খেলা শারদীয় সংখ্যা ১৯৮৪

খেলা শারদীয় সংখ্যা ১৯৮৪

উনিশশো আটাত্তরের পয়লা জুন। সকালে ‘খেলার কথা’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। পরিবেশক শ্রীচন্দ্র পারিজা অনুযোগ করেছেন, কেন মাত্র দশ হাজার কপি ছেপেছি। টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন অনেক শুভানুধ্যায়ী। তবু সংশয়, উৎকণ্ঠা যায় না। পাঠক-পাঠিকারা কীভাবে নিচ্ছেন? শহরের ম্যাগাজিন স্টলগুলোয় এই নতুন খেলার পত্রিকা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া কীরকম?

সন্ধে সাতটা নাগাদ সার্ভে শুরু হল। গড়িয়াহাট মার্কেটের সামনে একটা স্টলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, শুনলাম একটা নতুন খেলার কাগজ বেরিয়েছে, ‘খেলার কথা’ না কী যেন নাম? কেমন হয়েছে? আছে নাকি?’

মধ্যবয়সী স্টল-মালিক জানালেন, ‘খুব ভাল করেছে কাগজটা। খুব চলবে। আর দু কপি আছে, এই যে, নিন। এক টাকা তিরিশ পয়সা।’ আমার হাতের প্যাকেটে অন্তত পাঁচ কপি কাগজ, তবু কিনতে হল। গড়িয়াহাট থেকে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড়— এই পথটুকু হাঁটতে হাঁটতে এবং সার্ভে করতে করতে সেই সন্ধেয় আরও বার চারেক এক টাকা তিরিশ পয়সা খরচ করতে হল। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের একটা স্টলে ওই একই ভঙ্গিতে কথা শুরু করতেই স্টল-মালিকের পাশের টুলে-বসা এক যুবক বলে উঠলেন, ‘আরে আপনি কী খোঁজ নিচ্ছেন, আপনারই তো কাগজ!’ যুবকটি কীভাবে আমাকে চিনলেন, তা আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জা এড়াতে বোকার মতো হেসে পালিয়ে বেঁচেছিলাম।

কিন্তু ততক্ষণে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে, আমাদের কাগজ আগ্রহ তৈরি করতে পেরেছে। অনেক স্টলেই দেখলাম, সম্ভাব্য পাঠক পত্রিকা নেড়েচেড়ে দেখছেন এবং তার পর কিনছেন। দেশপ্রিয় পার্কের কাছে একটা স্টলে নিজের চোখেই একজন পাঠককে নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে দেখলাম। কাগজ ফুরিয়ে গেছে! সেই শুরু, কাগজ ফুরিয়ে যাওয়ানোর লড়াই। খবরের কাগজ খবর ধরে ছিবড়ে করে দেওয়ার পরও, তাকে নতুন ভাবে দেখে এবং দেখিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলার অসম যুদ্ধ। তারপর দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। হার, জিত, ব্যর্থতা, সাফল্য, বেদনা ও আনন্দের টানাপোড়েনে থাকতে থাকতে এক ধরনের একঘেয়েমিও এসে গেল। একাশিতে দৈনিক পত্রের জগতেও ঢুকে পড়া গেল। যুদ্ধ শুরু হল নিজের এবং নিজেদের বিরুদ্ধেও। প্রতিযোগিতায় থাকার জন্য সবরকম খবর, এমনকি তদন্তমূলক প্রতিবেদনও তুলে আনছে আজকাল, আর ‘খেলা’কে লড়তে হচ্ছে এই সর্বগ্রাসী খবরের কাগজের বিরুদ্ধে। খবর পেলেই তা আজকালে তুলে আনছি, এবং তারপর ভাবছি এর পরেও কীভাবে ‘খেলা’কে সমান আকর্ষণীয় রাখা যায়। এই সব চলতে চলতে অনিবার্যভাবেই বাড়ল দুটি জিনিস— বয়স আর অভিজ্ঞতা। অনেক কিছুই, নিজের মধ্যেও, পাল্টে গেল। শুধু এই সংশয়টুকু গেল না। আটাত্তরের পয়লা জুনের মতোই এখনও অচেনা স্টল-মালিকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘দাদা আমার ছোট ভাইয়ের জন্য একটা খেলার পত্রিকা কিনব, কোনটা ভাল বলুন তো? কোনটা বেশি চলে?’ প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘খেলা’র নাম শুনলেও একটু দাঁড়াই, অন্য দু-চারটে পত্রিকা ঘাঁটাঘাটি করি। কখনও কখনও উদ্দেশ্য সফল হয়। আমার প্রশ্নটশ্ন শুনে স্টলে আসা কোনও পাঠক বা ক্রেতা জানান, কেন খেলা কেনা উচিত। কাঁকুড়গাছির মোড়ের ম্যাগাজিন স্টলে এক কিশোর একদিন বলল,’খেলা’ই বেস্ট, কিন্তু মোহনবাগানের কাগজ!’ এদিকে ‘খেলা’ যে ইস্টবেঙ্গলের কাগজ— এই অভিযোগও কম চিঠিপত্রে থাকে না। কিন্তু, সে-কথা তো আর ছেলেটিকে বলা যায় না। তাই বললাম, ‘তাহলে অন্য কাগজ নেব।’ বিশ্বাস করুন, কিশোর পাঠক প্রায় চমকে উঠল, ‘না না খেলা ভাল, ‘খেলা’ই নেবেন। আমি ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার, আমিও নিই!’ তবু সংশয় যায় না। প্রতিদিন জানতে ইচ্ছা করে, পাঠক-পাঠিকাদের পছন্দসই লেখা লিখতে পারছি কিনা। তাঁরা তখন কী চাইছেন, তা বুঝতে পারছি কিনা। কখন কীভাবে অপ্রত্যাশিত উপহারে প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের মুখে হাসি ফোটাতে হয়, তা মাথায় ঠিকঠাক আসছে কিনা। সেজন্যই রোজ অফিসে ঢুকেই চিঠির পাহাড়ে ওঠা। প্রত্যেক সংখ্যা প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়া ধরার চেষ্টা। পাঠক-পাঠিকাদের বড় জোর শতকরা এক ভাগের চিঠিপত্র লেখার অভ্যেস আছে। তবু, এই ভগ্নাংশের মতামতই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতিনিধি স্থানীয়। কোথায় আমরা প্রত্যাশা মেটাতে পারলাম না, কোথায় আমরা বড় ভুল করছি, কী কী পাঠক-পাঠিকারা পছন্দ করছেন, তা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না। এই সব চিঠিই সংশয় কাটায়। তবু, পরের সপ্তাহে আবার সংশয়। এইরকমই, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, দিনের পর দিন।

কত চিঠি যে আসে! এবং কী আন্তরিক সব চিঠি। আমার মতো অতি সাধারণ লেখকের যে এত অনুরাগী থাকতে পারেন, এ কথা অন্য কারও ক্ষেত্রে বা অন্য কারও মুখের কথায় বিশ্বাস করতে পারতাম না। কোনওরকম বিনয়ের ছল না করেই বলছি, আমার লেখার প্রশংসা করে যাঁরা চিঠি লেখেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেরই লেখা আমার চেয়ে ভাল, অনেক বেশি টানটান। টেবিলের ডানদিকের ওপরের ড্রয়ারে রয়েছে এমন অনেক চিঠি, যা আমাকে লেখা হয়েছে জবাব পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে। এঁরা প্রত্যেকেই আমার… আমাদের আন্দোলনের শরিক। অধিকাংশই সেই আটাত্তর থেকে আমাদের সঙ্গী। কেউ চিঠি লিখেছেন অভিমানে, কোনও প্রসঙ্গে আমার বা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্ষুব্ধ হয়ে। কেউ শুধুই আলাপ করতে চেয়েছেন, এক লাইনের জবাব চেয়েছেন। হাওড়ার এক সচেতন পাঠক অসাধারণ এক চিঠিতে তাঁর দু-তিনটি অভিযোগ পেশ করার পর লিখলেন, ‘আগের চিঠির জবাব পাইনি। এবার ছোট্ট হলেও আপনার একটা চিঠি ভিক্ষা চাইছি।’ ভিক্ষা? লজ্জায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতে যেতে নিজেকে অনেক অভিশাপ দিলাম। তবু হায়, ওই চিঠির জবাব দেওয়া হয়নি। একটি চিঠিরও জবাব দেওয়া হয় না। সুনীল গাভাসকার রোজ অন্তত তিরিশটা চিঠির জবাব দিতে পারে, আর আমি কী এমন অমুক চন্দ্র তমুক যে দিনে তিনটে চিঠিরও জবাব দিতে পারি না? আমার কি উচিত ছিল না অন্তত সিউড়ির সেই ছেলেটির অসংখ্য চিঠির অন্তত একটির জবাব দেওয়া, যে আর কিছু নয়, আমার হাতের লেখাটুকু পেতে চেয়েছিল। কত অযোগ্য পাত্রে মানুষ ভালবাসা ঢালে, আমার মতো ওপর-চালাক খবরজীবীর অটোগ্রাফ চেয়ে চিঠি দেন কেউ কেউ। ছবিও চেয়ে ফেলে। সাম্প্রতিক একটি দাবি: আমার সঙ্গে টিমের সকলের গ্রুপ ছবি পাঠাতে হবে। সুরজিতের হাত দিয়ে এক দীর্ঘ চিঠি পাঠালেন এক পাঠক, শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় যিনি ঘরবন্দী। চিঠির সঙ্গে উপহার হিসাবে একটা চীনা কলম। সারাদিন কী এমন রাজকাজ করছি যে সেই চিঠিটারও একটা জবাব দিতে পারলাম না? আসলে, আলস্য। রাজকীয় আলস্য! দিনে সতেরো ঘণ্টা কাজ করতে পারি, যদি সেই কাজটা না করে উপায় না থাকে। যে কাজটা আজই না করলে চলে তা কাল বা পরশুর জন্য তোলা রাখাই আমার স্বভাব। কাল আসে, পরশুও এসে যায়, তখন তারও পরের কাল-পরশুর জন্য সব তোলা থাকে। থেকেই যায়।

এই পত্রলেখকদের কাছে আমার শুধু একটাই প্রার্থনা, দয়া করে আমাকে অহঙ্কারী ভাববেন না। কারণ, সাধারণ বুদ্ধিশুদ্ধি আমার আছে। অহঙ্কার থাকার কোনও কারণ আমার ক্ষেত্রে নেই, সেটা জানি। আসলে, একটা সর্বগ্রাসী পেশার জালে আটকে গেছি। সারাদিনে এক-আধ ঘণ্টার আলস্য ছাড়া রিক্রিয়েশন বা বৈচিত্র্য আর কিছু নেই। যদি এমন হত যে এই আন্তরিক চিঠিগুলির জবাব না দিলে ‘খেলা’ প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হবে না, সব চিঠিরই জবাব দিয়ে ফেলতাম। দিতেই হত। ক্ষমা করুন, প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা।

চুরাশির দলবদল সবে শুরু হয়েছে। ২১ মার্চ রাত বারোটায় অফিসের গাড়ি নিয়ে বাড়িতে হাজির সরোজ আর দেবাশিস। সরোজ অবিস্মরণীয় প্রশ্ন করল, ‘দলবদলের একটা দারুণ খবর আছে অশোকদা, কিন্তু, আমরা কি ছাপব?’ তিরাশির দলবদল রিপোর্টিংয়ের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা এই একটি প্রশ্নেই ধরা ছিল। দলবদলের খেলায় যে-কোনও সিদ্ধান্তই যে পাল্টে যেতে পারে এবং কোনও কোনও সিদ্ধান্ত যে শুধুমাত্র ঘোষণার জন্যই নেওয়া হয়— সে অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। এবং তিরাশিতে ‘খেলা’র সম্পাদক, আজকাল-এর ক্রীড়াসম্পাদক হিসাবে আমি তো বিব্রত হয়েছিলামই, ভুল খবর দেওয়ার অভিযোগে সরাসরি অভিযুক্ত হয়েছিল সরোজরাও। প্রসূন আর প্রশান্ত সরোজকেই বলেছিল এক টিমে খেলার ইচ্ছার কথা। এমন ‘স্কুপ’ কে হাতছাড়া করে? পরে একাধিকবার সংশয় দেখা দিলেও প্রসূন-প্রশান্ত বলে গেছে, ওরা এক টিমে খেলবেই। সরোজ ওদের বক্তব্যটাই জানিয়ে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন ওরা এক টিমে খেলল না, অনেকেই ভুলে গেলেন যে সিদ্ধান্তটা সরোজের নয় এবং তা ভাঙার দায়িত্বও সরোজের নয়। বারবার আমরা ভেবেছি, রিপোর্টার হিসাবে সরোজের বা সম্পাদক হিসাবে আমার কী করা উচিত ছিল? ওদের সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছার কথা জেনেও না ছাপা? তাই কখনও হয় নাকি! পল্লবের অভিজ্ঞতা তো আরও করুণ। যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও যোগ্য ছেলে, কিন্তু অভিজ্ঞতা ছিল কম। কোচিনে নেহরু গোল্ড কাপ চলার সময় ফুটবলাররা যে যা বলল, সবই গোগ্রাসে গিলে ও আজকাল আর খেলার পাতায় রাখল। ছেঁকে নেওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। কোন মেঘে বৃষ্টি হবে আর কোন মেঘে শুধু শুধুই আকাশের রঙ একটু পাল্টায়, তা বুঝত না। বিশ্বাস করুন, একজন ফুটবলার পরে আমাকে বলেছে, ‘পল্লব যে পুরোপুরি আপনাদের সঙ্গে আছে বা ওকে যা বলছি তার সবই আজকাল, খেলায় ছাপা হবে, তা জানতাম না। আমরা কিছুটা হালকা চালেই অনেক কথা বলেছি।’ এ বক্তব্যের সবটা বিশ্বাস করিনি অবশ্য!

এবার তাই এত সতর্কতা। কথা ছিল, কোনও নামী ফুটবলারকে নিয়ে সংশয় দেখা দিলেই, আমি নিজে ব্যাপারটায় ঢুকব। অবশ্য আমারও তো অভিজ্ঞতা বিশাল— মাত্র সাত বছরের! তবু এডিটর বলে কথা। ২১ মার্চ গভীর রাতে ওই দুর্ধর্ষ প্রশ্নটি করার পর সরোজ জানাল, ‘প্রশান্ত বলল, মোহনবাগানে সই করছে। সত্যি হলে, এ বছর এটাই হবে দলবদলের সব চেয়ে বড় খবর।’ বললাম, ‘কিন্তু ভুল হলে তোমার মৃত্যুই হবে সব চেয়ে বড় খবর!’

আমরা একটু নিরাপদ লাইন নিলাম। দলবদলের প্রথম দিনের খবরের শেষে সাব-হেডিং থাকল: ‘প্রশান্তকে ঘিরে সংশয়’। একটা অভিজ্ঞতা আমাদের বারবার হয়েছে। যতই উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করা যাক, যা ছাপা হবে তার সবটারই দায়িত্ব কাগজের। ধরুন, আমরা হেডিং ছাপালাম— ‘আমি আর টেস্ট ক্রিকেট খেলব না: কিরমানি’। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টে কিরি টেস্টে খেললেন। এমনকি এ কথাও জানালেন যে কেন সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন। তবু, কিছু লোক বলবেই, তবে যে আজকাল বলেছিল কিরমানি আর টেস্টে খেলবে না? তাই, ওই সতর্ক হেডিং— ‘প্রশান্তকে ঘিরে সংশয়’।

অমলরাজ মোহনবাগানে সই করে ফেলেছে। ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তারা প্রশান্তকে রাখার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন, এ কথা জানাই ছিল। পড়লেনও। কিন্তু পরদিন ২২ মার্চ রাত দেড়টায় আবার দেবাশিসের টেলিফোন, সঙ্গে সবুজ অ্যাম্বাসাডর। মানে, সবুজ অ্যাম্বাসাডরে প্রশান্তর মোহনবাগান শিবিরে প্রস্থানের কাহিনী। বালিতে শৈল চ্যাটার্জির বাড়িতে যাওয়ার পথে সরোজ আর দেবাশিসকে নামিয়ে দিয়ে গেছে প্রশান্ত। তারপরই দেবাশিসের টেলিফোন। হাতে একটুও সময় নেই, তখনই খবর ধরাতে হবে আজকাল-এ। হেডিংও সেইমতো করে নেওয়া হল: ‘মোহনবাগানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন প্রশান্ত’। হেডিংয়ে প্রসূনের মহমেডানে যাওয়ার আগাম খবরটাও ছিল। একে মোহনবাগানের কর্মকর্তার গাড়িতে তাঁরই বাড়িতে যাওয়া, তার ওপর প্রশান্তর বক্তব্য ছিল; ‘আমি ছাব্বিশ তারিখ, সোমবার সই করব। ওঁরা অবশ্য শুক্রবার, কালই সই করতে বলছেন।’ আলোচনাটা যখন শেষ পর্যন্ত সই করার তারিখে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন আর সংশয়ের কী আছে? তবু ‘প্রসূন মহামেডানে, ‘প্রশান্ত মোহনবাগানে’— এই রকম সরাসরি হেডিং আমরা করতে পারলাম না। বলা হল, প্রশান্তর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। গৌতম সম্পর্কে আজকালের স্পষ্ট হেডিং ছিল: ‘আজ গৌতম ইস্টবেঙ্গলে ফিরছেন’। প্রসূন আর গৌতম সম্পর্কে অন্য কোনও বড় ক্লাব আগ্রহী না থাকায় আমাদের দ্বিধা ছিল না। কিন্তু প্রশান্তকে ইস্টবেঙ্গল সহজে ছেড়ে দেবে কেন?

পরদিন সকাল থেকে শুরু হল অন্য নাটক। আজকালে প্রশান্তর সিদ্ধান্তের কথা জেনেই ইস্টবেঙ্গল শিবিরের সেমি-অ্যাকশন স্কোয়াড কাজে নেমে গেল। একটু বাদে বাদেই মোটরবাইক বা গাড়িতে করে কিছু কিছু যুবক এসে প্রশান্তর বাড়ির সামনে দাঁড়াতে থাকলেন এবং ভয়ঙ্কর সব হুমকি। প্রশান্তর বাবা ভয় পেলেন। তেইশ তারিখ সকালে বালি থেকে প্রশান্ত এল কালীঘাটে নিজের বাড়িতে। বাবার ভয়ের কারণ বুঝল। ভাবল, এই অবস্থায় মোহনবাগানে যাওয়া হয়ত সম্ভব হবে না। আজকালের হেডিংয়ে তবু বলা হল না যে প্রশান্ত ইস্টবেঙ্গলে থেকে যাচ্ছে। হেডিং ছিল— ‘প্রশান্ত আবার দোটানায়’। বোঝা গেল, দলবদলের ধারাভাষ্যে প্রাণবন্ত থেকেও যথাসাধ্য নিরাপদ থাকার রাস্তা আমরা খুঁজে পেয়েছি।

প্রশান্ত ইস্টবেঙ্গলে থাকছে, ময়দানে তখন এই খবরই চালু। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল। আমাদের এক রিপোর্টারকে ডেকে ‘হুঁ হুঁ আমার নাম গজু বসু’ বলেই ফেললেন, ‘এই তো সব প্লেয়ার, এর ওপর ভরসা করে কিছু অফিসিয়াল ফরিদকে নিতে চাইছিল না। না নিলে, আজ আমাদের অবস্থা কী হত?’ ২৪ মার্চ শনিবার শ্যাম থাপাকে সই করিয়ে ফেরার সময় ইস্টবেঙ্গলের সুবীর ঘোষ আমাদের আর এক রিপোর্টারকে বললেন, ‘প্রশান্ত আবার আপনাদের ডোবাল তো? শুধু শুধু ভুল খবরটা ছাপলেন?’

কিন্তু ‘হুঁ হুঁ গজু বসু’ যা-ই ভাবুন, মোহনবাগানের দু-একজন কর্মকর্তা তখনও হাল ছাড়েননি। রবিবার গভীর রাতে প্রশান্তকে নিয়ে যাওয়া হল সালকিয়ার এক বাড়িতে। টেলিফোনে প্রশান্ত নিজেই যখন এই খবর জানাল, তার বেশ কিছুক্ষণ আগেই কাগজ ছাপা শুরু হয়ে গেছে। ২৬ মার্চের আজকালে হেডিং ছিল: ‘প্রশান্ত কী করবেন?’ শেষ পর্যন্ত ওই দিনই মোহনবাগানে সই করল প্রশান্ত। এই তারিখটার কথাই ২৩ মার্চের আজকালে ছাপা হয়েছিল।

সই করার দিনই বিকেলে ময়দানে বাংলার ফুটবলারদের সংবর্ধনা জানাল একটি ক্লাব। কয়েক মিনিট থেকে চলে যেতে হল বাংলার অধিনায়ককে, পুলিস অফিসারদের পরামর্শে। রাতে আমাদের অফিসে টেলিফোন করে প্রশান্ত জানাল, পরদিন মোহনবাগানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কিছুটা পথ গাড়িতে গিয়ে বিকেলে খTপুরে বাংলা দলের সঙ্গে মিলিত হবে। ওই ট্রেনেই খTপুর পর্যন্ত গেল ফটোগ্রাফার এস এস কাঞ্জিলাল। ট্রেনের কামরার মুখে দাঁড়ানো প্রশান্তর ছবি পরদিনের আজকালে প্রকাশিতও হল। একটি দলবদলের কাহিনী যথাযথভাবে পেশ এবং শেষ করার আনন্দে আমরা সেই রাতে একটু বেশি ভাল করে ঘুমিয়েছিলাম।

চুরাশির দলবদলে আমরা কতখানি সতর্ক ছিলাম, তার উদাহরণ আরও আছে। দলবদল শুরু হওয়ার আগে প্রসূনের বৌভাতের অনুষ্ঠানে শ্যামের সঙ্গে দেখা। একপাশে দাঁড়িয়ে দু’জন খেতে খেতে কথা বলছিলাম। সহজে তো আর দেখা হয় না আজকাল, তাই কথা জমে থাকে। একবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করছ এবার? কোন টিমে খেলবে?’ শ্যাম বলল, ‘ইস্টবেঙ্গলে খেলব। অফিসিয়ালদের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওরা আমাকে প্লেয়ার-কাম-অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচ হিসেবে নিতে চায়। অমল দত্ত কোচ হচ্ছেন। পারফেক্ট জেন্টলম্যান, আমার কোনও অসুবিধা হবে না।’ গত বছর শ্যাম ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে পাকা কথা বলে ফেলেও শেষ পর্যন্ত মোহনবাগান ছাড়েনি। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু শ্যাম, তোমার ইস্টবেঙ্গলে যাওয়ার চান্স কত পার্সেন্ট?’ প্রশ্নটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি শ্যামের। হেসে আমার বুকে টোকা মেরে বলেছিল, ‘সেন্ট পার্সেন্ট।’

আমার বন্ধু শ্যাম থাপা এবং সেন্ট পার্সেন্ট— তবু খবরটাকে আমরা সম্ভাবনার স্তরেই রেখেছিলাম। আর কত সতর্ক হওয়া যায়?

শুধু সতর্ক থাকলেই তো চলে না, সজাগও থাকতে হয়। চুরাশির ফুটবল মরসুম শুরু হওয়ার সময় থেকেই আমরা সজাগ ছিলাম, গড়াপেটার গন্ধ পেলেই ছুটতে হবে। ময়দানের কয়েকজন ঝানু লোক খবর দিলেন, প্রথম দিকে গড়াপেটা হবে না। তিন-এক পয়েন্টের অঙ্ক বুঝতে সময় লাগবে। গড়াপেটার সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত, প্রথমদিকে স্ট্রেট খেলে যে যতটা পার পয়েন্ট তুলে নাও। তারপর, শেষের দিকে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

লিগ চালু হওয়ার দশ-বারো দিন পর আই এফ এ-র সহ-সম্পাদক আমাদের রিপোর্টার নির্মলকুমার সাহাকে জানালেন, ‘গাড়াপেটা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে!’ দু-একটা সূত্র দিলেন। খোঁজখবর নিয়ে তেমন কিছু কিন্তু পাওয়া গেল না। একটু হতাশ হলাম। পরে অবশ্য ব্যাপারটা ভেবে মনে মনে খুব হাসলাম যে খবরের কাগজে থাকতে থাকতে আমরা কী বিচিত্র বস্তুতে পরিণত হয়েছি! গড়াপেটা হচ্ছে না— এই ব্যাপারটায় আমরা কিনা হতাশ হলাম!

জুলাই মাসের মাঝামাঝি শোনা গেল, এবার গড়াপেটা শুরু হবে। খুব ভাল কথা, আমরাও প্রস্তুত, (এখানেও দেখুন, ‘গড়াপেটা শুরু হবে’— এটাকে ভাল কথা ভেবে ফেলেছি!) চুরাশির সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল লিগে প্রথম গড়াপেটা ম্যাচ খেলল উয়াড়ি ও ইস্টার্ন রেলওয়ে। উয়াড়ির অবস্থা কাহিল, বন্ধু ইস্টার্ন রেল তিন পয়েন্ট উপহার দিল। লস এঞ্জেলেস অলিম্পিক চলছে, মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে লিগ জেতা নিশ্চিত করে ফেলেছে, এই অবস্থায় ছোট ম্যাচের খবর কে রাখে? সরোজ কিন্তু সেদিন মাঠে হাজির ছিল, বিশেষ সূত্র থেকে খবর পেয়ে। আজকালে এই গড়াপেটার খবর ভাল করে ছাপা হল। পরদিন উয়াড়ির এক কর্মকর্তা সরোজকে বললেন, ‘আমরা জানতাম, আপনারা ছাপবেন না। কিন্তু, একটু হালকাভাবে লেখা যেত না? বুঝতেই তো পারছেন, আমাদের আর কোনও উপায় নেই।’

প্রায় এই সময়েই পোস্টকার্ডে টাইপ-করা একটি চিঠি হল। বক্তব্য: ‘ দ্বিতীয় ডিভিশন লিগে অনুশীলনী যথেচ্ছ গড়াপেটা ম্যাচ খেলেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওরা বিপক্ষ দলের ফুটবলারদের এবং রেফারিকে ‘ম্যানেজ’ করছে। আপনারা মাঠে এলে সব বুঝতে পারবেন। আমি জানি, কলকাতা মাঠের এই দুর্নীতিকে একমাত্র আপনারাই উচ্ছেদ করতে পারেন।’ চিঠির নিচে স্বাক্ষর— এস মেওয়ালাল। কিন্তু আমাদের সন্দেহ হল, এটা কি মেওয়ালের সই? সরোজ খবর নিল। সাহু মেওয়ালাল চিঠিটি দেখে অবাক: ‘আমি তো চিঠি লিখিনি।’

কিন্তু এরকম আরও চিঠি এল। স্পষ্ট অভিযোগ: পুলিস আর অনুশীলনী— দুটো টিমই দ্বিতীয় ডিভিশনে গড়াপেটার রাস্তায় যেতে চাইছে। ধীমান-নির্মল-অরূপ ব্যস্ত অলিম্পিকের খবর ধরে রাখায়, পল্লব বড় ম্যাচ এবং তিনটে ক্লাব টেন্টে যাতায়াতে, দেবাশিস-অরুণ পুজো সংখ্যার কাজে, রতন অসুস্থ— গড়াপেটার তদন্তের দায়িত্বটা একা সরোজকেই নিতে হল। অনুশীলনীর কর্মকর্তারা মাঠে আজকালের রিপোর্টারকে দেখেই বললেন, ‘আমরা সব স্ট্রেট ম্যাচ খেলছি।’ এই ম্যাচটায় খারাপ কিছু দেখাও গেল না। কিন্তু মাঠেই খবর পাওয়া গেল, অন্য কিছু ম্যাচে অনুশীলনী সোজা পথে হাঁটেনি। কিন্তু শোনা কথায় কতদূর এগনো যায়?

৬ আগস্ট, সোমবার বিকেলে ওয়াই এম সি এ মাঠে দ্বিতীয় ডিভিশন লিগের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলা— পুলিস বনাম অনুশীলনী। খেলায় কোনও টিমই জিতল না, কিন্তু পুলিসের সমর্থকরা অনুশীলনীর সেরা ফুটবলার প্রণব মণ্ডলের তলপেটে লাথি মারলেন, প্রণবের মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। এই সমর্থকরা যে তলপেটে লাথি মারায় বিশেষজ্ঞ তাতে আর সন্দেহ রইল না। প্রণব খেলা চলার সময়েই একবার মাঠের বাইরে ছিটকে পড়েছিল। নরখাদকেরা তাদের শিকারকে লাথি মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েই সন্তুষ্ট হয়েছিল, এটা হয়ত প্রণবের সৌভাগ্যই। অনুশীলনীর কোচও পুলিসের সমর্থকদের হাতে মার খেলেন। রেফারি প্রদীপ নাগকে শুধু প্রচুর গালিগালাজ দিয়েই ছেড়ে দেওয়া হল। দ্বিতীয় ডিভিশনের এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ সাধারণত ঘেরা মাঠেই দেওয়া হয়। তা হলে এভাবে হিংস্র হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। তিনটে বড় ম্যাচ উতরে যাওয়ার খুশিতে অশোক মিত্ররা এতই বিভোর ছিলেন যে ঘেরা মাঠের কথা খেয়াল ছিল না। কিন্তু মাঠে চারজন ঘোড়সওয়ার পুলিস ছিলেন, ছিলেন অন্তত চারজন জিপ-সওয়ার পুলিস অফিসার। সবার চোখের সামনেই এই ঘটনা ঘটল। সেই বিকেলেই, এই ঘটনাস্থল থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরেই স্টেট ট্রান্সপোর্ট টেন্টে বাংলার অতীত ও বর্তমানের ফুটবল নক্ষত্ররা সভায় বসেছিলেন, ফুটবলের উন্নতি এবং ফুটবলারদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে একটি সংগঠন করার জন্য!

একটি পয়েন্ট পাওয়াতেই পুলিসের প্রথম ডিভিশনে ওঠার পথ অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু, কলকাতার প্রায় সব কাগজেই এই নিষ্ঠুরতার খবর ছাপা হওয়ায় পুলিস কর্তারা অস্বস্তিতে পড়লেন। পুলিস ক্লাবের সভাপতি, ডি সি নর্থ প্রসূন মুখার্জি পরদিন আই এফ এ-র কাছে প্রকাশিত খবরের প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠালেন। প্রসূনবাবু টেলিফোনে আমাকেও বললেন, ‘মাঠে আমি নিজে ছিলাম, এত কিছু ঘটেনি। আমরা মাঠে না থাকলে ঘটনা নিশ্চয় খারাপ দিকে যেত। আমি একটা চিঠি পাঠালাম, ছাপলে ভাল হয়।’ ডি সি নর্থ-এর চিঠি নিয়ে এক ভদ্রলোক তখন বসে আছেন আমার ঘরে। চিঠির সারাংশ আমরা ছাপলাম, এটাই রীতি। কিন্তু সরোজ যে নিজে মাঠে হাজির ছিল? আমরা কী করে মেনে নেব যে কিছুই ঘটেনি?

৮ আগস্ট পুলিস আর অনুশীলনী খেলল যথাক্রমে সাদার্ন সমিতি আর ইয়ং বেঙ্গলের বিরুদ্ধে। ‘বিরুদ্ধে’ নয়— সঙ্গে। নির্লজ্জ গড়াপেটা, সাদার্ন সমিতি আর ইয়ং বেঙ্গলের ছেলেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হারল। দর্শকদের ব্যঙ্গবিদ্রুপে কোনও কাজ হল না, ততদিনে চামড়া অনেক মোটা হয়ে গেছে কিনা।

খেলার মাঠে ব্যক্তিত্ব যে দু-একজনের মধ্যে দেখছি তাঁদের মধ্যে একজনের নাম নিঃসন্দেহে কুমারেশ সেন, বেঙ্গল হকি অ্যাসোসিয়েশনের সচিব। তিরাশির হকি লিগের একটা ম্যাচে বেশ স্টিক চালাচালি হচ্ছিল। খেলার পরও তা চলছিল। এ-সব কাণ্ডকারখানার ছবি তুলে রাখছিল ফোটোগ্রাফার সুমন চট্টোপাধ্যায়। রেঞ্জার্সের এক ক্রুদ্ধ খেলোয়াড়, বাসুদেব ভট্টাচার্য, ছুটে এসে সুমনের ক্যামেরা কেড়ে নেয়, সুমনের মাথাও বাসুদেবের বিখ্যাত স্টিকের টার্গেট হয়। আহত ও অপমানিত সুমন মাঠ থেকে অফিসে এসে সব কথা জানায়। আমাদের হকির লোক নির্মলকুমার সাহা সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোনে কুমারেশ সেনকে ধরে ফেলে আমাকে লাইন দিল। ঘটনাটা বললাম। জানতে চাইলাম, ‘আপনারা কি কোনও অ্যাকশন নেবেন?’ কুমারেশবাবু একটুও না ভেবে বললেন, ‘নিশ্চয়ই নেব। আপনাদের ফটোগ্রাফারকে এখনই হেস্টিংস থানায় ডায়েরি করতে বলুন। যা ঘটেছে, সেজন্য বি এইচ এ-র পক্ষ থেকে আমি আপনার, আপনাদের ফটোগ্রাফার এবং আজকালের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। বাসুদেব এ বছর আর খেলতে পারবে না, এটা এখনই বলে দিতে পারি। চেষ্টা করব, যাতে ওকে দু-তিন বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়।’ তা-ই হল। তিন বছরের জন্য বাসুদেব ভট্টাচার্য সাসপেন্ড। কলকাতার হকিতে লাঠালাঠি যে সম্প্রতি কিছুটা কমেছে, তার কারণ বুঝতে অসুবিধে নেই। তবে, বি এইচ এ-সম্পাদকের কাছে অনুরোধ করলাম, সামনের মরসুমের আগেই যেন বাসুদেবের ওপর থেকে সাসপেনশন তুলে নেওয়া হয়। বেশ কয়েকটি ম্যাচে খেলতে না-পারাই আপাতত যথেষ্ট শাস্তি। তিন বছর খেলতে না পারলে বাসুদেব খেলাই ছেড়ে দিত। আমরা মাঠ থেকে খেলোয়াড়দের নয়, নোংরা কর্মকর্তাদের তাড়াতে চাই। এই ঘটনার পাশেও খবরের কাগজের হাস্যকর ভুলের একটা ছোট্ট গল্প আছে। আহত সুমন হাসপাতালে যাওয়ার সময় নেগেটিভ দেখিয়ে গেল, কোনটা বাসুদেব ভট্টাচার্যর ছবি। বুঝতে একটু ভুল হল আর-একজন ফটোগ্রাফারের। পরদিন আজকালে বাসুদেব ভট্টাচার্যর নামে যে ছবি ছাপা হল, আসলে তা রেঞ্জার্সের অন্য এক খেলোয়াড়— গ্যাব্রিয়েলের! ভুল সংশোধিত হল, কিন্তু ভুলের গল্পটা থেকে গেল।

২১ জুলাই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ শেষ হয়েছে। প্রেস বক্সের এক কোণে দাঁড়িয়ে পাইপ ধরিয়ে ধীমান-পল্লব-সরোজ-দেবাশিসের জন্য অপেক্ষা করছি। ‘দি হিন্দু’ ও ‘স্পোর্টস স্টার’ পত্রিকার অর্ণব ঘোষ এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ‘আমার নাম রঞ্জিত গুপ্ত, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব চালাই।’ দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ কথা হল। রঞ্জিতবাবু বললেন, ‘গত বছর আমার টিম অশোক মিত্রর ইন্টারন্যাশনালের কাছে আশি গোল খেয়েছিল। কিন্তু, বিশ্বাস করুন, বাজে লোকেদের এক্সপোজ করার জন্যই আমরা এত গোল খেতে রাজি হয়েছিলাম। জানতাম, এর ফলে তুমুল হইচই হবে এবং গড়াপেটা কমবে। আমি আপনার অফিসে গিয়েছিলাম একদিন, ছিলেন না। আমাকে ‘কুখ্যাত কর্মকর্তা’ বললেন আপনারা, খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। দু-দুবার মনের দুঃখে চিঠি লিখে তারপর ছিঁড়ে ফেলেছি।’

এই একটা ব্যাপার এখনও বুঝলাম না। ময়দানে কিছু ভাল লোক তো আছেনই। গড়াপেটার অনেক খবর আগেভাগে রটেও যায়। সব খবর আমাদের ছেলেদের সংগ্রহ করতে হয় কেন? এই সচেতন ব্যক্তিরা আমাদের সরাসরি সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন না কেন?

ময়দানের অনেকে বলেছেন, ‘আপনারা বালি প্রতিভার শ্যাম গাঙ্গুলিকে নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করেন!’ কেন করব না? আমরা লড়ছি নোংরা গড়াপেটার বিরুদ্ধে, আর এই একজন মানুষ অবনমনের ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করেও তাঁর সংগঠনকে গড়াপেটা থেকে মুক্ত রেখেছেন। আমাদের সংগ্রামের সবচয়ে বড় হাতিয়ার তো এই দৃষ্টান্তটিই, যার নাম বালি প্রতিভা, যার কর্ণধারের নাম শ্যাম গাঙ্গুলি। লোয়ার কোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট— তিন জায়গাতেই আই এফ এ-কে পর্যুদস্ত করে বালি প্রতিভা যখন দ্বিতীয় ডিভিশনে থেকে যাওয়ার রায় পেল, কেউ কেউ শা্যম গাঙ্গুলিকে ‘মামলাবাজ’ বলে কোণঠাসা করতে চাইলেন। চোর-ডাকাত-জালিয়াতের বিরুদ্ধেও মামলা করতে হয়। কিছু করার নেই। অশোক মিত্র খুব রেগে গেলেন। হাইকোর্টে হারার পর কয়েকদিন চুপচাপ থাকল আই এফ এ। শেষ পর্যন্ত অশোক মিত্র জানালেন, ১১ জুন গভর্নিং বডির সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, আই এফ এ সুপ্রিম কোর্টে যাবে কিনা। বালি প্রতিভা নিশ্চিত থাকবে, এদিকে এই ১১ জুনের আগেই সুপ্রিম কোর্টে চলে যাবে আই এফ এ। একতরফা শুনানির পর সুবিধাজনক আদেশ পেয়ে লিগ শেষ করবে আই এফ এ। দুর্দান্ত পরিকল্পনা। কিন্তু শ্যাম গাঙ্গুলি শুধু ভাল মানুষ নন, অশোক মিত্রর চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমানও। তিনি সুপ্রিম কোর্টে ‘ক্যাভিয়েট’ করে রেখেছিলেন, যাতে আই এফ এ মামলাটি ওখানে নিয়ে গেলেই খবর পাওয়া যায়। শ্যাম গাঙ্গুলি আমাদের অফিসে এসে জানালেন, ১১ জুন গভর্নিং বডির সভা, অথচ ওইদিন সকালেই সুপ্রিম কোর্টে মামলা উঠছে। সরোজ টেলিফোনে অশোক মিত্রকে সেই রাতেই বলল, ‘গভর্নিং বডির মিটিং না করেই সুপ্রিম কোর্টে চলে গেলেন!’ বিস্মিত, হতাশ ও ক্রুদ্ধ অশোক মিত্র প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘এ খবর কোথা থেকে পাওয়া গেল? আমি এখন কিছুই বলব না, যা বলার গভর্নিং বডির মিটিংয়ে বলব।’

আজকালের প্রতিবেদনে সংশয় প্রকাশ করা হল, গভর্নিং বডিতে একজনও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সদস্য আছেন কিনা, যিনি গভর্নিং বডিকে ডিঙিয়ে যাওয়া এবং অপমান করার এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাবেন। কেউ কেউ সামান্য প্রতিবাদ জানালেন ১১ জুনের সভায়। কিন্তু যে সদস্যটি সবচেয়ে বেশি হইচই করতে পারতেন, সেই ভূতনাথ বিশ্বাসকে সেদিনের সভাপতি বানিয়ে নীরব রাখা হল। পরে ভূতনাথবাবু ঘনিষ্ঠদের কাছে অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ‘কী করব, ওরা সবাই মিলে ধরল যে!’

শেষ পর্যন্ত বালি প্রতিভার সঙ্গে সমঝোতায় এসে আই এফ এ-কে মেনে নিতে হল, বালি প্রতিভা দ্বিতীয় ডিভিশনেই খেলবে। আদালতের অনুরোধে বালি প্রতিভা সে বছর না-খেলতে রাজি হল, লিগ শেষ করতে দেওয়ার কথা ভেবে। কিন্তু আদালত এই নির্দেশও স্পষ্টভাবে দিল যে, আই এফ এ শিল্ডে বালি প্রতিভাকে খেলতে দিতে হবে। ১১ জুন রাতে আমাদের অফিসে বসেই ট্রাঙ্ক টেলিফোনে আইনজীবী অমল গাঙ্গুলির সঙ্গে কথা বললেন শ্যাম গাঙ্গুলি। আমরাও কথা বললাম। অশোক মিত্র বললেন, বালিকে কিছুতেই আই এফ এ শিল্ডে নেওয়া হবে না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কপি পেয়ে অবশ্য সুবোধ বালকের মতো আদেশ মানতে হল। সর্বোচ্চ আদালতে বালি প্রতিভার এই ঐতিহাসিক জয়ের কাহিনীর মধ্যেও একটা ছোট্ট হাসির গল্প আছে। মামলার দেখাশোনা করার জন্য আই এফ এ দিল্লিতে পাঠিয়েছিল আর এক যুগ্ম সম্পাদক, এরিয়ানেরই বরুণ পালকে। বরুণবাবু কলকাতায় ফিরে খবর দেন: ‘মামলায় আমরাই জিতেছি।’

নকল মেওয়ালালের চিঠিতে ফিরে আসি। দু’বছর আগে হলে এই চিঠিটা পেয়েই আমরা হয়ত ছেপে দিতাম। এখন আমরা সতর্ক হয়েছি। মাঝে মধ্যে মনে হয় অভিজ্ঞতার আর এক নাম সতর্কতা।

আমার অন্তত একশো একটা দোষ আছে। কিন্তু কখনই নিজের লেখার ভক্ত নই। সম্পাদক হিসেবে নিজেকে মোটামুটি সফল বিবেচনা করি, বিনয়ের ভণ্ডামি করে লাভ নেই। কিন্তু লেখক হিসেবে আমি যে নিতান্তই সাধারণ তা নিয়ে কোনওরকম সংশয় কখনই ছিল না। খেলতে খেলতে একটা সেঞ্চুরি একদিন টেইলএন্ডারও করে ফেলে। তাই দু-একটা ভাল লেখা যদি লিখে ফেলে থাকি তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু, যে অর্থে মতি নন্দী বা সুপ্রিয় সেন ভাল লেখক, সেই অর্থে আমি ‘অলসো র্যান’ ছাড়া আবার কী?

ভালই ছিল ব্যাপারটা। নিজের কাছে ভাল লেখার প্রত্যাশা ছিল না। কাগজ চালানো ও লড়াই করার মধ্যে ডুবে থেকেছি। কিন্তু গণ্ডগোল বাধাল ‘হিং টিং ছট’। একদিন সুনীল গাভাসকার বলল, ‘তুমি যে ‘খেলা’য় ‘বাজিং অ্যারাউন্ড’-এর মতো মজার ফিচার কর, সেটা নাকি খুব ভাল হয়? অ্যান্টি-গাভাসকার কমিটি-টমিটি নিয়ে কীসব নাকি লিখেছ? কলকাতার কয়েকজনের চিঠিতে জানলাম। এবার যখন দেখা হবে পড়ে বুঝিয়ে দিও তো!’

গত বছর পুজোর পর সবে অফিসে বসেছি। আঠারো-উনিশ বছরের একটি ছেলে বিনা নোটিসে ঘরে ঢুকে পড়ে বলল, ‘আপনি স্পোর্টস লাইনে না থাকলে আমরা যে ‘হিং টিং ছট’ পাব না?’

বইমেলা শুরু হওয়ার মুখে সরোজ বলল, ‘অশোকদা তোমার নিজের উদ্যোগ নেই, কিন্তু ‘হিং টিং ছট’-এর একটা কালেকশন ছাপার ব্যবস্থা আমি করব।’

সরোজকে থামানো গেল। কিন্তু ক্ষেত্রনাথ রায়কে থামানো গেল না। প্রবীণ সাংবাদিক ‘ভারতবর্ষ’ থেকে ‘অমৃত’ বহু বছর ধরে খেলার লেখা লিখেছেন। একদিন সন্ধেয় অফিসে ঢুকে হিং টিং ছটের প্রশংসা করতে গিয়ে এমনও বলে ফেললেন, ‘রাজশেখর বসু বেঁচে থাকলে আপনাকে আশীর্বাদ করতেন। আপনি শুধু খেলার লেখা নয়, অন্য লেখাও লিখুন। জানেন তো সুবোধ ঘোষকে আমি আবিষ্কার করেছিলাম। কেউ প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি। ওঁর প্রথম বই আমিই পাবলিশ করেছিলাম। আমি বুঝি। আপনাকেও বলছি…।’

বয়স্ক মানুষ ভালবেসে গাধাকে ঘোড়া বলছেন। কিন্তু থামাই কী করে? তবে, এটুকু বোঝা গেল, হিং টিং ছট পড়ে ভদ্রলোক খুশি হন।

আজকালের প্রকাশক প্রতাপকুমার রায় সংবাদপত্র জগতের দিকপাল। একদিন ডেকে বললেন, ‘আমি তো জানতামই না যে ‘হিং টিং ছট’ তুমি লেখ। আমি তো খেলা-টেলা বুঝি না, তোমার ‘খেলা’য় এই একটা লেখাই পড়ি। এবার আমাকেও তোমার ফ্যান হয়ে যেতে হবে দেখছি!’

শ্যামল ব্যানার্জির বৌভাতের আসরে গেছি। এক তরুণ পাঠক, শ্যামলের বন্ধু, বলল, ‘লড়াই চালিয়ে যান অশোকদা, আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আর হ্যাঁ, আপনার ‘হিং টিং ছট’ দারুণ লাগে। ওটা কখনও বন্ধ করবেন না কিন্তু।’

কয়েকজন পাঠক নিয়মিত অনুযোগ করেন: ‘হিং টিং ছট প্রতি সংখ্যায় থাকে না কেন? না থাকলে ‘খেলা’ বয়কট করব।’ সুপ্রিয় সেন বললেন, ‘এই লেখাটাই সবার আগে পড়ি।’ সুরজিৎ সেনগুপ্ত, গোপাল বসু, অশোক ঘোষ— সবার মুখেই মাঝে মাঝে শুনি, ‘এবারের হিং টিং ছট-টা দারুণ হয়েছে।’ আমার সহকর্মীদের এই বিষয়ে গম্ভীর আলোচনা আমি একাধিকবার থামিয়ে দিয়েছি যে কোন ‘হিং টিং ছট’ এ পর্যন্ত সেরা।

কিন্তু এই সব শুনতে শুনতে সর্বনাশ হল এই যে আমি নিজেও ভেবে ফেললাম, ‘হিং টিং ছট’ বেশ ভাল লেখা হচ্ছে। আর অনেকের যখন এত ভাল লাগছে, সেই ভাল-লাগাটুকু বাঁচিয়ে রাখার একটা দায়িত্ব তো এসেই যায়। এই দায়িত্ব, বিশ্বাস করুন, কলমের ওপর বোঝা হয়ে বসল। এমনিতে ঘণ্টায় হাজার শব্দ লিখতে আমার অসুবিধে নেই। কিন্তু সে-সব তো ভাল লেখা নয়। ‘হিং টিং ছট’ যে ভাল লেখা, সবাই যে সেরকমই বলছে! সিদ্ধান্ত নিলাম, এত ভাল লেখা প্রতি সপ্তাহে লেখা সম্ভব নয়। এক সপ্তাহ অন্তর লেখা শুরু হল। তবু, বোঝা তো বোঝাই। দায়িত্বের বোঝা। আরোপিত ও অপাত্রে বর্ষিত সুনাম অক্ষুন্ন রাখার আশ্চর্য বোঝা। হয়ত একদিন মনে হবে ‘হিং টিং ছট’ আসলে এতই উৎকৃষ্ট লেখা যে আর লেখা উচিত নয়!

সহকর্মী অলক চট্টোপাধ্যায় একদিন বললেন, ‘আপনি ভুল করে দু-একটা লেখায় বাবুরাম সাপুড়েকে চিনিয়ে দিয়েছেন।’

আমার জবাব, ‘ভুল করে মোটেই নয়। এই একটা লেখার প্রশংসা সুধীজনেরা করছেন। আর এটা আমি সবাইকে জানিয়ে দেব না যে আমিই বাবুরাম সাপুড়ে? আমাকে কেন যে এত বোকা বা উদার ভাবলেন!’

চুরাশির ৯ আগস্ট সন্ধেয় মোহনবাগান-বাটা ম্যাচ কভার করে এসে পল্লব বলল, ‘অশোকদা, ওরা আমার মোটরবাইকে সবুজ রঙ লেপে দিয়েছে।’ কারা? কেন? আজকালে মোহনবাগান-স্পোর্টিং ইউনিয়ন লিগ ম্যাচের রিপোর্টে পল্লব লিখেছিল, ষাট মিনিটের পর স্পোর্টিং-এর লড়াইটা কেমন যেন মিইয়ে গেল। এই ম্যাচে শেষ দশ মিনিটে দু গোল পায় মোহনবাগান। এর পরেই বাটা ম্যাচ। খেলার পর মোহনবাগান টেন্টে ফুটবলারদের সঙ্গে কথা বলে চলে আসছিল পল্লব। বেশ কিছুদূর এসে ওর মনে পড়ে শৈলেন মান্নার সঙ্গে দেখা করা দরকার। ফিরে গিয়ে দেখে মান্নাদা নেই। কোনও ফুটবলারও নেই। কিন্তু তারা ছিল। প্রায় কুড়িজন মোহনবাগান সমর্থক যুবক পল্লবকে ঘিরে ধরে প্রথমেই প্রমাণ করে যে মোহনবাগান-সমর্থকদের সম্পর্কে এই অপবাদ সত্য নয় যে তারা ভাল গালাগালি করতে পারে না। তারপর আসল অভিযোগ, ‘আপনি কেন রিপোর্টে এসব কথা লিখেছেন? আপনি কি বলতে চান আমরা ম্যাচ ম্যানেজ করে লিগ নিচ্ছি।’ পল্লব জানায়, ‘আমি যা বলার ম্যাচ রিপোর্টেই বলেছি। ইচ্ছা হলে কাগজে প্রতিবাদপত্র পাঠাতে পারেন। গত বছর এইরকম একটা চিঠি আজকালে ছাপাও হয়েছিল।’ তারস্বরে আবার কিছু গালিগালাজ। শেষ পর্যন্ত মোহনবাগানের কোষাধ্যক্ষ কলকাতার প্রাক্তন মেয়র গোবিন্দ দে এসে এই অসাধারণ যুবকদের থামালেন। পল্লব মোহনবাগান লন থেকে বেরিয়ে এসে দেখে কে বা কারা মোটরবাইকে সবুজ রঙ লেপে দিয়েছে। মেরুনটা বোধহয় হাতের কাছে পাওয়া যায়নি। ওই যুবকদের আরও বক্তব্য ছিল, আজকাল ইস্টবেঙ্গলের কাগজ। তাই এই অপপ্রচার।

অধিকাংশ ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরও এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, আজকাল আসলে মোহনবাগানের কাগজ। নিশীথ ঘোষ আর তাঁর দলবল যথাসাধ্য রটিয়েছেন ইস্টবেঙ্গল টিম ভাঙাই আমার এবং আমার টিমের প্রধান কাজ। ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে লেখায় তাঁরা রটালেন আমরা মোহনবাগান-সমর্থক। অথচ ওই ঊনআশিতেই মহামেডান স্পোর্টিংয়ের সহকারী সম্পাদক হায়দার আলি নস্কর বলেন, ‘আপনি আসলে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে পছন্দ করেন। তাই ওদের দোষত্রুটি নিয়ে লিখে ক্লাবটার ভাল করতে চাইছেন।’ আর মোহনবাগানের এক প্রাক্তন কর্মকর্তা আমাদের অফিসে এসে মাঝে মাঝেই বুঝিয়ে যেতেন, আমরা ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক বলেই মোহনবাগানের ভেতরের দুর্নীতির কথা লিখছি না। শুধু ইস্টবেঙ্গল নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছি। ভেবে দেখুন, একই কারণে ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তাদের অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমরা ইস্টবেঙ্গলের শত্রু এবং সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছি! তিরাশিতে প্রথা অনুযায়ী প্রথম বড় ম্যাচ মহমেডান স্পোর্টিংয়ের খেলার কথা ছিল না। যতীন চক্রবর্তী আর সুভাষ চক্রবর্তীর মদতে আই এফ এ ব্যাপারটা চাপিয়ে দিল। প্রতিবাদে মহমেডান বড় ম্যাচ খেলতে অস্বীকার করল। আমরা এক্ষেত্রে মহমেডান স্পোর্টিংকে সমর্থন এবং আই এফ এ-কে ধিক্কার জানাতে দ্বিধা করিনি। মহমেডান স্পোর্টিংয়ের অনেক সমর্থক আমাদের অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু, অন্য দুই বড় ক্লাবের কিছু সমর্থক প্রচণ্ড চটে ছিলেন। একটি চিঠির বক্তব্য আমি জীবনে ভুলব না: ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দালালি করে কাগজ চালানো যায় না, এটা মনে রাখবেন!’ মনে রেখেছি। খেলাধুলোর জগতে আমি তাঁদেরই সংখ্যালঘু মনে করি, যাঁরা নিজেদের মন সঙ্কীর্ণতার পঙ্কে নিমজ্জিত রাখেন। এই সংখ্যালঘুদের দালালি আমরা করি না।

বাইরে থেকে দেখে হয়ত বোঝা কঠিন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, খবরের কাগজ বা খেলার পত্রিকার পেশায় থাকলে কোনও বড় ক্লাবের প্রতি মোহ বা টান আর থাকে না। আমাদের টিমের দুজনের কথা বলতে পারি যারা বছর পাঁচেক আগে পর্যন্ত ছিল বড় ক্লাবের উগ্র সমর্থক। প্রেস বক্সের সামনে মোহনবাগান সদস্য গ্যালারির সবচেয়ে সরব অংশে ছিল ধীমান দত্তর স্থায়ী আসন। আর ইস্টবেঙ্গল হারলে এক সপ্তাহ মনমরা হয়ে থাকত রতন ভট্টাচার্য। এখন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের হারজিতে কিছুই এসে যায় না। চোখের সামনে এই পরিবর্তন দেখলাম। তাহলে কি সাংবাদিকদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে কোনও বড় ক্লাবের তীব্র সমর্থক? আছে। কিন্তু যারা এই ক্রীড়া-সাংবাদিকতার পেশা ও নেশায় ডুবে যেতে চায়, তাদের পক্ষে কোনও বিশেষ ক্লাবের প্রতি পক্ষপাত বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব।

নিশীথ ঘোষের কিছু অনুচর রটাতেন, আমি বা আমরা তাঁদের গ্রুপের শত্রু। ডাঃ নৃপেন দাসের অনুগামী হিসেবে যাঁরা পরিচিত, আমি তাঁদেরই ‘লোক’। বিশেষ সভায় সদস্যদের অনাস্থা ভোটে অপসারিত হলেন নিশীথ ঘোষ এবং নির্বাচনের আগে দু’মাসের জন্য ক্লাব পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন দেবপ্রসাদ বসু। সেই সঙ্গে যাঁরা ক্ষমতায় এলেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন ডাক্তার নৃপেন দাসের অনুগামীরা। এঁদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে আমার সম্পর্ককে অবশ্যই ঘনিষ্ঠ বলা যেত। এঁরা ক্ষমতায় আসার কয়েকদিন পরেই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ। ক্লাব নির্বাচনের দিক দিয়ে এই ম্যাচের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বিরোধীরা গত কয়েক বছর ধরে বলে এসেছেন, টিম চালানোর ক্ষমতা নিশীথ ঘোষের নেই। তাই ভাল টিম নিয়েও ইস্টবেঙ্গল সাফল্য পায়নি। এবারের মোহনবাগান ম্যাচটা জিতলে ব্যাপারটা হাতেনাতে প্রমাণ করা যেত। কিন্তু বাবু মানি খুব ভাল গোল করে ফেলল। বিকাশ জীবনের সেরা ম্যাচ খেলে ফেলল। চোট নিয়েও সুব্রত অসাধারণ হয়ে উঠল। এমনকি ফর্ম-হারানো প্রশান্তও মাঝমাঠে হেলায় কর্তৃত্ব করল। আর গোটা ইস্টবেঙ্গল টিম ব্যর্থ। ফুটবলে মাঝে মাঝে এমন হয়। এবং হার মেনে নিতেও জানতে হয়। কিন্তু, এটা তো শুধু একটা ম্যাচ হারা বা একটা লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ হারানো নয়, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে কর্তৃত্ব করার সোনার সুযোগ নষ্টের আশঙ্কা। তাই ডাঃ দাসের অনুগামী হিসেবে পরিচিত কেউ কেউ উচ্চকণ্ঠে প্রচারে নামলেন, মনোরঞ্জন-তরুণ-মিহির-কার্তিক-বিশ্বজিৎ ইচ্ছে করে ভাল খেলেনি। কিছু অসভ্য সমর্থককে লেলিয়ে দেওয়া হল ফুটবলারদের বিরুদ্ধে। ড্রেসিংরুমের মধ্যেই অকথ্য গালিগালাজ শুরু হল। একজন ফুটবলার সবে খাবারের প্লেট হাতে নিয়েছে, পাশ থেকে বলা হল, কুকুর তো, তাই এত বাজে খেলার পরও খাচ্ছে!

নিশীথ ঘোষ, তাঁর অন্ধ অনুগামীরা, ময়দানের কিছু ঘুঘু, নিশীথ ঘোষের বিরোধীরা, এমনকি দু-একজন ফুটবলারও নিশ্চিত জানতেন, এক্ষেত্রে আমরা মুখ খুলব না। আমরা হলাম ডাঃ দাসের অনুগামীদের বন্ধু, আমরা কখনও ওদের বিরুদ্ধে লিখতে পারি? লিখলাম। বেশ জোরের সঙ্গেই। ফুটবলারদের বিরুদ্ধে এই চক্রান্তের প্রতিবাদে আজকালে দুটি দুর্ধর্ষ রচনা এল, তুলসীদাস বলরাম ও সুরজিৎ সেনগুপ্তর কাছ থেকে। তরুণ আর মনোরঞ্জনের ক্ষুব্ধ বিবৃতি প্রকাশিত হল। আমরা ঘোষণা করলাম, অন্য ফুটবলাররা এই পাঁচজনের পাশে থাকুক বা না-থাকুক, আমরা থাকব। যেভাবে থাকতে হয়, সেভাবেই থাকব। শেষ পর্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে পশ্চাদপসরণ করলেন কর্মকর্তারা। ফুটবল সাব-কমিটির দুই সদস্য বিবৃতি দিলেন, ‘কই, এমন কথা তো ক্লাবের পক্ষ থেকে বলা হয়নি!’ তাহলে আনন্দবাজার পত্রিকায় তরুণ-দের বিরুদ্ধে নোংরা অভিযোগ ছাপার ব্যবস্থা কে করেছিল? ফুটবলারদের দিয়ে বলাব নাকি, কে কে ড্রেসিংরুমের মধ্যে কুৎসিত ভাষায় ফুটবলারদের আক্রমণ করেছিল? ইস্টবেঙ্গল-মহমেডান ম্যাচের পরদিন ইস্টবেঙ্গলের এক সিনিয়র ফুটবলার বলে গেল, ‘অশোকদা, এতদিন পর্যন্ত আমার সামান্য সন্দেহ ছিল। এখন আর একটুও সন্দেহ নেই, আপনারা সত্যিই ফুটবলারদের ভালবাসেন। অসময়ে পাশে থাকেন।’

দুঃখের কথা একটাই, এই সার্টিফিকেটটা পাওয়ার জন্য আমাদের উনিশশো চুরাশির ৩০ জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল!

তিন বড় ক্লাবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ক্রীড়ানুরাগীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য আজকালে একটি ধারাবাহিক রচনা শুরু করি। লেখাটি প্রকাশিত হয় দশ কিস্তিতে। কেন হঠাৎ আজকালে কর্মকর্তাদের নিয়ে টানাটানি করতে হল? আপনারা জানেন, শিবাজি ব্যানার্জিকে নিয়ে মোহনবাগান কর্মকর্তাদের বিশেষত ধীরেন দে-র বিরুদ্ধে লড়াই চলছিল ‘খেলা’য়। প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়ে যাচ্ছিলেন মোহনবাগান সম্পাদক এবং অন্য কর্মকর্তারা, সাধারণ সদস্য-সমর্থকরাও শিবাজির পক্ষে সরব হতে শুরু করেছিলেন। শুধু আমাদের কাগজের অফিসে নয়, মোহনবাগান টেন্টেও পৌঁছোচ্ছিল ক্ষুব্ধ সমর্থকদের চিঠি। কিন্তু, আমার মনে হল, একটা চূড়ান্ত ধাক্কা দেওয়া দরকার। ‘খেলা’র আক্রমণ সামলানোর জন্য সপ্তাহের বাকি ছটি দিন পাওয়া যায়। কিন্তু আজকালে যদি পরপর কয়েকদিন ধাক্কা দেওয়া যায়, ফল ফলতে বাধ্য। হিসেবে ভুল হয়নি। ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তাদের ‘গুণকীর্তন’ করার পর মোহনবাগান এবং ধীরেন দে-তে পৌঁছোতেই টনক নড়ল। এবং ‘মৌচাকে ঢিল’-এর একটি কিস্তি এইভাবে শেষ হল : ‘কেমন মানুষ ধীরেন দে? কীভাবে তিনি এতকাল মোহনবাগান ক্লাবের মতো একটি ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠানে প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছেন। অতঃপর সেই প্রসঙ্গে ঢুকব।’

মোহনবাগান সম্পাদকের ‘কানেকশনস’ যে কত বহুমুখী এবং গুরুত্বপূর্ণ, তা সেই দিন থেকেই স্পষ্ট হল। একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি অনুরোধ করলেন, আমি যেন অবিলম্বে ধীরেন দে-র সঙ্গে আলোচনায় বসি।

এই অনুরোধ কিন্তু প্রথম এসেছিল অনেক আগে। ফেডারেশন কাপ তখনও শুরু হয়নি। প্রশান্তর বৌভাতের অনুষ্ঠানে কথা বলছি চুনী গোস্বামী আর প্রদীপ চৌধুরির সঙ্গে। আমার পাশেই ছিল শিবাজি। কিছুক্ষণ পর ‘খেলার আসর’ সম্পাদক অতুল মুখার্জির সঙ্গে দেখা। বললেন, ‘অশোক, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আমি অপেক্ষা করছি।’ ঘণ্টাখানেক পর অতুলদার সঙ্গে কথা হল। বললেন, ‘তোমাকে একটা রবিবার সকালে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’

‘কোথায়?’

‘এখন বলব না। এটা তো জানোই যে আমি তোমার ওয়েল উইশার। খারাপ জায়গায় নিশ্চয় নিয়ে যাব না। এটুকু বলছি, এক ভদ্রলোকের কাছে নিয়ে যাব।’

‘কে? নাম না জানলে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবব কী করে?’

অতুলদা বললেন, ‘ধীরেন দে! তোমার অস্বস্তির কিছু নেই। উনি শুধু তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান। আমি একদিন একটা কাজে গিয়েছিলাম। তোমার কথা উঠল। ধীরেন দে-র সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা নেই। বলতে পার, ‘ভাল পরিচয়’ আছে। অনেক বয়স হল ভদ্রলোকের, এই ধরনের লোকেরা একে একে চলেও যাচ্ছেন। একবার দেখা করোই না, অভিজ্ঞতা হবে। বিশেষ কোনও প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হবে না, শুধু একটু আলাপ-পরিচয়।’

‘কিন্তু শিবাজিকে নিয়ে ধীরেন দে এবং মোহনবাগান ক্লাবের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলছে। এটা আলাপ-পরিচয়ের উপযুক্ত সময় নয়। তা ছাড়া আমি কোনও কর্মকর্তার বাড়িতে যাই না।’

‘ভেবে দেখ অশোক।’

দিন তিনেক পর অতুলদাকে টেলিফোন করে জানালাম, ধীরেন দে-র সঙ্গে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অতুলদা আবার ভেবে দেখতে বললেন। তারপর, ‘মৌচাকে ঢিল’। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনুরোধ। শেষ পর্যন্ত বেঙ্গল ক্লাবে চায়ের নেমন্তন্ন।

রিসেপশনে অপেক্ষা করছিলেন ধীরেন দে, আমার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে গিয়েছিল দেবাশিস। ধীরেন দে বললেন, ‘একা একা কথা হলেই ভাল হয়।’ দেবাশিস গাড়িতে থাকল। এক ঘণ্টা পরেও আমাকে বেরোতে না দেখে দেবাশিস উদ্বিগ্ন হয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে— গুম করে ফেলা হল নাকি!

ওপরের বাতানুকূল ঘরে বিশাল সোফায় বসতে বসতে ধীরেন দে বললেন, ‘আমার বয়স তোমার ডবলের বেশি। তাই ‘তুমি’ বলছি কিন্তু।’

মানুষটা সত্যিই ইন্টারেস্টিং। প্রথম কুড়ি মিনিট জানালেন, কীভাবে ‘দেজ মেডিকেল’ দাঁড় করিয়েছেন ভাইয়েরা মিলে। কী করে জড়িয়ে গেছেন মোহনবাগান ক্লাবের সঙ্গে। মোহনবাগান ক্লাব কেন অন্য সব ক্লাবের চেয়ে আলাদা। আমিও একইভাবে মিনিট দশেক সময় নিলাম। ফুটবলাররা নির্দোষ, এ কথা তিনি মানলেন না। বিভিন্ন ফুটবলার সম্পর্কে মতামত স্পষ্টভাবেই জানালেন। কিন্তু তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের দাবি কী? আমি বললাম, ‘বারবার এ কথা লিখেছি, শিবাজি ব্যানার্জিকে ফিরিয়ে নিতে হবে।’ ধীরেন দে বললেন, ‘বেশ আমি তার ব্যবস্থা করব। তবে এ কথা এখনই ছেপে দিও না।’ ঠাট্টা-তামাশাও করলেন। একবার জানতে চাইলেন, ধীরেন দে-র পর আমার টার্গেট কে? বললেন, ‘মোহনবাগান বেস্ট টিম নাও হতে পারে, কিন্তু মোহনবাগান বেস্ট ক্লাব এটা মানতেই হবে।’ বললেন, ‘বাঙালি অথচ ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের সাপোর্টার নয়— এটা খুব খারাপ জিনিস। দুটোর মধ্যে একটা ক্লাবকে ভালবাসা অবশ্যই উচিত। মহমেডান স্পোর্টিং? ওটা বাজে!’

দু-তিন দিন পর সকালে টেলিফোন ধরে অপারেটরের কাছে শুনলাম, ‘একটা ডেথ নিউজ আছে। কথা বলুন।’ পরে শুনলাম, অনেক চেষ্টা করেও লাইন না পেয়ে ‘ওয়ান ডাবল নাইন’কে ধীরেন দে বলেছিলেন, ‘ডেথ নিউজ আছে, এই লাইনটা দিতেই হবে।’ এই অবস্থায় কোনওরকমে লাইনটা ধরে দিয়েছিল ‘ওয়ান ডাবল নাইন’। ধীরেন দে বললেন, ‘আজই সন্ধেয় একবার বেঙ্গল ক্লাবে এসো, খুব দরকার।’

‘কেন?’

‘বলছি তো খুব দরকার। জরুরি ব্যাপার। ডিনার আমার সঙ্গেই করবে কিন্তু।’

‘না। অন্য কাজ আছে। তবে একবার আসছি আটটা নাগাদ।’

ধীরেন দে জানালেন, ‘আজকাল আর খেলায় মোহনবাগান ক্লাব নিয়ে লেখালেখির সুযোগ নিচ্ছে ক্লাবের কিছু বিক্ষুব্ধ সদস্য। ওরা কোর্টে এমন সব কথা বলছে আজকাল আর খেলাকে কোট করে যে আমাদের সোমনাথ চ্যাটার্জি খুব রেগেছেন। বলছেন, একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। তুমি একটু সাবধানে থেকো। মোহনবাগান সেক্রেটারি হিসেবে এই কথাটা তোমাকে আমার বলা উচিত নয়। বলছি ওয়েল উইশার হিসেবে।’

আমি বলেছিলাম, ‘ধন্যবাদ। কিন্তু এই খবরটা আমাকে দিয়ে আপনি মোহনবাগানের কোনও ক্ষতি করেননি, আমারও কোনও উপকার করেননি। সোমনাথ চ্যাটার্জি আপনার ক্লাবের একজিকিউটিভ কমিটির মেম্বার, বড় ব্যারিস্টার। তিনি আইনের পথে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ-সব সম্ভাবনার কথা মনে রেখেই লিখি। এবং লিখব।’

আশ্বাসের ভঙ্গিতে ধীরেন দে বললেন, ‘না-না, ও-সব কিছু হবে না। আমি শুধু তোমাকে একটু কশাস থাকতে বলছিলাম।’

তারপর জানালেন, ‘খেলানো না-খেলানো কোচের ব্যাপার, তবে আমি শিবাজিকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করব। আর লিখবে না তো?’

‘লিখব। আবার যদি অন্যায় করেন।’

‘আমি শুধু অন্যায়ই করি! যত অন্যায় সব আমি করি। তুমি কবে আমার সঙ্গে ডিনার করছ, বলো?’

‘আগে শিবাজিকে ফিরিয়ে নিন।’

‘উঃ শিবাজি, শিবাজি আর শিবাজি। দেখতে সুন্দর বলে ওকে সাপোর্ট করতে হবে? যাকগে কবে আসছ?’

‘আগে শিবাজি প্র্যাকটিসে নামুক। তার পর আমিই আপনাকে ফোন করব।’

‘তুমি করবে না।’

‘সত্যি করব।’

না, এই টেলিফোনটাও করা হয়নি। যতটুকু না করলে নয়, ততটুকুই হয়। আর কিছুই করা হয় না। সেই রাতে এক সঙ্গে নিচে নেমে যে যার গাড়িতে উঠেছিলাম। আর কখনও ধীরেন দে-র সঙ্গে দেখা হয়নি।

রাত দশটা। এয়ারপোর্টে এত সিকিউরিটির কড়াকড়ি কেন? গম্ভীর পুলিস অফিসার জানালেন, কপিলদেব আসছেন দিল্লি ফ্লাইটে।’

অ!

দিল্লি ফ্লাইটে আমাদেরও একজন অতিথির আসার কথা এবং তাঁর নাম কপিলদেব। ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম টেস্ট কানপুরে। তার আগে কলকাতায় এসেছে সানি গাভাসকার, ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার’ পত্রিকার কাজে। পরদিন ও চলে যাবে কানপুর, তাই সারাদিন আমরা আলোচনায় কাটিয়েছি আজকাল আর গ্র্যান্ডে। তার পর এয়ারপোর্ট। পুলিস অফিসারটিকে আমরা কিছু বললাম না। দেবাশিস আর পল্লব অ্যারাইভ্যাল লাউঞ্জে ঢুকে পড়েছে। অলক চট্টোপাধ্যায় পুলিস অফিসারের কাছে প্রায় করজোড়ে নিবেদন করলেন: ‘একবার কপিলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতাম, এমন একটা চান্স…’ পুলিস অফিসার আরও গম্ভীর হলেন : ‘সম্ভব নয়।’ আমি অলক চট্টোপাধ্যায়কে বললাম, ‘ইস, আপনার সাহস তো কম নয়।’ আমরা দুজন পরিচয় না দিলেও পল্লব আর দেবাশিস সদর্পে প্রেস কার্ড দেখাল। পুলিস অফিসার বললেন, ‘কপিলদেব আসছেন ব্যক্তিগত কাজে, ওঁকে এয়ারপোর্ট হোটেলে তুলে দেওয়াই আমার কাজ। খবরের কাগজের লোকের এখন বিরক্ত না করাই ভাল। আর কোনও কাগজ তো আসেনি, আপনারা কেন?’

দিল্লির বিমান পৌঁছোল পৌনে এগারোটা নাগাদ। ফিল্ড মার্শাল মানেকশ বেরোলেন, কেউ লক্ষ্যই করল না। কপিলদেব আসছেন যে! বাইরে পুলিসের গাড়ি প্রস্তুত, কপিলকে এয়ারপোর্ট হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পুলিস অফিসার বেশ টেনশনে, বিশ্ববিজয়ী অধিনায়কের সঙ্গে কীভাবে কথা বলবেন। কপিলদেব এলেন এবং পল্লবকে দেখেই বললেন, ‘তোমার এডিটর কোথায়?’ শান্তি সেন ছবি তুলতে যেতেই বললেন, ‘আমার অ্যালবাম কোথায়?’ দেবাশিসের পিঠ চাপড়ে অলক চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে হ্যান্ডশেক (এমন একটা চান্স!) করে কপিলদেব যখন আমার সঙ্গে আজকালের গাড়ির দিকে এগোলেন, পুলিস অফিসারের মরিয়া আর্তনাদ শোনা গেল: ‘স্যার আমার ডিউটি ছিল…।’ আমরা নিষ্ঠুর নই। কপিলদেবকে অনুরোধ করলাম, অফিসারের সঙ্গে একবার হ্যান্ডশেক করতে। এমন একটা চান্স!

গাড়িতে উঠেই কপিল বলল, ‘কাল ভোর পাঁচটায় ফ্লাইট। আজ সারা রাত তোমাদের সঙ্গে কথা বলব। দি নাইট ইজ ইয়াং।’

কী কথা বলবেন? বিশ্ববিজয়ী কপিল যখন তুমুল অভিনন্দনের মধ্যে চণ্ডীগড়ে ফিরেছিলেন, সঙ্গী ছিল পল্লব আর শান্তি সেন। কপিলের মায়ের হাতের উপাদেয় আলু-পরোটাতে অভিভূত না হয়ে পল্লব যতটা পারে কাজের কথা সেরেছিল। কপিলদেব জানিয়েছিলেন, তিনি আমাদের কাগজে লিখতে রাজি। প্রুডেনশিয়াল কাপে ম্যাচ-রিপোর্ট করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীর হয়ে, তাই পল্লবের খবর বা আশ্বাসে আমাদের সংশয় ছিল। পাকিস্তানের সফরের আগেও আমরা যোগাযোগ করতে পারিনি। ভারত-পাকিস্তান সিরিজ শুরু হওয়ার মুখে ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড ঘোষণা করল, ভারতীয় দলের কোনও ক্রিকেটার ম্যাচ-রিপোর্ট করতে পারবে না। কপিলদেব প্রথমে সেই নির্দেশ অমান্য করার দিকে গেলেন। এমনও বললেন যে, তিনি টিমের বাইরে যেতে রাজি, তবু লিখবেন! শেষ পর্যন্ত বোর্ড প্রেসিডেন্ট সালভে বোঝালেন, অধিনায়কের কিছু লেখা উচিত নয়।

ভারত-পাকিস্তান সিরিজের রিপোর্ট আজকালে করল সানি গাভাসকার। বাঙ্গালোরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টের রিপোর্ট করবেন বিশ্বনাথ— এই ঘোষণা ‘দি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় দেখে আমরা বিস্মিত ও হতাশ হয়েছিলাম। বিশ্বনাথকে আমরা পাচ্ছি না, এটা ভাবতেই খারাপ লাগছিল। বাঙ্গালোরে টেস্ট কভার করতে গিয়েছিলেন অলক চট্টোপাধ্যায়। সানির সহায়তায় ভিশিকে অবশ্য আজকালে লিখতে রাজি করানো হল।

কিন্তু, কপিল তো বোর্ড প্রেসিডেন্টকে কথা দিয়ে ফেলেছেন, ম্যাচ-রিপোর্ট করবেন না, এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউও দেবেন না — ম্যাচ চলার সময়ে। জলন্ধর আর নাগপুরে পল্লব কথাবার্তা বলল এবং কলকাতায় ফিরে জানাল, ‘কপিল আমাদের হাউস থেকে অটোবায়োগ্রাফি প্রকাশ করতে চায়। ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারটাও হয়ত অসম্ভব নয়।’

দিল্লিতে কপিলদেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দেওয়া হল। সানিও তখন কলকাতায় আমাদের অতিথি, ও বলে রেখেছিল, কপিল আমাদের কাগজের সঙ্গে এলে খুবই ভাল হয়। রাতে আলোচনার সময়ে দরকার হলে আমরা যেন গ্র্যান্ডে টেলিফোন করি।

হোটেলে পৌঁছেই কপিল ঘরোয়া হয়ে গেলেন। লুঙ্গি, খালি গা, হাতে গ্লাস— দুধের। ওই ছোট্ট ঘরে কপিল ছাড়া আমরা দশজন। সিগারেটের ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে। কপিলদেব বললেন, ‘এবার তাহলে কথাবার্তা শুরু হোক।’ কিন্তু প্রথমেই কি কাজের কথা তোলা যায়? আমাদের ওয়ার্কস ম্যানেজার ঘোর ক্রিকেট-প্রেমিক, জানতে চাইলেন, ‘প্রুডেনশিয়াল কাপে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ওই ‘আউট অফ দিস ওয়ার্ল্ড’ ইনিংসটা খেলার সময় আপনার মানসিক অবস্থা কীরকম ছিল? — শুরুতে এবং পরের দিকে?’ তারপর প্রশ্নের ব্রিগেড: ‘এখন দুনিয়ার সেরা ফাস্ট বোলার কে? সেরা স্পিনার? সানি গাভাসকার কেন প্রডেনশিয়াল কাপে রান পেলেন না? আপনি জলন্ধর টেলিভিশনে লালা অমরনাথের সঙ্গে এভাবে তর্কযুদ্ধে গেলেন কেন? এখন দুনিয়ার সেরা অলরাউন্ডার কে? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা টেস্টেও জিততে পারলেন না কেন?…’ এইরকম আরও। রাত সওয়া বারোটায় কপিল আর-একবার বললেন, ‘এবার তাহলে কাজের কথা শুরু হোক!’

কপিল জানালেন, অটোবায়োগ্রাফি পঁচাশির শুরুতেই প্রকাশ করতে চান। দিল্লিতে এক পাবলিশারের সঙ্গে কথা হয়েছে, কিন্তু ওদের প্রস্তাব তাঁর পছন্দ নয়। আমরা বললাম, খেলার বই প্রকাশের দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও, এখনও আমরা তেমন প্রস্তুত নই। তবু চেষ্টা করা যেতে পারে। আমার দুটি প্রস্তাব কপিলের পছন্দ হল। এক, প্রুডেনশিয়াল কাপের আগেই প্রথম বইটা থেমে যাবে, বিশ্ববিজয় নিয়ে তৈরি হবে দ্বিতীয় বই। এবং দুই, কপিলের প্রথম অটোবায়োগ্রাফির নাম হবে— ‘টু থাউজ্যান্ড অ্যান্ড টু হানড্রেড’।

এবার আসল কথা, টাকার কথা। আমরা শতকরা কুড়ি ভাগ রয়্যালটি দিতে চাইলাম, যা অন্য অনেক প্রকাশকের চেয়ে বেশি। কপিল বললেন, ‘আমাকে ফাইভ পার্সেন্ট রয়্যালটি দাও ক্ষতি নেই, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই থোক টাকা হাতে দিতে হবে— যাতে আমি কোথাও ইনভেস্ট করতে পারি। বই বেরোবে, অল্প অল্প করে রয়্যালটি পাব, তাতে আমার কোনও লাভ নেই।’ আমরা জানালাম, এই প্রস্তাবে এখনই ‘হ্যাঁ’ বলা অসম্ভব। মাস তিনেক পর আমাদের সিদ্ধান্ত জানাব।

এবার ইন্টারভিউ প্রসঙ্গ। আমাদের কাছে এটাই আসল প্রসঙ্গ। গাভাসকার যেহেতু আমাদের লোক, কপিল অধিনায়ক হওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন, ভারতীয় ক্রিকেট শিবিরে আমরা অসহায় হয়ে পড়ব। কিরমানি, মদনলাল, বিনি, পাটিল, শাস্ত্রীরা সব সময়েই আমাদের কাছাকাছি ছিলেন। তবু চোখ ছিল কপিলদেবের দিকে। কপিলদেবকে আমাদের কাগজের সঙ্গে যুক্ত করতে পারা যাবে না? ওই রাতে দুঃখিত কপিলদেব জানালেন, ‘আপনাদের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছাও আছে, কিন্তু আমাকে তো ম্যাচ চলার সময় ইন্টারভিউ দিতেও বারণ করেছে।’ বোঝালাম, টিমের ক্যাপ্টেন তো ইন্টারভিউ দিতেই পারে। আমরা তো প্রচার করছি না যে এটা এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ। কপিলদেব বুঝলেন। মাদ্রাজে শেষ টেস্ট শুরু হওয়ার আগে কয়েকজন সাংবাদিক অন্য দুজন ক্রিকেটারকে তাতালেন; কপিল কী করে ডেইলি পেপারে ম্যাচের সময় ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছে? টেস্ট শুরু হওয়ার ঠিক আগে কপিলদেব জানালেন, এবার আর ইন্টারভিউ দেওয়া সম্ভব হবে না। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় মাদ্রাজ থেকে হতাশ অলক চট্টোপাধ্যায়ের টেলিফোন; ‘কী করব?’ — ‘কী আর করবেন, ওকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। বলুন এই টেস্টে ইন্টারভিউ না দিলে মেনে নেওয়া হবে যে আগের পাঁচটা টেস্টে কপিলদেব অন্যায় করেছেন। পাঠক-পাঠিকাদের প্রত্যাশার কথাও বলুন।’

ঘণ্টা তিনেক পরেই অলক চট্টোপাধ্যায় জানালেন, ‘কপিলের কপি পাঠাচ্ছি। রাজি করানো গেছে।’

শুধু কপিলদেব নয়, মহিন্দার অমরনাথের সঙ্গেও আমাদের কথাবার্তা এগিয়েছিল। কপিলদেব আর ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে চুক্তি হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত মহিন্দারের ব্যাপারটা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাইনি। চুরাশির ফেব্রুয়ারিতে ‘অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট লাইফ স্টাইল’ পত্রিকার সম্পাদক পিটার মারে একটি চিঠিতে জানিয়েছেন, মহিন্দারের অটোবায়োগ্রাফি তিনিই তৈরি করে দিচ্ছেন। ভারতে আমরা প্রকাশের দায়িত্ব নিতে রাজি কিনা? তাঁর আশা, ভারতে এই আত্মজীবনী ‘সানি ডেজ’-এর মতোই বিক্রি হবে। আত্মজীবনীর ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছেন কিরমানি, বেঙ্গসরকার এবং সোলকারও। কিন্তু আমরা প্রস্তুত নই।

ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজে নিয়মিত এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন কপিলদেব। তবু, ওই সিরিজে আজকালের সেরা আকর্ষণ ছিল ভিভিয়ান রিচার্ডসের ম্যাচ-রিপোর্ট। ভিভও প্রুডেনশিয়াল কাপের ম্যাচ-রিপোর্ট করেছিলেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীর কাগজে। প্রুডেনশিয়াল কাপের ছবি তুলে কলকাতায় ফিরে শ্রেণিক জানিয়েছিল, ‘ভিভ আমাদের কাগজে লিখতে পারে। আমি বলার সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়েছে।’ প্রুডেনশিয়াল কাপ ফাইনালের পর, সেই রাতেই ভিভ রিচার্ডসের একটা ছোট হলেও চমৎকার ইন্টারভিউ নিয়েছিল শ্রেণিক। তারই মধ্যে প্রস্তাব। ব্যাপারটা বিশ্বাস করা এমনিতে কঠিন ছিল। সকলেই জানেন, সঙ্গতি, প্রচার, সুযোগ-সুবিধা, উদ্যোগ— সব দিক দিয়েই, আনন্দবাজার গোষ্ঠী অনেক এগিয়ে। তার ওপর, তখন লন্ডনে বসে রয়েছেন আনন্দবাজারের আশিস রায়। ভিভকে আমরা কী করে পাব? কিন্তু শ্রেণিকের কথাকে উপেক্ষা করাও কঠিন। সুনীল গাভাসকারের ব্যাপারটাও তো ও এইরকম সহজভাবেই প্রথমে বলেছিল।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম ভারতে এসে পৌঁছোল। জয়পুরে ভারত-পাকিস্তান ওয়ান ডে ইন্টারন্যাশনাল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমও সেদিন জয়পুরে, পরদিন থেকে মধ্যাঞ্চলের বিরুদ্ধে ওদের খেলা শুরু। জলন্ধরে ভারত-পাকিস্তান তৃতীয় টেস্ট কভার করে দিল্লিতে এল পল্লব আর শ্রেণিক। আমিও দিল্লিতে, ভারত-সৌদি আরব প্রি-অলিম্পিক ফুটবল ম্যাচ কভার করার জন্য। শ্রেণিকের সঙ্গে ভিভের ব্যাপারে কথা হল। বললাম, টেস্ট এবং ওয়ান ডে সিরিজের জন্য আমরা মোট দু’হাজার ডলার দিতে পারি। কথা হল, এর ওপরে খুব বেশি হলে পাঁচশো ডলার ওঠা যেতে পারে। শ্রেণিক আগেই জয়পুর চলে গেল, ফুটবল ম্যাচের ছবি তোলার জন্য শিবু (কাঞ্জিলাল) দিল্লিতে ছিল। পল্লব রয়ে গেল। অনেক রাতে ম্যাচ শেষ হওয়ার পর প্রেস বক্সে বসেই আমার ম্যাচ-রিপোর্ট লেখা শুরু হবে, ততক্ষণে পল্লব ভারতীয় শিবির ঘুরে আসবে। পরদিন ভোরের ফ্লাইটে পল্লবের জয়পুর যাওয়ার কথা। গভীর রাতে বিদায় নেওয়ার সময় বলল, ‘অশোকদা ভিভের জন্য অ্যামাউন্ট আরও বাড়ান। না হলে আনন্দবাজার নিয়ে নেবেই।’ পল্লবের উৎসাহে জল ঢেলে বললাম, ‘ছেলেমানুষি করে লাভ নেই। টাকার লড়াইয়ে আনন্দবাজারের সঙ্গে পারবে? ভিভ রিচার্ডস আমাদের কাগজে লিখলে খুশি হব, কিন্তু খুব বেশি আশা করছি না।’ তখনও পর্যন্ত কপিলদেবের সঙ্গে কথা হয়নি। তবু, পল্লবের হতাশ মুখ দেখে মায়া হল। সবেশেষে তাই যোগ করলাম, ‘কিছু ভেব না। আমরা ঠিক ভাল কিছু পেয়ে যাব।’

জয়পুরে ভিভ রিচার্ডসকে শ্রেণিক প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিল। ভিভ বললেন, ‘মনে আছে।’ দু’হাজার ডলারের প্রস্তাবেও এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন ভিভ। পরে লন্ডন থেকে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর প্রতিনিধি ভিভকে টেলিফোন করলেন, ‘এটা কী করছ ভিভ? তুমি আমাদের হাউসের কাগজে লিখছ, এটা অ্যানাউন্স করা হয়ে গেছে। আমি খুব লজ্জায় পড়ে যাব।’ ভিভকে প্রায় দ্বিগুণ টাকার অফার দেওয়া হল। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান সিদ্ধান্ত পাল্টাননি। শ্রেণিক আর দেবাশিসের সামনে টেলিফোনেই বলেছিলেন, ‘মাই ওয়ার্ড ইজ মাই রিলিজিয়ন!’ ভিভ মাত্র দু’হাজার ডলারে আমাদের কাগজে লিখছেন— অনেক পরে আমার মুখে এই কথা শুনে চিরশ্রদ্ধেয় মুকুল দত্ত মন্তব্য করেন, ‘ভাবাই যায় না। আমি শুনেছিলাম, তোমরা পাঁচ হাজার ডলারের বেশি দিচ্ছ, তাই ভিভ তোমাদের কাগজে লিখতে রাজি হয়েছে।’

কলকাতা টেস্টের বিরতির দিনে আজকাল অফিসে এক সংবর্ধনা সভায় সানি গাভাসকারের সঙ্গে হাজির ছিলেন ভিভ। আমরা একটা বড় ভুল করেছিলাম। সস্ত্রীক কপিলদেবকে বলিনি। পরদিন রোমির প্রশ্নের সামনে অসহায় হয়ে গিয়েছিল পল্লব: ‘কপিলদেব কি তোমাদের লোক নয়?’ কপিল অবশ্য আবহাওয়া হালকা করার জন্য বলেছিলেন, ‘আমাকে ওরা পরে নিশ্চয় রিসেপশন দেবে, শুধু আমাকে। সানি আর ভিভ পাশে থাকলে, আমাকে কে দেখত?’

সব আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার সম্পর্কেই অবশ্য আমরা ভাল ধারণা গড়ে তোলার সুযোগ পাইনি। ভিভ কথার দাম দিতে অনেক টাকা হারিয়েছেন, দেশে ফেরার সময় বাড়তি টাকা ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন জিওফ বয়কট, একটি চিঠির সূত্রেই আজকালের রবিবাসর-এ চমৎকার লেখা পাঠিয়েছিলেন মাইক ব্রিয়ারলি, একটি লেখা চাইলে তিনটি পাঠান পিটার রোবাক। কিন্তু ব্যতিক্রম হিসাবে মনে রাখব জাভেদ মিয়াঁদাদকে। সুনীল গাভাসকারের অনুরোধে ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার’ পত্রিকায় ভারত-পাকিস্তান টেস্ট সিরিজের রিপোর্ট লিখতে রাজি হয়েছিলেন মিয়াঁদাদ। টেপ রেকর্ডারে জাভেদের বক্তব্য ধরেও রাখল আমাদের প্রতিনিধি। কিন্তু, প্রথম টেস্টের পরই দেখা গেল, ম্যাচ নিয়ে জাভেদের একান্ত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে ‘স্পোর্টসওয়ার্ল্ড’ পত্রিকায়। কী করব? সানি জানাল, ‘জাভেদের রিপোর্ট ফেলে দাও। আমি রাজার সঙ্গে কথা বলছি।’ শেষ পর্যন্ত ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার’ ওয়াসিম রাজার রিপোর্ট ছাপল।

ওই বছরেই সানি গাভাসকারকে ঘিরে অনেক ঘটনা। ব্র্যাডম্যানকে ছোঁয়া, অতিক্রম করা, বয়কটকে ডিঙিয়ে যাওয়া, আর ওই অপবাদ। এই সময়ের কাহিনী আপনারা নানা লেখায় পড়েছেন। হয়ত ভবিষ্যতে আরও পড়বেন। শুধু, এই সময়ের একটা সাইড স্টোরি শোনাই। কলকাতা টেস্টের বিরতির দিন সকাল, গ্র্যান্ডে দিলীপ বেঙ্গসরকারের কাছে অটোগ্রাফ নিতে এসেছে এক কিশোরী। ‘আইডল’-এর শুরুর পৃষ্ঠায় সই চাইতেই, দিলীপ জানতে চাইলেন, ‘তোমার আইডল কে?’ কিশোরী নির্দ্বিধায় জানায়, ‘গাভাসকার’। অটোগ্রাফ দিতে দিতে বেঙ্গসরকার বলেন, ‘এখন আর ওর ফ্যান হয়ে কী হবে? এবার আমার ফ্যান হয়ে যাও।’

একটি ছোট্ট ব্যাটের কথা বলে ক্রিকেট প্রসঙ্গ শেষ করব। মিনি-ব্যাট। সানি আর ভিভের সই করিয়ে আমাকে দিয়েছিল দেবাশিস। তারপর সেই ব্যাট সহকর্মীদের হাতে হাতে ফিরল। কলকাতার বাইরেও গেল। ইডেনে ডাবল উইকেট টুর্নামেন্টের পর সেই ব্যাট আমার হাতে ফিরে এল। সামনের দিকে ধরেনি, ব্যাটের পিছন দিকেও কিছু সই। কারা আছেন এই ছোট্ট ব্যাটে? স্যার গ্যারি সোবার্স, ওয়েসলি হল, ভিভ রিচার্ডস, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং, ডেনিস লিলি, সুনীল গাভাসকার, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, মহিন্দার অমরনাথ, সন্দীপ পাটিল, রবি শাস্ত্রী, দিলীপ দোশি, ব্রুস ইয়ার্ডলি, দলীপ মেন্ডিস, ইমরান খান, জাভেদ মিয়াঁদাদ, সরফরাজ নওয়াজ, জাহির আব্বাস এবং কপিলদেব। সাতচল্লিশ হাজারের বেশি টেস্ট রান, প্রায় উনিশশো টেস্ট উইকেট! ঈর্ষা করবেন না। নিশ্চিত জানবেন, এই ব্যাটটাও আমি হারিয়ে ফেলব!

মনোরঞ্জনকে ভারতীয় দল থেকে বাদ দেওয়া হল, যেন আমাদের প্রতিবাদের অভ্যাস বাঁচিয়ে রাখার জন্যই। আমরা নিজেরা তো লেখালেখি করলামই, আজকালের খেলার পৃষ্ঠায় লিখলেন বিশেষজ্ঞরাও— শৈলেন মান্না, তুলসীদাস বলরাম, পরিমল দে, সুভাষ ভৌমিক এবং সুরজিৎ সেনগুপ্ত। এই তালিকায় আরও দুটি নাম ছিল। প্রশান্ত সিংহর সঙ্গে তখন যোগাযোগ করা যায়নি। আর, লেখার প্রস্তাব পেয়ে সুব্রত ভট্টাচার্য বলেছিলেন আমাদের প্রতিনিধিকে: ‘আমি এখন প্রতিবাদ করা ছেড়ে দিয়েছি।’ আমরা আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ করিনি। পরে অবশ্য সুব্রত বলেছে, ‘প্রতিবাদ করেও কিছু হয় না বলে আমি হতাশ, তাই প্রথমে ওই কথা বলেছিলাম। কিন্তু স্পষ্ট করে এ কথা বলিনি যে লিখব না। আর একবার গেলে নিশ্চয় লেখা দিতাম।’

কলকাতার ময়দানে সুরজিৎ ছাড়া আর যে দু-তিনজন প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের ক্ষতি করেছে, নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে একজনের নাম সুব্রত ভট্টাচার্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও সত্যি, ওর ইমেজ এবং আমাদের প্রতিবাদের ভয়েই বারবার মোহনবাগান কর্মকর্তারা সুব্রতকে সরানোর চিন্তা ত্যাগ করেছেন। দেখেছি, সুব্রত নিজের স্বার্থের কথা ভেবে কাজে নামে না। এই চেনা ছেলেটির মুখে ওই প্রতিবাদ করা ছেড়ে দেওয়ার কথা শুনে তাই খারাপ লেগেছিল।

বিরাশির দলবদলের আগে সেই বিখ্যাত ঘোষণাটির কথা মনে করুন: ‘আমরা দুজন যেখানেই খেলি, একসঙ্গে খেলব।’ দুজনে শেষ পর্যন্ত এক টিমে না খেলায় আমাদের কত গালাগালি খেতে হল, সেটা বড় কথা নয়। এই লাইনে থাকলে এ জিনিসকে ডায়েটের মধ্যেই ধরে নিতে হবে। কিন্তু, ফুটবলারদের ওপর মানুষের বিশ্বাস কি কমে গেল না? সিনিয়র এবং অনেক বেশি সচ্ছল প্রসূন কি কথা রাখার জন্য আরও বেশি আত্মত্যাগের প্রস্তাব দিতে পারত না? এক্ষেত্রেও আমার দিক থেকে দুঃখের কারণ, ফুটবলারদের সংগঠিত করার কাজে প্রথমে যে অল্প কয়েকজন এগিয়ে আসতে চেয়েছিল, প্রসূন তাদেরই একজন।

প্রশান্ত ব্যানার্জি ইস্টবেঙ্গলের কাছ থেকে অ্যাডভান্স নিয়েও শেষ পর্যন্ত মোহনবাগানে সই করল। ফুটবলার যে-কোনও টিমে খেলতে পারে। কিন্তু, অ্যাডভান্স নেওয়াকেই যখন এখানে পাকা কথা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, পাকা কথার খেলাপ করায় কি কলকাতার ফুটবলারের ইমেজ উজ্জ্বল হল?

গৌতম সরকারের বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ থাকুক, মাঠের মধ্যে ওর আচরণ অধিকাংশ ফুটবলারের চেয়ে ভাল। দর্শকরা সে-কথা মানবেন। তিরুচিরাপল্লিতে ফেডারেশন সেমিফাইনালে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে বেশ ভাল খেলেছিল গৌতম। খেলার পর উত্তেজিত অমল দত্ত যখন নিজেকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে খারাপ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলছেন, গৌতমও উত্তেজনার বশে উচ্চস্বরে কিছু বাক্যবাণ নিক্ষেপ করেছিল মোহনবাগান শিবিরের দিকে। সরোজের ডেসপ্যাচে এই ঘটনার উল্লেখ ছিল। কলকাতায় ফিরে গৌতম জানায়, খবরটা মিথ্যা। দেবাশিসের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে তা ছাপার জন্যও বলে। ভেবে দেখুন, এই প্রতিবাদ ছাপলে আমাদের মেনে নিতে হয় যে আমাদের রিপোর্টার মিথ্যা কথা লেখে। আত্মরক্ষার অধিকার সবারই আছে। খেলায় প্রতিবাদের সঙ্গে সুমনের তোলা উত্তেজিত গৌতমের ছবিটাও ছাপা হল। ওই একটি ছবি হাজার শব্দের জোর নিয়ে সত্য প্রকাশ করেছিল। ক্ষুব্ধ গৌতম আমাদের তরুণ ফটোগ্রাফার সুমনের এই ‘অপরাধ’ ক্ষমা করতে পারেনি, তা বুঝিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। এই ঘটনার পরও গৌতমের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মোটামুটি ভালই আছে। কিন্তু, একজন উদীয়মান ফটোগ্রাফার যদি এক ভারতবিখ্যাত সিনিয়র ফুটবলারের কাছে এমন ব্যবহার পায়, তাতে কি তার ফুটবলারের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসা বাড়তে পারে? সুমন তো শুধু ছবি তুলেছিল, ছাপা-না-ছাপার দায়িত্ব সম্পাদকের। ক্ষোভ যদি প্রকাশ করতেই হয়, সরাসরি আমার বিরুদ্ধেই তা প্রকাশিত হওয়া উচিত ছিল নাকি?

মোহনবাগানের কাছে লিগে হারার পর, ইস্টবেঙ্গলের কয়েকজন কর্মকর্তা টেন্টের মধ্যেই এক সপ্তাহ ধরে চিৎকার করে গেলেন যে, পাঁচজন ইচ্ছা করে ম্যাচ ছেড়ে দিয়েছে। অশ্রাব্য গালিগালাজ, অপমান। আমরা কি খুব বেশি আশা করে ফেলেছিলাম যে অন্য ফুটবলাররা অন্তত মৌখিক প্রতিবাদটুকু করবে? একটি বিবৃতি কি দেওয়া যেত না এই পাঁচজনের মনোবল বাড়ানোর জন্য? টিমে এতজন ফুটবলার, একজনও কেন উদ্ধত কর্মকর্তাদের মুখের ওপর বলতে পারল না: ‘ড্রেসিং রুম ফুটবলারদের প্রস্তুতি ও বিশ্রামের জায়গা, আপনারা চিৎকার করবেন না?’ পরোক্ষভাবে একটু দেরিতে মৃদু সুরে প্রতিবাদ করেছে ভাস্কর। কিন্তু, প্রিয়তম ফুটবলার ভাস্কর গাঙ্গুলি, তোমার বিরুদ্ধেই অভিযোগ। অন্য সকলের হয়ে তোমারই উচিত ছিল শুরুতেই প্রকাশ্য প্রতিবাদে মুখর হওয়া। একটি মহান দায়িত্ব পালনের সুযোগ তুমি হাতছাড়া করেছ।

তবু, ফুটবলাদের সম্পর্কে কিছু অভিযোগ ও হতাশা সঙ্গে নিয়েও আমরা হাত দিই ‘ফুটবলার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর কাজে। এবং আজকের ফুটবলাররাও যথেষ্ট ভালভাবে সাড়া দেয়। আর আমরা ভাবছি, অভিযোগ অল্প, আশা ও সন্তাবনার পাল্লাই ভারি। কলকাতার ফুটবলাদের জানা থাকা উচিত, প্রধানত নিম্নবিত্ত ছেলেদের শুধুমাত্র খেলার জোরে আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখার ব্যাপারটা অধিকাংশ লোকই ভালভাবে মেনে নিতে পারেনি। বড় আমলা থেকে কৃতী সাহিত্যিক— সব স্তরের মানুষই আড্ডার মেজাজে আমায় অভিযুক্ত করেছেন অযোগ্য ও স্বার্থপর ফুটবলারদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য। লড়ি, এমনকি আড্ডাতেও। কিন্তু, লড়ার জোর ফুটবলাররা না দিলে কে দেবে?

শেষ পর্যন্ত একটা ব্রিফকেস কিনে ফেলতেই হল। রতনের তিন বছরের চেষ্টার ফল। ক্রমাগত বলে গেছে: ‘বাচ্চু, এবার ব্রিফকেসে কাগজপত্র রাখা শুরু কর। কত কাগজপত্র হারিয়ে যাচ্ছে। খুঁজে বার করতে সময় নষ্ট হচ্ছে।’ তিন বছরে অন্তত তেষট্টিবার বলেছে, আমি প্রত্যেকবারই বলেছি, ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।’ যা করার আদৌ ইচ্ছা নেই, তাতে এক কথায় রাজি হয়ে যাওয়াই ভাল। তবু শেষ পর্যন্ত ব্রিফকেস। কিন্তু ‘খেলা’-সম্পাদকের ব্রিফকেসটা যদি একবার খোলেন! উত্তর দেওয়ার দরকার, কিন্তু দেওয়া হচ্ছে না— এই জরুরি শ্রেণীর চিঠি অন্তত বত্রিশটা, ‘ছাপব কিন্তু কবে তা জানি না’ জাতীয় লেখা অন্তত দশটা, কিছু ম্যাগাজিন, খুচরো টাকা, বেশ কিছু ক্যাশমেমো, জমা-দিয়ে-উঠতে না-পারা ট্যুর-বিল, চিরকুটে মাঠ-ময়দানের ডায়েরির সাবজেক্ট, আজকাল আর ‘খেলা’র লেটার হেড, ডজন দেড়েক বলপেন, রিফিল, প্যাড, সিগারেট, পাইপ, তামাক, গ্যাস-লাইটার, দেশলাই, অন্তত এক ডজন খেলার ছবি, নীল পেনসিল, অন্তত মাসখানেক আগে কেনা কিন্তু ব্রিফকেস থেকে মুক্তি-না-পাওয়া ক্যাসেট— এবং অবশ্যই ‘কালই করে ফেলতে হবে’ জাতীয় অসংখ্য কাগজবন্দী কাজ। যা দরকার, তা কখনওই খুঁজে পাওয়া যায় না। এক সকালে ব্রিফকেস খুলে ওপরে দুটো কাচের পেপার ওয়েট পেয়েছিলাম। অফিস থেকে ওঠার সময় কাগজপত্রের সঙ্গে ওগুলোও….!

ভাল সম্পাদকের তালিকায় আমি লস এঞ্জেলেস অলিম্পিকে আটশো মিটারে চার্লি বোরোমিও। কিন্তু মোটামুটি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলা যায়, এমন অগোছালো সম্পাদক আর কোথাও নেই। ‘খেলার কথা’র দায়িত্ব নেওয়ার আগে ‘আনন্দমেলা’র সম্পাদক শ্রদ্ধেয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে বলেছিলাম, ‘এডিটিংয়ের ব্যাপারটা আপনার কাছে একটু একটু বুঝে নেব।’ নীরেনদা বলেছিলেন, শেখাবেন। দ্বিতীয় দিন এ কথা তুলিনি, বুঝেছি এত ভালভাবে কাজকর্ম করা আমার ধাতে নেই। কী সুন্দরভাবে নীরেনদা কাগজপত্র রাখেন। কত ফাইল। ‘ইমিডিয়েট’। ‘পেন্ডিং’। আরও কত। হাতের কাছে জরুরি সব রেফারেন্স। লেখা তৈরি হওয়ার পর কী আশ্চর্য প্রখর মমতায় পাতার দিকে তাকান। একটি ছোট ভুলও তাঁর চোখ এড়ায় না। আর অশোক দাশগুপ্ত? আমার কোনও ফাইল নেই। যত চিঠি লিখি, তাও যত দরকারই হোক, তার কোনও কপি নেই। ‘খেলার কথা’ থেকে ‘খেলা’একটা সংখ্যাও কাছে নেই। সম্পাদনার পরিকল্পনা ধরা থাকে কাগজের স্তূপে হারিয়ে যাওয়া চিরকুটে। আর মনে— তাও তো হারায়। এমন অবৈজ্ঞানিক অগোছালো ধরনধারণ সত্ত্বেও আমাদের কাগজটা যে চলে, তার কারণ এই যে এখানে প্রায় সবাই সম্পাদক। বড় টাইপে নামটা অবশ্য আমরাই ছাপা। কিন্তু কাগজ তৈরির ক্ষেত্রে প্রায় সবারই একটা ভূমিকা থেকে যায়।

‘খেলা’ প্রকাশিত হয়— বলা যাক, প্রকাশিত হওয়ার কথা শুক্রবার। ছ’দিন আগে শনিবার আমাদের কাজ শেষ হওয়ার কথা। লেখা জমা পড়ে সোম থেকে শনিবার। আমি স্কিম তৈরি করি, শনি অথবা সোমবার। এবং এই স্কিম পাল্টাতেই থাকে। হয়ত ধীমান বলল, স্যার গ্যারির ইন্টারভিউটা এবার তিনের জায়গায় চার পৃষ্ঠা হবে। ‘হোক।’ পল্লব বলল, বাঙ্গালোরের কপিটা বাড়তে পারে। ‘বাড়ুক।’ সরোজ জানাল, মোহনবাগানের স্টোরিটা এক পাতার মধ্যে করা অসম্ভব। ‘দু পাতা করে ফেল।’ কমল বোসকে পাওয়া যাচ্ছে না। ‘তাহলে এই সংখ্যায় থাক।’ বোম্বাই থেকে মৃণালকান্তি একটা দুর্দান্ত স্টোরি পাঠাচ্ছে। ‘দু পৃষ্ঠা রেখে দাও।’ আরও একটা বিজ্ঞাপন এল। ‘আসুক।’ এইভাবে শনিবারে পৌঁছে হয়ত সাঁইত্রিশ দাঁড়িয়েছে। তখন পাঁচ পৃষ্ঠা তুলে রাখার গোলমেলে কাজ। বত্রিশ জায়গায় একত্রিশ হয়েও যায়। ভরিয়ে দেওয়ার কাজটা অবশ্য অনেক সহজ। পরের সপ্তাহের প্রস্তুতি চলতে চলতেই সেই সপ্তাহে খেলা প্রকাশিত হয়। ছাপার ভুল, লেখার ভুল— এ-সব নিয়ে এক পশলা বকাঝকা। লেখা ঠিকমতো জমা না দেওয়ার জন্যও অনেক। আক্রান্ত সরোজ মন্তব্য করেছিল, ‘অশোকদাকে তো বকার কেউ নেই!’

তবে, মোটেই ভাববেন না যে সম্পাদকের কাজটা শুধু বকুনি বা বক্তৃতা দেওয়া। কষ্টের, হয়রানির দিকও আছে। শিবাজি সব সময়েই ঠিকসময় লেখা দেয়। গোপাল বসু বেশি সময় নেয় না। অনুবাদে অবশ্য কিছুটা সময় যায়। গোপাল হল খাঁটি ক্রিকেট-ইংরেজ। কিন্তু প্রধান সমস্যা তিন প্রধানকে নিয়ে। অমল দত্ত, সুপ্রিয় সেন এবং সুরজিৎ সেনগুপ্ত। এই তিনজনের কাছ থেকে কাজ পাওয়ার জন্য নতুন নতুন স্ট্র্যাটেজি নিতে হয়, কিছুতেই হতাশ না হওয়ার শিক্ষা নিতে হয়। কখনও কখনও সব কিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছাও দমন করতে হয়।

তবে, এটা স্বীকার করা উচিত, এই তিনজনের মধ্যে সুরজিৎই অপেক্ষাকৃত সহজ সমস্যা। নির্দিষ্ট দিনে লেখা পাওয়া যাবে না। তিমির একটি পবিত্র অজুহাত হজম করে ফিরে আসবে। দ্বিতীয় দিনে, লটারির প্রাইজের মতো অপ্রত্যাশিত ভাবেই লেখাটা এসে যেতে পারে। কিন্তু সাধারণত এই দ্বিতীয় দিনটা সুরজিতের সঙ্গে আমাদের তিমিরের দেখা হবে না। হয় সুরজিৎ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে অথবা তিমিরের যেতে দেরি হয়েছে। অথবা অন্য কিছু। কিন্তু সবেরই মূলে মসৃণ বোঝাপড়া, ‘সুরজিৎদা’র প্রতি রচনাবাহকের নিবিড় শ্রদ্ধা। তৃতীয় দিন লেখাটা সুরজিৎ বাড়িতে ফেলে আসবে। বাড়িতে গেলে ওটা অবশ্য অফিসেও থাকতে পারে। চতুর্থ দিন তিমির লেখাটা আমার টেবিলে রাখতে পারে। তিরাশির পঁচিশে জুন রাতে কপিলদেবের মুখেও এতটা গর্বের হাসি ছিল না। ব্যাপারটা পঞ্চম দিন রাত পর্যন্ত গড়াতে পারে। তবে, লেখা পাওয়া যাবে। এই সংখ্যায় না গেলে পরের সংখ্যায় যাবে! পরে সুরজিতের একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। আজকালের ম্যাচ রিপোর্ট আর স্ট্র্যান্ড রোডের চায়ের দোকানে বসে লেখে না, অফিসে আসে।

অমল দত্ত লেখার প্রস্তাবে বেশ সহজেই রাজি হন। কিন্তু, তারপর সে যে কী দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম! লেখা পাওয়ার দিন হিসেবে যেটিকে ধরা হয়, সেটি আসলে প্রথম ঘোষণা পাওয়ার দিন। প্রায় অনিবার্য প্রাথমিক ঘোষণা: ‘লেখাটা আসছে না।’ ভাল লেখকের ভাল লেখা সহজে আসে না— আমরা হতাশ হই না। নির্দিষ্ট সংখ্যায় লেখাটা ধরানোর চেষ্টা শেষ। যখন শিবু বা তিমির বাগুইআটিতে হাজির হয়, সাধারণত দ্বিতীয় ঘোষণা— ‘শুরু করেছি, কিন্তু এগোচ্ছে না। ঠিক দাঁড়াচ্ছে না।’ পরবর্তী সংখ্যার কাজকর্ম যখন মাঝপথে, তখন খবর আসে, লেখাটা দাঁড়াতে শুরু করেছে। লেখার টেবিলে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়েছে ম্যানসস্ক্রিপ্ট— অমলদা লেখার মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। এইবার শেষ পর্যন্ত লেখাটা পাওয়ার পালা। না, এখনও নয়! এবার— ‘লেখাটা আটকে গেছে। শেষটা ঠিক হচ্ছে না।’ বিশ্বাস করুন, এই পর্যায়ে এসেও অমলদার বেশ কিছু লেখা থেমে গেছে। হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো। কাগজের চাহিদা, অর্থের প্রয়োজন, হাজার অনুরোধ-উপরোধেও সেই লেখা কোনওরকমে শেষ করে দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয় না। একবার, যতদূর মনে পড়ছে, বিরাশির পুজো সংখ্যায় অমলদা খবর পাঠালেন, ‘এবার লিখব না। লেখা আসছে না।’ অনেক রাতে অমলদার বাড়িতে গেলাম। বললাম, ‘আপনার নাম বিজ্ঞাপনে ঘোষণা করা হয়ে গেছে। এরপর লেখা না দিলে হয়?’ শেষ পর্যন্ত অমলদা রাজি হলেন। হয়ত এই একবারই নিজস্ব মেজাজে না থেকেও লিখলেন। লেখাটা কিন্তু খারাপ হয়নি।

এরপর আপনাদের নিশ্চয় খেলা সম্পাদকের জন্য দুঃখ হবে, যদি বলি যে সুপ্রিয় সেন আরও গভীর জলের মাছ। অথবা আরও দূরের নক্ষত্র। অথবা— খুব বাজে লোক! নির্দিষ্ট বিষয়ে লেখা চাইবার পর তিনি নিরুদ্দেশ হন। হ্যাঁ, কখনও দূরে কোথাও, কখনও বাড়িতেই নিরুদ্দেশ। তিমির কোনওরকমে দেখা পেয়ে গেলে, সুপ্রিয়দা খুব সহজ ভঙ্গিতে জানান, ‘লেখা হয়নি। পারছি না।’ পরবর্তী স্তরে আমার চিঠি এবং সুপ্রিয়দার জবাব। ভাল লেখক, পাঁচ লাইনেই বুঝিয়ে দেন কী সব ভয়ঙ্কর কাজ এবং অসুবিধা তাঁকে ঘিরে রেখেছে। এবং তথাপি কী প্রচণ্ড চেষ্টা তিনি করছেন। মানুষ তো বড়জোর চেষ্টাই করতে পারে, তাই না? অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাঝপথেই পরিত্যক্ত হয় লড়াই। সুপ্রিয়দা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। কখনও কখনও তিনি আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রমাণ হিসেবে দু-এক পৃষ্ঠা লেখা দেখান। তিমির একটা তারিখ হাতে ফিরে আসে। নির্দিষ্ট দিনে লেখাটার খবর আর পাওয়া যায় না, সুপ্রিয়দার ধানবাদ বা জব্বলপুর যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। কলকাতার টেলিফোন ব্যারিকেড ভেঙে কখনও তাঁর লাইন পেয়ে গেলে সরাসরি অন্যদিকে চলে যান: ‘তোমার এবারের লেখাটা খুব ভাল হয়েছে গো।’ সুপ্রিয়দার গলায় এই ‘গো’ যেন তপ্ত বৈশাখে ফ্রিজ থেকে বার-করা এক বোতল থামস আপ। সম্পাদক হিসেবে বিলক্ষণ জানি আমি কী দরের লেখক, এসবে ভুলব কেন? তবু, সুপ্রিয়দা সম্ভবত নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার একটা সময় পান। এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে শ্রেষ্ঠ বক্তব্যই বেরিয়ে আসে। দু-একবার অবশ্য না চাইতেই লেখা দেন। অঘটন আজও ঘটে।

সম্পাদকের দুশ্চিন্তা ও টেনশনের খবর যদি এই ভাল লেখকরা রাখতেন! চুরাশির পুজো সংখ্যার উপন্যাসটার কথাই ভাবুন। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কানাডায় যাওয়ার সময় কথা দিয়ে গেলেন, জুলাই-শেষে লেখা তৈরি করেই ফিরবেন। জুলাই মাস শেষ হতে চলল, তবু তাঁর কোনও খবর নেই। মানবেন্দ্রবাবুর ভাই ক্রিকেটার সম্বরণ ব্যানার্জি। সম্বরণের কাছেও ঠিকঠাক খবর পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত খবর এল, আগস্টের শুরুতে উপন্যাসকার কলকাতায় পৌঁছেছেন, কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় কানাডায় লেখা শুরুই করতে পারেননি। এত দেরিতে এই লেখার আর কী বিকল্প ভাবা যাবে? দেবাশিস যাদবপুর গেল আমার চিঠি নিয়ে। দুর্ধর্ষ দ্রুতগামী লেখক নিজের ফর্মে থেকে দশ দিনের মধ্যে লেখা শেষ করলেন। যদি না পারতেন? নিরুদ্দেশ হতাম।

আমার অবশ্য নিরুদ্দেশ হওয়ার অধিকার নেই। টানা দু’দিন বিশ্রাম নেওয়ারও উপায় নেই। প্রতি সপ্তাহে, প্রায় প্রতি দিন লিখতে হবে। লেখা পড়তে হবে। অজস্র কথা বলতে হবে, শুনতে হবে। একশো একটা তুচ্ছ ব্যাপারে গম্ভীর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রতি সংখ্যায় আমাকে লিখতেই হবে। হ্যাঁ, আমি নিজের লেখা আর ফিচার না লিখলে নাকি কিছুতেই কাগজ চলবে না। খুব চলবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এই দৃঢ় বিশ্বাসই আমাকে ঝুঁকি বা ছুটি নিতে দেয় না। এত যত্নে ফাঁপানো বেলুনটা নিজের হাতে কে চুপসে দিতে চায় বলুন?

আমার লেখা প্রেসে যাওয়ার আগে অন্তত ধীমান পড়ে নেয়। ছোটখাট তথ্যের ভুল বা শব্দ বাদ পড়ে যাওয়া— এ সবের সংশোধনে ওর ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখা যায়। বিশেষ কোনও লেখা অবশ্য সবাই আগে পড়ে। চুরাশির এই ডায়েরি লেখা হল পাঁচ দিনে, অজস্র খুচরো কাজের ফাঁকে ফাঁকে। দ্বিতীয় দিনের পরই পল্লব জিজ্ঞেস করল, ‘অশোকদা, এবার কি কম কনসেনট্রেট করে লিখছেন?’

‘আমি আবার কবে কনসেনট্রেট করে লিখলাম?’

‘না বলছিলাম, গত দু’বছর লেখায় যেমন নাটকীয়তা ছিল, এবার অন্তত এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু পাচ্ছি না।’

‘পাবেও না।’

প্রথম পর্বে ছিল খেলা পত্রিকার আন্দোলনে নিজেদের এগিয়ে আনার আন্তরিক কাহিনী। একটি নতুন ও অনিশ্চিত পাক্ষিক পত্রিকা থেকে সর্বাধিক প্রচারিত সাপ্তাহিক এবং একটি দৈনিকের খেলার পৃষ্ঠার দায়িত্বে উঠে আসার জমজমাট গল্প। দ্বিতীয় পর্বে কী দারুণ সব ব্যাপার— ভারতের প্রুডেনশিয়াল কাপ জয়, দেশের মাটিতে এশিয়াড, একশো চুরানব্বই গোল, গাভাসকারের সম্পাদনায় ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার’-এর আত্মপ্রকাশ। এক বছরে এত সব ঘটনা বারবার ঘটে নাকি? সামান্য ক্রীড়া-সাংবাদিকের ডায়েরিতে তাই উঠে আসতে চায় ছোট ছোট নাটক, নাটকের টুকরো। তিন দৃশ্যের একটি ছোট্ট নাটিকা পেশ করা যাক। দৃশ্য এক: উনিশশো ঊনআশির আই এফ এ শিল্ড সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গল টাইব্রেকারে হারাল দক্ষিণ কোরিয়ার টিমকে। খেলা শেষ হতেই লক্ষ্য করলাম, অশোক দাশগুপ্তকে চিনে নিয়ে হেনস্থা করার জন্য অপেক্ষা করছে ইস্টবেঙ্গলের কিছু উগ্র সমর্থক। আমি মোহনবাগান মাঠের প্রেসবক্স থেকে বেরিয়েই শুনলাম, পেছনে অন্য সাংবাদিকদের কাছে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে, কোন লোকটি অশোক দাশগুপ্ত? হঠাৎই পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, এক সাংবাদিক আমার দিকে দেখিয়ে দিলেন, মুখে আশ্চর্য হাসি। দৃশ্য দুই: পাঁচ মিনিট পরেই আমাকে ঘিরে অন্তত তিরিশজন উত্তেজিত ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। ‘আপনি ইস্টবেঙ্গল টিম ভেঙেছেন, আপনি জঘন্য লোক, সুরজিৎ ভাল গোল করেছে, কিন্তু পাঞ্জাবিরা টাইব্রেকারে গোল না দিলে কী হত, বলে যান আর কখনও ইস্টবেঙ্গলের ব্যাপারে আজেবাজে লিখবেন না— না হলে আজ জ্যান্ত ফিরবেন না— প্রচণ্ড উত্তেজনা, উচ্চস্বর এবং গালিগালাজের পারফিউম সহযোগে এই সব চলল কয়েক মিনিট। আমি বললাম, ‘যা খুশি করতে পারেন, আমি যা লেখার লিখব।’ উগ্ররা আরও উগ্র হয়ত হতেন, কিন্তু ইস্টবেঙ্গলেরই কয়েকজন সমর্থক ব্যাপারটা থামালেন। সঙ্গে ছিল ধারাভাষ্যকার সুব্রতকুমার, ওকেও উদ্যোগ নিতে দেখা গেল। উত্তেজিতদের মধ্যেই সতেরো-আঠারো বছর বয়সী একটি ছেলে আবার শেষ পর্যন্ত এ কথাও বলে ফেলল, ‘অশোকদা, আপনার সব লেখা কিন্তু আমরা পড়ি।’ দৃশ্য তিন: উনিশশো বিরাশিতে ইডেনে নেহরু কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী দিন। এক সাংবাদিক আমার হাতে হাত রেখে বললেন, ‘কতদিন পরে দেখা। সব সময় তোমার কথা ভাবি, জানো অশোক?’ জানি, কারণ প্রথম ও তৃতীয় দৃশ্যের সাংবাদিক একই ব্যক্তি! এই নাটকে কোনও চতুর্থ দৃশ্য নেই। থাকলে, তাতে একটি পরিচ্ছন্ন চপেটাঘাত থাকত।

অভিজ্ঞতা খুব ভাল জিনিস। কিন্তু তার একটা খারাপ দিক এই যে তা মানুষকে ক্রমশই নিষ্ঠুর সত্যের দিকে নিয়ে যায়। অনেক সদিচ্ছা নিয়ে কাজ শুরু করলে কিছু না কিছু সাফল্য আসেই, কিন্তু অভিজ্ঞতা একদিন এসে কান ধরে বুঝিয়ে দিয়ে যায় যে যা করার ছিল, তার অনেকটাই করা হয়নি। করা যায়নি।

তবু, এখনও যা করা যায়নি, ভবিষ্যতে তা করা যেতে পারে। অভিজ্ঞতা শুধু ব্যর্থতা চেনায় না, ব্যর্থতাকে ডিঙিয়ে যাওয়ারও পথ দেখায়। আমরা সেই পথ দেখার, খোঁজার চেষ্টা করি।

তিরাশিতে এই ডায়েরিতে জানিয়েছিলাম, উনিশশো সাতাশির পর আর ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় থাকব না। যাঁদের অকারণ প্রশ্রয়ে এই সাংবাদিকের যৎসামান্য উত্থান, তাঁদের মধ্যে অনেকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন, এমন সিদ্ধান্ত যেন কখনই না নিই। এক সচেতন পাঠক লেখাটার প্রশংসা করে জানতে চেয়েছেন— এটা কি একটা স্টান্ট? আমি কি বাজিয়ে নিতে চাইছিলাম, ঠিক কতটা জনপ্রিয়?

না, প্রিয় পাঠক। সিদ্ধান্ত এখনও অপরিবর্তিত। ভোজের আসরে যাঁরা খাবার পরিবেশন করেন, আমার (হয়ত অনেকেরই) অবস্থা প্রায় তাঁদের মতোই। ওই পরিবেশকদের সেই রাতে আর খাওয়ার ইচ্ছা থাকে না। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ খেলার খবর পরিবেশন করতে করতে, মাঝে মাঝে আমারও খেলা থেকে অনেক দূরে পালাতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে রাগ হয়, কেন প্রতি সপ্তাহ, প্রতিদিন শুধুমাত্র পাঠক-পাঠিকাদের পছন্দ-অপছন্দের দাসত্ব করব?

অন্য একটা ব্যাপারও বারবার ধাক্কা দেয়। কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করছি? লড়ছি তো কিছু অসৎ আর ধান্দাবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, শুধুমাত্র মাঠেরই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। বিস্তীর্ণ সামাজিক জীবনে এর দাম কতটুকু? আর অন্য সব খারাপ-লাগাকে যদি অতিক্রমও করা যায়, এই দুঃসহ একঘেয়েমি কাটাবে কে? এবং কীভাবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *