ঘটনার ঘনঘটা – ৬

দুপুরবেলা ঠিক খাওয়ার সময় জয়দেব এসে হাজির। আমার খাওয়া তখন মধ্যপথে, জয়দেব সরাসরি চলে এলো খাওয়ার ঘরে, আমার মাকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে ফেলে বলল, কেমন আছেন, মাসিমা!

সেই দশাসই জোয়ানকে দেখে মা একেবারে হকচকিয়ে গেলেন। কলেজে পড়ার সময় জয়দেব দু’একবার মাত্র এসেছে আমাদের বাড়িতে, কিন্তু সেই জয়দেব আর এই জয়দেব তো এক নয়!

আজ জয়দেব একটু অতিরিক্ত সাজগোজ করে এসেছে, হাতঘড়িটা সোনা–সোনা দেখতে, চোখে সানগ্লাস, গায়ে সিল্কের শার্ট। সে ঘরে ঢোকামাত্র তার গা থেকে ভুরভুর করে বেরুতে লাগল বিলিতি পারফিউমের গন্ধ।

মা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি খেয়ে এসেছ? একটু কিছু খেয়ে নেবে?

জয়দেব বলল, আমার লাঞ্চ খাওয়া হয়ে গেছে সেই কখন। নীলু এত দেরি করে খায় কেন?

আমি বললুম, লাঞ্চ খেতে হয় ঠিক ঘড়ি দেখে, সাড়ে বারোটা থেকে দেড়টার মধ্যে। আর আমরা যারা ছুটির দিনে দুপুরের খাওয়া খাই, আড়াইটে তিনটের সময় খেলেও চলে!

—ছুটির দিন? তুই কি কোথাও চাকরি পেয়েছিস নাকি? এই যে সেদিন বললি, কোথাও বাঁধা কাজ–টাজ করিস না?

মায়ের সামনে এই রকম প্রশ্ন কেউ করে? মাথা–মোটা জয়দেবটার কোনোদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না!

আমি গম্ভীর ভাবে বললুম, যেদিন আমি বাড়িতে থাকি, সেটাই আমার ছুটির দিন।

আমার খাদ্যদ্রব্যের ওপর চোখ বুলিয়ে জয়দেব জিজ্ঞেস করল, এটা কি–চিংড়ি? প্লেটে করে একটু দিন তো মাসিমা, অনেকদিন খাইনি।

বাটিতে যতটা ছিল সবটাই একটা প্লেটে ঢেলে, সঙ্গে একটা চামচ দিয়ে মা তুলে দিলেন জয়দেবের হাতে। বাড়ির অন্য কারুর আর খাওয়া হবে না।

জয়দেব চোখের নিমেষে সবটা শেষ করে ফেলে বলল, অপূর্ব! অপূর্ব! এত ভালো স্বাদ, মাসিমা আপনার হাতের রান্না নিশ্চয়ই। জানেন তো, কাজের চাপে প্রত্যেকদিনই হোটেল–রেস্টুরেন্টে খেতে হয়, বাড়িতে খাওয়ার চান্সই পাই না। এই তো কালই গ্রান্ডে ডিনার খেতে হলো এক পার্টির সঙ্গে, ওরা পারবে এমন লাউচিংড়ি রাঁধতে?

মা একই সঙ্গে লজ্জিত ও বিগলিত হয়ে বললেন, শুধু একটুখানি তরকারি খেলে, আর একদিন এসো, ভালো করে খাওয়াব।

–আপনি তবু এই কথা বললেন, মাসিমা। গত শনিবার অজয়ের বাড়ি গিয়েছিলুম, অজয়ও আমাদের সঙ্গে পড়ত, নীলুর পাশেই বসত, এখন সরকারি অফিসার হয়েছে, এর মধ্যেই একটা গাড়ি কিনেছে। কিন্তু কী চালিয়াত! ওর সঙ্গে দু’ঘণ্টা ধরে কথা হলো, আমার জেনুইন খিদে পেয়েছিল, শুধু এক কাপ চা আর দু’খানা বিস্কুট ঠেকাল, আর কিছু না!

আমার গলায় ভাত আটকে যাবার মতন অবস্থা। মায়ের সামনে কী সব উদাহরণ তুলে ধরছে এই জয়দেবটা। আমারই সহপাঠীদের মধ্যে কেউ এরই মধ্যে গাড়ি কিনেছে, কেউ গ্র্যান্ড হোটেলে ডিনার খায়…। এরপর মা আমার নাম করে যে কতবার দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন তার ঠিক নেই।

এরকম ছেলেকে আর বেশিক্ষণ মায়ের সামনে বসিয়ে রাখা ঠিক নয়, আরো কত কী বলবে তার ঠিক নেই। তাড়াতাড়ি আঁচিয়ে এসে বললুম, চল জয়দেব, বেরুবি নাকি? আমাকে একটু কাজে যেতে হবে।

—কোথায় যাবি?

একবার যখন রেডিও স্টেশনের নামটা ব্যবহার করতে শুরু করেছি, তখন সারা মাস ধরে ওটাই চালাব। এরপর খুঁজে পেতে রেডিওতে একটা চেনা লোক বার করতেই হবে।

—রেডিওতে একটা প্রোগ্রামের ব্যাপার আছে!

–চল, আমিও যাব তোর সঙ্গে। আমি তোকে পৌঁছে দেব।

বাড়ি থেকে বেরুবার পর জয়দেব আমাকে একটা সিগারেট দিল। মৌজ করে দু’টান দেবার পর সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, রেডিও স্টেশনে তোকে ক’টার মধ্যে যেতে হবে? খুব তাড়াতাড়ি আছে?

—না। চারটে–পাঁচটার মধ্যে গেলেই হবে। ইন ফ্যাকট, রেকডিং আজ হবে না। একটু অন্য কথাবার্তা বলার আছে, কাল গেলেও চলে।

–তবে তো ঠিকই আছে। আজই তোকে আমি পাঁচটার মধ্যে পৌঁছে দিতে পারব।

—তুই পৌঁছে দিতে যাবি কেন, আমি নিজে যেতে পারি না?

—তার আগে দু’এক ঘণ্টা আমার সঙ্গে থাকবি, নীলু। একটু দরকার আছে রে?

—আজ তুই তোর সব সাইট দেখতে যাসনি?

জয়দেব কয়েক মুহূর্ত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রীতিমতন দুঃখ–দুঃখ গলায় বলল, অজয় আমার মনে একটা দাগা দিয়েছে!

আমার ধারণা ছিল, মেয়েরাই শুধু ছেলেদের মনে দাগা দেয়। জয়দেবের সবই উল্টো? অজয় ওর মনের মতন কোনো মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে? এর মধ্যে যেন একটা গল্পের গন্ধ পাচ্ছি!

—কী ব্যাপার, খুলে বল তো জয়দেব!

জয়দেব প্রথমে একটা লম্বা ভূমিকা করল। কলেজের বন্ধুদের অনেকেরই খোঁজখবর রাখি না আমি, কিন্তু জয়দেব অনেকের ঠিকানা খুঁজে বার করে দেখা করতে যায়। বিশেষত যারা জীবনে উন্নতি করেছে,’ কিংবা কোনো ব্যাবসা–প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত, কিংবা ঘুষের চাকরি করে। জয়দেব তাদের কাছে গিয়ে তার বাড়ি বানাবার কন্ট্রাকটারির গল্প শুরু করে। এতে কেউ কেউ নিজস্ব একখানা বাড়ি বানাবার জন্য প্রলুব্ধ হতে পারে, কেউ কেউ কোম্পানির বাড়ি বানাবার কন্ট্রাক্ট দিতে পারে। এ হচ্ছে জয়দেবের উদ্দেশ্য।

শ্যামল কাজ করে রাইটার্স বিল্ডিংসে, রণেন পুলিশ অফিসার হয়েছে, কড়েয়া থানায় বসে, মলয় দুর্গাপুরের ইঞ্জিনিয়ার, প্রীতম খবরের কাগজের রিপোর্টার, অরুণাংশু অন্য দু’জনের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যাবসা শুরু করেছে ইত্যাদি। এর মধ্যে প্রায় সবাই জয়দেবের বর্তমান চেহারা দেখে প্রথমে চিনতে পারে না। তারপর চিনলে ভালো ব্যবহার করে, দু’জন সত্যি সত্যি বাড়ি তৈরির কন্ট্রাক্টও দিয়েছে, আবার কেউ কেউ ওকে পাত্তাই দেয়নি।

সবচেয়ে দুর্ব্যবহার করেছে অজয়। না, কোনো মেয়েঘটিত ব্যাপার নয়। জয়দেবের কাহিনী একেবারেই স্ত্রী–ভূমিকা বর্জিত।

অজয় ডবলু. বি. সি. এস. অফিসার হয়েছে বলে তার নাকি খুব অহংকার। সে জয়দেবের পেশার কথা শুনে ঠাট্টা–ইয়ার্কি করেছে। নিজে সে একটা গাড়ি কিনেছে কিংবা শ্বশুরের কাছ থেকে পেয়েছে, তাই নিয়ে খুব চাল মারছিল।

এমনকি দু’জনে একসঙ্গে বেরুবার পর জয়দেব জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কোথায় যাবি! অজয় বলেছিল, তুই কোন দিকে? জয়দেবের যাবার কথা দেশপ্রিয় পার্ক, আর অজয় যাবে বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে। এমনই চশমখোর অজয় যে সে তার কলেজের বন্ধুকে নিজের গাড়িতে দেশপ্রিয় পার্কে পৌঁছে দেবার প্রস্তাব জানাল না। আচ্ছা চলি, বলে জয়দেবের নাকের ওপর ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেল?

জয়দেব চোয়াল কঠিন করে বলল, আমি অজয়ের ওপর প্রতিশোধ নেব! আমি জিজ্ঞেস করলুম, তুই মারিব নাকি অজয়কে? তার জন্য তুই আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিস? তুই একলাই তো পাঁচজনকে মারার পক্ষে যথেষ্ট! জয়দেব বলল, আমি সহজে কারুর গায়ে হাত তুলি না। কলেজ–ফ্রেন্ডদের তো মারার প্রশ্নই ওঠে না। আমি আজই একটা গাড়ি কিনব। সেই গাড়ি নিয়ে অজয়ের নাকের ওপর ধোঁয়া ছেড়ে আসব!

—গাড়ি কিনবি? আজই?

—হ্যাঁ, এতদিন ইচ্ছে করলে কি আমি গাড়ি কিনতে পারতুম না? আমার কাজ বেশির ভাগ মফস্বল শহরে, তাই ট্রেনে ট্রেনেই ঘুরে বেড়াই, গাড়ির দরকার হয় না। এবারে গাড়ি কিনে গ্যারাজে ফেলে রাখব তা সই, তবু গাড়ি কিনতেই হবে! তুই চল আমার সঙ্গে!

— গাড়ি কেনায় আমি কি সাহায্য করব রে, জয়দেব?

–তুই শুধু আমার সঙ্গে থাকবি। শোন, আমি সেদিন দেখেছি, অজয়ের

গাড়িটা নতুন নয়, ডব্লু এম এ নাম্বার, সেকেন্ড হ্যান্ড নির্ঘাৎ। থার্ড হ্যান্ড বা ফোর্থ হ্যান্ড হতে পারে। আমিও একটা সস্তার গাড়ি কিনব। গাড়ি একটা হলেই তো হলো! আমি খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের কাটিং নিয়ে এসেছি, সেই চার–পাঁচখানা গাড়ি দেখতে যাব। আমি গাড়ি সম্পর্কে কিছু কিছু বুঝি, অনেক ট্যাক্সি চেপেছি তো! তোর নিশ্চয়ই গাড়ি সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই নেই?

আমি সবেগে দু’দিকে মাথা নেড়ে বললুম, না! আমি ট্যাক্সি চাপার চান্সই পাই না।

–তুই তবু বিজ্ঞের ভান করবি। একজনের বদলে দু’জন থাকলে কেসটা জোরাল হয়। তাতে দাম কমাবার সুবিধে।

—একটা গাড়ির কত দাম হয় রে?

—তা নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না!

প্রথমে আমরা গেলাম হরিশ মুখার্জি রোডের একটা গ্যারাজে। সেখানে তিনখানা পুরোনো গাড়ি আছে বিক্রির জন্য। আমার তো মনে হলো তিনখানাই বেশ চমৎকার। বেশ চকচকে রং। তার মধ্যে সাদা রঙের গাড়িটা নিশ্চয়ই সবচেয়ে ভালো। আমি লক্ষ করেছি, বেশি বড়লোকেরা সাদা গাড়ি চড়ে।

মুখ খুলতে যাচ্ছিলাম, মনে পড়ে গেল, জয়দেব আমাকে বিজ্ঞ সেজে থাকতে বলেছে।

গ্যারাজের মালিকটির মুখে রুখু দাড়ি। গায়ে খাঁকি জামা, কিন্তু বেশ একটা ব্যক্তিত্বের ভাব আছে।

ভুরু নাচিয়ে সে জয়দেবকে জিজ্ঞেস করল, কত রেইঞ্জের মধ্যে চাইছেন? জয়দীপ বলল, ভালো গাড়ি দেখান, টাকার কোশ্চেন তো পরে! লোকটি একটা কচি–কলাপাতা রঙের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে বলল, এটা নিয়ে যান, এ–গাড়ির মাইলেজ ভালো পাবেন। ইঞ্জিন কন্ডিশন ফাইন।

জয়দেব অবহেলার সঙ্গে সেই গাড়ির বনেটে একটা চাপড় মেরে বলল, এ তো অ্যাকসিডেন্টের গাড়ি, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কবার অ্যাকসিডেণ্ট করেছে? খাকি জামা একটু থতমত খেয়ে বলল, হ্যাঁ, মানে অ্যাকসিডেন্ট করেছে একবার, ঐ একবারই, তবে ইঞ্জিন ড্যামেজ হয়নি!

–ক’জন মারা গেল?

—কী বলছেন মশাই, কেউ মারা যায়নি। তবে ড্রাইভারের একটু চোট লেগেছিল!

—এ রকম অপয়া গাড়ি আমি নিতে চাই না।

—দাম কিন্তু সস্তার ওপরে আছে।

—কত?

আমি একটা নতুন জিনিস শিখলাম। সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনতে হলে প্রথমেই বনেটে চাপড় মেরে বলতে হয়, এটা অ্যাকসিডেন্টের গাড়ি!

গাড়িটা দেখে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না, তবু জয়দেব কী করে বলল? আর লোকটাও মেনে নিল সঙ্গে সঙ্গে?

দু’খানা গাড়ি নিয়ে কিছুক্ষণ দরাদরি করার পর জয়দেব বলল, নাঃ, পোষাচ্ছে না। আমরা আরো অন্য দু’একটা দেখে আসি, দরকার হলে আপনার কাছে ফিরে আসব।

বাইরে বেরিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলুম, তুই সাদা গাড়িটাকে একেবারে পাত্তাই দিলি না কেন রে? দামও জিজ্ঞেস করলি না?

—ওটার নম্বার প্লেট লক্ষ করিসনি? মডেলটা বেশি পুরোনো নয়, দাম হাঁকত অনেক!

গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখে যে তার মডেল বোঝা যায়, তাই–ই বা আমি জানব কী করে? শুধু অ্যাম্বাসেডর গাড়িরই তো কত রকম নাম্বার দেখি, তারও আবার বিভিন্ন রকম মডেল হয় নাকি?

এরপর যাওয়া হলো, প্রতাপাদিত্য রোডের একটা গ্যারাজে। এখানে বিক্রির গাড়ি আছে একখানাই

জয়দেব প্রথমেই নাম্বার প্লেট দেখল। তারপর সে মুখ খোলার আগেই আমি বনেটের গায়ে চাপড় মেরেই উঃ বলে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলুম। চাপড়টা বেশ জোরেই হয়ে গেছে, আমার হাত জ্বালা করছে। কী রকম ভাবে চাপড় মারতে হয়, সেটাও দেখা দরকার।

যাই হোক, অতি কষ্টে উঃ দমন করে বললুম, এটা তো অ্যাকসিডেন্টের গাড়ি, দেখেই বোঝা যাচ্ছে!

এই গ্যারাজের মালিকের চেহারা নিরীহ, চোখে চশমা, সেই চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে একখানা শেল দৃষ্টি হেনে সে বলল, কলকাতা শহরে এমন একখানাও গাড়ি বার করুন তো, যেটা কোনো–না–কোনো অ্যাকসিডেন্ট করেনি? সে রকম একখানা বার করতে পারবেন?

বাবাঃ, এ যে গৌতম বুদ্ধের মতন প্রশ্ন। এমন একখানা বাড়ি থেকে এক দানা শর্ষে এনে দিতে হবে, যে বাড়িতে কখনো কোনো শোকের কারণ ঘটেনি। কলকাতার বাড়ির মতন গাড়িরও সেই অবস্থা!

জয়দেব বলল, এ গাড়ির কন্ডিশনটা এমনিতে ভালোই মনে হচ্ছে। কী রকম তেল খায়?

লোকটি পাল্টা প্রশ্ন করল, কী করে বুঝলেন কন্ডিশন ভালো? বাইরেটা দেখে গাড়ির কিছু বোঝা যায়? এই জন্যই তো অধিকাংশ লোক ঠকে।

এ লোকটি সত্যি অন্য টাইপের। এর কাছে মুখ খুলে লাভ নেই। আমি জয়দেবের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালুম। আমার কেন যেন ধারণা হলো, এই লোকটা আমাকে অপমান করার জন্য বদ্ধপরিকর। যা যায় জয়দেবের ওপর দিয়ে যাক! লোকটি চিবোনো গলায় জয়দেবকে প্রশ্ন করল, আপনি সত্যি সত্যি গাড়ি কিনবেন?

জয়দেব ধমকের সুরে উত্তর দিল, সত্যি নাকি মিথ্যে মিথ্যে আমরা আপনার কাছে ট্যাক্সি চেপে এসেছি?

–আজই কিনবেন?

— আজই!

—ক্যাশ ডাউন?

—ক্যাশ ডাউন! গাড়ি পছন্দ হলে এখান থেকেই ডেলিভারি নিয়ে যাব। লোকটি বলল, শুনুন তা হলে। এমনি এমনি দেখে গাড়ি চেনা যায় না। গাড়ি চালিয়ে দেখতে হয়। রানিং গাড়ির সাউন্ড শুনতে হয়, পিক আপ দেখতে হয়। ক্লাচ, গীয়ার, অ্যাকসিলারেটর…গাড়ি কি দর্শনধারী জিনিস, গাড়ি হচ্ছে চালাবার জিনিস!

জয়দেব গম্ভীরভাবে বলল, তা হলে চালিয়ে দ্যাখান একটু?

—এই গ্যারাজের মধ্যে কী বুঝবেন? গাড়িতে পাঁচ লিটার তেল ঢালুন। তারপর কলকাতার রাস্তায় এক–দেড় ঘণ্টা ঘুরে আসুন। তারপর অন্য কথা হবে।

–দর কত পড়বে, সেটা আগে বলবেন না?

—আমি অনেয্য দাম নিই না। গাড়ির কিছু দোষ থাকলে নিজে বলে দেব, যেমন আগেই বলে রাখছি, দু’খানা চাকা আপনাকে নতুন কিনতে হবে। যান ঘুরে আসুন।

—কে চালাবে? আমি অবশ্য চালাতে জানি, কিন্তু, মানে—

—আমার একজন ড্রাইভার সঙ্গে দিচ্ছি। কিন্তু আপনাকে দু’হাজার টাকা জমা রাখতে হবে। আমি রসিদ দিচ্ছি, গাড়ি ফেরত আসার পর, আপনি এ–গাড়ি কিনুন বা না কিনুন, দরে পোষাক বা না পোষাক, ও–টাকা আপনি ফেরত পাবেন, এক পয়সা কাটব না!

এই চশমাধারীর ব্যক্তিত্বের কাছে জয়দেবও হার মেনে গেল। মুখে আর কোনো কথা জোগাল না। আমারও মনে হলো, লোকটি মন্দ বলেনি, আগে কিছুক্ষণ গাড়ি চড়ে ঘুরে তো আসা যাক! এমনকি….

দু’ হাজার টাকা জমা রেখে, রসিদ নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল। ড্রাইভারটি একটি রোগা–পাতলা আঠেরো–উনিশ বছরের ছেলে, গায়ে শুধু একটা ময়লা গেঞ্জি। মনে হয় সে ড্রাইভার নয়, মেকানিক।

খানিক দূর যাবার পরই স্টিয়ারিং–এর তলায় ডান্ডাটায় একটা মড়মড় শব্দ হলো।

জয়দেব বলল, ওকি ওকি?

ছেলেটি বলল, গীয়ারে একটু সাউন্ড আছে, স্যার। কিছু কাজ করাতে হবে, সে খরচটা আপনি দাম থেকে বাদ দেবেন।

–কত খরচা পড়বে গীয়ারের কাজ করাতে?

–বড় জোর শ’ দুয়েক।

—আর কিসে কিসে গণ্ডগোল আছে বলো তো ভাই। তোমাকে আমি একশো টাকা দেবো।

—আর সে রকম কিছু গণ্ডগোল নেই স্যার।

—গাড়িটা এত দুলছে কেন?

—স্প্রিং একটু অ্যাডজাস্ট করতে হবে, স্যার।

আর শক অ্যাবজরভার বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমারও কিছু জিজ্ঞেস করা উচিত। তাই আমি ভারিক্কি ভাবে বললুম, এ গাড়ির পেছন দিয়ে ধোঁয়া বেরোয় তো?

ছেলেটি অবাক ভাবে মুখ ঘুরিয়ে বলল, না স্যার! ধোঁয়া বেরুবে কেন? মোবিল খায় না। ইঞ্জিন কন্ডিশন বেশ ভালো আছে।

আমি একটু হতাশ ভাবে তাকালুম জয়দেবের দিকে। গাড়ি থেকে যদি ধোঁয়াই না বেরোয়, তা হলে অজয়ের নাকের ওপর ধোঁয়া ছাড়া হবে কী করে?

জয়দেব ফিসফিস করে বলল, ইচ্ছে করলে ইঞ্জিন ভালো থাকলেও ধোঁয়া ছাড়া যায়!

গাড়ি ছুটছে ময়দানের দিকে। একটু বেশি লাফাচ্ছে এই যা, আর তেমন দোষ পাওয়া যাচ্ছে না। কলকাতার রাস্তায় সব গাড়িই লাফিয়ে লাফিয়ে চলে।

আমি জয়দেবকে জিজ্ঞেস করলুম, অজয় আজকাল কোন পাড়ায় থাকে রে?

জয়দেব ঠিক আমার মনে কথা বুঝেছে। আজ শনিবার, অজয়ের এখন বাড়ি থাকার সম্ভাবনা আছে। অজয়ের নাকের ওপর ধোঁয়া ছাড়াই যদি উদ্দেশ্য হয়, তা হলে আর গাড়িটা কেনার দরকার কী? আজই তো সেই কাজ সেরে ফেলা যায়। আমি অজয়কে ডেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে গাড়িটার পেছনে এনে দাঁড় করাবো, জয়দেব ধোঁয়া ছেড়ে দেবে।

জয়দেব আমার দিকে চোখ টিপে বলল, আমিও ঠিক এইকথাই ভাবছিলুম, তোতে আমাতে খুব মনের মিল রে, নীলু!

ড্রাইভারের কাঁধে টোকা মেরে সে বলল, এই যে ভাই, একটু বেকবাগানের দিকে চলো তো!

ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, স্যার, ময়দানের মধ্যেই তো ভালো টেস্টিং হবে।

–না, আমি ভিড়ের রাস্তায় চালিয়ে দেখতে চাই। চলো বেকবাগান

ময়দান ছেড়ে গাড়িটা থিয়েটার রোডে ঢুকল। তারপর আর বেশি দূর এগোতে পারল না। ধক্ ধক্ ধক্ ধক্ করতে লাগল, তারপর খ–র–র–র খ–র–র–র, তারপর একেবার চুপ।

জয়দেব জিজ্ঞেস করল, এটা কী ব্যাপার হলো?

ছেলেটি বলল, মনে হচ্ছে, কারবুরেটারে ময়লা এসে গেছে, এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে!

জিজ্ঞেস করলুম, কারবুরেটার জিনিসটা কোথায় থাকে।

সে হাত দিয়ে বনেটটা দেখিয়ে দিল।

আমি বললুম, ও জায়গাটা তো দিব্যি ঢাকা রয়েছে, ওখানে ধুলো–ময়লা আসবে কী করে?

ছেলেটি নেমে গিয়ে বনেটটা খুলল। কী সব নাড়াচাড়া করতে লাগল। ফিরে এসে আবার স্টার্ট দেবার চেষ্টা করল, গাড়ি আর কোনো শব্দই করল না।

ছেলেটি জয়দেবের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বলল, কেন এ রাস্তায় ঢুকতে বললেন? এ–গাড়ি ময়দানেই ভালো চলে।

জয়দেব আঁতকে উঠে বলল, তার মানে? গাড়ি কিনে আমি কি সারাজীবন ময়দানেই ঘুরব নাকি! বাড়ি যেতে পারব না!

–তেল ওভার ফ্লো করছে স্যার! একটু ঠেললে ঠিক হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। দু’হাত ঠেলে দিন না!

ছেলেটি ঠেলবে না। তাকে স্টিয়ারিং হুইলে বসে স্টার্ট নেবার চেষ্টা করতে হবে। ঠেলতে হবে জয়দেবকে আর আমাকে।

অগত্যা নেমে হাত লাগাতে হলো। এ–গাড়িখানা যেন অতিরিক্ত ভারী। পাঁচ মিনিটেই গলদ্ঘর্ম অবস্থা। জয়দেবের গায়ে অনেক জোর, তা ছাড়া, এ–গাড়ির জন্য সে এর মধ্যেই দু’হাজার টাকা জমা দিয়ে এসেছে, তার উদ্যম বেশি হতেই পারে, কিন্তু আমি অতটা পারব কেন?

জয়দেব বলল, তোকে খামোকা খাটাচ্ছি, নীলু! ঠিক আছে, রাত্তিরে তোকে জিমিস কিচেনে খাওয়াব।

তারপর সে হেঁকে বলল, কই হে! আর কত ঠেলতে হবে?

–আর একটুখানি, স্যার!

ক্যামাক স্ট্রিটের মোড় পার হয়ে গেলুম, তবু গাড়ির পুনর্জীবনের লক্ষণ নেই।

জয়দেব বলল, আমার প্রেস্টিজ কী রকম পাংকচার করে দিল, বল তো নীলু! হয়তো আমার কত ক্লায়েন্ট আমাকে গাড়ি ঠেলতে দেখে ফেলছে।

আমি বললুম, হয়তো তারা ভাববে, গাড়িটা আমার, তোকে আমি ঠেলার জন্য ভাড়া করেছি!

-তার মানে! কী করে লোকে তোকে গাড়ির মালিক ভাববে?

–আমার কপালে ঘাম জমে গেছে। তুই একটুও হাঁপাসনি। গাড়ির মালিকদের কি এতখানি গাড়ি ঠেলার অভ্যেস থাকে?

জয়দেব রেগে গিয়ে বলল, এটা একটা পচা, লঝঝড়ে গাড়ি। এটার ইঞ্জিন বলতে কিছুই নেই। এ–গাড়ি কেনার চেয়ে গলায় কলসি বেঁধে ডুবে মরা অনেক ভালো।

– আমার ধারণা কি জানিস, এ–গাড়িটার দাম দু’হাজারের থেকেও কম। কিংবা কারুকে বিনা পয়সায় দিতে চাইলেও এ–গাড়ি নেবে না। তোর ঐ টাকাটাই গেল!

—আমার টাকা যাবে! ঐ চশমা–পরা বুড়োটা তা হলে এখনো জয়দেব সাহাকে চেনেনি। গলায় গামছা দিয়ে টাকা আদায় করব!

-তা হলে আর ঠেলে লাভ কী?

জয়দেব ঠেলা থামিয়ে ড্রাইভারের কাছে গিয়ে বলল, তুমি কী ভেবেছ, বলো তো হে? এ–গাড়ি আর স্টার্ট নেবে কোনো দিন?

—বোধহয় তেল ফুরিয়ে গেছে।

—এই বললে তেল ওভার ফ্লো করছে, এখন বলছ তেল ফুরিয়ে গেছে?

—কী করব স্যার, আপনি কেন এই রাস্তায় ঢুকতে বললেন!

—চোপ! কেন, এ–রাস্তায় আর অন্য গাড়ি চলছে না?

-বললুম তো, এ–গাড়ি ময়দানে ভালো চলে। আর পাঁচ মিনিট ঠেলুন, তাতে গাড়ি গরম হয়ে যাবে।

—ঠিক পাঁচ মিনিট!

কলামন্দিরও ছাড়িয়ে প্রায় সার্কুলার রোডের মুখটায় এসে আমি বললুম, ওরে জয়দেব এবারে আমি অজ্ঞান হয়ে যাব!

—ঠিক বলেছিস! পাঁচ মিনিটের জায়গায় পনেরো মিনিট হয়ে গেছে। আমি একটা অন্যকথা ভাবছিলুম!

– অন্য কথা ভাবতে ভাবতে তোর গাড়ি ঠেলতে কষ্ট হয় না, কিন্তু আমার যে বুকে হাঁপ ধরে গেল!

–এবারে লোক ডেকে ঠেলাতে হবে।

–তা হলে আর এদিকে গিয়ে কী লাভ? তুই এই অবস্থায় গাড়িটা অজয়ের বাড়ির সামনে নিয়ে যেতে চাস?

— মাথা খারাপ! এ–গাড়ি গ্যারাজে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আগে আমার দু’হাজার টাকা আদায় করতে হবে।

—দেবে টাকাটা?

—দেবে না মানে? ওর বাপ দেবে! চোদ্দ পুরুষ দেবে! জয়দেব সাহার টাকা মারতে পারে এমন কোনো বাপের ব্যাটা নেই!

দুমদাম করে এগিয়ে গিয়ে সে ড্রাইভারের দিকে দরজা খুলে চোখ পাকিয়ে বলল, নাম, তুই এবারে নেমে গাড়ি ঠ্যাল, ব্যাটা শয়তানের সাগরেদ! আমায় এখনও চিনিসনি?

ছেলেটি বিনা আপত্তিতে নেমে। দাঁড়িয়ে বলল, আমি একলা পারব না, স্যার! আরও লোক জোগাড় করতে হবে।

—জোগাড় কর!

জয়দেব নিজে স্টিয়ারিং হুইল ধরে বসল। যে–গাড়ি অন্য লোক ঠেলবে, সে– গাড়ি চালানোয় বোধহয় খুব একটা কৃতিত্ব লাগে না।

আমি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললুম, তা হলে আমি এখন কী করব, জয়দেব? তোর সঙ্গে যাব?

আমাকে গাড়ির মধ্যে বসাবে, না ঠেলাওয়ালাদের দলে ফেলবে, সে বিষয়ে মনঃস্থির করতে না পেরে সে বলল, নাঃ তুই আর গিয়ে কী করবি? তোর অনেক পরিশ্রম গেছে, এবারে বিশ্রাম নে। তুই ট্রামে করে ফিরে যা। তোর কাছে ট্রাম ভাড়া আছে।

-আছে। টাকাটা উদ্ধার করতে পারলি কিনা পরে একদিন খবর দিস!

কলকাতা শহরে গাড়ি–ঠেলার লোকের অভাব হয় না। দেখতে দেখতে গোটা তিনেক নেংটি–নেংটি ছেলে জুটে গেল, তারা হৈ–হৈ করে গাড়িটা ঠেলে নিয়ে চলল, একটু বাদে বাঁক ঘুরে গেল।

আমি দাঁড়িয়ে রইলুম রাস্তার মোড়ে। সন্ধে হয়ে এসেছে। এতখানি পরিশ্রমের ঘামে ভিজে গেছে জামা। চায়ের তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে, কিন্তু এ–পাড়ায় সব দামী–দামী দোকান, পাশাপাশি দু’তিনটে বার, এখানে আমার চা খাওয়ার আশা নেই।

একটু জিরিয়ে নেবার জন্য একটা সিগারেট ধরালুম। এ–পাড়ায় আমার খুব কমই আসা হয়। পেট্রোল পাম্পটার ওপাশে ঐ বড় বাড়িটার নাম হিরনানি ম্যানসান না? খবরের কাগজে ঐ বাড়িটার নাম প্রায়ই দেখি!

একটু পরেই রাস্তার ওপারের একটা গোলমালের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো।

পেট্রোল পাম্পটার কাছে একটা ট্যাক্সি এসে থেমেছে, তার থেকে দু’জন যাত্রী নেমে ড্রাইভারের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। লোক দুটির কণ্ঠস্বর জড়ানো, শনিবারের সন্ধেবেলায় মাতালের কারবার। গাড়ি মধ্যে আরো দু’জন বসে আছে, তাদের একজনের মাথা এলানো, মনে হয় অসুস্থ।

ঝগড়াটা একটু বাদেই থেমে গেল, অন্য লোক দুটিও নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। তাদের একজনকে আর দু’জন দু’ কাঁধ ধরে ধরে নিয়ে চলল।

এটা এমন কিছু একটা দেখার মতন দৃশ্য নয়। আমি মুখটা ফিরিয়ে নিতে গিয়েও মাথার মধ্যে যেন একটা হোঁচট খেলুম। একেবারে আউট হয়ে যাওয়া লোকটা কে? চেনা চেনা লাগছে।

দ্রুত রাস্তা পার হয়ে সেই দঙ্গলটার পাশে এসে পড়তে সময় লাগল না একটুও। বুকটা কেঁপে উঠল। অসুস্থ লোকটি রাজা সরকার! তার সঙ্গীরা প্রত্যেকে প্রচণ্ড মাতাল!

জয়দেবের যদি গাড়ি কেনার হুজুগ না হতো, সেই গাড়ি যদি ময়দান ছেড়ে থিয়েটার রোডে না ঢুকত, এবং এতক্ষণ ধরে আমাদের ঠেলতে না হতো, তা হলে আজ সন্ধেবেলা এই মুহূর্তে এই জায়গাটায় আমার উপস্থিত থাকার কোনো প্রশ্নই ছিল না। তা হলে রাজা সরকারকেও আমি এমন অবস্থায় দেখতে পেতাম না।

ভালো চাকরি যারা করে, তারা টাই পরে অফিস যায়, তারা সাহেব। ধুতি–পাঞ্জাবি পরা অফিসার, কোনো–কোনো সংরক্ষিত প্রাণীর মতন, একেবারে অবলুপ্তির পথে। সাহেব–সাজা অফিসারদের সাহেবী কায়দায় মাঝে–মাঝে মদ খেতেই হয়। দু’একদিন মাতাল হয়ে যাওয়াও দোষের কিছু নয়। শরৎচন্দ্রই তো বলেছেন, যে মদ খায় অথচ কক্ষনো মাতাল হয় না, সে ‘অতি সাঙ্ঘাতিক মানুষ।

কিন্তু বিয়ের মাত্র কয়েকদিন আগে, সন্ধেবেলাতেই এরকম বেসামাল অবস্থা? সঙ্গের লোকগুলো কেউই রাজা সরকারের মতন একেবারে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেনি। হয়তো রাজা সরকারের দোষ নেই, ঐ লোকগুলো জোর করে ওকে বেশি খাইয়ে দিয়েছে। এখন ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রাজাকে?

এই দৃশ্য উপেক্ষা করে আমার পক্ষে চলে যাওয়া অসম্ভব।

আমি ওদের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলুম। যেমন রাস্তা দিয়ে অনেক লোক যাচ্ছে। অন্য তিনজন লোককে আমি কস্মিনকালেও দেখিনি, তবে সাজ–পোশাকে বেশ অর্থবান বলে মনে হয়।

রাজা সম্পূর্ণ চৈতন্য হারায়নি। তার পায়ে জোর নেই বটে কিন্তু মাঝে মাঝে তার সঙ্গীদের সঙ্গে অর্ধস্ফুটভাবে কী যেন বলছে। একবার হেসেও উঠল! সুতরাং এই লোকগুলো রাজাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে না! বদ্ধ মাতালদেরও কয়েকটা ব্যাপারে টনটনে জ্ঞান থাকে।

পেট্রোল পাম্পটা পার হয়ে ওরা এগলো হিরনানি ম্যানস্যানের দিকে। হয়তো লোকগুলোর কেউ একজন থাকে সেখানে। এটা ঠিক, রাজার এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া দরকার। এই অবস্থায় বাড়ি ফেরাও তো অনুচিত। রিটায়ার্ড আই. এ. এস. অফিসার কি ছেলের এই দশা থেকে খুশি হবেন! হাসির বড় মাসির বাড়িও খুব কাছে। বিয়ের আগেই দু’ বাড়িতে যথেষ্ট যাতায়াত আছে, হাসিদের বাড়ির কেউ এখন রাজাদের বাড়িতে বসে থাকতে পারে।

ওরা হিরনানি ম্যানসনের গেট দিয়ে ঢুকে লিফটের কাছ দাঁড়াল।

হঠাৎ আমার মনে পড়ল, বিহারের একজন এম. পি. এই কাছাকাছি একটা বাড়িতে ধরা পড়েছিল না কিছুদিন আগে? তাই নিয়ে খবরের কাগজে কত তোলপাড়! রীতিমতন কেলেংকারি! রাজার পক্ষে এখন এইসব জায়গার সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকাই ভালো নয়?

কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। রাজার বন্ধুরা কেউ আমাকে চেনে না। এই অবস্থায় রাজাও আমাকে চিনতে পারবে কি না খুব সন্দেহ আছে। আমি কিছু বলতে গেলেই বা ওরা পাত্তা দেবে কেন?

লিফট নামতেই ওরা একে একে ঢুকল। তারপর দরজা বন্ধ হবার আগেই আমি বিদ্যুতের মতন ছুটে গেলাম তার মধ্যে। কোনো লিফটম্যান নেই। লিফটের গায়ে নানা রকম নোটিশ সাঁটা। আমি মুখ ফিরিয়ে পড়তে লাগলুম সেগুলো। ওরা নামল থার্ড ফ্লোরে, আমি উঠে গেলুম চারতলায়। সঙ্গে সঙ্গে আবার নেমে এসে দেখি, ওরা ফ্ল্যাট নাম্বার থ্রি–এ’র সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে নিচে নেমে যেতে হলো।

অসম্ভব একটা উত্তেজনা হচ্ছে শরীরে। গোয়েন্দাগিরি করার তো অভ্যেস নেই। এরপর কী করতে হয়?

লেটার বক্স! ফ্ল্যাট নম্বর থ্রি–এ’ তে কে থাকে?

এ–বাড়িতে অসংখ্য লেটার বক্স, দেয়ালে ঝুল কালি মাখা। এত বড় বাড়ির যেন কোনো মা–বাপ নেই। কোনো বাক্সের ওপরটা ভাঙা।

অনেক খুঁজে থ্রি–এ পাওয়া গেল, তার ওপরে কোনো ব্যক্তির নাম লেখা নেই, একটা কোম্পানির নাম লেখা। ফ্রি এন্টারপ্রাইজ! শনিবার সন্ধের পর ফ্রি এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে রাজা সরকারের কী কাজ থাকতে পারে?

কোনো দারোয়ান শ্রেণীর লোক থাকলেও তার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলা যেত। কেউ নেই। এ বাড়ি যেন একটা হাট। লোকজন আসছে–যাচ্ছে, কেউ–কেউ লিফটের দরজাটা এমন জোরে টানছে যেন ওটা ভাঙতে পারলেই তার আনন্দ।

এখন ফিরে যাব? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো একটা সিগারেট শেষ করেও কোনো বুদ্ধি এলো না। এ–পাড়ায় আমার চেনা একজনও নেই যে তার কাছে বুদ্ধি নিতে যাব।

একমাত্র একটা কাজ করা যায়। ফ্রি এন্টারপ্রাইজ ব্যাপারটা কী সেটা অন্তত জেনে নেওয়া যাক। কোম্পানির নাম লিখে রেখেছে যখন, তখন যে–কেউ গিয়ে খোঁজ–খবর নিতে পারে।

আবার লিফটে চেপে আমি তিনতলায় নেমে থ্রি–এ’র সামনে দাঁড়ালুম। ভেতরে জোর কথাবার্তা চলছে। পাঁচ লাখ টাকা…হুইস্কি…কনসাইনমেণ্ট…নাইলন টায়ার…বরফ নেই, বরফ? …এই শেফালী, এদিকে এসো…আমরা গাড়ি দেব… হ্যাঁ… লন্ডনে …আর একটু নাও…

এইসব টুকরো–টুকরো কথা ভেসে আসছে। অন্য একটা ফ্ল্যাটে কে যেন চেঁচিয়ে গান গাইছে…করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছে দু’জন লোক, লিফটের সামনে দাঁড়াল, আমার দিকে একবার দেখল…। এভাবে একটা বন্ধ দরজার সামনে আমার দাঁড়িয়ে থাকা চলে না।

সাহস করে আমি দরজায় দু’বার ঠক–ঠক করলুম।

লোক দুটি লিফটে নেমে গেল। এই ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। শালোয়ার কামিজ পরা একটি যুবতী, বুকের সামনেটা অনেকটা খোলা, চোখদুটো চকচকে, ঠোঁট ভিজে–ভিজে, মাথার চুলে ফুল গোঁজা, হিন্দী সিনেমার নায়িকার মতন…

মেয়েটি আমাকে দেখে খানিকটা অবাক ও বিরক্ত হয়ে বলল, ও, আমি ভাবলুম বরফ এনেছে বুঝি! তোমাকে কে পাঠিয়েছে?

আমি নিরুত্তর।

—কে? কী চাই তোমার?

আমি ভেতরের দৃশ্যটা যেন গিলছি। কার্পেট–পাতা মেঝেতে গোল হয়ে বসেছে সেই লোকগুলো, মাঝখানে বোতল, কলের জল…রাজা বসে আছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে, তার হাতে ভর্তি গেলাস, যে–মেয়েটি দরজা খুলেছে, সে ছাড়াও ঐ রকমই সাজে আরো দুটি মেয়ে বসে আছে সেখানে। এই তা হলে ফ্রি এন্টারপ্রাইজ?

আমি কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না দেখে দরজার মেয়েটি রেগে গিয়ে বলল, এখন এখানে কিছু হবে না, হবে না, যাও!

ঝপাস করে সে দরজা বন্ধ করে দিল আমার মুখের ওপর।

ঐ রকম ভাবে দরজা বন্ধ করে দিয়েই সে বাঁচিয়ে দিল আমাকে। আর কয়েকটা মুহূর্ত দেরি হলেই আমি ধরা পড়ে যেতাম।

বন্ধ দরজার থেকে মুখ ফেরাতেই দেখলুম, লিফট এসে থেমেছে। তার থেকে নেমে আসছে চারজন সশস্ত্র পুলিশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *