চলো দিকশূন্যপুর – ৬

বিকেলের পর থেকেই রোহিলার মেজাজ উগ্র হতে থাকে। সন্ধের সময় কারুর বাড়িতে গেলে কিছু না কিছু ভাঙবেই, কারুর কথা শোনে না। কিন্তু সকালবেলাটায় সে নিজের বাড়িতেই থাকে, শুয়ে থাকে দরজা বন্ধ করে, পাশের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় কেউ কেউ তার কান্নার আওয়াজ শুনেছে।

সুতরাং আমার সকালেই যাওয়া উচিত, এই সকলের অভিমত।

দু’কাপের পর তৃতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছি, বন্দনাদি বলল, আর কত দেরি করবি, নীলু? এবার উঠে পড়।

বসন্ত রাও বলল, হ্যাঁ নীলু, এই বেলাবেলি তোমার বেরিয়ে পড়াই ভাল।

সবাই মিলে ঠেলাঠেলি করে আমাকে একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার জন্য পাঠাতে চায়। ওরে বাবারে, এত বিপদে আমি আগে কখনও পড়িনি।

জয়দীপ ভোর হবার আগেই বেরিয়ে গেছে। অচিন্তনীয় বারান্দায় জোড়াসনে বসে সূর্যের দিকে মুখ করে বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন, কোনও মন্ত্রটন্ত্র জপ করছেন বোধহয়।

জিজ্ঞেস করলুল, ম্যাজিশিয়ান, আপনি বলুন তো, আপনি তো অনেক কিছু জানতে পারেন, আমি পারব?

সবেগে মাথা নেড়ে তিনি বললেন, না, পারবে না!

বন্দনাদি বলল, ও কী অচিন্ত্যদা, আপনি আগে থেকেই ও রকম অলক্ষুনে কথা বলবেন না তো!

আগের রাতে অনেকক্ষণ এই বিষয়েই আলোচনা হয়েছে। রোহিলাকে অন্তত কিছুদিনের জন্য দিকশূন্যপুরের বাইরে নিয়ে যাওয়া উচিত, সে বিষয়ে সবাই একমত। এবং সে দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হবে।

বন্দনাদি বলল, চল নীলু, আমি তোকে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে আসি।

বসন্ত রাও-ও উঠে দাঁড়াল। অচিন্তনীয় বললেন, আমি যাচ্ছি না। প্রেম ট্রেম হবে না। নীললোহিত, তুমি প্রথমবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসো, তারপর আমি তোমাকে ঠিক ঠিক উপায় বাতলে দেব!

রোহিলার বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে বন্দনাদি বলল, আমরা আর যাব না। ও যেন বুঝতে না পারে। আমরা যেন কেউ কিছু জানি না।

আমি বললুম, বন্দনাদি, যদি রোহিলা আমার মাথা ফাটিয়ে দেয় কিংবা আমি অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি, তা হলে ঘণ্টা দুয়েক বাদে তোমরা একবার খোঁজ নিয়ো!

বন্দনাদি বলল, যাঃ, সে রকম কিছু হবে না। রোহিলা এ পর্যন্ত কারুর গায়ে হাত তোলেনি! কারুর গায়ে কিছু ছুড়ে মারেনি।

এ কথায় বিশেষ সান্ত্বনা পাওয়া গেল না। আমাকে দিয়েই প্রথম শুরু হতে পারে। আমার মতন বাড়ি বয়ে আর কেউ তো প্রেম করতে যায়নি।

বন্দনাদির চলে যাবার পর আমি একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলুম। লাল সুরকির রাস্তাটা সোজা অনেক দূর চলে গেছে। রাস্তায় আর কেউ নেই। আমি দেশ-বিদেশের কত রাস্তায় একা একা ঘুরেছি। কখনও এমন নিঃসঙ্গ বোধ করিনি।

ঝিরঝির করে বাতাস বইছে, সেই বাতাস যেন আমার কানে কানে বলছে, যেয়ো না, যেয়ো না!

ওই জয়দীপটা যদি রোহিলার সঙ্গে প্রেম করত, তা হলেই সব দিক থেকে মানিয়ে যেত। কিন্তু ওই নব-কার্তিকের মতন চেহারা নিয়েও জয়দীপ কোনও মেয়ের হাত ধরতেও চায় না। কোন মেয়ে ওকে এমন দাগা দিয়েছে কে জানে!

তিন বছর আগে, রোহিলা তখন এখানে সদ্য এসেছে, সংকোচ-জড়তা কাটেনি, কারুর সঙ্গে মিশতে পারত না। আমিই প্রথম ওর সঙ্গে ভাব করি, বন্দনাদির বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। তারপর রোহিলাকে সকলেরই খুব পছন্দ হয়েছিল। সব কিছুতে ওর শিশুর মতন বিস্ময়, সত্যি যেন তিন বছর বয়েস। ফিল্মের সহ-নায়িকা হিসেবে রোহিলাকে শুধু শরীর দেখাতে হত, নানা ভঙ্গিমায় শরীর, যেন ও একটা রক্ত-মাংসের পুতুল।

অধিকাংশ সিনেমাতেই ওকে মরে যেতে হত। জলে ঝাঁপ দিয়ে, পাহাড়ের ওপর থেকে লাফিয়ে। সুন্দরী মেয়ের মৃত্যু দৃশ্যে দর্শকরা খুব রোমাঞ্চ বোধ করে। সব ক’টা ফিল্ম মিলিয়ে ও সতেরো বার মরেছে। মরতে মরতে ক্লান্ত হয়ে রোহিলা একদিন ছুটে পালায়। দিকশূন্যপুরে ও নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছিল। এটা ওর পক্ষে সঠিক জায়গা। ওই বাসুদেবন নামে লোকটা সব গণ্ডগোল করে দিল!

রোহিলার বাড়ি থেকে খানিকটা দূরেই বিজনের বাড়ি। আগে ওর বাড়িটা ঘুরে যাব? বিজন নিশ্চয়ই মুর্গির ডিম খাওয়াবে, তাতে খানিকটা গায়ের জোর বাড়বে। বিজনের কাছ থেকে রোহিলার বিয়েভিয়ারাল প্যাটার্ন সম্পর্কে আরও খোঁজখবর পাওয়া যেতে পারে।

কয়েক পা এগিয়েও মনে হল, যাক, অত কিছু দরকার নেই। যা হবার তা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক।

রোহিলার বাড়িটি ছোট। একটিই মাত্র ঘর, সঙ্গে বারান্দা, পাশে বাগান। বাগানের একদিকে একটা কঞ্চির গেট আছে, সেই গেট ঠেলে একবার গলা খাঁকারি দিয়ে আমি বীরদর্পে ঢুকে এলুম ভেতরে।

শোবার ঘরের দরজাটা বন্ধ নয়, খোলা।

দরজার চৌকাঠে পা ছড়িয়ে বসে আছে রোহিলা। সেই কালো শাড়িটাই পরা। এই একই শাড়ি ও দিনের পর দিন পরে থাকে নাকি? গায়ে গন্ধ হয়ে যাবে না! খোলা চুলে মনে হয় বেশ কয়েকদিন চিরুনি পড়েনি, বোধহয় স্নানও করে না। খায় তো কিছু?

মুখে সামান্য প্রসাধনের চিহ্ন নেই, তবু কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওর মুখখানি। দুর্গা প্রতিমার মতন চোখ। আগের চেয়ে একটু রোগা হয়ে গেছে, তবু শরীরের গড়নটা অপূর্ব।

এ রকম একজন নারীর সঙ্গে কথা বলা, ভাব জমানো কিংবা আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার ইচ্ছে জাগা পুরুষদের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু সামান্য পাগলামির ভাব দেখা দিয়েছে বলে কোনও পুরুষই ভয়ে ওর কাছে এগোয় না। তা হলে শুধু শরীর নয়, মনটাই আসল। মন জয় করতে না পারলে শরীরে সুখ নেই।

গেট খোলার শব্দ হতেই রোহিলা আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। আমার বুকে গুম গুম শব্দ হচ্ছে, তবু আমি এগিয়ে গেলুম অকুতোভয়ে। বারান্দায় উঠে একটা নিঃশ্বাস ফেললুম সজোরে।

রোহিলা জায়গা ছেড়ে নড়ল না। একটা কথাও বলল না!

বাগানটার কী অবস্থা। দোপাটি ফুল, গাঁদা ফুল, লঙ্কা ও ঢ্যাঁড়শ গাছ লাগানো ছিল, সব উপড়ে ফেলা হয়েছে। সম্ভবত কালই সন্ধেবেলা। রাতে অত বৃষ্টি হয়েছে, মাটি এখনও ভিজে ভিজে। এমনভাবে কেউ গাছ নষ্ট করে? চারা গাছগুলো মৃত শিশুর মতন মাটিতে শুয়ে আছে।

বাগানে নেমে গাছগুলো তুলে তুলে দেখলুম। অধিকাংশই শিকড় শুদ্ধ ওপড়ানো হয়েছে, আবার লাগিয়ে দিলে বেঁচে যেতে পারে। উবু হয়ে একটার পর একটা গাছ পুঁতে দিতে লাগলুম। মাটি খোঁড়ার কিছু নেই, বৃষ্টিতে তলতলে হয়ে আছে মাটি, হাত দিয়েই গর্ত করা যায়।

‘আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর’। মালাকর না হোক, মালী। রোহিলার দিকে পিঠ ফেরানো, আমার এখন মালীর ভূমিকা।

অনেকগুলো গাছ লাগিয়ে ফেলেছি, রোহিলা তখন প্রথম মুখ খুলল।

রোহিলা বলল, ওখানে ওসব কী হচ্ছে?

মুখ না ফিরিয়েই আমি উত্তর দিলুম, দেখতেই তো পাচ্ছ, গাছ পুঁতছি।

—কেন?

—পুঁতে দিলে আবার বেঁচে উঠতে পারে, সেইজন্য।

—আমার বাগান চাই না। আমি আবার তুলে ফেলে দেব।

—দিয়ো।

—তবু কেন লাগাচ্ছ?

—আমার ইচ্ছে হচ্ছে তাই!

এগুলোকে ঠিক প্রেমের সংলাপ বলা যায় না বোধহয়। যাই হোক, কিছু একটা শুরু তো হল!

রোহিলা আর কিছু বলল না, আমি এক এক করে সব গাছগুলোই পুঁতে দিলুম। আবার সেটা একটা বাগানের রূপ পেল। ফুলগুলো নেতিয়ে গেছে, কিন্তু কয়েকটা গাছে নধর চেহারার ঢ্যাঁড়শ ফলে আছে।

এখানে সব বাড়িতে কুয়ো থাকে না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বড় বড় কুয়ো আছে, অনেককে সেই সব কমন কুয়ো থেকে জল টেনে আনতে হয়। বুড়ো মানুষদের অন্যরা জল এনে দেয়। রোহিলার বাড়িতে কিন্তু রয়েছে কুয়ো, কী ভাগ্যিস দড়ি-বাঁধা বালতিটি রোহিলা রাগের মাথায় ভেতরে ফেলে দেয়নি!

কুয়ো থেকে জল তুলে হাত-পা ধুয়ে নিলুম। পাজামাতেও খানিকটা কাদা লেগেছে, সে আর কী করা যাবে।

এবার নজর পড়ল বারান্দাটার দিকে। কতদিন ঝাঁট দেওয়া, ধোওয়া-মোছা হয়নি কে জানে। অথচ এই রোহিলাই আগে কত পরিচ্ছন্ন স্বভাবের ছিল। ধুলো-ময়লা সহ্য করতে পারত না।

বারান্দাটার এখানে সেখানে কাদা জমে আছে। এক কোণে এঁটোকাঁটা, তরকারির খোসা, আরও অনেক আবর্জনা ডাঁই করা। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা ঝাঁটা খুঁজলুম। নেই। কুয়োটার পাশ দিয়ে সরু পথ, রান্নাঘরের কাছে পাওয়া গেল ঝাঁটা। সেটা নিয়ে এসে শুরু করে দিলাম সাফাই অভিযান।

‘ম্যায়নে চাকর রাখো জি। চাকর রাখো, চাকর রাখো, চাকর রাখো জি, ম্যায়নে… এখন অনায়াসে এই গানটা গাইতে পারি। প্রেমিকার বাড়িতে চাকর সাজাও সুখের। অবশ্য এক আধদিনের জন্য।

এবারে রোহিলা বেশ রুক্ষ স্বরে বলল, কী করছ, অ্যাঁ?

—ময়লা সাফ করছি।

—কেন?

—এ রকম বিচ্ছিরি, নোংরা বাড়িতে কোনও মানুষের থাকা উচিত নয়।

—আমার বাড়িতে এ সব করার জন্য তোমাকে কে পাঠিয়েছে?

—কেউ পাঠায়নি। নিজে এসেছি।

কুয়ো থেকে জল এনে বারান্দায় ছড়িয়ে দিতেই তার একটু ছিটে বোধহয় রোহিলার গায়ে লাগল। সে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল, সত্যি করে বলো তো, নীললোহিত, তোমাকে এখানে কে পাঠিয়েছে?

ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রায় এক মিনিট তাকিয়ে রইলুম ওর চোখের দিকে। আমার চোখ গরম হয়ে উঠল, রীতিমতন ধমক দিয়ে বললুম, ও, চিনতে পেরেছ তা হলে? কাল ন্যাকামি করছিলে কেন? ডাকলুম, তবু আমার সঙ্গে কথা বলোনি!

ধমক খেয়ে খানিকটা কুঁকড়ে গেল রোহিলা।

ম্লান গলায় বলল, কাল আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।

–চেনা কেউ যদি চিনতে না পারার ভান করে, তা হলে আমার অপমান হয় না?

—তুমি এসেছিলে অনেকদিন আগে। এখানে আমার কোনও বন্ধু নেই। সবাই আমাকে তাড়িয়ে দিতে চায়। তুমি কেন এসেছ, প্লিজ বলো!

—প্রেম করতে আসিনি, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। এসেছি দুটো একটা কথা বলতে। বন্ধুর সঙ্গে লোকে দেখা করতে আসে না? তুমি কথা বলতে না চাইলে চলে যাব!

—আমি তোমার বন্ধু?

—তাই তো ছিলে। একসঙ্গে নদীতে নেমেছিলুম, মনে নেই?

—আমায় কেন সবাই এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়? তুমি সেইজন্য এসেছো?

—আমি কেন সে রকম চাইব? আমি তো দিকশূন্যপুরের কেউ না!

—আমি যাব না, যাব না, কিছুতেই যাব না! এই দিকশূন্যপুরেই আমি মরব।

—মরার জন্য ব্যস্ততার তো কিছু নেই। রোহিলা, তুমি কতদিন স্নান করো না?

—আমার ইচ্ছে করে না, কিচ্ছু ইচ্ছে করে না।

—এই বিচ্ছিরি কালো পোশাকটা পরে থাকো কেন?

—এটা পরে থাকলে কেউ আমার দিকে তাকাবে না। সেই-ই তো ভাল। —শোনো, আমি একটা কথা বলব? তুমি স্নান করে নাও, আমি বসছি। স্নান করে কাপড়-টাপড় বদলে নাও, দেখবে মন ভাল হয়ে যাবে।

রোহিলার চোখে জল টলটল করছে, কান্না শুরু হতে দেরি নেই। কোনওক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে হি হি করে বেশ জোরে হেসে উঠল।

এই আকস্মিক পরিবর্তনে আমি খানিকটা থতোমতো হয়ে গেলুম।

সেইরকম হাসতে হাসতেই রোহিলা বলল, আমি তো পাগল হয়ে গেছি! জানো না, পাগলরা জলকে ভয় পায়। তাই তো স্নান করি না।

আমি আবার ধমক দিয়ে বললুম, পাগলরা কখনও নিজের পাগলামি টের পায়? তার মানে তুমি পাগল সেজে থাকো? পাগল সেজে লোকদের ভয় দেখাও?

—না গো, নীললোহিত, পাগল সাজি না। মাঝে মাঝে আমার মাথা টিপ টিপ করে, খুব ব্যথা নয়, তখন আমি কী যে করি, কী যে বলি, কিছুই খেয়াল থাকে না। সব কিছু ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে।

—দেখি তুমি কেমন জলকে ভয় পাও!

বালতিতে আধ বালতি জল ছিল, সেটা ঢেলে দিলুম রোহিলার মাথায়।

ও একবার কেঁপে উঠল, তারপর এই প্রথম মুখে স্বাভাবিক হাসি ফোটাল।

—চলো, কুয়োর ধারে, আমি তোমায় স্নানের জল তুলে দিচ্ছি!

বাধ্য মেয়ের মতন রোহিলা এসে বসল কুয়োতলায়। আমি বালতি বালতি জল তুলে ঢালতে লাগলুম ওর মাথায়। সাবান টাবানের বালাই নেই, খানিকটা বালি দিয়ে রোহিলা মুখ আর হাত-পা মেজে নিল। এককালের শৌখিন চিত্রতারকা, বড় বড় হোটেলে হোটেলে দিন কাটিয়েছে, এখন কুয়োর জলে স্নান করতে করতে বালি দিয়ে মুখ ঘষছে।

একসময় জল তোলা থামিয়ে বললুম, যাও, তুমি ঘরে গিয়ে কাপড়-টাপড় ছেড়ে এসো, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।

হেমেন মজুমদারের ছবি হয়ে ও ধীর পায়ে হেঁটে ঘরে চলে গেল।

আমি আবার বারান্দা পরিষ্কার করায় মন দিলুম। বন্দনাদিরা আমাকে রোহিলার সঙ্গে প্রেম করার প্ররোচনা দিয়েছিল। এ পর্যন্ত যা ঘটছে, তা কি প্রেমের দৃশ্য বলা চলে? প্রেম মানে কি শুধু মিষ্টি মিষ্টি কথা?

পোশাক বদলে ফিরে আসার বদলে রোহিলার একেবারে অন্য রূপ। একটা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে, মুখখানা সদ্য বৃষ্টিতে ধোওয়া সাদা গোলাপের মতন। পিঠের ওপর খোলা চুল।

মুগ্ধভাবে বললুম, বাঃ, এই তো সেই আগেকার রোহিলা!

রোহিলা বলল, তুমি আমাকে রোহিলা রোহিলা বলছ কেন? এখন এখানকার সবাই মনে করে আমি সুলোচনা। আমি একটা বাজে লোকের বউ।

—কেউ সে রকম মনে করে না।

—হ্যাঁ করে। বসন্ত রাও আমাকে ওই লোকটার হাতে তুলে দিতে চায়। আমি নাকি তামিল ফিল্মের অ্যাকট্রেস ছিলুম। আমি এক বর্ণ তামিল ভাষা জানি না। মা মেরির নামে শপথ করে বলছি।

—তুমি বুঝি ক্রিশ্চান?

—ছিলুম এক সময়ে। তাতে কী আসে যায়? এরা বুঝি ক্রিশ্চানদের পছন্দ করে না?

—যাঃ, এরা কেউ তা নিয়ে মাথাই ঘামায় না। কোনও এক তামিল অ্যাকট্রেসের সঙ্গে তোমার চেহারার হয়তো খানিকটা মিল আছে। বসন্ত রাও সেই কথাই বলেছে।

—আমি ওই লোকটার কাছে যাব না, যাব না, কিছুতেই যাব না। কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাব।

—ছিঃ রোহিলা, এমন মরার কথা বলতে নেই। কুয়োতে ঝাঁপ দিলে কুয়োর সব জল নষ্ট হবে, তোমার শরীরটা পচে গলে একটা বিশ্রী ব্যাপার হবে।

—তা হলে নদীতে ঝাঁপ দেব।

—সিনেমার শুটিং-এ যেমন ঝাঁপ দিতে। সতেরো বার মরেও তোমার তৃপ্তি হয়নি, আবার সেই কথা?

—ওই লোকটা পুলিশ নিয়ে আসবে, তখন এরা কেউ আমার পাশে দাঁড়াবে না আমি জানি। এরা সব ইনটেলেকচুয়াল, ইন্ট্রোভার্ট, এরা কেউ এ সব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমি একটা সাধারণ মেয়ে, আমার ছবি আঁকার কোনও দাম নেই, শুধু শরীর সর্বস্ব, ওই বাসুদেবন লোকটা কী চায় আমার কাছে? ওকে আমি খুন করব। পুলিশের সামনেই খুন করব।

—দাঁড়াও, দাঁড়াও, কেন কেউ তোমার পাশে দাঁড়াবে না? মেয়েরা নিশ্চয়ই দাঁড়াবে। বন্দনাদিকে তুমি চেনো না? আসুক না পুলিশ, ধরে নিয়ে যাওয়া অত সোজা নাকি? কোনও স্ত্রীর যদি আপত্তি থাকে, তা হলে কোনও স্বামীও তাকে জোর করে কোথাও নিয়ে যেতে পারে না।

রোহিলা তেজের সঙ্গে কথা বলছিল, হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমি ওকে কাঁদতে দিলুম। রাগের থেকে কান্না অনেক ভাল।

একটু পরে সজল নয়ন তুলে রোহিলা বলল, নীললোহিত, আমার জন্য যদি দিকশূন্যপুরে পুলিশ আসে, সেটাই কত বড় লজ্জার বলো তো! এ জায়গাটার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যাবে, আমার জন্য, আমার জন্য, আমি একটা তুচ্ছ মেয়ে, আমার মরে যাওয়াই ভাল আজই, তুমি এসেছ ভাল হয়েছে। শেষ দেখা হয়ে গেল, তুমি সবাইকে বলে দিয়ো, রোহিলা আর থাকবে না…

ওর আন্তরিক কাতরতা আমায় একটা ধাক্কা মারল। সত্যি এখানে পুলিশের বুট জুতোর শব্দের কথা আমিও কল্পনা করতে পারি না। যদি আসে, তার জন্য রোহিলা দায়ী নয়, দায়ী ওই বাসুদেবন নামে লোভী লোকটি, সে এখানকার অযোগ্য। পরমান্নে এক ফোঁটা চোনা।

এই কথা ভেবে ভেবে রোহিলার আরও মাথার গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই না আত্মহত্যা করে বসে।

আমার দাদার দু’জন ডাক্তার বন্ধু আছে। তাদের কাছে শুনেছি, রোগীর কাছে রোগ কখনও গোপন রাখতে নেই। চিকিৎসার সব পদ্ধতিও তাদের জানানো উচিত। একজন রোগীকে তো শুধু ডাক্তাররাই বাঁচায় না। তার ইচ্ছাশক্তিও তাকে বাঁচায়।

এবার আমাকে সেই কাজটা করতে হবে। প্রেমের অভিনয় নয়, সোজাসুজি সত্যি কথাটা বলা।

আমি বললুম, রোহিলা, চোখের জল মোছো। মন দিয়ে আমার একটা কথা শোনো। তুমি নিজেই তো বুঝেছো, তোমার মধ্যে মাঝে মাঝে পাগলামি দেখা দেয়। এটা কিন্তু ক্রমশ বাড়ছে। এক সময় তুমি বদ্ধ পাগল হয়ে যাবে, এই পৃথিবীর কিছুই আর তখন উপভোগ করতে পারবে না।

—তার আগে তো আমি মরেই যাব।

–বাজে কথা ছাড়ো। কাজের কথা শোনো। বারবার মরে যাবার কথা বলাটাও পাগলামির একটা লক্ষণ। এখনও চিকিৎসা করলে কিন্তু সেরে উঠতে পারো। ভাল ভাল ওষুধ বেরিয়েছে। সে জন্য বাইরে গিয়ে তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে।

—দিকশূন্যপুর ছেড়ে যাব? আমি? কিছুতেই না। কিছুতেই না। আর আমি ওদিককার জীবনে ফিরে যাব না। এখানেই মরব।

ছেড়ে যাবে কেন? কিছুদিনের জন্য যাবে, সুস্থ হয়ে আবার ফিরে আসবে। তখন সব কিছু আরও ভাল লাগবে। এরকম আধপাগল অবস্থায় থাকলে তুমি কারুর সঙ্গে মিশতে পারবে না। সবাই তোমাকে ভয় পাবে। সে অবস্থাটা কি ভাল? মরে গেলে তো সব কিছু ফুরিয়ে যাবে। বাঁচার যখন উপায় আছে, তখন বাঁচবে না কেন?

রোহিলা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে বাধা দিয়ে আমি আবার বললুম, তা ছাড়া, ভেবে দ্যাখো, তুমি কিছুদিন যদি বাইরে থাকো, তা হলে বাসুদেবন পুলিশ আনলেও ফিরে যাবে। এখানে কোনও গোলমাল হবে না। সেই সময়টায় তুমি চিকিৎসা করিয়ে নেবে।

বারান্দাটা ভিজে, বসবার উপায় নেই, আমরা কথা বলছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। দেওয়ালের দিকে ফিরে রোহিলা একটুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, আবার ফিরে আসতে পারব? কে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে?

—আমি। আমিই নিয়ে যেতে পারি।

—কোথায় যাব?

—যেখানে তোমার ইচ্ছে। তোমার বাড়ি, তোমার আপনজন কেউ নেই?

—কেউ নেই। আমার কেউ নেই। যারা ছিল, তাদের কাছে আর কোনওদিন ফিরে যাব না বলেই তো এখানে এসেছি। নীললোহিত, তুমি একবার বলেছিলে, তাজমহলে শুয়ে থাকার কথা। আমার খুব ইচ্ছে করে, জীবনে একটা রাত অন্তত তাজমহলে গিয়ে শুয়ে থাকতে।

—হ্যাঁ, তাজমহলে যাওয়া যেতে পারে। অসুবিধে কিছু নেই।

–সেখানে পুলিশ থাকে না?

—তাজমহলে পুলিশ? তাদের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেওয়া হয় না।

—আর খাজুরাহো মন্দিরের চত্বরে রাত্রে শুয়ে থাকা? ঘুমের মধ্যে চারদিকে নাচের শব্দ শোনা যায়। পাথরের মূর্তিগুলো জেগে ওঠে।

—সেখানে যাওয়া তো আরও সহজ। আমরা প্রথমেই সেখানে যেতে পারি।

—পাগল বলে তুমি মাঝপথে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না? আমি রাস্তা হারিয়ে ফেললে আর কোনওদিন দিকশূন্যপুর খুঁজে পাব না!

—তোমার চিকিৎসা হবে, তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে, তারপর আমিই আবার তোমাকে এ জায়গায় পৌঁছে দিয়ে যান।

—আমরা কবে যাব?

—আজই। বাসুদেবন পৌঁছোবার আগেই। সে যে কোনওদিন এসে যেতে পারে।

—আমার এই বাড়িটা কেউ নিয়ে নেবে না? নতুন যদি কেউ আসে, খালি বাড়ি দেখলে এখানে যদি ঢুকে পড়ে?

–বন্দনাদিকে বলে যাব, তোমার এই বাড়ি বন্ধ করে রাখবে। কেউ নেবে না। তুমি যে ছবিগুলো একেঁছো, সঙ্গে নিয়ে নিতে পারো।

–সব ছিঁড়ে ফেলেছি। আমার কিছু নেই। এখানকার বাইরের জগতে টাকা-পয়সা লাগে, তা কোথায় পাব? আমার গয়না-টয়নাও নেই, সব ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। নীললোহিত, আমি নিঃস্ব। কী করে যাব?

–ও সব তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার এখন কত বয়েস? ছ’ বছর না? ছ’ বছরের মেয়েরা টাকা পয়সা নিয়ে ভাবে না।

—তা হলে চলো, বেরিয়ে পড়ি। এক্ষুনি! চলো, চলো, চলো, চলো। আর দেরি নয়। আমাকে কি ডাক্তারেরা ইঞ্জেকশান দেবে? ব্যথা লাগিয়ে দেবে না তো?

—ঠিক ছ’ বছরের মেয়ের মতন কথা! রোহিলা, তুমি একটু কিছু খেয়ে টেয়ে তৈরি হয়ে নাও। বন্দনাদির বাড়িতে আমার ব্যাগটা আছে, সেটা নিতে হবে। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসছি, তারপর আমরা বেরিয়ে পড়ব।

এতক্ষণ বাদে রোহিলা আমার হাত চেপে ধরল। তার ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ওই লোকটা আসবার আগেই আমরা পালাব। বেশ হবে। পুলিশ এলে আমাকে খুঁজে পাবে না। নীললোহিত, তুমি ভুলে যাবে না তো? এক ঘণ্টা পরে ঠিক আসবে?

—মা মেরির নামে শপথ করে বলছি, ঠিক আসব।

রোহিলা আমাকে বাগানের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিল। আনন্দে তার চোখ ছলছল করছে। এখন ওকে দেখলে কে বলবে, ও পাগল!

এত সহজে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল? আমি আশাই করিনি।

দিকশূন্যপুরে এসে এ বার আর আমার থাকা হল না। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা। দেখা হল না অনেকের সঙ্গে। কী আর করা যাবে!

রোহিলাকে এখান থেকে নিয়ে কোথায় যাব, তাও জানি না। আমার কাছে যা পয়সা আছে, তাতে দু’জনের ট্রেন ভাড়া কোনওক্রমে কুলিয়ে যেতে পারে। এখানকার কেউ টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারবে না, কারণ মাটি টাকা, টাকা মাটি করতে করতে এখন এদের মাটিই সম্বল। কলকাতায় আমাদের বাড়িতেই বা ওকে নিয়ে তুলব কী করে? আড়াইখানা ঘরের ছোট্ট ফ্ল্যাট, টানাটানির সংসার। একটা চাকরি জোটাবার বদলে আমি যদি একটি জলজ্যান্ত মেয়েকে নিয়ে ফিরি। তা হলে দাদা একেবারে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যাবে। দাদাকে দোষ দেওয়া যায় না। মা যখন জিজ্ঞেস করবে, এই মেয়েটি তোর কে? তখন কী উত্তর দেব? আমি রোহিলার প্রেমিকও নই। এ পর্যন্ত যতজন পুরুষ ওর ওপর অবিচার, অন্যায় করেছে, আমি একলা তা শোধ দেব কী করে?

এখন আর অত চিন্তা করে লাভ নেই। বেরিয়ে তো পড়া যাক। চরৈবেতি।

একটুখানি যাবার পরই বিজনকে দেখলুম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হাতছানি দিয়ে বললে, এই নীলু, শোন, শোন।

কাছে যেতেই মাথাটা ঝুঁকিয়ে এনে ফিসফিস করে বলল, তুই রোহিলার বাড়িতে গিয়েছিলি? তোর তো খুব সাহস! তোকে কামড়ে টামরে দেয়নি তো?

আমি নিরীহ মুখ করে বললুম, না তো? কামড়াবে কেন? চুমু খেতে চেয়েছিল একবার। আমি অবশ্য বলেছি, দিনের বেলা আমি ওসব খাই না। সন্ধের পর দেখা যাবে!

রীতিমতন অবাক হয়ে বিজন বলল, সে কি? ইয়ার্কি করিস না নীলু, সত্যি করে বল তো, তোর দিকে কিছু ছুড়ে টুড়ে মারেনি?

—মারবে কেন? বরং চা তৈরি করে খাওয়াল। অনেক গল্প হল।

–তোর সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ছিল, মনে রেখেছে তা হলে। আমি তো ভয়ে ও বাড়ির দিকেই যাই না। মাঝে মাঝে রাত্তিরের দিকে শুনতে পাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদছে। শুনে খুব কষ্ট হয়, আবার ভয়ও করে।

—তুই এত কাছাকাছি বাড়িতে থাকিস, এই ক’ বছরের মধ্যে তোর সঙ্গে ওর ভাব হয়নি?

—প্রথম থেকেই ও আমাকে সুনজরে দেখেনি। ওর বাড়িতে মুর্গির মাংস পাঠালে ও ফেরত দেয়। পরে জানা গেছে, ও নিরামিষ খাবার পছন্দ করে, মাছ-মাংস ছুঁতেই চায় না। এ রকম তো অনেকেই নিরামিষ খায়, আবার অনেকে মাছ-মাংস খুবই পছন্দ করে। কিন্তু রোহিলা শুধু নিরামিষাশী নয়, আমি মুর্গি পালন করি বলে আমাকেও অপছন্দ করে। মোরগগুলো ভোর হতে না হতেই তো কঁকর কোঁ শুরু করে, তাতে ওর ঘুমের ব্যাঘাত হয়। ওর জন্য কি আমি ফার্মটা বন্ধ করে দিতে পারি?

—তুই মুর্গি পোষার কাজ শিখলি কবে? কলকাতায় তো কখনও দেখিনি!

–এখানে সকলকেই তো কিছু না কিছু করতে হয়। প্রথমে শখ করে চারটে মুর্গি দিয়ে শুরু করেছিলুম। সহজ হাঁস-মুগি পালন নামে একটা বাংলা বই পড়ে নিয়েছি। তারপর দেখতে দেখতে এত বেড়ে গেল!

—বিজন, তুই কলেজে ভাল ছাত্র ছিলি। কী কারণে তুই বাড়ি ঘর ছেড়ে, মায়ের মনে দাগা দিয়ে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেলি, তা আমি জানি না। জানতেও চাই না। কিন্তু এখানে এসে মুর্গির কারবারি হয়েছিস, এটাই কি জীবনের সার্থকতা?

—কারবারই বটে, কিন্তু কী অপূর্ব কারবার! দুনিয়ার আর কোথাও দেখেছিস? টাকা পয়সার কোনও লেনদেন নেই। আমি খেটেখুটে মুৰ্গি পালন করি, লোকেরা এসে এমনি এমনি নিয়ে যায়। যে যত চায় নিতে পারে। মানুষকে দেওয়ার মধ্যে যে কী অদ্ভুত আনন্দ তা তুই বুঝবি না। শহরের লোকরা মানুষকে ঠকিয়ে যত আনন্দ পায়, আমার আনন্দ তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি!

—তা বুঝলুম। তবু তো এটা কশাইয়ের কাজ, রোজ রোজ হাতে রক্ত মাখা।

—না, না, না, ও কাজ আমি করি না। আমার বাড়ি ঘুরে দ্যাখ, কোথাও এক ছিটে রক্তের দাগ পাবি না। মুর্গি কাটা দূরের কথা, আমি রক্ত সহ্যই করতে পারি না। আমার বাড়িতে ছুরি, কাটারিও নেই। ও কাজ করে দেবদত্ত, সুলেমান, আজিজ, আপ্পা রাও এরা ক’জন। অনেক দূরে মাঠের মধ্যে নিয়ে গিয়ে কাটে। তুই বিশ্বাস করবি না নীলু, আমি নিজে মুর্গি খাই না। তবে ডিম খাই। তুই খাবি দুটো ডিম সেদ্ধ? বাড়িতে অনেক ডিম জমে গেছে। ভেতরে এসে বোস, তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথাও আছে।

আমি ডিম খেতে এতই ভালবাসি যে এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা যায় না। একটা ডিমেও ঠিক মন ভরে না। এক জোড়াই ঠিকঠাক।

বিজনের বাড়ি-সংলগ্ন বাগান নেই। চতুর্দিকে শুধু বাঁশের তৈরি মুর্গির খাঁচা, তাতে নানা আকারের মুর্গি। এগুলো সাদা সাদা পোলট্রির মুর্গি নয়, রঙিন, দিশি। মুর্গি পালনের প্রধান ভয় হচ্ছে মড়ক। এখানে কল-কারখানায় তেল-কালি-ধোঁয়া নেই, কোনও রকম বায়ুদূষণ নেই, তাই এখানে অসুখ বিসুখ কম হয়। মুর্গিগুলোরও স্বাস্থ্য ভাল।

বারান্দায় কয়েকটা মোড়া রয়েছে। একটা তোলা উনুনে বিজন কেটলি চাপিয়ে এল। ওই কেটলিতেই চা হয়, ওতেই ডিম সেদ্ধ, ওতে ভাতও হতে পারে বোধহয়। ওর সসপ্যান, ডেকচি লাগে না। অনেক কিছুই এ ভাবে সহজ করে নেওয়া যায়।

আমার মুখোমুখি বসে বিজন বলল, নীলু, কালকের মিটিংয়ের পর নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার সময় তোর কথা উঠেছিল। তোকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

—কেন, আমি হঠাৎ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠলুম কেন? কী করেছি?

—তুই মাঝে মাঝে এখানে আসিস, অতিথির মতন দু’ চারদিন থেকে আবার চলে যাস, এটা অনেকের পছন্দ নয়।

—এখানে কারুর অতিথি আসা অপরাধ?

—মানে, এটা তো ঠিক বেড়াবার জায়গা নয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্রও নয়। কেউ দু’ চারদিনের জন্য এল, আমোদ করল, ফিরে গেল, এটা অন্যদের ভাল লাগবে কেন? তোর মতন যদি দলে দলে আরও অনেক লোক আসতে শুরু করে, তা হলে এখানকার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে।

—একবার এখানে আমারও পাকাপাকি থাকার কথা হয়েছিল, একটা বাড়িও দেওয়া হয়েছিল আমাকে।

—হ্যাঁ, কিন্তু তুই থাকতে পারিসনি, মাঝরাতে চলে গেলি। তার মানে এখানকার মানসিকতার সঙ্গে তোর মিল নেই।

—এখানকার মানসিকতা ঠিক কী?

–এক কথায় বলা যাবে না। এখানে যারা আসে, তারা অনেক কিছু ছেড়ে আসে, অনেক বন্ধন ছিঁড়ে আসে, তাই প্রথম প্রথম সবারই খুব মন খারাপ থাকে। কিছুদিন পর টের পাওয়া যায়, এখানকার বাতাসে একটা সুর আছে, তার সঙ্গে নিজেরটা মেলাতে পারলে অনেক গ্লানি কেটে যায়। বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা কোথাও অনেকে একজোট হয়ে ধর্মীয় সাধনা করে, এ রকম তো কতই আছে। এখানে কোনও ধর্মের ব্যাপার নেই, তবু একটা সাধনা আছে, সেটা হচ্ছে মন থেকে স্বার্থজ্ঞান সম্পূর্ণ মুছে ফেলার সাধনা। একবার তা পারলে মনটা ভারী নির্মল হয়ে যায়, প্রতিদিন বেঁচে থাকাটা সার্থক মনে হয়।

—আমি সাধনা-টাধনা করি না বটে, তবু নিজেকে খুব একটা স্বার্থপর তো মনে হয় না। সে যাই হোক আমার এখানে আসাটা অনেকে পছন্দ করে না। তা শুনে তুই কী বললি, বিজন? তুই নিশ্চয়ই বলেছিস, ঠিক ঠিক, ওই নীললোহিতটাকে এখানে একদম আসতে দেওয়া উচিত নয়। ওকে বারণ করে দেওয়া হোক!

বিজন আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল একটুক্ষণ। ছেলেবেলায় এই বিজনের সঙ্গে আমি গুলি খেলেছি, ঘুড়ি উড়িয়েছি। সেই বিজনকে যেন এখন আর আমি চিনতে পারি না। কলকাতা ছেড়ে এসে এখানে মুর্গিওয়ালা হয়েছে, অথচ ওর মুখে সাধু সাধু ভাব। রামকৃষ্ণ মিশন বা অন্যান্য জায়গায় এ রকম অল্পবয়েসী সন্ন্যাসী দেখেছি, তারা কীসের আকর্ষণে বাড়ি-ঘর, প্রেম-পরিণয় ছেড়ে ওখানে যায় তা বোঝা আমার অসাধ্য।

বিজন বলল, সত্যি কথা বলছি, তোকে দেখলে তোমার দু’রকম অনুভুতি হয়। প্রথমে বিরাগের ভাব হয়। মনে হয়, নীলুটা আবার এসেছে কেন? ওর গায়ে লেগে আছে কলকাতা শহরের নোংরা বাতাস। আগেকার জীবনের যা সব আমি ভুলে যেতে চাই, তুই তা নিয়ে আসিস। আবার মনের একটা অংশ খুশিও হয়। তোকে দেখলে মনে পড়ে যায় আমার মায়ের কথা, আমাদের বাড়ির রাস্তা, কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়া, কফি হাউস, এ সব মন থেকে তাড়াতে চাই আবার উপভোগও করি। অনেকটা নিষিদ্ধ সুখের মতন। আগেরবার তুই আমার মায়ের কথা বলতে শুরু করলে আমি থামিয়ে দিয়েছিলুম, অথচ ইচ্ছে করছিল, বলুক, আর একটু বলুক! তোর এখানে আসাটা আমি পছন্দ করি না, অথচ চাই নীলু বারবার এখানে ফিরে আসুক। এ রকম দোটানা রয়েই গেছে আমার মধ্যে।

—আমি একটা প্রশ্ন করব, তার সত্যি উত্তর দিবি বিজন? তোর বাড়ির এত কাছে রোহিলার মতন একটি রূপসী মেয়ে থাকে, তার জন্য তোর মনে কখনও ছটফটানি হয়নি? ওর সঙ্গে ভাব করতে ইচ্ছে হয়নি? ওর রূপ তোকে টানেনি?

দু’দিকে মাথা নেড়ে বিজন আস্তে আস্তে বলল, না। সত্যি না। ওর মনের সঙ্গে যে আমার মন মেলেনি, তা হলে রূপ টানবে কী করে? ও খানিকটা শিল্পী স্বভাবের, তাই প্রথম থেকেই খানিকটা পাগলাটে। আমি তো তা নই। তবে আমি জানি, মেয়েটা ভাল। খাঁটি। অনেক পোড় খেয়ে বিশুদ্ধ হয়েছে। স্বার্থ কাকে বলে জানেই না।

—বাসুদেবন নামে একটা লোক ওকে খুব বিরক্ত করে। একদিন মাঝরাত্তিরে এসে হামলা করেছিল, তুই তখন ছিলি?

—হামলা তো করেনি! রোহিলার চিৎকার শুনে অনেকে ছুটে এসেছিল, আমিও গিয়েছিলুম। রোহিলার ঘরের দরজা বন্ধ ছিল, জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল বাসুদেবন। আমাদের দেখেও পালায়নি। ওর বক্তব্য, রোহিলা ওর সঙ্গে কথা বলে না, সব সময় এড়িয়ে যায়, কিন্তু রোহিলার কাছে ওর কিছু একটা প্রশ্ন আছে। রোহিলা সারাদিন প্রায় বাড়িতেই থাকে না বলে বাসুদেবন অত রাত্রে এসেছিল। তবে লোকটা খুব রাগী। রোহিলার চ্যাঁচামেচির জন্য আমরা ছুটে এসেছি বলে ও রাগে দাঁত তো কিরমির করছিল।

হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় আমি বললুম, এই দ্যাখ দ্যাখ ডিমগুলো বেশি সেদ্ধ হয়ে গেল কি না। আমি থ্রি কোয়ার্টার বয়েল পছন্দ করি।

পোলট্রির ডিম খেয়ে খেয়ে বিরক্তি জন্মে গেছে, ভেতরটা সাদা, ফ্যাটফেটে, কোনও স্বাদই নেই। এখানে টাটকা দিশি মুর্গির ডিম। কুসুম একেবারে টুকটুকে লাল, অপূর্ব, অপূর্ব! শুধু একটু গোল মরিচের গুঁড়োর অভাব অনুভব করা গেল। এরা গোল মরিচের চাষ জানে না।

আমার হাতে বেশি সময় নেই, উঠে পড়তে হল তক্ষুনি।

হনহন করে হেঁটে এসে দেখি টিলাটার নীচেই অপেক্ষা করছে বন্দনাদি আর বসন্ত রাও। চোখে মুখে উদ্বিগ্ন ভাব। আমাকে দেখেই বন্দনাদি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কী রে, তোর এত দেরি হচ্ছে দেখে আমরা ভাবছিলুম ওর ওখানে গিয়ে হাজির হব কি না।

যাকে বলে একগাল হেসে আমি বললুম, দেখো, সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছি। শুধু তাই নয়। এর মধ্যেই এমন প্রেম জমে গেল যে রোহিলা আমার সঙ্গে ইলোপ করতে রাজি হয়ে গেছে। আমরা তাজমহলের আঙিনায় ঘর বাঁধব।

বন্দনাদি বলল, ফক্কুড়ি করিস না। কী হল, সব খুলে বল?

–বিশেষ তো বলবার কিছু নেই। সত্যি ও আমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেছে। চিকিৎসার কথাও বলেছি।

—এত সহজে রাজি হয়ে গেল? কথা বলল? স্বাভাবিক ছিল?

—একেবারে স্বাভাবিক। বড় বেশি স্বাভাবিক।

—সন্ধের পর আবার কী হয় কে জানে!

—সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। আমরা এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ব। তোমার বাড়ি থেকে ব্যাগটা নিয়েই–

—এক্ষুনি, মানে আজই চলে যাবি। যাঃ, তা হয় না। তুই এত কষ্ট করে এসেছিস, তোর থাকাই হল না। আর রোহিলা আমাদের এত প্রিয়, ওকে এমনি এমনি চলে যেতে দেওয়াটা ভাল দেখায়? তোদের দু’জনের জন্য আজ রাত্তিরে আমার বাড়িতে একটা মজলিশ বসাতে হবে। গান বাজনা হবে, আনন্দ হবে, রোহিলা জেনে যাক, সবাই তাকে কত ভালবাসে। আমি রোহিলাকে এখনই আমার বাড়িতে আনিয়ে নিচ্ছি।

—কিন্তু যদি আজই বাসুদেবনের সঙ্গে পুলিশ এসে পড়ে?

—এই দশদিনের মধ্যে এল না, আজই আসবে?

বসন্ত রাও বলল, আসুক না পুলিশ, তখন দেখা যাবে। এলে তো পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে আসবে, ভাঙা রাস্তা। ব্রিজ উড়ে গেছে, গাড়ি চলে না। ও দিকে নজর রাখব। দূর থেকে পুলিশ দেখা গেলেই তুমি রোহিলাকে নিয়ে নদী পেরিয়ে চলে যাবে। তারপর পুলিশকে আমরা নাস্তানাবুদ খাওয়াব। আজ তোমাদের দু’জনের একটি বিনোদন-সন্ধ্যা প্রাপ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *