নৌকাডুবি ৫৯

ক্ষেমংকরীর নিকট হইতে ফিরিয়া আসিয়া হেমনলিনী তাহাদের বসিবার ঘরের টেবিলের উপর একখানা মস্ত ভারী চিঠি পাইল। লেফাফার উপরকার হস্তাক্ষর দেখিয়াই বুঝিতে পারিল, চিঠিখানা রমেশের লেখা। স্পন্দিতবক্ষে চিঠিখানি হাতে করিয়া শয়নগৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া পড়িতে লাগিল।

চিঠিতে রমেশ কমলা-সম্বন্ধীয় সমস্ত ব্যাপার আনুপূর্বিক বিস্তারিতভাবে লিখিয়াছে। উপসংহারে লিখিয়াছে—

তোমার সহিত আমার যে বন্ধন ঈশ্বর দৃঢ় করিয়া দিয়াছিলেন, সংসার তাহা ছিন্ন করিয়াছে। তুমি এখন অন্যের প্রতি চিত্ত

সমর্পণ করিয়াছ— সেজন্য আমি তোমাকে কোনো দোষ দিতে পারি না, কিন্তু তুমিও আমাকে দোষ দিয়ো না। যদিও আমি এক দিনের জন্য কমলার প্রতি স্ত্রীর মতো ব্যবহার করি নাই তথাপি ক্রমশ সে যে আমার হৃদয় আকর্ষণ করিয়া লইয়াছিল,

এ কথা তোমার কাছে আমার স্বীকার করা কর্তব্য। আজ আমার হৃদয় কী অবস্থায় আছে তাহা আমি নিশ্চয় জানি না। তুমি

যদি আমাকে ত্যাগ না করিতে তবে তোমার মধ্যে আমি আশ্রয় লাভ করিতে পারিতাম। সেই আশ্বাসেই আমি আমার বিক্ষিপ্ত

চিত্ত লইয়া তোমার নিকট ছুটিয়া আসিয়াছিলাম। কিন্তু আজ যখন স্পষ্ট দেখিলাম তুমি আমাকে ঘৃণা করিয়া

আমার নিকট হইতে বিমুখ হইয়াছ, যখন শুনিলাম অন্যের সহিত বিবাহ-সম্বন্ধে তুমি সম্মতি দিয়াছ, তখন আমারও মন

আবার দোলায়িত হইয়া উঠিল। দেখিলাম এখনো কমলাকে সম্পূর্ণ ভুলিতে পারি নাই। ভুলি বা না ভুলি, তাহাতে সংসারে

আমি ছাড়া আর- কাহারো কোনো ক্ষতি নাই। আমারই বা ক্ষতি কিসের ! সংসারে যে দুটি রমণীকে আমি হৃদয়ের মধ্যে

গ্রহণ করিতে পারিয়াছি তাঁহাদিগকে বিস্মৃত হইবার সাধ্য আমার নাই এবং তাঁহাদিগকে চিরজীবন স্মরণ করাই আমার পরম

লাভ। আজ প্রাতে যখন তোমার সহিত ক্ষণিক সাক্ষাতের বিদ্যুদ্‌বৎ আঘাত প্রাপ্ত হইয়া বাসায় ফিরিয়া আসিলাম তখন

একবার মনে মনে বলিলাম, ‘আমি হতভাগ্য !’ কিন্তু আর আমি সে কথা স্বীকার করিব না। আমি সবলচিত্তে আনন্দের

সহিত তোমার নিকট বিদায় প্রার্থনা করিতেছি— আমি পরিপূর্ণ-হৃদয়ে তোমার নিকট হইতে প্রস্থান করিব—তোমাদের

কল্যাণে, বিধাতার কল্যাণে, আমি অন্তরের মধ্যে এই বিদায়কালে যেন কিছুমাত্র দীনতা অনুভব না করি। তুমি সুখী হও,

তোমার মঙ্গল হউক। আমাকে তুমি ঘৃণা করিয়ো না, আমাকে ঘৃণা করিবার কোনো কারণ তোমার নাই।

অন্নদাবাবু চৌকিতে বসিয়া বই পড়িতেছিলেন। হঠাৎ হেমনলিনীকে দেখিয়া তিনি চমকিয়া উঠিলেন; কহিলেন, “হেম, তোমার কি অসুখ করিয়াছে ?”

হেমনলিনী কহিল, “অসুখ করে নাই। বাবা, রমেশবাবুর একখানি চিঠি পাইয়াছি। এই লও, পড়া হইলে আবার আমাকে ফেরত দিয়ো।”

এই বলিয়া চিঠি দিয়া হেমনলিনী চলিয়া গেল। অন্নদাবাবু চশমা লইয়া চিঠিখানি বার-দুয়েক পড়িলেন, তাহার পরে হেমনলিনীর নিকট ফেরত পাঠাইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। অবশেষে ভাবিয়া স্থির করিলেন, এ একপ্রকার ভালোই হইয়াছে। পাত্র হিসাবে রমেশের চেয়ে নলিনাক্ষ অনেক বেশি প্রার্থনীয়। ক্ষেত্র হইতে রমেশ যে আপনিই সরিয়া পড়িল, এ হইল ভালো।

এ কথা ভাবিতেছেন, এমন-সময় নলিনাক্ষ আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া অন্নদাবাবু একটু আশ্চর্য হইলেন। আজ পূর্বাহ্নে নলিনাক্ষের সঙ্গে অনেক ক্ষণ দেখাসাক্ষাৎ হইয়াছে, আবার কয়েক ঘণ্টা যাইতে না যাইতেই সে কী মনে করিয়া আসিল ? বৃদ্ধ মনে মনে একটুখানি হাসিয়া স্থির করিলেন, হেমনলিনীর প্রতি নলিনাক্ষের মন পড়িয়াছে।

কোনো ছুতা করিয়া হেমনলিনীর সহিত নলিনাক্ষের দেখা করাইয়া দিয়া নিজে সরিয়া যাইবেন কল্পনা করিতেছেন, এমন সময় নলিনাক্ষ কহিল, “অন্নদাবাবু, আমার সঙ্গে আপনার কন্যার বিবাহের প্রস্তাব উঠিয়াছে। কথাটা বেশি দূর অগ্রসর হইবার পূর্বে আমার যাহা বক্তব্য আছে, বলিতে ইচ্ছা করি।”

অন্নদাবাবু কহিলেন, “ঠিক কথা, সে তো বলাই কর্তব্য।”

নলিনাক্ষ কহিল, “আপনি জানেন না, পূর্বেই আমার বিবাহ হইয়াছে।”

অন্নদাবাবু কহিলেন, “জানি। কিন্তু— ”

নলিনাক্ষ। আপনি জানেন শুনিয়া আশ্চর্য হইলাম। কিন্তু তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে, এইরূপ আপনি অনুমান করিতেছেন। নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। এমন-কি, তিনি বাঁচিয়া আছেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করি।

অন্নদাবাবু কহিলেন, “ঈশ্বর করুন, তাহাই যেন সত্য হয়। হেম, হেম।”

হেমনলিনী আসিয়া কহিল, “কী বাবা !”

অন্নদাবাবু। রমেশ তোমাকে যে চিঠি লিখিয়াছেন, তাহার মধ্যে যে অংশটুকু—

হেমনলিনী সেই চিঠিখানি নলিনাক্ষের হাতে দিয়া কহিল, “এ চিঠির সমস্তটাই উঁহার পড়িয়া দেখা কর্তব্য।” এই বলিয়া হেমনলিনী চলিয়া গেল।

চিঠিখানি পড়া শেষ করিয়া নলিনাক্ষ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “এমন শোচনীয় ঘটনা সংসারে প্রায় ঘটে না। চিঠিখানি পড়িতে দিয়া আপনার মনে আঘাত দেওয়া হইল, কিন্তু ইহা আপনার কাছে গোপন করাও আমাদের পক্ষে অন্যায় হইত।”

নলিনাক্ষ একটুখানি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া অন্নদাবাবুর কাছে বিদায় লইয়া উঠিল। চলিয়া যাইবার সময় উত্তরের বারান্দায় অদূরে হেমনলিনীকে দেখিতে পাইল।

হেমনলিনীকে দেখিয়া নলিনাক্ষের মনে আঘাত লাগিল। ঐ-যে নারী স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া, উহার স্থির-শান্ত মূর্তিটি উহার অন্তঃকরণকে কেমন করিয়া বহন করিতেছে ? এই মুহূর্তে উহার মন যে কী করিতেছে তাহা ঠিকমত জানিবার কোনো উপায় নাই; নলিনাক্ষকে তাহার কোনো প্রয়োজন আছে কি না সে প্রশ্নও করা যায় না, তাহার উত্তর পাওয়াও কঠিন। নলিনাক্ষের পীড়িত চিত্ত ভাবিতে লাগিল, ইহাকে কোনো সান্ত্বনা দেওয়া যায় কি না। কিন্তু মানুষে মানুষে কী দুর্ভেদ্য ব্যবধান ! মন জিনিসটা কী ভয়ংকর একাকী !

নলিনাক্ষ একটু ঘুরিয়া ঐ বারান্দার সামনে দিয়া গাড়িতে উঠিবে স্থির করিল, মনে করিল যদি হেমনলিনী তাহাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করে। বারান্দার সম্মুখে যখন আসিল, দেখিল হেমনলিনী বারান্দা ছাড়িয়া ঘরের মধ্যে সরিয়া গেছে। হৃদয়ের সহিত হৃদয়ের সাক্ষাৎ সহজ নহে, মানুষের সহিত মানুষের সম্বন্ধ সরল নহে, এই কথা চিন্তা করিয়া ভারাক্রান্তচিত্তে নলিনাক্ষ গাড়িতে উঠিল।

নলিনাক্ষ চলিয়া গেলে যোগেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইল। অন্নদাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী যোগেন, একলা যে ?”

যোগেন্দ্র কহিল, “দ্বিতীয় আর কোন্‌ ব্যক্তিকে প্রত্যাশা করিতেছ শুনি ?”

অন্নদা কহিলেন, “কেন ? রমেশ ?”

যোগেন্দ্র। তাহার প্রথম দিনের অভ্যর্থনাটাই কি ভদ্রলোকের পক্ষে যথেষ্ট হয় নাই। কাশীর গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়া মরিয়া যদি তাহার শিবত্বলাভ না হইয়া থাকে, তবে আর কী হইয়াছে আমি নিশ্চয় জানি না। কাল হইতে এ পর্যন্ত তাহার আর দেখা নাই, টেবিলে একখানা কাগজে লেখা আছে— ‘পালাই— তোমার রমেশ।’ এ সব কবিত্ব আমার কোনোকালে অভ্যাস নাই। সুতরাং আমাকেও এখান হইতে পালাইতে হইল, আমার হেড্‌মাস্টারিই ভালো, তাহাতে সমস্তই খুব স্পষ্ট— ঝাপসা কিছুই নাই।

অন্নদাবাবু কহিলেন, “হেমের জন্য তো একটা-কিছু স্থির— ”

যোগেন্দ্র। আর কেন ? আমিই কেবল স্থির করিব, আর তোমরা অস্থির করিতে থাকিবে, এ খেলা বেশি দিন ভালো লাগে না। আমাকে আর-কিছুতে জড়াইয়ো না— আমি যাহা ভালো বুঝিতে পারি না, সেটা আমার ধাতে সয় না। হঠাৎ দুর্বোধ হইয়া পড়িবার যে আশ্চর্য ক্ষমতা হেমের আছে, সেটা আমাকে কিছু কাবু করে। কাল সকালের গাড়িতে আমি বিদায় হইব, পথে বাঁকিপুরে আমার কাজ আছে।

অন্নদাবাবু চুপ করিয়া বসিয়া নিজের মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। সংসারের সমস্যা আবার দুরূহ হইয়া আসিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *