদের দিক থেকে। যেহেতু সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড় ও কোচের নাম সুব্রত ভট্টাচার্য এবং অরুণ ঘোষ, জল অনেক ঘোলা হল। সুব্রতর লেখা পড়ে অসন্তুষ্ট হয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুললেন, এই ফুটবলারটিই তা হলে আগে অরুণ ঘোষের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পত্রপত্রিকায় বক্তব্য রেখেছিল কেন? এখানে এই কথাটাও অবশ্য লিখে রাখা দরকার যে, স্পষ্ট ভাষণের জন্য সুব্রতকে অভিনন্দন জানিয়েও বেশ কিছু চিঠি আমাদের দপ্তরে জমা হয়েছিল। এই বিতর্কের ভেতরে এখন আর ঢোকার প্রয়োজন নেই, কারণ পরবর্তী কালে দু’জনের সম্পর্ক আবার আগের অবস্থাতেই এসে গেছে। অরুণ ঘোষের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের কাছে শুনেছি, সুব্রতর লেখা সম্পর্কে তাঁর প্রথম বক্তব্য ছিল: এই লেখা অশোক প্রকাশ করল কেন? ভারতীয় দলের কয়েকজন ফুটবলার আমার কাছে অনুযোগ করল, অরুণদার বিরুদ্ধে এই কুৎসা প্রকাশ করা উচিত হয়নি। ওদের খুব খারাপ লেগেছে, খেলার কাছে এটা আশা করা যায়নি ইত্যাদি। আউট্রাম ঘাটে ‘গে’ রেস্তোরাঁয় বসে এক বিশিষ্ট ফুটবলার বলেছিল, একথা সত্যি যে অরুণদার মধ্যে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ কিছু কম, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কিছু লেখার অধিকার আর যারই থাকুক, সুব্রত ভট্টাচার্যের নেই।

এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও আমরা কখনও মনে করিনি যে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে ভুল করেছি। আমরা বরং উৎসাহী ছিলাম, অরুণ ঘোষের বক্তব্য তুলে ধরতে। এমনিতেই অরুণ ঘোষ চাপা মানুষ, তিনি কিছু বলতে চাইলেন না। অন্য দু-একটি পত্রিকায় আমাদের বিরুদ্ধে অনেক কথা লেখা হল। এই অভিযোগও করা হল যে, আজকালে একটি ম্যাচের রিপোর্ট লিখতে অরুণ ঘোষ রাজি না হওয়ার জন্যই নাকি তাঁর বিরুদ্ধে আমরা উঠেপড়ে লেগেছি।

ঘটনা হচ্ছে এই যে, অরুণ ঘোষ কখনই আমাদের বিমুখ করেননি। সুব্রতর ওই লেখা প্রকাশিত হওয়ার আগে এবং পরে তাঁর অনেক লেখাই প্রকাশ করার সুযোগ পেয়ে ‘খেলা’ সমৃদ্ধ হয়েছে। এবং আজকালও।

একথা নিশ্চয়ই কেউ বলবেন না যে, পি কে ব্যানার্জির সঙ্গে আমার বা আমাদের সম্পর্ক খারাপ। বরং অনেকের অভিযোগ, বরাবরই পি কে-র পক্ষে লিখে এসেছি। আমার প্রিয় এক বিশিষ্ট ফুটবলার বলে— ‘আপনার পি কে’। এই আমার পি কে-র বিরুদ্ধেও খেলার কথায় থাকার সময়, একটি বিতর্কিত লেখা প্রকাশ করেছিলাম। লিখেছিলেন কাজল মুখার্জি। দিলীপ পালিতের আক্রমণাত্মক বক্তব্যও প্রকাশ করেছি। এশিয়াডের আগে ভারতীয় দলের কোচ হিসেবে পি কে আজকাল বা খেলার পাতায় কম সমালোচিত হননি। বলা বাহুল্য, এসবের পেছনে কোনও মনোমালিন্য কাজ করেনি। সুব্রত-অরুণ ঘোষ বিতর্কে এই ধরনের অভিযোগ হাঠাৎ কেন উঠেছিল, তা তদন্তসাপেক্ষ। তার সময় নেই। হয়ত প্রয়োজনও নেই।

দিল্লি এশিয়াডে গিয়ে যখন অনেকদিন পর অরুণদার সঙ্গে প্রথম দেখা হল, ভেবেছিলাম, শুরুতেই ব্যাপারটা নিয়ে খোলাখুলি কথাবার্তা বলব। কিন্তু দেখা হতেই অরুণদা আগের মতোই সহজ হয়ে ওঠায় ওই প্রসঙ্গ তোলার সুযোগ হয়নি। আমি বরং সরাসরি অরুণদাকে খেলা ও আজকালে লেখার অনুরোধ জানালাম। অরুণদা বলেছিলেন, ‘লিখব, এশিয়াডের পর।’ আজকাল ও খেলার পাঠক-পাঠিকারা জানেন, অরুণ ঘোষ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। খেলার একটি সংখ্যায় যখন সুব্রতর খেলার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে চমৎকার লেখা লিখলেন, অরুণদার অনেক ফুটবলার বন্ধুই বিস্মিত হলেন। আমরা কিন্তু বিস্মিত হইনি।

খেলা সবচেয়ে বড় সমালোচনার মুখে পড়ল তিরাশির দলবদলের পালা শেষ হতেই। উনিশশো ঊনআশি সাল থেকেই দলবদলের পূর্বাভাস দিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। যেহেতু লেখার আগে ফুটবলার ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলে নিতাম, আগাম খবর প্রায় সব ক্ষেত্রেই মিলে যেত। ফুটবল-অনুরাগীদের বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা চার বছরে অনেক বেড়ে গেল। আগে সব খবর সরাসরি আমিই নিতে পারতাম। কিন্তু কাজ বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় এল, যখন ফুটবলার বা কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ল।

আটাত্তরে কাজ শুরু করেছিলাম মাত্র একজনকে নিয়ে, তিরাশিতে তেরোজন। গোটা টিমে নেতৃত্ব দেওয়াই যখন আমার কাজ, কোনও বিষয়েই— এমনকি দলবদলের মতো জনপ্রিয় ব্যাপারেও নিজেকে বেশি জড়িয়ে ফেলা আর সম্ভব নয়। এবার দলবদলের খবর তুলে আনার দায়িত্ব নিল প্রধানত ধীমান দত্ত ও সরোজ চক্রবর্তী। পরে কোচিনে নেহরু গোল্ড কাপ চলার সময় পল্লব বসুমল্লিকও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল। আমরা চাইছিলাম দলবদলের খেলার একটা প্রাণবন্ত ধারাবিবরণী খেলার পাতায় তুলে আনতে। খেলায় যেমন এক গোলে পিছিয়ে থাকা দল শেষ পর্যন্ত তিন-এক গোলে জিতে যেতে পারে, দলবদলের ক্ষেত্রেও তেমন ঘটতে পারে। আজ যা হতে পারে মনে হয়, কাল তার উল্টো ঘটনা ঘটতেই পারে। শ্যাম থাপা প্রথমে ইস্টবেঙ্গলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। পি কে-র সঙ্গে কথাবার্তা বলল এবং আমরা সেই খবর ছাপলাম। এরপর মোহনবাগান শ্যামের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে সফল হল। এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের খবরটা আমরা দলবদল শুরু হওয়ার আগেই ছেপে দিলাম। মিহির বসু প্রথমে বলল, ‘পি কে যে টিমে, সেই টিমে আমি কিছুতেই খেলব না।’ অন্য ফুটবলাররা মিহিরকে বোঝাল, মিহির তবুও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়তে রাজি হল না। মোহনবাগানে মিহির যেতই কিন্তু দু-একজন কর্মকর্তার অদ্ভুত কথাবার্তায় থমকে দাঁড়াল। এক উল্লেখযোগ্য কর্মকর্তা ওকে বললেন, ‘তুমি মোহনবাগানে সই করতে পার, তবে আমি কোনওরকম দায়িত্ব নেব না।’ অন্যদিকে ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তারা মিহিরের সঙ্গে পি কে ব্যানার্জির কথাবার্তার ব্যবস্থা করলেন। মিহির শেষ পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গলে থাকতে রাজি হয়ে গেল। ওকে ক্যাপ্টেন করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল। মিহিরের আগের সিদ্ধান্ত এবং পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন— সব খবরই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খেলায় ছেপে দেওয়া হল।

সুব্রতর সঙ্গে মোহনবাগানের কর্মকর্তারা ভালভাবে কথাই বলছিলেন না। ধীরেন দে এবং দু-একজন প্রাক্তন ফুটবলার সেবার সুব্রত আর গৌতমকে টিমে রাখতে চাইছিলেন না। গৌতমকে রাখতেই হবে এটা বুঝে নিলেও সুব্রতর ব্যাপারে মত পাল্টাতে কেউ কেউ রাজি হচ্ছিলেন না। সুব্রতর প্রচণ্ড জনপ্রিয়তার কথা ভেবে একটু কৌশল করা হল। খুব অল্প টাকায় খেলার প্রস্তাব এল, অর্থাৎ তোমাকে না পেলেও আমাদের চলবে। পি কে-র সঙ্গে সুব্রতর কথা হল, কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তারা উদ্যোগ নিলেন না। বরং ঝাঁপিয়ে পড়ল মহমেডান স্পোর্টিং। কর্মকর্তাদের নিয়ে মইদুল কথা বলল। অনেক ভাল অফার পেয়ে সুব্রত ঠিক করে ফেলল, মোহনবাগান ছাড়বে। যেদিন মহমেডানে সই করার কথা, তার আগের দিন শৈলেন মান্না শ্যামনগরে ওর বাড়িতে গেলেন। বোঝালেন। মোহনবাগানের পক্ষ থেকে অনেক ভাল অফার দিলেন। সুব্রতকে রাখতে না-চাওয়া কর্মকর্তারা ততদিনে গুটিয়ে গেছেন।

একদিন রাত একটায় কোচিন থেকে পল্লব খবর পাঠাল, অলোক মোহনবাগানে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমনকি মনোরঞ্জনও অসন্তুষ্ট, ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তারা ঠিকমত যোগাযোগ না করায়। আর, চিন্ময়ের সঙ্গে ভাস্করকেও পাওয়া যাবে, একথাও মহমেডানের এক উল্লেখযোগ্য কর্মকর্তা বলে বেড়াচ্ছিলেন। তার একটু আগে অফিস ছেড়েছি। পল্লবের রিপোর্ট পড়লাম পরদিন সকালে। অফিসে গিয়ে ধীমানকে বললাম, ‘পল্লবের এই কপিটাকে এত গুরুত্ব দেওয়া ঠিক হয়নি। বিশেষত অলোককে নিয়ে হেডিংটা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করতে পারে।’ অভিজ্ঞতা বলছে, অনেক ফুটবল-অনুরাগীই হেডিংটা মাথায় রাখেন। পরে বিস্তারিত কী লেখা আছে, তা ভালভাবে মনে রাখেন না।

আর, ওই প্রসূন-প্রশান্ত প্রসঙ্গ। দিল্লি এশিয়াডের সময়েই চোখে পড়েছিল, ওরা দুজন শুধু এক ঘরে নেই, খাওয়াদাওয়া, ঘোরাফেরা সবই করছে একসঙ্গে। ওদের দুজনকে একবারও আলাদা দেখা যায়নি। সুভাষ ভৌমিক দিল্লিতেই বলল, ‘প্রশান্ত এবার মোহনবাগানে খেলতে পারে।’ কলকাতায় ফিরে সরোজকে খবর নিতে বললাম, প্রসূন-প্রশান্ত কি সত্যিই এক টিমে খেলার কথা ভাবছে? দুজনেই জানাল, হ্যাঁ, ওরা এক টিমে খেলতে চায়। ডুরান্ড চলার সময় প্রসূন সরোজকে বলল, ও ইস্টবেঙ্গলে খেলবে। ব্যাপারটা যে সেদিকেই এগোচ্ছে, ডুরান্ড ফাইনালের দিনই গভীর রাত্রে প্রসূন-প্রশান্ত আমাকেও বলল, দমদম এয়ারপোর্টে।

তারপর মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের লড়াই শুরু হল। মোহনবাগান শুধু প্রসূনকে এবং ইস্টবেঙ্গল শুধু প্রশান্তকে রাখার ব্যাপারে বেশি উৎসাহ দেখাল। প্রসূন আর প্রশান্ত তখনও এক টিমে খেলার কথা ভাবছে। কিন্তু দুই বড় টিমের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে হলে দুজনের মধ্যে একজনকে আর্থিক ক্ষতি ও অন্যরকম ঝুঁকি মেনে নিতে হত। শেষ পর্যন্ত দুজন নিজের নিজের টিমে থাকল। এবং আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম অভূতপূর্ব সমালোচনার মুখোমুখি।

খেলা সেই সময়েই সাপ্তাহিক হয়েছে, পত্রিকার আঙ্গিকে আনা হচ্ছে আকর্ষণীয় পরিবর্তন। দলবদলের ধারাভাষ্য আমরা জাঁকজমক করেই ছাপছিলাম। অভিযোগ এল: এক, আমরা মিথ্যা খবর ছেপে কাগজের বিক্রি বাড়িয়েছি। দুই, কয়েকজন ফুটবলার আমাদের মাধ্যমে নিজেদের দর বাড়িয়ে নেওয়ার খেলা খেলেছে। এবং তিন, দলবদলের খবর তুলে আনার জন্য আমাদের রিপোর্টাররা কত পরিশ্রম করেছে, তা নিয়ে অযথা ঢাকঢোল পিটিয়েছি, কিন্তু নির্ভুল খবর পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। আসলে, গোটা ব্যাপারটাকেই ভুলভাবে বোঝা এবং বোঝানো হল। খেলার বিক্রি বাড়ানোর জন্য দলবদলের গপ্পো ছাপার প্রয়োজন ছিল না। দলবদলের অনেক আগে থেকেই খেলার প্রচার সংখ্যা ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত অন্য সব খেলার পত্রিকার থেকে বেশি। দলবদলের রিপোর্টিংয়ে তথাকথিত ব্যর্থতার পরেও খেলার প্রচার সংখ্যা কমেনি। দলবদলের খেলার প্রায় ধারাবর্ণনা পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নির্ভুল কি না এই নিয়ে প্রশ্নই উঠতে পারে। কিন্তু আমাদের চেষ্টায় আন্তরিকতার অভাব ছিল না। ব্যবসা নয়, কিছুটা অভিনবত্বের খোঁজে দলবদলের রিপোর্টিংকে বেশি আকর্ষণীয় করার চেষ্টা হয়েছিল।

আমরা এ কথাও বিশ্বাস করি না যে, কোনও ফুটবলার নিজের দর বাড়ানোর জন্য আমাদের ব্যবহার করেছে। কারণ আমরা তো শুধু ফুটবলারদের সঙ্গেই কথা বলিনি। যোগাযোগ করেছি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গেও। উদাহরণ হিসেবে শ্যামের কথা বলা যায়। শ্যাম তো ইস্টবেঙ্গলে গেলে কয়েক হাজার টাকা বেশিই পেত। প্রসূন-প্রশান্তও একটি টিমে খেলার প্রচারে আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হয়নি। বরং অনেক সমালোচনার সামনে পড়েছে। শৈলেন মান্না শেষ মুহূর্তে সম্মানজনক অফার নিয়ে শ্যামনগরে হাজির না হলে, সুব্রত সেবার মহমেডান স্পোর্টিংয়ে যেত, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। সুব্রত মোহনবাগানে থেকে যাওয়ার জন্য সই করার দিন সন্ধেয় আমাদের অফিসে এসেছিল। বললাম, ‘সামনের বছর তুমি বা অন্য ক্লাবের কোনও কর্মকর্তা তোমার দলবদলের খবর যত জোর দিয়েই দাও, আমরা ছাপব না। এই ধারণা এবার আরও বদ্ধমূল হল যে, তুমি কোনওদিনই মোহনবাগান ছাড়তে পারবে না।’

সুব্রত খুব আস্তে, আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, ‘আমি মহমেডানে সই করতাম। মান্নাদা ভাল অফার নিয়ে এলেন। প্রথমে উপেক্ষা করলেও পরে মোহনবাগানের কর্মকর্তাদের আমার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেই হল। আমার মনে হল, একটা লড়াইয়ে আমি জিতেছি। তাই মোহনবাগানে থেকে গেলাম।’

প্রসূন-প্রশান্ত কেন, কোন পরিস্থিতিতে আলাদা টিমে খেলতে বাধ্য হল, খেলার পাঠক-পাঠিকারা তা জানেন। আমার প্রশ্ন শুধু একটাই, কোনও পত্রিকা কি লিখেছিল যে প্রসূন-প্রশান্ত এক টিমে খেলবে না? প্রশ্নটা আসলে আমার নয়, সুরজিৎ সেনগুপ্তর। প্রসূন-প্রশান্ত এক টিমে খেলার কথা ভেবেছিল, এ কথা সকলেই জানেন। আমরা সেই ভাবনার কথা সবার আগে প্রকাশ করেছি এবং খবরটা সবচেয়ে জাঁকিয়ে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। এ জন্য অনুতপ্ত হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। দলবদলের পালা শেষ হওয়ার পরদিন সন্ধেয় যখন অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি, সুকিয়া স্ট্রিটের মোড়ে এক যুবক গাড়ির কাচের সামনে এসে দাঁড়ালেন। গাড়িটা বিশেষ প্রয়োজনেই মিনিট পাঁচেকের জন্য দাঁড় করাতে হয়েছিল। যুবকের বক্তব্য: আপনি লিখেছিলেন, প্রসূন-প্রশান্ত এক টিমে না খেললে ‘খেলা’ তুলে দেবেন।’

আমি বললাম, ‘এমন কথা কখনই লিখিনি। ‘খেলা’ পত্রিকা তুলে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। বরং আপনারা সকলে কেনা বন্ধ করে দিন। খেলা আপনিই উঠে যাবে।’

খেলা সাপ্তাহিক হওয়ার পর কাজের চাপ বাড়ল। আরও দুজন লোক দরকার। যেহেতু আমরা সকলেই একই সঙ্গে আজকাল এবং খেলার কর্মী, নবাগতদেরও দুটি জায়গাতেই কাজ চালানোর দক্ষতা থাকতে হবে। একজনকে নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না। ঠিক করে রেখেছিলাম, সুযোগ পেলেই পল্লব বসুমল্লিককে নেওয়া হবে।

পল্লবকে প্রথম দেখি ‘খেলার কাগজ’ অফিসে। নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্টস ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এসেছিল একটি সেমিনারে যোগ দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে। সেমিনারে যাওয়া হয়নি। যতদূর মনে পড়ছে ওকে দ্বিতীয়বার দেখি আজকাল অফিসে রিটন টেস্ট নেওয়ার সময়।

ট্রানস্লেশন, প্রেসি, ডিক্টেশন— খারাপ করেনি পল্লব। তবে খেলাধুলোর খবর ও তথ্য সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বেশ অভিনবত্ব দেখিয়েছিল। দশটির মধ্যে পাঁচটির নির্ভুল জবাব দিয়ে বাকি পাঁচটি সম্পর্কে লিখে জানিয়েছিল, কাজ করার সুযোগ পেলে এ ধরনের তথ্য দ্রুত সংগ্রহ করতে বা মিলিয়ে নিতে অসুবিধা হবে না। দুটি কারণে তখন পল্লবকে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এক, প্রথমে মাত্র দুজনকে নেওয়ার কথা হয়। এবং দুই, পল্লব সম্পর্কে আমি তখন কিছুই জানতাম না। নতুন ধরনের ক্রীড়া-সাংবাদিকতা করার ইচ্ছা নিয়ে এবং প্রতিশ্রুতি পেয়ে আজকালে এসেছিলাম। স্বভাবতই আমি এমন ছেলেদের সঙ্গে নিতে চেয়েছি, যাদের ভালভাবে চিনি, যারা টিমওয়ার্কের ক্ষতি করবে না— এমন বিশ্বাস আমার আছে। অজানা কাউকে নেওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইনি। কিছুদিন পর মৈনুদৌল্লা ট্রফি চলার সময় হায়দরাবাদে গেল পল্লব। জানতে চাইল আমাদের কোনওরকম কাজে আসতে পারে কি না। হায়দরাবাদ থেকে ঝকঝকে একটা চাবির রিং কিনল। এবং সেইরকমই ঝকঝকে কিছু ইন্টারভিউ। ভারতীয় ক্রিকেট নক্ষত্রদের সেই সব ইন্টারভিউ আজকালে ছাপাও হল। এবং পল্লব বসুমল্লিক একটু একটু করে আজকালের লোক হতে শুরু করল।

এশিয়াডের অনেক আগেই পল্লবকে দিল্লি যেতে হল, দূরদর্শনের ভাষ্যকার হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। এশিয়াডে ঘোষক হিসেবেও ওর নাম ছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আজকাল ওকে এতটাই গ্রাস করে নিয়েছিল যে ঘোষক হিসেবে কণ্ঠদান করা তো দূরের কথা, দূরদর্শনের অ্যাসাইনমেন্ট রাখতেই ওকে হিমশিম খেতে হয়।

এশিয়াডের আগে দিল্লিতে থাকায়, প্রস্তুতি নিয়ে একের পর এক ভাল রিপোর্ট পাঠানো ওর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। সেই সব রিপোর্ট পেতে পেতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল পল্লবকে নেওয়া হবে। কিন্তু ডাক্তারির চেয়ে ক্রীড়া সাংবাদিকতা ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে কেন? অথবা বলা যায়, কত দিন? এশিয়াডের দিন পনেরো আগে পল্লব একবার কলকাতায় এল এবং আমি কিছু বলার আগেই আজকালে আসার ইচ্ছা আবার প্রকাশ করল। পল্লবকে জানালাম, ‘আমি এদিকে কথা বলে রাখছি, এশিয়াডের পর থেকে তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে।’

প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারে পল্লব। আন্তরিকতারও তুলনা নেই। রোজ সকালে হাসপাতালে যায়, তার পর মাঠ চষে আজকাল অফিসে। আজকালের কাজ, তার পর প্রায়দিনই খেলার কিছু না কিছু লেখা। গভীর রাতে স্কুটারে চেপে বাড়ি ফেরে, কোনও কোনও দিন অফিসেই থেকে যায়। এত ধকল যদি ও আরও কয়েক বছর নিতে পারে এবং চাপের মধ্যে থাকতে পারে এইরকমই সতেজ এবং আন্তরিক, আমরা অনেক কিছু পাওয়ার আশা করতে পারি।

পল্লব কি শেষ পর্যন্ত ডাক্তারিই করবে? অন্তত মুখে পল্লব বলে, ‘না’। এবং ধীমানের মতে, ‘না যাওয়াই ভাল। অন্তত রোগীদের পক্ষে!’

এত পরিশ্রম, এত কাজের চাপের মধ্যেও পল্লব বসুমল্লিক সাজপোশাকের দিক দিয়ে বেজায় কেতাদুরস্ত। সঙ্গদোষ এখনও এ ব্যাপারটা পাল্টাতে পারেনি। (পরে পল্লব পুরোদস্তুর ডাক্তার হয়, আজকালেও থেকে যায় অবশ্য)।

পার্ট টাইমার হিসেবে এমন একটি ছেলেকে আমরা খুঁজছিলাম, যে এজেন্সি কপি থেকে মোটামুটি ভাল অনুবাদ করতে পারে। সাত-আটজনকে পরীক্ষা করে দেখা হল। একজনকে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল তার আন্তরিকতার জন্য, কিন্তু অনুবাদ পছন্দ হল না। অরূপ বসু আজকালের রবিবাসরে খেলার লেখা লিখছিল কিছুদিন থেকে। চমৎকার হাত। কিন্তু আমরা যাকে বলি সাবিং— তাতে কতটা দক্ষ? ভালই খুব অল্প টাকায় ওকে কাজ শুরু করতে বললাম। এক মাস কাটার পর কিছু বেশি টাকা হাতে পেয়ে অরূপ চমকে গেল। ওর কাজ মোটামুটি ভালই লাগছিল এবং আমরা জানতাম মোটামুটি ভদ্রস্থ পরিমাণ টাকা না পেলে কারও কাজে উৎসাহ বাড়ে না। অলক চট্টোপাধ্যায় যদি ধ্রুপদী জিওফ বয়কট হন, অরূপ তা হলে ক্রিস ট্যাভারে। সম্প্রতি ওকে দ্রুতগামী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চমৎকার বাংলা লেখে অরূপ। কিন্তু সব ঋতুতেই ওর এক পোশাক। গ্রীষ্মে, শীতে, বর্ষায় যেমন এক পোশাক চলে না, সব ধরনের লেখায় একই ধরনের ভাষা যে অচল, এই সত্যটা বুঝতে একটু সময় নিচ্ছে। কিন্তু সচেতন, মৃদুভাষী ও পরিশ্রমী অরূপ নিজেকে খেলার কাগজের উপযোগী করে নিতে পেরেছে ক্রমশ।

খেলার প্রুফ দারুণ যত্ন নিয়ে দেখত অরুণ সেনগুপ্ত। শুরু থেকেই পছন্দ এজন্য নয় যে ও আমার লেখার তীব্রতম ফ্যান! নিজের কাজের বাইরেও, রিপোর্টিংয়েও আমাদের টিমকে সাহায্য করার ইচ্ছা প্রথম থেকেই ছিল অরুণের। এমন আন্তরিক ও পরিশ্রমী একজন সরাসরি ক্রীড়াসাংবাদিকতায় আসবে না কেন? এসে গেল।

এই ডায়েরির প্রথম পর্বে আমার অন্য সহকর্মী ও সহ-লেখকদের কথা লিখেছি। একজনের কথা বলা হয়নি। পরিচয় গুপ্ত সেই ‘খেলার কথা’ থেকেই কার্টুন আর ছড়া নিয়ে আমাদের সঙ্গে। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী এই চমৎকার ভদ্রলোকের আসল নাম, বিশ্বাস করুন, এখনও জানি না। মাঝেমাঝেই আসেন, ছবি জমা দেন, দু-একটি কথা বলেই চলে যান। নিজের পরিচয় গুপ্ত রাখার ব্যাপারে ভদ্রলোকের বিশেষ দক্ষতা। আসল নামটা অবশ্য বিল সই করার সময়ই দেখে নিতে পারতাম। কী দরকার?

ধরুন, বেশ রাতে কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যু সংবাদ এল। পরদিনের কাগজে তাঁর ছবি অবশ্যই যাওয়া চাই, কিন্তু তখনই যদি না পাওয়া যায়? খবরের কাগজের অফিসে তৈরি থাকে বিখ্যাত ব্যক্তিদের অন্তত একটি করে ছবি। শুধু মৃত্যু সংবাদের আশঙ্কায় অবশ্যই নয়, খুব ভাল খবরও থাকতে পারে। ধরা যাক, পিটার মে-কে নাইটহুড দেওয়া হল। তারও তো একটা ছবি দরকার।

কিন্তু গ্যারিঞ্চার কোনও ছবি আমাদের কাছে ছিল না। খবরের কাগজের লাইনে নতুন কিনা। একদিন গভীর রাতে বাড়ি ফেরার অনেক পরে ধীমানের টেলিফোন এল: ‘অশোকদা, গ্যারিঞ্চা মারা গেছেন। আপনি নিশ্চয় কিছু লিখবেন? সুরজিৎদার কাছেও খবর পাঠিয়েছি। কিন্তু কোনও ছবি নেই। ‘বললাম,’ছোট হলেও একটা লেখা করছি। সুরজিৎ লিখবেই, অন্য ফুটবলার আর প্রাক্তন ফুটবলারদের মতামত নাও। ছবি নিশ্চয় কোনও না কোনও বই থেকে পাওয়া যাবে। জিমি হিলের ‘সকার সুপারস্টার’-এ তো আছেই।’

আমাকে লাইন ধরে রাখতে বলে ধীমান বইয়ের আলমারি ঘাঁটতে গেল। এবং মিনিট তিনেক পরে ভগ্নকণ্ঠে জানাল: ‘জিমি হিলের বইটি আলমারিতে নেই!’

ছোট্ট লেখা তৈরি করে অফিসে পৌঁছে শুনি, ছবি পাওয়া যাচ্ছে। দেবাশিসের মনে পড়েছে, জিমি হিলের বই সুরজিতের কাছে আছে, সুতরাং আর চিন্তা নেই। সুরজিতের লেখা এল, জিমি হিলের বই এল, ছবি পাওয়া গেল। অনেক বিশিষ্ট ফুটবলার এবং বিশেষজ্ঞর মতামত পাওয়া গেল। দুজনকে ধরা গেল না— অমল দত্ত এবং পি কে ব্যানার্জি। অমলদার বাগুইহাটির বাড়িতে টেলিফোন ছিল না তখন, অত রাতে ওই অল্প সময়ের মধ্যে অত দূরে যাওয়াও সম্ভব নয়। প্রদীপদাকে দশ মিনিট বাদে বাদে টেলিফোন করেও পাওয়া গেল না। সেদিন রঞ্জিত মুখার্জির বিয়ের জন্য বারুইপুরের দিকে গিয়েছিলেন, ফিরেছিলেন অনেক রাতে। পরে অবশ্য প্রদীপদার বক্তব্য ‘খেলা’য় প্রকাশিত হয়েছিল। পৃথ্বীপাল সিংয়ের শোচনীয় হত্যার খবর অফিসে বসেই পেয়েছিলাম, বিকেল পাঁচটা নাগাদ। আমাদের হকি-বিশেষজ্ঞ নির্মলকুমার সাহা তখন অফিসে থাকায় কাজের সুবিধে হল। আমি কিছু বলার আগেই নির্মল জিজ্ঞেস করল, ‘গুরবক্স নিশ্চয় আনন্দবাজারে লিখবেন, আমি কি ক্লডিয়াসের কাছে যাব?’

ক্লডিয়াসের ব্যাপারে সম্মতি জানিয়ে বললাম, ‘গুরবক্সের কাছেও যাও। যেখানেই লিখুন, আমরাও বক্তব্য পাব না কেন? আর যেভাবেই হোক, ভাল ছবি চাই।’

গুরবক্স সিংয়ের লেখা পরে প্রকাশিত হয়েছিল ‘স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকায়। কিন্তু নির্মলের কাছেও তিনি চমৎকার বক্তব্য রেখেছিলেন। এবং সেই রাতেই আমাদের হাতে দুটি দুষ্প্রাপ্য ছবি তুলে দিয়েছিলেন।

গ্যারিঞ্চা এবং পৃথ্বীপাল সিং বিশ্ববিশ্রুত খেলোয়াড়, ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাইনি। কিন্তু জে সি গুহ, জ্যোতিষদাকে তো বেশ কাছ থেকে দেখেছি। গভীর রাতে সেই ধীমানই টেলিফোনে দুঃসংবাদ দিল। তখনই কিছু লেখার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না। একদিন পরে আজকালে লিখলাম, তারপর আর একটা লেখা ‘খেলা’য়। কিন্তু কিছুই যেন লেখা হল না। প্রিয়জনের মৃত্যু কিছুদিনের জন্য বিমূঢ় করে রেখে যায়ই, সেই অবস্থা কেটে যাওয়ার পর হয়ত জ্যোতিষদাকে নিয়ে ভাল লেখার কথা ভাবা যেত। আজকালে সৈয়দ নঈমুদ্দিন চমৎকার আন্তরিক স্মৃতিচারণ করলেন এবং তারপর অমল দত্তর সেই দুর্ধর্ষ লেখা— তাঁর অলিখিত উপন্যাসের নায়ক জ্যোতিষদাকে নিয়ে। তারও পরে লিখলেন প্রশান্ত সিংহ। এবং পুজো সংখ্যায়— পরিমল দে। ‘দি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত চুনী গোস্বামীর স্মৃতিচারণও পাঠক-পাঠিকাদের স্পর্শ করেছিল।

গভীর রাতে অফিস থেকে আসা টেলিফোন নিয়ে আমার আতঙ্ক তাই বেড়েই চলে। তিরাশির ৪ সেপ্টেম্বর পল্লব ধরা-ধরা গলায় শুরু করল, ‘অশোকদা একটা খবর আছে।’ আর একটি মর্মান্তিক মৃত্যুসংবাদের জন্য মানসিক প্রস্তুতি প্রায় নিয়ে ফেলেছিলাম। আধ সেকেন্ড বিরতির পর পল্লব জানাল, ‘ফার্স্ট টেস্ট আর প্রথম দুটো ওয়ান ডে ইন্টারন্যাশনালের জন্য ইন্ডিয়ান টিম এইমাত্র পাওয়া গেল। দিলীপদা, দিলীপ দোশি টিমে আছেন।’

তখনই কথা হয়ে গেল, খেলার পাতায় ওপরে টেস্টে নির্বাচিত চোদ্দজন ক্রিকেটারের ছবি প্যানেল করে যাবে এবং বিশিষ্ট কর্মকর্তা ও ক্রিকেটারদের মতামত নেওয়া হবে। কিন্তু, প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা, আগেই লিখেছি, পল্লব কথা শুরু করেছিল ধরা ধরা গলায়। আজকালের খেলার পাতা সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়ার পরই বুঝলাম, পল্লব কেন চিন্তিত এবং তখনও টেলিফোন ছাড়েনি। ৯ সেপ্টেম্বর সংখ্যা ‘খেলা’র সব কাজ শেষ, ছাপা হবে পরদিন সকালেই। এবং তাতে তিন পৃষ্ঠা জুড়ে দিলীপ দোশিকে নির্বাচিত করার দাবি জানিয়ে গোপাল বসুর লেখা, সেই সঙ্গে বাংলার অন্য ক্রিকেটারদের বক্তব্য। এবং আমার একটি সম্পাদকীয়— ‘দোশিকে টিমে নিতে হবে’। দোশি টিমে আসার পরে এই সব লেখা দেখে পাঠক-পাঠিকারা কী ভাববেন?

টেলিফোন লাইনে এসে রতন ভট্টাচার্য পরামর্শ দিল: ‘সাড়ে তিন পৃষ্ঠা পাল্টানোর সময় নেই। তুমি বরং এডিটোরিয়ালটা পাল্টে দাও।’ বাড়িতে বসেই মিনিট কুড়ির মধ্যে লেখা হল পরিবর্তিত সম্পাদকীয়— ‘দোশিকে ডাকা হল’। তার পাঁচ মিনিট পরেই অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে এসে গেল দেবাশিস। আর একটি নির্দেশ দিলাম: গোপালের লেখা এবং অন্যদের দাবির হেডিং পাল্টে এইরকম করা হোক— ‘দিলীপকে প্রথম দলে রাখা উচিত’। আগে হেডিং ছিল— ‘দিলীপকে ভারতীয় দলে রাখা উচিত’। আজকালের কাজ শেষ হওয়ার পর রাত আড়াইটা নাগাদ আমার এডিটোরিয়াল কম্পোজ করা হল, পেস্টিং হল তার পরে।

প্রথমে বাঙ্গালোর, তারপর বোম্বাই, তারও পরে কলকাতায় কথাবার্তার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, সুনীল গাভাসকারের সম্পাদনায় ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার’ প্রকাশিত হবে। প্রথমে ঠিক ছিল, খবরটা গোপন রাখা হবে। কিন্তু সানি ফিরে যাওয়ার দিন আজকাল অফিসে এসে সব কিছু একবার দেখে নিতে চাইল। আমরাও চাইছিলাম। ক্যালকাটা ক্লাবে লাঞ্চ, তারপর গ্র্যান্ড হয়ে দুপুর তিনটে নাগাদ আজকাল অফিসে পৌঁছে দেখি, সামনে কয়েকশো লোক। কী করে যেন খবরটা চাউর হয়ে গেছে। অফিসের ভেতরেও একই দৃশ্য। অন্তত দশজন ক্যামেরাম্যান অজস্র ছবি তুলে গেলেন, আজকালেরই অনেক কর্মী অটোগ্রাফ নিলেন, আলাপও করিয়ে দিলাম অনেকের সঙ্গে। কিছুক্ষণ খেলার ঘরে, কিছুক্ষণ প্রকাশকের ঘরে বসার পর সানি যখন এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠল— আজকাল অফিস উত্তাল এবং আরও অনেক ক্রিকেট-উৎসাহী গাভাসকারকে সামনে থেকে দেখার আশায় হাজির। গাড়ি ছাড়ার পর সানি বলল, ‘খবরটা আর চেপে রাখতে পারবে না। ঠিকই রটে যাবে, তার চেয়ে ছেপে দেওয়াই ভাল, একটু পাবলিসিটি আগে থেকেই হয়ে যাক।’

পরদিন আজকালে আমার লেখা বেরল— ‘সানি এবার সম্পাদক’। কয়েকদিন পরে বোম্বাইয়ে পল্লবের হাতে আজকালের ওই দিনের কপিটা সানি দেখেছিল। ও একটু একটু বাংলা পড়তে পারে, ছোটবেলায় ওদের বাড়ির পাশেই একটি বাঙালি পরিবার ছিল। সানি অবশ্য একটু ভুল পড়ল— সানি আমার সম্পাদক। পল্লব ভুলটা ধরিয়ে দিল। সঙ্গের ছবিটা দারুণ ছিল। আমার টেবিলে বসে কাজ করছে সানি, পেছনের বোর্ডে খেলার কয়েকটা সংখ্যার কভার। তবে, সানগ্লাসটা কপালের ওপর তোলা ছিল। সাজানো ছবিতে এটুকু খুঁত ধরতে নেই।

ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারের জন্য গোপাল বসু ও অলক চট্টোপাধ্যায়কে আমরা প্রথমেই বেছে নিয়েছিলাম। পরে এল অরূপ। মোহনবাগানের কট্টর সাপোর্টার অরূপ, বিশিষ্ট চিত্রাভিনেতা অনিল চ্যাটার্জির ছেলে। কাজের চাপে একাধিকবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে অরূপ। মাঝে মাঝেই কাজ করতে হচ্ছে রাত জেগে। একবার টানা আটচল্লিশ ঘণ্টা বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না, কোনও খবর না পেয়ে উদ্বিগ্ন পিতাকে বারবার টেলিফোন করতে হয়েছে। পরে অরূপ টেলিগ্রাফে গিয়ে আরও ভাল কাজ দেখিয়েছে।

শিল্পী অপূর্ব পাল আর আমাদের ওয়ার্কস ম্যানেজার অমিত রায়চৌধুরিও ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারকে ভাল পত্রিকা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমাদের সবচেয়ে অসুবিধায় পড়তে হল সানিকে নিয়েই। ঠিক ওই সময়েই ওকে পর পর দুটো সফরে (পাকিস্তান আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ) যেতে হল। যেটুকু সময় পাওয়া গেল, তা যথাসম্ভব কাজে লাগাতে গোপাল বসু আর অলক চট্টোপাধ্যায়কে বোম্বাই যেতে হল। পাকিস্তান রওনা হওয়ার কয়েক দিন আগে সানি একবার কলকাতায় এল। সারা দিন গ্র্যান্ডের চারশো সতের নম্বর ঘরে আলোচনার পর এয়ারপোর্ট রেস্তোরাঁয় গিয়েও প্রসঙ্গ পাল্টায়নি। তখনও পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় হাতে ছিল। ফাইলপত্র রেখে আসা হয়েছিল আজকাল অফিসে, তাই শেষ পর্যন্ত রেস্তোরাঁর ক্যাশমেমোর উল্টোদিকও ব্যবহার করতে হল।

ততদিনে আমাদের ঘরে আন্তর্জাতিকতার গন্ধ ঢুকে পড়েছে। আজ যদি ইয়ান বথামের লেখা আসে, পরদিন হাতে আসছে রোহন কানহাই বা মাইক ব্রিয়ারলির চিঠি। কিছুদিন যাযাবর জীবনযাপনের পর ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার’ ভদ্রস্থ জায়গা পেল। প্রথম সংখ্যার (এপ্রিল, ১৯৮৩) জন্য ইমরান আর ভিশির দুটি চমৎকার ইন্টারভিউ করে পাঠাল সানি নিজেই। প্রথম সংখ্যার কভারে কপিলের ছবি যাবে, এই সিদ্ধান্তটাও সানিই নিয়েছিল। প্রথম দিকে আমার পরামর্শ মাঝে মাঝে প্রয়োজন হয়েছে, পরে গোপাল-অলক-অরূপ কোম্পানি অনেকটাই স্বাবলম্বী।

‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার’-এর প্রথম সংখ্যা যখন প্রকাশিত হল, এডিটর সাহেব তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে। তবে, প্রথম সংখ্যাকে সফল করার জন্যই কিনা কে জানে, তার কয়েকদিন আগে গায়ানায় সানি একটা চমৎকার সেঞ্চুরি করেছিল। ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার’-এর সঙ্গে সানির প্রথম দেখা হল বোম্বাইয়ে, এয়ারপোর্টে।

প্রথম সংখ্যা পনের হাজার কপি দেখতে দেখতে শেষ। অসংখ্য চিঠি এল ভারতের বিভিন্ন শহর থেকে। অধিকাংশই প্রশংসা, কিছু সমালোচনা, কিন্তু যাকে বলে সাড়া জাগানো— ব্যাপারটা সেইরকমই দাঁড়াল। একাধিক ফুটবলার এবং ক্রিকেটার আমাদের অফিসে এসে পত্রিকা নিল। কয়েকটি জায়গা থেকে পত্রিকা কালোবাজারে বিক্রি হওয়ার খবরও এল। এজেন্ট ও হকারদের দিক থেকে এল উত্তেজিত প্রশ্ন: ‘আপনারা এত কম কপি ছাপলেন কেন?’ সার্কুলেশন ম্যানেজার ও তাঁর সঙ্গীদের কাছে পরিস্থিতিটা সেই মুহূর্তে যতই অস্বস্তিকর হোক, সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কাছে এই প্রশ্ন যে কত মধুর, তা নিশ্চয় বলে বোঝাতে হবে না।

প্রাথমিক উল্লাস থিতিয়ে যেতেই আমরা বুঝলাম, দেখলাম, বেশ কিছু ভুল হয়ে গেছে। নানা দিক দিয়ে পত্রিকার আরও উন্নতি প্রয়োজন। আত্মসমালোচনায় মুখর হয়ে আমরা ভাবতে বসলাম, কোথায় কোথায় গণ্ডগোল হয়েছে। কিন্তু এই সময়েই একটা বড় আঘাত এল। ‘সানডে’ পত্রিকায় জনৈক বিনু কে জন জঘন্যভাবে সানি এবং গোপালকে আক্রমণ করলেন, যার মধ্যে অক্ষম ঈর্ষা ছাড়া আর কিছু ছিল না। প্রথম সংখ্যায় সানির সম্পাদকীয় হেডিং ছিল— ‘দি ফার্স্ট বল’। বিনু কে জন লিখলেন, প্রথম সংখ্যা পড়ে তাঁর ধারণা হয়েছে, অল্প দিনের মধ্যেই সানিকে যে সম্পাদকীয় লিখতে হবে, তার হেডিং হতে পারে— ‘দি লাস্ট ওভার’। আরও লেখা হল শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে একটি বেসরকারি টেস্ট ম্যাচে ভারতের ইনিংস শুরু করেছিল গাভাসকার-গোপাল বসু জুটি, আর এগোয়নি, এই নতুন উদ্যোগের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তার চেয়ে বেশি দূর এগোতে পারবে বলে মনে হয় না। দু-একটি ছাপার ভুলকেও সমালোচনার মধ্যে এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বিনু কে জন। সানির সাংবাদিকতায় আসা নিয়ে ব্যঙ্গ করা হল, এমনকি সানি যে কোম্পানিতে চাকরি করে, সেই নিরলন কেন ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিল, তাই নিয়েও কটাক্ষ। আক্রমণের সামনে সৌজন্য বা উপেক্ষা নয়, আক্রমণের বদলে পাল্টা আক্রমণ— এই পথেই চলতে চাই।

খেলায় আমার লেখায় (‘আমরা আক্রান্ত’) পাল্টা আক্রমণ শানানো হল। কিছুদিন পর বোম্বাই থেকে সানি জানাল, ‘সানডে’র দুর্দান্ত সম্পাদক এম জে আকবর দুঃখপ্রকাশ করেছেন। জানিয়েছেন, লেখাটি আগে পড়লে তিনি কিছুতেই ছাপতে দিতেন না।

পরে, অনেক পরে অবশ্য সত্যিই ‘লাস্ট’ ওভার’ এল ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার পত্রিকার। সেজন্য সুনীল গাভাসকার দায়ী ছিল না। আমরাও দায়ী ছিলাম না সরাসরি। কোনও একদিন জানানো যাবে সে কাহিনী। তবে, হয়ত তখন, একইসঙ্গে ঘোষণা করা যাবে ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার-এর পুনরাবির্ভাবের খবরও। দ্বিতীয় ইনিংস!

আক্রান্ত হওয়ার কথা ওঠায় আর একটি ঘটনা মনে পড়ছে। কলকাতায় সন্তোষ ট্রফির খেলা চলার সময় আজকালে পাঞ্জাবের অধিনায়ক পারমারের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। পারমার আই এফ এ-র বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ করেছিলেন। আই এফ এ-র স্বনামধন্য সম্পাদক অশোক মিত্র পরদিন পাঞ্জাবের খেলা শেষ হওয়ার পর পারমারকে সাংবাদিকদের সামনে নিয়ে এলেন। পারমার বললেন, ‘তিনি কোনও সাংবাদিকের কাছে কোনরকম বক্তব্য রাখেননি।’

পরদিন কলকাতার একাধিক বিখ্যাত দৈনিকপত্রে পারমারের বক্তব্য ছাপা হল। উৎসাহের আতিশয্যে আনন্দবাজার হেডিং করল: ‘সাক্ষাৎ না করেই সাক্ষাৎকার।’ অশোক মিত্র ভাবলেন, অশোক দাশগুপ্তদের শেষ পর্যন্ত শুইয়ে দেওয়া গেছে। আমরা অবশ্য অন্যরকম ভাবছিলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আই এফ এ-র চাপে পারমারকে ওই বিবৃতি দিতে হয়েছে। তাঁকে বোঝানো হয়েছিল, আজকালের রিপোর্ট পড়ে পাবলিক খুব ক্ষেপে গেছে, পাঞ্জাব টিমের ভাল চাইলে, অস্বীকার করে বিবৃতি দেওয়া দরকার। আজকালে একটি লেখায় জানলাম, সরোজ কবে কখন কোথায় কতক্ষণ ধরে ইন্টারভিউ নিয়েছে, সেই ঘরে আর কে কে ছিলেন। প্রমাণ করা গেল, পাঞ্জাব শিবিরে গিয়ে অধিনায়কের সঙ্গে কথা না বললে ওই রিপোর্টে প্রকাশিত অনেক খবরই পাওয়া সম্ভব ছিল না।

অশোক মিত্র তখনও আনন্দে আছেন। কিন্তু, পাঞ্জাব ছাড়ার আগে পারমার নিজের হাতে বিবৃতি লিখে সই করলেন। তাঁর বক্তব্য: আজকালের সরোজ চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়েছে এবং তিনি আই এফ এ সম্পর্কে ও-সব কথা বলেছেন।

চক্রান্ত খুব গভীর ছিল। এই একটি অপপ্রচারকে ভিত্তি করেই ক্রীড়ামোদীদের মধ্যে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব হত যে, আজকাল ‘সাক্ষাৎ না করেই সাক্ষাৎকার’ ছাপে। চক্রান্তটা মাঠে মারা গেল। তবে অশোক মিত্রর সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হল না! দেখা হবে আবার, গড়াপেটার যুদ্ধক্ষেত্রে।

বিরাশির দিল্লি এশিয়াড আসন্ন। শুধু আজকাল নয়, খেলার কথাও মাথায় রাখতে হল। আমাদের টিমটা খুব ছোট হল না। আমার সঙ্গে ধীমান তো থাকছেই, প্রধানত ফুটবল রিপোর্টিংয়ের জন্য সুরজিৎও গেল। সুভাষ ভৌমিকের সঙ্গে আগেই কথা হয়েছিল, সস্ত্রীক এশিয়াড দেখতে যাচ্ছে। আজকালের জন্য সুরজিৎ এবং খেলার জন্য সুভাষ। দিল্লিতেই ছিল পল্লব। প্রয়োজনে সাহায্য করতে পারবে শিবাজী দাশগুপ্ত আর প্রদীপ রায়। একমাত্র ফটোগ্রাফার এস এস কাঞ্জিলাল। ফর্ম পাঠানোর সময় শ্রেণিকের সই না পাওয়ায় ওর কার্ড করা যায়নি। শ্রেণিক এশিয়াডের আগে ইংল্যান্ডে ছিল বেশ কিছুদিন। কলকাতার অফিসে এশিয়াড কভারেজের মূল দায়িত্ব থাকল স্পোর্টস-এর অলক চট্টোপাধ্যায় এবং নিউজ-এর সুমন চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। সাহায্য করার জন্য স্পোর্টস-এর অন্যরা এবং ছোটদের পাতার ধ্রুবজ্যোতি নন্দী।

১৪ নভেম্বর বিকেলে রাজধানী এক্সপ্রেসে ওঠার আগে, হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই এশিয়াডের গন্ধ পাওয়া গেল। বাংলাদেশের অনেক প্রতিযোগী ওই ট্রেনেই দিল্লি যাচ্ছেন। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই মেরুন ব্লেজার। এক ভদ্রলোককে খুবই ব্যস্ত দেখলাম। কালো, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। এই ভদ্রলোক দিল্লিতে আমার সাংবাদিক জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন, কয়েকদিন পরেই।

ট্রেন ছাড়ল। স্ন্যাকস আর চা এল। ঠাণ্ডা কম্পার্টমেন্ট, সামনে চমৎকার চা, খুব আস্তে গান ভেসে আসছে, শুধু একটাই দুঃখ যে ভেতরে সিগারেট ধরানোর অনুমতি নেই— বেরসিক ধীমান জিজ্ঞেস করল, ‘অশোকদা, বাংলাদেশ টিম তো এই ট্রেনেই যাচ্ছে, কাজ শুরু করে দিই?’

ধীমানের এই মুশকিল। ও বোধহয় তাজমহল দেখতে গিয়েও ভাববে, আগ্রায় কোনও প্লেয়ার পাওয়া যায় কিনা— যার ইন্টারভিউ নেওয়া যায়। বললাম, ‘এখন চা খাও।’ ধীমান চা শেষ করল। তারপর কম্পার্টমেন্টের বাইরে গিয়ে সিগারেট শেষ করল। এবং তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘জ্যাকেরিয়া পিন্টো আছেন, তাঁকে দিয়েই তাহলে শুরু করি?’

ধীমানের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই আমাদের কম্পার্টমেন্টে ঢুকলেন বাংলাদেশের দুই অ্যাথলিট। ওঁদের জায়গা কয়েক কামরা পেছনে। এশিয়াড কভারেজের ফিতে কাটার দায়িত্বটা ধীমানের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলাম। ধীমান খুব খুশি। এতক্ষণ অস্বস্তিতে ছিল। এবার নিশ্চিন্ত— কাজ শুরু হয়ে গেছে।

কাঞ্জিলাল একই কম্পার্টমেন্টে ওর দু-তিনজন ফটোগ্রাফার বন্ধুর কাছাকাছি জায়গা করে নিয়েছিল। আমাকে ‘ইন অ্যাকশন’ দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘ছবি তুলি?’ আমি ‘না’ বলায় নিজের জায়গায় ফিরে গেল। ধীমান জিজ্ঞেস করল, ‘কেন অশোকদা, ট্রেনের মধ্যে ছবি তোলার নিয়ম নেই?’

বাংলাদেশের ওই দুই প্রতিযোগীর নাম নজরুল ইসলাম রুমি ও গিয়াসুদ্দিন। দুজনেরই ইভেন্ট ব্রডজাম্প, ট্রিপল জাম্প। রুমি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, দেখতে অনেকটা আমাদের চিন্ময় চ্যাটার্জির মত। কথাবার্তাও প্রায় একইরকম— বুদ্ধিমান আর রসিক। রুমিকে কিন্তু জানাইনি যে, আমরা খবরের কাগজের লোক। প্রথমেই একটা দেওয়াল গড়ার কী দরকার? দুই বাংলার মানুষ এক জায়গায়, কথা হবে সহজভাবে, এটাই তো ভাল। আধঘণ্টা পর অন্য কম্পার্টমেন্টের দিকে যেতে যেতে রুমি বলে গেলেন, ‘দিল্লিতে গিয়ে দেখা করবেন, পাস দেব। এশিয়াড ভিলেজের রিসেপশনে আমাদের দুজনের নাম বলবেন, ঠিক চলে আসব।’

আমি বললাম, ‘ওখানে কি আর আমাদের চিনবেন? শেষ পর্যন্ত সেই টিকিট কেটেই আপনাদের ইভেন্ট দেখতে হবে।’

১৫ ডিসেম্বর সকালে জ্যাকেরিয়া পিন্টোর (বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলার, আবাহনী চক্রের অধিনায়ক হিসেবে কলকাতাতেও খেলে গেছেন) সঙ্গে আলাপ হল। রুমি আরও তিন-চারজন অ্যাথলিটের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। দেখতে দেখতে ট্রেন নিউদিল্লি পৌঁছে গেল। স্টেশনে পল্লব অপেক্ষমাণ। কিন্তু পৌঁছেই দুঃসংবাদ, আমাদের অফিসের স্ট্যান্ডার্ড গাড়িটি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। বিদ্রোহ দমন করতে, নির্মম গ্যারেজ মালিকেরও ধারণা, অন্তত এক সপ্তাহ সময় লাগবে। তাহলে উপায়?

পল্লব এশিয়াডের অনেকদিন আগে থেকে দিল্লিতে, কাঞ্জিলাল দিল্লিতে আসে ঘনঘন। ওরা দুজনই আমাকে আর ধীমানকে আশ্বাস দিল, ‘অত চিন্তার কিছু নেই, দিল্লিতে ট্যাক্সি পাওয়া কলকাতার মতো কঠিন নয়।’

এই দুই বালককে বলা যেত যে, আমিও এর আগে একুশবার দিল্লিতে এসেছি এবং আমার সঙ্গে একবারও গাড়ি ছিল না। কিন্তু, এশিয়াড কভার করার জন্য নিজেদের গাড়ি চাই, সম্ভব হলে একাধিক। হোটেলে ফিরে জানলাম, এশিয়ান গেমস সংগঠন কমিটি বিভিন্ন স্টেডিয়ামে যাওয়ার জন্য চমৎকার বাসের ব্যবস্থা করেছে। বাস হোটেল থেকে একটু পরে পরেই ছাড়বে। খুব ভাল কথা, কিন্তু এ-সবে সন্তুষ্ট হলাম না। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হইহই করে খবর তুলে আনতে হবে আগামী কয়েকদিন এবং সেদিনই পাঠাতে হবে সব খবর, নিজেদের ট্রান্সপোর্ট চাই।

স্নান-খাওয়া সেরে পি টি আই বিল্ডিংয়ে আজকাল অফিসে গিয়ে টেলিফোন করলাম। আমাদের চিফ এগজিকিউটিভ সুনীল ভট্টাচার্য অ্যাম্বাসাডরের ব্যবস্থা করে দিলেন। সেদিন রাতে দিল্লি পৌঁছে গেল সস্ত্রীক সুভাষ ভৌমিক, সুরজিৎ এবং সুরজিতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নামী ভলিবলার প্রকাশ রায়। পরদিন সকাল থেকে সুভাষের হাতেও একটা অ্যাম্বাসাডর এসে গেল। কিন্তু পরে দেখা গেল, দুটো গাড়িও যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে তিন-চারজনকে, সুতরাং ট্যাক্সি আর অটোরিকশরও দরকার হল।

অশোকা যাত্রীনিবাস হোটেলে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সাংবাদিকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই হোটেলেই এশিয়াড শুরু হওয়ার আগের কয়েকদিন ভারতীয় ফুটবলাররা ছিল। হোটেলের কাজ তখনও শেষ হয়নি। নিচের কাফেটেরিয়া ও কফিশপ বিরাট, দারুণ। তাছাড়া আর সবই অতি সাধারণ।

সস্ত্রীক সুভাষ একটি ঘরে, সস্ত্রীক আমি আর একটি ঘরে, তৃতীয় ঘরে ধীমান আর কাঞ্জিলাল। সুরজিৎ আর প্রকাশ ওদের এক দাদার বাড়িতে থাকল, পল্লব আগে থেকেই ডেরা বেঁধেছিল কাছের একটা গেস্ট হাউসে। কাজের সুবিধের জন্য সুরজিৎকে হোটেলেই থাকতে বলেছিলাম। ও বলল, ‘কোনও চিন্তা নেই, রোজ রাতে যতক্ষণ বলবে, থাকব, যত সকালে আসতে বলবে, আসব।’

‘কিন্তু গভীর রাতে গান শোনার কী হবে?’

শিল্পীর আশ্বাস পাওয়া গেল: ‘মাঝে মাঝে থেকে যাব, গানও শোনাব, শোনার মতো অবস্থা যদি তোমাদের থাকে।’

রোজ রাত ১১টা সাড়ে ১১টায় কাফেটেরিয়ায় বসে মিটিং করতাম। কাল কে কোথায় যাবে, কে কী কাজ করবে। কাঞ্জিলালকে একটু আগে ছেড়ে দিতাম, রোজ খুব ভোরে ছবি কলকাতায় পাঠানোর জন্য ওকে এয়ারপোর্টে যেতে হত।

সুরজিৎ অনেক রাত পর্যন্ত থাকত, মাঝে মাঝে হোটেলে থেকেও গেছে, কিন্তু সকালে আসার ব্যাপারে কথা রাখতে পেরেছে কদাচিৎ। রাতের মিটিংয়ে তাই পাঁচ মিনিট সময় বরাদ্দ ছিল সুরজিৎকে সমালোচনা করার জন্য। এবং রোজই সুরজিতের স্টক অ্যানসার: ‘কাল খুব আগে চলে আসব।’ এই ‘কাল’টা বলা বাহুল্য এশিয়াড চলার সময়ে আর আসেনি।

পল্লবও প্রথম তিন-চারদিন দেরি করায় খুব বকুনি খেল। বুদ্ধিমান ছেলে, তারপর প্রস্তাব দিল, ‘এবার থেকে আমি আর সকালে আসব না। শুধু শুধু কয়েক মিনিট সময় নষ্ট, সোজা আমার অ্যাসাইনমেন্ট অনুযায়ী চলে যাব, দেখা হবে অফিসে সন্ধের সময়।’

মুশকিল হল, ধীমানও লেট রাইজার। কিন্তু সাতসকালে কফি আনিয়ে দরজায় টোকা মারত সুভাষ। এমনিতে হইহই করে থাকে, কিন্তু মিটিংয়ে সিরিয়াস। সব সময় বলত, ‘ভাই, আমার ঘাড়ে একটাই মাথা! এখানে অশোক আমাদের সবার লিডার, জেনারেল, ওর কথা শুনতেই হবে।’

সুভাষ ‘খেলা’ ছাড়াও ‘দি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় লিখছিল। জিজ্ঞেস করে নিয়েছিল, এতে আমার কোনও আপত্তি আছে কি না। আপত্তি করিনি। আজকালের জন্যও কিছু লেখা সুভাষের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল। টেলেক্সের জন্য রোমান হরফে লেখা চাই, প্রথম দিকে সুভাষের বক্তব্য শুনে নিয়ে অন্য কেউ লেখা তৈরি করত। কিন্তু পরে, নিজেই রোমান হরফে লেখা পাঠানো শিখে গেল।

সকালে এশিয়াড ভিলেজ হয়ে আমি নেহরু স্টেডিয়ামে অ্যাথলেটিক্স-এর আসরে যেতাম, সঙ্গে প্রায়দিনই সুরজিৎ। ধীমান এশিয়াড ভিলেজ থেকে অন্য কোথাও যেত। পল্লব তো আগের রাতেই অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ঘুরত এক স্টেডিয়াম থেকে অন্য স্টেডিয়ামে। সন্ধেবেলায় আমি অফিসে। পল্লব এসে যেত, ধীমান কিছু কপি পাঠিয়ে আবার এশিয়াড ভিলেজ যেত শেষ খবর কিছু পাওয়ার আশায়, ফুটবল মাঠ থেকে ফিরত সুরজিৎ আর সুভাষ। রোজ ভলিবল দেখতে ইন্দ্রপ্রস্থ স্টেডিয়ামে যেত প্রকাশ। বলত, ‘কী সব ফালতু খেলা দেখে সময় নষ্ট করছ!’ প্রকাশ অবশ্য ফুটবল মাঠেও নিয়মিত যেত। বলত, ‘ভাস্কর ক্যাপ্টেন, যেতে তো হবেই।’

দিল্লিতে সারাদিন আমরা কাজে ব্যস্ত থাকতাম। কতরকম সমস্যা। আমাদের বিশেষ ভাবতে হয়নি, কারণ প্রকাশ রায় ছিল। মাঝে মাঝেই দুর্দান্ত মন্তব্য করে বা ছড়া কেটে আমাদের ক্লান্ত মুখে হাসি ছড়িয়ে দিত। সেরা জিনিসটি বেরিয়ে এসেছিল কুয়েত-উত্তর কোরিয়া ফুটবল সেমিফাইনালের পর, গভীর রাতে।

ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার পরই আমাদের মধ্যে দুটি শিবির দেখা যায়— কে চ্যাম্পিয়ন হবে, এই নিয়ে। সুরজিতের ফেবারিট কুয়েত, সুভাষের ইরাক। ধীমান অবশ্য এক কথাই বলে গেল, প্রদীপদা কোচ, ইন্ডিয়া কিছু একটা করবেই।

কুয়েত খুব কষ্ট করে উত্তর কোরিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে উঠল। কিন্তু মাঠের অধিকাংশ দর্শকই মানলেন, রেফারি অন্যায়ভাবে উত্তর কোরিয়াকে হারিয়ে দিয়েছেন। মরণপণ ফুটবল খেলে— এক সময় অনেক দক্ষ কুয়েতকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল উত্তর কোরিয়া। হেরে যাওয়ার পর ওদের অতিরিক্ত খেলোয়াড় এবং অন্য ইভেন্টের প্রতিযোগীরা থাইল্যান্ডের অসৎ রেফারিকে আক্রমণ করে। রেফারিকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। শেষ পর্যন্ত এজন্য উত্তর কোরিয়াকে শুধু এই টুর্নামেন্ট থেকে নয়, আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকেই কিছুকালের জন্য বহিষ্কৃত করা হয়।

ওই রাতে, রাত সওয়া ১১টা নাগাদ অফিস থেকে হোটেলে ফিরছিলাম দলবেঁধে। রাত ৯টার পর আর গাড়ি রাখা হত না। আজকালের দিল্লি অফিস থেকে হোটেল, পল্লবের মতে পাঁচ মিনিট, আর ধীমানের মতে কুড়ি, আমাদের সবার মিনিট পনেরো লাগত। সব খবর ঠিকমত পাঠাতে পারলে বেশ খুশি মনে ফেরা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় একটু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। সেদিন হঠাৎ সুরজিৎ বলল, ‘রেফারি যা-ই করে থাকুন, তাঁকে এভাবে আধমরা করে দেওয়া উচিত হয়নি।’ সুরজিতের মন্তব্যে কুয়েতের প্রতি সহানুভূতির একটা গন্ধ পাওয়া গেল। রেফারি অন্যায় করেছেন এটা প্রায় সবাই মানছে। সুভাষ ভৌমিক বলল, ‘কুয়েতের টাকার অভাব নেই, ব্যাটা প্রচুর খেয়েছে।’ কিন্তু সুরজিতের বক্তব্য, রেফারিকে আধমরা করে ফেলা ঠিক হয়নি। এই অবস্থায়, প্রকাশ এই ছড়াটি শুনিয়েছিল:

‘পাপ করেছ রাশিরাশি

ভুগবে তোমার মাসিপিসি?’

শুনশান রাত, দিল্লির শীতার্ত রাজপথকে উষ্ণ করে আমরা সকলেই প্রাণ খুলে হেসে উঠলাম। কাজ শুরু হত সকাল ৮টা সাড়ে ৮টায়, তারপর রাত সাড়ে ১১টায় যে সবাইকে এভাবে চাঙ্গা করে দিতে পারে, তাকে আমরা টিমের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবেই বিবেচনা করেছিলাম।

অত রাতে ঠিকমত খাবার প্রায় দিনই পাওয়া যেত না। শক্ত চাপাটি, গরম কিন্তু কম সেদ্ধ হওয়া ভাত, একঘেয়ে মাটনকারি— খিদের মুখে সবই অবশ্য উঠে যেত। মাঝে মাঝে পল্লব ভাল রেস্তোরাঁ থেকে খাবার আনত। পল্লবের কিন্তু না খেলেও চলত। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সন্ধের পর আজকাল অফিসে এসে টোস্ট-ওমলেট, মাঝে কিছু না। সময় বা ইচ্ছে, কিছুই নাকি হত না। প্রায়ই বকতাম, ‘একে এত পরিশ্রম, তার ওপর খাওয়া-দাওয়া করছ না, কলকাতায় ফিরে ঠিক অসুখে পড়বে।’ কলকাতায় ফিরে জঘন্যভাবে অসুখে পড়তে হয়েছিল অবশ্য আমাকেই।

১৫ নভেম্বর বিকেলে এশিয়াড ভিলেজের দিকে গিয়ে চমৎকৃত হলাম। সত্যিই বিশাল ব্যাপার। পাশের দুর্দান্ত অডিটোরিয়ামের মুখে কয়েকজন বিশালদেহী ওয়েট লিফটারের সঙ্গে দেখা। ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই দেখি, আরও দুজন সঙ্গীকে নিয়ে রুমি আসছেন। ততক্ষণে আমাদের বুকে সাংবাদিকদের জন্য নির্দিষ্ট সবুজ কার্ড উঠে গেছে, না হলে তো এশিয়াড ভিলেজের রিসেপশন সেন্টারের সামনেই যাওয়া যাবে না। রুমি হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাহলে এই ব্যাপার। ইস, আপনাদের টিকিট দেওয়ার সৌভাগ্য তাহলে আমার হবে না!’

রুমি উচ্ছ্বসিত হয়ে আরও বললেন, ‘এ যা এলাহি ব্যাপার আপনারা করেছেন, জাপানের ছেলেমেয়েরাও চমকে যাচ্ছে, আমাদের কথা ছাড়েন।’

কথা হল, বাংলাদেশের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে, এমনকি ভিলেজে অন্য কোনও দেশের ডেরায় যেতে হলেও আমরা রুমির সাহায্য নিতে পারি।

এশিয়াড ভিলেজের বিশাল ও সুসজ্জিত রিসেপশন সেন্টার প্রথম দিন থেকেই জমজমাট। এশিয়ার নানা দেশের চকমকে ক্রীড়াবিদদের নানা ভাষার গুঞ্জনে মুখর। আট ফুট লম্বা জাপানি বাস্কেটবলারের সঙ্গে আলাপ হতে না হতেই সামনে জাফর ইকবাল, জাফরের সঙ্গে গল্প জমতে না জমতেই হইহই করে হাজির ভাস্কর গাঙ্গুলি, ওদিকে চীনের মেয়েরা আস্তানায় ফিরছে সাদা ফুলের মতো হাসি ছড়িয়ে। আর, ওই যে, উনি পাকিস্তানের হকিস্টার হাসান সর্দার। ওই তো প্রকাশ পাড়ুকোন। কিন্তু প্রকাশের সঙ্গে কথা বলছেন কে? গলায় ঝোলানো কার্ড, ছি ছি আগে ছবি দেখা সত্ত্বেও চিনতে পারিনি, হ্যান জিয়ান! আর ওই যে টুকটুক করে হেঁটে যাচ্ছে বুলা চৌধুরি।

রাত সাড়ে ৯টার মধ্যে কলকাতায় কপি পাঠানো শেষ। পরদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সবচেয়ে ভালভাবে কভার করব, এই প্রতিজ্ঞা আমাদের সবার মধ্যেই ছিল। পরিকল্পনা হল এইরকম: সকাল থেকে ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে থাকবে ধীমান আর কাঞ্জিলাল। ওখানে মশালে অগ্নিসংযোগ করবেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। পরে হাতে হাতে সেই মশাল আসবে বাইরে, দিল্লির রাজপথে সেই মশাল বহন করবেন কীর্তিমান ক্রীড়াবিদরা। গুরবচন সিং মশাল নিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকবেন, কমলজিৎ সাঁধু ও মিলখা সিংয়ের হাত ঘুরে সেই মশাল আসবে ডায়না সিমস ও বলবীর সিংয়ের হাতে। ওঁরা দুজন অতঃপর ওপরে উঠে প্রজ্জ্বলিত করবেন এশিয়াডের পবিত্র শিখা। ন্যাশনাল স্টেডিয়াম থেকে নেহরু স্টেডিয়াম— এই পথের দায়িত্ব নিল পল্লব। স্টেডিয়ামে আমি থাকব। আর, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে এশিয়াড ভিলেজের মেজাজ ধরে রাখার দায়িত্ব দেওয়া হল সুরজিৎকে।

সবচেয়ে কঠিন ছিল পল্লবের কাজ। ন্যাশনাল স্টেডিয়াম থেকে কাঞ্জিলালের চলে আসার কথা জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে, কারণ আমাদের অন্য কোনও ফটোগ্রাফার (পরে অবশ্য জয়ন্ত শেঠ আর অমিয় তরফদারের সাহায্য কিছুটা পাওয়া গিয়েছিল, শেষের দিকে শ্রেণিকও পৌঁছে গিয়েছিল) ছিল না। তাহলে ওই লম্বা পথটায় একটাও ছবি তোলা হবে না? আর, এত কড়াকড়ির মধ্যে পল্লব কি কোনও গাড়িতে উঠে পড়তে পারবে? পল্লব কিন্তু কেডস পরেই সেদিন বেরিয়েছিল। একটা গাড়িতে কোনওরকমে উঠে পড়ার পর বুঝেছিল ওভাবে কিছু কভার করা যাবে না। ক্যামেরা সঙ্গে নিয়েছিল, তাছাড়া যাঁরা মশাল বহনের মহান দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে কথাও তো বলতে হবে। সুতরাং, যোহানন-প্রসূনদের সঙ্গে পল্লবেরও দৌড় শুরু হল। মশাল এক হাত থেকে অন্য হাতে যাচ্ছে, পল্লবও দৌড়তে দৌড়তে সংক্ষিপ্ত ইন্টারভিউ নিচ্ছে। সংগঠন কমিটির একজন মাতব্বর হাসতে হাসতে বললেন, নাম লিস্টে ছিল না, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ইনিই দৌড়লেন। মশাল হাতে দৌড়তে দৌড়তেই ছবি চেয়ে রাখলেন অনেকে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের ‘নবান্ন’ দেখে কষ্ট হল। বোঝা গেল আমাদের রাজ্যে খরা চলছে। এই অসাধারণ অনুষ্ঠান দেখে শ্রীমতী গান্ধী খরা-খাতে পশ্চিমবঙ্গকে অনুদানের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলেন কিনা, তা অবশ্য জানা যায়নি।

পল্লব ওই ঐতিহাসিক দৌড়ের পর নেহরু স্টেডিয়ামে ঢুকেছিল এবং রবিশঙ্করের সঙ্গে আলাপ করে নিয়েছিল। এই আলাপের ফল ফলবে এশিয়াডের শেষ দিনে।

অফিসে পৌঁছে একসঙ্গে চারজনের লেখা শুরু হল। সবার সঙ্গে কথা বলে নিলাম। একেবারে ধারাবর্ণনার ঢঙে লেখা করতে হবে। ধীমানের কপি একটু ছোট, শেষ করেই এশিয়াড ভিলেজে চলে গেল। রাতে হোটেলে ফেরার সময় সুরজিৎ নিশ্চিন্ত গলায় বলল, ‘ওপেনিং ডে-র সবচেয়ে ভাল কভারেজ আজকালই করল।’ সুভাষ ভৌমিক বলল, ‘সত্যিই এই টিম ওয়ার্কের জবাব নেই।’ পল্লব বেচারার হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। অনেক দৌড়েছে তো। ধীমান প্রস্তাব দিল, ‘প্র্যাকটিসের মধ্যেই যখন আছ, এই পথটুকুও দৌড়ে নাও পল্লব!’

২১ নভেম্বর সকালে হোটেলে আমার ঘরের দরজায় টোকা মারলেন বাংলাদেশের দুই বিশিষ্ট কর্মকর্তা। পরিচিত জন বললেন, ‘খুব গোপনীয় কথা আছে। আপনার সাহায্য চাই।’ কিন্তু হোটেলে বসে নাকি কথা বলা ঠিক নয়। আমি বললাম, ‘বেশ তো, তাহলে খুব প্রকাশ্য জায়গায় কথা বলাই ভাল। ৯টা নাগাদ ভিলেজে যাচ্ছি, আপনারা তখন রিসেপশন সেন্টারে থাকবেন, যেন হঠাৎ দেখা হয়ে গেল, আমরা ওপরের রেস্তোরাঁ বসব। সবাই ভাববে, আপনাদের ইন্টারভিউ নিচ্ছি।’

৯টা বাজার মিনিট পাঁচেক আগে রিসেপশন সেন্টারে ঢুকে দেখি, ওঁরা অপেক্ষমাণ। অভিনয়-টভিনয়ের লাইনে গেলাম না। তিনজন সোজা ওপরে রেস্তোরাঁর দিকে চলে গেলাম। ওঠার মুখে কলকাতার এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। বললেন, ‘কফি খেতে যাওয়া হচ্ছে?’ কোনওরকম ঝুঁকি না নিয়ে বললাম, ‘ইন্টারভিউ উইথ কফি।’

ওঁদের বক্তব্য সংক্ষেপে এইরকম: শেফ দ্য মিশন সিদ্দিকি সাহেব ভাল মানুষ। তাঁকে অকেজো করে সব কিছুর মাথায় চড়ে বসেছেন কর্নেল জলিল ও মেজর ইমাম। কর্নেল জলিল দশ বছর আগে সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিলেও মেজাজটা চড়াই রেখেছেন। ইমাম তাঁর যোগ্য সহচর। ২০ নভেম্বর সকালে কর্নেল জলিল ফতোয়া জারি করেছেন, নিজের নিজের ইভেন্ট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে দেশে ফিরে যেতে হবে। এই আদেশ শুনে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা ভেঙে পড়েছে। অত দূর থেকে এসে যদি সব ইভেন্টের ফাইনালই না দেখা যায়, দিল্লি বা আগ্রা ভাল করে দেখার সুযোগও না পাওয়া যায়, ভেঙে পড়ারই কথা।

বাংলাদেশের দুই কর্মকর্তা হাত ধরে অনুরোধ করলেন, ‘মিলিটারি’ লোকেদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার উপায় আমাদের নেই। আপনারা যদি এই ব্যাপারটা ভাল করে লেখেন, বাংলাদেশের হাই কমিশনে হইচই হবে। হয়ত ছেলেরা থাকার সুযোগও পেয়ে যেতে পারে।

— এই ব্যাপারটা অন্য কোনও জার্নালিস্টকে জানিয়েছেন?

— আজ সকালে কলকাতার একজন রিপোর্টারকে অল্প অল্প বলেছি। দিল্লির কয়েকজনের সঙ্গেও যোগাযোগ হওয়ার কথা।

আমি খুব ধীরে বললাম, ‘আমাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন। শুধু একটা শর্ত, অন্য কোনও কাগজকে আর কোনও খবর দেবেন না।’

ওঁরা দুজন এককথায় রাজি। কর্নেল জলিলের আরও কিছু অসততা ও ঔদ্ধত্যের কথাও শুনলাম। এবং পরদিন আজকালের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হল, ‘কর্নেল জলিল সমাচার’।

ঠিক তিন দিন পর ২৫ নভেম্বর সকালে বাংলাদেশের ওই দুই কর্মকর্তা আবার আমাদের হোটেলে হাজির। আমরা কফি শপে ব্রেকফাস্ট সারছিলাম। এক কোনায় গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন একজন। বললেন, ‘আপনি যা করেছেন, ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করব না। আপনার জন্যই আমাদের ছেলেরা থেকে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। গতকাল রাতেই অর্ডার হয়ে গেছে, সবাই ফিরবে এশিয়াড শেষ হওয়ার পর ৬ ডিসেম্বর।’

আগের দিন সন্ধেয় বাংলাদেশের দূতাবাসে পার্টি ছিল। সেখানেই আজকালে প্রকাশিত লেখাটির জেরক্স কপি কর্মকর্তা ও প্রতিযোগীদের হাতে পড়ে। ফার্স্ট সেক্রেটরি কর্নেল জলিলকে বলেন, সবাই যাতে এশিয়াড গেমস শেষ হওয়ার পর ফেরে সেই ব্যবস্থা করুন।

কর্নেল জলিল বুঝলেন, জল অনেকদূর গড়িয়েছে। ২২ নভেম্বর কলকাতার ডেপুটি হাই কমিশনারের অফিস থেকে দিল্লির হাই কমিশনার অফিসে খবর যায়, আজকালে ভয়ঙ্কর খবর বেরিয়েছে।

কর্নেল ঘাবড়ে গেলেও তাঁর সহচর মেজর ইমাম বলেন, ‘রিপোর্টে লিখেছে, আমাদেরই দুজন অফিসিয়াল সব খবর দিয়েছেন। এই দুজনকে খুঁজে বার করব। তারপর উচিত শাস্তি।’

তখন দূতাবাসের ঝানু ফার্স্ট সেক্রেটারি বলেন, ‘একদম জল ঘোলা করবেন না। কলকাতার কাগজগুলোকে আপনারা চেনেন না। এই নিয়ে কিছু করলে, এমন লেখা লিখবে, আর মুখ দেখানো যাবে না।’

কফি শপে ওঁরা অবশ্য তিন মিনিটের বেশি থাকলেন না। বললেন, ‘অনেক ঝুঁকি নিয়ে এখানে আপনার সঙ্গে কথা বলছি। বাংলাদেশের কোনও জার্নালিস্ট দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি। নাম ফাঁস হয়ে যাবে। কাল রাতে খবরটা পেয়ে এত আনন্দ হয়েছে, আজ সকালে না এসে পারলাম না। আজ রাতে আসুন না, অশোকা হোটেলে আমরা একসঙ্গে ডিনার করি। আমরা দুজন আর আপনারা সবাই— আজকাল টিম।’

বললাম, এত কাজের মধ্যে সময় হবে না। রাতে কাজ শেষ হয় রাত সাড়ে এগারোটায়। সুতরাং ডিনার ঢাকায় একদিন না একদিন সেরে নেওয়া যাবে।

ওঁরা উপহার হিসেবে তুলে দিলেন কিছু ক্রেস্ট আর একটি ফ্ল্যাগ। কোনও স্মারকচিহ্ন আমি জমিয়ে রাখি না। নিজের বইপত্তর বা মুদ্রিত লেখাও যত্ন করে রাখার অভ্যাস নেই। কিন্তু এই পতাকাটি যত্ন করে রেখেছিলাম লেখার টেবিলের সামনে— তুচ্ছ সাংবাদিক-জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

দু-একদিন পর, ঢাকার সাংবাদিক আবদুল তৌহিদ (খেলার আসরের প্রতিনিধি) বললেন, আজকালে লিখে দারুণ কাজ হল, ‘কর্নেল জলিল সমাচার’ লেখাটা যেদিন বেরিয়েছে, সেদিনের আজকালটা আমাকে দিতে পারেন? দিলাম। জিজ্ঞেস করলেন, এই কপিটা আমি রেখে দিতে পারি? — পারেন।

কপি শপে বসে লেখাটা পড়ে আবদুল তৌহিদ বললেন, ‘বোঝা যাচ্ছে আপনার সোর্স খুব ভাল। একটা কথা বলছি, এই ‘আজকাল’টা তো রাখছি। এর ওপর একটা সই করে দেবেন।’ লজ্জা পেলাম বলা বাহুল্য। কিন্তু আন্তরিকতায় মুগ্ধও হলাম। এশিয়াডে সেবার বাংলাদেশ একটাও মেডেল পায়নি, কিন্তু আমাকে দিয়ে গেছে এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা এবং অবশ্যই শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

স্মরণীয় অবশ্য আরও কিছু ঘটনা! এই এশিয়াড আমাদের সুযোগ দিল বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ক্রীড়াবিদের কাছাকাছি আসার। অ্যাথলেটিক্স নিয়ে লিখলেন মিলখা সিং। মতামত দিয়ে সাহায্য করলেন শ্রীরাম সিং, টি সি যোহানন। এই তিনজনের সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ করে রেখেছিল পল্লব। ভারতের প্রথম হকি ম্যাচ রিপোর্ট করলেন কোচ বলবীর সিং। খবরটা একজন সাংবাদিক মারফত হকি ফেডারেশনের কর্মকর্তারা জানলেন। এবং বলবীর আমাদের জানালেন। ওঁর পক্ষে অন্তত এশিয়াডের কোনও খেলার ম্যাচ রিপোর্ট করা আর সম্ভব নয়। আমরা অবশ্য বিশেষ দুঃখিত হইনি। কারণ, ততদিনে ভারত আর পাকিস্তানের খেলার রিপোর্ট করার জন্য সেরা দুজনকে পেয়ে গেছি— শমিউল্লা ও অজিতপাল সিং।

হকি মাঠে ও শিবিরে পল্লব আর ধীমানই যেত। একই দিনে সেমিফাইনাল খেলল ভারত আর পাকিস্তান। দুই টিমই ফাইনালে উঠল। সেদিন মাঠে আমি আর সুরজিৎও গিয়েছিলাম। মাঠে ঢুকে শমিউল্লার সঙ্গে কথা বললাম, ততক্ষণে ঘামে-ভেজা জার্সি গায়ে ম্যাচ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য পল্লবকে জানিয়ে দিয়েছেন শমিউল্লা। বললেন, আন্তর্জাতিক হকি থেকে বিদায় নিতে চান। খবরটা আজকালেই প্রথম প্রকাশিত হল। পাকিস্তানের কোনও সাংবাদিকের কাছেও এই খবর তখনও ছিল না।

ভারতের ম্যাচ সম্পর্কে তাঁর বিস্তারিত বক্তব্য জানালেন অজিতপাল সিং। সেদিনই আলাপ হল। চমৎকার ভদ্রলোক। পল্লবের সঙ্গে আগেই কথা হয়েছিল, তবুও আমাকে বললেন, ‘আমি মোট আড়াই হাজার টাকা চেয়েছি লেখার জন্য।’ আমি বললাম, ‘কমই চেয়েছেন। আপনাকে পেয়ে আমরা গর্বিত।’

সুরজিৎ আর সুভাষ ছাড়াও আজকালে ফুটবলের ম্যাচ রিপোর্ট করলেন পিটার থঙ্গরাজ, সৈয়দ নঈমুদ্দিন এবং মহম্মদ হাবিব। মতামত দিয়ে সাহায্য করলেন অরুময় নৈগম এবং মজিদ বাসকার। মজিদের সঙ্গে ধীমানের দেখা হয়ে যায় হঠাৎই জনপথ হোটেলের সামনে। এশিয়াড দেখতে আরও অনেকে এসেছিলেন। জার্নাল সিং যুগান্তরে লিখলেন, চুনী গোস্বামী আনন্দবাজারে। ফুটবলের ফাইনালের আগে শৈলেন মান্না এলেন। শান্ত মিত্র, সুনীল ভট্টাচার্য আর প্রদীপ চৌধুরিও তখন দিল্লিতে। সবাই ছিলেন, শুধু সময় ছিল না। কারও সঙ্গেই জমিয়ে আড্ডা মারা গেল না। শান্ত মিত্র অবশ্য এরই মধ্যে এক রাতে কলকাতার আমেজ নিয়ে এলেন।

সৌদি আরবের কোচ, ব্রাজিলের বিশ্বকাপ ফুটবলার জাগালো আমাদের চমৎকার ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। কিন্তু ফাইনালের ম্যাচ রিপোর্ট করতে কিছুতেই রাজি হলেন না (পরে ব্রাজিলের কোচ) ডাঃ আলবার্তো পেরেরা, নেপালের কোচ পশ্চিম জার্মানির রুডি গুটেনডর্ফও সুভাষ ভৌমিককে বিস্তর ঘোরালেন।

ব্যাডমিন্টনের ম্যাচ রিপোর্ট করলেন আমাদের কাছের মানুষ দীপু ঘোষ, সুভাষ, সুরজিৎ আর পল্লবের সঙ্গে তিনি আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ। ব্যাডমিন্টনের অনেক সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গেল। ব্যাডমিন্টন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আর একজনকে পেলাম। প্রকাশের সঙ্গে এশিয়াড ভিলেজে কথা বলে নিল সুরজিৎ। আমার সঙ্গে তখনই আলাপ। প্রকাশ সেদিন হ্যান জিয়ানের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। হ্যান জিয়ান বললেন, ‘প্রকাশ ছাড়া আর কারও বিরুদ্ধে খেলতে আমি ভয় পাই না।’

হ্যান জিয়ান চলে যাওয়ার পর খুব বিনীত সুরে জানতে চাইলাম, ‘লেখার জন্য আপনাকে যে টাকা দেওয়া উচিত, তা দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। তবু যদি একটা অ্যামাউন্ট বলেন…।’

প্রকাশ বললেন, ‘ভদ্রতা করার কিছু নেই। আমি এখন প্রফেশনাল, টাকা পয়সার ব্যাপারটা ভাল বুঝি। কিন্তু এটাও জানি, বিদেশের মত টাকা পাওয়া এখানে সম্ভব নয়। কোপেনহেগেনে একটা টিভি প্রোগ্রাম করে যে টাকা পাওয়া গেছে, এখানে দশটা লেখা লিখেও তা পাব না। তাছাড়া, সুরজিৎ রয়েছে আপনাদের কাগজে। যা হয় দেবেন, তাতেই খুশি হব।’

টিম ইভেন্টের ফাইনালে চীন আর ইন্দোনেশিয়া মুখোমুখি। ম্যাচ রিপোর্ট করবেন প্রকাশ পাড়ুকোন। আমি আর পল্লব অফিসে বসে লেখা তৈরি করছি, টেলেক্সে কপি যেতেও শুরু করেছে। রাত নটা বেজে যাওয়ার পর হঠাৎ খেয়াল হল, সুরজিৎ আর ধীমান ফিরছে না কেন? প্রকাশের রিপোর্ট ওদেরই নিয়ে আসার কথা।

একমনে লিখে চলেছি, ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখা, পিঠে হাত পড়ল— মৃদু। সুরজিৎ বলল, ‘দ্যাখ, কে এসেছে।’ মাথা তুলে দেখি, স্বয়ং প্রকাশ। প্রকাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ম্যাচ বিশ্লেষণ করলেন। সেই লেখা পাঠানোর আগে আজকালের কলকাতা অফিসে জানালাম, ‘আজ আমাদের এক স্মরণীয় দিন, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাচ রিপোর্ট করছেন আমাদের পাশে বসে।’

রাতে হোটেলে ফেরার সময় ধীমানের কাছে জানতে চাইলাম, ওদের অফিসে আসতে এত দেরি হল কেন?

খেলা শেষ হতেই সুরজিৎ ড্রেসিং রুমে গিয়ে প্রকাশের সঙ্গে দেখা করে। প্রকাশ জানান, কিছু কাজ আছে, আধঘণ্টা পরে একসঙ্গে বেরিয়ে আমাদের অফিসে আসতে পারে। সুরজিৎ আর ধীমান অপেক্ষা করল। সৈয়দ মোদির সঙ্গে কথা বলে প্রকাশ যখন বেরোলেন, প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেছে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে, সুরজিৎ-ধীমানের সঙ্গে প্রকাশও দ্রুতপায়ে গাড়ির দিকে এলেন। গাড়ি আছে, কিন্তু ড্রাইভার নেই। আমাদের ড্রাইভার অজিতবাবু এমনিতে ভাল লোক, কিন্তু তাস-পাগল। কে জানে কোথায় তাস খেলতে বসে গেছেন। ইন্দ্রপ্রস্থ স্টেডিয়ামে ভলিবলও চলছে, প্রচুর গাড়ি দাঁড়িয়ে। ড্রাইভারদের মধ্যে অনেকেই ভাগে ভাগে তাস খেলায় মগ্ন। কিন্তু এদিক ওদিক অনেক খুঁজেও ধীমান অজিতবাবুকে পেল না। গলা ছেড়ে ডাকলও কয়েকবার। স্টেডিয়ামের সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে মানুষ আর গাড়ির ভিড়, দেখতে দেখতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় কেটে গেল। সুরজিৎ ততক্ষণে ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন নিয়ে গম্ভীর আলোচনা শেষ করে কোপেনহেগেনে ঢুকে পড়েছে। প্রকাশ বলছেন, ডেনমার্কে তাঁর দিন কীভাবে কাটে, ওখানে কী কী সুযোগ পাওয়া যায়— এই সব। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের লোক সুরজিৎ সেনগুপ্ত এবং দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাডমিন্টন নক্ষত্র প্রকাশ পাড়ুকোন। সুরজিৎ একবার দুঃখপ্রকাশ করতেই প্রকাশ বলেন, ‘না না ঠিক আছে, এখনই এসে যাবে।’ শেষ পর্যন্ত প্রকাশই পরামর্শ দিলেন, মাইকে ঘোষণার ব্যবস্থা করলে ফল পাওয়া যেতে পারে। ধীমান ব্যবস্থা করতে গেল। সত্যিই ফল হল। অদৃশ্য কোনও তাসের আসর থেকে উঠে এসে অজিতবাবু হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কি অনেকক্ষণ এসে গেছেন?’ সোয়া এক ঘণ্টা অপেক্ষারত সুরজিৎ আরও বড় করে হেসে বলে, ‘না, না, এইমাত্র।’

এশিয়াড ভিলেজের অফিসে যাওয়ার জন্য লিফটে উঠেই একদিন সামনে পেলাম চেনা চেনা একজনকে। বুকে ঝোলানো কার্ডে লেখা: হানিফ খান, হকি, পাকিস্তান। বললাম, ‘আপনার খেলা দারুণ লাগে, একদিন আপনাদের ক্যাম্পে যাব।’ লাজুক হানিফ হাসলেন। পরে অবশ্য শমিউল্লা জানিয়েছিলেন যে, পেছনে লাগায় এই ছেলেটির জুড়ি নেই। এবারও হানিফ হেসেছিলেন, তবে হাসিটা আর প্রথমবারের মতো নিরীহ ছিল না।

৮০০ মিটার দৌড়ে শ্রীরাম সিংয়ের রেকর্ড ভাঙার দিনই চার্লি বোরোমিওর সঙ্গে আলাপ হল। বললেন, ভিলেজে গেলে অনেকক্ষণ বসে কথা বলা যাবে। সেই সুযোগ অবশ্য আমি নিতে পারিনি। চার্লির অন্তরঙ্গ ইন্টারভিউ নিয়েছিল পল্লব পরে জামশেদপুর গিয়ে।

এক দুপুরে এশিয়াড ভিলেজের একটা মাইক্রোবাসে চড়েছি, চীনের কয়েকজন সুইমার আর ডাইভার উঠলেন। সুরজিৎ জিজ্ঞেস করল, ‘ডাইভারদের মধ্যে একটি মেয়ে তো ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, কিন্তু নাম যে জানি না!’

কোচকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন মেয়েটি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন?’ কী আশ্চর্য, মেয়েটি আমাদের পাশেই বসেছিল। ইংরেজি জানে না। কিন্তু ডাইভিংয়ে গোটা দুনিয়াকে তাক লাগাতে জানে। আমাদের শুভেচ্ছা ওর কাছে পৌঁছে দিলেন কোচ। তিনি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলতে পারেন, বোঝেন।

এশিয়াড চলার সময় ভারতীয় ফুটবল টিম, সুরজিৎ, ধীমান ও আমার প্রায় অর্ধেক সময় নিয়ে নেয়। না হলে, উচিত কি ছিল না অন্তত একবার লিয়েম সুই কিংয়ের সঙ্গে কথা বলা? হ্যান জিয়ানের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন প্রকাশ, একটা বড় ইন্টারভিউয়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া কি উচিত ছিল না? লজ্জার কথা, আমি একদিনও জিমন্যাস্টিকসের আসরে যেতে পারিনি। সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মানের ভলিবল খেলে গেল চীন আর জাপান, দেখা হল মাত্র ফাইনালে কিছুক্ষণ!

তবে, ফুটবলে সময় না দিয়ে উপায়ও তো ছিল না। আগের কুড়ি মাস ধরে ভারতীয় ফুটবল দলের প্রস্তুতি ও সম্ভাবনা নিয়ে আজকাল আর খেলায় আমরা যতটা সময় ও জায়গা খরচ করেছি, বিতর্কের যে হাওয়াকে নিশ্চিতভাবেই ঝড়ে পরিণত করেছি, শেষ কয়েকদিনে তার পরিণতির ছবিটা পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। সেজন্য, অন্যদিকে অনেক ক্ষতি হল।

এশিয়াড শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে, দিল্লি থেকে আনন্দবাজারের এক স্পোর্টস রিপোর্টার খবর পাঠান, ভাস্কর ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক হচ্ছে না। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার দিনই দিল্লি থেকে পল্লবের রিপোর্ট এল: অধিনায়ক হবে ভাস্করই। পরদিন অধিনায়ক এবং অন্য খেলোয়াড়দের নাম ঘোষণা করার কথা। আনন্দবাজার এবং আজকালে দুরকম খবর থাকায় ফুটবল-অনুরাগীদের সংশয় বাড়ল। সেদিন সকাল দশটা থেকেই টেলিফোনের পর টেলিফোন: ভাস্কর কি ক্যাপ্টেন হয়েছে? আমরা তখনও খবর পাইনি, কিন্তু ভাস্কর যে কত জনপ্রিয় তা বুঝতে অসুবিধে হল না।

পি টি আই বা ইউ এন আই খবর দেওয়ার আগেই দেড়টা নাগাদ দিল্লি থেকে পল্লবের উল্লসিত টেলিফোন: ‘উই হ্যাভ ডান ইট, ভাস্কর ইজ দ্য ক্যাপ্টেন!’ সত্যিই ঠিক খবর দিতে পেরেছি কিনা, তা নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না।

দিল্লিতে প্রথম দিন ভারতীয় ফুটবলারদের ধরতে আমাদের অবশ্য খুবই কষ্ট হয়েছিল। সকাল সাতটায় ভিলেজে গিয়ে শুনি, ওরা প্র্যাকটিস করতে চলে গেছে। রিসেপশন থেকে একটা কলেজের নাম পাওয়া গেল, সেখানেই ভারতীয় ফুটবলারদের প্র্যাকটিস করার কথা। পৌনে আটটা নাগাদ সেখানে পৌঁছে দেখি অনেক ফুটবলপ্রেমিক দিল্লিবাসী বাঙালি কিশোর হাজির, প্রিয় ফুটবলারদের কাছ থেকে দেখার জন্য। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলার ও কোচেদের দেখা নেই। সাড়ে আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর, প্রিন্সিপালের ঘর থেকে ভিলেজে ফোন করলাম, কোনও খবর নেই। হতাশ হয়ে হোটেলের দিকে ফিরছি, হঠাৎ দেখি একটা এশিয়াড বাস থেকে কে যেন হাত নাড়ছে। ভাল করে তাকিয়ে দেখি, ভেতরে বসে প্রশান্ত, প্রসূন, ভাস্কর। আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে হিন্দি ফিল্মের ঢঙে ওই বাসটাকে ফলো করতে বললাম। অনেক বাঁক নিয়ে শেষ পর্যন্ত ওদের বাস এবং আমাদের গাড়ি মডার্ন স্কুলের ভিতরে ঢুকে থামল। পি কে বললেন, ‘জানো তো, এখানে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী পড়ে, ভর্তি হতে গেলে ডোনেশন দিতে হয় কুড়ি হাজার টাকা!’

ফুটবলাররা মাঠের দিকে এগোল, আর তখনই স্কুলের ইনডোর স্টেডিয়াম থেকে প্র্যাকটিস করে বেরোলেন হ্যান জিয়ান ও লুয়ান জিন। অনেক দেরি হয়ে গেছে, পি কে, অরুণ ঘোষ ও ডেটমার ফিফার কাজে নেমে গেলেন। মালয়েশিয়ার এক সাংবাদিক পি কে ব্যানার্জিকে দেখে বললেন, ‘আমাকে চিনতে পারছেন? আহা ছোটবেলায় মারডেকায় কী খেলাই না আপনার দেখেছি, কিন্তু, যখন কোচ হয়ে গেলেন, আলাপ হয়েছিল, মনে নেই?’

ট্রেনিং শুরু হল। একটু দূরেই প্র্যাকটিস নিচ্ছিল সৌদি আরব ফুটবল টিম। পি কে বললেন, ‘ওদিকে যাও অশোক, ওই যে ট্রেনিং দিচ্ছেন, সাদা গেঞ্জি, সাদা প্যান্ট, উনি জাগালো।’ জাগালোর সঙ্গে আলাপ হল। ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর তিনি ছোট ইন্টারভিউও দিলেন। সেই ইন্টারভিউ আজকালেই প্রকাশিত হওয়ার পরদিন রাতে হোটেলের কাফেটেরিয়ায় বসে কলকাতার এক বিশিষ্ট সাংবাদিক অন্য একজন সাংবাদিককে বললেন, ‘জাগালোর খবরটা ভুয়ো, জাগালো দিল্লিতে আসেনইনি!’ তার পরদিন জাগালোর ছবি আজকালে ছাপা হল। ধীরে ধীরে সব কাগজেই এই খবর ছাপা হল যে সৌদি আরব টিমের কোচ হয়ে এসেছেন ব্রাজিলের কীর্তিমান প্রাক্তন ফুটবলার জাগালো। (ওই বিশিষ্ট সাংবাদিকের কাগজেও!)

ট্রেনিংয়ের পর ভাস্কর-প্রসূন-প্রশান্ত-বিদেশের সঙ্গে কথা হল। কথা বললাম পি কে আর অরুণ ঘোষের সঙ্গেও। সবার মনোবল বেশ উঁচু পর্দায় বাঁধা দেখলাম। স্টপ ওয়াচ বন্ধ রেখে ছেলেদের দু’ঘণ্টার জায়গায় আড়াই ঘণ্টা প্র্যাকটিস করিয়ে নিচ্ছেন পি কে, দারুণ খাটছেন অরুণ ঘোষ। ফুটবলাররাও যেন বিশ্বাস করছে, ভাল কিছু ঘটতে পারে। সবচেয়ে ভাল কথা বললেন ডেটমার ফিফার: একটা সময় তো আসেই, যখন কিছু করে দেখাতে হয়। এ হচ্ছে সেই সময়।

কিন্তু প্রথম ম্যাচের দিন সকালেই আবহাওয়া থমথমে হয়ে গেল। সুভাষ ভৌমিক, সুরজিৎ, ধীমান আর আমি ভিলেজের রিসেপশন সেন্টারে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম ফুটবলার ও হকি খেলোয়াড়দের সঙ্গে। কলকাতার বিখ্যাত অর্থোপেডিক সার্জেন ডাঃ ডি পি ভট্টাচার্য আলাপ করিয়ে দিলেন তাঁর এক ব্রিটিশ বন্ধুর সঙ্গে। ডি পি অপেক্ষা করছেন ব্রহ্মানন্দর জন্য। ব্রহ্মা এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরল। পরিচয় পাওয়ার পর ইংরেজ ভদ্রলোক জানতে চাইলেন ব্রহ্মা প্রথম ম্যাচে খেলছে কি না। ব্রহ্মা বলল, ‘না। আর-একজন গোলকিপার আমাদের ক্যাপ্টেন, খেলেও আমার চেয়ে ভাল।’

এই সব কথাবার্তার দশ-পনেরো মিনিট পর মুখ্য নির্বাচক এবং ভারতের টিম ম্যানেজার (সুরজিৎ নাম দিয়েছিল ‘টিম ড্যামেজার’) মগন সিং সুভাষ আর সুরজিৎকে জানান, ‘ভাস্কর খেলছে না। এখন ওর চেয়ে ব্রহ্মানন্দর কনফিডেন্স অনেক বেশি।’

ভাস্কর বাদ! ভিলেজে নিজের ঘরে বসে ভাস্কর জানাল, ‘মগন সিং ভুল খবর দিয়েছেন। সিলেকশনের সময়ে তো আমিও ছিলাম। আমি খেলছি। তবে গতকাল থেকেই বুঝতে পারছি, মগন সিং আমাকে বাদ দিতে চাইছেন।’ কেন যে মগন সিং দুই প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলারের কাছে মিথ্যা কথাটা বলেছিলেন, তা শেষ দিন পর্যন্ত পরিষ্কার হয়নি। শেষে তো ‘টিম ড্যামেজার’ একদিন সুরজিৎকে বলেই ফেললেন, ‘কই আমি তো তোমাদের ও কথা বলিনি।’ মোরারজি মিলসের একজিকিউটিভ মগন সিং অবশ্য নানা রকমের মিথ্যা কথা বলেন। ইরাক-সৌদি আরব সেমিফাইনাল ম্যাচের দিন নেহরু স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে মগন সিং সুরজিৎকে বলেন, ‘নাইনটিন ফিফটি এইটে ফর্ম থাকতে থাকতেই আমি ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল থেকে রিটায়ার করেছিলাম।’ উনিশশো ছাপ্পান্ন সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকের আগে ট্রেনিং ক্যাম্পে ডাক পেয়ে তিন দিন পরেই ছাঁটাই হওয়া মগন সিং জীবনে একটিও ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ খেলেননি। তবু, তিনি উনিশশো আটান্নয় ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল থেকে রিটায়ার করেছেন!

জিয়াউদ্দিনের তাঁবেদার মগন সিং ম্যানেজার হিসেবে প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত টিমের মনোবল ভাঙার চেষ্টা করে যান। ডেটমার ফিফারকে অপমান করার পর পি কে-র বিরুদ্ধে দল পাকান এবং মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে খেলায় প্রশান্তর বদলে চির-আহত হরজিন্দারকে টিমে ঢোকান। এমনিতে টিমের ফুটবলারদের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্কই ছিল না।

আমরা রোজ ভিলেজে ফুটবলারদের আস্তানায় গেছি। ভিলেজে ঢোকার জন্য শেফ দ্য মিশন বা ডেপুটি শেফ দ্য মিশন-এর সই করা পাস দরকার। প্রথম দিকে ডেপুটি শেফ দ্য মিশন, কলকাতার হরিপদ ঘোষ পাস দিতেন। পরে শেফ দ্য মিশন তা বন্ধ করে দিলেন। তবু, কী করে রোজ আমরা ঢুকলাম? বলা চলবে না। তবে ওই অপারেশনের লিডার ছিল সুভাষ ভৌমিক।

চীনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়ার্ধে পনেরো মিনিট স্বপ্নের ফুটবল খেলে অনেক আশা জাগিয়ে গেল ভারতীয় দল। সুদীপ, প্রসূন, প্রশান্ত, পারমিন্দার, কার্তিক, সাবির, বিদেশ ওই পনেরো মিনিট চীনের রক্ষণভাগকে চূর্ণবিচূর্ণ করল। ভারতীয় ফুটবল অত সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য নিয়ে সাম্প্রতিককালে আর কখনই হাজির হয়নি।

কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী জাগালোর সৌদি আরব। একটি জয় ভারতকে অপ্রত্যাশিত মেডেলের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই একটি জয় দু’বছরের পরিশ্রমকে আংশিক সার্থকতা দিতে পারে। এই একটি জয় এ আই এফ এফের কর্মকর্তাদের অনেক ওপরে তুলে দিতে পারে।

রাত ন’টায় খেলা শুরু হল। দশটা আটত্রিশ মিনিটে খেলা শেষ হওয়ার ঠিক দু’মিনিট আগে খেলার একমাত্র গোল করে সৌদি আরব। অসামান্য লড়াই করল ভাস্কর আর মনোরঞ্জন, জীবনের শ্রেষ্ঠ খেলা খেলল কম্পটন। তবু শেষ রক্ষা হল না। খেলা শেষ হওয়ার পর মাঠ থেকে বেরনোর সময় পি কে ব্যানার্জিকে বললেন জাগালো, ‘ব্যাড লাক, তোমরা খারাপ খেলনি।’ দু’বছরের পরিশ্রম ব্যর্থ হল এক মুহূর্তের ভুলে। লুটিয়ে পড়েছে ফুটবলাররা, কাঁদছে অনেকেই, বিধ্বস্ত পি কে, তবু ধীমান ড্রেসিং রুমে ঢুকল কয়েক মিনিটের মধ্যে, ছবিটাকে ধরে রাখার আশায়।

আমি আর সুরজিৎ দ্রুত বাইরে গাড়ির কাছে এলাম। সুভাষও এল। ধীমান এখনও আসছে না, গাড়ির বনেটের ওপর প্যাড রেখেই লেখা শুরু করে দিলাম। অফিসে ফিরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টেলিপ্রিন্টারে কপি ধরাতে হবে, আমাদের জন্য বসে আছে অক্লান্ত কর্মী হরিদাসন। ধীমান এল ছুটতে ছুটতে, গাড়িতে উঠেও দু-এক লাইন লেখার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। অফিসে পৌঁছেই দশ মিনিটের মধ্যে লেখা শেষ। আমার কপি যেতে যেতেই ধীমানের কপি তৈরি, ধীমানের কপি ধরতে না ধরতেই সুরজিতের ঘোষণা: আমারও হয়ে গেছে। ‘দি টেলিগ্রাফ’ অফিস থেকে সুভাষ ভৌমিক এল রাত পৌনে বারোটা নাগাদ। হোটেলে, নিচে কফি শপে বসে যা হল, তাকে শোকসভাই বলতে হয়। সুরজিতের সেদিন আর নিজের ডেরায় ফেরা হল না। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীর, তবু ঘুম এল না। সুরজিতের গলায় নজরুলগীতি এত করুণ হয়ে আর বোধহয় কখনই আসেনি। পরদিন সকালে ভিলেজে যেতে আর ইচ্ছা করছিল না। তবু যেতে হল। রিসেপশন সেন্টারে দোতলায় পি কে-র সঙ্গে বসে কম্পটন-সুদীপরা আগের রাতের ম্যাচটা দেখছিল টেলিভিশনে। টেলিভিশনে পল্লবের গলা। পল্লবের সঙ্গী বলছিলেন, এই এশিয়াডে তখনও পর্যন্ত ভাস্কর একটিও গোল খায়নি। গোল হল এ কথা বলার দেড় মিনিট বাদেই।

এশিয়াড চলার সময়ে আমাদের কথাবার্তায় বারবার একটা নাম আসত— পারমার। প্রথম দিকে পারমারের বদলে সুদীপকে খেলানোর দাবি আমরা জোর দিয়েই তুললাম। পরে দেখা গেল, কর্তারা কেউ তা চাইছেন না। পরে, পারমার আমাদের সব রকম কথাবার্তায় চলে এলেন। মালয়েশিয়া ম্যাচের পর আমি প্রস্তাব দিলাম, এইভাবে লিখলে কেমন হয়: ‘পারমার তো পারমার, কিন্তু মনোরঞ্জনও দু-একটা ভুল করেছে!’ সৌদি আরবের একটা ম্যাচ দেখে এসে সুভাষ ভৌমিক জানাল, ‘টিমটা মন্দ না, তবে ওদেরও একটা পারমার আছে!’ নেহরু স্টেডিয়ামের টি স্টলের এক কর্মী চা দিতে গিয়ে কিছুটা ফেলে দিলেন সুরজিতের প্যান্টে। সুরজিতের প্রশ্ন: ‘কোনও স্কিল নেই, ভাই আপনার নাম কি পারমার?’ ভারত-পাকিস্তান হকি ফাইনালের আগের রাতে ধীমান আর পল্লবের মধ্যে ঘোর তর্ক— কে জিতবে। ধীমানের মতে, ভারত ফেবারিট। কিন্তু শমিউল্লার বন্ধুর মতে, ফেবারিট পাকিস্তান। তর্ক যখন চরমে, উত্তেজিত ধীমান বলল পল্লবকে, ‘দূর, তুমি পারমারের মতো কথা বলছ!’

ফুটবলে ভারত হেরে যাওয়ায় আমরা এতই মনমরা হয়ে গেলাম যে এশিয়াড অর্থহীন মনে হচ্ছিল। কিছুটা চাঙ্গা করে গেল কিং-হ্যান জিয়ানের ব্যাডমিন্টন সিঙ্গলস ফাইনাল।

এশিয়াড শেষ হল ৪ ডিসেম্বর। নেহরু স্টেডিয়ামে সমাপ্তি অনুষ্ঠান হৃদয় স্পর্শ করল শুধু তখনই, যখন চীন আর জাপানের তরুণ-তরুণীরা গ্যালারিতে ছুঁড়ে দিলেন টুপি— নাকি হৃদয়? নাচের ভঙ্গিতে মাঠ প্রদক্ষিণ করলেন ইরাকের প্রতিযোগিরা। অন্য সব অনুষ্ঠান নিতান্তই নিষ্প্রাণ। যুগান্তরের অমৃত ঘোষ খানিক আগেই ‘বোগাস’ বলে আসন ছেড়ে চলে গেলেন। বাইরে বেরিয়ে দেখি, নেতিয়ে পড়ে রয়েছে রবারের আপ্পু, দুটি বাচ্চা টানার জন্য তার লেজ খুঁজছে।

আমরাও নেতিয়ে পড়েছিলাম। শেষ খবর পাঠাতে হবে। তখন আর উত্তেজনা নেই, উৎসাহ নেই। শুধু কর্তব্য, আর কিছু নয়। তবু শেষ রাতেও আলোর ঝিলিক নিয়ে এল পল্লব। ও কথা বলে ‘নোট’ নিয়ে এসেছিল। আমি লেখা তৈরি করলাম। ৫ ডিসেম্বর আজকালের প্রথম পৃষ্ঠায় রবিশঙ্করের বিশেষ রচনা প্রকাশিত হল।

আপ্পুর দু’দিন আগেই বিদায় নিয়েছিল আমাদের প্রাণবন্ত বন্ধু পাকিস্তানের সাংবাদিক আবদুল ওয়াহাব খান। ২ ডিসেম্বর সকালে আই টি ডি সি-র ট্যুরিস্ট বাসে আরও কয়েকজন পাকিস্তানি সাংবাদিকের সঙ্গে আগ্রা যাচ্ছিলেন। দিল্লি থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে এক শোচনীয় দুর্ঘটনায় তাঁকে প্রাণ হারাতে হয়। দিল্লিতে খবর এল দুপুরে। আমরা খবর পেলাম রাতে, কাজ সেরে হোটেলে ফেরার পর। আসন্ন সমাপ্তির বিষণ্ণতায় নেমে এল আরও ঘন কালো ছায়া।

দিল্লি থেকে ফেরার সময় ভাবছিলাম, এশিয়াড কী দিয়ে গেল তা বুঝতে কিছুদিন সময় লাগবে। কিছু কিছু নিয়েও তো গেল। দিল্লির কিছু মানুষ ক্রীড়ামন্ত্রী বুটা সিংয়ের নাম দিয়েছেন ‘ঝুটা সিং’ এ কথা শুনে যে অট্টহাস্যে ভেঙে পড়েছিলেন আবদুল ওয়াহাব খান, মনে মনে তা শুনতে পাচ্ছিলাম।

৯ জুন, প্রুডেনশিয়াল কাপের খেলা শুরু হওয়ার দিন আমাদের লন্ডন প্রতিনিধি মানব মজুমদারের প্রিভিউ আজকালে প্রকাশিত হল: ‘কে বলতে পারে, ভারত অঘটনা ঘটাবে না?’ এটা ছিল নেহাতই কথার কথা। কিন্তু প্রথম দিনই অঘটন। গত দু’বারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ভারত হারিয়ে দিল। যেহেতু এরকম খুচরো অঘটন আমরা মাঝে মাঝেই ঘটিয়ে থাকি, বিস্মিত হলেও অভিভূত হইনি। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ম্যাচ। সন্ধের সময় অফিসে ঢুকে শুনি, সতেরোয় পাঁচ উইকেট পড়ার পর কপিল প্রচণ্ড মারতে শুরু করেছেন। কপিল আরও মারবেন, ভারত হয়ত এই ম্যাচটা কোনওরকমে জিতেও যাবে, কিন্তু ভারতের দম ফুরিয়ে এসেছে, এই হিসেবটা মিলে যাওয়ায় অনেকের মধ্যেই বেশ স্বস্তির ভাব দেখা গেল। সেঞ্চুরিতে পৌঁছোনোর আগেই কপিলের ছবি তৈরি হয়ে গেল, কিন্তু একশো পঁচাত্তরে নট আউট থাকার ব্যাপারটা অভাবনীয়ই ছিল। পরের দুটি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারার পর, পঞ্চম ম্যাচে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে আবার জয়। সবই প্রত্যাশিত। প্রথমে চমক দেখানোর পর ধীরে ধীরে ম্রিয়মান হয়ে যাওয়ার চিরাচরিত ভারতীয় ক্রিকেট চিত্রনাট্য। শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে বিদায় এবং দেশে ফিরে ম্যানেজার মান সিংয়ের উচ্ছ্বসিত বিবৃতি: এর আগের দুটি প্রুডেনশিয়াল কাপে মাত্র একটি ম্যাচে ভারত জিততে পেরেছে। এবার শুধু তিনটি ম্যাচ জিতেছি তা-ই নয়, প্রথম ম্যাচে গত দু’বারের চ্যাম্পিয়নকেও হারিয়েছি।

কিন্তু চিত্রনাট্য পাল্টে গেল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে রিটার্ন ম্যাচ থেকে। কপিলদেবের সঙ্গী পেস বোলার নেই, এই অপমানজনক আর্তনাদে মুখর ক্রিকেট-পরিবেশে বেঁচে-থাকা মদনলাল এবং ‘দারুণ ভাল ফিল্ডিং করে ছেলেটা, অল্পস্বল্প ব্যাটিং আর বোলিং’— এই যুক্তিতে টিমে-ঢোকা বিনি ইংল্যান্ডের কয়েকটি বসন্ত দিনকে নিজেদের ক্রিকেট-জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। দু’জনে মিলে আট উইকেট তুলে নিয়ে ভারতকে অপ্রত্যাশিত সেমিফাইনালে এবং অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটকে এক অস্বস্তিকর বিতর্কে ঠেলে দিলেন।

এবার ইংল্যান্ড। ইংরেজ সাংবাদিকদের গালাগালি দিয়ে আমরা যে নির্মল আনন্দ পাই, তার সঙ্গে কোনও কিছুরই তুলনা হয় না। ভারত ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিলে, ওই সাদা উন্নাসিকদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হয় বটে, কিন্তু তার বিশেষ সম্ভাবনা আমরাও খুঁজে পেলাম না। তবু ‘দি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত মহিন্দার অমরনাথের এই বক্তব্য আমাদের খুবই মনে ধরল যে, আমাদের শক্তিকে যে ইংল্যান্ড ছোট করে দেখছে, তাতে আমাদেরই সুবিধা। অন্য সব জায়গার মতো আজকাল অফিসেও অ্যামেচার গ্যাম্বলারের অভাব নেই। আমাদের দেবাশিস দত্ত আগাগোড়া ভারতের পক্ষে বাজি ধরে গেছে। ভারত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ায় যারা আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হয়েছে, তাদের মধ্যে দেবাশিসের জায়গা সম্ভবত ষোলো নম্বরে, চোদ্দজন ক্রিকেটার এবং সেই ভদ্রলোকের পরেই, যিনি লন্ডনে ভারতের পক্ষে বাজি ধরে কয়েক লক্ষ পাউন্ড পেলেন।

তখনও পর্যন্ত রোহন কানহাই ছাড়া আর কারও লেখাই আমরা পাইনি। তাতেই সন্তুষ্ট ছিলাম। সেমিফাইনালে ভারত জিতবে, এইরকম আশা করলে নিশ্চয় আমাদের দিক থেকে আরও প্রস্তুতি থাকত। ধীমানদের আগের দিনই বলেছিলাম বাড়িতে বসে জমিয়ে টেলিভিশনে খেলা দেখব, অফিসে আসছি না।

ফাঁকা মাঠে খেলা দেখতে যেমন ভাল লাগে না, ফাঁকা ঘরে বসে টিভি দেখতেও ভাল লাগে না। সহধর্মিণী তো আছেই, সুব্রত কুমারও এল। রেডিও বা টিভি কমেন্টেটরদের নিয়ে বসার একটা অসুবিধা এই যে, খেলার চেয়েও ওরা বেশি মুগ্ধ হয় ব্রায়ান জনস্টনের বাচনভঙ্গিতে বা ট্রেভর বেইলির ব্যাখ্যায়। প্রথমে ট্যাভারে আর ফাউলারের ব্যাটিংয়ের সময় এই সবই চলছিল। কিন্তু ওরা দুজন আউট হয়ে যেতেই সুব্রতও নির্ভেজাল ভারতের সমর্থক-দর্শক হয়ে গেল। ও যখন বাড়ি ফিরল, মহিন্দার আর যশপাল চমৎকার ব্যাট করছে। বলে গেল, ফাইনালে তা হলে উঠছি। ‘গুড লাক’ বলে একটা কথা আছে। পঁচিশ তারিখেও প্রথম দিকটা এখানে এসে দেখে যাব।

পরদিন আজকালে হেডিং হল পাটিলকে নিয়ে। অফিসে গিয়ে ধীমানকে বললাম, ‘হেডিংটা ঠিক করনি। সন্দীপ দারুণ মেরে শেষ কাজটা করেছে ঠিকই, কিন্তু আসল খেলা তো খেলে গেছে মহিন্দার।’ ধীমান জানাল, মহিন্দার না পাটিল— এই নিয়ে গভীর রাতে ঝাড়া দশ মিনিট স্পোর্ট ডিপার্টমেন্টে উত্তপ্ত ক্রিকেট-বিতর্ক হয়। শেষ পর্যন্ত পাটিলের নামই দাঁড়ায়।

সেই দিন থেকেই প্রস্তুতি শুরু হল। ভারত প্রুডেনশিয়াল কাপের ফাইনালে উঠেছে এই অবিশ্বাস্য অথচ ঘটে-যাওয়া ব্যাপারটা এক ধাক্কায় আমাদের দারুণভাবে জাগিয়ে দিয়ে গেল। এত অঘটন ঘটল, আর একটি ঘটলে ক্ষতি কী? বারবিসে একবার, প্রুডেনশিয়াল কাপের প্রথম ম্যাচে আর একবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো গেছে, আর একবার হারানো যাবে না কেন? ফাইনালে হেরে গেলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের একমাত্র টুর্নামেন্টে ফাইনালে খেলছে ভারত, এই ঘটনাও তো ঐতিহাসিক। সুতরাং প্রস্তুত হও।

ভারত সেমিফাইনালে ওঠার পরই ট্রাঙ্ক টেলিফোনে কথা বলা হয় রেগ হেটারের সঙ্গে। হেটার সাহেব নিজে নামকরা সাংবাদিক। একটি সংস্থাও চালান, যে সংস্থা ইয়ান বথাম প্রমুখ বিখ্যাত ক্রিকেটারের এজেন্ট। তাঁকে বললাম, টেলেক্সেও জানালাম, রোহন কানহাই আর গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আগে থেকেই করা আছে, শুধু যোগাযোগ করতে হবে। পাকিস্তান এবং ইংল্যান্ডের দুজন বিশেষজ্ঞরও মতামত চাই। আমাদের পছন্দ: মুস্তাক মহম্মদ ও মাইক ব্রিয়ারলি। মুস্তাককে পাওয়া গেল, কিন্তু ব্রিয়ারলির জায়গায় ডেনেসের লেখা পাঠালেন রেগ হেটার। ফাইনালের দিন সকালের আজকাল জমজমাট। হেটারকে আমরা আরও জানিয়েছিলাম, এই চারজনের ফাইনালের ম্যাচ-রিপোর্টও চাই। ওই রাতেই পাওয়া সম্ভব নয়, পরদিন পেলে হবে।

এই হেটার সাহেব আমাদের চমকে দিলেন ফাইনালের রাতে। কিন্তু তার আগে ফাইনালের আগের দিনটার কথা বলি।

আজকাল সম্পাদক সকাল থেকে আমাকে খুঁজছেন, বিকেলের আগে আসব না, এ কথা জেনেও। আসলে মদনদাও টেনশনে ভুগতে শুরু করেছিলেন। মদনদা চাইলেন, প্রুডেনশিয়াল কাপ নিয়ে কলকাতা কতটা উত্তাল, তার একটা ভিন্ন স্বাদের প্রতিবেদন প্রথম পাতায় প্রকাশিত হোক। অলক চট্টোপাধ্যায় লিখতে বসে গেলেন। একই টেবিলের উল্টোদিকে গোপাল বসু লিখছে, ইংরেজিতে, ওই লেখা অনুবাদ করবে ধীমান। গোপালও চুনী গোস্বামীর মতোই এদিক দিয়ে সাহেব। ওদের দুজনের লেখাই ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে বাংলা কাগজে ছাপতে হয়। তফাত শুধু এই যে, চুনী গোস্বামী লেখেন খুব দ্রুত, কিন্তু হাতের লেখা উদ্ধার করা কঠিন, গোপাল লেখে একটু ধীরে, কিন্তু হাতের লেখা চমৎকার।

মদনদার সঙ্গে কথা বলার কিছুক্ষণ পর স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের মিটিং করলাম। ঠিক হল টিভিতে খেলা দেখে ম্যাচ রিপোর্ট করবে গোপাল, রেডিও আর টেলিভিশন কমেন্টারি থেকে বিশেষজ্ঞদের মতামত ধরে রাখবে পল্লব, আমাদের সারাদিনের প্রত্যাশা ও প্রস্তুতি নিয়ে একটা লেখা লিখব আমি এবং ভারত জিতে গেলে— কলকাতার মানুষের প্রতিক্রিয়া ধরে রাখার চেষ্টা করবে সরোজ আর দেবাশিস। গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে ধীমান, ম্যাচ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যও ধরতে হবে ওকেই। রতন আর নির্মলকে অন্য সব খেলার খবরের দায়িত্ব দেওয়া হল। এবং কথা হল, আমি আটটা নাগাদ একবার অফিসে আসব। পরিস্থিতি বুঝে নির্দেশ দেব। এবং যদি ভারত জেতে… না, থাক, আগে তো জিতুক!

স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের টেলিভিশনের ওপরে একটা বড় নোটিস পোস্টারের মতো লাগিয়ে দেওয়া হল। আজ শুধু খেলা দেখে আনন্দিত বা উত্তেজিত হওয়ার দিন নয়, আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় কথা হল খেলার সব খবর পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছে দেওয়া। আজ আমরা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখব শুধু কাজের কথা ভেবে, রেডিওয় কানও রাখব শুধু কাজের কথা ভেবে। এজেন্সি কপি পড়তেও হবে একাগ্র চিত্তে। সুতরাং ক্রিকেট-গুঞ্জন বা বিশেষজ্ঞর মন্তব্য মুলতুবি রাখলেই ভাল হয়, অন্তত আজকের মতো।

গোপালের প্রিভিউয়ের হেডিং ছিল, ‘আসুন, আজ আমরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা কামনা করি।’ ধীমান এই হেডিংটা অনেক বড় পয়েন্টে কম্পোজ করিয়ে টিভির পাশে লাগিয়ে দিল ফাইনালের দিন দুপুরেই।

ফাইনালের দিন দুপুরে আমার বাড়িতে চলে এলেন অলক চট্টোপাধ্যায়। অলক চট্টোপাধ্যায় একই সঙ্গে চমৎকার স্কোরার, স্ট্যাটিসটিসিয়ান এবং এক্সপার্ট— থ্রি ইন ওয়ান। টেলিভিশনে খেলা দেখলেন, একটা কান টিভির ভাষ্যের দিকে রাখলেন, এবং বিশ্বাস করুন, অন্য কানে রেডিও ধরলেন। তিনি কিছুই হারাতে রাজি নন। একই সঙ্গে লিখে গেলেন স্কোর, আমাকে জানিয়ে গেলেন প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান। বিশেষজ্ঞর মন্তব্য অবশ্য তাঁর সঙ্গে আমিও রেখে গেলাম।

সুব্রত কুমার যখন ‘গুড লাক’ করতে এল, গার্নারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সানি রবার্টসের বলে ডুজনের হাত হয়ে প্যাভিলিয়নে। রবার্টসের বলে শ্রীকান্তের স্কোয়ার ড্রাইভটা দেখে সুব্রত নিশ্চিন্তে উঠে গেল। অলক চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘শ্রীকান্তবাবু ঘণ্টাখানেক থাকলেই হয়।’ কিন্তু কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্তর আবার ক্রিজে বেশিক্ষণ থাকতে মোটেই ভাল লাগে না। মহিন্দার তাঁকে শান্ত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে হার মানলেন। শ্রীকান্ত আউট হওয়ার পর যশপাল এলেন, যাঁর ব্যাটিংয়ের চেয়ে স্কোর দেখে ক্রিকেট-অনুরাগীদের বেশি আনন্দ হয়। লর্ডসে ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছেন মহিন্দার আর যশপাল। সল্টলেকের এক কোণায় অন্ধকার ঘরে টেলিভিশনের সামনে বসে চা আর সিগারেট খেয়ে মনঃসংযোগ করছি আমরা দুজন। এমনিতে অভ্যেস নেই, তবে টেনশনে থাকলে প্রচুর সিগারেট খান অলক।

ভারতের ইনিংস ১৮৩ রানে শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই আমি নিজের ছোট্ট লেখা নিয়ে বসে গেলাম, আজকের প্রস্তুতি, উৎকণ্ঠা, আশা ও নিরাশা নিয়ে। তখন ধরেই নিয়েছি, ভারত হারছে। তবু ক্রিকেট তো, লেখাটা এমনভাবে রাখলাম, অঘটন ঘটলেও যাতে এই লেখাই চালিয়ে দেওয়া যায়, শুধু শেষ প্যারাগ্রাফ জুড়ে দিয়ে। খেলা যখন শেষ হবে, তারপর সব লেখা তৈরি করতে গেলে পরদিন দুপুরে কাগজ বার করতে হয়। অলক চট্টোপাধ্যায়কে রেখে, আমি একাই অফিসে গেলাম। তার আগেই ভারত অল আউট ১৮৩। হেডিং ছাড়াই আমার লেখাটা প্রেসে পাঠিয়ে ধীমানদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে আসার মুখেই ট্রাঙ্ক কল। লন্ডন থেকে রেগ হেটার ট্রাঙ্ক কল করছেন : তিনি ভারতের ইনিংস সম্পর্কে অ্যালান নটের বক্তব্য সংগ্রহ করেছেন। কোনও রকমে নোট নিলাম, একটা বড় ব্রাউন রঙের খামের ওপরেই। এবং বলে গেলাম, এই লেখাটাও তৈরি করে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাড়িতে ঢুকে দেখি, ভিভ রিচার্ডস দারুণ মারছেন। মন-খারাপ নিয়েই দ্রুত অ্যালান নটের কপি তৈরি করে আমার ড্রাইভার সেলিমের হাতে দিলাম। খেলাধুলোয় সেলিমের এক সর্ষেও উৎসাহ নেই, কিন্তু বুঝছিল যে দারুণ কিছু একটা ঘটছে। একেবারে ঝড়ের বেগে অফিসে লেখা দিয়ে এল।

লিখতে লিখতেই রিচার্ডসের আউট হওয়ার খবর পেয়ে গেছি। তিন উইকেট পড়ে গেছে বাহান্ন রানে, তাহলে কি….? আর-একবার অফিসে গেলাম, প্রস্তুতিকে ক্ষুরধার করে রাখার জন্য। মদনদা কোথায়? ‘খেলা’র কর্মী তিমির বলল, ‘পাঁচটা উইকেট পড়তে দেখেই মদনদা প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন, টেনশন কমাতে এইমাত্র স্নান করতে গেছেন।’

যখন অফিস ছাড়লাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ পাঁচ উইকেটে ছিয়াত্তর। গভীর রাত্রে আসতে হতে পারে।

স্টপ ওয়াচ ছাড়াই অলক চট্টোপাধ্যায় হিসেব দিলেন, আমাদের ডিনার হাতে হাতেই সারতে সময় লেগেছে, তিন মিনিট চোদ্দ সেকেন্ড। চিকেনে নাকি আর একটু বেশি ঝাল হলে ভাল হত, কারণ অনেক রাত পর্যন্ত জাগতে হবে।

এগারোটার খানিক পরে যখন সেদিন শেষবারের মতো অফিসের দিকে গেলাম, ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিশ্চিতভাবেই ধুঁকছে। শববাহকরা প্রস্তুত, শুধু মৃত্যুপথযাত্রী একটু সময় নিচ্ছেন, এইরকম আর কি! আট উইকেট পড়ে গেছে। মানিকতলা ব্রিজের কাছাকাছি গিয়ে প্রবল উল্লাস শোনা গেল। নিশ্চয় আর একজন আউট। গাড়ি জোরে চলছে, রেডিওয় কিছু শোনা যাচ্ছে না। অফিসে স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টে তখন হিরণ্ময় নীরবতা। সবার মুখ উত্তেজনায় এবং উল্লাসে ফেটে পড়ার অপেক্ষায় টুকটুকে লাল। অন্য ডিপার্টমেন্টেরও অনেকে এসে দাঁড়িয়েছেন। বেচারা একই সঙ্গে রেডিও আর টিভির বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ধরে রাখার চেষ্টায় গলদঘর্ম। শেষেরটুকু বাদ দিয়ে ধীমান তৈরি করে রেখেছে স্কোরশিট, শেষ হলেই কম্পোজে পাঠিয়ে দেবে। ক্রিকেটে পোড়-খাওয়া গোপাল বসু বিড়বিড় করছে: ‘শেষ না হলে কিছু বলা যায় না।’

আমার যে লেখাটা তৈরি হয়েছিল ভারতের দুঃসময়ে, দু-এক প্যারাগ্রাফ যোগ করে তার শুভসমাপ্তি ঘটাতে হল (সংশয়ের শেষ, ক্রিকেটের রাজসিংহাসনে ভারত) টেলিভিশনের সামনে বসেই। হোল্ডিং তখনও আউট হননি। তিমিরকে শেষ অংশটা দিয়ে বললাম, ‘লাস্ট উইকেট পড়লেই দৌড়ে প্রেসে দিয়ে আসবি।’

হোল্ডিং আউট হতেই ক্রিকেটাররা প্যাভিলিয়নের দিকে দৌড়োলেন, তিমির প্রেসের দিকে। তারপরই যাদের কাজে নেমে পড়ার কথা, তারা কেউই কিন্তু তখন টেলিভিশনের সামনে থেকে উঠতে চাইছে না, অশোক দাশগুপ্তও না। কপিলদেবের হাতে ট্রফি না ওঠা পর্যন্ত কী করে ওঠা সম্ভব? দেবাশিসকে অবশ্য নির্মম নির্দেশ দিতেই হল: ‘এখনই বেড়িয়ে পড়, আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে লিখতে বসবে।’ বিশ্বজয়ে কলকাতার মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দেবাশিস আর সরোজ। কপিলের হাত যখন সানি তুলে ধরল হাজার হাজার দর্শকের সামনে, আমরা কাজ শুরু করলাম।

পল্লব বিশেষজ্ঞদেরর মন্তব্য লিখে রাখছিল খুব দ্রুত, অল্প সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করে জিজ্ঞেস করল, ‘টেলিফোন করে নামকরা লোকেদের রিঅ্যাকশন জানতে চাইব?’

‘নিশ্চয়!’

ধীমান স্কোরশিট আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিল। এজেন্সি কপি এবং টেলিভিশন-দেখা নোট থেকে একটা কপি তৈরি করতে বসে গেল। পাশে, ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার’-এর ঘরে একটা করে প্যারাগ্রাফ ইংরেজিতে লিখছে গোপাল বসু, মুখোমুখি বসে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনুবাদ করে যাচ্ছেন অলক চট্টোপাধ্যায়।

ভারতের জেতার সম্ভাবনা মাথায় রেখে সকাল থেকেই বাহাত্তর পয়েন্টের হেডিং কম্পোজ করিয়ে রেখেছিলেন মদনদা: ‘ভারত বিশ্বজয়ী, লর্ডসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরাস্ত’। আমার একটা লেখা প্রথম পৃষ্ঠায় ‘অ্যাঙ্কর’ হিসাবে যাচ্ছে, অ্যালান নটের অর্ধসমাপ্ত ম্যাচ-রিপোর্টও পাঠিয়ে দিয়েছি অনেক আগে। সবার কাজ ঠিকমতো এবং খুব দ্রুত হচ্ছে কিনা, এটা দেখাই তখন আমার কাজ। কিন্তু মদনদা এসে বললেন, ‘অশোক একটা আলাদা লিড যাওয়া দরকার, হেডিং তো করাই আছে। গোপালের ম্যাচ-রিপোর্ট, নটের ম্যাচ-রিপোর্ট— সবই প্রথম পৃষ্ঠা থেকে যাবে, কিন্তু আলাদা ভাল লিড চাই। তুমি লিখলে ভাল হয়।’

মদনদা বলার পর বুঝলাম মানসিক প্রস্তুতি হয়েই ছিল। আমাদের অধিকাংশ লেখা প্রস্তুত হয় প্রয়োজনের তাগিদে, নিতান্তই প্রাত্যহিক কলম-পেষা বা কলম-ঠেলার কাজ, কিন্তু ওই আষাঢ় রাতে এক আশ্চর্য অনুপ্রেরণা ছড়ানো ছিল। প্রায় পাঁচশো শব্দের লেখাটি তৈরি হয়ে গেল বলতে গেলে এক নিঃশ্বাসেই, ঠিক পঁচিশ মিনিটে।

হৈ হৈ করে ফিরে এল দেবাশিস আর সরোজ। কপালে আবির মেখে ওই গভীর রাতে অফিসে এসে গেছেন আমাদের কালচারাল এডিটর রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, আরও অনেকে। দেবাশিস রিপোর্টটা লিখতে বসল ওই হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যেই। টেলিফোনের সামনে পল্লব আর তিমির। একজনের সঙ্গে কথা বলার পর তাঁর রিঅ্যাকশন লিখতে লিখতে দ্বিতীয় জনকে ধরে ফেলছে তিমির, খবরের কাগজের যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি।

অস্বাভাবিক দ্রুতবেগে লিখছে গোপাল, এমনকি হাত খুলে মারছেন বা লিখছেন অলক ‘বয়কট’ চট্টোপাধ্যায়ও। বাড়ি ফিরলাম দুটো নাগাদ।

বৃষ্টিভেজা রাত, তবু স্নান করলাম, পাইপ ধরিয়ে বারান্দায় বসলাম। সত্যি সত্যিই এ-সব ঘটেছে তো? এবং সেই মুহূর্তে সল্টলেকের জন্য আমার দুঃখ হল। না, এই সাজানো উপনগরীতে একটা মিছিল বেরোবে না। কে যেন এত রাতে নিয়ম ভেঙে দুটো পটকা ফাটাল!

সাতসকালে তিমির হাজির, হাতে সেদিনের আজকাল। বলল, আজ এমনিতে কাগজ আসতে দেরি হবে। ঘুম-চোখে কাগজটা খুলছি, তিমির একটা চিঠি দিল, মদনদা লিখেছেন। ছোট্ট চিঠি, কিন্তু সকালের আমেজ নষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট, ‘অশোক, আজকের কাগজ নিশ্চয় সবার ভাল লাগবে। আমি সারারাত অফিসেই ছিলাম, অল্প সময়ের জন্য বাড়ি ফিরতে পারি। ভেবে দেখলাম, কালকের কাগজে এই বিশ্বজয় নিয়ে একটা এডিটোরিয়াল যাওয়া দরকার। তুমি ছাড়া আর কে লিখবে? লেখাটা কিন্তু সকাল ন’টার মধ্যে চাই।’

‘তুমি ছাড়া আর কে লিখবে!’ বোঝা গেল, অল্পদিনেই মদনদা এডিটরগিরিতে ঝানু হয়ে গেছেন। তার ওপর তিমির এসেছে, লেখা না নিয়ে ঘাড় থেকে নামবে না। তখনও, আগের রাতের, যাকে বলে ‘হ্যাং ওভার’ চলছে। বিশেষ ভাবনাচিন্তা ছাড়াই এডিটোরিয়াল লেখা হল: ‘লর্ডসে সূর্যোদয়’। একটা বিকল্প হেডিংও দিয়েছিলাম— ‘ক্ষোভের নাম ভারতবর্ষ’। প্রথমটাই থাকল।

‘আজকাল’ আর ‘দি টেলিগ্রাফ’ সেরে সবে ‘আনন্দবাজার’ পড়তে শুরু করেছি, টেলিফোন এল। লন্ডন থেকে রেগ হেটার বিশেষজ্ঞদের মতামত পাঠাতে শুরু করেছেন। আমার অক্লান্ত কর্মী ড্রাইভার সব কপি নিয়ে এল। সাড়ে তিনটে নাগাদ তৈরি হয়ে গেল ওই চারটে লেখা এবং ‘খেলা’র সম্পাদকীয়, তিমির এসে নিয়ে গেল। রবিবার আমার ছুটি। লেখা পাঠালেও অফিস যাইনি। সোমবার অফিসে যেতেই অভিনন্দন আর অভিনন্দন। তখনও বিশ্বজয়ের ঘোর আছে, আমার পঁচিশ মিনিটের লেখাটার প্রচুর প্রশংসা শোনা গেল। আর রাইটার্স বিল্ডিংস থেকে গড়ের মাঠ— সর্বত্রই নাকি এক মন্তব্য, ‘আজকালের ওয়ার্ল্ড কাপ কভারেজের জবাব নেই’। এই হল সেই সব বিপজ্জনক কথা যা কাউকে দেয় আত্মসন্তুষ্টি, কাউকে আরও বেশি পরিশ্রম করার ইচ্ছা। সৌভাগ্যবশত, আমরা এখনও প্রথম দলে পড়িনি। কিন্তু পড়তে কতক্ষণ? বিকেলে আজকাল অফিসে এসে সেদিনের কপি নিয়ে গেল সুভাষ ভৌমিক আর সম্বরণ ব্যানার্জি। ওরা অনেক চেষ্টা করেও পায়নি। পরদিন পলাশ নন্দী আর শিবাজি ব্যানার্জি জানাল, অনেক বেশি পয়সা দিয়ে আজকাল পেতে হয়েছে। প্রসূন বলে গেল বর্ধমানে এক জায়গায় ২৬ জুনের আজকাল নাকি বিক্রি হয়েছে বারো টাকায়!

আজকালের তখনকার প্রধান প্রতিবেদক বীরেন ঘোষের কাছে পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী অনুযোগ করলেন, ‘আজকাল আজ পেলাম না কেন?’

মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও সেদিনের আজকালের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। খবর এল, ৪ জুলাই ক্রিকেটবীরেরা দেশে পদার্পণ করছেন। ‘খেলা’র একটা ফিচার তৈরি করতে করতেই ধীমানকে বললাম, ‘রিডারদের প্রত্যাশা নিশ্চয় অনেক বেড়ে গেছে। কপিলরা ফিরছে, আমাদের কিছু করা দরকার।’

যথারীতি নড়েচড়ে বসে ধীমান। বলল, ‘দরকার মানে, করতেই হবে!’

দশ মিনিটের মধ্যে পল্লব এবং দুই ফটোগ্রাফার শান্তি সেন আর এস এস কাঞ্জিলালের কথা হয়ে গেল। বোম্বাইয়ে সাহারা এয়ারপোর্টে থাকবে শিবু আর পল্লব। তারপর টিমের সঙ্গে বোম্বাই থেকে দিল্লি যাবে পল্লব। সেখানে অপেক্ষা করবেন শান্তি সেন। মদনদাকে পরিকল্পনাটা বলতেই লুফে নিলেন। বললেন, ‘কপিলের মা কপিলকে জড়িয়ে ধরছেন— একেবারে এই ছবি পর্যন্ত পৌঁছোতে হবে কিন্তু!’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, পল্লব আর শান্তিদাকে চণ্ডীগড়েও যেতে বলেছি।’

মাঝে মাত্র একটা দিন। তারপরেই ওদের রওনা হতে হবে। দুজন ফটোগ্রাফারকে সেদিন কাজ বুঝিয়ে দিলাম। শান্তি সেনের একটা মহৎ দোষ, একটা ছবি তোলার দরকার হলে পঁচিশটা ছবি তুলে আনেন। বললাম, ‘এবার যত খুশি ছবি তুলুন। দিল্লি থেকে চণ্ডীগড়ে ক্যামেরা যেন না থামে।’

পল্লবকে পরদিন সকালে আমার বাড়িতে আসতে বললাম। অনেক রাতে বাড়ি ফেরে, তবু সকাল সাতটার মধ্যে চলে এল। আমার দীর্ঘ ভাষণটি সে খুব মন দিয়েই শুনল। ‘আজ থেকে পাঁচ বছর আগে হলে এই দুর্দান্ত অ্যাসাইনমেন্টটা আমি নিজেই নিতাম। তোমার নিজেকে ভাগ্যবান বিবেচনা করা উচিত। মনে রেখো, আজকাল নতুন কাগজ, উড়িয়ে দেবার মত টাকাপয়সা আমাদের নেই। কিন্তু যতটুকু প্রয়োজন খরচ করতে দ্বিধা করবে না। যথেষ্ট টাকা নিয়ে যাচ্ছ, দরকার হলে দিল্লি থেকে আবার জানাবে। কিন্তু কখনও কপিলদেবের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। পাঠক-পাঠিকাদের আমাদের উপহার— ফলো। কপিল উইথ আজকাল। এই দায়িত্ব তোমাকে দুটি কারণে দিতে হচ্ছে। এক, তোমার ওপর আমার আস্থা। এবং দুই, তোমার ওপর আজকাল আর খেলার পাঠক-পাঠিকাদের আস্থা নেই। কোচিনে নেহরু গোল্ড কাপ টুর্নামেন্ট কভার করার সময় দলবদলের রিপোর্টিংয়ে তুমি অনেক ট্যাকটিক্যাল ব্লান্ডার করেছ। আমি চাই, এই অ্যাসাইনমেন্ট তোমাকে নিজের জায়গায় ফিরিয়ে আনুক। আমাকে বুঝতে দাও, তোমার ওপর আস্থা রেখে ভুল করছি না।’

দীর্ঘ ভাষণ বলে কথা, নিশ্চয় আরও অনেক কথা বলেছিলাম। তবে পল্লবকে খুব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনে হল। তারপর বিশ্বজয়ীদের ঘরে-ফেরার যে রিপোর্ট আর ছবি পল্লব, শিবু ও শান্তিদা কয়েকদিন ধরে আজকালের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পৌঁছে দিল, কোনও তুলনা নেই। আমি সামনাসামনি নিজেদের মধ্যে কারও প্রশংসা করি না। লেখাটা পল্লব পড়বে, এই ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও লিখছি, পল্লব একলাফে অনেকটা উঠে এল। পল্লবের এক-একটা ডেসপ্যাচ এল, আর উজ্জ্বলতর হল ওর সহকর্মীদের মুখ। এটা গর্বেরই ব্যাপার যে, আমাদের টিমের একজনের সাফল্যে অন্যদের মনঃকষ্ট হয় না। ভাল কাজটা যার কাছ থেকেই আসুক, সব মিলিয়ে আমরা সবাই এগোই অর্থাৎ ওপরে উঠি।

কপিলদেবের বাড়িতে অজস্র ছবি তুললেন শান্তি সেন। কলকাতায় পৌঁছে আমার কাছে শান্তিদার প্রথম কথা ছিল ‘কপিলের যা ছবি এনেছি, দশ বছর মাঠের বাইরের ছবি আর না তুললেও চলবে!’

এবং, সাহারা এয়ারপোর্টেই একটা অবিস্মরণী ছবি তুলেছিল শিবু, (এস এস কাঞ্জিলাল)। বিশ্বজয়ী ক্রিকেটারদের নিয়ে ক্রিকেট-অনুরাগী এবং ফটোগ্রাফাররা এতই উৎসাহিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ নামে একজন ক্রিকেটারকে তাঁরা দেখতেই পেলেন না। একজনও ভিশিকে চিনতে চাননি, একজনও তাঁর সঙ্গে করমর্দনের ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা ভিশিকে দেখেও দেখেননি। উপেক্ষিত বিশ্বনাথ যখন মালপত্তর বোঝাই ট্রলি ঠেলে আসছেন, কোনও কোনও অত্যুৎসাহী সেই ট্রলির চাকার ওপর উঠে বিজয়ী নক্ষত্রদের দেখার চেষ্টা করেন।

ছবিটা হাতে পেয়েই আমাদের মাথা গরম হয়ে গেল। কাঞ্জিলালকে বললাম, ‘ছবিটা রাখ। আমার ‘খেলা’র এডিটোরিয়ালের সঙ্গে যাবে।’ অলক চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘এত বড় ব্যাপারটা একদিনও ধরে না রেখে কালকের আজকালেই ছবি আর লেখা দিলে কেমন হয়?’ ধীমানও সায় দিল। এসব কথাবার্তার মধেষই গোপাল বসু ঢুকল আর ছবিটা দেখল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘আশ্চর্য! কালই ছবিটা ছাপা হোক। অশোকদা, তুমি এখনই লেখ। এই ছবি নিয়ে বসে থাকা যায় না।’

আমি বললাম, ‘অন্য সব কাজ ছেড়ে লিখব, তার আগে তুমি লেখ, তুমি ভিশির সঙ্গে খেলেছ।’ অলক চট্টোপাধ্যায়কে আর একটা লেখার দায়িত্ব দেওয়া হল যাতে ভিশির টেস্ট রেকর্ডও থাকবে। পরদিন আজকালের প্রকাশিত ওই ছবিটা ক্রিকেট-অনুরাগীদের হৃদয় তোলপাড় করল। সঙ্গের তিনটে লেখাও প্রশংসিত হল। অনেকে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। অভিভূত হওয়ার মতো মন্তব্য করলেন রবিদাস সাহারায়, ‘কাল রাতে আপনার ‘এই হল ভারতবর্ষ’ লেখাটা প্রুফ দেখতে দেখতে পড়ার সময় চোখে জল এসে গেল। অভিনন্দন গ্রহণ করুন। ভোরে বাড়ি ফেরার সময় চিঠি লিখে রেখে গেলাম, আশা করি বিকেলে অফিসে এসে পাবেন।’ জানি এই আন্তরিক অভিনন্দনের যোগ্য আমি নই, তবু, কেন যেন ভাল লাগে। মনে হয়, সাংবাদিকতার মতো আশ্চর্য পেশাই একজন সাধারণ মানুষকে এমন অসাধারণ পুরস্কার এনে দিতে পারে।

ফটোগ্রাফার কাঞ্জিলালকে অভিনন্দন জানিয়ে এল অজস্র চিঠি। মাসখানেক পর মদনদার নামে একটা পার্সেল এল মেদিনীপুর থেকে। দু-তিনটে মোড়ক খোলার পর পাওয়া গেল একটা টিনের কৌটো। মদনদা খুলতে যাবেন, একজন বলে উঠলেন, ‘দেখবেন, টাইম বোমা নেই তো!’ বীরত্বের সঙ্গে আজকাল সম্পাদক টিন খুললেন। তুলোর মধ্যে একটা স্টপ ওয়াচ এবং ছোট্ট চিঠি। সাহার এয়ারপোর্টের উপেক্ষিত ভিশির অবিস্মরণীয় ছবিটি দেখে অভিভূত পাঠক জগন্নাথ ব্যানার্জি স্টপ ওয়াচটি ফটোগ্রাফার এস এস কাঞ্জিলালকে উপহার হিসাবে পাঠিয়েছেন। ঘড়িটা শিবুর হাতে তুলে দেওয়ার সময় বললাম, ‘এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কোনও ফটোগ্রাফার পেয়েছেন কিনা জানি না। আশা করি, এর যোগ্য হওয়ার চেষ্টা করবে।’

‘খেলা’র বিশেষ ক্রিকেট সংখ্যা প্রকাশিত হল ২২ জুলাই। লিখলেন পলি উম্রিগড়, বাপু নাদকার্নি, হনুমন্ত সিং, অজিত ওয়াদেকার, বিষাণ সিং বেদি, একনাথ সোলকার, চেতন চৌহান, সুব্রত গুহ, সানি গাভাসকার এবং ‘খেলা’র পরিচিত লেখকেরা। ছড়া লিখলেন অমিতাভ চৌধুরী, পূর্ণেন্দু পত্রী এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়। খেলার ওই বিশেষ সংখ্যা পঞ্চান্ন হাজার কপি বিক্রি হল।

উৎসাহিত হয়ে একটা বড় পরিকল্পনা নেওয়া হল। আগস্টের মাঝামাঝির মধ্যে লিখে ফেলব বিশ্ববিজয়ের কাহিনী। বই প্রকাশিত হবে ‘আজকাল প্রকাশন’ থেকেই। আমাদের শ্রেণিক শেঠ প্রুডেনশিয়াল কাপের আসরে হাজির ছিল। অমিয় তরফদারও প্রচুর ছবি পাঠিয়েছিলেন। ক্রিকেটারদের দেশে ফেরার পর অসংখ্য ছবি ধরা হয়েছে শান্তি সেন আর কাঞ্জিলালের ক্যামেরায়। আমার লেখা যতই নীরস হোক, এই সব ছবির জোরে বইটা কেটে যাবে, এই আশা ছিল। গোপাল বসু বোম্বাই গেল, ওকে বলে দিলাম, সুনীলের কাছ থেকে যেন একটা ভূমিকা লিখে নিয়ে আসে। সুনীল চমৎকার ভূমিকা লিখে দিল, সঙ্গে চিঠিতে লিখল, ‘অশোক, তুমি ভারতের প্রুডেনশিয়াল কাপ জয় নিয়ে লিখছ জেনে খুব খুশি হলাম। আশা করি, ফাইনালে আমার করা দুই রানকেও যথোচিত গুরুত্ব দেবে। একশো তিরাশি রানের জায়গায় ভারত একশো একাশি রান করলে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের ওপর মানসিক চাপ আরও একটু কম থাকত, এটা নিশ্চয় মানবে!’

ওই ভূমিকা আর চিঠিটা আমার কাছে রয়ে গেল। বই আর লেখা হল না। ঠিক ওই সময়ই পয়লা আগস্ট ময়দান কাঁপিয়ে এসে গেল একশো চুরানব্বই গোলের ঝড়।

পয়লা আগস্ট সন্ধেয় আজকাল অফিসের মাঝখানের বাঁধানো উঠোনে দাঁড়িয়ে গুপী গাইনের সঙ্গে জরুরি কথা বলছিলাম। গুপী গাইন তখন তপেন চট্টোপাধ্যায় নামে আজকালের রিজিওনাল অ্যাডভার্টাইজমেন্ট ম্যানেজার হিসাবে কাজ করছেন। আমাদের কথার মাঝখানে ঢুকে মাঠ-ফেরত ফটোগ্রাফ শান্তি সেন জানালেন, ‘আজ মাঠে একটা দারুণ কাণ্ড হয়েছে। একটা টিম আশি গোল, আর একটা টিম একশো চার গোলে জিতেছে!’ এসব ক্ষেত্রে গোপাল বসুর ফেবারিট ডায়লগ আছে আমার জন্য: ‘তুমি লেখ, কালকের কাগজে।’ এরপর মাঠ থেকে ফিরে রতন বলল, একশো চার গোল ভুল শুনেছ, হয়েছে একশো চোদ্দ গোল। যে বেশি গোল দেবে সে থার্ড ডিভিশনে থাকবে, এই অবস্থায় ইন্টারন্যাশনাল আশি গোল দিয়েছে যুগশান্তিকে, আই বি এ সি একশো চোদ্দ গোল দিয়েছে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিংকে। সব খবর সরোজ নিয়ে আসছে।’

সরোজের আগে রেফারি প্রদীপ নাগ এলেন। কী ঘটেছে, বললেন। সরোজ আসার আগেই আমি লিখতে বসে গেছি। (লজ্জার দিন শেষ!)। সবাই বলল, দুই মাঠে একটা অ্যাম্বাসাডর নিয়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করেছেন অশোক মিত্রর ঘনিষ্ঠ অনুচর রাম গাঙ্গুলি। ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবকে বাঁচাতে হবে তো, তাই।

পরদিন কলকাতার সব পত্রিকাতেই এই খবর গুরুত্ব পেল। তার পরদিন কোনও কোনও পত্রিকায় সম্পাদকীয়ও প্রকাশিত হল। আজকালেও গোটা ব্যাপারটার ফলো-আপ স্বাভাবিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। ৭ আগস্ট বিকেলে পল্লবকে খুব বকলাম, বললাম, ‘তুমি আর সরোজ রিপোর্টিংয়ের মূল দায়িত্বে আছ। তোমাদের লজ্জা করছে না। এত বড় একটা ঘটনার পরও চুপচাপ বসে থাকতে? গট-আপের ব্যাপারে, এই কেলেঙ্কারিটার ব্যাপারে তোমাদের ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রাোচ গত কয়েকদিন ধরেই দেখছি।’ আরও অনেক কড়া ভাষায় বকুনি দেওয়ার পর মনে হল, শুধু মাত্র পল্লব-সরোজকে দেষ দিয়ে লাভ নেই। খুব দ্রুত একটা পরিকল্পনা আমার দিক থেকেই আসা উচিত ছিল। লড়াইয়ের জন্য সবাই তো তৈরি।

পরদিন ৮ আগস্ট বিকেলে অফিসে ঢুকতেই পল্লব সামনে এসে বসল। বলল, ‘কাল রাত্রে সবাই চলে যাওয়ার পর আমি আর সরোজদা অনেকক্ষণ কথা বলেছি। গট-আপ নিয়ে তোলপাড় করতে হবেই। আপনি ঠিক সময়েই বকুনিটা দিয়েছেন। এখন আপনি শুধু আমাদের গাইড করুন, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ছি।’

সরোজ মাঠ থেকে অফিসে আসে আটটার পর। সরোজকে ছাড়াই মিটিং হল। কী কী তদন্ত করা দরকার, কার কার ইন্টারভিউ নিতে হবে, কে কোন কাজের দায়িত্ব নেবে— এ সবই লিখে রাখা দরকার। কাগজের ওপরে লিখলাম: ‘অপারেশন গট-আপ’। একটু অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ না থাকলে এ-সব কাজে যেন ঠিক উৎসাহ পাওয়া যায় না।

দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হল। সপ্তাহে একদিন ছুটি পায় সবাই, বাতিল করে দেওয়া হল। কিছু করলে, দাগ কাটার মতো করাই ভাল। ধীমান জিজ্ঞেস করল, ‘অপারেশন গট-আপ’-এ ‘খেলা’র ভূমিকা কী হবে? আজকালের অনেক পাঠক-পাঠিকা খেলা পড়েন না। আবার ‘খেলা’র কিছু পাঠক-পাঠিকা সম্ভবত আজকাল পড়েন না। তবু, একই বক্তব্য দুটি পত্রিকাতেই রাখা চলতে পারে না। ঠিক হল গট-আপ বিরোধী আন্দোলনে আমরা প্রধানত আজকালকেই প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ব্যবহার করব। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য প্রতিদিন ঘা মারা দরকার। এক সপ্তাহের ব্যবধান লড়াইয়ের তীব্রতা কমিয়ে দিতে বাধ্য। অবশ্য খেলার পাঠক-পাঠিকাদের কাছেও মূল বক্তব্য এবং কিছু অসাধারণ রিপোর্ট পৌঁছে দিতে হবে। গত পাঁচ বছর ধরে সংগ্রামে যাঁরা সঙ্গী তাঁদের উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। মিটিংয়ের শেষে বললাম, ‘তোমরা জান, কাল আমি দিল্লি যাচ্ছি প্রায় এক সপ্তাহের জন্য। খুব ভাল হয়, যদি তিন-চারদিনের মধ্যে তোমরা তুলে আনতে পার বেশ কিছু তথ্য ও ইন্টারভিউ। তারপর লড়াইটা শুরু কর। কোনও সমস্যা দেখা দিলে, আমার পরামর্শ নেবে টেলিপ্রিন্টারে বা টেলিফোনে।’

তিন ও সাত আগস্টের আজকালে আমার দুটি লেখা (‘অশোক মিত্র প্রদত্যাগ করুন’ এবং ‘আমরা কিন্তু হতাশ নই’) প্রকাশিত হল। এবং ‘খেলা’য় ‘আবার অশোক মিত্র’। ভারতবিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্রের চেয়ে অনেক বেশিবার কোল ইন্ডিয়ার কর্মী মাননীয় আই এফ এ যুগ্ম সম্পাদক অশোক মিত্রর নাম খবরের কাগজে ছাপা হয়ে গেল।

১৩ আগস্ট বিকেলে আজকাল হাতে পেয়ে হতাশ হলাম। সেদিনও গট-আপ বিরোধী লড়াই শুরু করা হয়নি। কোনও সমস্যা? তাহলে তো আমাকে জানানোরই কথা। সেদিনই ধীমানের ট্রাঙ্ককল পেলাম, অন্য একটা জরুরি বিষয়ে কথা হল, অপারেশন গট-আপ সম্পর্কে একটা কথাও ধীমান বলল না। আমার খুব রাগ হল, কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। রিসিভারটা বোধহয় বেশ জোরেই রেখেছিলাম। তৎপর দক্ষিণ ভারতীয় যুবক আমাদের দিল্লি অফিসের অল রাউন্ডার হরিদাসন জানতে চাইল, আমি খুব রেগে গেছি কিনা। কিছু বললাম না। হরিদাসন আর এক রাউন্ড কফি বলতে পি টি আই ক্যান্টিনের দিকে গেল।

পরদিন, ১৪ আগস্টের কাগজেও কিছু পেলাম না। ১৫ আগস্ট সকালে দিল্লি ছাড়লাম। সেদিন আজকাল অফিস বন্ধ, পরদিন কাগজ নেই। ১৬ আগস্ট অফিসে গিয়ে যে ভাষায় আমার তরুণতর সহকর্মীদের বকেছিলাম, অন্য কোথাও হলে স্পোর্টস এডিটরকে নির্ঘাত মার খেতে হত। এই ঝড়ের মুখে সবাই চুপ। ধীমান একটা এজেন্সি কপিতে দারুণভাবে ঝুঁকে থাকল। শেষ পর্যন্ত আমতা আমতা করে পল্লব বলল, ‘আমরা কাজ কিছুটা করেছি, কিন্তু আপনি না থাকায় লেখা শুরু করতে পারিনি।’

‘তার মানে?’

‘মূল ব্যাপারটা আপনি বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক কীভাবে শুরু করব, অনেক আলোচনা করেও আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।’

এবার ধীমানের দিকে তাকাতেই হল। —’সত্যি?’

ভুল হোক, ঠিক হোক, সিদ্ধান্ত নিতে ধীমান দেরি করে না। সেই ধীমান আমাকে বিস্মিত এবং হতাশ করে বলল, ‘সত্যি।’

আমরা সবাইকে স্বাবলম্বী হতে বলি। কোনও না কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব বা ক্ষমতা সবাইকেই দেওয়া আছে। তাই এই শোচনীয় অবস্থা দেখে খুব দুঃখ হল। হতাশ ও ক্ষুব্ধ গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘যদি আমি এক মাসের জন্য বাইরে চলে যাই, তোমাদের সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ না থাকে, তোমরা কোনও সিদ্ধান্ত নেবে না?’

ধীমান জানাল, অত দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। এই একটি ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি প্রচুর জটিলতা থাকায়।

তার পরেই, লড়াই শুরু হয়ে গেল। অনেকে আশাতীত সাহায্য করলেন, গোপনে তথ্য জোগালেন এমনও কেউ কেউ যাঁরা আই এফ এ-র প্রধান কর্মকর্তাদের খুব ঘনিষ্ঠ। সম্ভবত বিবেকের দংশন এবং আমাদের আন্তরিকতাই এর জন্য দায়ী। শর্ত ছিল, সংবাদের সূত্র আমরা প্রকাশ করব না। এ-সব ক্ষেত্রে সূত্র আমরা প্রকাশ করিও না। অনেকে কথা দিলেন, সামনের বছর সরাসরি সাহায্য করবেন। এমনকি কোনও কোনও কর্মকর্তা প্রতিশ্রুতি দিলেন গড়াপেটা ম্যাচ খেলবেন না।

পাশাপাশি, অসহযোগিতাও পাওয়া গেল। কেউ উপদেষ্টা পর্ষদ দেখিয়ে, কেউ বা ‘আজ নয় কাল’ বলে এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু এড়িয়ে গেলেও পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এই সুযোগসন্ধানীদের মুখোশও আজকালের প্রতিবেদনে খুলে দেওয়া হল।

দুজন আবার আদর্শবাদীর মুখোশ এঁটে আমাদের বিভ্রান্ত করতে চাইলেন। স্কটিশ চার্চ কলেজের লেকচারার চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ভ্রাতৃসঙ্ঘ ক্লাবের সভাপতি। অনেক সাড়া জাগিয়ে, সততার পতাকা উড়িয়ে তাঁর ক্লাব প্রথম ডিভিশনে এসেছিল। তারপর, ময়দানের পাপচক্রে চন্দ্রনাথবাবুও জড়িয়ে পড়েন। সেই সঙ্গে ভ্রাতৃসঙ্ঘও। পয়লা আগস্টের ভয়ঙ্কর গড়াপেটার পর ১৫ আগস্ট আনন্দবাজারে অধ্যাপক মহাশয়ের একটি আলোকপ্রাপ্ত লেখা প্রকাশিত হল। একদা সৎপথে থাকা, পরে ময়দানের দুষ্টচক্রে জড়িয়ে-পড়া এবং অবশেষে অনুতপ্ত চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কেই প্রথম ইন্টিরভিউয়ের জন্য বেছে নেওয়া হল। দুদিন তাঁর বাড়িতে এবং একদিন স্কটিশ চার্চ কলেজে গেল পল্লব। টেলিফোনও করল বেশ কয়েকবার। ইন্টারভিউটি ছাপা হওয়ার দিন দুপুরেই চন্দ্রনাথবাবু প্রতিবাদপত্র পাঠালেন। তখন আমি অফিসে ছিলাম না। এবং ওই চিঠিতে পত্রলেখকের সই ছিল না। সন্ধ্যায় চিঠির আর একটি কপিতে সই করে পাঠালেন চন্দ্রনাথবাবু। আমার হাতে ওই চিঠি তুলে দিয়ে গেল সম্ভবত তাঁর দুই ছাত্র। কচিমুখ দুটি দেখে বড় কষ্ট হল। মিথ্যা বক্তব্যে ভরা অধ্যাপকের চিঠি বহন করছে দুই নিষ্পাপ প্রায়-কিশোর। চন্দ্রনাথবাবু লিখলেন, অন্তত সাতটি ক্ষেত্রে যা ছাপা হয়েছে তা তিনি বলেননি। এমনকি এ কথাও জানালেন, আজকালের রিপোর্টারকে তিনি কোনও ইন্টারভিউ দেননি। শুধু নাকি ‘মতামতের আদানপ্রদান’ হয়েছিল। পল্লব টেলিফোন করে চন্দ্রনাথবাবুকে বলল, ‘আপনার চিঠি নিশ্চয় ছাপব। তবে সঙ্গে অশোকদার লেখা থাকবে।’ চন্দ্রনাথবাবু বললেন, ‘চিঠিটা ছাপা দরকার, কিন্তু সঙ্গে লেখা না থাকলে খুব ভাল হয়।’ পল্লব যখন জানাল, চিঠি ছাপা হলে সঙ্গে লেখাও থাকবে, তিনি আইনের প্রচ্ছন্ন হুমকি দিলেন। ওই চিঠি ছাপা হল। ওই চিঠির অসত্য বক্তব্যকে খোলাখুলি আক্রমণ করে আমার লেখাও একই দিনে প্রকাশিত হল। কিন্তু মামলার কোনও খবর আর পেলাম না। চন্দ্রনাথবাবু নিজে আইনের স্নাতক, নিশ্চয় বুঝেছিলেন, নির্ভুল তথ্য ও বক্তব্যের বিরুদ্ধে মামলা করে কোনও লাভ নেই।

হঠাৎই ভাল সাজার শখ হয়েছিল হাওড়া ইউনিয়নের কর্মকর্তা আই এফ এ গভর্নিং বডির সদস্য আদিনাথ দে-র। বউবাজারকে বাঁচানোর জন্য হাওড়া টাউন যখন মাঠে কার্ডই নিয়ে গেল না, আদিনাথবাবু হাওড়া টাউন ক্লাব থেকে পদত্যাগ করলেন। গড়াপেটার প্রতিবাদে তিনি আই এফ এ-র গভর্নিং বডি থেকেও পদত্যাগ করলেন। একটু পরোক্ষভাবে হলেও আই এফ এ-র কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তিনি ইতস্তত বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন। তাঁর ইন্টারভিউ নিল সরোজ। অনেক চাঞ্চল্যকর কথা, পরে হঠাৎ ‘বদলে গেল মতটা’। তিনি জানালেন, ও-সব তিনি বলার জন্য বলেছেন, ছাপার জন্য নয়। বুঝলাম, এই ইন্টারভিউ ছাপা হলে আর একটি অদ্ভুত প্রতিবাদপত্র আসবে। এবং আর একজন সুযোগসন্ধানী ব্যক্তির জন্য আমাকে আর একটা লেখা খরচ করতে হবে। কম্পোজ-করা ইন্টারভিউটি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ফাইলে রাখতে বললাম। পরে কাজে লাগতে পারে, অন্যভাবে।

একশো চুরানব্বই গোলের দুটি ম্যাচের তদন্তের জন্য চার টিমের ফুটবলারদের সঙ্গে কথা বলা জরুরি ছিল। কিন্তু ক্লাবের কর্মকর্তারা জানালেন, ঠিকানা জানেন না। একটা ক্লাবের কর্মকর্তারা ফুটবলারদের এক জায়গায় এনে আমাদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে সরোজ দেখে, এক কর্মকর্তা শুধু এই খবরটা দেওয়ার জন্য আছেন যে, ফুটবলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি!

কিন্তু যোগাযোগ তো করতে হবে। আমরা আই এফ এ অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট ফুটবলারদের ঠিকানা পেতে চাইলাম। যুগ্ম সম্পাদক, এরিয়ান ক্লাবের বরুণ পাল নির্মলকে বললেন, ‘ঠিকানা দেওয়া সম্ভব নয়, বারণ আছে।’ ধীমানকে বললাম, ‘কাল তুমি আই এফ এ অফিসে যাও, সঙ্গে সরোজ থাকতে পারে। অশোক মিত্র থাকলে ভাল, না থাকলে বরুণ পাল বা ট্রেজারার প্রদ্যুৎ দত্তর কাছে ওই ফুটবলারদের ঠিকানা চাইবে। খাতাপত্র দিলে, তুমি টুকে নেবে, এ কথা বলবে।’

ধীমানকে এই কাজটার জন্য নির্বাচিত করার একটা বিশেষ কারণ ছিল। যেখানে সেলসম্যানশিপের ব্যাপার নেই, যেখানে আইন বা নিয়মমতো কাজ পাওয়া দরকার, ধীমানই উপযুক্ত। শুধু বললাম, যা আমার প্রথম কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলতেন, ‘বি পোলাইট ইন ইয়োর অ্যাপ্রাোচ, বাট ফার্ম ইন ইয়োর স্ট্যান্ড।’

ধীমান গেল এবং বরুণ পাল ‘না’ বললেন না। দুর্বোধ্য হাতের লেখার জন্য কিছু নাম-ঠিকানা উদ্ধার করা গেল না। একই ঠিকানায় পাঁচ-সাতজন ফুটবলারের নাম পাওয়া গেল। কিন্তু কিছু ঠিকঠাক ঠিকানাও পাওয়া গেল। পরদিন থেকেই কলকাতার বিভিন্ন পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ল সরোজ, নির্মল আর অরূপ। অনেক মজার ঘটনা ঘটল। এক পাড়ায় নির্মলকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘আপনি কি পাওলো রোসির সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?’ অন্য এক জায়গায় কাছাকাছির মধ্যে তিন ফুটবলারকে পেয়ে গেল অরূপ। জায়গাটা খুব নিরাপদ বিবেচনা না করায় নিরীহ অরূপ অভিনয় করল, যেন কোনও মফসসলের টুর্নামেন্টের জন্য প্লেয়ার খুঁজতে এসেছে। কোথায় খেলা, কী পাওয়া যাবে, এই সব কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে অরূপ সংগ্রহ করে নিচ্ছিল প্রয়োজনীয় তথ্য। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অরূপ ধরা পড়ে যায়। এবং স্বস্তির কথা, ও কোনও অসুবিধায় পড়েনি। ‘খেলা’য় তখন লড়ে যাচ্ছে অরুণ সেনগুপ্ত। শ্রীরামপুরে ওর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়ি। একদিন রাম গাঙ্গুলি সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর কিছু খবর নিয়ে এল। তিন-চারদিন পর অরুণের সঙ্গে সরোজ শ্রীরামপুরে রাম গাঙ্গুলির ঘাঁটিতে হাজির হল। পয়লা আগস্টের গট-আপ ম্যাচে যুগশান্তির হয়ে খেলেছিল ইন্টারন্যাশনালের দু-একজন ফুটবলার, জানা গেল। আরও জানা গেল, কীভাবে ওই ম্যাচটার জন্য রাম গাঙ্গুলি প্রস্তুতি নিয়েছেন, গোপন মিটিং করেছেন। ওই ম্যাচে খেলেছেন, রাম গাঙ্গুলির এমন এক ঘনিষ্ঠ যুবক সব কথা ফাঁসও করে দিলেন। আজকালে সেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হতেই উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপলেন রাম গাঙ্গুলি এবং তাঁর নেতা অশোক মিত্র। আবার মামলার হুমকি। আবার আমাদের প্রতীক্ষা। এবং আবার হতাশা। কেন যে কেউ মামলা করে না!

অশোক মিত্র, রাম গাঙ্গুলি অ্যান্ড কোম্পানির সবচেয়ে বড় বিপদ এল এরিয়ান-ক্যালকাটা জিমখানা ম্যাচের দিন। অশোক মিত্রর কথায় ক্যালকাটা জিমখানা সোনালি শিবিরকে দুটি পয়েন্ট ছেড়ে দিয়েছিল এই শর্তে যে, শেষ ম্যাচে রিলে সিস্টেমে ওই দুটি পয়েন্ট এরিয়ান ফিরিয়ে দেবে ক্যালকাটা জিমখানাকে। গড়াপেটার বিরুদ্ধে আজকালের লড়াই তখন যথেষ্ট গতি পেয়ে গেছে। আমরা সেদিনের কাগজে জানালাম, এরিয়ান-ক্যালকাটা জিমখানাকে দুটি পয়েন্ট ছাড়তে চলেছে। বেশ বড় কপি গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হল। এরিয়ান ক্লাবের সম্পাদক অজিত ব্যানার্জি চাপের মধ্যে পড়লেন। ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীও জানালেন, প্রহসন দেখতে তিনি মাঠে যেতে পারেন। অনেক দৌড়ঝাঁপ করেও অশোক মিত্র কিছু করতে পারলেন না। এরিয়ানের সম্পাদক এমনিতে অশোক মিত্রর দলের লোক, কিন্তু প্রভাবশালী সদস্যদের চাপ তিনি অস্বীকার করতে পারলেন না। মন্ত্রীর ভয়ে গুটিয়ে গেলেন অশোক মিত্র। খেলার আগে এরিয়ান টেন্টে গিয়ে নিজে টিম ঘোষণা করলেন এরিয়ান সম্পাদক। ক্রুদ্ধ রাম গাঙ্গুলির বিদ্রোহের হুমকি হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে বেশি সময় লাগল না। জিমখানাকে এক পয়েন্ট পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল। জিমখানার নেমে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল। খেলার পর জিমখানার কর্মকর্তারা আজকালের প্রতিবেদককে জানালেন, অশোক মিত্র তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আজকালের জন্যই টিম নেমে গেছে, এই কথা বলে জিমখানার কিছু হাফ-কর্মকর্তা গালিগালাজও করলেন। কিন্তু তাদের প্রধান কর্মকর্তা দিলীপ ঘোষ পরে এক সাক্ষাৎকারে আমাদের অভিনন্দন জানালেন। নেমে যাওয়ার পরেও, গড়াপেটার সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত থাকা সত্ত্বেও, দিলীপ ঘোষের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া গেল। তাঁর প্রশংসা মুক্তকণ্ঠে করতেই হয়।

টালিগঞ্জ অগ্রগামীর মন্টু ঘোষ সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘যদি কখনও গড়াপেটা খেলা বন্ধ হয়, আজকালের কাছে কলকাতার ফুটবল ঋণী থাকবে।’ আজকালের সংগ্রামকে সমর্থন করলেন ক্যালকাটা রেফারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আর কে দত্ত এবং সম্পাদক সন্তোষ সেন। উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য পরিতোষ চক্রবর্তীও বললেন, গড়াপেটা বন্ধ হলে বা কমলে আজকালের ভূমিকাই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এখানে আর-একজনের কথা আমি আলাদাভাবে বলে রাখতে চাই। এ আই এফ এফ সম্পাদক অশোক ঘোষ আজকালের অন্যতম ডিরেক্টর। অশোক মিত্র আই এফ এ সম্পাদক তাঁর ইচ্ছাতেই হয়েছেন। ময়দানের অনেক ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন অশোক ঘোষ। গড়াপেটার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই সেই সব ক্লাবের বিরুদ্ধেও গেছে, অশোক মিত্রর বিরুদ্ধে তো গেছেই। পয়লা আগস্টের প্রহসনের সময় অশোকদা বিদেশে ছিলেন। ময়দানে আমাদের কোনও কোনও শুভানুধ্যায়ী বললেন, তিনি ফিরে এলে আমাদের লড়াই বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। ময়দানের বাস্তুঘুঘুদের বাঁচানোর জন্য তিনি অবশ্যই চাপ সৃষ্টি করবেন।

অন্য সব পত্রিকার সঙ্গে আজকালের পার্থক্য এখানেই যে, সম্পাদকীয় ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কখনও হস্তক্ষেপ করেন না। যাকে বলে সম্পাদকীয় স্বাধীনতা, তা আজকালের মতো আর কোথাও আছে বলে আমার জানা বা শোনা নেই।

তবু, একটু ভাবতে হল। সত্যি যদি অশোকদা চাপ সৃষ্টি করেন? আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, নীতির প্রশ্নে আপস নেই। গড়াপেটার বিরুদ্ধে লড়াই যদি বন্ধই করতে হয়, আজকাল এবং খেলা থেকে দুঃখের সঙ্গেই বিদায় নেব। শুধুমাত্র মাসে কয়েক হাজার টাকা রোজগার করার জন্য ক্রীড়া-সাংবাদিকতা করতে আসিনি।

অশোক ঘোষ বিদেশ থেকে ফিরলেন। তাঁকে উত্তেজিত করার চেষ্টাও হল। কিন্তু তিনি আমাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে রাজি হলেন না। তিনি নিরপেক্ষ থাকলেন। বলা বাহুল্য, এই নিরপেক্ষতাই আমরা চাইছিলাম। তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। গড়াপেটা যদি কখনও বন্ধ হয় বা কমে, তার জন্য যদি ক্রীড়ামোদীরা আজকালের কাছে সামান্যতম কৃতজ্ঞ থাকেন, সেই কৃতজ্ঞতার একটা অংশ অশোক ঘোষের জন্য বরাদ্দ থেকে গেল।

এবং এই লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় সহযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া গেল বালি প্রতিভার শ্যাম গাঙ্গুলিকে। একবার বললেই শেষ ম্যাচে এক পয়েন্ট ছেড়ে দিত গ্রিয়ার এবং বালি প্রতিভাকে তৃতীয় ডিভিশনে নামতে হত না। শ্যাম গাঙ্গুলি একবারের জন্যও আদর্শচ্যুত হতে রাজি হলেন না। আনন্দবাজারে হেডিংটা দুর্দান্ত ছিল, ‘বালি প্রতিভা নেমে গিয়ে উঠে এল নক্ষত্র হয়ে।’

শ্যাম গাঙ্গুলি একদিন আজকাল অফিসে এসে আমাদের অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। আমি বালি প্রতিভার সদস্য হওয়ার জন্য লিখিত আবেদন করলাম।

চিঠি লিখে এবং টেলিফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন অসংখ্য ক্রীড়ানুরাগী। যাঁর কথাকে আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই, সেই মুকুল দত্তও বলেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত কী হবে জানি না। তবে তোমরা ঠিক পথেই চলছ।’

কেউ কেউ আবার নিরুৎসাহিত করে বললেন, এ-সব লেখালেখি করে কিছুই হবে না। কিছু হচ্ছে তাও এবারই বোঝা গেল। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এ লড়াই চলবে বছরের পর বছর। ময়দানে গড়াপেটা থাকলে, আমাদের লড়াইও থাকবে। কেউ কেউ আবার বলেছেন, লিখে কী লাভ? গড়াপেটা কমতে পারে, কিন্তু বন্ধ করা যাবে না। কোনও দেশই হয়নি। চুরি-ডাকাতি যদি সম্পূর্ণ বন্ধ না করা যায়, অবাধ চুরি-ডাকাতি চলতে দিতে হবে? গড়াপেটা যদি কমে, আমরা জানব, কিছুটা কাজ হয়েছে। আমরা সতর্ক থাকব, সজাগ থাকব। এটুকু বলতে পারি, গড়াপেটার কাজটা খুব কঠিন হয়ে গেল।

সেপ্টেম্বরের এক-দুই তারিখে আমহার্স্ট রো-র একটি সংস্থার এক কর্মকর্তা বললেন, ‘গড়াপেটার বিরুদ্ধে একটা সেমিনার করছি। আপনাকে যেতেই হবে।’

‘আমি তো সভা-সমিতিতে বিশেষ যাই না। কী দরকার? আমাদের বক্তব্য পেশ করার জন্য তো কাগজই রয়েছে। তবু, বলুন, এই সেমিনারে আর কে কে আসছেন?’

‘চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি আর রবিন লোধরায়।’

— ‘সে কী? এরা দুজন তো গট-আপ ম্যাচের দুই বড় পাণ্ডা। আমার যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। তবে আমাদের রিপোর্টার আর ফটোগ্রাফার যাবে।’

সেই রবিবারেই হাওড়ায় এক অনুষ্ঠানে আই এফ এ সম্পাদকের হাজির থাকার কথা ছিল। সেখানেও রিপোর্টার আর ফটোগ্রাফার পাঠানো হল। পরিকল্পনা ছিল পরদিন কাগজে প্যানেল করে দুটি সভার বক্তাদের ছবি ছেপে বড় ক্যাপশন দেওয়া হবে: ‘এরা এখনও সভা-সমিতিতে যাচ্ছেন!’

আমাদের হতাশ করে ওই তিন বিশিষ্ট ব্যক্তিই সভায় অনুপস্থিত থাকলেন।

‘খেলা’র চিঠি দেখার এবং বাছার দায়িত্বে আমাদের একজন সাংবাদিক রয়েছে। মাঝে কিছুদিন কাজের চাপে চিঠিপত্র পড়া ছেড়েই দিয়েছিলাম। সম্প্রতি কাজের চাপ আরও বেড়েছে, তবু চিঠিপত্র পড়ছি। বাছি না, শুধু পড়ি। চিঠিপত্র না পড়ায় কেমন যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম। কোনও লেখা বা ফিচার কতটা ভাল বা কতটা খারাপ লাগছে পাঠক-পাঠিকাদের, তা না বুঝলে কোন পথে চলব? অনেকে শুধুই প্রশংসা আর উৎসাহ দেন, কেউ কেউ চমৎকার পরামর্শ। আমরা উৎসাহিত হই, উপকৃত হই। সমালোচনাও আমাদের সংশোধিত ও উপকৃত করে যায়। কিন্তু দু-একটি চিঠি পড়ে মনে হয়, আমরা বোধহয় খুব খারাপ কাজ করছি। সবচেয়ে খারাপ লাগে তখনই, যখন বলা হয়, আমরা খেলাধুলোর উন্নতি মোটেই চাই না। আমাদের কোনও আদর্শ-টাদর্শ নেই, স্রেফ ব্যবসা, আর কিছু নয়। স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই, আমরা প্রচারসংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সচেতনভাবে কখনই লোক ঠকিয়ে নয়। ভাল কাজ করতে হলে বেঁচে তো থাকতে হবে। এবং বেঁচে থাকতে হলে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে পত্রিকাকে মজবুত রাখতেও হবে। তবু, বাণিজ্যিক সাফল্য এবং সেই সঙ্গে যৎসামান্য ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার মধ্যেও এ কথা জোর গলাতে বলতে চাই, শুধুমাত্র অর্থোপার্জন করার জন্য ক্রীড়া-সাংবাদিকতার চেয়ে অনেক সহজ রাস্তা খোলা ছিল।

বিরাশির পুজোসংখ্যায় ‘উটকো সাংবাদিকের ডায়েরি’র প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়। কীভাবে একে একে বেছে নিয়েছি আমাদের সাংবাদিকদের তার গল্প করে শতাধিক তরুণ আমাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তাঁরাও ক্রীড়া-সাংবাদিক হতে চান। অনেকে একাধিক চিঠি দিয়েছেন। কেউ কেউ জানিয়েছেন, ক্রীড়া-সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন ছোটবেলা থেকে। কয়েকজন অফিসে এসে দেখাও করেছেন। প্রায় সবাইকে বলি, রবিবাসরের খেলার পাতায় লেখা দিন। ভাল হলে নিশ্চয় ছাপা হবে। রবিবাসরে লিখতে লিখতে আমাদের টিমে এসে গেল অরূপ বসু। ওর লেখার হাতটা ভাল, এটা বোঝার জন্য কয়েকটা লেখাই যথেষ্ট ছিল।

অনেকেরই চিঠি পড়ে বোঝা যায়, লেখার হাত খারাপ নয়। খেলাধুলোয় আগ্রহ প্রবল। পরিশ্রম করে বড় হওয়ার ইচ্ছে আর জেদ আছে। বস্তুত, ক্রীড়া-সাংবাদিক হিসেবে মোটামুটি দাঁড়ানোর জন্য এর চেয়ে বেশি আর কী দরকার! কিছুই না। বারবার বলি এবং এটা কোনও কথার কথা নয়। আমরা কেউই প্রতিভাবান নই। যাঁরা ক্রীড়া-সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন এবং যাঁরা ক্রীড়া-সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সুযোগ পাচ্ছেন না— এই দুই দল তরুণের মধ্যে গুণগত বিরাট কিছু পার্থক্য আছে বলে মনি করি না। অনেক আশা ও শ্রদ্ধা নিয়ে যার কাছে চিঠিগুলো লেখা হচ্ছে, সেই অশোক দাশগুপ্তর চেয়ে অনেক বেশি সম্ভাবনাময় তরুণকে সুযোগই দেওয়া যাচ্ছে না।

উনিশশো আটাত্তরে যখন খেলার পত্রিকার কাজ শুরু করেছিলাম, তখন কিছুই জানতাম না। পরে যখন বুঝলাম ক্রীড়া-সাংবাদিকতা এমনই একটা জায়গা, যেখানে আসার জন্য অনেক উপযুক্ত তরুণ অপেক্ষমাণ, তখন সুযোগ অনেক কমে গেল। শুধুমাত্র ক্রীড়ানুরাগীদের জন্য পত্রিকা এবং শুধুমাত্র বঙ্গভাষাভাষীদের। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে খুব বড় কিছু ভাবা সম্ভব নয়। ভাবতে পারলে, আরও অন্তত দশজন তরুণকে বেছে নিতাম। মাঠ-ময়দান তোলপাড় করার জন্য, লেখায় লেখায় আন্দোলনের তুফান তোলার জন্য। এখনও এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দরজা খোলা রইল, কোনও সতেজ তরুণ যদি দুর্দান্ত লেখা এবং পরিশ্রম করার ইচ্ছে নিয়ে এগিয়ে আসে, অন্তত লেখার সুযোগটুকু করে দেওয়া যায়। কিন্তু ক্রীড়া-সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে না পেলে একজনের পক্ষে কতখানি সময় দেওয়া সম্ভব।

গত বছর আই এফ এ শিল্ডের সময় একটি ছেলে এল। স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। শুনলাম, দুপুর একটা থেকে। আমি অফিসে ঢুকেছি সন্ধের মুখে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বারকয়েক ক্যান্টিন থেকে হয়ত চা খেয়ে এসেছে, তা ছাড়া ওই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে! দুর্গাপুর থেকে এসেছে, আমার সঙ্গে দেখা না করে যাবে না। সেদিন অন্য সব দিনের চেয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলাম। বললাম, ‘আজ একটুও সময় নেই। কাল আসুন।’ ছেলেটি, যতদূর মনে পড়ছে— সঞ্জয় চক্রবর্তী। পকেট থেকে একটা বড় চিঠি বার করে বলল, ‘এটা আপনি পড়ুন। এত কথা গুছিয়ে বলতে পারব না বলে লিখে এনেছি।’ আমি বললাম, ‘চিঠিটা থাক, রাতে পড়ব, আপনি কাল আসুন।’

সেই রাতে নয়, পরদিন বিকেলে অফিসে আসার পথে গাড়িতে বসে চিঠিটা পড়লাম। ঝরঝরে বাংলায় লেখা লম্বা চিঠির মূল বক্তব্য: ‘আপনি আমার আদর্শ সাংবাদিক। আমি দুর্গাপুরে একটা কোম্পানিতে চাকরি করি। সেটা ছেড়ে দিয়ে জার্নালিজম করতে চাই আপনার কাগজে। সুযোগ দিন, আমি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবই।’ লেখা পড়ে এবং একবার মুখ দেখেই বোঝা গিয়েছিল, জেদি ছেলে। কিন্তু এককথায় তখনই চাকরি দেওয়ার উপায় ছিল না। থাকে না। বললাম, ‘চাকরি ছাড়বেন না। কিছু লেখা দিন। কিছু কাজ করুন, চাকরি বজায় রেখে। ভবিষ্যতে যদি মনে হয় যে আপনাকে আমাদের দরকার, চাকরি ছাড়ার কথা ভাববেন।’

ছেলেটি কিন্তু চাকরি ছাড়তে বদ্ধপরিকর। বলল, ‘যা হয় হবে। আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসব। আমার বাড়ি কলকাতাতেই।’ বোঝালাম, এমন পাগলামি করলে আমার দিক থেকে একটুও সাহায্য পাওয়া যাবে না। কথা হল, মাসখানেক পর কয়েকদিনের ছুটিতে কলকাতায় আসবে। একটা ইন্টিরভিউ নিয়ে লেখা তৈরি করবে। ছেলেটি আর আসেনি।

ক্রীড়া-সাংবাদিকতার সবটাই ভাল ব্যাপার নয়। প্রথম দিকের রোমাঞ্চ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ব্যর্থতার গ্লানি স্পর্শ করতে থাকে। যা করা উচিত ছিল, যতটা করা উচিত ছিল, তা কেন পারা গেল না— এই চিন্তা বাড়তে থাকে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি, একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পত্রিকা, সাপ্তাহিক খেলার পত্রিকা এবং দৈনিক পত্রের খেলার পাতা জুড়ে আমরা অবশ্যই নিজেদের অনেকখানি ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু, শুধুমাত্র এই কারণেই কোনওখানেই নিখুঁত হতে পারিনি। বিশেষ বিশেষ দিন ছাড়া আজকালকে সময় দিয়েছি খুব কম। অন্যদেরও অনেকখানি সময় কেড়ে নেয় ‘খেলা’। রোজ সকালে সবার আগে আজকাল তুলে নিয়ে খেলার পাতায় গিয়ে বারবার ধাক্কা খাই, মন খারাপ হয়। ভাবি, যত্নের অভাবে কত ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। ‘খেলা’ হাতে নিয়েও মনে হয়, আজকালের জন্য প্রচুর সময় দেওয়ার পর অনেকেরই লেখা আর প্রাণবন্ত থাকছে না, ভুলও থেকে যাচ্ছে প্রচুর। হয়ত, সাধ্যের বাইরে নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছি। কাজের চাপ বাড়তে বাড়তে মাঝে মাঝে যেন দম বন্ধ করে দিতে চায়। তবু লড়েছি। আমরা সবাই লড়েছি। দুঃখ শুধু একটাই, এই লড়াইয়ে এক ঝটকায় জিতে যাওয়ার মতো প্রতিভার সোনার কাঠি আমাদের কারও হাতে নেই।

উনিশশো আটাত্তর সালে ‘খেলার কথা’ করার সময়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দশ বছর চেষ্টা করে দেখব, ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় নতুন কিছু করা যায় কিনা। একটা যথার্থই ভাল খেলার পত্রিকা পাঠক-পাঠিকাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া যায় কিনা। হাতে আর চার বছর সময় আছে। এই তিরাশিতেই সিদ্ধান্ত, উনিশশো সাতাশি সালে ক্রীড়া-সাংবাদিকতা থেকে বিদায়। ব্যর্থ হলে তো বটেই, এমনকি সাফল্য পেলেও। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার নাম আর যাই হোক জীবন নয়। ব্যর্থতার অন্ধকার চিরে সাফল্য আনার চেষ্টায় অবশ্যই নিয়োজিত থাকবে আমার দুরন্ত সঙ্গীরা— কিন্তু আমি নই। আরও চার বছর সমস্ত আন্তরিকতা ক্রীড়া-সাংবাদিকতায়। তারপর অন্য কোনওখানে। হয়ত আরও ব্যস্ততায়। অথবা ব্যক্তিগত নির্জনতায়। যেখানে সাফল্য আর ব্যর্থতার আলো-আঁধারি নেই, ভাল, আরও ভাল, আরও ভাল কিছু করার দায় নেই। যুদ্ধে সবাই জেতে না, কিন্তু এই সৈনিকটি প্রাণপণ লড়াই করেছিল— খেলার পত্রিকা আন্দোলনের সৈনিক অশোক দাশগুপ্ত শুধু এই স্বীকৃতিটুকুই আশা করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *