জানি তুমি আসবে – ১১

১১

শিকরমন্ডল গ্রামের নূর-উদ্দিন খন্দকার খুব নামিদামি লোক ছিলেন। ওনার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে বড়। নাম সালাউদ্দিন। আর মেয়ে ছোট নাম শামিমা বেগম। দুই ভাই-বোনের বয়স যখন পনের ও বিশ বছর তখন নূর-উদ্দিন মারা যান। বিশ বছরের সালাউদ্দিনের উপর সংসারের দায়িত্ব পড়ল। ঢাকা ভার্সিটি থেকে উচ্চ ডিগ্রি নেয়ার ইচ্ছা থাকলেও বাবা মারা যাওয়ায় আইএ পাস করে আর পড়াশোনা করেননি। বাবা অনেক জমি-জায়গা রেখে মারা গেছেন। সেইসব দেখাশোনা করতে লাগলেন। আর একমাত্র বোন শামীমাকে গ্রামের কলেজ থেকে আইএ পাস করিয়ে ঢাকায় হোস্টেলে রেখে ভার্সিটিতে লেখাপড়া করান। মাস্টার্স করার সময় শামীমা বেগম তানভীর নামে ঢাকার মধ্যবিত্ত ঘরের একটা ছেলেকে ভালোবেসে গোপনে বিয়ে করেন। ফাঁইন্যাল পরীক্ষার পর ফোন করে প্রথমে ভাবিকে কথাটা জানান। ভাবি আখতার বানু স্বামী ও শাশুড়িকে কথাটা জানান।

কথাটা শুনে সালাউদ্দিনের মা ফজিলা বেগম খুব রেগে গিয়ে ছেলেকে বললেন, আমি কত করে বললাম, শামীমাকে আর বেশি পড়াবার দরকার নেই। এবার ওর বিয়ে দে। তা না করে বোনকে ঢাকার হোস্টেলে রেখে পড়াতে লাগলি। বোন মান ইজ্জত খুইয়ে কাকে বলতে কাকে বিয়ে করে ফেলল। তখন যদি আমার কথা শুনতিস, তা হলে এমন অঘটন ঘটত না।

শামীমাকে সালাউদ্দিন ভীষণ ভালোবাসতেন। তাই সে আইএ পাস করার পর যখন বলল, ঢাকা ভার্সিটিতে পড়বে তখন না করতে পারেননি। সেই বোন গোপনে বিয়ে করেছে শুনে যেমন খুব রেগে গেলেন, তেমনি বোনের উপর মনে কষ্টও পেলেন। রাগারাগি করাতে বললেন, তোমার কথা না শুনে ভুল করেছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও মা।

ফজিলা বেগম বললেন, ছেলেমেয়েরা অন্যায় করলে মায়েরা মাফ করবেই। এখন গিয়ে বোনের খোঁজ খবর নিয়ে দেখ, কোনো অজাত বেজাত ঘরের ছেলেকে বিয়ে করেছে কি না?

সালাউদ্দিন ঢাকায় এসে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলেন, ছেলেটা অজাত বেজাত ঘরের নয়। তবে ছেলের মা বাবা নেই। এক মামা তাকে মানুষ করেছেন এবং তিনি তাকে লেখাপড়া করিয়েছেন।

সালাউদ্দিন বোনের সাথে রাগারাগি করলেন না। তাদের বিয়ে মেনে নিলেন। তারপর অনেক টাকা পয়সা দিয়ে ছোটবোনের স্বামী তানভীরকে ব্যবসা করে দেন।

তানভীর মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে হলেও খুব ভদ্র, বুদ্ধিমান ও সৎ চরিত্রের অধিকারী। তাই কয়েক বছরের মধ্যে ব্যবসায় উন্নতি করে বাড়ি গাড়ি করেছেন। ওনাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে বড়, নাম তওফিক। সে লেখাপড়া শেষ করে বাবার সঙ্গে ব্যবসা করছে। তওফিকের পাঁচ বছরের ছোট ডালিয়া। সে ভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স পড়ছে। এটা তার সেকেণ্ড ইয়ার। সবার ছোট আতিক। তানভীর সাহেব স্ত্রীর অমতে আতিককে প্রথমে হাফেজিয়া মাদরাসা থেকে হাফেজ করান। তারপর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় পড়াচ্ছেন। সেখানে সে মাদরাসার হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করছে।

তানভীর সাহেব মোটামুটি ধর্মের নিয়ম-কানুন মেনে চললেও ওনার স্ত্রী শামীমা বেগম মোটেই মেনে চলেন না। তিনি পর্দা প্রথাকে ঘৃণা করেন। তাই একমাত্র মেয়ে ডালিয়াকে নিজের মতো করে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। তানভীর সাহেব শ্বশুরবাড়ির টাকায় ব্যবসা করে ধনী হয়েছেন। তাই ধর্মের নিয়ম-কানুন মেনে চলার কথা স্ত্রীকে বললেও তেমন জোরালোভাবে বলতে পারেন না। তা ছাড়া তিনি শান্তিপ্রিয় লোক। তাই কোনো ব্যাপারেই স্ত্রীর সঙ্গে রাগারাগি করেন না। তবে মেয়ে ডালিয়াকে স্ত্রীর অগোচরে কুরআন হাদিসের কথা বলেন।

আতিক ছেলেবেলা থেকে নিয়মিত নামায রোযা করত। তাই তানভীর সাহেব তাকে মাদরাসায় পড়াচ্ছেন। এ ব্যাপারে শামীমা বেগম স্বামীর সঙ্গে বেশ রাগারাগি করেছেন। বলেছেন, নিজে মোল্লাহ, তাই আতিককেও মোল্লা করতে চাও।

বড় ছেলে তওফিক বাবার মতো হয়েছে। সে যাতে ধর্মের দিকে বেশি ঝুঁকে না পড়ে সেজন্য শামীমা বেগম নিজে পছন্দ করে বড়লোকের ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে নাজিয়াকে বড় বৌ করে এনেছেন।

নাজিয়া খুব চালাক-চতুর মেয়ে। স্বামীর বাড়ি এসে সেযে যেমন তার সঙ্গে তেমন ব্যবহার করে। ধর্মের বিধি-নিষেধ নিয়ে মাথা ঘামায় না। বলে ধর্ম নিজস্ব ব্যাপার। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা কারও উচিত নয়।

তওফিকও বাবার মতো শান্তিপ্রিয়। তাই ধর্মের ব্যাপারে স্ত্রীকে তেমন কিছু না বললেও তার এই কথার প্রতিবাদ করে বলে, তুমি ঠিক বলনি। প্রত্যেক মুসলমানকে ইসলামের বিধি বিধান মেনে চলতেই হবে। নচেৎ সে মুসলমান থাকবে কিনা সন্দেহ। তাদের ফাবিহা নামে দু’ বছরের একটা মেয়ে আছে।

ডালিয়া ছোটবেলা থেকে খুব জেদী ও খামখেয়ালি। একটা খেলনা এনে দিলে বড়জোর এক সপ্তাহ সেটা নিয়ে খেলবে। তারপর সেটা ভেঙ্গে ফেলে বলবে, এটা পুরোনো হয়ে গেছে বলে ভেঙ্গে ফেলেছি। অন্য আর একটা এনে দাও। ড্রেসের ব্যাপারেও তাই। এমন কি খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও সপ্তাহ অন্তর অন্তর খাবারের মেনু পাল্টাতে হত। অবশ্য কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ওরকম না করলেও মাঝে মাঝে বন্ধু-বান্ধবী চেঞ্জ করে।

তাই এবারে মামা বাড়িতে বেশ কিছুদিন থেকে ফিরে এসে মেয়েকে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখে শামীমা বেগম অসন্তুষ্ট হলেও ভাবলেন, এটাও তার খামখেয়ালি। কয়েকদিন পর ঐসব ছেড়ে দেবে। একদিন তিনি স্বামীকে কথাটা জানালেন।

শুনে তানভীর সাহেব খুশি হলেও স্ত্রীর মন রাখার জন্য মৃদু হেসে বললেন, ওর স্বভাব তো জান, কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখ এরকম কতদিন থাকে। তবে একটা কথা না বলে পারছি না, ডালিয়ার যদি এটা খামখেয়ালি না হয়ে আল্লাহ তাকে হেদায়েত দিয়ে থাকেন, তা হলে আল্লাহর দরবারে আমাদের শুকরিয়া জানান উচিত। কারণ ও দিন দিন যেভাবে উচ্ছল জীবন যাপন করছিল, সেকথা ভেবে আমি খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।

শামীমা বেগম রেগে উঠে ঝংকার দিয়ে বললেন, তুমি তো এরকম কথা বলবেই। নিজে মোল্লা, তাই ছেলেমেয়েকেও মোল্লাহ বানাতে চাও। সেজন্যেই আতিককে আমার কাছ থেকে সরিয়ে মাদরাসায় পড়াচ্ছ।

স্ত্রী রেগে গেলে তানভীর সাহেব সব সময় চুপ করে থাকেন। এখনও চুপ করে রইলেন।

শামীমা বেগম ডালিয়াকে ছোটবেলা থেকে নিজের মতো করে মানুষ করেছেন। তাই সে যত বড় হয়েছে তত আপটুডেট হয়েছে। টাইটফিট প্যান্ট শার্ট পরে ভার্সিটি যায়। তাদের গাড়ি থাকলেও ব্যবহার করে না। শামীমা বেগম স্বামীকে দিয়ে মেয়ের জন্য হুন্ডা কিনিয়েছেন। ডালিয়া হুন্ডা নিয়ে সবখানে যাতায়াত করে। ভাবি নাজিয়ার সঙ্গে তার খুব ভাব। হুন্ডায় চড়িয়ে তাকে নিয়ে বেড়াতে যায়, মার্কেটিং করতে মার্কেটে যায়।

এবারে মামাবাড়ি থেকে ফিরে এসে ডালিয়া ভাবির সঙ্গে আগের মতো মেলামেশা করে না। একা মার্কেটে গিয়ে কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা ও অন্যান্য অনেক ইসলামিক বই কিনে এনেছে। অবসর সময়ে সেগুলো পড়ে প্রথমে নামায পড়তে শুরু করল। তারপর প্যান্টশার্ট পরা ছেড়ে দিয়ে সালোয়ার কামিজ ও ওড়না ব্যবহার করতে লাগল। বোরখা পরে ভার্সিটি যেতে লাগল। হুন্ডা চালানও ছেড়ে দিল।

তাই দেখে একদিন নাজিয়া তার রুমে এসে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, তুমি যে দিন দিন পীর সাহেব বা মৌলভী সাহেবদের বাড়ির মেয়ের মতো অসূর্যস্পর্শা হয়ে যাচ্ছ? তা ছাড়া মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের ঠিক ঠাক হয়ে থাকা সত্ত্বেও তাকে কী এমন বলেছ যে, সে এখান থেকে চলে গেল? এসবের পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে? তা না হলে আমার সঙ্গেও মেলামেশা করছ না কেন?

ডালিয়া তাকে বসতে বলে বলল, দুনিয়াতে কারণ ছাড়া যখন কোনো কিছু ঘটে না তখন কিছু একটা তো আছেই।

নাজিয়া বলল, আমি সেই কিছু একটা শুনতে চাই।

তুমি ভাবি হলেও আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তোমাকে বলব না তো কাকে বলব? তবে তার আগে একটা কথা বলতে চাই।

বেশ তো বল।

ইসলামের নির্দেশ হল, কারও সঙ্গে দেখা করতে গেলে প্রথমে দরজার বাইরে থেকে সালাম দিতে হবে। সালামের উত্তর না পাওয়া গেলে আরও দু’বার সালাম দিতে হবে। তারপরও যদি সালামের উত্তর না পাওয়া যায়, তা হলে ফিরে আসতে হবে। কারণ অনুমতি ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করা ইসলামে নিষেধ। একটা হাদিস বলছি, “একদা এক ব্যক্তি আসিয়া রসূল (দঃ)-কে প্রশ্ন করল, আমার মাতার নিকট গমন করিতে হলেও কি অনুমতি চাহিব? তিনি বলিলেন, হ্যাঁ। লোকটি বলিল, আমি তাহার সঙ্গে একই গৃহে বসবাস করি। রসূল (দঃ) বলিলেন, তবুও তাহার নিকট যাইতে অনুমতি চাও। লোকটি বলিল, আমি তাহার সেবা করি। রসূল (দঃ) বলিলেন, তবুও তাহার নিকট যাইতে অনুমতি চাও। তাহাকে কি তুমি উলঙ্গ দেখিতে আশা কর? লোকটি বলিল, না। তবে অনুমতি চাও।“[বর্ণনায় : আতায়া বিন ইয়াসার (রা.)-মালেক] তাই বলছিলাম, দরজার বাইরে থেকে সালাম দিয়ে ভিতরে আসার অনুমতি নেয়া উচিত।

নাজিয়া বলল, আমি তো তোমার মতো কুরআন হাদিস পড়িনি, জানব কী করে?

তুমি বোধ হয় জান না ভাবি। হাদিসে আছে, আমাদের নবী করিম (দঃ) বলেছেন, “প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা ফরয।” তারপর বলল, আমিও এসব জানতাম না। জানার জন্য এই সমস্ত কিতাব কিনে এনে পড়ছি বলে বুকসেলফ দেখাল। তুমিও পড়বে, তা হলে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) এর বিধি-বিধান মেনে চলার প্রেরণা পাবে।

নাজিয়া বলল, ঠিক আছে পড়ব। এবার তোমার পরিবর্তনের কারণটা বল।

কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে ডালিয়া বলল, বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, একটা ছেলেকে দেখে ও তার কার্যকলাপ দেখে আমার জ্ঞানের চোখ খুলে গেছে। আর যার জ্ঞানের চোখ একবার খুলে যাবে, সে ধার্মিক হতে বাধ্য।

নাজিয়া বলল, নিশ্চয় ছেলেটা মৌলভী অথবা পীর সাহেবের ছেলে?

ডালিয়া বলল, আচ্ছা ভাবি, আজকাল শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা মৌলভী ও পীর সাহেবদের কথা শুনলে নাক সিটকায়, তাদেরকে বিদ্রূপ করে। কেন করে বলতে পার?

নাজিয়া বলল, তুমিও তো এতদিন তাদের দলে ছিলে, উত্তরটা তো তোমারও জানা থাকা উচিত।

ডালিয়া বলল, হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথা বলেছ। এই কয়েকদিন ধর্মীয় বই পুস্তক পড়ে বুঝতে পারলাম, যারা ইসলামকে জানার মতো জানে না, কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ে না এবং ইসলামিক বই পুস্তকও পড়ে না, তারাই বিদ্রূপ করে ইসলাম পন্থীদের।

নাজিয়া বলল, আসল ঘটনা কিন্তু এড়িয়ে যাচ্ছ।

ঠিক এড়াইনি, কথা প্রসঙ্গে অন্যদিকে চলে গেছি। যাই হোক, এবার মামাবাড়িতে গিয়ে এমন একটা ছেলেকে দেখেছি, যার তুলনা সে নিজেই। কারও সঙ্গে তার তুলনা করা চলে না। আমার পরিবর্তনের কারণ সেই ছেলেটা।

কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু চোখের দেখা দেখে কি কেউ জীবনের গতি পরিবর্তন করতে পারে? নিশ্চয় কোনো ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে ছেলেটাকে দেখেছ। ঘটনাটা বললে বুঝতে পারতাম।

ঘটনা তেমন কিছু নয়, তারপর প্রথম দিন রাস্তার ঘটনা ও তার কিছুদিন পর মহসিন ভাই বন্ধুদের নিয়ে যে ঘটনা ঘটিয়েছে এবং ছেলেটার মোবাইল সেট হারিয়ে যাওয়া ও ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে যতটুকু আলাপ হয়েছে, সেসব বলে ডালিয়া চুপ করে রইল।

নাজিয়া অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, কিন্তু এসব ঘটনায় তোমার আমূল পরিবর্তনের কারণ তো খুঁজে পাচ্ছি না?

ডালিয়া বলল, মামাতো কোন রাহেলাও এই ঘটনায় তোমার মতো আমার পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পায়নি। তবে গতকাল এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে পেয়েছে। শুধু তাই নয়, যে নাকি ছেলেটার হাত-পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে চেয়েছিল, সে এখন তাকে পাওয়ার জন্য পাগল।

নাজিয়া অবাক হয়ে বলল, কী বলছ মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।

রাহেলা তার বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে ভাইয়ার অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কি ঘটনা ঘটাল ও রাহেলার দুর্ঘটনার কথা এবং কীভাবে শফি তার জান ও ইজ্জত বাঁচাল, সবকিছু জানিয়ে ডালিয়া বলল, গতকাল রাত বারটার পর রাহেলা ফোন করে তার দুর্ঘটনার কথা জানিয়েছে।

নাজিয়া বলল, তা হলে ঐ ছেলেটাই তোমারও মুন্ডু ঘুরিয়েছে? যার ফলে মহসিন ভাইকে আর পছন্দ করছ না।

ডালিয়া বলল, কোনো ধার্মিক ছেলেমেয়ে অধার্মিক ছেলেমেয়েকে পছন্দ করতে পারে না। মহসিন ভাইকে তো বলেছি, তুমি ধর্মকে ঠিকমতো জান ও মান তা হলে বুঝতে পারবে কেন আমি তোমাকে এড়িয়ে চলছি এবং আগের জীবনের পথ ত্যাগ করে ইসলামী পথে চলার চেষ্টা করছি।

নাজিয়া বলল, ছেলেটা সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রাহেলার জান ও ইজ্জত বাঁচিয়েছে বলে হয়তো তাকে পাওয়ার জন্য সে পাগল হয়ে উঠেছে; কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ছেলেটার সঙ্গে তেমন দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ হয়নি, তবু তার কারণে তোমার এত পরিবর্তন হল কেন বুঝতে পারছি না।

ডালিয়া বলল, ছেলেটা যে শুধু দেখতে খুব হ্যাঁন্ডসাম তাই নয়, তার কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার ও চরিত্রের দৃঢ়তা যারা জানবে, শ্ৰেণীমতো সবাই তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে বাধ্য হবে। আর ম্যাচিওর মেয়েরা তাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠবে।

নাজিয়া বলল, এতক্ষণে বুঝতে পারলাম তুমিও তাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছ। আর সেই জন্যেই ধার্মিক হওয়ার চেষ্টা করছ এবং মহসিন ভাইকে তারই কারণে এখন আর পছন্দ করছ না, কি ঠিক বলি নি?

ডালিয়া বলল, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ; তবে বুঝতে অনেক লেট করেছ।

নাজিয়া বলল, কিন্তু ছেলেটাও যে তোমাকে চায় তাকি জেনেছ?

হ্যাঁ, জেনেছি।

তোমাদের তেমন মেলামেশা বা কথাবার্তা হয়নি বললে, তা হলে জানলে কীভাবে?

ফোনে আলাপ করে।

তোমরা কি প্রায় ফোনে আলাপ করো?

না, কয়েকদিন আগে মাত্র একবার আলাপ হয়েছে।

ছেলেটা করেছিল, না তুমি করেছিলে?

আমি করেছিলাম।

তুমি কি তাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছ?

হ্যাঁ।

ছেলেটাও কি তোমাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে?

হ্যাঁ।

কী করে বুঝলে? মাত্র একবার ফোনে আলাপ করে তা বোঝা অসম্ভব।

তোমার কথা হয়তো ঠিক; কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

কেন প্রযোজ্য নয়?

ওটা মনের ব্যাপার মুখে বলা যাবে না।

তুমি কি ডিটারমাইন্ড ঐ ছেলেকেই জীবনসঙ্গী করবে?

হ্যাঁ।

নাজিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসেন। ওনার কথা না হয় বাদ দিলাম; কিন্তু মাকে ম্যানেজ করবে কী করে? তিনি মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে যে তোমার বিয়ের কথা পাকা করে রেখেছেন, তা তুমিও জানো?

ডালিয়া বলল, হ্যাঁ জানি; কিন্তু আমি এখন বড় হয়েছি, ভার্সিটিতে পড়ছি, আমার ব্যক্তিগত মতামত আছে। জোর করে মা তো এই কাজ করাতে পারবে না। তবে মা যে এ ব্যাপারে আমার উপর খুব চাপ সৃষ্টি করবে তা জানি। একটা কথা বলে রাখি ভাবি, আল্লাহপাক ছাড়া দুনিয়ার কোনো শক্তিই আমার সিদ্ধান্তকে বদলাতে পারবে না।

কি জানি ভাই, তোমাকে নিয়ে আমার বেশ চিন্তা হচ্ছে।

তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না, তকৃদিরে যা লেখা আছে তা হবেই।

তুমি বললে তোমার ভাইয়ার সঙ্গে আলাপ করতে পারি।

না ভাবি, এখন ভাইয়াকে কিছু বলার দরকার নেই। সময় হলে আমিই বলব ভাইয়ার সঙ্গে আলাপ করতে।

ঠিক আছে, এখন যাই বলে নাজিয়া তার কাছ থেকে চলে গেল।

প্রায় দশ বার দিন পর আজ সকালে শফির সঙ্গে ফোনে আলাপ করে যখন জানতে পারল, তাকে দেখার জন্য আজই সে আসছে তখন তার মনে আনন্দের তুফান বইতে শুরু করেছে। তার কি করা উচিত ভেবে ঠিক করতে না পেরে ভাবিকে কথাটা জানাল।

নাজিয়া বলল, মা জানতে পারলে হুলুস্থুল কান্ড করে বসবেন। তুমি বরং বাবাকে সবকিছু জানাও। উনি নিশ্চয় কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন।

ডালিয়া বলল, ঠিক বলেছ ভাবি। তারপর রুমে এসে বুয়াকে ডেকে বলল, বাবাকে বলবি আমি ডেকেছি। খবরদার, মা যেন জানতে না পারে।

তানভীর সাহেব ড্রইংরুমে বসে পেপার পড়ছিলেন। বুয়ার মুখে মেয়ে ডাকছে শুনে তার রুমে এসে বললেন, কীরে মা, কেন ডেকেছিস?

ডালিয়া জিজ্ঞেস করল, মা কি ঘুম থেকে উঠেছে?

তানভীর সাহেব ঘড়ি দেখে বললেন, কেন? তুই তো জানিস, সে আটটার আগে উঠে না। এখন সাতটা বাজে। তার কথা বাদ দিয়ে কেন ডেকেছিস বল।

তুমি বস বলছি।

তানভীর সাহেব বসে বললেন, কী বলবি তাড়াতাড়ি বল, অফিস যাওয়ার টাইম হয়ে আসছে।

ডালিয়া কিছুক্ষণ নিচের দিকে মুখ করে চিন্তা করতে লাগল কীভাবে কথাটা শুরু করবে।

তানভীর সাহেব অধের্য্য গলায় বললেন, চুপ করে আছিস কেন? কীজন্যে ডেকেছিস বলবি তো?

ডালিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, এবারে মামাবাড়ি গিয়ে সেখানকার একটা ছেলেকে ভালবেসে ফেলেছি। সে ধার্মিক। তার আদর্শ চরিত্র দেখে আমি মুগ্ধ। তাকে উপলক্ষ করে আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দিয়েছেন। কথা শেষ করে বাবার দিকে চেয়ে দেখল, বড় বড় চোখ করে তার দিকে রাগের সঙ্গে তাকিয়ে রয়েছে। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে না পেরে মুখ নিচু করে নিল।

তানভীর সাহেব কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। গম্ভীর স্বরে বললেন, এ তুই কী বলছিস? আমি কি আমার মেয়ের কথা শুনছি?

ডালিয়া মুখ নিচের দিকে করেই বলল, হ্যাঁ বাবা, এটা তোমার মেয়েরই কথা।

এর পরিণতির কথা ভেবেছিস? মহসিনের সঙ্গে তোর বিয়ের কথা পাকা হয়ে রয়েছে। এ কথা তোর মা শুনলে কী করবে তাও কি ভেবেছিস? তা ছাড়া ছেলেটা তোর মামাদের গ্রামের বললি, তোর মামা জানতে পারলে কী ঘটনা ঘটবে তাও ভেবে দেখবি না? না, না, এ হতেই পারে না। মহসিন শুনলে সে কী করবে তাও কী ভেবে দেখবি না? পাড়াগাঁয়ের ছেলেরা শহরের সমাজ সম্পর্কে একরকম কিছুই জানে না। তারা আনকালচার্ড। আমাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারবে না। তা ছাড়া পাড়াগাঁয়ের ছেলেরা খুব লোভী হয়। ঐশ্বর্যের লোভে বড় লোকের মেয়েদেরকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে। তারপর শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসার জন্য স্ত্রীর উপর অত্যাচার করে। এরকম ঘটনা যে পেপারে প্রায় লেখালেখি হচ্ছে তা তুইও জানিস। আর তোর মা যে নিজের মতের বাইরে কিছুতেই কোনো কাজ করে না, তাও তুই জানিস। তাই যা বলছি শোন, ভালোকে সবাই ভালোবাসে। তাই বলে তাকে পেতে হবে এটা তো ঠিক না। ওসব পাগলামী মাথা থেকে দূর করে দিয়ে ছেলেটাকে ভুলে যা মা। নচেৎ আমাদের সংসারে আগুন জ্বলবে।

ডালিয়া বাবার দু’পা জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোমার সমস্ত কথা ঠিক হলেও আমার সব কথা শুনতে হবে। বর্তমানে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভালোবাসার কথা যা শোনা যায়, আমাদের মধ্যে সেরকম কিছু হয়নি। ছেলেটার ধার্মিকতা, আদর্শ চরিত্র, সর্বোপরি তার সৎ গুণাবলী আমাকে এমনভাবে আকৃষ্ট করেছে, যা তাকে ভালোবাসতে বাধ্য। করেছে। তার সঙ্গে দু তিনবার দেখা ও খুব সামান্য আলাপ হলেও মনে হয়েছে তাকে যেন অনেক দিন থেকে চিনি। সে আমাকে ভালোবাসে কিনা জানতাম না। তারপর তার মোবাইল নাম্বার কী করে পেল, সে ঘটনা বলে বলল, থাকতে না পেরে আমিই তাকে ফোন করি। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি সেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আর পাড়াগাঁয়ের ছেলেদের ব্যাপারে তুমি যা বললে তার শতভাগের একভাগও তার মধ্যে নেই। সকালে ফোন করে জানিয়েছে, আজ বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। আমার কথা সত্য না মিথ্যা তার সঙ্গে আলাপ করলেই বুঝতে পারবে। তুমি যদি আমাদের দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে না দাও, তা হলে। কাল সকালে আমার মরা মুখ দেখবে। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

তানভীর সাহেব তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে ডালিয়াকে সব থেকে বেশি ভালোবাসেন। তাই তাকে কাঁদতে দেখে ও তার কথা শুনে রাগ পড়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেয়ের হাত ধরে পাশে বসিয়ে বললেন। কোনো বাবাই মেয়ের এরকম অন্যায় আব্দার মেনে নেবে না। মরা মুখ দেখার কথা না বললে আমিও মেনে নিতাম না। বুঝতে পারছি তোকে সব থেকে বেশি। ভালোবাসি বলে আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চাচ্ছিস। ঠিক আছে, তোদের দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করব, তবে আমিও থাকব।

বাবা বলে ডালিয়া ওনার দুটো হাত ধরে বলল, তোমার মতো বাবা। কারও আছে কিনা জানিনা। তারপর আবার বলল, নিশ্চয় তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে।

পরিচয় জানা থাকলে আলাপ করতে সুবিধে হবে ওর পরিচয় বল।

ওর নাম মুহাম্মদ শফি। ডাক নাম শফি। আরবি ও ইংরেজিতে উচ্চ শিক্ষিত। নয় দশ বছরের সময় ওর বাবা মারা যান। মা ও দাদি বেঁচে আছেন। বিষয় সম্পত্তি অনেক। গ্রামের নাম চরদৌলত খান। মামাদের গ্রামের পাশের গ্রাম।

ঠিক আছে, রেডি থাকিস। আমি ব্যবস্থা করে ফোন করে তোকে জানাব। তোর মায়ের ঘুম থেকে উঠার সময় হয়ে গেছে। আমি এবার যাই বলে তানভীর সাহেব যাওয়ার সময় বললেন, খুব সাবধান, তোর মা যেন ক্ষুণাক্ষরেও এসব জানতে না পারে।

ডালিয়া গোসল করে দু’রাকায়াত শোকরানা নামায পরে দোয়া করল, “ইয়া আল্লাহ, ইয়া রাব্বল আলামিন, শফিকে যেন বাবার পছন্দ হয়। তাকে যেন স্বামী হিসাবে পাই।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *