৫
টেলিফোন গাইডে দু’জন রবীন সরকারকে পাওয়া গেল, একজন গরচায়, আর একজন কাঁকুলিয়ায়। এ ছাড়া আর. এন. সরকার, আর. পি. সরকার এইসব অজস্ৰ। গরচা দিয়েই শুরু করা যাক।
আমাদের পাড়ায় নিউ ডেকরেটার্স দোকানটায় গিয়ে আমি মাঝে–মাঝে বসি। যখনই বিনা পয়সায় টেলিফোন করার দরকার হয়। উপেনদা অবশ্য টেলিফোনের ডায়ালে একটা ছোট্ট তালা দিয়ে রাখেন, মুখ–চেনা কেউ এসে টেলিফোন করতে চাইলে উনি অম্লান বদনে বলেন, চাবিটা তো খুঁজে পাচ্ছি না! এ–পাড়ার কোন্ একটি কলেজে–পড়া মেয়ে নাকি একবার এই টেলিফোনে তার প্রেমিকের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। সেই থেকে তিনি অন্য কারুকে টেলিফোন ব্যবহার করতে দিতে চান না। আসল কারণটা হচ্ছে কৃপণতা।
কিন্তু এর চেয়ে ঢের–ঢের বড় কৃপণদের আমি চরিয়ে খেয়েছি। এক–একজন কৃপণকে ট্যাকল করার এক–এক রকম কায়দা। এর জন্য মানবচরিত্র স্টাডি করা দরকার। আমি যাওয়া–আসার পথে উপেনদার দোকানের দিকে তাকিয়ে মাঝে–মাঝে দেখতে পাই চেয়ারটা খালি। তার একটা নির্দিষ্ট ব্যবধান আছে, দু’ থেকে আড়াই ঘণ্টা। অর্থাৎ উপেনদার পেটের রোগ, বাড়িওয়ালার বাথরুম ব্যবহারের বিশেষ বন্দোবস্ত আছে।
দোকানের ছোকরা কর্মচারীটি আমাকে ভালোবাসে, তার মালিককে কেউ ঠকালে সে খুব খুশি হয়। একবার উপেনদাকে কে যেন একশো টাকা কম দিয়েছিল, তাতে ঐ অমূল্য উপেনদার পেছনে দাঁড়িয়ে নেচেছে।
ক্যাশ ড্রয়ারে চাবিটা থাকে, টপ করে খুলে ডায়াল ঘোরাতে শুরু করি, অন্তত চার–পাঁচটা ফোন করার সময় পাওয়া যায় স্বচ্ছন্দে।
কিন্তু আমার এত উদ্যোগ, এত পরিকল্পনা সব ব্যর্থ করার জন্য সদা সতর্ক হয়ে আছে টেলিফোন দফতর। ওরা তো অমূল্যদার মতন কৃপণদের সাহায্য করার জন্যই ব্যস্ত। যতই ডায়াল ঘোরাও লবডঙ্কা! হয় এনগেজড টোন, অথবা খট করে একটা শব্দ হবার পর সব চুপচাপ। দুই রবীন সরকারেরই ঐ ব্যাপার। অন্য দু’একটা আর সরকার ট্রাই করলুম, সাড়া নেই। গাইডের যাবতীয় সরকারই বোধহয় আজ টেলিফোন–আওতার বাইরে।
তালা–ফালা লাগিয়ে সব ঠিকঠাক করে রাখলুম। অমূল্য বলল, ঐ যন্তরটা ভেঙে ফেলুন না।
আমি বললুম, তুই একদিন ধুলো ঝাড়ার নাম করে ওটাকে একটা আছাড় মারিস!
সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝন্ করে টেলিফোনটা বেজে উঠল। এ তো বেশ মজার ব্যাপার, ফোন করা যাবে না, কিন্তু আসবে। উপেনদার খুব মজা!
অমূল্য ফোন তুলে পাঁচবার শুধু হ্যাঁ বলে রেখে দিল। আমি জিজ্ঞেস করলুম কে ফোন করেছিল?
অমূল্য ঠোঁট উল্টে বলল, কী জানি!
আশ্চর্য, এই সব সত্ত্বেও উপেনদার দোকান বেশ ভালোই চলে। দু’খানা ঠেলাওয়ালা প্রতিদিন প্যান্ডেল বাঁধার জিনিসপত্তর নিয়ে যায়, নিয়ে আসে। এখন বিয়ের সিজ়ন, বর্ষাকালের বিয়েতে ডেকরেটরদের পোয়াবারো। লোকেরা শীতকালে বিয়ে করলেই তো পারে।
চুরি করে ফোন–টোনের চেষ্টা করে পালিয়ে যাবার পাত্র আমি নই। বসে রইলুম গ্যাঁট হয়ে। একটু বাদে ফিরে এলো উপেনদা, কোমরের ধুতির কষি আঁট করে বাঁধতে–বাঁধতে, মুখে একটা তৃপ্তির ভাব।
– কী খবর, নীলুচন্দর!
–এই যে উপেনদা, তোমার এখানে একটু চা খেতে এলাম।
—হ্যাঁ, চায়ের টাইম হয়ে গেছে। অমূল্য! দু’ কাপ চা বলে আয়। আর চারটে নোনতা বিস্কুট, আচ্ছা থাক, বিস্কুট দরকার নেই, দুটো চিংড়ির কাটলেট আনবি।
উপেনদার এতখানি ঔদার্য কোনোদিন দেখিনি। হঠাৎ চিংড়ির কাটলেট? আমি তো উপেনদার খদ্দেরও নই।
–কী ব্যাপার, উপেনদা?
—কিসের কী ব্যাপার রে?
—আজ মেজাজটা বেশ খুশি খুশি দেখছি? আপনার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে নাকি?
–আরে অন্য লোকের বিয়ের ঠ্যালা সামলাতে সামলাতেই হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি, যা বিয়ের হিড়িক পড়েছে এই সীজনে, চেনা গ্রাহকদেরই সাপ্লাই দিয়ে উঠতে পারছি না! দ্যাখ না এই পুরো মাসটার লম্বা লিস্ট, প্রত্যেকদিন দুটো করে।
—তা বলে চিংড়ির কাটলেট খাবেন? আপনার না পেটের…
—আজ পেটটা বেশ ভালো আছে। বাড়িতে, বুঝলি, সিঙ্গিমাছ কাঁচকলার ঝোল ছাড়া আর কিছু খেতে দেয় না। ভালো–মন্দ যদি খেতেই না পেলুম, তা হলে আর টাকা রোজগার করে লাভ কী!
–তা তো বটেই!
উপেনদার চার মেয়ে। উপেনদা মেয়ের বিয়েকে বলেন পার করা। তাঁর ভাষায়, তিন তিনটি মেয়েকে পার করতে পারলেও ছোট মেয়েটি গলার কাঁটা হয়ে আটকে আছে। উপেনদার ছোট মেয়ে শ্রীলাকে আমি চিনি, সে ফিলসফিতে এম. এ. পাশ করে এখন পি. এইচ. ডি–র জন্য তৈরি হচ্ছে। বিয়ে–টিয়ের ব্যাপারে সে মাথাই ঘামাতে চায় না। ডেকরেটরের মেয়ে হয়ে শ্রীলার কেন যে দর্শন শাস্ত্ৰ পড়ার ঝোঁক হলো তা কে জানে। মেয়ে যে দর্শন নিয়ে এম. এ. পাস করেছে, তা উপেনদা জানলেন মাত্র কয়েকদিন আগে। তিনি শুধু জানতেন মেয়ে ইউনিভার্সটিতে লেখাপড়া করে।
শ্রীলা বেশ তেজি মেয়ে। সে যদি এখন বিয়ে করতে না চায়, তাতে ক্ষতি কী আছে? তার যখন খুশি সে তার জীবনসঙ্গী খুঁজে নেবে।
কিন্তু উপেনদার মতে “বয়স্থা” মেয়ে বাড়িতে রাখা মানেই “গলার কাঁটা” পুষে রাখা।
আমাকে তিনি প্রায়ই বলেন, এই নীলু, একটু খোঁজখবর নিয়ে দ্যাখ না, মেয়েটার জন্য একটা ভালোমতন পাত্র জোগাড় করতে পারিস কি না!
চোখের সামনেই যে জলজ্যান্ত আমি আছি তা উপেনদার খেয়াল হয় না। উপেনদার ছোট ভাই রূপেন আমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত, সে হঠাৎ বোকার মতন আত্মহত্যা করেছে। সেই জন্যেই উপেনদা আমাকে একটু স্নেহ করেন, কিন্তু মেয়ের পাত্র হিসেবে গ্রাহ্য করেন না আমাকে। আমি কি এতই ফ্যালনা যে একটু প্রত্যাখ্যানের সুখও পেতে পারি না?
উপেনদা অনেকগুলো নাম ঠিকানা লেখা লম্বা একটা লিস্ট আমার সামনে ফেলে বলেন, একখানা ট্র্যাজেডিয়াস গল্প শুনবি? গল্প নয়, সত্যি ঘটনা, ফ্যাক্ট! উপেনদা বোধহয় হিলেরিয়াস, সিরিয়াসের সঙ্গে মিলিয়ে ট্র্যাজেডিয়াস শব্দটি বানিয়েছেন—তা মন্দ কী!
উপেনদা সেই কাগজের একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে বললেন, এই যে দেখছিস সত্যেন নিয়োগী, বেলেলিয়াস রোডে বাড়ি, এই ভদ্রলোকের ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গিয়েছিল, বুঝলি, পনেরো হাজার নগদ আর বিশ ভরি সোনা, সব দিতে রাজি হয়েছিলুম, কিন্তু মেয়ে আমার বেঁকে বসল, বলে কি না, একুশ বছর বয়েস হয়ে গেছে, বেশি চাপ দিলে বাড়ি থেকে পালাবে! আজকালকার ধিঙ্গি মেয়েদের কি কাণ্ড। মেয়ে বাড়ি থেকে পালালে আমারই মুখে চুন–কালি পড়বে…এখন সেই সত্যেন নিয়োগীর ছেলের ধুমধাম করে বিয়ে ঠিক হয়েছে অন্য জায়গায়, আর আমাকেই সেই বিয়ের প্যাণ্ডেল বাঁধতে হবে। অ্যাঁ? তুই–ই বল্!
–সত্যি বড্ড শ্যাড, উপেনদা। ও বাড়ির কাজটা আপনি না নিলেই পারতেন।
–কী করব বল, খদ্দের হলো লক্ষ্মী, কক্ষনো ফেরাতে নেই যে।
—ওদের প্যাণ্ডেলের চালে ফুটো রাখুন তা হলে, যাতে বৃষ্টি হলে বর–বউ ভেসে যায়।
ধ্যার! আর ওসবে কী হবে!
চিংড়ির কাটলেট এসে গেল, দুঃখ ভুলবার জন্য উপেনদা একখানা কাটলেট তুলে বড় একটা কামড় বসালেন।
চা দিয়েছে দুটো ময়লা গেলাসে। উপেনদা শুধু তেরপল–বাঁশ দিয়ে প্যাণ্ডেলই বানান না, ফার্নিচার, ক্রকারি–কাটলারিও ভাড়া দেন। ভেলভেটের চেয়ার আছে দু’খানা, চেয়ারের পেছনের আলমারিতে সারি–সারি গোলাপি রঙের কাপ–ডিশ। ঐ রকম একটা দামী কাপে একদিন চা খেতে ইচ্ছে করে।
নাম ঠিকানা লেখা লিস্টটা আমার সামনে পড়ে আছে, হঠাৎ সেটাতে চোখ আটকে গেল। একেবারে শেষের নামটা হলো রবীন সরকার, কাঁকুলিয়ার ঠিকানা! উত্তেজনা দমন করার চেষ্টা করে বললুম, উপেনদা, এই যে এই রবীন সরকার নামে ভদ্রলোককে আপনি চেনেন? ইনি কি আই. এ. এস. অফিসার ছিলেন?
ভুরু কুঁচকে উপেনদা বললেন, তা কে জানে! অর্ডার দিয়ে টাকা অ্যাডভান্স করে গেছে, কিসের অফিসার তা জানি না।
—বাড়িটা কি ফ্ল্যাট বাড়ি?
প্রত্যেক নামের পাশেই কোডে কী যেন লেখা আছে। সেটা দেখে উপেনদা বললেন, হ্যাঁ, ফ্ল্যাট বাড়ি। ছাদের ওপর ম্যারাপ বাঁধতে হবে, হাজার স্কোয়ার ফিট কভারড় এরিয়া, ভেতরে ফুলের ডিজাইন করতে হবে…
–ছেলের বিয়ে, না মেয়ের বিয়ে?
উপেনদা খামের পাশের কোড আবার দেখলেন। ছেলে কিংবা মেয়ে, তাও কোডে লেখা?
–বউভাত!
–কার বাড়ি, ছেলে না মেয়ের বাড়ি, সেটা জানতে চাইছি।
– আ গেল যা! মেয়ের বাড়িতে কখনো বউভাত হয়? এমন কথা কেউ ভু–ভারতে শুনেছে? বিয়ের দিন যে–থাকে কনে, শ্বশুরবাড়িতে এলে সে হয় বউ। তবে না বউভাত হবে!
আমার এ হেন অজ্ঞতায় মর্মাহত হবার ছলে মুখ নিচু করে আমি রবীন সরকারের বাড়ির ঠিকানাটা মুখস্থ করে নিলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, তারিখ? কত তারিখ?
–এ মাসের আঠাশে। কেন রে, তুই চিনিস নাকি?
—হ্যাঁ, চেনা–চেনা মনে হচ্ছে। ও বাড়িতে আমি অনেকবার গেছি!
—কাটলেটটা বেড়ে বানিয়েছে রে? আর একখানা করে হবে নাকি।
—উপেনদা, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? দু’খানা চিংড়ির কাটলেট তোমার সহ্য হবে?
–দ্যাখ, এত লোকের বিয়েতে প্যাণ্ডেল বানাই, কোনো শালা আমাকে কিন্তু নেমন্তন্ন করে না। আমাকে কাটলেট, ফিসফ্রাই নিজের পয়সায় কিনে খেতে হয়!
—তুমি তা হলে কেটারিং–এর ব্যাবসা ধরো। প্রত্যেকদিন অনেক চপ কাটলেট একস্ট্রা হবে।
এই আলোচনাটা আর বেশি দূর গড়াল না, একজন খদ্দের এসে হাজির হলো, সেই সুযোগে আমি কেটে পড়লুম।
তা হলে, শান্তিনিকেতনে সাইকেলে চড়ে যে সারল্য–মাখা রাজকুমারীটি ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে–ই এই কাঁকুলিয়ার ফ্ল্যাট বাড়িতে নববধূ হয়ে আসবে। এতগুলো মিল যখন…তারিখটাও মোটামুটি মিলে যাচ্ছে…।
কেন জানি না, ঐ রিটায়ার্ড আই. এ. এস. অফিসার রবীন সরকারের সঙ্গে দেখা করার একটা উদগ্র ইচ্ছে হলো আমার। একবার ঘুরেই দেখে আসা যাক না।
বাসে চেপে বসলুম কিন্তু যাত্রাপথে বারবার বাধা পড়তে লাগল। প্রথম কথা, কালীঘাটের কাছে এসে বাসটা গেল খারাপ হয়ে। বর্ষার সময় সরকারি বাসগুলো খারাপ হবার প্রতিযোগিতা নিয়ে রাস্তায় বেরোয়। প্রাইভেট বাস খারাপ হলে টিকিটের পয়সা ফেরত দেয়। কিন্তু সরকারি বাসের কন্ডাক্টর বলে, ঐ টিকিটে পরের বাসে চাপুন!
কিন্তু পরের বাস কখন আসবে সেটা তার মর্জি। তার বুঝি মাঝপথে খারাপ হবার অধিকার নেই?
এই সময় নামল তোড়ে বৃষ্টি। দু’খানা প্রাইভেট বাসের মধ্যে যাত্রী তোলার লোভে আমাদের ভিড়টার কাছে এসে দাঁড়াল। কিন্তু আমার জেদ আমি ঐ সরকারি টিকিটেই সরকারি বাসে যাব, খামোকা আবার পয়সা খরচ করব কেন?
কুড়ি মিনিট বাদে ঐ রুটের একটি সরকারি বাসকে আসতে দেখা গেল, আমাদের প্রাক্তন কন্ডাক্টর এগিয়ে গিয়ে হাত তুলে তাকে দাঁড়াবার জন্য অনুরোধ জানাল, কিন্তু সে থামল না। কী জন্য যেন তার অভিমান হয়েছে।
এর মধ্যে আমার বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে অবস্থা।
মোট পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ব্যবধানে আমি আর একটি বাসে চড়তে পারলুম। পুরনো বাসের যাত্রী শুধু আমি। এ বাসটা বেশ ফাঁকা। একটা সীট পেয়ে বসতে যেতেই কন্ডাক্টার বলল, টিকিট!
আমি আগের টিকিটটি সযত্নে রক্ষা করেছিলুম, প্যান্টের পকেটে মুঠো করে ধরা ছিল, ভিজতেও দিইনি। সেটা বার করে দেখাতেই কন্ডাক্টর বলল, এটা আবার কী? ভদ্দরলোকের এক কথার মতন একবার টিকিট কেটে সব বাসে চাপবেন ঠিক করেছেন নাকি?
আমি বোঝাবার চেষ্টা করলুম, আগে যে–বাসটি খারাপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল….
কন্ডাক্টরটি বড্ড তার্কিক ধরনের। সে টেকনিক্যাল পয়েন্ট ধরে বলল কই ঐ বাসের কন্ডাক্টর তো আমায় কিছু ডেকে বলেনি। আপনার টিকিটের পেছনে কিছু লিখে দিয়েছে?
অত বৃষ্টির মধ্যে আগের কন্ডাক্টর তার নিজস্ব বাসে উঠে বসেছিল, সে কথা এ লোকটি মানবে না। কিন্তু আমার বাঙালের গো, আমি কিছুতেই নতুন টিকিট কাটব না। কথাবার্তার টান শুনে বোঝা গেল, এই কন্ডাক্টরটিও বাঙাল, সুতরাং দুই বাঙালের গোঁ মিলে একেবারে রতনে–রতন!
অন্য যাত্রীরা যথারীতি ভাগ হয়ে গেল দুই পক্ষে। তারপর সিদ্ধান্ত হলো, আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে বালিগঞ্জ স্টেশন বাস গুমটিতে, সেখানে এই কন্ডাক্টারের ঊর্ধ্বতন কর্মচারীরা বিচার করবে।
আমার তাতে আপত্তি নেই। বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে কাঁকুলিয়া যেতে সুবিধেই হবে। আমি একডালিয়ার মোড়ে নামব ভেবেছিলুম, আর বড় জোর দু’তিনটে স্টপ।
বালিগঞ্জ স্টেশনে মামলাটা মোটেই জটিল হলো না। বাসের কন্ডাক্টারটি আমাকে নিয়ে, হাত ধরে টানতে টানতে নয় অবশ্য, পাশাপাশি, অফিস ঘরে যার কাছে নিয়ে গেল, সেই লোকটি এই বাদলার মধ্যে মুড়ি–বেগুনি খেতে খেতে একটা বাংলা উপন্যাস পড়ছিল। নিশ্চয়ই খুব রোমাঞ্চকর জায়গা, বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরাবার ইচ্ছেই নেই তার। আমাদের কথা একটুখানি শোনামাত্র সে আমার দিকে বাঁ হাতের পাঞ্জা নাড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, যান, যান, চলে যান! এতসব ঝুট ঝামেলার কী দরকার!
আমি আমার সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে, সগৌরবের মাথা তুলে বেরিয়ে এলুম সেই ঘর থেকে। তার পরেই আর একখানা অলৌকিক।
ফ্ল্যাট বাড়িতে যে–কোনো লোক যে–কোনো তলায় উঠে গিয়ে যে–কোনো দরজায় ধাক্কা মেরে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে পারে। লেটার বক্স দেখে রবীন সরকারের ফ্ল্যাট চিনে নেওয়াও শক্ত কিছু নয়। কিন্তু আমার জামা–প্যান্ট সম্পূর্ণ ভিজে, মাথা দিয়ে জল গড়াচ্ছে, এই অবস্থায় কোনো অচেনা লোকের বাড়িতে কি যাওয়া যায়? পকেটে একটা রুমালও নেই ছাই! রুমাল থাকলেই বা কী হতো, সেটাও ভিজে যেত। সিগারেটের প্যাকেটটাও ভিজে গেছে। তাতে অবশ্য ছিল মাত্র একটা।
প্রথমে একটা সিগারেট টেনে বুদ্ধি ঠিক করা দরকার। এত দূর এসে কিছু একটা না করে ফিরে যাবার কোনো মানে হয়?
সিগারেটের দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, অমনি পাশের ফলের দোকান থেকে লাল রঙের ছাতার আড়াল সরিয়ে একটি চেনা মুখ আমার নাম ধরে ডেকে বলল, ওমা নীলু, তুমি এখানে কী করছ?
এ যে বাউল–গান উৎসাহিনী উজ্জয়িনী! শান্তিনিকেতনের তুলনায় আজ তার সাজগোজ একটু বেশি। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, সাঁচি স্তূপের স্টাইলের চুলের খোঁপা।
আমি বললুম, উজ্জয়িনী, তুমি এখানে কী করে এলে?
উজ্জয়িনী ছাতা ঘুরিয়ে উল্টো দিকের বাড়িটা দেখিয়ে বলল, ঐ তো আমার দিদির বাড়ি। কলকাতায় এলে আমরা এখানেই উঠি। সেদিন তুমি আমাদের কিছু না বলে–টলে পালিয়ে এলে, আমরা তোমার ওপর খুব রাগ করেছি।
আমি একগাল হেসে বললুম, সেদিন বিকেলে রেডিওতে আমার একটা রেকর্ডিং ছিল, একদম ভুলে গিয়েছিলুম। তাই চলে আসতেই হলো… তোমরা শ্রীনিকেতনের দিকে গেলে…আমার মনে পড়ল যে, একটায় একটা ট্রেন আছে।
—তা বলে একটা চিঠি লিখে আসতে পারলে না? কলকাতায় তোমার ঠিকানাটা পর্যন্ত জানি না।
–বাঃ, ফিরেই তো তোমাদের চিঠি লিখেছি। পাওনি?
–না তো।
–ক’দিন লাগে চিঠি যেতে? ঠিক পেয়ে যাবে ফিরে গিয়ে!
—এরকম ভিজে–টিজে কোথা থেকে এলে?
—এই তো এই ডিপোয় বাস থেকে নামলুম!
–বাসে এলে বুঝি এরকম ভিজতে হয়? মনে হচ্ছে যেন কোনো পুকুরে ডুব দিয়ে এসেছ!
–না, মানে, বাসে ওঠার আগে—
—চলো, চলো, আমার দিদির বাড়িতে চলো, মাথা–টাথা মুছে নেবে।
— উজ্জয়িনী, আমার এখন একটু কাজ আছে…তোমরা ক’দিন থাকছ? আমি পরে না হয়—
–এই অবস্থায় আবার কী কাজ। চলো, পাগলামি করো না। আমার দিদির বাড়িতে যেতে তোমার লজ্জা পাবার কিছু নেই!
শান্তিনিকেতনের স্মার্ট মেয়ে, উজ্জয়িনী আর একটু হলে আমার হাত ধরে টানছিল, আমি বললুম, ঠিক আছে, চলো যাচ্ছি!
বৃষ্টি অবশ্য এখন গুঁড়িগুড়ি পড়ছে। মেয়েলি ছাতার তলায় দু’জনে যাওয়া যায় না। মানে, উজ্জয়িনীর সঙ্গে আমার ততটা ঘনিষ্ঠতা নেই। উজ্জয়িনীর ব্যবহার এত সাবলীল যে তার সঙ্গে চট করে বন্ধুত্ব হয়ে যায়, কিন্তু তার সঙ্গে প্রেম– ট্রেম করার চিন্তা মনে আসে না।
প্রথম সরকারি বাসটা যদি খারাপ না হয়ে যেত, তাহলে আমার চল্লিশ মিনিট দেরিও হতো না, বৃষ্টিতেও ভিজতুম না। নামতুমও দু’তিন স্টপ আগে। উজ্জয়িনীর সঙ্গে এমন ভাবে দেখা হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। এমনকি বাস গুমটির ঊর্ধ্বতন কর্মচারীটি যদি বাংলা উপন্যাস পড়ায় অতটা নিমগ্ন না হতো, আমাকে মিনিট পাঁচেক জেরা করলেও ততক্ষণে উজ্জয়িনী ফলের দোকান থেকে ফিরে যেত!
উপেনদার দোকানে আড্ডা, সরকারি বাস, বৃষ্টি, পুরোনো টিকিট, বাংলা উপন্যাস এই সবগুলো জিনিস মিলে আমাকে উজ্জয়িনীর সঙ্গে আবার দেখা করিয়ে দিল। বাংলা উপন্যাসটা কার লেখা তা দেখে রাখলে হতো, তা হলে চিঠি লিখে লেখককে ধন্যবাদ জানাতুম।
রাস্তা পেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলুম, হঠাৎ কলকাতায় এলে, শান্তিনিকেতন এখন ছুটি নাকি!
উজ্জয়িনী বলল, না, ছুটি নিয়েছি। বিয়ের বাজার করতে এসেছি।
আজ সর্বক্ষণই খালি বিয়ের কথা শুনছি। পৃথিবী শুদ্ধ সবাই কি এই বর্ষাতেই বিয়ে করছে নাকি!
—বিয়ের বাজার? কার বিয়ে?
– আমার মাসতুতো বোনের মেয়ের। ঐ তো, সেদিন তোমার সঙ্গে আলাপ হলো, অনিন্দিতা, সে তো আমার ছোড়দির মেয়ে!
আমি থমকে দাঁড়িয়ে একটা বড় ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলুম, এইটা মানে, এটা তোমার ছোড়দির বাড়ি?
—না। আমার তিন দিদি। এটা আমার বড়দির বাড়ি! মেজদি থাকে ভাগলপুরে। ছোড়দিরা তো আগে এলাহাবাদে থাকত, এখন আমাদের এখানেই…চলো, বড়দির সঙ্গে আলাপ করলে তোমার খুব ভালো লাগবে। রেডিও– তে তোমার কিসের রেকর্ডিং ছিল সেদিন? ব্রডকাস্ট হয়ে গেছে?
—রেকর্ডিং আমার নিজের ছিল নাঁ ঠিক, আমার এক বন্ধুর। পল্লীগীতি গায়। ও ভীষণ নার্ভাস, সেই প্রথম প্রোগ্রাম তো। গানগুলো অবশ্য আমিই ওকে জোগাড় করে দিয়েছি।
–ও, তাই বলো। আমরা প্রায় রোজই রেডিও শুনি, তোমার নাম দেখলে…তুমি এর মধ্যে আর নতুন বাউল গান পেলে?
–ফেরার পথে শ্রীরামপুর স্টেশনে পেয়েছি একটা। একদম নতুন!
–আমাকে দেবে তো? আমাকে দেবে তো?
—নিশ্চয়ই।
একতলায় দোকানপাট, দোতলা ভাড়া, সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলুম তিনতলায়। দরজা খোলাই ছিল, ভেতরে পা দিয়ে উজ্জয়িনী সহাস্যে বলল, এই, দ্যাখো, কাকে নিয়ে এসেছি!
বসবার ঘরে, একখানা সোফায় হাঁটু দ করে আধশোয়া হয়ে যিনি রয়েছেন, তিনি আর কেউ নন, ‘জীবন–দেবতা’ বিষয়ক খটমটে প্রবন্ধের লেখক অধ্যাপক চন্দন দত্ত।
বোঝা গেল স্ত্রী যেখানে যান তিনিও সেখানে, শুধু বাজার–হাট করার সময় নিজে না গিয়ে স্ত্রীকে পাঠান। এমনকি এ–বাড়ির প্রায় উল্টো দিকের ফলের দোকানেও তিনি যাননি।
চন্দনদা প্রথমে যেন ভূত দেখল। তারপর ধড়মড় করে উঠে বলল, এই সেই ছিন্নবাধা, পলাতক বালক? একে তুমি কোথায় পেলে? এই ছেলেটা কি কোনো সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে ছিল?
ফলগুলো একটা টেবিলে রেখে উজ্জয়িনী বলল, ওসব কথা পরে হবে। এই ডান দিকের বাথরুমটায় ঢুকে পড়ো, নীলু। আমি তোয়ালে আনছি। এই, তোমার একটা পাজামা আর পাঞ্জাবি ওকে দিচ্ছি। ওরকম ভিজে জামা–প্যান্ট পরে থাকলে ওর নির্ঘাৎ নিউমোনিয়া হয়ে যাবে!
আমার প্রবল আপত্তিতেও উজ্জয়িনী কিছুতেই কর্ণপাত করল না। এরক আমি কতবার জলে ভিজেছি, সারারাত মাঠে শুয়ে থেকেছি, এইসব কথা শুে সে আরো আঁতকে–আঁতকে ওঠে। জামাকাপড় ছাড়া বিষয়ে একটি নারীর সঙ্গে কতই বা তর্ক করা যায়।
ওগুলো হাতে ধরিয়ে দিয়ে উজ্জয়িনী আমাকে প্রায় ঠেলেই ঢুকিয়ে দিল বাথরুমে।
উজ্জয়িনীর মতন এমন দয়াবতী মহিলা আমি খুব কমই দেখেছি। মানুষকে যে কত সহজে আপন করে নিতে পারে। সে এত ভালো তার কারণ সে হাসির মাসি! তার এই নতুন পরিচয় জেনে আমার চোখে সে আরো সুন্দর হয়ে উঠল।
চন্দনদাও মানুষ ভালোই, কিন্তু কথাবার্তা এমন সহজ বাংলায় বললেও প্ৰবন্ধ লেখার সময় ওরকম বিকট বিকট শব্দ ব্যবহার করেন কেন! আর যদি ঐ জিনিস তিনি লিখতেই চান, তা হলে একা একা নিজে পড়লেই পারেন!
চন্দনদার পাঞ্জাবি–পাজামা আমার গায়ে মোটামুটি ফিট করে গেল। এখন আমার ভিজে জামা–প্যান্ট নিয়ে কী হবে? চন্দনদার এই পাজামা–পাঞ্জাবি কাচিয়ে আবার ফেরত দিতে আসতে হবে!
এই বাথরুমে পাউডার, ক্রিম, চিরুনি ইত্যাদি সবই আছে। কিন্তু এসব ব্যবহার করা যায় না, এমনকি অন্যের চিরুনি ব্যবহার করতেও সাহস পেলুম না। আমার নিজের আপত্তি কিছু নেই, কিন্তু ওরা যদি কিছু মনে করে?
আঙুল দিয়েই চুল আঁচড়ে বাইরে বেরিয়ে এলুম।
এখন একেবারে ঘর–ভর্তি লোক। চন্দনদা, উজ্জয়িনী ছাড়াও একজন বয়স্কা মহিলা, নিশ্চয়ই ইনিই বড়দি, ফুটফুটে ফর্সা, হাসিখুশি মুখ, সাদা শাড়ি পরা, বিধবা সিঁথি। দুটি প্রায়–যুবক ও একটি কিশোরী। কিশোরীটি ডাকল, হাসিদি, হাসিদি!
পাশের ঘর থেকে একটি ঝর্ণা ছুটে এলো। আমার রাজকুমারী।
হ্যাঁ, রাজকুমারী হিসেবে ও আমার, অনিন্দিতা হিসেবে ও রাজা সরকারের।
কী একটা অদ্ভুত পোশাক পরে আছে হাসি, ঠিক মনে হয় একটা ছাপ– ছাপ চাদরকে জামা বানিয়েছে, কাফ্ফান না কী বলে যেন একে। পোশাকটা যেন তার শরীরের চার পাশে উড়ছে।
হাসি সেই গভীর বিস্ময় মাখা চোখে আমাকে দু’এক পলক দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি ইচ্ছে করে বৃষ্টি ভিজছিলেন? রাস্তায় খুব জল জমেছে বুঝি?
এমনই আগ্রহ তার কথায় যেন রাস্তায় জল জমলে সে এক্ষুনি ছুটে দেখতে যাবে।
আমি বললুম, তা নয়, একবার একটু ভিজে গেলুম তো, তাই ভাবলুম, তা হলে আর পুরো ভিজলেই বা ক্ষতি কী!
উজ্জয়িনীর বড়দি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় থাক? তোমাকে তুমিই বলছি কিন্তু।
—হ্যাঁ নিশ্চয়ই। না, আমি খুব কাছে থাকি না, ভবানীপুরের ভেতরে…হ্যাঁচ্চো!
–তোমার খুব ঠাণ্ডা লেগেছে। একটু চা খাও। এই দ্যাখ না, চা–টা হলো কি না।
চন্দনদা নিজের পাশের জায়গাটা চাপড়ে বলল, এসো নীলু, এখানে বসবে এসো।
হাসি গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়াল। জানলার একটা পাল্লা খুলতেই পাওয়া গেল ট্রেন চলার শব্দ। হাসি বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি অনুভব করল, তারপর ভিজে হাত ছোঁয়াল তার চোখে।
আমি অসভ্যের মতন শুধু হাসির দিকে তাকিয়ে আছি কেন, ঘরে এত লোক থাকতে? চন্দনদার দিকে তাকাতেই চন্দনদা বলল, তোমার সঙ্গে একদিন রেডিও স্টেশনে যাব, তোমার তো চেনা আছে অনেকের সঙ্গে।
—হ্যাঁ–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
মণিমেলায় থাকার সময় একদিন দল বেঁধে দেখতে গিয়েছিলুম। ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল, ইডেন গার্ডেন, রেডিও স্টেশন ইত্যাদি, তারপর আমি আর কোনোদিন রেডিও স্টেশনের ভেতরে ঢুকিনি।
কিন্তু চন্দনদারই জামা–পাজামা পরে আছি, এখন কি ওঁকে কোনো বিষয়ে প্রত্যাখ্যান করা যায়?
চা এলো, মুড়ি আর ডিম–ভাজা তার সঙ্গে। সবাই এসে বসল কাছাকাছি।
উজ্জয়িনী তার বড়দির সঙ্গে কোটা–কাঞ্জিভরম–বালুচরী ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিল। তারই মধ্যে একবার গলা তুলে জিজ্ঞেস করল, এই তুমি কাল দুপুরে ফ্রি আছ? একটু বেরুতে পারবে আমাদের সঙ্গে?
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললুম, না, কাল আমি কলকাতায় থাকছি না!
উজ্জয়িনী হেসে বলল, তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি। চন্দনকে বলছিলুম! তুমি আমাদের সঙ্গে দোকান করতে যাবে, তা কি আমরা আশা করতে পারি!
ওর ভাইপো–ভাইঝিরা হেসে উঠল, একটি ছেলে বলল, উনি চন্দনদার পোশাক পরে আছেন, ইজিলি, চন্দনদার হয়ে প্রক্সি দিতে পারেন।
চন্দনদা তার পিঠ চাপড়ে বলল, ঠিক বলেছিস। মেয়েদের সঙ্গে বাজারে যাবার নাম শুনলেই আমার জ্বর আসে! নীলু, তুমি প্লীজ আমার হয়ে এই উপকারটা করে দাও না!
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, আমি কালই কলকাতার বাইরে যাচ্ছি। চন্দনদা, আপনার এই জামা–কাপড় অন্য একজনের হাতে পাঠিয়ে দেব!
চন্দনদা বলল, আরে বসো, বসো। এক্ষুনি পালাচ্ছ কেন? চা–টা খেলে না?
উজ্জয়িনী বলল, দাঁড়াও, তোমার ভিজে জামা–প্যান্ট আমি একটা ব্যাগে ভরে দেব।
হাসি বলল, আবার জোরে বৃষ্টি এসেছে। আবার আপনার জামা–টামা সব ভিজে যাবে। আপনি মুড়ি খাচ্ছেন না কেন?
এরপর আমি ঘাড় নিচু করে মুড়ি খেতে লাগলুম। হাসি তার এক মাসতুতো ভাইকে জিজ্ঞেস করল, বকু, তোর মনে আছে আমরা যে ডায়ণ্ডহারবার গেলুম, নৌকোয় বলে ঝাল–মুড়ি খাওয়া হলো।
সেই ছেলেটি বলল, বাবাঃ, তোমার সঙ্গে আমি আর কোনোদিন নৌকোয় চাপছি না। তুমি ইচ্ছে করে যা দোলাচ্ছিলে! যদি ডুবে যেত।
কিশোরীটি বলল, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি সাহসী হয়। আমার কিন্তু একটুও ভয় করেনি।
সম্পূর্ণ একটি পারিবারিক দৃশ্য, এখানে আমি বাইরের লোক। ওরা যে বিষয়ে কথা বলছে, তাতে আমার রস পাওয়ার কথা নয়। এই আড্ডায় হাসিই মধ্যমণি, কয়েকদিন পরেই সে অন্য বাড়িতে চলে যাবে, তাই সে একটু বেশি খাতির পাচ্ছে।
আমার মনের মধ্যে একটা অপরাধ বোধ জাগল। একটি নির্মল–হৃদয়া তরুণী নিজে পছন্দ করে এক সুদর্শন যুবাকে বিবাহ করতে যাচ্ছে, এর মধ্যে আমার কোনোরকম মাথা গলানো বা মেয়েটি সম্পর্কে একটা প্রেম–প্রেম ভাব পুষে রাখা খুবই অরুচিকর ব্যাপার। আমি এখানে বসে আছি কেন, আমার এক্ষুনি অদৃশ্য হয়ে যাওয়া উচিত। অবশ্য আত্মপক্ষ সমর্থনে আমি এটা নিশ্চয়ই যে–কোনো আদালতে বলতে পারি যে আমি তো ইচ্ছে করে হাসির সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। আমি হাসিকে অনুসরণও করিনি একবারও। ঘটনা পরম্পরা আমাকে নিয়ে আসছে বারবার, তাতে আমি কী করব?
যাই হোক, যথেষ্ট হয়েছে, এবারে কেটে পড়ো তো নীললোহিত! বিদায় রাজকুমারী!