নীললোহিতের চোখের সামনে – ৮

কইখালি পেরিয়ে এসেছে ওরা। এয়ারপোর্টের পিছনদিক ঘুরে এসে পড়েছে নতুন তৈরি হাইওয়ে পর্যন্ত। দমদম এয়ারপোর্ট থেকে এই হাইওয়ে সল্টলেকের পাশ দিয়ে চলে গেছে বেলেঘাটা পর্যন্ত, এখনও সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি, মজুররা খাটছে। সেই চারজন বিশ্রাম নেবার জন্য হাইওয়ের ওপাশে গাছতলায় খাটিয়াটা নামাল। তারপর বিড়ি ধরাল।

মড়া বয়ে নিয়ে চলেছে, সেই কইখালি থেকে আসছে, যাবে রোধহয় নিমতলা ঘাট পর্যন্ত। দুপুরের রোদে এতখানি বয়ে নিয়ে যাওয়া কি সোজা কথা, এখন যিনি মড়া—সেই ভূতপূর্ব ভদ্রলোকটির শখ দেখলে আশ্চর্য লাগে, অথবা বোধহয় মৃতের আত্মীয়স্বজনেরই এই শখ। যদিও আত্মীয়স্বজন কেউ মড়ার সঙ্গে যাচ্ছে বলে তো মনে হয় না, বোধহয় পাড়াপ্রতিবেশী বা ভাড়াটে লোক দিয়ে কাজ সারছে। চারটে লোকের কোমরে গামছা বাঁধা, বোধহয় গাঁজা খেয়ে চোখ লাল, যে-কর্কশ সুরে বলহরি হরিবোল বলে চেঁচাচ্ছে, তাতেই বোঝা যায়, মৃত লোকটির সঙ্গে ওদের কোন আত্মীয়তা নেই। আত্মীয়স্বজন বোধহয় আগেই গাড়ি চেপে শ্মশানে হাজির হয়েছে। এর বদলে, স্বগ্রামেই পুড়িয়ে গঙ্গায় শুধু অস্থি বিসর্জন দিলে তো হতো।

হাইওয়ে ধরে একদল লোক আসছে, তাই দেখে ঐ চারজন আবার ‘বলহরি’ রব তুলে খাটিয়া তুলল। একজন বলল, দেখিস একটু আস্তে, লাশ বড় দুলছে। আরেকজন বলল, ‘উঃ যা ভারী, মাইরি, লাশ একেবারে ফুলে ঢোল হয়ে গেছে!’

—শুধু ফুলবে কেন, গোপেনবাবুর গতরটাও তো কম ছিল না।

চারজনেই একসঙ্গে হেসে উঠল। ‘লে, লে, পা চালিয়ে চল। সন্ধের আগেই গঙ্গা পাইয়ে দিতে হবে।’

—বেরিয়েছিলাম বেশ ছায়ায়-ছায়ায়, আকাশে মেঘ ছিল। হঠাৎ এমন সুর্যি উঠে গেল! একেবারে কালঘাম ছুটিয়ে ছাড়ছে।

—গোপেনবাবুর যেমন ভাগ্য!

হাইওয়ে পেরিয়ে এসে এপারে বাগুইহাটির রাস্তা। এবার কোনদিক দিয়ে যাবে, সেটা আলোচনা করার জন্য ওরা আবার খাটিয়া নামিয়ে জিরোতে বসল। নামাবার সময় বলল, ‘দেখিস, সাবধানে। পা-দুটো না বেশি ঝুলে পড়ে!’

দুজনের মত হাইওয়ে ধরেই ফাঁকায় ফাঁকায় বেরিয়ে গিয়ে একেবারে উল্টোডিঙ্গির ধার দিয়ে শহরে ঢুকবে। আর দুজন বলল, ‘কেন বাগুইহাটি দিয়েই যাওয়া যাক্-না। বাগুইহাটির খাল পেরুলে সোজা রাস্তা ধরে যশোর রোড, সেখান থেকে শ্যামবাজার আর কতটুকু!’

—কিন্তু হাইওয়েটা বেশ ফাঁকা ছিল!

—আর রোদ যে চচ্চড় করছে! মড়া নিয়ে যাব তার আর ফাঁকা রাস্তা আর ভিড়ের রাস্তা কী? তুই মরলে তোকে নিয়ে যাব ফাঁকা রাস্তা দিয়ে, মরার পর তো শালা সবই ফাঁকা!

কয়েকবার জিরিয়ে-জিরিয়ে, ওরা চলে এল বাগুইহাটির খাল পর্যন্ত। একজনও বদলি নেই, ঐ-চারজন রোগা জিরজিরে লোক এতটা রাস্তা বয়ে আনতে হাঁপিয়ে গেছে একেবারে, কপালে ঘাম। তবু গলা ফুলিয়ে হাঁকছে, বলহরি হ-রি-বো-ল!

একজন পুলিশের দারোগা দাঁড়িয়েছিলেন খালপারে, পাশ দিয়ে মড়া যেতে দেখে নাক কুঁচকে বললেন, ‘ইস ডিউটিতে আসতে-না-আসতেই একটা মড়া দেখতে হল! একটু আস্তে চেঁচাও-না বাবা। ভগবান তো আর কানে কালা নন!’

একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ছড়ি হাতে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। বাগুইহাটির খাল কচুরিপানায় ভর্তি, বেড়াবার পক্ষে খুব একটা আদর্শ জায়গা নয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষেরই মতো ওঁরও দুটো উদ্দেশ্য থাকে সবসময়, ব্লাডপ্রেসার কমাবার জন্য একটু হাঁটাচলা, আর সেই ওপারের বাগুইহাটির বাজারটা দেখে আসা—ভালো কই মাছ উঠেছে কিনা। কিন্তু মাছের থলিটা নিয়ে বেরুতে পারেন না—ওপার থেকে থলি হাতে করে এলেই পুলিশ উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে—ভেতরে চাল কিনা। এপার পর্যন্ত রেশনিং এলাকা, ওপারে খোলাবাজার, পোলের পাশে পুলিশের ছাউনি

মড়া দেখে তিনি ছড়িশুদ্ধ হাত তুলে নমস্কার করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে মায়া কাটাল? মেয়ে না পুরুষ?’

—পুরুষ।

—কোথা থেকে আসছ ভাই তোমরা? কোন্ পাড়ার?

— কইখালি।

—কইখালির কে?

—গোপেন সাহা।

—অ্যাঁ! গোপেন সাহা! কবে মরল।

—সাহা কে বলল? গোপেন সান্যাল।

—গোপেন সাহা আমার বহুকালের বন্ধু। ওয়ারটাইমে তার সঙ্গে আমি সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে একসঙ্গে কাজ করেছি! শরীরটা তার খারাপ যাচ্ছে শুনেছিলাম। একবার নামাও তো, মুখটা দেখে নি।

–বললাম তো অন্য লোক। সাহা নয়, সান্যাল!

—বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছে। একবার নামাও-না, দেখে সন্দেহটা মিটিয়ে নিই। অন্যলোক হলে তো ভালোই।

—এখন নামানো হবেনা। পা চালিয়ে চল্‌!

-এক মিনিটে কী এমন অনর্থ হয়ে যাবে? বুড়ো মানুষকে শুধু-শুধু চমকে দিলে। একটু নামিয়েই দেখাও-না!

—পা চালিয়ে চল্‌-না। বেলা পড়ে এল।

ক্যালভার্টে কয়েকটা ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। লোক-চারজন মড়ার খাটিয়া নিয়ে প্রায় ছুটছে দেখে, তারা দৌড়ে এসে ওদের ধরল। জোর করে খাটিয়া নামাল। সরিয়ে ফেলল ওপরের কাপড়। মাথার কাছে একটা পরচুলো দেওয়া মুখোশ, পায়ের কাছে দুটো নকল মাটির পা। শরীরের জায়গায় ছবস্তা চাল ঠাসাঠাসি। মৃতদেহ নেই, সেখানে মানুষকে বাঁচাবার বস্তু।

হৈ হৈ, পুলিশ ডাকা, ভিড়। এই ছেলেগুলোই আজকাল চোরাকারবারী ধরার জন্য খুব সজাগ। অনেকসময় ওরাই রিকশা কিংবা গোরুর গাড়ি সার্চ করে—পুলিশ না-থাকলে, এমনকী লোকের বাজারের থলি কিংবা ডাক্তারের ব্যাগ পর্যন্ত, দৈবাৎ চাল পেয়ে গেলে পুলিশ ডাকে। পুলিশের দারোগা ছুটে এসে হুইসল বাজালেন, চারজন কনস্টেবল ছুটে এল।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওদের ধরা গেলনা। হঠাৎ তিন-চারটে কুকুর ঝগড়া করতে—করতে এসে ভিড়ের মধ্যে পড়তেই, ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, সেই চারজন লোক সেই ফাঁকে ছুট দিল প্রাণপণে-দক্ষিণপাড়া পেরিয়ে কেষ্টপুর দিয়ে কোথায় পালিয়ে গেল। ওদের ধরা গেল না কিন্তু বামাল গ্রেফতার হল। ভিড়ের অনেকেই চিনতে পেরেছে—ঐ-চারজন নাকি পাকা চোরাচালানি।

এই ঘটনা আমি শুনি লোকমুখে। চাল পাচার করার এই অদ্ভুত গল্পটি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর থেকে প্রত্যেকটি শ্মশানবন্ধু দলেরই খাটিয়া নামিয়ে মড়া চেক করে দেখা হতে লাগল।

কিন্তু এর পরবর্তী ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা। বাগুইহাটির বাজারে আমিও মাঝে-মাঝে কইমাছের খোঁজে যাই। দিন দশেক পরে, আমার চোখের সামনেই সেই অদ্ভুত কাণ্ডটি ঘটল।

খাটিয়ায় চাপিয়ে চারজন লোক মড়া নিয়ে আসছে। কালভার্টে সেইরকম কয়েকজন যুবক বসে। খালপারে পুলিশের দারোগা। হঠাৎ যুবক কয়েকজন বলে উঠল, ‘আরেঃ!’

তারা বিস্ময়ে উঠে দাঁড়াল। সেই আগের চারজন লোকই আবার একটা খাটিয়া নিয়ে আসছে। এ-ও কখনও সম্ভব, ওরা এত বোকা হতে পারে? যুবকরা বলল, ‘সেই চারজন, আমার স্পষ্ট মনে আছে, ঠিক সেই চারজন।’

আরেকজন বলল, ‘না, ঠিক সেই চারজন নয়। তার মধ্যে তিনজন। আমার ভালো মনে আছে। সেই চারজনের তিনজন আর একটা লোক নতুন। গাট্টাগোট্টা লোকটা আগেরবার ছিলনা। কী ব্যাপার?’

দারোগা সাহেব পর্যন্ত চিনতে পেরে হতভম্ব হয়ে গেছেন। তিনি কোমরে হাত দিয়ে পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ওদের প্রতীক্ষায়। লোকগুলো তীব্র স্বরে বলহরি ধ্বনি দিতে-দিতে কাছে এগিয়ে এল। এতগুলো উৎসুক চোখের সামনে এসে ওরা দাঁড়াল, কিছুই বলতে হল না, খাটিয়া নামিয়ে রাখল। গাট্টাগোট্টা নতুন লোকটা নিজেই ওপরের কাপড় সরাল। সত্যিই একটা মৃতদেহ। একটা রোগা শুটকো লোক মরে আছে। ওদের একজন বলল, ‘দেখুন, চাল নেই, সত্যিকারের মড়া। চাল নেই, দেখুন!

আমিও উঁকি মেরে দেখলাম। খুনটুন পর্যন্ত নয়, সাধারণভাবে একটা লোক মরেছে। ভিড়ের মধ্যে একজন অস্ফুটভাবে বলল, ‘এই সেই চারনম্বর লোকটা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *