নীললোহিতের চোখের সামনে – ২১

২১

সুবিমল বলল, ‘লোকটাকে আমি তিনহাজার টাকা পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলাম। ও নিতে চায়নি।’

আমি বললাম, ‘তাতে কী প্রমাণ হয়? লোকটা বোকা না ভীতু না সৎ লোক?’

—সেটাই তো প্রশ্ন। আমার ধারণা লোকটা সৎ-ই ছিল, একটু ভীতুও। সৎ লোকেরা সাধারণত একটু ভীতুই হয়। কথায় বলে না, ধর্মভীরু?

-আমি তা মনে করিনা। ‘ধর্মভীরু’ কথাটার মানে অন্য। আমার ধারণা, অসৎ লোকেরাই ভীতু—তাদের সৎ হবার সাহস নেই। অসৎ হওয়াই সোজা।

—যাক গে ও-কথা। এখন কী করা যায়?

যে লোকটি সম্পর্কে কথা বলছিলাম, সে আমাদের সামনেই শুয়ে আছে। তার সামনে যে-কোন কথা বলা যায়, কারণ সে কানে শোনেনা, চোখেও খুব কম দেখে, তাছাড়া এখন বোধ হয় সে অজ্ঞান হয়ে গেছে!

আমি আর সুবিমল দুটো বিড়ি ধরিয়ে টানছি। অনভ্যাসে বারবার নিবে যাচ্ছে বিড়ি। একটু আগে ঐ লোকটির কাছ থেকে দুবান্ডিল বিড়ি কিনেছি। সুবিমল ওকে পাঁচটা টাকা সাহায্য হিশেবে দিতে চেয়েছিল, ও নেয়নি। ও ভিক্ষে নেবেনা। ওর বিড়ির দোকান, ও আমাদের বিড়ি কিনে সাহায্য করতে বলেছিল।

কথা বলতে-বলতে কাশতে কাশতে লোকটি নিঝুম হয়ে পড়েছে, জ্ঞান আছে কিনা জানিনা। সুবিমল ভয়ে ভয়ে দুবার নিচু হয়ে ডাকল, ‘ইরফান, ইরফান!

কোন সাড়া নেই। সুবিমল গায়ে হাত দিতে সাহস পাচ্ছেনা। একটা লুঙ্গি—পরা, খালি গা—শরীরটা যে একটা খাঁচা তা ওকে দেখলে বোঝা যায়—একটা হাড়ের খাঁচা ছাড়া শরীরে আর-কিছু নেই।

পাশেই একটা বেশ বড় মনোহারী দোকান—আমি সেই দোকানে গিয়ে বললাম, ‘দেখুন, ঐ যে বিড়ি বিক্রি করে বুড়ো, ও হঠাৎ আমাদের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ওর বাড়ির লোককে কী করে খবর দেওয়া যায়? কিংবা কাছাকাছি কোন ডাক্তার-টাক্তার— ‘

আমাকে শহুরে লোক বুঝেই বোধহয় দোকানদারটি একটু অপ্রসন্নভাবে তাকাল। তারপর বলল, ‘ঐ ইরফান আলি তো? ওর এরকম প্রায়ই হয়—কিছু ভাবতে হবেনা, এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। বারোটার সময় ওর ছেলে আসবে—’

—একটু জল দিতে পারেন? ওর মাথায় ছিটিয়ে দিতাম—

-ঐ টিউকল থেকে নিন।

টিউবওয়েল একটা আছে বটে, কিন্তু হাতে করে তো আর জল নেওয়া যায়না! দোকানদারটির কাছ থেকে কোন পাত্রটাত্র চাইতে সাহস হচ্ছেনা। লোকটি আমার ব্যস্ততাকে নিশ্চিত আদিখ্যেতা মনে করছে। আমি ওর কাছ থেকে একটা কাচের গেলাস কিনে ফেললাম। সেই গেলাসে জল নিয়ে দিলাম সুবিমলকে। সুবিমল জলের ছিটে দিতেই বুড়ো ইরফান চোখ মেলে চাইল।

মুর্শিদাবাদ শহরে অনেক খুঁজে-খুঁজে আমরা ইরফানের দোকানে এসেছি। ইরফান আগে যে-বাড়িতে থাকত, সে-বাড়ি সুবিমলের চেনা ছিল, এখন ও—বাড়িতে থাকেনা। ইরফান আগে চাকরি করত নবাব সাহেবের লাইব্রেরিতে—এখন সে-চাকরিও গেছে, বলাই বাহুল্য।

এই ধরনের লোকদের সুবিমল ঠিক খুঁজে বার করে। পুরোনো, দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করে সুরিমল, তারপর গবেষকদের কাছে, সারা ভারতের বড়-বড় লাইব্রেরির কাছে বিক্রি করে। কোথায় কোন দুষ্প্রাপ্য বই আছে, সুবিমল তার সন্ধান রাখে, সেগুলো জোগাড় করার জন্য ও যে-কোন উপায় অবলম্বন করতে প্রস্তুত। এমনকী চুরিও। এ-সম্পর্কে সুবিমলের বিবেক খুব পরিষ্কার। ও বলে, শুয়োরের খোয়াড়ে যদি তুমি একটা মুক্তো পড়ে থাকতে দ্যাখো, তাহলে সেটা সেখান থেকে তুলে এনে কোন সুন্দরী মেয়ের আংটিতে বসিয়ে দেওয়া কি অপরাধ? কতসব, ক্ষয়িষ্ণু বনেদী পরিবারের উই-ধরা আলমারিতে দুর্লভ সব বই নষ্ট হচ্ছে, সেগুলো-যে-কোন উপায়ে গবেষকদের হাতে পৌঁছে দেওয়ায় কোন অন্যায় নেই। কথাতেই আছে ধনবানে কেনে বই, জ্ঞানবানে পড়ে।

মুর্শিদাবাদের নবাববংশেরই একটি শাখা পরিবারের আছে বহুপ্রাচীন বই ও পুঁথির কালেকশন। তার মধ্যে আছে একটি ফারসিবইয়ের পাণ্ডুলিপি, যেটি পাবার জন্য বহু ইতিহাসের গবেষক উদগ্রীব। সুবিমল প্রথমে বইটা কেনার চেষ্টা করেছিল। সে-বাড়ির বর্তমান বংশধররা সবাই মূর্খ, বইটই সম্পর্কে কোন আগ্রহই নেই, অযত্নে অবহেলায় বইগুলো নষ্ট হচ্ছে। নানান শরিকে ঝগড়ার ফলে আদালতে মামলা চলছে কয়েকবছর ধরে, কোনকিছুই এখন বিক্রির অধিকার নেই কারুর।

সেই বাড়িতে চাকরি করত ইরফান। লাইব্রেরি ঘর ঝাড়পোঁছ করত—সে নিরক্ষর, সেও বইয়ের মর্ম বোঝেনা—কিন্তু যে-কাজের ভার দেওয়া হয়েছিল তার ওপর, সেটা ভালো করে করাতে চাইত। সুবিমল ইরফানের বাড়িতে দেখা করে বলেছিল, সে যদি সেই ফারসি বইখানা গোপনে সরিয়ে আনতে পারে, তাহলে একহাজার টাকা পাবে।

ইরফান মাইনে পেত মোটে ছত্রিশ টাকা। অত্যন্ত গরিব মানুষ, বাড়িতে একগাদা ছেলেপুলে। বইখানা সরিয়ে আনা তার পক্ষে খুবই সহজ ছিল, জামার তলায় পেটের কাছে গুঁজে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারত। দু-চারবছরের মধ্যে কিংবা কোনদিনই বোধহয় সে-বইয়ের খোঁজ কেউ করত না। সে-বাড়ির লোকেরা কোনদিন লাইব্রেরি ঘরে ঢোকেনা, ভুলেও একটা বই উল্টে দেখেনা।

কিন্তু ইরফান তবু রাজি হয়নি। এ-কাজ তার চোখে হারাম। মালিকরা বিশ্বাস করে তার ওপর যে-ভার দিয়েছে, সেই বিশ্বাস সে নষ্ট করবে কী করে!

সুবিমল বারবার এসে লোভ দেখিয়েছে ওকে। সেবার ওকে তিনহাজার টাকা পর্যন্ত দিতে চেয়েছিল, সামান্য একখানা বইয়ের জন্য। বইখানা সত্যিই মূল্যবান, তার বাজার দর এখন পাঁচ হাজার টাকার মতন—ভারতবর্ষে ঐ পাণ্ডুলিপির দুটি মাত্র কপি আছে, আর একখানা হায়দ্রাবাদে নিজামের কাছে। এ-তথ্য অবশ্য শুধু গবেষকরা জানে, মুর্শিদাবাদে ঐ নবাব পরিবারের ফ্যাকড়ারা এর খোঁজও রাখেনা।

এবার এসে ইরফানের এই অবস্থা দেখলাম। হঠাৎ চোখের অসুখ হয়ে দৃষ্টিশক্তি প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ইরফানের চাকরি গেছে। নিষ্ঠুরভাবে এককথায় বরখাস্ত—মালিকরা একটা পয়সাও অতিরিক্ত দেয়নি। মালিকরা তো আর তার সততা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। অথচ স্যার যদুনাথ সরকার যখন ঐ বাড়িতে পড়াশুনো করতে এসেছিলেন, তখন ইরফান তাঁর কত সেবা করেছে। স্যার যদুনাথের সার্টিফিকেট আছে তার কাছে।

এখন ইরফানের এই সামান্য দোকান— কয়েক বান্ডিল বিড়ি, আর কাগজের প্যাকেটে কী একটা জিনিশ—শুনলাম স্বপ্নাদ্য—হাঁপানির ওষুধ। সারাদিনে এক টাকার বিক্রি হয় কিনা সন্দেহ। চোখে দেখতে পায় না, সারাক্ষণ অনবরত কাশছে, বোঝা যায় ইরফানের মৃত্যুর আর বেশি দিন দেরি নেই।

চোখ মেলার পর সুবিমল জিজ্ঞেস করল, ‘কী, এখন কী রকম লাগছে? একটু ভালো তো?’

দৃষ্টিহীন চোখে ইরফান কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে। বলল, ‘বাবু সবই আমার নসীব। তিন-তিনহাজার টাকা আপনি দিতে চেয়েছিলেন। সেই টাকা আমি পায়ে ঠেলেছি! এখন আমার ওষুধ জোটেনা, খাওয়া জোটেনা।’

–বুড়ো, তখন তো তোমায় কতবার বলেছি! ও-বই আনলে মালিকদের কোন ক্ষতি হতোনা। অন্যদের উপকার হতো অনেক। এখন আর-কোন নতুন লোককে রেখেছে?

–না, বাবু! এখন ঘর তালাবন্ধ থাকে। অ্যাদ্দিনি উইতে বোধহয় সব বই কেটে দিয়েছে।

ইস্! ঐ বই যদি নষ্ট নয়, তাহলে যা ক্ষতি হবে!

ইরফান বইয়ের মর্ম বেঝে না। কিন্তু তিনহাজার টাকার জন্য কী আফসোস্! তিনহাজার টাকা পেলে সে পাশের মনোহারী দোকানের মতন বড় একটা দোকান খুলতে পারত! হায়, হায়, কী যে তার বুদ্ধিভ্রম হয়েছিল! কেন যে সে তখন বাবুর কথা শোনেনি। এখন তার উচিত মাথায় কুড়ুলের কোপ দিয়ে মরা।

বেশিদিন আর বাঁচবেনা ইরফান, কিন্তু মৃত্যুর আগে সে তার সততার জন্য আফসোস করে যাচ্ছে, এ-দৃশ্যটা আমার দেখতে ভালো লাগলনা। পৃথিবীতে কত চোর-বদমাস তো বেশ মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়, কোনদিন অনুতাপ করেনা। আর এই লোকটি সৎ ছিল বলে অনুতাপ করছে। শীর্ণ হাতে কপাল চাপড়াচ্ছে আর হায়-হায় করছে ইরফান।

এখানে আমাদের আর কোন দরকার নেই। আমি সুবিমলকে এবার যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করলাম। সুবিমল বলল, ‘চলি, বুড়ো মিঞা।’ ইরফান কী বলতে গিয়ে আবার ঘং-ঘং করে এমন কাশতে লাগল যে ভয় হল, আবার না অজ্ঞান হয়ে যায়। অতি কষ্টে সামলে বলল, ‘আর তো আসবেননা আমার কাছে, না? আর তো কেতাব আনার ক্ষমতা নেই। তবু ফি বছর একবার আসবেন! আবার এলে দেখবেন, আমি মরে গেছি!’

বিদায় নেবার মুহূর্তটি সত্যি অস্বস্তিকর। সত্যি কথাই তো, আমরা ওর কাছে আর কেন আসব, আর তো ওকে কাজে লাগাবার কোন সম্ভাবনা নেই! সুবিমল একটা দশটাকার নোট বার করে বলল, ‘এই নাও বুড়ো মিঞা, এটা দিয়ে ছেলেমেয়েদের কিছু কিনে দিয়ো।’

ছানিপড়া বিবর্ণ চোখে ও জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’

—বিশেষ কিছু না। এই দশটা টাকা রাখো—দুহাত দিয়ে না করল ইরফান। বলল, ‘আপনার কাছ থেকে তিনহাজারই নিইনি, আর দশ টাকা নেব? মরার পর খোদাতাল্লাকে তবু বলতে পারব, আমি কোনদিন চুরিও করিনি, ভিক্ষেও করিনি।’

না, এ-লোককে কিছুতেই ভীতু বলা যায়না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *