নৌকাডুবি ৫৫

দিনের মধ্যে অক্ষয় এক সময় চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল। তিনি তাহাকে কমলার প্রত্যাবর্তন সম্বন্ধে কোনো কথাই বলিলেন না। রমেশের প্রতি অক্ষয়ের যে বিশেষ বন্ধুভাব নাই, তাহা খুড়া বুঝিতে পারিয়াছেন।

কমলা কেন চলিয়া গিয়াছিল, কোথায় চলিয়া গিয়াছিল, এ সম্বন্ধে বাড়ির কেহ কোনো প্রশ্নই করিল না— কমলা যেন ইঁহাদের সঙ্গেই কাশী বেড়াইতে আসিয়াছে, এমনিভাবে দিন কাটিয়া গেল। উমির দাই লছমনিয়া স্নেহমিশ্রিত ভর্ৎসনার ছলে কিছু বলিতে গিয়াছিল, খুড়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে আড়ালে ডাকিয়া শাসন করিয়া দিয়াছিলেন।

রাত্রে শৈলজা কমলাকে আপনার বিছানায় লইয়া শুইল। তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া লইল, এবং দক্ষিণ হস্ত দিয়া তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। এই কোমল হস্তস্পর্শ নীরব প্রশ্নের মতো কমলাকে তাহার গোপন বেদনার কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল।

কমলা কহিল, “দিদি, তোমরা কী মনে করিয়াছিলে ? আমার উপরে রাগ কর নাই ?”

শৈল কহিল, “আমাদের কি বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু নাই ? আমরা কি এটা বুঝি নাই, সংসারে তোর যদি কোনো পথ থাকিত তবে তুই এই ভয়ানক পথ লইতিস না। আমরা কেবল এই বলিয়া কাঁদিয়াছি, ভগবান তোকে কেন এমন সংকটে ফেলিলেন। যে লোক কোনো অপরাধ করিতে জানে না, সেও দণ্ড পায় !”

কমলা কহিল, “দিদি, আমার সব কথা তুমি শুনিবে ?”

শৈল স্নিগ্ধস্বরে কহিল, “শুনিব না তো কি বোন ?”

কমলা। তখন যে তোমাকে কেন বলিতে পারি নাই, তাহা জানি না। তখন আমার কোনো কথা ভাবিয়া দেখিবার সময় ছিল না। হঠাৎ মাথায় এমন বজ্রাঘাত হইয়াছিল যে, লজ্জায় তোমার কাছে মুখ দেখাইতে পারিতেছিলাম না। সংসারে আমার মা-বোন কেহ নাই, দিদি, তুমি আমার মা বোন দু’ই— তাই তোমার কাছে সব কথা বলিতেছি, নহিলে আমার যে কথা তাহা কাহারো কাছে বলিবার নয়।

কমলা আর শুইয়া থাকিতে পারিল না, উঠিয়া বসিল। শৈলও উঠিয়া তাহার সন্মুখে বসিল। সেই অন্ধকার বিছানার মধ্যে বসিয়া কমলা বিবাহ হইতে আরম্ভ করিয়া তাহার জীবনের কাহিনী বলিতে লাগিল।

কমলা যখন বলিল, বিবাহের পূর্বে বা বিবাহের রাত্রে সে তাহার স্বামীকে দেখে নাই তখন শৈল কহিল, “তোর মতো বোকা মেয়ে তো আমি দেখি নাই। তোর চেয়ে কম বয়সে আমার বিবাহ হইয়াছিল— তুই কি মনে করিস, লজ্জায় আমি আমার বরকে কোনো সুযোগে দেখিয়া লই নাই !”

কমলা কহিল, “লজ্জা নয় দিদি ! আমার বিবাহের বয়স প্রায় পার হইয়া গিয়াছিল। এমন সময়ে হঠাৎ যখন আমার বিবাহের কথা স্থির হইয়া গেল, তখন আমার সমস্ত সঙ্গিনীরা আমাকে বড়োই খ্যাপাইতে আরম্ভ করিয়াছিল। অধিক বয়সে বরকে পাইয়া আমি যে সাত রাজার ধন মানিক পাই নাই, ইহাই দেখাইবার জন্য আমি তাঁহার দিকে দৃকপাতমাত্র করি নাই। এমন-কি, তাঁহার জন্য কিছুমাত্র আগ্রহ মনের মধ্যে অনুভব করা আমি নিতান্ত লজ্জার বিষয়, অগৌরবের বিষয় বলিয়া মনে করিয়াছিলাম। আজ তাহারই শোধ দিতেছি।”

এই বলিয়া কমলা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পরে আরম্ভ করিল, “বিবাহের পর নৌকাডুবি হইয়া আমরা কী করিয়া রক্ষা পাইলাম, সে কথা তো তোমাকে পূর্বেই বলিয়াছি। কিন্তু যখন বলিয়াছিলাম তখনো জানিতাম না যে, মৃত্যু হইতে রক্ষা পাইয়া যাঁহার হাতে পড়িলাম, যাঁহাকে স্বামী বলিয়া জানিলাম, তিনি আমার স্বামী নহেন।”

শৈলজা চমকিয়া উঠিল; তাড়াতাড়ি কমলার কাছে আসিয়া তাহার গলা ধরিয়া কহিল, “হায় রে পোড়া কপাল— ও, তাই বটে। এতক্ষণে সব কথা বুঝিলাম। এমন সর্বনাশও ঘটে !”

কমলা কহিল, “বল্‌ দেখি দিদি, যখন মরিলেই চুকিয়া যাইত তখন বিধাতা এমন বিপদ ঘটাইলেন কেন ?”

শৈলজা জিজ্ঞাসা করিল, “রমেশবাবুও কিছুই জানিতে পারেন নাই ?”

কমলা কহিল, “বিবাহের কিছুকাল পরে তিনি একদিন আমাকে সুশীলা বলিয়া ডাকিতেছিলেন, আমি তাঁহাকে কহিলাম, ‘আমার নাম কমলা, তবু তোমরা সকলেই আমাকে সুশীলা বলিয়া ডাক কেন ?’ আমি এখন বুঝিতে পারিতেছি, সেইদিন তাঁহার ভুল ভাঙিয়াছিল। কিন্তু দিদি, সে-সকল দিনের কথা মনে করিতেও আমার মাথা হেঁট হইয়া যায়।” এই বলিয়া কমলা চুপ করিয়া রহিল।
শৈলজা একটু একটু করিয়া কথায় কথায় সমস্ত বৃত্তান্ত আগাগোড়া বাহির করিয়া লইল। সমস্ত কথা শোনা হইলে সে কহিল, “বোন, তোর দুঃখের কপাল, কিন্তু আমি এই কথা ভাবিতেছি, ভাগ্যে তুই রমেশবাবুর হাতে পড়িয়াছিলি। যাই বলিস, বেচারা রমেশবাবুর কথা মনে করিলে বড়ো দুঃখ হয়। আজ রাত অনেক হইল, কমল, তুই আজ ঘুমো। ক’দিন রাত জাগিয়া কাঁদিয়া মুখ কালি হইয়া গেছে। এখন কী করিতে হইবে, কাল সব ঠিক করা যাইবে।”

রমেশের লিখিত সেই চিঠি কমলার কাছে ছিল। পরদিন সেই চিঠিখানি লইয়া শৈলজা তাহার পিতাকে নিভৃত ঘরে ডাকিয়া পাঠাইল এবং চিঠি তাঁহার হাতে দিল। খুড়া চশমা চোখে তুলিয়া অত্যন্ত ধীরে ধীরে পাঠ করিলেন; তাহার পরে চিঠি মুড়িয়া, চশমা খুলিয়া কন্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাই তো, এখন কী কর্তব্য ?”

শৈল কহিল, “বাবা, উমির কয়দিন হইতে সর্দিকাসি করিয়াছে, একবার নলিনাক্ষ ডাক্তারকে ডাকিয়া আনাও-না। কাশীতে তাঁহার আর তাঁর মার তো খুব নাম শোনা যায়। একবার তাঁকে দেখিই-না।”

রোগীকে দেখিবার জন্য ডাক্তার আসিল এবং ডাক্তারকে দেখিবার জন্য শৈল ব্যস্ত হইয়া উঠিল। কহিল, “কমল, আয়, শীঘ্র আয়।”

নবীনকালীর বাড়ি যে কমলা নলিনাক্ষকে দেখিবার ব্যগ্রতায় প্রায় আত্মবিস্মৃত হইয়া উঠিয়াছিল, সেই কমলা আজ লজ্জায় উঠিতে চায় না।

শৈল কহিল, “দেখ্‌ পোড়ারমুখী, আমি তোকে বেশিক্ষণ সাধিব না, তা আমি বলিয়া রাখিতেছি— আমার সময় নাই— উমির ব্যামো কেবল নামমাত্র, ডাক্তার বেশিক্ষণ থাকিবে না— তোকে সাধাসাধি করিতে গিয়া মাঝে হইতে আমার দেখা হইবে না।”

এই বলিয়া কমলাকে জোর করিয়া টানিয়া লইয়া শৈলজা দ্বারের অন্তরালে আসিয়া দাঁড়াইল। নলিনাক্ষ উমার বুক-পিঠ ভালো করিয়া পরীক্ষা করিয়া ওষুধ লিখিয়া দিয়া চলিয়া গেল।

শৈল কমলাকে কহিল, “কমল, বিধাতা তোকে যতই দুঃখ দিন, তোর ভাগ্য ভালো। এখন দুই-একদিন, বোন তোকে একটু ধৈর্য ধরিয়া থাকিতে হইবে— আমরা একটা ব্যবস্থা করিয়া দিতেছি। ইতিমধ্যে উমির জন্যে ঘন ঘন ডাক্তারের প্রয়োজন হইবে, অতএব নিতান্ত তোকে বঞ্চিত হইতে হইবে না।”

খুড়া একদিন এমন সময় বাছিয়া ডাক্তার ডাকিতে গেলেন যখন নলিনাক্ষ বাড়িতে থাকে না। চাকর কহিল, “ডাক্তারবাবু নাই।”

খুড়া কহিলেন, “মাঠাকরুন তো আছেন, তাঁহাকে একবার খবর দাও। বলো একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে চায়।”

উপরে ডাক পড়িল। খুড়া গিয়া কহিলেন, “মা আপনার নাম কাশীতে বিখ্যাত। তাই আপনাকে দেখিয়া পুণ্যসঞ্চয় করিতে আসিলাম। আমার আর-কোনো কামনা নাই। আমার একটি দৌহিত্রীর অসুখ, আপনার ছেলেকে ডাকিতে আসিয়াছিলাম, তিনি বাড়ি নাই ; তাই মনে করিলাম শুধু-শুধু ফিরিব না, একবার আপনাকে দর্শন করিয়া যাইব।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “নলিন এখনি আসিবে, আপনি ততক্ষণ একটু বসুন। বেলা নিতান্ত কম হয় নাই, আপনার জন্য কিছু জলখাবার আনাইয়া দিই।”

খুড়া কহিলেন, “আমি জানিতাম, আপনি আমাকে না খাওয়াইয়া ছাড়িবেন না— আমার যে ভোজনে বেশ একটুখানি শখ আছে তাহা আমাকে দেখিলেই লোকে টের পায়, এবং সকলেই এ বিষয়ে আমাকে একটু দয়াও করে।”
ক্ষেমংকরী খুড়াকে জল খাওয়াইয়া বড়ো খুশি হইলেন। কহিলেন, “কাল আমার এখানে আপনার মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্ত্রণ রহিল; আজ প্রস্তুত ছিলাম না, আপনাকে ভালো করিয়া খাওয়াইতে পারিলাম না।”

খুড়া কহিলেন, “যখনই প্রস্তুত হইবেন এই ব্রাহ্মণকে স্মরণ করিবেন। আপনাদের বাড়ি হইতে আমি বেশি দূরে থাকি না। বলেন তো আপনার চাকরটাকে লইয়া আমার বাড়ি দেখাইয়া আসিব।”

এমনি করিয়া খুড়া দুই-চারি দিনের যাতায়াতেই নলিনাক্ষের বাড়িতে বেশ একটু জমাইয়া লইলেন।

ক্ষেমংকরী নলিনাক্ষকে ডাকিয়া কহিলেন, “ও নলিন, তুই চক্রবর্তীমশায়ের কাছ থেকে ভিজিট নিস নে যেন।”

খুড়া হাসিয়া কহিলেন, “মাতৃ-আজ্ঞা উনি পাইবার পূর্ব হইতেই পালন করিয়া আসিতেছেন, আমার কাছ হইতে উনি কিছুই নেন নাই। যাঁহারা দাতা তাঁহারা গরিবকে দেখিলেই চিনিতে পারেন।”

দিন-দুয়েক পিতায় ও কন্যায় পরামর্শ চলিল। তাহার পরে একদিন সকালে খুড়া কমলাকে কহিল, “চলো মা, আমরা দশাশ্বমেধে স্নান করিতে যাই।”

কমলা শৈলকে কহিল, “দিদি, তুমিও চলো-না।”

শৈল কহিল, “না ভাই, উমির শরীর তেমন ভালো নাই।”

খুড়া যে পথ দিয়া স্নানের ঘাটে গেলেন স্নানান্তে সে পথ দিয়া না ফিরিয়া অন্য এক রাস্তায় চলিলেন। কিছু দূর গিয়াই দেখিলেন, একটি প্রবীণা স্নান সারিয়া পট্টবস্ত্র পরিয়া ঘটিতে গঙ্গাজল লইয়া ধীরে ধীরে আসিতেছেন।

কমলাকে সম্মুখে আনিয়া খুড়া কহিলেন, “মা, ইঁহাকে প্রণাম করো, ইনি ডাক্তারবাবুর মাতা।”

কমলা শুনিয়া চকিত হইয়া উঠিয়া, তৎক্ষণাৎ ক্ষেমংকরীকে প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ের ধুলা লইল।

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তুমি কে গা ! দেখি দেখি, কী রূপ ! যেন লক্ষ্মীটির প্রতিমা !”

বলিয়া কমলার ঘোমটা সরাইয়া তাহার নতনেত্র মুখখানি ভালো করিয়া দেখিলেন। কহিলেন, “তোমার নাম কী বাছা ?”

কমলা উত্তর করিবার পূর্বেই খুড়া কহিলেন, “ইঁহার নাম হরিদাসী। ইনি আমার দূরসম্পর্কের ভ্রাতুষ্পুত্রী। ইহার মা-বাপ কেহ নাই, আমার উপরেই নির্ভর।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আসুন-না চক্রবর্তীমশায়, আমার বাড়িতেই আসুন।”

বাড়িতে লইয়া গিয়া ক্ষেমংকরী একবার নলিনাক্ষকে ডাকিলেন। নলিনাক্ষ তখন বাহির হইয়া গেছেন।

খুড়া আসন গ্রহণ করিলেন, কমলা মেজের উপরে বসিল। খুড়া কহিলেন, “দেখুন, আমার এই ভাইঝির ভাগ্য বড়ো মন্দ। বিবাহের পরদিনই ইহার স্বামী সন্ন্যাসী হইয়া বাহির হইয়া গেছেন, ইঁহার সঙ্গে আর দেখা-সাক্ষাৎ নাই। হরিদাসীর ইচ্ছা ধর্মকর্ম লইয়া তীর্থবাস করে— ধর্ম ছাড়া উঁহার সান্ত্বনার সামগ্রী আর তো কিছুই নাই। এখানে আমার বাড়ি নয়, আমার চাকরি আছে— উপার্জন করিয়া আমাকে সংসার চালাইতে হয়। আমি যে এখানে আসিয়া ইঁহাকে লইয়া থাকিব, আমার এমন সুবিধা নাই। তাই আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি। এটিকে আপনার মেয়ের মতো যদি কাছে রাখেন তবে আমি বড়ো নিশ্চিন্ত হই। যখনই অসুবিধা বোধ করিবেন গাজিপুরে আমার কাছে পাঠাইয়া দিবেন। কিন্তু আমি বলিতেছি দুদিন ইঁহাকে কাছে রাখিলেই মেয়েটি কী রত্ন তাহা বুঝিতে পারিবেন, তখন মুহূর্তের জন্য ছাড়িতে চাহিবেন না।”

ক্ষেমংকরী খুশি হইয়া কহিলেন, “আহা, এ তো ভালো কথা। এমন মেয়েটিকে আপনি যে আমার কাছে রাখিয়া যাইতেছেন, এ তো আমার মস্ত লাভ। আমি কতদিন রাস্তা হইতে পরের মেয়েকে বাড়িতে আনিয়া খাওয়াইয়া পরাইয়া আনন্দ করি, কিন্তু তাহাদের তো রাখিতে পারি না। তা, হরিদাসী আমারই হইল, আপনি ইহার জন্য কিছুমাত্র ভাবিবেন না। আমার ছেলের কথা অবশ্য আপনারা পাঁচজনের কাছে শুনিয়া থাকিবেন-নলিনাক্ষ— সে বড়ো ভালো ছেলে। সে ছাড়া বাড়িতে আর কেহ নাই।”
খুড়া কহিলেন, “নলিনাক্ষবাবুর নাম সকলেই জানে। তিনি এখানে আপনার কাছে থাকেন জানিয়া আমি আরো নিশ্চিন্ত। আমি শুনিয়াছি, বিবাহের পর দুর্ঘটনায় তাঁহার স্ত্রী জলে ডুবিয়া মারা যাওয়াতে তিনি সেই অবধি একরকম ব্রহ্মচারীর মতোই আছেন।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে যাহা হইয়াছে হইয়াছে, ও কথা আর তুলিবেন না— মনে করিলেও আমার গায়ে কাঁটা দিয়া ওঠে।”

খুড়া কহিলেন, “যদি অনুমতি করেন তবে মেয়েটিকে আপনার কাছে রাখিয়া এখন বিদায় হই। মাঝে মাঝে আসিয়া দেখিয়া যাইব। ইঁহার একটি বড়ো বোন আছে, সেও আপনাকে প্রণাম করিতে আসিবে।”

খুড়া চলিয়া গেলে ক্ষেমংকরী কমলাকে কাছে টানিয়া লইয়া কহিলেন, “এসো তো মা, দেখি। তোমার বয়স তো বেশি নয়। আহা, তোমাকে ফেলিয়া যাইতে পারে, জগতে এমন পাষাণও আছে ! আমি আশীর্বাদ করিতেছি, সে আবার ফিরিয়া আসিবে। বিধাতা এত রূপ কখনো বৃথা নষ্ট করিবার জন্য গড়েন নাই।”

বলিয়া কমলার চিবুক স্পর্শ করিয়া অঙ্গুলির দ্বারা চুম্বন গ্রহণ করিলেন।

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এখানে তোমার সমবয়সী সঙ্গিনী কেহ নাই, একলা আমার কাছে থাকিতে পারিবে তো ?”

কমলা তাহার দুই বড়ো বড়ো স্নিগ্ধ চক্ষে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করিয়া কহিল, “পারিব মা !”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তোমার দিন কাটিবে কী করিয়া আমি তাই ভাবিতেছি।”

কমলা কহিল, “আমি তোমার কাজ করিব।”

ক্ষেমংকরী। পোড়াকপাল ! আমার আবার কাজ ! সংসারে ঐ তো আমার একটিমাত্র ছেলে, সেও সন্ন্যাসীর মতো থাকে— কখনো যদি বলিত ‘মা, এইটে আমার দরকার আছে, আমি এইটে খেতে চাই, আমি এইটে ভালোবাসি’, তবে আমি কত খুশি হইতাম— তাও কখনো বলে না। রোজগার ঢের করে, হাতে কিছুই রাখে না ; কত সৎকাজে যে কত দিকে খরচ করে তাহা কাহাকে জানিতেও দেয় না। দেখো বাছা, আমার কাছে যখন তোমাকে চব্বিশ ঘন্টা থাকিতে হইবে তখন এ কথা আগে হইতেই বলিয়া রাখিতেছি, আমার মুখে আমার ছেলের গুণগান বার বার শুনিয়া তোমার বিরক্ত ধরিবে, কিন্তু ঐটে তোমাকে সহ্য করিয়া যাইতে হইবে।

কমলা পুলকিতচিত্তে চক্ষু নত করিল।

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আমি তোমাকে কী কাজ দিব, তাই ভাবিতেছি। সেলাই করিতে জান।”

কমলা কহিল, “ভালো জানি না মা !”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আচ্ছা, আমি তোমাকে সেলাই শিখাইয়া দিব।”

ক্ষেমংকরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “পড়িতে জান তো ?”

কমলা কহিল, “হাঁ, জানি।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে হইল ভালো। চোখে তো আর চশমা নহিলে দেখিতে পাই না, তুমি আমাকে পড়িয়া শোনাইতে পারিবে।”

কমলা কহিল, “আমি রাঁধাবাড়া ঘরকন্নার কাজ সমস্ত শিখিয়াছি।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “অমন অন্নপূর্ণার মতো চেহারা, তুমি যদি রাঁধাবাড়ার কাজ না জানিবে তো কে জানিবে। আজ পর্যন্ত নলিনকে আমি নিজে রাঁধিয়া খাওয়াইয়াছি— আমার অসুখ হইলে বরঞ্চ স্বপাক রাঁধিয়া খায়, তবু আর কাহারো হাতে খায় না। এবার হইতে তোমার কল্যাণে তাহার স্বপাক খাওয়া আমি ঘোচাইব। আর, অক্ষম হইয়া পড়িলে আমাকেও যদি চারটিখানি হবিষ্যান্ন রাঁধিয়া খাওয়াও তো আমার তাহাতে অনভিরুচি হইবে না। চলো মা, তোমাকে আমার ভাঁড়ার-ঘর রান্নাঘর সমস্ত দেখাইয়া আনি।”
এই বলিয়া ক্ষেমংকরী তাঁহার ক্ষুদ্র ঘরকন্নার সমস্ত নেপথ্যগৃহ কমলাকে দেখাইলেন। কমলা ইতিমধ্যে একটা অবকাশ বুঝিয়া আস্তে আস্তে আপনার দরখাস্ত জারি করিল। কহিল, “মা, আমাকে আজকে রাঁধিতে দাও-না।”

ক্ষেমংকরী একটুখানি হাসিলেন। কহিলেন, “গৃহিণীর রাজত্ব ভাঁড়ারে আর রান্নাঘরে— জীবনে অনেক জিনিস ছাড়িতে হইয়াছে, তবু ওটুকু সঙ্গে সঙ্গে লাগিয়াই আছে। তা মা, আজকের মতো তুমিই রাঁধো— দুই-চারিদিন যাক, ক্রমে সমস্ত ভার আপনিই তোমার হাতে পড়িবে, আমিও ভগবানে মন দিবার সময় পাইব। বন্ধন একেবারেই তো কাটে না— এখনো দুই-চারিদিন মন চঞ্চল হইয়া থাকিবে, ভাঁড়ার ঘরের সিংহাসনটি কম নয়।”

এই বলিয়া ক্ষেমংকরী, কী রাঁধিতে হইবে, কি করিতে হইবে, কমলাকে সমস্ত উপদেশ দিয়া পূজাগৃহে চলিয়া গেলেন। ক্ষেমংকরীর কাছে আজ কমলার ঘরকন্নার পরীক্ষা আরম্ভ হইল।

কমলা তাহার স্বাভাবিক তৎপরতার সহিত রন্ধনের সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত করিয়া, কোমরে আঁচল জড়াইয়া, মাথায় এলোচুল ঝুঁটি করিয়া লইয়া রাঁধিতে প্রবৃত্ত হইল।

নলিনাক্ষ বাহির হইতে বাড়িতে ফিরিলেই প্রথমে তাহার মাকে দেখিতে যাইত। তাহার মাতার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে চিন্তা তাহাকে কখনোই ছাড়িত না। আজ বাড়িতে প্রবেশ করিবামাত্র রান্নাঘরের শব্দ এবং গন্ধ তাহাকে আক্রমণ করিল। মা এখন রান্নায় প্রবৃত্ত আছেন মনে করিয়া নলিনাক্ষ রান্নাঘরের দরজার সামনে আসিয়া উপস্থিত হইল।

পদশব্দে চকিত কমলা পিছন ফিরিয়া চাহিতেই একেবারে নলিনাক্ষের সহিত তাহার চোখে চোখে সাক্ষাৎ হইয়া গেল। তাড়াতাড়ি হাতাটা রাখিয়া ঘোমটা টানিয়া দিবার বৃথা চেষ্টা করিল— কোমরে আঁচল জড়ানো ছিল— টানাটানি করিয়া ঘোমটা যখন মাথার কিনারায় উঠিল বিস্মিত নলিনাক্ষ তখন সেখান হইতে চলিয়া গেছে। তাহার পর কমলা যখন হাতা তুলিয়া লইল তখন তাহার হাত কাঁপিতেছে।

পূজা সকাল-সকাল সারিয়া ক্ষেমংকরী যখন রান্নাঘরে গেলেন, দেখিলেন, রান্না সারা হইয়া গেছে। ঘর ধুইয়া কমলা পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছে; কোথাও পোড়াকাঠ বা তরকারির খোসা বা কোনোপ্রকার অপিরচ্ছন্নতা নাই। দেখিয়া ক্ষেমংকরী মনে মনে খুশি হইলেন; কহিলেন, “মা, তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে বটে।”

নলিনাক্ষ আহারে বসিলে ক্ষেমংকরী তাহার সম্মুখে বসিলেন; আর-একটি সংকুচিত প্রাণী কান পাতিয়া দ্বারের আড়ালে দাঁড়াইয়া ছিল, উঁকি মারিতে সাহস করিতেছিল না— ভয়ে মরিয়া যাইতেছিল, পাছে তাহার রান্না খারাপ হইয়া থাকে।

ক্ষেমংকরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “নলিন, আজ রান্নাটা কেমন হইয়াছে ?”

নলিনাক্ষ ভোজ্যপদার্থ সম্বন্ধে সমজদার ছিল না, তাই ক্ষেমংকরী এরূপ অনাবশ্যক প্রশ্ন কখনো তাহাকে করিতেন না; আজ বিশেষ কৌতূহলবশতই জিজ্ঞাসা করিলেন।

নলিনাক্ষ যে অদ্যকার রান্নাঘরের নূতন রহস্যের পরিচয় পাইয়াছে তাহা তাহার মা জানিতেন না। ইদানীং মাতার শরীর খারাপ হওয়াতে নলিনাক্ষ রাঁধিবার জন্য লোক নিযুক্ত করিতে মাকে অনেক পীড়াপীড়ি করিয়াছে, কিন্তু কিছুতেই তাঁহাকে রাজি করিতে পারে নাই। আজ নূতন লোককে রন্ধনে নিযুক্ত দেখিয়া সে মনে মনে খুশি হইয়াছে। রান্না কিরূপ হইয়াছে তাহা সে বিশেষ মনোযোগ করে নাই, কিন্তু উৎসাহের সহিত কহিল, “রান্না চমৎকার হইয়াছে মা !”
আড়াল হইতে এই উৎসাহবাক্য শুনিয়া কমলা আর স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিল না। সে দ্রুতপদে পাশের একটা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া আপনার চঞ্চল বক্ষকে দুই বাহুর দ্বারা পীড়ন করিয়া ধরিল।

আহারান্তে নলিনাক্ষ আপনার মনের মধ্যে কী-একটা অস্পষ্টতাকে স্পষ্ট করিবার চেষ্টা করিতে করিতে প্রাত্যহিক অভ্যাস-অনুসারে নিভৃত অধ্যয়নে চলিয়া গেল।

বৈকালে ক্ষেমংকরী কমলাকে লইয়া নিজে তাহার চুল বাঁধিয়া সীমন্তে সিঁদুর পরাইয়া দিলেন; তাহার মুখ একবার এ পাশে, একবার ও পাশে ফিরাইয়া ভালো করিয়া দেখিলেন— কমলা লজ্জায় চক্ষু নত করিয়া বসিয়া রহিল। ক্ষেমংকরী মনে মনে কহিলেন, ‘আহা, আমি যদি এইরকমের একটি বউ পাইতাম !’

সেই রাত্রেই ক্ষেমংকরীর আবার জ্বর আসিল। নলিনাক্ষ উদ্‌‍বিগ্ন হইয়া উঠিল। কহিল, “মা, তোমাকে আমি কিছুদিন কাশী হইতে অন্য কোথাও লইয়া যাইব। এখানে তোমার শরীর ভালো থাকিতেছে না।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সেটি হবে না বাছা ! দু-চারদিন বাঁচাইয়া রখিবার আশায় আমাকে যে কাশী ছাড়িয়া অন্য কোথাও লইয়া মারিবি, সেটি হবে না। ও কি মা, তুমি যে দরজার পাশে দাঁড়াইয়া আছ ! যাও যাও, শুতে যাও। সমস্ত রাত অমন জাগিয়া কাটাইলে চলিবে না। আমি যে-কয়দিন ব্যামোতে আছি তোমাকেই তো সব দেখিতে শুনিতে হইবে। রাত জাগিলে পারিবে কেন ? যা তো নলিন, একবার ও ঘরে যা তো।”

নলিনাক্ষ পাশের ঘরে যাইতেই কমলা ক্ষেমংকরীর পদতলে বসিয়া তাঁহার পায়ে হাত বুলাইতে লাগিল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আর-জন্মে নিশ্চয়ই তুমি আমার মা ছিলে মা ! নহিলে কোথাও কিছু নাই তোমাকে এমন করিয়া পাইব কেন ? দেখো, আমার একটা অভ্যাস আছে, আমি বাজে কোনো লোকের সেবা সহিতে পারি না, কিন্তু তুমি আমার গায়ে হাত দিলে আমার গা যেন জুড়াইয়া যায়। আশ্চর্য এই যে, মনে হইতেছে , তোমাকে আমি যেন কতকাল ধরিয়া জানি। তোমাকে তো একটুও পর মনে হয় না। তা, শোনো মা, তুমি নিশ্চিন্তমনে ঘুমাইতে যাও। পাশের ঘরে নলিন রহিল— মার সেবা সে আর কারো হাতে ছাড়িয়া দিতে পারিবে না— তা, হাজার বারণ করি আর যাই করি— ওর সঙ্গে পারিয়া উঠিবে কে বলো। কিন্তু ওর একটি গুণ আছে, রাত জাগুক আর যাই করুক, ওর মুখ দেখিয়া কিছু বুঝা যাইবে না— তার কারণ, ও কখনো কিছুতে অস্থির হয় না। আমার ঠিক তার উলটা। মা, তুমি বোধ করি মনে মনে হাসিতেছ। ভাবিতেছ, নলিনের কথা আরম্ভ হইল, এবারে আর কথা থামিবে না। তা মা, এক ছেলে থাকিলে ঐরকমই হয়। আর নলিনের মতো ছেলেই বা কজন মায়ের হয় ? সত্য বলিতেছি, আমি এক-একবার ভাবি — নলিন তো আমার বাপ, ও আমার জন্যে যতটা করিয়াছে আমি কি উহার জন্যে ততটা করিতে পারি। ঐ দেখো, আবার নলিনের কথা ! কিন্তু আর নয়, যাও মা, তুমি শুইতে যাও। না না, সে কিছুতেই হইতে পারিবে না, তুমি যাও— তুমি থাকিলে আমার ঘুম আসিবে না। বুড়োমানুষ, লোক কাছে থাকিলেই কেবল বকিতে ইচ্ছা করে।”

পরদিন কমলাই ঘরকন্নার সমুদয় ভার গ্রহণ করিল। নলিনাক্ষ পূর্ব দিকের বারান্দায় এক অংশ ঘিরিয়া লইয়া মার্বেল দিয়া বাঁধাইয়া একটি ছোটো ঘর করিয়া লইয়াছিল, ইহাই তাহার উপাসনাগৃহ ছিল, এবং মধ্যাহ্নে এইখানেই সে আসনের উপর বসিয়া অধ্যয়ন করিত। সেদিন প্রাতে সে ঘরে নলিনাক্ষ প্রবেশ করিয়াই দেখিল, ঘরটি ধৌত, মার্জিত, পরিচ্ছন্ন; ধুনা জ্বালাইবার জন্য একটি পিতলের ধুনুচি ছিল, সেটি আজ সোনার মতো ঝক্‌ ঝক্‌ করিতেছে। শেল্‌‌ফের উপরে তাহার কয়েকখানি বই ও পুঁথি সুসজ্জিত করিয়া বিন্যস্ত হইয়াছে। এই গৃহখানির যত্নমার্জিত নির্মলতার উপরে মুক্তদ্বার দিয়া প্রভাতরৌদ্রের উজ্জ্বলতা পরিব্যাপ্ত হইয়াছে, দেখিয়া স্নান হইতে সদ্যঃপ্রত্যাগত নলিনাক্ষের মনে বিশেষ একটি তৃপ্তির সঞ্চার হইল।

কমলা প্রভাতে ঘটিতে গঙ্গাজল লইয়া ক্ষেমংকরীর বিছানার পাশে আসিয়া উপস্থিত হইল। তিনি তাহার স্নাতমূর্তি দেখিয়া কহিলেন, “একি মা, তুমি একলাই ঘাটে গিয়াছিলে ? আমি আজ ভোর হইতে ভাবিতেছিলাম, আমার অসুখ, তুমি কাহার সঙ্গে স্নানে যাইবে। কিন্তু তোমার অল্প বয়স, এমন করিয়া একলা— ”
কমলা কহিল, “মা, আমার বাপের বাড়ির একটা চাকর থাকিতে পারে নাই, আমাকে দেখিতে কাল রাত্রেই এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। তাহাকে সঙ্গে লইয়াছিলাম।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আহা, তোমার খুড়িমা বোধ হয় অস্থির হইয়া উঠিয়াছেন, চাকরটাকে পাঠাইয়া দিয়াছেন। তা, বেশ হইয়াছে— সে তোমার কাছেই থাক্‌-না, তোমার কাজে-কর্মে সাহায্য করিবে। কোথায় সে, তাহাকে ডাকো-না।”

কমলা উমেশকে লইয়া হাজির করিল। উমেশ গড় হইয়া ক্ষেমংকরীকে প্রণাম করিতে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোর নাম কী রে ?”

সে কহিল, “আমার নাম উমেশ।”

বলিয়া অকারণ-বিকশিত হাস্যে তাহার মুখ ভরিয়া গেল।

ক্ষেমংকরী হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “উমেশ, তোর এই বাহারে কাপড়খানা তোকে কে দিল রে ?”

উমেশ কমলাকে দেখাইয়া কহিল, “মা দিয়াছেন।”

ক্ষেমংকরী কমলার দিকে চাহিয়া পরিহাস করিয়া কহিলেন, “আমি বলি, উমেশ বুঝি ওর শাশুড়ির কাছ হইতে জামাইষষ্ঠী পাইয়াছে।”

ক্ষেমংকরীর স্নেহ লাভ করিয়া উমেশ এইখানেই রহিয়া গেল।

উমেশকে সহায় করিয়া কমলা দিনের বেলাকার সমস্ত কাজকর্ম শেষ করিয়া ফেলিল। স্বহস্তে নলিনাক্ষের শোবার ঘর ঝাঁট দিয়া, তাহার বিছানা রৌদ্রে দিয়া, তুলিয়া, সমস্ত পরিচ্ছন্ন করিয়া রাখিল। নলিনাক্ষের ময়লা ছাড়া-ধুতি ঘরের এক কোণে পড়িয়া ছিল। কমলা সেখানি ধুইয়া, শুকাইয়া ভাঁজ করিয়া আলনার উপরে ঝুলাইয়া রাখিল। ঘরের যে-সব জিনিস কিছুমাত্র অপরিষ্কার ছিল না তাহাও সে মুছিবার ছলে বার বার নাড়াচাড়া করিয়া লইল। বিছানার শিয়রের কাছে দেয়ালে একটা গা-আলমারি ছিল; সেটা খুলিয়া দেখিল তাহার মধ্যে আর-কিছুই নাই, কেবল নীচের থাকে নলিনাক্ষের এক জোড়া খড়ম আছে। তাড়াতাড়ি সেই খড়ম জোড়াটি তুলিয়া লইয়া কমলা মাথায় ঠেকাইল, এবং ছোটো শিশুটির মতো বুকের কাছে ধরিয়া অঞ্চল দিয়া বার বার তাহার ধুলা মুছাইয়া দিল।

বৈকালে কমলা ক্ষেমংকরীর পায়ের কাছে বসিয়া তাঁহার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছে, এমন সময় হেমনলিনী একটি ফুলের সাজি লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল এবং ক্ষেমংকরীকে প্রণাম করিল।

ক্ষেমংকরী উঠিয়া বসিয়া কহিল, “এসো এসো, হেম, এসো, বোসো। অন্নদাবাবু ভালো আছেন ?”

হেমনলিনী কহিল, “তাঁহার শরীর অসুস্থ ছিল বলিয়া কাল আসিতে পারি নাই, আজ তিনি ভালো আছেন।”

কমলাকে দেখাইয়া ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এই দেখো বাছা, শিশুকালে আমার মা মারা গেছেন; তিনি আবার জন্ম লইয়া এতদিন পরে কাল পথের মধ্যে হঠাৎ আমাকে দেখা দিয়াছেন। আমার মা’র নাম ছিল হরিভাবিনী, এবারে হরিদাসী নাম লইয়াছেন। কিন্তু হেম, এমন লক্ষ্মীর মূর্তি আর কোথাও দেখিয়াছ ? বলো তো।”

কমলা লজ্জায় মুখ নিচু করিল। হেমনলিনীর সঙ্গে আস্তে আস্তে তাহার পরিচয় হইয়া গেল।

হেমনলিনী ক্ষেমংকরীকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘মা, আপনার শরীর কেমন আছে ?”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “দেখো, আমার যে বয়স হইয়াছে এখন আমাকে আর শরীরের কথা জিজ্ঞাসা করা চলে না। আমি যে এখনো আছি, এই ঢের। কিন্তু তাই বলিয়া কালকে চিরদিন ফাঁকি দেওয়া তো চলিবে না। তা, তুমি যখন কথাটা পাড়িয়াছ ভালোই হইয়াছে— তোমাকে কিছুদিন হইতে বলিব বলিব করিতেছি, সুবিধা হইতেছে না। কাল রাত্রে আবার যখন আমাকে জ্বরে ধরিল তখন ঠিক করিলাম, আর বিলম্ব করা ভালো হইতেছে না। দেখো বাছা, ছেলেবয়সে আমাকে যদি কেহ বিবাহের কথা বলিত তো লজ্জায় মরিয়া যাইতাম— কিন্তু তোমাদের তো সেরকম শিক্ষা নয়। তোমরা লেখাপড়া শিখিয়াছ, বয়সও হইয়াছে, তোমাদের কাছে এ-সব কথা স্পষ্ট করিয়া বলা চলে। সেইজন্যই কথাটা পাড়িতেছি, তুমি আমার কাছে লজ্জা করিয়ো না। আচ্ছা, বলো তো বাছা, সেদিন তোমার বাপের কাছে যে প্রস্তাব করিয়াছিলাম তিনি কি তোমাকে বলেন নি ?”
হেমনলিনী নতমুখে কহিল, “হাঁ, বলিয়াছিলেন।”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “কিন্তু তুমি, বাছা, সে কথায় নিশ্চয়ই রাজি হও নাই। যদি রাজি হইতে তবে অন্নদাবাবু তখনি আমার কাছে ছুটিয়া আসিতেন। তুমি ভাবিলে, আমার নলিন সন্ন্যাসী-মানুষ, দিবারাত্রি কী-সব যোগযাগ লইয়া আছে, উহাকে আবার বিবাহ করা কেন ? হোক আমার ছেলে তবু কথাটা উড়াইয়া দিবার নয়। উহাকে বাহির হইতে দেখিলে মনে হয়, উহার যেন কিছুতেই কোনোদিন আসক্তি জন্মিবার সম্ভবনা নাই। কিন্তু সেটা তোমাদের ভুল। আমি উহাকে জন্মকাল হইতে জানি, আমার কথাটা বিশ্বাস করিয়ো। ও এত বেশি ভালোবসিতে পারে যে, সেই ভয়েই ও আপনাকে এত করিয়া দমন করিয়া রাখে। উহার এই সন্ন্যাসের খোলা ভাঙিয়া যে উহার হৃদয় পাইবে সে বড়ো মধুর জিনিসটি পাইবে তাহা আমি বলিয়া রাখিতেছি। মা হেম, তুমি বালিকা নও, তুমি শিক্ষিত, তুমি আমার নলিনের কাছ হইতেই দীক্ষা লইয়াছ, তোমাকে নলিনের ঘরে প্রতিষ্ঠিত করিয়া আমি যদি মরিতে পারি তবে বড়ো নিশ্চিন্ত হইয়া মরিতে পারিব। নহিলে, আমি নিশ্চয় জানি, আমি মরিলে ও আর বিবাহই করিবে না। তখন ওর কী দশা হইবে ভাবিয়া দেখো দেখি। একেবারে ভাসিয়া বেড়াইবে। যাই হোক, বলো তো বাছা, তুমি তো নলিনকে শ্রদ্ধা কর আমি জানি, তবে তোমার মনে আপত্তি উঠিতেছে কেন ?”

হেমনলিনী নতনেত্রে কহিল, “মা, তুমি যদি আমাকে যোগ্য মনে কর তবে আমার কোনো আপত্তি নাই।”

শুনিয়া ক্ষেমংকরী হেমনলিনীকে কাছে টানিয়া লইয়া তাহার মাথায় চুম্বন করিলেন। এ সম্বন্ধে আর কোনো কথা বলিলেন না।

“হরিদাসী, এ ফুলগুলো”— বলিতে বলিতে পাশে চাহিয়া দেখিলেন, হরিদাসী নাই। সে নিঃশব্দপদে কখন উঠিয়া গেছে।

পূর্বোক্ত আলোচনার পর ক্ষেমংকরীর কাছে হেমনলিনী সংকোচ বোধ করিল, ক্ষেমংকরীও বাধো-বাধো করিতে লাগিল। তখন হেম কহিল, “মা, আজ তবে সকাল-সকাল যাই। বাবার শরীর ভালো নাই।”

বলিয়া ক্ষেমংকরীকে প্রণাম করিল। ক্ষেমংকরী তাহার মাথায় হাত দিয়া কহিলেন, “এসো মা, এসো।”

হেমনলিনী চলিয়া গেলে ক্ষেমংকরী নলিনাক্ষকে ডাকিয়া পাঠাইলেন; কহিলেন, “নলিন, আর আমি দেরি করিতে পারিব না।”

নলিনাক্ষ কহিল, “ব্যাপারখানা কী ?”

ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আমি আজ হেমকে সব কথা খুলিয়া বলিলাম ; সে তো রাজি হইয়াছে, এখন তোমার কোনো ওজর আমি শুনিতে চাই না। আমার শরীর তো দেখিতেছিস। তোদের একটা স্থিতি না করিয়া আমি কোনোমতেই সুস্থির হইতে পারিতেছি না। অর্ধেক রাত্রে ঘুম ভাঙিয়া আমি ঐ কথাই ভাবি।”

নলিনাক্ষ কহিল, “আচ্ছা মা, ভাবিয়ো না, তুমি ভালো করিয়া ঘুমাইয়ো, তুমি যেমন ইচ্ছা কর তাহাই হইবে।”

নলিনাক্ষ চলিয়া গেলে ক্ষেমংকরী ডাকিলেন, “হরিদাসী !”

কমলা পাশের ঘর হইতে চলিয়া আসিল। তখন অপরাহ্ণের আলোক ম্লান হইয়া ঘর প্রায় অন্ধকার হইয়া আসিয়াছে। হরিদাসীর মুখ ভালো করিয়া দেখা গেল না। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “বাছা, এই ফুলগুলিতে জল দিয়া ঘরে সাজাইয়া রাখো।”

বলিয়া বাছিয়া একটি গোলাপ তুলিয়া ফুলের সাজিটি কমলার দিকে অগ্রসর করিয়া দিলেন।

কমলা তাহার মধ্যে কতকগুলি ফুল তুলিয়া একটি থালায় সাজাইয়া নলিনাক্ষের উপাসনাগৃহের আসনের সম্মুখে রাখিল। আর-কতকগুলি একটি বাটিতে করিয়া নলিনাক্ষের শোবার ঘরে টিপাইয়ের উপর রাখিয়া দিল। বাকি কয়েকটি ফুল লইয়া সেই দেয়ালের গায়ের আলমারিটা খুলিয়া এবং সেই খড়মজোড়ার উপর ফুলগুলি রাখিয়া তাহার উপরে মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিতেই তাহার চোখ দিয়া আজ ঝর্ ঝর্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল। এই খড়ম ছাড়া জগতে তাহার আর-কিছুই নাই— পদসেবার অধিকারও হারাইতে বসিয়াছে।

এমন সময় হঠাৎ ঘরে কে প্রবেশ করিতেই কমলা ধড়্‌ফড়্‌ করিয়া উঠিয়া পড়িল। তাড়াতাড়ি আলমারির দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া দেখিল, নলিনাক্ষ। কোনো দিকে কমলা পালাইবার পথ পাইল না— লজ্জায় কমলা সেই আসন্ন সায়াহ্নের অন্ধকারে মিশাইয়া গেল না কেন।

নলিনাক্ষ ঘরের মধ্যে কমলাকে দেখিয়া বাহির হইয়া গেল। কমলাও আর বিলম্ব না করিয়া দ্রুতপদে অন্য ঘরে চলিয়া গেল। তখন নলিনাক্ষ পুনর্বার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। মেয়েটি আলমারি খুলিয়া কী করিতেছিল, তাহাকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি বন্ধ করিলই বা কেন ? কৌতূহলবশত নলিনাক্ষ আলমারি খুলিয়া দেখিল, তাহার খড়ম-জোড়ার উপর কতকগুলি সদ্যসিক্ত ফুল রহিয়াছে। তখন সে আবার আলমারির দরজা বন্ধ করিয়া শয়নগৃহের জানলার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বাহিরে আকাশের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে শীতসূর্যাস্তের ক্ষণকালীন আভা মিলাইয়া আসিয়া অন্ধকার ঘনীভূত হইয়া উঠিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *