নৌকাডুবি ৫১

কমলা যখন গঙ্গাতীরে গিয়া পৌঁছিল, শীতের সূর্য তখন রশ্মিচ্ছটাহীন ম্লান পশ্চিমাকাশের প্রান্তে নামিয়াছেন। কমলা আসন্ন অন্ধকারের সম্মুখীন সেই অস্তগামী সূর্যকে প্রণাম করিল। তাহার পরে মাথায় গঙ্গাজলের ছিটা দিয়া নদীর মধ্যে কিছুদূর নামিল এবং জোড়করপুটে গঙ্গায় জলগণ্ডূষ অঞ্জলি দান করিয়া ফুল ভাসাইয়া দিল। তার পর সমস্ত গুরুজনদের উদ্দেশ করিয়া প্রণাম করিল। প্রণাম করিয়া মাথা তুলিতেই আর একটি প্রণম্য ব্যক্তির কথা সে মনে করিল। কোনোদিন মুখ তুলিয়া তাঁহার মুখের দিকে সে চাহে নাই; যখন একদিন রাত্রে সে তাঁহার পাশে বসিয়াছিল তখন তাঁহার পায়ের দিকেও তাহার চোখ পড়ে নাই, বাসরঘরে অন্য মেয়েদের সঙ্গে তিনি যে দু-চারিটা কথা কহিয়াছিলেন তাহাও সে যেন ঘোমটার মধ্য দিয়া, লজ্জার মধ্য দিয়া, তেমন সুস্পষ্ট করিয়া শুনিতে পায় নাই। তাঁহার সেই কণ্ঠস্বর স্মরণে আনিবার জন্য আজ এই জলের ধারে দাঁড়াইয়া সে একান্তমনে চেষ্টা করিল, কিন্তু কোনোমতেই মনে আসিল না।

অনেক রাত্রে তাহার বিবাহের লগ্ন ছিল; নিতান্ত শ্রান্তশরীরে সে যে কখন কোথায় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল তাহাও মনে নাই; সকালে জাগিয়া দেখিল, তাহাদের প্রতিবেশীর বাড়ির একটি বধূ তাহাকে ঠেলিয়া জাগাইয়া খিল্‌ খিল্‌ করিয়া হাসিতেছে–বিছানায় আর কেহই নাই। জীবনের এই শেষ মুহূর্তে জীবনেশ্বরকে স্মরণ করিবার সম্বল তাহার কিছুমাত্র নাই। সে দিকে একেবারে অন্ধকার–কোনো মূর্তি নাই, কোনো বাক্য নাই, কোনো চিহ্ন নাই। যে লাল চেলিটির সঙ্গে তাঁহার চাদরের গ্রন্থি বাঁধা হইয়াছিল তারিণীচরণের প্রদত্ত সেই নিতান্ত অল্পদামের চেলির মূল্য তো কমলা জানিত না; সে চেলিখানিও সে যত্ন করিয়া রাখে নাই।

রমেশ হেমনলিনীকে যে চিঠি লিখিয়াছিল সেখানি কমলার আঁচলের প্রান্তে বাঁধা ছিল; সেই চিঠি খুলিয়া বালুতটে বসিয়া তাহার একটি অংশ গোধূলির আলোকে পড়িতে লাগিল। সেই অংশে তাহার স্বামীর পরিচয় ছিল–বেশি কথা নয়, কেবল তাঁহার নাম নলিনাক্ষ চট্টোপাধ্যায়, আর তিনি যে রঙপুরে ডাক্তারি করিতেন ও এখন সেখানে তাঁহার খোঁজ পাওয়া যায় না, এইটুকুমাত্র। চিঠির বাকি অংশ সে অনেক সন্ধান করিয়াও পায় নাই। “নলিনাক্ষ’ এই নামটি তাহার মনের মধ্যে সুধাবর্ষণ করিতে লাগিল; এই নামটি তাহার সমস্ত বুকের ভিতরটা যেন ভরিয়া তুলিল; এই নামটি যেন এক বস্তুহীন দেহ লইয়া তাহাকে আবিষ্ট করিয়া ধরিল; তাহার চোখ দিয়া অবিশ্রাম ধারা বাহিয়া জল পড়িয়া তাহার হৃদয়কে স্নিগ্ধ করিয়া দিল–মনে হইল, তাহার অসহ্য দুঃখদাহ যেন জুড়াইয়া গেল। কমলার অন্তঃকরণ বলিতে লাগিল, “এ তো শূন্যতা নয়, এ তো অন্ধকার নয়-আমি দেখিতেছি, সে যে আছে, সে আমারই আছে।’ তখন কমলা প্রাণপণ বলে বলিয়া উঠিল, “আমি যদি সতী হই, তবে এই জীবনেই আমি তাঁহার পায়ের ধুলা লইব, বিধাতা আমাকে কখনোই বাধা দিতে পারিবেন না। আমি যখন আছি তখন তিনি কখনোই যান নাই, তাঁহারই সেবা করিবার জন্য ভগবান আমাকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন।

এই বলিয়া সে তাহার রুমালে বাঁধা চাবির গোছা সেইখানেই ফেলিল এবং হঠাৎ তাহার মনে পড়িল, রমেশের দেওয়া একটা ব্রোচ তাহার কাপড়ে বেঁধানো আছে। সেটা তাড়াতাড়ি খুলিয়া জলের মধ্যে ফেলিয়া দিল। তাহার পরে পশ্চিমে মুখ করিয়া সে চলিতে আরম্ভ করিল–কোথায় যাইবে, কী করিবে, তাহা তাহার মনে স্পষ্ট ছিল না; কেবল সে জানিয়াছিল, তাহাকে চলিতেই হইবে, এখানে তাহার এক মুহূর্ত দাঁড়াইবার স্থান নাই।

শীতের দিনান্তের আলোকটুকু নিঃশেষ হইয়া যাইতে বিলম্ব হইল না। অন্ধকারের মধ্যে সাদা বালুতট অস্পষ্টভাবে ধূ ধূ করিতে লাগিল, হঠাৎ এক জায়গায় কে যেন বিচিত্র রচনাবলীর মাঝখান হইতে সৃষ্টির খানিকটা চিত্রলেখা একেবারে মুছিয়া ফেলিয়াছে। কৃষ্ঞপক্ষের অন্ধকার রাত্রি তাহার সমস্ত নির্নিমেষ তারা লইয়া এই জনশূন্য নদীতীরের উপর অতি ধীরে নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল।

কমলা সম্মুখে গৃহহীন অনন্ত অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখিতে পাইল না, কিন্তু সে জানিল, তাহাকে চলিতেই হইবে–কোথাও পৌঁছিবে কি না তাহা ভাবিবার সামর্থ্যও তাহার নাই।

বরাবর নদীর ধার দিয়া সে চলিবে, এই সে স্থির করিয়াছে; তাহা হইলে কাহাকেও পথ জিজ্ঞাসা করিতে হইবে না এবং যদি বিপদ তাহাকে আক্রমণ করে, তবে মুহূর্তের মধ্যেই মা গঙ্গা তাহাকে আশ্রয় দিবেন।

আকাশে কুহেলিকার লেশমাত্র ছিল না। অনাবিল অন্ধকার কমলাকে আবৃত করিয়া রাখিল, কিন্তু তাহার দৃষ্টিকে বাধা দিল না।

রাত্রি বাড়িতে লাগিল। যবের খেতের প্রান্ত হইতে শৃগাল ডাকিয়া গেল। কমলা বহুদূর চলিতে চলিতে বালুর চর শেষ হইয়া মাটির ডাঙা আরম্ভ হইল। নদীর ধারেই একটা গ্রাম দেখা গেল। কমলা কম্পিতবক্ষে গ্রামের কাছে আসিয়া দেখিল, গ্রামটি সুষুপ্ত। ভয়ে ভয়ে গ্রামটি পার হইয়া চলিতে চলিতে তাহার শরীরে আর শক্তি রহিল না। অবশেষে এক জায়গায় এমন একটা ভাঙাতটের কাছে আসিয়া পৌঁছিল যেখানে সম্মুখে আর কোনো পথ পাইল না। নিতান্ত অশক্ত হইয়া একটা বটগাছের তলায় শুইয়া পড়িল, শুইবামাত্রই কখন নিদ্রা আসিল জানিতেও পারিল না।

প্রত্যুষেই চোখ মেলিয়া দেখিল, কৃষ্ঞপক্ষের চাঁদের আলোকে অন্ধকার ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে এবং একটি প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, “তুমি কে গা? শীতের রাত্রে এই গাছের তলায় কে শুইয়া?”

কমলা চকিত হইয়া উঠিয়া বসিল। দেখিল, তাহার অদূরে ঘাটে দুখানা বজরা বাঁধা রহিয়াছে–এই প্রৌঢ়াটি লোক উঠিবার পূর্বেই স্নান সারিয়া লইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছেন।

প্রৌঢ়া কহিলেন, “হাঁ গা, তোমাকে যে বাঙালির মতো দেখিতেছি।”

কমলা কহিল, “আমি বাঙালি।”

প্রৌঢ়া। এখানে পড়িয়া আছ যে?

কমলা। আমি কাশীতে যাইব বলিয়া বাহির হইয়াছি। রাত অনেক হইল, ঘুম আসিল, এইখানেই শুইয়া পড়িলাম।

প্রৌঢ়া। ওমা, সে কী কথা! হাঁটিয়া কাশী যাইতেছ? আচ্ছা চলো, ঐ বজরায় চলো, আমি স্নান সারিয়া আসিতেছি।

স্নানের পর এই স্ত্রীলোকটির সহিত কমলার পরিচয় হইল।

গাজিপুরে যে সিদ্ধেশ্বরবাবুদের বাড়িতে খুব ঘটা করিয়া বিবাহ হইতেছিল, তাঁহারা ইঁহাদের আত্মীয়। এই প্রৌঢ়াটির নাম নবীনকালী। এবং ইঁহার স্বামীর নাম মুকুন্দলাল দত্ত–কিছুকাল কাশীতেই বাস করিতেছেন। ইাঁহারা আত্মীয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করিতে পারেন নাই, অথচ পাছে তাঁহাদের বাড়িতে থাকিতে বা খাইতে হয় এইজন্য বোটে করিয়া গিয়াছিলেন। বিবাহবাড়ির কর্ত্রী ক্ষোভপ্রকাশ করাতে নবীনকালী বলিয়াছিলেন, “জানই তো ভাই, কর্তার শরীর ভালো নয়। আর ছেলেবেলা হইতে উঁহাদের অভ্যাসই একরকম। বাড়িতে গোরু রাখিয়া দুধ হইতে মাখন তুলিয়া সেই মাখন-মারা ঘিয়ে উঁহার লুচি তৈরি হয়–আবার সে গোরুকে যা-তা খাওয়াইলে চলিবে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

নবীনকালী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কী?”

কমলা কহিল, “আমার নাম কমলা।”

নবীনকালী। তোমার হাতে লোহা দেখিতেছি, স্বামী আছে বুঝি?

কমলা কহিল, “বিবাহের পরদিন হইতেই স্বামী নিরুদ্দেশ হইয়া গেছেন।”

নবীনকালী। ওমা, সে কী কথা! তোমার বয়স তো বড়ো বেশি বোধ হয় না।

তাহাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, “পনেরোর বেশি হইবে না।”

কমলা কহিল, “বয়স ঠিক জানি না, বোধ করি, পনেরোই হইবে।”

নবীনকালী। তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে বটে?

কমলা কহিল, “হাঁ।”

নবীনকালী কহিলেন, “তোমাদের বাড়ি কোথায়?”

কমলা। কখনো শ্বশুরবাড়ি যাই নাই, আমার বাপের বাড়ি বিশুখালি।

কমলার পিত্রালয় বিশুখালিতেই ছিল, তাহা সে জানিত।

নবীনকালী। তোমার বাপ-মা–

কমলা। আমার বাপ-মা কেহই নাই।

নবীনকালী। হরি বলো! তবে তুমি কী করিবে?

কমলা। কাশীতে যদি কোনো ভদ্র গৃহস্থ আমাকে বাড়িতে রাখিয়া দু-বেলা দুটি খাইতে দেন, তবে আমি কাজ করিব। আমি রাঁধিতে পারি।

নবীনকালী বিনা-বেতনে পাচিকা ব্রাহ্মণী লাভ করিয়া মনে মনে ভারি খুশি হইলেন। কহিলেন, “আমাদের তো দরকার নাই–বামুন-চাকর সমস্তই আমাদের সঙ্গে আছে। আমাদের আবার যে-সে বামুন হইবার জো নাই–কর্তার খাবারের একটু এদিক-ওদিক হইলে আর কি রক্ষা আছে। বামুনকে মাইনে দিতে হয় চৌদ্দ টাকা, তার উপরে ভাত-কাপড় আছে। তা হোক, ব্রাহ্মণের মেয়ে, তুমি বিপদে পড়িয়াছ–তা, চলো, আমাদের ওখানেই চলো। কত লোক খাচ্ছে-দাচ্ছে, কত ফেলা-ছড়া যায়, আর-এক জন বাড়িলে কেহ জানিতেও পারিবে না। আমাদের কাজও তেমন বেশি নয়। এখানে কেবল কর্তা আর আমি আছি। মেয়েগুলির সব বিবাহ দিয়াছি; তা, তাহারা বেশ বড়ো ঘরেই পড়িয়াছে। আমার একটিমাত্র ছেলে, সে হাকিম, এখন সেরাজগঞ্জে আছে, লাট-সাহেবের ওখান হইতে দু-মাস অন্তর তাহার নামে চিঠি আসে। আমি কর্তাকে বলি, আমাদের নোটোর তো অভাব কিছুই নাই, কেন তাহার এই গেরো। এতবড়ো হাকিমি সকলের ভাগ্যে জোটে না, তা জানি, কিন্তু বাছাকে তবু তো সেই বিদেশে পড়িয়া থাকিতে হয়। কেন? দরকার কী? কর্তা বলেন, “ওগো সেজন্য নয়, সেজন্য নয়। তুমি মেয়েমানুষ, বোঝ না। আমি কি রোজগারের জন্য নোটোকে চাকরিতে দিয়াছি? আমার অভার কিসের? তবে কিনা, হাতে একটা কাজ থাকা চাই, নহিলে অল্প বয়স, কি জানি কখন কী মতি হয়।’

পালে বাতাসের জোর ছিল, কাশী পৌঁছিতে দীর্ঘকাল লাগিল না। শহরের ঠিক বাহিরেই অল্প একটু বাগানওয়ালা একটি দোতলা বাড়িতে সকলে গিয়া উঠিলেন।

সেখানে চৌদ্দ টাকা বেতনের বামুনের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না–একটা উড়ে বামুন ছিল, অনতিকাল পরেই নবীনকালী তাহার উপরে একদিন হঠাৎ অত্যন্ত আগুন হইয়া উঠিয়া বিনা বেতনে তাহাকে বিদায় করিয়া দিলেন। ইতিমধ্যে চৌদ্দ টাকা বেতনের অতি দুর্লভ দ্বিতীয় একটি পাচক জুটিবার অবকাশে কমলাকেই সমস্ত রাঁধা-বাড়ার ভার লইতে হইল।

নবীনকালী কমলাকে বারবার সতর্ক করিয়া কহিলেন, “দেখো বাছা, কাশী শহর ভালো জায়গা নয়। তোমার অল্প বয়স। বাড়ির বাহিরে কখনো বাহির হইয়ো না। গঙ্গাস্নান-বিশ্বেশ্বরদর্শনে আমি যখন যাইব তোমাকে সঙ্গে করিয়া লইব।”

কমলা পাছে দৈবাৎ হাতছাড়া হইয়া যায় নবীনকালী এজন্য তাহাকে অত্যন্ত সাবধানে রাখিলেন। বাঙালি মেয়েদের সঙ্গেও তাহাকে বড়ো-একটা আলাপের অবসব দিতেন না। দিনের বেলা তো কাজের অভাব ছিল না–সন্ধ্যার পরে একবার কিছুক্ষণ নবীনকালী তাঁহার যে ঐশ্বর্য, যে গহনাপত্র, যে সোনারুপার বাসন, যে মখমল-কিংখাবের গৃহসজ্জা চোরের ভয়ে কাশীতে আনিতে পারেন নাই, তাহারই আলোচনা করিতেন। “কাঁসার থালায় খাওয়া তো কর্তার কোনোকালে অভ্যাস নাই, তাই প্রথম-প্রথম এ লইয়া তিনি অনেক বকাবকি করিতেন। তিনি বলিতেন, নাহয় দু-চারখানা চুরি যায় সেও ভালো, আবার গড়াইতে কতক্ষণ। কিন্তু টাকা আছে বলিয়াই যে লোকসান করিতে হইবে সে আমি কোনোমতে সহ্য করিতে পারি না। তার চেয়ে বরঞ্চ কিছুকাল কষ্ট করিয়া থাকাও ভালো। এই দেখো-না, দেশে আমাদের মস্ত বাড়ি, সেখানে লোক-লশকর যতই থাক্‌ আসে যায় না, তাই বলিয়া কি এখানে সাত গণ্ডা চাকর আনা চলে? কর্তা বলেন, কাছাকাছি নাহয় আরো একটা বাড়ি ভাড়া করা যাইবে। আমি বলিলাম, না, সে আমি পারিব না–কোথায় এখানে একটু আরাম করিব, না কতকগুলো লোকজন-বাড়িঘর লইয়া দিনরাত্রি ভাবনার অন্ত থাকিবে না।’ ইত্যাদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *