ক্ষেমংকরী কমলাকে গিয়া কহিলেন, “মা, কাল হেমকে আর তার বাপকে দুপুর-বেলায় এখানে আহার করিতে নিমন্ত্রণ করা গেছে। কী রকম আয়োজনটা করা যায় বলো দেখি। বেয়াইকে এমন করিয়া খাওয়ানো দরকার যে, তিনি যেন নিশ্চিন্ত হইতে পারেন যে এখানে তাঁহার মেয়েটির খাওয়ার কষ্ট হইবে না। কী বল মা ? তা, তোমার যেরকম রান্নার হাত, অপযশ হইবে না তা জানি। আমার ছেলে আজ পর্যন্ত কোনো রান্না খাইয়া কোনোদিন ভালোমন্দ কিছুই বলে নাই, কাল তোমার রান্নার প্রশংসা তাহার মুখে ধরে না মা। কিন্তু তোমার মুখখানি আজ বড়ো শুকনো দেখাইতেছে যে ? শরীর কি ভালো নাই ?”
মলিন মুখে একটুখানি হাসি আনিয়া কমলা কহিল, “বেশ আছি মা !’
ক্ষেমংকরী মথা নাড়িয়া কহিলেন, “না না, বোধ করি তোমার মন কেমন করিতেছে। তা-তো করিতেই পারে, সেজন্য লজ্জা কিসের। আমাকে পর ভাবিয়ো না মা ! আমি তোমাকে আপন মেয়ের মতোই দেখি, এখানে যদি তোমার কোনো অসুবিধা হয়, বা তুমি আপনার লোক কাহাকেও দেখিতে চাও তো আমাকে না বলিলে চলিবে কেন ?”
কমলা ব্যগ্র হইয়া কহিল, “না, মা, তোমার সেবা করিতে পারিলে আমি আর কিছুই চাই না।”
ক্ষেমংকরী সে কথায় কান না দিয়া কহিলেন, “নাহয় কিছুদিনের জন্য তোমার খুড়ার বাড়িতে গিয়া থাকো, তার পরে যখন ইচ্ছা হয় আবার আসিবে।”
কমলা অস্থির হইয়া উঠিল; কহিল, “মা, আমি যতক্ষণ তোমার কাছে আছি সংসারে কাহারো জন্য ভাবি না। আমি যদি কখনো তোমার পায়ে অপরাধ করি আমাকে তুমি যেমন খুশি শাস্তি দিয়ো, কিন্তু একদিনের জন্যও দূরে পাঠাইয়ো না।”
ক্ষেমংকরী কমলার দক্ষিণ কপোলে দক্ষিণ হস্ত বুলাইয়া কহিলেন, “তাই তো বলি মা, আর জন্মে তুমি আমার মা ছিলে। নহিলে দেখিবামাত্র এমন বন্ধন কী করিয়া হয়। তা, যাও মা, সকাল-সকাল শুইতে যাও। সমস্ত দিন তো এক দণ্ড বসিয়া থাকিতে জান না।”
কমলা তাহার শয়নগৃহে গিয়া, দ্বার রুদ্ধ করিয়া, দীপ নিবাইয়া, অন্ধকারে মাটির উপরে বসিয়া রহিল। অনেকক্ষণ বসিয়া, অনেকক্ষণ ভাবিয়া, এই কথা সে মনে বুঝিল— ‘কপালের দোষে যাহার উপরে আমার অধিকার হারাইয়াছি তাহাকে আমি আগলাইয়া বসিয়া থাকিব, এ কেমন করিয়া হয়। সমস্তই ছাড়িবার জন্য মনকে প্রস্তুত করিতে হইবে; কেবল সেবা করিবার সুযোগটুকু, যেমন করিয়া হউক, প্রাণপণে বাঁচাইয়া চলিব। ভগবান করুন, সেটুকু যেন হাসিমুখে করিতে পারি; তাহার বেশি আর-কিছুতে যেন দৃষ্টি না দিই। অনেক দুঃখে যেটুকু পাইয়াছি সেটুকুও যদি প্রসন্নমনে না লইতে পারি, যদি মুখ ভার করি, তবে সবসুদ্ধই হারাইতে হইবে।’
এই বুঝিয়া একাগ্রমনে বার বার করিয়া সে সংকল্প করিতে লাগিল, ‘আমি কাল হইতে যেন কোনো দুঃখকে মনে স্থান না দিই, যেন এক মুহূর্ত মুখ বিরস না করি, যাহা আশার অতীত, তাহার জন্য যেন কোনো কামনা মনের মধ্যে না থাকে। কেবল সেবা করিব, যতদিন জীবন আছে কেবল সেবা করিব, আর কিছু চাহিব না— চাহিব না— চাহিব না।’
তাহার পরে কমলা শুইতে গেল। এ পাশ-ও পাশ করিতে করিতে ঘুমাইয়া পড়িল। রাত্রে দুই-তিন বার ঘুম ভাঙিয়া গেল। ভাঙিবামাত্রই সে মন্ত্রের মতো আওড়াইতে লাগিল, ‘আমি কিছুই চাহিব না, চাহিব না, চাহিব না।’ ভোরের বেলায় সে বিছানা হইতে উঠিয়াই জোড়হাত করিয়া বসিল এবং সমস্ত চিত্ত প্রয়োগ করিয়া কহিল, ‘আমি আমরণকাল তোমার সেবা করিব; আর-কিছু চাহিব না, চাহিব না, চাহিব না।’
এই বলিয়া তাড়াতাড়ি মুখ-হাত ধুইয়া, বাসি কাপড় ছাড়িয়া, নলিনাক্ষের সেই ক্ষুদ্র উপাসনা-ঘরের মধ্যে গেল; নিজের আঁচলটি দিয়া সমস্ত ঘর মুছিয়া পরিষ্কার করিল এবং যথাস্থানে আসনটি বিছাইয়া রাখিয়া দ্রুতপদে গঙ্গাস্নান করিতে গেল। আজকাল নলিনাক্ষের একান্ত অনুরোধে ক্ষেমংকরী সূর্যোদয়ের পূর্বে স্নান করিতে যাওয়া পরিত্যাগ করিয়াছেন। তাই উমেশকেই এই দুঃসহ শীতের ভোরে কমলার সহিত স্নানে যাইতে হইল।
স্নান হইতে ফিরিয়া আসিয়া কমলা ক্ষেমংকরীকে প্রফুল্লমুখে প্রণাম করিল। তিনি তখন স্নানে বাহির হইবার উপক্রম করিতেছিলেন। কমলাকে কহিলেন, “এত ভোরে কেন নাহিতে গেলে ? আমার সঙ্গে গেলেই তো হইত।”
কমলা কহিল, “আজ যে কাজ আছে মা ! কাল সন্ধ্যাবেলায় যে তরকারি আনানো হইয়াছে তাহাই কুটিয়া রাখি; আর যা-কিছু বাজার করা বাকি আছে, উমেশ সকাল-সকাল সারিয়া আসুক।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “বেশ বুদ্ধি ঠাওরাইয়াছ মা। বেয়াই যেমনি আসিবেন অমনি খাবার প্রস্তুত পাইবেন।
এমন সময় নলিনাক্ষ বাহির হইয়া আসিবামাত্র কমলা ভিজা চুলের উপর তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া ভিতরে ঢুকিয়া পড়িল। নলিনাক্ষ কহিল, “মা, আজই তুমি স্নান করিতে চলিলে ? সবে কাল একটু ভালো ছিলে।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “নলিন, তোর ডাক্তারি রাখ্। সকালবেলায় গঙ্গাস্নান না করিলেও লোকে অমর হয় না। তুই এখন বাহির হইতেছিস বুঝি ? একটু সকাল-সকাল ফিরিস।”
নলিনাক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “ কেন মা ?”
ক্ষেমংকরী। কাল তোকে বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম, আজ অন্নদাবাবু তোকে আশীর্বাদ করিতে আসিবেন।
নলিনাক্ষ। আশীর্বাদ করিতে আসিবেন ? কেন, হঠাৎ আমার উপরে এত বিশেষভাবে প্রসন্ন হইলেন যে ? তাঁর সঙ্গে তো রোজই আমার দেখা হয়।
ক্ষেমংকরী। আমি যে কাল হেমনলিনীকে একজোড়া বালা দিয়া আশীর্বাদ করিয়া আসিলাম, এখন অন্নদাবাবু তোকে না করিলে চলিবে কেন ? যা হোক, ফিরিতে দেরি করিস নে, তাঁরা এখানেই খাইবেন।
এই বলিয়া ক্ষেমংকরী স্নান করিতে গেলেন। নলিনাক্ষ মাথা নিচু করিয়া ভাবিতে ভাবিতে রাস্তা দিয়া চলিয়া গেল।