চার্লসের স্বর্ণসম্পদ – ৪

একটু কেশে নিয়ে রাজা পিটার বলতে লাগলেন–খুব বেশিদিনের কথা নয়। বছর পঞ্চাশের আগে–এখান থেকে দক্ষিণদিকে আনজুনামে একটা জায়গা আছে। সেখানে ছিলেন চার্লস নামে একজন ভূস্বামী। পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে চার্লস প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা অলঙ্কারের অধিকারী হয়েছিলেন। সকলেই একথা জানতো কিন্তু কেউ কখনো চোখে দেখে নি। চার্লসের স্ত্রীও জানতেন না। তারা নিঃসন্তান ছিলেন। স্ত্রী আগেই মারা যান। চার্লস পিসায় গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি মারা যান। স্বর্ণমুদ্রা অলঙ্কার তিনি কোথায় রেখে গেছেন তাও তিনি কাউকে বলে যান নি।

–চার্লস কি কোনো সূত্র রেখে যান নি? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–না–কোনো সূত্র রেখে যান নি। নানাভাবে গত পঞ্চাশ বছর ধরেই খোঁজাখুঁজি চলছে। কেউ কোনো সূত্র বের করতে পারেনি। রাজা পিটার বললেন।

–তাহলে আমাকে একবার আনজু যেতে হবে। ঐ জায়গায় খোঁজখবর করে বলতে পিরবো চার্লসের ঐ ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারবো কি না। ফ্রান্সিস বলল।

-ঠিক আছে। এই ব্যাপারে তোমাদের আমি সমস্ত সুযোগ-সুবিধে করে দেব। দেখো–যদি উদ্ধার করতে পারো। রাজা পিটার বললেন।

এই সময় হ্যারি বলল–গ্রীক ভাষায় অভিজ্ঞ একজনকে আমাদের চাই রাজা পিটার তার কাছে-বসা একজন প্রৌঢ় ব্যক্তিতে দেখিয়ে বলল–ইনি সাজ্জিও–পাঁচটা ভাষা ইনি অনর্গল বলতে পারেন লিখতেও পারেন। সারা মাল্টাদ্বীপে সাজ্জিওর মতো ভাষাভিজ্ঞ বিদ্বান কেউ নেই। ফ্রান্সিস আর হ্যারি সাজ্জিওকে মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানাল। সাজ্জিও এতক্ষণ চুপ করে বিছানার একপাশে বসেছিলেন। এবার হেসে তিনিও একটু মাথা ঝোকালেন। ফ্রান্সিস বলল–প্রয়োজনে আমরা সাজ্জিওর সাহায্য নেব।

সাজ্জিও ফ্রান্সিসদের দেশীয় ভাষায় বললেন–আমি আনন্দের সঙ্গে আপনাদের সাহায্য করবো। ফ্রান্সিস আর হ্যারি অবাক। তারা আবার মাথা নুইয়ে সাজ্জিওকে সম্মান জানাল।

এবার ফ্রান্সিস রাজা পিটারকে বলল–আমার বন্ধুরা এখানে বন্দি অবস্থায় রয়েছে। তাদের মুক্তি দিন এই আর্জি জানাচ্ছি।

রাজা পিটার বললেন–এসব পরে ভাববো। আগে চার্লসের গুপ্ত ধনসম্পদ উদ্ধার করো। তারপরে তোমার বন্ধুরা মুক্তি পাবে। রাজা বলেন।

–সমুদ্রতীরে আমাদের জাহাজ রয়েছে। সেখানে আমাদের দেশের রাজকুমারী রয়েছে। কিছু বন্ধুও সেই জাহাজে রয়েছে। তাদের কী ব্যবস্থা করবেন?

রাজা পিটার সেনাপতি মালোকে ইশারায় ডাকলেন। দু’জনে কী কথা হল। রাজা পিটার বললেন–তোমাদের রাজকন্যা ও বন্ধুদের জাহাজেই বন্দি করা হয়েছে।

ফ্রান্সিস বললেন–মান্যবর রাজা–আনগোভিনের হয়ে লড়াই করতে গিয়ে আমাদের দুই বন্ধু মারা গেছে, একজন আহত হয়েছে। এই যুদ্ধে আমরা ইচ্ছে করে জড়াই নি। অথচ দুই বন্ধুকে হারিয়েছি। তাই অনুরোধ ঐ জাহাজেই বন্দি করে রাখুন। এখানে উন্মুক্ত আকাশের নীচে থাকতে গিয়ে হয়তো আরো বন্ধুকে হারাবো। আপনি দয়া করে আমার বন্ধুদের ঐ জাহাজেই বন্দি করে রাখুন। এতে ওদের শারীরিক ক্ষতি হবে না।

-বুঝলাম–রাজা পিটার মাথা নেড়ে বললেন–কিন্তু তোমরা যারা ধনসম্পদ খুঁজবে তোমারা তো সুযোগ বুঝে বন্দি বন্ধুদের নিয়ে জাহাজ চালিয়ে পালাতেও পারো।

ফ্রান্সিস বুঝল–রাজা পিটারের মনের সন্দেহ কিছুতেই দূর করা যাবে না। ফ্রান্সিস বলল ঠিক আছে। আমার বন্ধুদের কয়েদঘরে রাখুন। মাথার ওপর একটা ঢাকা তো থাকবে।

–এবার যাতে আমরা আনজু যেতে পারি তার ব্যবস্থা হলে ভালো হয়। হ্যারি বলল। রাজা পিটার সেনাপতি মালোকে কাছে ডাকলেন ফ্রান্সিসদের সাহায্য করার কথা বললেন।

ফ্রান্সিস ও হ্যারি মাথা একটু নুইয়ে রাজা পিটারকে সম্মান জানিয়ে দুর্গের বাইরে এলো।

দুর্গের বাইরে এসে দেখল–একটা শস্যটানা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেনাপতি মান্দো গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল। ফ্রান্সিসরা কাছে আসতে বলল, এই গাড়োয়ান আপনাদের আনজু নিয়ে যাবে। চার্লস-এর বিরাট অট্টালিকা গীর্জা গ্রন্থাগার দেখতে পাবেন ওখানে।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি গাড়িতে উঠল। গাড়ি চলল আনজুর দিকে। পথের দুপাশে! গাছপালা টিলা ঝর্ণা।

হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস দেখো কী সুন্দর প্রকৃতি।

ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি–প্রকৃতি দেখার মতো মনের অবস্থা আমার নেই। অনেক চিন্তা মাথায়।

বিকেল নাগাদ ফ্রান্সিসরা আনজু পৌঁছল। দু’জনে উঠল গিয়ে এক সরাইখানায়। গাড়ির গাড়োয়ানকে সঙ্গে নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিল।

দু’জনে যখন চার্লস-এর অট্টালিকার সামনে এলো তখন সন্ধে হয় হয়। দেয়াল ঘেরা অট্টালিকা। দেয়ালের মধ্যে প্রধান প্রবেশ পথ। ফ্রান্সিসরা প্রবেশ পথের সামনে এসে দেখল দুজন পাহারাদার বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।ফ্রান্সিসরা একজন পাহারাদারকে বেশ কষ্ট করে বোঝাল যে ওরা চার্লস-এর অট্টালিকা গীর্জা দেখতে এসেছে। একথাও বলল যে ওরা বিদেশি।

প্রহরী একজন ফ্রান্সিসদের ইশারায় সঙ্গে আসতে বলল। ফ্রান্সিস হ্যারি প্রহরীর পেছনে পেছনে চলল। ঢুকেই বিরাট হলঘর। হলঘরের মাঝখানে শ্বেতপাথরের গোল টেবিল। চারপাশের দেয়ালে কয়েকজনের ছবি। বোঝা গেল চার্লস ও চার্লসের পূর্বপুরুষদের ছবি। প্রহরী ওদের নিয়ে হলঘরের কোণায় একটা পাথরের ঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিসরা ঘরটায় ঢুকে দেখল একটা কালো কাঠের বাঁকা পায়াওয়ালা চেয়ারে বসে আছেন টাকমাথা একজন প্রৌঢ়। প্রহরী প্রৌঢ়কে কী বলল। প্রৌঢ়টি হেসে গ্রীক ভাষায়, বলল–মান্যবর চার্লসের এই অট্টালিকা গীর্জা গ্রন্থাগার এসব আমিই দেখাশুনো করি। আমার নাম গাইদা। হ্যারি ফ্রান্সিসকে কথাটা বুঝিয়ে বলল।

ফ্রান্সিস বলল–বলল যে আমরা চার্লসের গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করতে এসেছি। রাজা পিটার আমাদের অনুমতি দিয়েছেন।ওরা কথা বলছেতখনই ঘরে সাজ্জিও ঢুকলেন। হেসে ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে সাজ্জিও বললেন–রাজা পিটার আপনাদের সাহায্য করবার জন্যে আমাকে পাঠিয়েছেন। দেখা গেল গাইদা চেয়ার ছেড়ে উঠে সাজ্জিওকে সম্মান জানাল।

সাজ্জিও গাইদাকে বলল–আপনি আপনার কাজ করুন। আমিই এদের সব দেখাচ্ছি। তারপর ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বললেন–চলুন–আমিই আপনাদের সব দেখাচ্ছি।

তিনজনে ঘর থেকে বেরিয়ে হলঘরে এলো। পাথরে তৈরি হলঘরে পাথরের গায়ে কুঁদে কুঁদে ফুল লতাপাতার কাজ করা। দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির সামনে এসে সাজ্জিও বললেন–এই ছবিটা হচ্ছে মান্যবর চার্লসের ছবি। ফ্রান্সিসরা দেখল–এক প্রৌঢ়ের ছবি। সাধারণ পোশাক পরনে। মুখটা হাস্যোজ্জ্বল নয়। কেমন বিষাদময়।

ফ্রান্সিস বলল–সাজ্জিও–একটা কথা বলি।ছবিটা দেখে মাননীয় চার্লসকে কেমন বিষাদগ্রস্ত মনে হচ্ছে।

সাজ্জিও বললেন–ঠিকই ধরেছেন। এই ছবি আঁকার সময় চার্লসের এক পালিতা কন্যা মারা গিয়েছিল। তারপরই চার্লস তার জাঁকজমকের জীবন ত্যাগ করে প্রায় সাধুর জীবন কাটাতে লাগলেন। একটা গীর্জাঘর তৈরি করালেন। সেই গীর্জাতেই তিনি যীশুর আরাধনায় বেশিসময় কাটাতেন। গীর্জা চালাবার জন্যে একজন ধর্মযাজককে আনতে জেনিভা গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তাঁর শেষ ইচ্ছামতো এই গীর্জার প্রাঙ্গণেই তাকে সমাহিত করা হয়।

-মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর ধনসম্পদের কথা কাউকে বলে যাননি এটাই শুনেছি। ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ–এটা রহস্যময়ই থেকে গেল। তার মৃত্যুর পর অনেকেই তার ধনসম্পদ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে কিন্তু কেউ সেই বিপুল ধনসম্পদের হদিস করতে পারে নি। সাজ্জিও বললেন।

মনে হয় ভালো করে খুঁজলে কোনোনা কোনো সূত্র পাওয়া যেতই। হ্যারি বলল।

এবার সাজ্জিও হেসে বললেন–তাহলে সত্যি কথাটা বলি। প্রায় এক বছর ধরে মান্যবর চার্লসের অট্টালিকা গ্রন্থাগার গীর্জা আমি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কিন্তু কোনো সূত্র পাই নি।

ফ্রান্সিস বলল–তাহলে তো আপনি অনেক কিছুই জানেন।

–তা কিছু তো জানিই। যেমন গ্রন্থাগারে রক্ষিত সমস্ত গ্রন্থ আমি পড়েছি। বাসস্থান অট্টালিকা গীর্জা সব জায়গা খুঁজেছি। কিন্তু সবই ব্যর্থ। সাজ্জিও বলল।

–এই খোঁজাখুঁজি কি নিজের ইচ্ছেয় করেছেন? হ্যারি বলল।

-না–মান্যবর চার্লসের ধনসম্পদের ওপর আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই। রাজা পিটারের নির্দেশেই আমাকে খোঁজাখুঁজি করতে হয়েছিল। রাজা পিটার বলেছিলেন মান্যবর চার্লসের গ্রন্থাগারের গ্রন্থগুলো সব পড়ে যদি কোনো সূত্র আমি পাই সে জন্যেই আমাকে খুঁজতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

–আপনি কোনো সূত্রই পান নি। হ্যারি বলল।

–না–কিচ্ছু না। সাজ্জিও বললেন।

কথা বলতে বলতে তিনজনে চার্লসের গ্রন্থাগারে এলো। পাথরে তৈরি গ্রন্থাগারটি বেশি বড় না। গ্রন্থাগারের প্রহরী সাজ্জিওকে দেখে মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল।

গ্রন্থাগারে ঢুকল তিনজনে। প্রহরী একটা মোটা হলুদ রঙের মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে গেল। ফ্রান্সিসরা দেখলকাঠের পাটাতনের ওপর চামড়া বাঁধানো গ্রন্থ রাখা। গ্রন্থ বেশি নেই। সব মিলিয়ে আট-দশটা হবে।

হ্যারি বলল–সাজ্জিওগ্রন্থগুলো সবই কি গ্রীক ভাষায় লেখা।

–না– আরবী ভাষায়ও আছে। লাতিন ভাষায়ও আছে। সাজ্জিও বললেন।

–গ্রন্থগুলো কী বিষয় নিয়ে লেখা? হ্যারি বলল।

নানা বিষয়ে–অঙ্ক জ্যোতিষ মানুষের জীবনমৃত্যু এরকম বিভিন্ন বিষয়ে লেখা। সাজ্জিও বললেন। হ্যারি কয়েকটা গ্রন্থের পাতা উল্টে দেখল। আরবী আর গ্রীক ভাষায় লেখা।

হ্যারি বলল–গ্রন্থগুলো থেকে চার্লসের ধনসম্পদের কোনো হদিশ পান নি?

না–তবে পুরোনো গ্রীক ভাষায় লেখা একটা বাইবেল পেয়েছি। গ্রন্থটার নানা রকম জায়গায় দাগ দেওয়া। বোঝা যায় যে মান্যবর চার্লস খুব মনোযোগ দিয়ে ঐ বাইবেলটা পড়তেন। সাজ্জিও বললেন। ফ্রান্সিস গ্রন্থাগারটা ঘুরে দেখল। সাধারণ পাথরের ঘর। মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে এমন কিছু নেই।

–চলুন–গীর্জাটা দেখবেন। সাজ্জিও বললেন।

গীর্জাটা একটু দূরে। গীর্জাটা পাথরের। তবে চূড়োটা কাঠের। তাতে ফুল পাতার কাজ।

তিনজনে গীর্জায় ঢুকল। ঢুকেই ফ্রান্সিস আর হ্যারি অবাক হয়ে গেল। দেখল মানুষের মতোই যীশুর মূর্তি। এত বড়ো ধীশুর মূর্তি ওরা কখনো দেখেনি। ওক কাঠ কুঁদে কুঁদে মূর্তিটা তৈরি করা হয়েছে। ক্রুশে বিদ্ধ যীশুর মূর্তি। এত সজীব মূর্তি বড়ো একটা দেখা যায় না। ক্রুশের গায়ে হাত পা পেরেকে বিদ্ধ। মাথায় কাঁটার মুকুট।

মুখটা একটু ঝুঁকে পড়েছে। ফ্রান্সিস আর হ্যারি দু’জনেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।

সাজ্জিও বললেন–মূর্তিটা দেখে একটু অবাক হয়েছেন–তাই না।

–হ্যাঁ–সত্যি এত বড়ো আর এত সজীব মূর্তি আমরা কখনো দেখিনি। হ্যারি বলল।

–মান্যবর চার্লসের নির্দেশেই এই মূর্তি নির্মিত হয়েছে। তিনি শুধু খ্রীস্ট ভক্তই ছিলেন না। তার শিল্পবোধেরও প্রশংসা করতে হয়। সাজ্জিও বললেন।

তিনজনে বেদীর সামনে এসে দাঁড়াল। সাজ্জিও বললেন–কাঠের বেদীতে কত কারুকাজ দেখুন। সত্যিইফ্রান্সিসরা দেখে অবাক হল কত সূক্ষ্ম কাজ কাঠের বেদীটাতে। কাঠ কুঁদে কুঁদে তোলা হয়েছে নকশা। ফুল লতাপাতা দেখি। কাঠের মধ্যে এমন সূক্ষ্ম কাজ খুব কমই দেখা যায়।

হঠাই ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল–ফুল পাখি লতাপাতা যেখানে শেষ হয়েছে তার নীচে বাঁদিকে আর ডানদিকে কিছু যেন কথা কুঁদে তোলা। ফ্রান্সিস বলল–সাজ্জিও লক্ষ্য করেছেন বোধহয় নীচের দিকে কিছু লেখা আছে।

আপনি ঠিকই ধরেছেন। প্রাচীন গ্রীক ভাষায় লেখা বাইবেলের ‘নিউ টেস্টামেন্ট থেকে দুটো উদ্ধৃতি। সাজ্জিও বললেন।

–উদ্ধৃতি দুটো কী? হ্যারি জানতে চাইল।

সাজ্জিও বললেন–

-বাঁ দিকের উদ্ধৃতিটি হচ্ছে–”দুঃখ কষ্ট ব্যথা বেদনারূপে ক্রুশ বহন যে না করে সে আমার অনুগামী হতে পারে না।”

ডানদিকে আছে–”জীবনটা কেবল খাওয়াপরা নয় তার থেকে আরো অনেক বেশি।”

ফ্রান্সিসরা বুঝল বড়ো গভীর অর্থময় উদ্ধৃতি দুটি। চার্লস সত্যিই একজন চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। শুধু খ্রীস্টভক্তই ছিলেন না।

ওদিকে দুর্গের চত্বরে বন্দি শাঙ্কো বিস্কোরা ভাবছে কী করে ওখান থেকে পালানো যায়। পালিয়ে ওদের জাহাজে যাবে। বরং জাহাজেই বন্দি হয়ে থাকবে। এখানে এই উন্মুক্ত আকাশের নীচে এভাবে দিনের পর দিন থাকা চলে না। কিন্তু পালাবে ভাবলেই তো হবে না। কীভাবে পালাবে সেটাই আগে ভাবতে হবে। শাঙ্কো বিস্কোর সঙ্গে এই নিয়ে মৃদুস্বরে কথা বলছিল। শাঙ্কো বিপদ আঁচ করলেই যা করে এবারও তাই করেছে। কোমর থেকে বড়ো ছুরিটা বের করে ঢোলা জামার মধ্যে ছুরিটা ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছে। প্রয়োজনের সময় বের করবে।

শাঙ্কো তাই বলল–দেখো হাতে দড়ি কেটে ফেলা যাবে। কিন্তু দুর্গের দেয়াল ডিঙোবে কী করে? পাহারাদার সৈন্যরা তো ঘোরাফেরা করছে। ওদের একটাকে ঘায়েল করে তলোয়ার ছিনিয়ে আনা যায়। কিন্তু এত সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই–অসম্ভব।

–দেখা যাক–রাতের খাবার দেবার সময় কতজন সৈন্য থাকে। বিস্কো বলল।

 রাত হয়েছে তখন। চারজন পাহারাদার সৈন্য বন্দিদের খাবারদাবার জল নিয়ে এলো। হাত খোলা হবে না। সবার সামনে লম্বাটে পাতা পেতে দেওয়া হল। তাতে আধপোড়া। রুটি আর সবরকম আনাজপত্রের ঝোলমতো দেওয়া হল। সঙ্গে একটা করে মুরগির সেদ্ধ ডিম। হাত বাঁধা অবস্থাতেই সবাই খেতে লাগল। শাঙ্কো বিস্কো দু’জনেরই মনে পড়ল এরকম বন্দি অবস্থায় ফ্রান্সিসের উপদেশ–পেট পুরে খাও–খেতে ভালো না লাগলেও খাও। দুজনেই পেট পুরে খেল। একজন পাহারাদার কাঠের জালামতো জায়গায় জল নিয়ে এসেছিল। সে সবাইকে জল খাওয়াতে লাগল। শাঙ্কো সতর্ক দৃষ্টিতে লক্ষ্য রাখল। মশালের আলোয় দেখল বেশ কিছুটা দূরে সদর দেউড়িতে এখন সৈন্য সংখ্যা কম। যারা খাবার দিতে এসেছিল তারা খাবারের বড়ো বড়ো কাঠের এঁটো পাত্রগুলো নিয়ে চলে গেল। রইল শুধু যে পাহারাদারটি জল দিচ্ছিল–সে একা।

শাঙ্কো ফিস ফিস করে ডাকল–বিস্কো। বিস্কো ওর দিকে তাকাল। শাঙ্কো মাথা নিচু করে বলল–আমার পোশাকের মধ্যে থেকে ছোরাটা বের করো। বিস্কো সঙ্গে সঙ্গে শাঙ্কোর ঢোলা গলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ছোরাটা তুলে আনল। তারপর নিজের দড়িবাঁধা দু’হাত দিয়ে ছোরাটা ধরে শাঙ্কোর হাতের দড়ি কাটতে লাগল। ছোরার খোঁচা লেগে শাঙ্কোর হাতের কয়েকটা জায়গা কেটে গেল। রক্ত পড়তে লাগল। জ্বালা করতে লাগল। শাঙ্কো মুখ বুজে সহ্য করল। ছোরার ঘষা লেগে একসময় দড়িটা কেটে গেল। খোলা হাতে শাঙ্কো ছোরাটা নিয়ে বিস্কোর হাতের দড়ি কেটে ফেলল। এবার বিস্কো বাকি বন্ধুদে হাতের দড়ি কাটতে লাগল। জল দিচ্ছিল যে পাহাদারটা সে তখন জলের পাত্র নিয়ে চলে যাচ্ছে।

শাঙ্কো তখন বিস্কোকে ছোরাটা দিল। তখন সৈন্যটি ওদের সামনে দিয়েই যাচ্ছিল। বিস্কো অন্ধকারে এক লাফে সৈন্যটার কাঁধে ঝুলে পড়ল। পেছন থেকে ছেঁড়া দড়িটা দিয়ে সৈন্যটার গলায় ফাঁসমতো পরাল। তারপর দড়ি টানল। পাহারাদারটি টাল খেয়ে পাথর বাঁধানো চত্বরে পড়ে গেল। অজ্ঞান হয়ে গেল। শাঙ্কো কিছুক্ষণ চাপাগলায় বলল ছোরাটা দাও। আমার সঙ্গে এসো।

দু’জনে হামাগুলি দিয়ে পাথরের দেওয়ালের দিকে চলল। সদর দেউড়ির মশালের নি আলো এত দূর আসে নি। দেয়ালের নানা জায়গায় খোঁদলে মশাল জ্বলছে। শাঙ্কো হামাগুড়ি দিয়ে অমনি একটা জ্বলন্ত মশালের কাছে এলো। বিস্কোও এলো। দুজনেই ভীষণ হাঁপাচ্ছে তখন। শাঙ্কো একবার দুর্গের দেউড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে মশালটা নিয়েই দেওয়ালের গায়ে চেপে ধরল। ধোঁয়া বেরোল। মশালটা নিভেও গেল, এবার শাঙ্কো ফিস ফিস করে বিস্কোকে ডেকে বলল–বিস্কো এসোতোমার কাঁধে উঠে আমি দেয়াল ডিঙোবো।

–পারবে? বিস্কো বলল।

–পিরবো। মশাল রাখার আর একটা খোঁদল রয়েছে ওপরে। শিগগিরি এসো। শাঙ্কো বলল। বিস্কো এগিয়ে এসে দেয়াল ঘেঁষে বসল। শাঙ্কো ওর দুকাঁধে দু’পা রেখে দাঁড়াল। দেয়াল ধরে ধরে বিস্কো আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। দেয়ালের মাথায় শাঙ্কো পৌঁছাতে পারল না। তখনও হাত তিনেক বাকি। শাঙ্কো অন্ধকারে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল মশাল রাখার খোদলটা একটু উঁচুতে ডানদিকে রয়েছে। শাঙ্কো দেয়ালে শরীর চেপে খোঁদলটায় ডান পা-টা রাখল। তখন শাঙ্কো ভীষণ হাঁপাচ্ছে। নাক মুখ দিয়ে একসঙ্গে শ্বাস টানছে। দেয়ালে শরীর চেপে খোঁদলে পায়ের চাপ দিয়ে আস্তে আস্তে শাঙ্কো চেপে দেয়ালের মাথায় উঠে বসল। বিস্কো চাপা গলায় বলল-সাবাস্ শাঙ্কো। হাঁপানির ঠ্যালায় তখন শাঙ্কো কথাও বলতে পারছে না। অবশ্য এখন কথা বলার সময়ও নয়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–বিস্কো–দেয়ালের ওপাশে এটা ন্যাড়াগাছ দেখেছি আমি। আমি ঐ গাছ বেয়ে বেয়ে নেমে যাবো। আমাদের জাহাজে যাবো। মোটা দড়ি নিয়ে আসবো। ঐ গাছটায় বেঁধে দেয়ালের এপাশে দড়ির অন্য মাথাটা ফেলে দেবো। তোমরা দড়ি বেয়ে বেয়ে দেয়াল ডিঙোবে। তোমরা একজন একজন করে যখন এপাশে দড়ি ধরে নামতে থাকবে তখন দেয়ালের ওপাশে অন্যেরা দড়িটা টান ধরে ধরে রাখবে। তাহলেই এপারে সহজে নেমে যাবে।

শাঙ্কো এবার অন্ধকারে পা বাড়িয়ে ন্যাড়া গাছটার মগডালে শরীরের ভর রাখলো। তারপর শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাছটার কাণ্ড জড়িয়ে ধরল। দেখল–দুর্গের দেউড়িতে অনেক মশাল জ্বলছে কিন্তু সৈনসংখ্যা কম।

শাঙ্কো আস্তে আস্তে গাছটার ডাল ধরে ধরে কাণ্ড বেয়ে মাটিতে নেমে এলো। তারপর অন্ধকারেই পাথর ভরা পথটায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। হাঁপানি তখন ছেড়ে গেছে।

 কিছুক্ষণ এমনি করে শুয়ে থাকায় হাঁপানি একটু কমল। এবার শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। ঐ হাঁপধরা অবস্থায় যতটা দ্রুত সম্ভব চলল ওদের জাহাজ যেখানে আছে সেই তীরভূমির দিকে।

যেখানে জাহাজটা ছিল সেখানে শাঙ্কো এলো। জাহাজের কাছাকাছি আসতেই দেখল জাহাজ থেকে তীরভূমিতে পাতা কাঠের পাটাতনটা তুলে ফেলা হয়েছে। জাহাজের ডেক-এ একদল সশস্ত্র সৈন্য। দেখেই বুঝল ওরা রাজা পিটারের পাহারাদার সৈন্য। মুস্কিল হল। সোজা পথে দড়ি জোগাড় করা যাবে না। শাঙ্কো তাই ঠিক করল নোঙরের দড়িটাই নেবে।

শাঙ্কো জলের ধারে এলো। আস্তে আস্তে জলে নেমে নিঃশব্দে জল ঠেলে চলল। জাহাজের সামনের দিকে অন্ধকারে এগিয়ে এবার নোঙরের কাছিটা ধরে ডুব দিল। অনেকটা নীচে নেমে ছোরাটা কোমর থেকে খুলল। তারপর ছোরা চেপে ধরে কাছিটা পোচ দিয়ে কেটে ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে জলের ওপর ভেসে উঠল। এরপর জলের ওপরে কাছিটা কেটে ফেলল। এবার কাছিটা বাঁ হাতে ধরে ডান হাতে নিঃশব্দে সাঁতরাতে সাঁতরাতে তীরে উঠে এলো। পেছনে তাকিয়ে দেখল ওদের জাহাজটা তো এখন নোঙরহীন। হাওয়ার ধাক্কায় আস্তে আস্তে ভেসে চলেছে। জাহাজে বাড়তি নোঙর থেকে যে বন্ধুরা জাহাজে বন্দি আছে তারাই নতুন নোঙর লাগাবে। এখন দুর্গ থেকে বন্ধুদের মুক্ত করাই আসল কাজ। নোঙর থেকে কাটা কাছিটা গোল করে পেঁচিয়ে নিয়ে শাঙ্কো অন্ধকারে চলল দুর্গের দিকে।

দুর্গের দেয়ালের কাছাকাছি গাছটার ওপর উঠল। গাছটার মাঝামাঝি কাণ্ডটার সঙ্গে কাছির একটা মুখ ভালো করে গেরো দিয়ে বাঁধল। গাছ থেকে নেমে এলো। কাছির অন্য মুখটায় একটা পাথর বাঁধল। এবার সেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেয়ালের ওপর দিয়ে দুর্গের ভেতরে ছুঁড়ে দিল। শাঙ্কোর ভাগ্য ভাল। পাথরটা ভেতরের চত্বরে বন্দি কারো মাথায় পড়ল না। পড়ল চত্বরের ওপর। শব্দ হল। তবে খুব জোর শব্দ নয়। বিস্কো অন্ধকারে শব্দটা লক্ষ্য করে এগিয়ে এলো। পাথর বাঁধা কাছিটা দেখল। বুঝল শাঙ্কোই ছুঁড়েছে দড়ির মুখটা। বিস্কো বন্ধুদের ফিস ফিস করে বলল–শাঙ্কো কাছি ঝুলিয়ে দিয়েছে। একে একে পালাও। বন্ধুদের একজন কাছিটার কাছে এলো। কাছিটা টেনে দেখে বুঝল কাছিটা দেয়ালের ওপাশের গাছটার সঙ্গে বেশ শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। বন্ধু যখন দেয়ালের কাছে গিয়ে কাছি দিয়ে বেয়ে উঠছে নীচে বিস্কো ওরা কয়েকজন কাছিটা টান টান করে টেনে ধরে রাখল। বন্ধুটি দেয়ালের মাথায় বসল। তারপর টান টান কাছিটা ধরে ধরে এগিয়ে গেল। শাঙ্কো এসে বন্ধুটিকে জড়িয়ে ধরল। মুক্তি।

এবার বিস্কো সব বন্ধুকে একে একে দেয়ালের ওপাশে পার করে দিল। তারপর আনগেভিনের সৈন্যরা কাছি টেনে ধরে বিস্কোকে পার করাল। এরপর নিজেরা দেয়ালে উঠে পার হতে লাগল।

বিস্কো দেয়ালের ওপর উঠে দেখেছিল দেউড়ির দিকে তাকিয়ে। সৈন্যরা দু’তিনজন জেগে আছে। তবে পাহারা দিচ্ছে না। গল্পগুজব করছে। মশাল জ্বলছে। এদিকে কারো দৃষ্টি নেই।

বিস্কো পার হতেই ভাইকিংরা এবার ছুটল জাহাজ যে দিকে বাঁধা আছে সেদিকে। অন্ধকারে ছুটে চলল সবাই।

সমুদ্রতীরে পৌঁছে দেখল নোঙরহীন ওদের জাহাজটা বেশ দূরে ভেসে গেছে।শাঙ্কো বলে উঠল–সবাই সাঁতরে চলো। সমুদ্রের সঙ্গে ভাইকিংদের নাড়ির টান। ওদের কাছে এই দূরত্বটুকু সাঁতরে যাওয়া কিছুই না।

আস্তে আস্তে জলে নামল সবাই। শাঙ্কোর হুঁশিয়ারি শোনা গেল–কোনো শব্দ নয়। ভাইকিংরা নিঃশব্দে সাঁতরে চলল ওদের জাহাজের দিকে।

জাহাজের কাছাকাছি এসে বিস্কো একটু গলা চড়িয়ে বলল–আমরা রাজা পিটারের পাহারাদার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করবো। না। ওদের ধরে ধরে জলে ফেলে দেব।

জাহাজের হালের কাছে এসে জড়ো হল সবাই। হালের খাঁজে খাঁজে পা রেখে রেখে প্রথমে শাঙ্কো উঠল। ডেক-এ নেমে এলো না। হালের পাশে অপেক্ষা করতে লাগল। আস্তে আস্তে প্রায় সবাই উঠে এল। দেখল ডেক-এ চার পাঁচজন রাজা পিটারের সৈন্য ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে। তবে তলোয়ার কোমরে গোঁজা।

মুহূর্তে শাঙ্কো ছুটে এসে একজন পাহারাদার সৈন্যকে রেঙিলের দিকে ঠেলে নিয়ে এক ধাক্কায় জলে ফেলে দিল। শাঙ্কোর দেখাদেখি আর সবাইও তখন। ছুটে এসে বাকি পাহারাদার সৈন্যদের ঠেলে জলে ফেলে দিল।

এতে একটু হৈ চৈ হল। নীচের কেবিনঘরের অস্ত্রঘরের পাহারাদার সৈন্যরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ডেক-এ উঠে এলো। তাদেরও একই দশা হল। শুধু একজন পাহারাদার সৈন্য তলোয়ার চালিয়ে শাঙ্কোর কাঁধে ঘা মারতে পেরেছিল। শাঙ্কো আঘাতের কষ্টের মধ্যেও বলে উঠল–ওকে মেরো নাজলে ফেলে দাও। সবাই তাই করল। ওকে দোলাতে দোলাতে জলে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

এ সময় নীচের কেবিনঘর থেকে বাকি বন্ধুরা উঠে এলো ডেক-এ। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো। মারিয়া ডেক-এ উঠে এলো। ওর আশা ছিল হয় তো ফ্রান্সিস হ্যারিও মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু দেখল মুক্ত ভাইকিংদের মধ্যে ফ্রান্সিস আর হ্যারি নেই।

ওদিন ভেন শাঙ্কোর চিকিৎসা করতে লাগল। মারিয়াও শাঙ্কোর শুশ্রূষায় লেগে পড়ল। বিস্কো শাঙ্কোর কেবিনঘরে এলো। দেখল–শাঙ্কোর কাঁধ থেকে রক্ত পড়া বন্ধ। হয়েছে। শাঙ্কো এখন অনেকটা ভালো। ভেন আর মারিয়া শাঙ্কোর পাশে বসে আছে।

বিস্কো বলল–শাঙ্কো তুমি যেভাবে আমাদের মুক্ত করলে তা প্রশংসনীয়। শাঙ্কো হেসে বলল–এসবই আমার ফ্রান্সিসের কাছ থেকে শেখা। ফ্রান্সিস বলে–বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। কার্যকরী কোনো পন্থা বের করতে হয়, তারপর সেটা কাজে লাগাও।

–ঠিক তাই–বিস্কো বলল–কিন্তু আমি ভাবছি পালিয়ে তো এলাম এবার ফ্রান্সিস আর হ্যারির না কোনো বিপদ হয়। মারিয়া বলল–বিপদ আর কী হতে পারে। বড়ো জোর ওদের দুজনকে বন্দি করে রাখতে পারে। তবে দু’জন তো, ফ্রান্সিস ঠিক হ্যারিকে নিয়ে পালাতে পারবে। ওদের জন্য ভেবো না। এখন আমরা কী করবো সেকথা ভাবো। শাঙ্কো বলল–আমি নোঙরের কাছি কেটে নিয়ে গেছি। আমাদের জাহাজ এখন নোঙরহীন। বিস্কো বলল–নতুন নোঙর কাছির ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু আমাদের জাহাজটা কোথায় রাখবো? শাঙ্কো বলল–বেশ কিছুটা পুবে সমুদ্রতীরে চলো। দেখা যাক–জাহাজ লুকিয়ে রাখার কোনো জায়গা পাই কিনা।

বিস্কো বলল–ভোর হবার আগেই আমাদের এই তল্লাট ছেড়ে পালাতে হবে। রাজা পিটারের জাহাজগুলো থেকে বেশ দূরে। আমাদের জাহাজ যেন ওরা দেখতে না পায়। ওরা সকালেই জেনে যাবে যে আমরা পালিয়েছি। আমরা যেসব পাহারাদারকে জলে ফেলে দিয়েছি তাদের কাছেও আমাদের জাহাজের খবর পাবে তখন আমাদের জাহাজ লক্ষ্য করে কামানের গোলা ছুঁড়লেই আমরা বিপদে পড়ে যাবো। কাজেই এক্ষুণি এই তল্লাট ছেড়ে পালাতে হবে। বন্ধুদেরও এই কথা বলেছি। বিস্কো এবার ডেক-এ উঠে এলো। বন্ধুদের ডেকে-এর কাছে আসতে বলল। তারপর বলল–এক্ষুণি একদল দাঁড়ঘরে চলে যাও। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে একদল ভাইকিং দাঁড়ঘরে চলে গেল। অন্যদল পাল খুলে দিতে চলল। এবার বিস্কো জাহাজচালক ফ্লেজারকে বলল–জাহাজ পূর্বদিকে চালাও। ফ্লেজার হুইল ঘোরাল। বিস্কো পেড্রোকে বলল–তোমার জায়গায় উঠে যাও। লক্ষ্য রাখো তীরে কোনো ঘন জঙ্গলঘেরা জায়গা পাও কিনা। পেলেই বলবে। পেড্রো মাস্তুল বেয়ে নিজের নজরদারির জায়গায় চলে গেল।

জাহাজ পুবমুখো চলল। বেশ দ্রুতই চলল।

 রাত শেষ হয়ে এলো। পুবদিকের আকাশ লাল হয়ে উঠল। সূর্য উঠতে দেরি নেই। পেড্রে মাস্তুলের ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলল–তীরে একটা জংলা জায়গা দেখা যাচ্ছে। রেলিং ধরে বিস্কো আর মারিয়া দাঁড়িয়ে আছে। বিস্কো দেখল ওখানে একটা খাঁড়ি মতো। অনায়াসে জাহাজ খাঁড়িতে ঢোকানো যাবে।খাঁড়ির দুপাশে গভীর জঙ্গল। বাইরে থেকে জাহাজটাকে দেখা যাবে না।

বিস্কো গিয়ে ফ্লেজারকে বলল–জাহাজ খাঁড়িটায় ঢুকিয়ে দাও। ওখানেই থাকবে জাহাজটা। ওখানেই আমরা ফ্রান্সিস আর হ্যারির জন্যে অপেক্ষা করবো।

জাহাজটা বেশ দ্রুতই খাঁড়িটায় ঢুকে পড়ল। তখনই সূর্য উঠল। ভোরের নিস্তেজ আলো ছড়ালো সমুদ্রের জলে। জঙ্গলটার মাথায়।

শাঙ্কোরা সারাদিন শুয়ে বসে কাটাল।

বিকেলে শাঙ্কো ভাবল–কোথায় এলাম একটু দেখে আসি।

শাঙ্কো জাহাজের পাটাতন দুটোর কাছে এলো।একভাইকিং বন্ধুকে বলল-পাটাতনটা পাতবো চলো।

বন্ধুটি বলল–এসব জাংলা জায়গা। জাহাজ থেকে নামা কি ঠিক হবে?

–আরে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে চলে আসবো। এখন তো আমাদের ফ্রান্সিস আর হ্যারির জন্যে প্রতীক্ষা করা ছাড়া কোনো কাজ নেই। এসো। শাঙ্কো বলল।

শাঙ্কো আর বন্ধুটি মিলে জাহাজ থেকে দুটো পাটাতন ফেলল। পাটাতন দুটো পড়ল তীরের ঝোঁপঝাড়ের ওপর। বন্ধুটি বলল–তোমার একা নামা ঠিক হবে না। চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাই।

শাঙ্কো আর বন্ধুটি পাতা পাটাতন দিয়ে তীরে ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে নামল। শাঙ্কো ঝোঁপঝাড় দু’হাতে সরিয়ে হেঁটে চলল। পেছনে বন্ধুটিও শাঙ্কোর দেখাদেখি ঝোঁপজঙ্গল দু’হাতে সরিয়ে সরিয়ে চলল।

কিছুক্ষণ হেঁটে এগোতেই দেখল এখানে ঝোঁপজঙ্গল কম। বিরাট বিরাট সব গাছ।

শাঙ্কো চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে তখনই নজরে পড়ল একটা পায়ে চলা পথ উত্তরদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেছে। শাঙ্কো আশ্চর্য হল। এরকম জায়গায় তাহলে লোকজন যাওয়া-আসা করে। শাঙ্কোর বন্ধুটিও তখন অবাক। বলল–শাঙ্কো, মনে হচ্ছে এখানে লোকবসতি আছে।

–ভাবছি রাস্তাটা ধরে যাবো কিনা। শাঙ্কো বলল। বন্ধুটি চারদিকেতাকিয়ে বলল শাঙ্কো–দেখো অন্ধকার নেমে আসছে। আর না এগিয়ে চলো জাহাজে ফিরে যাই।

“তুই একটা ভীতুর ডিম। তুই চলে যা। আমি একাই যাবো। শাঙ্কো বলল।

না-না। বন্ধুটি বলল-শাঙ্কো জীবনের ঝুঁকিনিও না। ফিরে চললা। বন্ধুটি শাঙ্কোকে বারবার সাবধান হতে বলল। কিন্তু শাঙ্কো কথা শুনলো না। পায়েচলা পথটা ধরে এগোতে লাগল। অগত্যা বন্ধুটিও শাঙ্কোর পেছনে পেছনে চলল। একটু এগোতেই জঙ্গল শুরু হল। জঙ্গল খুব ঘন নয়। ছাড়া ছাড়া গাছপালা।

সন্ধে হতে দেরি নেই।পাখপাখালি বাসায় ফিরেছে। পাখির ডাকে এলাকাটা ভরে উঠেছে।

কিছুটা এগিয়ে গেল দু’জনে। হঠাৎ শাঙ্কো দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েকটা গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল একটা পাথরের বাড়ি। বন্ধুটি বলল–শাঙ্কো কী হল? শাঙ্কো নিঃশব্দে আঙ্গুল তুলে পাথরের বাড়িটা দেখাল। বন্ধুটিও অবাক হল। এই জঙ্গলে পাথরের বাড়ি? শাঙ্কো বলল–তুমি এখানে থাকো। আমি আড়াল থেকে দেখে আসি এটা পোড়ো বাড়ি না লোকজন থাকে। বন্ধুটি দাঁড়িয়ে রইল।

শাঙ্কো গাছপালার আড়ালে আড়ালে বাড়িটার কাছে গেল। কান পাতল। অস্পষ্ট কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। শাঙ্কো বুঝল বাড়িটায় লোজন আছে। এরা কারা? বাড়িটা পাথরের। মাথায় পাথরের ছাদ। দরজা জানালা ভাঙা। পাথরের কালচে দেয়াল এখানে ওখানে ধসে পড়েছে। একটা জানালা দিয়ে মশালের আলো দেখা যাচ্ছে।

আর একবার ভালো করে চারদিক দেখে নিয়ে শাঙ্কো বন্ধুর কাছে ফিরে এলো। বলল–যতটা পারলাম দেখলাম। এখানে কিছু লোক রয়েছে। তারা কারা বুঝতে পারলাম না। চলো–আর কিছু দেখার নেই।

দু’জনে ফিরে চলল। কিছুটা গিয়ে ওরা পায়েচলা পথ ছেড়ে ডানদিকের ঝোঁপঝাড়ে ঢুকল। গাছ ঝোঁপঝাড় পার হয়ে ওরা খাঁড়ির ধারে এলো। দেখল ওদের জাহাজটা বেশ কিছুটা উত্তরদিকে জলে ভাসছে।

দু’জনে তির ধরে ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তীরে এলো যেখানে ওদের জাহাজটা রয়েছে।

পাতা পাটাতনে দিয়ে দু’জনে যখন জাহাজে উঠল তখন সন্ধে হয়ে এসেছে।

বিস্কো আর কয়েকজন ভাইকিং ছুটে এলো। বিস্কো বলল–শাঙ্কো তোমাদের জন্যে আমাদের খুব ভাবনা হয়েছিল। কোথায় গিয়েছিলে?

জাহাজ থেকে নেমে একটু ঘুরেফিরে দেখছিলাম। শাঙ্কো বলল।

কী দেখলে? শুধু ঝোঁপজঙ্গল? বিস্কো বলল।

–হ্যাঁ ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে একটা পাথরের বাড়ি। শাঙ্কো বলল।

-বলো কি? এই ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে বাড়ি? তবে পোড়ো বাড়ি থাকতেও পারে। বিস্কো বলল।

পোড়ো বাড়ি নয়। লোকজনও রয়েছে। শাঙ্কো বলল।

আশ্চর্য! কারা থাকে ওখানে? বিস্কো বলল।

 –সেটাই তো বুঝতে পারলাম না। শাঙ্কো বলল।

বোধহয় চোর ডাকাতের দল। বিস্কো বলল।

“উঁহু-চোর ডাকাতরা অত গলা তুলে খোশগল্প করে না। শাঙ্কো বলল।

–কোন্ ভাষায় ওরা কথা বলছিল? একজন ভাইকিং জানতে চাইল?

–ওরা এখানে প্রচলিত গ্রীক ভাষাতেই কথা বলছিল। শাঙ্কো বলল।

–ভাগ্যিস তোমাদের ওরা দেখতে পায় নি। বিস্কো বলল।

–হ্যাঁ আমরা গাছের আড়াল থেকে সব দেখেশুনে দ্রুত চলে এসেছি।শাঙ্কো বলল।

–তাহলে ওরা কারা তা তো বোঝা গেল না।

–ওরা এই দেশেরই নোক এটা বোঝা গেল। এখন এরা আমাদের সম্পর্কে বা আমাদের জাহাজ সম্পর্কে কিছু জানে কিনা জানি না। এরা আমাদের শত্রু বা মিত্র তাও জানার উপায় নেই। শাঙ্কো বলল।

–ঠিক আছে। আমরা কিন্তু এই জায়গা ছেড়ে যাবো না। বিস্কো বলল।

দেখা যাক–আমাদের আবার কোনো বিপদ হয় কি না। শাঙ্কো বলল।

ভাইকিংদের রাতের খাওয়া শেষ হল। সবাই জাহাজের ডেক-এ কেবিনঘরে ঘুমিয়ে পড়ল। শাঙ্কো, জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি। লোকজন থাকে–ওখানে যারা থাকে তারা কারা। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে শাঙ্কোর দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *