চার্লসের স্বর্ণসম্পদ – ২

রাত শেষ হয়ে এসেছে। শাঙ্কো ওপরে আকাশের দিকে তাকাল। দেখল আকাশ সাদাটে হয়ে আসছে। সূর্যোদয়ের বেশি দেরি নেই।

একটু পরেই সূর্য উঠল। আলো ছড়ালো সৈন্যদের ছাউনিতে বন্দি শিবিরে। ওপাশের জঙ্গলে পাখির ডাক শুরু হল।

শাঙ্কো সৈন্যদের ছাউনিতে এ-ঘর ও-ঘর দেখতে লাগল। সব ঘরেই সৈন্যদের সংখ্যা বেশি। পশ্চিম দিকে একটা ছোট্ট ঘর দেখল। কাছে এগিয়ে এলো। ঘরটায় মাত্র একজন সৈন্য আছে। শাঙ্কো ঐ ঘরটাই বেছে নিল। ঘরে আর একটা খালি লোহার খাট।

শাঙ্কো ঘরটায় ঢুকল। দেখল সৈন্যটি ঠিক তখনই ঘুম ভেঙে উঠে বসল। সৈন্যটি হাই তুলতে তুলতে শাঙ্কোকে দেখতে পেল। তারপর গ্রীক ভাষায় শাঙ্কোকে বলল–ভাই তুমি কি কাউকে খুঁজছো?’ শাঙ্কো হাসল। আঙ্গুল দিয়ে মুখ গলা দেখিয়ে আবার হাসল।

ও বোবা কালা। সৈন্যটি বলল। শাঙ্কো হাত দিয়ে জল খাওয়ার ইঙ্গিত করল। সৈন্যটি বুঝল জলতেষ্টা পেয়েছে লোকটার। ও ঘরের কোণায় রাখা মাটির পাত্র দেখাল। শাঙ্কো গিয়ে জল খেয়ে এলো।

সৈন্যটি চুপ করে বসে রইল। শাঙ্কোর সঙ্গে আর কী কথা বলবে। তবু হাত নেড়ে ইঙ্গিতে জানতে চাইল বোবা কালা লোকটা কোন্ দেশের কোত্থেকে এসেছে। শাঙ্কোও হেসে আঙ্গুল নেড়ে বোঝাল ও এই দেশেরই লোক। সৈন্যটি কী বুঝল কে জানে। সে চুপ করে রইল। এবার শাঙ্কো খালি লোহার খাটটা দেখিয়ে ইঙ্গিতে বোঝাল এ খাটে সে শুতে চায় থাকতে চায়। সৈন্যটি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল।

সৈন্যটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শাঙ্কো তখন খালি খাটেই শুয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে। কত রাত জাগতে হয়েছে। সারা শরীরে হাতে পায়ে কাঁটাতারের খোঁচা। সেসব ঢাকতে শাঙ্কো হাত দুটো খোলা জামার পকেটে রাখল। সৈন্যটির নজরে পড়লে নিশ্চয়ই জানতে চাইবে কী করে কাটল।

কিছুক্ষণ পরে সৈন্যটি খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল। দু’জনের খাবারই এনেছে। ঘুমন্ত শাঙ্কোকে ডাকতে গিয়ে দেখল শাঙ্কোর কাটা ছেঁড়া হাত। ও খাবারটা শাঙ্কোর বিছানাতেই রাখল। নিজেও খেল না। শাঙ্কোর ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে শাঙ্কোর ঘুম ভাঙল। ও উঠে বসল। একটু সময় গেল বুঝতে যে ও এখন কোথায় আছে। সৈন্যটিকে দেখে বুঝল সব। সঙ্গে সঙ্গে ও হাত দুটো পকেটে পুরল। সৈন্যটি হেসে বলল–ঐ কাটা ছেঁড়া দাগ কি সবসময় পকেটে ঢেকে রাখতে পারবে? শাঙ্কো বোকার হাসি হাসল। সৈন্যটি ওর খাবার দেখিয়ে বলল–এবার তো হাত বের করতে হবেই। শাঙ্কো হেসে একবার মাথা ঝাঁকিয়ে নিয়ে খেতে লাগল। খেতে খেতে সৈন্যটি শাঙ্কোকে ইঙ্গিতে বোঝাল-তোমার হাত মুখ এরকমভাবে কেটে ছড়ে গেল কেন?শাঙ্কো গাছে চড়ার ইঙ্গিত দিয়ে বোঝাল গাছে উঠতে গিয়ে হাত মুখ কেটে ছড়ে গেছে। সৈন্যটি মাথা নেড়ে বোঝাল ও বুঝতে পেরেছে। সৈন্যটি বেরিয়ে গেল। শাঙ্কো আবার ঘুমিয়ে নিল।

ওদিকে খোলা আকাশের নীচে বন্দিশিবিরে ফ্রান্সিসরা ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে গেল। জল বেশি জমে নি। পুবদিকে ঢাল বেয়ে বৃষ্টির জল চলে গেছে। তবু মাটি তো ভেজা। ফ্রান্সিসরা ভেজা মাটিতেই শুয়ে বসে রইল। ফ্রান্সিসদের এরকম অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে। বন্ধুরাও খুব একটা কাবু হয়নি। কিন্তু মারিয়া দুহাত বুকের কাছে নিয়ে জড়সড় হয়ে বসে রইল।

ফ্রান্সিস উঠে গিয়ে ওর জামাটা খুলে ফেলল। ভেজা জামাটা দিয়ে মারিয়ার মাথা মুখ হাত পা মুছে দিতে লাগল।বিস্কো হ্যারিও জামা খুলে মারিয়ার মাথা হাত পা মুছিয়ে দিল। মারিয়ার শরীর একটু শুকোল। আগের ঠাণ্ডা ভাবটা আর রইল না।

সকালের খাবার খাওয়া হয়ে গেছে। কাঁটাতার আর কাঠে তৈরি দরজা দিয়ে দলপতি সিক্কা ঢুকল। হেসে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল–কাল রাতে তোমাদের খুব অসুবিধে হয়েছে তাই না? আমার বন্দিশিবিরটা এমনি। মাথার ওপরে খোলা আকাশ।

দলপতি সিক্কা এবার মারিয়ার দিকে তাকাল। মুখে চুকচুক শব্দ করে বলল–আহা একে তোরা অন্য জায়গায় নিয়ে গেলি না কেন। দ্যাখ তো কী অবস্থা হয়েছে চেহারার। বেচাকেনার হাটে তো দাম পড়ে যাবে। একে অন্দরমহলে নিয়ে যা। চানটান করে নতুন পোশাক পরুক।

একজন পাহারাদার মারিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়াল। বলল– উনি আমাদের দেশের রাজকুমারী।

–তাহলে তো আরো ভালো। রাজকুমারী বলে কথা। সিক্কা হেসে বলল।

-আমি যাবো না। মারিয়া গলা চড়িয়ে বলে উঠল। ফ্রান্সিসও বলে উঠল–না– রাজকুমারীকে নিয়ে যেতে দেব না।

হ্যারি উঠে দাঁড়াল। বলল ফ্রান্সিস বাধা দিও না। এই নরককুণ্ডে রাজকুমারী আর একদিনের জন্যে থাকলেও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তাতে আমাদের সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। অন্দরমহলে গিয়ে স্নান করে শুকনো পোশাক পরলেই রাজকুমারী সুস্থ থাকবেন। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বসে পড়ল। আর কোনো কথা বলল না। মারিয়া মাথা নেড়ে বলে উঠল–না আমি যাবো না। হ্যারি বলল রাজকুমারী আপনি আমাদের সকলের বিপদ ডেকে আনবেন না। আপনি যান। আপনি সুস্থ থাকুন এটাই আমরা চাই।

মারিয়া ফুঁপিয়ে উঠল। তারপর পাহারাদারদের সঙ্গে চলে গেল। দলপতি সিক্কাও বেরিয়ে গেল। ফ্রান্সিসরা চুপ করে বসে রইল।

ওদিকে সৈন্যটি শাঙ্কোকে নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে গেল। শাঙ্কোর গায়ে সিক্কার সৈন্যদের পোশাক। কাজেই কেউ সন্দেহ করল না। শাঙ্কো বোবা কালার অভিনয় করতে লাগল।

খেয়েটেয়ে শাঙ্কো এবার চলল সমুদ্রতীরের দিকে। যেখানে ওদের জাহাজটা রয়েছে শাঙ্কো সেখানে এলো। জাহাজ থেকে পার অব্দি পাতা কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে জাহাজে উঠল।

বন্ধুরা ছুটে এলো। সবাই জানতে চায় ফ্রান্সিসদের কথা। শাঙ্কো সকলের দিকে তাকিয়ে একে একে সব ঘটনা বলে গেল।

ফ্লেজার বলল–এখন কী করবে?

–দলপতি সিক্কা ফ্রান্সিসদের ক্রীতদাসের হাটে বিক্রির জন্যে তুলবেই। এখন পালানোর কথা ভাবতে হবে। কীভাবে ফ্রান্সিসদের মুক্ত করা যায়–এসব ভাবতে হবে। তার ব্যবস্থা করতে হবে। শাঙ্কো বলল।

–তুমি এখন কী করবে? ফ্লেজার বলল।

–আমি আজকের রাতটা জাহাজেই থাকবো। শাঙ্কো বলল। তারপর গায়ের পোশাকটা খুলে ফেলল। দেখা গেল ভেতরে ওদের পোশাকটাও ছিঁড়ে গেছে। বুকে পিঠে রক্তের দাগ। হাতেই সবচেয়ে দাগ বেশি। তখনও অনেক ক্ষতে রক্ত জমে আছে।

শাঙ্কো চারদিকে তাকিয়ে ভেনকে খুঁজল। ভেন এখানে নেই। শাঙ্কো ভেনের কাছে যাবে বলে এগোচ্ছে তখনই দেখা গেল ভেন ওর ওষুধপত্রের থলে নিয়ে আসছে। ভেন সকলের দিকে তাকিয়ে বলল-”তোমরা শাঙ্কোকে বিরক্ত করো না। ওর এখন বিশ্রাম প্রয়োজন।

সবাই চলে গেল। কয়েকজন রইল। ওরা চুপ করেই রইল।

ভেন শাঙ্কোকে বলল জামা খুলে ফেল। শাঙ্কো ওদের দেশীয় পোশাকটা খুলে ফেলল। এবার ভেন বলল-নড়াচড়া করো না।

ভেন থলে থেকে দুটো কাঁচের বোয়াম বের করল। বোয়াম দুটো রেখে থলে থেকে পরিষ্কার ন্যাকড়া বের করল। তারপর দুটো বোয়ামেরই ওষুধে ন্যাকড়াটা ভিজিয়ে নিয়ে শাঙ্কোর কাটাছেঁড়া জায়গায় ওষুধ লাগাতে লাগল। এবার দেখা গেল শাঙ্কোর শরীর হাত পা কাটাতারের খোঁচায় কীভাবে কেটে গেছে। ভেন বারকয়েক ওষুধটা লাগাল। তারপর বলল–এখন পোশাক খুলেই রাখো। যাও শুয়ে পড়ো গে।

শাঙ্কো আস্তে আস্তে উঠে নিজের কেবিনঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। জ্বালা যন্ত্রণা কমল অনেকটা।

সেই রাতটা শাঙ্কো জাহাজেই রইল।

পরদিন সকালেই সকালের খাবার খেয়ে চলল বন্দিশিবিরের দিকে। তার আগে দলপতি সিক্কার সৈন্যদের পোশাকটা পরে নিল। এখন এই পোশাকটাই ভরসা। সিক্কার সৈন্যদের চোখে ধূলো দেওয়ার এটাই বড়ো অস্ত্র।

অল্পক্ষণ পরেই শাঙ্কো বন্দিশিবিরের কাছে এলো। দেখল এর মধ্যেই বন্দিশিবিরের বাইরে লোকজন জমে গেছে।

বন্দিশিবিরের পাশেই একটা পাথরের মঞ্চমতো। তার মাঝখানে একটা গোল কাঠের থামমতো। তাতে দড়ি বাঁধা। সামনেই একটা পাথরের আসনমতো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দলপতি দু’জন বৃদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে এলো। বৃদ্ধ দু’জন বোধহয় তার পরামর্শদাতা।

একজন সৈন্যের পাহারায় মারিয়াকে আনা হল। মারিয়ার পোশাক এখন এ দেশীয় মেয়েদের মতো পা পর্যন্ত ঢাকা ঢোলা জামা। মারিয়াকে সৈন্যটি বন্দিশিবিরে ঢোকাল।

ফ্রান্সিসরা এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিস মারিয়ার মুখ চোখ দেখেই বুঝল মারিয়া রাত্রে ঘুমোয় নি। ফ্রান্সিস বললতোমার শরীর ভালো তো? মারিয়া মাথা কাত করল।

তখনও ক্রীতদাসের মঞ্চে ভোলা হয়নি।শাঙ্কো চারদিকে নজর রেখে ঘুরতে লাগল। শাঙ্কোর পরনে সিক্কার সৈন্যদের পোশাক। কাজেই কেউ সন্দেহ করল না।

শাঙ্কো উত্তর দিকের ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে একটা বিরাট চেস্টনাট গাছ দেখতে পেল। শাঙ্কো তাড়াতাড়ি সেদিকে গেল। ঝোঁপজঙ্গল সরিয়ে এগিয়ে গেল। চেস্টনাট গাছটা দেখল। তারপর ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আরো এগোল। দেখলো ওখানে একটা খাদমতো। খাদের পরেই সবুজ ঘাসে ঢাকা উপত্যকা। সঙ্গে সঙ্গে শাঙ্কোর পালানোর উপায় ভাবা হয়ে গেল। ও দ্রুত ছুটল সমুদ্রতীরের দিকে। ওদের জাহাজে এলো। তখন শাঙ্কো মুখ হাঁ করে হাঁপাচ্ছে।

ফ্লেজার এগিয়ে এলো। বলল–কী ব্যাপার শাঙ্কো?

–ফ্রান্সিসদের পালাবার উপায় বের করেছি। তুমি শিগগিরি আমাকে বেশ লম্বা মোটা কাছি দাও। ফ্লেজার ছুটে গেল ওদের কাঠ দড়ি কপিকল এসব রাখবার ঘরের দিকে।

কাছি নিয়ে ফ্লেজার একটু পরেই এলো। শাঙ্কো কাছিটা কোমরে বুকে পাচালো। তারপর চলল বন্দি শিবিরের দিকে।

বন্দি শিবিরের সামনে পৌঁছে দূর থেকেই দেখল আটজন ডাকাত মূরকে সেই পাথরের বেদীতে তোলা হয়েছে। শাঙ্কো লক্ষ্য করল–মূরদের হাত পা বাঁধা হয় নি। শাঙ্কো অস্ফুট স্বরে বলে উঠল–ও-হো-হো। তাহলে ফ্রান্সিসদের হাত পা বাঁধা হবে না।

শাঙ্কো একটু দূরে দূরে থেকে জঙ্গলটায় ঢুকল। চেস্টনাট গাছের গুঁড়ির সঙ্গে কাছিটার একটা মুখ বাঁধল। তারপর বাকি কাছিটা খাদে ঝুলিয়ে দিল। তারপর ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। দেখল অনেক লোক জড়ো হয়েছে।

তখনই ফ্রান্সিসদের আনা হল। সঙ্গে মারিয়া। ফ্রান্সিসদের হাত পা বাঁধা নয়। খুশিতে শাঙ্কোর মন নেচে উঠল। ফ্রান্সিসদের পাথরের বেদীর পাশে দাঁড় করানো হল। ফ্রান্সিস তখন ভাবছে–এইভাবে ক্রীতদাসের জীবন মেনে নেবে?কিন্তু ও তো নিরুপায়।সিক্কার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামা যেত। কিন্তু তাতে বেশ কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু মারা যেত। মারিয়াকে নিয়ে পালানো যেত না।ফ্রান্সিসের এই আশঙ্কার মধ্যেও ক্ষীণ আশা শাঙ্কো মুক্ত আছে। ও যদি কোনো উপায় বের করে।

শাঙ্কো সিক্কার সৈন্যদের পোশাক পরে বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। ফ্রান্সিসদের পেছন দিয়ে যাওয়া-আসা করতে লাগল আর মৃদুস্বরে ওদের দেশীয় ভাষায় বলে যেতে লাগল–উত্তরে জংলার কাছে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে বিরাট চেস্টনাট গাছ। গাছের গুঁড়িতে আমি কাছি বেঁধে রেখেছি। কাছি ধরে ঝুলে নীচে উপত্যকায় নেমে যাব। তারপর সমুদ্রতীরের দিকে ছুটবে। জাহাজে উঠবে।

এবার রাজকুমারী মারিয়াকে দু-তিনজন সৈন্য হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলো। মারিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলনা-না।তবু সৈন্যরা জোর করে মারিয়াকে নিয়ে আসতে লাগল। তখন অতলোকের গুঞ্জন থেমে গেল। শুধু ফিসফাস শোনা যেতে লাগল রাজকুমারী-রাজকুমারী।

মারিয়া শুধু একবার তাকিয়ে নিল ফ্রান্সিসের দিকে। তারপর আর বাধা দিল না। পাথরের বেদীতে উঠল। কোনোদিকে তাকাল না। শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। কাঠের থামের সঙ্গে মারিয়াকে দড়ি দিয়ে আগা করে বাঁধা হল।

উপস্থিত খরিদ্দারদের মধ্যে দামাদামি শুরু হয়ে গেল।

শাঙ্কো ফ্রান্সিসকে ফিসফিস্ করে বলল–হাত দুটো পেছনে আনন। ফ্রান্সিস পেছনে হাত নিল। শাঙ্কো এর বড়ো ছোরাটা ফ্রান্সিসের হাতে দিয়ে বলল–এবার কাজ হাসিল করো।

ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ছুটল দলপতি সিক্কা যে পাথরের আসনে বসে আছে সেই দিকে। সিক্কার সৈন্যরা কিছু বোঝবার আগেইফ্রান্সিস সিক্কার গলায় ছোরা চেপে ধরল।দাঁতচাপা স্বরে বলল–তোমার সৈন্যদের বলো এখান থেকে চলে যেতে।

ফ্রান্সিসের এই কাণ্ড দেখে লোকজন সব পালাতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা প্রায় জনশূন্য হয়ে গেল। সিক্কার কিছু সৈন্য তখনও ছিল। ফ্রান্সিস ছোরার চাপ বাড়াল। দলপতি সিক্কা বলল–বলছি–বলছি। এবার সিক্কা গলা চড়িয়ে বলল–সৈন্যরা তোমরা এখান থেকে চলে যাও। সৈন্যরা আর কী করে। দলপতির প্রাণ বিপন্ন। এখান থেকে চলে যেতেই হবে। সৈন্যরা দলবেঁধে চলে গেল।

এবার ফ্রান্সিস বিস্কোকে বলল–বিস্কো রাজকুমারীকে তুমি নিয়ে যাও। তোমরা সকলে চলে যাও উত্তরের ঐ বিরাট চেস্টনাট গাছের কাছে। গাছটায় মোটা কাছি বাঁধা আছে। কাছি ধরে নেমে একটা উপত্যকা পাবে। সেটা ধরে সমুদ্রতীরে জাহাজে চলে যাও।

সব ভাইকিং বন্ধুরা ছুটল চেস্টনাট গাছটার দিকে। বিস্কো বেদীতে উঠল। মারিয়ার গায়ে বাঁধা দড়িটা খুলে ফেলল। তারপর মারিয়াকে পাথরের বেদী থেকেনামিয়ে আনল। শরীরে অসহ্য ক্লান্তি। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–মারিয়া মনে জোর আনো। কাছি ধরে নীচে নামতে পারলেই আমাদের মুক্তি। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। মারিয়া ফ্রান্সিসের কথা শুনে একবার থমকে দাঁড়াল তারপর হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে শরীর ছেড়ে দিয়ে ঘাসে-ঢাকা মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। বিস্কো সঙ্গে সঙ্গে নিচু হয়ে মারিয়াকে তুলে কাঁধে শুইয়ে নিল।বিস্কো যতটা সম্ভব দ্রুত পায়ে ছুটল চেস্টনাট গাছটার দিকে।

বিস্কো যখন কাছিটার কাছে এলো ততক্ষণে বাকি বন্ধুরা কাছি ধরে ধরে নীচের উপত্যকায় নেমে গেছে। বিস্কো নিচু হয়ে কাছিটা ধরল। বলল–রাজকুমারী আমরা মুক্তির দোড়গোড়ায়। যতটা সম্ভব জোরে আমাকে ধরে থাকুন। মারিয়া দুহাত বাড়িয়ে বিস্কোর কোমর ধরে রইল।

বিস্কো আস্তে আস্তে কাছি ধরে নামতে লাগল। একটু হাঁপানো গলায় মারিয়া বলল– ফ্রান্সিস শাঙ্কো ওরা তো এলো না।

–ওদের জন্যে ভাববেন না। এখন শুধু একটাই সমস্যা আপনাকে নিরাপদে জাহাজে নিয়ে যাওয়া। বিস্কো বলল।

বিস্কো হাঁপাতে হাঁপাতে নীচের দিকে তাকাল। দেখল–আর হাত দশেক নামলেই উপত্যকায় নামা যাবে। বিস্কো হাঁপাতে হাঁপাতে উপত্যকায় নেমে এলো।

ওদিকে ফ্রান্সিস তখনও দলপতি সিক্কার গলায় ছোরা চেপে আছে।

শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বলল–এতক্ষণে মারিয়া আর বন্ধুরা উপত্যকায়। নেমে গেছে। ওরা জায়গাটা চেনে না। এইজন্যে আমাকে এখুনি যেতে হবে। একটু থেমে বলল–ফ্রান্সিস চলো–তাড়াতাড়ি।

এবার ফ্রান্সিস দলপতি সিক্কার গলা থেকে ছোরাটা তুলে নিয়ে ছুটল চেস্টনাস্ট গাছের দিকে। দু’জনে গাছটার নীচে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো তুমি আগে নেমে যাও। আমি পরে নামবো। কিন্তু তোমার হাত কাটাছেঁড়া। পারবে কাছি ধরে ধরে নামতে?

–আমি হাত দুটো বেশি কাজে লাগাবো না। দুই হাঁটু দিয়ে কাছি দিয়ে নেমে যাবো। আমার জন্যে ভেবো না।

–বেশ। নামো তবে। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো নামতে শুরু করল। একটু সময় নিয়ে শাঙ্কো উপত্যকায় নেমে গেল।

ফ্রান্সিস এতক্ষণ খোলা তলোয়ার হাতে আট দশজন সৈন্য ছুটে আসছে।

এবার ফ্রান্সিস কোমরে গোঁজা ছোরাটা বের করল। গাছের সঙ্গে বাঁধা কাছিটা পোঁচ দিয়ে দিয়ে অর্ধেকটা কাটল। তারপর সৈন্যরা এসে পৌঁছুবার আগেই কাছি ধরে ধরে ফ্রান্সিস দ্রুত নেমে এলো। দেখল শাঙ্কো পেছনে পেছনে অনেক দূর চলে গেছে।

ওদিকে দু’জন সৈন্য কাছি ধরে নেমে আসতে লাগল। ফ্রান্সিস কাছি ধরে প্রাণপণে হাঁচকা টান দিতে লাগল। অর্ধেক কাটা কাছিটা ছিঁড়ে গেল। সৈন্য দু’জন ছেঁড়া কাছির সঙ্গে ছিটকে পড়ল। নীচের উপত্যকার একটা পাথরের চাঙের ওপর দু’জনে পড়ল। দু’জনেই মারা গেল।

এবার ফ্রান্সিস ছুটল হ্যারি শাঙ্কোদের দলের দিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিস বন্ধুদের কাছে এসে পৌঁছল। সবাই ধ্বনি তুলল–ও হো-হো।

ফ্রান্সিস বললকাছি ছিঁড়ে দিয়ে এসেছি। দু’জন সৈন্য কাছি ছিঁড়ে পড়ে গেছে। কিন্তু ওরা হাল ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না। দলপতি সিক্কার সৈন্যরা জাহাজঘাটা পর্যন্ত ধাওয়া করতে পারে।

মারিয়া মুখ বুজে সহ্য করতে লাগল। ফ্রান্সিস মারিয়ার পাশে এলো। ডান হাতে মারিয়াকে ধরে নিয়ে চলল।

ফ্রান্সিসরা যখন জাহাজঘাটায় পৌঁছল তখন দেখল দলপতি সিক্কার আট দশজন সৈন্য ছুটে আসছে। তাই দেখে ফ্রান্সিসের বন্ধুরা যারা জাহাজে ছিল তারা খোলা তলোয়ার হাতে জাহাজের পাটাতন নিয়ে নেমে এলো। সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লড়াই শুরু হল। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে গলা চড়িয়ে বলল–আমার দলের সবাই জাহাজে উঠে যাও। লড়াই করতে যেও না।

অল্পক্ষণের মধ্যেই দলপতি সিক্কার সৈন্যরা হার স্বীকার করল। আহতদের ফেলে রেখে বাকিরা পালিয়ে গেল।

বিজয়ী ভাইকিংরা আনন্দে ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো। সব ভাইকিংরাই গলায় গলা মেলাল–ও-হো-হো-।

ফ্রান্সিস মারিয়াকে ধরে ধরে কেবিনঘরে নিয়ে এলো। বলল–আর কোনো কথা নয়। এখন শুধু বিশ্রাম। ঘুম পেলে ঘুমিয়ে নাও। রাঁধুনি বন্ধু বলেছে রান্না সারতে দেরি হবে।

ওদিকে ডেক-এ তখন আড্ডা শুরু হয়েছে। শাঙ্কো হাত, পা নেড়ে বাকি ঘটনাটা বলছে।

ভেন ওষুধের থলে নিয়ে এলো। শাঙ্কোকে বলল–চুপ করো–জামাটামা খোল। শাঙ্কো গলা থামিয়ে জামাটামা খুলল। ভেন দেখল শাঙ্কোর হাত থেকে অল্প অল্প রক্ত পড়ছে। ভেন শাঙ্কোর ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দিল। তারপর একটা ঝোলা থেকে একটা ওষুধ আঙ্গুলে তুলে নিয়ে দু-হাতের তেলোয় ঘষে ঘষে তিনটে বড়ি বানালো। শাঙ্কোকে বলল–দিনে একটা করে খাবে। এখন বকবকানি থামিয়ে নিজের কেবিনঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো। তোমার এখন সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার।

শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। চলল নিজের কেবিনের দিকে।

সেদিন শেষ রাতে সমুদ্রে ঘন কুয়াশা পড়েছে। মাস্তুলের মাথায় বসে নজরদার পেড্রো ঐ কুয়াশার আস্তরণের মধ্যে দিয়ে চারদিকে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। একঘেয়েমির জন্যেই বটে–পেড্রোর আবার একটু তন্দ্রা এসেছিল। কতক্ষণ পেড্রো তন্দ্রায় চুলছে জানে না। হঠাৎই সজাগ হয়ে দেখল কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দুটো ফেল্লুকা অর্থাৎ যুদ্ধ জাহাজ ওদের জাহাজের দুধার দিয়ে আসছে। পেড্রো ঘাবড়ে গেলেও ভয় পেল না। জলদস্যুদের জাহাজ নয়। দুটো জাহাজেই সবুজ নীল পতাকা উড়ছে। কিন্তু পেড্রো বুঝে উঠতে পারলো না ফেলুকা দুটোর উদ্দেশ্য কী। ওরা ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আসছে না লড়াই করতে আসছে। পেড্রো চিৎকার করে বলল– ভাইসব সাবধান। ফ্রান্সিসকে বলল দুটো যুদ্ধ জাহাজ আমাদের জাহাজের দুপাশ দিয়ে চলেছে।

ডেক-এ শোয়া দু-তিনজন ভাইকিং এর ঘুম ভেঙে গেল পেড্রোর চিৎকারে। ওরা দেখল ওদের জাহাজকে মাঝখানে রেখে দুটো যুদ্ধ জাহাজ চলেছে একই গতিতে।

কুয়াশার মধ্যে দিয়ে অস্পষ্ট দেখল দুটো জাহাজেই গ্রীক সৈন্যদের মতো বুকে বর্ম মাথায় শিরস্ত্রাণপরা কিছু সৈন্য দুটো জাহাজেরই ডেক-এ ঘোরা ফেরা করছে।

ওরা ছুটল ফ্রান্সিসকে খবর দিতে। একটু পরেই ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে ডেক-এ উঠে এলো। রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়াল দু’জনে। পেছনে আরো কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু। পাশের জাহাজ থেকে একজন সৈন্য গ্রীক ভাষায় জিজ্ঞেস করল–তোমরা কারা? হ্যারি থেমে থেমে গ্রীক ভাষাতেই বলল–আমরা ভাইকিং।

–তোমরা কোথায় যাচ্ছো? সৈন্যটি জিজ্ঞেস করল।

–দেশে ফিরে যাচ্ছি। হ্যারি বলল।

-ঠিক আছে। আমাদের দলপতি আনগেভিন তোমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। তোমরা জাহাজ থামাও। আমরাও জাহাজ থামাবো। সৈন্যটি বলল। হ্যারি ফ্রান্সিসকে সব বুঝিয়ে বলল। ফ্রান্সিস বলল-বলো যে আমরা তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে যেতে চাই। আমরা জাহাজ থামাবো না। হ্যারি বলল সেকথা। সৈন্যটি বলল–তোমরা যদি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করো তাহলে কামানের গোলা ছুঁড়ে তোমাদের জাহাজ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব। হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল কথাটা। ফ্রান্সিস মাথা নীচু করে একটুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল– বলল যে আমরা দলপতির সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমরা জাহাজ থামাবো। হ্যারি সৈন্যটিকে বলল সেকথা। সৈন্যটি বলল–তাহলে আমূরাও জাহাজ থামাচ্ছি।

ফ্রান্সিস ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–পাল নামাও। জাহাজ থামাও। ভাইকিং বন্ধুরা পাল খাটানোর কাঠে উঠল। একে একে পালগুলো গুটিয়ে ফেলল। দাঁড়িদেরও দাঁড় টানা বন্ধ করতে বলা হল।

তিনটি জাহাজই দাঁড়িয়ে পড়ল।

তখন সকাল হয়েছে। যুদ্ধ জাহাজের সৈন্যদের মধ্যে বেশ তৎপরতা দেখা গেল। কিছু পরেই ওদের দলপতি আনগেভিন যুদ্ধ জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। তার পরনে ধর্মযাজকদের পোশাক কালো জোব্বা। মাথায় কালো কাপড়ের ঢাকনা। ফ্রান্সিসরা একটু অবাকই হল। ধর্মযাজক হয়েও আনগেভিন সৈন্য, যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে কোথায় চলেছে?

আনগেভিন দু’জন সৈন্য সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। হ্যারি এগিয়ে গেল। ফ্রান্সিসরা কয়েকজন হ্যারির পেছনে পেছনে এলো। হ্যারি গ্রীক ভাষায় বলল–আমরা ভাইকিং। লড়াই নয় আমরা শান্তি চাই। আনগেভিন বলল আমরা কিন্তু লড়াই চাই। তবে তোমাদের সঙ্গে নয়। তোমরা ভাইকিং। বীরের জাতি। এই যুদ্ধে তামাদের সাহায্য চাই। হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল কথাগুলো। ফ্রান্সিস বলল– বলো যে আমরা দেশে ফিরে যাচ্ছি। কোনো কারণেই কোনো যুদ্ধের সঙ্গে আমরা জড়াবো না। আপনাদের সমস্যা আপনারাই মেটান। হারিআনগেভিনকে বলল সেকথা।

আনগেভিন মাথা নেড়ে বলল–তা হবে না। তোমাদের আমার সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তৃতীয় পিটারের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। কথাটা হ্যারির মুখে শুনে এবার ফ্রান্সিসদের চিন্তা হল। এরপর ফ্রান্সিসদের শেখানো মতো হ্যারি বলতে লাগল।

হ্যারি বলল–দেখতেই পাচ্ছেন আমাদের ঢাল নেই লোহার বর্ম নেই লোহার শিরস্ত্রাণ নেই। রাজা তৃতীয় পিটারের সশস্ত্র যোদ্ধাদের সঙ্গে আমরা লড়বো কী করে।

–তোমাদের ঢাল বর্ম শিরস্ত্রাণ সব দেওয়া হবে। আনগেভিন বলল।

–তা সত্ত্বেও যদি আমরা যুদ্ধ না করি। ফ্রান্সিস বলল। তাহলে কামান দেগে তোমাদের জাহাজ ধ্বংস করা হবে। আনগেভিন বলল। ফ্রান্সিস চিন্তায় পড়ল। ফ্রান্সিস যুদ্ধ জাহাজ দুটো ভালো করে দেখল। দেখল দুটো জাহাজেই কামান বসানো আছে। ইচ্ছে করলেই আনগেভিন ওদের জাহাজ ধ্বংস করতে পারে। ফ্রান্সিস বলল–আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে পরে আপনাকে জানাচ্ছি আমরা কী করবো।

–বেশ। আমি অপেক্ষা করছি। ততক্ষণ তোমাদের জাহাজও অপেক্ষা করবে। আমাদের জাহাজও দাঁড়িয়ে থাকবে। আনগেভিন বলল। তারপর দু’জন সৈন্যের সাহায্যে নিজেদের জাহাজে চলে গেল।

ফ্রান্সিস তখন হ্যারিকেবলল–সব বন্ধুকে ডেক-এ আসতে বলল।মারিয়াও যেন আসে।

সকালের খাওয়া সেরে সবাই ডেক-এ এসে জড়ো হল। ফ্রান্সিস বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে বলতে লাগলভাইসব–আমরা একটা গভীর সমস্যায় পড়েছি। কিছুক্ষণ আগে দুটো জাহাজের অধিকারী ও দলনেতা আনগেভিন আমাদের জাহাজে এসেছিল। সে ধর্মযাজকের পোশাক পরে অথচ যুদ্ধে মানুষের মৃত্যু রক্তক্ষয় চায়। কেন বুঝলাম না। যাহোক কাছেই মাল্টা দ্বীপপুঞ্জ। সেখানকার রাজা এখন তৃতীয় পিটার। তাকে যুদ্ধে হারিয়ে মালটা অধিকার করাই আনগেভিনের উদ্দেশ্য। সে চায় তার দলের হয়ে আমরা লড়াই করি। ফ্রান্সিস থামল।

–তাদের হয়ে আমরা লড়াই করতে যাবো কেন? আমরা এখন দেশে ফিরে যাবো। বিস্কো বলল।

– বিস্কো–ফ্রান্সিস বলল– আমিও ঠিক এই কথাটাই আনগেভিনকে বলেছি। উত্তরে আনগেভিন বলেছে তাহলে সে কামান দেগে আমাদের জাহাজ ধ্বংস করে দেবে। সমস্যাটা এখানেই। দেখতেই পাচ্ছো ওদের যুদ্ধ জাহাজে কামান রয়েছে। কাজেই ওরা ইচ্ছে করলে আমাদের জাহাজ ধ্বংস করতে পারে। ফ্রান্সিস থামল। তারপর বলল–এবার ভাইসব তোমরাই স্থির কর কী করবে। সবাই চুপ করে রইল। এরকম একটা সমস্যায় ওঁদের পড়তে হবে এটা ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি।

শাঙ্কো বলে উঠল– ভাইসব– এই সমস্যার সমাধান ফ্রান্সিস আর হ্যারির ওপর ছেড়ে দাও। ওরা দু’জনে যা বলবে তাই মেনে নাও। শাঙ্কো আর হ্যারির ওপর ছেড়ে দাও। ওরা দু’জনে যা বলবে তাই মেনে নাও। শাঙ্কো হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল হ্যারি তুমি কী বলো? হ্যারি একটু চুপ করে থেকে বলল –ভাইসব –খুবই গভীর সমস্যায় আমরা পড়েছি। আনগেভিনের দলে আমাদের যোগ না দিলে উপায় নেই। দু দুটো যুদ্ধ জাহাজের নজরদারি এড়িয়ে আমরা পালাতে পারবো না। পালাবার চেষ্টা করলেই জাজ সুদ্ধ সবাই আমরা ভীষণ বিপদে পড়বো। ওরা কামানের গোলা ছুঁড়ে আমাদের জাহাজ ধ্বংস করবে। আমরা ভীষণ বিপদে পড়বো। হ্যারি থামল। ফ্রান্সিসকে বলল –ফ্রান্সিস তুমি কী বলে?

ফ্রান্সিস বলল –হ্যারি– আমি তোমার সঙ্গে একমত। আমরা আনগেভিনের পক্ষেই যোগ দেব। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। তবে এই লড়াই আমরা করবো আত্মরক্ষামূলক। কারণ এই লড়াই থেকে আমাদের কোনো লাভ নেই। আনগেভিনের লক্ষ্য তৃতীয় পিটারকে পরাজিত করে মাল্টা দখল করা এবং রাজা হওয়া। এর জন্যে আমরা কেন প্রাণ দিতে যাবো। আমরা যতটা সম্ভব শরীর বাঁচিয়ে লড়াই করবো। ফ্রান্সিস থামল।

হ্যারি সব ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–তাহলে ফ্রান্সিসের প্রস্তাবে তোমরা রাজি। সকলেই চুপ করে রইল। সবাই বুঝতে পারল এ ছাড়া উপায় নেই। দু-দুটো যুদ্ধ জাহাজের পাহারা থেকে ওদের জাহাজ বের করে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শুধু শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস আবার দেশে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে।

ফ্রান্সিস বলল–তা ঠিক– তবে দেশে ফিরে কী হবে। যা ঘটতে যাচ্ছে সেটাও একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আমরা চিন্তা শুধু একটাই–আমাদের কারো যেন প্রাণহানি না ঘটে।

সভা ভেঙে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *