ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে – ২

কে যাবি পারে

—”সঙ্গী? সঙ্গী আমি কোথায় পাব? আচ্ছা, এই শীলাকেই জিজ্ঞেস করে আসি, দাঁড়ান। বেশ উৎসাহী মানুষ যদি যেতে রাজি হন?”

শীলা প্রথমে খুবই অবাক হয়ে যায়। তারপরে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, শেষে একটু বিরক্তও, বোধ হয়। তার স্বামী-পুত্রের সামনে প্রধানা অতিথির এ কী পাগলামি বলো দেখি? এতে কি মহিলা সাহিত্য সভার প্রেস্টিজ থাকে? স্বামী-পুত্রের কী ধারণা হল? তারা কি চোখের কোনাচ দিয়ে হাসবে না? ঠাট্টা তামাশা করবে না কি পরে? অগত্যা আমাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বলেন, “হঠাৎ তাওয়াং যাবেন কেন? খুবই অসুবিধের রাস্তা, তা ছাড়া খুবই ঠাণ্ডা, আপনার সঙ্গে তো কেবল একখানা কম্বল দেখতে পাচ্ছি। আমার বাড়িতে এখন নানান অসুবিধে, এতদিন সাহিত্য সভা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিলুম বলে বহু কাজ জমেছে, ছেলেরও পড়াশুনো আছে, আমার তো এখন কোথাও যাবার সুবিধে হবে না। কে যাবেই বা আপনার সঙ্গে? তা ছাড়া ওভারকোট চাই, মাফলার চাই, বাঁদরটুপি চাই, দস্তানা চাই, উলের মোজা, জুতো, মোটা সোয়েটার, গরম গেঞ্জি, গরম ইজের, যেতে হলে কত কী চাই। এ সব কি এখন কিনবেন আপনি? বহুত খরচের ব্যাপার। এতকাল বিদেশে ছিলেন যখন, নিশ্চয়ই আপনার ঘরেই একপ্রস্থ আছে এ সব। অবশ্য জানি, লেখক-কবি-টবিরা একটু একসেনট্রিক হয়। তা বলে এতখানি? তাওয়াং-এ আপনার তো সত্যি কোনও জরুরি দরকার নেই? তার চেয়ে চেপে দশদিনই বসে থাকুন দিকিনি তেজপুরে? বরং ডিব্রুগড়ে বেড়াতে যান কি দুলিয়াজানে ঘুরে আসুন। নীতির কাছে তো নেমন্তন্নই আছে আপনার। দেখবেন অয়েল ইন্ডিয়ার ব্যাপার স্যাপারই কেমন আলাদা? খুব আরামে রাখবে, খুব যত্ন আদর করবে। তা ছাড়া আপনার শরীরও ভাল নয়। দিনে চোদ্দোবার তো ওষুধ খাচ্ছেন, দেখছি। তাওয়াং-এ যাওয়ার কথা কে ঢোকাল বলুন তো হঠাৎ আপনার মাথায়? ও ভাবনাটা ছেড়ে দিন।”

শীলা এত যত্ন করে নিয়ে যাচ্ছে তেজপুরে তার কাছে বেড়াতে, তার সঙ্গে ঝগড়াও করতে পারি না। অথচ আমার “উঠল-বাই-তো-কটক-যাই” স্বভাব। একবার যখন ভেবেছি যাব, তখন আন্তরিক চেষ্টাটা করে দেখব। নেহাত না হলে, তখন হবে না। তা বলে অন্যের কথায় ছেড়ে দেব না। নিজেই শীলাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি—”না না আপনাকে সঙ্গে যেতে হবে না, কিন্তু আপনার কি ওভারকোট আছে? এবং অথবা মোটা সোয়েটার? কিংবা বাঁদুরে টুপি?”

শীলা অবাক হয়ে গিয়ে বলেন—”ওভারকোট? আছে। বাঁদুরে টুপি নেই।”

—”কোটটা আমাকে ধার দেবেন? ঠিক ফেরত পাবেন, যদি বেঁচে থাকি।”

—”ও কী অলুক্ষুণে কথা। ফেরত পাব না কেন? কোট নিশ্চয়ই ধার দেব। কিন্তু যাওয়াটি বাদ দিলেই ভাল হত না?”

—”ইনারলাইন পারমিটের জন্য ইটানগরে যেতে হবে শুনছি, কী উপায়ে যাই বলুন তো?”

—”ইটানগরে যাবার কোনও দরকার নেই”–এতক্ষণে কথা বলেন শীলার স্বামী মিস্টার বরঠাকুর।—”ওটা তেজপুরেই পাওয়া যায়, অরুণাচলের এ ডি সি-র অফিস থেকে। আপনার চাই? আমি ওদের চিনি, বলে দেব।” আমি তো হাতে চাঁদ পেয়েছি। নেহাত নিজে পরস্ত্রী, না হলে মিস্টার বরঠাকুরকে জাপটে ধরার একটা প্রেরণা এসেছিল। এতক্ষণ গাড়িতে ওঁর বা ওঁর ছেলের সঙ্গে একটাও প্রায় কথা হয়নি। দুজনের কেউই বিশেষ বাক্যবাগীশ নন। কিন্তু স্ত্রীর ব্যাপারে অক্লান্ত সহযোগ দেখেছি সভার সময়ে। কিশোর ছেলেটিও খুব খেটেছে, খাবারদাবার পরিবেশন করেছে, গাড়ি চালিয়ে বারবার ট্রিপ দিয়ে অতিথিদের যাতায়াতের সহায়তা করেছে। শীলা সত্যি খুব সুভগা। স্বামী সন্তানের কাছে সাধারণত বাড়ির বাইরের শখের কাজে গৃহিণীরা মোটেই সহায়তা পান না। পান টিটকিরি। কিন্তু শীলা বরঠাকুর সপরিবারেই সভাটি “তুললেন।” বেশি পুরুষমানুষ স্বেচ্ছাসেবক অবশ্য দেখিনি। মেয়েরা খেটেছে প্রচুর।

—”তাওয়াং যাওয়ার আইডিয়াটা ছেড়ে দেয়াই ভাল”–শ্রীবরঠাকুর বললেন—”তবে প্রয়োজন হলে বলবেন, ইনারলাইনের পারমিটের জন্যে বলে দেব।”

জিপের ভদ্রলোক বললেন—”সঙ্গী না পেলে ওঁর কোটটা দিয়ে কী করবেন? একা ও পথে ট্রাভেল করার প্রশ্নই নেই। তাওয়াং অবধি যাবেনই বা কীসে? উঠবেন কোথায় গিয়ে? সব বন্দোবস্ত তেজপুর থেকেই করে বেরুতে হবে। আমার সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে বমডিলা গিয়ে লাভ নেই। লোকাল বাস যায় তো তেজপুর টু বড়িলা। বাসেই যেতে পারেন। ফার্স্ট, মেক প্রপার অ্যারেঞ্জমেন্টস, ক্লিয়ার, কমপ্লিট অ্যান্ড ফিক্সড অ্যারেঞ্জমেন্টস। তারপরে বেরুবেন। আগেভাগে বম্‌ডিলায় গিয়ে লাভ কী আপনার? স্ট্র্যানডেড হয়ে মাঝপথে বসে থাকবেন?” অত উপদেশ ভাল্লাগে না ছাই। আমার যা খুশি, আমি তাই করব। তোমার জিপে না গেলেই তো হল? তোমার বাড়িতে গিয়ে না উঠলেই তো হল? যাব না রে বাবা, যাব না। আমি নিজের মতন নিজে নিজে যাব। তোমাদের ঘাড়ে পড়তে বয়ে গেছে আমার। স্ট্যানডেড হলেও যাব না, নিশ্চিন্ত থাকো। মনে মনে গজগজ করে এইসব খারাপ কথা বলি। আর মুখে বলি— “থাক থাক, আপনারা আর বৃথা এত ভাবনা করবেন না আমার জন্যে। ও যা হোক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে’খন। সুবিধা হয় তো যাব, না হলে যাব না। এত ভাবনার কী আছে? ওই দেখুন, ঘাট এসে গেল।” সত্যি তরী এবার ভিড়ছে—”ওই তেজপুর! ওই তো তেজপুর!” রব উঠল ডেকে।

—”আমার ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখুন তেজপুরের-পরশু বেলা একটায় বেরুচ্ছি। কালকের মধ্যে যদি আপনার সব ব্যবস্থা হয়ে যায়, তবে জানাবেন।” ভদ্রলোক এক টুকরো কাগজে নম্বর লিখে এগিয়ে দেন। যত মন্দ ভাবছিলুম, অত মন্দ নন নিশ্চয়। তাওয়াং বিষয়ে তো প্রচুর খবর রাখেন। ওঁর আলোচনা শুনে আমি অনেক কিছু শিখেছি, উৎসাহও বেড়েছে যাত্রার। ফোন নম্বরটি তুলে রাখি।

আলো হৃদয় হরা

তেজপুর এসে গেছে, আমরা নৌকো ছেড়ে, বালি পেরিয়ে এসে পাড়ে উঠি। হলুদ পর্দা উড়িয়ে জিপটা চলে যায় বালি পার হয়ে। শীলা বলে, “এখন আপনাকে একজনদের বাড়ি নিয়ে যাব, ওঁদের টেলিফোনে বলা আছে, ওখানেই আপনি থাকছেন। ওঁরা বাঙালি, কিন্তু তেজপুরে তিন-চার জেনারেশন ধরে বাস। আপনার লেখা ওঁরা খুব ভালবাসেন। ওখানে না থাকলে আমার ওপরে রাগ করবেন ওঁরা। তাই ওখানে নিয়ে যাচ্ছি। আমাকে ভুল বুঝছেন না তো? আমি কিন্তু খুবই খুশি হতুম, দু-একদিন বাদেই যদি আপনি আমার কাছে চলে আসতেন, ঘরদোর একটু গুছিয়ে নিতুম তারই মধ্যে। অনেকদিন তো গৃহছাড়া, অগোছালো হয়ে আছে সমস্ত। আপনার অসুবিধে হত।”

হায় রে! আমার আবার অসুবিধে? কিন্তু শীলা বরঠাকুর জানবেন কেমন করে যে আমার অগোছালো গৃহস্থালীতে আজকাল কোনওই অসুবিধে হয় না। ওঁর নিজেরই হত। অতিথি-আপ্যায়নের মতো মানসিক প্রস্তুতি আর বাকি ছিল না, এই সম্মেলনে অতিথিদের তো কম আপ্যায়ন করতে হয়নি বেচারিকে!

উদ্যোগপর্ব

—”নিয়ে এসেছি ডঃ দেবসেনকে। আমরা কিন্তু আর বসব না। এই যে, এই আমাদের মিসেস বোস, ইনি প্রফেসর বোস-

—”নমস্কার।”

—”এসো, এসো। তোমার কুম্ভমেলা জাস্ট পড়ে শেষ করলাম। দারুণ! কিন্তু তোমার প্রবন্ধেরও আমি…”

—”হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ…”

—”কেমন জমল জোড়হাটের সাহিত্য সভা?” এ প্রশ্নটি শীলাকে।

—”দারুণ। তবে খুব পরিশ্রম গেছে।”

—”চলুন, ভেতরে চলুন। মিস্টার বরঠাকুর এক্ষুনি চলে যাবেন কি, চা-টা, কফি-টফি কিছু একটা তো খেয়ে যাবেন? ক্লান্ত হয়ে এসেছেন, এতদূর রাস্তা-“

—”এখন থাক, বাড়িতে কাজ আছে, পরে একদিন আসব, থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ” বরঠাকুরেরা বসলেন না।

দু-মিনিটের মধ্যেই প্রফেসর বোস আর মিসেস বোস হয়ে গেলেন দাদা আর আলোদি। একটু বাদে মনুমেন্টের মতন লম্বা, এক মাথা ঝাঁকড়া চুলওয়ালা, স্কুলে পড়া ছোট একটা ছেলে এসে হাজির—সে আবার আসামের জুনিয়র টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ন। শমী চোখের পলকে মাসি বানিয়ে ফেললে আমাকে। আলোদির ঝকঝকে তকতকে প্রায় জার্মান হাউসওয়াইফদের মতন টিপটপ অহংকারী সংসারে মুহূর্তেই আমার একটা পার্মানেন্ট ঠাঁই হয়ে গেল। যেন তেজপুরেই আমার এত বছর কেটেছে, এমনি করে আলোদির খাটে শুয়ে শুয়ে আড্ডা মেরে, কিংবা টিনটিনের কমিক মুখে কোলের কাছে চিৎপটাং হয়ে শোওয়া শমীর চুলে-বিলি-কেটে- দেওয়ার হুকুম তামিল করে।

মুশকিল হল তাওয়াং নিয়ে। দাদা সত্যিই বয়সে অনেকটাই বড়, আর স্বভাবটা উদ্বেগ করার। এবং স্নেহপ্রবণ। এবং আগলে রাখার। তেজপুরের খানদানি ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাঁরই বাড়িতে বসে তাঁর মতটা চট করে ফেলেও দেওয়া যায় না। এ-হেন প্রফেসর বোসের মোটেই ইচ্ছে নয় আমি তাওয়াং যাই। আলোদিও চান না এ সব রিস্কি ব্যাপার। একমাত্র শমীর মহা উৎসাহ। অবিশ্যি সে সঙ্গে যেতে পারবে না, সামনেই টেস্ট পরীক্ষা আছে না? কিন্তু মরাল কারেজ জুগিয়ে যেতে লাগল সে :

—”কেন মাসিকে যেতে দিচ্ছ না তোমরা? মাসি কি তোমাদের মতন? ম্যাটারহর্নে চড়তে গিয়েছিল। আমি আনন্দমেলায় পড়েছি না? (অবশ্য পারেনি চড়তে। মুরগির খাঁচাতে ঢুকে পড়েছিল তার বদলে!) কুম্ভমেলায় ওকে যেতে কি দিতে তোমরা? নিশ্চয় দিতে না। কেউ তা হলে ওই লেখাটা পড়তে পেত? নিজেরাই তো খালি খালি বলছ, ইস কী দারুণ লিখেছে। (আমি অবশ্য এখনও পড়িনি)” তাতেও যখন কাজ দিচ্ছে না, তখন—

—”তোমরা কি মাসির গার্জিয়ান? মাসি একটা অ্যাডাল্ট। প্রধান অতিথি হতে পারছে, আর তাওয়াং যেতে পারবে না? তোমরা ওকে গ্রোন-আপ-ট্রিটমেন্ট দিচ্ছ না—আমাকে যেমন গাড়ি চালাতে দাও না ঠিক তেমনি। মাসি, তুমি যাও বরং বরঠাকুরদের বাড়ি থাকো গিয়ে। ওখান থেকে তাওয়াং যাও। এদের সব চেনো না তো? ভেরি ডিফিকাল্ট পিপল। তোমাকে এইসা শেলটার করে রাখবে—লাইফ একদম হেল করে ছেড়ে দেবে।”

এবারে আলোদি খুব আপত্তি করলেন।

“আমি কি বলেছি যেও না? আমি কেবল বলেছি, খুবই রিস্কি ব্যাপার। তোমার বাবাই কেবল আপত্তি করছেন।”

তা তিনি করছেন।

—”যতই জ্ঞানীগুণী হও না কেন”, তিনি বললেন, “একদম একা একা, পাহাড়ি ট্রাইবালদের মধ্যে, আর মিলিটারিদের মধ্যে—না, সেটা অ্যাডভাইজেবল নয়। সেখানে কেউ তোমাকে প্রধান অতিথি করেনি তো! মেয়েমানুষ, হাজার হোক। বয়েসটাও ডেনজারাস। বাপের বাড়ির কি শ্বশুরবাড়ির কেউই এখানে নেই—এখানে তো আমরাই আত্মীয়ের মতো। না, এটা খামখেয়ালি কথা। কুম্ভমেলা আর এটা এক নয়। সেখানে সবাই পুণ্যার্থী। পরিষ্কার মন নিয়ে একই উদ্দেশ্যে গেছে। সেখানে দল তৈরি হয়ে যায় আপনা আপনি। এখানে কেউই যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, কেউই কদাচ যায় না। এটা তীর্থস্থানও নয়, টুরিস্ট রিসর্টও নয়। একটা গডফরসে প্লেস, রিজার্ভড এরিয়া, কেবল আর্মি আর ট্রাইবালস আর লামারা থাকে। তারা অত্যন্ত আনপ্রেডিকটেবল। একে হিলস পিপলরা জন্মে স্নান করে না। তা ছাড়া ওখানে ওরা বিদেশি টুরিস্ট দেখতে অভ্যস্তও নয়। দে আর নট ইউজড টু ভিজিটর্স। ট্রাইবালদের নিয়মকানুনও ছাই আমরা কিছু জানি না। কখন কাকে তুমি অফেন্স দিয়ে ফেলবে তার ঠিক নেই। নিল হয় তো ঘচাং করে মুণ্ডুটা খুলে, কোথায় আর্মি গ্রাউন্ডসে ট্রেসপাস করে বসবে, দিল হয়তো গুড়ুম করে গুলি চালিয়ে। না না ও সব রিস্কের মধ্যে—

বাধা দিয়ে আলোদি হঠাৎ বলে বসলেন-

—”মুণ্ডু কেটে নিল, কি গুলি চালাল, সে সব তো পরের কথা। আগে তো যেতে হবে! যাবে কেমন করে? ট্রেন নেই, প্লেন নেই, গাড়ি নেই, ঘোড়া নেই। যাব বললেই তো হল না। যাবার উপায়টা কী? উপায় নেই। যাওয়া হবে না।”

আমি হাঁ হাঁ করে আপত্তি জানাই :

—”বম্‌ডিলা পর্যন্ত বাস যায় রোজ। ওখান থেকে একটা কিছু জোগাড় করে নেব। নট টু ওয়ারি। কিন্তু প্রথমে চাই পারমিট। এখানে অরুণাচলের এডিসির আপিসটা কোথায়?”

—”আমি চিনি!” শমী লাফিয়ে ওঠে।

—”চিনি আমিও।” গজগজ করে দাদা বলেন।

—”ওই তো, অমুক জায়গাটার ওপাশে না?” বলেন আলোদি।

—”সবাই যখন চেনেন, তখন চলুন, যাওয়া যাক?”

—”যাই বললেই হয় না। এখন ড্রাইভার কই? তা ছাড়া আপিস বন্ধ হয়ে গেছে। পাঁচটা বেজে গেছে কখন। “

এমন সময়ে এলেন এক পরমাসুন্দরী মহিলা।

—”তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেই এলাম”, তিনি বললেন। আলোদি পরিচয় করিয়ে দিলেন—”ডঃ প্রবোধচন্দ্র সেনের মেয়ে।—বুঝলে তো? তোমাদের শান্তিনিকেতনের লোক। আমাদের ইলাদি।”

সত্যি চমৎকার মানুষ ইলাদি। দু-মিনিট পরেই—”আপনার বাঁদুরে টুপি আছে?”—এই প্রশ্ন শুনে মোটেই অবাক হলেন না। “বাঁদুরে টুপি? আমার নেই, তবে আমার শ্বশুরমশাইয়ের আছে। কেন বলো তো?”

—”আর কেন? বলেন কেন!” ইলাদিকে বোঝাতে বসলেন আলোদি—”পাগলামির চূড়ান্ত। বলে কিনা, তাওয়াং যাব। মনাস্টারি দেখব। না আছে আগের থেকে ব্যবস্থা, না আছে পোশাক-পরিচ্ছদ, না পারমিট, না কোনও চেনাশুনো লোক। ওইজন্যেই বাঁদুরে টুপি চাইছে। দেবেন না, খবর্দার দেবেন না।”

—”না দিলে “শালমুড়ি দিয়ে হক্ষ’ হয়ে চলে যাব। দস্তানা আছে? গ্লাভস?”

—”শ্বশুরমশাইয়ের আছে বটে। বুড়ো মানুষ, খুব শীতকাতুরে। উলের দস্তানা পরেন।”

—”বাঃ! বাঃ! চমৎকার। ওতেই হবে! বেশ! বেশ! এবারে সোয়েটার!”

—”তুমি আমার সোয়েটারগুলোই পরে যেয়ো মাসি; আমার অনেক আছে। মা প্রত্যেক বছর বুনে দেন।” শমী রেডি।

—”বাবার হাতকাটাটা, আমার পুলোভারটা, শীলা বরঠাকুরের কোট”, শমী গুনতে থাকে—”ইলামাসির শ্বশুরমশায়ের টুপি, আর দস্তানা”-

—”আর জুতো মোজা? তোরটাই দে বরং। পরে যাক—” আলোদি বলেন।

—”আমার?”—শমী চেয়ারের তলা থেকে দেড় ফুট লম্বা একটি শ্রীচরণ বের করে সিরিয়াসলি চোখ কপালে তুলে বলে—”আমার জুতো? পা—গল? তবে আমার মোজাগুলো নিতেই পারো। বেশ হাঁটু পর্যন্ত গরম থাকবে। জুতোটা কিনতে হবে! হ্যাঁ মা। তোমার জুতো নেই? সব স্যান্ডাল? সব শিপার? ধ্যুৎ!”

–“স্নোবুট লাগবে। তোর খেলার বুট জোড়াই দিয়ে দে না?” আলোদি আবার বলেন।

—”দিতাম তো। পায়ে লাগলেই দিতাম। পা কতটুকু? তোমার সমান! ছেঃ। ওই আবার স্পোর্টসমস্যানের পা নাকি? একজোড়া ভাল কেডস কিনে নিতে পারো মাসি? নর্থস্টার?”

—”গ্র্যান্ড আইডিয়া। পাহাড়ে উঠতে সুবিধাই হবে কেডসে। তাই কিনে নেব। ডবল মোজা পরলেই পা গরম থাকবে। কী বলিস?” বেশ নিশ্চিন্ত লাগে এবারে।—

—”সত্যি সত্যিই যাচ্ছ নাকি?” ইলাদি এবার চমকান।—”আমি ভাবছি ঠাট্টা।”

অসম মহিলা সাহিত্যিক সম্মেলনের প্রধান অতিথি মহাশয়া যে সত্যিই ধার-করা পোশাক পরে তাওয়াং-এ যাবার চেষ্টা করছেন, সুস্থ মস্তিষ্কে, এটা কোনও ভদ্রমহিলার বিশ্বাস না হবারই কথা। একমাত্র ষোলো বছরের শমী ছাড়া কারুরই কছে আমার প্ল্যানটার বাস্তবতা স্পষ্ট হচ্ছিল না। এবার বেশ বুঝতে পারছি বয়স্কদের সম্পর্কে আমার ছেলেবেলা থেকেই যে ধারণাটা তৈরি হয়েছে, সেটা একদম নির্ভুল। ধারণাটা এই—ছোটবেলায় মাথাটা ক্লিয়ার থাকে। দৃষ্টিটা নির্ভেজাল বাস্তব, এবং সত্যদর্শনে অভ্যস্ত থাকে। যত বয়েস বাড়ে, মাথাটা গুলিয়ে যেতে থাকে। ভেজাল বাস্তব এবং ভেজাল সত্য দেখতে দেখতে চোখটা অবাস্তবে এবং অসত্যেই অভ্যস্ত হয়ে দাঁড়ায়। তখন সহজ সরল সত্যের চেহারা এতই অপরিচিত হয়ে যায় যে, হয় তাকে করুণ এবং পরাস্ত, অথবা সুদূর পরাহত, অশরীরী এবং অবাস্তব দেখায়। তা না হলে, খুব জটিল এবং বিপজ্জনক। এ দোষটা আস্তে আস্তে শুধরে নেন কেউ কেউ, তাঁদের সংসারে সাধু-সন্নিসি বলা হয়। সভ্য ভব্য বয়স্করা প্রথমেই ভুল করে বসেন। পরে ভেবেচিন্তে দ্বিতীয় চিন্তায় ঠিকঠাক করে নেন। আর ছোটরা প্রথমেই যেটা করে, সেটাই ঠিক। তারপর বড়দের কথা মতো চলতে গিয়ে ভুলভাল কাজ করে। শমী ছোট আছে বলে যেটা সহজেই দেখতে পাচ্ছে, বড় হয়ে গেছেন বলে অন্যরা কেউই সেটা দেখতে পাচ্ছেন না। সাতদিনের জন্যে যাওয়া—মনুষ্যবর্জিত জায়গাও নয়—মিলিটারি থাকা মানেই বেশ ল’ অ্যান্ড অর্ডার আছে এমন জায়গা। বাঙালি নেই—অথবা অসমিয়া নেই, মানেই কেউ নেই তা তো নয়? মধ্যবিত্ত বাবুদের ছাড়া অন্যদের মানুষ বলে মানব না, এই বা কেমন কথা? ট্রাইবাল বলো, আর্মি বলো, বৌদ্ধ লামা বলো, তাদের তো অতি উত্তম সমাজ ব্যবস্থা—সুগঠিত, সুশৃঙ্খল। ভয়ের কী আছে? মধ্যবিত্ত সমাজের বাইরে মানেই লক্ষ্মণের গণ্ডির বাইরের একটা অচেনা অঞ্চল। সেখানে পা দেওয়া মানেই বিবিধ বিপদকে হাতে ধরে ঘরে আনা। মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ও ধ্যানধারণা যে চমৎকার বালির বাঁধের মতো নরম পাঁচিল দিয়ে কেল্লা বানিয়ে ঘিরে রেখেছে আমাদের, সেটার বাইরে পা দিয়েছ কি গিয়েছ। সর্বনাশ! কুম্ভমেলায় যাওয়া তো মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের সাপের লেজে পা দেয়া নয়। না হয় একাই গেছ।

কিন্তু তাওয়াং?

এর মানে কী?

কেন যাওয়া? যাবার দরকারটা কী?

এতে কার কী লাভ? ব্যবসায়ে নয়, ধর্মের জন্য নয়, স্বাস্থ্য উদ্ধারে নয়, চাকরির জন্যে নয়, গবেষণার ইন্টারেস্টেও নয়। তবে কেন?

লেখার জন্য মেটিরিয়াল সংগ্রহ?

তাও নয়। তা যে নয়, সেটা প্রমাণ করতেই পাঁচ বছর ধরে লিখিনি তাওয়াং-এর গল্পটা।

-তবে?

—তবে আবার কী? স্রেফ উড়নচণ্ডেপনা!

-স্রেফ খামখেয়াল।

-মেয়েমানুষের অত খামখেয়াল ভাল নয়।

-মেয়েমানুষের অত জেদ ভাল নয়।

–মেয়েমানুষের অত সাহস ভাল নয়।

“বলছি ওরে ছাগলছানা
উড়িসনেরে উড়িসনে,
জানিসনে তোর উড়তে মানা
হাত পাগুলো ছুঁড়িসনে।”

—হ্যাঁ, হত যদি পুরুষমানুষ?

—পুরুষমানুষের অধিকার আছে। সে পারে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকে পদাঘাত করে অন্য জীবন বেছে নিতে। তাতে অন্য পুরুষরা ভীতিসূচক বা নিন্দাসূচক কিছু খুঁজে পান না। এরকম ব্যক্তিগত বিদ্রোহ তো চিরকালই আছে। তাতে সমাজ সংসার পদাঘাত করে অন্য জীবন বেছে নিতে। তাতে অন্য পুরুষরা ভীতিসূচক বা নিন্দাসূচক কিছু খুঁজে পান না। এরকম ব্যক্তিগত বিদ্রোহ তো চিরকালই আছে। তাতে সমাজ সংসার ভেঙে যায়নি। ও দু-চারজন খ্যাপাটে ওরকম থাকেই।

—কিন্তু মেয়েমানুষ? ছিঃ!

—ও মা! সে কী কথা? জগৎ সংসারে ছিরিছাঁদ থাকবে কেন তা হলে? মেয়েমানুষই তো লক্ষ্মী। সে লক্ষ্মীশ্রী ধরে রাখবে। স্ত্রী-পুরুষের শান্তির সংসারে মস্ত দুর্লক্ষণ হল স্ত্রী ‘বাইরে দূরে যায়রে উড়ে’ মন।

—উড়নচণ্ডে স্ত্রীলোককে কেউ ভালবাসে?

—কেউ না।

—কেউ আহা-উহু করে?

—কেউ না।

—কেউ তার ধূলিধূসর জামাকাপড় কেচে দেয়? না ঝকঝকে থালায় করে ভাত বেড়ে দিয়ে পাখাটি হাতে নিয়ে কাছে এসে বসে।

—কেউ না, কেউ না। উড়নচণ্ডীর পথক্লেশ দূর করতে কারুর মাথা-ব্যথা নেই।

যত গল্পের বই পড়েছি জীবনে সর্বত্রই আমি দেখেছি, যে পুরুষমানুষ যত উড়নচণ্ডে কাছাখোলা হয়, মেয়েরা তাকে তত ভালবাসে। কত আহা-উহু করে, কত যত্ন আত্তি করে, তার গেঞ্জি ইজের কেচে দেয়, ধুতি কুঁচিয়ে দেয়। জামা ইস্ত্রি করে দেয়। মেয়েরা ধড়াদ্ধড় তাদের প্রেমে পড়ে যায়, সেই মা-দের সময়ের শরৎচন্দ্র প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রবোধ সান্যাল থেকে আমাদের কালকূট বুদ্ধদেব গুহ পর্যন্ত সক্কলের দেখি একই অভিজ্ঞতা। আর নীললোহিত বেচারি নিজেই কেবল প্রেমে পড়ে। তার প্রেমেও যে এক্কেবারে কেউই পড়ে না তা নয়—দু-চারজন মেয়ে তার প্রেমেও পড়েছে, এমনও হয়েছে। তবে কালকূট—প্রবোধ সান্যালদের মতন অত নয়। কেন না তাঁরা নিজেরা তো ‘প্রেমিক’ প্রকৃতি নন, তাঁরা ডিট্যাচড থাকেন, দার্শনিক, বিশ্বপ্রেমিক। “অতিথি” গল্পের তারাপদর মতন কি গঙ্গা নদীর স্রোতের মতন। “তোমার কোনো বাঁধন নাই, তুমি ঘরছাড়া যে তাই”। আর আমার বেলায় দেখি একটাও হয় না? না আমি পড়ি কারুর প্রেমে, না আর কেউ পড়ে আমার প্রেমে। কী বলছেন? বয়েস হচ্ছে, মেয়ে বড় হচ্ছে, ও সব কী-কথা? বাঃ, দেবানন্দের বুঝি বয়েস হচ্ছে না, কিশোরকুমারের বুঝি ছেলে ছোট্ট? কেবল আমারি বয়েস হচ্ছে? এই যে এত ঘুরি, অনবরত ঘুরে বেড়াই, এ-দেশ—ও–দেশ, এ তীর্থ-ও কনফারেন্স, কোথাও কি কোনওই সম্ভাব্য প্রেমিক লুকিয়ে থাকতে পারত না আমার জন্যে?—খুব পারত। কিন্তু আমার স্বভাবদোষেই তা পারে না। এখন কথা হচ্ছে গিয়ে, কোনটা বেশি জরুরি? স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো না পরাধীন ভাবে প্রেম করা? প্রেমে পড়ার বড্ড ঝুটঝামেলা আছে মশাই, মান-অভিমান, মিলন-বিরহ, জ্বালা-যন্ত্রণা বড় কম নয়। তা ছাড়া প্রেমিকরা দারুণ পজেসিভ জীব হয়। একদম পুলিশের মতো। প্রেমের হাজতে পুরে দেবে। আর ইচ্ছেমতো বিহার করা বন্ধ। আমি তাই ইনডিরেক্টলি প্রেমটাকে সর্বদাই ডিসকারেজ করে থাকি। প্রেম এনকারেজ করা মানেই হাজতবাস। হ্যাঁ, যদি একতরফা এনকারেজ করেই মুক্তকচ্ছ হয়ে কালকূটদের মতন হাসিমুখে পালিয়ে যেতে পারতুম? সে আলাদা কথা! আমি তো তেমন স্মার্ট নই। শেষটা নিজেও জড়িয়ে পড়ব ঘাড়মুখ গুঁজে—বলা যায় না, বিয়ে থা করে হয়তো উনুন পেতে ঘর-সংসারই করতে লেগে যাব। তাই আমি “মারি-তো-গণ্ডার- লুটি-তো-ভাণ্ডার” স্টাইলে সুপার হিউম্যান লেভেলে প্রেমে পড়ি। কখনও গঙ্গার সঙ্গে, কখনও হিমালয়ের। কখনও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে কখনও তিব্বতের। একবার ভেবে দেখুন, প্রেম করার কতখানি, হান্ড্রেড পার্সেন্ট সুযোগ আমি পাই। আত্মীয় গুরুজনরা কেউ ধারে কাছে থাকেন না, বন্ধু-বান্ধবীরা কেউ নজরবন্দী রাখতে পারে না, পাড়া-প্রতিবেশির পর্যন্ত ইন্টারেস্ট থাকে না—এমন সব জায়গায় আমি ঘুরি, নির্জনতা যেখানে ছায়ার মতো আমার সঙ্গে ফেরে। নিভৃতি যেখানে খই-মুড়কি। মান-অভিমানের বালাই নেই, দায় দায়িত্ব বইতে হবে না।

আমাকে দেখলে ঠিক বোঝা যায় না বটে, কিন্তু মনে-প্রাণে বেশ খানিকটা ওল্ডফ্যাশন্ড রোমান্টিকতা আমারও আছে বইকী। থাকবে না এমন হতেই পারে না। ও ব্যাপার এমনকী ন্যাড়ামাথায় টিকিওলা হেডপণ্ডিতেরও থাকে। রক্তচক্ষু অঙ্কস্যারেরও।

.

আর চুপিচুপি বলি, উড়নচণ্ডী মেয়েদের আগলে রাখবার জন্যেও একজন সর্বদা জেগে থাকেন। যিনি কাছাখোলাদের কাছা তুলে গুঁজে দেন, এবং আমার মতন এলোপাথাড়ি পথ চলে যারা, তাদের পথক্লেশ নিবারণ করেন। এমন মাত্র একজনই আছেন বটে জগতে, কিন্তু তিনি একাই একশো।

কিন্তু তিনি তো নভেল লেখেন না, তাই সে খবরটি কেউ জানে না। অতএব কোনও বাংলা নভেলে কোনও উড়নচণ্ডী নায়িকা নেই। এমন মেয়ে কি আছে, যার পায়ের তলায় চাকা বাঁধা? যে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু বোষ্টুমী নয়। সন্ন্যাসিনী নয়, তবু অস্থির? নেহাত মধ্যবিত্ত ঘরের চাকুরে ভদ্রমহিলা, অথচ যার অস্থির বুকের ভেতরে “অন্য এক বোধ কাজ করে”? এক যাযাবর প্রাণবায়ু যাকে ঠেলে নিয়ে বেড়ায় অরণ্যে প্রান্তরে?

অথচ সাহিত্যে এমন পুরুষ হামেশাই দেখছি। উড়নচণ্ডেপনাটাই তো প্রধান আকর্ষণ। কাছাখোলা স্বভাবটাই তাদের অস্থির অনন্ত যৌবনের ট্রেডমার্ক। পুরুষমানুষেরা যেহেতু নিজেরা উড়নচণ্ডে হতে ভালবাসে, তারা মেয়েদের উড়নচণ্ডী দেখতে ভালবাসে না। উড়কি ধানের মুড়কি, কিংবা শালিধানের চিঁড়ে অফার করা দূরে থাক, কাঁঠালকাঠের পিঁড়েটি পর্যন্ত উড়নচণ্ডী নায়িকার জন্যে পেতে দেবে না কেউ, না পাঠক, না পাঠিকা। অমন নায়িকা-অলা বই বাজারে চলবেই না! অতএব “লেখার জন্য মেটিরিয়াল” সংগ্রহ করতে উড়নচণ্ডী হয়ে যে ঘোরে ঘুরুক কোটি মন্বন্তরে আমি ঘুরিব না, আমি কভু ঘুরিব না।

—”তবে কেন যাওয়া?” সেই প্রথম প্রশ্নে এসে ঠেকে যাওয়া। সেই জিপবাবু থেকে শুরু করে, আলোদি বরঠাকুরফ্যামিলি, ইলাদি সকলের মনে একই প্রশ্ন। একই বিস্ময়। সভ্যজগতের খুবই ‘ভ্যালিড’ প্রশ্ন।

—”এনি ভ্যালিড রিজন?”

সভ্যসমাজে ভ্যালিড হবে এমন রিজন খুঁজে বের করা আমার আদ্ধেক কাজকর্মের জন্যেই বেশ দুঃসাধ্য। এখন তো আরও মুশকিলে পড়া গেল।

সব কিছুর জন্যেই রিজন লাগবে কেন রে বাবা! এক্সপ্ল্যানেশান লাগবে কেন!

আমি যেহেতু ‘এক্সপ্লোরার’ নই, নই ‘কনটিকি’ এক্সপিডিশন কিম্বা এভারেস্ট বিজয়ের শরিক, নই হায়ারডাল কি হিলারি, কিম্বা ডঃ লিভিংস্টোন—তাই কি আমার হাত পা “রিজন” দিয়ে বাঁধা? আমি কিছুই আবিষ্কার করতে যাচ্ছি না।

কোনও রেকর্ড ভাঙতে বা রেকর্ড গড়তে যাচ্ছি না। কারুর কোনও উপকারেও লাগতে যাচ্ছি না। কেবল আপন মনের খেয়াল খুশিতে, কেবলই জীবনের স্বাভাবিক কৌতূহলে, বেঁচে থাকার আহ্লাদে যেতে চাইছি—এটা কি ভ্যালিড নয়, রিজন হিসেবে?

লক্ষ করেছি, জগৎসুদ্ধু মানুষের আমাকে খুব চটপট তাদের ‘ওয়ার্ড’ বলে মনে হয়, আর গার্জেনগিরি দায়িত্ব নিয়ে নেবার লোক জুটে যায়। এটা কি সেই পথ-ক্লেশহারীর বিশেষ কায়দা? আড়াল থেকে খেলা-ধুলো? যেমন বিঘ্ন ঘটান, তেমনই বন্ধুও জোটান।

—”এ মেয়ে তোমার কথা শুনবে না।” আলোদি অবশেষে দাদাকে বললেন—”এ কুম্ভে যাওয়া মেয়ে।”

—”সত্যিই যাচ্ছ? তা হলে তো কাল সকালে ইনারলাইন পারমিটের চেষ্টায় যেতে হয়। ফার্স্ট আওয়ারে পৌঁছে যাব। কী বলো আলো? কিন্তু, ও কার সঙ্গে যাবে? কীসে করে যাবে?”

—”জিপে। এই যে, এই ফোন নাম্বারের ভদ্রলোক কাল যাচ্ছেন বম্‌ডিলা পর্যন্ত। বাঙালি। তেজপুরে ওঁর স্ত্রী, বাচ্চারা থাকেন।”

—”এ কোথায় জোগাড় হল?”

—”ওই ফেরি-বোটে।”

—”কী করে সে, বম্‌ডিলাতে?”

—”তা তো জানি না?”

—”জিজ্ঞেস করোনি? আপনি কী কাজ করেন?”

—”না তো?”

—”চমৎকার। অ্যান আনআইডেন্টিফায়েড ম্যান! কেবল একটা ফোননম্বর। ওর নাম কী?”

—”তাও জিজ্ঞেস করা হয়নি।”

—”বাঃ। তারই সঙ্গে যাওয়া ঠিক?”

—”প্রায়। নাম দিয়ে কী হবে?”

“থাকবে কোথায়?”

—”ইন্সপেকশন বাংলোতে চেষ্টা করতে হবে।”

—”আগে থেকে বুক করে যেতে হয়।”

—”গিয়েও চেষ্টা করা যায়। আমি তো একলাই, ঝুটঝামেলা তো নেই কিছু? ও হয়ে যাবে।”

—“‘একলাই’ বলেই তো ঝুটঝামেলা। ‘ও হয়ে যাবে’ মানে? না হয়ে গেলে কী করবে?

ওই লোকের বাড়িতে কি থাকতেও দেবে বলেছে?”

—”তা দেবে না, বলে দিয়েছে। ফ্যামিলি নেই কিনা এখন ওখানে? থাকলে, দিত।”

—”তবু ভাল! পারহ্যাসপস্ হি ইজ আ ডিসেন্ট চ্যাপ, আফটার অল। আগে বার করি লোকটা কে! দাও দেখি নম্বরটা।”

ফোন নম্বর নিয়ে দাদা চলে গেলেন।

একটু বাদে সেই জিপওয়ালার ঠিকুজিকুলুজি জেনে এলেন টেলিফোন করে। ভদ্রলোক ভদ্রলোকই—বডিলাতে ব্যবসা করেন। তেজপুরেই বাড়ি। ভাবনার কিছু নেই। ঠিক আছে। যেতে পারো। তবে তাওয়াং-টাওয়াং নয়। ওই বম্‌ডিলা অবধিই যাও। চিনেরা কোথায় এসেছিল সব দেখেশুনে, ফিরতি বাসে চলে এসো। ফোন করে দিয়ো। আমরা বাস স্টপ থেকে নিয়ে আসব।—

রাত্রেই একবার গাড়ি করে বেরিয়ে দাদা তেজপুর শহর ঘুরিয়ে আনলেন। পদ্মবনে ভরা দীঘি, ছোট্ট ছোট্ট পাহাড় ভাঙা মন্দিরে সাজানো সবুজ পার্ক, আহ্, কী সুন্দর শহর সত্যি। নতুন একটা আশ্রম এবং মন্দির হয়েছে, সেটা দেখালেন। তার কাছেই ওই ভদ্রলোকের বাড়ি। সেটাও দেখা হয়ে গেল। হলুদ পর্দাওলা জিপ দাঁড়িয়ে আছে পোর্টিকোতে। দেখে কী আহ্লাদই হল! আঃ! ওই জিপে করে আমি আগামিকাল…বডিলা! রাত্রের ব্রহ্মপুত্রও একঝলক দেখা হল।

বাজারটা পার হয়েই প্রফেসর বোসের এই পৈতৃক ভিটে বাড়িটি। আধখানা বাজার নাকি প্রফেসর বোসের ঠাকুর্দার ছিল। পুরুষানুক্রমে ওকালতিই করেছেন এঁরা। প্রফেসর বোসেরও ল’ডিগ্রি আছে, যদিও প্র্যাকটিস করেন না।

এলাহাবাদ, ভাগলপুর, কটক এসব অঞ্চলেও দেখেছি, প্রবাসী বাঙালির সবচেয়ে বড় অংশ হয় উকিল, নইলে ডাক্তার। প্রফেশনাল বাঙালিরা ঘুরে ঘুরে প্রবাসে নতুন কর্মক্ষেত্র খুঁজে নিতেন একসময়ে। কলকাতার তীব্র প্রতিযোগিতায় যোগ না দিয়ে।

আর এখন? অন্যত্র কাজ থাকলেও নিরাপত্তা নেই।

ইনার লাইন

মুশকিল হল পরদিন সকালে। ইনার লাইন পারমিটের অফিসে গিয়ে। বাইরে দাঁড়িয়েই আছি, দাঁড়িয়েই আছি, কেউ ডাকে না। শেষে প্রফেসর বোস জোর করে একটা ঘরে গিয়ে খোঁজ খবর নিলেন, তারা আমাদের অন্য একটা ঘরে পাঠিয়ে দিল। সেখানে বসবার ব্যবস্থা আছে। এইটুকু উন্নতি। ব্যস। বসেই আছি, বসেই আছি, কেউই ডাকে না। অথচ বলে দিয়েছে ডাক এলে যেতে হয়। না ডাকলে হাভাতের মতন, আদেলের মতন হুড়মুড়িয়ে ঢুকে যাওয়া নিয়ম নয়। সব মিলিটারি প্রহরী চতুর্দিকে। নিয়মকানুন কড়া। বসে, বসে, বসে, বসে জানা গেল যে এ ডি সি ইটানগরে। ইনার লাইন পারমিট এরা দেয় না। তিনিই দেন। বললেন, একজন বেয়ারা। একটা অফিসঘর সামনেই। কী মনে হল, স্যুইং ডোর ঠেলে ঢুকে পড়লুম। দেখি এক ভদ্রলোক মস্ত চেয়ারে বসে আছেন। প্রফেসর বোসও এলেন সঙ্গে। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলেন। উনিও একই কথা জানালেন। প্রফেসর বোস বললেন, টেলিফোনেই জেনে নিন না একটু, পারমিট দেবার কথাটা! উনি তখন একজনকে ডেকে, সেই অনুরোধ করলেন। তিনি পাশের ঘরে ফোন করতে গেলেন। আমরা বসে রইলুম। আমি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলুম তাওয়াং যাবার কী কী উপায়। উনি বললেন, সপ্তাহে একটা বাস যায়, কিন্তু এ সপ্তাহেরটা কালই চলে গেছে। সাতদিন বাদে নেক্সট ট্রিপ।

“এ ছাড়া। অন্য কোনও উপায় নেই?”

—”আছে। ওখান থেকে মাঝে মাঝেই জিপ আসে। মেডিকেল সার্ভিসের জিপ, এঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের জিপ। এই তো একজন এঞ্জিনিয়ার এসেছেন, আজই বিকেলে ফেরার কথা, তাঁর জিপ বিগড়ে গেছে। সারানো হচ্ছে। কাল ফিরবেন।”

—”কোথায় ফিরবেন? তাওয়াংয়ে?”

—”হ্যাঁ। উনি তো ওখানেই পোস্টেড।”

—”আমি যাব! আমি যাব! আমি তা হলে এই জিপে নয়, ওই জিপে যাব! সোজা তাওয়াং পর্যন্ত!”

—”সেটা ইঞ্জিনিয়ারমশাইয়ের মর্জির ওপরে নির্ভর করবে। আপনাকে নেওয়া না নেওয়া তাঁর খুশি।”

—”আপনিই একটু বলে দিন না মশাই আমার হয়ে? তা হলেই তিনি নিয়ে যাবেন।”

—”যদি দেখা হয়।”

—”উনি কোথায় আছেন? ফোন আছে? আমি নিজেই কি বলতে পারি ওঁকে?- —”

–“এই গেস্ট হাউসেই আছেন। এখন বাড়ি নেই। গাড়ি সারাতে গেছেন।”

ভদ্রলোক বাঙালি নন, হিন্দিভাষী এবং অসম্ভব ভদ্র। তবে সাহায্য করতে খুব উৎসুক বলে মনে হল না।

এন্টার দি ড্রাগন

—”আচ্ছা, ইঞ্জিনিয়ারমশাইয়ের জিপের শেষ পর্যন্ত ফলটা কী হল, বলতে পারেন?”

বলতে বলতে পিছনে দরজা ঠেলে ঢুকলেন একটি যুবক, যাঁর ঊর্ধ্বাংশের চেয়ে দ্বিগুণ কি তিনগুণ দীর্ঘ তাঁর পা দুটি। দেখলে মনে হয় রণপায়ে হাঁটছেন। গোয়ালিয়র সুটিং কি রেমন্ডস সুটিংয়ের মডেলদের মতো ট্রাউজার্স প্রধান চেহারা, সাদা শার্ট পরিহিত অংশটি সংক্ষিপ্ত, মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত মুণ্ডুটি আরও সংক্ষিপ্ত। সদ্যোস্নাত। চুলে ব্রিলক্রিম, বোতাম খোলা জামার ফাঁকে বুকের লোমে পাউডার দেখা যাচ্ছে। মস্ত মস্ত জুতো মশমশ করে ঘরে ঢুকলেন। শুধু মশমশই নয়, জুতো চকচকও করছে।

চিরাচরিত নিয়মে এইরকম দৃশ্যের যুবকদেরই নায়ক বলে। “নায়কোচিত” চেহারা এটাই অর্থাৎ “টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম”। বেশ সুদৃশ্য যুবক, কিন্তু কথাগুলি শেষ হবার আগেই কেমন নেতিয়ে গেলেন আমাদের দেখতে পেয়ে। কথা বলতে বলতেই ঢুকেছিলেন, ঘরে আমাদের দেখবেন আশা করেননি। এই অফিসে সম্ভবত কেউই কখনও আসে না। আমাদের দেখে হঠাৎ অবাক হয়ে গেলেন, না লজ্জা পেলেন, কীযে অস্বস্তি বোধ করলেন, তা বোঝা গেল না। তবে আর কথা বললেন না।

—”সেই কথাই হচ্ছিল”, অফিসারটি জানালেন, “এখনও সারেনি। ইঞ্জিনিয়ার তো এখনও সেইখানেই পড়ে আছে।”

—”কারখানাতে?”

—”আবার কী।”

—”কিন্তু যদি আজ না সারে? কাল তো আমাকে চলে যেতেই হবে। হাসপাতালে কাজ আছে জরুরি।”

—”কাল একটা র‍্যাশনট্রাক যাচ্ছে। জিপটা না পেলে আপনি ওই র‍্যাশনট্রাকেই লিফট নিয়ে নিন। জরুরি ব্যাপার যখন।”

—”তা হলে ওটা আপনিই বন্দোবস্ত করে রাখুন?”

—”হ্যাঁ হ্যাঁ আমি বলে দিচ্ছি—”

এই সময়! এই বেলা না বললে আর হবে না।

গোয়ালিয়র সুটিং এবার ওই দরজা ঠেলে বেরিয়ে যাবে তার আগেই বলা দরকার–

—”ও মশাই, আপনি তাওয়াং যাচ্ছেন?”

উনি না-তাকিয়ে চলে যেতে থাকেন। উত্তর না দিয়ে। আমিও দুর্নিবার।

—”ও মশাই! ও ও ও মশাই! ও লম্বা দাদা! (ইংরেজিতে ও মিস্টার টল জেন্টেলম্যান!! ) শুনছেন?”

—”আমাকে বলছেন?”

ভূত দেখার মতো চমকে উঠে পিছন ফিরে এদিকে তাকান লম্বাদাদা। ওই একবারই।

—”হ্যাঁ আপনাকেই তো বলছি। আপনি বুঝি তাওয়াং যাচ্ছেন?”

—”হ্যাঁ। আমার জিপটা নষ্ট। তাই ইঞ্জিনিয়ারের জিপে লিফট নিতে এলাম। সেটাও নষ্ট। আশ্চর্য কাণ্ড মশাই। “

উনি কথার উত্তর দেন প্রফেসর বোসের মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে। আমার সঙ্গে কথাই কন না। দৃষ্টিপাত পর্যন্ত করেন না এদিকে।—

—”রাস্তা খুব ঘোরালো তো, তাই প্রায়ই গাড়ি বিগড়োয়। অনবরত সার্ভিসিং লাগে।”—অফিসারই ব্যাখ্যা করলেন।

—”তা, জিপ তো সবই খারাপ শুনছি। র‍্যাশনট্রাকটা কী জিনিস বলুন তো? আপনি যাতে করে যাবেন? ওতে অন্য যাত্রী নেয়? আমাকে নেবে?”

—”আপনাকে?” এতক্ষণে ভদ্রলোক নয়ন মেলিয়া আমাকে ‘নেহার’ করলেন।

—”আপনি যাবেন তাওয়াং-এ? ট্রাকে নয়। ট্রাকে যেতে পারবেন না। অপেক্ষা করুন, জিপটা সারবে, যাবেন। আমি ডাক্তার, আমার পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়, তাই। নইলে আমিও জিপে যেতুম।”

—”আপনার পক্ষে ট্রাকে যাওয়া সম্ভব?”

—”হ্যাঁ, আমরা তো অভ্যস্ত।”

“আমারও অভ্যেস হয়ে যাবে’খন। আপনি পারেন আর আমি পারব না?” এর উত্তর ওঁর জানা নেই। উনি চুপচাপ বেরিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করলেন। মরিয়া হয়ে আমি আবার হাঁক পাড়ি।

—”ও ও মশাই! আপনার সঙ্গে র‍্যাশনট্রাকেই আমাকেও নিয়ে চলুন না। আমারও ফেরার তাড়া আছে যে।”

—”র‍্যাশনট্রাকে মেয়েরা যেতে পারবে না, খুবই রাফ্ যাওয়া। আমার মনে হয় না ওতে আপনার সুবিধা হবে। ডাঃ লালওয়ানী ঠিকই বলছেন, আপনি দুদিন ওয়েট করে জিপে যান। ততদিনে পারমিটেরও ব্যবস্থা হতে পারে। আপনি পারমিট ছাড়া যেতে পারবেন না তো।” অফিসারটি হাসতে হাসতে বলেন।

—”ডাক্তারবাবুর পারমিট লাগে না? ওঁরটা কে দেবে?”

—”লাগে। ওঁরটা সঙ্গেই থাকে, রিনিউ করে নিতে হয়। উনি তাওয়াং-এর এম ও।”

—”এম ও মানে?” (মনি অর্ডার নিশ্চয়ই নয়!

—”মেডিক্যাল অফিসার।”

—”বাঃ বাঃ এই তো আমার আইডিয়াল ট্রাভলিং কম্প্যানিয়ন! অসুখ-বিসুখ করলে ভাবনা নেই! আমি ওঁর সঙ্গেই যাব। প্লিজ র‍্যাশনট্রাকে আমার জন্যেও একটা সিট রিজার্ভ করে রাখুন, পারমিট হয়ে যাবে ততক্ষণে। কী? হয়ে যাবে না?”

—”আমি কী করে বলব? পারমিট কি আমার হাতে? এ ডি সি ইটানগরে। উনি যদি আমাকে অনুমতি দেন তবেই আমি দিতে পারি। উনি কাল পরশুই ফিরবেন। দেরি নেই। এলেন বলে।”

—”দেরি নেই? কাল? …প-র-শু? তি-ন-দি-ন? আর বলছেন, দেরি নেই?”

—”কই, টেলিফোনের কী হল?”— দাদা তাড়া দিলেন।

—”ছেলেটা তো আর এলই না। এবার ফিরতে হবে।”

অফিসার ঘণ্টি বাজান, ছেলে আসে।

—”কই ফোনের কী হল? ইটানগর কী বলল?”

—”পাওয়া যাচ্ছে না স্যার।”

—”ওই শুনুন। পাওয়া যাচ্ছে না। চেষ্টার তো ত্রুটি করিনি। ফোনে না পেলে কী করা?” দাদা বললেন—”ঠিক কথা। চলো, চলো, উঠি, খিদে পেয়ে গেছে। আলো বসে আছে।”

বঁধু আর না ছাড়িব তোরে

হল না। ফিরে আসছি। মন খারাপ। হঠাৎ মনে হল—ডাক্তারটিকে চলে যেতে দেওয়া হবে না। ওকে ধরে রাখা উচিত।

—”চলুন, দাদা, গেস্ট হাউসে যাই। ওই যে, ওই ডাক্তার লালওয়ানীকে ধরি।”

–“কেন? ও কী করবে?”

—”ওই র‍্যাশনট্রাক হোক, জিপ হোক, যাতে করে ও যাবে, তাইতে করেই আমিও যাব। মেডিক্যাল অফিসার বলে কথা! তাওয়াং পৌঁছেও তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে? ওর সঙ্গে জুটে গেলে দুর্ভাবনা করতে হবে না আপনাদের।“

—”যদি তার মধ্যে পারমিট না হয়?”

—”সেটা ব্যাড লাক। চেষ্টা তো করি?” গেস্ট হাউসের বারান্দায় সারস পাখির স্টাইলে পদচারণা করছিলেন ডাক্তারবাবু। প্রফেসর বোস ওঁকে ডেকে আনলেন।

—”চলুন আমাদের বাড়িটা চিনিয়ে দিই আপনাকে। একটু কফিও খেয়ে আসবেন? আমরা আবার পৌঁছে দিয়ে যাব আপনাকে।”

—”বাড়ি চিনে কী হবে?”

–“বাঃ আপনারা যদি আমাকে ফেলে চলে যান? বাড়ি চেনা থাকলে, যে সময়েই আপনারা রওনা হোন না কেন, আমাকে খবর দিতে না পারলেও, তুলে নিয়ে যেতে পারবেন। আমার খুব জরুরি দরকার। তাওয়াং মঠ বিষয়ে একটা কাজে হাত দেব, তার জন্য। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। নমস্কার।

—”নমস্কার।”

—”চলুন, তবে? কফি খেয়ে আসবেন?

—”আপনার সঙ্গে গেলে সেফ, বুঝছেন না? দাদা বলেন। ইয়াং উওম্যান ট্রাভলিং আলোন, ইট ইজ নট আ গুড আইডিয়া—”

—”তা বটে। কিন্তু— “

—”কালই যাচ্ছেন তো? কোন সময়ে?”

–“সেটা র‍্যাশন-ট্রাক ছাড়ার ওপর নির্ভর করবে। সকাল এগারোটা নাগাদ?”

কফি খাইয়ে ডাক্তার লালওয়ানীকে পৌঁছে দেওয়া হল গেস্ট হাউসে।

জিপবাবুকে ফোন করে বলে দেওয়া হোক যে আমি ওর সঙ্গে যাব না। আধখানা পথ গিয়ে কী হবে? এ তো আরও ভাল ব্যবস্থা। পুরো পথ।

ফোন করে আমরা অবাক!

জিপবাবু নেই।

তিনি আজই রওনা হয়ে গেছেন বম্‌ডিলা!

—”তাই তো? ওঁর বাড়ির কাছ দিয়েই এলুম ফেরার সময়ে। হলুদ পর্দাওলা জিপটাকে দেখিনি।”

প্রচণ্ড আঘাত পেলুম মনে। ওঁর কাছে এ বাড়ির ফোন নম্বর, ঠিকানা, সব ছিল। উনি ফোনও করেননি, খবরও দেননি, নিয়েও যাননি। যদি ওঁর সঙ্গে যাব বলেই বসে থাকতুম? কেন যে মানুষ এরকম করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *