চার্লসের স্বর্ণসম্পদ – ৩

বিকেলে ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে আনগেভিনের যুদ্ধ জাহাজে গেল। আনগেভিনের কেবিনঘরে বসেই ওরা কথা বলল। ফ্রান্সিস নিজেদের সম্মতির কথা জানাল। আরো বলল–আপনারা জয়ী হলেই আমরা কিন্তু দেশের দিকে জাহাজ চালাবো।

–ঠিক আছে। আমাদের লক্ষ্য যুদ্ধে জয়লাভ করা। আনগেভিন বলল।

 সন্ধের পর থেকে আনগেভিন যুদ্ধ জাহাজ দুটি সামনে চলতে লাগল পেছনে ফ্রান্সিসদের জাহাজ।

পরদিন সকালে আনগেভিনের দূত হিসেবে একজন লোক এলো। হ্যারির সঙ্গে কথা বলল। হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল–আনগেভিন বলে পাঠিয়েছেন যে পঁচিশটি যুদ্ধাস্ত্র অর্থাৎ বর্ম ঢাল আর শিরস্ত্রাণ আমাদের দেবে। এর বেশি অস্ত্র ওদের মজুত নেই। আমাদের পঁচিশজনকে যেতে বলছে ওদের যুদ্ধ জাহাজে। যুদ্ধাস্ত্র আনতে।

চলো। আমরা নিশ্চইযাবো। এরকম যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া তৃতীয় পিটারের সশস্ত্র সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করা যাবে না। তখনই ভাইকিং বন্ধুদের ফ্রান্সিস হ্যারিকে দিয়ে ডেকে পাঠাল। সবাই এলে বন্ধুদের থেকে চব্বিশজনকে বেছে নিল। তারপর দলবেঁধে চলল আনগেভিনের যুদ্ধ হাজাজে। যাবার সময় ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল–তুমি লড়াইতে নামবে না। তুমি মারিয়ার সঙ্গে থাকবে।

ফ্রান্সিস বিস্কো শাঙ্কোসহ পঁচিশজন বর্ম শিরস্ত্রাণ ঢাল হাতে নিজেদের জাহাজে ফিরে এলো। এইসব যুদ্ধাস্ত্র পেয়ে সবাই খুশি। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল–হ্যারি তুমি বলে এসো যে আমাদের যে সববন্ধুরা যুদ্ধাস্ত্র পেল না তারা লড়াই করবে না। হ্যারি সেকথা আনগেভিনকে গিয়ে বলে এলো। আনগেভিন বলল–যুদ্ধ না করুক কিন্তু যুদ্ধরত সৈন্যদের সাহায্য করতে হবে। হ্যারি তাতে সম্মত হল।ফ্রান্সিসকে এসেবললও সেকথা। ফ্রান্সিস বলল ঠিক আছে।

পরদিন দুপুর নাগাদ নজরদার পেড্রো মাস্তুলের ওপরে ওর বসার জায়গা থেকে চেঁচিয়ে বলল–ডাঙা দেখা যাচ্ছে–ডাঙা।

একটু পরেই আনগেভিন হ্যারিকে ডেকে পাঠাল। হ্যারি এলে বলল– আমরা মাল্টায় এসে গেছি। আমরা মাল্টার উত্তর দিকে নামবো। এখানেই আছে সেন্ট অ্যাঞ্জেলো দুর্গ। সেই দুর্গ আমরা পিটারের সৈন্যদের যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে দখল করবো। তোমার বন্ধুদের সৈন্যদের যুদ্ধের জন্যে তৈরি হতে বলো। তৈরি হয়ে তারা যেন আমাদের দুই জাহাজে চলে আসে। তোমাদের জাহাজ তো যুদ্ধ জাহাজ নয়। তোমাদের জাহাজ একটু দূরে থাকবে। হ্যারি জাহাজে ফিরে এসে সব ফ্রান্সিসকে বলল।

মাল্টার তীরভূমি দেখা গেল। তিনটি জাহাজই তীরভূমির কাছে এলো। দেখা গেল তীরভূমিতে পাথরের চাঁই নেই। প্রায় সমতল পাথুরে রাস্তামতো ঢালু হয়ে সমুদ্রে নেমে এসেছে। এতে সৈন্যদের চলাফেরার সুবিধেই হবে। যুদ্ধ জাহাজ থেকে তিরপর্যন্ত কাঠের পাটাতন পাতা হল।

আনগেভিনের নেতৃত্বে তার সৈন্যরা আর ফ্রান্সিসরা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে পাতা কাঠের পাটাতন দিয়ে হেঁটে নেমে এলো। পাথুরে রাস্তামতো ঢালু জায়গা দিয়ে সকলেই উঠতে লাগল। রাজা তৃতীয় পিটারের কোনো সৈন্যের দেখা পাওয়া গেল না। খুশিতে আনগেভিনের সৈন্যরা তলোয়ার বর্শা উঁচিয়ে হৈ হৈ করে উঠল। ওরা ভেবেছিল যুদ্ধে নামতে হবে। অথচ দেখা গেল সমুদ্রতীরে রাজা পিটারের একটা সৈন্যও নেই।

ফ্রান্সিস একটু অবাকই হল যখন দেখল বিনা বাধায় ওরা এগিয়ে চলল। কিছুটা এগোতেই এবার একটা বড়ো দুর্গ দেখা গেল। পাথরের দুর্গার চারপাশ ঘিরে পাথুরে দেয়াল। আনগেভিন তার সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল–সেন্ট অ্যাঞ্জেলা দুর্গ আমরা জয় করবো। সব সৈন্যরা হৈ হৈ করে উঠল। শূন্যে তলোয়ার ঘোরাল। বর্শা ওঠাতে নামাতে লাগল।

সামনে একটু উত্রাইমতো। সেটা পার হতেই দেখা গেল রাজা পিটারের সৈন্যরা দুর্গ-ঘেরা পাথুরে প্রাচীরের চারদিকে ছড়িয়ে আছে।

আনগেভিনের নেতৃত্বে সৈন্যদল এগিয়ে চলল দুর্গের দিকে। মাত্র হাত পঞ্চাশেক দূরে থাকতেই আনগেভিন চিৎকার করে হুকুম দিল–আক্রমণ করো। তার সৈন্যরা শূন্যে তলোয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে অন্যদল বর্শা উঁচিয়ে দ্রুত ছুটে গিয়ে দুর্গরক্ষী সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসরাও তাদের পেছনে পেছনে ছুটে গেল। দুর্গের চারপাশ ভরে উঠল যুদ্ধরত সৈন্যদের অস্ত্রে ঝনঝনা রণহুংকার আর উৎসাহের ধ্বনিতে। তারপরই শোনা গেল আহতদের আর্ত চিৎকার।

লড়াই চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল রাজা পিটারের সৈন্যদের সংখ্যা কমে গেছে। যারা তবু লড়াই করছিল তারা পিছু হটতে হটতে দুর্গের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিল। আনগেভিনের সৈন্যদের হাতে দুর্গ পতনের মুখে। তীব্র লড়াই চলল। রাজা পিটারের সৈন্যরা এদিক-ওদিক ছুটে পালাতে লাগল। এতে আনগেভিনের সৈন্যদের ও যুদ্ধরত ভাইকিংদের উৎসাহ দ্বিগুণ হল। রাজা পিটারের সৈন্যদের বন্দি করা হতে লাগল। এবার দুর্গের ভেতের আশ্রয় নেয়া সৈন্যদের বন্দি করার জন্যে আনগেভিনের সৈন্যরা জলস্রোতের মতো দুর্গটায় ঢুকতে লাগল। দুর্গের মধ্যেও বেশ কিছুক্ষণ লড়াই চলল। তারপর পরাজিত রাজা পিটারের সৈন্যদের বন্দি করা হল। রাখা হল দুর্গের কয়েদঘরে।

যুদ্ধ শেষ। এবার ফ্রান্সিস ওর বন্দুদের খুঁজে খুঁজে বের করে দুর্গের একটি ঘরে নিয়ে এলো। সবাই যুদ্ধ ক্লান্ত। অনেকেই শুকনো ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসের বিশ্রাম নেই। বন্ধুদের গুণে গুণে দেখল–তিনজন এখানো আসেনি। তারা যুদ্ধে মারা গেছে কিনা আহত হয়েছে সেই খোঁজে ফ্রান্সিস দুর্গের বাইরে এলো। নিহত আহত সৈন্যদের মধ্যে ফ্রান্সিস বন্ধুদের খুঁজতে লাগল। অনেক নিহত আহত সৈন্যদের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে এক আহত বন্ধুকে পেল। আহত বন্ধুটাকে তুলে দাঁড় করাল। দেখল বন্ধুটির পিঠে তলোয়ারের কোপ গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। ফ্রান্সিস ওকে বলল–তুমি একটু অপেক্ষা করো। আরো দু’জন বন্ধুর খোঁজ পাচ্ছি না। ওদের কী হয়েছে দেখি, তুমি ততক্ষণ এখানে অপেক্ষা করবো। আমিই তোমাকে দুর্গে নিয়ে যাবো। জাহাজ থেকে বৈদ্য ভেনকে এনে তোমার চিকিৎসা করাব। এই বলে আহত বন্ধুটিকে ওখানে বসিয়ে রেখে ফ্রান্সিস আর দু’জন বন্ধুকে খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ যুদ্ধের জায়গায় ঘুরে ঘুরে ফ্রান্সিস দুই বন্ধুকে পেল। কিন্তু জীবিত বা আহত নয়। যুদ্ধে দু’জনেই মারা গেছে।

ফ্রান্সিসের গভীর দুঃখে চোখে জল এলো। এই বিদেশ বিভুইয়ে এসে বন্ধু দু’জন মারা গেল। দেশে ফিরে তাদের বাবা-মাকে অনেক কষ্টে শান্ত করতে হবে। ফ্রান্সিস ভাবল যুদ্ধে নামলে মৃত্যু হতেই পারে। এই নিয়ে মন খারাপ করে লাভ নেই। বরং এখন কী কী কাজ করতে হবে সেটাই ভেবে নিল।

ফ্রান্সিস আহত বন্ধুটির কাছে ফিরে এলো। ওকে তুলে ধরে আস্তে আস্তে দুর্গের দিকে নিয়ে চলল। বন্ধুটির পিঠ থেকে তখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। বেশ কষ্ট করেই বন্ধুটিকে ফ্রান্সিস দুর্গে নিয়ে এলো। ওরা যে ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল সেই ঘরেই আহত বন্ধুটিকে রাখল। তারপর বিস্কোকে বলল–জাহাজ থেকে ভেন হ্যারি আর এ মারিয়াকে এখানে নিয়ে এসো। বিস্কো চলে গেল।

ফ্রান্সিস এবার বন্ধুদের বলল–আমাদের দুই বন্ধু যুদ্ধে মারা গেছে। কথাটা শুনে সব ভাইকিংরা নিজেদের মধ্যে কথা বলা বন্ধ করল। মাথা নিচু করে সবাই মৃত বন্ধু দু’জনের স্মৃতির প্রতি ভালোবাসা জানাল।

দুর্গের ডানদিকে একটু দূরে কবরখানা। বিকেলে আনগেভিন সেখানে এলো। যেসব সৈন্য যুদ্ধে মারা গেছে তাদের কবর দেওয়া হল। ফ্রান্সিস মারিয়া হ্যারি অন্য কিছু বন্ধু তাদের মৃত দুই বন্ধুর দেহও কবর দিল।

সন্ধে নামতেই সবাই দুর্গে ফিরে এলো। ওদের ঘরেই ফ্রান্সিসরা এলো। দেখল– বৈদ্য ভেন-এর ওষুধে আহত বন্ধুটি এখন অনেকটা ভালো হয়েছে।

একটু রাত হতে ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল–হ্যারি আনগেভিনের নির্দেশ তো আমরা মেনেছি। যুদ্ধ করেছি। আনগেভিনকে সেকথা বলতে হবে–চলো।

বলবো যে যুদ্ধে জয়ও হয়েছে। এবার আমরা দেশের দিকে যাবো। সৈন্যদের জিজ্ঞেস করে দুর্গের সবচেয়ে ভালো ঘরটায় এলো। দেখল-আনগেভিন কয়েকজন অনুচরকে নিয়ে পাখির পালকে তৈরি বিছানায় বসে আছে। যুদ্ধজয়ের আনন্দে আনগেভিন মশগুল।

হ্যারি বলল–আনগেভিন–আপনি যুদ্ধে আমাদের সাহায্য চেয়েছিলেন। আমরা লড়াইতে অংশ নিয়েছি। আপনি সেন্ট অ্যাঞ্জেলো দুর্গ জয় করেছেন।

–হ্যা–তোমাদের সাহায্য আমাদের খুব কাজে লেগেছে। তোমাদের লড়াই করা তো দেখলাম। সত্যিই তোমরা দুঃসাহসী যোদ্ধা। আনগেভিন বলল।

হ্যারি বলল–যুদ্ধে আপনাকে সাহায্য করেছি। এবার আমরা আমাদের দেশের দিকে জাহাজ চালাতে চাই।

না–আনগেভিন বলল–এখনও আমরা রাজধানী ভ্যালেত্তা জয় করতে পারি নি। ভ্যালেত্তা জয় করা পর্যন্ত তোমাদের সাহায্য চাই।

–কিন্তু এসব তো আপনাদের দেশের ব্যাপার–আপনাদের দেশের সমস্যা। এসবের সঙ্গে আমাদের জড়াচ্ছেন কেন। এই যুদ্ধেই আমরা দুই বন্ধুকে হারিয়েছি। হ্যারি বলল।

–ও সব বুঝি না–ভ্যালেত্তা দখলের লড়াইয়ে তোমাদেরও থাকতে হবে। আমরা ভ্যালেত্তা জয় করবো। আমি মাল্টার রাজা হব। তখন তোমরা ছাড়া পাবে তার আগে নয়। আনগেভিন বলল।

হ্যারি একথা ফ্রান্সিসকে বলল। ফ্রান্সিস বলল–এখন আনগেভিনের কথা মানতেই হবে সময় সুযোগ বুঝে পালাবো আমরা। ফ্রান্সিস ওদের ভাষায় বললে।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি দুর্গের ঘরের দিকে এলো। সবাই এগিয়ে এলো কী হবে এখন জানতে। ফ্রান্সিস বলল, ভাইসব–আনগেভিন এখনই আমাদের মুক্তি দিতে রাজি নয়। রাজধানী ভ্যালেত্তা দখল না হওয়া পর্যন্ত আনগেভিনের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে আমাদের থাকতে হবে। লড়াইও করতে হবে।

–আমরা লড়াই করবোনা–আমরা দেশে ফিরে যাবো। শাঙ্কো বলল।কিছু ভাইকিং ও বন্ধু সেটা সমর্থনও করল। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো আনগেভিনকে এসব কথা আমরা না বলেছি। কিন্তু আনগেভিন আমাদের চলে যেতে দেবে না। ও কোনো কথাই শুনতে রাজি নয়।

–আমরা তো এখন বন্দি নই। গভীর রাতে জাহাজ নিয়ে পালাতে পারি। ফ্লেজার বলল। ফ্রান্সিস বলল–ফ্লেজার–এখন যুদ্ধ চলছে। আনগেভিনের সৈন্যরা রাত জেগে ওদের যুদ্ধ জাহাজ পাহারা দিচ্ছে। আমরা জাহাজে চড়ে পালাতে গেলে ওরা কামান দেগে আমাদের জাহাজ ধ্বংস করে দেবে। আমরা তাহলে অনেকেই মারা যাবো। যারা বেঁচে থাকবে তারাও দেশে ফিরে যেতে পারবেনা। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলতে লাগল– আমরা আমাদের অটুট জাহাজ নিয়ে পালাবো ঠিকই তবে সেটা সময় ও সুযোগ বুঝে।

বিকেলের দিকে ফ্রান্সিসরা খবর পেল যে কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে আনগেভিন তার সৈন্যদল নিয়ে স্থলপথে রাজধানী ভ্যালেত্তা আক্রমণ করবে। সৈন্যদলের সঙ্গে ফ্রান্সিসদেরও যেতে হবে।

সেদিন গভীর রাতে দূরে কামানের গোলার শব্দে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস হ্যারি শাঙ্কোদের ডাকল। আস্তে আস্তে সবারই ঘুম ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস বলল–মনে হচ্ছে রাজা পিটারের সৈন্যরা জলপথে লড়াই করতে এসেছে।

ততক্ষণে দুর্গে সাজো সাজো রব পড়ে গেছে। সব সৈন্যরা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে তৈরি হল। দু’তিনজন সৈন্য আনগেভিনের যুদ্ধ জাহাজ থেকে সংবাদ নিয়ে এসেছে–রাজা পিটারের সৈন্যরা তিনটি যুদ্ধজাহাজে এসে আনগেভিনের জাহাজ আক্রমণ করেছে।

ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো তৈরি হও। কামানের গোলা ছুঁড়ে দু’পক্ষই যুদ্ধ করবে। মাঝখান থেকে আমাদের জাহাজটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঐ জাহাজই আমাদের একমাত্র ভরসা। চলো–আমাদের জাহাজটা বাঁচাতে হবে।

শাঙ্কোকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সিস ঘরের বাইরে এলো। দেখল তখন আনগেভিনের সৈন্যরাও ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছে। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো অন্ধকারে উত্তর মুখো দিক ঠিক রেখে চলল। ওদিকেই সমুদ্রতীরে আনগেভিন আর ওদের জাহাজ রয়েছে।

অন্ধকার সমুদ্রতীরে এসে পৌঁছল ওরা। দেখল–আনগেভিনের গোলন্দাজ বাহিনীও ওদের যুদ্ধ জাহাজ থেকে কামানের গোলা ছুঁড়ছে।

ফ্রান্সিস এবার ছুটতে শুরু করে বলল–শাঙ্কো তাড়াতাড়ি চলো। আমাদের জাহাজটা কামানের গোলার হাত থেকে বাঁচাতে হবে। দু’জনেই ছুটতে লাগল।

সমুদ্রতীরে লাগানো কাঠের পাটাতন দিয়ে দু’জনে ওদের জাহাজে উঠে এলো। ফ্রান্সিস ছুটে গেল নোঙরের দড়িটার দিকে। দু’জনে নোঙরের দড়িটা টেনে নোঙর তুলে ফেলল। তারপর একটা লম্বা কাছি নীচের কেবিনঘর থেকে শাঙ্কো নিয়ে এলো ফ্রান্সিসদের নির্দেশে। কাছিটার মাঝামাঝি জায়গাটা জাহাজের মাথায় বাঁধল। ফ্রান্সিস বলল–কাছির মাথাটা কোমরে বাঁধ। এই বলে নিজেও কাছিটা কোমরে বাঁধল। তারপর জাহাজের মাথার কাছ থেকে দু’জনে জলে ঝাঁপ দিল। মারিয়া অন্য ভাইকিং বন্ধুরা জাহাজের রেলিং ধরে দেখতে লাগল–কী করে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো জাহাজটা টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে।

দু’জনে প্রাণপণে কাছি টেনে নিয়ে সাঁতরাতে লাগল। তখনইফ্রান্সিস দেখল অন্ধকার আকাশে আলো ছড়িয়ে দুপক্ষের জাহাজ থেকেই কামানের গোলা ছুটে আসছে। কাছিতে টান পড়ায় ফ্রান্সিসদের জাহাজটা একটু নড়ল ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো সমান টান রাখলো। জাহাজটার মুখ আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগল। ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে ধ্বনি দিল–ওহো হো। শাঙ্কোও ধ্বনি দিল ওহোহো। জাহাজ থেকে বন্ধুরা চিৎকার করে উঠল। এবার ফ্রান্সিসদের জাহাজ আনগেভিনের যুদ্ধ জাহাজ দুটি থেকে অনেকটা সরে এলো। তখনই একটা কামানের গোলা এসে পড়ল আনগেভিনের একটা যুদ্ধজাহাজের পেছন দিকে। পেছনের হালের কাছে আগুন ধরে গেল। ফ্রান্সিসদের জাহাজ তখন বেশদূরে চলে এসেছে। আর কিছুক্ষণ দেরি হলে ঐ আগুন ফ্রান্সিসদের জাহাজেও ছড়িয়ে পড়ত। ভাগ্য ভালো বলতে হবে।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো জাহাজটা আরো দূরে টেনে নিয়ে চলল। ফ্রান্সিস দেখল– আনগেভিনের সৈন্যরা দড়ি বাঁধা কাঠের পাত্রে সমুদ্র থেকে জল তুলে তুলে আগুন নেভাচ্ছে। তখনও আগুন বেশি ছড়ায় নি। জল ঢালারও বিরাম নেই। ফ্রান্সিস বুঝল– আগুন নিভে যাবে। অবশ্য জাহাজের হালের জায়গায় অনেকটাই পুড়ে গেছে।

ওদিকে রাজা পিটারের একটা জাহাজে কামানের গোলায় আগুন লেগে গেছে। রাজা পিটারের সৈন্যরা অনেক চেষ্টা করেও আগুন আয়ত্তে আনতে পারল না। জাহাজটায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। বোধহয় অস্ত্র-ঘরে মজুত কামানের গোলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ল। কামানের গোলাগুলো দুম্ দাম্ ফাটতে লাগল। আকাশে অনেক উঁচুতে আগুনের ফুলকি উড়ল। অরো কয়েকটা গোলা ফাটল। সৈন্যরা জাহাজ থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনে পোড়া জাহাজটার বাকি অংশ জলে ডুবে গেল।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো ওদের জাহাজটা অনেক দূরে টেনে এনেছে তখন। ওদিকে কামান দাগা শেষ হ’ল। ডেক-এ উঠে দু’জনেই শুয়ে পড়ল। দু’জনেই ভীষণ হাঁপাচ্ছে তখন। মারিয়া আর অন্য বন্ধুরা ছুটে এলো। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে মারিয়াকে বলল– একটু বিশ্রাম পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ফ্রান্সিস নিজের কেবিনঘরে ঢুকলো। ভেজা পোশাক ছেড়ে শুকনো পোশাক পরল। শাঙ্কো নিজের কেবিনঘরে এলো। দুজনেই একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ল। তখন রাত শেষ হয়ে এসেছে। মারিয়া আর ঘুমলো না। ফ্রান্সিসের শিয়রে বসে রইল।

সকাল হতেই রাজা পিটারের সৈন্যরা তাদের দু’টো জাহাজ থেকে নেমে আসতে লাগল। তাদের একটা জাহাজ তো গতরাতে পুড়ে গেছে। তাদের সেনাপতি মান্দোর নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী চলল সেন্ট অ্যাঞ্জেলো দুর্গ অধিকার করতো। কিছু সৈন্য চলল—আনগেভিনের একটা যুদ্ধ জাহাজ দখল করতে।

ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি ডেক-এ উঠে এলো। দেখল–যুদ্ধ শুরু হতে দেরি নেই। শাঙ্কো উঠে এলো। ফ্রান্সিস বলল–চলো–টেনে জাহাজটাকে ডাঙার, কাছে নিয়ে যাই।

দুজনেই দাঁড়ঘরে নেমে এলো।দাঁ ড় বাইতে লাগল। একটু পরেই জাহাজটা তীরভূমির খুব কাছে এলো।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো কাঠের পাটাতন পেতে জাহাজ থেকে মাটিতে নেমে এলো। তারপরই ছুটল দুর্গের দিকে।

ততক্ষণে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আনগেভিনের সৈন্যরা দুর্গের সামনের ময়দানে যুদ্ধ করছে রাজা পিটারের সৈন্যদলের সঙ্গে। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। উৎসাহব্যঞ্জক ধ্বনি চিৎকার, আহতের আর্তনাদে জায়গাটা ভরে উঠেছে।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো সমুদ্রতীর থেকে দুর্গের কাছে এলো। দুর্গের পেছন ফিরে ঘুরে এসে ওরা আনগেভিনের সৈন্যদলের সঙ্গে যোগ দিল।

যুদ্ধ চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিস বুঝল রাজা পিটারের এই সেনাবাহিনী দুর্ধর্ষ। ওরা যুদ্ধে নিপুণ।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দেখা গেল আনগেভিনের সেনাবাহিনী দুর্গের দিকে পিছুহটছে। তাদের মধ্যে অনেকেই আহত। মারাও গেছে অনেক। রাজা পিটারের সৈন্যরা সমান চাপ রেখে লড়াই চালাতে লাগল।

হারের মুখে এসে দাঁড়াল আনগেভিনের সৈন্যদল। ওরা রণক্ষেত্র থেকে পালাতে লাগল। অনেকেই পিছিয়ে দুর্গে আশ্রয় নিতে লাগল।

এক সময় লড়াই করতে করতে বিস্কো ফ্রান্সিসদের পাশে এলো। তলোয়ার চালাতে চালাতেই বলল–ফ্রান্সিস, দুর্গের পেছনের দরজা দিয়ে আনগেভিন পালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সমুদ্রতীরে পৌঁছবার আগেই আনগেভিন ধরা পড়েছে। এখন সে সেনাপতি মান্দোর হাতে বন্দি। কথাটা শুনেই ফ্রান্সিস তলোয়ার চালানো বন্ধ করল। চিৎকার করে বলল– বন্ধুরা-ভাইসব অস্ত্রত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্রের একপাশে দু’হাত তুলে দাঁড়াও। এখৰ আমাদের লড়াই করা অর্থহীন। আমরা বন্দিত্ব মেনে নেব।

ফ্রান্সিসের বন্ধুরা সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার মাটিতে ফেলে দিল। বর্ম শিরস্ত্রাণও মাটিতে ফেলে দিল। তারপর ফ্রান্সিসের নির্দেশে দু’হাত ওপরে তুলে রণক্ষেত্র থেকে সরে এলো।

পিটারের সৈন্যরা তুমুল চিৎকার ধ্বনি তুলে দুর্গের দিকে ছুটে গেল। দলে দলে সৈন্যরা দুর্গৰ্টায় ঢুকতে লাগল। আনগেভিনের সৈন্যদের বন্দি করতে লাগল।

যুদ্ধ শেষ। আনগেভিনের যে সৈন্যরা দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিল তারাও হার স্বীকার করল।

ফ্রান্সিসদেরও রাজা পিটারের সৈন্যরা বন্দি করল। ওদের নিয়ে চলল দুর্গের মধ্যে। ওদের হাত বেঁধে দুর্গের চত্বরে বসিয়ে রাখা হল। ওদিকে আনগেভিনের সৈন্যদের দুর্গের ঘরে ঘরে ঢুকে মান্দোর সৈন্যরা বন্দি করতে লাগল।

এভাবে বসে থাকাটা ফ্রান্সিসের কাছে অপমানজনক মনে হল। ও হ্যারিকে বলল রাজা পিটারের সেনাপতিকে গিয়ে বলল যে আমরা ভাইকিং। আনগেভিন আমাদের জাহাজ ডুবিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে তার দলের সঙ্গে আমাদেরও যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করেছে। হ্যারি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। সেনাপতি মান্দার একজন সৈনিককে বলল– আমরা সেনাপতির সঙ্গে কথা বলতে চাই।

–সেনাপতি মান্দো এখন বিশ্রাম করছেন। সৈন্যটি বলল।

ঠিক আছে। তুমি মান্দোকে গিয়ে বলো আমরা ভাইকিং। আমরা এখানকার লোক নই। বিশেষ প্রয়োজনে তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। হ্যারি বলল।

-বেশ-বলে দেখছি। সৈন্যটি চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে সৈন্যটি ফিরে এলো। বলল–তোমারাই তো ভাইকিং?

–হ্যাঁ হ্যারি বলল।

–সেনাপতি তোমাদের দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন। সৈন্যটি বলল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি উঠে দাঁড়াল। হাত বাঁধা অবস্থাতেই সৈন্যটার পেছনে পেছনে চলল। যেতে যেতে দেখল–যুদ্ধ শেষ। আহত সৈন্যরা গোঙাচ্ছে। আর্তনাদ করছে। আনগেভিনের জীবিত সব সৈন্যই বন্দি হয়েছে। দুর্গের চত্বরে সারি দিয়ে বসে আছে।

দুর্গের সবচেয়ে ভালো ঘরটাতে পালকের বিছানায় সেনাপতি মান্দো বসে আছে। ফ্রান্সিস আর হ্যারি মান্দার সামনে এসে দাঁড়াল। মান্দো বলল–শুনলাম তোমরা ভাইকিং–বিদেশি। আনগেভিনের সৈন্যদের হয়ে তোমরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল কেন?

–নিরুপায় হয়েই আমাদের যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছে। আনগেভিন আমাদের বন্দি করেছিল আমাদের জাহাজ আটক করেছিল। আমাদের ভয় দেখিয়েছিল যে তার সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমরা যদি রাজা পিটারের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করি তাহলে কামান দেগে আমাদের জাহাজ ধ্বংস করে দেবে। আমাদের জীবন বাঁচাতে জাহাজ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছি, তা নইলে এই যুদ্ধে আমাদের কী লাভ? আমরা যুদ্ধ চাই না–শান্তি চাই। হ্যারি বলল।

-বুঝলাম–মান্দো বলল কিন্তু উপায় নেই। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছো কাজেই তোমাদের বন্দি হয়েই থাকতে হবে। কাল সকালে রাজা পিটার এখানে আসবেন। তিনি তোমাদের ব্যাপারে যা করতে চান করবেন। আমি কিছু করতে পারবো না।

–বেশ। তাহলে তো আমাদের আনগেভিনের সৈন্যদের মতোই বন্দি হয়ে থাকতে হবে। হ্যারি বলল।

-হ্যাঁ। কাল আনগেভিনের বিচার হবে। সঙ্গে তোমাদেরও বিচার হবে। রাজা তৃতীয় পিটার যা বিচার করবেন তাই হবে। মান্দো বলল।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি নিজেদের জায়গায় ফিরে এলো। হ্যারির বন্ধুদের জানাল সেনাপতি মান্দোর সঙ্গে কী কথাবার্তা হয়েছে। সবাই বুঝল রাজা পিটার এখন যা বলবেন তাই হবে।

রাত হল। বন্দিদের খেতে দেওয়া হল। হাত বাঁধা অবস্থাতেই সবাইকে খেতে হল।

খাওয়াদাওয়ার পর ফ্রান্সিস মাথার পেছনে দুহাত রেখে পাথুরে চত্বরে শুয়ে পড়ল। হ্যারিও আধশোয়া হল। ফ্রান্সিস একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হল যে মারিয়া জাহাজেই আছে। এই বন্দিদশা মারিয়া সহ্য করতে পারতো না।

ফ্রান্সিস খোলা আকাশের দিকে তাকাল। ভাঙা চাঁদ। জ্যোৎস্না অনুজ্জ্বল। তারা জ্বলছে। ফ্রান্সিসের ভাবনার শেষ নেই। রাজা পিটার ওদের নিয়ে কী করবেন কে জানে। যদি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার অপরাধে ওদের কয়েদখানায় বন্দি করে রাখে তাহলে বিপদ। জাহাজে মারিয়া রয়েছে–যে বন্ধুরা অস্ত্রশস্ত্র পায় নি বলে যুদ্ধে যোগ দেয় নি তারা রয়েছে। ফ্রান্সিসরা বন্দি হলে ওরা দিশেহারা হবে–যেভাবে হোক সবারইমুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে ফ্রান্সিসের দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলো।

শেষরাতে একটা শিরু শি ঠাণ্ডা হাওয়ায় ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। বেশ শীত শীত করতে লাগল।

আর ঘুম আসছে না। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাই ফ্রান্সিসের বাড়ির কথা মনে হল। কোথায় সাদা ধগ্ধপে পালক-নরম বিছানা বালিশ সাজানো ঘর। জানালায় হালকা নীল পর্দা আর কোথায় এই দুর্গের পাথুরে চত্বর। পিঠের হাড়ে ব্যথা হয়ে গেছে–মাথার পেছনেও ব্যথা। বাকি রাতটুকু ফ্রান্সিসের আর ঘুম এলো না।

সকালে দুর্গে মান্দোর সৈন্যদের মধ্যে সাজো সাজো রব। রাজা পিটারের শৌখিন জাহাজ নাকি আসতে দেখা গেছে। সৈন্যরা সব দুর্গের বিরাট কাঠের সদর দরজার সামনে সার বেঁধে দাঁড়াল। এক সারি সৈন্যের হাতে বর্শা। পেতলের বর্শায় সূর্যের আলো পড়ে ঝলকাচ্ছে।

একটু বেলায় রাজা পিটার একটা সাদা ঘোড়ায় চেপে এলেন। ঘোড়ার গায়ে মাথায় নানা রঙের সাজ। রাজা পিটারের মাথায় মুকুট নেই। পোশাক লাল রঙের জোব্বামতো। তাতে সোন রুপোর সুতোর কাজ করা। রাজা পিটারের বয়েস বেশি নয়। মুখে গোঁফ থুতনিতে অল্প দাড়ি।

রাজা পিটারের পেছনে পেছনে এলো রাজার দেহরক্ষীর দল। তাদের পরনে বিচিত্র রঙদার পোশাক।

রাজা পিটারকে দেখে সৈন্যরা জয়ধ্বনি করল। রাজা সদর দেউড়ি দিয়ে সৈন্যদের মাথা নিচু করে অভিবাদন নিতে নিতে দুর্গে ঢুকে গেলেন। সেই পালকের বিছানা পাতা ঘরে গিয়ে রাজা বসলেন।

একটু পরেই হাত বাঁধা অবস্থায় আনগেভিনকে রাজার কাছে আনা হল। রাজা আনগেভিনকে বললেন–বেশ তো সিলিলিতে ধর্মকর্ম নিয়ে ছিলেন। হঠাৎ মাল্টার রাজা হবার শখ হল কেন?

–আপনার শাসনে সিসিলি জেনোয়ার যেসব লোক এখানে আছে তারা ক্ষুব্ধ। তারাই আপনাকে হারিয়ে মাল্টার রাজা হতে আমাদের ডেকে এনেছে। আনগেভিন বলল।

–এখন রাজা হওয়ার বদলে কয়েদঘরে পচতে হবে। রাজা হেসে বললেন। জেনে রাখুন–মাল্টার উচ্চবংশীয় মানুষেরা কিন্তু আমার বশ্যতা স্বীকার করেছে। তারা চায় আমিই যেন রাজা থাকি আর মাল্টাবাসীদের কল্যাণ করি। একটু থেমে রাজা বললেন এই আনগেভিনকে কয়েদঘরে আটক করে। তার আগে ওর পিঠে কুড়িবার চাবুক মারবে।

আনগেভিনকে নিয়ে সৈন্যরা চলে গেল।

অন্য সৈন্যদের সম্বন্ধে রাজা পিটার আদেশ দিলেন–এখানকার কয়েদঘরে যতজন আঁটে ততজনকে বন্দি করে রাখে।! বাকিদের আনজুতে নিয়ে যাও। ওখানকার কয়েদঘরে বন্দি করে রাখবে।

রাজার বিচার শেষ হল। তখন সেনাপতি মান্দো এগিয়ে এসে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল–একদল বিদেশি আনগেভিনের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তাদের কী করা হবে।

তাদের কাউকে নিয়ে এসো। সব, শুনি আগে। রাজা বললেন। মান্দো একজন সৈন্যকে পাঠালো ফ্রান্সিসদের ডেকে আনতে।

কিছুক্ষণ পরে হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সিস এলো। দু’জনেই মাথা একটু নুইয়ে নিয়ে শ্রদ্ধা জানাল। রাজা পিটার বললেন–শুনলাম তোমরা ভাইকিং। আনগেভিনের সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।

হ্যারি বলল–আমরা যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছি

–কেন? রাজা পিটার বললেন।

কারণ আনগেভিনের সৈন্যরা কিছুদিন আগে গভীর রাতে আমাদের জাহাজ দখল করেছিল। আনগেভিন সেন্ট অ্যাঞ্জেলো মানে এই দুর্গ অধিকার করতে আসছিল। আমাদের বলল তার সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে এই দুর্গ অধিকার করতে আমরা যেন সাহায্য করি। হ্যারি বলল।

–তোমরা অস্বীকার করলেই পারতে। রাজা পিটার বললেন।

–আমরা সে কথা বলেছিলাম। হ্যারি বলল।

–আনগেভিন কী বলল। রাজা পিটার জানতে চাইলেন।

–আনগেভিন বলেছিল মানে আমাদের ভয় দেখিয়েছিল–আমরা যুদ্ধে যোগ না দিলে সে কামান দেগে আমাদের জাহাজ ডুবিয়ে দেবে। হ্যারি বলল।

-সেই ভয়েই তোমরা আনগেভিনের সৈন্যদের সঙ্গে এসে যুদ্ধ করেছিল।

–এবার বলো তো তোমরা এই ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে এসেছ কেন? রাজা পিটার বললেন।

–এ কথার উত্তর আমার বন্ধু ফ্রান্সিস স্পেনীয় ভাষায় দেবে। আমার বন্ধুটি গ্রীক ভাষা জানে না। এই বলে হ্যারি ফ্রান্সিসকে দেখাল। রাজা পিটার এবার স্পেনীয় ভাষায় ফ্রান্সিসকে বললেন–বলো–তোমার কী বলার আছে। ফ্রান্সিস বলতে লাগল–আমরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি। কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাছাড়া কোথাও কোনোরকম গুপ্তধন গুপ্ত ঐশ্বর্যের সংবাদ পেলে আমরা তা উদ্ধার করি। সেইজন্যই এই অঞ্চলে আসা।

–এরকম গুপ্তধন উদ্ধার করতে পেরেছো? রাজা পিটার বললেন।হ্যারি বললেন– অনেক ধন-সম্পদ আমার এই বন্ধু উদ্ধার করেছে।

–গুপ্তধন উদ্ধার করে নিজেদের দেশে নিয়ে যাও। এতে একরকম চুরি ডাকাতিই বলা যায়। রাজা পিটার বললেন। ফ্রান্সিস বললেন–আপনি এটুকু বিশ্বাস আমাদের করতে পারেন যে আমরা চোর ডাকাত নই। যত গুপ্তভাণ্ডার খুঁজে বের করেছি সবই যাদের প্রাপ্য তাদেরকেই দিয়েছি। নিজেরা একটা রুপোর মুদ্রাও নিইনি। হ্যারি বলল– আমার বন্ধু ফ্রান্সিস চিন্তা করে বুদ্ধি খাঁটিয়ে গুপ্তসম্পদ উদ্ধার করেছে।

রাজা পিটার একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন–আমাদের এই মাল্টাতেও একটা গুপ্তধন ভাণ্ডারের কথা আমরা জানি। সেই গুপ্তধন ভাণ্ডার আজ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। তোমরা উদ্ধার করতে পারবে? ফ্রান্সিস বলল সব ঘটনা জেনে এবং কোথায় থাকতে পারে সেটা সেই জায়গায় গিয়ে জেনে তবেই বলতে পারবো সেই গুপ্তধনভাণ্ডার উদ্ধার করা যাবে কিনা। আপনি আগে ঘটনাটা বলুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *