চলো দিকশূন্যপুর – ৭

দুপুরবেলা খুব একচোট ঘুমিয়ে নিলুম। আগের রাত্তিরে ঘুম হয়নি, আজও কত রাত পর্যন্ত জাগতে হবে ঠিক নেই।

বন্দনাদি নিজে গিয়ে রোহিলাকে নিয়ে এসেছে। সে বারান্দায় বসে আছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে। চোখের দৃষ্টি উদাস। পাশে একটা ছোট্ট কাপড়ের পুঁটুলি। ওই ওর যথাসর্বস্ব।

ঘুম ভাঙার পর আমি যখন এসে বারান্দায় দাঁড়ালুম, ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। আজও টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আমার সূর্যাস্ত দেখা হল না।

এখনও ভাল করে অন্ধকার নামেনি, তবু এর মধ্যে দিব্যি একটা চকচকে চাঁদ উঠেছে। একটুও ক্ষয়ে যায়নি। আজ বৃষ্টি না হলে বাঁচি। বৃষ্টি হলে সবাইকে ঘরে বসতে হবে। বাইরের খোলামেলাতেই আমার বেশি ভাল লাগে।

একটা বঁটি নিয়ে বন্দনাদি আলু ছাড়াচ্ছে। আমার দিকে মুখ তুলে বলল, আজ বেশ মজার খাওয়া হবে। যাদের আসতে বলেছি, তারা প্রত্যেকেই একটা কিছু রান্না করে আনবে। কে কী আনবে জানি না। পট লাক যাকে বলে। আমি শুধু লম্বা করে একটা আলুর দম বানিয়ে রাখব!

—ক’জনকে আসতে বলেছো?

—বেশি নয়, সাতজন। খুব বেশি লোক হলে আড্ডা জমে না। সুরথকে বোধহয় তুই চিনিস না, বছর খানেক আগে এসেছে, তাকে বলেছি মাদলটা আনতে। খুব ভাল বাজাতে পারে। সুরথ বাজাবে, আর রোহিলা নাচবে।

দু’জনেই তাকালুম রোহিলার দিকে। সে যেন কথাটা শুনতেই পেল না। তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে।

সন্ধে গাঢ় হলে রোহিলা আবার বদলে যাবে?

—বন্দনাদি তোমার রান্নায় কিছু সাহায্য করতে হবে?

—না, তুই বরঞ্চ চা-টা বানিয়ে নে। আজ দুধ আছে।

রোহিলার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলুম, রোহিলা, তুমি চা খাবে তো? রোহিলা কোনও উত্তর দিল না।

তবু আমি তিন কাপ চা-ই তৈরি করলুম। রোহিলার পাশে একটা কাপ রাখতে সে একবার পাশ ফিরে তাকাল আমার দিকে। সেই দৃষ্টিতে নিঃশব্দ কাতরতা রয়েছে মনে হল।

বন্দনাদি, আলু-টালুগুলো রান্না ঘরে রেখে এসে রোহিলার পাশে গিয়ে বসল। তারপর স্নেহময়ী বড় বোনের মতন সুমিষ্ট স্বরে বলল, কী, চা খাবে না? খেতে ইচ্ছে করছে না?

রোহিলা এবার বন্দনাদিকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, বন্দনাদি, আবার আমার মাথা ব্যথা করছে। কী রকম যেন লাগছে। যদি আবার পাগলামি শুরু করি?

বন্দনাদি হাসতে হাসতে বলল, সত্যি কথা বলছি রোহিলা। খানিকটা পাগলামি তোমাকে বেশ মানিয়ে যায়! তুমি তো বরাবরই আধ-পাগল। কিন্তু জিনিসপত্র ভাঙাভাঙি শুরু করলে কেন? আমাদের সামান্য তো সম্বল, তাও যদি ভেঙে ফেলো।

—অনেক কিছু ভেঙে দিয়েছি, তাই না?

—ভাগ্যিস আয়নাটা ভাঙোনি! আজ আমি একটু সাজগোজ করব, চুল বাঁধব। তুমিও একটু সেজে নেবে না?

—না, বোলো না, অনেক কিছু ভেঙেছি? কেন যে আমার এত রাগ হয়। কেন তোমরা আমাকে সুলোচনা বলো?

—আমি কোনওদিন তোমাকে সুলোচনা বলিনি।

—আমি লোকের জিনিসপত্র ভেঙেছি, কেউ কেন আমার হাত চেপে ধরেনি?

–তোমার তখন যা মেজাজ, দেখলে ভয় লাগে।

—কেউ কেন আমাকে শাস্তি দেয়নি? আমাকে মারেনি?

—কারণ সবাই তোমাকে ভালবাসে।

আমার হঠাৎ অচিন্তনীয়র কথা মনে পড়ল। উনি তা হলে ঠিক বলেছিলেন। রোহিলার মনের মধ্যে শাস্তি পাবার, মার খাবার ইচ্ছে রয়ে গেছে! কেউ ওকে মারবে, ও তার প্রতীক্ষা করে।

সুন্দরী মেয়েদের গায়ে কেউ হাত তোলে না। রোহিলার যদি নাক ছোট, দাঁত উঁচু, কোঁচকানো চোখ হত, তা হলে এতদিনে নির্ঘাত কারুর কাছে চড় চাপড় খেত। জানা রইল, আমার সঙ্গে যাবার সময় যদি পাগলামি শুরু করে, তা হলে দু’ চার ঘা দিতে হবে।

মুখ তুলে রোহিলা বলল, আমার কপালের মাঝখানে ব্যথা করছে, যদি পাগলামি শুরু করি, তোমাদের পার্টি নষ্ট হয়ে যাবে।

বন্দনাদি বলল, আমাদের পার্টি নয়, তোমার জন্য। দুপুর থেকে এখানে ঠায় বসে আছ। একটুও তো ঘুমোওনি। একটু শুয়ে থাকো, ঘুমিয়ে নাও, দেখবে ভাল লাগবে। চলো, আমার সঙ্গে ঘরের মধ্যে চলো। অন্যদের আসতে এখনও অনেকটা দেরি আছে।

বাধ্য মেয়ের মতন রোহিলা বন্দনাদির সঙ্গে ঘরে চলে গেল।

আমি নীচে নেমে ফুলগাছগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে রইলুম কিছুক্ষণ।

সামনের দিকের বনানীর সবুজ রেখা আস্তে আস্তে কালো হয়ে আসছে। মাথার ওপরে ফুটেছে ধ্রুবতারা। এখন যেটা সন্ধ্যাতারা, ভোরবেলা তো সেটাই শুকতারা হয়ে যাবে। আজ আকাশ এমনই পরিষ্কার যে মিল্কি ওয়ে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। মিল্কি ওয়ে’র বাংলা ছায়াপথ, আমার ঠিক পছন্দ নয়। আকাশের এত তারার মধ্যে কোনও কোনওটি বহু বৎসর আগেই মৃত, কয়েক হাজার বছর আগেকার সেই তারার আলো এখন এসে পৌঁছোচ্ছে। যা নেই, তাও দেখা যায়!

এই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আছে শহরে যাবার রাস্তা। বেশ কষ্টসাধ্য। সেই জন্য কেউ আসে না। মাঝখানে নাকি দু-একজন ব্যবসায়ী বা ফেরিওয়ালা এসেছিল। সরকারি লোকদের চেয়ে ওদের অধ্যবসায় অনেক বেশি। এখানে এসে তারা খুব জব্দ হয়েছে। কেউ কিছু কেনেনি। কারুর কাছেই তো পয়সা নেই। কিনবে কী করে?

ওই রাস্তা দিয়েই পুলিশ আসছে? আমি চোখ ওপর করে রইলুম, এক বিন্দু আলোও দেখা যাচ্ছে না।

খানিক বাদে রান্নাঘরে গিয়ে বন্দনাদির পাশে বসলুম। উনুনে আলুর দম চাপানো হয়েছে।

বন্দনাদির পিঠে গালটা ঠেকিয়ে বললুম, মনটা খারাপ লাগছে। আর কোনওদিন আমার এখানে আসা হবে না!

বন্দনাদি চমকে গিয়ে বলল, কেন? রোহিলাকে নিয়ে তুই চিরকালের মতন হারিয়ে যাবি নাকি?

—তা নয়। আমার আসাটা এখানে অনেকে পছন্দ করে না। বিজন বলেছে আমাকে

—তুই এখানে না এসে পারবি নীলু? আমি তোকে মনে মনে ডাকব, তবু তুই সাড়া দিবি না?

—ছটফট করব, কিন্তু আসব কী করে? এখানকার লোক না চাইলেও জোর করে আসা যায়? কেউ আমাকে পছন্দ করছে না, এটা জানলে মনটা খারাপ হয়ে যায় না?

–কারা তোকে অপছন্দ করে?

—বিজন যে বলল, কয়েকজন আলোচনা করছিল, তারা চায় না এখানে বাইরের কোনও অতিথি আসুক।

—তা ক’জন? হয়তো দু-চারজন। আমার কাছে কেউ তো কিছু বলেনি! শোন নীলু, এক জায়গায় যদি পাঁচশো লোক থাকে, তারা সবাই সর্বক্ষণ সব ব্যাপারে এক মত হবে, তা হতে পারে না। পৃথিবীর কোথাও হয় না। এখানে দলাদলির প্রশ্ন নেই, তবু পুরনো স্বভাব যায় না, মাঝে মাঝে ছোট ছোট দল হয়। আবার ভেঙেও যায়। এখানে কেউ কেউ বড্ড গোঁড়া, বাইরের সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ রাখতে চায় না। আমার মতে, অতটা বাড়াবাড়ি ঠিক নয়। তা ছাড়া, তুই তো আমাদেরই একজন!

—আমি তো এখানে থেকে যেতে পারিনি, বন্দনাদি?

–এ রকম আরও কেউ কেউ চলে যায় কিছুদিনের জন্য। আবার ফিরে আসে। তুই যে রোহিলাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাচ্ছিস, তা তো অনেকেই জানে না। যখন জানবে, তখন সবাই তোর ভক্ত হয়ে যাবে।

উনুনের কাছ থেকে সরে এসে, আমাকে জড়িয়ে ধরে বন্দনাদি বলল, আহা রে, কে কী বলেছে, অমনি নীলুবাবুর মন খারাপ হয়ে গেছে!

—আমি যখন এখানে আসি না, অনেক দূরে থাকি, তখনও দিকশূন্যপুরের স্বপ্ন দেখি।

—তুই যখন থাকিস না, অনেকদিন আসিস না, তখন বসন্ত রাও, রোহিলা, মুরাদ সাহেব, প্রভাসদা এ রকম আরও কতজন প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, নীললোহিত কেন আসে না? নে, আলুর দমটা কেমন হল, একটুখানি চেখে দেখ!

একটু পরে বাইরে থেকে কে বন্দনা বন্দনা বলে দু’বার ডাকল।

উঠে গিয়ে দেখলুম জয়দীপ এসেছে। তার হাতে একটা শাল পাতার ঠোঙা, তা দিয়ে ঝোল গড়াচ্ছে। সে বলল, বন্দনা, এটা তাড়াতাড়ি রেখে দাও।

বন্দনাদি জিজ্ঞেস করল, কী এনেছ?

জয়দীপ বলল, আলুর দম।

বন্দনাদি বললেন, এই রে, আমিও তো আলুর দম বানিয়েছি। বেশি হয়ে যাবে।

জয়দীপ অপ্রসন্ন ভাবে বলল, আমি রান্নাটান্না ভাল পারি না।

বন্দনাদি বলল, তোমাকে তো কিছু আনতে হবে না বলেছিলুম। যাক গে, সবাই একটু বেশি করে আলুর দম খাবে। নাও, হাতটা ধুয়ে নাও!

বন্দনাদি একটা কেটলিতে করে জল এনে জয়দীপের হাতে ঢেলে দিতে দিতে বলল, এইখানেই একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। জয়দীপ, আমাদের দিকশুনপুরে যদি নীললোহিত মাঝে মাঝে অতিথি হয়ে আসে, তাতে তোমার আপত্তি আছে?

জয়দীপ অবাক হয়ে বলল, আমাকে এ কথা জিজ্ঞেস করছ কেন? ওঃ হো, ওকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলুম, তুমি আবার কেন এসেছো? আমি তো এই রকমই। আমার ভাষাজ্ঞান নেই। কী ভাবে কোনটা গুছিয়ে বলতে হয় জানি না। হয়তো আমি বলতে চেয়েছিলুম, তুমি আগের বছর কেন আসোনি? নীললোহিত তো অতিথি নয়। ও মাঝে মাঝে পালিয়ে যায়। ওকে জোর করে এখানে ধরে রাখা যায় না?

বন্দনাদি বলল, ‘ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না, ওকে দাও ছেড়ে, দাও ছেড়ে…।’ আচ্ছা অন্য কেউ যদি নীললোহিতের আসাতে আপত্তি করে?

–কে আপত্তি করেছে? কে? তার নাম বলো।

—আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও, তুমি কি মারামারি করবে নাকি?

—বন্দনা, মাঝে মাঝে আমার খুব রাগ হয়। কিন্তু কোনওদিন আমি কারুর গায়ে হাত তুলতে পারি না। নীললোহিত আজ চলে যাচ্ছে, ও কি আর ফিরে আসবে না? যদি না আসে, আমি নিজে গিয়ে ওকে জোর করে ধরে আনব।

—দ্যাখ, দ্যাখ নীলু! জয়দীপের মুখ থেকে এ রকম কথা শোনা অতি আশ্চর্য ব্যাপার। বাইরের কথা কেউ বললে জয়দীপ কান চাপা দেয়। সেই জয়দীপ বাইরে থেকে ধরে আনবে বলছে।

আমি বেশ অভিভূত হয়ে গেলুম। আমার ধারণা ছিল, আমি বন্দনাদির ঘনিষ্ঠ বলে জয়দীপ আমাকে খানিকটা ঈর্ষা করে। তা নয়। এ ছেলেটা একেবারে অন্যরকম।

দ্রিদ্রিম দ্রিদ্রিম শব্দে মাদল বাজাতে বাজাতে একটি যুবক উঠে এল। মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। হলুদ গেঞ্জি ও খাঁকি ট্রাউজার্স পরা, ছিপছিপে চেহারা। মাদলটি গলায় ঝোলানো, হাতে একটা রুমাল দিয়ে বাঁধা বাটি। বোঝা গেল, এরই নাম সুরথ।

সে বলল, বন্দনাদি, খুব ভাল আলুর দম রেঁধে এনেছি। নিজে বলছি, দারুণ টেস্ট হয়েছে।

এবার আমাদের দু’জনের সঙ্গে জয়দীপও হেসে উঠল।

এ রকম হাসি শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সুরথ। কিন্তু বুদ্ধিমান ছেলে, সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিয়ে বলল, জয়দীপও বুঝি আলুর দম এনেছে?

বন্দনাদি বলল, আমিও আলুর দম বানিয়েছি।

সুরথ বলল, আমার পেছন পেছন একটি মেয়ে আসছে। দেখা যাক, সে কী এনেছে?

একটু পরেই এল পিউ। একটা মেরুন রঙের শাড়ি পরা। এই মেয়েটির চেহারায় এমন একটা পাতলা পাতলা ভাব আছে, যেন শরীরের কোনও ওজন নেই। বাতাসে হাঁটে। কথা বলে থেমে থেমে, মনে হয় তোতলা, আসলে তোতলা নয়।

পিউ হাতে করে একটা বড় বাটি এনেছে, বড় বড় কচু পাতা দিয়ে ঢাকা।

বন্দনাদি জিজ্ঞেস করল, তুমি কী এনেছ পিউ?

পিউ বলল, অনেকটা আলুর দম করে এনেছি।

এবারে চারজনের হাসি একসঙ্গে।

সুরথ মাদলে একটা চাঁটি মেরে বলল, দা মোর দা মেরিয়র। পোটাটো গ্যালর। আলু আমার আলু ওগো আলু ভুবন ভরা, আলু নয়ন-ধোওয়া আমার, আলু হৃদয়-হরা!

পিউ ছলছলে চোখে বলল, আমি কিছু ভুল করেছি?

বন্দনাদি তার হাত ধরে টেনে এনে বলল, নারে কিছু ভুল হয়নি। তুইও হাসতে শুরু কর।

মাদুর নেই, শতরঞ্চি নেই, যার যেখানে খুশি বসে পড়া। পাথুরে দেশ, ধুলো কম। আমাদের ভয় দেখাবার জন্য কোথা থেকে একটা মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিল। বেশ পুরুষ্ট ধরনের মেঘ। ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’, এই গানটা আমাদের গাইতে দেবে না।

বন্দনাদির বাড়িটা এত ভাল, একটা চমৎকার বাথরুমও আছে, কিন্তু একটা দারুণ অসুবিধে, জলের কোনও ব্যবস্থা নেই। সাহেবদের আমলে তাদের অনেক খিদমদগার থাকত, টিলার নীচের কুয়ো থেকে জল এনে দিত। এখন বন্দনাদিকে জল টেনে আনতে হয়। আজ অনেক লোক আসবে, বেশি জল লাগবে।

দুপুরে আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলুম, সেই সময় জয়দীপ এসে অনেক বালতি জল তুলে বাথরুমের চৌবাচ্চা ভরে দিয়ে গেছে। তাকে অনুরোধ জানাতে হয়নি, নিজের থেকেই সে বন্দনাদির জন্য এই সব করে। অথচ বন্দনাদির সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক নয়। এ এক নতুন সম্পর্ক।

অনেকেই আগে কোনও না কোনও ঘা খেয়েছে, তাই প্রেম-ভালবাসা সম্পর্কে খুব স্পর্শকাতর। চট করে কারুকে হৃদয় দিতে চায় না। আর হৃদয় দেবার আগে শরীর স্পর্শ করার প্রশ্ন নেই।

যারা এসেছে, তারা কিন্তু কেউই জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিক নয়। যেমন বন্দনাদি। যেমন বসন্ত রাও। সাফল্যকে উপেক্ষা করে চলে এসেছে এখানে। আমি চিত্রশিল্পের বোদ্ধা নই, তবু যতটা দেখেছি টেখেছি, তাতে মনে হয়, বসন্ত রাও এ দেশের প্রথম শ্রেণীর শিল্পীদের অন্যতম হিসেবে গণ্য হতে পারত। সেই সাফল্য কেন তার কাছে তুচ্ছ মনে হল, তা সে বলে না।

যেমন জয়দীপ। তার চেহারা, আদব-কায়দা দেখলেই বোঝা যায়, সে বিত্তবান বড় ঘরের ছেলে। বেশ লেখাপড়াও জানে, মাঝে মাঝে শেক্সপীয়ার থেকে কোট করে। সার্থকতা তার পায়ে পায়ে ঘোরার কথা। জীবন তাকে কী এমন আঘাত দিয়েছে যাতে আগের জীবনের সঙ্গে সে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায়? সে কাহিনী সে কিছুতেই বলবে না।

পিউ মেয়েটিও একটি বিস্ময়। তাকে দেখলে মনে হয়, সে একলা একলা রাস্তা দিয়ে হাঁটতেই পারে না, কিছুই চেনে না। প্রায় ছিঁচকাদুনে মেয়ে, কেউ একটা ধাক্কা মারলে ও ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলবে। সেই পিউ একলা দিকশূন্যপুরের রাস্তা চিনে চিনে এল কী করে?

বন্দনাদি একদিন কথায় কথায় বলেছিল, পিউর বাবা মা একটা প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তাতে তাদের একমাত্র সন্তান পিউ প্রচুর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছিল। তখনও পিউ সাবালিকা নয়। তার এক মামা এক আরব শেখের কাছে পিউকে বিক্রি করে দেবার ব্যবস্থা করেছিল। শুনে প্রথমে আমি বিশ্বাস করিনি। কাগজে এ রকম খবর মাঝে মাঝে দেখি বটে, তবু বিশ্বাস হয় না। বন্দনাদি বলেছিল, নীলু, তোরা হয়তো কলকাতায় বসে টের পাস না। এখনও মেয়েদের নিয়ে যে কতরকম নোংরা ব্যাপার চলে, তোরা জানিস না। যে দালালটি আরব দেশে চালান দেবার ভার নিয়েছিল, সে প্রথমে নিজের কাছে দু’ রাত পিউকে আটকে রাখে, অনেক অত্যাচার করে। ওর কান্নাকাটি শুনে এক বুড়ির দয়া হয়, সে ভোরবেলা দরজা খুলে ওকে বার করে দেয়। পিউ কোনওক্রমে ওদের গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল, ওর মামা-মামি অনেক লোকের সামনে ওর গায়ে থুতু দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। ও আরব শেখের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে, ও নষ্ট হয়ে গেছে, ও বেশ্যা। সেই জন্য ও বাবার সম্পত্তিও পাবে না।

সেই জন্যই এই মেয়েটির বুকে জমে আছে এত কান্না।

ওর মামা আর মামির মুখ আমি কল্পনা করতে পারি না। যারা এত নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, কুচক্রী, তাদের মুখ কী রকম দেখতে হয়? পিউয়ের মতন এমন সরল, নিষ্পাপ, কোমল মেয়েকে কেউ কষ্ট দিতে পারে নিছক টাকাপয়সার লোভে? সেই টাকা-পয়সা একদিন বিষাক্ত সাপ হয়ে ওদের দংশন করবে না?

পিউয়ের সঙ্গে কথা বলতে বেশ মজা লাগে। মাঝে মাঝে ও অদ্ভুত প্রশ্ন করে। যেমন একটু আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আজ মেঘ এল কেন? উত্তরে আমি বলেছিলুম, আকাশে গিয়ে মেঘটাকে জিজ্ঞেস করে আসি?

পিউ এমন ভাবে তাকিয়েছিল আমার মুখের দিকে, যেন সেটা অসম্ভব কিছু নয়। আমি ইচ্ছে করলেই পারি।

পিউ মাঝে মাঝে একলা একলা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আপন মনে কথা বলে। তারপর ঝরঝর করে এক পশলা কেঁদে নেয়। যে মেয়ের কৌমার্য হরণ করেছে এক নৃশংস দস্যু, তার মনের অবস্থা কে বুঝবে? সব কুমারী মেয়েই একজন প্রিন্স চার্মিং-এর স্বপ্ন দেখে। সেই প্রিন্স চার্মিং একজন কেরানি হতে পারে, একজন কলের মিস্তিরিও হতে পারে, কিন্তু তার বড় বড় নখ আর হিংস্র দাঁত থাকার কথা নয়! প্রথম পুরুষটিই যদি বর্বর হয়, সব স্বপ্ন তছনছ করে দেয়, তারপর সে মেয়ে কি আর ভালবাসার বিশ্বাসে ফিরতে পারে?

সুরথ মাদলটাকে কখনও কীর্তনের খোলের মতন, কখনও তবলার মতন বাজিয়ে চলেছে। এক লাইন দু’ লাইন করে গাইছেও নানা রকম গান। ছেলেটি বেশ আমুদে ধরনের। সেই হিসেবে সুরথ এখানে ব্যতিক্ৰম। তাকে মনে হয় স্বাভাবিক মানুষ, সকলের সঙ্গে সহজে মিলতে পারে, কোনও বড় ধরনের চিন্তা-ভাবনা নেই। একেবারে স্বাভাবিক হলে দিকশূন্যপুরে চলে আসবে কেন? হয়তো ওর এই স্বাভাবিকতার আড়ালে কোনও ক্ষত লুকিয়ে আছে।

বসন্ত রাও, মুরাদ সাহেব, সুন্দররাজন, জ্যোৎস্না, ইসমাইলরা এসে গেছে। মজার ব্যাপার এই যে, একজন ছাড়া আর সবাই নিয়ে এসেছে আলুর দম। শুধু একজন এনেছে কুমড়োর ছক্কা। তাই নিয়ে হাসাহাসি হয়েছে অনেক। ভাত-রুটি কিছু নেই। এতজনের জন্য ভাত রাঁধার মতন বড় হাঁড়ি-কুড়ি নেই বন্দনাদির। ঘরে আটাও নেই। তাই ঠিক হয়েছে আজ আলুর দম উৎসবই হবে, মুখ বদলের জন্য একটু আধটু কুমড়োর ছক্কা।

অনেকদিন পর আজ কমলা রঙের শাড়ি পরেছে বন্দনাদি, কপালে একটা টিপ। রোহিলাকে রীতিমতন সাজিয়ে গুছিয়ে, নববধূর মতন ধরে ধরে নিয়ে এল। রোহিলার মুখে চন্দনের ফোঁটা, মাথার চুলে ফুল গোঁজা। চোখে লজ্জা লজ্জা ভাব।

বসন্ত রাও বলে উঠল, বন্দনা। তুমি চন্দন পেলে কোথায়? এখানে কি চন্দনের গাছ আছে?

বন্দনাদি হেসে বলল, ঠকিয়েছি তো? চন্দন নয়, গেঁড়ি মাটি, নদীর ধারে পাওয়া যায়। আমি মাঝে মাঝে এই মাটির টিপ পরে আয়নায় মুখ দেখি। রোহিলাকে কী ভাল দেখাচ্ছে বলো! আজ রোহিলা নাচবে।

রোহিলা মাথা নেড়ে বলল, না, আমি নাচব না!

বন্দনাদি বল, ঠিক আছে। এখন না, পরে যদি ইচ্ছে হয়। এখন জ্যোৎস্না একটা গান শুরু করুক।

সুরথ মাদলে চাঁটি দিল, জ্যোৎস্নাকে দ্বিতীয়বার অনুরোধ জানাতে হল না, সে সঙ্গে সঙ্গে গান ধরে দিল। একটা হিন্দি ভজন।

বসন্ত রাও জিজ্ঞেস করল, রোহিলার মাথায় ওটা কী ফুল?

বন্দনাদি বলল, পারিজাত।

বসন্ত রাও বলল, পারিজাত তো স্বর্গের ফুল। পৃথিবীতেও পাওয়া যায় নাকি?

সুন্দররাজন বলল, দেশের নানান জায়গায় নানান রকম ফুল পারিজাত নামে চলে। কোনওটার সঙ্গে কোনওটার মিল নেই।

আমি বললুম, এ ফুলগুলোর রং সাদা। আসল পারিজাত লাল রঙের হওয়া উচিত।

বসন্ত রাও চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি কী করে জানলে? স্বর্গে গিয়ে দেখে এসেছ বুঝি? আমাদের সরল লোক পেয়ে গুল ঝাড়ছো, নীললোহিত?

আমি বললুম, না। এখনও স্বর্গটা ঘুরে আসা হয়নি বটে। তবে এটা আমি নিজে বানাইনি। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, ‘সুন্দর, তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে/অরুণ-বরণ পারিজাত লয়ে হাতে…অরুণ-বরুণ! অবশ্য রবীন্দ্রনাথও গুল মেরে থাকতে পারেন। তিনি তো আর স্বর্গ ঘুরে এসে কবিতাটি লেখেননি!

সুন্দররাজন বলল, বন্দনা, তোমার কাছে ওই ফুল আর আছে। একটু হাতে নিয়ে দেখতুম।

বন্দনাদি ঘর থেকে আরও দুটো ফুল এনে বলল, নদীর ধারেই একটা গাছ আছে, তোমাদের দেখিয়ে দেব।

সুন্দররাজন ফুল দুটো হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। অনেকটা কাঠচাঁপা ফুলের মতন, বাইরের দিকটা সাদা, ভেতরে হলুদ আর গোলাপি আভা। মুগ্ধভাবে সুন্দররাজন বলল, বসন্ত রাও, ভেতরে রঙের কী অপূর্ব ব্যালান্স দেখেছো, আর ফুলটার গড়ন কী নিখুঁত, তুমি আমি চেষ্টা করলেও এ রকম একটা ফুল বানাতে পারব না। গাছে মাত্র একদিনের জন্য ফোটে। কে এর ডিজাইন করে?

বসন্ত রাও হাসতে হাসতে বলল, এই, এই নীললোহিতের সামনে ও রকম কথা বলো না। আগেরবার আমাকে ও বলেছিল, তোমাদের মধ্যপ্রদেশে যাকে ভগবান বলে, আমরা বাংলায় তাকেই বলি প্রকৃতি। আচ্ছা বলো তো, বাংলায় বুঝি ভগবান নেই?

বন্দনাদি বলল, এই তোমরা মন দিয়ে গান শুনছ না।

বসন্ত রাও বলল, ও সব ভজন টজন এখন জমবে না। ইসমাইলকে একটা গজল গাইতে বলো!

এরপর নানারকম গান বাজনা চলল। মাঝে মাঝে হাস্য-পরিহাস। সুরথ একাই অনেকটা জমিয়ে দিতে পারে। ও মাদলটা বাজাতে বাজাতে মাঝে মাঝে লাফ মারে। মাথা ঝাঁকিয়ে লম্বা চুল ঘোরায়।

সকলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে চায় বলে আমাকেও একবার বন্দনাদির সঙ্গে গলা মেলাতে হল। কারুর অনুরোধ ছাড়াই বন্দনাদি নেচে দিল খানিকটা।

এত সব আনন্দ-ফুর্তি হচ্ছে, তবু ভেতরে ভেতরে যেন একটা উদ্বেগের স্রোত রয়ে গেছে। সেটা কি পুলিশের জন্য? জঙ্গলের কাছাকাছি যাদের বাড়ি, তারা বাইরের কোনও আগন্তুক দেখলে বাঁশি বা মাদল বাজিয়ে দেবে কথা আছে। পুলিশ ছাড়াও যেন আরও কিছু। সুরথ মাঝে মাঝে আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে।

এক সময় সে বলল, বন্দনাদি, রোহিলা কি নীললোহিতের সঙ্গে যাবে? নীললোহিত বাইরের লোক, তার ওপর এ রকম একটা দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। ও দুদিনের জন্য বেড়াতে আসে, ওকে আমাদের খাতির যত্ন করা উচিত।

প্রসঙ্গটা বুঝতে না পেরে বন্দনাদি বলল, ওকে আবার আলাদা করে খাতির যত্ন করতে হবে কেন?

সুরথ বলল, কয়েকজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, সকলেই বলছে, রোহিলার চিকিৎসার ভার আমাদেরই কারুর নেওয়া উচিত।

বন্দনাদি বলল, আগে তো এই কথাটা কেউ বলেনি!

সুরথ বলল, আমিই নিয়ে যেতে পারি। আমাকে একবার দিকশূন্যপুর ছেড়ে যেতেই হবে, একটা পিছু টান আছে, ম্যাড্রাসে অন্তত একটা মাস…তারপর ফিরে আসব, রোহিলা আমার সঙ্গে গেলে ওখানেই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ম্যাড্রাসে ভাল হাসপাতাল আছে।

বন্দনাদি বলল, কিন্তু রোহিলাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই তো এক সমস্যা!

সুরথ বলল, নীললোহিতের যদি আপত্তি না থাকে, আমি চেষ্টা করে দেখব? আমাকে ও অপছন্দ করে না।

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললুম, না, না, আপত্তি থাকবে কেন? তা হলে তো ভালই হয়!

সুরথ বলল, আমি ওকে ঠিক বুঝিয়ে নিতে পারব। ফিরেও আসবে আমার সঙ্গে।

আমি বললুম, সেই ভাল।

রোহিলা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে, সে আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে না। তবু কি আন্দাজ করতে পারছে কিছু? তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে এদিকে।

আমি সেখান থেকে সরে গেলুম।

একটু বাদে সুন্দররাজন আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি রোহিলাকে নিয়ে কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে, কিছু ঠিক করেছ?

আমি হেসে বললুম, প্রথমে আগ্রায় তাজমহলে যাবার কথা। ওর তাজমহলে শুয়ে থাকার খুব শখ। আর যদি কলকাতায় যাই, সেখানেও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল আছে, অঢেল জায়গা। থাকার কোনও অসুবিধে নেই। খাজুরাহো বা কোনারকের মন্দির চত্বরেও কয়েকটা রাত কাটিয়ে দিতে পারি।

সুন্দররাজন বলল, তাতে ওর চিকিৎসা হবে কী করে?

—মন ভাল হলেই মনের অসুখ সেরে যায়! আর চিকিৎসা লাগে না।

—আজকাল অনেক ওষুধ বেরিয়েছে। আমি নিজে কিছুদিন….আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নার্সিংহোম আছে ব্যাঙ্গালোরে। রোহিলা সেখানে ভর্তি হলে পয়সাকড়ি কিছু লাগবে না!

—খুব ভাল কথা। আপনি সুরথের সঙ্গে আলোচনা করে নিন। রোহিলা আমার সঙ্গে যাচ্ছে না শেষ পর্যন্ত। সুরথ ওর ভার নিয়েছে।

—সুরথ। সে এ জায়গা ছেড়ে যাবে?

—হ্যাঁ, তাই তো বলল। মোট কথা, আমি দায়িত্ব মুক্ত। আমি তো বাইরের লোক।

—সুরথ কি পারবে ওকে সামলাতে? ব্যাঙ্গালোরে আমার বন্ধুর নার্সিংহোমে আমি নিজে নিয়ে গেলে…আমার আর বাইরে যেতে একেবারেই ইচ্ছে করে না, তবু ওই মেয়েটির জন্য, ওকে যদি পরিপূর্ণ সুস্থ করে তোলা যায়… দেখি ভেবে।

–দেখুন। বেশি দেরি করবেন না।

তা হলে, সকলেই উদাসীন নয়। রোহিলা সম্পর্কে বেশ কয়েকজনের আগ্রহ আছে। রোহিলাকে নিয়ে এই স্বর্গ ছেড়ে বাইরে যেতেও রাজি।

সুরথ রোহিলার কাছে গিয়ে একটা হাত চেপে ধরে বলল, এই, তোমাকে আজ এমন চুপচাপ থাকলে চলবে না। সবাইকেই আজ কিছু না কিছু করতে হবে, গান, নাচ, আবৃত্তি, কিংবা একটা মজার গল্প।

জ্যোৎস্না বলল, রোহিলা একদিন দারুণ নাচ দেখিয়েছিল।

সুরথ রোহিলাকে উঠোনের মাঝখানে এনে দাঁড় করালো।

রোহিলা বসন্ত রাও-দের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওরা যে চুপ করে বসে আছে, ওরা কিছু করবে না?

বসন্ত রাও বলল, আমি ছবি আঁকি, নাচ-গান তো জানি না। ঠিক আছে, পরে একটা কবিতা শোনাব।

রোহিলা বলল, আর পিউ? পিউ কি শুধু আমাদের কান্না দেখাবে?

পিউ বলল, আমি একটা গান গাইব। একদম শেষে। সেটা এখন শুনলে ভাল লাগবে না। বন্দনাদি বলল, রোহিলা, তোমাকে সেই গানটা শিখিয়েছিলুম, সেটার সঙ্গে নাচো। আমিও গাইছি :

সোহাগ চাঁদ বদনী ধনি নাচো তো দেখি
নাচো তো দেখি বালা নাচো তো দেখি
নাচেন ভাল সুন্দরী, বাঁধেন ভাল চুল
হেলিয়া দুলিয়া পড়ে নাগ কেশরের ফুল…

সুরথ লাফিয়ে লাফিয়ে মাদলের তাল তুলল। একটু একটু করে নাচতে লাগল রোহিলা, ক্রমে তার লয় বাড়ল, গান শেষ হয়ে গেল, তবু সে নাচছে, দারুন জোরে, যেন সে একটা ঝড় তুলে দিচ্ছে, শাড়িটা উদ্দাম ঝর্না হয়ে গেছে, লকলক করছে মাথার চুল, যেন তার বাহ্যজ্ঞান নেই।

নাচতে নাচতে এক লাফে সে বারান্দায় উঠে এসে বসন্ত রাওয়ের সামনে গিয়ে হিংস্র গলায় বলল, আমি সুলোচনা? আমি সুলোচনা? না, আমি রোহিলা, রোহিলা, রোহিলা!

বসন্ত রাও কাঁচুমাচু হয়ে গিয়ে বলল, না, না, তোমাকে আমি সুলোচনা বলিনি! তুমি আমাদের রোহিলা!

রোহিলা বলল, হ্যাঁ, তুমি বলেছো। তোমরা সবাই বলেছো!

রোহিলা এমন ভাবে ঝুঁকল, যেন সে বসন্ত রাওয়ের চুলের মুঠি ধরে টান দেবে। আমি দৌড়ে গিয়ে রোহিলার হাত চেপে ধরলুম।

রোহিলা ছটফটিয়ে বলল, ছাড়ো, আমাকে ছাড়ো।

আমি তাকে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললুম, না ছাড়ব না। কী হচ্ছে পাগলামি!

আর একটু হলেই একটা চড় মেরে বসতুম। বন্দনাদি রোহিলাকে টানতে টানতে সরিয়ে নিয়ে গেল।

সবাই এক মিনিটের জন্য চুপ।

বসন্ত রাও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ক্রমশ দেখছি বেড়ে যাচ্ছে। সবই আমার দোষ।

জয়দীপ বলল, আমরা সুলোচনা নামে কারুকে চিনি না। আমরা রোহিলাকে চিনি। তবু সুলোচনার নাম এখানে ওঠে কেন?

বসন্ত রাও বলল, আমি একবার মাত্র বলে ফেলেছি। তার জন্য তোমরা আমাকে কী শাস্তি দেবে দাও!

মুরাদ সাহেব বললেন, না, বসন্ত রাও তুমি এমন কিছু দোষ করোনি। তোমার মনে এসেছে, বলে ফেলেছ। মানুষ কী হিসেব করে সব সময় কথা বলতে পারে? ওই বাসুদেবনই সুলোচনা নামটা অনেকের মনে গেঁথে দিয়েছে।

বন্দনাদি ফিরে এসে বলল, ওকে শুইয়ে দিয়েছি। একটু বাদেই ঠিক হয়ে যাবে। কই, আরও গান টান হোক!

কিন্তু এর পরে কি আর আসর জমে? একটা দুটো গান-কবিতা হল বটে। আমি পিউকে বললুম, এবার তোমার গানটা শোনাও!

পিউ গলা খুলতেই চমকে উঠলুম। বেশ সুরেলা, মিষ্টি গলা। মনে হয় গান শেখেনি, সহজাত কণ্ঠস্বরটাই এমন। এ রকম গানও কখনও শুনিনি। কোনও কথা নেই, অথচ কালোয়াতি গানও নয়, শুধু এক টানা আ-আ করে টেনে যাওয়া সুর, অসম্ভব করুণ। যেন সুদীর্ঘ এক বিলাপধ্বনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *