ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে – ৪

মাদ্রাজ হোটেল

—”উঠুন মেমসাহেব উঠুন ভালুকপ এসেছে। পারমিট দেখাতে হবে।”

ব্যাগটা নিয়ে আবার হাত বাড়াই। অন্ধকারে কেউ আমার হাতটা ধরে নেয়। আর ধাপগুলোতে টর্চের আলো ফেলে। আমি নেমে পড়ি। নামতে নামতেই মনে হয়, এত কষ্ট না করে পিছন ফিরে ফিরে নামলেই হয়। ভেতরে ছোট হাতল মতন আছে যা ধরে নামা যায়।

মিলিটারি চেক-পয়েন্টে পারমিট দেখাতে গিয়ে আবিষ্কার করি লম্বু ডাক্তারকে এরা ভালই চেনে।

‘হ্যাল্লো ইয়ার’।! ‘হাই ডক্টর’। ইত্যাদি হচ্ছে। মিলিটারির ছেলেগুলোরও বয়েস বেশি নয়। এখানে তাঁবুতে আছে হই হই করে।

—”ডাক্তার, ডিনার খাবেন না?”

—”আমি এখানেই খেয়ে নেব। ওই যে মাদ্রাজি হোটেল।”

সত্যি সত্যিই তো! এই পাণ্ডববর্জিত পার্বত্য অঞ্চলে নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ারের সংকটময় চেক পয়েন্টে হাফ-ধুতির ওপরে শার্ট ঝুলিয়ে দিব্যি শান্ত, হাসিমুখে ইলি-দোসার দোকান দিয়েছেন সুদূর দক্ষিণাবর্তের কোনও উদ্যোগী মহাপুরুষ! সামনে Madres Hotel বলে সাইন বোর্ড টাঙানো। ভেতরে বেঞ্চি, টেবিল পাতা। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা আছে, দোসা, ইডলি, কারি, রাইস, লস্যি, কফির দামের তালিকা। দাম মোটেই বেশি নয়। কলকাতার চেয়ে কমই অথচ এইখানে মালপত্র বয়ে আনা কি সোজা? এখানে দক্ষিণী রান্নাঘরে কাজের লোক রাখা মানেই দক্ষিণ থেকে আমদানি করা—তার ট্রেনভাড়া নেই? বুঝলুম, দক্ষিণেই ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ বাঁধা পড়ে গেছে।

পাশাপাশি বসে আমরা দুজনে একই গরম গরম মশলাদোসা আর একই মাদ্রাজি কফি খেলুম, দারুণ লাগল! কিন্তু লম্বু ডাক্তার একটাও কথা কইলে না। যেন আমাকে চেনেই না জগতের যত লজ্জা সংকোচ আমার সঙ্গে কথা কইবার বেলায় যেন বেয়নেট বাগিয়ে তেড়ে যায় তার দিকে।

নিজের নিজের বিল চুকিয়ে দুজনে একই সঙ্গে লরিতে নিঃশব্দে ফিরে গেলুম। আবার গাড়ি চলল।

ধন্যি মাদ্রাজ হোটেল! বেশ দু-তিনদিন দক্ষিণী পুরুষমানুষকে কর্মব্যস্ত দেখলুম। কেউ রান্না করছে, কেউ পরিবেশন করছে, কেউ হিসেব রাখছে, টাকা গুনছে। আমি না জিজ্ঞেস করেই পারলুম না—”আপনারা মাদ্রাজের লোক বুঝি?”—যিনি টাকা গুনছেন তাঁকেই প্রশ্ন করেছি। সম্ভবত দোকানের মালিক তিনিই। মিষ্টি হেসে জবাব হল :

—”না!”

আমি তো অবাক। মাদ্রাজের নন? তবে?

—”কেরালার। আমরা ত্রিবান্দ্রামের।” এবার অবাক হই না আর।

—”তাই বলুন। কেরালার!”

কেরালার মানুষরা ঘুরে বেড়াতে জানে। কলকাতা ভর্তি চিরদিনই কেরালার নার্সে, আর কেরালার টাইপিস্টে। তার পরে তো জার্মানি, ইংলন্ডেও কেরালার নার্স রপ্তানির খবর কাগজে পড়েছি। ইদানীং কেরালার মানুষে ভরে গিয়েছে গালফ কান্ট্রিজ। দুবাই অঞ্চলের চাকরিতে কেরালার পুরুষরা দলে দলে পাড়ি দিচ্ছে—এবং টাকায় টাকায় ছেয়ে যাচ্ছে নাকি কেরালার গাঁ-গঞ্জ। বদলে যাচ্ছে সে-দেশের চেহারা, চরিত্র। দুবাইয়ের তুলনায় উত্তর-পূর্ব ভারত তো নস্যি!

—”তবে মাদ্রাজ হোটেল নাম কেন? কেরালা কাফে, কিংবা ত্রিবান্দ্রম হোটেল নয় কেন?”

—”ওসব জায়গা লোকে চেনে না। মাদ্রাজ তো বড় শহর। দক্ষিণ বলতে লোকে মাদ্রাজই বোঝে। মোর পপুলার নেম, ইউ সি?”

—”আই সি।”

এটুকু স্পষ্টই দেখতে পেলুম, যে কেরালার উন্নতি অবধারিত। বাংলার অবশ্যম্ভাবী পতন ও মূর্ছায় শত কেরালাকে দেখেও চৈতন্য উদয় হবে না। কেরালা, হাজার হোক, শিক্ষিত তো? ভারতের একমাত্র সাক্ষর প্রদেশ। হবেই তো। ওখানে গ্রামে গ্রামে সরকারি গ্রন্থাগার। সন্ধ্যায় আলো জ্বেলে গ্রামের সাধারণ লোকেরা লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছে, বই পড়ছে, পত্রিকা পড়ছে নিজের চোখে দেখে এসেছি। আমাদের গ্রাম কেন, শহরেও কি সেটা ঘটে? বরং তার চেয়ে আমরা পরের বাড়িতে গিয়ে, টিভি-র সামনে বসে থাকব।

নিশিরাত, বাঁকাচাঁদ

ভালুকপঙের পরে গাড়ি ছুটল আবার পাহাড়ি রাস্তায়। পাশ দিয়ে একটা নদীও ছুটছে মনে হচ্ছে। রাত্রি এখন তেমন অন্ধকার নেই। চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয়, কি পাহাড় কি সমুদ্র কি তেপান্তরের মাঠ, এসব যে খুবই মায়াময় দেখায় তা সকলেই জানি। কিন্তু এই পথটুকু যে কতদূর অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য মেখে নিয়েছিল পাহাড়ি চাঁদের আলোতে আমি বোঝাতে পারব না।

পাহাড়ি চাঁদের একটা আলাদা জাদুই আছে। তার সঙ্গে যদি একদিকে থাকে ঘোরানো পেঁচানো রাস্তা। দ্রুত ধাবমান রাত্রির ট্রাক। আর ঘুমঘুম কিন্তু একাগ্র চোখ।—আর অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে দৌড়োয় অচেনা বন, আর অচেনা ঝর্নানদীর বাঁক—সবটা মিলিয়ে সে এক অলৌকিক দৃশ্য। পাগল তো করে দিতেই পারে। এমনকী, একজন যুদ্ধক্ষেত্রগামী জেনারেলকেও! কে জানে সেই রাত্রিটা এইরকম ছিল কিনা। চাঁদের সে কী লুকোচুরি, কী ছুটোছুটি। একবার পাহাড়ের চুড়োয়, একবার গাছের ফাঁকে, একবার নদীর কোলে, একবার রাস্তার বাঁকে আকাশের ফাঁকে—যা তা কাণ্ড। ড্রাইভার ভাগ্যিস আমি নই, মানচন্দ্? তাই ট্রাক চলছিল নিজের মনে। চাঁদের ওই ঘোর “নখরা” তাকে মনঃচ্যুত করতে পারেনি। ওসব তার ঢের দেখা আছে।

আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু

এক জায়গায় এসে গাড়ি থামল। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ। মিস্টার সেন এতক্ষণে অভিমান ভঙ্গ করে কথা বললেন।

—”এখানেই নাইটহল করা হবে আমাদের।”

—”অ। তা আমরা শোব কোথায়?”

—”আপনি কোথায় শোবেন, তার ব্যবস্থা আমি কী জানি?”

মিস্টার সেনের গলায় জেনুইন ‘বিপন্ন বিস্ময়”।

—”না না আমার কথা হচ্ছে না।” লজ্জা পেয়ে গিয়ে বলি—”আপনারা শোবেন কোথায়?”

—”আমি তো এই লরিতেই শোব। আমাদের এত মাল রয়েছে না?”

—”লরিতে কোথায় শোবেন?”

—”কেন, এই সিটে? আপনারা নেমে চলে গেলে।”

—”আ। আর মানচন্দ্? মাইলা?”

—”ড্রাইভারও এখানেই শোবে। এই তো পিঠের কাছে একটা বাংক আছে, ওটা খুলে নামিয়ে নেওয়া যায়।”

—”মাইলা?”

—”ওর আত্মীয় আছে ওই দোকানে। ওখানেই শোবে।”

তর্জনী দিয়ে একটা ঘর দেখিয়ে দেন তিনি। ঘরটি লম্বামতন—দু-তিনটে দরজা আছে। ঘরে বহুত লোকজন। হই হল্লা করছে।

—”দোকানটা কীসের?”

—”হোটেল আর কী। সরাইখানা।”

—”ওখানেই তা হলে থাকা যাবে তো।”

—”যায়। তবে আপনি পারবেন না। লেডিজদের ব্যবস্থা নেই।”

—”তা হলে? ডাক্তারবাবু ওখানেই ঘুমোবেন?”

—”না না, ডাক্তারসাব তো আই বিতে যাচ্ছেন। আই বিতেই থাকেন ওঁরা।”

তাকিয়ে দেখি ডাক্তার গুটি গুটি চলেছে। সেদিকে, অন্ধকারের ভেতরে একটা পাকা একতলা বাড়ি। সামনে গেটওলা বাগানমতন। ভেতরে কিছু জিপ দাঁড়িয়ে আছে। তার ডানদিকে এই ছাউনি-ঘরে সরাইখানা। বাইরেও কিছু লোকজন। তক্তপোশে বসে বসে, হাতে বাটি ধরে কী সব খাওয়া-দাওয়া করছে। এগুলো রাস্তার বাঁ পাশে, রাস্তার ডানপাশে খাদ।

ট্রাকের শব্দ থেমেছে বলে অন্য একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে—খুব কাছেই জলপ্রপাতের গর্জন হচ্ছে।

—”আই বিটা কী ব্যাপার?”

—”আই বি জানেন না? কী আশ্চর্য!”

মিস্টার সেনের মুখে ভাষা জোগায় না।

—”বিলাতফেরত মানুষ, আই বি জানেন না?”

—”ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ? তাদের সঙ্গে ডাক্তারের কী?”

এবার আমি সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। এসব ডেন্জারাস এরিয়া। এ ব্যাটা ডাক্তার কীসের স্পাই, কে জানে? হয়তো ওই জন্যেই কথাবার্তা বলে না। আই বি-র সঙ্গে যোগাযোগ। আমি এখন কী করি? ওদিকে শুনি মিস্টার সেন বলছেন—

—”ইন্টেলিজেন্স-টেন্স জানি না ম্যাডাম, আই বি হইল গিয়া ইনিসপেকশন বাংলো। এই লাইফে ফাস্ট টাইম একজন এডুকেটেড ম্যান মিট করলাম যে জানে না আই বি কী বস্তু!”

অত্যন্ত ব্যাজার মুখে, তিতিবিরক্ত হয়ে, কেবল “ছিঃ”-টুকু না বলে, আর থুঃ করে থুথুটা না-ফেলে, সেনমশাই নেমে চলে গেলেন। সরাইখানার দিকে।

আমি নীচে নেমে দাঁড়িয়েছি, ভাবছি কী করি, মানচন্দ ফিরে এল।

—”আপ আই বি-মে যাইয়ে মেমসাব। উধরহি জাগা মিল্ যায়েগা।”

—”তোমরা এখন কী করবে, খাবে?”

মানচন্দ্ একটু লাজুক হেসে মাথা চুলকে বলল—”সাফ সাফ বাতা দুঙ্গা সাব? আব তো জরা ড্রিংক করনা। গাড়ি চলনেকা টাইমমে এক বুঁদভি নেহি পিউঙ্গা। হম্ লোগোঁকো দেওতা কা মনা হ্যায়।—গাড়িসে উতারকে রাতমে পিয়ো। ও ঠিক হ্যায়। দিনভর চায় পিউঙ্গা। বস হিল ড্রাইভিং বহুৎ খতরনাক কাম হ্যা। পিয়েগা তো জান চলা যায়েগা।”

এরই মধ্যে এক ঢোক হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে! মানচন্দ আবার বলে, —”আপকো বতানে আয়া, কি সুব্বাহ পাঁচ বজে গাড়ি স্টার্ট করেগি। ঠিক ঠিক্ টাইমপে আনা। হলোগ ঠাহরেঙ্গে নহি। ডাগ্দর সাবকো ভি জরা বতা দেনা জি।”

—”আরে হমেঁ ছোড়কর মত যাও ভাই। ফির্ ক্যায় সে যাউঙ্গি য়ঁহাসে?”

—”বহুত গাড়ি মিল যায়েগা সাব দিন মে। দিনভর গাড়ি আতা যাতা হ্যায়।”

আজি যে রজনী যায়

ওদিক থেকে ডাক্তার লম্বা লম্বা পা ফেলে ফিরে আসছে। আমি সেদিকে এগিয়ে যাই। আমাকে দেখামাত্র সে অ্যাবাউট টার্ন করে আবার বাংলোর দিকে চলতে শুরু করে দেয়। আমিও যাই। আমাকে যেতেই হবে। বাংলোয় একটা ঘর ঠিক করতে হবে তো। ডাক্তার এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলে। এই প্রথম সে নিজে থেকে আমার সঙ্গে কথা বলছে।

—”চৌকিদারকে ডেকে সাড়া পাচ্ছি না। বাংলোতে লোক আছে।”

—”চৌকিদারকে খোঁজা যাক, চলুন। ও থাকে কোথায়?

—”এই তো পেছনদিকে।”

পেছন দিকে কয়েকটা ছোট পাকাঘর।

—”চৌকিদার! চৌকিদার!” দুজনে মিলে চেঁচাই। দরজায় ধাক্কাও দিতে থাকি। একটি মেয়ে বেরিয়ে আসে। পাহাড়ি মেয়ে।

—”চৌকিদার নেই।

—”কোথায় গেছে সে?”

—”ওই যে, চটিতে।”

—”চলুন ডাক্তারবাবু, চটিতে যাই!”

—”চটিতে গিয়ে কি পাওয়া যাবে ওকে?”

—”বলছে, ওখানে রয়েছে, পাওয়া যাবে না কেন? ওর ডিউটি নেই বাংলোয়? চলুন চলুন ডেকে আনি।”

ডাক্তারের বড্ড তুলতুলে নরম স্বভাব দেখছি। চটিতে গিয়ে বাইরে লাজুক লাজুক ভাবে ঘোরাঘুরি করে। শেষে আমিই চেঁচাই।

—”চৌকিদার হ্যায়? আইবি কা চৌকিদার হ্যায়? আইবি কা চৌকিদার?”

—”জি হজৌর।”

এক মিনিটেই হাজির হয় একটি মানুষ। সেলাম সমেত। ভাল করে দেখে বলে—

—”ও, ডাগ্দার সাব?”

একটু যেন মিইয়ে যায় অ্যাটেনশনটা।

—”চটিতে যান। দেখুন যদি কিছু হয়।”

—”মানে?”

—”ঘর সব ফুল। দেখছেন কত জিপ এসেছে? এম এল এ এসেছেন এখানকার। তাঁর পার্টি নিয়ে।”

—”একটাও ঘর নেই?”

—”একটাও না।”

—”সব ফুল?”

—”স-ব ফুল।

—”ওই তো বললাম। চটিতে দেখুন। নিশ্চয় জায়গা হয়ে যাবে।”

ডাক্তার ভাবিত হয়।

চুপ করে যায়।

এবার আমার পালা।

আমি বলি, —”বসবার ঘরটা তো খালি?”

—”বসবার ঘর?” চৌকিদার অবাক হয়ে তাকায়।—”হ্যাঁ, সেটা খালি।”

—”ঠিক আছে। ওটা আমাকে খুলে দাও।”

—”ওটা? ওখানে তো কাউকে—

—”নইলে এম এল এ কে ডেকে দাও, কথা বলছি। একটা ঘর ছেড়ে দিক।”

—”ডাকব? কিন্তু মেমসাব, এম এল এ সাব সে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছেন। এখন ডাকব কেমন করে? তার চেয়ে চলুন বসার ঘরটাই—”

—”হ্যাঁ হ্যাঁ তা হলেই হবে—”

—”কিন্তু খাট-বিছানা নেই—’

—”না থাক। চেয়ার টেবিলে তো আছে। সোফা কৌচ?”

—”তা আছে।”

—”চলো, দেখি কেমন ঘর। চলুন ডাক্তারবাবু। আভি আইয়ে।”

ঘর খুব বড় নয় তবে ছোটও নয়। বরং বড়ই। আধখানাতে বৈঠকখানা আর আধখানাতে একটা বিরাট ডাইনিং টেবিল পাতা, অনেক চেয়ার ঘেরা। বৈঠকখানাতে বেতের চেয়ার, বেতের সোফা। সেই সোফায় শোওয়া সম্ভব নয়। দুটি সিট, যেন দুটি ইঁদারার মতো বসে গেছে। হঠাৎ মাথায় এল একটা বদ খেয়াল।

—”চৌকিদার, চলো তো মেরে সাথ।”

—”কিধার মেমসাব?”

—”আও তো জরা। চটি-মে যানা।”

চটির বাইরে কয়েকটা তক্তপোশ। কিছু মাতাল সেইসব তক্তপোশে বসে মদ খাচ্ছে। ভাতও খেয়েছে মনে হয়, বাটি পড়ে রয়েছে। আমি গম্ভীর ভাবে বললুম—”আপ লোগ মেহেরবানি কর কে এ-তক্তাসে উতার যাইয়ে। এ তক্তা আই-বি-মে লাগেগা। কটোরা-উটোরা হটাইয়ে জদি!”

তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মাতালেরা কটোরা ঘরে রেখে এল। এবং তিনজন মাতাল আর একজন চৌকিদার তাড়াতাড়ি একটি তক্তপোশ মাথায় করে আইবি-তে নিয়ে যেতে লাগল। আমি গম্ভীরভাবে তাদের আগে আগে গিয়ে তক্তাটি বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখতে সাহায্য করলুম। এতটা সহজে হবে আমিও ভাবিনি! লম্বু ডাক্তার এই তক্তপোশ ট্রান্সফার অপারেশন পর্ব দূরে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করছে। মাতালেরা তক্তপোশ রেখে দিয়েই চটিতে ফিরে গেল। কোনও বকশিসের পরওয়া করে না এরা, স্বাধীন জাতি। চৌকিদার বলল—”বিস্তারা? মেমসাব?” আমি তো অবাক। বিছানাও জুটবে নাকি? গম্ভীরভাবে বলি—”হ্যাঁ, লাও। ডবল ব্ল্যাংকেট, ডবল শিট, ডবল পিলো। গদ্দা হ্যায়?”

—”জি, গদ্দা তো নহী? ঔর দো ব্ল্যাংকিট দে দুঙ্গা।”

মুহূর্তের মধ্যে “দুগ্ধফেননিভ শয্যা” যাকে বলে, তাই তৈরি হয়ে গেল।

—”দু রুপাইয়া, বেড়িং চার্জ।”

পাঁচটা টাকা হাতে দিয়ে বলি—”বহুত সুকরিয়া। থ্যাংকিউ। অব অ্যায়সা করো থোড়া চায় তো পিলা দো? ঔর এক লালটিন রাখ দো ঘরমেঁ।”

ডাক্তার এবার বলল-

—”চটি মে জাগা মিলেগা? চৌকিদার?”

—”আপ বোলনেসে কিঁউ নেহি মিলেগা?” এবার আমার একটু মায়া হয়। নাঃ। ওকে একটু সাহায্য করা উচিত।

—”ওই অতবড় টেবিলটা আছে তো। ওতেই আপনি শুয়ে পড়ুন না? ওর কাছে কি আরও বেডিং নেই?”

—”বেডিংতো আমার সঙ্গেই আছে।”

—”কোথায়?”

—”ট্রাকে।”

—”সেইটে নিয়ে এসে শুয়ে পড়ুন।”

—”এই ঘরে?”

—”আবার ঘর পাচ্ছেন কোথায়?”

—”কিন্তু—মানে এই ঘরেই?”

—”তাতে হয়েছেটা কী? আপনি তো তিনবছর আগে ডাক্তার হয়েছেন, আমি তেরো বছর আগে ডাক্তার হয়েছি। আপনার বাপের বয়িসি আমি, বুঝেছেন?”

—”আপনিও ডাক্তার? কী আশ্চর্য। এতক্ষণ বলেননি?”

“আমিও ডাক্তার, কিন্তু মেডিক্যাল ডাক্তার নই, তবে আমাকে ডক্টর সেন বলতে দোষ নেই। নিন, এবার বেডিংটা আনুন। ভয়ের কিছু নেই। আপনারই বয়িসি আমার বড় বড় দুটো মেয়ে আছে।” (একটার তখন ১৩, একটার ৯!)

—”না না ভয়ের কী আছে? ভয় কে পেয়েছে!” ডাক্তার একটু বাদে বেডিং নিয়ে এসে টেবিলের ওপরে রাখল। কিন্তু পাতল না। বসেই রইল। চৌকিদার বলল —”স্টোভ ধরাই! চা খাবেন কজন।”

ডাক্তার বলল, “আমিও খাব। “

চৌকিদারের কাছে বলতে, বাথরুমও জোগাড় হয়ে গেল। ওই এম এল এ-দের একটি বাথরুমে বাইরে দিক থেকেও ঢোকা যায়। চৌকিদার আমার জন্য সেটা খুলে, আলো দিয়ে দিল। কোনও অসুবিধে নেই।

যতক্ষণ চা হচ্ছে, ততক্ষণের জন্যে আমি একটু হাঁটতে গেলুম বাইরে। সেই ঝর্নার শব্দটা এখন কানমন ভরে ফেলছে। বেশ চাঁদের আলো ফুটফুটে। পথ ফাঁকা। কেউ নেই। পাহাড়ের গায়ে গাছগুলো স্থির হয়ে চাঁদের আদর খাচ্ছে। নদীর ধার দিয়ে আওয়াজ লক্ষ্য করে হাঁটতে থাকি। বুনোফুলের গন্ধে পথ ভরা। জ্যোৎস্নায় সব ফুলেরই রং অবশ্য সাদা—পাহাড়ি নদীটা অনেক নীচে। শব্দটা আরও দূরে। গাছের পাতায় নানারকমের অচেনা পোকামাকড়, কত ধরনের শব্দ করছে। চটির মৃদু হইচইও এখানে শোনা যাচ্ছে না—শুধু ঝর্নার শব্দ, আর পতঙ্গের ধ্বনি। কী অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ। হাঁটতে খুব ভাল লাগছে। আর আমার পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি শুনতেও। একটা বাঁক ঘুরে এক মিনিট নদীর ধারে দাঁড়াই। নদীটা দেখতে ঝুঁকে পড়ি। তারপরেই—বুক ধড়াস! তারপরেই, ভয়ে হাত পা জমে বরফ। আমি তো হাঁটছি না, তবে আমার হাঁটার শব্দের প্রতিধ্বনি ওঠে কেমন করে? ভূতুড়ে ব্যাপার নাকি? পরক্ষণেই আরও একটা ভয়ের ঝাপটা এসে লাগে। ভূতুড়ে কেন হবে? নিশ্চয় আর কেউ নেই। আর কেউ। আর কেউ। এই নির্জন পাহাড়ে, নদীর ধারে রাত সাড়ে বারোটা বাজে—কে যেন কাশে। হ্যাঁ স্পষ্ট আবার কাশি।

—”হু ইজ দেয়ার?”

হঠাৎ গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠি। কোন্ হ্যায়?

—”লালওয়ানী।”—লম্বুডাক্তার এসে দাঁড়াল। খুব উত্তেজিত, কোনও কারণে। হাঁপাচ্ছে।

—”আর ইউ ম্যাড? ক্রেজি? নিউরটিক?”

—” কেন?

—”এত রাত্রে, এই নির্জনে, এভাবে কেউ হাঁটে? ওফ! কী ডেনজারাস লেডি! চলুন। আই বিতে চলুন। ওখানেই বাথরুম আছে।”

—”বাথরুম তো আছেই। বাথরুম দিয়ে কী হবে?”

—”তবে কীজন্য এদিকে আসছিলেন?”

—”এমনি। বেড়াতে। ওই যে ঝর্নার শব্দটা ওটা আবিষ্কার করতে। চা কি হয়ে গেছে?”

—”কে জানে চা হয়েছে কি না। আমি তো আপনাকেই ফলো করছি দূরে দূরে, নট নোয়িং দ্য পারপাস অফ ইয়োর ওয়াক। ঝর্নার শব্দ! ওটা তো দুই মাইল দূরে। ইউ আর সার্টেনলি আ ক্রেজি লেডি! মাই গড!”

ক্রেজি শব্দটার সঙ্গে লেডি শব্দটা এমন পাশাপাশি কখনও দেখিনি বা শুনিনি। বেশ মানিয়েছে দুজনকে। ক্রেজি লেডি। মিসেস গান্ধীকে অবশ্য বছরখানেক আগে, ইমারজেন্সির সময়ে একথা বলতে পারত। আমাকে নয়। আমি ক্রেজি নই, লেডি তো নইই।

—”কাম, লেটস গো ব্যাক—” বলেই বিশাল এক হাঁচি দিল লম্বু।

—”আপনার সোয়েটার নেই? বেশ ঠাণ্ডা। খালি শার্ট পরে এলেন কেন।”

—”সোয়েটার পরবার সময় ছিল কি? অত রাত্রে আপনি একা একা… আমি তো ভয়ে ভয়েই তক্ষুনি পেছন পেছন—” হাঁচ্চো!

—”কী লজ্জা! এই নিন, আমার শালটা খুব লম্বা আছে, আদ্ধেকটা আপনি জড়িয়ে নিন। সবটা দেব না, আমারও ঠাণ্ডা লাগানো চলবে না।”

—”না না না না আপনার শাল আমি জড়াব কী! চলুন বরং দৌড়ে দৌড়ে চলুন—তা হলে শীত করবে না”–দৌড়ে দৌড়ে আই বিতে ফিরে দেখি চৌকিদার চা ঢাকা দিয়ে রেখে চলে গেছে। মাথার কাছে লণ্ঠন। আমরা চা খেতে খেতেই সে কোত্থেকে উদয় হল আবার।

“কাল সকাল ৫টায় আপনাদের ট্রাক ছেড়ে দেবে। ড্রাইভার বলেছে তুলে দিতে।—দেব কি?” —”অতি অবশ্যই তুলে দেবে। সাড়ে চারটেয়। আর প্লিজ, এক কাপ করে চা-ও দিয়ো! কেমন?”

—”জরুর। জরুর। গুডনাইট সার।” গেলাস নিয়ে চলে যায় চৌকিদার। —”শুয়ে পড়ুন ডাক্তার লালওয়ানী। গুডনাইট।” আমি শুয়ে পড়ি —”গুড নাইট।” লম্বু টেবিলের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে।

শুলুম বটে। কিন্তু শুয়ে স্বস্তি হচ্ছে কই?

—”আপনি শোবেন না? ডাক্তার?”

—”এই শোব।”—টেবিল থেকে পা দুলতেই থাকে। লণ্ঠনের আলোয় দেয়ালে নানারকম ছায়া কাঁপে। বড় হয়, ছোট হয়। বাইরে ঝর্নার শব্দ। জংলি পোকার ডাক। ঘরের মধ্যে একটি যুবক নিদ্রাহারা।

—যাচ্চলে। বড্ড অস্বস্তি করলে তো? এবারে উঠে বসি। বসতে বসতেই চোখ ছাদের দিকে যায়। এবং, হঠাৎ দেখি, আরে? আধখানা ঘর ভাগ করেছে পর্দা টানার তারে! তার নয়, ডাণ্ডা। দেয়াল ঘেঁষে ঝুলছে ভারী পর্দা। এতক্ষণ উত্তেজনায় লক্ষ করিনি, ঘরটিকে ড্রয়িং ও ডাইনিং দুভাবে ভাগ করার ব্যবস্থা আছে। ব্যস। লেডিজ আর জেন্টস দুটো ওয়েটিংরুম হয়ে যাক বেশ! আমি চিরকালই খেলতে ভালবাসি। হে ভগবান, তুমি আছো। তুমি আজ বেচারি লালওয়ানীর সতীত্ব রক্ষার ব্যবস্থা করলে। জয় জয়।—

—আস্তে আস্তে ডাকি—আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই— —”ডাক্তার! ওই দ্যাখো, কী জিনিস! দেখেছ?”

—”পর্দা। কার্টেন্‌স!”

—”হুঁ হুঁ! বাব্বা! দারুণ! এবার ওই পরদা টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ো দিকিনি, লক্ষ্মী ছেলে।” ব্যস দুজনের দুটো ঘর হয়ে গেল বেশ?

আগের কালের জাপানে নাকি এটাই চালু ছিল শুনেছিলুম, এমনি করেই কাগজের পর্দা টেনে ঘর ভাগাভাগি হত। দেয়াল ছিল।

পর্দা দেখে ডাক্তারের সে কী সরল আহ্লাদ। লাফিয়ে নামল। মুহূর্তের মধ্যে ঘর ভাগাভাগি করে নিজেকে অদৃশ্য করে ফেললে। করলে কী হবে পর্দার তলা দিয়ে হাঁটু থেকে জুতোমোজা পর্যন্ত দেখা যেতে লাগল। ড্যাডি লং লেগস বোধ হয় হেডিং খুলছে। পর্দা টেনেও দেয়ালে নানাবিধ প্রেতছায়া নাচছে। মেঝের লণ্ঠনটার শিশ আরও কমিয়ে দিলুম। নাচও একটু কমল দেয়ালে। এবার নিদ্রা

—”গুডনাইট ডক্টর! টাক ইওর সেলফ ইন নাউ!” বলতে বলতে পিছন ফিরে চেয়ে দেখলুম—কই? শুল না তো? ওই দ্যাখো আবার টেবিলেই উঠে বসেছে। পর্দানশীন ডাক্তারের বুটজোড়াটি দুলে দুলে সারা। যাক গে, যা খুশি করুক গে।

মানুষের কত চাই?

মাথার ওপরে ছাদের ব্যবস্থা ছিল না, ছাদ হল। ঘর হল। খাট ছিল না, খাট হল। আৰু ছিল না। আব্রু পর্যন্ত হল। এখনও শান্তি নেই? আরও কী চাই তার? আমি এঘর থেকে চলে না গেলে বুঝি তার স্বস্তি নেই? কিন্তু সেটা তো হবার নয়।—রাগ হয়ে গেল এবারে।

—”ডাক্তার?”

—”ইয়েস ম্যাডাম?”

—”শুয়ে পড়ছ না কেন?”

–“…”

—”শোবে না?”

–“…”

—”লুক হিয়ার। আই হ্যাভ নো ইভিল ডিজাইনস অন ইউ। হোয়াট ফ্লাইটেনস ইউ সো? টেল মি!”

—”আরে–না, না, না,—ওঃ! কী মুশকিল! কী যে বলেন, সত্যি! ইউ আর আ ক্রেজি লেডি! টুলি, ডিয়ার গড! দ্যা থিংস ইউ স্যে! ওঃ—”

ডাক্তার লজ্জা পেয়ে গড়গড় করে কথা বলে গেল। কিন্তু শুয়ে পড়ল না।

[আমি ক্রেজিও নই আমি লেডিও নই। তুমিই ক্রেজি, তুমিই লেডি। নইলে কেউ খাটবিছানা পেয়েও শোয় না? ঘরে অন্য লোক আছে বলে লজ্জা পায়? যতই জাঁদরেল হই. মেয়েই তো? তুমি সারারাত জেগে বসে থাকলে বরং আমি তোমার যতটা ক্ষতি করতে সক্ষম হব, তুমি ঘুমোলে কি ততটা করতে পারব? ঘুমোনোই তো বেশি সেফ! বুন্ধু! ]

মুখে বলি—”ডোন্ট ওয়ারি ডক্টর, প্লিজ রিল্যাক্স, আই প্রমিস ইউ কমপ্লিট মর‍্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সেফটি—”

হাহাহাহাহাহাহাহা বালকের দল, মার কোলে যাও চলে নাই ভয়!

[আমি ক্রেজিও নই আমি লেডিও নই। তুমিই ক্রেজি, তুমিই লেডি। নইলে কেউ খাটবিছানা পেয়েও শোয় না? ঘরে অন্য লোক আছে বলে লজ্জা পায়? যতই জাঁদরেল হই, মেয়েই তো? তুমি সারারাত জেগে বসে থাকলে বরং আমি তোমার যতটা ক্ষতি করতে সক্ষম হব, তুমি ঘুমোলে কি ততটা করতে পারব? ঘুমোনোই তো বেশি সেফ। বুদ্ধ!]

—”এভরিথিং উইল বি ও কে। জাস্ট ইউ রিল্যাক্স প্লিজ! ট্রাই টু শিল্প। ডক্টর? আর ইউ লিসেনিং গুড নাইট। “

[দয়া করে শুয়ে পড়ো বাছা, নইলে যে এবার আমারই ভয় করছে! পাগলটাগল নয় তো? পাগলের সঙ্গে এক ঘরে রাত কাটানোর ভয় ঢুকছে প্রাণে—নইলে এত লজ্জা কীসের? এটা তো বাসরঘর নয়! ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে। যা হয় তবে। জয় জয়। গুড নাইট, ড্যাডি লং লেগস।]

খুকুমণি জাগো রে

—”চায়, মেমসাব!”

মাথার কাছে চৌকিদারের হাঁকে ঘুম ভাঙল।

—”গুড মরনিং, মেমসাব।”

—”গুড মরনিং। চৌকিদার। থ্যাংকিউ।”

—”ট্রাক রেডি হো গিয়া।”

—”এ বেডিং লে যাও।” ওদিক থেকে হঠাৎ ডাক্তার বলে। পর্দার ওপাশে ড্যাডি লং লেগস পা দোলাচ্ছে। কীরে বাবা? শোয়নি নাকি? এর মধ্যেই উঠে পড়ে বিছানা বেঁধে রেডি? নাকি বিছানা পাতেইনি মোটে? আহা রে।—”হায়! ভীরু কপোতি আমার!” বলে এক্ষুনি ওকে “বক্ষে টানিয়া লওয়া” উচিত হয় আমার। দস্যু মোহন স্টাইলে। ও রকম কিছুই তো সে ভাবছে আমাকে। আমার উপস্থিতিতে বেচারির ‘প্রাণান্ত পরিচ্ছেদ’ উপস্থিত হয়েছে। অবশ্যি এতে আমার আহ্লাদই হচ্ছে বেশ। আমার মতো এই নিরীহ প্রাণীর অস্তিত্বও যে কারওর পক্ষে এত ভয়াবহ হতে পারে আগে টের পাইনি। আমার মস্ত দুঃখ প্রত্যেকটা বন্ধু তাদের স্বামীদের আমার হাতে অর্পণ করে দিব্যি নিশ্চিন্ত থাকে এমনই আমি নিরামিষ মনুষ্য। কেউ সন্দেহ পর্যন্ত করে না।

যা হোক, গলা ছেড়ে—”হম্ তুম্…এক করেমে বন্দ হো—”ঔর চাবি খো জায়ে…” গেয়ে ওঠবার প্রবল বাসনাকে অতি কষ্টে দমন করে বললুম—

—”গুড মরনিং ডক্টর। ডিড ইয়ু স্লিপ ওয়েল?”

—”ইয়েস, থ্যাংকিউ।”

—”ওয়ান্ট সাম টি?”

—”ইয়েস, থ্যাংকিউ।”

.

বাথরুম থেকে ঘুরে এসে দেখি ব্রিলক্রিম-ট্রিম মেখে চুল পাট পাট করে ডাক্তার রেডি। গায়ে সবুজ সোয়েটার। চা খেতে খেতে ডাক্তারই আইবি-র খাতায় সই করলে। ফলে আমি আর সই করতে পেলুম না। কেন না একেই ঘরটা ঠিক অর্থে ‘ঘর’ নয় তা ছাড়া একটাই ঘর দুজনকে দেওয়া আইনসিদ্ধ নয়। চৌকিদার যে অসহায় অবলা প্রাণীদের উদ্ধার করছিল সেটা সরকার বুঝবে না। খাতায় এখন দেখলুম, এই জায়গাটার নাম হল : “জামীরী”। এতক্ষণে।

—”মাত্র আড়াই টাকা ভাড়া?” আমি অবাক!

—”একা বলেই আড়াই টাকা,” চৌকিদার সখেদে জানাল—”ম্যারেড হলে দেড় টাকা লাগত। আনম্যারেডদের বেশি ভাড়া।” যাবার সময়ে ওকে আবার দুটো টাকা দিতেই এবার চৌকিদারই অবাক। তার হঠাৎ-খুশির হাসিই বলে দিল জামীরী টুরিস্টে অভ্যস্ত নয়। সরকারি কর্মচারী আর কনট্রাক্টররাই যাতায়াত করেন, বিশেষ বকশিস দেবার দরকার হয় না তাঁদের। এসব জায়গার চৌকিদার অন্যান্য টুরিস্ট ডাকবাংলার চৌকিদারদের চেয়ে ভিন্নগোত্রের।

.

আধ-ফোটা ভোরের জামীরী আশ্চর্য সুন্দর। খাদের মধ্যে নদীটা খুব স্রোতস্বিনী, চারিদিকে হেমন্তের রঙিন গাছপালা, আর কত যে ঝর্না! ছোট্ট ছোট্ট ঝর্নায় পাহাড় ভর্তি। ঠিক দার্জিলিঙের পথে আগে আগে যেমন দেখেছি ছেলেবয়সে। গুনে শেষই করা যেত না, এত ঝর্না।

মাঝে মাঝে পাহাড়ি বস্তি—বাচ্চাগুলো ভারি মিষ্টি দেখতে। আর বেড়ালগুলো সবাই ছাইরঙের, আর খুবই মোটকা।

মানচন্দ যে রাত্রে শরাব পিয়া, এখন তার বিন্দুমাত্রও চিহ্ন নেই। ফের ধূপ কাঠি জ্বেলেছে। ফিটফাট সব্বাই। মাইলা মানচন্দ সুপ্রভাত জানাতে মিষ্টি হাসল। মিস্টার সেনের আজ একটুও নেশা নেই। হেসে বললেন—”গুড মরনিং, মিসেস সেন। গুড মরনিং ডক্টর সাব।”

.

পাহাড়ি ভোরের তুলনা হয় না। বেশ ঠাণ্ডা। শালে কুলোয়নি, হাতকাটা সোয়েটারটাও পরেছি। যা দেখছি চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। এত সুন্দর বনপথ, আমি আগে ভারতবর্ষের কোনও পার্বত্য অঞ্চলে দেখিনি। দীর্ঘ গাছগুলোর গা জড়িয়ে বিশাল বিশাল পাতাওয়ালা লতা উঠেছে, কত রকমের ফুল ফুটে আছে এই কার্তিক মাসে তার ঠিক নেই। ‘কামেঙ’ নামের নদীটা সমানেই পথের পাশ দিয়ে ছুটছে। কেন যেন প্রায় সব পাহাড়ি রাস্তার পাশ দিয়ে একটা না একটা নদী ছোটে? বড় হয়ে ছাত্র বয়সে রকি মাউন্টেনে কলোরাডো নদীর খাদ ধরে নদীর পাশ দিয়ে গাড়িতে যেতে যেতে ছেলেবেলায় আবিষ্কৃত এই অত্যন্ত অরিজিনাল বিস্ময়কর তথ্যটি অমর্ত্যকে বলতেই তিনি বেচারি লজ্জা রাখবার পথ পান না। “সে কী, তুমি কি জানতে না, যে নদীগুলোই পাহাড় কেটে কেটে উপত্যকা বানায়? তাই নদীর তৈরি করা খাঁজ দিয়ে দিয়েই মানুষ পথ করে নেয়? নদীর গা ঘেঁষেই রাস্তা ছোটে, রাস্তার গা ঘেঁষে নদী ছোটে না! “

তখন থেকে জ্ঞান হয়েছে। তা বলে কিন্তু ছোটবেলার ভুল দৃষ্টিটা বদলায়নি। সেই যে, বাল্যকালে, বাবা-মার সঙ্গে ইন্টারলাকেনে যাবার পথে আল্পসের গায়ে অপূর্ব একটা দুধ-ধবধবে দুর্ধর্ষ নদীকে লাফাতে লাফাতে রেলগাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়োতে দেখেছিলুম। সেই থেকে এই ধারণাটা বদ্ধমূল যে নদীরাই রাস্তার সঙ্গে দৌড়ে পাল্লা দেয়। আমি যেহেতু রাস্তাটাকে দেখতে পাচ্ছি না, তাই ওটাকেই ধরে নিচ্ছি মূল বলে। এই সমগ্র উপত্যকার নামই কামেঙ উপত্যকা। কামেঙ-ই এই অঞ্চলের প্রাণধারা। কামেঙ নদীই আমাকে তুলে নিয়ে এল তাওয়াং পর্যন্ত।

.

জামীরী থেকে দেজা। ছোট জায়গা। সেখানে একটা পাহাড়ি বস্তিতে নেমে চা খেলুম। সেখান থেকে টেঙ্গা। টেঙ্গা আরেকটু বড় জায়গা। সেখানে খেলুম ব্রেকফাস্ট। চা, টোস্ট। ওরা ডিম খেল। রাস্তাও কেরলই আরও সুন্দর হয়ে উঠছে, পাহাড়ও তাই। এবং ট্রাক থেকে পিছন ফিরে নামতে আমার কারুর করুণা হস্তের প্রয়োজন হচ্ছে না। উঠতে অবশ্য এখনও একটু সাহায্য লাগে। নতুবা ট্রাকবিহারে দিব্যি এক্সপার্টিজ লাভ করে ফেলেছি।

.

টেঙ্গায় ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে, মিস্টার সেন বললেন, “বম্‌ডিলাতে কোথায় থাকবেন আপনি? ডাক্তারের না হয় হাসপাতাল, কি মেডিক্যাল সেন্টার, নানান জায়গা আছে। ওরা কামেঙের মেডিক্যাল সার্ভিসের লোক। কিন্তু আপনি থাকবেন কোথায় এই তিনদিন?”

—”তিনদিন? মানে?”

—”আমরা তো বম্‌ডিলার আশেপাশেই এখন থাকব তিনদিন। তারপর রওনা হব তাওয়াং। এখানেই কাজ আছে আমাদের পয়লা পর্যন্ত।”

—”সে কী কথা? ডাক্তারও থাকবে? বডিলায়?”

—”আমি কী জানি? আপনি জানেন না তার প্ল্যান কী? আপনারই বা কী প্ল্যান?”

‘প্ল্যান’ এই শব্দটিকে আমি খুবই মান্য করি। খুব সম্ভ্রম করি। কিন্তু হায় আমার জীবনে তার ঠাঁই প্রায় নেই বললেই চলে।

—”আমার আবার কী প্ল্যান? যত তাড়াতাড়ি পারি তাওয়াং যাব। বমডিলায় থামবার ইচ্ছে নেই। থেকে কী হবে? থাকবই বা কোথায়?”

—”সে দরকার হলে, আমিও ব্যবস্থা করে দিতে পারি। অনেক বাঙালি ভদ্রলোক আছেন বম্‌ডিলাতে সপরিবারে। তা ছাড়া বাংলোও আছে। হোটেল-টোটেলও আছে নিশ্চয়।”

—”না না, আমি তাওয়াং চলে যাব।”

—”কীসে করে যাবেন? আমরা তো যাচ্ছি না।”

–“ও–হো!”

—”সেটাই বলছি।”

—”ডাক্তার?”

—”ইয়েস ম্যাডাম?”

—”এরা এখন তিনদিন বন্‌ডিলাতে থাকবে! জানতে কি তুমি?”

—”তাই নাকি? কী মুশকিল। জানতুম না তো? আমি তো শুনেছিলুম তাওয়াং যাচ্ছে।”

—”কী করবে তা হলে?”

—”দেখি। অন্য একটা ট্রাক ধরতে হবে। বম্‌ডিলাতে নিশ্চয়ই অন্য ট্রাক মিলে যাবে। নইলে কারুর জিপ। কিংবা লোকাল বাসও অনেক সময়ে পাওয়া যায়। চলে যাওয়া যাবে।”

—”ও ডাক্তার! আমিও তোমার সঙ্গে যাব কিন্তু।” ডাক্তার কোনও উত্তর দিল না। বলেই বুঝেছি এটা বলা ভুল হল। এইবার ডাক্তারের ভয় ধরে যাবে। সর্বনাশ করেছি! —”ডাক্তার, আমি তোমার চেয়ে কুড়ি বছরের সিনিয়র। তোমার বাপের বয়িসি। আমাকে মিছিমিছি তুমি ভয় পেয়ো না—” [আমি আছি গিন্নি আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে…]

—”ওনলি টোয়েন্টি? নট টু হান্ড্রেড?”

একটা বোমা পড়বার মতন কথা বলে ফেলল ডাক্তার।

কী ভেবে বলল?

বিরক্ত হয়েই বলল, সন্দেহ নেই।

ভাল করে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি মুখে অল্প অল্প হাসির চিহ্ন।

বিরক্তি বলে মনে হচ্ছে না। ডাক্তার আবার মুখ খুলল :

—”ইউ কান্ট বি ওলডার দ্যান মাই এলডেস্ট সিস্টার। মাই ফাদার ইজ সেভেনটি টু।”

—”ওই একই হল। যাঁহা বাহান্ন। মোটকথা, আয়াম নট টোয়েন্টি সিক্স লাইক ইউ। ডোন্ট বি টু শাই, তা হলে দুজনেরই খুব অসুবিধা হবে।“

—”নট টু ওয়ারি, মিসেস সেন। উই’ল ফাইনড আওয়ার ওয়ে টু তাওয়াং।”

.

বম্‌ডিলাতে নেমে গেলুম মানচন্দ্-এর ট্রাক থেকে। মিস্টার সেন হচ্ছেন ট্রাকের ওই র‍্যাশনগুলির ইনচার্জ। ট্রাকের সঙ্গে সঙ্গে মাল নিয়ে দোকানে বিলি করা তাঁর কাজ, এবং হিসেব রাখা। মানচন্দকে জিজ্ঞেস করি—”ভাড়া কত দিতে হবে?”—”ভাড়া?” মাইলা হাসে। মানচন্দও হাসে।—”কিছু দিতে হবে না। এটা কি বাস? না রেলগাড়ি?” মিস্টার সেন বলেন।—”আপনাকে লিফ্ট দিলাম। এ গাড়ির ভাড়া তো দিচ্ছে আমাদের কোম্পানি। যদি বকশিস কিছু দিতে চান তবে দ্যান ড্রাইভার-ক্লিনারকে। সেটা আপনার খুশি।”

ডাক্তার কুড়ি টাকা দিল।

দেখাদেখি আমিও।

মানচন্দ, মাইলা, ওতেই খুব খুশি।

—”গুডবাই মানচন্দ্ ফির্ মিলেঙ্গে। থ্যাংকিউ মাইলা। বাই বাই। চলি তা হলে মিস্টার সেন। খুব ভাল লাগল।”

—”আমারও খুব ভাল লাগল। যান, ওইদিকে যান, ওইখানটায় সব ট্রাক এসে দাঁড়ায়। তাওয়াং-এর লিফট ঠিক মিলে যাবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *