চলো দিকশূন্যপুর – ৩

সেই ছোট্ট মেঘটা বৃষ্টি ছড়াতে ছড়াতে আসছে।

যেন লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলছে, ওগো, বৃষ্টি নেবে? বৃষ্টি চাই, এই নাও!

টিলার ওপর থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। এক দিকটা বৃষ্টিতে ঝাপসা, অন্য দিকগুলো খটখটে শুকনো। সত্যি সত্যি আমাদের কাছাকাছি আসবার পর সেই মেঘে ছোট্ট গুরুগুরু শব্দ হল।

বন্দনাদি বলল, আয়, একটু বৃষ্টিতে ভিজি।

বারান্দা থেকে আমরা নেমে এলাম নীচে। মৃদু, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, বাতাসও জোরালো নয়। এ রকম বৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে বসে না থেকে আকাশের তলায় দাঁড়ানোই সবচেয়ে স্বাভাবিক। কলকাতা শহরে কেউ তো কারুকে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য ডাকে না।

বন্দনাদির সঙ্গে আমার একটা খেলা চলছে। দুপুরে এক সঙ্গে বসে ভাত-ডাল, বড়ি ভাজা আর ডিম ভাজা খেলাম, কত গল্প হল, কিন্তু বন্দনাদি আমাকে একবারও তপেশদা-অর্চনাদির কথা, ও বাড়ির মেয়েদের কথা জিজ্ঞেস করেনি। সন্ন্যাসীদের যেমন পূর্ব-জীবনের কথা বলতে নেই, তেমনি দিকশূন্যপুরের লোকেরাও ফেলে আসা জীবন কিংবা আগের চেনা মানুষজন সম্পর্কে কোনও আগ্রহ দেখায় না। যদিও এরা কেউ সন্ন্যাসী নয়, সকলেই গৃহী, প্রেম-ভালবাসা, বিচ্ছেদ-বিরহ এখানে নিষিদ্ধ নয়। এরা ঘর সাজায়, নিজেরা চাষও করে।

তা বলে কি আগেকার জীবনের কথা মনে পড়ে না? এককালের প্রিয়জনদের জন্য বুক মোচড়ায় না কখনও? আমিও ঠিক করেছি, নিজের থেকে বলব না কিছু।

আগে এ বাড়ির সামনের জায়গাটায় বেগুন খেত ছিল। এখন রয়েছে ক’টা জবা ফুলের গাছ। শুধু লাল নয়, গোলাপি, সাদা, হলুদ। এতগুলো রঙের জবা গাছ একসঙ্গে আগে দেখিনি।

—এত জবা কোথায় পেলে, বন্দনাদি?

—আমরা যে পাহাড় থেকে নুন আনতে যাই, সেখানে ঝোপঝাড়ে অনেক ফুল ফুটে থাকে। কয়েকটা ছোট ছোট চারা তুলে এনে লাগিয়েছি, দিব্যি গাছ হয়েছে। কোনও সার লাগে না, কত ফুল ফোটে।

—কিন্তু আগে তোমার বেগুনের খুব স্বাদ ছিল।

—আর বলিস না। বেগুন খেতে খেতে পাগল হয়ে যাবার মতন অবস্থা। এই জায়গাটায় বেগুন খুব ভাল ফলে। আমার দেখাদেখি অনেকে বেগুন চাষ শুরু করে দিল। রাস্তায় কারুর সঙ্গে দেখা হলেই বলে, বেগুন নেবে, বেগুন নেবে? কত বেগুন খাব? তাই আমি বেগুন চাষ বন্ধ করে দিয়েছি।

—বেগুনের বদলে জবা ফুল! জবা ফুল কি খাওয়া যায়? কুমড়ো ফুল, বক ফুল ভাজা খেতে বেশ লাগে। লোকে অন্য ফুল ভেজে খায় না কেন? আজ রাত্তিরে বেসনে ডুবিয়ে জবা ফুল ভাজার এক্সপেরিমেন্ট করলে হয়।

—এমন সুন্দর ফুলগুলো দেখে তোর খাবার ইচ্ছে হল?

—এটা একটা জেনুইন প্রশ্ন। বক ফুল আর কুমড়ো ফুল খাওয়া যায়, তা হলে অন্য ফুল খাওয়া যাবে না কেন? রাস্তার ধারে কত কচুরিপানার ফুল ফুটে থাকে। সেগুলো যদি ভেজে খাওয়া যেত।

—লোকে নিশ্চয়ই আগে খেয়ে দেখেছে, খেতে ভাল না, কিংবা বিষাক্ত!

—পৃথিবীতে যত রকম ফুল আছে, সব কি একবার করে কেউ খেয়ে খেয়ে দেখেছে? সাহেবরা কোনও ফুলই খায় না। বক ফুল, কুমড়ো ফুল ভাজা খেতেই জানে না। অথচ আমরা খাই। পৃথিবীর অন্য দেশে বোধহয় অন্য ফুল খায়।

—আমাদের দেশে সজনে ফুল, সর্ষে ফুলও খায়।

—তবে? আরও ফুল ট্রাই করা যেতে পারে। জবা ফুলকে ইংরিজিতে বলে চায়না রোজ। চিনেম্যানরা হয়তো জবা ফুল খায়। আমার ধারণা, গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে পেঁয়াজি বানালে দারুণ খেতে লাগবে।

—আঃ নীলু, থাম তো! গোলাপের মতন সুন্দর ফুল, তা দেখলে কারুর খাওয়ার কথা মনে হতে পারে?

—বন্দনাদি, মুর্গি নামে পাখিটাও কি দেখতে সুন্দর নয়? পালকে কত রঙের বাহার। ভাবো তো, একটা মোরগ, যখন মুখটা উঁচু করে দাঁড়ায়, মাথায় টকটকে লাল ঝুঁটি, তখন কী ম্যাজেস্টিক দেখায়! তবু, ওদের দেখলেই খাবার কথা মনে পড়ে। যাক গে যাক, তোমাদের এখানে তো বিনিময় প্রথা, তুমি আর বেগুনের চাষ কোরো না। এই জবা ফুলের বদলে কি কেউ তোমায় আলু-পটল দেয়?

—পেছন দিকটায় আমি পেঁয়াজ আর আদার চাষ করছি। চল, তোকে দেখাই।

এই টিলার ওপর দিকটা প্রায় সমতল। এই একখানাই বাড়ি, পেছন দিকটাতেও খানিকটা জমি আছে। নদীর ধার থেকে বালি এনে ফেলা হয়েছে সেখানে। পেঁয়াজকলি দেখলেই চেনা যায়, আদা গাছ আমি আগে দেখিনি। আদাও মাটির তলায় হয়!

একটা গাছ টেনে তুলে তার শেকড়ের মাটি পরিষ্কার করতে করতে বন্দনাদি বলল, কী রকম মোটাসোটা আদা হয়েছে দেখছিস? রান্নায় একটু আদা দিলে ভাল স্বাদ হয়, তাই সবাই আমার কাছ থেকে আদা চায়। একটুখানি আদার বদলে কেউ একটা এত বড় লাউ দিয়ে যায়, কেউ দেয় আলু। তোমার বন্ধু বিজন, সে তো পোলট্রি করেছে, আমি চাই না, তবু খানিকটা পেঁয়াজ চাইতে এসে সে আমাকে একটা আস্ত মুর্গি দেবেই। পেঁয়াজ তবু আরও পাওয়া যায়, কিন্তু এখানে আমি ছাড়া আর কেউ আদা ফলাতে পারেনি!

বন্দনাদির মুখে বেশ গর্ব গর্ব ভাব। আমার হাসি পেল। বন্দনাদির যে রকম রূপ যৌবন, এবং এক সময় নাচের জন্য যে রকম নাম হয়েছিল, তাতে অনায়াসে সে ইচ্ছে করলে কোনও জাহাজের মালিককে বিয়ে করতে পারত। তার বদলে এখানে এসে সে আদার ব্যাপারী হয়েছে!

কোনও জাহাজের মালিকের স্ত্রীর চেয়ে এই আদা-পেঁয়াজের চাষিনীটি বেশি সুখী কি না, সে বিচার কে করবে?

নাচ ছেড়ে দিলে মেয়েরা মোটা হয়ে যায় শুনেছি। বন্দনাদির বুকের দিকটা বরাবরই বেশি ভারী ধরনের, পরিপূর্ণ স্তন, কিন্তু কোমর এখনও সরু। ঘাঘরা আর ব্লাউজের মাঝখানে পেট খানিকটা দেখা যায়, একটুও মেদের চিহ্ন নেই। তার কারণ, এখানে বন্দনাদিকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়, এই টিলায় কয়েকবার ওঠা-নামা করলেই অনেক ঘাম ঝরে।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, বন্দনাদি, নীচে পাতকুয়োর পাশের বাড়িটায় যে অঙ্কের অধ্যাপক থাকতেন, তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, তার কী হল?

বন্দনাদি মুখে কৃত্রিম হতাশা ফুটিয়ে, থুতনিতে আঙুল দিয়ে বলল, আমার কপালে কি আর বিয়ে আছে রে? বার বার ফস্কে যায়! আমি তো রাজিই ছিলুম, সেই অধ্যাপকমশাই সরে পড়লেন।

—কোথায়?

—তিনি স্বর্গে গিয়ে নিশ্চয়ই দেবতাদের অঙ্কের পড়া ধরছেন, আর বকুনি দিচ্ছেন!

—আহা, রোগা পাতলা হলেও স্বাস্থ্য তো খারাপ ছিল না! কী হয়েছিল?

—তুই বিশ্বাস করবি না, ওর চলে যাওয়াটাও নিখুঁত অঙ্কের হিসেব কষে। কয়েকদিন ধরে ওর জ্বর হয়েছিল, আমি গিয়ে সেবা করতাম। ওঁর জন্য রান্না করে দিতাম। জয়দীপ আর তুতান এসেও আমাকে সাহায্য করত। আমাদের এখানে তো কয়েকজন ডাক্তারও আছে। ডাক্তার দেব দেখতে এসেছিলেন। তিনি বললেন, এমন কিছু না, চোরা ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হয়েছে, এখনই কমে যাবে। অধ্যাপকমশাই ডাক্তারের মুখের দিকে চেয়ে কাষ্ঠহাসি দিয়ে বললেন, তুমি ছাই জানো! আমার শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে। আগামী মঙ্গলবার বিকেল চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে আমার শেষ নিঃশ্বাস পড়বে!

—তারপর কি জঙ্গলের সেই জায়গাটায় গিয়ে শুয়ে রইলেন?

—না, উনি যেতে চাননি। আমরা কেউ বিশ্বাসও করিনি। তবে কথাটা রটে গেল, সেই মঙ্গলবার দুপুর থেকেই অনেকে ভিড় করে এল।

—তবে যে তোমরা বলো, এখানে কেউ কৌতূহল দেখায় না। অত লোক এসেছিল কেন?

—ওরা দেখবার জন্য আসেনি। ওরা এসেছিল সেই লোকটিকে বাঁচাতে। আমরা সবাই ওঁকে অঙ্কবাবু বলে ডাকলেও ওঁর নাম গৌরীশঙ্কর দাশগুপ্ত। সেই মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্তও উনি কিন্তু তেমন অসুস্থ ছিলেন না! গায়ে সামান্য জ্বর। পুরোপুরি জ্ঞান আছে, কথা বলছেন, শুধু বিছানা ছেড়ে উঠতে চান না, আর মাঝে মাঝেই বলছিলেন, আর বেশিক্ষণ নেই, বিকেল চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে…। আমরা তো ঘড়ি রাখি না। মোটামুটি আকাশের অবস্থা দেখে যখন বিকেল চারটের মতন মনে হল। তখন আমরা সবাই মিলে ঘরের বাইরে বসে সুর করে বলতে লাগলুম, অঙ্কবাবু, আপনি যাবেন না, আপনাকে যেতে দেব না। গৌরীশঙ্করবাবু, যাবেন না, যাবেন না, আমাদের ছেড়ে যাবেন না—। ঘরের মধ্যে ওঁর শিয়রের কাছে তিনজন ডাক্তার বসেছিল। এক সময় খবর এল, গৌরীশঙ্করবাবু আমাকে ডাকছেন। ঘরে শুধু আমি থাকব, ডাক্তারদেরও বেরিয়ে যেতে হবে। উনি আমাকে হাতছানি দিয়ে খুব কাছে ডাকলেন, ফিসফিস করে বললেন, বাইরে সবাইকে চ্যাঁচামেচি বন্ধ করতে বলো, আমি শান্তিতে চলে যেতে চাই। আমাকে কেউ কখনও ভালবাসেনি। জীবনে কারুর ভালবাসা পাইনি। খুব কম বয়েসে মা মারা গেছেন, স্নেহ কাকে বলে তাও বুঝিনি। তাই তো নীরস অঙ্ক চর্চা করে কাটালাম সারা জীবন! এবার জ্বর হবার পর হঠাৎ উপলব্ধি করলাম, ভালবাসা না পেলে অঙ্কটঙ্ক সব কিছুই বৃথা! জীবনটাই অর্থহীন। তা হলে আর বেঁচে থেকে লাভ কী?…আমি জোর দিয়ে বললুম, আমি আপনাকে ভালবাসি, সত্যি, বিশ্বাস করুন। উনি বললেন, যদি সত্যিও হয়, তবু বড় দেরি হয়ে গেছে। আমার যৌবনকালে যদি তোমার দেখা পেতাম বন্দনা, দেখা হবেই বা কী করে, তুমি তখন জন্মাওনি…এই বলতে বলতেই শেষ!

—ইচ্ছা মৃত্যু?

—এরকম যে হতে পারে, কখনও শুনিনি।

শুধু একটা ব্যাপার বুঝতে পারলুম না, মঙ্গলবার বিকেল চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যেই কেন?

—উনি একটা ডায়েরি রাখতেন। তাতে পড়েছি, সাতষট্টি বছর আগে এক মঙ্গলবার বিকেলে ওঁর জন্ম!

—ঠিক করে বলো তো বন্দনাদি, উনি যদি বেঁচে উঠতেন, তা হলে কি তুমি সত্যিই ওই বৃদ্ধকে ভালবাসতে? ওকে বিয়ে করতে? না নিছক সান্ত্বনা দেবার জন্য বলেছিলে?

—যদি সান্ত্বনা দেবার জন্যও বলে থাকি, সেটা কি অন্যায়? একজন মানুষকে বাঁচাবার জন্য যদি মিথ্যে কথাও বলতে হয়, তাতে কোনও দোষ নেই।

—তা হলে আমি যে মাঝে মাঝে মিথ্যে কথা বলি, তাতে তুমি রাগ করো কেন?

—তুই আবার কাকে বাঁচাতে চাস রে, পাজি?

—নিজেকে!

বন্দনাদি আমার কাঁধে একটা ছোট্ট চাপড় মারল।

বৃষ্টি এর মধ্যে আবার অন্যদিকে চলে গেছে। আমরা ভিজেছি, আবার ভিজিওনি বলতে গেলে। অর্থাৎ মাথাটা মুছে নিলেই হয়, পোশাকটা না পাল্টালেও চলে। সন্ধে হতে এখন অনেকটা বাকি আছে।

আমি বললুম, চলো, বন্দনাদি, আমরা নুন ভাঙতে যাই।

বন্দনাদি বলল, অনেকটা নুন জমা আছে, এখন আর দরকার নেই রে।

—তা হলেও চলো। ওই জায়গাটা দেখতে আমার ভালো লাগে।

—বরং চল, বসন্ত রাওয়ের কাছে যাই, তোকে দেখলে খুশি হবে।

—ওখান থেকে ফিরে এসে যাব।

একটা শাবল আর একটা থলি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। দরজা বন্ধ করার প্রশ্ন নেই। কারুর যদি ইচ্ছে হয়, এ বাড়ি থেকে যে কোনও জিনিস নিয়ে যেতে পারে। কেউই প্রয়োজনের বেশি নেয় না। খুব জরুরি কারণ না ঘটলে কেউ না বলে কোনও জিনিস নেবে না।

কুয়োটার দিক দিয়ে ছাড়াও আর একটা নামার রাস্তা আছে টিলা থেকে। এটা অনেক খাড়াই। পা হড়কে পড়ে যাবার সম্ভাবনা খুব। বন্দনাদির অভ্যেস হয়ে গেছে, আমার হাত ধরে রইল।

মাঝে মাঝেই বন্দনাদিকে দেখে আমার মনে হয়, ইচ্ছে করলেই বন্দনাদি কলকাতার একটা সমাজের মধ্যমণি হয়ে থাকতে পারত। অনেক যুবক এই রকম ভাবে বন্দনাদির হাত ধরার সুযোগটুকু পেলেও ধন্য হয়ে যেত। কিন্তু বন্দনাদি এই রকম একটা জায়গায় একা জীবন কাটাবে বলে ঠিক করে ফেলেছে। মানুষের অভিমান এত তীব্র হতে পারে?

বন্দনাদি অবশ্য অভিমানের কথাটা কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না।

কলকাতায় চেনাশুনোরা সবাই জানে, বন্দনাদি কোথাও হারিয়ে গেছে। কিংবা ইওরোপ-আমেরিকার কোনও জায়গায় থাকে, কারুর সঙ্গে ইচ্ছে করে যোগাযোগ রাখে না। কারুর কারুর বিশ্বাস বন্দনাদি বেঁচে নেই। অর্চনাদির দৃঢ় বিশ্বাস, তার বোন মরেই গেছে। জীবিত থাকলে সে একখানা চিঠিও লিখবে না। এটা বিশ্বাস করা যায় না।

আসল কারণটি অর্চনাদি কোনও দিনই জানবে না।

হঠাৎ বলে ফেললুম, তপেশদা খুব অসুস্থ। পা ভেঙে বিছানায় পড়ে আছে। হার্টেও কিছুটা দোষ আছে। একদিন আমি তপেশদার সঙ্গে দাবা খেলেছি অনেকক্ষণ।

বন্দনাদি থমকে দাঁড়াল। আমার চোখের দিকে অপলক ভাবে একটুক্ষণ চেয়ে থেকে বেদনার্ত গলায় বলল, কেন, ওই সব কথা বলিস, নীলু? আমি তো জানতে চাই না। কলকাতার কোনও খবর সম্পর্কে আমার একটুও আগ্রহ নেই।

—সত্যি তুমি চেনা মানুষজনের কথা একবারও ভাবো না? মানুষ কি মনকে এমন ভাবে দমন করতে পারে? অতীতটাকে পুরোপুরি মুছে ফেলা সম্ভব?

—বর্তমানটাকে, প্রতিদিনের জীবনটাকে যদি শরীর, মন সব কিছু দিয়ে উপভোগ করা যায়, তা হলে অতীতের কথা ভাবার কী দরকার?

—উত্তরটা এড়িয়ে যেয়ো না। মনে পড়ে কি না বলো!

—মাঝে মাঝে মনে পড়ে, এক এক ঝলক সিনেমার দৃশ্যের মতন, মনে হয় সেটা একটা দৃশ্যই, আমার জীবনের কিছু নয়। সেই সব দেখার মধ্যে কোনও খেদ মিশে নেই।

—তা হলে তুমি আমাকে ডেকেছিলে কেন?

—তোকে ডেকেছি?

—ডাকোনি? তোমার ডাক শুনতে পেয়েই তো আমি দৌড়ে চলে এসেছি!

—ওমা, তাই বুঝি? আমি ভাবলুম, তুই আমার টানে এসেছিস। আমাকে দেখার জন্য এসেছিস। হ্যাঁ নীলু, এটা ঠিক, ক’দিন ধরেই তোর কথা খুব ভাবছিলুম, মনে মনে বলছিলাম, নীলু, নীলু, নীলু কেন আর আসে না? কিন্তু তুই তো আমার অতীত না। আমি তোকে ভালবাসি, সেটা সারা জীবনের।

—তুমি আর কতটুকু ভালবাসা জানো, নারী? আমার ভালবাসা তোমার চেয়ে দশ হাজার গুণ বেশি। বছরের পর বছর চোখের দেখা না হলেও সে ভালবাসা একটুও কমে না।

—ইস, নীলুসোনা, এরকম কথা শুনলেও বুকটা জুড়িয়ে যায়।

—এই, বাচ্চা বাচ্চা ভাব করবে না। আমার ভালবাসা ছোট ভাইয়ের ভালবাসা নয়। নেহাত অনেক দিনের অভ্যেস, তাই বন্দনাদি বলি। তোকে আমার বন্দনা, তুই বলা উচিত।

—তোকে আমি ছোটভাই মোটেই ভাবি না। ঠিক প্রেমিকও না। আবার শুধু বন্ধুও বলা যায় না। অন্য একটা কিছু। মনে কর, নাম নেই এরকম একটা সম্পর্ক।

—তোমার নিজের মেয়ের কথাও মনে পড়ে না?

—একটি তিন বছরের বাচ্চা মেয়ের মুখ মাঝে মাঝে চোখে ভাসে। বুকটা তখন টনটন করে ঠিকই। কিন্তু সে তো এখন আর বাচ্চা মেয়ে নেই, অনেক বড় হয়ে গেছে, সে আর আমার মেয়ে নয়। দিদির মেয়ে। সে আমার কথা নিশ্চিত ভুলে গেছে।

—রুপসা ভাল আছে।

—দিদির কাছে সে দিদির নিজের মেয়েদের মতনই ভাল থাকবে জানি। ব্যস, আর না, নীলু, ওসব কথা থাক।

টিলা থেকে নেমে খানিকটা এগোলেই জঙ্গলটা চোখে পড়ে। সেটাও উঁচু নিচু পাহাড়ি এলাকা। এ জঙ্গলে বাঘ কিংবা হাতি নেই, হরিণ আছে, খরগোশ আছে, মাঝে মাঝে ছোট জাতের ভাল্লুকও দেখা যায়। ভাল্লুকদের ভয় পাবার কিছু নেই, ভাল্লুকরা মানুষের চ্যাঁচামেচি একেবারে সহ্য করতে পারে না। আমি গান গাইবার চেষ্টা করলেই ভাল্লুক পালাবে।

এই জঙ্গলের মধ্যেই রয়েছে এক জাতের নুন-পাথর। জীবজন্তুদেরও শরীরে মাঝে মাঝে নুনের প্রয়োজন হয়, তাই তারা এসে এই পাথর চেটে খায়। এর নাম সল্ট লিক, দিকশূন্যপুরের মানুষরাও এই পাথর ভেঙে নিয়ে যায়। সকলের আসবার দরকার হয় না, একজন কেউ ভেঙে নিয়ে গিয়ে অন্যদের বিলিয়ে দেয়।

পাথরটার রং ঠিক সাদা নয়। গোলাপি গোলাপি, মাঝে মাঝে লালচে শিরা। অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এখানকার মানুষ একটু একটু করে ভেঙে নিয়ে গেলেও কয়েক শতাব্দীতে ফুরোবে না।

এই জায়গাটাতে এলে কেমন যেন একটা আদিম পৃথিবীর রূপ কল্পনা করা যায়। মানুষ যখন সভ্য হয়নি, পোশাক পরত না, বাসা বাঁধতে জানত না, পাথরের অস্ত্র দিয়ে পশু শিকার করে আগুনে ঝলসে নিত, তখন তো তারা এই পাথরের নুনই ব্যবহার করত।

আমি আর বন্দনাদি সেই রকম আদিম মানব-মানবী। কিন্তু আমরা জামা-কাপড় পরে আছি। জামা-কাপড়ের সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলো সামাজিক নিয়মকানুন-ভব্যতা আমাদের গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। মানুষ কি আর কোনও দিনও পোশাক-পরিচ্ছদ বিসর্জন দিতে পারবে? তা হলে অনেক ঝামেলা বেঁচে যায়। মানুষের মধ্যে শ্রেণীভেদ সহজে ঘুচে যেত!

পৃথিবীর কোনও কোনও দেশে নুডিস্ট কলোনি খুব ভাল ভাবেই চলে শুনেছি। সেখানে কেউ মারামারি করে না, হ্যাংলামি, অসভ্যতা করে না।

দ্বিতীয় চিন্তায় মনে হল, নাঃ, সব সময় উলঙ্গ থাকার বদলে পোশাক পরে থাকাই ভাল। মানুষের বহু শতাব্দীর ভাবনা চিন্তায় পোশাকের উদ্ভব হয়েছে। পৃথিবীর সব লোক নগ্ন হয়ে থাকলে খুব একঘেয়েমির ব্যাপার হবে। শরীরগুলো বড্ড বেশি শরীর শরীর দেখাবে, কোনও রহস্য থাকবে না।

থলিতে বেশ খানিকটা নুন-পাথর ভরে আমি কাঁধে ঝুলিয়ে নিলুম। জঙ্গল থেকে বেরুবার বদলে আমরা ঢুকে গেলুম আরও জঙ্গলের মধ্যে। সেই জায়গাটা তো একবার দেখতেই হবে।

জায়গাটার নাম দেওয়া যেতে পারে মহানির্বাণ পরিমণ্ডল। দিকশূন্যপুরের কোনও মানুষ যখন মনে করে নিজের অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে, তখন সে চুপি চুপি এখানে এসে শুয়ে থাকে। খোলা হাওয়ার মধ্যে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বরণ করে মৃত্যুকে। অন্যদের বিব্রত করে না।

একটা উঁচু পাথর, প্রায় বেদীর মতন। পাশেই একটা জলাশয়। এখানে বড় গাছ নেই, ছোট ছোট ঝোপ, বন্দনাদির বাড়ির মতন কয়েক জাতের জবা ফুল ফুটে আছে।

আগেরবার এলে এই বেদীতে নীহারদাকে শুয়ে থাকতে দেখেছিলুম। এমন ধুঁকছেন, মনে হয়েছিল আর একবেলাও আয়ু নেই। তবু সেই নীহারদা রাত্তিরবেলা এখান থেকে উঠে হেঁটে লোকালয়ে ফিরে গিয়েছিলেন জ্যোৎস্না নামে একটা মেয়েকে একটা চুমু খাওয়ার জন্য! যৌনতার কী তীব্র টান! মৃত্যুর আগেও যায় না?

সৌভাগ্যের কথা, আজ সেই বেদীটা ফাঁকা। দিকশূন্যপুরের সকলেরই শরীর ভাল আছে। জায়গাটা এমনই সুন্দর যে দেখলেই মনে হয়, একটু শুয়ে থাকি। গভীর রাত্তিরে এই জলাশয়ে নিশ্চয়ই হরিণরা জলপান করতে আসে।

বন্দনাদি আমার পিঠে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, চুপ, শব্দ করিসনি, ওই দ্যাখ একটা ময়ূর।

একটা নয়, দুটো। জলাটার উল্টো দিকে পাশাপাশি দুটো গাছের ডালে বসে আছে। একটাকে ভাল করে দেখা যাচ্ছে না, অনেকখানি পাতায় ঢাকা পড়ে গেছে। অন্য ডালটি শুকনো, তাতে ময়ূরটিকে দেখা যাচ্ছে পরিপূর্ণ ভাবে, বেশ দীপ্ত ভঙ্গি, বিশাল ল্যাজটা ঝলমল করছে বিকেলের আলোয়।

পাখি হিসেবে ময়ূর মোটেই ভাল নয়। খুব হিংস্র, সাপের সঙ্গে লড়াই করতেও দ্বিধা করে না। গলার আওয়াজ কর্কশ। প্যাঁও প্যাঁও করে ডাকে। তবে ময়ূরের এত সুন্দর হবার কী দরকার ছিল? কেন এত রং, এত ছবি তার শরীরে? ময়ূর নিজের রূপ সম্পর্কেও খুব সচেতন। বালিগঞ্জের লিলিপুলে দুটো পোষা ময়ূর আছে। কারুর হাতে ক্যামেরা দেখলেই সেই একটা ময়ূর পুরো পেখম মেলে ঘুরে ঘুরে নাচ দেখায়।

মুর্গি এত সুন্দর দেখতে, তবু তাকে দেখলে খেয়ে ফেলার কথা মনে পড়ে। ময়ূরের মাংস কেমন : একদিন খেয়ে দেখলে হয়!

ছিঃ, এ কথা চিন্তা করাও পাপ, ময়ূর আমাদের জাতীয় পক্ষী না? মেনকা গান্ধী জানতে পারলে খুব রাগারাগি করবে! সে আবার নিজের নাম ভুল করে লেখে মানেকা। হিমালয় পাহাড়ের বউয়ের নাম মেনকা, মানেকা মানে কী? মানে নেই বলেই তাকে বিশেষ কেউ মানে না।

ময়ূরকে এ দেশের জাতীয় পক্ষী করা হয়েছে কেন? দিল্লির নেতাগুলো তো সব ময়ূরপুচ্ছধারী কাক!

বন্দনাদি বলল, চল, ওদিকটায় গিয়ে দেখি, এক-আধটা ময়ূরের পালক পাওয়া যায় কি না। তা হলে তোকে কৃষ্ণ সাজাব।

—আমি নীললোহিত, আমি তো পাগলা মহাদেব, আমি কৃষ্ণ হতে পারি না! তোমার জন্য আমি একটা কৃষ্ণ খুঁজে দিতে পারি।

—সেই একটা গান আছে না, ‘কৃষ্ণনগর থেকে আমি কৃষ্ণ খুঁজে এনেছি। ‘

—অতদূর যেতে হবে না, এখানেই তো তোমার একজন প্রেমিক আছে, জয়দীপ? তার খবর কী?

—তোকে কতবার বলেছি। জয়দীপ আমার প্রেমিক নয়। ওর মনের মধ্যে একটা বেশ গভীর ক্ষত আছে, সেটা না শুকোলে ওর প্রেম-ভালবাসার বোধই জাগবে না।

—ও তোমার বাড়িতে আসে না?

—কখনও সখনও আসে, আবার মাসের পর মাস দেখাই করে না। এক এক সময় খুব ফুর্তিতে থাকে, হাসে, গল্প করে। আবার এক এক সময় উৎকট গম্ভীর, কথাই বলে না।

বন্দনাদি, আমার সঙ্গে রোহিলার দেখা হয়েছিল আসবার পথে, আমাকে যেন চিনতেই পারল না। কী ব্যাপার বলো তো?

বন্দনাদি কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বেশ ব্যগ্রভাবে বলল, দেখা হয়েছিল? রোহিলা কী বলল?

—কিছুই তো বলল না।

—তুই ডাকলি না?

—ডাকলুম তো, কাছে গিয়েও ডাকলুম, যেন শুনতেই পেল না, মুখ ফিরিয়ে চলে গেল।

—আহারে, তোর নিশ্চয়ই দুঃখ হয়েছে। তোর সঙ্গে রোহিলার বেশ ভাব ছিল।

—অবাক হয়েছি ঠিকই। এত তাড়াতাড়ি কি মানুষ ভুলে যায়?

—তুই আর একবার দেখা করিস, নীলু। হয়তো চিনতে পারবে।

ময়ূর দুটো ঝটপটিয়ে উড়ে গেল। গাছের তলায় কোনও পালক পড়ে নেই।

এতখানি নুন বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাবার কোনও মানে হয় না। আবার লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নুন নেবে গো, নুন নেবে গো বলে সাধাসাধি করতেই বা যাব কেন? এ ছাড়াও এখানে একটা ব্যবস্থা আছে। একটা ভাঙা গির্জায় যার যা অতিরিক্ত দ্রব্য রেখে চলে যায়। যার প্রয়োজন সে ওখান থেকে তুলে নেয়।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে এলুম ভাঙা গিজার্টার কাছে। বাইরেটা বেশ জরাজীর্ণ অবস্থা হলেও ভেতরের হলটা মোটামুটি ঠিকই আছে। বৃষ্টিতে এক দিকে জল পড়েছে ছাদ চুঁইয়ে, অন্য দিকটা শুকনো। দিকশূন্যপুরে যারা হঠাৎ বাইরে থেকে এসে কোনও আশ্রয় পায় না, তারা প্রথম কয়েকদিন এই গির্জার মধ্যেই শুয়ে থাকে।

ইংরেজদের বানানো শহর, তাই এখানে মন্দির বা মসজিদ নেই, রয়েছে একটি মাত্র গির্জা। নতুন বস্তিতে কেউ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে না, যেন একটা অলিখিত নির্দেশ আছে, যার যার ধর্ম ব্যক্তিগত, বাড়ির মধ্যেই আবদ্ধ। গির্জাটাকে কমিউনিটি হলের মতন ব্যবহার করা হয়। রোহিলাকে দেখেছিলুম যীশুর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ক্রুশ চিহ্ন আঁকতে। শুধু প্রভাসদা নামে একজন কখনও এই গির্জার মধ্যে পা দেন না, তাঁর নাস্তিকতার গোঁড়ামি অতি তীব্ৰ।

যীশুর মূর্তির কাছে রাখা আছে দু’টি কাঁঠাল, একটা ঝুড়ি ভর্তি বেগুন, সাত-আটটি মুর্গির ডিম, প্রায় দু’ ডজন মাটির প্রদীপ, অত গুলিই মাটির পুতুল, শনজাতীয় কিছু দিয়ে বোনা চারখানা আসন, অনেক পেয়ারা ও পেঁপে।

ভাবা যায়, বিনা পয়সায় এখান থেকে যে কোনও জিনিস তুলে নেওয়া যেতে পারে! দিকশূন্যপুর ছাড়া পৃথিবীতে এরকম জায়গা আর কোথাও আছে?

পুতুলগুলো দেখতে দেখতে বন্দনাদি বলল, বাঃ ভারী সুন্দর তো, এর থেকে আমি দুটো নেব!

জিজ্ঞেস করলুম, এগুলো কে বানিয়েছে, বন্দনাদি?

—জানি না রে, সবাইকে তো চিনি না। কার ভেতরে যে কী গুণ আছে।

—আমার ধারণা ছিল, সবাই এখানে খাবার জিনিস উৎপন্ন করে। তা না, কেউ কেউ এখানে পুতুলও বানায়!

—ম্যান ডাজ নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন! বসন্ত রাও কী সুন্দর ছবি আঁকে তুই তো দেখেছিস। ছবি আঁকা ছাড়া সে গিরিন, শোভন আর শশিকলাদের ধান-গম চাষে সাহায্য করত। ক’দিন আগে আমাদের মিটিং-এ ঠিক হয়েছে, বসন্ত রাওকে ওসব কিছু করতে হবে না। সে শুধু ছবি আঁকবে, তার খাবার দাবারের ব্যবস্থা অন্যরা করবে।

—বন্দনাদি, মুর্গির ডিম দেখে লোভ হচ্ছে। দুটো নিলে হয় না?

—তুই ইচ্ছে করলে এখান থেকে সব কিছু নিয়ে যেতে পারিস, কেউ কিছু বলবে না। তবে এখানে কিছুদিন থাকার পর নিজেদের প্রয়োজনের বেশি কিছু বাড়িতে জমিয়ে রাখতে কেউ চায় না। অন্যকে দেওয়ার আনন্দটাই বেশি।

—আর একটা বেগুন, ব্যস! তুমি বেগুন চাষ বন্ধ করে দিয়েছ, একদিন অন্তত বেগুন ভাজা।

—আমি দুটো পেঁপে নেব। বাড়িতে আলু আছে, আলু-পেঁপের ডালনা অনেকদিন খাইনি। শুধু নুনের বদলে এত কিছু নিতে লজ্জা করছে। কাল এখানে কিছু পেঁয়াজ আর আদা রেখে যেতে হবে!

পেছনে পায়ের শব্দ শুনে ফিরে তাকালুম। পাজামার ওপর শার্ট পরা একটা উনিশ-কুড়ি বছরের ছেলে, এক হাতে একটা ছোট ঝুড়ি ভর্তি শশা।

বন্দনাদি জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন, বাবুমশাই?

ছেলেটি প্রায় খেঁকিয়ে উঠে বলল, যেমনই থাকি না কেন, তোর তাতে কী?

প্রথমে চিনতে পারিনি। উত্তরটা শুনে মনে পড়ে গেল। এই সেই রাগী ছোকরা। সবার সঙ্গে তুই-তোকারি করে আর খারাপ খারাপ ভাষা ব্যবহার করে। বেশ মাথায় গোলমাল আছে। এখানকার সবাই তবু ঠিক করেছে, কেউ ওর কথায় বা ব্যবহারে রাগ করবে না, বরং খাতির করে ওকে আপনি বলা হবে!

বন্দনাদি হাসতে হাসতে বলল, আমার তাতে কী? গত মাসে যখন পেট ব্যথা হল, তখন আমার বাড়িতে ছুটে আসেননি আপনি?

ছেলেটি বলল, যা, যা, তোর বাড়িতে আর কোনও দিন যাব না!

বন্দনাদি বলল, কাল দুপুরে খিচুড়ি হবে!

ছেলেটি মুখ বিকৃত করে বলল, নাঃ খিচুড়ি আবার মানুষে খায়! বিচ্ছিরি। গরুকে খাওয়ানো যায়!

ছেলেটিকে আরও রাগাবার জন্য আমি বললুম, বাবুমশাই, আপনার পেছনে একটা লেজ ঝুলছে কেন?

ছেলেটি অমনি পেছনে হাত দিয়ে দেখল। তারপর চোখ পাকিয়ে আমাকে বলল, স্টুপিড! মেথরের ঝাঁটার ভাঙা খ্যাংরা কাঠি তুই! তোর মুখখানা উপোসী বাঁদরের মতন! তুই ব্যাঙের থুতু খা!

আমি আর বন্দনাদি দু’জনে খুব হাসতে লাগলুম। হাসতে হাসতে বললুম, ওরে বাবা, এ যে দেখছি ছোটখাটো একটি ক্যাপ্টেন হ্যাডক!

ছেলেটি আমাদের অগ্রাহ্য করে যীশুর মূর্তির কাছে শশা ভর্তি ঝুড়িটা রাখল। তারপর দুটো শুধু পেয়ারা নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

আমি বললুম, তিন বছর আগে ওকে একইরকম দেখেছি। কোনও পরিবর্তন হল না তো? তোমরা যে ওর সঙ্গে এত ভাল ব্যবহার করে এলে এতদিন, সেই চিকিৎসায় তো কাজ হল না!

বন্দনাদি বলল, কিছুটা হয়েছে। একা কারুর সঙ্গে দেখা হলে আর রাগারাগি করে না। কিছুদিন আগে ওর পেট ব্যথা হয়েছিল খুব, আমার কাছে ছুটে এসেছিল। আমি তেল গরম করে ওর পেটে মালিশ করে দিচ্ছিলুম, ও একটা শিশুর মতন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমার হাঁটু জড়িয়ে ধরেছিলে। এমন মায়া লাগছিল তখন। আহারে, কোন মায়ের বুকে দাগা দিয়ে পালিয়ে এসেছে ছেলেটা। নিজের ভাল-মন্দ বোঝার মতো জ্ঞানই হয়নি। ওকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারলে ভাল হয়।

—একটা জ্ঞান হয়েছে বোঝা গেল। বিনিময় প্রথাটা বুঝেছে। পেয়ারা নেবার বদলে শশা রেখে গেল।

—খিচুড়ি খেতে দারুণ ভালবাসে। কাল দুপুরে দেখবি, ঠিক আসবে আমার বাড়িতে। তখনও হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে আসবে।

গির্জার বাইরে এসে বন্দনাদি বলল, নীলু, তুই রাস্তা চিনে বাড়িতে যেতে পারবি? আমি একটু প্রভাসদার বাড়ি ঘুরে যাব, ওঁর শরীর ভাল নেই।

টিলার ওপরে বাড়ি, দূর থেকে দেখা যায়, রাস্তা চেনার আর অসুবিধে কী? বড়জোর একটু ঘুর পথ হবে!

খানিকটা যাবার পর একটা চৌরাস্তার মোড় এল। এ জায়গাটা চেনা। দু’দিকে দুটো বড় ব্ল্যাক বোর্ড আছে। মিলিটারির আমলে এখানে নিশ্চয়ই নানা রকম নির্দেশ লেখা থাকত। এখন এখানকার লোকেরা ইচ্ছে মতন কিছু একটা লিখে যায়। তবে, মুখস্থ করা কোটেশান চলবে না। নিজস্ব ভাবনার কথা লিখতে হবে। অনেকেই নানা রকম প্রশ্ন করে দেখেছি।

এবারেও দুটো প্রশ্ন চোখে পড়ল :

অনিদ্রারোগীরা শুনুন। জোর করে ঘুমোবার চেষ্টা করবেন না। বরং সারা রাত জেগে থাকুন। এক রাত্তির জাগলে শরীর হালকা হয়ে যায়, মন অনেক সূক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ হয়। পরের সারা দিনটা বেশ ভাল কাটে। পরের রাত্তিরেও বিছানায় শুয়ে প্রথমেই ঠিক করতে হয়, আজও সারা রাত ঘুমোব না! কিছুতেই না। তারপরেই কিছুক্ষণ আধো-ঘুম, আধো-জাগরণ। চমৎকার চমৎকার স্বপ্ন দেখা যায়। বাকি রাতটা কেটে যায় গভীর ঘুমে। আমি এই ভাবে অনেকবার সুফল পেয়েছি। ডাক্তারবাবুরা কী বলেন?

পরের প্রশ্ন এত সাদামাঠা নয়। একটা প্রশ্ন নয়, প্রশ্নাবলি।

এক নদীতে কতবার স্নান করা যায়? যদি অনেকবার হয়, তাহলে নদী কাকে বলে? বহতা জল, না দুই পার? মানুষের জীবন কাকে বলে, বয়েসের গড়িয়ে যাওয়া, না আয়ু। বিদ্যুৎ কী? তরল, কঠিন বা বায়বীয় নয়, তবু বিদ্যুৎ কি কোনও পদার্থ? কোনও কোনও নারীর চোখেও বিদ্যুৎ থাকে। নারীরা কি কখনও কোনও পুরুষের চোখে বিদ্যুৎ দেখেছে?

এই সব প্রশ্নের আবার কেউ উত্তর লিখে দেয় কিনা জানি না। আমার উত্তর দেবার সাধ্য নেই। একটা টিনের বাক্সে নানা রঙের খড়ি রাখা আছে। আমারও কিছু লিখতে ইচ্ছে হল।

লিখলাম, আমাদের মাথার ওপরে যে বিশাল শূন্যতা, তার নাম আকাশ। আমাদের বুকের মধ্যে যে শূন্যতা, তার নাম কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *