নিতু বলছি – ১০

১০

কিছু অভ্যাস এবং কিছু ইচ্ছে, মনে হয় মানুষের মন থেকে কখনও মরে যায় না। লুকায়িত থাকে। সময় ও সুযোগ পেলেই জেগে ওঠে। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো।

ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত পৌনে চারটা। আমি মোবাইল অন করলাম। সিম নাম্বার, পাঁচ। সিম্বল, ‘ই’। সিগনাল পাওয়ামাত্রই ঠাস্ ঠাস্ করে ঢুকে পড়ল গোটা দশেক এস.এম.এস।

রেজা স্যার, তাসলি আপু, রাফিয়া, এমনকি কালাপেত্নী পর্যন্ত আছে এই রিসিভ লিস্টে। আমি অবাক হলাম! নাম্বারটা এতদিন শুধু একজনই জানত। দ্বিতীয় কাউকে দেয়া তো দূরের কথা, কল পর্যন্ত করা হয়নি এটা থেকে। তাহলে এতগুলো মানুষের কাছে পৌঁছাল কিভাবে!

সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হল, কেউ এর মূল-মালিক সানি লিওনি কে টেক্সট করেনি। সবাই যার কাছে করেছে, তার নাম–নিতু। এবং অনুরোধ যেটা করেছে, তা হল– ভুল সিদ্ধান্ত না-নেয়া। টেক্সটগুলো ঠিকমতো পড়বার আগেই মোবাইল বেজে উঠল ঝনঝন করে।

আমি যথারীতি বলে উঠলাম।

হ্যালো, সানি স্পিকিং। প্লিজ টেল্ ডেইট অ্যান্ড প্লেইস্।

ওপাশ থেকে একটা ভেজা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। অনেকটা বাচ্চাদের মতন।

দ্যাখো নিতু, জীবনটা ‘ফেইক আইডি’ না। এটা জনম-জনম সাধনার ফল। চুরাশি লক্ষবার ভিন্ন ভিন্ন রূপে জন্মগ্রহণ করে, তার পুণ্যস্বরূপ একটি মানব জনম উপহার দেয়া হয় জীবাত্মাকে। তাকে এভাবে নষ্ট…

উহ্! ওয়ান্স আগেইন। ডিস্পাটিং! হু ইজ নিতু হিয়ার? অ্যান্ড হোহাই আর ইউ ওয়েস্টিং মাই টাইম?

শোনো নিতু, আমি প্রথমদিন থেকেই জানি এটা তুমি। মানুষ যত চেষ্টাই করুক, তার স্বকীয়তা ও ভালো-লাগা লুকাতে পারে-না। যেমন তুমিও পারনি। তেমনি আমিও না।

বাজে কথা বন্ধ করুন। আমার নম্বরটা সবাইকে দিয়েছেন কেন?

ভুল, সবাইকে না। আমি শুধু রাফিয়াকে বলেছি। কারণ, আমার বিশ্বাস, ও তোমাকে প্রচণ্ড মিস্ করছে। বাকিদের সে-ই দিতে পারে। তাছাড়া সারাটা রাত আমি নিজেও অসংখ্যবার চেষ্টা করেছি তোমার সেলে ঢুকতে। পারিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তুমি অন্তত একবারের জন্য হলেও এই সিমটা খুলবে।

আমি একটু তাচ্ছিল্যের স্বরে বললাম।

নিজের ওপর বিশ্বাস দেখি এখনও কমেনি আপনার। বলুন তাহলে, কী কারণে খোঁজ করছেন আপনার এই পুরনো খেলনাকে?

স্যার মনে হয় অনেকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল। একটু স্থির ভঙ্গিতে বলতে লাগল এবার।

প্লিজ নিতু, মন দিয়ে বুঝবার চেষ্টা কর বিষয়টা। খেলনা তুমি নও। আমি। সেই শুরু থেকেই। তাছাড়া তুমি যে খেলাটা খেল্‌ছ, সেটা অনেক পুরনো একটা গেইম। সাইকোলজির ভাষায়, ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইডের সেই পুরনো কাহিনি। প্রেম নিবেদনে মন যা চায়, তা না-করা। উল্টোটা করা।

থামুন! আপনার এই টক্‌শো-মার্কা কথাবার্তা নতুন কাউকে শোনাবেন। নিউ স্টুডেন্টস্, নিউ মিস্ট্রেস। তারা অবাক হবে। আমি আর না। কারণ, আমি এখন অন্য কারো। অন্য কারো বাগদত্তা।

স্যার প্রায় আর্তনাদের ভঙ্গিতে বলে উঠলেন একরকম।

প্লিজ নিতু, সিনেমার মতো জীবনকে এত সস্তা রোমান্টিকতায় ফেল না। জীবন অনেক দামি।

আমি এতক্ষণে গম্ভীর হয়ে গেলাম। শেষবারের মতো কিছু ডায়ালগ পাওনা হয়েছে পিসু’র।

সিনেমা! চলচ্চিত্র! সস্তা রোমান্টিকতা! তাহলে আপনিও শুনুন, মন দিয়ে। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা রোমান্টিক প্রেম-কাহিনি কোনটিকে বলা হয় জানেন নিশ্চয়ই! ফ্র্যাঙ্ক কাপরা’র ইট হ্যাঁপেন্ড ওয়ান নাইট। কোটিপতির মেয়ের ঘরপালানোর কাহিনি। প্রায় একই রকম কাহিনির ছবি ওয়েলারের রোমান হলিডে। রাজকুমারীর স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ। অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছে এই ছবি দুটিই। অসংখ্য ছবি হয়েছে এই একই ঘটনা নিয়ে। তবে মজার ঘটনাটা জানেন না বোধ হয়। এ দু’টি ছবির স্ক্রিপ্ট পড়েই কিন্তু সে সময়ের ‘প্রথম নির্বাচিত নায়ক’রা, নাক সিঁটকেছেন। বলেছেন, এমন বস্তা-পচা আর সস্তা-ঘটনার স্ক্রিপ্ট না-কি তারা জীবনে পড়েননি আর। আসলে কাহিনি নয়। মূল হল কাহিনির উপস্থাপন। কাহিনিকারের উপস্থিতি। কে তার কাহিনি কিভাবে তুলে ধরল, সেটিই বড় কথা। যেমন আপনি আপনার মতো। আমি আমার মতো। ভালো থাকবেন স্যার। আপনার মতো ভালো।

কথা শেষ করেই সিমটা বন্ধ করে দিলাম আমি।

.

বহুদিন পর ড্রয়ারে থাকা ওষুধগুলো বের করলাম আমি। সম্ভবত আজ কাজে লাগাব।

আমি পানির গ্লাসে হাত রাখলাম। কানে ইয়ার-ফোন। বিছানায় শুয়ে পড়লাম আকাশের ধ্রুবতারার দিকে চোখ করে, আমার রাতজাগা তারার দিকে।

হুঁ। ওই তো! ওই তো শোনা যাচ্ছে লাইনটা।

প্লিজ ঘুম হয়ে যাও চোখে, আমার মন খারাপের…

আমি সম্ভবত আজ আর কাঁদতে পারছি না। চোখে পানি আসছে না। চোখ জড়িয়ে ঘুম আসছে। ঘুম।

ঘুমের ঘোরেই স্বপ্ন দেখলাম আমি।

আমি একাই বেড়াতে গেছি স্যারের বাসায়। কাউকে না-বলে। সম্ভবত, এটাই আমার স্যারের বাসায় প্রথম গৃহদর্শন। গৃহ বলা মনে হয় ভুল হল। গৃহে খাট থাকে। সোফা থাকে। ওয়ার্ডরোব ড্রপ, আলমারি, ফ্রিজ, টিভি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু স্যারের বাসাটা দেখলে মনে হবে, এটা গৃহ নয়, গুদাম। গুদামঘর। একটা আস্ত বইয়ের গোডাউন তুলে এনে, জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে রেখেছেন তিনি। শুধু বই আর বই। মাঝখানে কিছু আসবাবপত্র।

স্যারের বাসায় ঢুকেই সবকিছু কেমন যেন আমার নিজের বলে মনে হতে লাগল। কত আপন। কত চেনা। তাই নিজেকে এক ধরনের আত্মপ্রত্যয়ী আর সাহসী বলে সবকিছুতেই অধিকার ফলাতে ইচ্ছে করল। মনে হল আমি আজ সাহসী। অনেক সাহসী। অনেক সাবলীল।

আমি শোবার ঘরে গেলাম। বিছানায় বসলাম। বালিশ সরাতেই নিচে দেখা মিলল টলস্টয় সাহেবের আন্না কারেনিনা’র সাথে। সম্ভবত তুলার জায়গায় তার অবস্থান মিলেছে। খাবার-ঘরে গেলাম। ফ্রিজ খুললাম। দস্তয়ভস্কি সাহেব উঁকি মারলেন ভেজিটেবল বক্স থেকে। এরপর গেলাম ড্রয়িংরুমে। সোফা থেকে শুরু করে দেয়াল পর্যন্ত দখল করে আছেন নাম জানা না-জানা, বিখ্যাত-কুখ্যাত লেখক সাহেবরা।

পুরো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার জন্য তো অনেক করেছেন। এবার আপনার জন্য অন্তত একটা কাজ করি স্যার! ঘরটা গুছিয়ে ফেলি।

স্যার আঁতকে উঠল।

সর্বনাশ! ওই কাজ করতে যেয়ো না। আমি বই খুঁজে পাব-না।

আমি চোখের ইশারায় বললাম।

বই খোঁজার আর দরকার নেই তোমার। আমার চোখে তাকাও, দেখবে সব কবি আর সব লেখক এক হয়ে আছে সেখানে।

সম্ভবত এই প্রথম তুমি করে বললাম স্যারকে। তা-ও নির্লজ্জভাবে। স্যার নির্বাক তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

আমি বলতে লাগলাম, একটা কবিতা শুনবে? তোমার চোখ জোড়া পাঠাভ্যাসের মতো পড়ে আছে আমার পড়ার টেবিলে, আমি তোমার চোখের মুখবন্ধ খুলি….

স্যার হাসলেন। সেই হাসি।

.

আমার ঘুম ভাঙল অনেক চিৎকার-চেঁচামেচির মাঝে।

মনে হল আশে-পাশে অনেক লোকজন। তবে সবাই দূরে। বহু দূরে। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, এটা একটা হাসপাতালের বিছানা। সম্ভবত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট। মা কাঁদছে। বাবার চোখে-মুখে হাত ঢাকা। তাসলি আপু, রাফিয়া, সবার মুখ ফ্যাকাশে। চোখে পানি। তবে বিছানার পাশে যে লোকটি বসা, সে যেন কেমন অচেনা অচেনা মনে হচ্ছে আজ। লোকটির এমন চেহারা, আগে কোনোদিন দেখেছি বলে মনে হয় না। এমন দৃঢ় লৌহমানব অথচ ঝরঝর করে কাঁদছে। বাচ্চাদের মতো জামার হাতলে নাক-চোখ মুছছে শব্দ করে। কেন! তার কী হয়েছে?

আমার হালকা খোলা চোখ দেখতে পেয়ে, লোকটি তড়িঘড়ি উঠতে লাগল ডাক্তার ডাকতে। আমি জোর করে তার হাত ধরে বসালাম।

সবাইকে অবাক করে বলে বসলাম, তুমি আবারও উঠে যাচ্ছ!

লোকটি এ দফায় হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠল, আমি কখনো উঠিনি। কক্ষনো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *