নীললোহিতের চোখের সামনে – ৪

জিপিও-র সামনে বিরাট লাইন পড়েছে বেকার যুবকদের। পোস্ট অফিসের কেরানির কিছু চাকরি খালি হবে, সেইজন্য ফর্ম বিলি হচ্ছে। আগে থেকেই জানা গেছে, চাকরি দেওয়া হবে একশো চল্লিশ জনকে, সেইজন্য ফর্ম বিলি করা হবে চৌদ্দ হাজার। একটা আধটা পোস্ট তো নয়, একশো চল্লিশটা, লাইনের ছেলেদের মধ্যে বেশ খানিকটা উদ্দীপনা চোখে পড়ে।

আমি বাসের গুমটিতে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। বেকার যুবক বলতে আগেকার গল্প-উপন্যাসে যে-বর্ণনা পাওয়া যেত, এরা কেউই সেরকম নয়। কারোরই রোগা, না-খেতে-পাওয়া চেহারা কিংবা মলিন পোশাক নয়, দিব্যি সব স্বাস্থ্যবান চেহারা প্রাণশক্তিতে টগবগ করছে। অনেকেই পরেছে চাপা ড্রেন পাইপ, জামায় বাহার আছে, চুল আঁচড়েছে দারুণ কায়দায়। এইসব চেহারা দেখলে মায়া কিংবা বিরক্তি আসেনা, এইসব চেহারা দেখলে ভালো লাগে।

লাইনের মধ্যে আমার চেনা একটা ছেলে ছিল, আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে চেঁচিয়ে বলল নীলুদা, আপনি এখানে কী করছেন, তারপর লাইনের অন্য একটি ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমার জায়গাটা রাখবেন তো দাদা!’ আমার দিকে সে এগিয়ে এল লাইন ছেড়ে।

আমি আগে যে-পাড়ায় ভাড়া থাকতাম, ছেলেটি সে-পাড়ার! আমার সঙ্গে বেশ পরিচয় ছিল, নানান্ ছুতোয় চাঁদা নিতে আসত, বহু বই পড়ত, নিয়ে আর ফেরত দেয়নি।

আমি বললাম, ‘কী রে বাবলু, কেমন আছিস!’

—আপনি এখানে কী করছেন?

একটু চোরা হাসি দিয়ে বললাম, ‘আমিও ভেবেছিলাম ফর্ম নেবার জন্য লাইনে দাঁড়াব, তোকে দেখে আর লজ্জায় দাঁড়াতে পারলামনা। প্রেসটিজে লাগল!’

বাবলু রীতিমতন দাঁত বার করে বলল, ‘যা-ন্! আপনি এই সামান্য ছ্যাঁচড়া চাকরির জন্য লাইন দেবেন? আপনি তো আজকাল—’

—লাইন ছেড়ে যে চলে এলি, আবার ঢুকতে পারবি?

—হ্যাঁ, এক দাদাকে বলে এসেছি। এখন ফর্ম দেওয়া বন্ধ আছে।—দাদা মানে? এখানকার পাতানো দাদা?

-না, না, ওর সঙ্গে এরকম সাতটা লাইনে আর তিনটে ইনটারভিউতে দেখা হয়েছে। আমরা দুজনেই ভেটারান্।

—তুই বি এসসি পড়তিস না? পাশ করেছিস? নাকি তার আগেই চাকরির জন্য—

কী করব বলুন, আমাদের ফ্যামিলিতে একটা ব্যাপার হয়ে গেল— যাক শুনতে চাইনা! একটা-কিছু বিপদ হয়েছে তো? মানুষের দুঃখের কথা শুনতে আমার আর ভালো লাগেনা। প্রত্যেক দিন খবরের কাগজ খুললে দেখতে পাই, পথে-ঘাটে শুনি, এই যে, হাজারখানেক ছেলে দাঁড়িয়েছে—এদের প্রত্যেকের জীবনেই এরকম কিছু আছে, আমারও আছে। সবই তো জানি, শুনে কী হবে?

—নীলুদা, একটা সিগারেট খাওয়াবেন।

বাবলুর সাহস বেড়েছে। আগে আমাকে দেখলে সিগারেট লুকতো, এখন সরাসরি চেয়েই বসল। আমি অবশ্য তেমন রাগ করলামনা, ছেলেছোকরাদের খানিকটা ঔদ্ধত্য থাকলে আমার ভালোই লাগে। সিগারেট দিয়ে দুজনে ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই বুঝি এরকম চাকরির খবর পেলেই ছুটে আসিস?’

—কী আর করি দাদা, চেষ্টা তো করতেই হবে?

—এক-একবার চাকরির চেষ্টা করতে গিয়ে কত খরচ পড়ে?

—আপনি ঠিক আসল কথাটা ধরেছেন তো। সত্যি, চাকরি না-পাওয়ার চেয়েও এইসব খরচাগুলোর জন্যই বেশি গায় লাগে। তা ধরুন, যাতায়াত বাসভাড়া তিরিশ নয়া, সার্টিফিকেটের কপি টাইপ করাতে নেয় চল্লিশ-চল্লিশ আশি, তারপর রেজিস্ট্রির জন্য আশি—টাকাদুয়েক মিনিমাম! কোন কোন শালার অফিস (আমার সামনে ‘শালা’ কথাটা উচ্চারণ করেও বাবলু জিভ কাটলনা) আবার পোস্টাল অরডার চায়।

—এমপ্লয়মেন্ট একসচেনজে নাম লেখাসনি? তাহলে তো আর দরখাস্ত করতে হয়না!

—আপনি আছেন কোথায়? তিন বছরে একবারও কল পাইনি। তবু এইসব খুচখাচ দরখাস্তে অনেকসময় ইনটারভিউ পাওয়া যায়। ইনটারভিউতে আবার ডবল খরচ। পাঁচ-ছঘন্টা ধরে হয়তো ফুডের জন্য কিছু পয়সা চলে যায়!

-এরকম কত জায়গায় দরখাস্ত করেছিস?

—ইনটারভিউ দিয়েছি তেরোবার। আনলাকি থারটিন পার হয়ে গেছি, এবার যদি পাওয়া যায়।

—এখানে তুই চাকরি পাবি আশা করছিস? কাগজেই তো বেরিয়েছে, একশো চল্লিশটা পোস্টের জন্য চোদ্দ হাজার ফর্ম বিলি হবে। তার মানে প্রতি একশোজনের জন্য একটা পোস্ট। কী করে বাছবে? কোন যুক্তিসম্মত উপায় আছে? এখানে অনেকের স্বাস্থ্য ভালো, সবাই স্কুল ফাইনাল পাশ তো বটেই, বি এ, বি এসসি, এম এ পাশও আছে হাজার হাজার। তারমধ্যে একশো চল্লিশ জনকে কী করে বাছবে? তুই কি এখানে লটারির টিকিট কাটতে এসেছিস?

বাবলু চুপ করে আমার দিকে তাকাল। নাকটা অদ্ভুতভাবে কুঁচকে একটা বিরক্তির ভঙ্গি করল। সিগারেটটা টুসকি মেরে ছুড়ে দিল রাস্তার মাঝখানে। তারপর জামার হাত গুটিয়ে আমার সামনে এসে বলল, ‘নীলুদা হাতখানা দেখছেন? মাস্‌ল টিপে দেখুন! শরীরে এখন দারুণ জোর, কোন অসুখবিসুখের নামগন্ধও নেই। সারাটা দিন কী করে কাটাই বলুন তো! সারাদিনরাত চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকা যায়? কোথাও একটা লেবারের চাকরি পেলেও করতাম, তা সব ফ্যাকটারিতেও তো এখন লোক নেওয়া একদম বন্ধ! আর বাড়িতে থাকলেই তো, এটা নেই সেটা নেই, এত বড় বুড়োধাড়ি ছেলে কিছু করতে পারেনা—এইসব শুনতে হয়! আর নয়তো পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে গুণ্ডামি-ছিনতাই করতে হয়। তাহলে বলু তাই করব, টাকাপয়সার জন্য নয়, জোয়ান ছেলে—সারাদিনে একটা কিছু তো কাজ চাই, কোন কাজ নেই—কী করব, বলে দিন আমাকে!’

আমি বিচলিতভাবে বললাম, ‘বাবলু, তুই একথা আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন! আমি এর উত্তর কী করে জানব। এ তো আমারও প্রশ্ন। কে উত্তর দেবে জানিনা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *