চলো দিকশূন্যপুর – ৪

বন্দনাদি ফিরে আসার আগেই আমি চায়ের জল চাপিয়ে দিয়েছিলুম। দুধ খুঁজে পাওয়া গেল না, চিনিও নেই, শুধু লিকারই সই।

সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, পশ্চিম আকাশে তবু এখনও রঙের ছড়াছড়ি। উড়ে যাচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক পাখি। মাঝে মাঝে একলা একলা একটা পাখিও দেখা যায়। পাখিদের মধ্যেও কেউ কেউ দলছাড়া হয়, যাযাবরের মতন ঘুরে বেড়ায়?

বন্দনাদির জবা গাছগুলোতেও দুটো খুব ছোট্ট পাখি ওড়াউড়ি করছে। কী পাখি, চিনি না। মৌটুসি নয়, টুনটুনি বা মুনিয়া নয়, গায়ের রং কালচে নীল, বুকের কাছটা হলদেটে। এতই হালকা পাখি, ফুলের ওপর বসেও দোল খেতে পারে। মাঝে মাঝে আমাকে দেখছে। নতুন লোক দেখে অবাক হচ্ছে বোধহয়।

আমি তাদের বললুম, কী রে, সন্ধে হয়ে এসেছে, এবার বাড়ি যাবি না?

সত্যি সত্যি যেন আমার কথা শুনতে পেয়ে তারা একসঙ্গে ফুরুত করে উড়ে চলে গেল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা শালিক এসে বারান্দার এক প্রান্তে বসল। শালিকের ঠোঁটের রং হলুদ, চোখ দু’টি যেন কাজল টানা, সব সময় ব্যস্ত সমস্ত ভাব। ককেটু ককেটু ককেটু বলে তিনবার ডাকল।

আমি বললুম, কাকে চাই? কাকে চাই? কাকে চাই?

শালিকটা সেই জায়গাটা থেকে উড়ে একটা আকাশমণি গাছে বসে একবার শুধু বলল, ককেটু। তারপর আবার উড়ে যাবার আগে তিড়িং করে একটা শব্দ ফেলে রেখে গেল।

পাখিরা কেন কোথায় বসে, কেন ডাকে, সবই দুর্বোধ্য।

এই পাখিদের দেখে আমার কোকিলের কথা মনে পড়ল। জীব জগতে কোকিলই বোধহয় একমাত্র প্রাণী যাদের সন্তান স্নেহ নেই। স্বামী-পুত্র-কন্যা নিয়ে সংসার চায় না। ওরা শিল্পী। যেমন বন্দনা রায়। নর্তকী হিসেবে সুনাম ছিল, ভাল গাইতেও পারত, নিজের মেয়েটাকে রেখে এসেছে দিদির বাড়িতে।

আমার ব্যাগটা থেকে একটা খাম বার করলুম।

অর্চনাদি তিন মেয়ের নাচ দেখবার জন্য দু’খানা টিকিট দিয়েছিল। এই সব অনুষ্ঠানে আমার কক্ষনো যেতে ইচ্ছে করে না। তবু টিকিট নিয়েছিলুম বিশেষ কারণে। আমার সঙ্গে আর কে যাবে, প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে যেতে হয়েছিল প্রীতমকে। প্রীতম অনেকদিন আমারই মতন বেকার ছিল, হঠাৎ ফটোগ্রাফার হিসেবে নাম করে ফেলেছে, ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে ভাল টাকা রোজগার করে।

প্রীতমকে বলেছিলুম, তোকে পুরো সময়টা থাকতেও হবে না। আমি যেমন যেমন বলব, সেই রকম কয়েকটা ছবি তুলে দিবি। তারপর আমরা দু’জনেই কাটব।

মোট ছ’খানা ছবি তুলেছে প্রীতম, বেশ ভাল ছবি হয়েছে। তিনখানা গ্রুপ ছবি, তিনখানা শুধু রূপসার। সামনাসামনি এতটা বোঝা যায় না, ছবিতে স্পষ্ট বোঝা যায়, বন্দনাদির সঙ্গে তার মুখের খুব মিল। দুই মাসতুতো বোনের তুলনায় রূপসাই ভাল নাচে। তিন বছর বয়েসের পর মাকে সে আর দেখেনি, তবু মায়ের গুণ সে পেল কী করে?

রূপসার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে সাহস পাই না। গোপনীয়তা রক্ষা করা খুবই কঠিন ব্যাপার। যদি রূপসার সামনে কখনও মুখ ফসকে বলে ফেলি তার মা-বাবার কথা। শুধু মায়ের কথা জানতে পারলেই প্রশ্ন উঠবে, তার বাবা কে? সে কথা কিছুতেই বলা চলবে না।

ছবিগুলো বারান্দায় ছড়িয়ে রেখে দিলুম, বন্দনাদি এসে দেখুক।

পায়ের শব্দ পেয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি, বন্দনা নয়, কালো শাড়িপরা এক নারী মূর্তি। রোহিলা।

শ্বেত পাথরের মূর্তির মতন মুখ, ঠোঁটে কিংবা চোখে হাসি নেই, আমার দিকে তাকাল না, জবা গাছগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

দুপুরে ও আমার সঙ্গে কথা বলেনি, এখন আমি যেচে ওর সঙ্গে কথা বলতে যাব কেন? দৃষ্টি দিয়ে ওকে অনুসরণ করতে লাগলুম।

রোহিলা পট পট করে একটা লাল ঝুমকো জবা, আর একটা সাদা জবা ছিঁড়ে নিল।

অকারণে ফুল ছেঁড়ায় আমার আপত্তি আছে। কিন্তু এটা আমার বাড়ি নয়, আমার বারণ করা সাজে না।

ফুল দুটোকে কুচি কুচি করে ফেলল রোহিলা, মাটিতে ফেলে পা দিয়ে ঘষতে লাগল। তারপর বারান্দায় উঠে, আমার ধার দিয়েই চলে গেল ঘরের মধ্যে। যেন আমার অস্তিত্বই সে গ্রাহ্য করছে না।

এ যেন অন্য রোহিলা। আগেরবার সে ছিল হাসি-কান্নায় ভরা একটা ছটফটে মেয়ে, আমার সঙ্গে প্রাণখুলে কত গল্প করেছে। বিচিত্র রোমাঞ্চকর ওর জীবন। কালো পোশাকটা ওকে মানায় না বলেছিলুম বলে তক্ষুণি প্ৰতিজ্ঞা করেছিল, জীবনে আর ওটা পরবে না।

ঘরের মধ্যে কী যেন ভাঙার ঝনঝন শব্দ হল।

গত বছর রোহিলা আমাকে একটা চমৎকার কথা বলেছিল। ফিল্ম লাইন ছেড়ে দিয়ে, ফিল্মের লোকজনদের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে যেদিন থেকে ও ছবি আঁকতে শুরু করে, সেইদিন থেকে ওর নবজন্ম। সেই হিসেবে ওর বয়েস মাত্র তিন বছর। তা হলে এখন ওর বয়েস ছ’ বছর হওয়া উচিত। ছ’ বছরের মেয়ে কিছু জিনিসপত্র ভাঙতেই পারে।

কিন্তু ওর শরীরটার বয়েস তো তিরিশ পেরিয়ে গেছে। উত্তর-তিরিশ শরীরে ছ’ বছরের মন। কে কাকে সামলাবে? লক্ষণ একেবারেই ভাল নয়।

আরও কিছু ঘটার আগেই বন্দনাদি এসে গেল। রোহিলা তখনও ঘরের মধ্যে। আমি দৌড়ে গিয়ে উত্তেজিতভাবে বললুম, রোহিলা এসেছে, ওই ঘরে কী সব ভাঙছে!

বন্দনাদি বিচলিত হল না। জিজ্ঞেস করল, ওর সঙ্গে ভাব করিসনি?

—আমার সঙ্গে তো কথাই বলছে না।

—তুই নিজে থেকে একটু চেষ্টা করবি তো!

বারান্দায় উঠে এসে বন্দনাদি ডাকল, রোহিলা, রোহিলা?

রোহিলা বেরিয়ে এল, তার হাতে একটা ছোট আয়না। হাতটা উঁচু করে আছে, এক্ষুনি ছুড়বে, এই ভঙ্গিতে।

বন্দনাদি বলল, ওটা ভাঙিসনি, লক্ষ্মী সোনা, মাঝে মাঝে মুখটা দেখতে ইচ্ছে করে। দে, আমাকে দে!

দিল না, রোহিলা সেটা ছুড়েই মারল উঠোনে।

আয়নাটার সাত পুরুষের ভাগ্য, মাটিতে পড়েও সেটা ভাঙল না। আমি দৌড়ে গিয়ে সেটা টপ করে তুলে নিলুম।

বন্দনাদি বলল, বাঃ, এই তো ভাল মেয়ে। বোস রোহিলা। চা খাবি?

রোহিলা এবার আমার খাওয়া চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে পাথুরে দেওয়ালে বেশ জোরে জোরে ঠুকে ঠুকে ভেঙে ফেলল।

বন্দনাদি হাসতে হাসতে বলল, ব্যস ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে, আর না। আমার আর কাপ নেই, এর পরে কীসে চা খাব?

বন্দনাদি হাসছে? এদের বাসনপত্র-সরঞ্জাম কত সামান্য। বন্দনাদির দুটো মোটে চায়ের কাপ, বেশি লোক এলে ধুয়ে ধুয়ে পালা করে খেতে হয়। সেই অতি প্রয়োজনীয় জিনিস কেউ অকারণে ভেঙে দিচ্ছে, তাতেও রাগ হবে না?

রোহিলা দ্বিতীয় কাপটা তুলে নিতেই আমি তার হাত চেপে ধরে ধমকে বললুম, কী হচ্ছে কী?

যেন নোংরা কেউ ছুঁয়েছে, এই ভাবে এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিল। ভ্রুকুটি দিয়ে তাকাল আমার দিকে। তারপর নেমে গেল উঠোনে।

বন্দনাদি বলল, চা খেয়েছিস, রোহিলা? আমার জন্য চা বানাব, খাবি নাকি?

রোহিলা আমাদের দিকে পেছন ফিরে এক খামচা দিয়ে একটা জবা গাছের কয়েকটা পাতা আর ফুল ছিঁড়ল।

আমার মেজাজ গরম হয়ে গেছে। আমি বললুম, এই, গাছ নষ্ট করবে না! এসব কী ছেলেমানুষি হচ্ছে।

বন্দনাদি বলল, বকিস না ওকে। রোহিলা চমৎকার মেয়ে।

তারপর বন্দনাদি চোখের ইঙ্গিতে আমাকে মিনতি করতে লাগল রোহিলার কাছে যেতে।

আমি আস্তে আস্তে নেমে গিয়ে ওর পিঠের দিকে দাঁড়ালুম।

ফুলবাগানে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবতী, কিছুদিন ফিল্মের অভিনেত্রী হিসেবে নাম করেছিল, এটাও তো ফিল্মের দৃশ্যের মতনই। পেছনে দাঁড়িয়ে এক যুবক গান গেয়ে উঠবে?

মিউজিক ডাইরেক্টার আমাকে গান শেখায়নি। বন্দনাদি পরিচালকের আসনে। কিন্তু আমাকে সংলাপ দেয়নি। নিজে নিজে বানাতে হবে।

যথাসম্ভব গলার আওয়াজ নরম করে বললুম, রোহিলা, আমায় চিনতে পারছ না? আমি নীললোহিত।

রোহিলা ফিরেও তাকাল না।

নায়িকার যদি সংলাপ না থাকে, তা হলে ধরে নিতে হবে, তার অভিমান হয়েছে। মান ভাঙাবার জন্য পিঠে হাত দিতে হয়। কিন্তু আমার একটু ভয় ভয় করতে লাগল।

আবার বললুম, রোহিলা, একবার এদিকে ফেরো। তোমার কী হয়েছে, আমাকে বলো!

কোনও সাড়া না দিয়ে রোহিলা আবার গাছের কয়েকটা পাতা ছিঁড়ল।

আমি পরবর্তী নির্দেশের জন্য বন্দনাদির দিকে তাকালুম। বন্দনাদি নিঃশব্দে ইঙ্গিত করল, আরও চেষ্টা চালিয়ে যেতে!

এবার আমি বললুম, রোহিলা, তুমি এই কালো পোশাকটা পরেছো কেন? এটা তোমাকে একেবারেই মানায় না। এটা তোমার গত জীবনের মতন!

হঠাৎ এমন ডুকরে কেঁদে উঠল রোহিলা যে থতমত খেয়ে আমি কয়েক পা পিছিয়ে এলাম।

আকাশের দিকে মুখ তুলে রোহিলা কাতর আর্তনাদ করে বলল, মা, মাগো! আমার কী হবে? আমি কোথায় যাব?

একটু পরেই সে দৌড়ে চলে গেল নীচে।

একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। তারপর বন্দনাদির কাছে এসে বললুম, মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে?

বন্দনাদি বলল, কী জানি! এখানকার সবাই একটু আধটু পাগল। একেবারে সুস্থ, স্বাভাবিক, প্র্যাক্টিক্যাল ধরনের লোকরা নিজেদের ঘর সংসার ছেড়ে এই নিরুদ্দেশের দেশে এসে থাকতে যাবে কেন? অনেক দার্শনিক, বিজ্ঞানী, কবিরাও তো একটু একটু পাগল হয়। তা নিয়ে এখানে কোনও সমস্যা নেই, কেউ কারুকে বিরক্ত করে না। আমাদের এখানে কোনও অশান্তি নেই, শুধু কিছুদিন ধরে এই রোহিলাকে নিয়েই খানিকটা মুশকিলে পড়া গেছে।

—বন্দনাদি, তুমি বসো, সবটা শুনব। তোমার জন্য চা করে দেব?

—আমি প্রভাসদার বাড়িতে একবার খেয়ে এসেছি। এখন না হলেও চলবে।

বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসতে গিয়ে ছবিগুলোর দিকে চোখ পড়ল বন্দনাদির। জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী রে?

আকাশের আলো মিলিয়ে গেছে। এখন হালকা হালকা অন্ধকার। একটা চাঁদ উঠেছে বটে, তাকে নিয়ে ছোট ছোট মেঘেরা খেলা করছে।

দিকশূন্যপুরে বিজলি সংযোগ নেই। সরকার মাথা ঘামায় না, এরাও কৃত্রিম আলো চায় না। বাড়িতে প্রদীপ বা মোম জ্বালায়। সন্ধের পর যেদিন মিটিং ডাকা হয়, সেখানে মশাল জ্বলে। এখন টিলার ওপর থেকে কোথাও এক বিন্দুও আলো চোখে পড়ে না। এই জনবসতিটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।

আমার ঝোলার মধ্যে সব সময় একটা টর্চ থাকে, সেটা জ্বালতেই বন্দনাদি ঝুঁকে পড়ে বলল, এ কী?

—চিনতে পারো?

ছবিগুলোর দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বন্দনাদি! তারপর ফ্যাকাসে গলায় বলল, কেন এনেছিস, নীলু? আমি তো চাই না।

—বন্দনাদি, আগে প্রত্যেকবার তুমি রূপসার খবর জানতে চাইতে। দারুণ একটা ব্যাকুলতা ফুটে উঠত তোমার মুখে। এবারে তুমি একবারও জিজ্ঞেস করোনি। মা কি তার সন্তানকে একেবারে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে?

—নীলু, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অনেক রকম, বিভিন্ন তার রং মাতৃস্নেহ ব্যাপারটাকে খুব গ্লোরিফাই করা হয়েছে, যেন মায়েরা সবাই মহান, সব মাই-ই তার সন্তানের জন্য দারুণ আত্মত্যাগ করে! এটা কিন্তু ঠিক নয়, সব মা একরকম হতে পারে না। অতি গরিব পরিবারে মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের যা সম্পর্ক, মধ্যবিত্ত পরিবারে সম্পর্কটা সেরকম নয়। অভাব, দারিদ্র্য, ক্ষুধার জ্বালায় মাতৃস্নেহ ক্ষয়ে যায়। খুব গরিবরা ছেলেমেয়েদের অনেক সময় বেড়াল-পার করে দেয়, কিংবা বিক্রি করে দেয়, মধ্যবিত্ত পরিবারের বাপ-মা তা কল্পনাও করতে পারে? মধ্যবিত্ত পরিবারে বাপ-মায়েরা সন্তানকে সব সময় আঁকড়ে রাখতে চায়। খুব ধনী পরিবার আবার অন্য রকম, তাদের অনেক কাজের লোক, আশ্রিত পরিজন থাকে, তারা ছোট ছেলেমেয়েদের দেখে। তাই বাপ-মা সন্তানদের নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। সারা দিনে বড় জোর একবার দু’বার দেখা হয়।

—তুমি আমার কাছে লেকচার দিচ্ছ, বন্দনাদি। মনের কথা বলছ না।

—না রে, এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। প্রথম প্রথম তো অনবরত ভাবতুম, একা একা কাঁদতুম। মাতৃস্নেহ তো একটা ইনস্টিংক্‌ট! ছেলেমেয়েদের হাত-পা শক্ত হবার আগে পর্যন্ত মা যাতে তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করে, সেইজন্য প্রকৃতি মেয়েদের মধ্যে এই টানটা ভরে দিয়েছে। ছেলেমেয়েদের দেখাশুনো করার জন্য যদি অন্য লোক থাকে, তা হলে এই টানটা আপনিই কমে যায়। আমার দিদি রূপসাকে নিজের মেয়ের মতনই যত্ন করবে আমি জানি, সুতরাং আমি আর উতলা হব কেন? রূপসা আমাকে দেখলে এখন হয়তো আর চিনতেই পারবে না। কোনওক্রমে চিনলেও মাসি বলে ডাকবে!

—রক্তের টান বলে কিছু নেই?

—অনেক গল্প-কবিতায় আছে। সেই গল্প-কবিতার প্রভাব অনেক মধ্যবিত্ত মায়ের মনের মধ্যে থাকে।

—ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে আর মাতৃস্নেহ থাকে না!

—থাকে, কিন্তু অনেক কমে যায় ভাই, কমে যায়। একটা দু’তিন বছরের বাচ্চা একটুক্ষণ চোখের আড়াল হলেই মায়েরা কী রকম ছটফটিয়ে ওঠে। আর মেয়ে যখন বিয়ের পর পরের ঘরে চলে যায়, কিংবা ছেলে যখন বিদেশে চাকরি করতে যায়, বছরের পর বছর দেখা হয় না, তখনও কি সেরকম ছটফটানি থাকে?

—তোমার দিদি নাচ জানে না। তুমি নাম করা নাচিয়ে ছিলে। তোমার দিদি তিনটি মেয়েকেই এক জায়গায় নাচ শেখায়, কিন্তু অন্য দু’জনের চেয়ে রূপসা যে অনেক ভাল নাচে তা সবাই স্বীকার করছে। এটাও রক্তের টান নয়?

—কী জানি, ও নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না।

—এই রূপসার জন্যই তোমার জীবনটা বদলে গেল!

—অনেক ছোটখাটো ব্যাপারের জন্য মানুষের জীবন বদলে যেতে পারে। কত লোক লটারির টিকিট কাটে। কিছু পেল না, টিকিটটা ফেলে দেয়। হঠাৎ এক কোটি টাকা পেয়ে গেলে তার জীবনটা অন্যরকম হয়ে যায়। কেউ রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, আচমকা একটা গাড়ি ধাক্কা মেরে তার একটা পা খোঁড়া করে দিয়ে গেল। আগের মুহূর্তে তার যা জীবন ছিল, পরবর্তী জীবনটা সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে গেল। তা বলে কেউ লটারি, লটারি বা অ্যাক্সিডেন্ট, অ্যাক্সিডেন্ট বলে সারা জীবন চিৎকার করে না। জীবন সব কিছুই মানিয়ে নেয়।

—আমার কী ইচ্ছে করে জানো, বন্দনাদি? তুমি যদি আর একবার কলকাতায় যাও, সবার সামনে আত্মপ্রকাশ করো, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া, আর তোমার মনের অবস্থা কী হবে, তা খুব জানতে ইচ্ছে করে!

—আমি? আবার কলকাতায়? ওই ধুলো, ধোঁয়া, মদ-সিগারেট, ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, লোভ, বড় বড় রেস্তোরাঁ বিষাক্ত মশলা মেশানো খাবার লোকে গপ গপ করে খাচ্ছে, সেই সব দৃশ্য ভাবলেই ঘেন্নায় আমার গা গুলিয়ে ওঠে। তুই বললি, রূপসার জন্য আমার জীবন বদলে গেছে। হ্যাঁ, কিন্তু সেই অ্যাক্সিডেন্টে আমার পা খোঁড়া হয়নি, বরং আমি দুটো ডানা পেয়েছি। যখন তখন উড়ে যেতে পারি। সত্যিই পারি। তুই যদি এই দিকশূন্যপুরে অন্তত ছ’মাস থাকিস, দেখবি কোনও কিছুর জন্যই তোর আর লোভ হবে না। আস্তে আস্তে কমতে কমতে মিলিয়ে যায়। তাতে কী শান্তি! কারুর সঙ্গে কারুর স্বার্থের সম্পর্ক নেই, তবু যে-কোনও একজনের বিপদে অন্যরা ছুটে আসে। এ জায়গা ছেড়ে আর আমি সারা জীবন কোথাও যাব না নীলু!

—অন্য সব লোভ চলে যেতে পারে, কিন্তু শরীরের কামনা কি যায়?

—কামনা কথাটা শুনতে ভাল না। তাতে যেন শুধু কাম মিশে থাকে। বরং আকাঙ্ক্ষা বা বাসনা বলা যেতে পারে। ইচ্ছেটা খুব তীব্র হলে তার থেকে আসে ভালবাসা। দু’জনের ভালবাসা যদি মেলে, তখন শরীর তো কোনও বাধা হতে পারে না?

—যদি ছেলে মেয়ে জন্মে যায়?

—জন্মালে জন্মাবে। যাদের ব্যাপার তারা বুঝবে।

—কিন্তু তোমাদের নীহারদা, জ্যোৎস্না নামের মেয়েটিকে জোর করে চুমু খেতে গিয়েছিলেন। সেখানে দু’জনের ভালবাসা ছিল না।

—ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, ব্যতিক্রমই নিয়মকে প্রমাণ করে। দুটো একটা ব্যতিক্রম তো হতেই পারে। সবাই একরকমভাবে বদলায় না। রোহিলার ব্যাপারটা যেন একটা প্রচণ্ড ব্যতিক্রম।

—হ্যাঁ, রোহিলার ব্যাপারটা কী বলো তো!

—নীলু, তুই আমাদের একটা সাহায্য করবি?

—কী সাহায্য?

ছবিগুলো সরিয়ে রেখে বন্দনাদি আমার পাশে উঠে এল। আমার পিঠে হাত রেখে বলল, এতদিন পরে এলি, তোকে এখনও একটুও আদর করা হয়নি। তুই আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়। আমি তোর চুলে হাত বুলিয়ে দি।

অতি উত্তম প্রস্তাব। বিন্দুমাত্র দেরি না করে আমি বন্দনাদির চওড়া ঊরুদ্বয়ে মাথা রাখলুম। একটা হাত কোমরে। আমার নাকের খুব কাছে ওর স্তন।

বন্দনাদি আমার চুলে আঙুল দিয়ে বলল, নীলু, তুই ছাড়া আমার টানে আর তো কেউ ছুটে আসে না।

আমি বললুম, দ্যাখো, ওরকম বাচ্চা ছেলের মতন আদর আমি চাই না। ওই সুরে কথাও বলবে না, তা হলে আমি উঠে পড়ব কিন্তু।

বন্দনাদি ঝুঁকে আমার ঠোঁটে একটা চুমু দিল। সেটা যাতে সংক্ষিপ্ত না হয়, তাই আমি ওর মাথাটা চেপে ধরে রইলুম। চুমুর সঙ্গে আমি পেলুম বন্দনাদির বুকের সুগন্ধ।

মুখটা তুলে বন্দনাদি বলল, এই একবারই। আর না। শোন নীলু, তোকে একটা দায়িত্ব নিতে হবে, নিতেই হবে, তুই না বলতে পারবি না।

—সেইজন্য বুঝি আদরটা ঘুষ দিলে?

বন্দনাদি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, আদর করার সঙ্গে এই কথাটা বলা উচিত হয়নি, তাই না? ঠিক ধরে ফেলেছিস। তবে এরকম ঘুষকে বোধহয় নির্দোষ বলা যায়, তাই না?

—দায়িত্বটা কী শুনি?

—তোকে একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে হবে। মানে ওই রোহিলার সঙ্গে, তুই ঠিক পেরে যাবি, আমি জানি।

এবার আমার হাসির পালা। এমন মজার কথা কেউ শুনেছে? আমি বন্দনাদিকে ভালবাসি, ছুটে এসেছি তার সঙ্গে দেখা করতে। বন্দনাদিও, আমাকে ভালবাসে। ঊরু পেতে আমার মাথাকে স্থান দিয়ে তারপর সে বলছে কি না আমাকে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে যেতে!

বন্দনাদি সরলভাবে বলল, তাতে কী হয়েছে? তোকে ভালবাসি বলে কি আমি স্বার্থপর হব! তুই যখন কলকাতায় থাকিস, তখন অন্য মেয়ের সঙ্গে মিশতি না? আর কারুর সঙ্গে তোর ভাব ভালবাসা হবে না? আমারও তো- এখানে দু’তিনজনের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি বন্ধুত্ব আছে।

—রোহিলার সঙ্গে প্রেম করব, না প্রেমের অভিনয়?

—না, না, অভিনয়টা খুব বিশ্রী জিনিস। সত্যিকারের প্রেম। আগেরবার রোহিলার সঙ্গে তোর বেশ ভাব হয়েছিল, তার থেকেই প্রেম হতে পারে। সব প্রেমই চিরস্থায়ী কিংবা অমর হবে, তা আমি বিশ্বাস করি না। অল্প দিনের প্রেমও খুব খাঁটি হতে পারে।

—বন্দনাদি, আমি পাগলদের বড্ড ভয় পাই। পাগলের সঙ্গে কি প্রেম হয়?

—রোহিলা তেমন পাগল তোকে কে বলল? ওর যেটা চলছে, সেটাকে বলা যায়, আইডেন্টিটিটি ক্রাইসিস। বাংলায় কী বলব, আত্মপরিচয়ের সঙ্কট? মাঝে মাঝে ঠিক থাকে, মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। রোহিলা এমনিতে চমৎকার মেয়ে, হাসিখুশি, সবার সঙ্গে মিশতে পারে, চমৎকার নাচতে পারে, এক জ্যোৎস্না রাতে ও একাই নেচে নেচে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিল।

—আমি তো আগেরবার সেরকমই দেখে গেছি।

—হ্যাঁ। সেরকমই ছিল। তোর মনে আছে, নদীর ধারে একদিন একটা লোক বলেছিল, আমি এই মেয়েটিকে চিনি, এর নাম রোহিলা নয়, এ সুলোচনা!

—হ্যাঁ, মনে আছে, লোকটার ভাবভঙ্গি ভাল ছিল না।

এখানে অনেকে পূর্ব পরিচয় মুছে আসে। নাম বদলে ফেলে। আমরা তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। কার জীবনে কী ঘটেছিল, আমরা তা জানতেও চাই না। আমরা ওকে রোহিলা বলেই জানি, সেই নামটাই আমাদের কাছে সত্য।

—রোহিলা আমাকে বলেছিল, রোহিলাখণ্ড নামে একটা জায়গায় ফিল্মের আউটডোর শুটিং-এর সময় ফিল্মে অভিনয়ের ব্যাপারটার ওপরেই তিতিবিরক্ত হয়ে ও পালিয়ে যায়। সেই থেকে ও নাম নেয় রোহিলা। আগে নিশ্চয়ই ওর অন্য একটা নাম ছিল, সে নামটা কী, তা অবশ্য বলেনি।

সে যাই হোক না, আমাদের তাতে কী আসে যায়! টাক মাথা, জোড়া-ভুরু সেই লোকটার নাম বাসুদেবন, সে লোকটা বারবার দাবি করতে লাগল, সুলোচনা নামে অভিনেত্রীটি তার স্ত্রী ছিল, আর এই রোহিলাই সেই সুলোচনা।

—রোহিলা আমাদের কাছে বলেছিল, ওর কখনো বিয়ে হয়নি। অনেক পুরুষ ওকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে।

—রোহিলা আমাদেরও বলেছে, ওই বাসুদেবনকে ও চেনে না, কস্মিনকালে দেখেনি, কারুর সঙ্গেই ওর বিয়ে হয়নি। ওর কথাই সত্যি মনে হয়।

—তা হলে এমন হতে পারে, ওই বাসুদেবন লোকটাই পাগল। কিংবা বদ।

—অথবা দুটোই। এই ধরনের গণ্ডগোল আমাদের এখানে আগে কখনও হয়নি। এই বাসুদেবন যেখানেই রোাইলাকে দেখে, সেখানেই চেঁচিয়ে ডাকে, সুলোচনা, এই সুলোচনা। আর রোহিলা অমনি চিড়বিড়িয়ে ওঠে, সে বলে, না, না, আমি সুলোচনা নই, আমি রোহিলা!

—এটা তো নারী নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে যায়।

—বাসুদেবনকে আমরা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছি। আমি নিজে কতবার মিনতি করে বলেছি, আপনি পুরনো কথা ভুলে যান। রোহিলা যখন অস্বীকার করছে, তখন ওকে বারবার সুলোচনা নামে ডাকা ঠিক নয়। লোকটা কিছুতেই শুনবে না। জয়দীপকে তো জানিস কী রকম রগচটা, একদিন বাসুদেবনকে ঘুষি মেরে বসল। তাতে ফল হল উল্টো। এখানে মারামারি একেবারে নিষিদ্ধ। অনেকে বিরক্ত হয়ে জয়দীপকেও ক্ষমা চাইতে বলল। জয়দীপ কিছুতেই রাজি নয়। তার ফলে মিটিং ডাকা হল, আমি জোরজার করে জয়দীপকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ালাম। বাসুদেবন তখন আবদার ধরল, সুলোচনা তার ধর্মপত্নী, সুতরাং রোহিলা অর্থাৎ সুলোচনার সঙ্গে তার স্বামী-স্ত্রীর মতন বসবাস করার অধিকার আছে।

—মিটিং-এ কী সিদ্ধান্ত হল?

—বেশ তর্কাতর্কি হয়েছিল, কোনও মীমাংসাই হল না। আমি বলেছিলুম, রোহিলা যখন অস্বীকার করছে সে কারুর স্ত্রী নয়, আর তার নাম সুলোচনা নয়, তাহলে এই প্রশ্নটা এখন মুলতুবি থাক। রোহিলার ওপর জোর করা উচিত নয়। আমি ওকে সব সময় নিজের কাছে কাছে রাখতুম। রোহিলাও আমাকে আঁকড়ে ধরে ছিল। ওর প্রথম রাগ পড়ল বসন্ত রাওয়ের ওপর।

—সে তো নিরীহ মানুষ, সে আবার কী দোষ করল?

—বসন্ত রাও সারাদিন গাছতলায় বসে ছবি আঁকত, জানিস তো। রোহিলা ওর ভক্ত ছিল, ছবি আঁকা বিষয়ে পরামর্শ নিত। একদিন আমরা কয়েকজন মিলে বসন্ত রাওয়ের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। বসন্ত রাও কথায় কথায় বলল, দেখো, এখানে আমরা অবস্থা অনুযায়ী এক একটা নিয়ম-নীতি ঠিক করি। এই একটা ব্যাপারেও আমাদের নীতি ঠিক করতে হবে। স্বামী আর স্ত্রী দু’জনেই যদি এখানে আসে, এরকম আগে কখনও হয়নি, কিন্তু যদি আসে, তাহলে তারা একসঙ্গে থাকবে, না আলাদা আলাদা? স্বামী যদি চায়, তাকে কি আমরা নিবৃত্ত করতে পারি? দক্ষিণ ভারতে তামিল ফিল্মে সুলোচনা নামে একটি অল্পবয়েসী অভিনেত্রী খুব নাম করেছিল আমি জানি। হঠাৎ সে ফিল্ম ছেড়ে দেয়। সেই সুলোচনার সঙ্গে হয়তো এই বাসুদেবনের বিয়ে হয়েছিল। …রোহিলা কাছেই ছিল, সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, আমি কতবার বলেছি। আমি সুলোচনা নই, কোনওদিন আমার বিয়ে হয়নি, আমি তামিল ফিল্মে কখনও অভিনয়ও করিনি। …বসন্ত রাও সঙ্গে সঙ্গে বলল, না, না, তুমি না, মানে সুলোচনা নামে একজন আছে, তার সঙ্গে নিশ্চয়ই তোমার চেহারার খুব মিল, তাই বাসুদেবন ভুল করছে।

—রোহিলার সামনে এই আলোচনা করাটা ঠিক হয়নি।

—মারাত্মক ভুল হয়েছিল। রোহিলা হঠাৎ যেন বদলে গেল, ছুরির মতন ঝকঝক করতে লাগল চোখ দুটো। ঠোঁট বেঁকে গেল ঘৃণার ভঙ্গিতে, একটা পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে অস্বাভাবিক গলায় বলল, বসন্ত রাও, তোমাকে ভেবেছিলাম বন্ধু, তুমিও ওই লোকটার দলে, তুমি আমাকে মনে করো সুলোচনা, বিশ্বাসঘাতক!…সেই পাথরটা দিয়ে বসন্ত রাওয়ের ছবির ক্যানভাসটা ফালাফালা করে ছিঁড়ে দিল। তারপর থেকে বসন্ত রাও ছবি আঁকতে বসলেই ও ছিঁড়ে দেয়। বসন্ত রাও আর গাছতলায় বসে না ঘরের দরজা বন্ধ করে ছবি আঁকে।

–বসন্ত রাও ওই কথাটা বলতে গেল কেন? কোনও প্রাক্তন স্বামী আর স্ত্রী দু’জনেই যদি এখানে এসে পড়ে, তাহলেও তাদের দু’জনের আলাদা অস্তিত্ব। স্ত্রী যদি স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করে, তাহলেও স্বামী তার অধিকার খাটাবে? তা হতে পারে না।

—স্বাভাবিক বুদ্ধিতে সেরকমই মনে হয়। কিন্তু আইনের প্রশ্ন আছে। বাসুদেবন বলতে চায় যে তার স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়নি, লিগ্যাল সেপারেশান হয়নি, স্ত্রী শুধু পালিয়ে এসেছে। সে সম্পর্কটা আবার ঝালিয়ে নিতে চায়। অন্যরা সেখানে কী করে মাথা গলাবে?

—কিন্তু রোহিলা যে চাইছে না। সে হয়তো সত্যিই সুলোচনা নয়। চেহারার মিল আছে বলেই একটা উটকো লোককে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে হবে? তোমরা ওই বাসুদেবনকে তাড়িয়ে দিতে পারো না?

—কে তাড়িয়ে দেবে বল? আমাদের এখানে কেউ প্রেসিডেন্ট নয়, কেউ দলনেতা নয়, দল ফল কিচ্ছু নেই। যে-কোনও ব্যাপারে মিটিং ডেকে সবাই মিলে কিছু একটা ঠিক করা হয়। রোহিলাকে মানসিকভাবে জ্বালাতন করা ছাড়া বাসুদেবনের নামে আর কোনও অভিযোগ নেই। এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেকেই তাই মাথা ঘামাতে চায় না। বাসুদেবন অনেক দিন পর্যন্ত রোহিলার ওপর কোনও জোরজার করেনি, শুধু সুলোচনা, সুলোচনা বলে ডেকেছে। শুধু একদিন একটা ভুল করে ফেলল। রাত্তিরবেলা রোহিলার বাড়িতে হানা দিয়েছিল। রোহিলার চ্যাঁচামেচিতে অনেক লোকজন জড়ো হয়ে গেল, বাসুদেবনকে ধরে ফেলা হল হাতে নাতে। তক্ষুনি সভা ডেকে আমরা বললুম, এটা একটা গুরুতর অপরাধ। কোনও স্বামীও স্ত্রীর ওপর বলাৎকার করতে পারে না। সর্বসম্মতিক্রমে বাসুদেবনকে শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত হল।

—কী শাস্তি দাও তোমরা?

বয়কট। এক মাস বাসুদেবনের সঙ্গে কেউ কথা বলবে না। কোনও জিনিস বিনিময় করবে না, তার বাড়িতেও কেউ যাবে না। দু’দিনের মধ্যে বাসুদেবন এই জায়গা ছেড়ে চলে গেল!

—যাক বাঁচা গেল!

—নারে, অত সহজে মিটে যায়নি। যাবার আগে সে শাসিয়ে গেছে, সে শিগগির আবার ফিরে আসবে। লোকজন নিয়ে আসবে না পুলিশ আনবে কে জানে! রোহিলার ধারণা হয়েছে, বাসুদেবন পুলিশ এনে তাকে ধরে নিয়ে যাবে। তারপর থেকেই মাথার গোলমাল শুরু হয়ে গেল। সে ধরে বসে আছে, আমরা সবাই তাকে সুলোচনা মনে করি। পুলিশ এলে বলব, হ্যাঁ, ও রোহিলা নয়, সুলোচনা। আমরা যত অস্বীকার করি, ও অবুঝ হয়ে গেছে। সেই রাগে ও এখন লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। শুধু অন্যের নয়, নিজের জিনিসও ভেঙে টেঙে শেষ করে দিয়েছে। নদীর ধারে পাথরের ওপর ও একটা মূর্তি খোদাই করছিল, বেশ সুন্দর হচ্ছিল, সেটাকেও নিজের হাতে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। ও বাড়িতে এসে এটা সেটা ভাঙলেও আমরা কিচ্ছু মনে করি না, রাগ দেখাই না, কিন্তু এরকমভাবে কতদিন চলতে পারে বল? বাসুদেবন চলে গেছে দশ দিন আগে, যে-কোনওদিন ফিরে আসতে পারে, তখন আবার কী ঝঞ্ঝাট হবে কে জানে!

—হুঁ, বুঝলুম। তোমাদের এই স্বপ্নের দেশে এ কী অশান্তি! কিন্তু বন্দনাদি, আমি কতটুকু সাহায্য করতে পারি, বলো তো? ধরা যাক, তোমাদের কথা অনুযায়ী আমি রোহিলার সঙ্গে প্রেম করার চেষ্টা করলুম, প্রেম প্রেম ভাবও হল, তাতেই কি ও সুস্থ হয়ে উঠবে? আর ওই বাসুদেবন নামে লোকটা ফিরে এলেই বা কী করে সামলানো যাবে?

—শোন, নীলু, প্রেম করার কথাটা এমনি এমনি বলিনি। তুই প্রেম করলেই সব সমস্যা মিটে যাবে, তাও নয়। আসল দায়িত্বটা অন্য। এখানকার দু’জন ডাক্তার বলেছেন, রোহিলাকে দিকশূন্যপুরের বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার। আজকাল অনেক ওষুধ বেরিয়েছে। এ জায়গা থেকে কিছুদিনের জন্য চলে গেলেই ওর খানিকটা উন্নতি হতে পারে। কিন্তু কে ওকে নিয়ে যাবে? দিকশূন্যপুর ছেড়ে কেউ বাইরে যেতে চায় না। জানিস তো মাঝে মাঝে আমাদের দু’একটা শস্য বিক্রি করে খুব প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র, যেমন রং-তুলি, কাগজ-কলম, মোম, তেল এইসব কেনার জন্য দু’একজনকে দূরের একটা শহরে যেতেই হয়। তখনও এ ওকে ঠেলাঠেলি করে, এই জায়গা ছেড়ে বাইরের কোনও আওয়াজ আর ধোঁয়া ভরা শহরে কেউ এক রাত্রিও কাটাতে চায় না। তুই তো এখানে থাকিস না, একমাত্র তোর পক্ষেই রোহিলাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। পুলিশ যদি এখানে আসে, রোহিলাকে খুঁজে না পেলে কোনও গণ্ডগোল হবে না।

—রোহিলাকে আমি কোথায় নিয়ে যাব, বন্দনাদি? তুমি তো জানো, আমার চাল-চুলোর ঠিক নেই, টাকাপয়সাও নেই! ওর চিকিৎসার ব্যবস্থাই বা করব কী করে?

—তা অবশ্য ঠিক, তোর ঘাড়ে কতটা আর দায়িত্ব চাপানো যায়! তুই ওকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারবি না?

—রোহিলা আমাকে আগেরবার বলেছিল, ওর কোনও বাড়ি নেই। ওর আপনজন কেউ নেই।

—তা কি হয়? একটা মেয়ে, সে তো আর আকাশ থেকে পড়েনি। কেউ না কেউ আছে নিশ্চয়ই।

—সে রকম থাকলেই বা। ও সব ছেড়ে এখানে চলে এসেছে, কারুর প্রতি মায়ার বন্ধন নেই, এখন কার কাছে ফিরে যাবে? আমি ওর সঙ্গে প্রেম করে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাব এখান থেকে। তারপর এক জায়গায় ফেলে দিয়ে পালাব?

—না, না, নীলু। সেরকম হতেই পারে না। রোহিলার ওপর আমাদের যে খুব মায়া পড়ে গেছে। কিছুদিন বাইরে চিকিৎসা করিয়ে যদি আবার ফিরে আসে, সেটাই হবে সবচেয়ে ভাল। তার কোনও উপায় বার করা যায় না?

—রোহিলার সঙ্গে প্রেম করতে গেলে…সে নানান জিনিসপত্র ভাঙছে, যদি আমার মাথাটাও ভেঙে দেয়? যদি একটা পাথর ছুঁড়ে মারে।

—ধ্যাৎ, সে কথা ভাবিসনি। আসলে তো রোহিলা খুব নরম মেয়ে, ও এ পর্যন্ত কারুর গায়ে হাত দেয়নি। জিনিসপত্র যখন ভাঙতে শুরু করে, তখন ওকে ধমক দিলে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে। বাচ্চা মেয়েদের মতন কেঁদে ভাসায়। আজ দেখলি না? সেইজন্যই তো ওকে আমরা বকি না। আর একটা কথা, প্রত্যেকদিন ও এমন উগ্র মেজাজে থাকে না। মাঝে মাঝে দু’তিন দিন একেবারে চুপচাপ থাকে, বাড়িতে শুয়ে থাকে।

—বন্দনাদি, আমি বেকার বলে আমাকে অনেকে অনেক রকম কাজের ভার দেয়। কিন্তু এরকম অদ্ভুত ও কঠিন দায়িত্ব কখনও কেউ দেয়নি। এটা কি আমি পারব?

—একমাত্র তুই-ই পারতে পারিস, আর কেউ পারবে না!

আমি ধড়মড় করে উঠে বসলুম। এক যুবতীর কোলে মাথা দিয়ে আমি অন্য একটি যুবতীর কথা শুনে যাচ্ছি এতক্ষণ ধরে। তাও আবার কঠিন সমস্যার কথা। মধুর রসটি কখন অন্তর্হিত হয়ে গেছে।

ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললুম।

বন্দনাদি বলল, সে কী রে, তুই এখনও সিগারেট ছাড়িসনি?

—দাঁড়াও, অনেকক্ষণ সংযম নিয়ে ছিলুম। এখন বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া দিতে হবে। আমরা ধোঁয়া-দূষিত শহরের মানুষ, তাই বেশিক্ষণ ধোঁয়া ছাড়া থাকতে পারি না। তোমাদের এখানেও দু’একজন লুকিয়ে চুরিয়ে চুরুট খায়, আমি নাম বলব না।

—লুকিয়ে চুরিয়ে আর ক’দিন খাবে? একদিন স্টক তো ফুরোবেই। এখানে তো আর কিনতে পাওয়া যায় না। আজকাল আর আমি গন্ধটা একেবারে সহ্য করতে পারি না রে নীলু। ফেলে দে!

পরপর জোরে দুটো টান দিয়ে আমি সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিলুম। তারপর আবার উঠে গিয়ে সেটা পা দিয়ে নিভিয়ে আসতে হল।

তখুনি দূরে শোনা গেল মাদলের শব্দ।

চতুর্দিকে এমনই নিস্তব্ধতা, দূর থেকে হলেও মাদলের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়। এ শব্দটা অবশ্য তেমন দূরের নয়। এখানে মিটিং হয় বিভিন্ন চৌরাস্তার মোড়ে। মাদল বাজিয়ে ডাকা হয় সকলকে।

বন্দনাদি উঠে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করল, কোথাও মশাল জ্বলছে কিনা। দেখা গেল না। মাদলটা বেজেই চলেছে।

বন্দনাদি আমার বাহু চেপে ধরে বলল, নীলু, আমার ভয় করছে। এখানে আসার পর কোনওদিন একটুও পায় পাইনি। যদি বাসুদেবন পুলিশ নিয়ে ফিরে আসে? আমাদের এই স্বর্গের শান্তি তছনছ হয়ে যাবে?

বন্দনাদি গলা ধরে গেল। স্পষ্ট বোঝা যায়, তার দু’চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *