নীললোহিতের চোখের সামনে – ৬

পণ্ডিতমশাইকে গিয়ে বললাম, আপনি একটা বিধান দিন। ধর্ম তো মানুষের প্রাণ বাঁচাবার জন্যই। ধর্মের তো উদ্দেশ্য মানুষকে মেরে ফেলা নয়।

পণ্ডিতমশাই উঠোনে হাঁটু ছড়িয়ে বসেছিলেন। হাঁটুর দুপাশে গোল করে সুতো জড়ানো, অর্থাৎ উনি পৈতের গ্রন্থি দিচ্ছেন, এখন কোন কথা বলবেন না। রিফিউজি কলোনির ছোট কাঁচা বাড়ি, মাটির উঠোন, একপাশে একটা ঝিঙে গাছে তক্তক্ করছে দুটো নতুন ঝিঙে। পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে এসেছিলাম আমার ঠাকুমার জন্য। আমার ঠাকুমা কয়েকদিন ধরে কিছুই খাচ্ছেননা প্রায়, সামান্য কিছু দাঁতে কাটছেন। দুসপ্তাহ ধরে আমাদের এলাকায় রেশনে, আলোচাল দেওয়া হচ্ছেনা। আমার ঠাকুমা সাঁইত্রিশ বছর ধরে বিধবা, তিনি সেদ্ধচাল খাবেননা, আর প্রায় সারাজীবন পূর্ববঙ্গে থেকে এসেছেন—সুতরাং ভাতের বদলে রুটি মুখে রোচেনা, রুটি খেলে নাকি সহ্য হয়না, ফল খেতেও অরুচি; অতএব, ক’দিন ধরেই এটাওটা অজুহাত দেখিয়ে প্রায়োপবেশন করে আছেন। বহু চেষ্টা করেও আমি আতপচাল জোগাড় করতে পারিনি। ঠাকুমাকে একবার ধমকে বললাম, ‘সেদ্ধচালই খাও-না। কে দেখতে যাচ্ছে।’ ঠাকুমা একগাল হেসে বললেন, ‘খাবার সময় আমি নিজের চোখে তো দেখবই! নাকি, অন্ধকারে খাওয়াবি।’

আমি বললাম, ‘ঠাকুমা, আমি অনেক বই পড়েছি, বিধবাদের সেদ্ধচাল খাওয়া বারণ—একথা কোথাও লেখা নেই। তুমি আমার কথা রেখে খাও!’

তিনি বললেন, ‘ওসব যুদ্ধ-বিপ্লব তোরা করিস বাপু। আমার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে—এখন আমি পরকালটা ঝরঝরে করতে যাব? দুদিনের জন্য নিয়ম ভেঙে চিতায়ও শান্তি পাবনা। রোদ্দুরে ঘেমে এসেছিস, যা, মুখেচোখে জল দিয়ে আয়। তারপর আমার কাছে বোস, পাখার হাওয়া করি।’

মাথার ওপর ইলেকট্রিকের পাখা ঘুরছে, তবু ‘হাওয়া করি’ বলা ঠাকুমা—দিদিমাদের অভ্যেস। শুনলেই মনে হয় হাঁটু মুড়ে বসে পড়ি, মনে হয় আঃ, কী ঠাণ্ডা!

ক’দিন ধরেই ঠাকুমাকে দেখে খুব মন খারাপ লাগছে। শুধু খাওয়া না, একটা প্রতিষ্ঠানই যেন বন্ধ হয়ে গেছে। ৭০ বছর বয়েস হয়ে গেলেও তাঁর শরীর এখনও শক্ত আছে, নিজেই নিজের রান্না করেন। খুব ভোরে উঠে স্নানটান সেরে পুজো—আহ্নিকে ঘণ্টাদুয়েক কাটে, তারপর ঢোকেন হবিষ্যি-রান্নাঘরে। তারপর প্রায় সারাদিন ধরে টুকটাক কত কী যে রান্না চলে তার ঠিক নেই। নিমপাতা ভাজা, হিঞ্চে শাক, ডাঁটা চচ্চড়ি, আলুর খোলা ভাজা, উচ্ছে আর লাউয়ের সঙ্গে মেথি পোড়া দিয়ে কাঁচা মুগের ঠাণ্ডা ডাল, কাটোয়ার ডাঁটাচচ্চড়ি, চিচিঙ্গের ছেঁচকি—এইসব গাছপালার আবর্জনা খেয়ে শরীরের কিছুই হয়না জানি, তবু ঐ রান্নাতেই আনন্দ আর সময় কাটান। আনন্দে আছেন বলেই শরীর ভালো আছে আমি মাঝেমাঝে টুকটাক উঁকি দিয়ে ঠাকুমার রান্না এটাসেটা চেয়ে খেতাম। আরও ছেলেবেলায়, ঠাকুমা যখন সারা ঘরে বাসনপত্র ছড়িয়ে খেতে বসে গল্প করতেন, আমি তখন আমডাল-মাখা ভাতের এক গেরাস খাবার জন্য মুখ বাড়িয়ে দিতাম। ক’দিন ধরে—এসব বন্ধ। ঠাকুমা আর রান্নাঘরে ঢোকেননা—ভাতই নেই, শুধু, শাক—তরকারি কে খায়। ফলটল কেটে দেওয়া হচ্ছে ওঁর জন্য, কিন্তু ওঁর সারাদিন সময় কাটে কী করে?

পণ্ডিতমশাই পৈতের গ্রন্থি বেঁধে, মুখ তুলে বললেন, ‘আমি আর কী করব বলো! তোমরাই বলো-না গিয়ে সেদ্ধচালই খেতে। আজকাল তো অনেকেই খাচ্ছে।’

–সে তো আমাদের মা-মাসিমা-বৌদির বয়েসী যাঁরা অনেকদিন শহরে আছেন—তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, তাঁদের সেদ্ধচালে আপত্তি নেই। কিন্তু দিদিমা—ঠাকুমাদের কে বোঝাবে? আপনারা ছাড়া?

—শাস্ত্রজ্ঞ হয়ে, নিয়ম ভাঙার কথা মুখ দিয়ে কী করে উচ্চারণ করি বলো? তাছাড়া, তোমার ঠাকুমা হলেন স্বর্গত অমুকচন্দ্র অমুকের বিধবা স্ত্রী, কত বড় নিষ্ঠাবান ছিলেন তোমার ঠাকুরদাদা, তাঁর পত্নীকে শাস্ত্র না-মানার কথা আমি নিজের মুখে বলতে পারবনা।

—পণ্ডিতমশাই, এর মধ্যে শাস্ত্রটা আবার কোথায়? শাস্ত্রে আত্মসংযমের কথা থাকতে পারে, কিন্তু না-খাইয়ে মেরে ফেলার কথা আছে?

–তুমি ছেলেমানুষ, তোমার সঙ্গে শাস্ত্র নিয়ে তর্ক করা আমার সাজেনা। শাস্ত্রের রহস্য অনেক গূঢ়।

একথা বলে তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন, যার অনুক্ত বক্তব্য হল, খুব না হয় দুপাতা ইংরিজি পড়ে প্যান্টালুন চড়িয়ে সিগারেট টানতে শিখেছ, কিন্তু আসতে তো হল আমার কাছে! দেখো-না বাছাধন, এমন ইস্ক্রু টাইট দেব। আমার ইচ্ছে হল পণ্ডিতমশাইয়ের রোগা দেহটা, দুহাত দিয়ে শূন্যে তুলে একটু শাস্ত্রচর্চা করি। কিন্তু তখনই মনে পড়ল, মাথা গরম করলে এখানে কার্যসিদ্ধি হবেনা। সুতরাং আমি প্যান্টালুনের ক্রিজ অগ্রাহ্য করে ওঁর পাশে মাটিতেই দুম করে বসে পড়লাম। এবং বিনীত গলায় জানালাম, ‘পণ্ডিতমশাই, আমি শাস্ত্র কিছুই জানিনা-কিন্তু সেটা আমার দোষ নয়, শিক্ষার দোষ। আমায় কেউ শেখায়নি, শেখবার সুযোগও দেয়নি। তবে, যে-কোন সংস্কৃত কথা শুনলেই মনে হয় শাস্ত্রের কথা। সংস্কৃতে একটা কথা আছে না, বিপদে নিয়মো নাস্তি? এখন যখন আতপ পাওয়া যাচ্ছে না—’

—লুচি ভেজে খাওয়াও। ফল খাওয়াও।

—কিন্তু ওঁর যে সহ্য হয়না। ভাত খাওয়া চিরকালের অভ্যেস। অম্বুবাচীর সময় ওঁকে তিনদিন উপোস করতে দেখেছি, কিন্তু এখন যে ছ-সাত দিন হয়ে গেল! আপনারা শাস্ত্র দেখে যদি বিধান দেন যে, সেদ্ধচালে কোন দোষ নেই, তাহলে বাংলাদেশে কত বিধবার যে উপকার হয়।

–সেদ্ধচালে শরীর উত্তপ্ত হয়, তা জান!

আমি কোনক্রমে হাসি চেপে বললাম, ‘অরুণের জ্যাঠামশাইয়ের বয়েস পঁচাত্তর, তিনি সেদ্ধচাল খেলে উত্তপ্ত শরীর নিয়ে যদি—’

-পুরুষের কথা আলাদা! শাস্ত্র লোকাচারে বিধবার অনেককিছু ভক্ষণ করার নিষেধ আছে।

–বিদ্যাসাগরমশাই শাস্ত্র ঘেঁটে যদি বিধবাবিবাহের নির্দেশ বার করতে পারেন, আপনারা বিধবার সেদ্ধচাল খাবার নির্দেশ বার করতে পারবেননা?

পণ্ডিতমশাই শরীর মুচড়ে বললেন, ‘আমাকে যে একটু বেরুতে হবে, বাবা। এখন তো তর্কের সময় নয়, এবার তাহলে তুমি—’

পণ্ডিতমশাইয়ের নির্দেশ আমি আদায় করতে পারিনি। কিন্তু বাজার থেকে তখুনি আমি ভালো-ভালো কোম্পানির লিভার এক্সট্র্যাক্ট, প্রোটিন কিনে এনে বোতলের লেবেল ছিঁড়ে ঠাকুমাকে খাওয়াচ্ছি। বিধবার পক্ষে আমিষ খাওয়া উচিত নয়, তবু আমি অন্য কথা বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে খাওয়াচ্ছি। কিন্তু, আমার মন পরিষ্কার, আমি জানি আমি কোন অন্যায়, কোন পাপ করছিনা।

সরমাদি আমাদের পাশের বাড়িতে থাকেন। এখন বয়েস ৪২, দশবছর আগে বিধবা হয়েছেন। সরমাদি সংস্কৃতে বি.এ. অনার্স, একটা স্কুলে কাজ করেন, শাস্ত্র শোনার জন্য কোন পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে যাননা। সরমাদি রঙিন শাড়ি পরেন, হাতে একগাছি করে সোনার রুলি, সেদ্ধচাল খান-কিন্তু পাড়ায় সরমাদির নামে কোন অপবাদ নেই, সকলেই তাঁকে সমীহ করে। আমি সরমাদিকে একদিন চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সরমাদি, তুমি এতসব ভেঙেছ, কিন্তু তুমি এখন আর মাছ—মাংস খাওনা কেন? তুমি তো জান বিধবাদের মাছ-মাংস খাওয়ার মধ্যে কোন অন্যায় থাকতে পারেনা। বিপত্নীকরা যদি পারে-তবে বিধবাদেরই বা কেন। তুমি সাহস করে—’

সরমাদি বললেন, ‘দূর পাগলা!’

আমি বললাম, ‘না সত্যিই, তোমাদের মতো কয়েকজনের উচিত আরম্ভ করা। প্রকাশ্যে স্বীকার করা। তোমাদের মতো যাদের লোকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, তারা যদি শুরু করে, অন্যান্য সাধারণ ঘরের বিধবারাও ভরসা পায়। দেখো, আজকাল দুধ-ঘি কিছু খাওয়া যায়না, শুধু শাক-পাতা আর একবেলা ভাত খেয়ে বিধবার চল্লিশ পেরুতে-না-পেরুতেই পুরো বুড়ি। দাঁত পড়ে যায়, চোখ খারাপ হয়, শরীর বেঁকে যায়, ঘর থেকে বেরুতে পারেনা, জীবস্মৃত অবস্থা। বুড়ি মেমসাহেবদের দেখো তো একা-একা সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। বার্ধক্যেরও একটা সৌন্দর্য আছে, কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ ঘরের বুড়ি-বিধবারা?’

সরমাদি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, একেই বাজারে মাছ-মাংসের যা অবস্থা! তার ওপর যদি আবার বিধবারা খাওয়া শুরু করে, তোদের কপালে একটুকরোও জুটবেনা।’—তারপর সরমাদি নিচু গলায় বললেন, ‘না, তোকে সত্যিকথা বলি, আগে, মানে কপাল সাদা হওয়ার আগে মাছ খেতে বিষম ভালোবাসতাম। একবেলা মাছ না থাকলে মুখে ভাত রুচতনা। কিন্তু এখন মাছ খেতে কেন পারিনা জানিস, লোকে হ্যাংলা বলবে। ভাববে, আমার লোভ কতখানি। সাদা কাপড় বেশি ময়লা হয় বলে যুক্তি দেখিয়ে আমি রঙিন শাড়ি পরতে পারি, সোনার চুড়ি যখন আছেই-তখন বাক্সে না-রেখে হাতে রাখাই নিরাপদ। কিন্তু মাছ-মাংসের বেলায় কোনই যুক্তি টিকবেনা। শুধু ভাববে, আমার হ্যাংলামি। এমনকী বিধবারা প্রেম করে আবার বিয়েও করতে পারে, কিন্তু নিজেনিজেই মাছ-মাংস খাওয়া শুরু করতে পারেনা। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতরা যদি এতে সম্মতি দেন, সমাজে প্রচার করেন, কাগজে-টাগজে লেখেন, বাড়ির পুরুষেরা যদি জোর করে, তবে চালু হতে পারে। দেখ, হয়তো আস্তেআস্তে এসব বদলে যাবে।’

আমি বললাম, ‘বদল হয় হয়তো, কিন্তু এত আস্তে যে চোখে দেখা যায়না। ছেলেবেলায় দেখতাম ট্রামের জানালার পাশে বসা একধরনের টিপিক্যাল অফিসযাত্রী, ঠনঠনের কালীবাড়ির পাশে এলেই মেশিনের মতো যাদের হাত কপালে উঠে যেত। ভাবতাম, আমাদের জেনারেশনে হয়তো এসব বদলে যাবে, কিন্তু এখনও ঠিক ঐ একই চেহারার লোকদের দেখি কপাল ঠুকতে। বছর পনেরো আগে একটা অফিসে একজন লোক আমার কাছে ঘুষ চেয়েছিল। মাঝবয়েসী, গুঁপো চেহারার সেই লোকটা। সেই অফিসে কয়েকজন ছেলে-ছোকরা কর্মচারীও ছিল। ভেবেছিলাম, বুড়োরা বিদায় নিলে-এই ছেলে-ছোকরারাই যখন সব চেয়ারে বসবে-তখন সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে। কয়েকদিন আগে সেই অফিসে গিয়েছিলাম, ঠিক সেইরকম মাঝবয়েসী আর-একটা গুঁপো লোক আমার কাছে ঘুষ চাইল। এরা বদলায়না, এঁরা অমর। ভেবে দ্যাখো আমাদের পাড়ার যে ভট্টচাজ্যি পণ্ডিতমশাই—শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলিতে কি উনিই ছিলেন না?’

টুকুন আমার এক বন্ধুর বোন—হঠাৎ বাসে তার সঙ্গে দেখা। কুড়ি-বাইশ বছর বয়েস, ভারি ছটফটে ঝলমলে মেয়ে, বছর তিনেক আগে ওর বিয়ে হয়ে যাবার পর আর ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। আমার ছোট বোনের বন্ধু ছিল। হঠাৎ মনে পড়ল গতমাসে আমার বোনের বিয়েতে তো টুকুন আসেনি। আমার বোনের ও প্রাণের বন্ধু, নেমন্তন্ন নিশ্চয়ই করেছিল। আমি জিগগেস করলাম, ‘এই টুকুন, তুই আমার বোনের বিয়েতে এলিনা কেন রে? ভারি অহংকারী হয়েছিস, না?’

টুকুন হঠাৎ মুখের আলো নিবিয়ে আস্তেআস্তে বলল, ‘পরে একদিন যাব। বিয়েবাড়িতে বিধবাদের যেতে নেই।’

আমি আর্ত চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম, টুকুনের বাবা পাশ থেকে বললেন, ‘বিয়ে হবার দুমাস পরেই টুকুনের স্বামী দুর্ঘটনায় মারা গেছে!’ আমি টুকুনের দিকে তাকালাম, কোন চিহ্ন নেই, দামি রঙিন শাড়ি পরেছে, হাতভর্তি গয়না, খোঁপায় হাতির দাঁতের ফুল, কপালে লাল টিপ পর্যন্ত। কিন্তু মনে হল একটা খড়-মাটির প্রতিমার গায়ে পোশাক চড়ানো। আমি আবার তাকালাম, হ্যাঁ, অবিকল খড়-মাটির প্রতিমা। অল্পদিনের মধ্যেই ঐ শরীরের রঙ জ্বলে যাবে, উঠে যাবে, গায়ের মাটি গলে যাবে, দু-এক বছর পরেই আমি টুকুনের দেহের খড়ের কাঠামোটা শুধু দেখতে পাব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *