জানি তুমি আসবে – ৮

লাঠিখেলার প্রতিযোগিতার কথা মাতব্বর সাহেব কয়েকজন লোক দিয়ে কাছের ও দূরের গ্রামগুলোতে ঢেড়া পিটিয়ে দিলেন।

সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান জেনে ভাবলেন, ভালই হল এ বছর তাকে টাকা খরচ করে প্রতিযোগীতার ব্যবস্থা করতে হল না। একদিন মোবারক লেঠেলকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এ বছর চরদৌলতখান গ্রামের মাতব্বর লাঠিখেলার প্রতিযোগীতা করার ব্যবস্থা করেছেন, সেকথা শুনেছ নিশ্চয়?

মোবারক বলল, জি সাহেব শুনেছি এবং সে ব্যাপারে তৈরি হয়ে আছি। চেয়ারম্যান বললেন, আমরা প্রতিযোগীতা দেখতে যাব যদি শফি প্রতিযোগীতায় নামে, তা হলে খেলারছলে কাজ হাসিল করে ফেলবে। আর যদি না নামে, তা হলে লোক দিয়ে শফিকে চিনিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করব।

মোবারক বলল, প্রতিযোগীতায় নামলে এমন ধোলাই দেব, পাটাই করে তাকে ঘরে নিয়ে যেতে হবে।

আজ প্রতিযোগীতার দিন। প্রতিযোগীতা শুরু হবে বেলা তিনটে থেকে। মাতব্বর সাহেবের বাগান বাড়ির সামনের জমিতে প্রতিযোগীতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শামিয়ানা খাঁটিয়ে লোকজনের বসার জায়গা করা হয়েছে। পর্দা খাঁটিয়ে মেয়েদেরও আলাদা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকাল থেকে বিভিন্ন গ্রামের লোকজন ও প্রতিযোগীরা আসতে শুরু করল। চেয়ারম্যান ও অন্যান্য গন্যমান্য লোকেরা আসার পর ঠিক তিনটেয় প্রতিযোগীতা শুরু হল। পাঁচজন লেঠেল কেউ পাঁচ মিনিটের বেশি মোবারকের কাছে টিকতে পারল না। সবাইকে হারিয়ে দিয়ে মোবারক বুক চিতিয়ে লাঠি ঠুকে বলল, আর কোনো বাপের পুত থাকলে আমার সামনে এসে দাঁড়াক।

তিন মিনিট অপেক্ষা করার পর যখন বিচারকরা তাকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দিতে যাবেন ঠিক তখন শফি লড়াই-এর ময়দানে ঢুকল।

ঘোষক শফির পরিচয় জানাল।

শফির আপনজনেরা ও পাড়া পড়শীরা হায় হায় করে উঠল। তারা বলাবলি করতে লাগল, একী সর্বনাশের কথা, লেঠেল সর্দার মোবারকের সঙ্গে এই ছেলে কী লড়বে? ও তো মার খেতে খেতে শেষ হয়ে যাবে। আর যারা শফিকে চেনে না, তারাও বলাবলি করতে লাগল, ছেলেটার সাহস তো কম না? যেখানে বড় বড় নাম করা লেঠেলরা মোবারকের কাছে গোহারা হেরে গেলো, সেখানে এই পুচকে ছোঁড়ার অবস্থা কী হবে আল্লাহ জানে।

রবিউল গত কয়েক বছর ধরে মোবারকের লাঠিখেলার প্রতিযোগীতা দেখে আসছে। তবুও শফিকে তার সঙ্গে লড়াই করার জন্য ময়দানে ঢুকতে দেখে একটুও ভয় পেল না বা ঘাবড়ালও না। কারণ তাকে যতটুকু জেনেছে তাতে সিওর শফি জিতবে। কিন্তু সে দুঃখ পেল এই ভেবে শফি তাকে এ ব্যাপারে কিছুই জানাইনি বলে।

মোবারক যখন পাঁচজন লেঠেলের সঙ্গে লড়ছিল তখন শফি পুংখানুপুংখভাবে তার খেলার কায়দা-কানুন দেখেছে। তাই তার সঙ্গে কীভাবে লড়বে ভেবে রেখেছে।

মোবারক শফিকে দেখে ও তার পরিচয় জেনে ভাবল, এই পিচ্ছি। ছোঁড়াটাকে ঘায়েল করতে মাত্র কয়েক মিনিট লাগবে। চেয়ারম্যান সাহেব একেই তুখোড় ছেলে বলেছেন। তিন চার মিনিটের মধ্যে ওর হাতপা ভেঙ্গে না দিয়েছি তো আমি আমার বাপের জন্মই না।

হাজার হাজার লোক এই অসম লড়াই দেখার জন্য উৎসুক হয়ে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে রইল।

রেফারী হুইসেল বাজাতে খেলা শুরু হল। প্রথম চান্সেই শফিকে ঘায়েল করার জন্য মোবারক তার উপর আক্রমনাত্মক খেলা চালাল।

শফি আক্রমণ ঠেকাতে লাগল; কিন্তু প্রতি আক্রমণ করল না। সে চাচ্ছে মোবারক হাঁপিয়ে যাক, তারপর আক্রমণ করবে। তাই প্রায় দশ পনের মিনিট খেলা চলার পর শফি আক্রমণ শুরু করল। তবে ততো জোরাল নয়। কারণ মোবারক বুঝুক সে তত শক্তিশালী নয় এবং আক্রমণ করার কলাকৌশলও জানে না। ফলে এর মধ্যে মোবারকের বেশ কয়েকটা আঘাত তাকে হজম করতে হয়েছে। আরও পাঁচ মিনিট পর যখন শফি বুঝতে পারল মোবারক হাঁপিয়ে পড়েছে তখন শক্তভাবে আক্রমণ না করে লাঠিটা শুধু বনবন করে ঘুরাতে ঘুরাতে মোবারকের দিকে এগোল।

দর্শকরা অবাক হয়ে দেখল, শফির লাঠি দেখা যাচ্ছে না। শুধু বনবন আওয়াজ হচ্ছে। আর মোবারকও তাই দেখে অবাক হয়ে নিজের লাঠি দিয়ে আক্রমণ বাধা দিতে গেল। শফির লাঠির আঘাতে তার লাঠিটা হাত ছাড়া হয়ে উড়ে গিয়ে দর্শকদের মাথার উপর পড়ল।

মোবারকের মনে হল শফি মানুষ না। কোনো মানুষের গায়ে এত শক্তি থাকতে পারে না। হাতছাড়া হয়ে লাঠিটা দূরের দর্শকদের উপর পড়তে দেখে এত অবাক হল যে, শফির দিকে চেয়ে পাথরের মতো জমে গেল।

এই সুযোগে শফি তার বামহাতের কুনুই-এর নিচে প্রচন্ড জোরে আঘাত করল।

মোবারকের মনে হল হাতটা বুঝি জয়েন্ট থেকে খুলে পড়ে গেল। শফি তার পায়ে আঘাত করতে যাচ্ছে দেখে দু’হাত তুলে সারেন্ডার করতে চাইল; কিন্তু বাম হাত তুলতে না পেরে শুধু ডান হাত তুলল।

শফি লাঠিটা সামলে নিয়ে বলল, আমি কিন্তু আপনার চার হাত পা–ই। ভেঙ্গে লুলা করে দিতে চেয়েছিলাম; স্যারেন্ডার করলেন বলে তা আর করব না। কারণ ন্যায় অন্যায় চিন্তা না করে লেঠেলগিরী করে যেমন অনেক টাকা রোজগার করেছেন, তেমনি সেই সাথে অনেক গুণাহও অর্জন করেছেন। এবার তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে সম্ভাবে জীবন যাপন করার সুযোগ দিলাম। আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি, তবু কেন কয়েকটা টাকার জন্য কারও কথায় আমার হাত পা ভেঙ্গে আমাকে লুলা। করে দিতে চেয়েছিলেন? মওত, কবর ও হাশরের কথা মনে করে এখন থেকে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দ.) এর হুকুম মেনে চলার চেষ্টা করুন। যদি টাকা পয়সার দরকার হয় আসবেন, যথাসাধ্য দেয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। দোয়া করি “আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দিয়ে সভাবে জীবনযাপন করার তওফিক দিক।”

শফি থেমে যেতে মোবারক চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোমাকে মানুষ বলে মনে হয় না। তোমার কথা শুনে আল্লাহ আমার জ্ঞানের চোখ খুলে দিয়েছে। ওয়াদা করছি, জীবনে আর কখনও লেঠেলগিরী করে টাকা রোজগার করব না।

মোবারকের সঙ্গে লাঠি খেলার প্রতিযোগীতায় শফির ক্ষীপ্রতা ও লড়াইয়ের কলাকৌশল সর্বোপরী তার লাঠি ঘোরানো দেখে গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ জনসাধারণ অবাক। তাদেরও মনে হয়েছে, শফি মানুষ নয় অন্য কিছু। শেষে মোবারকের পরিণতি এবং শফি ও মোবারকের কথা শুনে হাততালি দিয়ে শফিকে বাহবা দিতে লাগল। বিচারকরা শফিকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন।

শফি এগিয়ে এসে মাতব্বর সুরুজমিয়াকে কদমবুসি করে জড়িয়ে ধরে বলল, দাদু, আল্লাহর মেহেরবানীতে ও আপনার নেক দোয়ার বরকতে আমি সফল হয়েছি।

মাতব্বর নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে দোয়া করলেন, “আল্লাহ তোমাকে দোজাহানে সফলতা দান করুক।” তারপর দশহাজার টাকার বান্ডিলটা তার হাতে তুলে দিলেন।

শফি সেটা নিয়ে মোবারকের হাতে দিয়ে বলল, লেঠেলগিরী ছাড়াবার জন্য আপনার একটা হাত ভেঙ্গে দিয়েছি। আমার অন্যায় হয়েছে, আমাকে মাফ করে দিন। আর এই টাকা দিয়ে হাতের চিকিৎসা করাবেন।

প্রথম থেকে শফি চেয়ারম্যান ও মহসিনকে দেখলেও এতক্ষণ না দেখার ভান করে ছিল। এবার কাছে গিয়ে সালাম বিনিময় করে চেয়ারম্যান ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে বলল, আপনাদের দোয়ায় আল্লাহ আমাকে সফলতা দিয়েছেন। সেজন্যে তাঁর পাক দরবারে শুকরিয়া জানাচ্ছি। এবার আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ করছি, লেঠেল বা অন্য কোন কাজে গরিব লোকদেরকে নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য কোনো অন্যায় কাজে ব্যবহার করবেন না। বরং কারও সঙ্গে কারও বিরোধ ঘটলে, উভয়পক্ষ এক সঙ্গে বৈঠক করে মিমাংসা করে নেবেন। এটাই হল ইসলামের হুকুম।

শফির কথা শুনে সবাই হাত তালি দিতে লাগল।

মাতব্বর সাহেব সবাইকে চুপ করতে বলে চলে যেতে বললেন।

.

সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান ফেরার পথে ছেলেকে বললেন, আমি যে মোবারককে টাকা দিয়ে শফির হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে বলেছি, তা বোধ হয় শফি জানতে পেরেছে।

মহসিন বলল, তা কী করে সম্ভব?

চেয়ারম্যান বললেন, তা তো আমিও জানি; কিন্তু ওর কথা শুনে তাই তো মনে হচ্ছে। তোরও তো বোঝা উচিত ছিল। যাই বলিস, জীবনে অনেক লেঠেলের লাঠি খেলা দেখলাম; কিন্তু শফির মতো কাউকে দেখিনি।

মহসিনও শফির লাঠিখেলার কলাকৌশল দেখে মুগ্ধ হলেও তার প্রতি রেগে রয়েছে। তাই বলল, ওসব কথা বাদ দিয়ে চিন্তা কর শফিকে কীভাবে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া যায়।

চেয়ারম্যান বুঝতে পেরেছেন, শফির বিরুদ্ধে লাগা ঠিক হবে না। তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়াও সহজ হবে না। তাই বললেন, তুই অত মাথা গরম করছিস কেন? এখন আমাদেরকে ধৈর্য্য ধরে চিন্তা ভাবনা করে কাজ করতে হবে। জানিস না, ধৈর্যই সফলতার চাবি? এসব নিয়ে তুই কিছু ভাববি না, যা করার আমি করব। তুই কাল ঢাকায় চলে যাবি, মাথা ঠান্ডা রেখে গোছগাছ করে নিবি।

শফির অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে চাচা জাকির হোসেনও এসেছেন। সকলে চলে যাওয়ার পর জাকির হোসেন রয়েছে দেখে মাতব্বর তাকেও চলে যেতে বললেন, তারপর শফিকে নিয়ে বৈঠকখানায় বসলেন।

পর্দা করা জায়গায় শফির মা সাজেদা খাতুনও পাড়ার অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে লাঠিখেলা দেখতে এসেছিলেন। সবার মতো তিনিও জানতেন না, শফি মোবারক লেঠেলের সঙ্গে লড়বে। সবার শেষে যখন ঘোষক তার নাম ঘোষণা করলেন তখন শুনে ভয়ে চমকে উঠলেন। তারপর থেকে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দোয়া করতে থাকেন, “আল্লাহ যেন শফিকে সফলতা দেন।” শফি জিতে যাওয়ার পরও চোখের পানি বন্ধ হয়নি। সেই অবস্থায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন। স্বামী চলে যাওয়ার পর ঘোমটা দিয়ে বৈঠকখানার একপাশে দাঁড়িয়ে শফি বলে ডেকে বললেন, আমার কাছে আয়।

শফি দ্রুত মায়ের কাছে এসে কদসবুসি করে বলল, তোমার দোয়ার বরকতে আল্লাহ আমাকে জয়ী করেছেন।

ছেলের কীর্তিকলাপ দেখে সাজেদা খুব অবাক হলেও বুক গর্বে ফুলে উঠেছে। কদমবুসি করতে তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, তুইও তো অনেক লাঠির বাড়ি খেয়েছিস। ঘরে চল, সেসব জায়গায় মলম লাগিয়ে দেব।

ওনার কথা মাতব্বর শুনতে পেয়েছেন। তাই শফি কিছু বলার আগে বললেন, শফির মা তুমি ঘরে যাও। ওর জন্য কোনো চিন্তা করো না। আমি একজনকে ডাক্তার নিয়ে আসতে পাঠিয়েছি। তা ছাড়া ওর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। তারপর তখনও যারা সেখানে ছিল তাদেরকে চলে যেতে বলে শফিকে বলল, তুমি আমার কাছে এসে বস।

কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার এসে শফির আঘাত পাওয়ার জায়গাগুলো পরীক্ষা করে বললেন, তেমন গুরুতর কিছু নয়। তারপর প্রেসক্রীপসান করে দিয়ে বললেন, মলমটা ফুলে উঠা জায়গাগুলোতে লাগাবেন আর ওষুধগুলো ঠিকমতো খাবেন। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর মাতব্বর শফিকে বললেন, ঘরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসরের নামায পড়ে এস, একটা ব্যাপারে আলাপ করব। আমি ওষুধ কিনতে লোক পাঠিয়েছি। তখন ওগুলো নিয়ে যাবে।

ঘরে আসার পথে হঠাৎ রবিউলের কথা শফির মনে পড়ল। প্রতিযোগীতায় নামার আগে শফি তার চোখের আড়ালে ছিল। প্রতিযোগীতা শেষ হবার পর যখন সবাই তাকে হাততালি দিয়ে বাহবা দিচ্ছিল তখন রবিউলকে দেখতে না পেয়ে ভাবল, ওকে এ ব্যাপারে কিছু জানাইনি বলে নিশ্চয় আমার উপর খুব রেগে আছে। কথাটা ভেবে ঘরে না গিয়ে ওর কাছে যেতে লাগল। রবিউলের ঘরের কাছে এসে তাদের কাজের ছেলেটাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, রবিউল ঘরে আছে?

কাজের ছেলেটা শফিকে চেনে। বলল, জ্বি আছে। লাঠিখেলা দেখে কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে। আপনি সদরে বসুন ডেকে দিচ্ছি।

শফি বলল, বসার সময় নেই, তুমি ওকে তাড়াতাড়ি ডেকে দাও।

একটু পরে রবিউল এলে শফি সালাম দিয়ে বলল, ইচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে এলাম।

রবিউল সালামের উত্তর দিয়ে চুপ করে রইল।

কী রে, ক্ষমা চাইলাম, তবু ক্ষমা করবি না? জানিস না বুঝি ক্ষমাকারীকে আল্লাহ খুব পছন্দ করেন?

তা জানব না কেন? কিন্তু তুই তো নিজেই বললি ইচ্ছাকৃত ভুল করেছিস। কেউ না জেনে ভুল করলে তাকে ক্ষমা করা যায়; কিন্তু…….

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে শফি বলল, মোবারক লেঠেলের সঙ্গে লড়াই করব একথা তোকে কেন বলিনি জানিস? বললে তুই লড়তে দিতিস না।

তোর ধারণা ভুল। আমি এতটুকু বাধা দিতাম না। কারণ আমি হ্যাঁন্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর, যে কাজে তুই নামবি, তাতেই তুই সাকসেসফুল হবি। তবু তর্কের খাতিরে না হয় তোর কথা মেনেই নিলাম; কিন্তু মাতব্বরের সঙ্গে প্রতিযোগীতার প্ল্যান প্রোগ্রাম করেছিস, সেকথা জানালি না কেন? সেটাতেও বাধা দিতাম?

দিতিস না বলে শফি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, এ ভুল আমি অজান্তে করেছি। দু’টো ভুল একসঙ্গে ক্ষমা করে দে। যদি না করিস, তা হলে তোর মনে যতটা কষ্ট হয়েছে তার চেয়ে বেশি আমার মনে কষ্ট হবে।

রবিউল নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল, আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুক। তারপর বলল, ঘরে চল, নাস্তা খেয়ে যাবি।

শফি বলল, গোসল না করে এ অবস্থায় খেতে পারব না। তা ছাড়া প্রতিযোগীতার পর মায়ের সঙ্গে দেখা হলেও দাদির সঙ্গে হয়নি। জানিসতো উনি খুব পর্দা মেনে চলেন। উনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। এখন যাই, কাল সকালে আসব। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেল।

জমিলা খাতুন খুব পর্দানশীন মহিলা। তাই তিনি প্রতিযোগীতা দেখতে যাননি। কিছুক্ষণ আগে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মুখে শফি লেঠেলসর্দার মোবারকের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় নেমে তার একটা হাত ভেঙ্গে দিয়েছে শুনে খুব খুশি হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন। এখন শফিকে ঘরে ঢুকতে দেখে তবু জিজ্ঞেস করলেন, তুই নাকি মোবারক লেঠেলের সঙ্গে লড়াই-এ নেমে তার একটা হাত ভেঙ্গে দিয়েছিস?

শফি বলল, হ্যাঁ দাদি। ওনার হাত ভাঙ্গার ইচ্ছা ছিল না, তবু ভেঙ্গেছি ভবিষ্যতে উনি যেন আর কখনও লেঠেলী করতে না পারেন। তারপর বলল, এ ব্যাপারে পরে আলাপ করব। এখন আপনি নাস্তা রেডি করুন। আমি গোসল করে আসি বলে লুংগী গামছা নিয়ে পুকুরের দিকে চলে গেল। শফি ফিরে আসার পর তার কাজ-কর্ম ও আচার-ব্যবহারে গ্রামের ছোট বড় সবাই শ্ৰেণীমতো তাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে। আজ লাঠিখেলা প্রতিযোগীতার, ঘটনায় তার প্রতি সবাইয়ের ভক্তি শ্রদ্ধা আরও অনেক বেড়ে গেছে। শফি মসজিদে নামায পড়তে যাবার পথে সবার মুখে তার গুণাগুণ শুনে মনে মনে আল্লাহকে জানাল, কখন কোনো ব্যাপারেই যেন তার মনে অহংকার না আসে। অহংকার থেকে তাকে হেফাজত করো।

.

মাতব্বর সাহেব বৈঠকখানায় বসেছিলেন। শফিকে দেখে বললেন, এস ভাই বস, তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

শফি সালাম বিনিময় করে বসে বলল, কী যেন আলাপ করার জন্য ডেকেছিলেন?

মাতব্বর বললেন, তোমার চাচা জাকির হোসেনকে তুমি কী করবে না করবে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, তুমি না কী ঢাকায় চাকরি করবে। কথাটা কি সত্য?

শফি বলল সত্য মিথ্যা দু’টোই।

ব্যাপারটা বুঝলাম না।

বললেই বুঝবেন। শুনুন, কথাটা বলেছি সত্য; কিন্তু ওনার মন বোঝার জন্য মিথ্যে করে বলেছি।

মাতব্বর হেসে উঠে বললেন, তুমি খুব জিনিয়াস জেনেছি; কিন্তু এতটা জিনিয়াস বুঝতে পারিনি। তারপরই বললেন, কেন ডেকেছি শোন-তোমার নানাবাড়ি তো নলছটি, আমার নানার বাড়িও নলছটি। তুমি বোধ হয় জান না ওখানে একটা কামিল মাদ্রাসা আছে। যাই হোক, আমার নানার কোনো ছেলে সন্তান ছিল না, শুধু দু’টো মেয়ে ছিল। বড় মেয়ে মারা যায়। আমার মা ছোট। নানার অনেক বিষয় সম্পত্তি ছিল। তিনি মারা যাওয়ার পর মা সব সম্পত্তির মালিক হয়। মায়ের কথা মতো বাবা কারিগরী শিক্ষাসহ একটা কামিল মাদ্রাসা করে সব সম্পত্তি ওয়াকফ করে দেন। তখন বাবা ছিলেন মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির প্রেসিডেন্ট। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কমিটি আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছে। আগে ওয়াকফ করা সম্পত্তির আয়ে মাদ্রাসার যাবতীয় খরচ চলত। এখন সরকারের অণুদান। পায়। মাদ্রাসায় যিনি প্রিন্সিপাল ছিলেন তিনি কিছুদিন আগে মারা গেছেন। বর্তমানে ভাইস প্রিন্সিপাল প্রিন্সিপালের কাজ করছেন। আমি চাই তোমাকে প্রিন্সিপাল করতে।

শফি বলল, শুধু আপনি চাইলে তো হবে না কমিটির অন্যান্য সদস্যদেরও তো চাইতে হবে।

মাতব্বর বললেন, তা তো বটেই। তবে আমার বিশ্বাস আমি যাকে পছন্দ করব, তাকে কমিটি না রেখে পারবে না। কয়েকদিন আগে-ঐ পদের জন্য দু’তিনটি কাগজে বিজ্ঞপ্তী দেয়া হয়েছে। আমি চাই তুমিও একটা দরখাস্ত নিজে গিয়ে ভাইস প্রিন্সিপালের কাছে দিয়ে এস। আমি একটা চিঠি লিখে দেব, সেটাও ওনাকে দিবে।

শফি বলল, ঠিক আছে দাদু, চিন্তা করে আপনাকে জানাব।

মাতব্বর বললেন, চিন্তা করতে চাও কর, তবে আমি বলব, কোথাও অন্য কিছু করার চেয়ে এখানে থেকে এটা করা অনেক ভালো। কারণ গ্রামের গরিব ও অশিক্ষিত লোকজন তোমার কাছ থেকে অনেক উপকার পাবে। তুমি যে শুধু সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত তাই নও, ধার্মিক ও আদর্শবান ছেলে। গ্রামের লোকজন ধর্ম সম্পর্কে একরকম কিছুই জানে না। যারা জানে তারা সার্থের জন্য ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করছে। আর একশ্রেণীর লোক মডার্ন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রগতির নাম দিয়ে ধর্মকে এড়িয়ে চলছে। তা ছাড়া ধর্মের নামে অনেক কুসংস্কার ও রীতিনীতি প্রচলিত রয়েছে। তুমি সেসব সমাজ থেকে দূর করতে পারবে। এতকিছু জানার পরও আর কিছু চিন্তা করার আছে?

শফি বলল, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমি দু’একদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে আপনার কাছে আসব। এবার আসি বলে সালাম বিনিময় করে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *