শৈলজা এবং তাহার পিতা নলিনাক্ষের বাড়িতে আসিয়াছেন। শৈলজা কমলাকে লইয়া একটা কোণের ঘরে বসিয়া ফিস্ফিস্ করিতেছিল, চক্রবর্তী ক্ষেমংকরীর সঙ্গে আলাপ করতেছিলেন।
চক্রবর্তী। আমার তো ছুটি ফুরাইয়া আসিল, কালই গাজিপুরে যাইতে হইবে। যদি হরিদাসী আপনাদের কোনোরকমে বিরক্ত করিয়া থাকে, বা যদি আপনাদের পক্ষে—
ক্ষেমংকরী। ও আবার কী রকম কথা চক্রবর্তীমশায় ? আপনার মনের ভাবটা কী শুনি। আপনি কি কোনো ছুতা করিয়া আপনাদের মেয়েটিকে ফিরাইয়া লইতে চান ?
চক্রবর্তী। আমাকে তেমন লোক পান নাই। আমি দিয়া ফিরাইয়া লইবার পাত্র নই, কিন্তু যদি আপনার কিছুমাত্র অসুবিধা হয়—
ক্ষেমংকরী। চক্রবর্তীমশায়, ওটা আপনার সরল কথা নয়— মনে মনে বেশ জানেন, হরিদাসীর মতো অমন লক্ষ্মী মেয়েটিকে কাছে রাখিলে সুবিধার সীমা নাই, তবু—
চক্রবর্তী। না না, আর বলিতে হইবে না, আমি ধরা পড়িয়া গেছি। ওটা একটা ছলমাত্র— আপনার মুখে হরিদাসীর গুণ শুনিবার জন্যই কথাটা আমার পাড়া। কিন্তু একটা ভাবনা আছে— পাছে নলিনাক্ষবাবু মনে করেন যে, এ আবার একটা উপসর্গ কোথা হইতে ঘাড়ে পড়িল। আমাদের মেয়েটি অভিমানী, যদি নলিনাক্ষের লেশমাত্র বিরক্তিভাবও দেখিতে পায় তবে উহার পক্ষে বড়ো কঠিন হইবে।
ক্ষেমংকরী। হরি বলো ! নলিনের আবার বিরক্তি ! ওর সে ক্ষমতাই নাই।
চক্রবর্তী। সে কথা ঠিক। কিন্তু দেখুন, হরিদাসীকে আমি নাকি প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি, তাই তার সম্বন্ধে আমি অল্পে সন্তুষ্ট হইতে পারি না। নলিনাক্ষ যে ওর ’পরে বিরক্ত হইবেন না, উদাসীনের মতো থাকিবেন, এইটুকুই আমার পক্ষে যথেষ্ট মনে হয় না। তাঁর বাড়িতে যখন হরিদাসী আছে তখন তাকে তিনি আপনার লোক বলিয়া স্নেহ করিবেন, এ না হইলে মনে বড়ো সংকোচ বোধ হয়। ও তো ঘরের দেয়াল নয়, ও একটা মানুষ— ওর প্রতি বিরক্তও হইবেন না, স্নেহও করিবেন না, ও আছে তো আছে, এইটুকুমাত্র সম্বন্ধ, সেটা যেন কেমন—
ক্ষেমংকরী। চক্রবর্তীমশায়, আপনি বেশি ভাবিবেন না— কোনো লোককে আপনার লোক বলিয়া স্নেহ করা আমার নলিনের পক্ষে শক্ত নয়। বাহির হইতে কিছুই বুঝিবার জো নাই, কিন্তু এই-যে হরিদাসী আমার এখানে আছে, ও কিসে স্বচ্ছন্দে থাকে, ওর কিসে ভালো হয়, সে চিন্তা নিশ্চয়ই নলিনের মনে লাগিয়া আছে, খুব সম্ভব, সেরকম ব্যবস্থাও সে কিছু-না-কিছু করিতেছে, আমরা তাহা জানিতেও পারিতেছি না।
চক্রবর্তী। শুনিয়া বড়ো নিশ্চিন্ত হইলাম। তবু আমি যাইবার আগে একবার বিশেষ করিয়া নলিনাক্ষবাবুকে বলিয়া যাইতে চাই। একটি স্ত্রীলোকের সম্পূর্ণ ভার লইতে পারে, এমন পুরুষ জগতে অল্পই মেলে; ভগবান যখন নলিনাক্ষবাবুকে সেই যথার্থ পৌরুষ দিয়াছেন তখন তিনি যেন মিথ্যা সংকোচে হরিদাসীকে তফাতে রাখিয়া না চলেন, তিনি যেন যথার্থ আত্মীয়ের মতো তাহাকে নিতান্ত সহজভাবে গ্রহণ ও রক্ষা করেন, তাঁহার কাছে এই প্রার্থনাটি জানাইতে চাই।
নলিনাক্ষের প্রতি চক্রবর্তীর এই বিশ্বাস দেখিয়া ক্ষেমংকরীর মন গলিয়া গেল। তিনি কহিলেন, “পাছে আপনারা কিছু মনে করেন এই ভয়েই হরিদাসীকে আমি নলিনাক্ষের সামনে তেমন করিয়া বাহির হইতে দিই নাই; কিন্তু আমার ছেলেকে আমি তো জানি, তাহাকে বিশ্বাস করিয়া আপনি নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন।”
চক্রবর্তী। তবে আপনার কাছে সব কথা খোলসা করিয়াই বলি। শুনিয়াছি, নলিনাক্ষবাবুর বিবাহের প্রস্তাব হইতেছে; বধূটির বয়সও নাকি অল্প নয় এবং তাঁহার শিক্ষাদীক্ষা আমাদের সমাজের সঙ্গে মেলে না। তাই ভাবিতেছিলাম, হয়তো হরিদাসীর—
ক্ষেমংকরী। সে আর আমি বুঝি না ? সে হইলে ভাবনা ছিল বৈকি। কিন্তু সে বিবাহ হইবে না—
চক্রবর্তী। সম্বন্ধ ভাঙিয়া গেছে ?
ক্ষেমংকরী। গড়েই নি, তার ভাঙিবে কী। নলিনের একেবারেই ইচ্ছা ছিল না, আমিই জেদ করিতেছিলাম। কিন্তু সে জেদ ছাড়িয়াছি। যাহা হইবার নয় তাহা জোর করিয়া ঘটাইয়া মঙ্গল নাই। ভগবানের কী ইচ্ছা জানি না, মরিবার পূর্বে বুঝি আর বউ দেখিয়া যাইতে পারিলাম না।
চক্রবর্তী। অমন কথা বলিবেন না। আমরা আছি কী করিতে ? ঘটক-বিদায় এবং মিষ্টান্ন-আদায় না করিয়া ছাড়িব বুঝি ?
ক্ষেমংকরী। আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক চক্রবর্তীমশায়। আমার মনে বড়ো দুঃখ আছে যে, নলিন এই বয়সে আমারই জন্যে সংসারধর্মে প্রবেশ করিতে পারিল না। তাই আমি বড়ো ব্যস্ত হইয়া সকল দিক না ভাবিয়া একটা সম্বন্ধ করিয়া বসিয়াছিলাম— সে আশা ত্যাগ করিয়াছি, কিন্তু আপনারা একটা দেখিয়া দিন। দেরি করিবেন না— আমি বেশি দিন বাঁচিব না।
চক্রবর্তী। ও কথা বলিলে শুনিব কেন। আপনাকে বাঁচিতেও হইবে, বউয়েরও মুখ দেখিবেন। আপনার যেরকম বউটি দরকার, সে আমি ঠিক জানি; নিতান্ত কচি হইলেও চলিবে না, অথচ আপনাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করিবে, বাধ্য হইয়া চলিবে— এ নহিলে আমাদের পছন্দ হইবে না। তা, সে আপনি কিছুই ভাবিবেন না, ঈশ্বরের কৃপায় নিশ্চয়ই সে ঠিক হইয়াই আছে। এখন যদি অনুমতি করেন, একবার হরিদাসীকে তার কর্তব্য সম্বন্ধে দু-চারটে কথা উপদেশ করিয়া আসি, অমনি শৈলকেও এখানে পাঠাইয়া দিই— আপনাকে দেখিয়া অবধি আপনার কথা তাহার মুখে আর ধরে না।
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “না, আপনারা তিন জনেই এক ঘরে গিয়া বসুন, আমার একটু কাজ আছে।”
চক্রবর্তী হাসিয়া কহিলেন, “জগতে আপনাদের কাজ আছে বলিয়াই আমাদের কল্যাণ। কাজের পরিচয় নিশ্চয় যথাসময়ে পাওয়া যাইবে। নলিনাক্ষবাবুর বধূর কল্যাণে ব্রাহ্মণের ভাগ্যে মিষ্টান্নের পালা শুরু হউক।”
চক্রবর্তী, শৈল ও কমলার কাছে আসিয়া দেখিলেন, কমলার দুটি চক্ষু চোখের জলের আভাসে এখনো ছল্ছল্ করিতেছে ! চক্রবর্তী শৈলজার পাশে বসিয়া নীরবে তাহার মুখের দিকে একবার চাহিলেন। শৈল কহিল, “বাবা, আমি কমলকে বলিতেছিলাম যে, নলিনাক্ষবাবুকে সকল কথা খুলিয়া বলিবার এখন সময় হইয়াছে, তাই লইয়া তোমার এই নির্বোধ হরিদাসী আমার সঙ্গে ঝগড়া করিতেছে।”
কমলা বলিয়া উঠিল, “না দিদি, না, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি এমন কথা মুখে আনিয়ো না। সে কিছুতেই হইবে না।”
শৈল কহিল, “কী তোমার বুদ্ধি ! তুমি চুপ করিয়া থাকো, আর হেমনলিনীর সঙ্গে নলিনাক্ষবাবুর বিবাহ হইয়া যাক। বিবাহের পরদিন হইতে আর আজ পর্যন্ত কেবলই তো যত রাজ্যের অঘটন ঘটনার মধ্যে পাক খাইয়া মরিলি, আবার আর-একটা নূতন অনাসৃষ্টির দরকার কী ?”
কমলা কহিল, “দিদি, আমার কথা কাহাকেও বলিবার নয়, আমি সব সহিতে পারিব, সে লজ্জা সহিতে পারিব না। আমি যেমন আছি, বেশ আছি, আমার কোনো দুঃখ নাই, কিন্তু যদি সব কথা প্রকাশ করিয়া দাও তবে আমি কোন্ মুখে আর একদণ্ড এ বাড়িতে থাকিব ? তবে আমি বাঁচিব কেমন করিয়া ?”
শৈল এ কথার কোনো উত্তর দিতে পারিল না, কিন্তু তাই বলিয়া হেমনলিনীর সঙ্গে নলিনাক্ষের বিবাহ হইয়া যাইবে ইহা চুপ করিয়া সহ্য করা তাহার পক্ষে বড়ো কঠিন।
চক্রবর্তী কহিলেন, “যে বিবাহের কথা বলিতেছ সেটা ঘটিতেই হইবে, এমন কী কথা আছে !”
শৈল। বল কী বাবা, নলিনাক্ষবাবুর মা যে আশীর্বাদ করিয়া আসিয়াছেন !
চক্রবর্তী। বিশ্বেশ্বরের আশীর্বাদে সে আশীর্বাদ ফাঁসিয়া গেছে। মা কমল, তোমার কোনো ভয় নাই, ধর্ম তোমার সহায় আছেন।
কমলা সব কথা স্পষ্ট না বুঝিয়া দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া খুড়ামশায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
তিনি কহিলেন, “সে বিবাহের সম্বন্ধ ভাঙিয়া গেছে। এ বিবাহে নলিনাক্ষবাবুও রাজি নহেন এবং তাঁহার মার মাথায়ও সুবুদ্ধি আসিয়াছে।”
শৈলজা ভারি খুশি হইয়া কহিল, “বাঁচা গেল বাবা ! কাল এই খবরটা শুনিয়া রাত্রে আমি ঘুমাইতে পারি নাই। কিন্তু সে যাই হোক, কমল কি নিজের ঘরে চিরদিন এমনি পরের মতো কাটাইবে ? কবে সব পরিষ্কার হইয়া যাইবে ?”
চক্রবর্তী। ব্যস্ত হোস কেন শৈল ? যখন ঠিক সময় আসিবে তখন সমস্ত সহজ হইয়া যাইবে।
কমলা কহিল, “এখন যা হইয়াছে এই সহজ, এর চেয় সহজ আর-কিছু হইতে পারে না। আমি বেশ সুখে আছি, আমাকে এর চেয়ে সুখ দিতে গিয়া আবার আমার ভাগ্যকে ফিরাইয়া দিয়ো না খুড়ামশায় ! আমি তোমাদের পায়ে ধরি, তোমরা কাহাকেও কিছু বলিয়ো না, আমাকে এই ঘরের একটা কোণে ফেলিয়া আমার কথা ভুলিয়া যাও। আমি খুব সুখে আছি।”
বলিতে বলিতে কমলার দুই চোখ দিয়া ঝর্ ঝর্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল।
চক্রবর্তী ব্যস্তসমস্ত হইয়া কহিলেন, “ও কী, মা, কাঁদ কেন ? তুমি যাহা বলিতেছ আমি বেশ বুঝিতেছি। তোমার এই শান্তিতে আমরা কি হাত দিতে পারি ? বিধাতা আপনি যা ধীরে ধীরে করিতেছেন, আমরা নির্বোধের মতো তার মধ্যে পড়িয়া কি সমস্ত ভণ্ডুল করিয়া দিব ? কোনো ভয় নাই। আমার এত বয়স হইয়া গেল, আমি কি স্থির হইয়া থাকিতে জানি না ?”
এমন সময় উমেশ ঘরে প্রবেশ করিয়া তাহার আকর্ণবিস্ফারিত হাস্য লইয়া দাঁড়াইল।
খুড়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী রে উম্শে, খবর কী ?”
উমেশ কহিল, “রমেশবাবু নীচে দাঁড়াইয়া আছেন, ডাক্তারবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন।”
কমলার মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। খুড়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িলেন; কহিলেন “ভয় নাই মা, আমি সব ঠিক করিয়া দিতেছি।”
খুড়া নীচে আসিয়া একেবারে রমেশের হাত ধরিয়া কহিলেন, “আসুন রমেশবাবু, রাস্তায় বেড়াইতে বেড়াইতে আপনার সঙ্গে গোটা-দুয়েক কথা কহিব।”
রমেশ আশ্চর্য হইয়া কহিল, “খুড়ামশায়, আপনি এখানে কোথা হইতে ?”
খুড়া কহিলেন, “আপনার জন্য আছি; দেখা হইল, বড়ো ভালোই হইল। আসুন, আর দেরি নয়, কাজের কথাটা শেষ করিয়া ফেলা যাক !”
বলিয়া রমেশকে রাস্তায় টানিয়া লইয়া কিছুদূর গিয়া কহিলেন, “রমেশবাবু, আপনি এ বাড়িতে কেন আসিয়াছেন ?”
রমেশ কহিল, “নলিনাক্ষ ডাক্তারকে খুঁজিতে আসিয়াছিলাম। তাঁহাকে কমলার কথা আগাগোড়া সমস্ত খুলিয়া বলা উচিত স্থির করিয়াছি। আমার এক-একবার মনে হয়, হয়তো কমলা বাঁচিয়া আছে।”
খুড়া কহিলেন, “যদি কমলা বাঁচিয়াই থাকে এবং যদি নলিনাক্ষের সঙ্গে তার দেখা হয়, তবে আপনার মুখে নলিনাক্ষ সমস্ত ইতিহাস শুনিলে কি সুবিধা হইবে। তাঁহার বৃদ্ধা মা আছেন, তিনি এ-সব কথা জানিতে পারিলে কমলার পক্ষে কি ভালো হইবে ?”
রমেশ কহিল, “সামাজিক হিসাবে কী ফল হইবে জানি না, কিন্তু কমলাকে যে কোনো অপরাধ স্পর্শ করে নাই সেটা তো নলিনাক্ষের জানা চাই। কমলার যদি মৃত্যুই হইয়া থাকে, তবে নলিনাক্ষবাবু তাঁহার স্মৃতিকে তো সম্মান করিতে পারিবেন।”
খুড়া কহিলেন, “আপনাদের ও-সব একেলে কথা আমি কিছু বুঝিতে পারি না— কমলা যদি মরিয়াই থাকে তবে তাহার এক রাত্রির স্বামীর কাছে তাহার স্মৃতিটাকে লইয়া টানাটানি করিবার কোনো দরকার দেখি না। ঐযে বাড়িটা দেখিতেছেন ঐ বাড়িতে আমার বাসা। কাল সকালে যদি একবার আসিতে পারেন, তবে আপনাকে সব কথা স্পষ্ট করিয়া বলিব। কিন্তু তাহার পূর্বে নলিনাক্ষবাবুর সঙ্গে দেখা করিবেন না, এই আমার অনুরোধ।”
রমেশ বলিল, “আচ্ছা।”
খুড়া ফিরিয়া আসিয়া কমলাকে কহিলেন, “মা, কাল সকালে তোমাকে আমাদের বাড়িতে যাইতে হইবে। সেখানে তুমি নিজে রমেশবাবুকে বুঝাইয়া বলিবে, এই আমি স্থির করিয়াছি।”
কমলা মাথা নিচু করিয়া বসিয়া রহিল। খুড়া কহিলেন, “আমি নিশ্চয় জানি তাহা না হইলে চলিবে না— একেলে ছেলেদের কর্তব্যবুদ্ধি সেকেলে লোকের কথায় ভোলে না। মা, মন হইতে সংকোচ দূর করিয়া ফেলো— এখন তোমার যেখানে অধিকার অন্য লোককে আর সেখানে পদার্পণ করিতে দিবে না, এ তো তোমারই কাজ। এ সম্বন্ধে আমাদের তো তেমন জোর খাটিবে না।”
কমলা তবু মুখ নিচু করিয়া রহিল। খুড়া কহিলেন, “মা, অনেকটা পরিষ্কার হইয়া আসিয়াছে, এখন এই ছোটোখাটো জঞ্জালগুলো শেষবারের মতো ঝাঁটাইয়া ফেলিতে সংকোচ করিয়ো না।”
এমন সময় পদশব্দ শুনিয়া কমলা মুখ তুলিয়াই দেখিল, দ্বারের সম্মুখে নলিনাক্ষ। একেবারে তাহার চোখের উপরেই নলিনাক্ষের দুই চোখ পড়িয়া গেল— অন্যদিন নলিনাক্ষ যেমন তাড়াতাড়ি দৃষ্টি ফিরাইয়া চলিয়া যায়, আজ যেন তেমন তাড়া করিল না। যদিও ক্ষণকালমাত্র কমলার দিকে সে চাহিয়াছিল, কিন্তু তাহার সেই ক্ষণকালের দৃষ্টি কমলার মুখ হইতে কী যেন আদায় করিয়া লইল, অন্য দিনের মতো অনধিকারের সংকোচে দেখিবার জিনিসটিকে প্রত্যাখ্যান করিল না। পরমুহূর্তেই শৈলজাকে দেখিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইতেই খুড়া কহিলেন, “নলিনাক্ষবাবু, পালাইবেন না— আপনাকে আমরা আত্মীয় বলিয়াই জানি। এটি আমার মেয়ে শৈল, এরই মেয়েকে আপনি চিকিৎসা করিয়াছেন।”
শৈল নলিনাক্ষকে নমস্কার করিল এবং নলিনাক্ষ প্রতিনমস্কার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার মেয়েটি ভালো আছে ?”
শৈল কহিল, “ভালো আছে।”
খুড়া কহিলেন, “আপনাকে যে পেট ভরিয়া দেখিয়া লইব এমন অবসর তো আপনি দেন না— এখন, আসিলেন যদি তো একটু বসুন।”
নলিনাক্ষকে বসাইয়া খুড়া দেখিলেন, পশ্চাৎ হইতে কমলা কখন সরিয়া পড়িয়াছে। নলিনাক্ষের সেই এক মুহূর্তের দৃষ্টিটি লইয়া সে পুলকিত বিস্ময়ে আপনার ঘরে মনটাকে সংবরণ করিতে গেছে। ইতিমধ্যে ক্ষেমংকরী আসিয়া কহিলেন, “চক্রবর্তীমশায়, কষ্ট করিয়া একবার উঠিতে হইতেছে।”
চক্রবর্তী কহিলেন, “যখনই আপনি কাজে গেলেন তখন হইতেই এটুকু কষ্টের জন্য আমি পথ চাহিয়া বসিয়া ছিলাম।”
আহার সমাধা হইলে পর বসিবার ঘরে আসিয়া চক্রবর্তী কহিলেন, “একটু বসুন, আমি আসিতেছি।”
বলিয়া পরক্ষণেই অন্য ঘর হইতে কমলার হাত ধরিয়া তাহাকে নলিনাক্ষ ও ক্ষেমংকরীর সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিলেন, তাঁহার পশ্চাতে শৈলজাও আসিল।
চক্রবর্তী কহিলেন, “নলিনাক্ষবাবু, আপনি আমাদের হরিদাসীকে পর মনে করিয়া সংকোচ করিবেন না— এই দুঃখিনীকে আপনাদেরই ঘরে আমি রাখিয়া যাইতেছি, ইহাকে সম্পূর্ণই আপনাদের করিয়া লইবেন। ইহাকে আর-কিছু দিতে হইবে না, আপনাদের সকলের সেবা করিবার সম্পূর্ণ অধিকার দিবেন— আপনি নিশ্চয়ই জানিবেন, আপনাদের কাছে জ্ঞানপূর্বক এ একদিনের জন্যও অপরাধিনী হইবে না।”
কমলা লজ্জায় মুখখানি রাঙা করিয়া নতশিরে বসিয়া রহিল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “চক্রবর্তীমশায়, আপনি কিছুই ভাবিবেন না, হরিদাসী আমাদের ঘরের মেয়েই হইল। ওকে আমাদের কোনো কাজ দিবার জন্য আমাদের তরফ হইতে আজ পর্যন্ত কোনো চেষ্টা করিবার দরকারই হয় নাই। এ বাড়ির রান্নাঘরে ভাঁড়ার-ঘরে এতদিন আমার শাসনই একমাত্র প্রবল ছিল, এখন আমি সেখানে কেহই না। চাকর-বাকররাও আমাকে আর বাড়ির গৃহিণী বলিয়া গণ্যই করে না। কেমন করিয়া যে আস্তে আস্তে আমার এমন অবস্থাটা হইল, তাহা আমি টেরও পাইলাম না। আমার গোটাকয়েক চাবি ছিল, সেও কৌশল করিয়া হরিদাসী আত্মসাৎ করিয়াছে— চক্রবর্তীমশায়, আপনার এই ডাকাত মেয়েটির জন্যে আপনি আর কী চান বলুন দেখি ! এখন সব চেয়ে বড়ো ডাকাতি হয় যদি আপনি বলেন, এই মেয়েটিকে আমরা লইয়া যাইব।”
চক্রবর্তী কহিলেন, “আমি যেন বলিলাম, কিন্তু মেয়েটি কি নড়িবে ? তা মনেও করিবেন না। উহাকে আপনারা এমন ভুলাইয়াছেন যে, আজ আপনারা ছাড়া ও আর পৃথিবীতে কাহাকেও জানে না। দুঃখের জীবনে এতদিন পরে ও আপনাদের কাছেই আজ শান্তি পাইয়াছে— ভগবান ওর সেই শান্তি নির্বিঘ্ন করুন, আপনারা চিরদিন ওর ’পরে প্রসন্ন থাকুন, উহাকে সেই আশীর্বাদ করি।”
বলিতে বলিতে চক্রবর্তীর চক্ষু সজল হইয়া আসিল। নলিনাক্ষ কিছু না বলিয়া স্তব্ধ হইয়া চক্রবর্তীর কথা শুনিতেছিল; যখন সকলে বিদায় লইয়া গেলেন তখন ধীরে ধীরে সে আপনার ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল। তখন শীতের সূর্যাস্তকাল তাহার সমস্ত শয়নঘরটিকে নববিবাহের রক্তিমচ্ছটায় রঞ্জিত করিয়া তুলিয়াছিল। সেই রক্তবর্ণের আভা নলিনাক্ষের সমস্ত রোমকূপ ভেদ করিয়া তাহার অন্তঃকরণকে যেন রাঙাইয়া তুলিল।
আজ সকালে নলিনাক্ষের এক হিন্দুস্থানি বন্ধুর কাছ হইতে এক টুকরি গোলাপ আসিয়াছিল। ঘর সাজাইবার জন্য সেই গোলাপের টুকরি ক্ষেমংকরী কমলার হাতে দিয়াছিলেন। নলিনাক্ষের শয়নঘরের প্রান্তে একটি ফুলদানি হইতে সেই গোলাপের গন্ধ তাহার মস্তিষ্কের মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। সেই নিস্তব্ধ ঘরের বাতায়নের আরক্ত সন্ধ্যার সঙ্গে গোলাপের গন্ধ মিশিয়া নলিনাক্ষের মনকে কেমন যেন উতলা করিয়া তুলিল। এতদিন তাহার বিশ্বে চারি দিকে সংযমের শান্তি, জ্ঞানের গম্ভীরতা ছিল, আজ সেখানে হঠাৎ এমন নানা সুরের নহবত বাজিয়া উঠিল কোথা হইতে— কোন্ অদৃশ্য নৃত্যের চরণক্ষেপে ও নূপুরঝংকারে আজ আকাশতল এমন চঞ্চল হইয়া উঠিতে লাগিল !
নলিনাক্ষ জানলা হইতে ফিরিয়া ঘরের মধ্যে চাহিয়া দেখিল, তাহার বিছানার শিয়রের কাছে কুলুঙ্গির উপরে গোলাপফুলগুলি সাজানো রহিয়াছে। এই ফুলগুলি জানি না কাহার চোখের মতো তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, নিঃশব্দ আত্মনিবেদনের মতো তাহার হৃদয়ের দ্বারপ্রান্তে নত হইয়া পড়িল।
নলিনাক্ষ ইহার মধ্যে একটি ফুল তুলিয়া লইল— সেটি কাঁচা সোনার রঙের হলদে গোলাপ,পাপড়িগুলি খোলে নাই, কিন্তু গন্ধ লুকাইতে পারিতেছে না। সেই গোলাপটি হাতে লইতেই যেন সে কাহার আঙুলের মতো তাহার আঙুলকে স্পর্শ করিল, তাহার শরীরের সমস্ত স্নায়ুতন্তুকে রিমিঝিমি করিয়া বাজাইয়া তুলিল। নলিনাক্ষ সেই স্নিগ্ধকোমল ফুলটিকে নিজের মুখের উপরে, চোখের পল্লবের উপরে বুলাইতে লাগিল !
দেখিতে দেখিতে সন্ধ্যাকাশ হইতে অস্তসূর্যের আভা মিলাইয়া আসিল। নলিনাক্ষ ঘর হইতে বাহির হইবার পূর্বে একবার তাহার বিছানার কাছে গিয়া শয্যার আচ্ছাদনটি তুলিয়া ফেলিল এবং মাথার বালিশের উপর সেই গোলাপফুলটি রাখিল। রাখিয়া উঠিয়া আসিবে, এমন সময় খাটের ও পাশে মেঝের উপরে ও কে অঞ্চলে মুখ ঝাঁপিয়া লজ্জায় একেবারে মাটিতে মিশাইতে চাহিল ! হায় রে কমলা, লজ্জা রাখিবার আর স্থান নাই। সে আজ কুলুঙ্গিতে গোলাপ সাজাইয়া স্বহস্তে নলিনাক্ষের বিছানা করিয়া বাহির হইয়া আসিতেছিল, এমন সময়ে হঠাৎ নলিনাক্ষের পায়ের শব্দ শুনিয়া তাড়াতাড়ি বিছানার ও পাশে গিয়া লুকাইয়াছিল— এখন পালানোও অসম্ভব, লুকানোও কঠিন। তাহার রাশীকৃত-লজ্জা-সমেত এই ধূলির উপরে সে এমন একান্তভাবে ধরা পড়িয়া গেল।
নলিনাক্ষ এই লজ্জিতাকে মুক্তি দিবার জন্য তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইবার উপক্রম করিল। দরজা পর্যন্ত গিয়া একবার দাঁড়াইল। কিছুক্ষণ কী ভাবিয়া সে ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিল; কমলার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কহিল, “তুমি ওঠো, আমার কাছে তোমার কোনো লজ্জা নাই।”