চলো দিকশূন্যপুর – ২

ট্রেন থেকে ছোট্ট স্টেশনটায় নেমেই মনে পড়ল, কয়েকটা জিনিস আমার সঙ্গে নিয়ে আসা উচিত ছিল। খানিকটা ভাল চা, দু-এক প্যাকেট ব্লেড, খান কয়েক সুগন্ধি সাবান। দিকশূন্যপুরে আমার বন্ধুরা এইরকম টুকিটাকি উপহার পেলে খুব খুশি হয়। তাদের সেই খুশির মাধুর্যটুকু দেখতে বড় ভাল লাগে।

এত তাড়াহুড়ো করে আসতে হয়েছে যে, এ সব কিছু মনে পড়েনি। সবসময় ভয় ছিল, দাদা যদি জোর করে ডাল্টনগঞ্জে পাঠিয়ে দেয়, কিংবা লালুদা আমাকে ধরে ফেলে! আমার গোপন অভিপ্রায় শুধু জানিয়েছিলুম বউদিকে। দিকশূন্যপুরের কথা কারুকে বলতে নেই, তবু বন্দনাদির কথা : আমার বউদি কিছুটা শুনেছে। বন্দনাদি আমার বউদির কলেজের বান্ধবী।

বন্দনাদি যে বেঁচে আছে, কোনও গোপন জায়গায় একা একা স্বাবলম্বী হয়ে আছে, এটা জেনেই বউদি খুশি। মেয়েদের মধ্যে, বিশেষত বিবাহিতা মেয়েদের, দু’রকম টান থাকে। তারা সংসার ভালবাসে, স্বামী-পুত্র-কন্যা নিয়ে জীবনটাকে সাজিয়ে তৃপ্তি পায়। কিন্তু তৃপ্তিটা আংশিক। এই সব কিছু সত্ত্বেও মাঝে মাঝে তারা মুক্তি চায়, একাকিত্ব চায়। আমার বউ নেই, তবু আমি এসব জানলুম কী করে? জানাটা এমন কিছু শক্ত নয়, চোখ-কান খোলা রাখলেই চলে। কত বাড়িতে গিয়ে আমি আপাতত-সুখী বিবাহিতা মেয়েদের বলতে শুনেছি, আমার খুব ইচ্ছে করে কোথাও গিয়ে একদম একা একা থাকি, কেউ ডিসটার্ব করবে না, কেউ আমাকে চিনবে না—

আমার বউদিরও এরকম একটা স্বপ্ন আছে, যদিও শাশুড়ির সঙ্গে তার ঝগড়া বা মনোমালিন্য নেই, স্বামী তাকে অনাদর করে না, দেওরের সঙ্গেও বেশ ভাব। তবু।

এই ছোট্ট স্টেশনটাতে দু’-একটা নড়বড়ে দোকান রয়েছে, বিশেষ কিছুই পাওয়া যায় না। এমনকী ব্লেডও নেই। আগেরবার দেখেছিলুম, জয়দীপ একটা খুব পুরনো ব্লেড মাটিতে ঘষে ঘষে ধার দিয়ে তা দিয়ে দাড়ি কামাচ্ছে। বড় মায়া হয়েছিল। কোনও প্রয়োজন নেই, তবু প্রতিদিন সে দাড়ি কামায়।

এখান থেকে বাস বা অন্য কোনও রকম যানবাহন নেই দূরের যাত্রার জন্য। গ্রাম্য লোকেরা এখনও গোরুর গাড়ি ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে ট্রাক যায়। ট্রাক ড্রাইভারের দয়া হলে হাত দেখালে থামে, কিছু পয়সার বিনিময়ে যাত্রী তুলে নেয়।

রাস্তার ধারে একটা পাথরের ওপর বসলুম। কখন ট্রাক আসবে ঠিক নেই। আমাদের বম্বে রোড-দিল্লি রোডে মুহুর্মুহু দৈত্যের মতন ট্রাক ছুটে যায়, এখানে এক ঘণ্টায় একটা ট্রাক চলে কি না সন্দেহ। অবশ্য এটা হাইওয়ে নয়।

দূরে দেখা যায় পাহাড়ের রেখাচিত্র। ছোট ছোট পাহাড়, সারা গায়ে জঙ্গল মাখানো, তার মধ্য দিয়ে পথ। এদিকে লোকবসতিও খুব কম। রুক্ষ জমি, তাতে চাষ হয় না, আগাছায় ভরে আছে।

একটি আট-ন’ বছরের মেয়ে কয়েকটা ছাগল চড়াচ্ছে পাশের মাঠে। মেয়েটির পরনে একটা রংচটা ঝ্যালঝেলে ফ্রক, কাঁধের কাছটা ছেঁড়া। এরকম গ্রাম দেশেও শাড়ির বদলে ফ্রক এসে গেছে।

মেয়েটা একসময় আমার কাছাকাছি এসে, অদ্ভুতভাবে শরীরটা বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। আমি মোটেই বিশেষ দ্রষ্টব্য নই, তবু কী দেখছে সে? শুধু ছাগল দেখতে দেখতে একঘেয়ে লাগছে বলে সে আর একটি প্রাণী দেখতে এসেছে! হাতে একটা ছপটি। ওর মুখখানায় যেন কার মুখের আদল আছে, অনেক ভেবে ভেবে মনে পড়ল। সত্যজিৎ রায়ের তিনকন্যা ফিল্মের একটা গল্পে কিশোরী অপর্ণা সেন দারুণ অভিনয় করেছিল, তখন তার নাম ছিল অপর্ণা দাশগুপ্ত, অনেকটা যেন সেই রকম!

জিজ্ঞেস করলুম, এই তোর নাম কী রে?

একজন উটকো অচেনা লোকের কথার উত্তর দিতে তার বয়ে গেছে। সে মুখ খুলল না।

আমার কাছে লজেন্স বা বিস্কুট জাতীয় কিছু নেই। শুধু শুধু পয়সা দেওয়া অন্যায়। ওর সঙ্গে ভাব জমাবার কোনও উপাদান আমার সঙ্গে নেই। ওকে কিছু না দিয়েও ওর কাছে একটা জিনিস চাইলে ও ঠিক নড়ে চড়ে উঠবে। যদি বলি, এ বিটিয়া, এক গিলাস পানি পিলাওগে? এ দেশে জল চাইলে কেউ না বলে না।

কিন্তু আমার তেষ্টা পায়নি, ও মেয়েটিকেও অকারণে ব্যতিব্যস্ত করার কোনও মানে হয় না।

একটা ট্রাকের শব্দ পাওয়া গেল, আমি উঠে হাত দেখাবার আগেই সেটার গতি কমে এসেছে। ঠিক আমাদের কাছেই এসে থামল। ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে গেলুম, সে আমাকে পাত্তাই দিল না। বরং দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন চেঁচিয়ে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকের পেছন দিক থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল তিনটি লোক। তারা পাশের মাঠে গিয়ে দৌড়ে দৌড়ে ছাগল তাড়া করতে লাগল। ধরেও ফেলল তিনটে ছাগল, টানতে টানতে সেগুলো নিয়ে আসতে লাগল ট্রাকের দিকে।

বাচ্চা মেয়েটি একটুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থেকে, তারপরই দৌড়ে গেল ওদের বাধা দিতে। তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল। একজন লোক জোরে ধাক্কা দিয়ে ওকে ছিটকে ফেলে দিল।

এ যে দিনে ডাকাতি! ট্রাকের লোকেরা জোর করে ছাগল তুলে নিচ্ছে। আমি এখন কী করব? তিনজনেরই ষণ্ডামার্কা চেহারা, ওদের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা আমার নেই। তবু বীরত্ব দেখাতে গেলে ওরা হয়তো আমাকে এখানে একেবারে মেরেই ফেলে দিয়ে যাবে।

যদি মেয়েটিকে ওরা আরও মারে, কিংবা ওকেও ট্রাকে তুলে নেয়, এই ভেবে আমি দৌড়ে গিয়ে মেয়েটিকে মাটি থেকে তুলে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলুম, সে তখনও প্রাণপণে চ্যাঁচাচ্ছে।

মাঠের যে-দিকটা ঢালু, সেদিক থেকে গোটা চারেক লোক ছুটে এল বটে, কিন্তু ততক্ষণে তিনটে ছাগলকে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে ট্রাকের মধ্যে। লোক তিনটেও উঠে পড়ল। ট্রাকটা স্টার্ট নেওয়ার পর ড্রাইভার কী যেন একটা গোল্লা পাকিয়ে ছুড়ে দিল। মাটিতে পড়ার পর বোঝা গেল, সেটা একটা একশো টাকার নোট।

কলকাতায় পাঁঠার মাংস একশো টাকা কেজি, গ্রামের দিকেও অন্তত আশি টাকা, এরা তিন-তিনটে ছাগল নিয়ে গেল মাত্র একশো টাকায়। এ যে গোরু মেরে জুতো দান!

বাচ্চা মেয়েটি একজন লোককে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদছে, অন্য লোকগুলি রুষ্টভাবে আমার দিকে চাইল। এই রে, আমাকেও ডাকাত দলের সঙ্গী ভাবছে নাকি?

আমি বললুম, আমি ট্রাকের নম্বরটা দেখে রেখেছি। আপনারা গিয়ে থানায় খবর দিন।

ওরা দুর্বোধ্য হিন্দিতে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করতে লাগল। ট্রাকের নম্বর জানার কোনও আগ্রহ নেই। অর্থাৎ এরা থানার ওপর ভরসা রাখে না, হয়তো থানা অনেক দূরে। গ্রামের গরিব মানুষরা থানায় যেতেই ভয় পায়, গেলেই পয়সা চাইবে।

সেই চারজন লোক বসে পড়ল রাস্তার ওপর।

দিকশূন্যপুরে যাবার পথে প্রথমেই এরকম বাধা পড়ায় আমার মনটা দমে গেল খানিকটা। তা হলে কি আরও অশুভ কিছু ঘটবে? আমার ফিরে যাওয়াই উচিত? না না, এসব কুসংস্কার। আমাকে যেতেই হবে।

ছি ছি, দেশটার কী অবস্থা হল, শেষপর্যন্ত ছাগলও ডাকাতি হয়? সোনা-দানা নয়, টাকা পয়সা নয়, মাত্র তিনটে ছাগল, তাও একটা বাচ্চা মেয়ের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া! ডাকাতদেরও আর জাতধর্ম কিছু রইল না!

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে আর একটা ট্রাক এল একই দিক থেকে। লোকগুলো উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে চিৎকার শুরু করল। ট্রাকটা আসছে ঝড়ের বেগে, থামবার কোনও লক্ষণই নেই, লোকগুলো শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে রাস্তার ধারে চলে না গেলে নিশ্চিত ওদের চাপা দিয়েই চলে যেত!

কলকাতা কিংবা আশেপাশের অঞ্চল হলে এতক্ষণে ইট ছুড়ে, রাস্তা ব্যারিকেড করে, ঠিক ট্রাকটাকে আটকাত, তারপর আগুন ধরিয়ে দিত। যদিও দ্বিতীয় ট্রাকটির কোনও দোষ নেই। এরা সে সব কিছু জানে না। শুধু অসহায় রাগ দেখাতে পারে।

আমি যদি রাস্তা ব্যারিকেড করার বুদ্ধিটা দিই, তাতে আমারই ক্ষতি। আমি যাব কী করে? দিকশূন্যপুরে যাবার অন্য একটা রাস্তা আছে বটে, সেটা অনেক ঘুরে, আবার ট্রেনে অন্য একটা স্টেশনে নামতে হবে। সেদিককার রাস্তায় ট্রাকও চলে না, যদিও বেশ বড় রাস্তা, তবু একটা ব্রিজ ভেঙে পড়ে আছে বহুদিন। এ রাজ্যের সরকার সেই ব্রিজটা সারাবার কথা ভুলেই গেছে, ব্যবহার হয় না বলে রাস্তাটার আরও দু-এক জায়গায় ধস নেমেছে। তবু হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু রাত্তিরের আগে যে ট্রেন নেই!

খানিক বাদেই দেবদূতের মতন এক ট্রাক ড্রাইভারের আগমন। আগের থেকেই গতি কমিয়ে সে আমাদের কাছে দাঁড় করাল। একজন ক্লিনার ছাড়া সে ট্রাকে আর কোনও লোক নেই, পেছন দিকটা কোনও মালে বোঝাই। গ্রামের লোকরা ড্রাইভারকে জোর করে টেনে নামাবার চেষ্টা করতেই সে নিজেই লাফ দিয়ে নামল। তার হাতে একটা লোহার ডাণ্ডা। ড্রাইভারটি অন্তত সাড়ে ছ’ ফুট লম্বা, চেক লুঙ্গি ও নীল গেঞ্জি পরা, গোঁফ-দাড়িতে ঢাকা মুখ, চোখ দু’টি নেশাখোরের মতন লালচে। তাকে ছোটখাটো একটি দৈত্য বলা যায় এবং দেখা গেল, দৈত্যরাও দেবতাদের চেয়ে ভাল হতে পারে।

প্রথমে সে লোহার ডান্ডা ঘুরিয়ে সবাইকে ছত্রখান করল। তারপর ডান্ডা নামিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, ক্যা হুয়া?

সব শুনে সে মাটিতে চিক করে থুতু ফেলে বলল, ছিঃ! এরকম বুরা কাম করে সে সব ট্রাক ড্রাইভারদের ইজ্জত বরবাদ করে দিয়েছে। নম্বর লিয়া?

আমি এগিয়ে এসে তাকে নম্বর জানালুম। ততক্ষণে নম্বরটি আমি একটি কাগজে লিখে ফেলেছি।

সেই নম্বরটির দিকে প্রায় এক মিনিট তাকিয়ে থেকে সে গম্ভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হারামি! এ শালাকে আমি চিনি। আমি এর ব্যবস্থা করছি। কাল থেকে এই ট্রাক অন্য ড্রাইভার চালাবে।

তারপর সে ট্রাক থেকে বার করল এক বান্ডিল নোট, তার থেকে অবহেলাভরে একটি একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, লে লেও!

তার শারীরিক শক্তির জন্য তো বটেই, তা ছাড়াও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সে একশো টাকা জরিমানা দিল বলে গ্রামের লোকেরা একেবারে বিগলিত হয়ে গেল। জরিমানাও নয়, দান। গ্রামের মানুষ অযাচিত দান নিতে অভ্যস্ত নয়। একজন লোক একটি ছাগলছানা এনে ড্রাইভারটিকে উপহার দিতে গেল। ক্লিনারটি সেটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে ছিল, ড্রাইভারটি তাকে এক ধমক দিল, সে কিচ্ছু নেবে না।

এবার আমি আবেদন জানালুম, ড্রাইভারজি, আমাকে খানিকটা রাস্তা নিয়ে যাবেন?

মুখে কিছু না বলে সে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। আমি উঠে বসলুম ক্লিনারের পাশে।

যারা খুব শক্তিশালী হয়, তারা কথা কম বলে। এই ড্রাইভারটি একেবারেই বাক্ কুণ্ঠ। একটি কথাও বলল না আমার সঙ্গে। দু’টি পাহাড়ের রেখা পেরিয়ে তৃতীয় উপত্যকায় যখন আমি থামাতে বললুম, তখন শুধু সে জিজ্ঞেস করল, এখানে কোথায় যাবেন? এ দিকে তো কোনও গাঁও নেই।

আমি বললুম, এই জঙ্গলেই কয়েকদিন থাকব।

পকেট থেকে টাকা বার করতেই সে অবহেলার সঙ্গে হাত নাড়ল। টাকা নেবে না? এর আগে অন্য ট্রাক ড্রাইভারদের এইটুকু দূরত্বের জন্য অন্তত কুড়ি টাকা দিতে হয়েছে। কেউ কেউ কুড়ি টাকার নোট দেখে ভুরু কুঁচকোলে আরও পাঁচ টাকা গচ্চা যায়। এ যে দেখছি সত্যি দেবদূত!

তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ট্রাক থেকে নামার পরেই আমার শরীরে একটা শিহরন হল।

ছাগল-চোরদের ট্রাকে যদি আমি দৈবাৎ চাপতুম, তা হলে আমার অন্য রকম গতি হতে পারত। হয়তো জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে আমাকে মেরে ফেলে দিয়ে যেত জঙ্গলে। যারা ছাগল চুরির মতন ছ্যাঁচড়ামি করতে পারে, তাদের পক্ষে একটা মানুষ খুন তো কিছুই না।

এই জঙ্গলে পড়ে থাকত আমার লাশ। কেউ টেরও পেত না। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, আমার মৃত শরীরের ওপর ঝরে পড়ছে রাত্রির শিশির, একটা ফড়িং এসে বসছে আমার নাকে, একটা শেয়াল এসে…

একেই বলে রাখে হরি মারে কে? হরির বদলে তিনটে ছাগল আমার প্রাণ বাঁচিয়ে দিল।

মনে হয় বেশ কিছুদিন বৃষ্টি হয়নি এদিকে, জঙ্গল একেবারে শুকনো। পরিচিত বেজিটার সঙ্গে দেখা হল না, ময়ূররাও উধাও। এ অরণ্য প্রাণী-শূন্য হয়ে গেল নাকি?

আমি ঘড়ি পরি না, আকাশের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এখন দুপুর সাড়ে বারোটা। এই সময় থেকে পেট একটু একটু খিদেয় চিনচিন করতে শুরু করে। বন্দনাদি দুটো-আড়াইটের আগে খায় না। ঠিক সময়েই পৌঁছে যাব।

সেই শিমুল গাছটা খুঁজলুম, সেটাই দিক চিহ্ন। গ্রীষ্ম শেষ হয়ে গেলেই সব শিমুল ফুল ঝরে যায়। তবু একটা টিলার ওপর রাজার মতন মাথা উঁচু করে আছে গাছটা। ওই টিলাটার ওপরে উঠলে আর একটুখানি পথ।

‘টিলার উপর দাঁড়াইয়া শশী আর কোনওদিন সূর্যাস্ত দেখিবে না।’ এই টিলার ওপর উঠলেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র এই লাইনটি মনে পড়ে। আমিও কোনও দিন এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখিনি।

চোখে পড়ে নদীটি। প্রথমবার দেখে মনে হয়েছিল, এই নদী যেন কোনও অপ্সরীর ভুল করে ফেলে যাওয়া অলঙ্কারের মতন নিঃশব্দে পড়ে আছে। অপ্সরীরা ফুলের গয়না পছন্দ করে। সেই ফুল শুকিয়ে গেছে। চন্দ্রহার নদীটিকে এবার বড় শীর্ণ মনে হল। বর্ষা আসুক, নদী আবার তার রূপ ফিরে পাবে।

নদীর পরপারে আমার স্বপ্নের দিকশূন্যপুর। ‘ঐ দেখা যায় বাড়ি আমার, চারদিকে মালঞ্চের বেড়া/ ভোমরা সেথা গুন গুন করে, গুন গুন করে, কোকিলাতে দিচ্ছে সাড়া—’। হ্যাঁ, এক সময় এখানে আমারও একটা বাড়ি ছিল। কোকিল ডাকেনি, কিন্তু সাদা প্যাঁচা এসে বসেছিল সেই বাড়ির ছাদে। আমি স্বেচ্ছায় ছেড়ে চলে গেছি। দূরে চলে গিয়েও ছাড়তে পারিনি পুরোপুরি, রয়ে গেছে বুকের মধ্যে।

এই নদী হেঁটে বা সাঁতরে পার হতে হয়। চটি জোড়া খুলে ভরে নিলুম ব্যাগে। পাজামা-পাঞ্জাবি ভিজলেও ক্ষতি নেই, পাল্টে নিলেই হবে। সাঁতার কাটতে হল না, কোথাও বুক জলের বেশি নয়। আগেরবার রীতিমতন স্রোত ছিল।

নদীর এ পাড়ে অনেক পাথর পড়ে আছে। বেশ বড় বড় পাথর, তাতে বাড়িগুলি আড়াল হয়ে থাকে। একটা পাথরের গায়ে একটি অর্ধসমাপ্ত মানুষের মুখ খোদাই করা ছিল। পাথরটা চিনতে ভুল হল না। কিন্তু তার এ কী দশা? কেউ যেন ছেনি দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে সেই ভাস্কর্যটি নষ্ট করতে চেয়েছে। চোখ-নাক বোঝা যায় না। ঠোঁটের কাছে গভীর ক্ষত। এখানে কোনও ফিলিস্টিনের উৎপাত শুরু হয়েছে নাকি? এখানে তো কেউ কিছু নষ্ট করে না।

পাথরগুলির ফাঁক দিয়ে সরু পথ।

এক জায়গায় সেই কঠিন পাথরের বুকেই গজিয়ে উঠেছে একটা অশ্বত্থ গাছ, প্রায় এক মানুষ প্রমাণ লম্বা, তার ডগায় ঝটাপটি করছে দুটো বুলবুলি পাখি। বুলবুলি পাখির ডাকে যেন কোনও দুষ্টু ছেলের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। এই পাখি এত সুন্দর, অথচ দেখলেই আমার মধ্যে একটা অপরাধবোধ জাগে।

ছোটবেলায়, তখন আমার আট ন’বছর বয়েস, আমি মামাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে বোড়াল গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলুম। সেই বোড়াল গ্রাম, যেখানে ‘পথের পাঁচালি’র শুটিং হয়েছিল। তখন ওদিকে অনেক ফাঁকা মাঠ ও ঝোপঝাড় ছিল। একটা বেতগাছের ঝোপে আমি আবিষ্কার করেছিলুম একটা পাখির বাসা, তার মধ্যে ছিল দুটো পাখির ডিম। মার্বেলের টলগুলির সাইজের সেই ডিম। কোন পাখির ডিম বুঝিনি, ডিম দুটো তুলে নিতেই একটা বুলবুলি পাখি কোথা থেকে এসে ওড়াউড়ি করতে লাগল আমার মাথার ওপরে।

কেন আমি ডিমদুটো চুরি করেছিলুম? পাখির ডিম তো কোনও কাজেই লাগে না। মা-পাখিটা যে কষ্ট পাবে, সে বোধও ছিল না। যৌন বোধ জাগার আগে সব শিশুরাই যে নিষ্ঠুর হয়, সে সব তো বড় হয়ে জেনেছি। ডিম দুটো নিয়ে ছুটে পালাচ্ছি, পাখিটাও আসছে আমার সঙ্গে, একটু পরেই আমার হাত থেকে ডিম দুটো পড়ে ভেঙে গেল। দুটো ডিমের মধ্যেই স্পষ্ট বাচ্চা পাখির অবয়ব, আর দু’ চারদিনের মধ্যেই ফুটে যেত। সেই অবস্থায় তাদের বাঁচানো অসম্ভব, আমি চেষ্টাও করিনি। মায়ের সামনেই সন্তানের মৃত্যু।

এখন যতবার সেই দৃশ্যটা ভাবি, আমার নিজের গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করে! কেন দুটো পাখিকে আমি আকাশে উড়তে দিইনি!

এত কাছ থেকে বুলবুলি পাখি অনেকদিন দেখিনি। আমি হাত জোড় করে বললুম, হে বুলবুলিদ্বয়, তোমরা আমাকে ক্ষমা করবে? আমি অবুঝ বালক ছিলাম, অপরাধ করেছি তোমাদের কাছে। যা শাস্তি দিতে চাও মাথা পেতে নেব!

বুলবুলিরা আমার কথা শুনে কী মনে করল কে জানে, ফুড়ুত করে উড়ে গেল। ক্ষমাহীন অবজ্ঞা?

পাথরগুলির এ পাশে আগেরবারে দেখেছিলুম সর্ষের খেত, এখন সে জায়গাটা ফাঁকা। একটু দূরে একটা বড় ছাতিম গাছ, তার নীচে বসে আছে একজন মানুষ। মহর্ষি বাল্মীকি নাকি! ধপধপে সাদা দাড়ি, তুলোর মতন চুল, গায়ে গেরুয়া চাদর জড়ানো, বসে আছেন গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে। চোখ কিন্তু খোলা। ধ্যান করতে গেলে যে চোখ বুজে থাকতেই হবে, তার কোনও মানে নেই অবশ্য। আমি তো বরং দেখেছি, চোখ বুজে থাকলেই নানান কুচিন্তা মাথায় আসে।

আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সেই শ্বেতশ্মশ্রু ব্যক্তিটি বেশ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ফেরিওয়ালা?

বিনীতভাবে বললুম, আজ্ঞে না।

—পথ ভুলে?

—আজ্ঞে না।

—কী কারণে এখানে আগমন?

—আমি এখানে আগেও এসেছি। এ জায়গাটা আমার চেনা।

—এবারে কেন এসেছ?

—তা আপনাকে বলব কেন? এরকম কৌতূহল থাকাও আপনার উচিত নয়।

ভেবেছিলুম, এ কথা শুনলেই বৃদ্ধ রেগে উঠবেন। বুড়োদের রাগাতে আমার ভাল লাগে। ভাল ভাল গালাগাল শোনা যায়। বেয়াদপ, বেল্লিক, বদমাস এই ধরনের গালাগাল কতদিন শুনিনি!

বৃদ্ধ কিন্তু হা-হা করে হেসে উঠলেন। বাঁ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে গোঁফ মুছে বললেন, তুমি পাশ করেছ। ভেবেছিলুম বুঝি কোনও উটকো লোক এসে ঢুকে পড়েছে। এসো, আমার কাছে এসে একটু বসো।

ওঁর সামনে গিয়ে মাটির ওপরেই আসন পিঁড়ি হয়ে বসে পড়লুম। বৃদ্ধটি মুখ ঝুঁকিয়ে বললেন, দেশলাই আছে?

আমি পকেটে হাত ভরলুম। উনি চাদরের নীচের ফতুয়ার পকেট থেকে একটা আধপোড়া চুরুট বার করলেন।

দিকশূন্যপুরে কেউ অযথা কৌতূহল প্রকাশ করে না, কেউ কারুর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা ঘামায় না। এখানে কেউ ধূমপানও করে না। আমাকে সিগারেট টানতে হয় খুব লুকিয়ে চুরিয়ে, তাও সারা দিনে বড়জোর দুটো।

এই বৃদ্ধটি ব্যতিক্রম। উনি ধূমপান করলে আমিও বা সিগারেট ধরাব না কেন?

বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমাকে আগে দেখোনি। তাই না? আমি এখানে এসেছি দু’ বছর আগে। আমি আগে ম্যাজিক দেখাতুম। বছর পাঁচেক হল ছেড়ে দিয়েছি, সাধু হয়ে চলে গিয়েছিলুম হিমালয়ে। সেখানে আমার পোষালো না। বেশি ঠাণ্ডা আমি সহ্য করতে পারি না। অন্য সাধুগুলো বড্ড জ্ঞান দেবার চেষ্টা করে। আমার আদি নাম পান্নালাল, বাপ-মায়ের কী কাণ্ড বলো তো, আমার ওপর একটা ভুল নাম চাপিয়ে দিয়েছে। পান্না কখনও লাল হয় নাকি? রবিঠাকুরের কবিতা আছে না, ‘আমার চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনী উঠল রাঙা হয়ে’। রবিঠাকুর বড় মানুষের ছেলে ছিলেন, চুনী-পান্না, হীরে মুক্তো ঢের দেখেছেন। অধিকাংশ বাঙালিই পান্না দেখেনি, ছেলের নাম রেখে দেয় পান্নালাল!

বুঝলুম, বৃদ্ধ কথা বলতে ভালবাসেন। উনি কী করে এখানে এলেন সেটা জানতে ইচ্ছে করলেও এরকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে নেই।

পান্নালাল বললেন, তুমি আমাকে বুড়ো ভাবছ, আমি কিন্তু বুড়ো নই। এখনও গাছে চড়তে পারি, বিয়ে করলে বাচ্চার জন্ম দিতে পারি, বুনো মোষ তাড়া করলে দৌড়ে পালাতে পারি, ডুব সাঁতার দিয়ে জলের নীচে সাত মিনিট থাকতে পারি, বয়েসে মাত্র ছেষট্টি। হিমালয়ে গিয়ে চুল-দাড়ি সব পাকিয়েছি। হ্যাঁ যা বলছিলুম, আমার আদি নাম পান্নালাল, পরে সেটা পাল্টে নিয়ে হয়ে যাই মেঘনাদ। জাদুকর মেঘনাদ, ম্যাজিশিয়ান মেঘনাদ, শুনতে ভাল না? কেউ কেউ বলত প্রফেসার মেঘনাদ! তা বলে আমাকে যেন মেঘনাদবাবু কিংবা মেঘনাদদা বলে ডেকো না। ম্যাজিকও ছেড়েছি, ও নামও ছেড়েছি। হিমালয়ে আমার নতুন নাম হয় স্বরূপানন্দ।

বললুম, তা হলে আপনাকে স্বরূপদা বলে ডাকা যেতে পারে?

তিনি বললেন, আরে না, না, হিমালয় ছেড়ে আসার সময় কমণ্ডলু আর ল্যাঙটের মতন ওই নামটাও ছেড়ে রেখে এসেছি। এখন আমার নাম অচিন্তনীয়।

—তা হলে অচিন্ত্যদা ঠিক আছে?

—সবাই তাই বলে। এমনকী ওই ব্যাটা প্রভাস, আমার চেয়ে বয়েসে কত বড়, সেও আমাকে অচিন্ত্যদা বলে ডাকে।

—আপনি এতগুলি নাম বললেন, এবার আমার নামটাও আপনাকে জানানো উচিত।

—দাঁড়াও, দাঁড়াও, বোলো না, বোলো না, দেখি আমি পারি কি না।

অচিন্তনীয় তাঁর ডান হাতের তর্জনী আমার কপালের ঠিক মাঝখানে ছোঁয়ালেন। তার পর মন্ত্র পড়ার মতন একটুক্ষণ বিড় বিড় করার পর বললেন, নীল, নীল, নীল দিয়ে কিছু একটা, তাই না? নীলকমল?

আমি চমকে উঠলুম। বৃদ্ধকে জীবনে কখনও দেখিনি।

—আপনি অনেকটা কাছাকাছি গেছেন। আমার নাম নীললোহিত।

—তা হলে? প্রায় পেরেছি কি না বলো!

—কী করে পারলেন বলুন তো? এটা কি ম্যাজিক?

—না, একে বলে থট রিডিং। আমি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারি, সব সময় নয়, এক এক সময়। তখন সব মিথ্যে কথাও ধরে ফেলতে পারি।

—এ রকম কি সত্যি সম্ভব?

—সম্ভব কি না নিজেই তো প্রমাণ পেলে! আর একটু মনঃসংযোগ করলে তোমার ঠিক ঠিক নামটা বলে দিতে পারতুম।

—তা হলে আপনি জ্যোতিষী হলেন না কেন? খুব নাম করতে পারতেন, অনেক টাকা রোজগার করতে পারতেন।

—টাকা!

এতক্ষণ মুখখানা হাসি খুশি ছিল, এবার ম্লান হয়ে গেল। আপন মনে হাত দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগলেন।

অনেকটা আপন মনে বললেন, টাকা? এই দিকশূন্যপুরটা এত ভাল লাগে, এখানে টাকা-পয়সার কোনও ব্যাপার নেই। কেউ টাকা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আঃ কী আরাম, কী শান্তি!

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, এবার তা হলে আসি অচিন্ত্যদা? পরে আবার দেখা হবে।

তিনি বললেন, হ্যাঁ, এসো। শুভমস্তু। নীললোহিত, সবচেয়ে বড় জাদুকরী কে জানো? এই বিশ্বপ্রকৃতি। দেখো, আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম, পরিষ্কার তকতকে আকাশ, কোথা থেকে একখণ্ড মেঘ এসে গেল। হাওয়া ছিল না, এখন সব গাছের পাতা কাঁপছে। এমনকী দিনের বেলা চাঁদ দেখিয়ে দিতে পারে, তা জানো? আজ সকালে আমি চাঁদ আর সূর্য এক সঙ্গে দেখেছি। আকাশের দু’ দিকে চাঁদ আর সূর্য!

পায়ে চলা পথটা ধরে আর কিছুটা এগোলে পাওয়া যায় বড় রাস্তা। পিচের নয়, সুড়কির। কত কাল আগে, ইংরেজ আমলে মিলিটারির লোকেরা এখানে একটা অস্থায়ী বসতি বানিয়েছিল। তারা চলে যাবার পর পরিত্যক্তই পড়েছিল সব বাড়ি ঘর। আস্তে আস্তে পলাতক মানুষদের দিয়ে গড়ে উঠেছে দিকশূন্যপুর। রাস্তাঘাট এখানকার লোকেরাই কোনও রকমে ব্যবহারযোগ্য করে রাখে। সরকারও এই জায়গাটা নিয়ে কখনও মাথা ঘামায় না, এখানকার মানুষও সরকারের কোনও সাহায্য চায় না।

ঠিক দুপুর বেলাটায় রাস্তায় মানুষজন দেখা যায় না বিশেষ। অচিন্তনীয় কি গাছতলাতেই বসে থাকবেন? ক্ষুধা-তৃষ্ণা নেই?

একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে এদিকটায় পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে এক রমণী। কুচকুচে কালো রঙের শাড়ি পরা। মুখ দেখতে না পেলেও চিনতে দেরি হল না। এ তো রোহিলা।

দু’বার তার নাম ধরে ডাকলুম, সে ফিরে তাকাল না। কী ব্যাপার, শুনতে পাচ্ছে না নাকি? ওই কালো কাপড়টা পরতে রোহিলাকে বারণ করেছিলুম, ওতে ওর ফর্সা মুখখানা পাথরের মূর্তির মতন দেখায়।

রাস্তা পার হয়ে কাছে গিয়ে আবার ডাকলুম, এই রোহিলা?

এবার সে মুখ ফেরাল। অচেনা মানুষ বিরক্ত করলে যেরকম মুখের ভাব হয়, সেই রকম ঈষৎ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল, কয়েক পলক। তারপর পাশের একটা গলিতে চলে গেল।

রোহিলা আমাকে চিনতে পারল না? বুকটা একবার মুচড়ে উঠল। রোহিলার সঙ্গে আমার এত ভাব ছিল! একটা নির্জন ঘরে বসে অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বলার পরেও ওকে জড়িয়ে ধরিনি কিংবা চুমু খেতে চাইনি বলে রোহিলা আমাকে বন্ধু বলে গ্রহণ করেছিল। মাত্র তিন বছর দেখা হয়নি। তিন বছরে এতখানি বিস্মৃতি? কিংবা এটা ওর অভিমান? পরে দেখা যাবে।

এখানকার রাস্তা উঁচু নিচু, ঢেউ খেলানো, মাঝে মাঝে এক একটা ঢিপি কিংবা টিলা। দু’ পাশে বড় বড় গাছ বেশ ছায়া দিয়ে রাখে। আকাশের মেঘ একবার গুরু গুরু করে উঠল। সত্যি, একটু আগেও মেঘের চিহ্ন ছিল না।

এদিক ওদিক তাকিয়ে বসন্ত রাওকে খুঁজতে লাগলুম। বসন্ত রাও যেখানে সেখানে ইজেলে ক্যানভাস বসিয়ে ছবি আঁকতে বসে। জল রং, তেল রং দুটোতেই ভাল হাত। বসন্ত রাও অ্যাক্রিলিক ব্যবহার করে না কখনও। সেই বসন্ত রাও আজ কোথায়?

ইসমাইল সাহেবের বাড়ির দরজাটা খোলা। এখানে দরজা বন্ধ রাখার কোনও প্রয়োজনও নেই। বাড়ির সামনের বাগানে তিনটে পেয়ারা গাছে প্রচুর পেয়ারা ফলে আছে। এলাহাবাদের পেয়ারার মতন সাইজ। আমি যদি এখন গোটা কতক পেয়ারা ছিঁড়ে নিই, ইসমাইল সাহেব কিছুই বলবেন না। সেটাই এখানকার নিয়ম।

ইসমাইল সাহেবের সঙ্গে দেখা করলে তিনি খুশি হবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এখন সময় নেই।

গেটের দু’পাশে থামের মতন মোটাসোটা দুটো ইউক্যালিপটাস গাছ বসানো বাড়িটা কার, তা জানি না। সে বাড়ির সামনের চত্বরে বেশ ভিড়। কয়েকজন উত্তেজিতভাবে, চাপা গলায় কথাবার্তা বলছে। এখানে নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে। অর্থাৎ এখানে একটা গল্প আছে। সেই গল্পটা জানবার জন্য কৌতূহল হবেই। ভিড়ের মধ্যে কিছুক্ষণ মিশে থাকলেই জানা যায়। কিন্তু খালি পেটে যেমন ধর্ম হয় না, তেমনি খিদে পেলে গল্প জানতেও ভাল লাগে না।

আমি এবার প্রায় দৌড়তে শুরু করলুম। টিলার ওপরে ওই তো দেখা যাচ্ছে সেই বাড়ি। নীচের দিকে একটা বাঁধানো কুয়ো। কুয়োতলায় কেউ নেই। পাশের বাড়িটা রাগী মতন অঙ্কের অধ্যাপকের। সেদিকে তাকিয়েই মনে হল, সে বাড়িটা শূন্য। বাড়িতে এখন কেউ নেই, আর বাড়িটা পরিত্যক্ত, এক পলক দেখলেই এই তফাতটা বোঝা যায়। কী করে বোঝা যায় কে জানে!

ওপরে উঠে এসে একটুক্ষণ থমকে দাঁড়ালুম, হাঁপাতে হাঁপাতে কারুর সঙ্গে প্রথম দেখা করা উচিত নয়। প্রথম দেখা হলে ঠিক কোন কথাটা বলব? নিছক সাধারণ একটা কথা বলা যায় না। কোনও গদ্য কথাই মানায় না।

দু’ মিনিট জিরোবার পর নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে গেল। এখন একটা গান গাইলে হয়। কিন্তু সুরটা ঠিক জানি না। আবৃত্তির মতনই টেনে টেনে বলতে লাগলুম :

আজ তোমারে দেখতে এলেম
অনেক দিনের পরে
ভয় পেও না, সুখে থাকো
বেশিক্ষণ থাকবো নাকো
এসেছি দণ্ড দুয়ের তরে….

ভেতরের ঘর থেকে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল বন্দনাদি। একটা ময়ূরকণ্ঠী রঙের ঘাঘরা পরা, ওপরে শুধু ব্লাউজ। সদ্যস্নাত মুখ, মাথার চুল খোলা। · সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কে? কে এসেছে?

—বলো তো কে?

—নীলু? সত্যি, নীলু?

বন্দনাদি দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল দু’ হাতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *