ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে – ৩

যত্নে কৃতে যদি না সিদ্ধতি

শীলা বরঠাকুরের স্বামী বলেছিলেন পারমিটে সাহায্য করবেন। তাঁকে ফোন করা হল। তিনিও বললেন এ ডি সি না ফিরলে পারবেন না। আমি বাড়িতে বসে বসে মরিয়া থেকে মরিয়াত হচ্ছি।

হঠাৎ একটা কথা মনে হল।—”দাদা, ইটানগরের টেলিফোন ডিরেকটরি কোথায় পাওয়া যাবে?”

“ওই ড্রয়ারে।”

—”এ বাড়িতেই আছে?”

—”ব্যস ব্যস ওতেই হবে। একবার আমি নিজে নিজেই চেষ্টা করি।”

—”তুমি কাউকে চেনো ওখানে?”

—”নাঃ।”

—”না চিনলে বুঝি ফোন করতে নেই?”

—”কাকে করবে?”

“দেখি, গবর্নমেন্টের কাউকে।”

শমী ছুটে ডিরেক্টরি এনে দিল। আলোদিও খুব উৎসাহিত। কাকে ফোন করছে রে বাবা! দাদা মহা দুশ্চিন্তিত। ডিরেক্টরি খুঁজে খুঁজে কিছুতেই বুঝতে পারলুম না পারমিট দেওয়ার ব্যাপারটা কার হাতে থাকতে পারে। ডিরেক্টরিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছি, আর রানিং কমেন্টারি শুনছি।

—”ওয়াইল্ড গুড চেজ!” দাদার মন্তব্য

—”মাসি, ইউ আর ক্রেজি!”—শমী।

—”আঃ ওকে দে না যা করছে করতে দে।” আলোদি আমার পক্ষে এসে গেছেন। হঠাৎ একটা নামে চোখটা আটকে গেল। জোড়হাটে একটা কথোপকথন শুনেছিলুম। একজনদের বাড়িতে রাত্রে ডিনারে নেমন্তন্ন ছিল। সেখানে ইটানগর থেকে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন। বিজয় হেনড্রিকে, ওখানকার এম এল এ, (আমাদের বন্ধু। তাঁরই স্ত্রী রানী আমাকে গাড়ি করে কাজিরাঙ্গা পৌঁছে দিয়েছিলেন।) তাঁকে বলছিলেন ইটানগরে তাঁর এক নিকট বন্ধু (না আত্মীয়?) আছেন, লেফটেনান্ট গভর্নরের অ্যাডভাইজার হয়ে। নামটা খুবই অদ্ভুত লেগেছিল শুনতে, আমি শুনেছিলুম—”খাউনড”।

গাইডে হঠাৎ দেখি একটা নাম—অ্যাডভাইজার টু দ্য লেফটেনান্ট গভর্নর, মিস্টার খাউনড। এই নিশ্চয় সেই!

দাও লাগিয়ে ফোন।

সোজা অ্যাডভাইজার টু দি লেফটেনান্ট গভর্নরের আপিসে।

.

“নমস্কার। খাউনড বলছি।”

যথাসাধ্য গলায় ওজন ঢেলে, সিসের মতো ভারী করে বলি :

—”নমস্কার। তেজপুর থেকে ডক্টর নবনীতা দেবসেন বলছি। আমি এসেছিলুম কলকাতা থেকে জোড়হাটে অসম সাহিত্য সভাতে যোগ দিতে।”

—”ওহো, ডক্টর দেবসেন? কালই আপনার একটা ইন্টারভিউ শুনলাম গৌহাটি রেডিয়োতে। তা আপনি তেজপুরে কবে এলেন?”

এবার আমি অবাক। এ কীরে বাবা? ওঁকে ইমপ্রেস কররার জন্যে ডক্টর ফক্টর বলে ইনট্রোডাকশন শুরু করে এখন লজ্জা পেয়ে গেছি।

—”আপনার ইন্টারভিউটা আমার ভাল লেগেছে। ঠিকঠাক কথা বলেছেন। জন্মভূমির ইন্টারভিউটাও দেখলাম। আপনি তো অসমিয়া পড়তে পারেন।”

—”অতি অল্পস্বল্প। (ততক্ষণে আমি পুনমূষিক।) এমন কিছু নয়। মানে—”

—”হঠাৎ কী মনে করে ফোন? কী করতে পারি আপনার জন্যে?”

—”ও হ্যাঁ। আমি একটু তাওয়াং মঠে যেতে চাই। তা, এডিসি এখন তেজপুরে নেই, ইটানগরে। ইনার লাইন পারমিট দিচ্ছে না। কালই একটা ভাল লিফট পাচ্ছি তাওয়াং-এর এম ও-র সঙ্গে, তাই—”

“নট টু ওয়ারি। আধঘণ্টা অপেক্ষা করুন। আপনার ফোন নম্বরটা কী?”

–“…“

“আপনার ভাষণও কাগজে পড়েছি। ভাল লাগল আলাপ হয়ে। তাওয়াং মঠ নিয়ে কিছু লিখবেন নাকি?”

—”হ্যাঁ, ওই একটু, আর কী, মানে, ও হ্যাঁ, আপনার কথা বিজয় হেনড্রিকের কাছে শুনেছিলাম। তাই—”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ! ওরা কেমন আছে?”

—”ভাল আছে। রানী আমাকে…

—”বেশ বেশ ঘুরে আসুন তাওয়াং মঠ—”

আধঘণ্টা পরেই এডিসির অফিস থেকে ফোন এল, ডক্টর সেনের পারমিটটা যেন আজ‍ই পাঁচটার মধ্যে কালেক্ট করে নেওয়া হয়। ডঃ সেনকেই যেতে হবে, সইটই করার আছে।

নাচতে নাচতে ছুটি। শমীর অহংকার ফেটে পড়ছে। আর দাদাকে দেখে মনে হচ্ছে দাদাই ব্যবস্থাটা করে দিলেন।

শমীকে দেখে মনে হচ্ছে শমীই।

আলোদি কেবল বলছেন-

—”বলছি না, ও কি সোজা মেয়ে? ও যা চাইছে করতে দাও। ও কুম্ভে-যাওয়া মেয়ে।”

যাবই, আমি যাবই

সন্ধেবেলার মধ্যে শীলা বরঠাকুরের সবুজরঙের ডবলব্রেস্টেড ওভারকোট এসে গেল। এসে গেল ইলাদির শ্বশুরমশাইয়ের বাঁদুরে টুপি, দস্তানা ও মাফ্লার। আলোদি বের করে দিলেন দাদার হাত কাটা স্লিপওভার শমীর হাত-পুরো পুলওভার, মোজা। তারপর বেরুনো হল জুতো কিনতে। মোজাও কিনলুম, দুজোড়া নাইলন-উল মেশানো। বাটা থেকে “রপ্তানির জন্য প্রস্তুত” কোয়ালিটির কেডস জুতো। লাফাতে লাফাতে বাড়ি এসে বাক্স গুছোতে লাগলুম।

আলোদি-ইলাদি-শমী খুব উৎসাহিত। দাদা নিরুৎসাহ। স্তিমিত মুখে ঘুরছেন। হঠাৎ উজ্জ্বল মুখে এসে ঘোষণা করলেন—

—”কাল সকালে আগে মেডিক্যাল চেকআপ করাতে হবে। ডাক্তার দেখে যদি বলে, ‘হ্যাঁ যাত্রার যোগ্য স্বাস্থ্য’ তবেই যাবে। না-করলে না।”

হঠাৎ এ কী ফ্যাসাদ রে বাবা! স্বাস্থ্যটা আমার চিরকাল উইক পয়েন্ট। ছেলেবয়েসে আন্ডার ওয়েট বলে এন সি সি-তে নেয়নি। এখন তো শরীরং ব্যাধিমন্দিরম্। ডাক্তার যত না জানিত ততই আমার মঙ্গলম্।

.

—”দেখুন, আমার দু-একটা ক্রনিক ডিজিজ আছে। তাতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। প্রেশার দেখলে, হয়তো দেখবেন ডায়াস্টোলিক একশো সিস্টোলিক একশো-কুড়ি কিংবা একশো দশ-একশো চল্লিশ। এসবে চিন্তার কিছু নেই। ব্রিনারড্রিন বলে একটা ওষুধ আছে সঙ্গে। খেয়ে নেব এবেলা ওবেলা।

তা ছাড়া বুকে স্টেথো লাগালেই শুনতে পাবেন শন শন শব্দে অ্যাজমাটিক স্প্যাজম চলছে। ও কিছু না। ওটা আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। আমি রোজই স্টেরয়েড খাই, অ্যাজমার বড়ি খাই। সামলে-সুমলে থাকি।

এ ছাড়া, আমার হার্টে একটু ইস্কিমিয়া হয়েছে, তা, কলকাতার প্রায় সবকজন অ্যাডাল্টেরই হার্দিক অবস্থা তাই। সঙ্গে সরবিট্রেট আছে।—অতএব ডাক্তারবাবু আপনি যাই দেখুন, জেনে রাখুন এটাই আমার নর্মাল ফাংশনিং স্টেট—এটাই আমার স্বাভাবিক স্বাস্থ্য। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলে তো চলবে না? এভাবেই আমি যদি রোজ চাকরি করতে যেতে পারি, বেড়াতে যেতে পারব না? সকলের কি শরীরে সব কিছু সহ্য হয়? আমার হয়। আমি খুব শক্তপোক্ত।

এসব ছাড়া, আমার ঘাড়ে একটু বাত, আর মাথায় একটু মিগ্রেন আছে। তা, তারও ওষুধ সমস্ত সঙ্গে মজুত। বিনাযুদ্ধে ছেড়ে দেব না বুঝলেন? অস্ত্রশস্ত্র সব সঙ্গে। এমনকী ম্যালিরিয়ার জন্যে ক্লোরোকুইন, পেটখারাপের জন্যে এন্টারোকুইনল! মানে পুরো শমীবটবৃক্ষটাই। কেবল পাগলাষাঁড়ে করলে তাড়া—”

আলোদির আর সহ্য হল না।

—”হয়েছে! ঢের লেকচার হয়েছে! থামো দেখি? এবার ওঁকে দেখতে দাও। ওঁর সময় নষ্ট হচ্ছে।”

ডাক্তারবাবু বাঙালি। অল্পবয়সি। শান্ত হয়ে স্পিচ শুনলেন। তারপর রুগিকে নেড়ে চেড়ে, উলটে-পালটে, যথাসাধ্য যত্ন করে দেখে, হেসে ফেললেন।

—”যা যা বললেন, ঠিক তাই! বি পি একশো বাই একশো পঁচিশ। আগে না বললে ভয়ই পেতাম। এক্ষুণি হাফ ব্রিনারডিন। একশো থাকা ঠিক নয়। এই জন্যই ইস্কিমিয়া। স্প্যাজমও চলছে, তবে বেশি না। ওষুধ চালিয়ে যান। তবে একা তাওয়াং যাচ্ছেন যখন, আমি বলব সেফটির জন্য দিনে তিনটে করে স্টেরয়েড খান এখন ক’টা দিন। ফিরে এসে টেপার-টাউন করবেন। সঙ্গে স্প্রে আছে?”

—”আছে, কিন্তু এক্সট্রা নেই। ফুরিয়ে যেতে পারে। বিলিতি তো, বেশি ছিল না।”

—”নিও-এপিনাইন কিনে নিন একটা, ব্রভন স্প্রে নিয়ে যান সঙ্গে, আর সব ওষুধগুলোই বেশি বেশি করে সঙ্গে রাখুন যখন আপনি যাবেনই—আমি অবশ্য এমনিতে বলব না যে আপনি সুস্থ—”

—”তা হলে তো আমাকে বারোমাসই মেডিক্যাল লিভে থাকতে হয়—”

—”যাচ্ছেন যান, তবে এই স্বাস্থ্যে এই রিস্ক নেয়াটা ঠিক হচ্ছে না। সঙ্গে ডাক্তার আছে, তাই নিশ্চিন্ত। কিন্তু একটা কথা, একটানা উঠে যাবেন না যেন পাহাড়ে। হঠাৎ অত হাই অলটিচ্যুডে উঠে গেলে মানুষের ব্রেনের ফাংশনিং অনেক সময়ে অ্যাফেক্ট করতে পারে। পথে জার্নি অতি অবশ্যই ব্রেক করে যাবেন। চিনে যুদ্ধের সময়ে আমাদের হারের একটা কারণ তো ওই।”

—”মানে?”

—”মানে, জেনারেল অমুক উদ্বেগের চোটে খুব জোরে জিপ চালিয়ে নন-স্টপ উঠে যান তাওয়াং। ওই অলটিচ্যুডে ওভাবে ওঠা, শরীর অ্যাডজাস্ট করতে পারে না। ওঁর ব্রেন অ্যাফেক্ট করেছিল। অথচ বাইরে বোঝা যায়নি। উনি যে-সব ডিসিশন নিয়েছিলেন, এবং মিলিটারিকে যা যা অর্ডার দিয়েছিলেন, সবই পাগলের মতো। প্রচণ্ড সেল্ফ-ডেস্ট্রাকটিভ এবং রং জাজমেন্টে পূর্ণ ছিল। তখন তো বোঝা যায়নি, পরে বোঝা গেল যে মেডিক্যালি হি ওয়াজ অ্যাবসলুটলি আনফিট —”

—”কী সর্বনাশ!”

—”থেমে, থেমে, বুঝলে তো নবনীতা, থেমে, থেমে” দাদা উদ্বিগ্ন স্বরে বলেন—”একটানা নয়। যদি বা ওই লোকটা উঠতেও চায়, তুমি ওকে এই জেনারেলে-র গল্পটা বলবে। বুঝলে তো?”

—”ও তো নিজেই ডাক্তার। ও কখনও একটানা উঠবে না।”—আলোদি বলেন।

ইতিমধ্যে ডাক্তার লালওয়ানীকে ফোন করে জানিয়েছি, যে পারমিট হস্তগত হয়েছে। তিনিও জানিয়েছেন, যে জিপ দুটোর একটাও সারেনি, এবং র‍্যাশনট্রাকেও লোডিং শেষ হয়নি। সন্ধ্যাবেলা ছাড়বে।

এবার ওষুধপত্র কেনার পালা। দাদার গাড়ি সর্বদাই আছে আমার জন্য। সত্যি, এত যত্ন, এত ভালবাসা এত খবরদারি—যেন সত্যিই দাদার সহোদরা বোন আমি—এই পাঁচ বছর পরেও তার উষ্ণস্বাদ একটুও কমেনি স্মৃতিতে! আলোদি খুব কাজের আর তেমনিই মজার। যেমন হাসেন, তেমনি হাসান। মহা আড্ডাবাজ। মজার মজার কথা খেলেও বটে মাথাতে। আমাদের যে বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের জানালায় বেঁটেখাটো অল্পকাপড়ের পর্দা টাঙাই আমরা, আলোদি তার গোপন নাম দিয়েছেন বডিজ-পর্দা। উপর-নীচে ফাঁকা, মাঝখানে ঢাকা। চোলি স্টাইলের ব্লাউসের মতো, ওতে কিছুই ঘরের আব্রু থাকে না। এটা অবশ্য উনি খুবই গোপনে বলেছিলেন। কাগজে ছাপিয়ে দিয়েছি শুনলে চটে যাবেন নিশ্চয়ই! তেজপুরে ক’টাই বা দিন? কিন্তু দাদা-আলোদি-শমীর সঙ্গে সম্পর্কটা যেন অনেক দিনের পুরনো বাঁধন।

সারাদিন আড্ডায় আর উত্তেজনায় কাটল। কলকাতায় টেলিফোন করে মাকে খবর দিয়ে দিলুম। “ফিরতে সাতদিন দেরি হবে—তেজপুর থেকে বাইরে, অরুণাচলের দিকে একটু ঘুরতে যাচ্ছি। মা গো যেন ভাবনা কোরো না!”

দাদাকে বলে গেলুম প্লেনে বুকিং করে রাখতে। সাতটা দিন হাতে নিয়ে সন্ধেবেলা রওনা হচ্ছি তাওয়াং। ম্যাকমাহন লাইনের পাশে। সেই লাসা-তাওয়াং রোড, যেখান দিয়ে চিনেরা এসেছিল! সেই যে আশ্চর্য পুঁথি বোঝাই মঠের কথা রীতা গুপ্তার মুখে শিলং-এ শুনে অবধি সেখানে যেতে আমার ভীষণ লোভ! সত্যি সত্যিই সেখানে যাচ্ছি!

ইলাদির শ্বশুরের টুপি-দস্তানা-মাফলার শীলার কোটের পকেটে গুঁজে, ব্যাগের ওপরদিকে শমী ও তার বাবার সোয়েটারগুলো রেখে, নিজের শালটি গায়ে দিয়ে, সুটকেস হাতে গুটিগুটি দুগ্‌গা বলে রওনা হলুম পাঁচটা নাগাদ, যেখানে ট্রাকটি থাকবার কথা। গিয়ে দেখি, বাপস। বিরাট, বিশাল, জবরদস্ত একখানা লরি। যেমন লরি ফুটপাথে উঠে পড়ে—পথে শুয়ে থাকা মানুষদের চাপা দেয়। কেন যেন ট্রাক’ বলতে আমি মনে মনে মিলিটারি ট্রাকের মতো ঢাকা গাড়ি ভেবে নিয়েছিলুম।

খোলা লরি দেখে একটু ঘাবড়ে গেলুম না তা নয়। যদিও খোলা লরিতে চড়েই তো দুর্গাঠাকুরের সঙ্গে বিসর্জনে যেতুম। কিন্তু এটা শুধু খোলা লরিই তো নয়? এ যে দোতলার সমান উঁচু জিনিসপত্রে ঠাসা! অসংখ্য বস্তা, অনেক থলি, এবং বহু বহু কাগজের কার্টন। এ ছাড়া, আস্ত-মস্ত গোদরেজের আলমারি। এবং প্রচুর বেতের আসবার পত্তর। তার ওপরে বসে রয়েছে ঝুড়ি ঝুড়ি জালঢাকা নানা সাইজের মুরগি। তারা কঁক্ কঁক্ করে প্রচণ্ড বিরক্তি প্রকাশ করছে। ওদের ওপরে আমিই বা উঠব কোথায়, ডাক্তার লালওয়ানীই বা বসবেন কোথায়?

–“আরিবাব্বা! এইটা কী জিনিস? এর মধ্যে মানুষ বসবে ক্যামন করে? নো নো নো ইউ আর নট গোয়িং ইন ইট। ইমপসিবল।” দাদা ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়তে থাকেন। কোলে তাঁর আদরের নাতনি, (ভাইঝির কন্যা) আলোদি সমেত আমাকে তুলে দিতে এসেছেন। তাঁর সেই মাথা নাড়া আমি কোনওদিন ভুলব না। আমি হলেও মাথা নাড়তুম ওইরকমই।

—”নো, নো, নো। ম্যাডনেস—এটা তো মালবোঝাই! এর মধ্যে তুমি উঠবে কোথায়?” আলোদি অবাক হয়ে বলেন—”তা ছাড়া এতে তো কোনও ছাদই নেই! জায়গা থাকতও যদি, শেডহীন গাড়িতে আমি ওকে যেতেই দিতাম না! ঠাণ্ডা লেগে নিমোনিয়া হয়ে যাবে যে। আমি ভেবেছিলাম শেড আছে বুঝি! এত বড় ধ্যাধধেড়ে মালের লরি করে কি মানুষ যায়? ও যাওয়া-টাওয়া হবে না। ফিরে চলো।” আলোদি এবারে খুবই জোরালো আপত্তি করেন।

আমিও ঘাবড়ে গেছি।

সত্যিই তো। দি স্পিরিট ইজ উইলিং বাট দি ফ্লেশ ইজ উইক। এর মধ্যে উঠে বসবার মতো তিলটিও স্থান নেই। মুরগিরা পর্যন্ত বিরক্ত। এই মালপত্রের মনুমেন্টের মাথায় চড়ে বসব কোনখানে? গাড়ি চললেই পড়ে যাব যে।

দাদা আর আলোদির কথার বিরোধিতা করবার মতো কোনওই সৎ যুক্তি আমার মাথায় আসছে না। সব কথাই যথার্থ।

মন মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। তার মানে আজ হল না।

ঠিক হ্যায়। জিপ তো সারছে। সারুক। যাবই, আমি যাবই। এটাকে না পাব যদি আরেকটাকে পাবই।

সেই ডাক্তারই বা গেল কোথায়? নিশ্চয়ই এটাতে উঠতে না পেরে অন্য কোনও গাড়ি চেপে হাওয়া। সেই বাঙালি জিপবাবু যেমন না বলে একদিন আগেই নো-পাত্তা

—সবাই এক।

—কেউ আমার কথা ভাবেনি।—না ঈশ্বর না প্রতিমা!

এমন সময়ে লাজুক লাজুক মুখে একটু দূরে এসে দাঁড়াল ডাক্তার। আমাকে চেনবার লক্ষণ দেখাল না।

দাদা এগিয়ে গেলেন উদ্বিগ্ন মুখে।

—”বসবে কোথায়? এ তো মাল বোঝাই!”

—”বসার জায়গা তো ভিতরে।” ডাক্তার খুব স্বল্পভাষী।

“কীসের ভিতরে?” মালের পাহাড়ের তলায় দৃষ্টি চালাতে চেষ্টা করেন দাদা। গুহা-টুহা আছে কিনা!

—”ড্রাইভারের পাশে।”

এতক্ষণে নজর করি—সত্যিই তো লরির তো ছোট্ট একটুখানি ছাদ-ঢাকা অংশও থাকে! তার মধ্যে বসে থাকে ড্রাইভার ক্লিনার ইত্যাদি। সেখানে কি আরও লোক বসানো যায়? দেখি, কতটা জায়গা? উঁকি মারতে গিয়ে টের পাই লরি ব্যাপারটা কতটা উঁচু। ড্রাইভার সিংহাসনে বসে আছে। মাটির চেয়ে অনেকখানি উঁচুতে। আমার মাথার কাছ বরাবর দরজার পদপ্রান্ত। লরির গায়ে তিনটে পা-দানি আছে অবশ্য, ওঠার জন্য। সেগুলো একটা অন্যটার নীচে, একই লাইনে। সিঁড়িভাঙা নয়। ওঠা খুবই শক্ত। কেউ হাত ধরে না টেনে নিলে আমার পক্ষে ওঠা অসাধ্য। কোনও হাতল-টাতলও নেই যেটা ধরে উঠব। দরজাটা দাদাই খুললেন। মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিলেন। ভেতরে কে একজন লোক বসে আছে। ড্রাইভারই বোধ হয়। ক্লিনারও হতে পারে। গুটি গুটি গিয়ে তার হাতেই আমার বাক্সটা তুলে দিই। সে তুলে নেয়। আমাকে এক্সপেক্ট করছিল মনে হয়। তার পরে আমার দক্ষিণ হস্তটি বাড়িয়ে দিয়ে অকারণ রুক্ষ গলায়, খুব গম্ভীর হয়ে বলি :

—”মেহেরবাণী করকে হামারা হাথ পকড়কে উপর খিঁচ লিজিয়েগা জরা!” (হাত ধরে তুমি লয়ে চলো সখা!) সে ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। পাণিগ্রহণ করে। আমিও শক্ত করে তার হাতটি ধরি; সাবধানে ওই ধাপগুলোতে পা রাখতে রাখতে ওপরে উঠে পড়ি। উঠে পড়ে আর গাম্ভীর্য থাকে না। নিশ্চিন্ত হয়ে হেসে ফেলি—”থ্যাংকিউ জি!”

সেও হাসে—”উঁচু হ্যায় আপকো লিয়ে। সাবধানীসে উতারনা জি।

ব্যস। হয়ে গেছে। টিমওয়ার্ক চলবে। ওই হাসিটাই শিলমোহর করে দিয়েছে টিম। নিশ্চিন্ত হয়ে তাকিয়ে সীট-ফিটগুলো নিরীক্ষণ-সমীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ করি। বেশ তো। পুরনো প্রাইভেট বাসের টানা সীটের মতো। ৪-৫ জন বসতে পারে। মন্দ কী?

দাদা-আলোদি নাতনি সমেত বাইরে। উদ্বিগ্ন।

“কী? কেমন ব্যবস্থা? ভাল?”

—”ভাল, আলোদি, খুব ভাল, কিছু ভাবনা করবেন না।”

—”কখন ছাড়বে?”

ড্রাইভারই উত্তর দেয়, “ছাড়ল বলে।”

—”মিনিট পনেরোর মধ্যে। দুজন আসা বাকি। ওরা এলেই ছাড়বে।”

—”তবে চলি? ছ’টায় বাচ্চার খাবার টাইম—” আলোদি বলেন।—”সাবধানে যেয়ো। ওষুধপত্র খেতে ভুলে যেয়ো না।”

—”পথে নিশ্চয় থামবে কিন্তু! মনে থাকে যেন!”

—”সাবধানে থেকো।”

—”ফিরতে দেরি করো না।”

—”আমরা ভাবনায় থাকব কিন্তু। একা যাচ্ছ।”

—”আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন।” একা যাচ্ছি না। আমি কখনও কোথাও একা যাই না। এটাই মজা!

—”কিছু ভাবনা করবেন না। ঠিক সময়ে ফিরব।”

‘যার কেহ নাই, তুমি আছ তার।”—এই চমৎকার কথাটা মনে থাকে না কেন কারুর? রজনীকান্ত বেশি কবিত্ব না করে সহজ সরল ভাবে কথা বলতেন। আমার সেটা খুব মনে ধরে।

.

উঃ। একা। একা। একা।

শুনতে শুনতে শুনতে মন সত্যিই একা হয়ে যায়।

-কেন একা নয়?

—এমন কেউ আছে কি জগতে যে একা নয়? এমনকী শ্যামদেশি যমজরাও একটা বিন্দুতে খুব একা। আমরা মনে করি, ‘আমরা দুজন’, ‘আমরা চারজন’, ‘আমরা দশজন।’ ঠিক। সে তো আমরা। কিন্তু আমি? আমি-টা কজন? ‘আমি দুজন’ তো নই? আমি মানেই একলা।

যেখানেই আমি, সেখানেই একাকিত্ব। একমাত্র সন্তান বলে জন্ম ইস্তক আমি এই ‘একা’ গাল খেয়ে আসছি।

এখন আবার ঘর গেরস্থালি নেই বলে আরেক দফার নতুন করে ‘একা’ গাল খাচ্ছি। আরে বাপু, আমাকে বলছ যে, তুমিই বা কোন দুজন?

তুমিও একাই।

আমিও একা। তুমি-ও একা।

এটা গ্রামাটিকা’ ‘ফ্যাক্ট। একাকিত্বটাই মূল অবস্থা।

আমি কিন্তু একলা নই।

‘যার কেহ নাই, তুমি আছ তার’ আমার চেয়ে বেশি করে আর কে জানে, এ-উচ্চারণের সত্যতা!

দাদা-আলোদিরা নাতনি নিয়ে চলে গেলেন। আরও দুজন লোক এসে পড়ল ডাক্তারও উঠে পড়ল। অন্ধকার নেমে গেছে তখন তেজপুরের পথেঘাটে। আমাদের লরির, স্যরি, ট্রাকের—হেডলাইট জ্বলে উঠল, যেন সার্চলাইট—দূর-দূরান্ত পর্যন্ত আলো ছড়িয়ে পড়ল। সামনে একটি ধূপদানিতে দু-তিনটি ধূপকাঠি। তাতে দেশলাই ধরিয়ে দিল।

আর একটা পাতলা সাদা গামছার মতো জিনিস জড়ানো আছে একটা দণ্ডে। মালার মতন করে। আমরা পাঁচজন পাশপাশি বসেছি। কোনওই অসুবিধা হচ্ছে না। আমার পাশে কোট, ব্যাগ রাখা। ছজনও বসতে পারত। অবশ্য আমরা কেউই মোটা নই। ভয় করছে, ধূপের গন্ধে আমার হাঁপানি না বেড়ে যায়। ধূপের ধোঁওয়া ধুনোর ধোঁয়ায় আমার আবার অ্যালার্জি। মহাপাপী আর কাকে বলে! আরেকটাও অন্য স্বাদের তীব্র গন্ধ আসছে এপাশ থেকে। একটু কম পবিত্র গন্ধ। এতেও আমার রুচি নেই। এতেও গা বমি-বমি করছে। এই দুর্গন্ধের মধ্যে কদিন? কঘণ্টা? কত অনন্ত মুহূর্ত? মহা মুশকিল হল দেখছি। একটু দেখি। গাড়িটা ছাড়ুক তো। জোরে বাতাস ঢুকলে হয়তো খোলা হাওয়ায় এসব সুগন্ধ-দুর্গন্ধ সবই উড়ে যাবে।

ভাবতে ভাবতেই হর্ন দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। দুর্গা দুর্গা। আমার গুরুদাস দাদা হলে বলতেন ‘জয় জয়’। কার জয়, কীসের জয়, সেসব কিছু না। কেবলই জয় জয়কার। ও যার জয়, সে জানে, সে ঠিকই তুলে নেবে নিজের জিনিসটি নিজে।

মিস্টার সেন মিসেস সেন

—”নমস্তে। আপকা শুভনাম?”

হিন্দি দিয়ে শুরু করাই ভাল। সর্বভারতীয় ভাষা। ট্রাক-চালকের ভাষা তো বটেই। ডানপাশের ছেলেটিকে দিয়ে শুরু করেছি। বয়েস উনিশ-কুড়ি হবে।

—”মাইলা।”

—”আপ ক্যা করতে হেঁ?”

—”হাম তো ক্লিনার। “

—”আপ অহমিয়া?”

—”নেই, নেই। নেপালি।“

—”নেপালি? আচ্ছা, আচ্ছা। ঔর আর শুভ্নাম? ড্রাইভর সাহাব?”

—”জি, মানচন্দ।”

—”আপ্ ভি অহমিয়া নেহি?”

(হিন্দি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।)

—”জি নহি। ম্যায় তো রাজপুতানাসে আয়া। ম্যয় জাঠ হুঁ।”

—”রাজপুতানাসে ইতনা দূর চলা আয়া?”

–“ঔর ক্যা? রোটিকে লিয়ে। কামকা ওজেসে।”

—”বহুৎ সাল হো চুকা, ইধর মে আপ কাম করতে হেঁ?”

—”জি হাঁ। ময় তো অ্যাসামিজ ওয়াইফ্ লে লিয়া। ইধরই ঘর বনা লিয়া।” যুবকটি এবার এদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসে। চমৎকার ঝলমলে হাসি।

—”বাঃ বাঃ। গুড। লেকিন রাজপুতানাকে লিয়ে দিল্‌ নেহি দুখাতা?” আরেকবার হাল মানচন্দ। ধবধবে হাসি।

—”যাতা ভি হুঁ কভি কভি। মা-বাপ হ্যায়। ভাই হায় রূপাইয়া ভেজতা হর্ মহিনা।”

এবার যাঁকে প্রশ্ন করি তিনি আমার ঠিক বাঁ পাশে। তিনিই গাড়ি দুর্গন্ধে আমোদিত করে রেখেছেন। ধূপের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে তার পানীয়। আমার ভয় করছে তিনি যে-কোনও মুহূর্তে ঢুলতে ঢুলতে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়বেন। তাই তাঁকে জাগিয়ে রাখাটা খুব দরকার। এবং এই তীব্র মদের গন্ধেরই বা কী ব্যবস্থা করা? গলা খাঁকারি দিয়ে বাক্য শুরু করি।

—”নমস্তে জি।”

—”ন্নমস্তে। গর্রর্… —”আপকা শুভ্নাম?”

—”গরররা…।”

—”আপকো নাম বাতাইয়ে, মেমসাব নাম পুছতা—” মাইলা জোরে জোরে বলে। হাসতে হাসতে। মজা পেয়ে।

—”ন্নাম? মেরে ন্নাম মিস্টার সেন। আকা স্নাম কেয়া?” এক চোখ খুলে তিনি জবাব দেন।”

—”মিসেস সেন।”

—”কেয়া?” দুটি চোখই খুলে যায়। নেশাও কেটে গেছে বলে মনে হয়। ভাবটা “ঠিক শুনছি তো?” টাইপের। উদ্বিগ্ন।

—”নাম কেয়া বোলা আপকা?”

—”মিসেস সেন।”

—”মিসেস সেন? আপ্ বাঙালি?”

—”আজ্ঞে হ্যাঁ।”

—”আপ্ বদ্যি?”

—”আজ্ঞে হাফ-বদ্যি। বদ্যি বাই বার্থ নই, বদ্যি বাই ম্যারেজ।”

—”ওই একই হইল গিয়া। গোত্রান্তর হইয়া যেইটা হইসেন, হেইটাই অহন আপনের জাতি। গুড। মিসেস সেন, মিস্টার সেন। মিস্টার সেন। মিসেস সেন। ভেরি গুড।”

সর্বনাশ! শুনেছি মাতালদের, দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার দিলে তারা নেশা কাটিয়ে ওঠে। তাই বলি—”মিস্টার সেন, আমার ধোঁয়ার খুবই অ্যালার্জি। এই ধুপের ধোঁয়াতে আমার হাঁপানি হবে। ওটা নিবিয়ে দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা করতে পারেন?”

—”সর্বনাশ! তাই হয় কহনও? মঙ্গলচিহ্ন বইল্যা কথা! পার্বত্য পথে কত শত বিপদ আপদ। ধূপ জ্বালাইয়া বিপদ খণ্ডন করে কিনা? ও-ধূপ নিবাইতে নাই। ও আমি পারুম না।”

অগত্যা ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। ওই আর্জিটাই ইংরিজিতে পেশ করি। এবং ওই উত্তরটাই ইংরিজিতে শুনতে পাই। সঙ্গে আরেকটুও কথা বলেন ডাক্তারবাবু।

—”আপনি বরং এদিকে এসে বসুন, জানলার কাছে। ধূপটা তো ড্রাইভারের পাশে—এতদূরে ধোঁয়া আসবে না। ফ্রেশ এয়ারও পাবেন। গাড়ি থামলে বদলে নেবেন। একটু বাদেই নিবেও যাবে অবশ্য।” নিবে যাবার কথায় কান না দিয়ে, এবার আমি আরেকটু বলি—

—”মিস্টার সেনও যদি ড্রাইভারের পাশে চলে যান, মাইলা আর আপনি ওদের এপাশে থাকেন, তা হলে, দুটো গন্ধই দূরে থাকবে। অন্য গন্ধটাও আমার সহ্য হচ্ছে না।”

—”স্যরি। মিসেস সেন। স্যরি।”—বলেন মিস্টার সেন। বেশ ইংরিজি বোঝেন তার মানে।—”আমি তো জানতাম না লেডিপ্যাসেঞ্জার আছে, জানলে খাইতাম না আইজ। লেডিপ্যাসেঞ্জার তো থাকে না, এক ফেমিলি ছাড়া।”

—”তার মানে?”

—”মানে অনেক সময় তো ফেমিলি ট্র্যাভেল করে। বাডিলা, জামীরী, কি দিরাংজং কি রূপা, কোথাও হয়তো হাজব্যান্ড ব্যবসা করে, কি চাকরি করে। ফেমিলি লইয়া যাতায়াতের সময় ট্রাকে তাগো লেডিরা উঠে, বেবিরা উঠে। কিন্তু সিংগিল লেডি যাইতে দেখি নাই বড় একটা। মনে পড়ে না, দেখসি বইল্যা।”

যত কথা বলছেন ততই গন্ধ উৎসারিত হচ্ছে। আমি বলেই ফেলি-

—”মনচন্দ্ জি, জরা গাড়ি রুখিয়ে গা? জাগা বদ্‌লি করনা পড়েগা। বু-সে মেরা তবিয়ৎ…”

—”জি জরুর। থোড়া বাদ রুখ লেগা। লে-বাই আয়েগা আভি আভি।”

.

গাড়ি থামে। জায়গা বদল করে আমি বসি জানলার পাশে। তারপর ডাক্তার, মাইলা, মিস্টার সেন, মানচন্দ। খাঁজে খাঁজে পা রেখে রেখে ওঠা নামা করতে খুবই কসরত লাগে। মানচন্দ্ সাহায্য করে। সে উলটো দিক থেকে নেমে এগিয়ে এসেছে। ওঠার সময়ে তারই সাহায্যে উঠেছিলুম। মাইলা টর্চ ধরে খাঁজ দেখিয়ে দেয়। এই তো, চমৎকার ফ্যামিলি। একটু একলা লাগছে না আমার। কে বলেছে আমি একা ট্র্যাভল করি? কক্ষনও নয়। সপরিবারে। সর্বদা সপরিবারে। মানুষের পরিবার কি একটা?

যেতে যেতে এক জায়গায় গাড়ি থামে। মিস্টার সেন বলেন এখানে র‍্যাশনের দোকানে তাঁরা এখন মাল দেবেন। আমরা ততক্ষণ চা খেতে পারি। উলটো দিকে চায়ের দোকান। আমি প্রথমে ছোট মনিহারি দোকানটিতে যাই, একটা ব্যাটারি সমেত টর্চ কিনি। সঙ্গে টর্চ না থাকাটা একটা মস্ত অসুবিধা। পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে আলোর জন্যে। আমার মতন শহুরে সং-সাজা মেয়ে খরিদ্দার বোধ হয় এই দোকানে আসে না। চারিদিকে ছোট ছেলেমেয়ের ভিড় জমেছে। দারুণ দোকান! দোকানে তেল সাবান, শ্লেট পেনসিল, খাতা, কালি, বিস্কুট, লজেন্স প্লাস্টিকের নানা জিনিস, চটের থলি, ইশকুল ব্যাগ, কড়াই সসপ্যান, ছুরি কাঁচি স্টোভ, লণ্ঠন, কী নেই? এমনকী বেডকভার লুঙ্গি, সোয়েটার পর্যন্ত আছে। আটফুট বাই দশফুটের মধ্যে এমন খানদানি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর জগতে কোথাও দেখিনি!

টর্চ কিনে বেরিয়ে দেখি মানচন্দ্ মাইলা ও মিস্টার সেন ভারী ভারী বস্তা নামাতে ব্যস্ত। ডাক্তার গেল কোথায়?

ওই যে।

হাতে চায়ের গেলাশ। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে লম্বদাদা।

আমিও যাই। একটা চা নিয়ে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াই।

অমনি ডাক্তার অন্যমনস্কভাবে চলতে শুরু করে লরির দিকে। হাতে চায়ের গেলাস।

এ কীরে বাবা? কোথায় চলল? আমাকে দেখেই পালাচ্ছে না কি? ভারী মজা তো?

ফলো করব নাকি? ভয় দেখাব? না, থাক। যাকগে যেখানে যাচ্ছে। আমি এখানেই চা খাই। ও ওখানে শান্তিতে চা খাক।

হাতি! চিতা! জ্যাকল!

চা শেষ।

ওদের কাজও শেষ।

মানচন্দ্‌ গাড়িতে চড়ে হর্ন দিচ্ছে। ডাক্তার এল চায়ের গেলাস ফিরিয়ে দিতে। না এসে উপায় নেই! সেধে সেধে আমি কথা বললুম-

—”আবার কতক্ষণ পরে থামবে?”

গেলাস নামিয়ে ডাক্তার ফিরে যেতে যেতে বলল—”আই ডোন্ট নো।”

ফিরে গিয়ে লরিতে বসলুম। গাড়ি ছুটল।

—”এখন আর থামবে না।”—মিস্টার সেন বললেন, এবার জঙ্গলে ঢুকবে কিনা। কত জীবজন্তু দেখা যায়।

—”সত্যি? কী কী জন্তু?”

কাজিরাঙ্গার অভিজ্ঞতায় টেটম্বুর মাথা তখন

—”কত? কত? হাতির পাল, চিতাবাঘ, বান্দর, গণ্ডার, হরিণের দল, ভালুক, খরগোশ, প্রচুর, প্রচুর।”

—”আমরা দেখতে পাব?”

—”নিশ্চয়ই। হেডলাইটে ধরা পড়ব, দ্যাখবেন। কত জীবজন্তু। আমিই দ্যাখাইয়া দিমুখনে—”

—”দেবেন তো? প্লিজ, দেবেন কিন্তু ঠিক।” আমি গদগদ।

একটু বাদেই চিৎকার!

—”হাতি! হাতি! ওই যে, হাতি! দ্যাহেন!” ওঁর নিশানা লক্ষ্য করে দেখি সত্যিই একটা হাতি বনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে, বড় রাস্তার ধারে একটা সিমেন্টের গেটের গায়ে শুঁড় ঘষছে।

—”আপনের ওদিকেও একটা আছে।” বলেন মিস্টার সেন।

আমার দিকেও? সত্যিই তো। তোরণের এ দিকেও আরেকটা হাতি। ওই একই মনোরম ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান। কী ব্যাপার?

অ।

সিমেন্টের হাতি।

হাতির মূর্তি। প্রমাণসাইজ। রং করা।

রাত্রির অন্ধকারে হঠাৎ দেখলে সত্যি হাতি বলেই মনে হয়।

হাঃ হাঃ হাঃ কেমন মজা? মিসেস সেন খুব ঠকছেন!

—”হেঁঃ হেঃ হেঃ। সত্যি। খুব মজার!

(মজার না ছাই!)

.

মাইলা, মানচন্দ্ কেউই কথাবার্তা বিশেষ বলে না। ডাক্তার তো মুখে তালাচাবি এঁটে বসেছে। মিস্টার সেন কথা না বললেই ভাল হত, কিন্তু তিনিই কথা বলছেন। ভদ্রলোক মানুষ ভালই। আই এ পাস করে নানা কাজে, নানা ধান্ধায় ঘুরেছেন। আর্মিতেও জয়েন করেছিলেন। নর্থ বেঙ্গলের লোক। এখন সেটলড তেজপুরেই। অসমিয়া স্ত্রী। নর্থ বেঙ্গলেও স্ত্রী ছিল। বাঙালি। একটি ছেলেও হয়েছিল। কিন্তু তাদের উপযুক্ত দেখাশুনো করেননি। কে জানে তাদের কী হয়েছে। তাদের জন্য মাঝে মাঝে মিস্টার সেনের মনটা খুব পোড়ায়। বাবা-মা? তাঁরা মারা গেছেন বাল্যকালেই। তাঁর অসমিয়া স্ত্রীটি খুবই ভাল। দুটি মেয়ে তাঁদের। একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। অবশ্য সেই মেয়েটি স্ত্রীর আগেই ছিল। তাঁর প্রথম স্বামীর। আর একটি মেয়ে মিস্টার সেনের। সে স্কুলে পড়ছে। হ্যাঁ, তাঁরা খুব সুখী। বিধবাবিবাহ করেছেন মিস্টার সেন। তাঁর স্ত্রীর স্বামী একজন জওয়ান ছিল, চিনাযুদ্ধে প্রাণ দেয়। মেয়ে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিল সুন্দরী সদ্য বিধবাটি। মিস্টার সেনের ছন্নছাড়া জীবনে ছন্দ এনে দিয়েছে এই স্ত্রী। তার বহু আগেই ছেড়ে এসেছেন প্রথম স্ত্রী-পুত্রকে, তখন তাঁর জীবনই ছিল অন্য ধাঁচের। মোটেই ভাল না!

–“ইররেসপনসিবল নেচার ছিল আমার। কাকা বিয়া দিসিলেন, ঠিক করেন নাই। তখনও বিবাহের যোগ্য হই নাই।”

যেন এখনই খুব যোগ্য! প্রথমে রাগ হল। তারপর মনে হয়, কে জানে, হয়তো যোগ্য। মদ খাওয়া মানেই তো উচ্ছন্নে যাওয়া নয়। দেখাই যাচ্ছে স্ত্রীকে, মেয়েদের খুব ভালবাসেন।

বেশ যাচ্ছি, যাচ্ছি, উনি কথা বলছেন, আমি শুনছি। হঠাৎ উনি বলে বসলেন—

—”মিসেস সেন, আপনের মিস্টার কী করেন? তাওয়াং-এ পোস্টেড বুঝি?”

সত্যি। যেভাবে আমি তাওয়াং-এ ছুটেছি, মনে হতেই পারে, উৎকণ্ঠ আমার লাগি ওখানে কেহ প্রতীক্ষিয়া আছে। কী বলি এখন?

এখানে গুল মারার বেশ চান্স আছে। বললেই হয়, শুনছি মিস্টার সেন তাওয়াং মঠে লামা হয়ে আছেন, গত বিশ বছর নিরুদ্দেশ। অথবা, সেই চিনেযুদ্ধের সময়ে তাওয়াং-এ যে পোস্টেড ছিলেন, তারপর থেকেই নো নিউজ। অথবা, হ্যাঁ, উনিই তো আমাকে নিতে আসবেন।

কিন্তু কোথায়? এই ট্রাক কোথায়, কোন ঠিকানায় পৌঁছে দেবে আমাকে? তাও তো জানি না। ভাবতে ভাবতেই শুনতে পেলুম আমি বলছি—

“মিস্টার সেন বিলেতে থাকেন।”

—”বিলাইতে? কীসের বিজনেস? রেস্টুরেন্ট? বহুত বাঙালি ওই বিজনেসে আছেন।” কথা ঘুরিয়ে দিতে সুযোগ পেয়ে মহা উৎসাহে বলি—”হ্যাঁ হ্যাঁ সিলেটি আর চট্টগ্রামী বাঙালিতে ভর্তি। তাঁরা বেশিরভাগই বাংলাদেশি অবশ্য এখন। দারুণ চলে ইনডিয়ান রেস্তরাঁগুলো।”

—”আপনের মিস্টার আপনারে নিয়া যান নাই বিলাইত? আপনি গেছেন? লন্ডন?”

—”হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেকবার।”

—”বাঃ। বাঙালি মাইয়া আরও অনেক আছে, নায়? বিলাইতে?”

—”ঢের! প্রচুর। গাদা গাদা।”

—”আমাগো জীবনে কিসুই হইল না।”

—”তা কেন বলছেন।

—”পৃথিবীড়াই দেখা হইল না। কূয়ার বেঙ্ হইয়াই জীবন কাইট্যা গেল। কূপমণ্ডূক।”

—”তা কেন বলছেন। আপনি কত ধরনের মানুষ দেখেছেন, কত ধরনের জীবনযাত্রা দেখেছেন, কত জায়গায় ঘুরে, কতরকমের বিভিন্ন কাজ করেছেন। আপনার তো বেশ অন্যরকম অভিজ্ঞতা।”

—”কিন্তু জাহাজের কাম তো করি নাই। আমার শল্ডা আছিল সেইলর হওনের। লাইফে সেই চান্স তো পাইলাম না। ওই যে, ওই চিতাবাঘ।”

—”কী? কী? কী?”

—”চিতাবাঘ। ওই যে। ওই পলায়। চক্ষু দেখা যায়। ওই দ্যাখেন। চক্ষু।” সত্যিই, এক জোড়া সবুজ চোখ। কী একটা ছোট জীব, দৌড়ে পালাল, তারপর হঠাৎ ফিরে দাঁড়াল। চোখ জ্বলতে লাগল অন্ধকারে।

—”চিতাবাঘ ওটা?”

—”আবার কী? কইসিলাম না চিতা আছে? লেপার্ড! হরিণও আছে। আর ভালুক। বিশাল!”

আমিও এবার চেঁচাই :

—”ওই যে! ওই দেখুন! লেপার্ড! আপনারা কেউ লেপার্ড দেখছেন না কেন? আশ্চর্য তো!”

সঙ্গীদের অন্যমনস্কতায় যারপরনাই বিচলিত হয়ে আমি পার্শ্ববর্তী নির্বিকার ডাক্তারকে এক ঠেলা মারি। হঠাৎ ঠেলা খেয়ে বিরক্ত হয়ে বোবা ডাক্তার কথা বলে ফেলে :

“হোয়াট লেপার্ড? দ্যাটস আ জ্যাকল। লেপার্ডস ডোন্ট কাম নিয়ার মেন।“

—”তবে যে উনি বললেন।”

—”হি হ্যাজ হ্যাড টু মাচ টু ড্রিংক। এ পথে কোনও জীবজন্তু বড় একটা দেখা যায় না শেয়াল আর খরগোশ ছাড়া। মাঝে মাঝে অবশ্য হরিণ দেখা যায়। বাঁদর? দু-একটা। হাতি ও দেখা গেছে বটে। তবে ওরা এদিকে খুব একটা আসে না। ভাল্লুক? কক্ষনও না। বাইসন? কী জানি। রাইনো? নেভার। লুক, হি ইজ টকিং ননসেন্স।”

রাগে ডাক্তার অনেকগুলো কথা বলে ফেলেছে। এই সুযোগে ভাব জমানো যাক। মুখটা যখন খোলাই গেছে একবার।

—”ডাক্তার, আপনার দেশ কোথায়?”

—”বরোদা। আগে ছিল সিন্ধুতে। এখন সেটা পাকিস্তানে।”

—”কোথা থেকে পাস করেছেন?”

—”বম্বে।”

“কত দিন হল পাস করে বেরিয়েছেন?”

—”বছর তিনেক।”

—”মাত্র? কতদিনের চাকরি?”

—”দু বছর।”

—”মাত্র? দেশে কে কে আছেন?”

—”সবাই।”

—”সবাই মানে কে কে?”

—”বাবা মা, ঠাকুরদাদা ঠাকুমা, ভাই বোনেরা। “

—”আপনি হায়ার স্টাডিজে গেলেন না কেন? আগেই চাকরিতে—”

—”যাব তো। টাকা জমিয়ে নিই। বাপের টাকায় তো যেতে পারব না? স্কলারশিপ পাবার মতো অত ভাল ছাত্রও নই। তাই চাকরিতে ঢুকেছি। টাকা জমাচ্ছি। আর তিন বছর পরেই আমেরিকায় যাব। “

—”আমেরিকায় কেন?”

—”আমার ওখানেই যেতে ইচ্ছে। ইংলন্ড ইজ ওলড ফ্যাশনড।”

“ইনডিয়ান ডিগ্রি ওরা মানে কি ইউ এস এ তে?”

—”মানে তো। হায়ার স্টাডিজের জন্য কোনও অসুবিধা নেই। চাকরি করতে-করতেই পড়া যায় টিচিং হাসপাতালে।”

—”খবর সবই নেওয়া হয়েছে দেখছি! কেবল যাওয়াই বাকি।”

লাজুক হেসে ডাক্তার চুপ করে যায়। আমাকে একটাও প্রশ্ন করেনি। কেবল আমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। যেন ইন্টারভিউ দিচ্ছে। মিস্টার সেনও “স্বামী কী করেন” প্রসঙ্গটা টেনে চেপে ধরেননি। ডাক্তার তাঁকে ‘হি ইজ টকিং ননসেন্স’ বলায় এবং লেপার্ড-কে জ্যাকল বলায় তাঁর খুব রাগ হয়েছে। তিনি মৌনী হয়ে গেছেন।

ধূপ কখন নিবে ছাই। কিন্তু ধোঁয়া আছে। মাইলা মাঝে মাঝে সিগারেট ধরিয়ে মানচন্দ এর ঠোঁটে তুলে দিচ্ছে। নিজেও খাচ্ছে।

সিগারেটের ধোঁয়াতেও আমার শ্বাস কষ্ট হয়। কিন্তু এখন হচ্ছে না। দু দিকের জানলা খোলা। হু হু করে রাতের বাতাস বয়ে যাচ্ছে লরি এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে। ঠাণ্ডা হাওয়া, কিন্তু এমন কিছু হিমঠাণ্ডা নয়। বেশ তাজা রাখে শরীর। একটু একটু ঘুম পাচ্ছে। জানলায় কনুই রেখে, তাতে মাথা রেখে ঘুমুতে চেষ্টা করি। আমার আর ডাক্তারের মাঝখানে শীলা বরঠাকুরের কোট, আমার ব্যাগ। গায়ে শুধু শালটাই যথেষ্ট।

মাইলা গুনগুন করে একটা নেপালি গানের সুর ভাঁজছে। সেটার ঘুমপাড়ানি এফেক্ট হচ্ছে। এরা কেউ রাত্রে খাবে না? ডিনার-টিনার কিছু করবে না? খিদে-খিদে পাচ্ছে যে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *