ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে – ৫

ফিকর নট

সত্যিই, মিলে গেল।

আরেকটা র‍্যাশনট্রাক। এখানে ট্রাক ভর্তি গাদা গাদা কিছু নেই। অল্প কিছু মালপত্র কয়েকটা বস্তায় রয়েছে। ড্রাইভারের নাম ঘনশ্যাম ছেত্রী, অল্পবয়সি নেপালি ছেলে! সে ছাড়া আরও দুটি ছেলে আছে, কিন্তু তারা গাড়ির ভিতরে রইল না, খোলা লরিতে চড়তেই তাদের বেশি ভাল লাগে। ভেতরে কেবল ডাক্তার, ড্রাইভার আর আমি। ড্রাইভার খুব ফুর্তিবাজ ছেলে, মানচন্দ-এর মতো গুরুগম্ভীর নয়। আমার ধারণা ছিল ট্রাক-ড্রাইভার মাত্রেই মোদো মাতাল, ভয়ংকর মদ খেয়ে গাড়ি ছোটায়। অথচ মানচন্দ্ বলল হিল্‌-ড্রাইভিং-এর ট্রাডিশন অন্য। স্টিয়ারিংয়ে থাকার সময় মদ স্পর্শও করে না ওরা। দেবীর অভিশাপ লাগে।

ঘনশ্যামকে জিজ্ঞেস করলুম—”তুমি মদ খাও?”

ঘনশ্যাম মাথা চুলকে বলল —”জরুর, মেমসাব!”

—”এখন খেয়েছ?”— অমনি জিব কেটে ফেললে।

—”দিনমে কভি নেহি মেমসাব! নাইট হলট কা টাইম মে। ডিউটিপর পিনে সে পাপ লাগতা ড্রাইভার কো।”

অতএব কি জাঠ, কি নেপালি, হিল-ড্রাইভিংয়ের একই ধর্ম। মদ ছুঁলে স্টিয়ারিং ছুঁতে পারবে না।

তা পথও তো তেমনি।

একের পর এক হেয়ারপিন বেন্‌ড।

চুলের কাঁটার মাথাটা যেমন গোল, পাহাড়ের গায়ে রাস্তা ঠিক সেইভাবে বোঁ করে ঘুরে যাচ্ছে। আর সারাটা পথ ভর্তি নানারকমের নোটিস সাঁটা। সমস্ত নোটিসই মনে হচ্ছে আর্মির ড্রাইভারদের জন্যে। কী জানি, তারা সিবিলিয়ান ড্রাইভারদের ধর্মে দীক্ষিত নাও হতে পারে। বেশির ভাগই সাইনবোর্ডেই প্রথমে লেখা—FIKAR NOT, তারপরে নানারকম উপদেশ। Better late than never! Someone is waiting for you,—সবচেয়ে আমার মনের মতন হল এইটে : What’s the hurry, when passing from hills to heaven? আরও বহু উপদেশামৃত—Look for a tiger at every turn! বা Accident to you, misery to others, smile and drive, Live and let live! Be soft to my curves! রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে আর্মির ক্যাম্প আসছে। সেখানে নোটিস মারা—THEIRO! M. P. KO REPORT KARO! এবার টের পেলুম রোমান হরফে হিন্দি লেখা কী বস্তু! FIKAR NOT মানে তবে ফিকর মৎ, Not to worry-র হিংরিজি (বা ইন্দি)?

দিরাং বস্তিতে পৌঁছে চা খেলুম। বিশাল, প্রবল দিরাং নদীর ওপরে মস্ত বড় ক্যাম্প আছে দিরাংজং। আবার ট্রাক চলল, ওপর দিকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওঠা ওড়নার মতন রাস্তাটা বেয়ে ক্যাম্পগুলোতে আবার সিনেমা হল আছে, ওয়্যারহাউসের মতন টিনের ছাউনি—তার নাম Ball of Fire; ওই নামে সিনেমা হল বেশ কটাই চোখে পড়ে। কী হচ্ছে? হিন্দি ছবি! বাইরে কাগজের পোস্টার সাঁটা।

রাস্তা দিয়ে কেবলই সাঁজোয়া গাড়ির সারি যাচ্ছে। ঝরঝরে রোগা বাস একটা কি দুটোই দেখেছি মোট। আমাদের মতন ট্রাক কয়েকটা দেখা যাচ্ছে অবশ্য মাঝে মাঝেই। তবে রাস্তাটা প্রকৃতপক্ষে ব্যবহার করে আর্মি। টাটা-মার্সিডিসের তৈরি ‘শক্তিমান’ মিলিটারি ট্রাকের শোভাযাত্রা যাচ্ছে মাঝে মাঝেই, অল্পবয়সি ছেলেতে গাড়ি ভরতি। দেখলে উত্তর ভারতীয় বলেই মনে হয়—শিখ সৈন্য সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। হয়তো শিখরা এমনিতেই চোখে পড়ে বেশি বেশি।

.

‘রামা ক্যাম্পে’ লাইড খেতে থামা হল। রামা ক্যাম্পে আমার প্রথম উত্তেজনা, বিপুল লোমে ভরা ছোটখাটো মহিষের মতন জন্তুটি। কী জন্তুরে বাবা? তারপরে লেজটি দেখেই চিনে নিলাম তারে সখি, চিনে নিলাম তারে! ওই দীর্ঘ চামরের মতো পুচ্ছ যার সে চমরী ভিন্ন কেউ নয়। প্রথম চমরী গাইটি দেখে মহা খুশি, চটিতে ঢুকলুম খেতে। চমৎকার ভাত, মাংস, গরম গরম চা। গাবদা গোবদা লোমে ঢাকা আহ্লাদী ভুটিয়া কুকুরেরা পথে পথে ঘুরছে। যত দেখছি, ইচ্ছে করছে তুলে নিয়ে যাই সব কটাকে। খেয়ে উঠে চটির পিছনে একটা ঝর্নার জলে হাত মুখ ধুলুম। ওটাই দেখা গেল ওখানকার মুখ ধোয়ার বেসিন। কী সুন্দর ঠাণ্ডা জল। কী চমৎকার শ্যাওলা ঢাকা পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কত ফার্ন হয়েছে ঝর্নার ধারে ধারে। মুখহাত ধুয়ে কী তাজা টাটকাই যে লাগল শরীর কী বলব!

.

আহীর গড়ের কাছ থেকেই নীচের দিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এক অপূর্ব দৃশ্য চোখে পড়তে থাকে। নর্থ আমেরিকাতে যাকে বলে ‘ফল,’ বা ‘অটাম্ কালার্স’— পাতাঝরার আগে বনে জঙ্গলে একটা রঙের আগুন লাগে ওদের দেশে। কিছু গাছের পাতার রং বদল হয়—হলুদ-গেরুয়া—কমলা-বাদামি, সিঁদুরে-লাল, রক্তলাল, আবির-লাল,—যেমন মেপল, কিম্বা ওক,—আবার কিছু কিছু গাছ চিরশ্যাম, তাদের শান্ত সবুজের ফাঁকে এদের বর্ণচ্ছটা—আশ্চর্য একটা নেশা ধরায়। এই সময়ে, উইক-এন্ড ছুটিতে দল বেঁধে হেমন্তের রঙের বাহার দেখতে বেরুনো, আমেরিকানদের একটা বার্ষিক শখের মধ্যে পড়ে।

কোথা থেকে এসে পড়েছি আমি এই শীত সাহসিক হেমন্ত লোকে’-র মধ্যে? আমার নিজের দেশেই যে এমনধারা হৈমন্তী মায়া আছে, কোনওদিনও কি জানা যেত, না যদি এসে পড়তুম এই পূর্বপার্বতে!

.

রাস্তা ক্রমশই পাহাড়ি, বন ক্রমশই হালকা, বাতাস ক্রমশই ঠাণ্ডা, ঝর্না এখনও প্রচুর। সঙ্গে—জু বলে এক জায়গায় বিকেলে চা খেলুম। পরমাসুন্দরী দুটি মেয়ে এসে চা দিল। গল্পও জুড়ল ঘনশ্যামের সঙ্গে। তাদের পরনে তিব্বতি বাকু, আর সাদা ব্লাউজ, কোমরে এপ্রন। তাদের একটা ছোট গ্রাম্য মনিহারী দোকানও আছে। অনেক প্রাত্যহিক দরকারের জিনিসের সঙ্গে অদ্ভুত সুন্দর গরম তিব্বতি জ্যাকেটও বিক্রি করছে, মাত্র ৫০ টাকাতে। চিনে সিল্কের ওপর জরিতে ও রেশমে কারুকার্য করা, ভেতরে তুলো ভরা জামা। রাজকীয় দেখতে। খুব গরম। আছে বাকু, আছে শতরঞ্চির মতন এপ্রন। ফেরবার পথে কেনা যাবে। তবে এখানে চা-টা বেশ।

.

ক্রমশ দিনের আলো নিবে আসছে। সামনে পড়ল আবার একটা গ্রাম। প্রত্যেক গ্রামেই একটা সাইনবোর্ড আছে, গ্রামের নাম লেখা। এই নামটা পড়েই বুকের ভেতর ধস নামল।

—শাংগ্রিলা’!

শাংগ্রিলা তো সেই আশ্চর্য তিব্বতি গ্রাম? হিমালয়ের তুষাররাজ্যের এককোণে সেই চিরযৌবনের গ্রাম, মহাকাল যেখানে হাত ছোঁয়াতে ভুলে গিয়েছেন। ‘দি লস্ট হরাইজন’ ছবির সেই মায়াময় জাদুগ্রাম, তারই তো নাম শাংগ্রিলা?

এতদূরে এসে পড়েছি?

তারপর দেখি পাহাড়ের গায়ে আরেকটিও বিশাল সাইনবোর্ড লটকানো—The Lost Horizon—এবং তার সঙ্গে দীর্ঘ একটি ইংরেজি ভাষায় নোটিস, অথবা উদ্ধৃতি। কিন্তু আমাদের ট্রাক তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল এত জোরে, যে পাহাড়ি হেমন্তের সান্ধ্য আলো-আঁধারির মধ্যে প্রাণপণে দৃষ্টিকে তীক্ষ্ণ করে তুলেও পড়তে পারলুম না। কেবল বোঝা গেল :—”ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল বন্ধ”—কী বন্ধ কেন বন্ধ সেটা না জানে ডাক্তার, না ঘনশ্যাম। তারা এও জানে না, যে শাংগ্রিলার মানুষরা অজর, অমর। এতই অজ্ঞ? এত কাছাকাছি থেকেও! দুজনের কেউই ‘লস্ট হরাইজন’ ছবি দেখেনি, নামও শোনেনি। ঘনশ্যাম যদিও মাঝে মাঝে ‘অংরেজি পিকচার বি দেখলেতা হ্যায়’।

সত্যি সত্যি যে অনেকদূর এসে পড়েছি, রূপকথার রাজ্যে পৌঁছে গেছি, নিউ ইয়র্ক-লন্ডনের চেয়ে ঢের দূর, ঢের অচেনা দেশে—তিব্বতের রহস্যঘন ওড়নার ছায়ায়—সেটা এক মুহূর্তে রক্তের ভেতরে টের পাইয়ে দিল এই একটি নাম—শাংগ্রিলা!

কিন্তু ওইটুকুর মধ্যে দেখা গেল, তাতে জরা-হারা চিরযৌবনাদের বদলে চোখে পড়ল প্রধানত শিখ জোয়ানরা।

বিরাট আর্মি ক্যাম্প এখন শাংগ্রিলা!

এবার পাইন বনে টাক পড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাড়ছে। চড়াই পথ। পরের গ্রামটির নাম বৈশাখী। ছোট গ্রাম। সমুদ্র থেকে এগারো হাজার পাঁচশো ফুট উঁচুতে। পথ এবারে আরও চড়াই। শিগগিরি সে-লা এসে গেল। সে-লা পাস প্রায় চোদ্দো হাজার ফুট উঁচুতে। বিশ্বে এটাই নাকি দ্বিতীয় উচ্চতম পথ—উচ্চতম পথটিও এই হিমালয়েই—পশ্চিমপ্রান্তে। লাদাখের লাহুল স্পিটি। (তখনও “কারাকোরাম হাইওয়ে” খোলেনি। জানি না এখনও এই হিসেবটাই ঠিক আছে না কারাকোরামের কাছে হার মেনেছে!)

একটা পাথরের স্মৃতিসৌধ আছে সে-লা পাসে। তাতে লেখা : This road from SELA ( 13,714 ) to Tawang dedicated by Mrs. Ruth Marley on 14 December 1972 to commemorate the work done by these units of 14 Border Roads Task Force, Fikar Not Fourteen, & to remember the men of the force who died with snowboots on.

এতক্ষণে FIKAR NOT-এর পূর্ণ অর্থ উপলব্ধি করলুম। বনজঙ্গল-পাহাড় কেটে, ঠাণ্ডায়-হিমে-বরফে কষ্ট পেয়ে, মাসের পরে মাস তাঁবুতে থেকে যারা এই রাস্তা তৈরি করেছে, তারাই “ফিকর নট’। সত্যিই তো তারা যদি ফিকর নট না হবে, তবে কি আমি?

একটু দূরেই নাকি একটা গুম্ফা আছে, সে-লা গুম্ফা। খুব জাগ্রত দেবতা সেখানে, খুব পুরনো তিব্বতি বইপত্তরও আছে, ঘনশ্যাম জানাল। কিন্তু যাওয়া যাবে না। গাড়ির পথ নয়। হাঁটার সময় নেই। অতএব গুম্ফা দেখার প্রশ্ন নেই।

সব সময়েই একটা ঘন কুয়াশার চাদর দিয়ে সে-লা পাস ঢাকা থাকে। আরও দুয়েকটা লরি থেমেছে। যদিও কোনও চা-দোকান নেই। লোকেরা কী করতে নামছে তা হলে? ও, কুয়াশার আড়ালে কিছু প্রাকৃতিক কর্ম সমাপন হচ্ছে! পাথরের পিছনে গিয়ে। গাছপালার পর্দা তো নেই এখানে!

গাড়ি ফেলে ডাক্তার ও ঘনশ্যাম খুব ফিলসফিক্যালি দূরে দূরে হাঁটতে চলে গেল দেখে আমিও উলটোদিকে হাঁটতে শুরু করি।

যেদিকেই মনে হয় একটু আড়াল আছে, আবিষ্কার করি একজন মনুষ্য আগেই সেখানটা আবিষ্কার করে ফেলেছে।

মাটিতে অল্প অল্প বরফ ছড়ানো। একটা ধূসর হেমন্ত গোধূলির রঙে পাহাড়ি পথটা মোড়া। কয়েকটা রামছাগল দেখা গেল, শিং উঁচিয়ে কান নাচিয়ে আমাকে দেখছে। তাদের রাখাল একটা বাচ্চা ছেলে। কোথা থেকে এসেছে? কাছাকাছি কোনও গ্রাম তো নেই। অনেক হেঁটেছে নিশ্চয়। এবারে ফিরে যাক। সন্ধে তো হল। আমিও ফিরি লরিতে।

রাস্তা এর পরে নামতে শুরু করেছে—নামতে নামতে আশ্চর্য একটা হ্রদে এসে পৌঁছয়—এখানে খুব বরফ। বরফে চারিদিক ঢেকে গেছে। এই রকমই একটা হ্রদ একবার যেন প্লেনে পামীর পার হবার সময়ে ওপর থেকে দেখেছিলুম। সাদাতে সবুজে আশ্চর্য বরফ-জলের রং। জানি না মানস কেমন সরোবর। এই হ্রদটি সম্পূর্ণ জমে, তুষারহ্রদ হয়ে আছে। দূরে সাদা বরফঢাকা এক সারি পাহাড় তাতে হঠাৎ কোথা থেকে ডুবন্ত সূর্যের আলো এসে কমলা বেগুনি রং মাখিয়ে দিল। পাহাড়ের কোলেই হ্রদ। তার ধার দিয়ে খচ্চর যাবার পথ। হঠাৎ দেখি একটা শ্লেজ গাড়ি যাচ্ছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে চারটে কুকুর–লোভেরা, বলিষ্ঠ কুকুর। শ্লেজে একটা বাচ্চা ছেলে, একটা ঝুড়ি নিয়ে বসে আছে। ছেলেটার মাথা গা সব মুড়িসুড়ি দেওয়া। যেন একটি এস্কিমো। এক মুহূর্তের জন্যে পুরো দৃশ্যটাই পরিণত হল মেরুপ্রদেশে। ওই দিগন্ত-প্রসারিত তুষারহ্রদ, তার তীরে সাদা পাহাড়ের সারি, সামনে এই শ্লেজগাড়িতে ওই শিশু—সবটাই এত ভূগোলবই-ভূগোলবই, যে আমার নিজের অস্তিত্বটাই অবাস্তব মনে হল ওইখানে।

.

–“যশবন্ত গড় হয়েছে জোয়ান যশবন্ত সিংয়ের নামে”–বলল ঘনশ্যাম ছেত্রী।

—”১৯৬২-র যুদ্ধে যশবন্ত সিং নামে এক শিখ জোয়ান একলাই এই আউটপোস্ট আগলে ছিল। দলকে পালাতে সুযোগ দিয়ে একাই গুলি চালিয়ে গিয়েছিল সে। যাতে গুলির শব্দে চিনেরা ভাবে এখানেই আর্মি রয়েছে। আসলে তখন সবাই নেমে গিয়েছিল, যশবন্ত ছাড়া। ও নিজেই এই কাজটা বেছে নিয়েছিল অন্যদের প্রাণ বাঁচাতে। নইলে সবাই যেত। শেষপর্যন্ত চিনেরা এসে শুধু ওকেই মেরে ফ্যালে। সেই থেকে যশবন্তগড় নাম।”

ডাক্তার বললে—”বাকিটাও বলে দাও?”

—”বাকিটা?” ঘনশ্যাম হাসল।

—”জোয়ানরা বলে যশবন্ত এখনও ঘাঁটি ছেড়ে যায়নি। এই আউটপোস্টে কোনও সান্ত্রীর ঘুমিয়ে পড়বার উপায় নেই। যেই ঘুমোবে, অমনি এক বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় এসে পড়বে তোমার গালে। ডিউটির সময়ে ঘুমুলে, যশবন্ত সিং ছেড়ে দেয় না।”—

—”এমনিতে কিছু দৌরাত্ম্যি করে না তো যশবন্ত সিং? এই যে আমরা যাচ্ছি এখান দিয়ে, ঠেলে ফেলে দেবে না তো রাস্তা থেকে?” ডাক্তার হাঁ হাঁ করে ওঠে—”নো, নো, হি ইজ আ বেনেভোলেন্ট স্পিরিট—”

—”আই সি।”

—”তিব্বতিরা খুব স্পিরিটে বিশ্বাস করে। ভূতকে বলে ‘হাং’। বহু বিভিন্ন জাতের ভূত-প্রেত আছে ওদের। পাহাড়িরা সবাই দেখি ভূতবিশ্বাসী জাত। মিলিটারিও ঠিক তাই।” দুর্ঘটনায় মৃত্যু যাদের নিত্যসঙ্গী, তাদের বোধ হয় অপদেবতায় আর অতৃপ্ত আত্মায় বিশ্বাস হওয়াটা অস্বাভাবিক।

অফ মেন অ্যান্ড ট্রাউটস্

নুরুয়ানাঙ-এ একটা ট্রাউটফার্ম আছে। কামেঙ্ নদীর একটা শাখাতে বাঁধ দিয়ে আটকানো হয়েছে, যেখানে ট্রাউটের বাচ্চা ছাড়া হয়। ট্রাউটের স্বভাব স্রোতের বিপরীতে ঠেলে যেতে চেষ্টা করা, কই মাছের মতো। ট্রাউট লাফও মারে মন্দ নয়।

অক্সফোর্ডের কাছাকাছি একটা ট্রাউট ফার্মে দেখেছি কী ভাবে কৃত্রিম উপায়ে ছোট চৌবাচ্চায় স্রোত আর ঢেউ সৃষ্টি করা হচ্ছে আর ট্রাউটরা কেবলই তাতে লাফ মারছে (এটাই তাদের পক্ষে স্বাস্থ্যকর)আর ছিটকে দু-চারজন পড়ছে কঠিন শুকনো সিমেন্টের মেঝেয় অমনি বাঁশের ডগায় বাঁধা জালে করে তাদের ফের তুলে রাখা হচ্ছে জলে। ফের ওতে করেই ধরে নিয়ে তাদের বিক্রিও করা হচ্ছে খদ্দেরের কাছে।

আমার শ্বশুরমশাই যেতেন কুলু মানালিতে ট্রাউট ফিশিং করতে। ওখানে পার্বত্য ঝর্নায় ট্রাউট আছে খুব। কামেঙ নদীর ট্রাউট ফার্মিং বিরাট সরকারি প্রকল্প। শুনলুম কাশ্মীরেও আছে এরকম। নুরুয়ানাঙ-এ ট্রাক থামল। ইতিমধ্যে ট্রাকের পিছনে আরও একটি সওয়ারি উঠেছে। কে জানে কোন গ্রাম থেকে। গোড়ায় যে দুটি পাহাড়ি ছেলে ছিল, তার একজন ট্রাকের ক্লিনার আরেকজনের পোশাক পরিচ্ছদে সাচ্ছল্যের স্পষ্ট ছাপ। ঠিক গ্রামের লোক নয়। ঠিকেদার জাতীয়ও নয়। নুরুয়ানাঙ-এ সবাই নেমে পড়লুম। চা খেতে যাওয়া হবে।

ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করে শুনি সে ছাত্র, তেজপুরে পড়াশুনো করে। বাবা-মা থাকেন তাওয়াঙ-এর কাছাকাছি এক গ্রামে। হাঁটতে হাঁটতে একটা ঘটনা ঘটল।

হঠাৎ দেখি পাথুরে পথের ওপরে একটা মাছ পড়ে আছে। জ্যান্ত, না মরা? ছাত্রটি নিচু হয়ে মাছটা কুড়িয়ে নেয়। মাঝারি মাপের। চার-পাঁচশো গ্রাম ওজন তো হবেই। ধরতেই, হঠাৎ মাছ একটা সাদারঙের জলীয় দ্রব্য ছিটিয়ে দিল ছেলেটির ঝকঝকে নতুন পুলওভারের বুকে। সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি ছেলেটির মুখের সুকুমার কান্তি পালটে যেন একটা মুখোশ নেমে এল। ছেলেটি হাঁটু মুড়ে বসে, একটা পাথর তুলে নিয়ে ঠুকে ঠুকে মাছটাকে মেরে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে। এবং আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

এই আচরণটার মধ্যে একটা প্রাকৃতিক জৈব প্রতিশোধস্পৃহা রয়েছে। ‘জিঘাংসা’ শব্দটা কী বীভৎস, না? এই তো ‘জিঘাংসার’ মুখ। একটা অবলা জীব, তার জৈব প্রকৃতিতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে আর একটি বলবান জীব জৈব প্রকৃতিতে সেই আক্রমণের প্রতিশোধ নিয়েছে। এমন তো নয় যে মাছ আমরা ধরি না, ছাগল মারিনা। মুরগি কাটি না। কিন্তু এটার মধ্যে অন্যরকম কী যেন একটা বন্য গন্ধ আছে, মাছে মানুষে তফাত নেই

এমনি সময়ে এক পাহারাওলা হাজির হয়—নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না—ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করল। মাছ খুন করার অপরাধে! মাছ ধরা, ও মারা ট্রাউট ফার্ম অঞ্চলে দণ্ডনীয় অপরাধ। ছেলেটি বারবার ক্ষমা চাইতে লাগল, বেশ খানিক তর্জন গর্জন করে, শেষে সান্ত্রী তাকে মুক্তি দিল, কিছু ঘুষ-টুষ না নিয়েই!!

নুরুয়ানাঙ ইন্‌ন্‌

ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া, বাঁধ দেওয়া ঝর্না নদীর একধারে ছোট একটা চায়ের দোকান। ঝুপড়ির মধ্যে। ধাবার-ই পাহাড়ি সংস্করণ। ভেতরে অন্ধকার। প্রথম ঘরটিতে একদল মানুষ বসে আছে। চা খাচ্ছে, বাটি করে খাবার খাচ্ছে। ওখানেই রান্না হচ্ছে। পাশেই আরেকটি আরও ছোট ঘর, তার মাঝখানে একটা টিনের মধ্যে গগনে আগুন জ্বলছে, ওটাই ফায়ার প্লেস। এটার নাম ‘বুখারী’। কাশ্মীরে যেমন ‘কাংড়ী’, লোকে চাদরের তলায় বুকেও জড়িয়ে থাকে কাংড়ীর ছোট সংস্করণ, বুখারী ঠিক তেমন নয়। কাঠের ধোঁয়ায় ঘর ভর্তি। কাঠের আগুনের তাতে ঘরটা বেশ গরম। বুখারী ঘিরে কিছু টুল পাতা, একপাশে বেঞ্চি টেবিল। আমরা প্রথমেই দু কাপ করে চা খেলুম, তারপর এক এক বাটি থুপ্‌পা খেলুম। কী বিশ্রী খেতে এই থুপ্‌পা। নুন নেই লঙ্কা নেই তেল নেই ঘি নেই মাংস নেই সবজি নেই কী যে আছে কে জানে? কয়েক টুকরো করে শুকনো চমরী গাইয়ের মাংস নাকি থাকে আর থাকে কিছু সস্তায় কেনা আর্মি সারপ্লাস মিট। এত বিস্বাদ বস্তু ফেনের মতন খেতে, সকলে সেটাই সোনামুখ করে খেয়ে নিলুম যা খিদে পেয়ে গেছে। তা ছাড়া ঠাণ্ডাটাও একেবারে হঠাৎই পড়ে গেছে, ঝুপ করে। গরম গরম থুপ্‌পাটা গলার নলীর মধ্যে দিয়ে যে পেটের মধ্যে চলে যাচ্ছে সেই যাত্রাটি বেশ সুখকর। থুপ্‌পা শেষ করে আবার এক বাটি করে চা। চা আসছে চিনে বাটিতে করে, এমনি কাপে কি গেলাসে নয়। ঘরে এত ধোঁয়া পরস্পরের মুখ দেখা যায় না। কাঠের ধোঁয়ায় আমার প্রবল এলার্জি, কলকাতা, কি শান্তিনিকেতন কিংবা দিল্লি হলে এতক্ষণ ধরাশায়ী হয়ে যেতুম! কিন্তু পথে পথে যখনই ঘুরি আমার সঙ্গে থাকেন এক পথিকদের দেবতা, যিনি সবরকমে আমাকে রক্ষা করে চলেন। মোট ৬ কাপ চা, দুবাটি থুপ্‌পা খাবার খরচ পড়ল তিনটাকা। ডাক্তার এ টাকাটা নিজেই দিল। আমাকে দেড় টাকা দিতে দিল না।

সেই কাঠের ধোঁয়া ভরা ঘুপচি ঘরে জোর আলো জ্বেলে দেয়নি কেউ—বুখারীর আগুনেই যেটুকু আঁধার ঘুচছে। অন্ধকার মেখে বসে আছে কিছু কম্বল জড়ানো মূর্তি

—”ওরা ছাং খাচ্ছে।”

—”ছাং কী বস্তু?”

—”বিয়ারের মতো।”

—”অ।”

—”বক্‌শিও খাচ্ছে।”

—”সেটা কী?”

—”স্ট্রংগার লিকর।”

—”চলুন, চলুন”—তাড়া দিল ঘনশ্যাম ছেত্রী। “—রাত দশটা হয়ে যাবে পৌঁছুতে। জাং-য়ে থামতে হবে। কিছু জিনিস দেবার আছে।” ডাক্তার বলল, তাকেও থামতে হবে জাং-এ। উঠে পড়লুম নুরুয়ানাঙ ইন থেকে।

.

জাং এই পূর্ব-প্রান্তিক অঞ্চলে শেষ সৈন্যশিবির। এর পরে সেনানিবাস নেই। না চিনের, না ভারতের। মোট চল্লিশ মাইল বোধ হয় (নাকি কিলোমিটার? কে জানে!) এইরকম মিলিটারি-ফ্রি অঞ্চল। সেই জিপবাবু বলেছেন মাটির নীচে সব বাংকার তৈরি করা আছে তাতে গিজগিজ করছে একদিকে শুধু চিনে, আর একদিকে ভারতীয়। কিন্তু আমাকে কেউই হায় তার ঠিকানা জানাবে না। সে-দৃশ্য আমি দেখতে পাব না স্বচক্ষে

জাং-এ ট্রাক গেল নিজের মনে ঘুরতে, আমাকে নিয়ে ডাক্তার নেমে পড়ল এক জায়গায়, ছেত্রীর সঙ্গে একটা সাক্ষাতের জায়গা ঠিক করা রইল।

ডাক্তারের সঙ্গে যাঁদের বাড়িতে গেলুম মিলিটারি ব্যারাকের মধ্যে, তাঁর নাম কর্নেল দেবদত্ত, তিনি কাশ্মীরি। তাঁর রূপসী স্ত্রী, আর দুটি দেবশিশুর মতো ছেলেমেয়ে তাঁর কাছেই রয়েছে। ওখানে নিশ্চয় আর্মি-র ইস্কুল-টিস্কুলও আছে তার মানে। কর্নেল দেবদত্তের স্ত্রী ও বাচ্চারা আমাকে দেখে মহাখুশি। প্রথমেই ভাবলেন ডাক্তার বুঝি বউ নিয়ে এসেছে। বোঝা গেল এই অঞ্চলে স্ত্রীলোক অতিথি এরা দেখেন না বড় একটা।

তখন অনেক রাত। দশটা বাজে। বাচ্চারা শুয়ে ছিল। আমাদের দেখে উঠে পড়ল। মিসেস দেবদত্ত আমাদের গুলাবজামুন খেতে দিলেন। কফিও দিতে চাইছিলেন। কিন্তু সময় ছিল না। আর্মি ডিজপোজ্যালস থেকে ডাক্তার কিছু ব্র্যান্ডি আর মিল্কমেড কনডেন্সড মিল্ক কিনে রেখেছিল এখানে, সেইগুলো নিয়ে নিল। কথা বলতে বলতে দেরি। ওদিকে হর্ন শোনা গেল। অমনি ছুট ছুট ছুট।

ডাক্তারের দুহাতে ধরা রয়েছে বাজার-করা কাগজের কার্টন। কারুর হাতেই টর্চ নেই। দীর্ঘ পাহাড়ি পথ। যে পথে এসেছিলাম সেটা নয়—যাবার সময়ে অন্য পথে যাচ্ছি। গাড়ি থাকবার কথা অন্যত্র। নতুন, অচেনা রাস্তা। অন্ধকারে অন্ধের মতো ছুটছি ডাক্তারের পেছু পেছু। আমার ব্যাগে যে টর্চ ছিল, সেটা মনে পড়ল ট্রাকে চড়বার পরে। পাথুরে পথ—কিন্তু কী ভাগ্যি, নুরুয়ানাঙ কি সে-লার মতন বরফ পড়ে নেই। ওরই মধ্যে পায়ে কী একটা লাগল ছুটতে ছুটতে। কুড়িয়ে নিলুম। ডালিম। কিংবা বেদানা হতে পারে। ছোট্ট। পথে দেখেছি বটে বাচ্চারা পাকা ডালিম খাচ্ছে, কাঁচা কাঁচা পীচফল ডাঁশা পেয়ারার মতন কচকচিয়ে খাচ্ছে, বিরাট লাউয়ের মতন ভীম-শশা, পথের ধারে বসে থাকা অলস বৃদ্ধ, কোমরের ভোজালি দিয়ে কেটেকুটে খাচ্ছেন। ছোট ডালিমটা কুড়িয়ে নিয়েই দৌড়ই—হঠাৎ সামনে দীর্ঘ একটা আলো এসে পড়ল। দূরের লরি থেকে ড্রাইভার হেডলাইটটা জ্বেলে দিয়েছে, আমাদের পথ দেখাতে। আর অসুবিধা হল না। কিছুক্ষণের মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে ট্রাকে উঠলুম।

চোখ দিয়ে কার্টনটা দেখিয়ে ড্রাইভার চোখ টিপে বলল—”রম্?”

—”ব্র্যান্ডি।”

—”একই বাত।”

নিষ্ঠুর আলোর বৃত্তে

শান্ত রাস্তায় খানিকটা উত্তেজনা গড়ে উঠল। মজা নয়, উদ্বেগেরই ব্যাপার। ট্রাকের হেডলাইটের বৃত্তের মধ্যে আটকা পড়ে গেল হঠাৎ দুটি ক্ষুদ্র প্রাণী, দুটো বেঁটে পাহাড়ি ঘোড়া। নিশ্চিন্ত নিভৃত পার্বত্য অন্ধকারে হাঁটছিল দুজনে, হঠাৎ তাদের তাড়া করল নিষ্ঠুর আলোর তীর। ঘোড়ারা প্রাণপণে ছুটেও ছুটন্ত ট্রাকের আলোর থাবার নাগাল আর ছাড়াতে পারে না। ঘনশ্যাম ছেত্রীকে যত বলছি, আলো বন্ধ করো,—সে বলে, তা কখনও হয়?—সে আলো কমাচ্ছে বাড়াচ্ছে—তাতে আরও ঘাবড়ে, এলোমেলো ছুটতে থাকছে পোনিদুটো। আমার একবারও মনে হল না যে বলি— ‘স্পিড কমাও, ওদের পেরিয়ে যেতে দাও তোমার আলোর বেড়া”–এই সমাধানটা অনেক পরে খেয়াল হল। ততক্ষণে ট্রাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত ঘোড়া দুটো প্রায় চাপা পড়ে পড়ে! আমার কেবলই ভয় করছে পা পিছলে, কি ঘাবড়ে-টাবড়ে, পড়ে না যায় খাদের মধ্যে। আমার সমস্ত মনটা অস্থির হয়ে প্রাণভয়ে ছুটন্ত ঘোড়া দুটোকেই জড়িয়ে ধরল, যতক্ষণ না রাস্তাটা হঠাৎ চওড়া হল, আর ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এল ঘনশ্যাম ছেত্রীর দানবীয় ট্রাক।—শিকারে আমি যাইনি কখনও, কিন্তু বুঝতে পারলুম, শিকারির তাড়া খেলে জন্তুদের কীরকম লাগে। এই বোকা ঘোড়া দুটো বুঝতে পারেনি, এ পশ্চাদ্ধাবন শিকার-সন্ধানীর নয়। ওদের কাছে হয়তো মানুষ মাত্রেই পশুখাদক, মানুষ মাত্রেই শিকারি-সব জন্তুরাই নিশ্চয় ভয় পায় মানুষকে। মানুষই একমাত্র প্রাণী জীবজগতে যে নিজের জাতভাইকে নিজেই মেরে ফ্যালে! জন্তুরাও মারামারি করে, আহত করে, কিন্তু নিহত করার উদ্দেশ্যে নয়, পরাজিত করার উদ্দেশ্যে। পরাজয় স্বীকার করে নিলেও, তাকে মেরে ফ্যালে একমাত্র মানুষই। জন্তুরা নাকি ছেড়ে দেয়।

আন্ধে কিনারে আন্ধে রাতে যায়ে তো যায়ে কাঁহা

এক জায়গায় ট্রাক থামিয়ে ডাক্তার বলে-

—”আমি এইখানেই নেমে যাব। এইখানে আমার বাড়ি।” সে নেমে ট্রাকের পিছন থেকে বেডিং নামাতে যায়।

—”আপনি কোথায় নামবেন?”—ছেত্রীর প্রশ্নে আমার সর্বপ্রথম খেয়াল হয় যে তাওয়াঙ-এ আমার কোনও রাত্রির আশ্রয় নেই।

—”আমি? এখানে আই বি নেই?”

—”এখানে সার্কিট হাউস আছে, কিন্তু সে তো এখন বন্ধ। সেখানে কেউ নেই। আপনি কি চিঠি নিয়ে এসেছেন?”

—”নাঃ। চিঠিপত্র তো নেই?”

এমন সময়ে দেখি মালপত্তর নামিয়ে নিয়ে, ডাক্তার গুটি গুটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে :

—”গুডবাই, ডক্টর সেন।”

“দাঁড়ান দাঁড়ান, ডাক্তার। সার্কিট হাউস খোলানোর কোনও উপায় আছে?”

—”এত রাত্রে? সাড়ে দশটা বেজে গেছে তো—এখন এখানে বিদ্যুৎও নেই, সবাই ন’টায় শুয়ে পড়েছে।”

—”তা ছাড়া এ ডি সি বম্‌ডিলাতে। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে।” ছেত্রী বলে।—”ওঁর কাছে চিঠি নেই, কেউ দেবে না সার্কিট হাউস খুলে।”

—”তা হলে আমি কোথায় যাই? কোনও হোটেল-টোটেল?”

—”এখানে? হোটেল কোথায়?” হেসে ফ্যালে ট্রাক ড্রাইভার।—”কিছু ব্যবস্থা না করেই এসে পড়েছেন? কার কাছে এসেছেন? যাবেন কোথায়?”

হায় রে ঘনশ্যাম ছেত্ৰী!

যদি জানতেম, এসব মৌল প্রশ্নের জবাব, তোমায় জানাতাম!

–“এসেছি গুম্ফার কাছে। যাব গুম্ফায়।”

—”সে তো কাল সকালে। এখন?”

—”আমি যাচ্ছি”–তাড়াতাড়ি ডাক্তার বলে। “আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে—”

—”সেকী কথা? কোথায় যাচ্ছেন মশাই আমাকে ছেড়ে? আমিও যে যাচ্ছি—

—”কোথায়?”

—”কেন, আপনার বাড়িতে?”

–“না না, সে হয় না, আমি ব্যাচেলর।”

—”তাতে কী? ব্যাচেলর বলে কি গাছতলায় থাকেন? ঘরবাড়ি নেই?”

—”ঘর আছে, কিন্তু লোকজন নেই—”

—”ভালই তো, তা হলে জায়গায় কুলোবে—”

—”কিন্তু, এ কখনও হয় না—আমি একা থাকি, আমার বাড়িতে-“

—”একটাই ঘর?” ড্রাইভার প্রশ্ন করে।

—”ঘর চারটে। কোয়ার্টার্স তো।”

—”তবে আবার কী? মেমসায়েবকে নিয়ে যান। নইলে তো আমাদের বাড়িতেই নিয়ে যেতে হবে। বস্তিতে কী করে থাকবেন উনি? কষ্ট হবে না?

—”আমি একটা ঘর হলেও যেতুম ভাই শ্যাম তোমার সঙ্গে। আমি যে ভাল লোক, এটা তো প্রমাণিত তথ্য। তবে, এত ভয় পাচ্ছো কেন?”

“বাহাদুর কী ভাববে, তাই ভাবছি।”

—”বাহাদুর কে?”

—”আমার কাজের লোক।”

—”তবে তো তুমি একা নও? তবে আর তোমার ভাবনা কী? বাহাদুরই তোমাকে পাহারা দেবে। চলো, চলো, এই নাও আমার বাক্সটা ধরো, আমি নামি।”

অন্ধকার থেকে এগিয়ে এসে একটি মূর্তি ডাক্তারের বাক্স বেডিং মাথায় তুলে নিয়ে পথ হাঁটতে শুরু করে। ডাক্তার আমার বাক্সটা নেয়, খুব অনিচ্ছাসত্ত্বেও। ছেত্রীকে ডাক্তার কত দিল দেখিনি, অমি কুড়ি টাকা দিই। সারাটা পথ পান-তাম্বুল খাওয়াতে খাওয়াতে এসেছে। একবার পকেট থেকে কিছু ফটো বের করে দেখিয়েছে। কীসের ফটো, কিছুই বোঝা গেল না। ছেত্রী বলল—”তাওয়াং-এর হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্টের ছবি। আমি নিজের ক্যামেরায় তুলেছি।” জলের চিহ্ন দেখলাম না সেই ছবিতে যদিও। ওটা সুন্দরবনের টাইগার প্রজেক্টের ছবিও হতে পারে, অথবা বাঁকুড়ার খরার। যাই হোক খুব আমুদে ছেলে। টাকাটা প্রথমে নিতে আপত্তি করে, তারপর পকেটে পুরল। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে ‘গুডবাই’ করলুম—খুব খুশি!

তারপর এগোলুম ডাক্তারের পেছু পেছু। একজনের পিছনে আর একজন হাঁটতে হয়, সরু রাস্তা। আমার মনে পড়ল টর্চের কথা। টর্চ বের করে জ্বাললুম। রাস্তা ঠিক বলা যায় না, পাহাড় কেটে এবড়ো খেবড়ো পায়ে চলার শর্টকাট মতন। একটা পাঁচিল লম্বা পায়ে ডিঙিয়ে টুক করে ডাক্তার ঢুকল। এবং তারপরই মুশকিলে পড়ল। আমাকে নিয়ে।

—”গেট উলটোদিকে। এটা আমার বাড়ির পেছন দিক। তুমিও দাঁড়াও। আমি আসছি। অনেকটা হেঁটে ঘুরে আসতে হবে তোমাকে নিয়ে।”

—”কীসের জন্যে? আমি কি পাঁচিল ডিঙোতে পারি না নাকি? ভারী তো একটুখানি বেঁটে পাঁচিল”—বলতে বলতে আমি হাতের ভরে পাঁচিলে উঠে, পাঁচিল ডিঙিয়ে ফেলেছি।

—”গুড!” আওয়াজটা হাসি হাসি। এতক্ষণে ডাক্তার বোধহয় একটু হাস্যবদন হল। আশ্চর্য। এর কি মাথায় কিছু বুদ্ধিশুদ্ধি নেই? এটুকু মাটির পাঁচিল ডিঙোনো যে এই ব্যক্তির পক্ষে কিছু না, সে তো ওর অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল। জামীরীর ডাকবাংলোয় ঘরের মধ্যে অদৃশ্য পাঁচিলটা অত সহজেই যে গেঁথে ফেলতে পারে।

ভেতরে গিয়ে দেখি বেশ সুন্দর বাংলো। বাহাদুর একটা মস্ত ঘরে বসাল, সেখানে শুধু একটা হ্যারিকেন, আর দুটো কাঠের পিঠ উঁচু-হাতল সোজা চেয়ার আছে। আর একটা হিমেল ভাব।

আমাকে ডাক্তার জিজ্ঞেস করল—

—”চা খাবেন?”

—”নিশ্চয়ই।”

—”দুধ-ভাত?”

—”থাকলে, খাব।”

—”রেঁধে দিচ্ছে।”

—”আমি একটু চান করতে চাই। দুদিনের পথের ক্লান্তি চান না করলে যাবে না।”

—”তা হলে তাড়াতাড়ি তৈরি হন, জল গরম করছে। তবে রাত্রে মাথায় জল দেবেন না। কেবল গা-হাতপায়। সঙ্গে সঙ্গে ওভারকোট পরে নেবেন, নইলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। এখানে খুব চোরা-শীত।”

আমি মনে মনে ভাবছি, আমি তো এর চেয়ে ঢের বেশি ঠাণ্ডায় থেকেছি ভাই, মাইনাস ত্রিশে, নাকের ডগাটি তৈমুরলং এসে তরওয়াল দিয়ে কেটে নিলেও কিচ্ছু টের পেতুম না তখন।

কিন্তু সে তো বাইরে।

ঘরের ভেতরে সেন্ট্রাল হিটিংয়ের অতিরিক্ত হাঁস-ফাঁস-করা গরমের নিশ্চিন্ত আওতায় থেকেছি। চান করে বেরিয়েই ঠাণ্ডা লাগার ভয়টি আমেরিকায় নেই। কিন্তু আমার প্রথম যুগের ইংলন্ডে খুবই ছিল। চান করে বেরিয়েই অর্থাৎ বাথটাবের গরমজল থেকে উঠেই তো হিমশীতল হি-হি-করা বাথরুমে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে গা-মোছা, জামা পরা, তারপর হিমশীতল শোবার ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি কম্বলের তলায় ঢুকে পড়া, হট ওয়াটার বটল সমেত বটল মানে বোতল নয়, ব্যাগ। সেই ইংলন্ডে ক্রমশ হিটিং প্যাড এল, এল ইলেকট্রিক ব্ল্যাংকেট, এখন তো সেন্ট্রাল হিটিং যথেষ্ট চালু। শোবার ঘরে হিটার থাকত না প্রায়ই, ফায়ার প্লেসও না। শোবার ঘর নাকি ঠাণ্ডা হওয়াই স্বাস্থ্যকর, তখন সবাই বলত। বোধ হয় পাছে কোনও উপায়ে asphyxiation না হয়ে যায় তার জন্য এই foolproof উপায়। ট্রিনিটি কলেজে, ছাত্রাবস্থায়, অমর্ত্যদের আবার এক বাড়িতে ছিল শোওয়া, আরেক বাড়িতে স্নান। দুই বাড়ির মধ্যে পেরুতে হত বিরাট উঠোন। শীতের রাত্রে ঠাণ্ডা লাগার পাকা সুব্যবস্থা আর কী। ফলে ছেলেরা সাপ্তাহিক স্নানটি আরও কমিয়ে পাক্ষিক, মাসিক, এমনকী ত্রৈমাসিক করে ফেলত। শীত যেমন বাড়ত, স্নানদিনের সংখ্যাও তেমনি কমত।

কিন্তু সেসব পঁচিশ বছর আগের কথা। এখন সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও না। এখন ট্রিনিটিতেও নিশ্চয় সেন্ট্রাল হিটিং হয়েছে, অ্যাটাচড শাওয়ার হয়েছে। ছেলেরা হয়তো রোজ রাত্রেই স্নান করে শোয়। জমানা বদল গয়া।

চা খেয়ে উঠতেই, বাহাদুর বলে গেল গরমজল দিয়েছে। বাথরুমটি পাশেই। সেখানে দুটি ঠাণ্ডা জলের কল, ও শাওয়ার। হায়! ওই শাওয়ারের মতো অপ্রয়োজনীয় এবং অর্থহীন শোভা বোধহয় কলকাতার সাহেব বাড়ির ফায়ার প্লেসগুলোও নয়। কলের নীচে ধোঁয়াচ্ছে বাষ্প-আবৃত একটা ক্যানেস্তারা। তাতে আমার চানের জল। সরু করে ঠাণ্ডা জলটা খুলে জল মেশাতে দিয়ে ঘরে এলুম জামাকাপড় তোয়ালে সাবান নিয়ে যেতে। দু-মিনিটও নয়। গিয়ে দেখি জল ঠাণ্ডা হিম। কল থেকে সরু একটা আইসির ঝুলছে। নাঃ, বিলেত আমেরিকায় আমার এই অভিজ্ঞতা হয়নি। বাহাদুর একটু পরে আবার গরমজল দিল। নলের ওপরে গরমজল ঢেলে জলের ধারা ফিরিয়ে আনল। স্নান শেষে সত্যি বেশ তাজা বোধ হল। ডাক্তারের শোবার ঘরটি বেশ গরম। দৌড়ে সেখানে ঢুকে পড়ি। ঘরের মাঝখানে একটি ‘বুখারী’, তাতে চিমনি লাগান। সেই চিমনির জল ছাদ ফুটো করে উঠেছে। ওটা ঘরের মাঝখানে থাকায় মেঝেটা ছিন্নভিন্ন। একপাশে ছোট পড়ার টেবিল, চেয়ার, বুকব্ল্যাক। দেয়ালে আয়না, তাকে চিরুনি, দাড়ি কামানোর জিনিসপত্র, ব্রিলক্রিম, পাউডার। অন্যপাশে সরু খাট বিছানা। একলা মানুষের ঘর। আর কী বা লাগে? বুকরাকটা ঘাঁটতে গিয়ে অবাক। কোথায় হ্যাডলি চেজ থাকবে, হ্যারল্ড রবিনস থাকবে, তা নয় ভগবদ্গীতা রয়েছে, আর উপনিষদ। আর কিছু, থ্যাংক গড়, আগাথা ক্রিস্টি।

ডাক্তার একটু বেরিয়েছিল। টর্চ নিয়ে অত রাত্রে কোথায় গেল জানি না। ফিরল বগলে বিরাট এক বেডিং নিয়ে।

—”এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ধার করে এনেছি।”

—”আমার জন্যে বুঝি?”

—”না। আমার জন্যে। আপনি আমার খাটে শোবেন।”

বাহাদুর দুধ আর ভাত এনে দিল। তাই খেয়ে নিয়ে শোবার জন্যে তৈরি হচ্ছি ডাক্তার বলল—”একটু ব্র্যান্ডি খেয়ে নিন এবারে। এখানে ঠাণ্ডায় উপকার হবে।” মন্দ আইডিয়া নয়। ঠাণ্ডায় উপকার হোক না হোক, শরীরে তেজ তো হবে। কাল কেমন দিন যাবে কে জানে? ডুডু তো খেলুম, এবার ব্র্যান্ড্রুও খাই!

একের পিঠে দুই/চৌকি পেতে শুই

দু চামচ ব্র্যান্ডি আমি তো চট করে খেয়ে ফেলেছি। ডাক্তার অল্প অল্প করে খাচ্ছে। অথচ কথা বলছে না। আমি শুয়েই পড়েছি।

—”তুমি কোথায় শোবে?”

—”ওঘরে।”

—”বিছানা হয়ে গেছে?”

—”বাহাদুর করে দেবে।”

—”ও ঘরে ঠাণ্ডা লাগবে না তো?”

—”না।”

—”ও-ঘরে ‘বুখারী’ আছে?”

—”না।”

–“ও-ঘরে খাট আছে?”

—”না।”

—”ও ঘরে কার্পেট আছে?”

—”নাঃ। ও-ঘরে পর্দাই নেই, কার্পেট!”

—”বাঃ, বেড়ে ঘর তো? ও-ঘরে তোমার শোওয়া হবে না ভাই। নিজের ঘরে নিজে শোও। আমিই ও-ঘরে যাচ্ছি। থাকতুম তো রাস্তায় পড়ে, তার চেয়ে হাজার গুণে ভাল এই ব্যবস্থা। ও-ঘরে আমি শোব।”

“না না। আপনার এই ঘর। ‘বুখারী’ আছে খাট আছে। ওঘরে আপনি শুতে পারবেন না। আমি শুচ্ছি।”

উঠলুম। ওঘরে গিয়ে দেখি বিশাল শূন্য ঘরের মেঝেয় একটি সরু বিছানা। হিমঠাণ্ডা একটা বাতাস ঘরে ঝুলে • আছে। ঢুকলেই গায় কাঁপুনি দেয়। বাহাদুর শুয়ে পড়েছে বাইরে—করিডরে। দোরের কাছে হ্যারিকেন জ্বলছে।

হায় রে এখানে শুলেই তো নিমোনিয়া হবে! এইখানে শ্রীমান ডাক্তার “তড়বড়িয়ে বুক ফুলিয়ে শুতে যাচ্ছেন রাতে?” অথবা এই শ্ৰীমতী? পাগল?

আমি বললুম—”ও বাহাদুর, ডাক্তারবাবুর বিছানা তাঁর শোবার ঘরে নিয়ে এসো। তোমার বিছানাও শোবার ঘরের সামনে করো। এ-ঘরে খুব ঠাণ্ডা যে।”

বাহাদুর বিছানা শোবার ঘরের মেঝেতে এনে পেতে দিল। ডাক্তার মুখে খুব আপত্তি করলেও বাধা দিল না। এই ঘরটিই যা গরম। ও ঘরটা সত্যি অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। করিডর তার চেয়ে ঢের গরম। বদ্ধ জায়গা তো? অন্য ঘরটায় জানলার কাচ ভাঙা, আরও ঠাণ্ডা।

প্রথম সমস্যা, পোশাক। কী পরে শোব? কেউ কিছু না আলোচনা করেই দুজনে যা পরে বের হই, তাই পরেই বিছানায় শুতে গেলুম। শুধু জুতোজোড়া খুলে রেখে।

নেক্সট প্রবলেম ছিটকিনি। খোলা থাকবে, না আঁটা থাকবে? দরজা বন্ধ না রাখলে ঘরের হিট বেরিয়ে যাবে।

এদিকে বন্ধ করলে বাহাদুর…? তাই ডাক্তারের ইচ্ছে ছিটকিনি খোলাই থাক। শেষ পর্যন্ত ছিটকিনি লাগিয়েই শোওয়া হল। বাহাদুরকে ডেকে এনে শোওয়ানো হল ঠিক দোরগোড়াটিতে। নেহাত ঘরের মধ্যে শোওয়ানোর ঠাঁই নেই, তাই। বাহাদুরের মুখে তো কোনও ভাব-বৈচিত্র্য ফোটে না, তাই বোঝা গেল না সে কী মনে করছে। ডাক্তার এই স্বজন রহিত বিদেশে কেন যে বাহাদুরকে জ্যাঠামশাইয়ের মতন মান্য-ভক্তি করে চলেছে, সেটাও বোঝা গেল না। যে আভ্যন্তরীণ আপত্তি এবং উদ্বেগগুলোর জন্ম হওয়া উচিত ছিল এই আমারই মধ্যে, যেহেতু আমি মেয়ে হয়ে জন্মেছি।

একে তো বায়োলজিক্যালি, নারীর স্বাভাবিক প্রকৃতিগত ভাবে, অপরপক্ষে সোশিওলজিক্যালি, সামাজিক নীতির অনুশাসনের ফলে এগুলো নারীর ভূষণস্বরূপ। অথচ সেগুলোর চিহ্নমাত্র আমার চরিত্রে নেই, আর এই যুবক, এই ছ ফুট লম্বা সিন্ধী ডাক্তারটি সেই সব বাধা-বন্ধের দড়ি-শেকলে হাত-পা বাঁধা হয়ে ছটফট করছে। বেচারি! দূর থেকে যাকে অবিকল অমিতাভ বচ্চনের মতো দেখায়, যার চোখের রং নীল, সে কেন এমন?

আমার এখন বেজায় লোভ হচ্ছে একটু ছেলেটাকে খ্যাপাতে। যাব নাকি, একবার : – “আজ হোলি খেলব শ্যাম তোমার সনে, একলা পেয়েছি তোমায় নিধুবনে”—বলে রোম্যান্টিকালি তেড়ে? কী করবে তা হলে ডাক্তার? জহরব্রত নেবে? কুকুরি বের করে হঠাৎ খুনখারাপি করে ফেলবে? নাকি সেই সুখকর আশা-আশঙ্কার আধে-আঁধুরেতেই জামীরীতে সারারাত ঘুম হয়নি তার? পুরুষের চরিত্র, দেবসেন ন জানতি। ন চিন্তয়তি চ।—”স্লিপ ওয়েল, ডক্টর—ইট্স ভেরি কাইন্ড অফ ইউ টু অফার মি আ শেলটার। গুড নাইট, ডক্টর।”

আমি তো আরামে-গরমে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়লুম। ডাক্তারও তার মেঝের বিছানায় নিশ্চয়ই মৌজেই ঘুমিয়ে ছিল। নিজের ঘরের উষ্ণ নিরাপত্তায়, এবং দোরগোড়ায় বাহাদুরের হুঁশিয়ার পাহারায়, তার অনিদ্রা হওয়ার কারণ ছিল না। থাকলই বা ঘরে একটা গুণ্ডা হাতির মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ মেয়ে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *