খেলা শারদীয় সংখ্যা ১৯৮৫
যাই-যাই বিকেলে অথবা ছুঁই-ছুঁই সন্ধেয় হাওড়া-আসানসোল এক্সপ্রেস হাওড়া স্টেশন ছাড়ার মিনিট খানেক পরই শঙ্খ রায়চৌধুরি গম্ভীর মুখে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, আমরা কেন আসানসোল যাচ্ছি?’ জবাবটা শঙ্খর ভালমতোই জানা ছিল। আগের দিন থেকে বার পাঁচেক এই প্রশ্নটা কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে তুলে ও শুধু বোঝাতে চাইছিল, আমার আর সুরজিতের মাথা নিশ্চয় খারাপ হয়ে গেছে, না হলে এই ছোট্ট কাজটার জন্য এমন সদলবলে আসানসোল যাওয়ার কথা ভাবতাম না। আসানসোলগামী টিমে আমি আর সুরজিৎ ছাড়াও ছিল আমাদের তিন বন্ধু তথা এফ ডব্লু এ-র সংগঠক শঙ্খ, জ্যোতি ও প্রকাশ রায়, আমার স্ত্রী তপু এবং সাড়ে তিন বছর বয়সী পুত্র জিকো।
কম্পার্টমেন্টের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায় জিকোকে ব্যাটিং প্র্যাকটিস দিচ্ছিল সুরজিৎ। হঠাৎ নিজের জায়গায় ফিরে এসে বলল, ‘শঙ্খ যাই বলুক, আমরা বড় কাজে যাচ্ছি। কিন্তু সাকসেসফুল না হলে খুব খারাপ লাগবে। এতদূর গিয়েও…।’ শঙ্খ এবার সত্যি সত্যিই গম্ভীর হয়ে গেল। শিশু ব্যাটসম্যান পরবর্তী বোলার বাছার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ল, কারণ বড় ছয়জনই তখন বেশ গভীর চিন্তায় মগ্ন: কাজটা ঠিকমতো হবে তো? চা-ওয়ালার আওয়াজ এবং ততোধিক কর্কশ চা নীরবতা ভাঙতে সাহায্য করল। আরও তিন-পাঁচ রকমের আলোচনা শুরু হল বটে, আমাদের মনের মধ্যে ঘুরেফিরে সেই নীলেশ সরকার। নীলেশ সরকারকে পদত্যাগ করাতে রাজি করাতে পারব তো? আমাদের মধ্যে সব চেয়ে নিশ্চিত ছিল প্রাক্তন ভলিবলার প্রকাশ রায়। নিজস্ব ইংরেজি এবং বিচিত্র প্রবাদ-প্রবচন দিয়ে আমাদেব টেনশন কাটাতে কাটাতে ও মাঝে মাঝেই বলে যাচ্ছিল: ‘নো প্রবলেম!’
পনেরো-ষোলোজন জাতীয় ফুটবলার বিদেশকে টিমে নেওয়ার দাবি জানিয়ে লেখার পরেও, অধিকাংশ নির্বাচক ব্যক্তিগতভাবে বিদেশকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মোটামুটি আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও, অশোক মিত্রর চেষ্টায় প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত থাকল। আজকালে আমার আর সুরজিতের লেখায় ভয়ঙ্কর আক্রমণ ছিল। ফিরিয়ে আনা না গেলেও, বাংলার প্রায় সব ফুটবল অনুরাগীকেই এ কথা বিশ্বাস করানো সম্ভব হয়েছিল যে, বিদেশকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে, নির্বাচকরা আই এফ এ-র প্রতিহিংসাপরায়ণ সচিবের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছেন। সেই পর্যায়ে আমাদের আর কিছু করার ছিল না। ‘খেলা’র দপ্তরে বসে সুরজিৎ বলল, ‘আমাদের লড়াইয়ের সমর্থনে একজন সিলেক্টরও যদি রিজাইন করতেন!’ রিজাইন? হাতের কাজ সরিয়ে রেখে বললাম, ‘রিজাইন একজনই করতে পারেন, নীলেশ সরকার। আসানসোল এমন কিছু দূরে নয়। কিন্তু উনি বন্ধুদের ছাড়তে চাইছেন না।’
যে মিটিংয়ে বিদেশকে বাংলার প্রাথমিক দল থেকেই বাদ দেওয়া হয়, তাতে নীলেশ সরকার হাজির ছিলেন না। আসানসোলে ট্রাঙ্ক-কল করতেই তিনি পরিষ্কার বলেন, ‘ব্যাঙ্কের বিশেষ কাজে আটকে পড়ায় মিটিং অ্যাটেন্ড করতে পারিনি, কিন্তু পরিষ্কারই বলছি, বিদেশকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থন করি না। এটা অন্যায়। আর একটা মিটিং নিশ্চয় হবে। সেখানে লড়ব।’ আমি জানালাম, বিদেশকে বাদ দেওয়ার চক্রান্তের নেতা স্বয়ং অশোক মিত্র। নীলেশ সরকার: ‘হু ইজ অশোক মিত্র?’ প্রথম এবং দ্বিতীয় সভার মাঝে নীলেশ সরকারের সঙ্গে টেলিফোনে দশবার কথা হয়। নিশ্চিত ছিলাম, কিছু করতে না পারলে তিনি অন্তত পদত্যাগ করে আমাদের নৈতিক সমর্থন জানাবেন। কিন্তু, কিছুই হল না। দ্বিতীয় সভায় বিদেশকে নেওয়ার ব্যাপারে কথা বিশেষ এগোল না, নীলেশ সরকারও পদত্যাগ করলেন না। সুকুমার সমাজপতি চাইলে, অশোক মিত্রও শেষ পর্যন্ত বিদেশের টিমে-আসা রুখতে পারতেন না। তিনি অজ্ঞাত কারণে অনড় থাকলেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধেই আমাদের অভিযোগ সব চেয়ে প্রবল। তারপরই— নীলেশ সরকার। কেন তিনি প্রথমে বড় বড় কথা বলে পরে গুটিয়ে গেলেন? আজকালে আমার লেখায় তাই এই দু’জনের বিরুদ্ধেই আক্রমণ ছিল বেশি। তবু, আমার মনে হচ্ছিল, নীলেশ সরকার একেবারে ‘লস্ট কেস’ নয়। সুরজিতের কথায় চিন্তাটা ফিরে এল: নীলেশ সরকারকে পদত্যাগের ব্যাপারটা মনে করিয়ে দিলে কেমন হয়?
নির্বাচন কমিটির শেষ সভায় চূড়ান্ত দল নির্বাচিত হওয়ার কথা। বিদেশের আর টিমে ঢোকার প্রশ্ন নেই। তবু, এই মিটিংয়ের দিনটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তার আগেই নীলেশ সরকারের পদত্যাগ করা দরকার। হাতে সময় মাত্র চারদিন। মিটিং— 2 মার্চ। ২৭ ফেব্রুয়ারি ভোরে রতন ভট্টাচার্যকে আসানসোল পাঠানো হল। সেদিন বিকেলে আসানসোলের উপকণ্ঠে বার্নপুরে বাংলার সম্ভাব্য ফুটবলারদের ট্রায়াল ম্যাচ। একজন রিপোর্টার তো যেতেই পারে। রতন অবশ্য ম্যাচটা না দেখেই ফিরে এল! স্টেশন থেকে সোজা স্টেট ব্যাঙ্ক, নীলেশ সরকারের অফিস। নীলেশদাকে রতন আমাদের বক্তব্য জানাল: ‘আপনি যখন মনেই করেন যে, বিদেশকে বাদ দেওয়া অন্যায় হয়েছে, প্রতিবাদে পদত্যাগ করবেন না কেন?’ আজকালের লেখায় (‘এই পাঁচজনকে আপনারা চিনে রাখুন’) গুটিয়ে যাওয়া নীলেশ সরকারকে আক্রমণ করতে গিয়ে ব্র্যাকেটে একবার লিখেছিলাম— ‘আহ, নীলেশ সরকার!’ সেই বাক্যটি এবং আরও কিছু অংশ বারবার উদ্ধৃত করে নীলেশ সরকার রতনকে বলেন, ‘না, অশোক ভুল কিছু লেখেনি। আমাকে আঘাত করতে গিয়ে একটাও মিথ্যে কথা লেখেনি। টেলিফোনে ওর সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে, ঠিক তা-ই লিখেছে, একটুও বাড়িয়ে লেখেনি। কথাবার্তার দাঁড়ি কমাও কী করে মনে রাখল, তাই ভাবছি। তুমি নিশ্চিন্তে কলকাতায় ফিরে যাও, অশোককে গিয়ে বল, আমি পরশু রাতে ফিরছি। হাওড়া স্টেশনে তোমরা থেক, কথা বলে বলরামের কাছে যাব। পরদিন সকালেই রেজিগনেশন দেওয়া যাবে। শুধু একটা জায়গায় খচখচ করছে, সিনহা-সুকুমারদের সঙ্গে হয়ত এ জন্য বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ হয়ে যাবে।’
সেদিন সন্ধেয় ক্যালকাটা স্টেট ট্রান্সপোর্ট টেন্টে এফ ডব্লু এ-র মিটিং ছিল। মিটিং শেষ হওয়ার পর গেটে দাঁড়িয়ে বিদায়কালীন আড্ডা মারছি— এমন সময় রতন হাজির। নীলেশ সরকারের অফিস থেকে সোজা স্টেশনে এসে ট্রেন ধরেছিল, যাতে খবরটা সেই সন্ধেতেই সুরজিৎ আর আমি পেয়ে যাই। রতন, শঙ্খ, প্রকাশ, অলক চট্টোপাধ্যায়, পল্লব, সুরজিৎ আর আমি পার্ক স্ট্রিটে ফ্লুরিজ-এ বসলাম। জরুরি মিটিং। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সুরজিৎ বলল, ‘অশোক, তোমার যাওয়া দরকার।’ রতন বলল, ‘আমার মনে হয়, দরকার নেই। কথা দিয়েছেন, পরশু রাতে আসছেন।’ সুরজিৎ: ‘নীলেশদা ব্যাঙ্কের কাজে ফেঁসে গেলে কী হবে? তা ছাড়া, বন্ধুদের কথা ভেবে পিছিয়ে যাওয়াও তো অসম্ভব নয়।’ পল্লব আর একটা মোক্ষম যুক্তি দেখাল, ‘নীলেশদা পরশু রাতে কলকাতায় এলে কোনও লাভ নেই। পরদিন মিটিং, আগের দিন বিকেলেই রেজিগনেশন লেটার জমা পড়া দরকার।
আমি: ‘তা হলে যাই। সুরজিৎ, তুমিও চল।’ সুরজিৎ এমন ভাব দেখাল, যেন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। শঙ্খ আর প্রকাশও সঙ্গে সঙ্গে টিমে ঢুকে গেল। পল্লব করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু ওকে টিমে ঢোকানো সম্ভব ছিল না। কলকাতায় তখন আমাদের প্রচণ্ড কাজের চাপ। অলক চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করলেন, ‘পল্লব টিমের ‘লেফট আউট’!’
ট্রেন বর্ধমান ছাড়ার পর কথা উঠল, ‘নীলেশ সরকার কী কী বলতে পারেন। নীলেশ সরকারের ভূমিকায় একবার আমি, একবার সুরজিৎ। সব রকমের অ্যাঙ্গেল থেকেই আমরা নীলেশ সরকারকে, অর্থাৎ আমাদের নিজেদেরকেই বোঝাতে লাগলাম, পদত্যাগ না করার কোনও কারণ নেই। কাল্পনিক সংলাপে আমরা একবার এমন জায়গাতেও পৌঁছে গেলাম যেখানে এসে নীলেশ সরকার কিছুতেই পদত্যাগে রাজি হচ্ছেন না— বন্ধু নির্বাচকদের কথা ভেবে। প্রায় গীতার শ্রীকৃষ্ণর ভঙ্গিতে নিষ্কাম কর্মের ভাষণ পেশ করলাম।
হোটেলে যখন পৌঁছোলাম, রাত তখন প্রায় সাড়ে ন’টা। আসানসোলে নেমে খানিক হয়রানি হল, সে অন্য গল্প। হোটেলের দুটো ঘরে জিনিসপত্র রাখার আধঘণ্টার মধ্যেই দুটো চমক। পনেরো মিনিটের মাথায় আবিষ্কৃত হল, সুরজিৎ নিরুদ্দেশ! এবং তার পনেরো মিনিট পর আমাদের ঘরের এয়ারকন্ডিশনারের ঢাকনাটা ছিটকে এল তীরবেগে, একটুর জন্য বেঁচে গেলাম। ব্যাপারটা কী করে ঘটল, তা নিয়ে আলোচনা বাড়েনি, কারণ সুরজিৎ তখনও ফেরেনি। হোটেল থেকে বেরিয়ে শঙ্খ আর প্রকাশ একটু খোঁজাখুঁজি করল, যদি সিগারেটের দোকান কাছাকাছি না থাকে! হারিয়ে যাবে না নিশ্চয়— এ কথা ভেবে আমরা নিশ্চিন্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম। পৌনে এগারোটা নাগাদ ফিরে জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে সুরজিৎ বলল, ‘না, পাওয়া গেল না।’ কী? নীলেশদার বাড়ির ঠিকানা। ভাবলাম, তোমরা ফ্রেশ হয়ে নিতে নিতে খোঁজ নিয়ে আসি, যাতে কাল খুব সকালেই গিয়ে কথা বলা যায়। ব্যাঙ্কেরও দু-একজনকে পেয়ে গেলাম, কিন্তু কেউ বাড়ির ঠিকানা জানে না। শেষ পর্যন্ত স্টেট ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের বাড়িতে গিয়ে একজনের মুখে একটা আবছা ধারণা পেলাম, তাও পাকা কিছু নয়। কাল বোধহয় কপালে কষ্ট আছে।’
পরদিন সকালে বড় কাজ কিনা, আমরা রাতে বেশি আড্ডা মারিনি। তিনটের মধ্যেই শুয়ে পড়লাম। সবার আগে ঘুমিয়ে এবং সবার পরে বিছানা ছেড়ে প্রকাশ বেশ দ্রুতই তৈরি হয়ে নিল। অরণ্যদেব ব্র্যান্ডের সানগ্লাস লাগিয়ে জানাল, ‘আমি রেডি।’ আমরা জানালাম, সকালের এই অভিযানটিকে আমরা মোটেই হিন্দি সিনেমার মতো রোমহর্ষক বানাতে চাইছি না। সুতরাং, প্রকাশও হোটেলে থাকল। একটা অ্যাম্বাসাডর অনির্দিষ্টকালের জন্য ভাড়া করে সুরজিৎ আর আমি বেরিয়ে পড়লাম।
ম্যারাথন সার্চ। আবছা ধারণা বলতে, সুরজিৎ একটা হোটেলের নাম পেয়েছিল। হোটেলের মালিক জানালেন, এক বিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলার তথা বর্তমান ব্যাঙ্ক অফিসার তাঁর হোটেলে মাঝে মাঝে খেতে আসেন বটে, কিন্তু ভদ্রলোকের ঠিকানা জানা নেই। গাড়ি থেকে এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে যাকে পাচ্ছিলাম, তাকেই জিজ্ঞেস করছিলাম। অনেকেই সুরজিৎকে চিনে ফেললেন, এমনকি কেউ কিউ সুরজিতের সঙ্গীর নামও আন্দাজ করে ফেললেন, কিন্তু কেউই নীলেশ সরকারের ঠিকানা বলতে পারলেন না। দশটার পর ব্যাঙ্কে গেলে পাওয়া যাবে ঠিকই, কিন্তু আমরা তার আগেই কথাবার্তা সেরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতায় ফিরে রেজিগনেশন লেটার আই এফ এ অফিসে জমা দিতে চাইছিলাম।
অবস্থা এমন দাঁড়াল, স্টেট ব্যাঙ্কে চাকরি করেন— এরকম কারও খোঁজ পেলেই তার বাড়ির কড়া নাড়ছিলাম। এক ভদ্রমহিলা, স্টেট ব্যাঙ্কেরই চাকুরে, সুরজিৎকে চিনলেন এবং স্টেট ব্যাঙ্কের অফিসারদের একটা মেসের খোঁজ দিলেন। সেখানে গিয়ে ঘনিষ্ঠ দু-একজনকে পেয়ে গেল সুরজিৎ, কিন্তু নীলেশ সরকারকে নয়।
সতের না সাতাশ নম্বর ব্যক্তির মুখে মনে নেই, কেন না ততক্ষণে আমরা ক্লান্ত এবং হতাশ, শেষ পর্যন্ত এক ভদ্রলোকের বাড়িতে পৌঁছানো গেল যিনি নীলেশ সরকারের আস্তানা চেনেন। আলাপী ভদ্রলোকের ছেলে স্টেট ব্যাঙ্কেরই চাকুরে। তাঁরা সুরজিৎকে তো চেনেনই, কী আশ্চর্য, আমার নামও শুনেছেন। তখন কিছুই ভাল লাগছিল না। তবু চা-টা খেতে হল। রসিক ভদ্রলোক নীলেশ সরকারের ফ্ল্যাটের খোলা দরজার সামনে আমাদের এন বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতেই বললেন: ‘হিয়ার ইজ ইয়োর নীলেশ সরকার।’
নীলেশদা ততক্ষণে অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি। হাতে ব্রিফকেস, সন্ধ্যেয় ব্ল্যাক ডায়মন্ডে ওঠার ইচ্ছায় সঙ্গে সুটকেস। আমাদের দুজনকে দেখে নীলেশদা এতটাই বিস্মিত হলেন যে, অর্ভ্যথনার হাসি মুখে ফোটাতেও ভুলে গেলেন।
মিনিট পাঁচেক ‘বিটিং অ্যাবাউট দ্য বুশ’-এর পর আসল কথায় আসা গেল। নীলেশদা বললেন, ‘আমি তো আজ রাতে কলকাতায় যাচ্ছিলামই, তোমরা আবার কথা বলার জন্য এতদূর এলে কেন?’ ব্ল্যাক ডায়মন্ড কলকাতায় পৌঁছায় দশটা-সাড়ে দশটায়, তারপর দরকার হলে বলরামদার সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে মধ্যরাত হয়ে যাবে। তারপর বালিতে তাঁর বাড়ি ফেরা মুশকিল। সবচেয়ে বড় কথা, সেই দিনই তাঁর রেজিগনেশন লেটার আই এফ এ দপ্তরে জমা পড়লে ভাল হয়— নীলেশদাকে বোঝালাম। কথা বলা শুরু করে বুঝলাম, আশঙ্কা অনেকটাই সত্যি। নীলেশ সরকার আর পদত্যাগের মাঝখানে তখনও দাঁড়িয়ে আছেন অন্য নির্বাচকরা, তাঁর ফুটবলার বন্ধুরা। সুকুমার সমাজপতির অনুরোধ-উপরোধে তিনি আমাদের বিরুদ্ধে একটা বিবৃতিতে সই করে এসেছেন, তাও জানালেন। বললেন: ‘রেজিগনেশন দিতে এমনিতে আপত্তি নেই। আর কখনও সিলেক্টর হতেও চাই না। কিন্তু এখন সরে দাঁড়ালে, ওরা কী ভাববে?’ নীলেশদা বারবার বিশেষ করে প্রশান্ত সিংহ আর সুকুমার সমাজপতির নাম করছিলেন। বুঝলাম, আমরা আসানসোল না গেলে কিছুতেই তাঁর পদত্যাগপত্র জমা পড়ত না। তবে একটা সুবিধা ছিল, নীলেশদা স্বীকার করছিলেন, পদত্যাগ করা উচিত। প্রায় কুড়ি মিনিট পর নীলেশ সরকার বললেন, ‘বেশ, আমার আর আজ কলকাতায় ফেরার দরকার নেই। অফিসে চল, চিঠি টাইপ করিয়ে সই করে দিচ্ছি, তোমরা আজই জমা দেওয়ার ব্যবস্থা কর।’ তারপর হেসে ফেললেন, ‘তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে এফ ডব্লু এ-র সেক্রেটারি করার প্রপোজাল কে দিয়েছিল, বল তো?’ বললাম, ‘আমরা নিজেরাই।’
স্টেট ব্যাঙ্কের বিরাট আসানসোল ব্রাঞ্চের ম্যানেজারের ঘরে আমাদের বসিয়ে নীলেশ সরকার নিজের দপ্তরে গেলেন। বললেন, ‘চিঠিটা টাইপ করতে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।’
কিছুক্ষণ? ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মিঃ মুখার্জি আগে এন এস রোড ব্রাঞ্চে ছিলেন, চুনী গোস্বামীর সঙ্গে। দারুণ রসিক ও দক্ষ অফিসার। চা আর আড্ডায় সময়টা খারাপ কাটছিল না, কিন্তু আমাদের তো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতায় ফিরতে হবে। সুরজিৎকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নীলেশদা ট্রাঙ্ক-কলে সুকুমারদার সঙ্গে কথা বলছেন না তো?’ সুরজিৎ আশ্বস্ত করল, ‘না, না, এত সহজে ট্রাঙ্ক-কলের লাইন পাওয়া যায় না।’ শেষ পর্যন্ত নীলেশদা এলেন। নিজের দপ্তরে আটকে গিয়েছিলেন। চিঠিতে সই হল, আর এক কাপ চা খাওয়া হল, তারপর নীলেশদা নিচে নেমে আমাদের গাড়িতে তুলে দিলেন। গাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুজনই একসঙ্গে উচ্চারণ করলাম: ‘উফ!’
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ট্রেনে উঠে পড়া গেল। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়ে প্রকাশ রায় সোজা আই এফ এ অফিসে গেল। একটু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। পরদিন সকালে ওই চিঠি নিয়ে আই এফ এ অফিসে গেল এফ ডব্লু এ-র অন্য এক কর্মী। কিছুতেই জমা নেওয়া হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জমা নিতেই হল।
সেদিন সকালে আজকালে সকলেই নীলেশ সরকারের পদত্যাগপত্রের ফটোকপি দেখলেন। সুকুমার সমাজপতি তাঁর বন্ধু সম্পর্কে খুব খারাপ কথা বললেন। কলকাতার এক দৈনিকের ঝানু রিপোর্টার মন্তব্য করলেন, ‘এটা কোনও খবরই নয়।’
পি কে ব্যানার্জি ঠিকই বললেন, ‘তোমার পেশায় তো ওটাই আসল কথা, বাবা।’ বিদেশকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে পাঁচ নির্বাচকের বিরুদ্ধে আমার লেখা পড়ে চুনী গোস্বামী বলেছিলেন, ‘এইরকম লিখে আজকাল, খেলা আর অশোকের ইগো স্যাটিসফ্যাকশন ছাড়া আর কী হয়? নির্বাচকদের বিরুদ্ধে একটা জনমত তৈরি হয়েছে। গতবার অশোকের লেখার জন্য শিবাজিকে মোহনবাগান ডেকে নিয়েছে, আগের পাওনা মিটিয়েও দিয়েছে। কিন্তু আসল ব্যাপার তো সেই জেদ, সেই ‘ইগো’?’ চুনী গোস্বামীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বেশ ভাল। কিন্তু, তিনি আমার বা আমাদের লড়াইয়ের ব্যাপারটা কোনওদিনই বুঝবেন না। চুনী গোস্বামী শুধু বিরাট ফুটবলারই ছিলেন না, তাঁর ব্যক্তিত্বও দেখার মতো। কিন্তু, স্রোতের বিরুদ্ধে তাঁকে কখনই সাঁতার কাটতে হয়নি। তিনি আমাদের বুঝবেন না।
এ নির্বাচকদের বিরুদ্ধে অমন আক্রমণাত্মক লেখা (এই পাঁচজনকে আপনারা চিনে রাখুন) লিখেছিলাম, তাঁদের মধ্যে অন্তত তিনজনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠতাই ছিল। ওঁদের বিরুদ্ধে লেখার আগে আমাকে কি কম দ্বিধার স্তর পেরিয়ে আসতে হয়েছে? কিন্তু, তখন আর ফেরার উপায় ছিল না। যেভাবে জনমত এবং ফুটবলারদের দাবিকে উপেক্ষা করে আই এফ এ সম্পাদক অশোক মিত্রকে তুষ্ট করা হল, যথাসাধ্য আক্রমণ না করলে, যুদ্ধটাই ফাঁকি বলে মনে হয়।
লেখাটায় ঝুঁকি ছিল। ফুটবলার এবং ফুটবল-অনুরাগীরা ব্যাপারটা কীভাবে নেবেন? সুরজিতের লেখাটাও তো কম আক্রমণাত্মক ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেখা প্রকাশিত হলে, সেদিনই কিছু মতামত পাওয়া যায়। ২৪ ফেব্রুয়ারি আজকালে প্রকাশিত লেখাটার কী প্রতিক্রিয়া হল, তা জানার সুযোগ কমই ছিল। সেদিন অফিস আইনি, সারাদিন কারও সঙ্গে টেলিফোনেও কথা হয়নি। ২৪ ফেব্রুয়ারি, রবিবার সকালেই আমরা চলে গিয়েছিলাম তারকেশ্বর, মোহনবাগান ও ভারতের প্রাক্তন মিডফিল্ডার শ্যামসুন্দর মান্নার নিমন্ত্রণে। তারকেশ্বরে একটা ফাইনাল ছিল, এফ ডব্লু এ-কে বেশ কিছু টাকাও দেওয়া হল, কিন্তু প্রায় সারাটা দিনই কেটে গেল শ্যাম মান্নার বাড়িতে আতিথেয়তার দাপটের মধ্যে। একটা গাড়িতে গিয়েছিলেম আমি, সুরজিৎ আর চিন্ময়, চুনী গোস্বামী আর প্রদীপ চৌধুরি অন্য দুটি গাড়িতে। গাড়িতে বসেই আমার আর সুরজিতের লেখা পড়ে চিন্ময় যে মন্তব্য করেছিল, তা শুধু ওর পক্ষেই করা সম্ভব: ‘আরও কড়া লেখা উচিত ছিল!’
তারকেশ্বরে পৌঁছোনোর অল্প পরেই মন্দিরে যাওয়ার ডাক এল। সস্ত্রীক চুনী গোস্বামী, সস্ত্রীক চিন্ময়, সস্ত্রীক প্রদীপ চৌধুরি —টিমটা নেহাত ছোট হল না। আমার মন্দির-টন্দির যাওয়ার প্রশ্ন নেই, ছোট্ট ঘরে জিকোকে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স করানোই শ্রেয় মনে করলাম। কিছুক্ষণ পরেই এক স্কুলশিক্ষক এলেন। একেবারে নতুন খাতায় অটোগ্রাফ নিয়ে বললেন, ‘আপনার লেখা বরাবরই মন দিয়ে পড়ি, কিন্তু আজকের লেখাটা সবচেয়ে ভাল। খুব দরকার ছিল।’ ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই শ্যাম মান্নার পরিচিত দু-তিনটি ছেলে এসে গেল। ওরাও বলল, লেখা দুটো খুব ভাল হয়েছে। কলকাতার খবর না পেলেও, তারকেশ্বরে বসেই কিছু অনুকূল প্রতিক্রিয়া পেয়ে ভাল লাগল। সুরজিৎ ফিরলেই বলতে হবে। কিন্তু সুরজিৎই খবর আনল: মন্দিরের এক পুরোহিত বলেন, ‘সুরজিৎবাবু, আপনার সঙ্গে অশোকবাবু নেই কেন? ওনারও তো আসার কথা ছিল। আজ আপনারা যা লিখেছেন না, তুলনা নেই। আপনাদের কলমের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।’
পথেও নাকি অনেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ফেরার পথে ভয়ঙ্কর জ্যাম। সাদা মারুতি থেকে নেমে প্রদীপ চৌধুরি এবং আমাদের গাড়ির চিন্ময় চ্যাটার্জি রাস্তা পরিষ্কার করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। অনেক রাতে কলকাতায় ঢুকে মনে হল, নির্বাচকরা কী ভাবছেন? আজকাল অফিসের লাইন অনেক চেষ্টা করেও পাওয়া গেল না। দুজন নির্বাচকের টেলিফোন নম্বর জানা ছিল। সুকুমার সমাজপতির চেয়ে রবীন গুহই ভাল, এরকম টেলিফোনের জন্য। নান্টা গুহ ফোন ধরলেন। আমাদের এক সঙ্গীর সঙ্গে তাঁর এইরকম কথাবার্তা হল:
— সরি, হয়ত ঘুম ভাঙালাম।
— না, না, কিন্তু আপনি কে বলছেন?
— আমি, অ্যাঁ, হরিপদ সমাদ্দার (বানিয়ে বলা হল), আপনার একজন ফ্যান। এলাহাবাদে বাড়ি, এখন ইউ বি আই-এর বড়বাজার ব্রাঞ্চে আছি। কথায় সামান্য অবাঙালি টান শুনে নিশ্চয় বুঝেছেন, প্রবাসী বাঙালি, দু জেনারেশন আগে থেকেই এলাহাবাদে, তবে ফুটবল খেলা দেখতে কলকাতায় আসতাম। তখন থেকেই আপনার ফ্যান। আহা, কী গোলকিপিং করতেন আপনি।
বাংলায় সূক্ষ্ম একটা হিন্দি টান লাগিয়ে চমৎকার বলে যাচ্ছিল আমাদের গুণী সঙ্গী। মানসচক্ষে আমরাও যেন কল্পিত ফ্যানটিকে দেখতে পাচ্ছিলাম। রবীন গুহ বললেন:
— ‘আমার ফ্যান, বাঃ! কিন্তু টেলিফোন নম্বর কী করে পেলেন?’
— ‘ফ্যানেরা কী পারে না, বলুন তো? যাক, যেজন্য ফোন করছি। আজ আজকাল কাগজে সুরজিৎ সেনগুপ্ত আর, আর একটা কে যেন, হুঁ, অশোক দাশগুপ্তর লেখা পড়লাম। আপনার ফ্যান কিনা, আমার খুব কষ্ট হল। কিছু করবেন তো?’
— ‘আমরা আগে থেকেই স্টেটমেন্ট করে রেখেছিলাম। ভাবছি, এবার একটা প্রেস কনফারেন্স করব।’
— ‘করুন, তাড়াতাড়ি করুন। আচ্ছা, এই অশোক দাশগুপ্ত লোকটা কে? আমি আবার বাংলা কাগজ কমই পড়ি, আজ চোখে পড়ে গেল।’
— ‘ও একটু লেখে। আমরা একটা অ্যাসোসিয়েশন করেছি, তার সেক্রেটারি। মনে করে, লিখে সব ঠিক করে দেবে।’
— ‘অ। গুড নাইট!’
প্রেস কনফারেন্সের খবরটা পেয়ে সুবিধেই হল। সেইমতো একটা লেখা করা গেল। অন্য কিছু প্রস্তুতিও নেওয়া হল। নির্বাচকরা ওই ‘প্রেস কনফারেন্স’ আর ডাকলেনই না!
ওই সময়েই গৌতম সরকারের বোনের বিয়েতে সুধীর কর্মকারের সঙ্গে দেখা। সুধীর যা বলেছিল, কোনওদিনই ভুলব না: ‘লিখে যতটা করা যায় ততটা আপনারা করে দিয়েছেন। কিন্তু এবার ডাইরেক্ট কিছু অ্যাকশন নেওয়ার সময় আসছে।’ সুধীর আরও বলেছিল, ‘শুধু একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছি, সিনহাদাকে সব সময় উচিত কথা বলতে শুনেছি, উনি কেন এমন অন্যায়ের সঙ্গে থাকলেন!’
আমিও কম অবাক হইনি। সুকুমার সমাজপতি আর প্রশান্ত সিংহর সঙ্গে যখন ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, তখনও ক্রীড়া-সাংবাদিকতার পেশায় আসিনি। ব্যস্ত ব্যাঙ্ক অফিসার সুকুমার সমাজপতি সারা দিনের ক্লান্তিকে সরিয়ে রেখে অন্তরঙ্গ ফুটবল আলোচনায় মগ্ন হয়েছেন। বেশ কয়েকবার মতান্তর ঘটেছে, একবার তাঁর লেখা পাইনি বা নিইনি শুধুমাত্র টাকার অঙ্কে একমত না হওয়ায়, তবু সম্পর্ক কখনও খারাপ হয়নি। বিদেশ প্রসঙ্গে ঢোকার আগে ভাবিনি, সুকুমারদার বিরুদ্ধে একদিন লিখতে হবে। আমি কী করে ভুলি সওদাগরি অফিসের কাজ ছেড়ে যেদিন ক্রীড়া-সাংবাদিকতার পেশায় এসেছিলাম, সেদিন, সেই প্রথম দিনেই অফিসে এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে গিয়েছিলেন সুকুমার সমাজপতি? কেন তিনি অশোক মিত্রর ফাঁদে ধরা দিলেন, কেনই বা এমন একগুঁয়ে মনোভাব দেখালেন, তা আমার জানা নেই। শুধু এটুকু জানি, সুকুমারদার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে। কী আর করা যাবে। (পরে, এখন, আবার আগের মতো, দারুণ ভাল!)
প্রশান্ত সিংহকে এখনও শ্রদ্ধা করি। এত কিছুর পরেও। তিনিও, যতদূর জানি, আমার বা আমাদের নামে তেমন কোনও কটূক্তি করেননি। কিন্তু, এফ ডব্লু এ-র সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। বলেছেন, ‘আমাদের তো বয়কট করা হয়েছে! জানি না, এ কথা বলার জন্য কখনও সিনহাদার সঙ্গে দেখা হবে কিনা যে, সম্পর্ক ছিন্ন হতে পারে অশোক দাশগুপ্ত, খেলা এবং আজকালের সঙ্গে, এফ ডব্লু এ কী দোষ করল? ফুটবর্লাস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনে অশোক দাশগুপ্ত না থাকলে তেমন কিছু এসে যায় না, কিন্তু প্রশান্ত সিংহর মতো ফুটবলার থাকবেন না— এটা ভাবা যায়? ‘আজকাল’ আর ‘খেলা’র সঙ্গে এফ ডব্লু এ-কে মিশিয়ে ফেলা নিশ্চয় ঠিক নয়। হ্যাঁ, কাজটা আমরা শুরু করেছি। কিন্তু এই সংগঠনের সংবিধানের কোথাও আজকাল বা খেলার নাম রাখা হয়নি। নতুন লেটারহেডে আজকাল বা খেলার নাম উল্লেখ করা হয়নি। আজকাল বা খেলার কয়েকজন এই সংগঠনে আছে, এই পর্যন্ত। আমি চিরকাল এফ ডব্লু এ-র সেক্রেটারি থাকব না। (ছেড়েছি, বছর দেড়েক পরই) কিন্তু ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে প্রশান্ত সিংহর নাম থাকবে। তিনি কেন এফ ডব্লু এ থেকে দূরে সরে থাকবেন?
ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক সনৎ শেঠ তখন এফ ডব্লু এ-র সুভেনির সাব-কমিটির চেয়ারম্যান (সুকুমার সমাজপতি চেয়ারম্যান ছিলেন ফিনান্স সাব-কমিটির)। তিনি বলেন, ‘আমি লাইফ মেম্বারের চাঁদাটা দিতে পারি, কিন্তু এফ ডব্লু এ-র মেম্বার থাকব না। ওরা আমাদের বয়কট করেছে!’ এফ ডব্লু এ বয়কট করেছে? কিন্তু, সুকুমার সমাজপতি আর প্রশান্ত সিংহর মতো ঠান্ডা মাথার মানুষই যখন গোটা ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেললেন, সনৎ শেঠের কাছে ভাল কিছু আশা করে কী লাভ? একদিন তো আমাদের অরূপ বসুকে নিজের অফিসে পেয়ে গিয়ে বিশ্রী গালিগালাজ করে বসলেন। অরূপ খুব শান্তভাবে একটা কথা বলেছিল। সনৎ শেঠ তখন টেবিলে মাথা ঠুকে বলেন, ‘সরি, কিছু মনে করবেন না।’
আর রবীন গুহ। সল্টলেক স্টেডিয়ামে প্রি-ওয়ার্ল্ড কাপের খেলা চলার সময় আমাদের তিমিরের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। পরদিন বাংলাদেশ দলের সম্মানে এফ ডব্লু এ-র চা-চক্র। তিমির বলে, ‘কাল আসছেন তো?’ নান্টা গুহ এক নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায় জানান যে, তাঁরও মানসম্মান আছে, সুতরাং চা-চক্রে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না! উনি এক মহান দায়িত্ব পালন করলেন। সব সময় কিছুদিন আজকাল, খেলা এবং এফ ডব্লু এ-র নামে উদ্ভট খিস্তিখেউড় করে ভেটারেন্স ক্লাব টেন্টের পবিত্রতা নষ্ট করছেন। ভদ্রলোক অকৃতজ্ঞ। এতদিন পর একটি কুকর্মের সুবাদে তিনি আবার পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এলেন, এ ব্যাপারে আমরা তাঁকে এতখানি সাহায্য করলাম, ‘তবু…’ না, ময়দানের অভিধানে সত্যিই ‘কৃতজ্ঞতা’ বলে কোনও শব্দ নেই।
অমল দত্তের মতে যিনি ভারতের সর্বকালের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ফরোয়ার্ড সেই পদ্মোত্তম বেঙ্কটেশের সঙ্গে আমার একবারই দেখা হয়েছিল, ছিয়াত্তরের প্রথম দিকে, ইস্টবেঙ্গল টেন্টে। তখনও সাংবাদিকতায় আসিনি। লেখালেখির জন্য নয়, এক দিকপাল ফুটবলারকে হঠাৎই কাছে পেয়ে যাওয়ার আনন্দে কথা বলছিলাম। অন্য অনেক বিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলারদের মতো, তিনি কিন্তু এখনকার ফুটবলারদের অপদার্থ বলছিলেন না। চমকে দেওয়ার মতো একটা কথা সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘সুরজিৎ আমার চেয়ে বড় ফুটবলার।’ বাড়িয়ে বলেছিলেন, সন্দেহ নেই। বেঙ্কটেশ বা গাভাসকাররাই পারেন অনায়াসে নিজের চেয়ে অন্যদের বড় বলতে। ওঁরা জানেন, এ জন্য একটুও ছোট হয়ে যাবেন না। ডাঃ কল্যাণ মুখার্জি যখন নিশ্চিন্তে সুরজিৎ সম্পর্কে বলেন, ‘দি গ্রেটেস্ট উইঙ্গার ইন্ডিয়া হ্যাজ এভার প্রাোডিউসড’— সেটাও নিশ্চয় প্রচণ্ড বাড়াবাড়ি। রমন, পি কে ব্যানার্জি, বেঙ্কটেশ, সালে— এই সব দুর্ধর্ষ উইঙ্গারকে পেয়েছে ভারতীয় ফুটবল। সুতরাং…। তবু, সুরজিৎ নিশ্চয় এই প্রজন্মের অনেকের প্রিয়তম ফুটবলার, সুরজিৎ সম্ভবত সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ফুটবলার। ফুটবলার সুরজিৎকে আপনারা চেনেন জানেন, ওর সম্পর্কে কিছু লেখার অভ্যেস আমি বহু আগেই ত্যাগ করেছি। একাশি সাল থেকেই মনে হতে থাকে, সুরজিতের কোনওরকম প্রশংসা আমার করা উচিত নয়। সুরজিতের প্রসংসা মানে নিজের প্রশংসা— যা কোনও ভদ্রলোক করে না। তারপর যা দাঁড়িয়েছে, আমার সামনে কেউ সুরজিতের প্রশংসা করলে লজ্জা পাই, নিজের প্রশংসা শুনলে যেভাবে সবাই লজ্জিত হয়। থামিয়ে দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতে চাই।
তবু, সুরজিৎকে নিয়ে এই ডায়েরিতে কিছু লিখতেই হচ্ছে। —এফ ডব্লু এ-র সুরজিৎ। গত কয়েক বছরে অন্তত তিনশো পঁয়ষট্টি জন বলেছেন, ‘আপনিই (অথবা তুমিই) এফ ডব্লু এ তৈরি…। আপনি (বা তুমি) না থাকলে…’ ইত্যাদি। এ কথা সত্যি, আমি এবং আমার সহকর্মীরা (বিশেষত পল্লব) উদ্যোগ না নিলে এফ ডব্লু এ-র কথা ভাবা যেত না— অন্তত চুরাশিতে নয়। কিন্তু, এফ ডব্লু এ-র কাজে হাতই দিতাম না, যদি সুরজিৎ না থাকত। অনেকের ধারণা, এফ ডব্লু এ-র মূল সংগঠনটা আমি একাই গড়েছি। সংগঠন গড়ে ওঠার ইতিহাস সম্পর্কে কারও ভুল ধারণা থাকা উচিত নয়। এটা লিপিবদ্ধ থাকুক, এফ ডব্লু এ গড়ে এবং বেড়ে ওঠায় যার অবদান সবেচেয়ে বেশি, তার নাম সুরজিৎ সেনগুপ্ত। এই যে একটা কর্মমুখর, দুর্দান্ত সময় পেরিয়ে এল এফ ডব্লু এ তাতে কোনও কাজেই একবারও বোধহয় আমি কারও কাছে যাইনি। একেবারে মূল সাংগঠনিক ব্যাপারটা ছাড়া সব কিছুই গড়ে উঠেছে সুরজিতের চেষ্টায়, পল্লবের উদ্যমে এবং আরও কয়েকজনের আন্তরিক সহযোগিতায়। আমার একটা সুবিধে ছিল। সাত-আট বছর ক্রীড়া সাংবাদিকতায় থাকার সুবাদে প্রাক্তন ও বর্তমান ফুটবলারদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। আমরা না ডাকলে সব প্রজন্মের ফুটবলাররা এত তাড়াতাড়ি সাড়া হয়ত দিতেন না। আমরা যে ফুটবলারদের ভালর কথা ভাবি, এটা নিয়েও কারও বিশেষ সংশয় ছিল না। অর্থাৎ, আমি স্বাভাবিকভাবেই ‘অ্যাকসেপটেবল’ ছিলাম। সুরজিতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। এখনকার ফুটবলারদের মধ্যে অধিকাংশই সুরজিৎকে পছন্দ করে। কিন্তু দু-একজন ঘোর অপছন্দও তো করে! প্রাক্তন ফুটবলারদের মধ্যেও অনেকের ধারণাই নেই, সুরজিৎ কত ভাল সংগঠক। সুরজিৎ শুরুতেই সবার কাছে ‘অ্যাকসেপটেবল’ ছিল না। কিন্তু পরে এক-আধজন ঈর্ষাকাতর অর্ধোন্মাদ ছাড়া সকলেই মেনেছেন, সুরজিৎকে ছাড়া এফ ডব্লু এ-র কথা ভাবা যায় না। রাইটার্সের মন্ত্রী আর আমলারা, লালবাজারের পুলিস কর্তারা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ঝানু সব একজিকিউটিভ— সকলেই সহযোগিতার হাত একটু বেশি বাড়িয়ে দেন, সুরজিৎ হাজির হলে। ভেবে অবাক হই, এই ছেলেটাকেই কেন মাঠে ফাঁকিবাজ হিসাবে একদা দুর্নাম পেতে হয়েছে। কাকে বলে ‘ওয়ার্কলোড’ নেওয়া, এফ ডব্লু এ-তে সুরজিৎ তা দেখিয়ে দিয়েছে। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফিরেছে মধ্যরাতে, আরও রোগা হয়ে গেছে, অনুভব করেছি— ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে। তবু, একবারও বলেনি, ‘আর পারছি না।’ যতই ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হই না কেন, বয়সে তো সুরজিৎ আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোটই। মমতায় মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছা হয়েছে, ‘সুরজিৎ, এত পরিশ্রম করার দরকার নেই।’ বলা হয়নি। তাহলে সংগঠনটাই দাঁড়াত না।
‘ওয়াক র্যালি’ সংগঠিত করতে ছুটে গেছে দার্জিলিং আর শিলিগুড়ি, অসুস্থতার কথা মনে রাখেনি। বাঁশবেড়িয়ায় ‘ওয়াক র্যালি’ থেকে ফেরার সময় ট্রাফিক জ্যামে আটক সুরজিৎ করুণ হাসি মুখে টিকিট ছিঁড়ে ফেলেছে, নাইট শোতে সস্ত্রীক সিনেমা দেখার কথা ছিল। বাইরে কোথায় গিয়েছিলাম ঠিক মনে পড়ছে না, একদিন ফিরে আসার পর আমার বাড়ি থেকে ওর স্কুটার নিয়ে বাড়ি ফিরল রাত দুটোয়। রাত দুটোয়, কলকাতার এক মেরু থেকে অন্য মেরুতে— একা।
প্রবীণদের মধ্যে তিনজন এফ ডব্লু এ-র কাজে সব সময় থেকেছেন। সভাপতি শৈলেন মান্না এবং দুই সহ-সভাপতি— পি কে ব্যানার্জি আর তুলসীদাস বলরাম। সুভাষ ভৌমিক, শান্ত মিত্র, প্রসূন ব্যানার্জি, মঙ্গল পুরকায়স্থ, দীপু দাস, অশোক চ্যাটার্জি, মইদুল ইসলাম, নিমাই গোস্বামী, শ্যাম থাপা আর প্রশান্ত ব্যানার্জির কাছ থেকেও সব সময় কাজ পাওয়া গেছে। নানা কাজে এগিয়ে এসেছেন অনেকে। কিন্তু আমাদের সবার চেষ্টাতেও কিছু হত কিনা সন্দেহ, যদি সংগঠনের সব কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে সুরজিতের উদ্যোগ না থাকত।
মান্নাদা যে শুধু নানা অনুষ্ঠানে হাজির থেকে এফ ডব্লু এ-র হয়ে অর্থসংগ্রহ করেছেন তা-ই নয়, সব দিক দিয়েই থেকেছেন আদর্শ সভাপতির ভূমিকায়। পরামর্শ দিয়েছেন, প্রয়োজনীয় উৎসাহ দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, এফ ডব্লু এ-র ক্ষেত্রে ভুলে গেছেন, তিনি মোহনবাগান ক্লাবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা।
কেউ কেউ প্রথম দিকে রটানোর চেষ্টা করেছিলেন, স্রেফ পাবলিসিটির জন্য পি কে ব্যানার্জি এফ ডব্লু এ-র সব কাজে এগিয়ে আসছেন। স্রেফ পাবলিসিটির জন্যই সকলে মিলে যদি এফ ডব্লু এ-র কাজে এগিয়ে আসতেন! আমি বিশ্বাস করি, পি কে পাবলিসিটির পেছনে ছোটেন না, পাবলিসিটিই পি কে-র পেছনে ছোটে। সেই কানাইয়ানকে এয়ারপোর্টে বরণ করার মুহূর্ত থেকেই, কতবার যে পি কে অনুপ্রাণিত করেছেন। অনেক তথাকথিত ‘ভাল লোক’-এর চেয়ে পি কে আমার কাছে অনেক বেশি শ্রদ্ধেয়, একটা ভাল কাজে তিনি আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছেন। কলকাতার এক বিখ্যাত দৈনিকের রিপোর্টার বলেছিলেন, ‘প্রদীপদা, আজকাল আর অশোক দাশগুপ্তর এই কান্ডকারখানায় দয়া করে থাকবেন না।’ প্রদীপদা মুখে জবাব দিয়েছিলেন শতকরা পঁচিশ ভাগ, বাকি পঁচাত্তর ভাগ কাজে।
আর, তুলসীদাস বলরাম। একেবারেই সৃষ্টিছাড়া মানুষ। তাঁর যা যা করা উচিত, কিছুই করেন না। তাঁর হাবভাব নিশ্চয় দিকপাল ফুটবলারের মতো হওয়ার কথা, কিন্তু মোটেই তা নয়। তাঁর আমাদের নির্দেশ দেওয়া উচিত, উল্টে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী করতে হবে আমাকে?’ এমনিতে ‘পাবলিক লাইফ’ থেকে দূরে থাকাই তাঁর পছন্দ। সেই তুলসীদাস বলরামই এক বছরে গেছেন অন্তত সত্তরটি অনুষ্ঠানে, শুধুমাত্র একটি ভাল কাজের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে। একটা মেয়েদের স্কুলের স্পোর্টসে প্রাইজ দিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলরামদাকে। সব হয়ে যাচ্ছে, প্রাইজ দেওয়ার সময়ও ঘনিয়ে এল, বলরামদা দেখলেন— এফ ডব্লু এ-কে টাকা দেওয়ার নামগন্ধ নেই। খুব ভদ্রভাবে হেড মিস্ট্রেসকে বললেন, এফ ডব্লু এ-কে অর্থসাহায্য না করলে কী করে পুরস্কার বিতরণ করা সম্ভব! হেড মিস্ট্রেসকে তখনই উদ্যোগ নিয়ে ব্যবস্থা করতে হল। এমনিতে কোনও অনুষ্ঠানে সভাপতি বা প্রধান অতিথি হতে বলরামদা রাজি নন। তাঁর সোজা কথা, ‘কারও জন্য কোথাও নয়, এফ ডব্লু এ-র জন্য সব জায়গায়।’
খেলার জগতের কাছাকাছি এসে আমি এমন কিছু আহ্লাদিত হইনি। না এলে খুব বেশি ক্ষতি ছিল না। একটা ক্ষতি নিশ্চয় হত, তুলসীদাস বলরামকে জানা হত না। দু-তিনটে ছোট্ট ঘটনা আপনাদের শোনাই।
বলরামদার পাড়ায় কানাইয়ানের স্মৃতিতে ফুটবল টুর্নামেন্ট। সারাদিন তিনি ব্যস্ত। এফ ডব্লু এ-কে মোট সতেরশো টাকা দেওয়া হল। বলরামদার সেদিনই সন্ধের সময় যাদবপুরে একটা অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা। নির্দিষ্ট সময়ে উদ্যোক্তারা কেউ আসেননি। বলরামদা ঘড়ি দেখছিলেন। বাড়ি ফেরার আগে সুরজিৎ বলল, ‘আপনি আজ টায়ার্ড, বোধহয় বেঁচে গেলেন।’ বলরামদা ঈষৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘বেঁচে গেলাম মানে? এফ ডব্লু এ-কে ওদের দুশো টাকা দেওয়ার কথা!
প্রথম দিকে এফ ডব্লু এ-র সব মিটিংই ক্যালকাটা স্টেট ট্রান্সপোর্ট টেন্টে হত। পরে একটা বড় মিটিং কবাডি ফেডারেশন টেন্টে হয়, কয়েকটি মিটিং বি এন আর টেন্টেও। বি এন আর টেন্টে প্রথম মিটিং শেষ হওয়ার পর বলরামদা টেবিলক্লথ ভাঁজ করে রাখছিলেন। কী ব্যাপার? টেবিলের এক কোণায় কাচ সামান্য ভাঙা, এফ ডব্লু মিটিং বলে কথা, বলরামদা বাড়ি থেকে টেবিলক্লথ এনেছেন। সেদিনই বলেছিলাম, ‘বি এন আর টেন্টে চা পাওয়া যায় না, ছি ছি!’ কয়েক দিন পর আবার বি এন আর টেন্টে গেছি, উল্টোদিকের মাঠে উয়াড়ি-গ্রিয়ার ঐতিহাসিক ম্যাচ দেখে। লনে বসে অরুণ ঘোষ আর অবনী বসুর সঙ্গে কথা বলছিলাম, দেখা হওয়ার পরই বলরামদা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মিনিট পনেরো পর উঠতে চাইতেই অরুণদা বললেন, ‘আরে, কোথায় যাচ্ছ? বলরাম তোমার জন্য চা করতে গেছে!’ টেন্টের দিকে তাকিয়ে দেখি, মালীর হাতে ট্রে, নিজের হাতে চা বানিয়ে সহাস্যে হেঁটে আসছেন, এফ ডব্লু এ-র কর্মী অসীম ভট্টাচার্যর ভাষায় ‘এফ ডব্লু এ-র ফুসফুস’ ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে কমপ্লিট ফুটবলার তুলসীদাস বলরাম!
‘শ্রদ্ধেয় মান্নাদা, শুনলাম বাবলু এফ ডব্লু এ-র কাজকর্মের খুব সমালোচনা করছে। এমনিতেই আমি এফ ডব্লু এ-র জয়েন্ট সেক্রেটারি আর থাকতে চাই না। বাবলু কি দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত? একটু কথা বলে দেখবেন। বাবলুর যদি সুরজিতের সঙ্গে চলতে অসুবিধা হয়, সুরজিৎও ছাড়ার জন্য তৈরি। এফ ডব্লু এ-র কনস্টিটিউশনে একজন জেনারেল সেক্রেটারির প্রভিশনও রয়েছে। প্রণাম নেবেন। আপনার— অশোক।’
লেখা, ফাইল, অফিস ছেড়ে ময়দানে যাওয়া হয় না বললেই চলে, কলকাতার টেলিফোন ব্যবস্থাও তখন অতি চমৎকার, সুতরাং মাঠের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ সহকর্মীদের মাধ্যমে। আজ পর্যন্ত একজন ফুটবলারও (প্রাক্তন বা বর্তমান) আমার সামনে আমাদের নিন্দা বা সমালোচনা করেননি। মাঝেমাঝে তো দেখা হয়েই যায়। কিন্তু তখন শুধু ভাল কথাই শুনি। কিন্তু আমাদের ছেলেদের মুখে মাঝেমাঝে অন্যরকম খবর পাই। আগে ভাবতাম, সংশ্লিষ্ট ফুটবলারের সঙ্গে দেখা হলে কথা বলব। কিন্তু মাঝে প্রচুর সময় চলে যেত, ভুল যেতাম। পরে এ ধরনের ক্ষেত্রে চিঠি চালু করলাম। তাতে সঙ্গে সঙ্গে একটা জবাব পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, হাতে হাতেই। কারণ সব ক্ষেত্রেই পত্রবাহক কোনও সহকর্মী।
মান্নাদাকে চিঠিটা লিখেছিলাম বেশ ক্ষুব্ধ হয়েই। সুব্রত ভট্টাচার্য এফ ডব্লু এ-র নামে খারাপ কথা বলছে মোহনবাগান টেন্টে বসেই— এ খবর প্রথম দিয়েছিল মোহনবাগানের তিনজন ফুটবলার। তারপর আরও কিছু সূত্র থেকে খবর আসে। মান্নাদা নিজে এফ ডব্লু এ-র প্রেসিডেন্ট, তিনি কিছু বলছেন না কেন— এই অভিমানটাও প্রচ্ছন্ন ছিল। মান্নাদা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তিনি মোহনবাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল সেক্রেটারি। ফুটবলার হিসাবে সুব্রত তাঁর প্রিয়, তাঁর ক্লাবের কাছে অপরিহার্য। কিন্তু এফ ডব্লু এ-র ব্যাপারে তাঁর কাছে সুব্রতর বক্তব্যের কোনও গুরুত্ব নেই। সুব্রতর কথায় আমারও— মান্নাদার মতে— ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত নয়। সংগঠন করতে গেলে কত লোক কত কিছু বলে। মান্নাদাকেই কি মোহনবাগান ক্লাবে কম কথা শুনতে হয়েছে? সুতরাং, ব্যাপারটা ভুলে যাওয়াই ভাল।
মান্নাদার বক্তব্য খুব পরিষ্কার। কিন্তু আমি শৈলেন মান্নার নখের যুগ্যি নই, এত সহজভাবে কী করে গোটা ব্যাপারটা নেব? এফ ডব্লু এ-র প্রথম প্রস্তুতি সভায় মাত্র দুজন বর্তমান ফুটবলারকে ডাকা হয়েছিল। একজনের নাম সুব্রত ভট্টাচার্য। বাবলুকে তারপর কালচারাল সাব-কমিটির কনভেনর করা হয়। একজিকিউটিভ কমিটির মেম্বার হিসাবে ও এফ ডব্লু এ-র সব কাজে প্রথম সারিতে থাকবে— এটা তো আশাই করা হয়েছিল। বাস্তবে কিন্তু তা ঘটেনি। ওর সাব-কমিটির একটি মাত্র সভা হয়েছে, তাও নোটিস লিখে শুধু সই করার জন্য এয়ারপোর্ট হোটেলে ওর কাছে পল্লবকে পাঠিয়েছিলাম। এই সাব-কমিটি একটি কাজও করেনি। একজিকিউটিভ কমিটির সভাতেও ও এসেছে কদাচিৎ। একদিন তো একটু কথা কাটাকাটিই হয়ে গেল। আমরা যে পাঁচজন প্রাক্তন দুঃস্থ ফুটবলারকে তিরিশ হাজার টাকা দিয়েছি, তাঁদের মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে মিটিংয়ে খুব তর্ক হয়েছিল। এফ ডব্লু এ-র সংবিধানের নির্দেশ, এ-সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তদন্ত করে প্রস্তাব পেশ করবে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং সাব-কমিটি এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে একজিকিউটিভ কমিটি। এই বিশেষ ক্ষেত্রে প্রচণ্ড বিরোধিতা করল সুভাষ ভৌমিক। সুরজিৎ আর আমি ওকে সমর্থন করলাম। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অরুণ ঘোষের এক বিশেষ আবেদনে আমরা সকলেই সাড়া দিলাম, একমত হয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম। বাবলু এই মিটিংয়ে আসেনি। এর পর কবাডি ফেডারেশন টেন্টে এক জরুরি সাধারণ সভায় আলোচ্য বেনিফিট ম্যাচ প্রসঙ্গ ওঠে। বাবলু হাজির থাকলেও আলোচনায় অংশ নেয়নি। কিন্তু, পরের একজিকিউটিভ কমিটির মিটিংয়ে বসেই ও বলে, ‘…কে টাকা দেওয়া উচিত হয়নি। আমি মানতে পারছি না।’ আমি: ‘দ্যাখ বাবলু, এ নিয়ে এখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। একজন প্রাক্তন ফুটবলারকে আমরা শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছি, এ নিয়ে বিতর্ক বাড়ানো কি উচিত? হ্যাঁ, এখন তাঁকে টাকা দেওয়া ঠিক হয়নি— এ কথা মনে হতে পারে। ভৌমিক, সুরজিৎ আর আমি তাই আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু অন্য কয়েকজনের ইচ্ছায় আর অরুণদার আবেদনে সাড়া না দিয়ে পারিনি। তুমি মিটিংয়ে এলে, বক্তব্য পেশ করতে পারতে। এখন এটা নিয়ে অন্যরকম কিছু বলার অধিকার আমাদের মানে একজিকিউটিভ কমিটির মেম্বারদের আর নেই।’ সুব্রত এই যুক্তি মানতে নারাজ। সামান্য কথা কাটাকাটি।
১৩ সেপ্টেম্বর কানাইয়ান বেনিফিট ম্যাচে সুব্রত খেলল না। প্রসূনও খেলেনি, সামান্য জ্বর থাকায়। ওরা দু’জন একসঙ্গে বসে খেলা দেখল। পরে একদিন প্রসূনকে বললাম, জ্বর নিয়েও কিছুক্ষণ খেলা উচিত ছিল। প্রসূন অস্বীকার করেনি। এবং পরে দুটো ম্যাচে খেলেছে, নিজে উদ্যোগও নিয়েছে। কিন্তু বাবলুকে কিছু বলিনি। পরে, অনেক পরে বাবলু একদিন বলল, ‘সেদিন চোট নিয়েও হয়ত খেলতে পারতাম। খেলিনি কেন জান? এখনকার ছেলেদের টিমে খেলার ঝুঁকি নিতে চাইনি। আমি তো জানিই, গৌতম-শ্যাম-ভৌমিক-সুরজিৎ-হাবিব-ইন্দাররা ওদের নাস্তানাবুদ করবে। মাঠে নেমে আর অস্বস্তির মধ্যে পড়তে চাইনি। সিনিয়র টিমে রাখলে হয়ত খেলতাম।’
তার পর, দুর্গাপুর আর আসানসোলের বেনিফিট ম্যাচেও ওকে পাওয়া গেল না। কাজ ছিল? সপ্তাহের একটি মাত্র ছুটির দিনে কার কাজ থাকে না? তার পর পঁচাশির ২৩ মে মোহনবাগান মাঠে পরব-ল্যাংচা মিত্র বেনিফিট ম্যাচ। খেলা শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে মোহনবাগান টেন্টে ঢুকে সুব্রত জানাল, ‘আমি খেলব না।’ আমি খেলার জন্য অনুরোধ করলাম। তখন অন্য দিকের কাজে এত ব্যস্ত যে একজনের খেলা না খেলা নিয়ে মাথা ঘামানোর উপায় ছিল না। তবু বললাম। তার পর বলল সুভাষ ভৌমিক আর গৌতম সরকার। না, বাবলু খেলবেই না। এক পরিচিত মোহনবাগান সদস্য জিজ্ঞেস করল, ‘অশোকদা, বাবলুদা খেলছে না কেন?’ আমি ঠান্ডা গলায় জবাব দিলাম, ‘সেটা তোমাদের বাবলুদাকেই জিজ্ঞেস কর।’
টিম মাঠে নামার মিনিট দশেক আগে হঠাৎ বাবলু বলল, ‘আমি খেলব, কিন্তু একটা শর্তে। পুরো সময় খেলব। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলা, উঠে আসতে পারব না।’ আমি জানালাম, ঠিক আছে। সুব্রত খেলল— এই প্রথম, এফ ডব্লু এ-র কোনও খেলায়।
এটা অবশ্য এখানে পরিষ্কারভাবেই লিখে রাখা কর্তব্য যে, এখনও পর্যন্ত বাবলু ব্যক্তিগতভাবে আমার বিরুদ্ধে কোথাও কিছু বলেছে বলে জানা নেই। কিন্তু, এফ ডব্লু এ-র বিরুদ্ধে বললে, আমার বিরুদ্ধে বলা বাকি থাকে কি?
আজকাল আর খেলার বিরুদ্ধে সুব্রতর বক্তব্য তো আরও বিস্ময়কর। আমরা নাকি এখন শুধুই ওকে খোঁচা দিই। আজকাল নাকি নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করে না। আমাদের রিপোর্টারের সঙ্গে সুব্রত বেশ খারাপ ব্যবহারই করে ফেলল একদিন। কে যেন মনে করিয়ে দিল, ‘তোমার হয়েই তো ‘আজকাল’ সবচেয়ে বেশি লিখেছে।’ সুব্রতর জবাব, ‘তাতে আমার ক্ষতিই হয়েছে।’ এক সকালে ধীমানের সঙ্গে এসব নিয়ে প্রচণ্ড তর্ক হল সুব্রতর, মোহনবাগান টেন্টে। ধীমানের সঙ্গে বাবলুর সম্পর্ক খুবই ভাল। কিন্তু সেদিন ধীমান কিছু বলতে বাকি রাখেনি। একবার এটাও বলে: ‘বাবলুদা, আমি তোমার টিমের জুনিয়র প্লেয়ার নই যে, ধমকে গুটিয়ে যাব!’ পরে অবশ্য দুজনই কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু এই দিনের কথাবার্তার বিবরণ আমি ভুলতে পারিনি। সেদিন টেন্ট থেকে বেরিয়ে মোহনবাগানের এক সিনিয়র ফুটবলার বলেছিল, ‘ধীমান আজ তুমি যেভাবে বললে, গত দশ বছরে ওকে কেউ সেভাবে বলতে পারেনি। আমাদের কারও সাহস নেই। কনগ্র্যাচুলেশনস!’
সুব্রত-ধীমান উত্তপ্ত কথাবার্তার শুরুতেই মান্নাদা টেন্ট থেকে অন্তর্হিত হয়েছিলেন, ওঁর পক্ষে কারও দিকে থাকা সম্ভব ছিল না। একবার পাশ থেকে অন্য এক ফুটবলার নাকি বলেছিল, ‘লোকে বলে, ‘আজকাল’ আর ‘খেলা’কে নাকি আমরাই মাথায় তুলেছি।’ ধীমানের তাৎক্ষণিক জবাব: ‘তাই নাকি? আমাদের তো লোকে বলে যে, ‘আজকাল’ আর ‘খেলা’ই তোমাদের মাথায় তুলেছে!’
সঞ্জীব ভট্টাচার্য প্রসঙ্গে পৌঁছে সুব্রত আমাদের আর একবার বিস্মিত করল। বলল, ‘আমি চিঠিতে সই করব না। অন্য ক্লাবের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাব না।’ অমল দত্ত সই করলেন, প্রথম সইটাই শৈলেন মান্নার, মোহনবাগানের আঠারোজন ফুটবলার সই করল, কিন্তু সুব্রত কিছুতেই নয়। এই সময়টায় অদ্ভুত দু-একটা কথা বলল। যেমন, ‘সঞ্জীব কেমন ছেলে তা কি তোমরা জান?’ ‘সঞ্জীবের জন্য হচ্ছে, সবার জন্য হবে না। মুখ চিনে লড়া হয়!’ এই শেষের কথাটার অবশ্য তীব্র প্রতিবাদ করেছিল কৃষ্ণেন্দু রায়: ‘আমাদের যখন একটা অর্গানাইজেশন হয়েছে, সবার বিরুদ্ধেই লড়া হবে। এ-সব বাজে কথা বলার কোনও মানে হয় না।’
আগেও একবার বাবলুর সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছিল। মোহনবাগানের কয়েকজন প্রাক্তন ও বর্তমান ফুটবলারের মুখে শুনেছিলাম, বাবলু আমাদের বিরুদ্ধে আড়ালে অনেক কথা বলছে। বাবলু কিন্তু আজকাল অফিসে এসে পরিষ্কার জানিয়ে গিয়েছিল, ‘এ-সব হল অপপ্রচার— তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ করে দেওয়ার একটা চক্রান্ত।’ কয়েকদিন পরেই খবর পেলাম, অন্য একটা কাগজের অফিসে বসে সুব্রত আমাদের সমালোচনা করেছে। দুঃখ পেলাম, বলা বাহুল্য।
কিন্তু এবার আর দুঃখ-টুঃখ ছিল না। সুব্রত সম্পর্কে এতটাই বিরক্ত হয়ে পড়ি যে, ওর ব্যাপারে ভালমন্দ কিছুই ভাবার ইচ্ছা চলে যায়। আমাদের সঙ্গে সুব্রতর সম্পর্ক যে এখন আর ভাল নয় — এটা ময়দানে অনেকেই জেনে গেলেন। ফেডারেশন কাপ চলার সময় খেলায় যখন সুব্রতর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হল, অনেকেই অবাক হলেন। মোহনবাগানেরই এক জনপ্রিয় প্রাক্তন ফুটবলার জানতে চাইলেন, ‘ব্যাপারটা কী?’ ব্যাপারটা খুবই সহজ। সুব্রত এই বয়সেও খুব ভাল খেলছিল এবং দীর্ঘ সাক্ষাৎকার সিরিজে আসার যোগ্যতা ওর ছিল। আমরা ফুটবলার সুব্রতকে অস্বীকার করতে পারি না, বড় জোর মানুষ সুব্রতর হালচালে মর্মাহত হতে পারি।
হঠাৎ, পঁচাশির সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে একদিনে সন্ধের পর অফিসে ঢুকে সরোজ জানাল, ‘খবর আছে।’ সেদিন সকালেই মোহনবাগান টেন্টে সুব্রত ওকে এই কথাগুলো বলেছে: ‘আমি বুঝতে পারছি না, তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এত খারাপ হয়ে গেল কেন। কী ঘটল? অশোকের সঙ্গে আমার এমন সুন্দর সম্পর্ক কেন নষ্ট হয়ে যাবে? খেলার পুজো সংখ্যা বেরোচ্ছে, অথচ আমার নাম নেই? চিরকাল তোমাদের সঙ্গে আছি, এবার কী হল? অশোককে গিয়ে বলবে, আমি খেলার পুজো সংখ্যায় লিখতে চাই।’
ছোট্ট লেটারহেডে চিঠি লিখে সরোজের হাতে দিলাম। জানতে চাইলাম, আমাদের বিরুদ্ধে ওর রাগের কারণ কী? এতদিন অসহযোগিতা করারই বা কী কারণ? বাবলু সরোজকে স্পষ্টভাবে জানাল, আজকাল বা খেলার বিরুদ্ধে ওর কোনও অভিযোগই নেই। ধীমান হয়ত ওর কথা বুঝতে ভুল করেছে। তাছাড়া পরে তো সব মিটমাট হয়েই গেল। আজকাল ওর ক্ষতি করেছে— এমন কথা ও বলেনি, বলতে পারে না। এবং আগের বারের মতোই বলল, ‘এটা অশোকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ করার একটা চক্রান্ত।’
ধীমান, অরুণ আর রতনের মুখে শুনেছি, বাবলুর দিক থেকে অপ্রত্যাশিত মন্তব্য এবং আচরণ সত্যিই পাওয়া গেছে। একদিন, আনন্দবাজারের গৌতম ভট্টাচার্য এবং যুগান্তরের জয়ন্ত চক্রবর্তীর সামনেই সুব্রত এমন কিছু মন্তব্য করেছিল— যা অন্যায়, অপ্রত্যাশিত। সবটাই ভুল বোঝা, এটা বোধহয় ঠিক নয়। তবু, আপাতত, আর বিতর্ক বাড়াবার প্রয়োজন নেই। গত চার বছরের মধ্যে অন্তত দুবার মোহনবাগান ক্লাব সুব্রতকে বিদায় দেওয়ার কথা ভেবেছে। পিছিয়ে যাওয়া হয়েছে, শুধুমাত্র আমাদের কথা ভেবে। বিশ্বাস করুন, কথাটা শতকরা একশো ভাগ সত্যি। ধীরেন দে জানতে চেয়েছিলেন, ফুটবলারদের মধ্যে কে কে আমার বন্ধু। ‘সুরজিৎ, সুভাষ ভৌমিক, প্রদীপ চৌধুরি, শ্যাম থাপা, প্রসূন, সুব্রত….।’ ‘সুব্রত কেন?’ —এই ছিল ধীরেন দে-র প্রতিক্রিয়া। কথাবার্তায় বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে, সুযোগ পেলেই তিনি সুব্রতকে বিদায় দিতেন। চুরাশিতেই দলবদলের ঠিক আগে মোহনবাগানের ফুটবল সাব কমিটির এক সদস্য আমাকে টেলিফোনে জিজ্ঞেস করেন, ‘সুব্রতকে যদি আমরা না রাখি, কথা দেওয়া কি সম্ভব যে খেলা বা আজকাল কিছু লেখালেখি করবে না?’ না। কথা দিতে পারিনি।
অনেক ফুটবলার এবং ক্রীড়ানুরাগীই একাধিকবার জানতে চেয়েছেন, সুব্রতর বিরুদ্ধে একটা দীর্ঘ আক্রমণাত্মক লেখা লিখছি না কেন? মাঝেমাঝে যে লেখার জন্য প্রলুব্ধ হইনি, তা নয়। কিন্তু, কয়েকটা কথা তো কিছুতেই ভুলতে পারি না। আটাত্তরে, সেই খেলার পত্রিকা করার প্রথম দিকে, সুভাষ ভৌমিক আর মহম্মদ হাবিবের নেতৃত্বে মোহনবাগান টেন্টে যখন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ, তখন এই সুব্রতই (প্রসূন আর শ্যামও) প্রচণ্ড সাহায্য করেছিল। কী করে ভুলি কোয়েম্বাটোরের সেই দিনগুলো, দিনের খেলার ক্লান্তি কাটিয়ে গভীর রাতে সুব্রত যখন বলে গেছে ওর জীবনের গভীরতর আনন্দ-বেদনার কথা, গান গেয়ে পার করে দিয়েছে মধ্যরাত? মাঝে এমনও হয়েছে, সুব্রতর ওপর আমি ক্ষুব্ধ— এটা জেনে অনেকেই ওর বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। না। ‘সুব্রত ভট্টাচার্য সমীপেষু’ নামে কোনও লেখা আমি কোনও দিনই লিখতে চাইনি।
সুধীর কর্মকার ওর বিবৃতি বা চিঠিটা ফেরত চাইল। তাই আমাকেও একটা চিঠি লিখে পাঠাতে হল। ব্যাপারটা এইরকম: বেশ কিছুদিন আগে থেকে আজকাল আর খেলার বিশেষজ্ঞ লেখক হিসাবে সুধীর আমাদের সঙ্গে রয়েছে। বরাবর দেখেছি এবং শুনেছি, সুধীর বাড়িতে থাকতেই ভালবাসে, নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চায় না। আমাদের অরুণ সেনগুপ্ত যখন এসে জানাল যে, সুধীর কর্মকারকে চিফ কোচ করে ওরা রিষড়ায় একটা ট্রেনিং ক্যাম্প করতে চায়, অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু শুনলাম, সুধীর শুধু রাজি নয়, নিজেই দারুণভাবে উদ্যোগী। রিষড়া রবীন্দ্র ভবনে যেদিন মিটিং হল, সুধীরের সক্রিয় ভূমিকা দেখে সুরজিৎ অবাক। সুরজিৎ বক্তৃতায় জানাতে ভুলল না, ‘এখানকার ছেলেরা ভাগ্যবান, সুধীর কর্মকারের কাছে ফুটবল শেখার সুযোগ পাচ্ছে।’ ক্যাম্প শুরু হয়ে গেল, আনন্দমেলার বিজ্ঞাপনের ভাষায়— ‘হইহই করে’। কিন্তু কিছুদিন পরই সুধীরকে কেউ বোঝাল, এফ ডব্লু এ-র কেন্দ্রীয় সংগঠন কোনও সাহায্য করছে না, শুধু শুধু ও কেন খেটে মরছে? পাশাপাশি আর একটা ঘটনা ঘটল। ‘মাঠের ডায়েরী’ নামে একটি পত্রিকা বেরোল এবং তার প্রথম সংখ্যায় সুধীরের নামে একটা লেখা। অরুণ আমার বক্তব্য সুধীরকে জানাল। সুধীর সঙ্গে সঙ্গে লিখে দিল: ‘মাঠের ডায়েরী পত্রিকায় আমি কোনও লেখাই দিইনি। আমার নামে যে লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। খেলা আর আজকালের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ লেখক হিসাবে আমি চুক্তিবদ্ধ।’ চিঠিটা সুধীর খেলায় ছেপে দিতেও বলল। ছাপলাম না। খেলার পত্রিকা চালানোর কাজ যখন শুরু করেছিলাম, তখন আমার ঘনিষ্ঠতম সহকারী ছিল বিপ্লব। এখনও আমার মনে ওর জন্য একটা নরম জায়গা আছে। ও যখন নতুন পত্রিকা করেছে, তাতে যতই আমাদের কুৎসা রটনা হোক, কোনও ক্ষতি করতে চাইনি।
এই সময় প্রায় একই সঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটল। ২৩ মে পরব-ল্যাংচা মিত্র বেনিফিট ম্যাচ খেলতে সুধীর এল না। খবর পাঠাল— অসুস্থ। অথচ রিষড়ারই এক ফুটবলার বলল, এফ ডব্লু এ-র ওপর অভিমানেই ও আসেনি। আর, ওই চিঠি ফেরত চাওয়া। সুধীর বলেছিল, ‘অন্য কাগজে কেন লিখব না?’ এফ ডব্লু এ ক্যাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে, এমন একটা আভাসও দিয়েছিল।
দীর্ঘ চিঠিতে বক্তব্য রেখেছিলাম। এক: তুমি অন্য কোনও পত্রিকায় লিখতেই পার, আপত্তি করার অধিকার আমাদের নেই। যেহেতু এখনও তোমাকে আমরা নিজেদের লোক মনে করি, অন্য পত্রিকায় তোমার নামে লেখা দেখে দুঃখিত হয়েছি। এখন যদি তুমি তোমার চিঠি ফেরত চাও, নিশ্চয় পাঠিয়ে দেব। এই চিঠিটা ব্যবহার করে কারও ক্ষতি করতে চাইলে, এতদিন বসে থাকতাম না। তুমি ছাপতে বললেও, আমরা ছাপিনি। দুই: আজকাল এবং খেলার বিশেষজ্ঞ লেখক হিসাবে তুমি না থাকতেই পার, কিন্তু এফ ডব্লু এ ক্যাম্প ছাড়ার নৈতিক অধিকার তোমার নেই। প্রথমত ক্যাম্পের কী কী দরকার, তার একটা লিস্ট চেয়েছিলাম, এখনও পাইনি। অসহযোগিতার প্রশ্নই ওঠে না। তার চেয়েও বড় কথা, তুমি এফ ডব্লু এ ছাড়বে কেন? অশোক দাশগুপ্ত আজ এফ ডব্লু এ-র সেক্রেটারি, কাল থাকবে না। কিন্তু সুধীর কর্মকার— ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে একজনেরই নাম। এফ ডব্লু এ তোমার সংগঠন, আমার নয়। যদি তোমাদের ক্যাম্পের ওপর ঠিকমতো নজর রাখতে না পেরে থাকি, জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসাবে সেটা আমার ব্যর্থতা। সেজন্য তুমি অভিযোগ আনতেই পার। কিন্তু নিজের সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পার না।’
খুবই সুখের কথা, সম্পর্ক ছিন্ন তো হয়ইনি, আরও দৃঢ় হয়েছে। সুধীর এই চিঠি আমাদের রেখে দিতে বলেছে, শুধুমাত্র আমাদের লেখক হিসাবে থেকে যেতে চেয়েছে— এবং ট্রেনিং ক্যাম্পেও নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করেছে। মাস খানেক পর অরুণ একদিন সেই লিস্ট নিয়ে এল, এফ ডব্লু এ-র পক্ষ থেকে সুধীরের হাতে তুলে দেওয়া হল প্রচুর ফুটবল এবং ট্রেনিংয়ের নানা সরঞ্জাম।
মোহনবাগান টেন্টে সুব্রত ছাড়াও আর একজন একটু একটু অন্যরকম কথা বলছে, এই খবরটা এমন কিছু অস্বাভাবিক ছিল না। চমক ছিল নামটায়— বিদেশ বসু। বিদেশকে লেখা চিঠিটা এইরকম ছিল: ‘বিদেশ, এ কথা শুনে আমি মর্মাহত যে, আমাদের বিরুদ্ধে কিছু কথা তোমার মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে। কী তোমার অভিযোগ? সরোজকে জানিও। আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুল সামান্য পুড়ে গেছে, লিখতে অসুবিধা হচ্ছে। সরোজের মুখে আমার বক্তব্য শুনবে। এবং তোমার বক্তব্য জানাবে, আশা করি।’
বিদেশ আকাশ থেকে পড়ে সরোজকে বলে: ‘এ খবরটা অশোকদাকে কে দিয়েছে? নিশ্চয় ভুল বুঝেছে। আমি কখনও খেলা বা আজকালের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি? কোথাও বলিনি। বাবলুদাকে আমি কখনই সমর্থন করিনি। সামনাসামনি প্রতিবাদ করে অপ্রীতিকর কিছু ঘটাতে চাইনি, এই পর্যন্ত। অশোকদাকে আমি চিঠি দেব। সত্যি, আমার খুব খারাপ লাগছে।’
এফ ডব্লু এ-র প্রথম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে একসঙ্গে এল শ্যামল ব্যানার্জি আর বিদেশ। বিদেশ বলল, ‘কথা আছে অশোকদা।’ —’আজ থাক’। বিদেশ: ‘না, আজই। আপনি আমার সম্পর্কে এরকম ভুল বুঝলেন? বাবলুদা সেদিন অনেক কথাই বলছিল। প্রতিবাদ করিনি, করে লাভ নেই। কিন্তু আমি কখনই ওকে সাপোর্ট করিনি। করতে পারি না।’
ফুটবলারদের প্রসঙ্গ উঠলে মনোরঞ্জন সম্পর্কে একটা শব্দই উচ্চারণ করি— গোল্ড। নানা দিক দিয়ে এই ছেলেটিকে আমি পছন্দ করে ফেলেছি। তাই, দেবাশিস যখন কথাগুলো বলল, খুব দুঃখ পেলাম। এবার একটা লিগ ম্যাচে মনোরঞ্জন মাথা গরম করে অশোভন ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। পরদিন কলকাতার সব কাগজে ওর তীব্র সমালোচনা করা হয়। আজকালেও ঘটনাটির উল্লেখ ছিল। কিন্তু পাশাপাশি মনোরঞ্জনের দিকটাও ভাবার কথা বলা হয়। এমনিতে খারাপ আচরণ করার ছেলে মনোরঞ্জন নয়। কিন্তু সব কাগজে এমনভাবে লেখা হল, যেন ওর মতো অপরাধ আর কেউ করে না। দিন তিনেক পর সকালে ইস্টবেঙ্গল টেন্টে অ্যাসাইনমেন্ট ছিল দেবাশিসের। বিকেলে আমি অফিসে ঢুকতেই ও বলে, ‘মনোরঞ্জন খুব চটে গেছে। বলেছে, ‘আমি আর তোমাদের কাগজে লিখব না, তোমরা সবাই সমান।’ তার চেয়েও ভয়ঙ্কর বক্তব্য: ‘আসলে আমরা টাকা রোজগার করছি, সেটা তোমাদের সহা হচ্ছে না, তোমরা জ্বলছ। তাই যে যা খুশি লিখে যাচ্ছ।’
কথাগুলো যেন চাবুকের মতো আঘাত করল। সব কাজ ফেলে, মনোরঞ্জনকে লম্বা চিঠি লিখতে বসলাম। আমার মূল বক্তব্য ছিল: ‘আমাদের কাগজে তুমি না লিখলে, কিছু বলার নেই। এটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু, সবার সঙ্গে আমাদের মিলিয়ে দিলে! আর, এটা তুমি কী বললে মনোরঞ্জন, ফুটবলাররা টাকা রোজগার করায় আমরা জ্বলছি, আমাদের সহ্য হচ্ছে না? সাত-আট বছর ক্রীড়া-সাংবাদিকতার পর এমন কথা আমাকে শুনতে হল? আমি লিখে খাই, তাই দীর্ঘ ব্যক্তিগত চিঠি লিখে সময় নষ্ট করি না কখনও। এত বড় চিঠি লিখলাম, তোমাকে ভালবাসি বলে। আশা করি, তুমি আমাকে বুঝবে।’
চিঠিটা সত্যিই দীর্ঘ ছিল। এখানে শুধু মূল বক্তব্যটা তুলে ধরলাম। চিঠি নিয়ে গেল সরোজ। মনোরঞ্জন বলল, ‘আজ রাতে বাড়ি গিয়ে ভাল করে পড়ব, তুমি কাল এস।’ কী বলল মনোরঞ্জন? বেশি কিছু বলেনি, এই চিঠিটা দিয়েছিল : প্রিয় অশোকদা, আশা করি ভাল আছেন। সরোজের হাতে আপনার চিঠি আজ সকালে পেলাম। খুব দুঃখ পেলাম এটা জেনে যে, আপনিও আমাকে ভুল বুঝলেন। দেবাশিসের সঙ্গে আমি সব সময় ঠাট্টাইয়ার্কি করি। এ কথাগুলোও আমি ঠাট্টা করেই বলেছিলাম। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে এমনিতে সেদিন আমার মেজাজ ভাল ছিল না। হয়ত সে জন্যই ঠাট্টাটা ও আলাদাভাবে নিতে পারেনি। আমাকে আপনার এত কিছু লেখার দরকার ছিল না। পরদিন দেবাশিস আমার কাছে এলেই সব মিটে যেত। আপনাদের টিমের সবার সঙ্গেই আমার খুব ভাল রিলেশন, সবার সঙ্গেই সব সময় ইয়ার্কি করি। এই তো কিছুদিন আগে পল্লব যখন আমার কাছে ইন্টারভিউ নিতে এসেছিল, ওর সঙ্গে তো কত আজেবাজে কথা বললাম। দেবাশিস বা আপনি যদি সেদিনের ঘটনায় দুঃখ পেয়ে থাকেন, তা হলে আপনাদের সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এবং কথা দিচ্ছি, আর কোনওদিন এই ধরনের ইয়ার্কি করব না। দয়া করে আপনারা আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি জানি, আপনারা সব সময় খেলোয়াড়দের পাশে আছেন এবং থাকবেন। সুতরাং, আপনাদের সঙ্গে কেন আমি খারাপ ব্যবহার করতে যাব? আপনিও আমাকে খুব ভাল করে জানেন, আমি খুব কম কথা বলি, কোনওদিন কাউকে কোনও বাজে কথা বলি না। আর আপনাদের তো বলার প্রশ্নই আসে না।
মনার চিঠির শেষ লাইনটা পড়ে ওর প্রতি ভালবাসা অনেক বেড়ে গেল। প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা, সেই লাইনটা এখনও উদ্ধৃত করিনি। ও এইভাবে শেষ করেছিল, ‘অশোকদা, সব শেষে আপনাকে আমি একটা কথা দিয়ে চিঠি শেষ করছি। মাঠে আমার কাছ থেকে আর কোনওদিন এই ধরনের আচরণ পাবেন না।’
এত সহজে এমন ভাল একটা কথা কলকাতার আর কোনও নামকরা ফুটবলারই বলতে বা লিখতে পারত না। আমার চিঠির জবাবে এই লাইনটা লেখার কোনও প্রয়োজনও ছিল না। তবু, এই লাইনটাই সোনা। এ জন্যই আমার কাছে মনোরঞ্জন— ‘গোল্ড’।
‘কলকাতা ময়দানে যদি কখনও গড়াপেটা বন্ধ হয়, তা হলে ‘আজকাল’-এর কাছে ক্রীড়ামোদীদের কৃতজ্ঞ থাকতে হবে।’ তিরাশিতে এ কথা বলেছিলেন ভেটারেন্স ক্লাবের প্রাণপুরুষ, শ্রদ্ধেয় প্রাক্তন ফুটবলার পরিতোষ চক্রবর্তীও। আই এফ এ নিয়োজিত উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি ও অজয় বসু দুর্দান্ত রিপোর্টও পেশ করেছিলেন, খবরের কাগজ এবং অনেকের বক্তব্যের ভিত্তিতে। আই এফ এ আইন পাল্টায়। মূলত এই আইনের বাঁধনে এবং অংশত সমালোচনার ভয়ে চুরাশি থেকে গড়াপেটা অনেকটা কমে যায়। চুরাশিতে আমরা সতর্ক ছিলাম। তবে, সমালোচনার ভয়ে বা চক্ষুলজ্জায় পিছিয়ে যায়নি পুলিস। পুলিস বলে কথা। একাধিক গড়াপেটা ম্যাচ খেলে এবং প্রয়োজনে লোক ঠেঙিয়ে পুলিস প্রথম ডিভিশনে উঠে যায়। গড়াপেটার স্মৃতি জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব নিল দ্বিতীয় ডিভিশনের কিছু ক্লাব। আই এফ এ-র নবাগত সচিব প্রদ্যুৎকুমার দত্ত কথা দিলেন, সামনের মরসুমের আগেই চারটে দলের ওঠানামার নিয়ম নিচের ডিভিশনেও চালু করা হবে। গড়াপেটার রাস্তা আরও বন্ধ হবে। আমরা ভাবলাম, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, দেখা যাক।
আমাদের বিরামহীন লেখালেখি এক-এক জনকে এক-এক ভাবে প্রভাবিত করেছে। অশোক মিত্রর মতো কিছু লোক শুধুই চটেছেন, ফুঁসেছেন। শ্যাম গাঙ্গুলি ও প্রভাত বসুর মতো কয়েকজন অকুণ্ঠ সমর্থন আর অভিনন্দন জানিয়েছেন। রাম গাঙ্গুলির মতো কিছু লোক গড়াপেটার বিরহে কাতর থাকতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু কেউ কেউ বোধহয় নিজেদের পথ সানন্দেই পাল্টেছেন। অনেক কষ্টে, নিরলস পরিশ্রমে প্রথম ডিভিশনে পৌঁছেছিল ভ্রাতৃ সঙ্ঘ। আগে ভ্রাতৃ সঙ্ঘ ‘আন্ডারহাইট টুর্নামেন্ট’ খেলত। তখন টিমের সেরা ফুটবলার— পরবর্তীকালে সহকারী জাতীয় কোচ প্রবীর মজুমদার। কলকাতায় ভ্রাতৃ সঙ্ঘ নামে একাধিক ক্লাব থাকায় আন্ডারহাইট সার্কিটে এই ক্লাবকে বলা হত ‘প্রবীর ভ্রাতৃ’। প্রবীরদা বয়সে আমার চেয়ে বড়, তাঁর উচ্চতা যখন চার ফুট দশ ইঞ্চি, তখন থেকেই ভ্রাতৃ সঙ্ঘর খেলা দেখছি। প্রবীরদারা বড় হয়ে যাওয়ার পর ভ্রাতৃ সঙ্ঘও বড় হতে লাগল। রবীন্দ্র সরোবরের পাশে মাঝে মাঝে ভ্রাতৃ সঙ্ঘর প্র্যাকটিস দেখতে যেতাম। রোজ এক দৃশ্য: মাঠের ভেতরে সমর বিশ্বাস, মাঠের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি ওরফে গগনদা। এই দুজনের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ফুটবলারদের আন্তরিকতায় ভ্রাতৃ সঙ্ঘ শেষ পর্যন্ত প্রথম ডিভিশনে উঠে আসে। জুনিয়র ডিভিশনে থাকার সময় ভ্রাতৃর খেলায় ছিল আধুনিক ফুটবলের স্পষ্ট ছাপ, যা আমাদের গর্বিত করত। কত কিছু পাল্টে যায়! তিরাশিতে যে চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জিক তীব্র সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত করার চেষ্টা করতে হল, বছর ষোলো-সতেরো আগে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে পেরেই খুশি হয়েছিলাম। রবীন্দ্র সরোবর অঞ্চলে সেদিনও এক মনে ট্রেনিং দেখছিলেন চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি। কাছে গিয়ে বলেছিলাম, ‘আপনাদের টিমের খেলা দেখতে খুব ভাল লাগে, তাই আলাপ করতে এলাম।’ সেদিন তাঁকে ‘গগনদা’ বলেই সম্বোধন করেছিলাম। কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো ছেলেটির মুখ চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু, সেই আলাপের কথা, তখনকার গগনদা এবং ভ্রাতৃ সঙ্ঘর কথা আমি ভুলিনি। চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির সেই ভ্রাতৃ সঙ্ঘই যখন ময়দানের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে গড়াপেটা ম্যাচ খেলতে শুরু করল, বিশ্বাসের ভিতটাই নড়ে গেল। ময়দানে কি মাথা উঁচু করে সৎ পথে থাকা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়? চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির ময়দানী অধঃপতন কল্পনার বাইরে ছিল। তাই, তিরাশির গড়াপেটা-বিরোধী লেখালেখির ঝড়ে অশোক মিত্রর পরেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। পরের বছর আনন্দের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করলাম, গড়াপেটার নিশ্চিত প্রলোভন তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। ছোট ঘটনা। তবু অনেকখানি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার পক্ষে যথেষ্ট।
কিন্তু, পঁচাশির ফুটবল মরসুম শুধু বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার নয়, বিশ্বাস ভঙ্গেরও। এবারও ব্যাপক গড়াপেটা হল— সেই দ্বিতীয় ডিভিশনেই। এবং এজন্য যিনি সবচেয়ে বেশি দায়ী, তাঁকে বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করতে কোনও দ্বিধা নেই। দ্বিতীয় ডিভিশন লিগ এগোচ্ছিল গড়াপেটা ছাড়াই। কিন্তু মিলন সমিতির নামার আশঙ্কা দেখা দিতেই গড়াপেটা এল— একেবারে মাঠ কাঁপিয়ে। একের পর এক নিরঙ্কুশ গড়াপেটা ম্যাচ খেলে মিলন সমিতি শুধু রেলিগেশন থেকেই বাঁচল না, আর একটু হলে রানার্স আপ হয়ে যাচ্ছিল। মিলন সমিতি এই কাজটা সহজে করতে পারল, কারণ এই ক্লাবের প্রধান কর্মকর্তা বিকাশ রায়চৌধুরি আই এফ এ-র অন্যতম সহসচিব। অশোক মিত্র বা রাম গাঙ্গুলির মতো লোকের কাছে আমরা কিছু আশা করি না। বিকাশ রায়চৌধুরি এমন নির্লজ্জ পথে যেতে পারেন, কখনও ভাবিনি। সত্যি, কতটুকুই বা চিনেছি এই ময়দানকে। কর্মকর্তাদের মধ্যে যে কয়েকজনকে মোটামুটি ভাল বলা যায়, বিকু রায়চৌধুরিকে তাঁদের মধ্যে একজন হিসাবেই বিবেচনা করে এসেছি। তিনি প্রদ্যুৎ দত্তর ঘনিষ্ঠ, এই তথ্যটাও তাঁকে গড়াপেটা-বিরোধী হিসাবে পরিচিত করেছে। নিজের টিম বিপদে পড়তেই তিনি সব নীতি বিসর্জন দিলেন। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা গভীর, তাই আক্রমণও তীব্র। আজকালে মিলন সমিতির প্রত্যেকটি গড়াপেটা ম্যাচের রিপোর্টে লেখা হল ‘বিকাশ রায়চৌধুরির মিলন সমিতি’। এবং শেষ পর্যন্ত, ‘হিং টিং ছট’-এ ময়দানে তাঁর মূর্তি স্থাপনের প্রস্তাব।
দ্বিতীয় ডিভিশনে গড়াপেটার মহান পতাকা অবশ্য শুধু বিকাশ রায়চৌধুরীর মিলন সমিতিই বহন করেনি, চ্যাম্পিয়ন উয়াড়ি এবার গড়াপেটাতেও চ্যাম্পিয়ন। উয়াড়ির কথা বলার আগে সুবার্বানের কথা একটু বলে নিই। ঠিক সুবার্বান ক্লাবের কথা নয়, ওদের ডি ফ্যাক্টো কোচ মনা ঘোষের কথা (আই এফ এ-র খাতায় কোচ হিসেবে নাকি অন্য কারও নাম!)। এক বছর ইস্টবেঙ্গলে থাকলেও জর্জ টেলিগ্রাফের ফুটবলার হিসাবেই তিনি ময়দানে বেশি পরিচিত ছিলেন। একদা কলকাতার তিন বড় দলের সব বড় ফরোয়ার্ড এই মনা ঘোষকে ভয় পেতেন। এবং এ জন্য মনা ঘোষকে মোটেই ভাল ডিফেন্ডার হতে হয়নি। তিনি সেই বিরল ও বীর গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, যাঁরা বিশ্বাস করেন— মারের কোনও বিকল্প নেই। খেলা ছেড়ে দিয়েছেন, এখন আর তিনি মাঠে নেমে কাউকে মারতে পারেন না, তাই অল্পবয়সী ফুটবলারদের মারেন— নৈতিকভাবে। সুবার্বানের একটা ম্যাচে তিনি কচি ফুটবলারদের গড়াপেটার পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিলেন মাঠের ধারে চেয়ারে বসে, বাংলা ধারাভাষ্যের ভাষায় ‘একেবারে সেন্টারলাইন বরাবর’। বেশ মেধাবী ও অনুগত ছাত্র সব। কারও কোনও ভুল হল না। নিখুঁত গড়াপেটা খেলে ম্যাচ হারল সুবার্বান। ছোট্ট করে ব্যাপারটা রিপোর্ট করল নির্মল, আজকালে। দিন কয়েক পরে একই মাঠে নির্মলকে পেয়ে গেলেন বীর মনা ঘোষ। গ্রামের যাত্রানুষ্ঠানের অত্যুৎসাহী ও সদ্য সুযোগ-পাওয়া-ভীমও এত আস্ফালন করেন না। বললেন, ‘আজকাল আবার কাগজ নাকি, ওটা তো একটা…।’ নির্মল জিজ্ঞেস করল, ‘কাগজটা যখন নয়, এত রেগে যাচ্ছেন কেন?’ মনা ঘোষ আরও ক্ষেপে গেলেন: ‘দেখে নেব, একেবারে শেষ করে দেব।’ এবং এই কথা বলেই সোজা আমার সামনে এসে বসে পড়লেন। পাশেই বি এন আর টেন্টে সেদিন সঞ্জীব ভট্টাচার্যকে নিয়ে এফ ডব্লু এ-র সভা। মনা ঘোষ মুখ লাল এবং চোখ লাল করে প্রথম সারিতে এসে বসলেন, একেবারে আমার মুখোমুখি, মাঝে শুধু একটা টেবিল। গড়াপেটার চেয়ার থেকে এফ ডব্লু এ-র মিটিং— দুর্ধর্ষ কম্বিনেশন। মনা ঘোষ ঠিক এফ ডব্লু এ-র সদস্য নন, আবেদনপত্রে একজিকিউটিভ কমিটির দুজন সদস্যের সুপারিশ দরকার। তাঁর আবেদনপত্রে কারও সুপারিশ নেই। সাধারণত সুরজিৎ আর আমিই ব্যাপারটা চুকিয়ে দিই। কিন্তু মনা ঘোষের সদস্য হওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করা আমার, সুরজিতের পক্ষে সম্ভব নয়। আবেদনপত্রটি তাঁর কাছে ফেরত গেল।
উয়াড়ি তখন দু-তিনটে গড়াপেটা ম্যাচ খেলে ফেলেছে, আরও দু-তিনটে খেলতে বদ্ধপরিকর। ‘হিন্দুস্থান স্টিল’-এর অফিসে সুরজিতের সঙ্গে উয়াড়ির প্রাক্তন ফুটবলার নির্মল গাঙ্গুলির দেখা। নির্মল বলেন, ‘সুরজিৎ, এই আজকালটাকেই ম্যানেজ করা গেল না। এখন যা অবস্থা, শেষ দু-তিনটে ম্যাচ আমাদের খেলা না দেখতে এলেই পারে!’ কথাগুলো অবশ্য হালকা চালেই বলা হয়েছিল।
শেষ ম্যাচে গ্রিয়ারের সঙ্গে এক পয়েন্ট দরকার ছিল উয়াড়ির। উয়াড়ি তবু ঝুঁকি নিল না। এমনিতে এ বছর দ্বিতীয় ডিভিশনে সেরা দলই ছিল উয়াড়ি, তবু। উয়াড়ির বিরুদ্ধে কিছু লেখা উচিত নয়, এটা অনেকেই বলেছেন। পরিমল দে, তরুণ বসু, কাজল চ্যাটার্জি— অনেকেরই এক কথা: ঐতিহ্যশালী ক্লাবটা ফার্স্ট ডিভিশনে ফিরছে, পেছনে না লাগলেই ভাল হয়। আমরা অবশ্য এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। ঐতিহ্যশালী ক্লাবকেই বরং ভাল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হয়। একদিন খবর পেলাম, স্বয়ং বাঘা সোম চিঠি পাঠিয়েছিলেন শৈলেন মান্নাকে, তিনি যেন একটি ক্লাবকে বুঝিয়ে বলেন— উয়াড়িকে পয়েন্ট দেবার কথা। সেদিন অবশ্য খেলাটা হল না। আমাদের রিপোর্টার মাঠে হাজির ছিল।
শেষ ম্যাচটা দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। মোটামুটি গোপনেই খেলা দেখছিলাম পাইপ আর আদা-চায় মশগুল হয়ে। হাঠাৎ দেখলাম, আমার পেছনে এসে গেছেন সেই সদালাপী ভদ্রলোক, গড়াপেটার অঙ্কে ময়দানে যিনি ‘উইজার্ড’ হিসাবে খ্যাত। বললেন, ‘অনেক লিখেছেন, গড়াপেটা অনেক কমে গেছে। আজকের দিনটা উয়াড়িকে ছেড়ে দিন।’ তারপর প্রাচীনকালের গড়াপেটার কিছু স্মরণীয় উপকাহিনী শোনালেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি স্পষ্ট করে বলুন তো, এই যে ম্যাচটা এখন চলছে, তা কি গট-আপ ম্যাচ?’ ভদ্রলোক মাঠের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এমন নির্মল, পবিত্র, স্পষ্ট হাসি আমি গত দশ বছরে দেখিনি।
উল্টোদিকে তখন আজকালের আদ্যশ্রাদ্ধের আয়োজন চলছিল। ঐতিহ্যশালী ক্লাবের সদস্য-সমর্থকরা যে গালিগালাজের ক্ষেত্রে রীতিমতো প্রগতিশীল, তা বোঝা যাচ্ছিল। সেদিন ওই জায়গাটায় আমরা এমন একজনকে রেখেছিলাম, যে আজকালের চেনা লোক নয়। তাই সব মণিমুক্তোই তুলে রাখা সম্ভব হয়। বেশ কিছুক্ষণ গোল না হওয়ায় উয়াড়ির এক রিজার্ভ ফুটবলার পাশের জনকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী ব্যাপার, এখনও হচ্ছে না কেন রে?’ কর্মকর্তাদের সংগঠনশক্তির ওপর পাশের জনের অগাধ আস্থা : ‘দাঁড়া না, ঠিকই হবে।’ খেলার পর উয়াড়ির শ্রদ্ধেয় কর্মকর্তা, বিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলার পাখি সেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকার করলেন। কাগজে নাকি উয়াড়িকে নিয়ে যা-তা লেখা হচ্ছে। যা-তা করতে দ্বিধা নেই, তা নিয়ে লিখলেই রাগ! খেলার পর পরিমল দে বললেন, ‘অশোক, আজ একটু আমার ক্লাবকে কনগ্র্যাচুলেটস করিস, ওরা খুশি হবে। এখন বিশেষ যোগাযোগ নেই, কিন্তু উয়াড়ি তো আমাদেরই ক্লাব। ফার্স্ট ডিভিশনে ফিরল বলে ভাল লাগছে। তোরা যা লিখছিস, তা নিয়ে অবশ্য বলার কিছু নেই। এটা তোকে বলছি, আজ খেলার আগে থেকেই উয়াড়ি টেন্টে প্রচুর আলোর ব্যবস্থা, উৎসবের আয়োজন। পয়েন্টটা না পেয়েই কেউ এ-সব আয়োজন করে? আসলে সিওর ছিল, বুঝলি?’ বুঝলাম। আগেই বুঝেছিলাম। খেলা শুরুর আগেই পটকা ফাটছিল। এবং খই ফুটছিল— গালিগালাজের ঐতিহ্যশালী খই!
গড়াপেটা সংক্রান্ত রিপোর্ট এবার দুজন প্রাক্তন ফুটবলারকে আজকাল অফিসে টেনে এনেছিল। প্রথমজন— দীনু দাস। এই নামটি ষাটের দশকে মোহনবাগান সমর্থকদের মনে আতঙ্ক ছড়াত। ইস্টার্ন রেলের হয়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ভাল গোল তিনি করে গেছেন। দারিদ্র্যর বিরুদ্ধে সাহস আর সততা নিয়ে লড়াই করে উঠে আসা এক ফুটবলারের নাম দীনু দাস। পি কে-র মুখে শুনেছি, খালি পেটে খেলতে খেলতে দীনু দাসের জ্ঞান হারিয়ে মাঠে লুটিয়ে পড়ার মর্মস্পর্শী গল্প। এ বছর নির্মল রিপোর্ট করেছিল, কাস্টমস-সোনালি শিবির ম্যাচ গড়াপেটা হয়েছে। কাগজে বেরনোর দিন সন্ধ্যাবেলাতেই ক্ষুব্ধ দীনু দাস হাজির। রাগে থরথর করে কাঁপছিলেন। বললেন, ‘জোর গলায় বলছি, গট-আপ ছিল না। সিজনের শুরুতে কেউ গট-আপ খেলে? এটা স্ট্রেট খেলা ছিল, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। তোমার রিপোর্টার কি মাঠে ছিল? তুমি ওকে পানিশমেন্ট দাও, কেন এ-রকম লেখে?’
আমি : ‘দীনুদা, আপনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু নির্মলও উল্টোপাল্টা রিপোর্ট করার ছেলে না। আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখছি।’ দীনু দাস এ কথায় সন্তুষ্ট হলেন না। এক সময় আমাকে বলতে হল, ‘আপনার বক্তব্য শুনেছি, এবার আমার কাজ আমাকে করতে দিন। আমার কী করা উচিত তা আমি জানি।’
একদিকে নির্মল, অন্যদিকে দীনু দাস। তদন্তের দায়িত্বটা তবু নির্মলের হাতেই দিলাম। ওর ওপর আস্থা না থাকলে কার ওপর থাকবে? সেদিন মাঠে ছিল দুজন রিপোর্টার— আমাদের নির্মল আর বসুমতীর পূর্ণেন্দু চক্রবর্তী। খেলার পর কথাবার্তা বলে দুজনই একমত হল— গট-আপ। মাঠে কিছু দর্শকও এ কথা চেঁচিয়ে বলেছিলেন।
নির্মল তবু পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে জানাল: দুই দলের কিছু ফুটবলার বলছে গট-আপ ছিল। কিন্তু অন্য কথাও বলছেন অনেকে। ওর ধারণা ‘গট-আপ’, কিন্তু ওর ধারণা ভুল হওয়াও অসম্ভব নয়। ‘খেলা’র লেখায় কাস্টমসকে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দেওয়া হয়েছিল। হয়ত, আবার বলছি ‘হয়ত’, টিমে সুযোগ না-পাওয়া ফুটবলার বিভ্রান্তিটা ছড়িয়েছিল।
মির্জাপুরের কোচ শ্যামল দত্ত (এখানেও আই এফ এ-র খাতায় অন্য নাম, কী খাতারে বাবা!) কিন্তু আজকাল অফিসে এসে এ কথা বলেননি যে তাঁর টিম উয়াড়ির সঙ্গে গট-আপ ম্যাচ খেলেনি। তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার, ‘ফার্স্ট হাফে স্ট্রেট খেলা হয়, উয়াড়ি গোল করতে পারেনি। হাফটাইমে উয়াড়ির লোকেরা মির্জাপুরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে রফা করে তিন পয়েন্ট তুলে নেন। এর মধ্যে আমি নেই।’ পরদিন আজকালে গোটা ঘটনা পেশ করেছিলাম। এই প্রথম একজন কোচ নিজের মুখে মানলেন যে, তাঁর টিম গড়াপেটা ম্যাচ খেলেছে। পরে উয়াড়ির দু-একজন বলেন, ‘শ্যামল দত্তটা কী ভোঁদারাম লোক। ওকে কতভাবে খুশি করা হল, আর ও-ই কি না এখন বড় বড় স্টেটমেন্ট দিচ্ছে?’ শ্যামল দত্ত অন্যরকম বলেছেন। যদি উয়াড়ির লোকেদের বক্তব্য তর্কের খাতিরে মেনেও নিই, ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? উয়াড়ি গট-আপ খেলেনি?
বলরামদা বললেন, ‘আমি মহমেডান টেন্টের সামনে অনশন করতে চাই। যতদূর যাওয়া দরকার, ততদূর যেতে চাই।’ কিন্তু, সবাই তো আর তুলসীদাস বলরাম নন। তাই সংশয় ছিল, সঞ্জীব ভট্টাচার্য ইস্যুতে এফ ডব্লু এ-কে কতদূর নিয়ে যাওয়া যাবে। নতুন সংগঠন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তাছাড়া, এফ ডব্লু এ মূলত প্রাক্তন ফুটবলারদের সাহায্য করার সংগঠন— এরকম একটা ধারণা তো আছেই। ময়দানি অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই সংগঠনকে মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করার কথা ভেবে আর কতজন এসেছেন? ঘুষ নিয়ে ক্লাবকে ডুবিয়েছে, এই অভিযোগে সঞ্জীবকে সাসপেন্ড করেছিল মহমেডান। সঞ্জীব ইস্যুতে আমরা এগিয়েছি ধৈর্য ধরে, ধাপে ধাপে। এবং ফলও পেয়েছি। মহমেডান স্পোর্টিং সচিবের কাছে আবেদনপত্র পাঠানো দিয়ে শুরু, মহমেডান স্পোর্টিংয়ের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে শেষ। সঞ্জীবকে মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাব বরখাস্ত করার চিঠি ধরানোর পরদিনই প্রখ্যাত আইনজীবী গীতানাথ গাঙ্গুলির সঙ্গে আমাদের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘মামলা চলবে যথারীতি অনেক দিন, কিন্তু শুরুতেই ইনজাংশন পাওয়া যাবে— সঞ্জীব মহমেডানের ফুটবলার এবং অ্যাসোসিয়েট মেম্বার হিসাবে বিবেচিত হবে।’
আমরা জানতাম, আদালতের রায় মেনে মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাব সঞ্জীবকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলেও, কিছুতেই ম্যাচ খেলাবে না। দরকারও বিশেষ ছিল না। তারপরই ভারতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়ে যায় সঞ্জীব। তাই, সঞ্জীব এক কথায় রাজি হওয়া সত্ত্বেও, প্রথমেই মামলার পথে যাইনি। জানতাম, শেষ পর্যন্ত মামলাই একমাত্র পথ, তবু এফ ডব্লু এ-কে এ পথে এনেছি ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে, সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে। প্রথমেই যদি সুরজিৎ আর আমি প্রস্তাব তুলে দিতাম যে, এফ ডব্লু এ-র পক্ষ থেকে মহমেডানের বিরুদ্ধে মামলা করা হোক, অনেকেই পিছিয়ে যেতে চাইতেন— প্রস্তাবটাকে অতিরিক্ত জঙ্গি মনে হত। তিন সপ্তাহ পরে, এটা আর কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয়নি যে, মামলা ছাড়া উপায় নেই।
সঞ্জীব ইস্যুতে আমরা যে নৈতিক জয় পেয়েছি, সে জন্য সবার আগে সঞ্জীব ভট্টাচার্যরই নাম করতে হয়। চিঠি পাওয়ার দিন দুপুরে ও যখন সরোজের সঙ্গে আমার বাড়িতে এল, চিন্তিত একজন যুবককে দেখেছিলাম। কিন্তু তারপর, দ্বিতীয় দিন থেকেই প্রচণ্ড শক্ত হয়ে ওঠে। বারবার বলে, ‘ইব্রাহিম আলি মোল্লারা কিছু করবে না অশোকদা, কড়া কিছু ডোজ দরকার।’ একবারও ওকে বলতে শুনিনি, মিটিয়ে ফেললে ভাল হয়। এ-সব ক্ষেত্রে বাড়ির লোকেরা পিছনে টানেন। সঞ্জীবের বাবা এবং দাদারা কিন্তু আগাগোড়া লড়াইয়ের পথে থাকতে চেয়েছেন।
সঞ্জীবকে নিয়ে আন্দোলনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য, স্থানীয় অঞ্চলে প্রবল প্রতিক্রিয়া। মধ্যমগ্রাম এবং বারাসতের প্রায় সব ক্লাব একযোগে প্রতিবাদ জানায়। সভায় সভায় মহমেডান কর্মকর্তাদের ধিক্কার জানানো হয়। মধ্যমগ্রাম স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্ররা মিছিল করেন। একজন ফুটবলারের জন্য একটি অঞ্চলের মানুষের এমন স্বতঃস্ফূর্ত জেগে ওঠা অভাবনীয়। মোহনবাগান ক্লাবের এক বিখ্যাত কর্মকর্তা সহাস্যে জিজ্ঞেস করেন, ‘সঞ্জীব কি এবার ইলেকশনে দাঁড়াবে নাকি?’
শতাধিক ফুটবলার এফ ডব্লু এ-র আবেদনপত্রে সই করেন। মহমেডান ও মোহনবাগানের অধিকাংশ ফুটবলার এবং ইস্টবেঙ্গলের সব ফুটবলারের সই পাওয়া গেল। প্রাক্তনরাও পিছিয়ে থাকলেন না। পল্লবকে টেলেক্সে জানালাম, কলম্বো থেকে যেন ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারদের প্রতিবাদপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করে। খবর পাওয়ার পরদিনই মিটিং করে প্রতিবাদপত্রে সই করলেন ইস্টবেঙ্গলের পঁচিশজন ফুটবলার, পি কে আর শ্যাম থাপার সইও থাকল।
কার কার সই পাওয়া যায়নি? মানি, দুই মজিদ, আসলাম ও মুশির আমেদ এড়িয়ে গেল। বলা যায়, পালিয়ে গেল। সরাসরি আপত্তি দেখা গেল দু’জনের— সুব্রত ভট্টাচার্য ও সমর ব্যানার্জি। সুব্রতর কথা আগেই লিখেছি। সমর ব্যানার্জি (বদ্রু) মেলবোর্ন অলিম্পিকে ভারতের অধিনায়ক হয়েছিলেন কেন, এই নিয়ে বরাবরই জিজ্ঞাসা ছিল। আর কিছু কারণের সঙ্গে এটাও নিশ্চয় ছিল: ভদ্রলোক ফুটবলারদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কর্মকর্তাদের খুশি করায় ওস্তাদ ছিলেন। এক কথায় প্রতিবাদপত্রে সই করে দেন বাঘা সোম, সাহু মেওয়ালাল, সুশীল ভট্টাচার্য, পরিতোষ চক্রবর্তী, ধনরাজ। সমর ব্যানার্জি অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলেন (এটা স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া… ইত্যাদি!) এবং সই করতে অস্বীকার করেন। পাঁচ গজ দূরে দাঁড়িয়ে অন্য এক বিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলার বলেন, ‘ওকে ছেড়ে দাও, ও বরাবরই এরকম, ভাল কিছুতেই নেই!’
মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবলাররাও যে কিছুটা প্রত্যক্ষ প্রতিবাদের পথে গিয়েছিল, সেজন্য সবার আগে অতনু ভট্টাচার্যর প্রশংসা করতে হয়। সঞ্জীব প্রসঙ্গে এফ ডব্লু এ-র প্রথম সভাতেই এজন্য অতনুকে অকুণ্ঠ অভিনন্দন জানায় সুভাষ ভৌমিক। কিছু লেখায় সুভাষ ভৌমিক গোলকিপার হিসেবে অতনুর কঠোর সমালোচনা করেছে। একাধিক সাক্ষাৎকারে এ জন্য অতনু স্পষ্টভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে। তাই, ওই সভার শুরুতেই সুভাষ যখন অতনুকে আন্তরিক অভিনন্দন জানায়, আমাদের সকলেরই মুখে একটা স্বস্তি ও আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে। সঞ্জীবকে চিঠি ধরানোর দিন সকালে অতনু প্র্যাকটিসে আসেনি। সন্ধেয় সঞ্জীব আর সরোজ অতনুর বাড়িতে গেল। ওকে কিছু বোঝাতে হয়নি। শুনেই বলে, ‘আর কে কী করবে জানি না, এই চিঠি ফিরিয়ে না নিলে মহমেডানে আর খেলব না।’
পরদিন সকালে অতনু আর মানস ইব্রাহিম আলি মোল্লার বাড়িতে গিয়ে বলে, ফুটবলাররা সঞ্জীবের ব্যাপারে কথা বলতে চায়। প্র্যাকটিসের পর ক্লাব টেন্টে মোল্লার সঙ্গে অতনু, মানস, প্রসূন, মইদুল ও সাবিরের কথা হয়। ইব্রাহিম আলি মোল্লা মিথ্যার জ্যান্ত জাহাজ। মুখ খুললেই অনায়াসে মিথ্যা বেরোয়। তিনি হেঁ হেঁ করে জানালেন, ‘এটা তো আমার একার ডিসিশন নয়, মিটিং করতে হবে, প্রেসিডেন্ট ফিরলেই মিটিং হবে, তোমরা খেলা চালিয়ে যাও, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
প্রেসিডেন্ট ফিরলেই! এফ ডব্লু এ-র সদস্যদের শতাধিক প্রতিবাদপত্রের বান্ডিল যখন মোল্লার হাতে তুলে দেওয়া হয়, তখনও তিনি প্রেসিডেন্ট ফিরে আসার কথা তোলেন। তার পর মাস দুয়েকের মধ্যেও দুবাই থেকে ফেরেননি এরফান তাহের! মোল্লা প্রেসিডেন্ট দেখালেন, অথচ আমাদের কাছে খবর আছে, এরফান তাহের সঞ্জীবকে তাড়ানোর সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কথাই বলেছিলেন। অধিকাংশের চাপে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অতনু ছাড়া এই লড়াইয়ে মানস আর প্রসূনের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। প্রথমে অবশ্য মজিদ বাসকারের ভূমিকাতেই বেশি খুশি হতে হচ্ছিল। সঞ্জীবকে যেদিন চিঠি ধরানো হল, মজিদ ওকে সান্ত্বনা জানিয়ে বলে, ‘ঘাবড়ে যেও না, মন খারাপ করবে না, আমরা তো আছি। কর্মকর্তারা তো এমন অন্যায় করেই থাকে, সেজন্য কি ফুটবলারদের ভেঙে পড়লে চলে?’ এই মজিদই দিন চারেক পর ভোল পাল্টে ফেলে বলে, ‘সঞ্জীব ইচ্ছা করে হ্যান্ডবল করেছে, পার্ক সার্কাসে আমাকে অনেকেই এ কথা বলেছে। যদি ইচ্ছা করে না-ও হয়, বড় ম্যাচে এমন ভুলের ক্ষমা নেই। ওর হয়ে কিছু করতে যাব কেন, আমার হয়ে কে বলতে আসে? সঞ্জীব হিন্দু বলে এত হইচই হচ্ছে, আমার ব্যাপার হলে হত না!’
ফুটবলারদের মধ্যে মানস রাজনীতি-সচেতন, অনেক খবরই ওর নখদর্পণে। প্রতিবাদটা মহমেডান টেন্টে ও যে পদ্ধতিতে চালিয়ে গেছে, কলকাতা ময়দানে তা অভূতপূর্ব। বেশ দূরে, বাটানগরে থাকে, না হলে এফ ডব্লু এ-র দৈনন্দিন কাজকর্মেও ওকে টেনে আনা যেত।
সাবির আর মইদুল— দুজনেই মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রভাবশালী ফুটবলার। কিন্তু খবর পেলাম, ওরা সঞ্জীবের ব্যাপারে তেমন কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না। মইদুল এফ ডব্লু এ-র প্রথম উদ্যোগ কানাইয়ান বেনিফিট ম্যাচে যা পরিশ্রম করেছিল, তাতে এক বছর আর কিছু না করলেও চলত। পরেও নানা কাজে এগিয়ে এসেছে। দুর্গাপুরে মহাবীর প্রসাদ বেনিফিট ম্যাচের সময় অধিকাংশ ফুটবলারকে খবর দিয়েছে মইদুল, তুলেও এনেছে। এসপ্ল্যানেড থেকে বাস ছাড়ার কথা সকাল আটটায়, পৌনে আটটায় মইদুল শুনল, দু-তিনজন যেতে পারছে না। কাউকে কিছু না বলে পনেরো মিনিটের মধ্যে মহমেডান মেস থেকে প্রেমনাথ ফিলিপ ও সুবীর সরকারকে তুলে নিয়ে এল। সেই মইদুল এফ ডব্লু এ-র সঙ্গে থাকবে না, যেহেতু লড়াইটা মহমেডান কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে সাবির আর মইদুল প্রতিবাদপত্রে সই করতে রাজি নয়?
তারিখটা মনে নেই, একটা রবিবার, রাতে মইদুলের বাড়িতে হাজির হলাম, দেবাশিস কোনওরকমে চিনিয়ে নিয়ে গেল। তার আগে গাড়িটা সল্টলেকের ধূ ধূ প্রান্তে পাক খেল আট-দশ কিলোমিটার। মইদুলের কাছে সরাসরি দুটো প্রশ্ন রাখলাম। এক, সঞ্জীবকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে এ কথা ও বিশ্বাস করে কিনা? দুই, এফ ডব্লু এ-র লড়াইয়ে ও থাকছে কিনা।
মইদুল বলল, ”সঞ্জীব সম্পর্কে ফিসফাস অফিসিয়ালরা ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচের তিন-চার দিন আগে থেকেই শুরু করেছিলেন। কথা ওঠে, ওকে এই ম্যাচে খেলানোই হবে না, ও নাকি ‘গট-আপ’ হয়ে গেছে। আমি বললাম, ‘এ-সব বিশ্বাস করি না। সঞ্জীব খুব ভাল খেলে, ছেলেও ভাল। ওকে বাদ দিয়ে টিম নামতে পারে না। অফিসিয়ালরা চুপ করে গেলেন। সল্টলেক স্টেডিয়ামে ড্রেসিং রুমে পৌঁছে শুনি, সঞ্জীবকে টিমে রাখা হয়নি। স্টপার হিসেবে আমার সঙ্গে আসলামের নাম। আমি সঙ্গে সঙ্গে জানাই, ‘জয়দেব নেই, সঞ্জীবকে পাশে না পেলে আমার পক্ষে খেলা সম্ভব নয়। আসলাম আবার কবে স্টপার হল?’ আসলামও তখন বলে, ‘আমি স্টপারে খেলতে পারব না।’ অফিসিয়ালরা বাধ্য হয়ে সঞ্জীবকে টিমে রাখেন। হাফটাইমে আবার ওকে বসিয়ে দেওয়ার কথা ওঠে। আমি ওমরদাকে বলি, ‘সঞ্জীবকে বসালে টিম আরও খারাপ খেলবে।’ হ্যান্ডবলটা ও ইচ্ছা করে কিছুতেই করেনি। আমিও কাছে ছিলাম, জামশিদ পুশ করেছিল, তাই ব্যালান্স রাখতে পারেনি। খেলার পর দু-একজন অফিসিয়াল বলেও ফেললেন, ‘মইদুলের জন্যই সঞ্জীবকে বসানো গেল না।’ অশোকদা, এর পরও কি বলবেন যে আমি সঞ্জীবের পক্ষে নই? আসলে কি জানেন, ফুটবলারদের ওপর আমার খুব বেশি ভরসা নেই। দমদম এয়ারপোর্টে যেদিন আমাকে চিঠি ধরানো হয়েছিল, কেউ একটা কথা বলেনি, সবাই ভাল ছেলে হয়ে ঢাকার প্লেনে উঠে পড়েছিল। আমি চোখে জল নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু, আমি আছি।”
তার পর, তখনই প্রতিবাদপত্রে সই করে বলল মইদুল: ‘কাল সাবির আর সাত্তারদা যাতে সই করে, সে দায়িত্ব আমার। আসলে, কিছু অফিসিয়াল বলে বেড়ান, মইদুলই সব গন্ডগোল পাকায়। তাই কিছু করার আগে এখন দুবার ভাবতে হয়। আমি বুঝছি, বিরাট অন্যায় করা হয়েছে। কিন্তু কী করব? জানেন, এই হ্যান্ডবলটা যদি আসলাম বা মুশির করত, কেউ কিছু বলত না। অফিসিয়ালদের মধ্যে অনেকেই বাঙালিদের দেখতে পারে না, আমিও তাই ওদের চোখে খারাপ।’
পরদিন সাবির আলি আর মহম্মদ আবদুস সাত্তারের সই পাওয়া গেল। কিন্তু এই দু’জন সম্পর্কে আমার কিছু বলার আছে। সাবির খুবই ভদ্র ছেলে, জুনিয়র ফুটবলারদের জন্য ওর মমতাও দেখার মতো। আটাত্তর থেকেই ব্যক্তিগতভাবে ও আমার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ। শুধুমাত্র সুরজিতের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতাই এ জন্য দায়ী নয়। বোম্বের তাজ হোটেলের রিসেপশনিস্ট ছিল সাবির, কথাবার্তায় এমনিতেই মার্জিত। কিন্তু শুধু ওপর-ওপর নয়, ওর কথায় আন্তরিকতার একটা সুরও পরিষ্কার। মুখে একটাও খারাপ কথা নেই, কথা দিলে রাখে, পরনিন্দা বলতে গেলে করেই না। ময়দানে এই সব গুণ তো আর চাইলেই পাওয়া যায় না। তাই ভাল লেগে গিয়েছিল। প্রদীপ চৌধুরি কিন্তু সেই আটাত্তরেই বলেছিল, ‘বম্বেতে সাবিরকে বলা হয় জালি আলি। ওর যত দহরম-মহরম অফিসিয়ালদের সঙ্গে।’ কলকাতাতেও বোধহয় এই ব্যাপারটাই কাল হল। অতনুর জেদি মনোভাবকে সাবির মোটেই ভাল চোখে দেখেনি। আদালতের নির্দেশের জোরে সঞ্জীব যেদিন মহমেডান মাঠে প্র্যাকটিসে নামল, মইদুল সঙ্গে থাকলেও সাবির প্র্যাকটিসে নামেনি— অসুস্থতার অজুহাতে। ও জানত, এই ‘রাজনৈতিক অসুস্থতা’ কর্মকর্তাদের খুশি রাখবে। সরোজ মারফত সাবির জানতে চেয়েছিল, ‘অশোক কি আমার ওপর খুব চটে আছে?’ পরিষ্কারই জানিয়ে দিয়েছি— ‘হ্যাঁ’।
মহম্মদ আবদুস সাত্তারের নাম এফ ডব্লু এ-র অন্যতম সহ-সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব করেছিলাম এ জন্য নয় যে, তিনি মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কোচ, মূলত এ জন্য যে, তিনি একজন নিরহঙ্কার বরেণ্য ফুটবলার। জীবনে যিনি কখনও আলগা গ্ল্যামারের পেছনে ছোটেননি, তিনি ভাল কাজে সামনের সারিতে থাকবেন— এই প্রত্যাশা ছিল। সাত্তারদা সরাসরি ফুটবলারবিরোধী কিছু করেছেন, এ কথা বলব না। কিন্তু একবারও কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে মুখ ফুটে বলতে পারেননি, ‘সঞ্জীব ইচ্ছা করে ডুবিয়েছে— এ কথা সত্যি হতে পারে না, ওকে ফিরিয়ে নিন।’ বরং, যথাসম্ভব এড়িয়ে গেছেন। প্রতিবাদপত্রে সইও হয়ত করতেন না, মইদুল না বললে। সাত্তারদা ভাল মানুষ। এই রকম ভাল মানুষ বা ভাল ছেলে ময়দানে আরও কিছু দেখেছি। মুশকিল হল, এঁরা সবার কাছেই ভাল থাকতে চান, খারাপ লোকেদের কাছেও। তাই, কখনই কোনও ব্যাপারেই প্রতিবাদ জানাতে পারেন না। কর্মকর্তারা এ ধরনের লোকেদেরই পছন্দ করেন। আমরা করি না!
মামলা করার দিনটার গল্প করে এই অধ্যায়টা শেষ করব। গীতনাথ গাঙ্গুলি বলে রেখেছিলেন, ঠিক দুটোয় আমাদের সিটি সিভিল কোর্টে হাজির হতে হবে। আমার বাড়িতে এল সঞ্জীব আর ওর দাদা, আমরা তিনজন এক গাড়িতেই গেলাম। সরাসরি কোর্টে হাজির সুরজিৎ, সরোজ আর শিবু— এস এস কাঞ্জিলাল। গীতানাথবাবু, আজকালের আদালত প্রতিবেদক আইনজীবী দীপক সেন এবং গীতানাথবাবুরই তিনজন সহকারী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পাশেরই একটা এজলাসে পিনাকী চ্যাটার্জির রহস্যজনক মৃত্যু-সংক্রান্ত মামলার শুনানি চলছিল। শিবুর যেন ওই মামলার ব্যাপারেই বেশি উৎসাহ!
আড়াইটে নাগাদ গীতানাথ গাঙ্গুলি বললেন, হাকিম এজলাসে নয়, আমাদের নিজের চেম্বারে ডেকেছেন। বিচারক কে ডি ব্যানার্জি অত্যন্ত সদালাপী মানুষ ও ফুটবল-অনুরাগী। বললেন, ‘আপনারা তো এফ ডব্লু এ করে একটা হইচই বাধিয়ে দিয়েছেন। খুব ভাল কাজ করেছেন। সঞ্জীব, ভেঙে পড়ছ কেন, সেদিন আমিও মাঠে ছিলাম, তোমার কোনও দোষ নেই। সুরজিৎ, আরও কিছুদিন খেলা যেত না? আমরা কিছু পায়ের কাজ দেখতে পেতাম! অশোকবাবু, এই আলাপ হল, কিন্তু আপনার লেখার সঙ্গে আমি খুব পরিচিত। মিঃ গাঙ্গুলি, মামলা একটু বাদে হবে, আগে অশোকবাবুদের অনারে এক রাউন্ড চায়ের অর্ডার দিই।’ চা-বিস্কুট এল। সাবালক হওয়ার পর চায়ের সঙ্গে বিস্কুট এই প্রথম খেলাম। বিচারক কে ডি ব্যানার্জির ব্যবহারে তখন এতটাই অভিভূত যে, কোনও কিছুতেই ‘না’ বলার প্রশ্ন ছিল না। তারপর গীতানাথ গাঙ্গুলি আইনের দিক দিয়ে বক্তব্য ও তথ্য পেশ করলেন। কোনও ফাঁক ছিল না। রায় পাওয়া গেল বিকেল সাড়ে চারটেয়, সঞ্জীবকে মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবে প্র্যাকটিস করার এবং খেলার জন্য বিবেচিত হওয়ার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হল। সঞ্জীব ওই ২৬ আগস্ট থেকেই আবার মহমেডানের ‘অ্যাসোসিয়েট মেম্বার’। সন্ধে সাতটায় ক্যালকাটা স্পোর্ট জার্নালিস্ট ক্লাবে সুরজিৎ, আমি আর সঞ্জীব সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য পেশ করলাম। সঞ্জীব বলল, ‘যতদিন মোল্লা আছেন, মহমেডানে খেলতে চাই না, যেতেও চাই না।’ শ্যামসুন্দর ঘোষ বললেন, ‘এটা মানতে পারছি না। মহমেডান সঞ্জীবকে খেলাবে না, সঞ্জীবও খেলবে না— ঠিক আছে। এফ ডব্লু এ ফুটবলারের রাইট এস্টাবলিশ করছে— এটাই বড় কথা। কিন্তু প্র্যাকটিস করতে না গেলে কী করে ‘রাইট এস্টাবলিশড’ হচ্ছে? ওর যাওয়া উচিত।’
এফ ডব্লু এ-র এক-একটা অনুষ্ঠান হয় আর আমরা ভাবি, কত অল্প সময়ে কত কিছু করে ফেলা গেল। এফ ডব্লু এ-র বেনিফিট ম্যাচের পর আর বাড়ি ফিরি না, সপরিবারে ক্যাম্প বসাই কোথাও— নিজের খরচে কিন্তু! সুরজিৎ, পল্লব আর প্রকাশ থেকে যায়, সারা রাত হয়ত ঘুমই হয় না। কত কথা। কত অভিমান। কত স্বপ্ন। কানাইয়ান বেনিফিট ম্যাচের পর রাতে অবশ্য সুরজিৎ বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেছিল। রাত আড়াইটেয় নিচ থেকে প্রচুর ডাকাডাকি করে, তিনতলায় বাড়ির কেউ শুনতে পায়নি। তিনটে নাগাদ ঠকঠক। পল্লব দরজা খুলে দেখে— সুরজিৎ। ঘুম পেয়েছিল খুব। সাড়ে চারটে নাগাদ শুয়ে পড়লাম আমি আর সুরজিৎ। পল্লব আর প্রকাশ তখনই বেরিয়ে গেল ইন্দার সিংকে ভোরের ফ্লাইট ধরানোর জন্য। এই সব রাতে, এবং অনেক সন্ধ্যায় এফ ডব্লু এ-কে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখেছি। হয়ত স্বপ্নই। এ কথা সত্যি, আমরা প্রথম বছরেই দুঃস্থ প্রাক্তন ফুটবলারদের হাতে তুলে দিতে পেরেছি এক লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার টাকা, স্টেডিয়াম গড়ার কাজে সাহায্য করেছি, ট্রেনিং ক্যাম্প করেছি, ফুটবলারের বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনও গড়েছি। বাংলাদেশের ফুটবলারদের সম্মানে আয়োজিত চা-চক্র দেখে এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের সচিব পিটার ভেলাপ্পন বলেছিলেন, ‘ফুটবলারদের কোনও সংগঠন যে এত ভাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারে, আজ এখানে না এলে জানতে পারতাম না।’ জিয়াউদ্দিন বলেছিলেন, ‘আপনারা বিরাট জিনিস করে ফেলেছেন।’ ১৩ সেপ্টেম্বরের প্রথম বার্ষিক অনুষ্ঠানে সুব্রত মুখার্জি বলে গেলেন, ‘আপনাদের অর্গানাইজেশন দাঁড়িয়ে গেছে, এখন শুধু বাড়িয়ে যান।’ রবি ঘোষ সবিস্ময়ে বললেন, ‘এমন একটা সংগঠন যদি আমরা, শিল্পীরা করতে পারতাম!’
আর শুভেচ্ছা এবং সহযোগিতার তো শেষ নেই। এই সংগঠনের কাজে যে যেখানে গেছে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই সহজে কাজ হয়েছে। মন্ত্রী, সব দলের রাজনৈতিক নেতা, পুলিস অফিসার, ব্যুরোক্র্যাট, শিল্পী, ব্যবসায়ী— কেউ নিরাশ করেননি। রামচন্দ্র পরবকে রাখার জন্য ‘হোটেলিয়ার্স অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’-এ গেলাম। কত টাকা লাগবে? তরুণ স্বত্বাধিকারী বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কীসের টাকা? এফ ডব্লু এ-র কাছ থেকে কি টাকা নিতে পারি?’ ১৩ সেপ্টেম্বর চা-চক্র হওয়ার কথা ছিল বি এন আর টেন্টের লনে, কোনওরকম ছাউনি ছাড়াই। ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধেয় সুরজিৎ বলল, ‘এত আয়োজন করা হচ্ছে, সব কিছু যদি বৃষ্টিতে ভেস্তে যায়? প্যান্ডেলের ব্যবস্থা কর অশোক।’ প্যান্ডেল? মাঝে একটা দিন, সেই ১২ সেপ্টেম্বর আবার শিল্প বনধ তথা বাংলা বনধ। কী করে মাল নিয়ে যাওয়া হবে? এই অল্প সময়ে কী করে প্যান্ডেল তৈরি হবে? মডার্ন ডেকরেটর্সের সমীর রায়চৌধুরি মোহনবাগান ক্লাবের লোক, আমার ব্যক্তিগত বন্ধুও। তিনি থাকতে কীসের চিন্তা? আমাদের কথা শুনেই তাঁর মাথায় হাত। ‘কাল বনধ, পরশু অনুষ্ঠান, এখন কী করব?’ বললাম, ‘মডার্ন ডেকরেটর্স চাইলে সব পারে।’ সমীর রায়চৌধুরি উঠে পড়ে বললেন, ‘দেখা যাক কী করা যায়, কথা দিয়ে যাচ্ছি না কিন্তু।’ ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে বি এন আর টেন্টে পৌঁছে দেখি, বি এন আর টেন্টের প্রশস্ত লন যেন ইন্দ্রপুরী। দুর্ধর্ষ প্যান্ডেল, অসংখ্য টিউব আর মার্কারি লাইট, সুদৃশ্য মঞ্চ, চারপাশে উড়ছে নানা রঙের পতাকা— উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
এটি একটি উদাহরণ মাত্র। এইরকম সহযোগিতায় বারবার পুষ্ট হয়েছে এফ ডব্লু এ। প্রবল জনসমর্থন যে রয়েছে, তা তো আপনারা সকলেই জানেন। তবু হতাশার রেখাও স্পষ্ট। হতাশা মাত্র একটা জায়গায় এবং সেটাই মোক্ষম জায়গা। ফুটবলারদের সংগঠনে ফুটবলাররা সক্রিয় ভূমিকায় আসে না কেন? নানা অনুষ্ঠানে ফুটবলারদের দেখে মনে হয়, ওরা যেন অতিথি। কেন আমাদের মতো অ-ফুটবলাররা দিনের পর দিন সংগঠনের নেতৃত্বে থাকবে? ফুটবলারদের কাজে আমরা সহযোগিতা করতে পারি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মনে হয়, ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। এমনকি সহযোগিতাও সবার কাছ থেকে পাওয়া যায় না। কয়েকজন নিশ্চয় সক্রিয়, কিন্তু আরও কিছু ফুটবলার সক্রিয় না হলে এবং ফুটবলাররা এটাকে নিজেদের গর্বের সংগঠন না ভাবলে এফ ডব্লু এ-র কোনও ভবিষ্যৎ নেই।
এফ ডব্লু এ করতে এসে যা পেয়েছি, তারও তো তুলনা নেই। কত শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ— যার এক কণার যোগ্য আমি নই। আর এফ ডব্লু এ করতে এসেই পেয়েছি জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।
১৩ সেপ্টেম্বর বি এন আর টেন্টে পৌঁছে শুনি, কাছেই ফেডারেশন মাঠে গ্লুকোনেট-এর বিরুদ্ধে স্টেট ব্যাঙ্কের হয়ে অফিস ম্যাচ খেলতে গেছে সুরজিৎ। কাজকর্ম কিছুটা দেখে-বুঝে স্টেট ব্যাঙ্কেরই অসীমকে নিয়ে মাঠের দিকে গেলাম। হাফ টাইম হয়ে গেছে, স্টেট ব্যাঙ্ক দু’গোলে এগিয়ে, একটা গোল সুরজিতের। সুব্রত আর পায়াসও খেলছিল। একটু দূরেই রুমাল পেতে বসেছিলাম। খেলতে খেলতেই হঠাৎ লক্ষ্য করল সুরজিৎ এবং কপট বিস্ময়ে মাথায় হাত দিয়ে মাঠে প্রায় বসে পড়ল। খেলা শেষ হতে মিনিট পনেরো বাকি ছিল। দুবার দু-তিনজনকে কাটিয়েও গোল পেল না সুরজিৎ। তার পর, মাঝমাঠের একটু সামনে থেকে বল নিয়ে ঢুকল, একে একে পাঁচজনকে কাটিয়ে গোলে বল পাঠাল। খেলার পর বলল, ‘কার্লোস অ্যালবার্টো ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে একটা গোল করেছিলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের সম্মানে— ‘প্রেসিডেন্টস গোল’। আমার গোলটা খেলার এডিটরের সম্মানে— ‘এডিটর্স গোল’!
অন্য কাগজের সঙ্গে লড়াই আছে, থাকবেও। কোথাও এক ইঞ্চি জমিও তো কেউ ছেড়ে রাখে না। ডুরান্ড-রোভার্স-ডি সি এম-নাগজিতেও রিপোর্টার পাঠানো আমরাই চালু করলাম। দার্জিলিং, গ্যাংটক, পাটনা— যেখানে কলকাতার বড় টিম, সেখানেই আজকাল আর খেলা। পাকিস্তান সফরে গেল দেবাশিস, পল্লব গেল সিঙ্গাপুর, ঢাকা আর কলম্বোয়। দু-তিন বছর আগেও এ-সব ভাবা যেত না। আরও খবর, আরও ভালভাবে খবর তুলে আনার লড়াই আজ আমাদের এখানে পৌঁছে দিয়েছে। পল্লব কলম্বোয় গেল প্রথমে ইস্টবেঙ্গল টিমের সঙ্গে। ফুটবলের পর ক্রিকেট কভার করে ফিরবে। মুকুলদা এই সময় একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘পল্লব কি টেস্ট সিরিজও কভার করে আসবে?’ সুকঠিন প্রশ্ন! মুকুলদাই তখন আনন্দবাজারের খেলার পাতার দায়িত্বে। অন্য কাগজের লোককে এ-সব ক্ষেত্রে ঝাপসা জবাব দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু মুকুলদা যে। বললাম ‘হ্যাঁ’। দু-তিন দিনের মধ্যেই অভীক সরকার মুকুলদার কাছে জানতে চাইলেন, পল্লব ক্রিকেট সিরিজ কভার করে আসছে কিনা। তারপর আর দু মিনিট সময় লাগল এটা ঠিক হতে যে, টেস্ট কভার করতে কলম্বোয় যাবে গৌতম ভট্টাচার্য।
‘বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ’-এর খেলা চলার সময় আমরা অস্ট্রেলিয়ায় কাউকে পাঠাতে পারিনি। কিন্তু মৃণালকান্তি সাহার চেষ্টায় এমন কিছু দিতে পেরেছিলাম, যাকে সত্যিই বলা যায় ‘এক্সক্লুসিভ’। মৃণাল আমাদের দুরন্ত বোম্বাই-প্রতিনিধি, পেশায় টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার। মেলবোর্ন ও সিডনিতে একই পেশার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে ও ব্যবস্থা করে রেখেছিল যাতে ভারতের সব ম্যাচের ঘণ্টাখানেক পর ভারতীয় দলের হোটেলে আমরা টেলিফোন লাইন পাই। দূরদর্শনে খেলা দেখেছি আর দূরভাষণে রোজ পেয়েছি অধিনায়কের ‘এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ’। এটা কিন্তু সত্যিই ‘সাক্ষাৎ না করেই সাক্ষাৎকার!’ প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে হারানোর পর গাভাসকার বলেছিলেন, ‘চ্যাম্পিয়ন তো আমরা হচ্ছিই, রানার্স কারা হয়— এটাই এখন দেখার!’ সানি গাভাসকারের পরিচিত কৌতুকস্নিগ্ধ মুখটা ভেবে নিতে অসুবিধা হয়নি। তবে, ‘বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ’ ঘিরে সবচেয়ে স্মরণীয় উক্তি জাহির আব্বাসের। নিজেদের টিম হেরে যাওয়ার পর ইংল্যান্ডের সুভদ্র সাংবাদিকরা লিখতে থাকেন, এরকম টুর্নামেন্টের কোনও গুরুত্বই নেই! ভারত-পাকিস্তানের ফাইনালের আগের দিন এঁদের একজন জাহির আব্বাসের কাছে জানতে চান, ‘কাল কারা জিতবে?’ ‘ঠোঁটে কৌতুকহাস্য জাহির করে পাক অধিনায়ক বলেন: ‘তাতে আপনাদের কী? ফাইনাল খেলছে এশিয়ার দুটো দেশ, হারা-জেতার ব্যাপারটা আমরাই বুঝে নেব!’
আমাদের পাঠক-পাঠিকাদের ‘ক্যাপটিভ অডিয়েন্স’ বলে রাজু মুখার্জি অপমান করতে চেয়েছিলেন। এটা ঘটনা যে, কয়েক বছরে অন্তত চল্লিশ হাজার পাঠক-পাঠিকা আমার এবং আমাদের সঙ্গেই কাগজ পাল্টেছেন। দুটি পত্রিকা ছেড়ে এসেছি, দুটিই অবলুপ্ত। এবং পাঠক-পাঠিকারা জমায়েত নতুন পত্রিকার আসরে। কেন? রাজু ভাবতে পারেন, ‘ক্যাপটিভ অডিয়েন্স’ তো পেছন পেছন ছুটবেই। ভুল, রাজু। অভিধান বলছে, ‘ক্যাপটিভ’ শব্দের একটা অর্থ (রূপে বা নৈপুণ্যে) ‘বিমুগ্ধ ব্যক্তি’। খুব একটা আপত্তিকর ব্যাপার নয়। (অনেক পরে, কথাটা সদর্থেই ব্যবহার করেছে ‘দেশ’ পত্রিকায় গৌতম ভট্টাচার্য)। তবে, রাজু নিশ্চয় ‘ক্যাপটিভ’ বলতে ‘বন্দী’ বুঝিয়েছেন। এই যে হাজার হাজার পাঠক-পাঠিকা এবং আমরা একসঙ্গে আছি, এখানে কেউ কারও ‘ক্যাপটিভ’ নয়। আমাদের লেখায় পাঠক-পাঠিকারা প্রভাবিত হন, তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় বা বক্তব্যে প্রভাবিত হই আমরাও। ভালমন্দের বিচারক আমরা নিজেরা নই, রাজু মুখার্জি তো ননই, কিন্তু একটা কথা হয়ত সবাই মানবেন যে, ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় একটা প্রতিবাদের পতাকা আমরা বহন করছি। সেই পতাকার নিচে যেমন আমরা আছি, আছেন আমাদের পাঠক-পাঠিকারাও। যাঁদের রাজু ‘ক্যাপটিভ অডিয়েন্স’-এর অংশ ভেবেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের চিঠি পড়লে বা বক্তব্য শুনলে রাজু বুঝতেন, আমার বা রাজুর চেয়ে তাঁরা কম বোঝেন না।
এই পাঠক-পাঠিকারা আমাদের ছেড়ে কথা বলেন না। রামবাঁধ-এর সুকান্ত পোদ্দার ‘উমাপতি কুমার সমীপেষু’ পড়ে লিখলেন: ‘আপনি লিখেছেন, এই লেখা তৈরির সময় আপনার এক হাতে কলম, অন্য হাত ছুঁয়ে আছে উমাপতি কুমারের পা। কলম তো ডান হাতে, তার মানে উমাপতি কুমারকে প্রণাম করছেন বাঁ হাতে? এ যে দেখছি…!’
কঠোর সমালোচনার চিঠিও আসে। পড়তে পড়তে মনে হয়, এই পত্রলেখক আমাকে সামনে পেলে ছিঁড়ে ফেলবেন। সেই চিঠিও হয়ত শেষ হল এই সহজ বাক্য দিয়ে: ‘আপনার কিন্তু সাতাশির শেষে বিদায় নেওয়া চলবে না।’ ক্যাপটিভ অডিয়েন্স!
এত লিখলে ভাল লেখা কঠিন, তার ওপর আমি নই ভাল লেখক। তবু, ‘বিমুগ্ধ’ অথবা ‘বন্দী’ পাঠক-পাঠিকারা কখনও কখনও লেখার প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হন। ‘বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ’-এর খেলার ভিত্তিতে একদিনের ক্রিকেটে বিশ্ব একাদশ গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম আমরা। বাংলার তিন ক্রিকেটার— গোপাল বসু, পলাশ নন্দী এবং সম্বরণ ব্যানার্জির নির্বাচিত দল অধিকাংশ পাঠক-পাঠিকার পছন্দ হয়নি। তখন একটা লেখা তৈরি করি: ‘না-হওয়া সভা, না-লেখা রিপোর্ট।’ জানতাম, এ লেখা অনেকেরই ভাল লাগবে না। হয়ত, কয়েকজন পছন্দ করবেন। অন্তত পাঁচশো পাঠক-পাঠিকার নাম আমি জানি, চিঠিপত্র থেকেই। তিন-চারজনের নাম মনে এল, যাঁদের এই লেখাটা ভাল লাগা উচিত। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম— বাকসাড়ার দেবাশিস সেনগুপ্ত। লেখাটা নিয়ে বিশেষ হইচই হল না। বড়জোর দায়সারা প্রশংসা করল কেউ কেউ। কিন্তু দিন সাতেক পরই এক পাঠক টেলিফোন করে জানালেন, ‘পরব বেনিফিট ম্যাচ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বলে আগে বিরক্ত করিনি, ২৪ মে সংখ্যায় আপনার লেখাটা পড়ে আমি থ্রিলড! চিঠি লিখে নয়, নিজের মুখে বলতে ইচ্ছা করল। সাতাশিতে…।’ পাঠকের নাম দেবাশিস সেনগুপ্ত। ক্যাপটিভ অডিয়েন্স!
ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় আরও কয়েক বছর স্বেচ্ছায় থাকা যেত, অন্তত টানা এক বছর ছুটি পেলে! লিখতে না জানলেও, লেখার মতো ভাল জিনিস আর নেই। এবং সম্পাদকের চেয়ে খারাপ চাকরি আর হয় না। তার ওপর একটি বিশেষ জগৎ ও বিষয়ের বিরক্তিকর সীমাবদ্ধতা।
এবার, সময় এসেছে, ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় নতুন কিছু আসুক। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, এই দশকের শেষ দিকেই আসবে আর একটা পরিবর্তনের ঝড়। সেই পরিবর্তনের পতাকা যদি থাকে আমার তরুণতর সহকর্মীদের হাতে, সবচেয়ে খুশি হব নিশ্চয়। যদি অন্য কারও হাতে থাকে, থাকুক। নতুন কেউ আসুক। নতুন কিছু আসুক। নবীন পত্রেপুষ্পে বাংলা ক্রীড়া-সাংবাদিকতার বৃক্ষ আন্দোলিত হোক। মরা পাতারা ঝরে যাক, সরে যাক, উড়ে যাক।