১
চলন্ত বাসের দোতলা থেকে কে যেন ডাকল, নীলু! নীলু!
আমি চমকে উঠে প্রথমে বুঝতেই পারিনি ডাকটা কোথা থেকে এলো। অন্তরীক্ষ থেকে? রাস্তার এদিকে–ওদিকে কোনো মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে নেই। এ পাড়ায় আমাকে কারুর চেনবারও কথা নয়। তবে কে ডাকল? দোতলা বাসটা একটু আগেই স্টার্ট নিয়ে বেরিয়ে গেছে, ঐ বাসের জানলায় কারুকে দেখতে পাইনি।
তাহলে কি একটা ডাক শুধু শুধু হাওয়ায় ভেসে চলে যাবে, আমার কোনো উত্তর দেওয়া হবে না?
বর্ষার আকাশ মাথায় নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলুম শেক্সপীয়ার সরণির মোড়ে একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন আকাশ কালো, এই কালো আকাশ অনেকখানি বিকেল খেয়ে ফেলেছে আজ। সামনের ময়দানের গাছগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ফিনফিনে বাতাস। বিড়লা প্ল্যানেটরিয়ামের ঘড়িটা বন্ধ। ভেতরে মহাশূন্যের গ্রহ–নক্ষত্রের খেলা দেখাচ্ছে, বাইরে সময়ের ঠিক নেই।
একটা সিগারেট ধরালুম। দুম করে বৃষ্টি না এসে গেলে এইসব ব্যস্ত রাস্তায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে নানারকম মানুষের চলচ্চিত্র দেখতে ভালোই লাগে। অফিস–ফেরত লোকজনদের ট্রাম–বাস ধরার হুড়োহুড়ি, মেয়েরা হাঁটছে পা টিপে টিপে, কাদা বাঁচাবার জন্য শাড়ি সামান্য উঁচু করে, অবিকল তিতির পাখির মতন….
হঠাৎ পিঠে একটা চাপড় খেয়ে চমকে উঠে দেখি রাহুলদা। পাজামা–পাঞ্জাবি পরা, তাও ধোপ–দুরস্ত নয়, মুখে দেড় দিনের দাড়ি, পায়ে রবারের চটি। চমকে ওঠবারই কথা, রাহুলদা এমনিতে খুব সাহেব মানুষ, বিকেলবেলা চৌরঙ্গি পাড়ায় তাঁকে এই পোশাকে দেখতে পাব, এমন আশাই করা যায় না।
রাহুলদা বললেন, তুই যে চলে যাসনি, এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস, এটা মিরাকল্! সত্যি মিরাকল্! তুই আমার ডাক শুনতে পেয়েছিলি?
ডাক শুনলেও সেটা যে রাহুলদার কণ্ঠস্বর সেটা আমি বুঝতে পারিনি, যে– ডেকেছিল সে যে ফিরে আসবে তেমন আশা করেও আমি এখানে দাঁড়িয়ে নেই। কেন যে এখানে দাঁড়িয়ে আছি তা আমি নিজেই জানি না। হাসি–হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলুম রাহুলদার দিকে।
রাহুলদা বললেন, কতগুলো কয়েনসিডেন্স শোন্। তিন চারদিন ধরে গাড়িটা খারাপ বলে আমি ট্রামে–বাসে ঘুরছি। কলকাতার ট্যাক্সি ড্রাইভাররা অবনক্সাস ব্যবহার করে বলে আমি পারতপক্ষে ট্যাক্সি চাপি না। তার চেয়ে ভিড়ের ট্রাম–বাস অনেক ভালো। গাড়িতে করে যদি যেতুম, তা হলে নিজে গাড়ি চালাতে চালাতে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো তোকে হয়তো লক্ষ্যই করতুম না। অনেকদিন বাদে দোতলা বাসে চাপছি তো, তাই জানলার ধারে বসে চারদিক দেখতে দেখতে যাচ্ছি!
আমি বললুম, এদিকের রাস্তায় কত সব দেখার জিনিস থাকতে তুমি শুধু আমায় দেখতে পেলে?
রাহুলদা এক হাতের আঙুলে অন্য হাতের আঙুল ছুঁইয়ে বললেন, দু’ নম্বর কয়েনসিডেন্স হলো, আজ আমি অফিস যাইনি, অফিসে গেলে বেরুতে বেরুতে আমার অন্তত সাতটা বেজে যায়, এ পথ দিয়ে আমি যাইও না।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, পাজামা–পাঞ্জাবি পরে তুমি নিশ্চয়ই অফিসে যাও না।
রাহুলদা বললেন, তারপর শোন তিন নম্বর…আমি ঠিক যখন এখান দিয়ে পাস করছি, তখন মনটা খুব খচখচ করছিল। ভাবছিলুম, যদি চেনাশুনো কারুর সঙ্গে দেখা হতো, তক্ষুনি জানলা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি যে মূর্তিমান নীলুচন্দর এখানে দাঁড়িয়ে পা দুটো ক্রস করে কেষ্টঠাকুরের মতন—
—মোটেই ওরকম ভাবে আমি দাঁড়াই না।
—তুই কি নিজের দাঁড়াবার ভঙ্গিটা দেখতে পাস? তুই কি জানিস যে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেই তোর চোখ ট্যারা হয়ে যায়? যাকগে, সবচে বড় কথা কী জানিস, আমি পরের স্টপে বাস থেকে রিস্ক নিয়ে নেমে দৌড়োতে দৌড়োতে এলুম, এর মধ্যে তুই যদি চলে যেতিস তাহলে একেবারে বোকা বনে যেতুম।
—ব্যাপারটা কী বলো তো, রাহুলদা? পরশুদিন তোমার সঙ্গে বাজারে দেখা হলো, তখন তো একটুও বুঝতে পারিনি যে আমার সঙ্গে তোমার এমন কিছু দরকারি কথা আছে।
–পরশুদিন দরকার ছিল না। দরকারটা আজই। ঠিক দরকারও বলা যায় না, তোকে আমি একটা উপহার দিতে চাই।
—উপহার? আমাকে? তোমার কোম্পানির ক্যালেণ্ডার চেয়েছিলুম একটা, তা তুমি দিতে ভুলে গেছ।
—ভালো করে মনে করিয়ে দিসনি কেন? ঠিক আছে, দেব, নেক্সট উইকে একবার অফিসে আসিস।
–এই জুন মাসে আমি ক্যালেণ্ডার নিয়ে কী করব?
– যাক গে যাক, সামনের বছরে পাবি। ডায়েরিও দেব। শোন, তোকে আমার একটা উপকার করতে হবে। আমার দিদি জামাইবাবু হাওড়ায় থাকেন জানিস তো? কাল সন্ধ্যেবেলা থেকে জামাইবাবু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ট্রান্সফার করতে হয়েছে পি. জি–তে। কাল প্র্যাকটিক্যালি সারারাত ছিলুম হাসপাতালে। সাত বোতল রক্ত দিতে হয়েছে। জানিস তো আজকাল রক্ত জোগাড় করা কত শক্ত।
–ও, এই ব্যাপার! আমার ব্লাড গ্রুপ হচ্ছে ‘ও’, তাতে চলবে? আমি রক্ত দিতে রাজি আছি।
–তোর রক্ত কে চেয়েছে?
–সাত বোতল লেগেছে, আরও যদি লাগে? রক্ত দেওয়াটা আমার পক্ষে কিছুই না।
–ধ্যাৎ! শোন, তোকে আমি রবীন্দ্রসদনের একটা ফাংশানের দুটো টিকিট দেব।
–না–না, তোমায় কিচ্ছু দিতে হবে না। আমি তো এমনিই রক্ত দিতে রাজি আছি বললুম। রক্ত দিতে আমার ভালো লাগে। প্রত্যেকদিন ট্রামে–বাসে চাপতে কত রক্ত জল হয়ে যায়, রাত্তিরবেলা মশারা কত রক্ত খেয়ে নেয়, তার চেয়ে কোনো অসুস্থ মানুষের জন্য রক্ত দেওয়া—
—কী আবোল–তাবোল বকছিস! রক্ত দেবার কোনো কোয়েশ্চেনই উঠছে না। আমি তোকে একটা ফাংশানের দুটো টিকিট দিতে চাই, ফ্রি।
—ফ্রি তো বুঝলুম, কিন্তু তার বদলে?
—তার বদলে তোকে কিছু করতে হবে না!
—এত খারাপ ফাংশান? কিশোরকুমারের নাচ–?
–না–না, তা নয়। খুব ভালো ফাংশান।
–ও বুঝেছি, তোমার চেনা কেউ গান গাইবে? তোমার মেয়ে?
–শোন নীলু, আমার বেশি সময় নেই, আমাকে এক্ষুনি আবার যেতে হবে পি. জিতে। তোকে সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলছি। আজই সাতটার সময় রবীন্দ্রসদনে একটা চ্যারিটি শো আছে। সুচিত্র মিত্র, ঋতু গুহর গান আছে, আরো কী সব ভ্যারাইটি পারফরমেন্স। একটা মূক–বধির বিদ্যালয়ের জন্য টাকা তুলছে, ওরা আমার অফিসে এসে খুব করে ধরেছিল, আমাকে একশো টাকার দু’খানা টিকিট গছিয়েছে। কোম্পানির অ্যাকাউন্ট অবশ্য, কিন্তু ভালো একটা কাজ, ভালো ভালো আর্টিস্ট আছে, ভেবেছিলুম আমি নিজেই যাব। হঠাৎ জামাইবাবুর এরকম অসুখ হলো। টিকিট দুটো নষ্ট হবে, তাই আমি পকেটে নিয়েই বেরিয়েছি। তোকে পেয়ে গেলুম, তুই যা!
–কেন, হাসপাতাল ঘুরে, তারপর তুমি চলে যাও?
–তোর মাথা খারাপ হয়েছে? বসন্তদার এরকম ক্রিটিক্যাল অবস্থা, এর মধ্যে আমি নাচ–গান শুনতে যাব? আজও কতক্ষণ হাসপাতালে থাকতে হয় ঠিক নেই।
—কিন্তু…কিন্তু…একশো টাকার টিকিটে আমি যাব?
–তোর তো এক পয়সাও লাগছে না।
—সেজন্য না। একশো টাকার টিকিট নিশ্চয়ই খুব সামনের দিকে?
—একেবারে ফ্রন্ট রো। এই দ্যাখ, ‘এ’ দিয়ে নাম্বার।
—সেখানে আমি যাব? এই চেহারায় আর এই পোশাকে? চাকর–বাকর ভেবে আমার মাথায় চাঁটি মেরে উঠিয়ে দেবে না?
রাহুলদা এবারে আমার আপাদমস্তক দেখলেন, চোখ দুটো একটু ছোট হয়ে গেল, মাথাটা একদিকে হেলিয়ে বললেন, তোর চেহারাটা…পোশাক তো মোটামুটি ঠিকই আছে, প্যান্টের সঙ্গে চটি পরে বেরোস কেন, শু পরতে পারিস না? যাক গে, এতেই চলে যাবে। তোর কাছে তো টিকিট থাকছে।
আমি বললাম, টিকিট থাকলেই বা। যদি ওরা ভাবে আমি এত দামী টিকিট পকেট মেরেছি! না–না ওসব ঝঞ্ঝাটের মধ্যে আমি যেতে চাই না। শুধু শুধু যেচে অপমান নেওয়া।
রাহুলদা ক্ষুণ্নভাবে বললেন, একশো টাকার টিকিট…নষ্ট হবে? তা ছাড়া, চ্যারিটি শো–এর টিকিট কেটে না যাওয়াটা অত্যন্ত অভদ্রতা। এদের প্রোগ্রাম ও খুব ভালো।
—তুমি তো হাসপাতালে যাচ্ছই, ওখানে চেনাশুনো আর কারুকে পেয়ে যেতে পার। তাদের দিয়ে দিও!
–তোর কোনোদিন বুদ্ধি হবে না, নীলু! হাসপাতালে কেউ বেড়াতে আসে না। ওখানে যারা যায়, তাদের থিয়েটার–জলসার টিকিট দেওয়া যায় না। টিকিটটা যে আজকেরই, এক ঘণ্টা বাদে…তোর জন্য আমি বাস থেকে নামলুম, আর তুই এরকম করছিস? আমি তো বলছি, তোর কোনো ভয় নেই, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না, তুই চলে যা!
রাহুলদা প্রায় জোর করেই আমার হাতে টিকিট গুঁজে দিলেন। একটা নয়, দুটো। দুশো টাকা! ওফ, এই দুশো টাকা পেলে আমি কত কাজে লাগাতে পারতুম!
—একটা টিকিট তো তবু নষ্ট হবে!
—এখনো প্রায় সোয়া ঘণ্টা আছে, এর মধ্যে তোর কোনো বান্ধবী জোগাড় করতে পারবি না? তুই কী রে, ইয়াংম্যান, তোর মতন বয়েসে আমরা…
হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠে রাহুলদা আবার বললেন, আমি আর দেরি করতে পারছি না। তুই দ্যাখ কাকে জোগাড় করতে পারিস। আর শোন, এই দশটা টাকা রাখ, তোর বান্ধবীকে কোল্ড ড্রিংক্স আর বাদাম খাওয়াতে হবে তো…
আমার বুক পকেটে দশটা টাকা গুঁজে দিয়ে রাহুলদা হনহনিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গেলেন।
পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতন দুশো দশ টাকা! অবশ্য টিকিট দুটোর দাম দুশো টাকা হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই মূল্যহীন কাগজের টুকরো হয়ে যাবে। অর্থাৎ ঐ দুটো কারেন্সিও নয়, প্রমিসারি নোটও নয়, যা দাম লেখা আছে তার সমমূল্যের বস্তুও নয়। তা হলে অর্থনীতির ভাষায় একে কী বলে? কিছু একটা বলে নিশ্চয়ই, তা নিয়ে আমার মাথা ঘামাবার দরকারটাই বা কী! সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক হয়, কিন্তু এই সব ফাংশানের টিকিট এমনকি যথা দামেও বাইরে দাঁড়িয়ে বিক্রি করা যায়? সন্দেহ আছে। কিশোরকুমার নাইট হলেও তবু কথা ছিল। চ্যারিটি শো–এর টিকিট কাউন্টারে দিয়ে দাম ফেরত চাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
অর্থাৎ এই দশ টাকাটাই আসল টাকা। তাই–ই বা মন্দ কী? টিকিট দুটো অনায়াসে ছিঁড়ে ফেলা যেতে পারে।
কিন্তু এই চ্যারিটি শো–এর উদ্যোক্তারা যদি রাহুলদার চেনা হয়, তা হলে পরে হয়তো অনুযোগ করবে। সামনের সীট খালি পড়ে থাকলে ওরা লক্ষ করবে নিশ্চয়ই। তা হলে কিছুক্ষণের জন্য যাওয়া যেতে পারে। সুচিত্র মিত্র, ঋতু গুহ’র গান শোনা যাবে…আগামী সন্ধ্যাটিতে আমার মূল্যবান কিছু কাজ নেই…নাচ–গানের অনুষ্ঠান দেখার জন্য দশ টাকা মজুরি পাওয়া গেল!
দ্বিতীয় টিকিটটা কী হবে? আমার বান্ধবীর সংখ্যা অসংখ্য, এমনকি অকালে দেহান্তরিতা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীও আমার বান্ধবী ছিলেন। আমার বর্তমান বান্ধবীদের মধ্যে আছে অপর্ণা সেন, মেরিল স্ট্রিপ, শাবানা আজমী, বচ্চেন্দ্ৰী পাল, অনীতা দেশাই, মল্লিকা সারাভাই, সাঁওতাল পরগনার ফুলমনি…এরকম আরো কত নাম করা যায়, একা একা এদের সঙ্গে আড্ডা মেরে আমার কত সময় কেটে যায়, কিন্তু এখন এদের কারুকে পাওয়া মুশকিল।
রাস্তা দিয়ে যেসব মেয়েরা একলা একলা হেঁটে যাচ্ছে,…ঐ যে নীল শাড়ি পরা মেয়েটি, হাতে একটি ব্রাউন প্যাকেট, অন্যমনস্ক চোখ, ও কি আমার বান্ধবী হতে পারে না? ওর সামনে গিয়ে বলা যায় না, আপনার কি আজ সন্ধেবেলা বিশেষ কোনো কাজ আছে? চলুন না, আমরা একসঙ্গে রবীন্দ্রসদনে একটা জলসা শুনতে যাই?
আমার এই নির্দোষ প্রস্তাব পুরোপুরি পেশ করার আগেই হয়তো মেয়েটির চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠবে। গল্পের বইয়ের নায়িকাদের মতন চটি খুলে মারতেও পারে। আজেবাজে পুরুষরাই মেয়েদের এরকম তিরিক্ষি করে দিয়েছে। কিংবা ভীতু। ভয় থেকেও অনেক সময় রাগ আসে।
চড়াৎ করে একবার বিদ্যুৎ ঝলকাবার পর খেয়াল হলো যে একটু আগেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি নেমে গেছে। তুষারপাতের মতন মিহি ও শব্দহীন। এর চেয়ে যদি বেড়ে যায় তা হলে রবীন্দ্রসদন পর্যন্ত পৌঁছতেই পারব না। এখান থেকে বাসে মাত্র একটি স্টপ। এই ভিড়ের বাসগুলির কোনো একটায় ঠেলেঠুলে উঠতে পারলে, এক স্টপের মধ্যে ভাড়া দেওয়া যাবে না। লোকে ভাববে জোচ্চোর। শুধু এক স্টপ যাওয়ার জন্য ভাড়া দেবই বা কেন?
হনহন করে হাঁটতে শুরু করে দিলুম।
এইবার মনে পড়ল, আমার একটা খুচরো কাজ ছিল। আমার ছোটমামা একটা রেকর্ড প্লেয়ার বিক্রি করবেন, তাই সেই ব্যাপারে আমাকে বলেছিলেন, নীলু, একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখবি, তোর তো অনেক চেনাশুনো, যদি কেউ নিতে চায়…
ক্যাসেটের যুগ এসেছে, রেকর্ড প্লেয়ারের গৌরবের দিন শেষ। এখন ঐ যন্ত্র সেকেণ্ড হ্যাণ্ড কে আর কিনবে, বিক্রিই করতে চায় সবাই। কিন্তু ছোটমামা তা বুঝতে চান না, তাঁর ধারণা নর্থ ক্যালকাটার লোকেরা এখনও বড় বড় রেকর্ড চালিয়ে গান শুনতে ভালোবাসে।
ছোটমামাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই বলেছিলাম, ঠিক আছে, বুধবার সন্ধেবেলা গিয়ে তোমার ওটা কী কণ্ডিশনে আছে দেখে আসব!
এমন কিছু ব্যাপার নয় যে ছোটমামা–মামি আমার প্রতীক্ষায় সারা সন্ধে বসে থাকবে। বড় জোর রাত্তিরে খেতে বসে ছোটমামা বলবে, নীলুটা আজ আসবে বলেছিল, এলো না! ওর কোনো কথার ঠিক নেই, এই জন্যই তো কাজকম্মো কিছু জোটে না!
ছোটমামার বাড়ি হাজরা মোড়ের কাছেই, এখনো চট করে ঘুরে আসা যায়। কিংবা টিকিট দুটো ওদের দিয়ে দিলে কেমন হয়। আমার এই মামা–দম্পতি বেশ কালচার ভক্ত। প্রায়ই মুখে পাউডার মেখে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে যায়, একশো টাকা দামের দু’খানা টিকিট পেলে খুশি হবে নিশ্চয়ই! আমারও প্রেস্টিজ বাড়বে। ওরা বুঝবে যে আমি শুধু সবসময় নিই না, কিছু দিতেও পারি।
কিন্তু রাহুলদা আমায় দশ টাকা বকশিস দিয়েছেন, পরে রিপোর্ট চাইবেন…অবশ্য সীট দুটো ভর্তি করা নিয়ে কথা…
সিদ্ধান্ত বদলাবার আর সময় পাওয়া গেল না, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হঠাৎ কুকুর– বেড়াল হয়ে গেল, আমি পকেট চেপে ধরে দৌড়ে পৌঁছে গেলুম রবীন্দ্রসদনে।
আরম্ভ হতে এখনো ঢের দেরি আছে, দর্শকদের মধ্যে আমিই প্রথম উপস্থিত। একশো টাকার টিকিটের কী হেনস্থা! যারা এত দামী টিকিট কাটে, তারা অনুষ্ঠান শুরু হবার দশ–পনেরো মিনিট পরে পৌঁছয় এবং গাড়িতে আসে।
উদ্যোক্তারা অবশ্য এসে গেছে, খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, তারা মঞ্চ সাজাচ্ছে ফুল দিয়ে। দু’একজন লবিতে সাঁটছে পোস্টার। আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে দু’ একবার…ঠিক বুঝতে পারছে না আমি কে….
হঠাৎ মনে হলো, আমার জীবনে আজকে বিশেষ কিছু একটা ঘটবে! চলন্ত বাস থেকে রাহুলদার নেমে পড়া…আমার কাছে একশো টাকার দু’খানা টিকিট…আমি এখানে একঘণ্টা আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছি…এর কি কোনো মর্ম নেই! প্রতিদিনের ঘটনার সঙ্গে তো এসব মেলে না! হয়তো এমন কেউ আসবে, যে আমার জীবনটা বদলে দেবে। একজন কেউ এসে বলবে, আমি তোমায় চিনতে পেরেছি, নীলু! সবাই স্রোতের শ্যাওলার মতন তোমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চায়, কিংবা কৃপা করে তোমাকে দিতে চায় ছিটেফোঁটা সাহায্য, কিন্তু আমি ত্রিশিরা কাচের মধ্যে দিয়ে দেখেছি তোমার হৃদয়…
এক এক করে আসতে লাগল লোকজন। গাড়িতে কিংবা ট্যাক্সিতে, বাস থেকে নেমে বৃষ্টির মধ্যে ছুটতে ছুটতে একজনকেও আসতে দেখা গেল না। এরা সবাই ঘ্যাম ঘ্যাম পার্টি, অন্য কারুর দিকে দৃপাত না করে সোজা হেঁটে যায়…সুসজ্জিতা মহিলারা নিজের নাকটা দেখতে ভালোবাসেন। সকলেরই সাজগোজের খুব বহর। এটা বেশ উচ্চাঙ্গের চ্যারিটি শো বোঝাই যাচ্ছে।
একজনও আমার চেনা মানুষ চোখে পড়ল না। এমনকি কেউ আমার আধো চেনাও নয়, আমার দিকে কেউ সামান্য ভুরুও তোলে না। কেউ অতিরিক্ত টিকিটের খোঁজ করলে একশো টাকার একখানা টিকিট বিনামূল্যে আমি দিয়ে দিতে পারি, সেরকমও কেউ নেই।
তা হলে সে কোথায়! যে আমার জীবন বদলে দেবে? তবে কি আমার পাশের সীটেই এসে সে বসবে হঠাৎ?
সেকেণ্ড বেল বাজা পর্যন্ত অপেক্ষা করলুম। নাঃ, কেউ এলো না। একখানা টিকিট তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ফেলে দিয়ে আর একখানা নিয়ে ঢুকে পড়লুম। দু’ পাশের লোকেরা এবার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখুক, এতক্ষণ যাকে তারা গ্রাহ্য করেনি, সে এখন গিয়ে বসবে ফ্রন্ট রো–তে!
যে লোকটি টিকিট ছিঁড়ল, যে–লোকটি টর্চ হাতে আমায় সীট দেখাতে এলো, ওরা কি সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে আমার দিকে? আমার কিছু যায় আসে না! মঞ্চে এখন যে বাজনা বাজছে, তা যেন আমাকে অভ্যর্থনা করবার জন্যই।
যথারীতি সামনের সারি প্রায় ফাঁকা। আমার ডান পাশে বা বাঁ পাশে চার– পাঁচখানা সীটের মধ্যে কেউ নেই। খেলা যখন শুরু হবে, তখন অন্ধকারের মধ্যে কেউ সারা গায়ে সুগন্ধ মেখে আমার একপাশে, ঝুপ করে বসে পড়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছ, নীললোহিত?
খেলা শুরু হয়ে গেল, কেউ এলো না। রাহুলদা বেশি বেশি বাড়াবাড়ি করছিলেন। সামনের দিকের প্রথম দু’সারির অনেকেই আসে না। কিছু কিছু নিশ্চয়ই কমপ্লিমেন্টারি কার্ড থাকে। স্যুভেনিরে যারা বিজ্ঞাপন দেয়, তারাও নিশ্চয়ই ফ্রি কার্ড পায়। রাহুলদার দু’খানাও সেরকম নাকি? কিন্তু কার্ড নয়, টিকিট, তাতে আমি একশো টাকা দাম লেখা দেখেছি। নিশ্চয়ই একশ্রেণীর মানুষ আছে, যারা চ্যারিটির জন্য একশো টাকা দিতে পারে। কিন্তু দু’তিন ঘণ্টা সময় দিতে পারে না।
উদ্বোধনী সঙ্গীত, তারপর বক্তৃতা, তারপর মাল্যদান, তারপর বক্তৃতা, এ সব কিছুই আমার কানে গেল না, আমি শুনতে না চাইলে কেউ জোর করে কিছু আমাকে শোনাতে পারে না। সে আমার নিজস্ব ব্যবস্থা আছে। বিনা ডাকটিকিটে মনকে আমি যখন তখন দূরে পাঠিয়ে দিতে পারি। এমনকি স্বর্গেও।
সুচিত্রা মিত্র, ঋতু গুহ’র গান নিশ্চয়ই শেষের দিকে হবে। ওঁরাই তো তুরুপের তাস। তার আগে কবিতা পাঠ, অতুলপ্রসাদের গান, যুগ্ম নৃত্য। আমি মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দর্শক–দর্শকাদের দেখছি। স্টেজে এক একজন নতুন শিল্পী এলেই হলের এক অংশে মৃদু গুঞ্জন উঠছে। অর্থাৎ এক একজন শিল্পীর আত্মীয়স্বজনের সংখ্যা যথেষ্ট। এখানে আমার একজনও চেনা নেই? এই একাকিত্ব অসহ্য লাগে।
রুম–ঝুম শব্দে মঞ্চের ওপর মুখ ফেরালুম। এবারে যুগ্ম নৃত্য, কিংবা একটা কোনো নৃত্যনাট্যের অংশ, রাজকুমারী ও বিদেশী পথিক, দুটিই যে মেয়ে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তবে ওরা কিশোরী না যুবতী তা বোঝবার উপায় নেই। মেয়েরা ছেলে সাজলে আমার দেখতে ভালো লাগে। পথিক–সাজা মেয়েটি আবার গোঁফ এঁকেছে, বুকের দু’পাশ উঁচু হয়ে আছে যদিও। অন্য মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলুম।
সত্যিকারের রাজকুমারী তো আমরা কেউ দেখিনি। এই ভারতবর্ষে আর কোনোদিন দেখতেও পাওয়া যাবে না। কিন্তু এ মেয়েটি যেন নেমে এসেছে ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে। কোনো জলসায়, নাচগানের আসরে তো এরকম কোনো মেয়েকে কখনো দেখা যায় না।
মেয়েটি কতখানি সুন্দরী তা আমি বলতে পারব না। রূপের বিচার আমি করতে জানি না। তাছাড়া মঞ্চের মেয়ের অনেকখানিই তো সাজ–পোশাক। আমাকে চুম্বকের মতন টানছে ওর চোখ দুটি। এরকম সারল্য ও বিস্ময়–মাখা চোখ এখনো আছে এই পৃথিবীতে! মেয়েটা কলকাতা শহরেই থাকে নিশ্চয়ই, এই শহর এর মধ্যে একবারও ওকে আঁচড়ে দেয়নি?
নাচ তো তেমন বুঝি না। ওদের নাচ কতটা উচ্চাঙ্গের তা কে জানে! লম্বা চুলওয়ালা একজন তবলচি বাঁয়া–তবলা পিটিয়ে যাচ্ছে মনের সুখে। নেপথ্য থেকে ভেসে আসছে গান। মেয়ে দুটি নাচছে সারা স্টেজ জুড়ে। রাজকুমারীর চোখের দিকে যতবার চোখ পড়ছে, ততবারই কেঁপে উঠছে আমার বুক। বুকের এরকম ব্যবহারের মানে কী? আমি প্রেমে পড়ে গেলুম নাকি?
অন্ধকারে খুব উপভোগের সঙ্গে হাসলুম। এই সব ব্যাপারগুলো একা না থাকলে ঠিক মৌজ করা যায় না। আমার পাশে চেনা কেউ বসলে তার সঙ্গে গল্প করতুম, এতখানি মনোযোগ দিতুম না এই নাচের দিকে। বুক কাঁপত না। ইচ্ছে করে কেউ নিজের বুক কাঁপাতে পারে না। আকাশ থেকে দৈবাৎ কখনো কখনো নেমে আসে বুক কাঁপার মূহূর্ত।
আমি রাজকুমারীকে দেখছি কিন্তু সে আমাকে দেখছে না। মঞ্চ থেকে সব কিছুই অন্ধকার দেখায়। তাছাড়া ওর চোখ দূরের দিকে।
মেয়েটির নাম কী? বাইরে দু’জন মহিলা স্যুভেনির হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু পাঁচ টাকা করে দাম! পাঁচ টাকা খরচ করে ঐ পচা জিনিস কিনতে আমার বয়ে গেছে। একশো টাকার টিকিটে এসেছি। আমাকে ঐ স্যুভেনির একখানা বিনামূল্যে দেওয়া উচিত ছিল না।
নাচটা হঠাৎ শেষ হয়ে গেল, যাবার সময় সেই রাজকুমারী আবার আমার বুক কাঁপিয়ে গেল। মোট তিনবার। তাহলে ব্যাপারটা বেশ গুরুতর। ওর সঙ্গে আর দেখা হবে না? আমি যদি কেউকেটা হতুম, তাহলে ইন্টারভ্যালের সময় মঞ্চে উঠে গিয়ে উদ্যোক্তাদের কারুকে জিজ্ঞেস করতে পারতুম, ঐ যে রাজকুমারী সেজে নাচল, ঐ মেয়েটি কে? দিব্যি নাচ শিখেছে তো। কই, ওকে একবার ডাকো তো! মেয়েটি লাজুক লাজুক মুখ করে এসে দাঁড়ালে…।
আমি একশো টাকার টিকিটের খাঁটি অধিকারী হলে উদ্যোক্তারা নিশ্চয়ই কেউ না কেউ চিনত। রাহুলদাকে যে টিকিট বিক্রি করে গেছে, সে কি এসে একবার অন্তত দেখা করে যেত না! মেয়েটি নিশ্চয়ই এখন সাজপোশাক খুলছে। একটু পরে যদি চলে যায়, তাহলে আর দেখা হবে না সারা জীবনে!
মনটা বিমর্ষ হয়ে গেল। সব দোষ রাহুলদার! কী দরকার ছিল এখানে আসবার, সেধে সেধে দুঃখ পাওয়া। এর পর শুরু হলো নজরুলের একটা লম্বা কবিতার আবৃত্তি…।
মিনিট পনেরো বাদে আবার চমকে উঠলুম। সাত–আটটি ছেলেমেয়ে কোরাস গাইতে এসেছে। তাদের মধ্যে রাজকুমারী না? পোশাক বদলে এসেছে। মাথায় মুকুট নেই। শরীরে ফুলের অলংকার নেই, তবু মুখটা দেখলে ঠিকই চেনা যায়। বাঃ, যাকে দেখে বুক কাঁপল, তার মুখ কি আর সারা জীবনে ভুলতে পারি?
কোরাস গানের সময়ও আলাদা করে গলা চেনা যায়। তার জন্য বিশেষ অধ্যবসায়ের দরকার। আগে নিজের আত্মাকে দু’চোখের মণিতে আনতে হয়। তারপর শুধু একজন ছাড়া আর সবাইকে মুছে ফেলতে হয়। আমি রাজকুমারীর চোখে চোখ রেখে ধ্যানস্থ হলুম। না, মেয়েটি এখন আর রাজকুমারী নয়, তবু, ঝলমলে সাজপোশাক খুলে এলেও ওর চোখের সেই দৃষ্টিটা পাল্টায়নি। ঐ দৃষ্টির জন্যই তো অনন্যা।
আস্তে আস্তে তরল হয়ে গেল মঞ্চটা। ঐ যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে বাঁদিক থেকে তৃতীয়। থুতনিটা একটু উঁচু করে আছে। দুটো হাত সামনের দিকে বাড়ানো…আর সবাই মিলিয়ে গেল, অমনি আমি অন্য সব শব্দের মধ্যে থেকে ছেঁকে শুধু একজনের গলাই শুনতে পেলুম। ওর ঠোঁট নড়ছে, আমি শুনছি একক সঙ্গীত। খুব একটা দারুণ কিছু গান না। চলনসই বলা যেতে পারে। কিন্তু খুব তন্ময় হয়ে আছে…। আমার আর একবার বুক কেঁপে উঠল।
অনেক আশা করেছিলুম, আজ সন্ধেবেলা আমার জীবনে একটা কিছু ঘটবে। সেরকম কিছুই ঘটল না। শুধু কয়েকবার বুক কাঁপল, তা–ও এমন একজনকে দেখে, যে আমার দিকে একবারও তাকিয়ে দেখেনি। যে সারা জীবনও আমার কথা জানতে পারবে না।