নিতু বলছি – ৮

তাসলি আপু আমার জন্য, একটা নতুন বোরকা কিনেছে। এটা হচ্ছে নিরাপত্তা বেষ্টনি। ওনার নিজের জন্য আগে থেকেই কেনা আছে। নিরাপত্তার কারণ হচ্ছে, আমাদের চিনতে না-পারা। বিশেষ করে বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব কিংবা এলাকাবাসী।

আমরা একটা গোপন মিশন ফুল-ফিল করতে যাব। যাব বলছি, কেননা, সময় ও সুযোগ কোনোটিই আমাদের সপক্ষে নেই এখন। তারপরও আমি যতবার জেদ ধরি, আপু বলে, এই তো কালকে।

রেজা স্যার গ্রেফতার হবার তৃতীয় দিন আজ। রিমান্ড শেষ হয়েছে গতকাল। ওনার সাথে দেখা করা তাই অসম্ভব ছিল এই কয়েকদিন।

কিন্তু আজ আমাদের পরিকল্পনা সার্থক করতেই হবে।

সকাল দশটা নাগাদ আপু এসেছিল আমাদের বাসায়। বাবা-মা’কে বহু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তার বাসায় নিয়ে এসেছে একপর্যায়ে। যুক্তি হচ্ছে, আমার মন খারাপ। স্কুল বন্ধ। তাই আজ সারাদিন ওনাদের বাসায় থাকব। ভালো না-লাগলে, একটু বাইরেও যেতে পারি। মা এক শর্তে রাজি হয়েছেন। বাবাকে এই পরিকল্পনার বাইরে রাখতে হবে।

অর্থাৎ যেখানেই থাকি, অফিসছুটির আগেই, ঘরের মেয়ে ঘরে থাকবে।

.

স্যার আমাকে দেখে যতটা-না অবাক হলেন, তার চেয়ে শতগুণে অবাক হলাম আমি। স্যারকে দেখে।

উনি হাজতখানায় আছেন, না হাম্মামখানা, কে জানে!

কথাবার্তা সেই আগের মতোই। বরং আরও ফুরফুরে। এতদিন জানতাম, রিমান্ডে নাকি মানুষকে লেবুর মতো চেপা হয়। সব রস বের করে আনা হয়। আজ দেখি উল্টো। স্যার আরো সরেস।

কী ব্যাপার অড্রে হেপবার্ন, একাই! সালমা হায়েক আসবে না!

না স্যার। রাফিয়া অসুস্থ। (ইচ্ছে করেই মিথ্যে বললাম)

স্যার মিথ্যা ধরে ফেললেন। যথারীতি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় কথা পাল্টালেন।

কিন্তু, এই নতুন বেশ-ভূষা কেন? বোরকা স্টাইল। ফিল্ম কি রিলিজ হয়ে গেল না-কি? অ্যান্ড ইউ বোথ বিকাম সুপারস্টার।

স্যার হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন। সেই ভুবনমোহিনী হাসি!

পাশের জন-টা কে? দেখে যেন মনে হয়, চিনি উনারে।

তাসলি আপু সালাম দিলেন।

কিছু বলবার আগেই স্যার বলে বসলেন, ওহ্ চিনেছি। তাসলিমা জাহান। ব্যাচ টু থাইজেন্ডস্ ফিটিন।

আমি কথায় ব্যাঘাত ঘটালাম।

স্যার, একটা জরুরি প্রয়োজন ছিল।

তা-তো বুঝতেই পারছি। নতুবা কি রক্তকরবীর নন্দিনী, প্রফেসর সাহেবের সাথে দেখা করতে আসে?

আমাদের কালাপেত্নী মিস্ (বলেই জিহ্বায় কামড় দিলাম আমি), স্যরি স্যার, মানে ভিপি মিস যে শাড়ির কথা বলেছেন, সেটা কি জন্মদিনে পরে যাওয়া শাড়িটা?

বাপরে, আইডিয়া কি পাল্টে ফেলেছ! গোয়েন্দাগিরির স্টাইলে ছবি বানাবে?

আমি কোনো কথা না-বলে সরাসরি স্যারের চোখের দিকে চোখ ফেললাম। জীবনে প্রথমবার। সরাসরি চোখে চোখ রাখা দৃষ্টি। যাতে তিনি বুঝতে পারেন, এ দৃষ্টি সাধারণ কোনো দৃষ্টি নয়। বরঞ্চ সেই দৃষ্টি, যা এক পুরুষকে বুঝিয়ে দেয়- আমি ছিলাম। আমি আছি। আমি থাকব। শেষ পর্যন্ত।

.

লিসেন নিতু, খামোখা নিজেকে এই ঝামেলায় জড়াচ্ছ কেন?

স্যার মাথা নামিয়ে উত্তর দিলেন।

আমি প্রথম লক্ষ করলাম, স্যারের চোখে রাতজাগা কালি। না, সেই তরতাজা ভাবটি আসলেই নেই। বরঞ্চ পুরো অবয়বে একটা অবসাদের ছায়া। কানের কাছে হালকা একটা দাগ। কিসের! কোনো নির্যাতনের নয়তো!

আমার চোখ ঝাপসা হতে শুরু করেছে। আচ্ছা, মানুষটা এমন কেন! আর আমিই-বা এত বেকুব কেন! উনি যে এতটা অবসাদগ্রস্ত, তা একবারের জন্যও বুঝতে পারলাম না?

আমি দৃঢ়কণ্ঠে বলতে লাগলাম আমার বক্তব্য।

স্যার, যে ঝামেলায় আমরা আপনাকে জড়িয়েছি, তার সমাধান না- পারি, সান্ত্বনাটুকু তো নিতে পারব অন্তত।

স্যার বেশ খানিকটা অবাক হয়ে গেলেন আমার শেষ কথায়।

আমি সেদিকটায় মনোযোগী না হয়ে, আধো-ভেজা কণ্ঠে বলতে লাগলাম আমার অপরাধ।

স্যার, আজ আপনার যত সমস্যা, সব আমাদের জন্য। এত অসম্মান, এত অপমান, এত মিথ্যে রটনা-ঘটনা সবকিছুর জন্য আমি দায়ী স্যার।

স্যার যথারীতি স্ব-রূপে আবর্তিত হলেন আবারও। হাসতে লাগলেন।

এই পাগলি বলে কী! শোন নিতু। দোষ কিংবা দায় কারও নয়। সুরা আল্ ইমরানের সাতাশ নম্বর আয়াতটা জানো তো। ‘ওয়াতু ইঝু মাং তাশা~উ, ওয়া তুষি’ললু মাং তাশা~উ’ অর্থাৎ To whom, you wish, you give the honor and from whom, you wish, you take away.

স্যার, তাহলে সুরা আল ওয়াকি আ-এর আরেকটা আয়াতও আপনি শোনেন। ‘ওয়া আম্মা ইং কা-না মিনাল মুকাফ্ যি বীনাদ দা~ল্লীন, ফানুঝুলুম্‌ মিন্ হামীম, ওয়া তাসলিয়াতু জাহীম। ইন্না হা-যা-লাহুয়া হাক্কুল ইয়াকীন।’

বলেই নিশ্চুপ হয়ে গেলাম আমি।

স্যার বোঝাতে লাগলেন, ঠিক যেন ক্লাস নেবার ভঙ্গিমায়।

দোষী-নির্দোষী প্রশ্ন উঠছে কেন এখনি? কেউ একজন আমার বিরুদ্ধে তার অভিযোগ দিয়েছে। দিতেই পারে। এর সাক্ষ্য হবে। প্রমাণ হবে। ডকুমেন্ট-এভিডেন্স আসবে। প্রয়োজনে আদালত যেতে হতেই পারে।

জি স্যার। আমিও সেটাই বলছি। আমি পুলিশকে দু’টো প্ৰমাণ পৌঁছে দেব। এক, যে শাড়ির কথা ভিপি মিস্ বলছেন, সেটা আমার জন্মদিনে পরে যাওয়া শাড়ি। এবং সেদিন শাড়িটা আমিই ছিঁড়েছিলাম। আপনি নন। আমার কাছে প্রমাণ আছে। ছবিসহ। রাফিয়ার ক্যামেরায় ভিডিও ফুটেজ আছে সেদিনের।

স্যার হাসছেন।

তাই না-কি? যদি ছেঁড়া আরও থাকে। আই মিন মোর দ্যান ওয়ান পজিশন। জোরপূর্বক অথবা টানা-হ্যাঁচড়ার মাধ্যমে? তাহলে কি প্রমাণিত হবে আমি ছিঁড়েছি?

নো স্যার। আই অ্যাম শিউর। দেয়ার ইজ ওলি, অ্যান্ড ওনলি ওয়ান কাট্ ইন দ্যা ক্লোথ।

তুমি অনেকটা বাচ্চাদের মতো যুক্তি দিচ্ছ নিতু। অ্যান্ড ইট ইজ রিয়ালি আ ফ্যাক্ট। ইউ আর সো। তুমি একটা বাচ্চা মানুষই। অনেকটা ছোটবেলায় আমরা যেমন খেলেছিলাম। আলমারির চাবি নিজেই লুকিয়ে রেখে মা’র কাছে বায়না ধরেছিলাম। ‘বল তো, চাবি খুঁজে দিলে তুমি আমাকে কী দিবে আম্মু’?

আমি আপনার কাছে বাচ্চা হই কিংবা বৃদ্ধা, তাতে আমার যায় আসে-না স্যার। কিন্তু একটা মেয়ে যত ছোটই হোক, পুরুষের দুর্বলতা সে ঠিকই বোঝে। আমি নিশ্চিত, আপনি সেই কাপুরুষ নন, যে অন্যের ওপর জোর করে।

কথার কাঠিন্য পাল্টাতে আমি স্যারকে একটা ছবি দেখালাম।

স্যার, প্লিজ ভালো করে দেখবেন? এই ছেলে কি কখনো এসেছিল আপনার কাছে? অথবা একে কি আপনি কখনো দেখেছেন ম্যাডামের সাথে?

সি.আই.ডি! ক্রাইম-পেট্রল! হিন্দি সিরিয়াল দেখছ?

স্যার প্লিজ, ইট্স সিরিয়াস। নট জোক্। অ্যান্ড আই থিংক, হি ইজ ওয়ান অব দ্যা প্ল্যান-মেকার।

এসব কী নিতু? বিপদে একজন মানুষ, অন্য একজন মানুষের সাথে থাকতেই পারে। সো হোয়াট! তাই বলে কি সেই দোষী? বিপদে অর্জুনের রথের সারথি কৃষ্ণ, যুদ্ধক্ষেত্রে যা বলেছেন, তাকে গীতা বলা হয়। শ্রীমৎ ভগবদ গীতা। পরম শ্রদ্ধেয় ধর্মগ্রন্থ। ইট ইজ নট আ ওয়ার প্ল্যানিং এভিডেন্স।

স্যার, সবাই কৃষ্ণ নয়। তাছাড়া বিপদে থাকা, আর বিপদ তৈরি করা! বিষয় দু’টো কি এক! প্লিজ কনফার্ম দ্যা পিকচার। আমি জানি, আপনার স্মরণশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। বিশ বছরের পুরনো ছাত্রী অবধি এক দেখায় নামসহ চিনে ফেলেন।

স্যার এতক্ষণে ছবিটার দিকে তাকালেন।

হুঁ! আমি একে দেখেছি। স্কুলে। স্কুলে এসেছিল একদিন। তোমাদের ভিপি মিসের সাথে কথা বলছিল। সম্ভবত ওনার রিলেটিভ হবে কেউ।

আমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

ঘটনা তাহলে এই! যা অনুমান করেছি, তাহলে সেদিকেই যাচ্ছে সব। হি ইজ দা মাস্টার-মাইন্ড।

স্যার আমার অবস্থা দেখে সান্ত্বনাবাণীর মতো বলতে লাগলেন।

শোন নিতু, আবার বলছি। প্লিজ, বড়দের এসব ঝামেলায় খামোখা নিজেকে জড়িও-না। লেখাপড়ায় মন দাও। তাছাড়া এই সমস্যা একদিন ঠিকই মিটে যাবে। যেটুকু আমার দোষ, তার জন্য শাস্তি আমাকে পেতেই হবে। এভরি ক্রাইম হ্যাঁজ অ্যান ওউন পানিশমেন্ট। তোমরা শুধু আমার জন্য দোয়া কর। এবং আমি জানি, তোমাদের মতো পুণ্যবানদের দোয়া সৃষ্টিকর্তা কখনো ফেরান-না।

স্যারের শেষ কথাগুলো আমার কানে বিউগলের মতো বেজে উঠল। নিজেকে এত অসহায় লাগল যে, মনে হল নিজের হাত-পা নিজেই কামড়ে ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলি। তারপর চিৎকার করে বলি।

স্যার, আমি পুণ্যবান নই। আমি পাপী। মহাপাপী। আমার পাপের শাস্তি আপনি নেবেন কেন? প্রয়োজনে আমি জেলে যাব। আমি রিমান্ড নেব। আমি সব দোষ মাথা পেতে নেব। তবু আপনাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট পেতে দেব না। দরকার হলে যিশুর ভক্ত পতিতালয়ের ম্যাগডেলেনা মারিয়া’র মতো চোখের জলে পা ধুইয়ে দেয়ার বদলে, আমার শরীরের প্রতিটি রক্ত-কণিকা দিয়ে, আপনার সকল অপবাদকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দেব। এবং এরপর আর কোনোদিন কোনো দাবি নিয়ে আপনার সামনে দাঁড়াব-না। আপনার অফিসে ঢুকব-না। গভীর রাতে ফোন করে বিরক্ত করব-না। দেবেন-না সে সুযোগটুকু?

.

তাসলি আপু সম্ভবত আমার অবস্থা বুঝতে পারছে। তাই হাল্‌কা করে ধাক্কা দিল।

নিতু, ঘড়ির দিকে তাকা। তিনটা চল্লিশ। আংকেল আসার আগেই আমাদের ফিরতে হবে।

স্যার মাথা উঁচিয়ে আরো একবার আমার দিকে চোখে-চোখ রাখলেন। তারপর হাল্কা স্বরে বললেন।

বাই দা ওয়ে, তোমার দ্বিতীয় প্রমাণ কি এই বাচ্চা ছেলেটা? আই মিন, তোমাদের ফিল্মের সুপার হিরো!

আমার কণ্ঠস্বর ততক্ষণে রুদ্ধ হয়ে গেছে।

আমি গভীর বেদনার চোখ নিয়ে শেষবারের মতো স্যারের চোখের দিকে তাকালাম। বললাম-

‘দুঃখ যদি না পাবে ত, দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে,
বিষকে বিষে দাহ দিয়ে, দহণ করে মরতে হবে।
দর্দ তো হোতা হ্যায়, দর্দকে দিনহি প্যারে হ্যায়
জৈসে তেজ ছুরিকো হামনে রহ রহ কর ফির ধার কিয়া।‘

তবে দু’টো কবিতাই মনে মনে।

আর মুখে শুধু এইটুকু বলতে পারলাম, স্যার আসি।

যাবার বেলায় পা-ছুঁয়ে সালাম করতে গেলে স্যার বললেন।

এ কী, এ কী! আশেপাশের লোকজন আমাকে মহামানব বাকের ভাই মনে করবে যে!

আমি বললাম, বটবৃক্ষকে তো মহীরুহ নামেই ডাকা উচিত। লতাগুল্ম নামে নয়, তাই-না?

তবে একথাটাও বললাম মনে মনে।

মুখে শুধু ফোঁটালাম একটা শুকনো হাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *