ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে – ৬

প্রথম দিনের সূর্য

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে, মেঝেয় ডাক্তার ঘুমন্ত। দোর খুলে, করিডরে বাহাদুর নেই। বাইরের দরজাটি খোলা। বেরিয়ে, সামনেই আশ্চর্য এক ছবি।

ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা, সূর্য প্রায় উঠে পড়েছে, চারিদিকেই পাহাড় ঘেরা—সেই পাহাড়ের পিছন থেকে সূর্যের ছটা বেরুচ্ছে, ছোটবেলায় যেমন সূর্যের ছবি আঁকতুম। দূর দুরান্তের তুষার শিখরে সেই সূর্যের আলো ছিটকে গিয়ে পড়ছে গাছপালা বিশেষ দেখা যাচ্ছে না, চারিদিক স্তব্ধ। অবিশ্বাস্য গম্ভীর শান্ততায় ঢাকা। ভোরবেলাকার ছবি, অথচ ভোরবেলাকার শব্দ নেই। একটিও পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে না।

ঠিক বাড়ির সামনেই একটা ভাঙা তিব্বতি মন্দির। গুম্‌ফা। তাক করে ঠিক তার পিছনেই সূর্যটা উঠছে। যেন থিয়েটারের স্টেজ সেটিং। হবে না? এই সূর্যটাই তো কন্যাকুমারিকায় দুখানা বাঁকা নারকোল গাছের ঠিক মাঝখানে কায়দা মেরে ডুবছিল, যেবার রাজ-সরসম্মার সঙ্গে গেলাম,—ঠিক বস্তাপচা ক্যালেন্ডারের সস্তা ছবির নকল করে। এখানেও নাটকীয় মুহূর্ত ঠিক সৃষ্টি করে নিয়েছে। দৃশ্যপট সাজাতে বুড়ো সূর্যের জুড়ি নেই। ওর তুল্য অভিজ্ঞ আর কে? হ্যাঁ আছে আরেকজন, চাঁদ।

একটাও পাখি না-ডাকা, এমন বিপুল নিঃশব্দ, কেমন গা ছম ছম করে। কোটটা চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ি। ওই গুম্ফার দিকে। ওটা তাওয়াং গুম্ফা নয়। তাওয়াং গুম্ফা মস্ত বড় ব্যাপার—দুর্গের মতো, কেল্লার মতো, এবং তারই ভেতরে মন্দির। কাল ট্রাকে আসতে আসতে ঘনশ্যাম ছেত্রী বলেছে। পথে এক জায়গায় একটা গ্রাম দেখিয়ে বলেছে—”এখানে জং ছিল, কেল্লা-খাম্পারা এসে মোম্পাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করে খাজনা আদায় করত। এখানে মাটির নীচে গুহাঘরে বন্দিদের আটকে রেখে দিত—খাম্পারা আসত তিব্বত থেকে—খুব নিষ্ঠুর জাত। শেষকালে মোম্পারা একদিন ওদের মেরে ধরে তাড়িয়ে দিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।”— আমার মনে হল, সেটা নিশ্চয় ইংরেজদের আসার পরে। ছেত্রীই বলল—”তাওয়াং গুম্ফাতেও জং আছে—বাইরে—গুম্ফাতে বহুৎ সোনা তো, জং না থাকলে সব কেড়েকুড়ে নিয়ে যেত খাম্পা ডাকুরা।”

কিন্তু এই গুম্ফাতে নিশ্চয় মোটেই সোনাদানা নেই। ছোট্ট মন্দির, পাথরের তৈরি দোতলা বাড়ি। কেল্লাটেল্লার ব্যাপার নেই। ঢুকতে গিয়ে দেখি সামনের বারান্দাময় কী যেন একটা শস্য ছড়ানো। শুকুতে দেওয়া হয়েছে। ঘাসের বীজের মতো দেখতে আর তারই মধ্যে গোটা চারেক লোমঝুলঝুল কুকুর আরামসে শুয়ে আছে।

আমাকে দেখবা মাত্র কুকুরগুলোর কী প্রচণ্ড চিৎকার, নির্জন শীত সকালের শান্ত স্তব্ধতা খান-খান হয়ে গেল।

আমি কুকুর ভয় পাই না, ভালবাসি। এগিয়ে গিয়ে শিস-টিস দিয়ে ওদের ভোলানোর চেষ্টা করতেই, ওরে ব্বাবা! আরও জোরে জোরে হল্লাগুল্লা শুরু করে দিল। গুম্ফাবাসী সন্ন্যাসী কুকুরের ব্যাপারই আলাদা। তখন গুম্ফায় ঢোকবার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে প্রদক্ষিণ করতে গেলুম। ওরাও চুপ করে গেল। বাইরে প্রেয়ার হুইল রয়েছে। ঘোরালেই ওম মণিপদ্মে হুম্ বলা হবে একশো আটবার। বাইরে থেকে একটা সরু পাথুরে সিঁড়ি উঠে গেছে গুম্ফার দোতলায়। সেখানে থেকে নেমে এলেন এক গেরুয়াধারী লামা।

—”নমস্কার।”

“…।” তিনিও নমস্কার করলেন।

—”গুম্ফাকা অন্দর যা সক্তা?”

—”…।” তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে চললেন, কিন্তু কী যে বললেন বোঝা গেল না। তাঁকে দেখে কুকুররা মহা উল্লসিত, বেঁটে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে তাঁর পিছু পিছু মন্দিরের ভেতরে এসে ঢুকল। মন্দিরে কুকুর ঢুকতে আগে দেখিনি। একটু অস্বস্তি হল না, তা বলব না। কুকুরদের পশ্চাদ্ধাবন করলুম আমি।

ভিতরটা বেশ বড় একটি হলঘর। শেষ প্রান্তে পূজাবেদী ইত্যাদি। সেখানে একটি স্তম্ভ, তাতে থাকার কথা বুদ্ধমূর্তি। কিন্তু আছে কী? পাঠক, বিশ্বাস ধারণ করুন। বেদীর ওপরে ঘৃতপ্রদীপের সামনে ভক্তিভরে প্রতিষ্ঠিত,—কে? গান্ধীটুপি জহরকোট-পরা নেহরুর প্লাস্টার অফ প্যারিসের মূর্তি। তারই সামনে জ্বলছে ধূপধুনো। চারিপাশে ইন্দিরা গান্ধী এবং সঞ্জয় গান্ধীর ফোটো ঝুলছে। বড় বড় পোস্টার সাঁটা রয়েছে সঞ্জয়ের বাণী উদ্ধৃত করে। সব চেয়ে মজা লাগল ‘তাংখা’গুলি দেখে। তিব্বতি তাংখা তো আগেও দেখেছি। সিল্কের ওপর মাটির রং দিয়ে আঁকা তিব্বতি দেবদেবীদের ছবি, ওপরে-নীচে জরি-সাটিনের ব্রোকেড আঁটা, ফ্রেমের মতো করে নীচে ওপরে কাঠের রুল ভরা, আর তলায় ঝালর।

এখানে ঠিক সেই রকম বহু তাংখা, কেবল দেবদেবীর ছবির জায়গায় আছে ইন্দিরা, সঞ্জয়, এবং জবাহরলালের সিংগল এবং গ্রুপ ফোটোগ্রাফ। কখনও একা, কখনও ভিড়ের ছবি। সভার বক্তৃতামঞ্চের ছবিও ঢের।

এটা তো বড্ড দূরে, আর বড্ড উঁচুতে, এখানে কি এখনও খবর আসেনি, যে ইন্দিরা-সঞ্জয় আর গদিতে নেই? ১৯৭৭-এর নভেম্বর মাস।—মার্চ মাসেই তো রাজনীতির আকাশ থেকে সঞ্জয়-উল্কার পতন হয়েছে। বেদিতে দূরে দূরে কয়েকটি ধূলিমলিন, ম্রিয়মাণ, অপূজিত, অবহেলিত বুদ্ধমূর্তি অবশ্য পড়ে আছে। ধূপ দীপ জ্বলছে জবাহরলালের সামনে।

বাইরে প্রেয়ার হুইল ঘোরালে কি এই গুম্ফার ‘মানি’ যন্ত্রটি “ওম মণিপদ্মে হুম্”-এর বদলে অন্য কিছু মন্ত্র বলে?”নেহরু পদ্মে হুম্”? আমার অবাক মুখচ্ছবি দেখে বৃদ্ধ লামাটি বলেন—”নেহরু-গুম্পা, নেহরু-গুম্পা!”

তারপর বাইরে উঠোনে আসেন, কুকুরের পাল সমেত। উঠোন অযত্নে, আগাছায় ভরা। তৃণহীন, ছাগল-নাদিতে অলংকৃত। সেখানে একটি ঘণ্টাতলা আছে, পাথরে বাঁধানো। লামা ধীর পায়ে এসে ঘণ্টাটি বাজান। কেন বাজান? চমৎকার গম্ভীর গম্ভীর ধ্বনি, পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়। আমি কিছুই বুঝি না।

ভাষার সেতু নেই দুজনের মধ্যে।

আস্তে আস্তে ফিরে যাই।

কুকুররা কিছু বলে না।

তাড়া করে না।

যে চলে যায়, তার পথে বাধা নেই। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ অন্য একটা ঘণ্টার মিষ্টি শব্দ পাই। একটা নয়, অনেকগুলো। টুং টাং টুং টাং টুং। একটি বাড়ির ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসে হৃষ্ট-পুষ্ট একটি চমরী গাই। গলায় চৌকো ঘণ্টা বাঁধা। যেমন ঘণ্টা দেখেছি আল্পসের টিরোল অঞ্চলের গোরুদের গলায়। তারপর আরেকটি, তারপর আরেকটি। একপাল ঘণ্টাঝংকৃত চমরী গাই নিয়ে দায়িত্বপূর্ণ পায়ে চরাতে যাচ্ছে, দুটি তিব্বতি কুকুর! বিলিতি বইতে যাদের বলে শীপ-ডগ। তাদের পিছনে লাফাতে লাফাতে আসছে, একটি ক্ষুদে লাঠি হাতে, অতীব ক্ষুদ্র একটি প্রাণী, তার নাকের সামনে সর্দি সবুজ হয়ে আছে, গায়ে নোংরা মোটা ভুট্-কম্বলের বাকু, পায়ে জড়ানো জড়ানো রঙিন ফিতের মতন তিব্বতি জুতোমোজা। ফুটন্ত গোলাপফুলের মতন মুখটি। আমার দিকে অবাক চাউনি ছুড়তে ছুড়তে চলে গেল। বাঃ, চমরী গাইদের গিন্নিবানি রাখালীটি তো ভাল? বয়সে বছর চারেকের বেশি মনে হল না।

নেহরু গুম্ফার উঠোনে সেই লামার বাজানো গম্ভীর ঘণ্টাধ্বনির পরে, এই হালকা টুং টাং—দুটো মিলে চমৎকার একটু সুরেলা আমেজ সৃষ্টি করেছে; এই কূজনহীন ভোরের নগ্ন নৈঃশব্দ্য তবু কিছুটা ঘুচিয়েছে।

ডাক্তারের কোয়ার্টারটি সামনেই। ঢুকেই দেখি ডাক্তার বারান্দায়। দু হাতে দু কাপ চা। দেখেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল —”কোথায় গিয়েছিলেন? আমি ভয় পাচ্ছি, নতুন জায়গা, হারিয়ে টারিয়ে না যান!”—হায় রে, হারাতে চাইলেও কিছু হারাতে পারব এই জনহীন জনপদে? ঘরবাড়ি নেই গাছপালা নেই মানুষজন নেই শুধু তো পাথর! পাথরের সঙ্গে মিলে মিশে হারিয়ে যাব, এমন অবস্থা এখনও হয়নি! হলে অবশ্য মন্দ হয় না।

.

ডাক্তারের ঘাড়ে সেই যে গম্ভীর রাত্রে চাঁদনিরাতের পেতনি পিসি হয়ে চেপে বসলুম, সার্কিট হাউসে, যাবার আর চেষ্টাই করলুম না, কেন না সেটা একটা উঁচু শৈলচূড়ায় একলা বসে আছে। সেখানে বন্ধু পাব কোথায়? বাহাদুর ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছে —”এক হতা তো ঠাহ্রিয়ে, মেমসাব? ইধরপে কোঈ মেহমান নেহি আতা—” শুনে শুনে ডাক্তারও মনে বল পেয়ে এখন বলছে—”নো পয়েন্ট ইন ইওর মুভিং আউট, নাউ দ্যাট আই হ্যাড বড়োড দ্যা বেডিং—”

আমিই বা আর আপত্তি করি কেন? অসুবিধে কিছু তো নেই, বরং একটা ভাল বন্ধু পেয়েছি। লাজুক, কিন্তু মানুষটা মোটেই খারাপ নয় ডাক্তার। তা না হলে আমাকে দুপুরের আগেই আরও চারজন ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়? ডাক্তার কর, যাঁর বাড়ি থেকে বিছানা ধার করা হয়েছে, আর ডাক্তার মহান্তি, এঁরা দুজনে উড়িষ্যার, ডাক্তার গুপ্তা বিহারের।

ডাঃ করের বাড়িতেই লাঞ্চ খেলুম, ওঁর স্ত্রীর রান্না ট্রাউট মাছের ঝোল, ডাল, ভাত, আলুভাজা। খুব ভাল লাগল।

.

লাঞ্চের পর হাসাপাতালে নিয়ে গিয়ে যার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল ডাঃ লালওয়ানী, সেটি একটি “সারপ্রাইজ”। সেই প্রায়-কিশোরী মেডিক্যাল অফিসারটি ডাঃ স্বপ্না চৌধুরী, সদ্য পাস করা বাঙালি মেয়ে। স্বপ্না তার কোয়ার্টারে আমাদের ধরে নিয়ে গেল, সেখানে বিধবা মায়ের সঙ্গে থাকে সে। ছিমছাম সংসারটি দেখে খুবই ভাল লাগল। পুত্রসন্তানের কাজ করছে মেয়ে। এই পাণ্ডববর্জিত দুর্গম প্রবাসে জেনারেল হসপিটালের জাঁদরেল মেডিকাল অফিসার কে? না, একটি অবিবাহিতা ছেলেমানুষ বাঙালি মেয়ে। ওর মায়ের হয়ে আমারই তো গর্বে ছাতি দশহাত! স্বজনশূন্য দেশে অবশ্য ওঁদের স্বাভাবিক ভাবেই মন বসছে না, বদলির অপেক্ষায় আছেন। স্বপ্নাকে দেখে আমি যত না অবাক, র‍্যাশনট্রাকে চড়ে বিনা প্রয়োজনে বিনা পরিচিতিতে এমন হুট করে আমি তাওয়াং চলে এসেছি বলে, স্বপ্না এবং তার মা ততোধিক অবাক। এমনও করে মানুষ? চাকরি-বাকরিতে নয়, কাজে-কর্মে নয়, শুধু শুধুই?

হ্যালো, মিসেস লালওয়ানী

ডাক্তার চিফ ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতেও নিয়ে গেলেন, এবং আরও কয়েকজন হোমরা চোমরা অফিসারের বাড়িতে। এই ঘোরাঘুরির সময়ে রাস্তায় একটা জিপ দাঁড়াল।

—”ডাক্তার! হ্যাল্লো! তাই বলো, এই জন্যে দেশে গিয়েছিলে? মিসেস লালওয়ানীকে আনতে? হ্যালো, হ্যাল্লো!” ছুটতে ছুটতে চেঁচাতে চেঁচাতে লাফাতে লাফাতে এক ব্যক্তি নামলেন জিপ থেকে। পাহাড়ি চেহারা। খাকি পোশাক, শোলার হ্যাট, মিলিটারি নন। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

—”হ্যালো! প্লিজড টু মিট ইউ। আমি কিন্তু মিসেস লালওয়ানী নই। আমি ডক্টর সেন। আপনি?”

—”দুঃখিত। দুঃখিত। আমি দেউরি। আমি ভেবেছিলুম —”

—”আপনিই প্রথম নন, অনেকেই এখানে এরকম ভেবেছেন—তাতে কিছু না। ডক্টর লালওয়ানী কিছু মনে না করলেই হল!”

—”আমাদের এ ডি সি,” ডাক্তার সসম্ভ্রমে বলে।—আমার মুখে বোধ হয় একটা প্রশ্নচিহ্ন ফুটেছিল—যার উত্তরে ফিসফিস করে “অ্যাডিশনাল ডেপুটি কমিশনার”–জিপের পিছন থেকে কেউ একজন বলেন। তারপর “নমস্কার, আমি সুভাষরঞ্জন ঘোষ। এখানে অ্যাগ্রিকালচারাল অফিসার।”

তারপরেই দেউরিকে আমি বলছি শুনতে পেলুম—”আমাকে একটা জিপ দিতে পারেন? তাওয়াং গুম্ফা দেখতে যাব? আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি—গাড়ি ছাড়া তো যাওয়া যাবে না-

—”নিশ্চয়, নিশ্চয়, গাড়ি দেব বইকী ডক্টর সেন, আপনি আগে চলুন আমাদের অফিসে একটু চা-টা খাবেন”–তক্ষুনি সেই জিপেই তুলে নিলেন মিস্টার দেউরি আমাদের।

চমৎকার মানুষ। নিজে অরুণাচলের ওই অঞ্চলেরই ট্রাইবাল মানুষ। আই এ এস অফিসার। চমৎকার অফিস তাঁর, আধুনিক সরঞ্জাম সাজানো। যেতেই একটি সুন্দরী সারমেয়ী এসে দেউরিকে আদর অভ্যর্থনা করলে। —”কী সুন্দর কুকুর!”

—”আমাদের পাহারাদার। নাইট ওয়াচম্যান। সম্প্রতি আটটি সন্তানের মা হয়ে ব্যতিব্যস্ত আছেন, এই যা। প্রচণ্ড পাওয়ারফুল ওয়াচ-ডগ।”

—”আটটা? আমি একটা নিয়ে যাব?”

—”নিশ্চয়ই। কোনটা চাই? ওদের নিয়ে এসো তো।”

মুহূর্তেই আটটি তুলোর বল এনে সেপাইরা অফিসের কার্পেটের ওপরে ছেড়ে দিলে। যেটি সবচেয়ে মোটা অথচ সবচেয়ে চঞ্চল আমি সেটাই বাছলুম। আজকে তো নয়, সেই যাবার দিনে নিয়ে যাব। ততদিন মার কাছে থাক।

—”গুম্ফা দেখাতে ডক্টর সেনকে কে নিয়ে যাবে? ঘোষসাহেব?” সেটাই ঠিক হল।

তাওয়াং গুম্ফা

আমি তো ইতিহাস লিখতে বসিনি। তাওয়াং গুম্ফার কথা নানা জায়গায়ই আছে। আলাদা করে বলবার মতন কিছু বিশেষ জ্ঞান আমার নেই। লে-লাদাখের গুম্ফাও শুনেছি নাকি এই রকমই। বিরাট ব্যাপার। বাইরে দিকে বহু জনবসত পাথরের ঘরবাড়ি, কেল্লার মতন দেওয়ালের ভেতরে গুম্ফার চত্বর। চত্বরে খুব দীর্ঘ একটা খুঁটি, সারা গা উজ্জ্বল নানারঙে রং করা, তাতে মস্ত নিশানা উড়ছে। দেয়ালের বাইরের দিকে একজায়গায় বহু খুঁটির জঙ্গল, তাতে বহু সাদা নিশান। শুনলুম আত্মাদের শান্তির জন্যে আত্মীয়রা ওগুলো দান করে। গুম্ফার বাইরে বিরাট ঘণ্টা ঝুলছে। ভেতরে অনেক তরুণ লামা ধর্মগ্রন্থ পাঠ করছে। আশ্চর্য একটা উদাত্ত সুর। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেও পবিত্র গুম্ফা ঘরে ঢোকার আগে লাফিয়ে দড়ি টেনে ঘণ্টা বাজিয়ে ঢুকছে।

ভিতরে নানা বয়সের ছাত্র-লামার পড়াশুনো চলছে। আট থেকে আঠারো তো বটেই।

.

গোলমাল বাধল প্রধান গুম্ফার ভিতরে ঢুকে, বুদ্ধমূর্তি দেখতে গিয়ে। মূল বৃহৎ ঘরটির মধ্যে আরেকটা ছোট ঘর। সেখানে কাচের দেওয়ালের ওপাশে ঠাকুর’ আছে। অর্থাৎ বুদ্ধমূর্তি। মস্তবড় একটি ঘৃতপ্রদীপ জ্বলছে, প্রদীপটা পিতলের বোধ হয়, দেখতে সোনারই মতন।—সুভাষবাবু বললেন—”পিওর চওঁরীঘিউ।” একটি প্রকাণ্ড রুপোর বাটিতে জল রাখা কিন্তু ঠাকুর কই? বেদির ওপরে পদ্মাসনে বসা দুটি শ্রীচরণ। তারই সামনে ধূপ, দীপ, জল। উঁকিঝুঁকি মেরে বুদ্ধমূর্তির বাকিটা দেখা গেল না। সুভাষবাবু বললেন—”সিঁড়ি দিয়ে, বাকিটা সিঁড়ি দিয়ে।”—দোতলায় উঠে ভয়ে ভয়ে দেখি ওই যে বরাভয়ের মুদ্রায় দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত। স্কন্ধকাটা মূর্তি। মন ভরল না।

আবার সিঁড়ি।

সত্যি সত্যি দুটি শব্দের অর্থ এমনভাবে মর্মে মর্মে বুঝিনি আগে।—একটা হল “ক্রমশ প্রকাশ্য”, আর অন্যটা—”আপাদমস্তক”। তাওয়াং গুম্ফার বুদ্ধ এই দুটি শব্দেরই মুর্তিমান মর্মার্থ। তাঁর পা থেকে মাথা অবধি ক্রমে ক্রমে প্রকাশ পেল। সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে দেখতে পেলাম তাঁর প্রসন্ন হাসি আর অর্ধনিমীলিত চোখ।

.

ত্রিশ-চল্লিশফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তি সিংহলেও দেখেছি, কিন্তু সেই সব মূর্তি খোলা আকাশের নীচে। শ্রবণবেলগোলার জৈন মহাবীরের দীর্ঘ মূর্তিটিও এমন গুম্ফাঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে নেই। একতলায় পা, তিনতলায় মাথা বললে ব্রহ্মদৈত্যের কথাই মনে পড়ে, বুদ্ধমূর্তির কথা নয়। এভাবে দ্বিতল ত্রিতলের গৃহস্থ ঘরোয়া হিসেবে ওইসব মূর্তি তো ধরা পড়ে না। নাঃ এভাবে দেখে সুখ নেই।

মন ভরল না। মূর্তির বিরাটত্ব তো হাড়ে হাড়ে টের পেলুম, কিন্তু কই, মর্মে মর্মে শিহরণ তো উঠল না? প্রতিবার সিঁড়ি ভাঙবার সময়ে যে একটু একটু করে মনটাও ভেঙে ভেঙে যায়। এই বিশাল পিতল প্রতিমাটি যদি একটু দূর থেকে দর্শকের সামনে এক নজরেই উদ্ভাসিত হত পরিপূর্ণভাবে, তার প্রতিক্রিয়া হত অনেক বেশি।

চিনে যাইনি। কিন্তু জাপানে দেখেছি তো, কিয়োটোতে ও নারুতে বিরাট বিরাট বুদ্ধমূর্তিগুলি মন্দিরের ভিতরেই—। মস্ত উঁচু ছাদের নীচে বিশাল ঘরে, দর্শককে একনজরেই দেখা দেয় সেই মহান মূর্ত প্রতিমা, আর তার ফলও হয় শ্বাসরোধকারী।

এই গুম্ফার মূল ঘরটিও খুবই বড়, কিন্তু জানি না কেন বুদ্ধমুর্তিটিকে রাখা হয়েছে এমন আলাদা একটু খুপরির মধ্যে বাক্স-বন্দি করে। কীসের এত সতর্কতা। লিফটের জন্য তৈরি ঘরের মতো সরু লম্বা একটা ফাঁক তৈরি করে তার মধ্যে মাপে মাপে বসানো আছে এই মূর্তি। কিন্তু এই টুকরো টুকরো দেখায়, পায়ের পরে হাত, হাতের পরে মাথা,—এতে অখণ্ড দর্শনের তৃপ্তি কই? এ তো কমিক স্ট্রিপের মতন দেবদর্শন। দেখলুম বটে, কিন্তু না-দেখারই মতো। একটা অপূর্ণতা, একটা খিদে-তেষ্টা রয়েই গেল।

আমি আগে বুঝতুম না সব সাহিত্যেই প্রেমিকরা তাদের ভালবাসার নারীকে পূর্ণ নগ্নতায় দেখতে চায় কেন? আজ তাওয়াং-এর বুদ্ধমূর্তির খণ্ড খণ্ড দর্শনে বুঝতে পারি, পোশাক- আশাকের ফাঁকে ফাঁকে ভালবাসার মানুষটিকে দেখা যায় না। ও দেখায় ‘দর্শন’ নেই।

.

একদিকে কাচের আলমারির মধ্যে সহস্র বুদ্ধমূর্তি, (বোধহয় পেতলেরই, কিন্তু) বলল তো সোনার। তারপর দেখলুম, সেই অসামান্য গ্রন্থাগার। সারাজীবনে পুঁথি এমনিতেই দেখেছি দু-চারটে মাত্র! এখানে দু-হাজারের বেশি বৌদ্ধ পুঁথি রাখা আছে। প্রত্যেকটি হলদে কাপড়ে জড়ানো, দড়ি দিয়ে বাঁধা। যত্ন করে তাকে সাজানো নিয়মিত ঝাড়া মোছা হয়। আমাদের কোনও আধুনিক গ্রন্থাগারের stack-এর মতন দুরবস্থা নয় তাদের। এসব বই পড়বার সৌভাগ্য আমার নেই। আমার মাস্টারমশাই স্যার হ্যারলড বেইলি এখানে এলে, তাঁর আহ্লাদের অন্ত থাকত না। তিনি এর মর্মোদ্ধার করতে পারতেন।

সুভাষবাবু বলছিলেন অরুণাচলে গ্রামে গ্রামে গুম্ফা আছে, আর গ্রাম্য গুম্ফাগুলোতেও গ্রন্থাগার আছে। সেইসব আর্কাইভস্‌ মোটে ঘাঁটাই হয়নি। সেখানে ঐতিহাসিকদের অনেক মালমশলা মজুত। স্থানীয় ইতিহাস সেখানে জমা আছে। ইংরেজরাও এদের ঘাঁটায়নি, চিনেরাও লুটে-পুটে নেয়নি। সবই এখনও রয়েছে। গবেষকরা কেউ সেগুলো ব্যবহার করেন না। বুঝতে পারি, সেখানে অজস্র মিথ পাওয়া যাবে। অনেক হিরে-মুক্তো, অনেক ফোকলোর। শুধু তো ওতে রাজা-মন্ত্রী আর লামাদের ইতিহাসই নেই। কিন্তু তার প্রস্তুতি আমার কোথায়? অপ্রস্তুত অবস্থায় গিয়ে পড়েছি, কিছুই কাজে লাগাতে পারলুম না। কিন্তু খুব ইচ্ছে হল একটা গ্রামে গিয়ে মোম্পা উপজাতির কোনও পরিবারের সঙ্গে থাকি।

যেই মনে হল, অমনি সেটা সুভাষবাবুর কাছে পেশ করলুম। হাসিমুখে উনি বললেন—”অসম্ভব হবে কেন? দেখি চেষ্টা করে। ভাবতে দিন একটু।”

আনি-গুম্ফা

দূরে পাহাড়ের মাথায় আরেকটা সাদা গুম্ফা দেখা যায়। ওটা কী?

—”ওটা আনি-গুম্ফা। অনেকটা পথ খচ্চরের পিঠে চড়ে যেতে হবে। গাড়ি যায় না। হাঁটতেও, চড়াই তো, পারবেন না।”

—”আনি-গুম্ফা আবার কী? নেহরু-গুম্ফার মতন? কারুর নামে?”

—”না, আনি হল সন্ন্যাসিনী। আনি-গুম্ফা সন্ন্যাসিনীদের মঠ। সেখানে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। নানারি আর কী। ভারতবর্ষে মাত্র দুটি আছে। এই তাওয়াং-এ একটা, আর ধরমশালায় একটি, দলাই লামা যেখানে। খুব রেয়ার জিনিস। কদিন যদি থাকেন, খচ্চর ঠিক করে, আপনাকে পাঠিয়ে দেব ইয়েশির সঙ্গে।”

—”ইয়েশি কে?”

–“একজন আনি। আমাদের বন্ধু। হিন্দি জানে। তাওয়াং-এরই মেয়ে। এখন এসেছে।”

—”সত্যি? তার সঙ্গে আলাপ হয় না?”

—”কেন হবে না? আজই আলাপ করিয়ে দেব’খন। এই তো, পাশেই শিউ-বস্তিতে ওদের বাড়ি। ওর বাবা মা এখানে আছে। বস্তি মানে কিন্তু স্লাম নয়, বসতি।”—

ফেরার সময়ে আলাপ করে এলুম শিউ-বস্তিতে গিয়ে ইয়েশি আনির সঙ্গে। সে আমাদের লাঞ্চে নেমন্তন্ন করল পরদিন। নিশ্চয় যাব, নিশ্চয় যাব। কী সুন্দরী মেয়েটা! বছর উনিশ-কুড়ি বয়েস। ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলতে পারে, ভাঙা ইংরিজিও।—”আমরা ফিমেল মাংক” ইয়েশি একগাল হেসে বলল —”আমাদের পাপ করতে নেই। মেয়েদের এমনিতেই অনেক পাপ হয়, আনি হয়ে পাপ-কর্ম করলে আরও বেশি বেশি পাপ হয়ে যায়।” একেবারে শিশুর হাসি তার মুখে। সাত ভাই বোনের সবচেয়ে বড়, মা-বাবা তাকে আনি করে দিয়েছে। এতে তারও পুণ্য, তার বাবা-মায়েরও পুণ্য। তিন ছেলে হলে, মেজ ছেলেকে লামা করতেই হয়, গুম্ফাতে পাঠানো আইন। মেয়েদের বেলায় কোনও আইন নেই। ইচ্ছে, শখ হল, তো আনি হল। বহু সন্ন্যাসিনী আছে, বাচ্চা মেয়েরাও হতে পারে। ইয়েশি পনেরো বছর বয়সে গুম্ফাতে গেছে, এখন তার বয়েস কুড়ি।—”সকালে উঠে কী করো মঠে?”

—”পুজো করি। পুজো করতে হয়। ঘুম থেকে উঠে ঝাঁটপাট দিয়ে ধূপ জ্বেলে, বুদ্ধকে রুপোর বাটিতে পুজোর পানি দিয়ে, চা খাই। তারপর পুজো করি। যেদিন বেশি বেশি কাজ থাকে, সেদিন পুজোটা কম কম করি। পুজো করে নাস্তা খাই। কভি রোটি, কভি জাউ, কভি হালুয়া। বস্তিতে এসে র‍্যাশন নিয়ে যাই, উদুখলে আটা ভাঙি, কাজ কি কম? সন্ন্যাসিনীদের অনেক কাজ।

পয়সা? না আমাদের পয়সা নেই। পয়সা অন্য লোকেরা দেয়। যখন বাড়ি যাই, বাড়ি থেকেও পয়সা দেয়। চল্লিশজন আনি থাকি গুম্ফাতে। পনেরো দিন অন্তর তিন-চার জনে মিলে রান্না করি। সুবা-সাম পূজা করি। পড়াশুনোও করি।” পাঁচ-ছটি ছোটা-আনিকে এক একজন বড়া-আনি বসিয়ে তিব্বতি ভাষা শেখায়। পুঁথি পড়তে শেখায়। সারাদিন পড়াশুনো হয় তাদের। হেড-আনি আছেন একজন। চাবি থাকে তার কাছে। ধর্মগ্রন্থের চাবি। এ ছাড়া আর চাবি দেবার কী আছে আনিদের?

অবশ্য হ্যাঁ, জীবনে আনিদের অনেক কিছু ‘মনা হ্যা।’ যেমন—’ঝুট নাহি বোল না। চোরি নাহি কর না, শাদি নাহি কর না, প্যার নাহি কর না, আদমিকা সাথ কুছ্ নাহি করনা, বাত-উত কুছবি নাহি! কিসিকা সাথ বাত করনা, ঘুম্না ফির্না, তো বদনাম তো জায়েগা প্যার কর্ লিয়া বোলকে। তভি কোঈ কোঈ আনি ভাগ্ যাতা, কিসিকো মিল্ গয়া, তো গুম্ফা ছোড়কে ভাগতা, শাদি কর্ লেতা।’ ফাইন দিতে হয় অবশ্য, আনি-লামাদের ‘চায় খিলানা পড়তা’।

যারা পালায় না, তিন-চার বছর সন্ন্যাস নেবার পরে ভাল করে একটা পুজো হয় হাজার/পাঁচশো/একশো যে যেমন পারে, আত্মীয় স্বজন গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে পুজো দেয়। তারপরে সে ভালরকম সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনী হয়ে যায়।।

তিন শত্রুর

এইসব গল্প-গুজব শিউ-বস্তির সীমানায় এক তিব্বতি চা-দোকানে। তিব্বতি নমক্‌-চায় খেতে খেতে। ডাক্তারের সঙ্গে কাল তাওয়াঙে এখানে ওখানে ঘোরবার সময়েও চা-ঘরে ঢুকে চা খেয়েছি। তখনই শিক্ষাটা পেয়েছি, তিব্বতি “টি সেরেমনি টা কেমন ধারা। গোল কালোরঙের কাঠের সুদৃশ্য বাটির ধারে ধারে পেতল আর তামার পাত বসানো ও পুঁতির রঙিন কারুকার্য। চায়ের স্বাদ অনাস্বাদিতপূর্ব।

আমি ধাবার চা খেয়েছি, এক ফুট দু-ফুট, হতে হতে গজের চা (ছোট করে কড়া করে), চিনে-চা খেয়েছি; যুঁইফুলের গন্ধ ভাসানো, জাপানি চা খেয়েছি, হাঁটুমুড়ে বসে, দু হাতে বাটি ধরে, সবুজ রং, বুনো গন্ধ, খেতেও (যতই কায়দা করে পরিবেশন করুক) বন্য। কুম্ভমেলায় সাধুর তৈরি প্রসাদি চা-ও খেয়েছি, এলাচ-দারচিনির গন্ধে, মালাইয়ের স্বাদে, পায়েস-পায়েস। কিন্তু তিব্বতি চায়ের তুলনা হয় না। মুখে ছুঁইয়েই চমক লাগল। মনে হল কেউ আমার সঙ্গে ঘোর বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কান্নাই পেয়ে গেল। এত বীভৎস স্বাদের চা নিজে তৈরি করে খেলেও হয় না। আমিই বিশ্বের নিকৃষ্টতম চা-করি বলে জানতুম। কিন্তু গোটা তিব্বতি জাতটা আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। স্বেচ্ছায়, পূর্ণ সচেতন প্রয়াসে কেউ কখনও এমন একটা পানীয় প্রস্তুত করতে পারে?

অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের রুচির ওপরেও ঘেন্না এসে গেল। গল্প শুনেছিলুম তিব্বতে রেকর্ডেড প্রথম বাংলা শব্দগুলি হচ্ছে—”ভাল, ভাল, খুব ভাল।” এই শব্দগুলি উচ্চারণ করেছিলেন অতীশ দীপঙ্কর জীবনের প্রথম পাত্র তিব্বতি চা পান করবার পরে। হায়, একজন বাঙালি হয়ে এই স্বাদজ্ঞান?

ঘোর নোনতা। ঘি-দেওয়া, আঁশটে গন্ধ, তেল-ভাসানো,—অ্যাঃ—মুখে দিয়ে সত্যি সত্যি গা গুলিয়ে বমি এসে যায়। অনেকটাই অবশ্য আশাতীতের ধাক্কা! খাওয়া ভীষণ মুশকিল। অথচ, ডাক্তার বলল, চা শেষ করতেই হবে। ফেলে দেওয়া অপমান। এমনকী দোকানেও। অ্যালুমিনিয়মের তৈরি গোলাপ জলের ঝারির মতন গড়নের, মস্ত বড় কুঁজোটাইপ চা-দানি। তার থেকে চা ঢেলে দিচ্ছে একটি রূপসি দুর্গন্ধময় তরুণী, ভুবনমোহিনী তার হাসিটি। ভাষা বুঝি মা কেউ কারুর। প্রতিবার চা ঢেলে কুঁজোটি ঠক করে মাটিতে নামিয়ে রাখছে। তারপর আবার তুলে কাপে দিচ্ছে। এরকমই নিয়ম। জগতের যাবতীয় বীরত্বপূর্ণ কর্তব্যনিষ্ঠা, দুঃসাহসিক কাজকর্মের কথা স্মরণ করতে-করতে ক্যাসাবিয়াংকার পদ্য মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে যেই বাটিটি খালি করেছি, অমনি পেটের মধ্যে প্রচণ্ড গুলিয়ে উঠেছে। আপ্রাণ মনোবলে সেটা দমন করেছি,—অমনি মিষ্টি মিষ্টি হেসে, আবার আমার চায়ের শূন্য বাটি পরিপূর্ণ করে দিল মেয়েটি! এই অমানুষিক দৃশ্যে আমার সত্যি কান্না পেয়ে গেল এবারে। ডাক্তার সহানুভূতির সঙ্গে আস্তে আস্তে বললে—”উপায় নেই। তিনবার খেতেই হবে। নিয়ম। এরা কিন্তু ভীষণ রিচুয়ালবাদী, নিয়মমাফিক চলে। কষ্ট করেও খেয়ে নিন। খারাপ তো কিছু না। শরীরের পক্ষে ভালই। চমরী গাইয়ের মাখন ওতে আছে, চমরীর দুধ আছে, নুন, আর চা। আছে তো এই! খেয়েই ফেলুন! যে দেশের যা! ফেলা চলবে না কি না? তা হলে ট্রাইবালরা অপমানিত হবে।” দ্বিতীয় বাটি শেষ হতে না হতে তৃতীয় বাটি। তৃতীয় বাটি শেষ করতে এক ঘণ্টার ওপর লাগল। সঙ্গে ছিল অবশ্য একরকম শুকনো নিমকি, তেল-তেলে জিলিপি, আর বিস্কুট। সেইসব দিয়েই ব্রেকফাস্ট সেরেছিলুম তাওয়াং-এর প্রথম প্রভাতে। সেই প্রথম নমক্‌-চা খেতে শিখলুম। একটা ফুটদুয়েক লম্বা মতন কাঠের উদ্‌খলের ভেতর মেড়ে মেড়ে ওই চা তৈরি হয়। সেটা দেখতে ভারী সুশ্রী যন্ত্র।

কে বলবে তার গর্ভ থেকে অমন দুর্দান্ত বিস্বাদ বস্তু বেরুবে?

যাই হোক শিউ-বস্তির এই চা-দোকানে আর বোকা বনিনি। দিব্যি খেতে লাগলুম প্ৰথম কাপটি। কিন্তু ফুরিয়ে যেতেই ভয়-ভয় করতে লাগল। “ও বাবা! আরও দু কাপ বাকি!” বলে ফেলতেই সুভাষবাবু হাসতে হাসতে বললেন—”কায়দাটা শিখে নিন! খানিকটা খেয়ে, কাপটাকে মাটিতে নামিয়ে রাখবেন। তা হলেও ওরা বাটিটা ভরে দেবে। আবার খানিকটা খেয়ে, ফের মাটিতে বাটি রেখে দেবেন। ওরা আরেকবার ভরে দেবে। তা হলে এই দেড়বাটিতেই তিনবার পরিবেশনের কাজটা মিটে যাবে। রিচুয়ালও রইল, পেটও রক্ষে পেল। তবে কী দু-একদিনের মধ্যেই অভ্যেস হয়ে যাবে। আর বিস্বাদও লাগবে না, চমরী-ঘিয়ের জন্যেই ওই আঁশটে গন্ধটা হয়। আমার তো এখন তিব্বতি চা খেতে বেশ ভালই লাগে।”

—”আপনি হাফ তিব্বতিই হয়ে গেছেন বোধ হয়, দশ বছর এই তিব্বতে থেকে।”

অধরা মাধুরী

—”সর্বনাশ! তিব্বত বলবেন না ম্যাডাম, দিস ইজ ইন্ডিয়া! দেখছেন না চতুর্দিকে কেমন ‘আওয়ার ইন্ডিয়া” পোস্টার মারা?

—”আমরা ভারতীয় বলে গর্বিত, প্ল্যাকার্ড টাঙানো? কলকাতায় কখনও এসব দেখেছেন? কিংবা দিল্লিতে?”

—”কিন্তু দেশটা যে তিব্বত তাতে কি কোনও সন্দেহ আছে? মানুষগুলো তিব্বতি উপজাতি, তাদের ভাষা তিব্বতি, তাদের খাওয়া দাওয়া, পোশাক-আশাক, ধর্ম-কর্ম, সবই তিব্বতি, মায় কুকুর বেড়াল গোরু ছাগলগুলো পর্যন্ত তিব্বতি, টিবেটান হাউনড্, লাসা আপসো, আর ইয়াক—তবু বলবেন এটা তিব্বত নয়?”

—”জ্বালালেন ম্যাডাম আপনি! কবিতা-ফবিতা লেখেন, না জানেন পলিটিকস্ না জানেন হিস্ট্রি, না অ্যানথ্রপলজি—তিব্বতি কালচার মানেই যে তিব্বত নয়, এটাও বোঝেন না? জলপাইগুড়ি তো আঠারো শো ষাট-সত্তর পর্যন্ত ভুটানের অন্তর্গত ছিল। তা বলে কি ওটা ভুটান? দার্জিলিং তো তার বিশ-ত্রিশ বছর আগে পর্যন্ত সিকিমের অংশ ছিল, তা বলে কি দার্জিলিং এখন সিকিমে? যে তাওয়াং হবে তিব্বতে? চিনেরা যে কথা বলে, আপনিও, সেই কথা বলবেন?”

সত্যি, বড্ডই মুখ্যুর মতন কথাবার্তা বলছি।

—”আচ্ছা, চিনেদের আপনি দেখেছিলেন?”

—”কী করে দেখব? আমি তো সাতষট্টিতে এলাম। তবে যে-পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল, চিনেদের তৈরি সেই পথটা দেখেছি! লাসা-তাওয়াং রোড। দশদিনের মধ্যে ব্যাটা চিনেরা আশ্চর্য রাস্তা বানিয়েছে, সত্যি। এত বছর, পনেরো বছর তো মেইনটেনান্সের নামগন্ধ নেই। তবুও একদম ঠিকঠাক আছে। জিপ যেতে কোনওই অসুবিধে হয় না। “

ওই পথেই কিছুদূর গেলে, মানস সরোবরের রাস্তা। অপূর্ব এরিয়া, জানেন? মাইল দশেক পর্যন্ত যাওয়া যায়, কেউ কোনও বাধা দেয় না, এ ডি সি-র পারমিশন নিয়ে পিকনিকে গিয়েছিলাম। অদ্ভুত একটা নীল পদ্মতারা দীঘি আছে। কত হাঁস। এই রাস্তা থেকেই মাইল কয়েক ভিতরদিকে গেলেই কৈলাস, মানস সরোবর।” বলেন কী? এইখানেই? এত কাছে?—মানস? কৈলাস? বাঃ! অমনি, “আমিও যাব, আমিও যাব” করে ভয়ানক ঝুলোঝুলি শুরু করলুম। তাতে যখন হল না, তখন—”চুপি চুপি চলুন যাই” বলেও অনেক গূঢ় চেষ্টাচরিত্র করলুম। কিন্তু নো লাক। অনড় হয়ে সুভাষরঞ্জন বললেন : “অমন হট করে হয় না। পারমিশন চাই।” তবু দয়া করে খানিকটা আমাকে ঘুরিয়ে আনলেন ওই স্বপ্নের রাস্তাটার পাশ দিয়ে। অনেকখানি উঁচুতে সোজা পরিষ্কার, চওড়া রাস্তা চলে গেছে উত্তর পশ্চিমে। একেবারে কৈলাস, মানস সরোবর পার হয়ে সেই লাসানগরীর চির-রহস্যের আড়ালে। আর ওইখানেই সেই অধরা মাধুরী—ম্যাকমাহন লাইন।

.

—”লাসা-তাওয়াং রোড?” মিস্টার সাইগল বললেন, “ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একটা অসামান্য উদাহরণ।”

ওখানকার চিফ ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার সাইগলের বাড়িতেই পরোটা সবজি খেতে খেতে রাত্তিরবেলা গল্প হচ্ছিল। ছেলেদের মধ্যে তাস আর রামও চলছিল, চওড়া তক্তপোশের ওপরে। সাইগলদের বাচ্চাদুটি তারই এক ধারে। শুচ্ছে না কিছুতেই, আড়চোখে তাকাচ্ছে হাসছে। খালি দুষ্টুমি করছে। তাওয়াংয়েই ইস্কুলে পড়ে তারা। মিসেস সাইগলের ইচ্ছে, বড় হলে কোনও ভাল বোর্ডিংয়ে দেওয়া ওদের।

—”লাসা-তাওয়াং-রোড তো একটা মেয়ের তৈরি”–মিসেস সাইগল বলেন।

—”সে কী? সত্যি?”

—”হ্যাঁ, ছাব্বিশ বছর বয়স্ক একটি চিনে মেয়ে, আর্মি ইঞ্জিনিয়ার। তারই তৈরি এই রাস্তা। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।—”চোখে না দেখলে বিশ্বাস হত না যে এই অলটিচ্যুডে এই অ্যাভেলেবল মেটিরিয়ালস দিয়ে এমন রোড বিল্ডিং সম্ভবপর। এবং সময়ই বা কত? দশ দিন। ওই পথে আসবে কী? না হেভি ভিহিক্লস। ট্যাংক ইত্যাদি। একটা আশ্চর্য, প্রচণ্ড অ্যাচিভমেন্ট এই লাসা-তাওয়াং রোড। লোকাল পাহাড়িদের কাজে লাগিয়ে পাথর দিয়ে জলা-জমি ভর্তি করেছে। মাটি শক্ত হলে তাতে কাঠের বিম আড়াআড়ি ভাবে, রাইট অ্যাঙ্গেলে ফেলেছে। বিমগুলো সাজিয়েই রাস্তাটা তৈরি করেছে। ওই সব কাঠ আসবার পথে গাছ কেটে তৈরি করে নিয়েছে, নিজেরাই বয়ে এনে ফেলেছে কেন না এ অঞ্চল তো ট্রি-লাইনের ওপরে, এখানে বড় গাছপালা গজায় না। ওদিকের উপত্যকা থেকেই গাছ কেটে বিম বানিয়েছে। সব সেই মেয়ের বুদ্ধি!”

.

এই সেই বিখ্যাত ম্যাকমাহন লাইন। ৪০০০-১৯০০০ ফুট অলটিচ্যুডে বিস্তৃত এই তাওয়াং বর্ডার সাবডিভিশন, কামেঙ ডিস্ট্রিক্টের মধ্যে। পাশেই, লুমলা গ্রামের ওপরে তিব্বত-ভুটান সীমান্ত। সে-লা পাসের ওপাশে আছে বুমলা পাস, সেটাই ভুটানে যাবার রাস্তা। সেলার চেয়ে আরও উঁচু। আমার খুবই ইচ্ছে হল, বুমলা গিরিপথে বেড়াতে যাবার, এবং সেখান দিয়ে ভুটানে যাবার—কিন্তু হাতে তো মোটে সময় নেই। ছুটি খতম। কলেজ এবারে খুলে যাবে।

সত্যি সত্যি তো বনের পাখিটি নই আমি; শেকল না থাক, তবু দাঁড়েরই পাখি। খাঁচায় থাকি না বটে, কিন্তু ফিরে ফিরে যেতেই হয়। সেইখানে যে দানা-পানি বাঁধা আছে! আর, বনের পাখিরও তো বাসা থাকে, বাসাতে লাল টুকটুকে হাঁ-করা ছানারা থাকে। ফিরতে হয় তাকেও। মুক্তি কখনও নিশ্চয় নয়! আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন পরে বাঁধা সবার কাছে। আর আমরা তো তুশু প্রাণী। উড়াল দিই, ফিরেও আসি।

—”তিব্বতি গ্রামে যাবেন বলছিলেন? এই যে লামা পেমা খাণ্ডু, ইচ্ছে করলে এর বাড়িতে থাকতে পারেন গিয়ে। এ হিন্দি বলতে পারে।” সুভাষবাবুর সঙ্গে সুন্দর দেখতে একটি তরুণ লামা আমাকে “নমস্তে” বলছেন। কথা হয়ে গেল, বিকেলবেলায় ওর ছোট্ট গ্রামে সাম্‌প্রুং (চমপ্রুং?) যার নাম, জিপ আমাকে নিয়ে যাবে। পেমা খাণ্ডুই আমাকে রিসিভ করবেন সেখানে। এখনই গ্রামে ফিরে গিয়ে বাড়িতে খবর দিতে হবে তাঁকে। বেচারি এ ডি সি-এর অফিসে কী কাজে এসেছিলেন, হঠাৎ সুভাষবাবু ওঁকে ধরে ফেলেছেন। এ ডি সি আজ তাওয়াং-এ নেই, কাজও উদ্ধার হচ্ছে না। আমি তো মহা উল্লসিত। দুপুরে যাচ্ছি ইয়েশি-আনির বাড়ি মধ্যাহ্ন ভোজনে, ডিনার খাব লামা পেমা খান্ডুর বাড়িতে। ‘তিব্বতি লাইফ’ তবু খানিকটা দেখা হবে। লামাদের, আর আনিদের জীবনযাত্রার ধরন সম্বন্ধেও কিছুটা ধারণা হবে।

এস টি ডি!!

শিউ-বস্তিতে, ওদের বাড়ির সামনে ইয়েশি-আনি অপেক্ষা করছিল। একমুখ হেসে আমাদের দোতলায় নিয়ে গেল। নীচে একটা বড় ঘর, উপরে একটা ছোট্ট ঘর। সব তিব্বতি বাড়িতেই কেবল এই দুটি ঘর থাকে। নীচেরটি ঘর-সংসারের, বসবাসের, উপরেরটি পুজোর। এটাই ছেলেপুলের পড়ার ঘর, বা অতিথি এলে বসানোর।

নীচের ঘরে পুরো সংসার। রান্না খাওয়া শোওয়া বসা। উপরেরটি ছিমছাম। নিভৃত। ছোট দেড়তলার ঘর। ওর বাবা সেখানেই অপেক্ষা করছেন। আমাদের স্বাগত জানালেন, বসালেন। ছোট ছোট ভাইবোনেরা উঁকিঝুঁকি মেরে যেতে লাগল। নিমন্ত্রিত তিনজন। ডাক্তার, আমি, আর সুভাষবাবু। সকালে ডাক্তারের ডিউটি ছিল। লাঞ্চে তাকে তুলে নেওয়া হয়েছে তার ‘এস টি ডি ক্লিনিক’ থেকে।

—”এস টি ডি ক্লিনিকটা কী বলুন তো? টেলিফোনে তো একটা STD সার্ভিস চালু হয়েছে—এটাও বুঝি টেলিফোনের কিছু?” হঠাৎ দেখি ডাক্তার সেই আগের মতন লালচে হতে শুরু করেছে! টুকটুকে লালই হয়ে গেল। ব্যাপার কী?

সুভাষবাবুও কিছু বলছেন না।

তাঁকে অবশ্য কেউ সুভাষবাবু বলে না, আমিই জোর করে বলছি। সবাই ওঁকে মিস্টার ঘোষ বলেই ডাকে। এখানে ওসব বাবু-ফাবু চলে না। এ হচ্ছে মিলিটারি এরিয়া বলে কথা! এখানে এমনি সিবিলিয়ানদের পুলিশ পর্যন্ত নেই, কেবল সি আর পি! হুঁ!

তবুও, আমি সুভাষরঞ্জনবাবু বলেই ডাকতে থাকি তাঁকে। একটা যাচ্ছেতাই গেঁয়ো বাঙালিয়ানায় মাঝে মাঝে আমাকে পেয়ে বসে। মিষ্টার অমুক’ আমার একদম ভাল লাগে না।

—”কী ব্যাপার? এস টি ডি ক্লিনিকটা কী?”

—”এটা কি জিজ্ঞেস করাই ভুল হয়ে গেছে? কেন?”

—”ওটা কি মিলিটারির কোনও সিক্রেট কোড-ফোড নাকি? থাক তা হলে! কিন্তু কেউ কিছুই বলছেন না কেন?…”

আমার পরের পর প্রশ্নে উত্ত্যক্ত হয়ে সুভাষবাবু বলেন—”ওটা হল ভিনিরিয়াল ডিজিজের ক্লিনিক।”…

“অ! কিন্তু তাকে তো ভি ডি বলে! তাই না? এস টি ডি মানেটা কী?”

—”ভি ডি এখন আউট অফ ফ্যাশন। নতুন শব্দটা হচ্ছে সেকশুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ! এস টি ডি”—

একটু গলা খাঁকারি দিয়ে নিয়ে, আর কলারটা সোজা করে, এবার ডাক্তার নিজেই জবাব দেয়। ও হরি, তোমাকে হর রোজ এই রোগের চিকিচ্ছে করতে হয়, আর তুমিই কিনা বিনা কারণে লজ্জায় লাল হয়ে যাও, ঘরে একটা ভদ্রমহিলা থাকলে ঘুমুতে পারো না? হায় রে, কোন মানুষের কী শাস্তিই হয়েছে, রুজি রোজগারের জন্যে!

কথা চালানোই উচিত। তাই বলি—

“এখানে বুঝি খুব S T D হয়?”

—”হয় না আবার? এখানে চারটেই তো প্রধান রোগ। কৃমি, কুষ্ঠ, ভি ডি, আর টি বি। বড্ড ভোগে এই সব রোগে পাহাড়িরা।”

—”বাপরে। চারখানাই বেশ জবরদস্ত। চট করে সারবার নয়।”

—”ভি ডি-টা পেনিসিলিনে, আর টি বি-টা স্ট্রেপ্টোমাইসিনে—আজকাল এ দুটো রোগ তবু অনেকটা কন্ট্রোলে। কৃমি আর কুষ্ঠটা এখনও ঠিক—”

লাক্ষার কারুকার্যকরা ট্রেতে করে কতগুলি চিনে-দর্শন বাটিতে গরম গরম সাদা রঙের পানীয় সাজিয়ে আনে ইয়েশি আনি।

—”সিং ছাং”, সুভাষবাবু বললেন, “অ্যাপিটাইজার।”

– “মদ?”

—”ওই হল। ওয়াইন মনে করে খেয়ে ফেলুন। হার্মলেস। এখানে বাচ্চারাও খায়, রিচুয়াল ড্রিংক, গা গরম রাখে। চা যেমন। আসলে এক ধরনের ফিলটার্ড বিয়র আর কী।”

.

খেতে খারাপ লাগল না সিং ছাং। বাটি ফুরোলে আবার। এও তিনবার। ডাক্তার আর ঘোষমশাইয়ের তিন কেন, আরও অনেক বারেও আপত্তি ছিল বলে মনে হল না, কিন্তু খাদ্য এসে পড়ল। মোমো আর থুপ্পা। সিং ছাংটা গরম গরম খেতে অনেকটা জাপানি “সাকে”-র মতো। বেশ সুস্বাদু পানীয়, খুব তীব্র কিছু নয়।

এবার আমার মাথায় একটা ব্যাপার স্ট্রাইক করল, বিদ্যুচ্চমকের মতো। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান নিশ্চয় তিব্বতি চা খেয়ে ওই প্রশংসা বাক্যটি বলেননি, বলেছিলেন নির্ঘাত ছাং খেয়ে। কিন্তু একে মধ্যবিত্ত বঙ্গসন্তান, তায় মহামান্য পণ্ডিতপ্রবর-তাঁর তো একটা মান সম্মান আছে? গল্পটা চালানোর সময়ে আমরা বাঙালিরা তাই ছাং-টা আর না বলে, চা বলে চালিয়ে দিয়েছি নিশ্চয়ই। অতবড় পণ্ডিত মানুষটি উষ্ণ মদ্যপানে আহ্লাদিত হইয়া বারংবার গদগদ কণ্ঠে উচ্চ প্রশংসা করিতে লাগিলেন, এটা শুনতে যেন কেমন-কেমন!

মোমোর ভেতরে চমরীর সেদ্ধ করা মাংসের পুর ভরা, সঙ্গে লঙ্কার চাটনি, থুপ্‌পাতেও শাকসবজি এবং মাংস, খুবই স্বাদু দুটোই। ওর মা ট্রেতে করে খাদ্য এনে আমাদের দিতে লাগলেন, বাচ্চারা হাসিমুখে দরজায় উঁকি দিতে লাগল।

—”ওরা খাবে না?”

—”ওদের খাওয়া অনেকক্ষণ শেষ।”

ইয়েশির বাবা আমাদের সঙ্গে খাচ্ছেন, কিন্তু ইয়েশি আর তার মা খাচ্ছেন না।

—”আপনারা কখন খাবেন?”

—”এইবারে খাব। আপনাদের হয়ে যাক।”

ওরা সাতভাই বোন শুনেছি কিন্তু বাড়িতে অতজনকে দেখা গেল না। কেবল গোটা তিন চার অ্যান্ডা-গেন্ডা বাচ্চাই ঘুরছে।

ইয়েশি খুব যুবতী, কিন্তু শিশুর সারল্য ওর চোখে। খুব সিরিয়াসলি পাপ-পুণ্যের কথা বলে। তখন চোখমুখের চেহারা কী!

—”আনিরা শাদি করে না কেন? ইয়েশি? লামারা তো করে, শুনলুম?”

—”ছোটা লামারা শাদি করে, লেকিন বড়া লামারা করে না। ওরা কেবল গুম্ফাতেই থাকে। ওদের ঘর নেই। আনিরাও তো গুম্ফাতেই থাকে। গুম্ফায় যারা থাকে তারা কেউ শাদি করে না। আনিদের কুমারী থাকা নিয়ম। আনি শাদি করলে পাপ হয়।”

—”যারা পালিয়ে গিয়ে শাদি করে? তুমি যে বলেছিলে? তাদের কী হয়?”

—”কিছুই না। শুধু ফাইন হয়। গুম্ফায় থাকতে দেয় না আর। গুম্ফার সব আনিদের একদিন চায় খিলানা পড়তা।”

আর যা হয়, তা হয় ‘মরণকা বাদ মে।”

—”মরণকা বাদ মে আবার কী হয়?”

–বাঃ। পাপ হবে না?

—”ভগবানকা দেশমে যানা মুশকিল হো যাতা ইসমে। একদিন কা পাপসে এক জনম কা পুণ্য চলা যাতা—মাটির নীচে পোকা হয়েও জন্মাতে হতে পারে। অন্তত, চওরী জনম তো লেনাই পড়েগা, সাঁপজনম ভি হো সক্তা”—মোটকথা ভয়ংকর সব শাস্তি যে হবেই, ইয়েশির মনে সংশয়মাত্র নেই।

—”গেটোম্পা দেখেছ?” ইয়েশি আনি আমাকে জিজ্ঞেস করল।—”তাওয়াং গুম্ফায়?”

—”না তো। গেটোম্পা কাকে বলে?”

–“গেটোম্পা কাকে বলে? আটটা বড় বড় বই, যাতে বুদ্ধদেবের জীবনকথা আর উপদেশাবলী আছে। তিনখণ্ড আবার সত্যি-সত্যিই সোনার অক্ষরে লেখা। তিব্বতের জিনিস, এই গুম্ফায় আছে। তবে বোধ হয় সবাইকে সে সব দেখতে দেয় না।” সুভাষবাবু বলেন।

আসলে তাওয়াং গুম্ফায় প্রধান মন্দির ছাড়াও অনেক ছোটখাটো স্তূপ, মন্দির, তান্ত্রিক মুর্তিটুর্তি ওই মন্দির প্রাঙ্গণের চারিপাশে আছে। আমি সেই সব ঘুরে ঘুরে দেখছিলুম। দেখছিলুম ঘুচি ঘরগুলো, যেন জেলখানা, ঘিঞ্জি গলিপথ, এক বৃদ্ধা ভিক্ষুণী নুয়ে পড়ে কেমন চত্বরটা ঝাঁট দিচ্ছেন, চশমা চোখে আরেকজন কিছু শস্য ঝাড়ছেন বাছছেন একটা চৌকোমতো কুলোয়। ওপাশে শিউ-বস্তি শুরু হয়েছে। তার অলিগলি, তার ঝর্না-কলতলা, তার দারিদ্র্য, তার বাসিন্দাদের দোকানপাট, জীবনযাপন।

দুপুরবেলায় তাওয়াং রেডিয়ো স্টেশনে আমার ছোটখাটো একটা সাক্ষাৎকার নিলেন একটি যুবক : কেমন লাগল এই ট্রাকে চড়ে তাওয়াং-এ চলে আসা? আমি কোথায় কী কী পড়াশুনো করেছি? এখন কী করি? কী লিখি? কী পড়ি? রেডিয়ো স্টেশনটি একটু উঁচুতে, নির্জন পাহাড়ের ওপর। ব্যারাক বাড়ির মতন কাঠের ঘরদোর।

রেডিয়ো থেকে সুভাষবাবু আমায় তাওয়াং-এর আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট্স সেন্টারে নিয়ে গেলেন, সেখানে মাত্র তিনদিনের জন্যে উদ্বোধন করতে গিয়েই শ্রীমতী কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় আটকে গিয়েছিলেন তাওয়াং-এর টঙে, হপ্তার পর হপ্তা। সেখানে কার্পেট তৈরির কারখানাটাই সত্যি দেখবার মতন। একটাও কার্পেট বিক্রির জন্যে তৈরি নেই। সবগুলো তাঁতে। সবই বোনা হচ্ছে। সময় নেয়। ফুল লতাপাতা ড্রাগন স্বস্তিকা চড়া রঙের আশ্চর্য চিনে প্রাচীন ডিজাইনের তিব্বতি উলের গালচে। অর্ডার দিয়ে গেলে পাঠিয়ে দেবে। আমি একটা অর্ডার দিয়ে দিলুম। তিনমাস লাগবে বুনতে, যেতে একমাস তো বটেই। (সেই কার্পেট কিন্তু কোনওদিনই এসে পৌঁছয়নি। ডাক্তার আর সুভাষবাবুর প্রমিস-করা রঙিন ফোটোগুলিও!)

কার্পেট বোনা ছাড়া, নানারকমের কাঠের কাজও হচ্ছে সেখানে, কাঠের ফুলদানি, অ্যাসট্রে, তৈরি হচ্ছে, রং হচ্ছে। চমৎকার! কালোতে লালেতে সোনাতে সবুজে অদ্ভুত ঝলমলে সব ড্রাগন আঁকা হয়ে যাচ্ছে তাতে। আমি অনেকগুলো নিলুম। প্লেন, না-আঁকাগুলিও ভারি চমৎকার খুবই সুন্দর দেখতে সাদা ধবধবে কাঠ। সুন্দর একটা নমক্‌-চা-তৈরির যন্ত্র কিনতে খুব লোভও হয়েছিল, সুভাষবাবু বারণ করলেন, বললেন ‘কাজে তো লাগবে না। সেটা সত্যি! কিন্তু গোলাপজলের ঝারির মতন সেই চা-দানিটা পেলে, কিনতুম। ছিল না। ‘বুখারী’ ছিল নানা সাইজের, আর আগরবাত্তি। শুনলুম হাতে তৈরি কাগজ এখানকার একটা বিশিষ্ট শিল্প কিন্তু কিনতে পেলুম না কিছুই। কাঠের পাত্রে ছবি আঁকা হচ্ছিল একটি ঘরে। এক বৃদ্ধ-তিব্বতি, আর কয়েকটি বালক-তিব্বতি দিব্যি গোল হয়ে বসেছে রং তুলি নিয়ে। চমৎকৃত হয়ে দেখি রংটা হচ্ছে ক্যামেল, পোস্টার কালার। কাঠের পাত্রগুলি রং করা হচ্ছে প্রথমে তারপর তাতে কোপ্যাল ভার্নিশ চড়ানো হচ্ছে। যেমন আমরাও করি কলকাতার বাড়িতে। তাওয়াং-এও এই রং? দেখে মনটন খারাপ! শুনেছিলুম স্থানীয় কায়দায় মাটির রং তৈরি করে ব্যবহার করাই নিয়ম। সে আর এই এলাহি সরকারি বাণিজ্যিক প্রকল্পে মানলে চলবে কেন? সে গ্রামেই চলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *