চলো দিকশূন্যপুর – ৫

এই চৌরাস্তার মোড়ে একটা পাকাপাকি মাচা বাঁধা আছে। এখন জ্বালানো হয়েছে দুটো মশাল। মাচার ওপর দাঁড়িয়ে একজন বাজাচ্ছে মাদল।

প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন নারী পুরুষ জমায়েত হয়েছে এর মধ্যে। আরও কিছু লোক আসছে। এদের মিটিং-এ আসার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। যার খুশি সে না আসতেও পারে।

লক্ষ করে দেখলুম, এদের মধ্যে বৃদ্ধের সংখ্যা বেশি নয়। বুড়ো বয়েসে খুব কম লোকই নিরুদ্দেশে যেতে চায়। শরীরের জোর যত কমে যায়, ততই নিজের পরিচিত বিছানাটার প্রতি মায়া বাড়ে। অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ে প্রায় নেই, রাগীবাবু বা বাবুসাহেবই সবচেয়ে ছোট। অনেক কিশোর-কিশোরীও বাড়ি থেকে পালায়, কাগজে কত বিজ্ঞাপন দেখি, কিন্তু তারা দিকশূন্যপুরে আসে না, এলেও তাদের ভাল লাগবে না। এখানে খেলাধুলোর উন্মাদনা নেই, হই চই নেই, সবাই বড় বেশি আত্মমগ্ন।

কিছু প্রৌঢ় রয়েছে, তবে যুবক-যুবতীর সংখ্যাই বেশি। যৌবনেই অভিমান তীব্র হয়। যৌবন সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে, লাফিয়ে লাফিয়ে নামে, অনেকবারই হয়তো হোঁচট খায়, তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যাকে প্রিয়জন মনে করে, এমন কেউ যদি আচমকা পেছন থেকে ধাক্কা দেয়? সেই বিস্ময়, সেই আঘাত অনেকেই সামলাতে পারে না। জোর করে অধিকার প্রতিষ্ঠার বদলে যৌবন স্বেচ্ছায় সব কিছু ছেড়েছুড়ে চলে যেতে পারে।

যতদূর শুনেছি, জোড় বেঁধে আজ পর্যন্ত কেউ আসেনি। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে ঘর ছাড়ে না, ছাড়লেও এক রাস্তায় যায় না। অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা সমাজের চাপে প্রতিষ্ঠা পায় না, ঘর বাঁধতে পারে না, সেই অভিমানে তারা আত্মহত্যা করে। হোটেলের ঘরে বিষ খেয়ে শুয়ে থাকে দু’জন যুবক-যুবতী এক সঙ্গে জলে ডুব দেয়। ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেন তারা এই দুর্লভ মানব জন্ম এরকম ঝোঁকের মাথায় শেষ করে দেয়? তারা দিকশূন্যপুরে চলে এলেই তো পারে। এখানে কোনও সমাজ নেই, রাজনীতি নেই, কোনও অভিভাবক শ্রেণীর চোখরাঙানি নেই, এমনকী কিছুটা খাটাখাটনি করলে বেঁচে থাকার মতন খাদ্যেরও অভাব হয় না। দিকশূন্যপুরে এখনও জনসংখ্যার কোনও সমস্যা হয়নি। নবাগতদের বাধা দেয় না কেউ।

জোড় বেঁধে কেউ আসে না, এখানে আসার পর কেউ যদি পূর্ব পরিচিত কারুকে দেখে, সে প্রসঙ্গও তোলা হয় না। এখানে সকলেরই তো অতীত মুছে ফেলার সাধনা। শুধু এই বাসুদেবন নামের লোকটাই গোলমাল পাকিয়েছে। হয়তো পুরোটাই ওর কল্পনা, কিংবা যাকে বলে ফিক্সেশান। বোধহয় সুলোচনা নামে অন্য কেউ ছিল। একটি মেয়ের সঙ্গে আর একটি মেয়ের চেহারার কিছুটা মিল তো থাকতেই পারে। কিন্তু সেই সুলোচনার জন্য রোহিলা ওর কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাবে কেন? পুরুষদের সম্পর্কে ওর আগেকার জীবনের অভিজ্ঞতা যে খুব তিক্ত।

গোড়ালিতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে এদিক ওদিক চেয়ে খুঁজলাম, রোহিলা আসেনি।

হঠাৎ ফুলমণির কথা মনে পড়ল। ফুলমণিকে তো আমি দিকশূন্যপুরের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলুম, এখানেই তার থাকার কথা। তার কথা বন্দনাদিকেও জিজ্ঞেস করা হয়নি। বন্দনাদির এখনও মুখ ভার হয়ে আছে, এখন থাক।

এখানে যারা রয়েছে, তারা কেউই নেহাত সাধারণ মানুষ নয়, ধরাবাঁধা জীবন কাটায়নি। এদের প্রত্যেকের জীবনেরই এক একটা গল্প আছে। কিন্তু সে সব গল্প জিজ্ঞেস করা যায় না। আমি দু’তিনজনের মাত্র জানি। এক ধরনের সাহস না থাকলে নিজের জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটাবার সিদ্ধান্ত মানুষ সহজে নিতে পারে না। দিকশূন্যপুরের সবাই পোড়খাওয়া মানুষ, তাই তারা অন্যদের সম্মান করে।

পেছন থেকে কেউ একজন আমার কাঁধে চাপড় মেরে জলদমন্ত্রে বলল, কবে এলে, নীলু?

মুখ ফিরিয়ে দেখলুম, মুরাদ সাহেব।

একটু অপরাধবোধ হল। এবারে ওঁর মা কিংবা রফিকের সঙ্গে দেখা করে আসতে পারিনি। ওদের ধারণা, মুরাদ সাহেব আত্মহত্যা করেছেন, বাড়িতে সেই মর্মে চিঠি লিখে এসেছিলেন।

দাড়ি কামানো মসৃণ মুখ। অতিশয় সুপুরুষ, অনেক মানুষের মধ্যে তাঁকে আগে চোখে পড়ে। কলকাতায় ওঁদের ইলেকট্রিকের সাজ সরঞ্জামের বিরাট ব্যবসা, সে সব ছেড়ে উনি এখানে এসে পেয়ারাবাগান করেছেন।

—কেমন আছেন, মুরাদভাই? আমি আজই এসে পৌঁছেছি, তবু এর মধ্যেই মনে হচ্ছে যেন কয়েকটা দিন কেটে গেছে।

—ঠিকই বলেছ। আমরা এখানে দৌড়োদৌড়ি করি না, কিন্তু জীবন এখানে মন্থর নয়। সময় বেশ তরতরিয়ে কেটে যায়। তোমার কী খবর বলো!

—বিকেলে নুন পাহাড়ের কাছে দুটো ময়ূর দেখেছি

—হ্যাঁ, এটা একটা খবর বটে। ভাল খবর। আমি কেমন আছি? আজ সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠেই দেখি ঠিক আমার পায়ের পাতার ওপর খানিকটা রোদ পড়েছে। প্রত্যেকদিনই জানলা খোলা থাকে, তবু ওখানে রোদ পড়ে না। আজকের দিনটা অন্যরকম। তা হলেই বুঝতে পারছ, আজ আমি বেশ ভাল আছি।

—আজ আপনার বাড়িতে বৃষ্টি হয়েছিল?

—না তো।

টিলার ওপরে বন্দনাদির বাড়িতে আমরা খানিকটা বৃষ্টি পেয়েছি। সব জায়গায় বৃষ্টি হয়নি, তাও বোঝা যাচ্ছিল।

—বাঃ, তোমরা তা হলে আরও ভাল আছ। আমি পেলুম নতুন রোদ, তোমরা পেলে আলাদা বৃষ্টি। প্যাশান ফ্লাওয়ার নামে একটা ফুল আছে জানো? আমি সেই গাছ লাগিয়ে ছিলুম, গাছ মানে লতানে গাছ, এতদিন ফুল আসেনি। আজ দেখি প্রথম একটা ফুল ফুটেছে, তা দেখে মনটা ঠিক যেন ঝর্নার জলে জ্যোৎস্নার মতন স্নিগ্ধ হয়ে গেল। তখনই ঠিক করলুম, আজ আর একলা নিজের জন্য রান্না করব না, অন্তত পাঁচজন লোককে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে হবে সেই ফুলের সম্মানে। জানি না তো তুমি এসেছ, তা হলে নিশ্চয়ই ডাকতুম তোমাকে।

যে মুরাদ সাহেবকে আমি কলকাতায় চিনতুম, তিনি এ রকম কবিত্ব করে কথা বলার ধার ধারতেন না। ছিলেন খানিকটা দাম্ভিক প্রকৃতির! একটা ফুল ফুটেছে বলে পাঁচ জনকে খাওয়ানো?

বন্দনাদির দিকে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন, তোমার বাড়িতেও আমার ওই ফুল ফোটার খবর দিতে গিয়েছিলুম, তখন বেলা দশটা-এগারোটা হবে। তুমি ছিলে না। বন্দনা, তুমি কতদিন আমার বাড়িতে আসো না।

বন্দনাদি বলল, হ্যাঁ, ওই সময়ে আমি প্রভাসদার খবর নিতে গিয়েছিলুম। আমি এমনিই একদিন আপনার বাড়িতে গিয়ে ওই ফুল দেখে আসব।

—ওই ফুলের মাত্র একদিন আয়ু।

—একবার যখন ফুটতে শুরু করেছে, আরও ফুটবে।

—তুমি এলে আমি ধন্য হব। বন্দনা, তুমি পেয়ারার জ্যাম বা জেলি বানাতে জানো? বাড়িতে এত পেয়ারা, কেউ নিতে চায় না, পেকে পেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কেউ খাবার নেই।

—আপনি রাওকে জিজ্ঞেস করবেন। সে বোধহয় ওসব জানে।

—রাইট। আপ্পা রাও আমাদের একবার টমাটো সস বানিয়ে দিয়েছিল। পাশ থেকে একজন বলল, ওহে, খাওয়া দাওয়ার আলোচনা বন্ধ করো। মিটিং শুরু হবে!

মাদল বাজানো বন্ধ হয়েছে, মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়েছে দু’জন পুরুষ ও একজন নারী।

আমি একজনকেও চিনি না, মুরাদ সাহেব আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, মেয়েটির নাম ফিরোজা, তার পাশে বলবন্ত, আর একজন কে বন্দনা?

বন্দনাদি বলল, ওর নাম বিজন, আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে।

আমি চমকে উঠে বললুম, বিজন? সে তো আমার বন্ধু ছিল, এক মুখ দাড়ি রেখেছে। ঘাড় অবধি চুল।

বন্দনাদি বলল, বিজন চুল-দাড়ি কাটা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। পুরুষেরা যদি কখনও চুল না কাটে, তা হলে কি মেয়েদের মতন লম্বা চুল হতে পারে? কয়েক বছরের মধ্যেই বিজনকে দেখে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

এখানে বাংলা, হিন্দি, ইংরিজি, গুজরাতি, মারাঠি, তামিল যার যে ভাষায় ইচ্ছে কথা বলতে পারে মঞ্চ থেকে। অন্য কেউ সংক্ষেপে তর্জমা করে বিষয়টা বুঝিয়ে দেয়। অনেকেই তিন-চারটে ভাষা জানে, প্রতিবেশীরা পরস্পরের ভাষা শিখে নেয়, বাংলা প্রায় সবাই বোঝে।

যে-কেউ মিটিং ডাকতে পারে। তবে নিতান্ত জরুরি কারণ না থাকলে একলা কেউ মিটিং ডাকে না, অন্তত তিনজনের সঙ্গে পরামর্শ করে নেয়। আজকের মিটিং-এর এই তিনজন কনভেনার, বোঝা গেল।

হাত তুলে সবাইকে নীরব হবার আবেদন জানিয়ে বলবন্ত বলল, আমি গান জানি না। ফিরোজা গান জানে না। বিজনের ঠাণ্ডা লেগেছে, গলা ঠিক নেই। আপনাদের মধ্যে কেউ এসে একটা গান শোনাবেন?

একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গল। যারা গান জানে, তারাও নিজে থেকে মঞ্চে উঠতে চায় না। আমি বললুম, বন্দনাদি, তুমি যাও, তুমি গান করো একটা।

বন্দনাদি কটমট করে আমার দিকে তাকাল।

মুরাদ সাহেবও সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ, বন্দনা, অনেকদিন তোমার গান শোনা হয়নি।

আরও কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠল, বন্দনা, বন্দনা!

একটা রোগা পাতলা মেয়ে ভিড় ঠেলে এসে বন্দনাদির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। এই মেয়েটিকে চিনি, এর নাম পিউ। আগেরবার একটা বুনো খরগোশ কোলে নিয়ে বন্দনাদির বাড়িতে এসেছিল। একটা মজার কথা বলেছিল পিউ। মেয়েদের স্তনে দুধ জমে গেলে যেমন মাঝে মাঝে বার করে দিতে হয়, সেই রকম ওর বুকে অনেক কান্না জমা আছে, মাঝে মাঝে খরচ না করলে ওর বুক ব্যথা করে। সেই জন্য পিউ যখন তখন একটু মুখ ফিরিয়ে কেঁদে নেয়।

কাজের সুবিধের জন্য বন্দনাদি শাড়ি পরে না, সব সময় স্কার্ট-ব্লাউজেই তাকে দেখা যায়। স্কার্ট আর ঘাঘড়া তো একই, হাঁটু পর্যন্ত ঝুল। বাহু দু’টি নগ্ন, চুল বাঁধবার ঝামেলা এড়াবার জন্য লম্বা চুলও কেটে ফেলেছে। মঞ্চের ওপর দাঁড়াবার পর বন্দনাদিকে রাশিয়ান নর্তকীর মতন দেখাল।

মাইক নেই, হারমোনিয়াম নেই, বন্দনাদি প্রথমে হাত চাপড়ি দিয়ে তাল আর লয়টা ঠিক করে নিল। তারপর গাইল :

জাগাও পথিকে ও যে ঘুমে অচেতন
বেলা যায় বহুদুরে পান্থনিকেতন
রে পান্থনিকেতন
থাকিতে দিনের আলো
মেলে সে বসতি ভাল
নতুবা করিবে কোথা যামিনী যাপন
জাগাও পথিকে ও যে ঘুমে অচেতন…

শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ল, কলকাতার রবীন্দ্রসদনে ‘শকুন্তলা’ নৃত্যনাট্যে বন্দনাদি নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। নাচতে নাচতে গান গেয়েছিল, সে দারুণ ব্যপার। এখন যদি আমি চেঁচিয়ে বন্দনাদিকে নাচতে বলি, তা হলে নিশ্চয়ই বন্দনাদি আমাকে মারবে!

গান শেষ হতেই বলবন্ত বলল, কী আশ্চর্য বন্দনা, তুমি কী করে এই গানটাই বাছলে আজ? আমাদের মিটিং-এর প্রধান আলোচনাই আজ ঘুম। তোমার গানটা হল প্রস্তাবনার মতন!

অনেকেই অবশ্য দাবি জানাল, আর একখানা, আর একখানা! বন্দনাদি পাত্তা দিল না, নেমে পড়ল মঞ্চ থেকে।

বলবন্ত সকলের উদ্দেশে বলল, আমি ঘুম বিষয়ে কিছু জানাতে চাই। মানুষের জীবনে দিনে-রাতে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ছ’ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। কেউ কেউ পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়েও দিব্যি থাকতে পারে। ডাক্তারদের মতে ছ’ ঘণ্টাই ভাল এবং যথেষ্ট। আমরা অনেকে কিন্তু বেশি ঘুমোই, দুপুরে ও রাত্তিরে, আট ঘণ্টা, ন’ ঘণ্টা। যত বেশি ঘুমোই, সেই সময়টা আমরা পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ থেকে বঞ্চিত হই।

স্বাস্থ্য বিষয়ে একটা বক্তৃতা দিচ্ছে ভাবলে ভুল হবে। আসল কথাটা এর পরে আসবে। এটাই এখানকার রীতি।

বলবন্ত থামতেই ফিরোজা বলল, একটানা ছ’ ঘণ্টা দিনের বেলা ঘুমিয়ে নিলে আর রাত্তিরে ঘুমোনোর কোনও দরকার হয় না। সবাইকে যে রাত্তিরেই ঘুমোতে হবে, তার কোনও মানে নেই। এমন অনেক লোক আছে, যারা রাতের পর রাত জেগে থাকে, দিনের বেলা ঘুমিয়ে নেয়, তাদের স্বাস্থ্যের কোনও ক্ষতি হয় না। আমিও রাত্তিরে ঘুমোই না।

ঠিক নাটকের মতন বলবন্ত তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন রাত্তিরে ঘুমোও না ফিরোজা?

ফিরোজা বলল, আমার ভয় করে।

বলবন্ত বলল, তোমার কিসের ভয় ফিরোজা? তুমি ভূত-টুত বিশ্বাস করো নাকি! এখানে তো অন্য কোনও ভয় নেই।

ফিরোজা বলল, কেন ভয় পাই, সেটা আমি বলব না।

সভায় একটা হাসির রোল উঠল।

মুরাদ সাহেব ফিসফিস করে আমায় বললেন, ফিরোজা স্লিপ ওয়াকার। ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ায়। এটা খুব বিপজ্জনক। এক রাতে ও ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে একটা টিলায় উঠে গিয়েছিল। পা পিছলে মরে যেতে পারত। লজ্জায় সে কথা বলছে না।

বলবন্ত জনতার দিকে ফিরে বলল, অনেক প্রাণী রাত্রে জেগে থাকে। যেমন বাঘ-সিংহ, যেমন শেয়াল। বাঘ-সিংহের কথা থাক, শেয়াল সম্পর্কে একটু বলি। আপনারা কেউ কি সম্প্রতি শেয়াল দেখেছেন? নুন-পাহাড়ের জঙ্গলে কিন্তু কয়েকটি শেয়াল এসেছে। আমার বাড়ি জঙ্গলের খুব কাছে, আমি সন্ধেবেলা শেয়ালের ডাক শুনতে পাই। শেষ রাত্তিরে যখন সব মানুষ ঘুমোয়, তখন শেয়ালেরা মানুষের বাড়ির কাছাকাছি নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের এখানেও শেয়াল আসে।

আমি মুরাদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলুম, হঠাৎ শেয়ালের কথা? সত্যি সত্যি শেয়াল, নাকি উনি প্রতীকের কথা বলছেন?

মুরাদ সাহেব বললেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।

বলবন্ত এবার বিজনকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কিছু বলবে?

বিজন বলবন্তের কানে কানে ফিসফিস করে কিছু জানাল।

বলবন্ত চেঁচিয়ে বলল, বিজনের গলা ভেঙে গেছে, সে জানাতে চায় যে, সেও সারা রাত জেগে থাকে। কেন রাত জাগে, তা আপনারা জানতে চান?

বেশ কয়েকজন বলল, হ্যাঁ জানতে চাই, জানতে চাই!

বিজন একটা হাত জোরে জোরে নাড়ল। অর্থাৎ সে জানাবে না। কারণটা ব্যক্তিগত।

বলবন্ত বলল, এ বার আমি একটা প্রস্তাব পেশ করতে চাই। এই দিকশূন্যপুরে আমরা প্রতি সপ্তাহে অন্তত দশজন পুরুষ পালা করে রাত জাগব। দিনের বেলা ঘুমিয়ে নিলেই হবে। রাত্তিরে আমরা পথে পথে ঘুরে বেড়ার, গান গাইব। রাত্রিরও তো একটা সৌন্দর্য আছে, দিনের আকাশ আর রাতের আকাশে কত তফাত, দিনের বেলার বাতাসের চেয়ে রাত্তিরের বাতাসও অন্যরকম, দিনের বেলা এক রকম ফুল ফোটে, রাত্রে অন্য রকম ফুল, এই সব সৌন্দর্য উপভোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হব কেন? প্রতি সপ্তাহে দশ জন দশ জন, তা হলে সকলেরই জাগা হবে। কারুর আপত্তি আছে? থাকলে হাত তুলুন।

কেউ হাত তুলল না।

বলবন্ত বলল, বেশ। তা হলে আমি প্রথম দশ জনের নাম লিখে নিতে চাই।

একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দাঁড়ান। দশ জন পুরুষ সারারাত এখানকার পথে পথে ঘুরে বেড়াবে, গান গাইবে, মেয়েরা পারবে না কেন? মেয়েদের কেন বাদ দিচ্ছেন?

বলবন্ত বলল, শুধু পুরুষ বলেছি বুঝি? ভুল হয়ে গেছে। মেয়েরা যোগ দিলে তো আরও ভাল হয়, তা হলে পুরুষদের ঘুম পাবে না। গান জমবে। মেয়েরাও ওয়েলকাম! আর আমাদের কোনও বক্তব্য নেই, মিটিং শেষ, এখন যার যা খুশি।

বন্দনাদি জয়দীপকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কাছে ফিরে এল।

জয়দীপকে দেখলে আমার হ্যামলেট চরিত্রটি মনে পড়ে। বেশ রূপবান ও স্বাস্থ্যবান যুবা, কিন্তু মুখখানা সব সময় বিষাদে আচ্ছন্ন। জয়দীপের পূর্ব জীবনের কাহিনী কেউ জানে না, ও ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করে না।

জয়দীপের ওপর বন্দনাদির বেশ দুর্বলতা আছে। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল, এই যুবকটিই বুঝি বন্দনাদির এখানকার প্রেমিক। তা অবশ্য নয়। জয়দীপ কোনও নারীকে স্পর্শ করে না। সে একদিন বন্দনাদিকে আমাদের সামনেই বলেছিল, বন্দনা, তোমাকে আমি মেয়ে বলে মনে করি না, যদি মনে হত, তাহলে আমি তোমার সঙ্গে মিশতাম না। তুমি আমার বন্ধু!

আমি অবশ্য এই ব্যাপারটা বুঝি না। একটি জলজ্যান্ত রূপসী রমণী, তাকে রমণী বলে মনে হবে না, তবু বন্ধু হবে কী করে?

জয়দীপের সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হয়। এক এক সময় তার ব্যবহার পাগলামির সীমানায় চলে যায়, তখন বন্দনাদি তার রাশ টেনে ধরে।

জয়দীপ আমাকে দেখেই কড়া গলায় বলল, তুমি আবার কেন এসেছো? আমি মিনমিন করে বললুম, তোমার আপত্তি আছে? তা হলে এক্ষুনি ফিরে যেতে পারি।

জয়দীপ বলল, তুমি আমার সামনে বাইরের পৃথিবীর কথা কক্ষণো বলবে না! আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না।

বন্দনাদি বলল, না, না, বলবে না, নীলু কিছু বলবে না।

জয়দীপ বলল, ওর নাম নীললোহিত, তুমি ওকে নীলু বলে ডাকো কেন?

বন্দনাদি বলল, তোমার নামও তো জয়দীপ। মাঝে মাঝে আমি তোমাকে জয় বলে ডাকি।

মুরাদ সাহেব জয়দীপকে ভাল চেনেন না। তিনি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। জয়দীপের এ ধরনের কথাবার্তা তাঁর পছন্দ হয়নি।

বন্দনাদি বলল, বসন্ত রাও আসেনি। অথচ এই ধরনের মিটিং-এ সে নিয়মিত আসে। তার নাকি মন টন খুব খারাপ। চল নীলু, একবার বসন্ত রাওয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি। মুরাদভাই, তুমিও যাবে নাকি?

মুরাদ বলল, দুঃখিত, বন্দনা। আমার বাড়িতে একজন অতিথি আসবে, আমি যেতে পারছি না। তুমি প্যাশান ফ্লাওয়ার দেখতে এসো কিন্তু

একটুখানি যাবার পর আমি বললুম, বন্দনাদি, আমার একটা খটকা লেগেছে। বলবন্ত যতই কবিত্ব করে দিনের বেলা ঘুম আর রাত্তিরে সৌন্দর্য উপভোগের কথা বলুক, আসলে তো রাত্তিরে পাহারা দেবার ব্যাপার। পালা করে নাইট গার্ড। এখানে কি চুরি-ডাকাতির উপদ্রব শুরু হয়েছে নাকি? কিংবা যে সব মেয়েরা একা একা থাকে—

বন্দনাদি বলল, না, তা নয়। চুরি কে করবে? লোকের বাড়িতে আছেই বা কী? এটা একটা পাহারা দেবার প্রস্তাব ঠিকই। সেটা অন্য কারণে। এক নম্বর কারণ হচ্ছে বিজন। তোর বন্ধু বিজন মুর্গি পালন করে জানিস তো। এখন ওর বাড়িতে প্রায় শ’ খানেক মুর্গি। বিজন সবাইকে মুর্গির মাংস দেয়, মুর্গির ডিম দেয়। ইদানীং ওর মুর্গি চুরি হচ্ছে, মানে শেয়ালে নিয়ে যাচ্ছে। ওর তো তেমন ভাল খাঁচাটাঁচা কিছু নেই। তার ফলে বিজনকেই সারা রাত জেগে পাহারা দিতে হয়। বিজন এত লোককে মুর্গি খাওয়াচ্ছে, অথচ ও একলা একলা পাহারা দেবে কেন? শেয়াল তাড়ানো আমাদের সকলেরই দায়িত্ব!

জয়দীপ বলল, এত লোকের দরকার কী? আমিই বিজনের বাড়িতে পাহারা দিতে পারি। আমার রাত্তিরে ঘুমের দরকার হয় না।

বন্দনাদি বলল, তবু সকলে মিলে দায়িত্বটা ভাগ করে নিলে ভাল লাগে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, কেউ কেউ ঘুমের মধ্যেই বিছানা ছেড়ে বাইরে চলে আসে। হাঁটতে শুরু করে। ফিরোজার মতন আরও দু’ জনের এই রোগ আছে। আপ্পা রাও এক মাঝ রাত্তিরে, রাস্তা দিয়ে পাগলের মতন ছোটাছুটি করছিল, বলবন্ত দেখতে পেয়ে তার হাতে চেপে ধরল, আপ্পা রাও বলবন্তকে চিনতেই পারল না। বলতে লাগল, কে? কে? অথচ দিনের বেলা আপ্পা রাও কত স্বাভাবিক, বলবন্তের সঙ্গেও খুব বন্ধুত্ব। এই ধরনের স্লিপ ওয়াকারদের যখন তখন বিপদ হতে পারে। ডাক্তাররা বলেছে, কয়েকটা দিন দলবলের সঙ্গে ওদের যদি সারারাত জাগয়ে রাখা যায়, তা হলে রোগটা কমতে পারে। আর তৃতীয় কারণ হচ্ছে রোহিলা। রোহিলাকে নিয়ে দু’ রকম বিপদ। ভাঙচুরের নেশা তাকে এমনই পেয়ে বসেছে যে রাত্তিরেও লোকের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তাকে আটকানো দরকার। অন্য দিকে, সেই বাসুদেবন নামে লোকটা যেমন খেপে আছে, ও চুপি চুপি কোনও রাত্তিরে ফিরে এসে রোহিলাকে ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারে। সেই জন্যই পাহারা দিলে ভাল হয়।

আমি বললুম, উদ্দেশ্য তো খুব মহৎ, কিন্তু কতদিন চলবে? এক সময় সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। মানুষের শরীর রাত্তিরের ঘুমটাই চায়।

বন্দনাদি বলল, বেশিদিন হয়তো দরকারও হবে না। আমি পরের সপ্তাহে ওদের দলে যোগ দেব ঠিক করেছি। রাত জাগতে আমার খারাপ লাগে না।

জয়দীপ বলল, তুমি যে সপ্তাহে জাগবে, সেই সপ্তাহে আমি তোমার সঙ্গে থাকব।

বন্দনাদি বলল, বেশ, আমরা দুজনে হাত ধরাধরি করে গান গাইব। নীলু, তোর হিংসে হবে নাকি?

জয়দীপ বলল, ঈশ্বর আমাকে সুর থেকে বঞ্চিত করেছেন। আমি একটা লাইনও গান গাইতে পারি না।

আমি বললুম, তোমার এমন সুন্দর চেহারা, তোমার গান গাইবার দরকার কী? তুমি হাত ধরে থাকবে, বন্দনাদি গান গাইবে।

খুব ছেলেমানুষের মতন জয়দীপ বলল, বন্দনা, আমি যদি তোমার হাত না ধরি, তা হলে কি গান গাইবে না? আমার হাত ধরতে ইচ্ছে করে না।

বন্দনাদি বলল, কেন, আমি কি অদ্ভুত নাকি? ঠিক আছে বাবা, তোমাকে হাত ধরতেও হবে না।

জয়দীপ তবু অভিযোগের সুরে বলল, এই নীললোহিত কেন আমার চেহারা সুন্দর বলল? ও কী জানে, সুন্দর কাকে বলে? যে কোনও মানুষ যদি আর একজনের বন্ধু হয়, তা হলেই সে সুন্দর।

বন্দনাদি বলল, ঠিকই তো। নীললোহিত তোমাকে বন্ধু মনে করে।

এ বারে আশ্বস্ত হয়ে জয়দীপ বলল, ওঃ, তা হলে ঠিক আছে।

বসন্ত রাওয়ের বাড়ির মধ্যে আলো জ্বলছে, দরজা বন্ধ।

আমরা ঠক ঠক করতে সে হেঁকে জিজ্ঞেস করল, কে? কে?

এতক্ষণে জয়দীপও হাসল। বৃষ্টি-বাদলা না হলে এখানে কেউ দরজা বন্ধ করে না, কে কে করে না। রোহিলার ভয়ে তার এই অবস্থা। অথচ রোহিলার মতন একটি সুশ্রী মেয়েকে দেখে কোনও পুরুষেরই ভয় পাবার কথা নয়।

দু’খানা মোটা-মোটা মোম জ্বালিয়ে ছবি আঁকছিল বসন্ত রাও, দরজা খুলে আমাদের দেখে তার স্বভাবসিদ্ধ স্মিত হাসি ছিল না, সাদর সম্ভাষণ জানাল না, শুকনো মুখে বলল, ও, তোমরা এসো!

একমাত্র বসন্ত রাওয়ের বাড়িতেই কয়েকখানা পুরনো আমলের চেয়ার আছে। বসবার ঘরটি বেশ প্রশস্ত, এককোণে ফায়ার প্লেস ছিল আগে। এটি কোনও বড় সাহেবের বাড়ি ছিল মনে হয়।

ভেতরে ঢুকে বন্দনাদি বলল, তোমার এ কী অবস্থা হয়েছে বসন্ত রাও? দরজা বন্ধ করে ছবি আঁকতে হচ্ছে?

বসন্ত রাও ফ্যাকাসে ভাবে বলল, কী করি! সেই কৃষ্ণবসনা সুন্দরীটি যে আমাকে আর বাইরে তিষ্ঠোতে দেয় না। দেখলেই ছবি ছিঁড়ে দেয়।

বন্দনাদি বলল, তুমি মাদলের আওয়াজ শোনোনি? মিটিং-এ গেলে না? বসন্ত রাও বলল, এই ছবিটা শেষ করছিলুম। এটা অনেকদিন ধরে আঁকছি, আজ শেষ না করলে শান্তি হচ্ছিল না।

বসন্ত রাওয়ের ছবি বিক্রি হবে না, কোনও প্রদর্শনীতে পাঠানো হবে না, তবু ছবি শেষ করার এই ব্যাকুলতার মর্ম বুঝবে কে?

জয়দীপ ইজেলের পাশে গিয়ে ছবিটা দেখতে দেখতে বলল, আগে তুমি গাছ-পালা, নদী-পাহাড় আঁকতে। এতে যে দেখছি তাও নেই, শুধু রং, নানারকম রং, আর কিছুই নেই, এটা কী করে ছবি হয়?

বসন্ত রাও বলল, ওই রঙের মধ্যে আছে জীবনের ছন্দ। রঙের সঙ্গে রং মেলানোই যে কী কঠিন!

আমার সঙ্গে আগে কত গল্প করত, এখন চোখে চোখ পড়তে শুধু জিজ্ঞেস করল, কবে এসেছ, নীললোহিত?

বন্দনাদি বলল, তুমি এমন চিঁচিঁ করে কথা বলছ কেন? কী হয়েছে তোমার? চিয়ার আপ! আমি তোমার রান্না ঘরে গিয়ে চা বানাব?

বসন্ত রাও বলল, বানাও। আমি সর্বক্ষণ মরমে মরে আছি বন্দনা। ওই রোহিলা মেয়েটি আমার ওপর এত রেগে আছে, অথচ আমি তো ওর মন্দ চাই না। কী করলে ওর মন ফেরানো যায়? আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে তোলার কি কোনও উপায় নেই?

বন্দনাদি বলল, তুমি সাউথ ইন্ডিয়ান ফিল্মে সুলোচনা নামে একজন অভিনেত্রীর কথাটা বলে ফেলেই খুব ভুল করেছো। ওর বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে, তুমি ওকে সুলোচনা মনে করো। সেটাই তো ওর মাথা খারাপের কারণ।

বসন্ত রাও মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ভুল করেছি, খুবই ভুল করেছি। আমি বোকা-সোকা, ন্যালা খ্যাপা ধরনের মানুষ, কখন যে কী বলে ফেলি তার ঠিক নেই।

—ওর সামনে না বললেই পারতে।

–সে খেয়ালও যে আমার থাকে না। কী দরকার ছিল আমার বলার। তবে কি জানো, নানা কারণে ও অনেকদিন থেকেই আমার ওপরে রেগে আছে। মেয়েটি মন্দ ছবি আকে না। ভালই আঁকে বলা যায়, একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। প্রথম প্রথম আমার কাছে জল রং আর তেল রঙের ব্যবহার শিখতে আসত। কিন্তু আমি শেখাতে গেলেই আবার তর্ক করত। সেটাও একটা অরিজিনালিটির লক্ষণ। আমি ওকে বলেছিলুম, আমার কাছে তোমার কিছু না শেখাই ভাল বরং, তুমি নিজে যা পারো, সেটাই আঁকো। আমার প্রভাব তোমার ওপরে ভাল হবে না। তাতে রেগে গিয়ে বলে কী, ও বুঝেছি, তুমি আমায় শেখাতে চাও না! যাকে বলে উল্টো বুঝলি রাম! আমার সব কথাই উল্টো বোঝে। একদিন এসে বলল, ও আমার ছবি আঁকবে, আমার ফিগার স্টাডি করবে, সে জন্য ওর সামনে আমাকে পোজ দিতে হবে! সেটা কি আমার পক্ষে সম্ভব?

–কেন, সম্ভব নয় কেন? তুমি ওর জন্য খানিকটা সময় দিতে পারতে না?

—আরে ও পাগল মেয়ে বলে কী, আমাকে সব জামাকাপড় খুলে বসতে হবে। আমার নুড স্টাডি করবে!

আমরা সবাই হেসে উঠলুম।

বসন্ত রাও আমার দিকে আঙুল তুলে বলল, এই নীললোহিতই তো ওর মাথায় এই সব উদ্ভট চিন্তা ঢুকিয়ে গেছে

আমি বললুম, উদ্ভট কেন? বলেছিলুম, যুগ যুগ ধরে পুরুষ শিল্পীরা মেয়েদের এত ছবি এঁকেছে। মেয়েদের কত রকম নুড স্টাডি করেছে। এখন মেয়েরাও ছবি আঁকছে, এখন মেয়েরা কেন পুরুষদের ছবি আঁকবে না। পুরুষদেরও নুড স্টাডি করবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

বসন্ত রাও বলল, দূর দূর, সব বাজে কথা। একটা মেয়ে হয়ে আমাকে ও রকম একটা প্রস্তাব দেওয়া ওর সাজে?

—বসন্ত রাও, তুমি হিউম্যান ফিগার আঁকো না। ধরো যদি আঁকতে, তোমার মডেল লাগত। তুমি রোহিলাকে জামা-কাপড় খুলে তোমার জন্য পোজ দিতে বলতে পারতে। এর মধ্যে অশোভন কিছু নেই। সেইরকম, রোহিলাও তোমাকে পোজ দিতে বলতে পারে।

—পুরুষরা কখনও উলঙ্গ মডেল হয়? কখনও শুনেছেন?

কেন হবে না? রদ্যাঁ ভিক্তর হুগোর উলঙ্গ মূর্তি গড়েননি?

—সে তো একজন পুরুষের সামনে। কোনও মেয়ের সামনে সম্ভব?

–মেয়েরা যদি পুরুষদের সামনে ওই ভাবে দাঁড়াতে পারে, পুরুষরাই বা কেন মেয়েদের সামনে পারবে না। বুঝতে পারছি না!

—তুমি দাঁড়াও না! কিংবা জয়দীপ, তার অমন চেহারা, তোমরা যত ইচ্ছে দাঁড়াও। আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন?

বন্দনাদি হাসতে হাসতে বাধা দিয়ে বলল, বসন্ত রাও, এত রেগে যাচ্ছ কেন? তুমি রোহিলার প্রস্তাবে রাজি হলে না, তখন রোহিলা কী বলল?

—রাগের চোটে একেবারে চিড়বিড় করতে লাগল। বলল, তুমি আমার জন্য পোজ দিতে রাজি নও, তার মানে তুমি আমাকে শিল্পী বলে মনে করো না। তুমি ভাবো, আমি শুধু একটা মেয়ে, মেয়েরা আবার ছবি আঁকবে কী! মেয়েরা পুরুষদের সামনে হাসবে-খেলবে- নাচবে-গাইবে-শরীর দেখাবে। তাদের আর কোনও যোগ্যতা থাকার দরকার নেই!…আ মোলো যা, আমি এ সব কথা ভাবিওনি। বলিওনি। আমার ওপর চাপিয়ে দিল।

জয়দীপ বলল, তোমরা দুজনেই শিল্পী, তবু তোমাদের ভাব হল না। শিল্পীরা বুঝি পরস্পরের বন্ধু হতে পারে না?

বন্দনাদি ঠোঁট টিপে হেসে বলল, দ্যাখো বসন্ত রাও, তুমি যদি এখন জামাকাপড় খুলে পোজ দিতে রাজি হও, তা হলে রোহিলাকে ডেকে তোমার সঙ্গে ভাব করিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

বসন্ত রাও দু’ হাত তুলে বলল, রক্ষে করো। তোমরা জোর করলে আমি এই স্বর্গ রাজ্য ছেড়ে পালাব। না, বন্দনা, ঠাট্টা নয়, এই যে মেয়েটা সব কিছু ছিঁড়ছে, ভাঙছে, এ আর কতদিন সহ্য করা যাবে? একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাবে না? পরশু রাতেও আমার বাড়িতে হানা দিয়েছিল।

বন্দনাদি বলল, ব্যবস্থা হচ্ছে। শিগগিরই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা কোরো না। তোমার বাড়িতে আর ও আসবে না।

বন্দনাদি এরপর চা বানাতে চলে গেল।

আমি বসন্ত রাওয়ের অন্য কয়েকটি ছবি দেখতে লাগলুম। এই শিল্পী মানুষ আঁকে না, শুধু প্রকৃতি আঁকে। যদিও ওর অ্যানাটমি জ্ঞান, ফিগার ড্রয়িং-এর হাত খুব পাকা। একদিন খেলাচ্ছলে, মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কয়েকটা টানে আমার মুখের স্কেচ করে দিয়েছিল। বসন্ত রাওয়ের সাম্প্রতিক ছবিতে ক্রমশ কালো ও খয়েরি রং বাড়ছে, মানুষটা মানসিক অশান্তিতে আছে বোঝা যায়।

বন্দনাদি কেটলি ভর্তি চা নিয়ে এসে বলল, বসন্ত রাও, তোমার দেখছি একটি কাপও অবশিষ্ট নেই।

বসন্ত রাও বলল, না, সব ভেঙে দিয়েছে। খাবারের প্লেট ভেঙে দিয়েছে, এই কেটলিটা পারেনি, আর…

একটা চেয়ারের পেছন থেকে সন্তর্পণে দু’টি স্টিলের গেলাস বার করে বলল, এ দুটো ভাঙতে পারেনি। এই দুটো গেলাসে ম্যানেজ করতে হবে।

বন্দনাদি বলল, ঠিক আছে, জয়দীপ আর নীলুকে আগে দিচ্ছি। ওদের হয়ে গেলে আমরা ধুয়ে নেব।

জয়দীপ বলল, আমাকে আগে কেন?

আমি বললুম, আমারও পরে হলে চলবে।

বন্দনাদি বলল, মেয়েরা সব সময় পরেই খায়, আর বসন্ত রাও গৃহস্বামী, অতিথিদের না দিয়ে তার খাওয়াটা ভাল দেখায় না। তোমরা শুরু করো।

জয়দীপ বলল, আমি চাই না। আমি চা খাবই না।

বন্দনাদি বলল, তবে তো ঝামেলা মিটেই গেল। বসন্ত রাও, তুমি একটা গেলাসে নাও, আমি নীলুর গেলাস থেকেই চুমুক দেব।

জয়দীপ চোখ পাকিয়ে বলল, বন্দনা, তুমি কেন আমার সঙ্গে এক গেলাসে, খাবার কথা বললে না?

বন্দনাদি মুচকি হেসে বলল, বোঝাই তো যাচ্ছে, আমি নীলুকে বেশি ভালবাসি।

এই সময় বাইরে একটা গুনগুন গান শোনা গেল : এবার কালী তোমায় খাবো, খাবো গো দীন দয়াময়ী, গণ্ডযোগে জন্ম আমার, এবার কালী তোমায় খাবো…

সাদা দাড়ি, সাদা চুল নিয়ে ঢুকলেন অচিন্তনীয়। গান থামিয়ে সহাস্য মুখে সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাঃ বেশ ছোটখাটো একটা আড্ডা জমেছে দেখছি। চা খাচ্ছ, আমায় একটু দেবে না?

বসন্ত রাও বলল, আর গেলাস নেই ভাই, আমারটা হয়ে যাক, তোমাকে ধুয়ে দিচ্ছি।

অচিন্তনীয় বললেন, সব কাপ টাপ সেই বেটী ভেঙে দিয়ে গেছে বুঝি? বেশ হয়েছে! আমার তো কিছু ভাঙেনি। আমার বাড়িতে সে ভয়ে যায় না। আমাকে খুব ভয় পায়।

বন্দনাদি জিজ্ঞেস করল, কেন, আপনাকে ভয় পায় কেন?

অচিন্তনীয় বললেন, একদিন বলেছিলুম, এই কালা কাপড়াওয়ালী, আমি ম্যাজিক জানি, তোকে একটা খরগোশ বানিয়ে দেব, তোর কাপড় সাদা হয়ে যাবে! এখানে যারা আছে, তারা বেশিরভাগই তো ভেতরে ভেতরে একটা শিশু! এই জয়দীপকুমারটি যেমন আর একটি শিশু।

জয়দীপ বলল, আমি তোমার ম্যাজিক ট্যাজিক বিশ্বাস করি না।

অচিন্তনীয় বললেন, এক্ষুনি একটা ম্যাজিক দেখবে? গেলাস লাগবে না, বন্দনা, কেটলিটা দাও তো, ওর থেকেই একটু চা খেয়ে নিই।

বন্দনাদি বলল, দারুণ গরম চা। খাবেন কী করে?

হাতটা বাড়িয়ে অচিন্তনীয় বললেন, দাও না!

কেটলিটা তুলে নিয়ে তিনি উঁচু করে গলায় চা ঢালতে লাগলেন। ধোঁয়া ওঠা গরম চা। দিব্যি খেয়ে গেলেন। আমরা তাজ্জব।

বন্দনাদি বলল, সত্যি, আপনি পারেন বটে। আচ্ছা অচিন্ত্যদা, আপনি ম্যাজিক দিয়ে রোহিলাকে আগের মতন ভাল করে দিতে পারেন না? আবার হাসবে, সকলের সঙ্গে মিশবে।

অচিন্তনীয় বললেন, ম্যাজিক ট্যাজিক নয়, ওর কী দরকার জানো, মার, বেশ ভাল রকম মার। ও এত জিনিস টিনিস ভাঙছে কেন। ও নিজেই চাইছে কেউ ওকে একদিন এই জন্য মারুক। একজন কেউ মারবে, আর সবাই ছুটে গিয়ে আহা উহু করে বলবে, রোহিলাকে মেরো না, রোহিলা বড় ভাল মেয়ে, তাই শুনে ওর আত্মারাম সন্তুষ্ট হবে।

জয়দীপ বলল, খবর্দার, মেয়েদের গায়ে কেউ হাত দেবে না।

বন্দনাদি বলল, রোহিলাকে কে মারবে? ও যতই অবাধ্যপনা করুক, তবু এখানে ওকে কেউ মারবে না।

অচিন্তনীয় বললেন, আমার ওপর ভার দাও! আমি বেটিকে উপুড় করে শুইয়ে পাছায় বেশ করে ছপটি পেটাব, হাউ হাউ করে কাঁদবে, তারপর ধাতস্থ হয়ে যাবে। ছোট ছেলেমেয়েদের মাঝে মাঝে এ রকম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হয়। স্পেয়ার দা রড অ্যান্ড স্পয়েল দা চাইল্ড, জানো না?

বন্দনাদি বলল, না, না, ও সব আমি বিশ্বাস করি না। মারধর আবার কী! তাতে হিতে বিপরীত হয়। এখন মা বাবারা ছেলেমেয়েদের শাস্তি দিতে গেলে তারা ফট করে আত্মহত্যা করে বসে।

অচিন্তনীয় বললেন, তাহলে তোমরা বোঝো! আমি তো আমার বাপের হাতে অনেক মার খেয়েছি!

আরও এক ঢোঁক চা খেয়ে তিনি আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, কী হে নীললোহিত, তুমি কথা বলছ না কেন? তোমার মাথায় ওটা কী?

আমি চট করে চুলে হাত দিয়ে বললুম, কই, কিছু নেই তো!

অচিন্তনীয় মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, হুঁ, আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি। বেশ বড় একটা বোঝা। একটা দায়িত্বের বোঝা তোমার মাথায় কেউ চাপিয়ে দিয়েছে।

আমি এবারে স্তম্ভিত। লোকটি কি সত্যিই থট রিডিং জানে নাকি? বন্দনাদি আর আমার মধ্যে যা কথা হয়েছে, তা আর কারুর জানার কথা নয়। তবে রোহিলার প্রসঙ্গ যতবার উঠছে, ততবারই আমি ভেতরে ভেতরে একটু কেঁপে উঠছি ঠিকই।

বন্দনাদিও আমার দিকে আড় চোখে তাকাল।

আমি অচিন্তনীয়কে বললুম, সেটা এখানকার বাইরের ব্যাপার। জয়দীপের সামনে বলা চলবে না। ও বাইরের কথা শুনতে চায় না।

জয়দীপ বলল, আমি বাইরের কোনও কথা শুনতে চাই না।

অচিন্তনীয় বললেন, আমার এখনও পিছুটান যায়নি। এখানে খবরের কাগজ নেই, রেডিও নেই, তা বেশ ভালই। তবু বাইরের খবর জানবার জন্য মাঝে মাঝে মনটা আকুলি বিকুলি করে। হ্যাঁ হে, এবারে দেশের প্রধানমন্ত্রী কে হল? ইন্দিরা গান্ধীর সেই মেম পুত্রবধূ, না নাতনীটা?

জয়দীপ বলল, চুপ! বলবে না, আমরা জানতে চাই না।

কথা ঘোরাবার জন্য আমি বললুম, বসন্ত রাও, এখানে ফুলমণি নামে একটি মেয়ে এসেছিল, সে কোথায় থাকে জানো? মধ্যপ্রদেশের একটি আদিবাসী মেয়ে, ছবি আঁকতে পারে।

বসন্ত রাও বলল, হ্যাঁ, এসেছিল বটে, টিকতে পারল না। দু’ মাসের মধ্যেই চলে গেল। আমারও মনে হয়েছিল, ওর চলে যাওয়াই ভাল। ওই ধরনের মেয়েদের জায়গা এটা নয়। এখানকার কালচারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে না।

—কেন চলে যেতে হল? দিকশূন্যপুরে জাত, ধর্ম নিয়ে কোনও বাছবিচার থাকার কথা নয়। শ্রেণী বৈষম্য নেই বলেই জানি। ধনী দরিদ্রের প্রশ্ন নেই। তবে কেন একটি আদিবাসী মেয়ে এখানে টিকতে পারবে না?

—বাছবিচার নেই, শ্রেণী বৈষম্য নেই, সবই ঠিক। তবু কি জানো, এখানে যারা আসে, শেষ পর্যন্ত থেকে যায়, তাদের কোথাও না কোথাও একটা মানসিকতার মিল থাকবেই। দিকশূন্যপুর তো শুধু একটা জায়গার নাম নয়, একটা ফিলোসফি, একটা বিশেষ ওয়ে অব লাইফ, একটা এক্সপেরিমেন্ট। খানিকটা শিক্ষাদীক্ষা, খানিকটা নিজস্ব চিন্তাভাবনা না থাকলে অন্যদের সঙ্গে মিলবে কী করে?

বন্দনাদি বলল, ফুলমণিকে আমিও দেখেছি। সে কারুর সঙ্গে কথাই বলত না।

আমি বললুম, মেয়েটি বড় দুঃখী। জয়দীপের আপত্তি আছে, তাই তার জীবনের গল্পটা বলতে পারব না এখন।

বন্দনাদি বলল, সব সময় হীনম্মন্যতায় ভুগলে তো লোকের সঙ্গে সমানভাবে মেশা যায় না। তাকে আমার বাড়িতে ডেকেছি, চা খাওয়ার পর সে কাপ-প্লেট ধুয়ে দেবেই। আমি হাজার আপত্তি করলেও শুনবে না। আদিবাসী মেয়ে বলেই তাকে দাসীর ভূমিকা নিতে হবে কেন? আমি তাকে দাসী মনে করি না, সমান সমান ভাবে মিশতে চাই, কিন্তু সে নিজেকে কিছুতেই সমান ভাবতে পারে না।

বসন্ত রাও বলল, ওকে খানিকটা লেখাপড়া শেখানো দরকার ছিল। কিন্তু আমরা তো সে ধাতের সমাজ-কর্মী নই। আমরা সমাজ ছাড়া।

অচিন্তনীয় নিজে কথা বলতে ভালবাসেন, এ আলোচনায় প্রবেশ করতে পারছেন না বলে তিনি প্রশ্ন করলেন, রাও, তোমার এখানে আজ বৃষ্টি হয়েছে?

বসন্ত রাও বলল, না তো। অন্য কোথাও দু’-এক পশলা হয়েছে শুনেছি। অচিন্তনীয় বললেন, আই ব্রিং ফ্রেশ শাওয়ার, ফর দা থাস্টিং ফ্লাওয়ার্স…বাইরে গিয়ে দেখো গে, আমি বৃষ্টি এনেছি। বেশ বৃষ্টি পড়ছে।

সত্যি বৃষ্টি, ক্রমশ জোর বৃষ্টি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে থামার আর লক্ষণই দেখা গেল না। এ বাড়ি থেকে বন্দনাদির টিলাটা বেশ দূর। এতটা পথ বৃষ্টি ভিজে যাওয়া যাবে না। সামান্য কিছু খেয়ে আমরা রাত সেখানেই কাটিয়ে দিলুম। প্রায় সারা রাত জেগেই গল্প হল।

নিজস্ব দল মিলে থাকলে রাত জাগায় সত্যিই কোনও কষ্ট নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *