চার্লসের স্বর্ণসম্পদ – ৫

তখন শেষ রাত। চাঁদের ম্লান আলোয় দেখা গেল একদল সৈন্য তীরের ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এসে দাঁড়াল। তারপর পাতা কাঠের পাটাতন দিয়ে হেঁটে ফ্রান্সিসদের জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। কোনোরকম শব্দ না করে চারজন সৈন্য সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে অস্ত্রঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল যাতে ভাইকিংরা কেউ অস্ত্র হাতে না পায়।

এবার সৈন্যদের সর্দার ডেক-এ ঘুমিয়ে থাকা ভাইকিংদের ঘুম ভাঙাতে বলল। সৈন্যরা ভাইকিংদের একে একে তলোয়ারের খোঁচা দিয়ে জাগাতে লাগল। এই ভাইকিংদের মধ্যে শাঙ্কো ঘুমিয়ে ছিল। তরোয়ালের খোঁচায় ঘুম ভেঙে সৈন্যদের দেখল। সৈন্যদের মধ্যে সৈন্যদের সর্দারকেও দেখল। গালে চিবুকে সামান্য দাড়িওয়ালা সর্দারকে দেখেই চিনল। বুঝল এরা আনগেভিনের সৈন্য। এরাই যুদ্ধে হেরে এসে জঙ্গলের মধ্যে পাথরের বাড়িটায় আশ্রয় নিয়েছে।

শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। সর্দারের কাছে গেল। বলল–তুমিই তো আলগেভিনের সৈন্যদের সর্দার?

–তাহলে চিনতে পেরেছো। সদার হেসে বলল।

–হ্যাঁ–কিন্তু আমাদের এভাবে বন্দি করা হচ্ছে কেন? শাঙ্কো জানতে চাইল।

–কারণ আমরা তোমাদের সাহায্য চাই। সর্দার বলল।

–একবার তো লড়াইয়ের সময় সাহায্য করেছি। আবার কীসের সাহায্য? শাঙ্কো বলল।

–আমরা আমাদের জাহাজটা পিটারের সৈন্যদের হাত থেকে মুক্তি করে নিয়ে আসবো। সদার বলল।

–আমরা আর তোমাদের সাহায্য করবো না। এসব তোমাদের সমস্যা। তোমরা নিজেরাই মিটিয়ে নাও। আমরা এখন দেশের দিকে জাহাজ চালাবো। শাঙ্কো ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল।

–না–আমাদের সঙ্গে যোগ দিন জাহাজ উদ্ধার করতে সাহায্য করতে। তারপর দেশে ফিরে যাবেন তার আগে নয়।

–আমরা তোমাদের সাহায্য করবো না। শাঙ্কো বলল।

–এটাই তোমাদের শেষ কথা? সর্দার বলল।

–হ্যাঁ–শাঙ্কো বলল।

–তাহলে তোমাদের বন্দি করে নিয়ে যাবো। আমাদের আস্তানায় তোমরা বন্দি থাকবে। সর্দার বলল।

–ঠিক আছে–আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে নিই।

বেশ। কথা বলো।

ততক্ষণে যারা জাহাজের কেবিনঘরে ছিল তাদেরও বন্দি করে আনা হয়েছে। সবাই ডেক-এর ধারে ধারে দাঁড়িয়ে আছে। সর্দারের সৈন্যরা সবাইকে খোলা তলোয়ার হাতে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু মারিয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।

শাঙ্কো বিস্কোকে ডাকল। বিস্কো কাছে এলো। শাঙ্কো সর্দারের সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে সব বলল। তারপর বলল–এখন কী করা যায়?

–আনগেভিনের জন্যে আমরা যুদ্ধ করতে যাবো কেন? বিস্কো বলল।

–তাহলে কি আমরা বন্দি হয়েই থাকবো? শাঙ্কো বলল।

–তাই থাকবো। বিস্কো বলল।

শাঙ্কো সর্দারের কাছে ফিরে এলো। বলল–আমরা বন্দি থাকবো।

–বেশ। সর্দার গলা চড়িয়ে বলল–সবাইকে হাত বেঁধে আমাদের আস্তানায় নিয়ে চলো।

–সবাইকে নয়। আমাদের দেশের রাজকুমারীকে এই জাহাজেই রাখতে হবে। বিস্কো বলল।

–না–সর্দার গলা চড়িয়ে বলল–সবাইকে আমাদের আস্তানায় বন্দি হয়ে থাকতে হবে।

মারিয়া শাঙ্কোর কাছে এলো। বলল–আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি অনায়াসেই ওখানে থাকতে পারবো।

–বেশ। শাঙ্কো বলল।

তখন ভোর হয়েছে। জঙ্গলের পাখিগুলো ডাকতে শুরু করেছে। রোদ পড়ল সমুদ্রে জঙ্গলের মাথায়।

সর্দারের সৈন্যরা ফ্রান্সিসদের জাহাজের মালখানা থেকে দড়ি জোগাড় করল। ছোটো ছোটো করে দড়ি কেটে নিয়ে ভাইকিংদের হাত বাঁধলো। শুধু মারিয়ার হাত বাঁধা হল না।

সবাইকে তক্তার ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে তীরে আনা হল। ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সবাই চলল। সর্দারে সৈন্যরা খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিয়ে ভাইকিংদের নিয়ে চলল।

কিছুদূর এসে পায়েচলা পথটা দেখা গেল। সেই পথ দিয়ে উত্তরমুখে চলল সবাই।

যেতে যেতে শাঙ্কো বলল–ঐ পাথরের বাড়িটায় দরজা জানালা নেই। ওদের হাত বেঁধে রাখা হবে। ভাববার কিছু নেই। ছোরা দিয়ে দড়ি কেটে মুক্ত হওয়া যাবে। তারপর ভাঙা দরজা দিয়ে পালানো যাবে। নিজেদের জাহাজে ফিরে আসা যাবে। কারণ তখন কোনো পাহারাদার থাকবে না। আনগেভিনের সব সৈন্যই জাহাজ তখল করতে যাবে।

সবাই ভাঙা পাথরের বাড়ির সামনে এলো। বাড়িতে ঢুকল সবাই। শাঙ্কো তখন বুঝল ও বাড়িটা ছোটো ভেবেছিল। আসল বাড়িটা বেশ বড়ো।

সর্দার শাঙ্কোদের নিয়ে এলো একটা বেশ বড়ো ঘরের কাছে। শাঙ্কো দেখল ঘরটার কাঠের দরজা অটুট আছে। সর্দার দরজাটা খুলে দিল। শাঙ্কোদের ঢোকানো হল সেই ঘরটায়।

ঘরের ভেতর ঢুকে শাঙ্কো দেখল–ঘরটার কোনো জানালা নেই। ওপরে ঘুলঘুলিমতো। ওটা দিয়েই আলো হাওয়া আসছে।

শাঙ্কো হতাশ হল। এখান থেকে কী করে পালাবো? শাঙ্কো এবার বুঝতে পারল ফ্রান্সিস আর হ্যারি কাছে না থাকলে ওরা কতটা অসহায়।

বিছানা বলতে শুনো ঘাসপাতা মেঝেটায় বিছোনো। ভাইকিংরা কেউ বসল কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। রাতের ঘুমটা হয় নি। এখন ঘুমোনো যাবে।

কিছুক্ষণ পরে ঘরটার দরজা খুলে গেল। সর্দার ঢুকল। হেসে বলল–এখানকার এক মস্তবড়ো জমিদারের প্রাসাদ ছিল এটা। কোনো প্রজা জমিদারের বিরুদ্ধে গেলে খাজনা না দিতে পারলে এই ঘরে তাদের বন্দি করে রাখা হত। এটাকে কয়েদঘরও বলতে পারো।

–এসব শুনে আমাদের লাভ? বিস্কো বলল।

লাভ এই যে তোমরা এমন একটা ঘর থেকে কোনোদিনই পালাতে পারবে না–এটা জানানোর জন্যেই এত কথা বলা। সর্দার বলল।

-ঠিক আছে। আমাদের সকালের খাবারের ব্যবস্থা করো। শাঙ্কো বলল।

-হা-হা সকালের খাবার তৈরি হচ্ছে। তোমাদের জাহাজ থেকে আটা ময়দা এসব আনা হয়েছে। একটু পরেই খেতে দেওয়া হবে। সর্দার বলল।

সর্দার এবার বলল–আমাদের জাহাজ উদ্ধারের কাজে তোমরা সাহায্য করতে পারতে। এই বন্দি দশা তোমরা ইচ্ছে করেই মেনে নিলে।

–ঠিক তাই–তোমাদের আমরা কোনোমতেই সাহায্য করবো না। তোমাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমরা বন্ধুকে হারিয়েছি। আর না। শাঙ্কো বলল।

সর্দার আর কোনো কথা না বলে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে সকালের খাবার দেওয়া হল। পোড়া পোড়া রুটি আর আনাজের ঝোল। শাঙ্কোরা তাই খেতে লাগল।

দু’জন সৈন্য একটা জলের পীপে এনে ঘরের কোণায় রাখল। খাবার খেয়ে জল খেল সবাই। সৈন্যরা চলে গেল। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।

মারিয়া ঘরের এক কোণে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল। এবার একটু গলা চড়িয়ে ডাকশাঙ্কো।শাঙ্কো তাড়াতাড়ি মারিয়ার কাছে এলো। বলল রাজকুমারী আপনার কি কষ্ট হচ্ছে।

না–আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না–মারিয়া বলল–আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না।

–কিছু বলবেন? শাঙ্কো জিজ্ঞেস করল।

–হ্যাঁ মারিয়া বলতে লাগল–এই আনগেভিনের সৈন্যদের সঙ্গে জাহাজ উদ্ধারে। সাহায্য করার জন্যে তুমি যেতে রাজি হলো না কেন?

–এই সৈন্যদের সর্দারকে বিশ্বাস করলে আমাদের বিপদই বাড়তে শুধু। ওদের যুদ্ধ জাহাজ দখল হলে ওরা প্রথমেই আমাদের হত্যা করতো। কারণ ওদের কাছে তখন আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। শাঙ্কো বলল।

–সেটা আমিও ভেবেছি। সেক্ষেত্রে লড়াই শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তোমরা জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে সমুদ্রের পারে উঠবে। তারপর হেঁটে আমাদের জাহাজে গিয়ে উঠবে।মারিয়া বলল। একটু ভেবে নিয়ে শাঙ্কো বলল–আমরা লড়াইয়ে নামলে আবার হয়তো বন্ধুদের কাউকে না কাউকে হারাবো।

–জানি সেটা হতে পারে। কিন্তু যদি তোমরা আত্মরক্ষমূলক লড়াই করো তাহলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা কম। ওদিকে রাজা পিটারের পাহারাদার সৈন্য বেশি থাকবে না। জাহাজ পাহারার কাজে অল্প সৈন্যই থাকবে। তাদের হারিয়ে দেওয়া খুবই সহজ হবে। আনগেভিনের সৈন্যরা থাকবে তোমরা থাকবে লড়াইয়ে জেতা কঠিন হবে না। মারিয়া বলল।

–তাহলে এখন আমরা কী করবো? বিস্কো বলল।

–সর্দারকে ডেকে বল–আমরা তোমাদের সাহায্য করতে রাজি আছি।

–ঠিক আছে। শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। একটু গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব– আনগেভিনের সর্দার আমাদের সাহায্য চেয়েছে–আমরা সর্দারকে সাহায্য করবো। ভাইকিংদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। একজন ভাইকিং বলল–শাঙ্কো হঠাৎ মত পাল্টালে কেন?

–অনেক ভেবে চিন্তে দেখলাম–এখন এটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। শাঙ্কো বলল।

রাজকুমারী এই প্রস্তাবটা দিয়েছেন। বিস্কো বলল।

 গুঞ্জন থেমে গেল। রাজকুমারী বলেছেন। কাজেই মেনে নিতেই হবে। আর কেউ কোনো কথা বলল না।

শাঙ্কো উঠে দরজার কাছে এলো। আঙ্গুল ঠুকে দরজায় শব্দ করল। শাঙ্কো বলল, তোমাদের সর্দারকে একবার আসতে বললো। খুব দরকার। দরজা বন্ধ হল।

কিছুক্ষণ পরেই সর্দার দরজা দিয়ে ঢুকল। শাঙ্কোদের কাছে এসে দাঁড়াল। হেসে বলল তোমরা কী বলতে চাও?

–আমরা আমাদের আগেকার মতো পাল্টেছি। আমরা জাহাজ উদ্ধারের কাজে তোমাদের সাহায্য করবো। শাঙ্কো বলল।

–এই তো একটা কাজের মত কাজ। তোমরা দুঃসাহসী তোমরা সঙ্গে থাকলে আমরা লড়াইয়ে জিতবই। সর্দার বলল।

কিন্তু শর্ত রইল লড়াই শেষ হলেই আমরা আমাদের জাহাজে ফিরে আসবো। শাঙ্কো বলল।

–বেশ। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। সদার বলল।

 –তোমরা জাহাজ উদ্ধার করতে কবে যাবে? বিস্কো জানতে চাইল।

–আজ রাতেই। সময়মতো তোমাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হবে।

 –কিন্তু আমাদের অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে আমাদের জাহাজে। শাঙ্কো বলল।

 “ঠিক আছে। তোমাদের মধ্যে কয়েকজন যাও। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসো।

 –তোমরা কীভাবে জাহাজ দখল করতে চাও? শাঙ্কো বলল।

–তোমাদের জাহাজটা নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু ভেবে দেখলাম জাহাজ নিয়ে গেলে ওরা সাবধান হয়ে যাবে। আমরা সমুদ্রের জলে সাঁতার কেটে যাবো। সর্দার বলল।

– তাহলে শিরস্ত্রাণ বর্ম পরে যাওয়া যাবে না। শাঙ্কো বলল।

–কেন বলো তো? সর্দার বলল।

–জলে অত ভারী জিনিস পরে সাঁতার কাটতে অসুবিধে হবে। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পরিশ্রান্ত হয় পড়বো।শত্রুপক্ষের জাহাজে উঠে লড়াই করবো কী করে? কাজেই শুধু তলোয়ার নিয়ে আমরা যাবো। শাঙ্কো বলল।

–ঠিকই বলেছো। একটুক্ষণ ভেবে সর্দার বলল।

–আমরা তৈরি থাকবো। তুমি ডাকলেই রওনা হবে। তার আগে আমাদের রাজকুমারীকে আমাদের জাহাজে পৌঁছে দাও। দু’জন বন্ধু সঙ্গে যাবে। তারা তিনজনেই আমাদের জাহাজে থাকবে। শাঙ্কো বলল।

–বেশ। তাহলে তৈরি থেকো। সর্দার বলল। তারপর একজন পাহারাওয়ালাকে হাতের ইশারায় ডেকে বলল–এদের ভালো ঘরটায় নিয়ে যাও। তারপর রাজকুমারী আর দু’জন বন্ধুকে তাদের জাহাজে রেখে এসো।

–বেশ। পাহারাদার শাঙ্কোদের দিকে এসে দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলল–সবাই ওঠো। তোমাদের অন্য ঘরে যেতে হবে। সর্দার তখন চলে গেছে।

ভাইকিংরা আস্তে আস্তে উঠেদাঁড়াল। পাহারাদার বলল-রাজকুমারী, এদিকে আসুন। মারিয়া এগিয়ে এলো। পাহারাদার বলল–যে দু’জন রাজকুমারীর সঙ্গে জাহাজে যাবে সেই দু’জনও এগিয়ে এসো। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে বলল–বিস্কো আর পেড্রো এগিয়ে এসো।

বিস্কো এগিয়ে এসে বলল–না শাঙ্কো–আমি লড়াইয়ে যাবো।

–পাগলামি করো না বিস্কো। তুমি রাজকুমারীর কাছে আমাদের জাহাজে থাকলে আমি নিশ্চিন্ত মনে লড়াইয়ে যেতে পারবো। বিস্কো ভুলে যেও না আমরা এখনও বন্দি। বিস্কো আর কোনো কথা বলল না। পেড্রো এগিয়ে এলো। বিস্কোকে বলল–বিস্কো– রাজকুমারীকে ডাকো।

মারিয়াকে আর ডাকতে হল না। মারিয়া বিস্কোর কাছে এসে বলল–চলো।

 বিস্কো মারিয়া আর পেড্রোকে নিয়ে কয়েদঘরের বাইরে এলো। সেই পাহারাদারটি দাঁড়িয়ে ছিল। পাহারাদার ওদের দেখে হাঁটতে শুরু করল। মারিয়া বিস্কো পেড্রো পাহারাদারদের পেছনে পেছনে চলল।

তখন দুপুর হয়েছে। পাহারাদার মারিয়াদের নিয়ে পায়েচলা পথটা ধরল। গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে চলল।

একসময় পাহারাদার ডানদিকে ঘুরল। এখানে সেই পায়েচলা পথটা নেই। ঝোঁপঝাড় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ওরা চলল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা খাঁড়িটার সামনে এলো। দেখল ওদের জাহাজটা শান্ত ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলছে।

পাটাতন পাতাই ছিল। মারিয়ারা পাটাতনের ওপর দিয়ে গিয়ে জাহাজে উঠল। পাহারাদারটি চলে গেল। ঝোঁপঝাড় গাছের মধ্যে ওকে আর দেখা গেল না।

মারিয়া জাহাজে উঠেই বলল–বিস্কো–আগে খাবারদাবারের ব্যবস্থা করো। খিদেয় পেট জ্বলছে। পেড্রো বলল–রাজকুমারী আপনি শুয়ে বসে বিশ্রাম করুন। আমিই রান্না চাপাচ্ছি।

–তুমি পারবে? মারিয়া বলল।

–আমার বেশিরভাগ সময়ই তো কাটে মাস্তুলের মাথায়। তবু একবার গন্ধ পেলে আমি ঠিক বলে দেব আজকে কী রান্না হচ্ছে। পেড্রো বলল।

তাই নাকি? মারিয়া এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও পেড্রোর এই গুণ শুনে হেসে ফেলল। পেড্রো হেসে বলল রাজকুমারী আপনি খুশির হাসি হাসলে আমরা যে কী খুশি হই তা বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু আপনার বিষণ্ণ চিন্তাকুল মুখ দেখলে আমরা সবচেয়ে বেশি দুঃখ পাই। কথাটা শুনে মারিয়া আবার হাসল।

–আপনি আপনার কেবিনঘরে গিয়ে বিশ্রাম করুন। কথাটা বলে পেড্রো চলল রসুইঘরের দিকে।

ওদিকে ভালো ঘরটায় এসে শাঙ্কোরা দেখল ঘরে শুকনো ঘাসপাতা দড়ি দিয়ে নিপুণভাবে বেঁধে বিছানামতো করা হয়েছে। তাতেই সৈন্যরা শুয়ে বসে আছে। ঘরটা বেশ বড়ো। ওপরে ছাদটা এখনও ভেঙে পড়েনি। অনেক খোলামেলা ঘর।

শাঙ্কোরা জায়গা করে নিয়ে বসল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল।

এখন কিছুই করার নেই। শুধু রাতের জন্যে প্রতীক্ষা।

 রাত হল। রাতের খাওয়া তাড়াতাড়িই দেওয়া হল। এঘরে আসার সময় দু’জন পাহারাদার শাঙ্কোদের হাতে বাঁধা দড়ি কেটে দিয়েছিল। খোলা হাতেই শাঙ্কোরা রাতে খাবার খেয়ে নিল। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ল। সর্দারের সৈন্যরা শাঙ্কোরা সবাই একে একে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমুলো না কেউ।

রাত গম্ভীর হল।

তখনই সর্দার এলো। সবাই উঠে দাঁড়াল। সবাই সর্দারের নির্দেশে অস্ত্রঘরে চলল। সবাই তলোয়ার নিয়ে কোমরে গুজল। কাউকে বর্ম শিরস্ত্রাণ পরতে দেওয়া হল না। পাথরের বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো সবাই। পায়েচলা পথটা ধরে চলল।

চাঁদের আলো উজ্জ্বল নয়। বনজঙ্গলের মাথার ফাঁক দিয়ে জোছনা পড়েছে এখানে ওখানে। সমুদ্রের দিক থেকে জোর হাওয়া আসছে। হাঁটতে হাঁটতে শাঙ্কো ওদের দেশীয় ভাষায় গলা চড়িয়ে বলল-এ লড়াই আমাদের লড়াই নয়। পাকেচক্রে এই লড়াইয়ে আমরা জড়িয়ে গেছি। আমরা কাউকে আগ বাড়িয়ে হত্যা করবো না। তবে জীবন বিপন্ন হলে আত্মরক্ষার জন্যে হত্যা করতেই হবে। আমরা যথাসাধ্য সাবধানে লড়াই করবো যাতে আমরা অক্ষত থাকতে পারি। অপরপক্ষ আমাদের শত্রু নয়। কাজেই জীবন বিপন্ন করে আমরা লড়তে যাবো কেন? আমাদের প্রথম এবং শেষ কথা আত্মরক্ষা। শাঙ্কোর কথা বুঝতে না পেরে সর্দার বলল তোমার বন্ধুদের কী বললে?

–এই কীভাবে লড়তে হবে। শত্রুপক্ষ বর্ম শিরস্ত্রাণ পরে লড়াই করবে। কাজেই সাবধানে লড়াই করতে হবে। এসব শাঙ্কো বলল।

–সে তো ঠিকই। সর্দার বলল।

সর্দারের সঙ্গে কথা হল না আর। সবাই নিশ্চুপ হেঁটে চলেছে ঝোঁপঝাড় জঙ্গলের মধ্য দিয়ে।

সমুদ্রের দিক থেকে জোর হাওয়া বইছে। সমুদ্রের শব্দ আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল।

একসময় সমুদ্রের তীরে পৌঁছল সবাই। অল্প জোছনায় দেখল আনগেভিনের জাহাজটা বেশ দূরে সমুদ্রের জলে ভাসছে। কখনও কখনও কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে জাহাজটা।

সর্দার বলল–আমরা সমুদ্রের ধারে ধারে আরো কিছুদূর যাবো। যতটা সম্ভব জাহাজটার কাছাকাছি যাবো। তারপর জলে নেমে সাঁতরে গিয়ে জাহাজে উঠব।

এখানে সমুদ্রের সৈকতে ছোটো মাপের বালিয়াড়ি অনেক দূর চলে গেছে। সবাই উঁচু তির থেকে বালিয়াড়িতে নেমে এলো। চলল বালিয়াড়ি দিয়ে।

কারো মুখে কথা নেই। একটানা সমুদ্রের বাতাস শোঁ শোঁ শব্দ তুলে ছুটে আসছে।

একসময় ওরা জাহাজটার কাছাকাছি এলো।–সাঁতরে গিয়ে জাহাজে উঠতে হবে। সর্দার বলল–কোনো শব্দ যেন না হয়।

সর্দারের সৈন্যরা ভাইকিংরা জলে নামল। জলে কোনোরকম শব্দ না তুলে সবাই সাঁতরে চলল জাহাজটার দিকে।

দূরত্বটা খুব কম নয়। সর্দারের সৈন্যরা হাঁপিয়ে গেল। ভাইকিংরা সমুদ্রের সঙ্গে আজন্ম পরিচিত। সমুদ্রের জলে সাঁতার কাটা ওদের ছোটোবেলা থেকে অভ্যেস।

কয়েকটা নীলচে কুয়াশার আস্তরণ পার হয়ে শাঙ্কোরা সবার আগে জাহাজের কাছে পৌঁছল। দেখল–কেবিনে জানলার সিঁড়ির মাথায় একটা কাঁচে ঢাকা লণ্ঠন। জাহাজের আর কোথাও আলো নেই।

এবার জাহাজে উঠল। শাঙ্কো জাহাজের হালের কাছে এলো। দেখল কিছু দড়িদড়া ঝুলছে। শাঙ্কো হালের খাঁজে পা রেখে উঠে পড়ল। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় শাঙ্কো হাত দিয়ে ঝুলন্ত দড়িদড়া দেখাল।

এবার সবাই দড়ি ধরে ধরে জাহাজে উঠে পড়তে লাগল। হালের দিক থেকে সবাই ভেক-এর কাছে এলো। দেখল পনেরো কুড়িজন রাজা পিটারের সৈন্য ডেক-এ ঘুমিয়ে আছে।

সর্দার দু’তিনজন সৈন্যকে কানের কাছে বলল–সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামো। অস্ত্রঘরের সামনে গিয়ে পাহারা দাও যাতে কেউ অস্ত্র আনতে না পারে। সৈন্য ক’জন চলে গেল।

বোঝা গেল–এই জাহাজে বেশি পাহারাদার সৈন্য রাখা হয় নি।

সর্দার হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে বলে উঠল–সব কটাকে হত্যা করো। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে ওদের দেশীয় ভাষায় বলে উঠল-কাউকে হত্যা করো না। জলে ছুঁড়ে ফেল।

রাজা পিটারের সৈন্যদের ঘুম ভেঙে গেল। ডেক-এ যারা ঘুমিয়েছিল তারা ঘুম ভেঙে উঠেদাঁড়াল। নিরস্ত্র তাদের ওপর সর্দারের সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাজা পিটারের নিরস্ত্র সৈন্যরা অসহায় অবস্থায় মারা যেতে লাগল। আর্ত চিৎকার গোঙানি শোনা যেতে লাগল।

শাঙ্কোরা ধরে ধরে কয়েকজন সৈন্যকে জলে ছুঁড়ে ফেলল।

রাজা পিটারের সৈন্যদের কয়েকজন সিঁড়ি বেয়ে অস্ত্রঘরের কাছে ছুটে এলো। দেখল সর্দারের সৈন্যরা অস্ত্রাগার পাহারা দিচ্ছে খোলা তলোয়ার হাতে। ওরা বুঝল যে প্রাণ সংশয়। তাড়াতাড়ি ওপরে ডেক-এ উঠে এলো। ততক্ষণে কেবিনঘর থেকে রাজা পিটারের সৈন্যরা ডেক-এ উঠে এলো। উঠেই পড়ল আক্রমণের মুখে। সর্দারের সৈন্যরা ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এলোপাথারি তলোয়ার চালাতে লাগল। রাজা পিটারের সৈন্যরা অসহায় অবস্থায় মারা যেতে লাগল।

ওদিকে ভাইকিংরা রাজা পিটারের নিরস্ত্র সৈন্যদের ধরে ধরে জলে নিক্ষেপ করতে লাগল। যুদ্ধটা হল এক তরফা। নিরস্ত্র সৈন্যদের সঙ্গে সশস্ত্র সৈন্যদের লড়াই।

অল্পক্ষণের মধ্যেই রাজা পিটারের সৈন্যরা হার স্বীকার করল। ওরা দু’হাত ওপরে তুলে ডেক-এর একপাশে দাঁড়াল।

সর্দার চিৎকার করে বলে উঠল–এইক’টাকে হত্যা করো। রাজা পিটারের সৈন্যদের মুখ শুকিয়ে গেল। ওরা বুঝল–আর বাঁচার আশা নেই।

তখনই শাঙ্কো এক লাফে রাজা পিটারের সৈন্যদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সর্দারের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমাদের নিষ্ঠুরতার নমুনা দেখেছি। এখন এই সৈন্যরা যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের হত্যা করতে চাও। আমরা তা হতে দেব না। যদি রাজা পিটারের নিরস্ত্র সৈন্যদের আক্রমণ করো তবে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবো। সাহস থাকে এগিয়ে এসো।

সর্দার বুঝল–আবার এক লড়াইয়ে নামতে হবে। তাতে বিপদই বাড়বে। জাহাজ দখল করতেই ওরা এসেছিল সেটা তো হয়ে গেছে। সর্দার বলল ঠিক আছে এদের কয়েদঘরে নিয়ে রাখো।

সর্দারের সৈন্যরা এগিয়ে এলো। রাজা পিটারের সৈন্যদের ঘিরে দাঁড়াল। তারপর নিয়ে চলল নীচে নামার সিঁড়ির দিকে। রাজা পিটারের যে সৈন্যরা বেঁচেছিল তাদের সবাইকে কয়েদঘরে বন্দি করে রাখা হল।

এবার সর্দার আস্তে আস্তে শাঙ্কোদের কাছে এলো। দেখে বলল-তোমরা এই জাহাজেই থাকবে। আরো কিছু লোক জোগাড় করে সৈন্যসংখ্যা বাড়াবো। তারপর সেন্ট অ্যাঞ্জেলা দুর্গ অধিকার করবো। আনগেভিনকে মুক্ত করবো। তোমরা আমাদের হয়ে লড়াই করবে।

–যদি লড়াই না করি? শাঙ্কো বলল।

–তাহলে তোমাদের কয়েদঘরে আটকে রাখা হবে। সর্দার বলল।

শাঙ্কো, সঙ্গে সঙ্গে গলা চড়িয়ে ওদের দেশের ভাষায় বলে উঠল–ভাইসব জলে ঝাঁপিয়ে পড়ো। জলদি।

ভাইকিংরা সঙ্গে সঙ্গে কোমরে তলোয়ার খুঁজে রেলিঙ ডিঙিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সবশেষে দলে শাঙ্কো ছিল। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল।

শাঙ্কো গলা চড়িয়ে বলল–তীরের দিকে চলল। জাহাজের সর্দার আর সৈন্যরা বোকার মতো তাকিয়ে রইল।

শাঙ্কো সাঁতার কাটতে লাগল। তখনই সূর্য উঠল। গাঢ় কমলা রং সূর্যের। সমুদ্রের ঢেউ-ওঠা জলে সূর্য প্রথমেই সবটা উঠল না। নীচের দিকে একটা ফোঁটামতো জলের মধ্যে আটকে রইল। একটু পরে সেটা ওপরে উঠে সূর্যের সঙ্গে মিশে গেল।

শাঙ্কোরা সাঁতারে চলল তীরের দিকে।

সমুদ্রতীরে যখন শাঙ্কোরা পৌঁছল তখন সবাই হাঁপাচ্ছে। জল থেকে উঠে অপরিসর সৈকতে এসে দাঁড়াল। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে বলল–এবার আমাদের জাহাজের দিকে চললো।

অপরিসর সৈকতভূমি দিয়ে শাঙ্কোরা হেঁটে চলল। কিছুটা গেল। আর সৈকতভূমি নেই। শাঙ্কোরা তীরে উঠল। ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ওরা ওদের জাহাজের দিকে লক্ষ্য রেখে চলল।

একসময় শাঙ্কোরা ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে ওদের জাহাজের কাছে এল। পাতা পাটাতন দিয়ে হেঁটে গিয়ে জাহাজে উঠল।

মারিয়া আর বিস্কো ছুটে এলো। পেছনে পেড্রো। সবাই ধ্বনি তুলল-ও-হো-হো।

শাঙ্কোরা কেবিনঘরে চলে গেল। ভেজা পোশাক ছাড়তে।

শুকনো পোশাক পরে শাঙ্কো ডেক-এ উঠে এলো। মারিয়া এগিয়ে এলো। বলল– এখন কী করবে?

–আমরা জাহাজটা চালিয়ে খাঁড়ির আরো ভেতরে চলে যাব। জাহাজ লুকিয়ে রাখবো। তারপর ফ্রান্সিসদের জন্যে অপেক্ষা করবো।

শাঙ্কো সবার দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলল–সবাই হাত লাগাও। পাল তুলে দাও দাঁড়ঘরে দাঁড় টানতে যাও আমরা এই খাঁড়ির আরো ভেতরে চলে যাবো যাতে আমাদের জাহাজ কারো নজরে না পড়ে।

পাল তোলা হল। দাঁড় বাওয়া চলল। জাহাজ খাঁড়ির আরো ভেতরে ভেসে চলল।

একসময় খাঁড়ির দু’ধারের গভীর বনের গাছপালা দু’পাশ থেকে ঝুঁকে পড়েছে দেখা গেল। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে পেট্রোকে বলল-পেড্রো মাস্তুলে উঠে দেখো তো জাহাজটা বনজঙ্গলের আড়ালে পড়েছে কি না।

পেড্রো দ্রুত মাস্তুল বেয়ে একেবারে মাথায় উঠে গেল। চারপাশ দেখে নেমে এলো। একটু হাঁপিয়ে বলল–আমাদের জাহাজটা দুপাশের জঙ্গলে একেবারে ঢাকা পড়ে গেছে কারো নজরে পড়বে না।

জাহাজটা ওখানেই নোঙর ফেলল। এবার ফ্রান্সিসদের জন্যে প্রতীক্ষা।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি ফিরে এলেই জাহাজ ছাড়া হবে ওদের দেশের দিকে।

এখন শুধুই প্রতীক্ষা। এখন আলগেভিন আর রাজা পিটারের সৈন্যরা ওদের খোঁজ পাবে না।

.

ওদিকে গীর্জাটা ভালো করে দেখে ফ্রান্সিস হ্যারি সাজ্জিও গীর্জার বাইরে এলো। সাজ্জিও বললেন–রাজা পিটার আমাদের চার্লসের প্রাসাদেই থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

–ভালোই হয়েছে। এতে আমাদের খোঁজাখুঁজির কাজ ভালোভাবেই চলবে।ফ্রান্সিস বলল।

তিনদিন কেটে গেল। ফ্রান্সিসরা চার্লসের প্রাসাদেই রইল। অঢেল সুস্বাদু খাবার। বড়ো পালকের শয্যায় শোয়া।ফ্রান্সিসদেরসময় ভালোভাবেই কাটতে লাগল। কিন্তু ফ্রান্সিসের নজর নেই এইসব বিলাসবহুল জীবনের প্রতি। ও সর্বক্ষণ নিজের চিন্তায় বিভোর। ওর দৃঢ় বিশ্বাস চার্লস কোথাও না কোথাও গুপ্ত ধনসম্পদের সূত্র রেখে গেছেন। ওরা সেই সূত্র খুঁজে পাচ্ছে না। ফ্রান্সিস প্রাসাদের সর্বত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। কিন্তু সূত্র হিসেবে কাজে লাগে এমন কিছুই খুঁজে পেল না।

গ্রন্থাগারের প্রাচীন গ্রন্থগুলো শুধু–পাতা উল্টে-ই দেখল ফ্রান্সিস। গ্রীক আরবী ভাষায় লেখা সেসব গ্রন্থ ও কী বুঝবে। শুধু প্রাচীন গ্রীক ভাষায় লেখা বাইবেলটার পাতা উল্টে ভালো করে দেখেছে–অনেক জায়গায় দাগ দেওয়া। বোঝাই যাচ্ছে–চার্লস খুব মনোযোগ দিয়ে বাইবেল পড়েছেন। ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে অনেকে মনে শান্তি পান। হয়তো চার্লসও মনের শান্তি পেয়েছেন। সাজ্জিও চার্লসের শেষ দিককার জীবনের কথা বলেছেন। গীর্জায় প্রার্থনা করেই সময় কাটতো তার। নিশ্চয়ই যীশুর বাণীর মধ্যে তিনি সান্ত্বনা পেয়েছিলেন সন্দেহ নেই। পালিতা কন্যার মৃত্যুর পর তার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন এসেছিল।

গীর্জাটায় ফ্রান্সিস হ্যারি ঘুরে বেড়িয়ে দেখছিল। গীর্জাটার পাথুরে দেওয়ালে কোথাও কোথাও কুঁদে কুঁদে ফুল পাতা পাখির ছবি তোলা হয়েছে। সবচেয়ে জমকালো সুন্দর কাঠের বেদীটা। ঐ বেদীতেই বসানো যীশুর মূর্তি। বেদীতে সূক্ষ্ম নকশার কাজ।

ফ্রান্সিস কাঠ কুঁদে তোলা বেদীর নক্‌শাগুলো ভালো করে দেখছিল। সাধারণ নশা যেমন হয়। ফুল পাতা পাখি লতাগাছ। দেখতে দেখতে সেই লেখাটায় চোখ পড়ল। বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি। সাজ্জিও পড়ে অর্থটা বলেছিলেন। বড়ো গভীর অর্থ উপদেশটির। ডানদিকেও আর একটি উদ্ধৃতি। উদ্ধৃতি দুটো দেখতে দেখতে হঠাৎ ফ্রান্সিসের মনে হল উদ্ধৃতি দু’টোর মাঝখানে লতাফুল পাতা দিয়ে যেন দুটো চোখ খোদাই করা হয়েছে। ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে কাছে গিয়ে দেখল সত্যিই একজোড়া চোখ। ফ্রান্সিস আঙ্গুল দিয়ে জায়গাটা দেখাল। হ্যারিও মুখ নিচু করে কাছ থেকে ভালো করে দেখে বলল– ফ্রান্সিস তোমার অনুমান ঠিক। একজোড়া চোখ খোদাই করা হয়েছে। এমনিতে দেখলে ফুল লতাপাতা মনে হবে। ভালো করে দেখলে তবেই বোঝা যাবে।

ফ্রান্সিস বলল-দাঁড়াও সাজ্জিওকে ডেকে আনি। ফ্রান্সিস চলে গেল। একটু পরে সাজ্জিওকে নিয়ে ফিরে এলো।

সাজ্জিও বেদীর কাছে আসতে আসতে বলল–

–আপনারা ভুল দেখেছেন। আমি অনেকদিন এইনকশাগুলো দেখেছি। একজোড়া চোখ আমি কোনোদিন দেখিনি।

–তবু–আজকে এই জায়গাটা ভালো করে দেখুন। বলে ফ্রান্সিস আঙ্গুল দিয়ে সেই জায়গাটা দেখাল। সাজ্জিও খুব কাছে গিয়ে দেখতে দেখতে বলল–আশ্চর্য! সত্যিই একজোড়া চোখ খোদাই করা হয়েছে। কিন্তু এই চোখের সঙ্গে চার্লসের ধনসম্পদের কি সম্বন্ধ।

–নিশ্চয়ই কোনো সম্বন্ধ আছে–ফ্রান্সিস বলল–এবার আপনি বলুন তো এই সব কিছুই কি চার্লসের নির্দেশেই তৈরি হয়েছে?

–হ্যাঁ–চার্লসের তত্ত্বাবধানেই এই গীর্জার সব কিছু নির্মিত হয়েছে। সাজ্জিও বললেন। ফ্রান্সিস বলল–এবার বলুন তো এই চোখ জোড়াকে কেন্দ্র করে কি কোনো উদ্ধৃতি লেখা আছে। সাজ্জিও ভালো করে চোখ জোড়াটা দেখলেন। বললেন–না– কিছু লেখা নেই।

–ঠিক আছে ফ্রান্সিস বলল–মানুষের চোখ নিয়ে বাইবেলে কোনো বাণী আছে?

 –থাকতে পারে বৈ কি। সাজ্জিও বললেন।

–তেমন কোনো বাণী কি আপনার মনে আসছে? ফ্রান্সিস বলল। সাজ্জিও চোখ। ঝুঁজে কিছুক্ষণ চুপ করে বলে উঠলেন–একটি বাণী আছে।

–সেটা কী? ফ্রান্সিস জানতে চাইল। সাজ্জিও বললেন–বাণীটির অর্থ হল– “তোমার চোখই হল অন্তর আত্মার প্রদীপ। তোমার চোখের দৃষ্টি যদি নির্মল হয় তবে তোমার সমস্ত সত্তা দীপ্তিময় হবে।” সাজ্জিওর কথাটা শেষ হতেই ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলে উঠল–সাজ্জিও হ্যারি–এই বেদীর মধ্যেই আছে চার্লসের গুপ্ত ধনসম্পদ।

সাজ্জিও বলে উঠলেন–এটা আপনার কেন মনে হল?

–দেখুন সাজ্জিও ফ্রান্সিস বলতে লাগল–আমার প্রথম থেকেই নিশ্চিত ধারণা হয়েছিল–চার্স প্রতিষ্ঠিত এই গীর্জা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চার্লস তার ধনসম্পদ গোপনে রেখেছেন। তিনি তার জন্যে এই গীর্জাকেই বেছে নিয়েছেন। সূত্র রেখেছেন বাইবেলের তৃতীয় উদ্ধৃতির মধ্যে। সেটা তিনি এখানে লেখান নি। যাঁরা প্রকৃত যীশুভক্ত তাদের কারো না কারো নজরে এই চোখ দুটো পড়বেই। সঙ্গে সঙ্গে যীশুর উপদেশবাণীও মনে পড়বে। খোদাই করা জোড়া চোখের গুরুত্ব তিনি বুঝতে পারবেন। এতদিন সেটা কেউ বোঝেন নি। আজ আমরা বুঝলাম।

–তাহলে তো বেদী ভেঙে দেখতে হয়। সেটা সম্ভব নয়। রাজা পিটারও রাজি হবেন না। সাজ্জিও বললেন।

–বেদি ভাঙা হোক এটা চার্লসও চান নি। কাজেই তিনি সহজ পথটাই রেখেছেন। –এই খোদাই করা চোখ জোড়া। ফ্রান্সিস বলল। তার পর দুটো আঙ্গুল চোখ জোড়ায় রেখে একটু চাপ দিল। চোখ জোড়া খসে পড়ল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ভাঙা চোখের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকাল। অন্ধকার। কিছুই নজরে পড়ছে না।

–কিছু দেখতে পাচ্ছেন? সাজ্জিও বললেন।

–অন্ধকারটা একটু সয়ে আসার সময় দিন। ফ্রান্সিস বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *