ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে – ৮

ও কে! ও কে! ও কে গো?

সবে একটু চোখের পাতাটা জড়িয়ে এসেছে, হঠাৎ ধপাধপ ধপাধপ করে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল কেউ। প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা। ডাকাত পড়ল নাকি? কত্তা গিন্নি উঠে পড়লেন—সাড়া নিলেন। আমি টর্চটি জ্বেলেছি, ওঁরাও কুপি জ্বালিয়ে ফেলেছেন। খুবই ভয় পেয়েছেন। কিন্তু বাইরের মানুষটির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলবার পরে যেন ওঁদের ভয়টা কাটল। মনে হচ্ছে চেনা মানুষ।

—কী ব্যাপার?

—একটা ছেলে এসেছে। বলছে এ ডি সি এসেছেন ডাক্টর সেনের খবর নিতে। বড় রাস্তায়, গাড়িতে আছেন। চলুন আপনাকে নিয়ে যাই। নিয়ে যেতে বলছে।

অত্যন্ত উত্তেজিত মনে হল কত্তাগিন্নিকে। এ ডি সি আসা সোজা কথা? আছি তো তৈরিই রাস্তার জন্য। জুতো আর কোট গলিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

এ ডি সি? মানে দেউরি। এত রাত্তিরে? পৌনে দশটা বাজে। পাহাড়ি গ্রামে এটা ঘোর মধ্যরাত্রি। ব্যাপার কী?

লামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা পথ উঠতে হয়। মিনিট পনেরোর হাঁটা। এবড়ো-খেবড়ো, পাথুরে, পাহাড়ি পায়ে-চলা রাস্তা। এর ক্ষেতের ভিতর দিয়ে, ওর উঠোনের মাঝখান দিয়ে, অনেকগুলো উঁচু উঁচু বেড়া টপকে এবং পাঁচিল ডিঙিয়ে (যার দু-একটি আবার মই বেয়ে উঠে ডিঙোতে হয়), খুব মজার রাস্তা বেয়ে হাজির হলুম সেই বড় রাস্তায়। ভাগ্যিস পায়ে ছিল কেড্স জুতো। নইলে এই বেড়া ডিঙোনো সম্ভব হত না। গ্রামটি পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথাও একটিও আলো চোখে পড়ল না। আকাশের আবছা চন্দ্রালোকই ভরসা। আমার সঙ্গে অবশ্য টর্চ। সেই ছেলেটিও টর্চ নিয়েই এসেছিল।

বড় রাস্তায় গাড়িতে ছিলেন তিনজন—এ ডি সি শ্রীদেউরি, ই এ সি শ্রী বি কুমার, (যিনি হেসে হেসে বললেনঃ ‘আমি বাইশ-বছর অরুণাচলে আছি—এতদিনে একটা ভাল পোস্টিং হয়েছে! আফটারঅল, তাওয়াং ইজ আ রোড-কনেকটেড প্লেস!’) এবং এম ও, ডাঃ কর, যাঁর বাড়িতে একদিন লাঞ্চ খেয়েছি তাওয়াং-এ, এবং যিনি ডাঃ লালওয়ানীকে বেডিং ধার দিয়ে আমার শোবার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। একজন এই নেফা অঞ্চলেরই মানুষ, একজন উত্তরপ্রদেশের, আরেকজন উড়িষ্যার। তাঁরা যার খোঁজ করতে এসেছেন, সে-মানুষটা বাংলার।

দেউরি বললেন—আমি তো ছিলাম না তাওয়াং-এ, ফিরে এসে শুনি আপনি চলে গেছেন সাম্প্রং গ্রামে। মোম্পাদের মধ্যে বাস করবার শখ হয়েছে। আপনি অ্যান্থ্রপলজিতেও কাজ করেন তা তো জানতাম না? যা হোক আমার বড়ই উদ্বেগ হল। একে তো আপনাকে কোনও যত্ন আত্তি করা হয়নি। গুডবাইটুকুও করা হল না, তার ওপরে কে জানে কোথায় চলে গেছেন আপনি? ভাবলুম যাই সরেজমিনে তদন্ত করে আসি। এঁরা বললেন এঁরাও আসবেন। তাই দলবল নিয়ে চলে এলাম। চলুন দেখে আসি কে কোথায় উঠেছেন, কেমন আছেন!

কী আর বলব? এই উদ্বেগ, এই আন্তরিকতা, এবং কর্মক্লান্ত দিনের পরে, এই আসা,—এ কোনও উত্তর হয় না।

আবার সেই দুর্গম পথে চড়াই ভেঙে সবাই মিলে ফেরা হতে লাগল। লোকের বাড়ির উঠোন দিয়ে, আপেল বাগিচার বেড়া ডিঙিয়ে, আলুক্ষেতের আল বেয়ে, ঘুমন্ত ঘরবাড়ির ছায়া দিয়ে গল্প করতে করতে হেঁটে হেঁটে লামার বাড়িতে ফেরা। লামা আগেই খবর পাঠিয়েছেন সেই ছেলেটিকে দিয়ে। যাতে স্ত্রী তৈরি থাকেন অতিথিদের জন্যে।

যখন পৌঁছোলুম, দেখি ইন্দ্রসভা সেজে ঘর হাসছে। যেন কোনও শেখ-এর বিলাস তাঁবু। হ্যাজাক জ্বলছে, কার্পেটে-কুশনে শোবার ঘরটি বৈঠকখানা হয়ে গেছে। মুহূর্তে মুহূর্তে রূপ বদলায় এই ঘর। কখনও রান্নাঘর, কখনও শোবার, কখনও সভার। এই ছিল লালচে অন্ধকারে ডোবা। এই হয়ে গেছে রাজসভা। ঘুমন্ত কারমো আর কিন্দন উঠে হাসিমুখে অতিথি সৎকার করছে। হঠাৎ এতগুলি ক্লাস-ওয়ান অফিসার ওদেরই ঘরে এসেছেন, ওদের বিশ্বাস হচ্ছে না। সবাই মিলে একসঙ্গে বসে মাখন-চা আর রক্‌শি খেয়ে আড্ডা দিয়ে রাত সাড়ে এগারোটার সময়ে উঠলেন। সেই ছেলেটি ওদের সঙ্গে গাড়ি অবধি গেল। পেম্মা খাণ্ডুও যাচ্ছিল, কিন্তু লামাকে যেতে বারণ করলেন ওঁরাই! আবার আগুন নিবিয়ে, বিছানা পেতে দোর বন্ধ করে শুয়ে পড়া হল। ঠিক স্বপ্ন দেখার মতো মনে হচ্ছে ওঁদের আসাটা। আবার ঘর অন্ধকার। সেই লালচে আভা। নেভানো আগুনের মৃদু উদ্ভাস, আর পোড়া কাঠের উটকো ছুটকো শব্দ।

পাখি সব করে রব

পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল। ঘরে কেউ নেই। এর মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে। কী সুন্দরই যে একটা সকাল হল। ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম, সামনেই কাঠের উঠোন। উঠোনকে উঠোন, বারান্দাকে বারান্দা! মস্ত চওড়া একটা বড় মঞ্চের মতন। ওপাশে ঘেরা রেলিং। তার নীচেই পীচফলের বাগান। দূরে তুষারমৌলি শিখরের সারি, স্নোরেঞ্জ। তার নীচের দিকে ঢালু বনপাহাড়ির গায়ে পাতলা মসলিনের ওড়নার মতন ভোরের কুয়াশা জড়িয়ে আছে। ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলেই এই দৃশ্য আর পাখির শিস—দোয়েল পাখিই মনে হচ্ছে—আমি কেমন করে জানাব আমার জুড়াল হৃদয় প্রভাতে।

দেবেন ঠাকুরের কথা মনে পড়ে গেল। হিমালয়ের এই শান্তিই বালক রবীন্দ্রনাথের আত্মার গভীরে প্রবেশ করেছিল।

ঘরের ড্রাম থেকেই ওই সসপ্যান (কিয়ো) ডুবিয়ে ঠাণ্ডা জল নিয়ে মুখ ধুতে যাচ্ছি, কারমো ডেকে গরম জল মিশিয়ে দিল তাতে। মুখ ধুলুম ওই কাঠের বারান্দার রেলিং থেকে, পীচফলের বাগানের ওপর। তারপর নমক্ চা হাতে করে আবার এই খোলা জায়গাটাতে চলে এলুম। এটা উঠোন-কাম-বারান্দা। একধারে হাতের তাঁত রয়েছে। তাতে মোটা কম্বলের মতন গরম কাপড়ের থান বোনা হচ্ছে। পাশে থলে ভর্তি উলের বল রাখা। থানটি ফুটখানেক চওড়া। সংসারের যাবতীয় পোশাক পরিচ্ছদ ওই থান কেটে, জুড়ে তৈরি হবে। বড় বড় পাত্র ভরা গম, যব, ভুট্টার দানা রাখা। বিরাট বিরাট লাউ কুমড়োও রাখা। বাসনপত্র। ছাতা। সংসারের সর্বস্ব এরা বারান্দায় রেখে, নিজেরা ঘরের মধ্যে ঢুকে শীতের হাত থেকে লুকোয়। এখানে কেউ কারুর জিনিস চুরি করে না। লামা বললে উলের দাম খুব বেড়ে গেছে, তিন টাকা কিলো ছিল এখন বিশ্বরুপেয়া রয়েছে। চট্টকে সকালে দেখলুম না, শিম্পুকে দেখি সম্ভ্রান্ত ভঙ্গিতে একটা বাটি থেকে চা খাচ্ছে।

সকালে উঠেই বিছানা তুলে ফেলা প্রথম কাজ। তারপরই ঘরটি হয়ে যায় রান্নাঘর। ঘরটার একদিকে পাহাড়ই বোধ হয়, পাথরের দেওয়াল। বাকি তিনদিক কাঠের তৈরি। মেঝেও কাঠের। ছোট একটা পাঁচ ফুট মতন দরজা—পাথরের চৌকাঠ, দুফুট উঁচুতে উঠে, একধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে ঢুকতে হয়। ঢুকে ফের দুধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে নামতে হয় ঘরে। ঘর অন্ধকার। ক্রমশ চোখে সয়ে আসে। কিন্তু বেশ গরম থাকে জানলা নেই বলে। মাথার ওপরে কাঠের কড়িবরগা, পিচ মাখান। কিন্তু পেম্মা খাণ্ডুর বাড়িতে আরেকটাও ঘর লাগান হয়েছে, বাইরে। নতুন বসানো ঘর। এই ঘরে তিন-চারটে আধুনিক জানলা আছে তাতে গেরুয়া পর্দা আছে ভেতরে তিনটি বিছানা পাতা। শুনলুম তিনজন তিব্বতি লামা এসেছেন, তাঁদের জন্যেই বানান হয়েছে ওই ঘর। ওখানে তাঁরা বেশ কয়েকমাস যাবৎ অতিথি। বসতবাটির মধ্যে তাঁদের যাতায়াত নেই, যা দেখলুম।

ঘুম থেকে উঠেই এদের রান্না খাওয়া শেষ। সাতটার মধ্যে সবাই পেট ভরে ভাত, পা, চা, ডিমভাজা খেয়ে কাজে বেরিয়ে গেল। তারপরে আম্মার ঘর-কন্না শুরু। মেয়ে সাহায্য করছে। পীচবাগানে কয়েকজন মেয়ে এসে কাজে লাগল দেখলুম। মেয়েরা এখানে বিড়ি সিগারেট খায়। কিন্তু লামারা ধূমপান করে না। এ বাড়িতে কেউই করে না দেখলুম।

—”মোম্পারা গাঁজা ভাং খায় না,” লামা বললে, “কেবল বিড়ি সিগ্রেট নস্যি আর রশি। কখনও বা আরা, লোপানি, সিং-ছাং বা-ছাং।” পেম্মা গে-র স্ত্রী খুব কর্মঠ সত্যিই। যব, গম ঝাড়ছে, শুকোচ্ছে, রোদে মেলে দিচ্ছে, গুটিয়ে বস্তায় ভরছে তুলছে। লামা সকালে গুম্ফায় চলে গেছেন। আমি বাইরে একটু হাঁটতে বেরুই। টুং টাং শব্দ—এখানেও তেমনি চমরীর পাল নিয়ে চরাতে যাচ্ছে দুটি বালক। চমরী মরে গেলে এরা নাকি কেঁদে ভাসায়। পুরনো পরম আত্মীয়রাই চমরী জন্ম নিয়ে ঘরে আসে কিনা! চমরী লক্ষ্মী।

.

পালিশ করা, তামা-পেতলের পাত বসানো চমৎকার কুনকে করে শস্য তোলে লামার বউ। এমন একটা কুনকে পেলে নিয়ে যেতুম। নিয়ে যেতুম এই চায়ের বাটিও। চকচকে পালিশ করা কাঠের বোল-এ করে চা খায়, ডেনিশ পাত্রের মতো গড়ন। তেমনই খুরোওলা, ঢাকনিওলা বাটিতে করে খাদ্য খায়। ঢাকনি কেন? যাতে ঠাণ্ডা না হয়ে যায়।

এখানকার সকালের সঙ্গে তাওয়াং-এর সকালের প্রধান তফাত, এখানে বনের মধ্যে পাখি ডাকে। বড় বড় গাছ-গাছালি, পাখ্-পাখালি আছে। তাওয়াং-এ দুটোই নেই। পাহাড়গুলো একই হলে কী হবে, উচ্চতার তফাতে স্থান মাহাত্ম্য পালটে যায়।

পেম্মা এবার ফিরবে। আমিই বরং দেখে আসি গুম্ফাটা দিনের বেলায় কেমন লাগে। একবার যাই গুম্ফায়। উড়কিন স্কুলে গেছে, ক্লাস থ্রিতে পড়ে। আন্নি-মেয়ে তৈরি হচ্ছে আনিগুম্ফায় ফিরে যাবার জন্য। কারমো তার বড় মেয়েকে নিয়ে ফলের বাগানে কাজ করছে কী সব। একসময়ে পাতায় করে কিছু বাগানের পীচফল তুলে এনে দিল আমাকে। লাল সবুজ রঙের কাঁচা, ডাঁশা টক-মিঠে পীচফল। নুন দিয়ে খেতে বেশ লাগে। ব্যাগে ভরে নিই মেয়েদের জন্য। কাঁচা পীচফল তো কেউ দেখেনি ওরা। আমি গুম্ফায় যেতে আমার সঙ্গেই পেম্পা ফিরে এল।

সত্যিই যা ভেবেছিলাম তাই—দিনের বেলায় ঠাকুর দেবতাদের অনেক কম ভয়াল দেখাচ্ছে।

ইতিমধ্যে একজন প্রতিবেশী এসে আমাকে তিনটে ডিম ও একটি খাদা উপহার দিলেন। তারপরে এলেন গিন্নির দুই রূপসী বড় বোন। একজনের পিঠে নাতি বাঁধা। ছেলে-বউ কাজে গেছে। এর দুই স্বামী। আরেকজনের হাত ধরে এসেছে বছর চার-পাঁচের এক নাতনি। খুব মিষ্টি দুটো বাচ্চাই। নাতনির কোমরে আবার রিক্সাওলার ঘণ্টার মতন মস্ত একটা ঘণ্টি বাঁধা ‘নমস্তে করো”–বললেই সে নমস্তে করে আর “সালাম করো”, বললেই সালাম। করেই হেসে ঠাকুমার পিছনে লুকোয়। এঁরই তা হলে তিন স্বামী? সুন্দরী বটে। এঁরা দুজনেই ষাট পেরিয়েছেন, কিন্তু গোটা চল্লিশের বেশি দেখায় না। এখানেই তো ‘শাংগ্রিলা’ খানিক খানিক ছড়িয়ে আছে। এরাও এনেছেন খাদা আর পাঁচটা করে ডিম, বোনের বাড়ির অতিথিকে আদর অভ্যর্থনা জানাতে হবে তো? ডিমগুলো এই সংসারে রেখে দিয়ে, খাদাগুলো ব্যাগে ভরে নিচ্ছি। ‘খাদা’ হল ব্যাণ্ডেজের গজকাপড়ের মতো অতি পাতলা মাড় দেওয়া একটা জ্যালজ্যালে সাদা গামছার মতন জিনিস, যেটা তিব্বতে মালার বদলে ব্যবহৃত হয়। বিলেতে পনির-ছাঁকনি, চিজ-ক্লথ ঠিক এমনি দেখতে। মানুষ কি দেবতা যাকেই হোক সম্মান দেখাতে চাইলে এরা ‘খাদা’ দেয়। ডিমটাও তাই। আমরা যেমন সন্দেশ, মালা দিই।

জীবনে এই প্রথম একত্রে বহুপতিচারিণী সচ্চরিত্রা বিবাহিতা স্ত্রী দেখছি। দুঃখের বিষয় : ভাষার অন্তরায়ের কারণে তেমন ভাবে কোনও প্রশ্নই করা গেল না। লামার মাধ্যমে তো সব প্রশ্ন হয় না? কিছুক্ষণের মধ্যে অতিথিরাও বাগানে কাজ করতে লেগে গেল কারমোর সঙ্গে এরা বসে থাকে না। বেড়াতে এলেও না! সাধে এত রূপ?

জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার

—”বেড়াতে যাবেন? আশপাশের গ্রাম-টামে?” পেম্পা গে লামা বলে ওঠে—”লামা দেখার এত শখ যখন, তখন চলুন লামা ছোছে-রিমপো-ছে-রে সঙ্গে দেখা করিয়ে আনি। আপনি একজন প্রকৃত তিব্বতি পাক্কা লামা দেখে যান। দলাই লামা, কি পাঞ্চেন লামার মতো না হলেও, এঁরা কিন্তু ভি আই পি লামা! এঁদের অনেকগুলি পূর্বজন্ম মনে থাকে। ইনি দলাই লামারই সঙ্গে ১৯৫৯-এ এখানে এসেছেন। এঁদের অনেকের পুঁথি পড়বার বিদ্যে নিয়েই জন্ম হয়, অনেকে আবার পূর্বজন্মের কিছু চিহ্ন নিয়ে জন্মান। এঁর সেই জন্ম চিহ্ন আছে। আশ্চর্যরকম ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। চলুন রিমপো-ছে-কে এখন গেলে পাওয়া যাবে। হেঁটে যেতে পারবেন তো আপনি? না, ঘোড়াটা ঠিক করে দেব?

–“কই? কোথায় তোমার ঘোড়া? দেখাওনি তো? খুব দূরে যেতে হবে নাকি?” গুম্ফার সামনে একটুখানি মাঠ। গুম্ফার চারিপাশে পাইনবন। সেই মাঠে একটি সুন্দর বাদামি বেঁটে ঘোড়া ঘাস খাচ্ছিল। চট্ট কুকুরও দেখলুম খেলছে ওখানে।

—”ওইটেই আমার ঘোড়া।”— লাজুক হেসে পেম্মা জানায়।—বেশিদূর নয়। ঘোড়া লাগে না। হাঁটতে হাঁটতে আমরা পাহাড়ের আর এক ধারে, ঢালুর কাছে চলে এলুম। গ্রামের প্রান্তে। জানি না এটাও সাস্প্রং না অন্য কোনও গ্রাম। এবারে অনেকগুলো বেড়া, এবং উঠান পেরুতে হবে এখানেও। কিছু হণ্টন, কিছু উল্লম্ফন। কেন যে মিঃ কুমার কাল বলেছিলেন তাওয়াং “গুড পোস্টিং” কেন না “রোড কনেকটেড প্লেস” সেটা এত অল্পেই টের পেলুম। তবু তো এটা উদোম বুনো পাহাড় পর্বত নয়, রীতিমতো গ্রাম-বসতিতে পোষ মানানো সভ্যজগৎ।

একটা বাংলোবাড়ি। তার সামনে, ক্ষেতে একজন কাজ করছিল, সে বললে খবর নিয়ে আসছে লামা দেখা করবেন কিনা। আমরা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি উঠোনে একটা দীর্ঘ কাঠের খুঁটি। তার মাথায় একটি ছোট্ট কাঠের খাঁচা, খাঁচার সামনে খানিকটা বারান্দা মতন করা আছে। সেখানে একটি বাঁদর বসে আছে। আমাদের দেখেই বাঁদর নেমে এল, বোধ হয় খাদ্যের আশায়। কাছে তো কিছুই ছিল না, যে দেব তাকে!

সে তখন আবার উঠে গেল, এবং একটা ভাঙা আয়না কোথা থেকে নিয়ে, চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে নিজের মুখটি দেখতে লাগল। ভারি বিমর্ষ সেই মুখ। বাঁদরের পায়ে সরু শিকলি।—আহা, হাতে কিছু খাবার থাকলে খুব ভাল হত। বেচারি!

ইতিমধ্যেই আমার আশপাশে কিছু লোক জমা হয়েছে। পেম্মা গে তাদের বলল, “কিছু খাবার দিতে পারো, বাঁদরের জন্য” একটি ছোট ছেলে দৌড়ে চলে গেল।

—”বাঁদর নয়, উনি বাঁদরি। বাঁদররা দল বেঁধে ভুট্টা চুরি করতে এসেছিল। তাড়া খেয়ে ওর মা ওকে ফেলে রেখেই পালিয়েছিল। লামা রিমপো-ছে ওকে বাচ্চা থেকে মেয়ের মতো যত্ন করে পুষেছেন।” লামা জানাল আমাকে। শেকলপরা বাঁদরি একমনে চিৎ হয়ে শুয়ে ভাঙা আয়নাতে মুখ দেখছে। মা তাকে ফেলে পালিয়ে গেছে।

.

আমার মনে হল একেবারেই আমাদের অন্তর্জীবনের প্রতিচ্ছবি। এটা তো পুরোপুরি একটা কবিতার শক্তিশালী ইমেজ। মনুষ্য জীবন তা এইই।

.

একটু পরেই ছেলেটি ফিরে এল, কোত্থেকে চিনে বাদাম আর ভুট্টার খই নিয়ে। বাঁদরি নীচে এসে বাদামগুলি বেছে বেছে খুঁটে খুঁটে খেল। ফের ওপরে উঠে গিয়ে তার ভাঙা আয়নাটি হাতে তুলে নিল সে।

লোকটি এসে খবর দিল। আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে পেম্মা গে বলল—চলুন, রিমপো-ছে ডাকছেন আমাদের। আপনার ভবিষ্যৎটা জেনে নিতে ভুলবেন না। ইতিমধ্যে আমারও তো জীবন কাহিনি এক্সচেঞ্জ করা হয়ে গেছে? পেম্মা খাণ্ডু এবং কারমোর ইচ্ছে : হয় আমার স্বামীর সঙ্গে পুনর্মিলন হোক। এক্ষুনি। নয়তো আমি একটা শাদি করে নিই। এক্ষুনি। এমন আওয়ারা হোকে ঘুম্‌না ঠিক নেহি। আমি যে মোটেই আওয়ারা হয়ে ঘুরছি না, বাসা বেঁধে ডিমে তা দিচ্ছি, সেটা বোঝাবার মতো অত ভাষাজ্ঞান আমাদের কারুরই নেই। ওর হিন্দিও বলে “আমাকে দ্যাখ্” আমার হিন্দিও বলে “আমাকে দ্যাখ।” কে কাকে দেখবে! তবে মুশকিল হল রিমপো-ছে-র কাছে গিয়ে।

এঁরা পুনর্জাত লামা। শিশু অবস্থাতেই তিব্বতে দলাই লামার দূতেরা গিয়ে খুঁজে খুঁজে এঁদের ঘর থেকে তুলে আনে। দলাই লামাই চিহ্ন বলে দেন, কোথায়, কবে, কোন গ্রামে, কার ঘরে জন্মাবেন পরবর্তী কোন লামা। তাঁর দেহে একটা জন্মচিহ্ন থাকবে। “পুনর্জাত” তিব্বতি এই খানদানি লামাদের জাতই আলাদা, মানই আলাদা। এঁরা সব সময়ে পুঁথি পড়েন।শুভ-অশুভ, পরজন্ম-পুনর্জন্ম, পাপ-পুণ্য, ভূত-ভবিষ্যৎ, আত্মা-পরমাত্মার চিন্তায়, ধৰ্ম- আলোচনায় মগ্ন থাকেন। একবার এক দলাই লামা নাকি জন্মেছিলেন এই তাওয়াং-এর কাছেই, উরগিলিং বলে একটা গুম্ফার পাশে। একটা কর্পূরগাছ আছে সেইখানে। সেই খবর তিব্বতের লামারা স্বপ্নে জেনে গিয়েছিলেন, উরগিলিং-এ লোক পাঠিয়ে শিশুটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই উরগিলিং গুম্ফা, সেই বৃদ্ধ কর্পূর গাছ এখনও আছে। সময় থাকলে দেখেও আসা যেত, জিপ যায়।

এই বৌদ্ধ ধর্ম ব্যবস্থায় তন্ত্র অত্যন্ত জরুরি, এখানে নারীর ভূমিকা মোটেই গৌণ নয়। লোকেশ্বরী, তারা, মহাকালী, কালী, তান্ত্রিক দেবীদের প্রবল প্রতাপ, অশেষ মহিমা। স্বয়ং যমরাজ আছেন এঁদের পুরুষ সঙ্গী। আমার বদলে আমার বন্ধু সংযুক্তাদি এখানে এলে আমার চেয়ে বেশি কাজে দিত—নেদারল্যান্ডে এখন সে তন্ত্র নিয়েই পড়াশুনো করছে। এখানে প্রত্যেক গুম্ফায় প্রচুর পুঁথিপত্র আছে, আছে তাংখায় আঁকা নানা প্রাচীন ছবি। আর মুখে মুখে প্রচলিত প্রচুর মিথ, ফোকলোর, কিংবদন্তি। মিথগুলো সংগ্রহ করবার প্রবল বাসনা হয়েছিল আমার, কিন্তু সময় ছিল না। পরে কখনও ফিরে আসব—ভেবেছিলুম। কিন্তু পাঁচটা বছর তো কেটেই গেল! জাং লামার সামগ্রুং-এ জল আনার গল্পটা যেমন সগর রাজার ছেলেরা আর ভগীরথের গল্পের মতন, একটা আর্কিটাইপাল গল্প, তেমনি তাওয়াং-এর নাম কেন তাওয়াং হল, তার চার-পাঁচটা ব্যাখ্যান-আখ্যান,–মোটকথা হাজার হাজার গল্প এখানে বাতাসে উড়ছে তুলোর বীজের মতো। ধরে নিলেই হল। কিন্তু আমি একে ভাষার ভিখারি, তথা সময়ের কাঙাল—আমার ঝুলি তাই ভরল না।

.

পেম্মা গে বলল,—”ইনি বহুৎ বড়া লামা—এঁর নাম ছোছে-রিপো-ছে, বয়েস সাতচল্লিশ, তিব্বতের “সেরা” নামের গুম্ফা থেকে এসেছেন। এঁর হাতে জন্মদাগ আছে, সেই দাগের হদিশ দিয়েই ওঁকে তুলে এনেছিল লামার লোকেরা। এঁরও পুরোপুরি পূর্বজন্ম স্মরণ আছে, নিজের গুম্ফা। সেই গুম্ফার সম্পত্তির হিসেব, পূর্বজন্মের বাপ-মার নামধাম সব বলতে পেরেছিলেন। আশ্চর্য কিছু নয়। যাঁরাই পুনর্জাত লামা, তাঁরাই পারেন। ইনি খুব সৎ লোক। সেরা গুম্ফায় কত সোনার বুদ্ধমূর্তি, কত সোনার দেবীমূর্তি, তিব্বতে সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছেন। এখানে নিতান্ত দীন দরিদ্রের মতো বাস করেন। সর্বদা গরিবদুঃখীর বাড়িতে যান। ব্যক্তিগত কোনও উচ্চাশা নেই। খুব পড়াশুনো আছে, আরও পড়াশুনো করেন। মমতার শরীর। অনেক জীবজন্তু পোষেন। এটা এই লামার দ্বাদশ জন্ম চলছে। এগারোটা জন্মই ওঁর স্মরণে আছে, মুখস্থ আছে। সমস্ত ইতিহাস বলতে পারেন।”—সসম্ভ্রমে পেম্মা বলল।

মমতার শরীর তাতে সন্দেহ নেই। যখন ওঁর ঘরে গেলুম, তার আগে বারান্দায় দুটো কুকুর ভয়ানক রেগে চিৎকার করতে লাগল। তাদের শেষটা শেকল পরিয়ে বাঁধতেই হল। মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দেখি লামার সঙ্গে এক আসনে তাকিয়া ঠেশ দিয়ে গালচের ওপরে গা এলিয়ে আহ্লাদ করছেন আরেকজন কুকুর মহারাজ। এঁরা কোন জন্মে কী ছিলেন কে জানে? এবং চতুর্থ একজন খুদে লোমভরা বস্তু এসে আমারই কোলে উঠে বসলেন। লামাটির তপঃক্লিষ্ট চেহারা দেখে বয়েস বোঝা যায় না। পেম্মার মতো নধরকান্তি নন। আস্তে আস্তে, গম্ভীর হয়ে কথা বলছিলেন অনেক। কিন্তু সেসব হিন্দিতে অনুবাদ করবার শক্তি নেই পেম্মার। অতএব লামার সঙ্গে আমার বিশেষ কথোপকথন সম্ভব হল না। কেবল পেম্মার সঙ্গেই কথা বললেন। আমার ভবিষ্যৎ জিজ্ঞেস করতে অনেকবার পেম্মা আমাকে মনে করিয়ে দিলেও আমি সেটা পেরে উঠলুম না। অথচ জানতে যে একদম ইচ্ছা করছিল না, তা বলব না কিন্তু কিছুতেই ব্যক্তিগততম প্রসঙ্গটি তুলতে সম্মত হলুম না। ইগোতেই বাধল। তা হলে আমারও অহং আছে? অর্থাৎ আমিও মুক্তপ্রাণী নই?—”সব অহংকারই বন্ধন। কঠিন বন্ধন আপন শোকের অহংকার।” চুপ করে রইলুম। লামার পূর্বজন্মের লক্ষণ-স্বরূপ জন্মচিহ্নটা দেখালে পেম্মা দক্ষিণ বাহুতে লাল জড়ুল।

.

খুব যত্ন করে চমৎকার জাপানি কাপ ডিশে আমাদের নমক-চা ও বিস্কুট খাওয়ালেন। বেরিয়ে আসছি, দেখি বাড়ির সামনে স্বাস্থ্যসুন্দর একটি ঘোড়া চরছে।

—”ওই দ্যাখো তোমার মতন এঁরও ঘোড়া রয়েছে।”

—”কী যে বলেন?” পেম্মা লজ্জা পেয়ে বলল—”ওঁর কি ঘোড়া একটা? ওঁর সাতটা ঘোড়া। তিনটে নিজেই কিনেছেন, গ্রামের লোকেরা চারটে উপহার দিয়েছে।”

—”উনি সাতটা ঘোড়া দিয়ে কী করবেন? উনি কি সূর্যদেব? না হপ্তায় সাত দিনে সাতটা ঘোড়া চড়েন?”

—”নাঃ ওই আছে। এই আর কী। লোকে দিয়েছে, আছে। লোকে পুণ্যলোভে দেয়।” সাতটি অশ্ব, চারটি সারমেয়, একটি বানরি এবং বেশ কয়েকটি গ্রামভর্তি বিশ্বস্ত মানুষ—পূর্বজন্মে যাই হয়ে থাকুন, যা দেখেছি, এ জন্মে রিপো-ছে-র সময়টা কাটছে ভাল। কিন্তু ভাষা না বুঝতে পারার বড় কষ্ট!

নাস্তা রেডি

আবার “মানি” ঘুরিয়ে ঈশ্বরকে স্মরণ করে পেম্মা গে-র পেছু পেছু বাড়িতে ঢুকলুম। বারোটা বাজে। আম্মাও বাগান ছেড়ে ফিরে এসে আবার উনুন ধরালেন। এবারে লাঞ্চ তৈরি হবে।

পরিবারের লোক নয় এমনও দু-একটি ছেলে মেয়ে এল, একজন তো এক থালা ভুট্টার খই (আমার মেয়েরা যাকে পপকর্ণ বলে) নিয়ে পা ছড়িয়ে খেতে বসে গেল। আম্মা এক বিরাট লাউ নিয়ে একটা ছোরা বাগিয়ে কুটনো কুটতে বসলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই খানা প্রস্তুত। আটা মেখে রুটি না করে লেচিটা সেদ্ধ করে খেলে বেসন হয়, তেমনি একটা জিনিস, শুনলুম mil- let থেকে তৈরি—ভাতের বদলে সেটি, পা, মাখম-চা এবং রক্‌শি। দুপুরেও রকশি। এ বাড়িতে কাউকে ছাং খেতে দেখছি না।

—”রোজ দুপুরে কিন্তু এমন হয় না। কেউ যেদিন গোরু ভেড়া চরাতে যায়, দূরে দূরে খেতির কাজে যায়, সেদিন সঙ্গে টিফিন নিয়ে যায়।”

—”কী টিফিন?”

–“কেন? চওঁরী মাংসের পুর দেওয়া মোমো, কিংবা ঝ্যান্ আর লঙ্কার চাটনি?”

–“কখন ফেরে?”

—”ফেরে সন্ধে হলে। ফিরে চা খায়, রক্‌শি খায়। আরাম করে। সাতটা বাজলে রাত কা খানা খায়েগা। খানার পরে আরেকটু রক্‌শি খায়। জপতপ করে। আটটার মধ্যে বিছানা। লামাদের অবশ্য রুটিন একটু অন্য। রশিটা বাদ।”

.

আম্মারা সকাল থেকে কী কী করেন? ঘুম থেকে উঠে প্রথমে বিছানা তোলা। ঝাড় লাগানো। তারপরে উনুন ধরানো।

পানি গরম।

মুখ ধোয়া।

চায় বানানা।

সবজি, ঝ্যান, পা বানানা

খানা খতম করে বেরিয়ে পড়া। খেতিকাম দেখা, চওঁরী-বকরি দেখা। ছেলেরা চলে যায় বাঁশ কাটতে, কাঠ কাটতে, তক্তা চিরতে, লাকড়ি আনতে, গোরু-ভেড়া চরাতে। আম্মা খেতিকামের পরে ফিরে এসে উলের থান বোনেন তাঁতে,—কাঁটাতেও বোনেন সোয়েটার, টুপি, মোজা, মাফলার। যব, গম ঝাড়েন, বাছেন রোদে দেন। কোনও কোনওদিন রশি তৈরি করে। মিরচকা আচার, চওঁরী দুধের ঘি বানান। মাংস শুকনো করেন। ভরে রাখেন। আম্মার কত কাজ! আম্মাদের কাজের কি শেষ আছে? সাধে কি আম্মাদের বাপ-মাকে পণ দিয়ে তবে তাদের ঘরে আনতে হয়?

.

স্নান করাটা এদের রুটিনে নেই। বছরে মাত্র একদিন! বসন্ত কালে।

.

এরা বড় স্বল্পভাষী। নিজেদের মধ্যেও খুব একটা কথাবার্তা বলতে দেখছি না। মোটামুটি চুপচাপ। খালি হাসে। কিছু বললে খুব নিচু গলায় বলে।

চিত্রকর

খেয়ে উঠে, আমি আর পেম্মা খাণ্ডু গ্রামে ঘুরতে বেরুই। পেম্মা বলল, চলুন এবার আপনাকে তাংখা আঁকা দেখিয়ে আনি। ওইদিকে একজন—”পেন্টিং করনেওয়ালা জাতকা ঘর হ্যায়।”

বেরুবার সময়েও একবার “মানি’টা ঘুরিয়া যাই। ওঁ মণি পদ্মে হুম্।

ওর গুম্ফা পেরিয়ে, একটা আলুর ক্ষেত পার হয়ে, আমরা একজনদের বাড়ির আওতার মধ্যে ঢুকে পড়ি। মস্ত সবজি বাগান। বাড়িটা ভেতর দিকে। পথে দেখা একটি চোদ্দো-পনেরো বছরের মেয়ের সঙ্গে। তার হাত ধরে নাচতে নাচতে যাচ্ছে বছর তিন-চারের একটি দেবশিশু। পেম্মা তার সঙ্গে কী কথাবার্তা বলে। সে হেসে উত্তর দেয়। আমাকে নমস্তে করে। তারপরে চলে যায়। পেম্মা বলে—”বাড়িতে আছে। এই হচ্ছে পেন্টিংকরনেওয়ালার বউ, আর ওইটে ছেলে।”

–“এতটুকু বউ? তার অতবড় ছেলে? ওর বয়েস কত?”

—”উনিশ বিশ হবে।”

—”আর যে আঁকে, তার?”

—”ওই, বিশ বাইশ হবে।”

নীচের ঘর খোলা। হাট দরজা। ঘরে কেউ নেই। বাসনপত্র সাজানো। উনুনে চায়ের ঝারি।

পেম্মা ছোট সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। আমি নীচে অপেক্ষা করি।

একইরকম ঘর। কেবল এর সামনের বারান্দাটা সরু, মাথায় চালা আছে। সামনে ক্ষেতি বাগিচা। পাহাড় দূরে। পেম্মা এসে আমাকে ওপরে নিয়ে যায়। দোতলার ঘরটি সেই ইয়েশি আনির বাড়ির পুজোর ঘরের মতোই। ছোট। খুব আলো আছে, মস্ত জানলা। একদিকে পুজোর ব্যবস্থা। কাঠের বেদীতে বুদ্ধমুর্তির সামনে রূপোর বাটিতে জল রাখা। দেবদেবীর তাংখা অনেকগুলি ঝুলছে, ঘিয়ের প্রদীপ, ধূপ জ্বলছে।

এক বৃদ্ধ সেখানে বসে বসে সুর করে পুঁথি পড়ছেন। ভারি সুন্দর দৃশ্য। আমাকে নমস্কার করলেন।

তার পাশে, ঠাকুর দেবতাদের দিকে পাশ ফিরে জানলার দিকে মুখ করে এক তরুণ আপন মনে ছবি আঁকছে, সামনে একটা বড় পেতলের থালায় অনেক বাটি বাটি ভর্তি মাটির রং গুলে রেখেছে। তুলি রেখে দু-হাত তুলে নমস্কার করল, লজ্জা-লজ্জা হেসে।

দুটি ছবি সে আঁকছে একসঙ্গে।

দুটিতেই যেখানে যেখানে নীল রং লাগানোর, সেই কাজটি করছে। নীল রং দিয়ে জায়গাগুলো ভরা। একটি তাংখা মহাকালীর, অন্যটি গৌতমবুদ্ধের ছবি। অত্যন্ত সুন্দর লাগল আমার। এর দাম কত? পেম্মা জেনে নিয়ে বলল চল্লিশ টাকা। এ টাকা তক্ষুনি দিতে চাইলুম—কিন্তু লৌ ছং (ছেলেটির নাম তাই) নিল না। বলল, অর্ডার দিয়ে যান পরে এঁকে দেব। এগুলো অর্ডারি মাল, আর্টস এন্ড ক্রাফ্টস সেন্টারের জন্য। (সেখানে এই তাংখার দাম দেড়শো। সে কথা কি লৌ ছং জানে না?) এখানে ক্যামেল রং-এর চিহ্ন দেখা গেল না।

পেম্মা জানায় লৌ ছং-এর বাবা তুন্‌ড্রলা বড় বৃদ্ধ হয়েছেন আর তুলি ধরতে পারেন না, তাই দিন রাত পুজো আচ্চা পুঁথিপাঠ নিয়ে আছেন। লৌ ছং উপযুক্ত পুত্র হয়েছে সে উপার্জন করে বাবাকে খাওয়ায়, স্ত্রী পুত্রের ভরণ-পোষণ করে। ওর মা নেই। ছবি এঁকেই লৌ ছং-এর বাবা সংসার চালিয়েছেন, লৌ ছং-ও তাই চালাচ্ছে। লৌ ছং আমাদের চা খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আমি ওর কাজে বিঘ্ন করতে চাইলুম না। ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লুম। এবার ফিরতে হবে।

দূর মেরা মনজিল

ব্যাগসমেত দাঁড়াতে হবে সেইখানে, যেখানে এ ডি সি-র জিপ এসেছিল। বার বার করে হাত ধরে বিদায় নিলুম লামার পরিবারের কাছে। এতটা সহৃদয়তা, ভাষা ছাড়াই যেটা অন্তরে পৌঁছে যাচ্ছে, তার মূল্য দেবার মতো কোনওই সম্পদ নেই আমার শহুরে ঝুলিতে, আমার ‘ফুটানিকা ডাব্বা’তে।

উড়কিন খামো লাফাতে লাফাতে এল আমাদের পেছন পেছন বড় রাস্তা অবধি, কারমো আর কিন্দন নিজের বাড়ির চৌকাঠেই বিদায় দিলে।

ওরাও আমাকে খাদা দিয়েছে, আর ফল দিয়েছে।

রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, অনেকে এসে পেম্মার কাছে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে ব্যাপার কী? এখনই চলে যাচ্ছে কেন তোমার অতিথি? ওই তিনজন তিব্বতি লামার মতো থাকবে না এখন আট-দশ মাস?

হঠাৎ হর্ন দিয়ে শান্ত স্তব্ধ পাহাড়ি বিকেলটাকে চমকে দিয়ে ট্রাক এসে পড়ল। বাস নয়! বাস মেলেনি, ট্রাকেই যাওয়া

সুভাষবাবু বেরিয়ে এলেন।

–“কই, ব্যাগ-ট্যাগ কই? ভাবলুম বুঝি এবার আন্নি হয়ে আন্নি গুম্ফাতেই চলে যাবেন বুঝি!”

—”সে কপাল করলে তো? কই, কুকুরছানা কই? ভুলে গেছেন?”

—”সে কপাল করলে তো? ভুলব কী? এ ডি সি, ই এ সি এম ও, এ ডি সি-র ড্রাইভার, প্রত্যেকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। ডক্টর সেনের কুকুরছানাটা নিয়ে যেতে হবে কিন্তু—দু-দিনের জন্যে এসে কেন যে আপনারা মায়া বাড়ান ম্যাডাম। চলুন চলুন উঠে পড়ুন দেরি হয়ে যাচ্ছে—”

—”কই? কই? কুকুরছানা দেখি?”

—”কোনটা?”

—”মানে?”

—”দুটো এনেছি। একটা লাসা আসো আছে। ওগুলোই লোকে কেনে। তিব্বতি হাউন্‌ড তো সভ্য অঞ্চলে কেউ দেখেনি। ওরা চমরী পাহারা দেয়। এখানে সরকারি আপিস পাহারা দিচ্ছে। তাই আপনি জানতে পারলেন।”

—”লাসা আপসো সেই বেঁটে গুড়গুড়ে লোমঝুলঝুলেগুলো? ও আমার ভাল লাগে না। ওদের মোটেই আত্মবিশ্বাস নেই, কেবল খিটখিট করে। কামড়াতে যায়। বেড়াল-বেড়াল কুকুর আমার পছন্দ নয়। বেড়াল হবে বেড়ালের মতো, আর কুকুরের মতো কুকুর।”

—”তা হলে তো খুব ভাল। ওরা অন্যটাই চাইছিল–প্লেসে নিয়ে চারশো টাকায় বেচতে পারবে। বলছে অবশ্য পুষবে।”

–“কারা?”

—”এই গাড়িতে এক ড্রাইভার যাচ্ছে কিনা আমাদের, ফ্যামিলি নিয়ে, ছুটিতে। একটা কুকুরছানা সে নেবে। আপনার প্রথম চয়েস ছিল।”

—”আমি আমারই নেব।”

গোল একটা উলের বলের মতো নরম গরম তুলতুলে জিনিস ট্রাকের ওপর থেকে কেউ আমার কোলে ছুড়ে দিল। কোলে নিয়ে ট্রাকে উঠলুম। সে ছোট্ট জিভ বের করে আমার হাত চেটে দিয়ে, কাজল-পরা চোখে চেয়ে রইল। পিছনে পড়ে রইল সাম্প্রং গুম্ফার মানুষখেকো ঝিল আর প্রাণদায়িনী ঝর্না, লৌ ছং আর তার তুলি, পেম্মা খাণ্ডু আর তার পাকা পীচফলের মতো বউ। ট্রাকের ধুলোয় গ্রামটা মুছে গেল, স্বপ্নের মতো। বাঁক ফিরতেই বন।

গোধূলির আলো লয়ে দুপুরে সে করিয়াছে খেলা

ঝিমিয়ে পড়েছিলুম, একটুখানি। সুভাষবাবু বললেন—”ওই দেখুন পেছনদিকে তাকিয়ে। কে আপনাকে বিদায় জানাচ্ছে।”

তাকিয়ে দেখি দূরে আশ্চর্য এক দৃশ্য। বন-পাহাড়ির মাথার ওপরে অনেক উঁচুতে মুকুটের মতো ঝলমল করছে সূর্যের আলোয় সাদা রঙের তাওয়াং গুম্ফা। হঠাৎ মন কেমন করে উঠল। জন্মের মতো বিদায়, তাওয়াং। আরেকটা মন বলল, ক্যা হ্যায় তুম্হারা, মুসাফির?

ট্রাক নেমে যাচ্ছে। পথের পাশে একরকম ছোট ছোট গাছের জঙ্গল—”এ সমস্তই রডোডেনড্রনের বন! যখন ফুটবে, না? একদম পাগল করে দেবে রঙে রঙে—”

—”এত ছোট ছোট গাছ?”

—”এখানকার জাতটা ওইরকম, বেঁটে জাত— “

আরেকটা বাঁকে আরেকবার চেঁচালেন সুভাষবাবু—”দেখে নিন! লাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল ভিউ—আর তাওয়াং গুম্ফা দেখা যাবে না—এই শেষ।”

এবার আরও দূর থেকে। আরেকটা বিকেল গড়িয়েছে। আলোর রংটা অস্ত-সূর্যের, তাওয়াং গুম্ফাটা যেন তামা দিয়ে তৈরি মনে হচ্ছে।

এবার আরও মন কেমন করা। দুটো পাহাড় পেরিয়ে। এখনও রাজকীয়। তাওয়াং ক্রমশ দূর হয়ে যাচ্ছে, অবাস্তব হয়ে যাচ্ছে, এর পরে নিশার স্বপন হয়ে যাবে।

হিন্দি চিনী ভাই ভাই

—”এই ঝর্নাটা, বুঝলেন, লাল রঙের হয়ে গিয়েছিল যুদ্ধের সময়ে। এখানে তখন রক্তগঙ্গা বয়েছিল। আরেকটু নীচে, বাঁধের গায়ে মৃত সৈন্যের বডিতে বডিতে দেওয়াল গড়ে উঠেছিল। উঃ কী দিনই গেছে!”

সবুজ ঢালের গায়ে ছবির মতো শান্ত সব গ্রাম। গ্রাম আর ঝর্না, নদী, আর কাঠের সেতু। এসব যাবার সময়ে দেখা হয়নি, অন্ধকার ছিল।

—”আমরা রূপার পথ ধরে যাব।”

“রূপা? কী সুন্দর নাম।“

—”সুন্দর নাম, সুন্দর শহরও। আমাদের মোরারজি আসছেন তো ওখানে। উনি অবশ্য প্লেনে আসবেন। “

—”এ অঞ্চলে চিনে সৈন্যেরা এসে দখল নিয়েছিল?”

—”নেয়নি? বমডিলা পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল না? তবে কী জানেন, এখানে আজ যদি আবার চিনেরা আসে, গাঁয়ের লোকেরা ওদের মাথায় করে রাখবে।”

—”সে কী কথা? এই না বললেন মেরে রক্তগঙ্গা করেছিল?”

—”সে তো সিবিলিয়ানদের নয়। গাঁয়ের লোকেদের সঙ্গে অত্যন্ত সদ্ব্যবহার করেছিল। প্রথমেই মিন্টু লুঠ করে, তারপর মুঠো মুঠো টাকা গাঁয়ের লোকদের মধ্যে বিলি করে—ব্যস, গরিবলোক তো ওদের কেনা হয়ে গেল!”

মুখ খুললেন আরেকজন ভদ্রলোক, আমাদের তৃতীয় সঙ্গী,—”শুধু টাকা বিলিই তো নয়, র‍্যাশন? এসেই র‍্যাশন বিলি করেছে। নিজেদের মিলিটারি র‍্যাশন পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছে ওদের মধ্যে।”

—”আর মেয়েদের সঙ্গে ব্যাভার? সেদিকটাও দেখবার মতন। একটাও মেয়েকে বেইজ্জতি করেনি।”

—”বাচ্চাদের হাতে লজেন্স বিস্কুট তুলে দিয়েছে। কিছু লুঠপাট করেনি।”

—”আর আমাদের জোয়ানরা? সে আর বলে কাজ নেই—

—”এ যে শুনছি সেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার গল্প—শত্রুপক্ষ জাপানিরা এসে, মণিপুরে অসামান্য ভাল ব্যবহার করে লোকাল পিলের মন কেড়ে নিল, আর দেশভক্ত আই এন এ সৈন্যদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে লোকজন খেপে উঠল —”

—”কেন, বাংলাদেশের যুদ্ধের সময়?”

—”হলে কী হবে, কথাগুলো তো বলা চলবে না। বললেই লোকে বলবে দেশদ্রোহী। বদমাশ।”

যাবার সময়েই দেখেছিলুম নুরুয়ানাঙ-এ রাস্তার ধারে একটা ভাঙা ছোট এরোপ্লেন পড়ে আছে। এরা কেউ জানে না ওটা ১৯৪২-এর, না ১৯৬২-র। বেশ চকচকে নতুন নতুন দেখতে। কাদের, কে জানে?

দ্বা সুপর্ণা

পথের রূপ অনবরতই পালটাচ্ছে—রূপার কাছে এসে পথ দু ভাগ হয়ে যায়। রূপার দিক দিয়ে যেতে দিল না। মোরারজির জন্য প্রেপারেশন হচ্ছে—

—”একটু ঘুরে আসি? একটু উঁকি মেরে আসি? আবার না-হয় এই রাস্তা দিয়েই যাব”—বহু সাধ্য-সাধনা করতে, মিলিটারি পুলিশ কী মনে করে একটু হেসে নম্বর টুকে রেখে যেতে দিল!—”এখুনি ফিরবে কিন্তু!”— আমাকে ‘রূপা’ দেখানোর জন্যেই এত কাণ্ড। এঁরা সবাই বহুবার দেখেছেন।

একচক্কর ঘুরিয়ে আনা হল ট্রাক রূপার বড় রাস্তা দিয়ে। তারপর দিরাং-এর রাস্তা ধরা হল। নিজেদের ট্রাক, তাই। হত যদি আমার একটা র‍্যাশনট্রাক, বেরিয়ে যেত ইচ্ছেমতো ঘোরা।

কোলের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে, ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে ভুক্‌ভুক্ করে অপদেবতা তাড়াচ্ছে বুম্‌লা তাওয়াং। ওর নাম দিলুম বুম্‌লা তাওয়াং। যাওয়া তো হল না বুমলা পাস দেখতে। একটু দেখা, আর একটু না-দেখায় মেশানো একটা মুগ্ধ স্মৃতি—খানিকটা পাওয়া বাকিটা চাওয়ায় আটকে থাক।

—”দিয়াং জং-এ রাতটা কাটাব আমরা। আই বি-তে ঘর ঠিক করা আছে। একটা ঘরে ছেলেরা, অন্য ঘরে মেয়েরা। অর্থাৎ হরি ড্রাইভারের বউ, বাচ্চা আর ডক্টর সেন! ডক্টর সেনের কোথাওই কোনও অসুবিধা হবে না, সেটা আমি বলতে পারি, তবে বিহুরানীর হতেও পারে। হঠাৎ, একজন ডক্টরেটের সঙ্গে—”

–“বিহুরানী? অসমিয়া?”

—”উঁহু! বিহারি ড্রাইভার, বিয়ে করেছে এক বাঙালিকে। বাঙালি মেয়ে অসমিয়া নাম, বিহুরানী।“

—”বাঙালি মেয়ের অসমিয়া নাম আর বিহারি স্বামী? বাঃ।”

—”এবং তিব্বতি কুকুর!”

—”তারা কোথায়?”

—”ওই তো ট্রাকেই, পিছনদিকে। “

নদীর পাশ দিয়েই পথ, তবু অনেক দূর থেকে খুব সুন্দর আরও একটা নদীর ধার দেখা যাচ্ছে—”ওটা কোন জায়গা? খুব চওড়া আর খুব তেজি নদী একটা—”

—”এই তো দিরাং।”

—”এরা বড্ড সংস্কৃত-সংস্কৃত নাম দেয়। সব কিছুই অনুস্বারে শেষ, তাওয়াং, কামাং, দিরাং, জাং, সাম্প্রং? এসব শব্দের কি কোনও মানে থাকে? না শুধু ধ্বনিসর্বস্ব?”

—”মানে থাকে বই কী। তাওয়াং শব্দেরই তো তিনটে মানে—”তা’ মানে ঘোড়া, আর ‘ওয়াম’ মানে—যেখানে ভালভাবে পালন করা যায়—অর্থাৎ আস্তাবল।”

—”আরেকটা মানে আছে, তা’ থেকে নেমে দেবতা এদের ‘অং’ করেছিলেন অর্থাৎ ঘোড়া থেকে নেমে আশীর্বাদ করেছিলেন, তাই তা-অং নাম।”

—”আর তৃতীয় মানে হচ্ছে তান্ত্রিক দেবতা তাদ্রিন এখানে বেড়াতে এসে মোম্পাদের যত্নে প্রসন্ন হয়ে ওদের কষ্ট যাতে লাঘব হয় তাই বর দিয়েছিলেন। কী বর? ঘোড়া! তার আগে এদের ঘোড়া ছিল না। সেই থেকে জায়গাটার নাম তা-অং, অর্থাৎ ঘোড়া-রূপ আশীর্বাদ।”

—”বুঝলুম, রূপক কর্মধারয়? এবার বলুন দিরাং মানে কী? ওই নাম কেন?”

—”দিরাং? দিরাং নাম তো ওই নদীর নামে। দিরাং নদীর ধারের গ্রাম তো?”

–“দিরাং নদীরই বা নাম দিরাং কেন?”

—”দিরাং শব্দের মানে দুটি পাখি।”

—”দুটি পাখি? বাঃ! কী নাম!“

.

দ্বা সুপর্ণা?

একটি পাখির খুঁটে খাওয়া আরেকটি চোখের চাওয়া।

একটি ভোগী, আরেকটি যোগী।

দিরাং নদীর যেমন তেজ, তেমনি রূপ।

পার্বত্য বেগ, আর উপত্যকার ব্যাপ্তি দুটোই ধরে ফেলেছে, দিরাং নাম ভুল হয়নি।

আমার মধ্যেও কি অমন দুটো পাখি নেই? ওই দুটো পাখিই—?

একটি প্রপাত, আরেকটি সরসী?

একটা কেবল নুড়ি কুড়িয়ে জড়ো করে, পাতা কুড়িয়ে জড়ো করে। আরেকটা হাল ছুঁড়ে ফেলে পাল ছিঁড়ে ফেলে নৌকো খুলে দেয়।

একটা কেবলই জড়িয়ে ধরে, আরেকটা কেবল ছেড়ে যায়।

—”যাকে ছেড়ে এলেম,
তাকে নিচ্ছি চিনে।
সরে এসে দেখছি
আমার এতকালের সুখদুঃখের ঐ সংসার
আর তার সঙ্গে
সংসারকে পেরিয়ে কোন্ নিরুদ্দিষ্ট।”

কোলের মধ্যে শুয়ে, স্বপ্ন দেখন্ত বুম্‌লা তাওয়াং ভুক ভুক করে বললে : ছাড়তে আর শিখলে কোথায়?

জড়াচ্ছই তো কেবল।

তাওয়াংকেই কি ছেড়ে যেতে পারলে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *