৭
আমাদের স্কুলের ইতিহাসে, সবচেয়ে অবাক ঘটনাটা ঘটল আজ
সকাল দশটা নাগাদ একটা পুলিশ ভ্যান আসল। কিছু পুলিশ স্যারের রুমে ঢুকল। এবং মিনিট দশেকের মধ্যে স্যারকে গাড়িতে উঠিয়ে চলে গেল। আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে গেল, ঠিক তার দশ মিনিট পর।
ঘটনা জানা গেল পরে। দুপুরে। টিভি চ্যানেলে।
ব্রেকিং নিউজ। ঢাকার একটি স্বনামধন্য বেসরকারি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ, ধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার। অভিযোগকারি নারী, তার প্রতিষ্ঠানেরই একজন অধঃস্তন।
আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর অভ্যাস অনেকটা শেয়ালের মতো। কেউ একজন ‘হুক্কা-হুঁয়া’ বললেই, বাকিরা সে সুরে সুর মেলাতে শুরু করে। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের একটা গান তাদের প্রশিক্ষণে এবং প্রতিষ্ঠানে বারবার বাজানো হয়। তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে… আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে।
মোবাইল, কম্পিউটার সব কিছু বন্ধ করে, ভয়াবহ মনখারাপ নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম আমি। সবকিছু এক ধরনের বিরক্তিকর লাগতে লাগল আমার কাছে। যথারীতি মনখারাপের আইন ও গানের কথা অনুযায়ী, বিছানা ছেড়ে উঠলাম একেবারে সাঁঝবেলা। অর্থ্যাৎ সন্ধ্যা নাগাদ।
কোনো একটি টেলিভিশন চ্যানেল, হাইভোল্টেজ একটি টকশো’র আয়োজন করেছে। বিষয়বস্তু, ধর্ষণ ও নিরাপদ প্রতিষ্ঠান। বক্তারাও মোটামুটি প্রস্তুত। আলোচনার টেবিল-সেট ভাঙতে হবে। এবং নিয়ম অনুযায়ী বাবা-মা-ও দু’জনে মিলে, সকল কাজ ফেলে, অত্যন্ত চিন্তিত মুখে তা দেখতে বসে পড়েছেন টিভি সেটের সামনে। যথারীতি আমাকে দেখামাত্রই, কথার ইশারায় পাঠিয়ে দিল অন্য ঘরে।
আমিও কিছুই বুঝতে পারিনি, এমন গোবেচারী একখানা ভাব ধরে চলে গেলাম সোজা ছাদে। আর এ.ভি’র একটি জনপ্রিয় ডায়ালগ মনে করলাম, Art is a form of catharsist
বুঝেছি কি বুঝি নাই
সে তর্কে কাজ নাই
ভালো লেগেছিল, মনে রইল এই কথাই।
আমি নিশ্চিত, রেজা স্যার আর যা-ই হোক, কারও ওপর জোর করবেন, এমন মানুষ কখনোই নন। তবে শুধু এইটুকু জানতে ইচ্ছা করছে, অভিযোগটা করল কে? কী তার উদ্দেশ্য?
.
আমাদের বাসা রায়েরবাজারের একটু ভেতরে। জায়গাটার নাম দুর্গামন্দির গলি।
আশেপাশে বেশকিছু নতুন অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে উঠলেও, অনেকগুলো পুরাতন দোতলা-তিনতলা এখনও রয়ে গেছে এখানে। হয়তো ডেভলপারের সাথে বনিবনা হচ্ছে না বলে। তাই অনায়াসে মধ্যবিত্ত কিছু পরিবার, এখনও কম ভাড়ায় থাকতে পারছে এইসব পুরনো আমলের বড়বড় ঘরওয়ালা বাড়ি নিয়ে। যথারীতি আমাদের তিনতলা বাড়ির ছাদটাও তাই বেশ খানিকটা বড়।
আমাদের ছাদ থেকে একটু সামনে, একটা চার রাস্তার মোড় দেখা যায়। যার ল্যাম্পপোস্টের একমাত্র লাইটটি বছরের অধিকাংশ সময়ই নষ্ট থাকে। আর এ কারণেই এই জায়গা দিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকার রিক্সাভ্রমণের দৃশ্য অত্যন্ত আনন্দময়। একটু দূর থেকে লক্ষ করলে, বিষয়টা স্পষ্ট বোঝা যায়। স্ক্রিপ্ট বানালে, কাহিনিটা দাঁড়াবে ঠিক এরকম।
দৃশ্যপট এক। রিক্সা আলো থেকে আলো-আঁধারি। ছেলেটি সরে বসছে মেয়েটির গা ঘেঁষে। মেয়েটি হালকাভাবে এলিয়ে দিচ্ছে শরীর।
দৃশ্যপট দুই। রিক্সা আলো-আঁধারি থেকে অন্ধকার। ছেলেটির হাত পেছনে। মেয়েটি ইতস্তত না-না ভাব।
দৃশ্যপট তিন। রিক্সা ঠিক ল্যাম্পপোস্টের নিচে। এবার ঘন অন্ধকার। গালে গাল; হাল্কা ঘষা-ঘষি, লেপ্টালেপ্টি। হঠাৎ ঠোঁটে ঠোঁট I
শেষ দৃশ্যপট। রিক্সার অন্ধকার থেকে মোড় অতিক্রম। যথারীতি ছেলে-মেয়ের আগের পজিশন। এবং এরপর শুধু হাতে হাত, চোখে চোখ। আর মধুময় কিছু স্মৃতির রোমন্থন।
মাঝে মাঝে অবশ্য আরও খারাপ কিছু দেখা যায়। তবে সেটা হুড তোলা থাকে বলে, অনুমানে বুঝে নিতে হয়।
তাসলি আপু অবশ্য বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি, ছাদ থেকে এসব দৃশ্য অবলোকনের নিয়মিত দর্শক। তাই প্রিয়ংবদার মতো, প্রতিটি দৃশ্যের অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ধারাভাষ্য ও মতামত দিতে পারেন তিনি। স্বভাববশতই বাজে ভাষায়। রিক্সাভ্রমণ নিয়ে আপুর মন্তব্য শুনলে, যে কারো মাথা ঝিমঝিম করে উঠবে সাথে সাথে।
.
একদিন সন্ধ্যায় আমাকে ছাদে দেখে উনি বললেন।
শোন্ নিতু, ভুল করেও ফোমের ব্রা ছাড়া ছেলেমানুষের সাথে রিক্সায় উঠবি না। আর অন্ধকারে তো জিন্স প্যান্ট ছাড়া বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘোরা হারাম।
আমি হাসতে থাকলাম।
হাসবি না, হাসবি না। ঢাকা শহরের যত গলির লাইট, সব নষ্ট! কারণ কী, জানিস?
আমি না-সূচক মাথা ঝাঁকালাম।
মাস্তানদের মতো ইয়াং পোলাপাইনরাও সিটি কর্পোরেশনের লাইটম্যানদের ঘুষ দেয়। রাস্তা অন্ধকার রাখার জন্য। আলো রাখলেই অসুবিধা।
আমি জানতে চাইলাম, কী অসুবিধা আপু?
আছে, আছে। ক’দিন পরে বুঝবি।
বলেই তাসলি আপু কেমন যেন একটু উদাসীন হয়ে গেল। এটা আপুর অত্যন্ত স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এই মেঘ, এই রোদ্দুর। এখনই হাসি- খুশি, আবার একটু পরেই মনখারাপ।
আচ্ছা নিতু, ঢাকা শহরের সব জায়গাতেই-তো না-কি ইদানিং সিসি ক্যামেরা আছে।
আমি মাথা ঝাঁকালাম।
এগুলো মনিটরিং করে কে?
জানি না। মেট্রোপলিটন পুলিশ অথবা সিটি কর্পোরেশনও হতে পারে। কিন্তু কেন!
এগুলো দিয়ে তো ক্রাইম অ্যান্ড ক্রিমিনালস্ ধরা হয়, তাই না? যেমন, মাস্তান, সন্ত্রাসী, খুনি, ছিনতাইকারী… ধর্, সেইভাবে একদিন ডিসিশন নেয়া হল যে, প্রেমিকা-প্রেমিকা ধরা হবে। অর্থাৎ কাপল্স। যারা বেশি রোমান্টিক তাদের বেশি শাস্তি।
কী শাস্তি দেবে!
আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
লাইক, ভেলেনটাইস ডে কিংবা পহেলা ফাল্গুন অথবা বর্ষার প্রথম দিনে, ভিডিও ফুটেজ দেখে দেখে খুঁজে বের করা হবে এইসব অতি রোমান্টিক জুটিদের। রোমান্টিকতার মাত্রা অনুযায়ী শাস্তিস্বরূপ দেয়া হবে বিবিধ উপহার। কাউকে বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল। কাউকে এক ঘণ্টার জন্য ঘুরতে দেয়া হবে ফ্রি পুলিশ পিক-আপ ভ্যান। অথবা কাউকে এক দিনের কারাবাস, একটি নির্জন কক্ষ—-তুম-হাম এক কামরে মে বান্দ্ হো, অ-ওর সব চাবি খো গ্যায়া হ্যায়।
আমি মনে মনে ভীষণ হাসতে লাগলাম।
তাসলি আপুকে আমার অত্যন্ত ভালো লাগে। অসম্ভবরকম ভালো। স্পেশিয়ালি ওনার জোক্সগুলোর জন্য। তবে, আমি জানি, আপুর মনে অনেক কষ্ট। অনেক। আমাদের দেশের আর দশজন মেয়ের যে কারণে কষ্ট হয়, সে কষ্ট।
তাসলি আপু একটু কালো। বাল্কি-ফিগার! আর এ কারণেই কোনো বয়ফ্রেন্ড স্থায়ী হয়-না তার। এমনকি বাবার এতকিছু থাকা সত্ত্বেও, ভালো বিয়ের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায় ওনার। কিছুদিন আগে এক ছেলেপক্ষ নাকি সরাসরি বলেই ফেলেছে, জায়গাটা ছেলের নামে লিখে দিলে আলোচনা শুরু করা যায়, নতুবা মেয়ে দেখে কী লাভ!
আমার মাঝে মাঝে খুব মনে হয়। সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে সত্যিই যদি ‘ইচ্ছে-দেবতা’ কখনও এসে আমাকে বলে, বল, তুমি কী চাও?
আমি আমার একটিমাত্র ইচ্ছে পূরণের কথা বলব।
আমি চাই, পৃথিবীর প্রতিটি মেয়েই সুন্দরী হোক। অতিশয় ফর্সা। অতি রূপবতী। অসুন্দর বলতে কোনো মেয়েই যেন আর জন্ম না-নেয়, কোনো মায়ের কোলে কখনো।
তাহলে একদিন দেখা যাবে, সুন্দরীদের অহংকার আর অসুন্দরীদের হীনমন্যতা কোনোটাই থাকবে না এই পৃথিবীতে কখনো। সবচেয়ে বড় কথা, একটু সুন্দরী মেয়ে দেখলেই, কিছু পুরুষের জিভ আর লক্ লক্ করবে না বন্য পশুদের মতো।
.
কিরে, একা একা কী বিড়বিড় করছিস? মোবাইলও তো কানে নেই।
আমি পেছন থেকে কণ্ঠ শুনেই বুঝলাম, এটা তাসলি আপু।
তুমি কি ছাদেই ছিলে এতক্ষণ?
না। এইমাত্র আসলাম। কেন, কেউ আসবে নাকি? গোপন অভিসার!
আমি হাসলাম।
হুঁ! এই তো তুমি এলে!
আমি তো আসলাম সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে।
মানে?
আমি জানতাম এটা তুই-ই হবি। আর তোকে আমার দরকারই দরকার। ইমার্জেন্সি।
আমাকে! কেন?
ও-মা, বলিস কী রে! তোরা তো হলি আজকের মিডিয়া স্টার। দি স্টুডেন্টস অব রেজা স্যার।
আমি মৃদু হাসলাম।
তাই না-কি? এতক্ষণে তাহলে আলোচনায় চলে এসেছে সব!
সব মানে! অল টিভি-চ্যানেল, অনলাইন ম্যাগাজিন, ওয়েবপোর্টাল, টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স নিউজ মিডিয়া, ফেইসবুক, সোশাল পেইজ, সব তো বন্যায় সয়লাব। তোদের ‘দেবতা-স্যার’ নাকি ছাত্রীদের সাথেও ইটিস- পিটিস্ চালাতেন মাঝে মাঝে!
আমি হঠাৎ হাসিমুখ বন্ধ করলাম।
আপু বলতে লাগলেন।
কী রে, তুইও আছিস না-কি লিস্টে? থাকলে বল্? কতদূর! ড্রাই টেস্ট, না-কি….
এই প্রথম তাসলি আপুর কোনো জোক্স আমার কাছে বিরক্ত লাগছে। আমি একটু গম্ভীর হয়ে গেলাম।
ছিঃ আপু! কী যে বল-না তুমি। স্যারকে নিয়ে এসব বোলো-না।
ছাদে অন্ধকার। তাই হয়তো আপু আমার মুখ দেখতে পাননি। ওনার মতো করে বলতেই লাগলেন।
আর যাই হোক, ব্যাটার চেহারাটা কিন্তু জটিল। দেখলেই ক্র্যাশ! হৃদয় ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো। আমাদের স্যার হলে তো, আমি কমপক্ষে…
আমার চোখে সরাসরি পানি চলে এল। ছিঃ! ছিঃ! স্যারকে নিয়ে তাহলে, এখনিই এতদূর কথা বলা শুরু করে দিয়েছে মানুষ! আমার মতো খারাপ মেয়েরা স্যারকে দশটা বাজে কথা বলুক। বাজে ফাঁদে ফেলুক। কিন্তু অন্যরা কেন? অন্যরা কেন…
আপু প্লিজ, স্যার প্রসঙ্গ বাদ দাও।
আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে বসলাম শেষ বাক্যটা।
এ কী! এ কী! তুই তো দেখি সত্যি ওনার ওপর ক্র্যাশ খাওয়া পাবলিক!
আমি ওনার কোনো কথা না শুনেই, সরাসরি সিঁড়ি বরাবর চলে এলাম একরকম দ্রুত পা ফেলে।
পেছন থেকে তাসলি আপু ডেকে চলেছেন।
নিতু, এই নিতু। থাম্। যাবি-না। তোকে বেশ কিছু ইমার্জেন্সি কথা বলার আছে। আমি এইজন্যই এসেছি। থাম্ বলছি।
আপু অনেকটা দৌড়ে এসে আমার হাত ধরলেন।
আমি উল্টোমুখ করেই বললাম।
বল, কী বলবে? আমি পড়তে বসব।
আপু একটু ঘুরে আমার মুখের দিকে তাকালেন।
শোন, তোর ফেইসবুকে জন্মদিনের বেশকিছু ছবি আছে। স্যারের সাথে। ডুয়েল, সিঙ্গেল, গ্রুপ। এমনকি ক্লোজলিও। মিডিয়া ছাড়াও পুলিশ, ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট এগুলো অ্যানালাইসিস করছে। টিভিতে বারবার এইসব সোশ্যাল ওয়েবসাইটের কথা আলোচনা হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ওগুলো সরিয়ে ফেলিস্।
এতক্ষণে আমার মনে একটা কাঠিন্য ভাব চলে এসেছে। আমি গলার স্বরটা যথাসম্ভব ভারি করেই বললাম।
আর যদি না সরাই? কী হবে? ডিবি’ আসবে! অ্যারেস্ট করবে! মিডিয়ার মাতামাতি হবে!
বলেই চোখ রাখলাম আপুর চোখ বরাবর।
তাসলি আপু কোনো কথা না-বলে সরাসরি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
লক্ষ্মী বোন আমার! রাগ করিস না। আমার কথা শোন্। তোদের স্যারের এখন বিপদ। ভীষণ বিপদ। এই ছবিগুলো ওনাকে আরো বিপদে ফেলবে। আই নো, হি ইজ ইনোসেন্ট। মেয়েরা আর যা-ই হোক, পুরুষের চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে, কে মানুষ আর কে পশু! বাট উয়ি হ্যাভ টু হেল্প হিম। ইট্স নট দ্যা টাইম টু বি ইমোশনাল।
আমি তাসলি আপুর বুকে ঝাঁপিয়ে কেঁদে ফেললাম। ঝরঝর করে কান্না। সারাদিনের জমানো কান্না। সারা জীবনের জমানো কষ্ট!
আপু আমি জানি। আমি জানি। সব জানি। স-অ-ব।
আপু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।
এ কী! এ কী! তুই তো দেখি আসলেই সিরিয়াস হয়ে গেছিস। চুপ্ চুপ্। জাস্ট ফুল-স্টপ। ফুল গার্ল!
আমি আরও বেশি কাঁদতে লাগলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। ছোট বাচ্চার মতো।
আপু, উনি পশু হোক কিংবা মানুষ। দেবতা হোক অথবা দৈত্য। আমি কিচ্ছু জানি-না। জানতেও চাই-না। আমি শুধু একটা কথাই বলব। শুধু তোমাকেই বলব। আর কাউকে না। আমি, আমি…
বলার আগেই হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললাম এ দফায়।
.
আপু হাসতে লাগল।
এই যাহ্! এ তো দেখি সত্যিই বিপদ! পুরো স্কুল একসাথে এক লোকের প্রেমে ফিদা। ছাত্রী-শিক্ষিকা, বুয়া-আয়া, চেয়ার-টেবিল সব! মিডিয়া তো দেখি এক বিন্দুও বানিয়ে বলছে-না।
তাসলি আপু গভীর মমতায় আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
চুপ্ পাগলি। সব কষ্ট সবসময় বিলাতে হয় না-রে। যারা কষ্টকে হাসি দিয়ে মুড়ে দিতে পারে, তারাই আসল মানুষ। আলকেমিস্টদের নাম শুনেছিস্। তারা কী করত জানিস্! ইনফেরিয়র মেটাল অর্থাৎ কাঁচা-লোহাকে স্বর্ণে রূপান্তর করত। আমার কী মনে হয় জানিস নিতু? আমরা প্রতিটি মানুষই একজন এক্সপার্ট আলকেমিস্ট। কিন্তু মনে মনে। মনের ধাতব কষ্টকে সবার জন্য সোনার হাসিতে রূপান্তর করাই আমাদের আসল কাজ।
.
ছাদ থেকে বাসায় ঢোকামাত্রই, বাবা-মা দু’জন একসাথে আমার পিছু পিছু ঘরে আসলেন।
বোঝাই যাচ্ছে টেনশনে অস্থির। নতুবা আমার চোখ যে ভেজা ছিল, তা অন্তত কারও চোখে পড়ত। নাকি হয়তো-বা পড়লেও এড়িয়ে যাচ্ছেন সেসব।
বাবা যথারীতি ধৈর্য রাখতে পারলেন না।
শোন্ নিতু, তোর ফেইসবুক, ভাইবার, মোবাইল, কী কী সব আছে না, সব এক্ষুণি অন কর্
আমি তাসলি আপুর কথামতো, একজন অভিজ্ঞ আলকেমিস্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলাম। মুখে হাসির ফোয়ারা ফোঁটালাম।
বুঝেছি তো। বুঝেছি। সব ডিলেট করতে হবে। তাই না বাবা? হোয়াটস্ অ্যাপ, ইমো, ভাইবার, মেসেঞ্জার, এমনকি মোবাইলের এসএমএস, কল রেকর্ডস্, সব।
মা আমার দিকে কঠিন করে তাকালেন।
সব সময় বেশি বোঝা ভালো-না। আমাদের সামনে ওইসব ছবি-ফবি সব ফেলে দে। পারলে কম্পিউটার, মোবাইল থেকেও সরিয়ে ফেল সব কিছু। এক্ষুণি।
আমি মা’র মেজাজটা একটু চড়ানোর জন্য বললাম।
ক্যান মা, পুলিশ কি বাড়ি বাড়ি গিয়েও তল্লাশি করবে? সব ছাত্রীর লেপ-তোষক, বিছানা-বালিশ!
কথা শেষ হবার আগেই মা ঠাস্ করে চড় বসালেন।
যা বললাম, এই মুহূর্তে কর্।
উহ্! তুমি আবার এইসব কী শুরু করলে মিতুর মা! নাহ্! ঠাণ্ডা মাথায় কোনো চৌবাত-ই তোমরা সালাবাহ্ করতে পার-না কেউ।
বাবা তার ঘর বরাবর পা বাড়ালেন। চোখে-মুখে তার তীব্র বিরক্তির ভাব।
আমি মোবাইল অন করলাম। ল্যাপটপ খুললাম। দিনের প্রথমবারের মতো ফেইসবুক ওপেন করলাম।
মা যথারীতি আমার ঘর থেকে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন রান্নাঘরে।
.
ও মাই গড! এ কী!
পুরো সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে আজ একটাই গল্প
ধর্ষক ও তার শাস্তি। প্রাচীন আমলের ইট-পাথর নিক্ষেপ থেকে শুরু করে ক্রসফায়ার, ফায়ারিং স্কোয়াড, এমনকি নর্থ কোরিয়ার আধুনিক আনবিক বোমায় লাগিয়ে এমন শিক্ষককে মারার প্রস্তাবও দিয়েছেন কোনো কোনো বিজ্ঞ কমেন্টস্কারী।
টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স নিউজ পোর্টালগুলো একটু পরপর আপডেট দিচ্ছেন। চরিত্রহীন অধ্যক্ষের নানাবিধ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে।
উদাহরণ এক। বিকৃত রুচিশীলতা। ছাত্রীদেরকে গোপন কামরায় নিয়ে কু-প্রস্তাব। প্রমাণ, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিভাবকদের অভিযোগ।
উদাহরণ দুই। কর্মস্থলে হীনমন্যতা। সুন্দরী শিক্ষিকাদের নিজ বাসায় আমন্ত্রণ দিয়ে অশালীন কাজ। প্রমাণ, মুখ ফ্রোজেন করা একজন শিক্ষিকা ও একজন অফিস কর্মকর্তা। যাদের চেহারা দেখলেও, অফিসের বলে ঠিকমতো সনাক্ত করা যাবে মনে হচ্ছে না।
উদাহরণ তিন। নৈতিক স্খলন। খারাপ মেয়েদের সাথে অবৈধ মেলামেশা ও রসালাপ। প্রমাণ, নাম না-জানা বিভিন্ন ফোনালাপ ও সোশ্যাল মিডিয়ায় করা চ্যাটিং-এর স্ন্যাপ শট।
সবকিছু দেখে আমার এমন উদ্ভট লাগতে লাগল যে, এক পর্যায়ে আমি সত্যি সত্যি নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। তাসলি আপুর বর্ণনায় নিজেকে একজন দক্ষ আলকেমিস্ট বানিয়ে ফেললাম অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে। কিন্তু একজায়গায় যেয়ে আমার চোখ একদম স্থির হয়ে গেল।
এটা কে! এটাই কি সেই অভিযোগকারিণী?
অসম্ভব এ হতেই পারে না। ইম্পসিবল! ইম্পসিবল ইজ মাস্ট বি আ ওয়ার্ড, দ্যাট উইল বি ফাউন্ড ফর দিস কেইসে’স ডিকশনারি।
.
আরো কিছু ভাববার আগেই আমার মোবাইল বেজে উঠল I
হ্যালো, নিতু! তুই কি একটা গাধা না-কি একটা বেকুব, বল তো?
রাফিয়ার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।
আমি স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলাম, এ মুহূর্তে দ্বিতীয়টা বলতে পারিস। তবে সারাদিন গাধাই ছিলাম। কারণ, কিছুই জানতাম না।
তোর মোবাইল বন্ধ। ফেইসবুক অফলাইন। মেসেঞ্জার অফ। আর এদিকে আমি তো টেনশনে অস্থির তোকে নিয়ে। শুধু তোদের বাসায় যেতে পারিনি মাত্র! বাবা আমার চলাফেরায় কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন বলে।
থাম্, থাম্। এক হল আমাকে নিয়ে টেনশন। দুই, নিষেধাজ্ঞা। কারণ?
তুই কিছু জানিস না?
সন্ধ্যা পর্যন্ত জানতাম না। এই একটু আগে থেকে জানা শুরু করলাম।
তুই জানিস ঘোড়ার ডিম। ইউ নো দ্যা এগ অফ এ হর্স।
কেন? কালাপেত্নীর কথা বলবি তো?
ধূর্, ধূর্। ছবি দেখেছিস্?
কী ছবি?
সেটাই তো বলছি! জন্মদিনের ছবি।
মানে?
তোর জন্মদিনে তোলা আমাদের সেই বিখ্যাত ছবি। কালাপেত্নী আর পিসু’র এডিটেড পিকচার। জয়েন্ট। সিংগেল। ডুয়েল। শাড়িতে হাত দেয়া।
যেটা আমরা পেত্নীর ফেইসবুকে শেয়ার-পোস্ট দিয়েছিলাম? ফেইক আইডি থেকে?
ইয়েস গাধীরাম। সেই ছবি। পেত্নী সব মিডিয়ায় ওইসব ছবি, কী সব ছেঁড়া-ফাঁড়া শাড়ি, হাবি-জাবি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে।
ও মাই গড!
শুধু গড়? পারলে ঈশ্বর-ভগবান-মহাদেব সব নামে ডাকা শুরু কর। আসল কথা তো এখনো শুনিস্-ই নি।
আরও!
পেত্নী বলেছে, অনেক ছাত্রীরা না-কি তার রুমে যেয়ে বাজে বাজে কথা বলত। বাজে কাজ করত। এমনকি বাজে একটা ছবিও নাকি বানানোর প্ল্যান করছিল পিসু নিজে।
আমার হাত-পাসহ পুরো শরীর কাঁপতে থাকল।
বলিস কী এসব!
শুধু তাই না। কালাপেত্নী সিগনাল দিয়েছে। সময় হলে এসব নামও নাকি বলে দেবে সে।
নিজের কান আর রাফিয়ার বক্তব্য, দু’টোকেই কেমন অবিশ্বাস্য বলে মনে করতে ইচ্ছে করছে আমার। রাফিয়া তার বেকুবসুলভ কথার রেলগাড়ি চালাতেই লাগল।
জানিস্ নিতু, আমার ভীষণ ভয় করছে। আমরা মনে হয়, আমরা ধরাই খেয়ে যাব শেষমেষ। বুমেরাং চিনিস! বুমেরাং? অস্ট্রেলিয়ান অস্ত্র। আমরা যেসব ছবি পাঠিয়ে এতদিন সবাইকে বোকাস্-বু’র ভয় দেখিয়েছি। এখন আমাদেরকেই সেসব ছবি বুমেরাং বানিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছে অ্যান্টিপার্টি। হিট অ্যান্ড রিটার্ন মেথড।
থাম, থাম্, রাফিয়া। ওয়ার্ডটা আরেকবার বল তো? কী বললি, হিট অ্যান্ড রিটার্ন!
কেন? বললেই কি সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে? দুধ কা দুধ, ওয়াটার কা ওয়াটার। শোন্ নিতু, দুধ-পানি-বরফ আমরা সব একসাথে গুলিয়ে ফেলেছি। আমাদের ধরা খাওয়া ছাড়া…
রাফিয়ার বেকুবীয় বক্তব্যে মাথা না ঘামিয়ে, আমি ঠাণ্ডা মাথায় বলতে লাগলাম।
লিসেন রাফিয়া, অভিনয় নিয়ে রেজা স্যার বিশ্ববিখ্যাত এক ফিল্ম প্রডিউসারের একটা উক্তি প্রায়শই বলতেন, মনে আছে? অ্যাক্টিং ইজ দ্যা ফুল্স বিজনেস, অভিনয় হল মিথ্যার বেসাতি। আর এই মুহূর্তে তুই কী বলছিস্, হিট অ্যান্ড রিটার্ন! তাহলে, অভিনয়ের মিথ্যে মিথ্যে খেলায় আমরা কাকে কাকে হিট করেছি, হিসাব করে বল তো?
মানে কী? আমরা আবার মিথ্যে-মিথ্যে কী করলাম?
রাফিয়া উত্তেজিত কণ্ঠে কথার মাঝখানেই প্রশ্ন করল।
আমি আগের মতোই ধীরকণ্ঠে উত্তর দিলাম।
ইয়েস্ রাফিয়া, ইয়েস! আই গট্ ইট্।
কী পেয়েছিস?
অস্ট্রেলিয়ান উইপন। কী যেন নাম বললি একটু আগে, বুমেরাং? ইয়েস্ এগেইন বুমেরাং
কী সব আবোল-তাবোল বলছিস্? নিউজ শুনে তোর কি মাথা-মুথা অলরেডি লগ-আউট? এগেইন বুমেরাং-টার মানে কী?
মানে হল, আমরা যাদেরকে হিট করেছি, সলিউশন তাদের কাছেই আছে। এবং স্যারকে ফাঁসানোর এই প্ল্যানটা, তাদের মধ্যেই কারো।
কী বলছিস্, খোলাসা করে বল্! এত জেমস্ববন্ডগিরি আমার একদম ভাল্লাগছে না। আমি আর ফিল্মে-ফুল্মে নাই। আমার আর চার্লিস্ অ্যাঞ্জেল্স-এর ক্যামেরন ডায়াজ হবার কোনো শখ নাই। শুধু তুই এই বিপদ থেকে উদ্ধার কর, আম্মাজান। প্লি-ই-জ।
লেট্স কাম টু দ্যা পয়েন্ট রাফিয়া। বল তো, লাস্ট টাইম আমরা আক্রমণ করেছি কার ওপর?
কালাপেত্নী? শাকচুন্নি? পিসু?
উঁ হু, ইউ আর নাউ এ হর্স এগ। মনে কর, শেষদিন রাতের ঘটনা। আমরা কাকে ভয় দেখিয়েছি? মনে পড়ে?
ওহ্, ইয়েস্!
রাফিয়া এই প্রথম তার পুরনো আত্মবিশ্বাসের সাথে, জোর সাহস নিয়ে বললো শেষ কথাটা
কিন্তু নিতু, ওই পাবলিক কিভাবে জড়ালো এটাতে? তাছাড়া পিসু’র সাথে ওর শত্রুতা কী?
এটাই তো কোয়েশ্চেন। পিসুর সাথে ওর রিভেঞ্জটা কোথায়?
তুই কি বলতে চাচ্ছিস আমরা?
ইয়েস্। ভালোভাবে ভেবে দ্যাখ, এর কারণ আমরাই। সুতরাং পুরনো সূত্রের নতুন প্রয়োগ। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা।
আবার নতুন পরিকল্পনা!
নিতু হাসল।
ভয় পাচ্ছিস কেন? সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশির কিসের ভয়।
শোন্ নিতু, তোর যেখানে যখন ইচ্ছা, বিছানা পাত্। পারলে ক্যাথা বালিশও নিয়ে যা। কিন্তু আমাকে শুধু এইটুকু বল্, হোয়াট টু ডু নাউ।
আরেকবার ডাকতে হবে। ‘ওয়ান্স মোর’।
কাকে?
বুঝতে পারছিস না, ‘ওয়ান্স মোর’ মানে কী?
প্যাট্না আসিফ!
ইয়েস, মিস্টার আসিফ দ্যা প্যাট্না। তবে এবার তুই না, ফেইস হব আমি। আমি নিজে। ফুল অ্যান্ড ফাইনাল ভারশন।
রাজি হবে না।
হবে, হবে। ইট্স মাই কল। আমার আবেদন এড়ানোর মতো দুঃসাহস এখানো দেয়া হয়নি ওকে। তুই শুধু ক্যামেরা-লাইট-সেট-ক্রু সব রেডি রাখবি। সময়মতো। জায়গামতো।
কথাগুলো এত দৃঢ়তার সাথে বললাম যে, রাফিয়া ‘হ্যাঁ-না’ কিছু বলার সুযোগই পেল-না।
শুধু বলল, নো টেনশন। অল ক্রু’জ স্ট্যান্ডবাই।
আমি বলতেই থাকলাম।
কিন্তু তার আগে সবচেয়ে যেটা জরুরি, তা হল, রেজা স্যারের সাথে দেখা করা।
রাফিয়া এই দফায় চিৎকার করে উঠল।
আর ইউ ম্যাড? আমার ধারণা তুই সত্যি-সত্যি পাগল হয়ে গেছিস্। স্যারের উল্টা-পাল্টা নিউজ শুনে তোর মাথা আউলা হয়ে গেছে। ইট ইজ কোয়াইট ইম্পসিবল নিতু!
হয়তো সেটাই। কিন্তু দেখা আমি করবই। ইট্ ইজ মাই কমিটমেন্ট টু রেজা স্যার।
.
কেটে গেল নির্ঘুম আরো একটা রাত।
সকাল সকাল পত্রিকায় বিশদ ব্যাখ্যা দেখলাম ঘটনার। তবে, সকল ঘটনার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন বলে মনে হল কয়েকটা বিষয়।
এক, রেজা স্যার আর আমাদের প্রিন্সিপাল নেই। নতুন কাউকে নিয়োগ দিয়েছে গভর্নিং বড়ি।
দুই, রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে স্যারের। এক দিনের।
তিন, বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে আমাদের স্কুল। অনির্দিষ্ট কালের জন্য।
চার, ঘটনার সপক্ষে স্কুলের কোনো ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউই সাক্ষ্য দিতে নারাজ। শুধু ভিক্টিম ছাড়া।