নিতু বলছি – ২

শোনো তাহলে, যা বলছিলাম। ‘এ-ভি’ অর্থাৎ অডিও ভিজুয়্যাল প্রোডাকশনের প্রথম শব্দই হল কাট্। কাট্ ফর অ্যাকশন, কাট্ ফর রি- অ্যাকশন, কাট্ ফর মোটিভেশন-পপুলারাইজেশন-কম্প্রেশন, অ্যান্ড কাট্ ফর কনটিনিউটি। ফিল্ম লাইনে আসতে হলে প্রথমে যা শিখতে হবে, তা হল কাট্ করা।

আমি মনে মনে বললাম।

কাট্। কাট্ ফর ক্লোজড্। কাট্ ফর ক্লোজ ইয়োর ভ্যাজর ভ্যাজর।

আমরা বসে আছি বিশিষ্ট প্রযোজক, পরিচালক ও নাট্যকার জনাব ফাহাদ বিন ফারুকের নিজস্ব স্টুডিওতে। আরো কাট্ করে বলতে হলে, খাস কামরায়।

রাফিয়া বারবার উস্ করছে। নিজের জন্য নয়। আমার জন্য। কারণ ঘড়িতে এখন বারোটা পঞ্চান্ন। যথারীতি আমার হাল তেরোটা। সময়ের হিসাবে বাসায় ফেরার বাকি আছে আর মাত্র চার মিনিট।

আমরা এসেছি সকাল নয়টা চল্লিশে। ভদ্রলোক নিজে আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন। ‘দশটা থেকে দশটা ত্রিশ, রাইট টাইম, নো লেইট।’ অথচ তিনি স্টুডিওতে এসে পৌঁছেছেন এগারোটা পঁয়তাল্লিশে। এসেই ঢুকেছেন এডিটিং রুমে। সেখানে আধা ঘণ্টা।

এর মধ্যে ভদ্রলোকের মোবাইলে কল দিতে দিতে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করে ফেলেছে রাফিয়া। সেটাও আমার জন্য। কারণ দুপুর একটা আমার লাস্ট টাইম। অর্থাৎ জুম্মা’র নামাজের আগেই বাসায় ফিরতে হবে।

এমনিতেই বদনা স্যারের প্রাইভেট ফাঁকি দিয়ে এখানে এসেছি। অনেককে ম্যানেজ করে। অনেক গোপনে। কাউকে না-জানিয়ে। শুধু মা’কে বলা হয়েছে, একটু দেরি হবে। স্যার ইম্পর্টেন্ট নোট দেবেন আজ। অথচ এখানে ডিরেক্টর সাহেবের ইম্পর্টেন্ট সময় থেকে আমাদের জন্য সময় বরাদ্দ শুরু হয়েছে দুপুর বারোটা বত্রিশে। তার একান্ত ব্যক্তিগত খাস-কামরায়।

দীর্ঘ দু’ঘণ্টা বত্রিশ মিনিট বসিয়ে রাখা! নিজে ডেকে এনে স্ব-কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়া! অথবা মোবাইলে মিস্ড কলের বন্যা বইয়ে দেয়া! এতকিছুর পরও একবারের জন্য স্যরি কিংবা অন্য কোনো অ্যাপোলজি ওয়ার্ড ব্যবহার করেননি তিনি। সম্ভবত মিডিয়া লাইনে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এই লাইনে প্রডিউসার-ডিরেক্টরদের দেবতা সমতুল্য সম্মান দেয়া হয়। সুতরাং দেবতার দর্শনে বিলম্ব, ভক্তের সাধনা সিদ্ধিরই অংশবিশেষ। অন্যথায় অভিশাপ দিলেই জীবন ধূলিসাৎ ধ্বংস।

.

স্বীয় কামরায় প্রবেশ করে, অঙ্গুলি হেলনের ইশারায় আমাদের বসতে বলে, প্রথম যে কৃতার্থ বাক্যটি ডিরেক্টর সাহেব ব্যবহার করেছেন, তা হল– আউট অফ ইউ, হু ইজ রাফিয়া?

রাফিয়া শ্রেণিকক্ষে অনুগত ছাত্রীর মতো এক হাত উপরে তুলেছে।

তিনি আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে দৃষ্টি নিবন্ধন করেছেন রাফিয়া বরাবর। ফিল্ম লাইনের ভাষায় সম্ভবত এর নাম জাম্পকাট অ্যান্ড জুম টু রাফিয়া। অর্থাৎ ‘কাট্ ফর মোটিভেশন’।

তুমি সোবহান সাহেবের মেয়ে?

অন্য কেউ হলে রাফিয়া নিশ্চয়ই এতক্ষণে বলে বসত তার নিজস্ব ভঙ্গিমায়।

কেন, সন্দেহ আছে? বার্থ সার্টিফিকেট লাগবে?

কিন্তু আজ যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে সে। সেই শুরু থেকেই।

ঠাণ্ডা মাথায় একমগ তিতা ব্ল্যাক-কফি গিলেছে। দু’টো ড্যাম বিস্কিট সাথে হজম করেছে ফিল্ম, ইয়াং জেনারেশন, প্রি-প্রোডাকশন প্রিপারেশন, বাজেট ইত্যাদি নিয়ে ভ্যাজর ভ্যাজর বক্তব্য। তা-ও আবার হাসিমুখে!

কিন্তু এই মুহূর্তে কেন যেন একটু উত্তেজিত মনে হচ্ছে ওকে। ডিরেক্টর সাহেবের কাট্ লেকচারের পরপরই আবারও এক হাত উপরে তুলল রাফিয়া।

ভদ্রলোকও যথারীতি অভিজ্ঞ শিক্ষকের মতো ইশারায় হাত নামাতে বললেন ওকে।

নিজের মনমতো কথা বলতে বলতে সাইড ড্রয়ার থেকে বের করলেন ইয়াব্বড় সাইজের একটা বই। এরপর আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন সেটা। এবং বলতে লাগলেন আগের ভঙ্গিমায়।

বইটা পড়বে। দু’জনেই। মন দিয়ে। ইট ইজ কল্ড দ্যা বাইবেল অফ ফিল্ম মেকিং। এর পর যত বই লেখা হয়েছে, সব হল এটার কপি- পেস্ট।

রাফিয়া কিছু একটা বলবার জন্য মুখ হা করতে যাচ্ছিল। আগের মতোই ভদ্রলোক ওর উত্তেজনাকর ভঙ্গিকে আবারও উপেক্ষার জন্য বলতে লাগলেন।

ইয়েস্ ইয়াং গাইজ, তোমাদের কাজ এর পর থেকে শুরু। আমার ধানমন্ডির টিচিং সেন্টারটায় আগামী তিনমাস রেগুলার এস। শর্টকোর্সটা করিয়ে দেব।

রাফিয়া অবশেষে মুখ খুলল। তবে অবাক ব্যাপার হল একদম শান্ত ভঙ্গিমায়।

না, মানে, আমাদের একটু তাড়া ছিল। কোর্সের বিষয়গুলো একটু দ্রুততম সময়ের মধ্যে জানলে আমাদের ভালো হত। আই মিন, থ্রি মানস ইজ সো লং। সময়টা দ্রুত করা যায় কি?

ভদ্রলোক এ দফায় হো হো করে হেসে উঠলেন 1

ইটস্ দ্যা প্রবলেম ফর ইয়াং পিপলস্। সবকিছুতেই দ্রুততা। দ্রুত নাটকে চান্স পেতে চাই। দ্রুত নায়িকা হতে চাই। দ্রুত জনপ্রিয়তা চাই। আরে বাবা, সব কি ইন্টারনেট! চাইলেই স্পিড বাড়াও।

না, মানে। ক্যামেরা, মনিটর, থার্মোকল, সানগান, সবকিছু আমাদের কেনা শেষ প্রায়। মোটামুটি একটা র’ স্টুডিও-সেট আপও দিয়ে ফেলেছি আমরা। আসলে আমরা একটা কম্পিটিশনে ফিল্ম জমা দেব তো!

বলেই ফেঁসে গেল রাফিয়া। অনেকটা মায়ের কাছে মাসির গল্পের মতো অবস্থা।

আমি মনে মনে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। এখন যদি ভদ্রলোক জানতে চান, কী কম্পিটিশন? কী টাইপ ফিল্ম? কোথায় জমা? কার কাছে? তাহলে কী বলব! উনি তো আর এই লাইনে অবুঝ না। এটা ওনারই জগৎ। কতক্ষণ মিথ্যে বলা যাবে! তাছাড়া সবাই তো আর রেজা স্যার নন। মিথ্যে কথা ধরে ফেললেও, হাসিমুখে না-বোঝার ভান করবেন। মাফ করে দেবেন।

কালকের ঘটনার কথাই ধরা যাক।

উহ্! কী এক জানে বাঁচা বেঁচেছি দু’জন।

.

ঘটনাটা শুরু থেকে বলা যাক।

আমার মতো রাফিয়ার মনেও ভয়ঙ্কর একটা ইচ্ছে ছিলো। রেজা স্যারকে চমক দেবার। ডামি চমক। অনেকটা ট্রায়াল অ্যান্ড ইরোর মেথড। স্যারের চারিত্রিক ট্রায়াল।

বুদ্ধিমান পাঠকরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বাকিটা বুঝতে পারছেন। অর্থাৎ ডামি-টা কিসের! হুঁ। ঠিক ধরেছেন। আমাদের ফিল্মের ডামি শ্যুট। এ বিষয়ে রাফিয়া আমার সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেছিল। যথারীতি আমিও রাজি

আমার রাজি হবার কারণ তিনটা।

প্রথমটা একান্ত ব্যক্তিগত। বলব-না। পরে বলতে পারি।

দ্বিতীয়টি বায়োলজিক্যাল। অর্থাৎ সিমবায়োসিস। একজন আরেকজনকে সাহায্য করা। কারণ রাফিয়া আমার ফিল্মের কো-আর্টিস্ট, কো-প্রডিউসার এবং ডাইরেক্টর। অর্থাৎ পুরো ফান্ড সে-ই জোগাড় করবে।

ওর প্রস্তাবে রাজি হবার সর্বশেষ কারণটি হল অভিনয়-প্রতিভা প্রদর্শন। জ্ঞানের ডিব্বাকে, মিস্টার পিসকে আমি আমার অভিনয়-প্রতিভা দেখাতে চাই। যা দেখে ডিব্বা, সরাসরি ড্যাম্ব ব্লাস্ট হয়ে যায়। মানে ফুস্।

এই যা! একটা গোপন কথা ফাঁস করে ফেলেছি।

প্রত্যেকটা টিচারকে আমরা নিজেদের মধ্যে আমাদের দেয়া গোপন নামে ডাকি। ক্লাসের বাইরে। এমনকি ক্লাসের ভেতরেও। যেমন বদনা স্যার, শাক-চুন্নি মিস্, ওড়না স্যার, কালাপেত্নী মিস্, টু-কেজি মিস্। এসব প্রত্যেক নামের একটা বিচ্ছিরি ব্যাখ্যা আছে। যা আমরা কেউ মুখে বলতে পারব না। শুধু ‘কি-ওয়ার্ড’ বললেই বাকিরা বুঝে নেবে। হাসতে থাকবে। যেমন টু- কেজি মিসের অর্থ হল তার বড় বড়…।

ধুত্তুরি! আবারও গোপন কথা বলে ফেলতে ধরেছিলাম।

তবে সবসময় কিন্তু আমরা আজে-বাজে নামে স্যার-মিসদের ডাকি না। পড়া না-বুঝলে কিংবা বেশি বেশি হোমওয়ার্ক দিলে এইসব নাম বলি।

যাক্। বলেই যেহেতু ফেলেছি, এখন থেকে পিসু বলেই বলব।

এখন আসল কথায় ফিরে আসি। পিসুর শিক্ষা। মানে, ডামি চমক।

তবে মনে রাখতে হবে, তাকে চমক দেবার কাজটা ডালিমকুমারের পাতালপুরীতে প্রবেশের চেয়েও কম কঠিন নয় কিন্তু। কারণ আমাদের অফিসের সব কয়টা সুন্দরী মিস্ পিসু বাবুকে ঘিরে রাখে সর্বক্ষণ। এটা-সেটা বিষয়ে মিটিং-সিটিং চলতেই থাকে ওনার রুমে। তার ওপর শাক-চুন্নি আর কালাপেত্নী দুইজন তো আছেই। এরা হল স্যারের বডিগার্ড। আমাদের এডমিন আর ভাইস প্রিন্সিপাল মিস। এই নামদুটোও অবশ্য রাফিয়ার দেয়া। কিন্তু বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ওনাদের আসল নামে এখন আর কেউ চেনে-না স্কুলে।

রেজা স্যারের অন্দরমহলে অর্থাৎ খাস কামরায় ছাত্রীদের যেতে হলে অফিসিয়াল পারমিশন লাগে দুইটা। প্রথমটা অ্যাকিউট রিজন পেপার। আর দ্বিতীয়টা হল অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্লিপ। তার ওপর আবার সিসি ক্যামেরা পার হতে হয় তিন-তিনটা। প্রতি পদে পদে রাক্ষস, খোক্ষস আর ডাইনি বুড়ির যাদুমন্ত্র ঘেরা দুর্গম অরণ্য।

সো হোয়াট! হু কেয়ারস্! তাই বলে আমরাও থেমে ছিলাম না পরিকল্পনায়। শিল্পী মানেই আত্মাহুতি। হেমিংওয়ে, গিলেপি, ভ্যানগগ, ক্রিস্টোফার-উড জীবন পর্যন্ত দিয়েছিলেন। আর আমরা তো নগণ্য নিতু রাফিয়া। জ্ঞানী পিসকে জ্ঞানভাণ্ডার দেখাকেই দেখাব।

.

রাফিয়ার তথ্য অনুসারে চমক দেখানোর কাজটা করার কথা ছিল যে কোনো বৃহস্পতিবার।

বৃহস্পতিবার না-কি ওর জন্য লাকি ডে। ওর জন্ম ওইদিনে। ও না- কি কোন হরস্কোপে দেখছে, বার্থডে ইজ দ্যা লাকি ডে ফর এভরিওয়ান। আমার ধারণা কথাটা মিথ্যে। কারণ রাফিয়া আর মিথ্যা, একে অন্যের পরিপূরক।

তারপরও আমি বৃহস্পতিবারকে সঠিক দিন মানতে রাজি। কারণ ওই দিন অফিসে শাকচুন্নি থাকে-না। অর্থাৎ অ্যাডমিনে একজন মিস কম থাকেন। ব্যাংকিং ও আউটার ওয়ার্ক করেন। আর আমাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, স্যারের অতিপ্রিয় বডিগার্ড, জনাবা কালাপেত্নী মুখখানা অতিশয় কালীরূপ ধারণ করে খড়গ হাতে একাই সামলান একাডেমি।

ঘটনার সময় অবশ্য ইলেকট্রিসিটি থাকা যাবে না। এতে বহুবিধ সুবিধা। একদিকে জেনারেটর চলবে। এবং মৃদু শব্দ থাকবে পুরো একাডেমি জুড়ে। অন্যদিকে বডিগার্ড কালাপেত্নী, ক্লাস তদারকিতে ব্যস্ত থাকবেন। কারণ কোনো সিসি ক্যামেরা অ্যাডাপটার লাইন পাবে না। তার ওপর সবচেয়ে বিগ অ্যাডভান্টেজ হল, এসি বন্ধ থাকবে। এসি বন্ধ থাকলে পিসুর মাথা অটোমেটিক হ্যাং করে। স্যার এমনিতেই ঘামতে থাকেন। সে অবস্থায় এমন দৃশ্যে তার হাল কী হবে, কে জানে!

ডামি শটে রাফিয়া কী কী করবে, তার পুরো ট্রায়াল দেয়া হয়েছিল।

একবার না। তিন তিন বার। জামা পড়ে। জামা খুলে। অর্ধনগ্ন বুকে টেবিলে ঝুঁকে। মোবাইলের ক্যামেরায় রেকর্ডও করা ছিল সেসব। নিজের ডায়ালগ, নিজের অ্যাকটিং এবং সময়মতো এডিটিং সব একে একে চেক করেছিল রাফিয়া। সো, সি ওয়াজ পারফেক্ট রেডি।

আমি অবশ্য আমার অংশটা ট্রায়াল দেইনি সেভাবে। শুধু ডায়ালগগুলো প্র্যাকটিস করেছিলাম। তা-ও ক্যামেরায় না। একা একা। বাথরুমে। আয়নার সামনে। কারণ আমি জানি, আই হ্যাভ মাই কনফিডেন্স ওনার সামনে বুক কেন, সর্বস্ব শরীর খুলে দাঁড়াতেও আমার বিন্দুমাত্র হাত- পা কাঁপবে না। কোনো ডায়ালগ এদিক-ওদিক হবে না। শুধু, শুধু যদি উনি একবার…

না থাক। সে কথা এখন বলব না। কারণ বড়দের সব কথা যেমন ছোটদের শুনতে নেই। ছোটদের সব ইচ্ছেও তেমন বড়দের জানতে নেই। এতে বড়দের কষ্ট বাড়ে।

আচ্ছা, বড়রা কেন ভাবে, ছোটরা জীবন নিয়ে কিছুই বোঝে না! তাদের কষ্ট শুধু ঘুম, খাওয়া আর লেখাপড়াতেই সীমাবদ্ধ! স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসার মতো জটিল কষ্টে কি তারাও নিত্যদিন কষ্ট পায় না?

.

এবার মূল ঘটনায় আসি।

গতকাল ছিল বৃহস্পতিবার।

রাফিয়ার ভাগ্য গণনায় লাকি-ডে। লাকও ফেভার করেছিল দুপুর বারোটা নাগাদ। যেই ফোর্থ পিরিয়ড বেল পড়ল, অমনি বিদ্যুৎ চলে গেল। যথারীতি সবাই ব্যস্ত ক্লাস সামলাতে আর স্টুডেন্ট ম্যানেজমেন্টে। এই ফাঁকে আমি আর রাফিয়া ঢুকে পড়লাম প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে।

শুরুতেই মোবাইল অন করে রাখার কথা ছিল রাফিয়ার। কিন্তু টেনশনে ভুলে গেছে সে।

যাই হোক, স্যার তখন ক্লাস শেষে কেবল নিজের রুমে ফিরেছেন মাত্র। বিদ্যুৎ না থাকায় হাল্‌কা হাল্‌কা ঘামছেন।

শুরুটা করলাম আমি।

স্যার, রাফিয়া আপনাকে একটা ইম্‌পর্টেন্ট ম্যাথ দেখাতে চায়।

রাফিয়ার একহাতে ম্যাথস্ কপি। অন্যহাতে গোপন মোবাইল ফোন। সে মোটামুটি রোবট স্টাইলে দাঁড়ানো।

মূল স্ক্রিপ্টে এই জায়গায় রাফিয়া এগিয়ে যাবে স্যারের টেবিলের বাঁ- পাশে। ঠিক চেয়ারে বসবার এন্ট্রি কর্নার বরাবর। এবং যথারীতি একটু ঝুঁকে পড়বে টেবিলের উপর।

কেন ঝুঁকবে, নিশ্চয়ই বুঝতে পারা যাচ্ছে!

হুক আগেই খোলা আছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যা অনুসারে। সুতরাং উদ্দেশ্য অনুযায়ী আমাদের পিস স্যারের চোখ জায়গামতো পড়তে হবেই হবে।

বাস্তবে ঘটনাটা ঘটল উল্টোভাবে।

আমাদের রোবট অভিনেত্রী ‘ফ্রিদা’ সিনেমার সালমা হায়েকের মতো কাঁপা কাঁপা হাতে টেবিলের উপর খাতাটা রাখল। এরপর একহাতে ভর দিয়ে, সামনের বদলে, ভয়ে কুঁচকে ঝুঁকে পড়ল পেছনে। মোটামুটি যায় যায় অবস্থা। দেখে মনে হবে পেছন থেকে কেউ বুঝি বাঁশের খুঁটি দিয়ে হেলান দিয়ে রেখেছে টেবিলে আটকে রাখার জন্য।

স্যার, সেদিকে না-তাকিয়ে চায়ের মগে চুমুক দিয়ে বললেন, ক্লাসে দেখিও। রবিবারেই তো ম্যাথস ক্লাস আমার।

আমি দুঃসাহসী অড্রে হেপবার্নের মতো আগ বাড়িয়ে বলতে লাগলাম।

স্যার, এটা আসলে গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য। তাই ক্লাসে যদি ডিসটার্ব হয়…

বলেই সেই ‘রোমান হলিডে’ সিনেমার বিখ্যাত অবুঝ হাসিখানা সারা চোখে-মুখে ছড়ালাম।

ম্যানুস্ক্রিপ্টের বর্ণনায় ক্যামেরা এবারে রাফিয়ার দিকে মুভ করবে।

তাই পাক্কা অভিনেত্রীর মতো, আমি চোখ দিলাম খাতা থেকে ওর মুখ বরাবর। যেন স্যারও ‘অডিয়েন্স লুক’ দেন সেই দিকে। জায়গামতো।

.

ও মাই গড! রাফিয়া কাঁপছে। রীতিমতো থর থর করে। ওর যে মৃগীরোগ আছে, এটা আমি প্রথম আবিস্কার করলাম।

স্যার কোনোকিছু খেয়াল না-করেই বলতে লাগলেন।

ঠিক আছে, নিয়েই যেহেতু এসেছ, দাও দেখি ম্যাথটা।

স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী এখন ওর ভিন্ন একটা পৃষ্ঠা ভুল করে বার করবার কথা। যেখানে লেখা থাকবে, ‘ফিল্ম: লাভ ইউ ওল্ড জিপসি ম্যান। প্ল্যানিং ওয়ান। শুভ মহরত অনুষ্ঠান। ইনঅগুরেশন করবেন, বিখ্যাত জ্ঞানতাপস জনাব রেজাউর রহমান, পি.এইচ.ডি, এডওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি, ইউ.এস.এ। ডিরেক্টেড বাই মাসুমা নিতু। প্রডিউসড অ্যান্ড প্রেজেন্টেড বাই আর.এন ফিল্মস্।

স্যার খাতা বরাবর দৃষ্টি দিতেই, আমি সর্বশেষ চোখের ইঙ্গিত দিলাম।

রাফিয়া প্লিজ, সুইচ অন দ্যা ক্যামেরা। নাউ। অ্যাটলি-ই-স্ট!

.

একহাতে মোবাইলের ক্যামেরা অন করতে গিয়েই ঘটল বিপর্যয়

ঠাস্ করে হাত থেকে পড়ে গেল ক্যামেরাটা। খাতাটাও কাঁপতে কাঁপতে নিচে। যথারীতি রাফিয়ার অবস্থা মাথা-চক্কর।

তা-ও যদি বুদ্ধি করে স্যারের উপর পড়ত! মানা যেত। বুঝতাম শেষরক্ষা হয়েছে। কারণ, আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সর্বশেষ দৃশ্যে স্যারকে জড়িয়ে ধরে রাফিয়ার বলার কথা, ‘থ্যাংক ইউ স্যার। থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ। আপনি আসবেন, এটা আমরা জানতাম। আপনাকে ছাড়া এটা অসম্ভব স্যার’।

সেই চিরায়ত ফিল্মি অবস্থায় লুইচ্চা পিসু রাফিয়ার চিকা চিকানিতে কেমন করে, সেটা দেখাই হল আমাদের উদ্দেশ্য।

কিন্তু হায়! সালমা হায়েক আমাদের!

মোবাইল, খাতা, মানুষ, তিনসহ ধপাস্। ভাগ্যিস স্যার উঠে দ্রুত এসে ওকে ধরলেন। সামনের চেয়ারে বসালেন। নিজের জন্য রাখা পানির বোতল থেকে একগ্লাস পানি স্ব-হস্তে ঢেলে খাওয়ালেন। এবং সবশেষে খুব মোলায়েম ভঙ্গিতে সমবেদনা জানালেন।

অ্যানি প্রবলেম! তোমার কি খুব খারাপ লাগছে রাফিয়া? আর ইউ টায়ার্ড?

রাফিয়া আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল।

আমার তখন ‘ভিক্ষে চাই-না মা, কুত্তা সামলাও’ অবস্থা।

তারপরও অসীম সাহস নিয়ে আমি সমাপনী ডায়ালগ দিলাম।

স্যরি স্যার। আমরা অন্য একদিন আসব।

স্যার ফিক্ করে হেসে ফেললেন।

অন্যদিন কেন! বস। আজকেই আলোচনা হোক। এমনিতেই ইলেকট্রিসিটি নেই। তার ওপর আমার মনটাও যেন কেমন অস্থির অস্থির লাগছে আজ। ক্লাস নিতে ইচ্ছে করছে-না। বরঞ্চ তোমাদের ফিল্ম নিয়েই কথা বলি কিছুক্ষণ।

রাফিয়া হঠাৎ জ্ঞান ফেরা রোগীর মতো চোখ বড় বড় করে সোজা হয়ে বসল। ছবির দৃশ্যে নায়িকারা সাধারণত যে জায়গায় বলে বসে, ‘আমি কোথায়? আমি এখানে কীভাবে এলাম!’

স্যার ওর দিকে তাকিয়ে হাল্কা হাসি দিলেন।

কী, একটু সুস্থ লাগছে এখন? সুমির মা’কে (আমাদের আয়া) ডাক দেব? রেস্টরুমে নিয়ে যাবে?

রাফিয়া নির্বাক।

স্যার নিজেই বলতে লাগলেন আবারও।

আমার মনে হয়, এখানেই বসে কিছুক্ষণ গল্প কর। ভালো লাগবে। তাই-না নিতু?

আমি মাথা ঝাঁকালাম। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না, এমন একটা ভাব।

একক বক্তা হিসেবে মঞ্চনাটকের সূত্রধরের মতো স্যার বলতে লাগলেন ব্যাকস্টেজ থেকে।

বাই দ্যা ওয়ে, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বাধিক বিতর্কিত ছবির নাম কি তোমরা শুনেছ?

আমি আবারও মাথা ঝাঁকালাম। তবে এবার একদিকে নয়। দু’দিকে। যার স্পষ্ট অর্থ হচ্ছে, ‘না’।

স্যার জ্ঞানের ডিব্বা খুললেন।

‘দ্যা বার্থ অব আ নেশন’। আমেরিকান ছবি। উনিশ শত পনের সালের। এর পরিচালনা, প্রযোজনা, চিত্রনাট্য এমনকি সংগীত পর্যন্ত একজনের হাতেই করা। ভদ্রলোকের নাম, ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ। মজার ঘটনা হল, ছবি তৈরির সময় কোনো কিছুই ছিল না তার। না কোনো স্ক্রিপ্ট, না কোনো নোট, এমনকি চিত্রনাট্যও লিখিত ছিল-না তার। শুধু মনে মনে গল্পটা বেঁধেছিল গ্রিফিথ। আধুনিক চলচ্চিত্রে যে প্যাট্‌নারোমিক শট, হাই-এক্সেল শট, নাইট ভিউ, এক্সটার্নাল শট দেখানো হয়, সেই একশ বছর আগে তিনি উইদাউট প্লানিং এতসব সাকসেসফুল্লি এবং ইফিসিয়েন্টলি তুলে ধরেন একা একাই। তোমরা আবার ভেব-না যে, এটি একটি অ-জনপ্রিয় আমাদের ‘ভাবমার্কা আর্টফিল্ম’ স্টাইলের ছবি। বরঞ্চ সেই সময়েই কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করেছে এই দি ক্লাম্যান সিনেমাটি। আই মিন, ছবিটির মহরত-রেকর্ডিং-ফার্স্টশো, সবকিছুতে এটাই ছিল প্রথম নাম। পরে বিতর্কে জড়িয়ে নামটিও বদলান হয়। ও হ্যাঁ, তোমাদের ছবির শুভ মহরত করবে কবে?

আমি আর রাফিয়া এই প্রথম বাস্তব জগতে ফিরে আসলাম।

রাফিয়ার চোখ এখনও ছানাবড়া, স্যরি দুধবড়া হয়ে আছে। কারণ আমার মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণেই মধ্যেই ও কান্না শুরু করবে। ‘লিকুইড মিল্ক ফ্রম আইস’।

শোন, পৃথিবীর সবচেয়ে কমবয়সী প্রডিউসার কে জান?…

বলতে বলতেই স্যার যেন আনমনে কোথায় হারিয়ে গেলেন। একটু থেমে গলার স্বর পাল্টিয়ে ফেললেন।

থাক্ ভাল্লাগছে-না আজ আর। তোমরা বরং অন্যদিন এস। ফিল্ম আসলে আমারও ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট ছিল। কিন্তু আমাদের সময় বাবা- মা’রা এসবকে লেখাপড়া হিসেবে দেখতেন না। অ্যানিওয়ে, হয়তো তারাই ঠিক। নতুবা এখনও এসবের নামে এত নোংরামি আর নষ্টামি ছড়াচ্ছে কেন? হাজার হাজার, স্যরি, লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েরা শুধু এই নামেই ধ্বংস করছে নিজেকে। স্বভাব-চরিত্র, ধন-সম্পত্তি, জীবনের মূল্যবান সকল কিছু। তোমরা তোমাদের ফিল্মের মহরতে একজন বিখ্যাত প্রডিউসারকে দাওয়াত দিয়ো। যার জন্য যে কাজ। হুজুরকে দিয়ে গীতাপাঠ করালে, তা তো আর শুদ্ধ হবে না! কী বল রাফিয়া?

স্যার হাসতে থাকলেন। তার সেই বিখ্যাত রমণীমোহন হাসি। যে হাসির দৃশ্য দেখে আমি কেন, বিশ্বের যেকোনো কিশোরী, রাধার মতো মণ্ডা- মিঠাইয়ের হাঁড়ি ফেলে দৌড়ে যেয়ে ঝাঁপ দেবে আগুনসম কৃষ্ণের বুকে।

আমার খুব ইচ্ছে করল, অন্তত একবার, একবারের জন্য হলেও স্যারকে বলি–

প্লিজ স্যার, প্লিজ, প্লিজ কন্টিনিউ। থামবেন না। আমি শুধু একবারের জন্য রাফিয়ার ক্যামেরাটা অন করি। শুধু একবার।

কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক বিশাল অসুবিধা। সব কথা সবখানে বলতে পারে না সে। মনের অধিকাংশ গোপন কথাই, মনের গহিনে গোপনে কবর দিতে হয় তাকে।

স্যারের রুম থেকে বের হতে হতে পুরো বিষয়টা পরিস্কার হয়ে গেল আমাদের কাছে। স্যার আমাদের সাথে বিদ্যা বালানের ‘কাহানি’, ‘কাহানি’ ফিল্ম খেলেছেন। আমরা যেমন কাহিনি বানিয়ে তার কাছে গিয়েছিলাম, তাকে ধরা খাওয়াতে। তিনিও তেমনি কাহিনি শুনিয়ে আমাদের ধোঁকা দিয়েছেন, বেকুব বানিয়ে

আসলে শুরু থেকেই তিনি বুঝে ফেলেছেন আমাদের মতলব। নতুবা রাফিয়ার আধা-অজ্ঞান হওয়া সত্ত্বেও বিচলিত না-হওয়া। অনুমতিবিহীন ছাত্রীদের অঙ্ক দেখানোতে রাজি হওয়া। এমনকি ছবির জগতের দীর্ঘ আলোচনায় আমাদের বসিয়ে রাখা। সবকিছুই তার পূর্বাপর পরিকল্পিত। তিনি শুরুতেই আমাদের মিথ্যে ধরে ফেলেছিলেন।

.

কিন্তু আজকের এই নতুন মিথ্যের পরিণতি কী?

আমার তীব্র ভয় হতে লাগল পুরো বিষয়টা নিয়ে। জনাব ফাহাদ বিন ফারুকও কি স্যারের মতো আমাদের ছেড়ে দেবেন? না-কি বিষয়টা রাফিয়ার বাবার কান পর্যন্ত গড়াবে! এবং আমাদের ফিল্ম! এখানেই ইতি। সিনেমা হলের মতো পর্দা পড়বে… স-মা-প্তি।

আমি মনে মনে মিথ্যা গোছাতে লাগলাম। ইউনেস্কো, ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডস, সোশ্যাল মিডিয়া—- এই নিয়ে যা যা পারি সব রিভাইজ দিতে লাগলাম। তবে শেষরক্ষা হল আবারও মোবাইলের মাধ্যমে। ভদ্রলোকের একটা মোবাইল ঝন্‌ঝন্ শব্দে বেজে উঠল। সম্ভবত এটা ইমার্জেন্সি নম্বর। কারণ, কল আসামাত্রই তিনি ফোন উঠিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন। এবং যখন ফিরে এলেন, তখন তার মুখ হাসি হাসি।

আমি শুধু শেষ বাক্যটি শুনতে পেরেছি। বললাম তো, অনলি ফিফটিন মিনিটস বেইবি।

বেইবি যে ছোট কেউ না, তার আনন্দের ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

রাফিয়া এই প্রথম তার স্বকীয় বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাল।

ফারুক ভাই, তাহলে আমরা শর্ট কোনো কোর্স করতে পারি না?

ভাই বলাতে অ্যান্টিবায়োটিক ডোজটা মনে হয় আরও সঠিক জায়গায় পৌঁছে গেল। মুখ থেকে হাসিটা পুরো দেহজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল জনাব ফারুক ভাইয়ের। উনি অত্যন্ত মোলায়েম ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন এবার।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি আমার অ্যাসিন্ট্যান্ট ডিরেক্টর ওমর রশীদকে বলে রাখব। সাত দিনের একটা ক্র্যাশ প্লান বানিয়ে দেবে।

রাফিয়া মোটামুটি ফর্মে ফিরে এসেছে এতক্ষণে। দ্বিতীয় ছয়টি মারবার জন্য ব্যাট হাতে এক স্টেপ এগিয়ে গেল এবার। পুরোপুরি ন্যাতানো শরীরে বলতে লাগল।

ভাইয়া, পর পর, আই মিন, কন্টিনিউ সাত দিন করা যায় না!

ফারুক সাহেব তড়িঘড়ি বলে ফেললেন।

যায়, তবে খরচ হয়তো একটু বেশি-ই পড়তে…

রাফিয়া কিছু বলতে যাবার আগেই উনি হাত তুললেন।

ইট্স ওকে। তোমার বাবা এ বিষয়ে সব বলেছেন।

রাফিয়া অবশ্য শেষমেষ খেলার শেষ ছক্কাটা মেরেই বসল।

আমাদের একটা লাস্ট রিকোয়েস্ট ভাইয়া। কোর্সটা কি ধানমন্ডির কোথাও করানো যায়। একটু সাইলেন্ট স্পেসে।

কেন, তোমার বাসা তো এদিকেই?

না, মানে আমার বান্ধবী অর্থাৎ নিতু ধানমন্ডিতে থাকে। পরপর সাতদিন সন্ধ্যায় ওর প্যারেন্টস বনানীতে আসতে না-ও দিতে পারে।

ডিরেক্টর ফাহাদ বিন ফারুক এই প্রথম আমার দিকে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। এরপর আবার টেবিলে চোখ ফেরালেন।

ঠিক আছে, তোমরা বললে দেখব।

না, না। ইউ হেভ টু ভাইয়া, প্লি-ই-জ। আপনি চাইলে সব সম্ভব। অন্তত নিতুর জন্য এটা আপনাকে করতেই হবে ভাইয়া।

ফারুক সাহেব হাসতে লাগলেন।

দেখি, লালমাটিয়ায় আমার একটা বাসা নেয়া আছে। তিনমাসের কন্টাক্ট। একটা মেগা সিরিয়ালের শুটিং স্পট। আমি অবশ্য ইদানিং প্রতিদিন একবার করে যাই। দেখি সেখানে কোনো অ্যারেঞ্জমেন্ট করা যায় কি-না তোমাদের জন্য।

কথা শেষ হতেই তিনি আবার আমার দিকে দৃষ্টি ঘোরালেন। তবে এবার ভিন্ন ভঙ্গিমায়। বিচ্ছিরি রকমের দৃষ্টি। যাকে বলে অ্যানিমেল প্ল্যানেট ভিউ। হরিণশিকারি ব্যাঘ্রের দৃষ্টি।

সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা।

বিরক্তিকর বক্তব্য।

বাড়ি ফেরার টান টান উত্তেজনা।

এত সবকিছুর বাইরে এই প্রথম নিজেকে সবচেয়ে অস্থির লাগতে লাগল আমার। মনের ভেতর এক ধরনের প্রাগৈতিহাসিক তীব্র হিংসা জাগতে লাগল। মনে হল, বলেই ফেলি, চলুন না, আজকেই হয়ে যাক প্রথম শিক্ষাদান। আই অ্যাম কোয়াইট আ বিট রেডি। আমাদের ফিল্মটা তো আপনার মতো জন্তুদের জন্যই তৈরি করা হচ্ছে, মিস্টার ফাহাদ বিন ফারুক!

.

ফেরার পথে পুরো রাস্তা প্রায় নির্বাক থাকলাম আমরা দু’জন।

শুধু বাসায় নামিয়ে দেবার আগে রাফিয়া একা একা বিড় বিড় করতে লাগল রাস্তার দিকে তাকিয়ে।

বল, কতগুলো আসিফকে শাস্তি দেব আমরা। দেশটা ভরে যাচ্ছে আসিফ দিয়ে।

আমি মৃদু হাসলাম। ‘ক্রাইম প্যাট্রল’ নামে আমার একটা পছন্দের সিরিয়াল আছে। সনি চ্যানেলে দেখায়। রাফিয়ার দিকে তাকিয়ে, সেখান থেকে হোস্ট আনুপ সোনি’র একটা বিখ্যাত ডায়ালগ বললাম।

‘খ্যায়াল রাক্ষিয়ে, সিখ্‌ এক-কো, সাবাক্ হাম সাবকো’। শোন্ রাফিয়া, একটা বিখ্যাত উক্তি জানিস বোধহয়। ইউ কান্ট ডেস্ট্রয় দ্যা চেইন অব করাপশন। বাট্ ইউ ক্যান কাট্ ইট টু মেক ইট স্মল।

রাফিয়া দীর্ঘ সময় পর আবারও স্বীয় ভঙ্গিমায় হেসে উঠল

উহ্! আবারো সেই কাট্!

আমিও হেসে ফেললাম।

ঠিক আছে। নো কাট্। বাট্ এভি প্রোডাকশনের জনপ্রিয় আর একটা ল্যাঙ্গুয়েজ বলি শোন্

কী?

কোয়াইট প্লিজ! অল ক্রুজ স্ট্যান্ড বাই! ফাইভ, ফোর, থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো…

মানে কী?

মানে হল, অল লাইট’স ওপেন… ক্যামেরা রোলিং… সাউন্ডস্ স্টার্ট… অ্যা-ক-শ-ন।

ইয়েস্। খেলা কেবল শুরু হচ্ছে। সবাই সাবধান।

বলেই দু’জন হেসে ফেললাম একসাথে।

.

সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য কখনো একা আসে না। সঙ্গী-সাথীসহ আসে। একের পর এক। কথাটা যে-ই বলুক। সত্য। এবং ধ্রুব সত্য। যথারীতি আজকেও সত্য বলে প্রমাণিত হল আরেকবার।

দুপুর দুইটায় বাসায় ফিরেও কোনো প্যাদানি খেলাম না আমি।

তাই সৌভাগ্যের এমন পৌনঃপুনিক সুযোগ হাতছাড়া করলাম না আর। লম্বা সময় লেখাপড়া করে টায়ার্ড, এমন একটা ভাব দেখিয়ে খেয়ে- দেয়ে চলে গেলাম সোজা বিছানায়। এবং শোয়ামাত্রই লম্বা ঘুম।

রাতের নির্ঘুমতা, দিনের ক্লান্তি, কাজের টেনশন– সব মিলিয়ে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ‘গোল্ডেন এ’ কোয়ালিটির ঘুম দিলাম একটা। যথারীতি স্বপ্নও দেখলাম ‘জিপিএ ফাইভ’ স্টাইলে।

আমি আর রেজা স্যার দু’জন মিলে একটা প্রাচীন আমলের দালানের বারান্দায়। হাঁটছি আর গল্প করছি। স্যার বললেন, তুমি যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছ আজ থেকে প্রায় দুইশত বছর আগে…। আমি ওনার মুখে হাত দিলাম। চুপ, আর একটা জ্ঞানের কথাও না। ডিব্বা ক্লোজড্। আপনি আরেফিন রুমির গানের নায়কও না, আমিও পড়শি না। সুতরাং গানের শুটিং বন্ধ। স্যার সত্যি সত্যি কথা বন্ধ করে, আমার দিকে এগিয়ে আসলেন! হাত ধরলেন। এরপর উনি যা করলেন…

এখন না। এখন এটা বলা যাবে না। বললে আমার সব রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে এক্ষুণি।

রাত আটটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত বিছানাতেই গড়াগড়ি গেল আমার। কিন্তু ঠিক বারোটায় যা ঘটল, তার জন্য নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি।

রাফিয়া, সায়েমা, সাজিয়া, যুঁথি, জান্নাত, ফাতিমা থেকে শুরু করে স্কুলের নাম জানা, না-জানা সব বান্ধবীরা ফোনে ফোনে অস্থির করতে লাগল আমাকে।

এমনকি প্যাটনা আসিফ পর্যন্ত রোমান্টিক ভঙ্গিতে শুভকামনা জানাল জীবনের আরেকটি নতুন বছরে পা দেবার জন্য। ফেইসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো, ভাইবার সবকিছু ভর্তি শুধু সেলিব্রেশন আর সেলিব্রেশন! হ্যাপি বার্থ- ডে টু নিতু, হ্যাপি বার্থ-ডে টু ইউ।

আমি শুধু অবাক না, রীতিমতো থমকে গেলাম! যখন দেখলাম, একটু পর বাবা নিজেই একটা আস্ত কেক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন আমার দরজার সামনে। এবং ঠিক তার পেছনে মা। হাতে একটা বিশাল ফুলের তোড়া।

আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। হাউ মাউ করে। কিছু বলতে পারলাম না।

শুধু বাবার সবসময় বলা একটা বক্তব্য মনে আসতে লাগল বার বার। ‘হাল্ জাঝা~উল্‌ ইহ্ ছা-নি ইল্লাল্ ইহ্ ছা-ন। ফাবিআইয়ি আ-লা-ই রাব্বিকুমা-তুকায্ যি বা-ন। The reward of goodness is nothing but goodness. Which, then, of the favours of your Lord will you twain deny?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *