ঘটনার ঘনঘটা – ৪

রাজতন্ত্রের আমি সব কিছু অপছন্দ করি, রাজা–রানী, মন্ত্রী, রাজার কাকা, রাজার শালা, সেনাপতি ইত্যাদি। তবে আমার বরাবরই ধারণা, রাজকুমারীদের থেকে যাওয়া উচিত ছিল। কয়েকটি রাজপুত্রও অ্যালাউ করা যেতে পারে। রাজকুমারী, রাজকুমার, কিন্তু তারা কোনোদিন রাজা–রানী হতে পারবে না, তারা শুধু নতুন–নতুন রূপকথা তৈরি করে যাবে।

মঞ্চের ওপর রাজকুমারীবেশিনী যে নর্তকীকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলুম, দৈবের কী লীলা, তারই ভাবী স্বামীর নাম রাজা!

হাসির ভালো নাম অবশ্য অনিন্দিতা। সে মোটামুটি ভালো গান করে, নাচে, সবচেয়ে বড় কথা, বর্ষাকালের ঝর্ণার মতন তার খুশির চাঞ্চল্য যেন সব সময় উপছে পড়ছে। এরকম একটি মেয়ের সঙ্গে সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান এবং একটা টায়ার কোম্পানির উন্নয়নশীল অফিসার রাজা সরকারের বিয়ে হবে, এ তো অতি স্বাভাবিক ও আনন্দজনক ঘটনা।

আমার দুঃখ পাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, কারণ আমি প্রতিযোগিতায় নামার কোনো সুযোগই পাইনি। শান্তিনিকেতনে এসে যদিবা অকস্মাৎ আমার কয়েকদিনের ধ্যান–সুন্দরীকে রক্তমাংসের শরীরে দেখলাম, কিন্তু তারপর এত তাড়াতাড়ি রাজা এসে পড়ল যে হাসির সঙ্গে আমার আলাপই হলো না ভালো করে। জীবন এরকম অদ্ভুত। এ যদি গল্প হতো, তা হলে পাকা লেখকের বর্ণনায় হাসি ওরফে অনিন্দিতা মজুমদারের সঙ্গে বাউলগান সংগ্রাহক, বাউণ্ডুলে নীললোহিতের অন্তত দু’তিনদিনের আলাপ, ঘনিষ্ঠতা, প্রেম, তারপর বিচ্ছেদের মুহূর্ত, দু’জনে দু’জনের প্রতি সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে বিদায়…বেশ একটা রসঘন ব্যাপার তৈরি হয়ে যেত।

কিন্তু এ যে সূচনা হতে না হতেই শেষ! রাজা অন্তত একটা উইক এন্ড বাদ দিলে পারত না? হাসি যে বাগদত্তা একথা জানতে পারলে নিশ্চয়ই আমি বেশি দূর এগোতুম না, কিন্তু তবু তো মনে একটা দুঃখ–দুঃখ ভাব নিয়ে কাটানো যেত। সেসব কিছুই না, মাঝখান থেকে আমাকে মাথার চুল ছিঁড়ে গোটা পাঁচেক দু’তিন লাইনের বাউল গান লিখতেই হলো উজ্জয়িনীর জন্য, আর ওর খাতা থেকে আমায় টুকতে হলো অত্যন্ত অনাবশ্যক চোদ্দখানা বাজে গান।

সেদিন সন্ধেবেলা চন্দনদা উজ্জয়িনী–রাজা–হাসির আড্ডায় সামান্য কিছুক্ষণ বসে থেকে আমি ভেতরে চলে গিয়েছিলুম প্রচণ্ড মাথা ধরার অছিলায়। কাত্যায়ন না মধুকৈটভ কী যেন সেই বাউল–বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোকের নাম, তাঁর সঙ্গে দেখা করার কোনো প্রশ্নই ছিল না। পরের দিন সকালেও রাজা আর হাসির সঙ্গে একবার ঘণ্টাখানেকের জন্য দেখা হয়েছিল বটে, কিন্তু আমি কেটে পড়েছি দুপুরের ট্রেনে।

রাজার কাছাকাছি দাঁড়ালেই আমাকে মিটমিটে দেখাচ্ছিল। সে সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান যুবক, তার পাশে আমি যেন কাটা সৈনিক। তার সঙ্গে যে–কোনো প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম রাউণ্ডেই কুপোকাৎ হতে বাধ্য। আমার সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা, আমার কোনো ভদ্রগোছের জীবিকা নেই, আমার বাবাও বড় সরকারি অফিসার ছিলেন না। যাক গে যাক, ওসব কথা আর ভেবে লাভ নেই। মাঝখান থেকে হলো কী, শান্তিনিকেতনের ওপরেই আমার রাগ ধরে গেল। আমার পক্ষে বড্ড অপয়া জায়গা। একে তো এইসব ব্যাপার, তার ওপর আবার চন্দনদার সেই প্রবন্ধ শুনতেই হয়েছে।

আমি চেষ্টা করেও দুপুরের ট্রেনে বসে শান্তিনিকেতনের কথা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিলুম না।

সকালে, সবাই মিলে হাঁটতে যাওয়া হয়েছিল রিজার্ভ ফরেস্টের দিকে। ওখানে নাকি হরিণ আছে, ময়ূর আছে। কিছুই দেখা যায়নি অবশ্য। ফরেস্ট বাংলোটিতে কোন্ এক মন্ত্রী এসে রয়েছেন, সুতরাং সেই বাংলোর হাতায় বসে চা খাওয়ার বাসনাটিও জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। তবে, একটা জামরুল গাছের ডালে একটা ময়ূরের পালক আটকে ছিল, হাসি সেটা দেখে ছেলেমানুষের মতন আবদার করে বলেছিল, আমাকে ঐ পালকটা পেড়ে দাও না!

রাজা কয়েকটা ঢিল ছুঁড়ে সেই পালকটা পাড়বার চেষ্টা করেছিল। চন্দনদা গাছটা ধরে ঝাঁকাবার বৃথা চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেই পালক অতি অবাধ্য। তখন রাজা বলেছিল, বোলপুরের দোকানে ময়ূরের পালক বিক্রি হয় আমি দেখেছি, তোমাকে একগোছা কিনে দেব এখন! তুমি এখনও পুতুল খেল বুঝি?

কিন্তু যে–মেয়ে জঙ্গলে গাছের ডালে আটকানো কোনো উড়ন্ত ময়ূরের খসে–পড়া পালক দেখে মুগ্ধ হয়েছে, সে কেন দোকানের জিনিসে প্রবোধ মানবে?

হাসি একবার মাত্র আমার দিকে তাকিয়ে তারপর নিজেই চড়বার চেষ্টা করেছিল ঐ গাছটায়। উজ্জয়িনী আর রাজা দু’দিক থেকে তার হাত চেপে নামিয়ে আনল। আর কিছুদিনের মধ্যেই শুভকাজ, এখন হাসির পড়ে–টড়ে গিয়ে পা মচকালে সেটা খুবই অমঙ্গলের ব্যাপার হবে।

সেই সময়ে আমি একবার একটুখানি দুর্বল হয়েছিলুম। আমি ছেলেবেলায় অনেকবার খেজুর গাছে উঠে রস চুরি করে খেয়েছি। একটা জামরুল গাছে ওঠা তো আমার পক্ষে ছেলেখেলা। ঐ ময়ূরের পালক আমি পেড়ে দিতে পারতুম নিশ্চিত। অন্তত না পারলেও গাছটায় ওঠার চেষ্টা তো করতে পারতুম ঠিকই।

কিন্তু একটি যুবতী তার প্রেমিক তথা হবু স্বামীর কাছে একটা শখের জিনিসের জন্য অনুরোধ করছে, সেখানে আমার মতন বাইরের একটা উটকো লোকের মাথা গলানো যে চূড়ান্ত ক্যাবলামি, সেটুকু অন্তত বোঝার মতন কাণ্ডজ্ঞান আমার আছে। সেই মুহূর্তে আমি ঠিক করেছিলুম, পরবর্তী ট্রেনেই সটকে পড়ব শান্তিনিকেতন থেকে।

ময়ূরের পালক চাওয়াটা অবশ্য এমন কিছুই নয়, অন্য অনেক মেয়েই চাইত। তবে, অন্ধকারে, বৃষ্টির মধ্যে খোয়াই দেখতে যাওয়ার কথা খুব বেশি মেয়ে বলরে কি? আর কিছু না হোক, সাপের ভয় পাবে না?

আর ঐ দিনের বেলা চৌরঙ্গিতে সব গাড়ি থামিয়ে নাচের আইডিয়াটা? অন্য কোনো মেয়ের মুখে আমি এ ধরনের কথা শুনিনি। অন্তত কোনো শান্তিনিকেতনের মেয়ের কাছে এই কথা আশাই করা যায় না। রাজা অবশ্য এই কথা শুনে বলেছিল, খবরদার, তুমি যেন আমার বাবা–মার সামনে এরকম কথা কক্ষনো ভুলেও উচ্চারণ করো না, ওঁরা যা শক্ড হবেন!

হাসি অর্থাৎ অনিন্দিতা তার চেহারা বা রূপে এমন কিছু অনন্যা নয়, কিন্তু ঐ তিনটি কথার জন্য তাকে আমার বেশি ভালো লেগেছিল। অন্ধকারে, বৃষ্টির মধ্যে খোয়াইয়ের ধারে যাবার প্রস্তাব শুনেই আমার মন নেচে উঠছিল। হাসি চৌরঙ্গির মাঝখানে সত্যি কোনোদিন নাচলে আমি গাদাখানেক ভদ্র, গম্ভীর, নাক–উঁচু বাবা–মায়েদের জোর করে ধরে এনে বলতুম, দ্যাখো, দ্যাখো, হাততালি দাও, তোমরাও নাচো!

কিন্তু এসব আমার যোগ্যতা নয়, আমি রাজার তুলনায় নিজেকে বড় করে দেখাবার, মানে রোমান্টিক হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করছি! কেন? কার কাছে? বসবার জায়গা পাইনি, দাঁড়িয়ে–দাঁড়িয়ে দুলতে–দুলতে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল, হঠাৎ পিঠে একটা চাপড়! তারপরেই মধুর সম্ভাষণ, কী রে হারামজাদা!

একগাল হাসি–মুখে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে জয়দেব। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় জয়দেবের প্লুরিসি হয়েছিল। তার আগে ওর চেহারা ছিল প্যাংলা মতন, চোখ দুটোও ছোট–ছোট, নিবু–নিবু। প্লুরিসি সারবার পর থেকেই ও হয়ে গেল গাট্টাগোট্টা জোয়ান, আর চোখদুটোও বেশ বড়–বড় আর উড়োন–তুবড়ির মতন। জয়দেবকে দেখে আমার হিংসে হতো, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতুম, ইস, আমার কেন একবার প্লুরিসি হয় না!

জয়দেব আবার দাড়ি রেখেছে, সেই জন্য এখন তার চেহারা অবিকল চম্বলের ডাকাতের মতন।

জয়দেব বলল, ভাগ্যিস দৌড়তে–দৌড়তে এসে সেকেন্ড ক্লাসে উঠেছিলুম, তাই তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এদিকে কোথায় গিয়েছিলি রে?

অর্থাৎ জয়দেব আজকাল ফার্স্ট ক্লাসে যাতায়াত করে? লটারির টিকিট পেয়েছে নাকি? যতদূর মনে আছে জয়দেব কলেজের পড়াশুনো শেষ করেনি। ওর পক্ষে ভালো চাকরি পাওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। অথবা বলা যায় না, হয়তো কোনো এম. এল. এ–র সাগরেদ হয়ে ভাগ্য ফিরিয়ে ফেলেছে।

ট্রেনের এতগুলো লোকের মধ্যে পাছে জয়দেব আমাকে হেনস্থা করে কথা বলে, তাই গলায় বেশ একটা শম্ভু মিত্র স্টাইলের ব্যক্তিত্ব এনে বললুম, শান্তিনিকেতন গিয়েছিলুম রে। ওখানে একটা বক্তৃতা ছিল।

জয়দেব বলল, বক্তৃতা? তুই কি প্রফেসর হয়েছিস নাকি?

–না, মানে, একটা সেমিনার। ‘রবীন্দ্র–সাহিত্যে ঠাকুর্দার ভূমিকা’, এই বিষয়ে…

–পয়সা দেয়?

দেবে না কেন। শান্তিনিকেতন একটা সেন্ট্রাল ইউনির্ভাসিটি, প্রাইম মিনিস্টার তার আচার্য।

—ফার্স্ট ক্লাস ভাড়া দেয় না? নাকি, ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়াটা মেরে দিয়ে তুই সেকেন্ড ক্লাসে যাচ্ছিস?

অন্য যাত্রীরা ড্যাব–ড্যাব করে তাকিয়ে, দু’কান দিয়ে সোঁ–সোঁ করে আমাদের কথাগুলো গিলছে। নাঃ, জয়দেবটা আর প্রেস্টিজ রাখতে দেবে না। আমি যদি কাল ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্টও হই, তা হলেও জয়দেব এই সুরেই কথা বলবে আমার সঙ্গে। প্লুরিসির কী মহিমা, প্লুরিসির কী ব্যক্তিত্ব।

–তুই এদিকে কোথায় গিয়েছিলি, জয়দেব! তোদের বাড়ি তো ছিল রামরাজাতলায়, তাই না?

—এখনো সেখানেই আছে। ফোর–ফাদার্সদের বাড়ি, তাই ছাড়িনি। না হলে ইচ্ছে করলে অনেক জায়গাতেই থাকতে পারি। এখন ব্যাবসা করছি, বুঝলি? চাকরি–বাকরির তো সুবিধে হলো না, তাই এই লাইনেই…

—কিসের ব্যাবসা রে? চিঁড়ে–মুড়কির?

—চিঁড়ে…মানে…তুই হঠাৎ এই কথাটা বললি কেন? চিঁড়ে–মুড়কির কথা বললি কেন?

—কী জানি, হঠাৎ মনে এলো, অনেকদিন চিঁড়েও খাইনি, মুড়কিও খাইনি। কেন যে মনে পড়ে গেল তা জানি না!

—তুই অনেকটা কাছাকাছি এসেছিস, বুঝলি নীলু! যে ব্যাবসা ধরেছি, তাতে একেবারে মুড়ি–মুড়কির মতন পয়সা! সব জামার বড় বড় পকেট বানাতে হয়েছে।

আমাদের পাশে দু’তিনজন লোক আমাদের গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। জয়দেব তাদের ঠেলে দিয়ে কড়া গলায় বলল, না দাদা, এত সহজে ব্যাবসার সিক্রেট শুনে ফেলা যায় না। এ ছেলেটা আমার পুরোনো বন্ধু, এর কাছে সব কিছু বলা যায়, আপনারা নাক গলাচ্ছেন কেন?

সেই লোকগুলোর মধ্যে একজন রসিকতা করার চেষ্টা করে বলল, না, মানে, আপনাকে দেখে ব্যাবসাদার মনে হয় না কিনা!

জয়দেব চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তা হলে আমাকে দেখে কী মনে হয়? ব্যাবসাদারদের বুঝি টিপিক্যাল কোনো চেহারা আছে?

—আপনাকে দেখে মনে হয় আপনি কুস্তি–টুস্তি করেন!

—হ্যাঁ, কুস্তিও করি। লড়বার ইচ্ছে আছে?

–ওরে বাবা, আমি না, আমি না, আমাদের পাড়ার জগুদা আছেন।

তারপর সবাই একেবারে চুপ। জয়দেব সবার দিকে একবার সগর্ব দৃষ্টি দিয়ে, আমার কাঁধে পুনরায় একটা রাম–চাপড় দিয়ে বলল, চল, পরের স্টেশনে নেমে ফার্স্ট ক্লাসে উঠব!

জয়দেবের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুফল হলো এই যে, আমার মনের মধ্যে আমি যে রোমান্টিকতার ফানুস ওড়াচ্ছিলুম, সেটা চুপসে, ছিঁড়ে রদাফাই হয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল। জয়দেবের সঙ্গে রোমান্টিকতার যেন অহি–নকুল সম্পর্ক।

আমরা শ্রীরামপুরে নামলুম, কিন্তু ফার্স্ট ক্লাসে আর ওঠা হলো না। জয়দেব বলল, যেতে দে, এই ট্রেনটা যেতে দে, এখান থেকে আরো কত ট্রেন আছে। তোর নিশ্চয়ই কোনো কাজ নেই, এখানে আমার একটা সাইট দেখে আসব।

—সাইট মানে?

—শ্রীরামপুরে একটা বাড়ি বানাচ্ছি, তিনতলার ভিত, বড় প্রজেক্ট।

–তুই এখানে বাড়ি বানাচ্ছিস?

– হ্যাঁ, এখানে একটা, চন্দননগরে দুটো, বালিতে পাঁচখানা, তোদের শান্তিনিকেতনেও তো গোটা তিনেক বানিয়েছি, ফোটাতে হাত দেব সামনের হপ্তায়।

আমার মুখখানা নিশ্চয়ই তালের বড়ার মতন হয়ে গিয়েছিল, তা দেখে জয়দেব হো–হো করে হেসে উঠে বলল, তুই কি ভাবছিস, সব আমার নিজের বাড়ি? আরে না রে, এসব অন্য লোকের, আমি তো এখন বাড়ি বানাবার কন্ট্রাক্টরি করি, এতেই তো এখন কাঁচা পয়সা! আমি ‘টার্ন কী’ প্রজেক্ট করি, বুঝলি। তার মানে জানিস? আমি কাস্টমারদের কাছে বাজেট ফেলে দিয়ে বলি, এই মাল ছাড়ুন, চার মাসের মধ্যে কমপ্লিট বাড়ি পাবেন। দরজার চাবি তুলে দেব আপনার হাতে। প্ল্যান স্যাংশান থেকে ইলেকট্রিসিটি কানেকশন আনবার যত রকম হুজ্জোত ঝামেলা সব আমার! আমি অ্যাট র‍্যান্ডম ঘুস দিয়ে ওসব দু’চারদিনে বার করে আনি। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বাঙালিই তো বাড়ি সম্পর্কে কিছু বোঝে না, তারা আমার প্রস্তাব লুফে নেয়। আমার ক্লীন আঠারো থেকে বাইশ পার্সেন্ট প্রফিট থাকে।

–বাঃ বাঃ, তুই তো দারুণ করছিস রে, জয়দেব।

–তুই একটা বাড়ি বানাবি, নীলু?

একটুও দ্বিধা না করে আমি বললুম, হ্যাঁ।

—তুই কী রকম বাড়ি চাস বল? বাংলো প্যাটার্ন, না…

–ওসব কিছু নয়। আমার বাড়ি এমন হবে যে তার কোনো ভিত থাকবে না, একতলা, দোতলা থাকবে না, শুধু তিনতলায় দু’খানা ঘর, ব্যস!

চোখ কুঁচকে আমার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জয়দেব বলল, একখানা গান আছে এইরকম, তাই না রে?

–তুই আবার গানও শুনিস নাকি?

—ঐ গানটা গেয়ে শোনা তো!

–আরে, এই স্টেশনে দাঁড়িয়ে আমি গান শোনাব নাকি?

–শোনা, শোনা, দু’লাইন শোনা। বেশ চমননে খিদে পাচ্ছে, কচুরি–ফচুরি খাব বুঝলি, তার আগে একটু গান শুনলে জমবে!

–আরে আমি গান গাইতে পারি না, জয়দেব।

–ধর ধর ধর, দেরি করিসনি!

“কী ঘর বানাইনু আমি শূন্যের মাঝার
লোকে বলে,
বলে রে, ঘর–বাড়ি ভালা না আমার…”

—দেব, তোকে একদিন ঐরকমই একখানা বাড়ি করে দেব। বড় বড় পিলার তুলে…একতলা, দোতলা থাকবে না, তিনতলার হাইটে ঘর হবে।

গরম গরম কচুরি ভাজছে। শ্রীরামপুরের কাঁচাগোল্লা নাকি বিখ্যাত, তার সঙ্গে চা। জয়দেব যতটা খাবে, আমাকেও ততটাই খেতে হবে।

জয়দেবের সঙ্গে কিছুদিন ঘুরলে, আমি যে নীললোহিতের বদলে গোললোহিত হয়ে যাব, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

খাওয়া–দাওয়ার পর জয়দেব একটা রিক্সা ডেকে বলল, চলো, গঙ্গার ধার! নিরিবিলি ফাঁকা জায়গায় মাটি কাটার কাজ চলছে, এক পাশে কিছু ইঁটের স্তূপ। সবে মাত্র ভিত কাটার কাজ চলছে। জনাপাঁচেক মজুরের কাজ পর্যবেক্ষণ করছে জয়দেবের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট।

জয়দেব তার দামী সিগারেটের প্যাকেট থেকে সহকারীটিকে একটি সিগারেট দিল। পরে সে আমাকে বলেছিল, বস্–এর হাত থেকে এরকম সিগারেট পেলে নাকি কর্মচারীরা বশংবদ থাকে।

দু’চারটে কাজের কথা সেরে নেবার পর জয়দেব ইঁটের পাঁজার ওপর বসে পড়ে বলল, আয় নীলু, একটু জিরিয়ে নিই এখানে, গঙ্গার হাওয়ায় তাড়াতাড়ি কচুরি–ফচুরি হজম হয়ে যাবে।

তারপর একখানা ইট তুলে নিয়ে বলল, এক নম্বরি মাল। বাজে–বাজে মেটেরিয়াল দিই না। তুই ইট চিনিস? এটা ধরে দ্যাখ!

—ইঁট আবার দু’নম্বরি, তিন নম্বরি হয় নাকি রে?

—হাঃ হাঃ হাঃ, তোরা শুধু বই মুখস্থ করেছিস, আর কিছুই শিখলি না। ইট, বালি, সুরকি, সিমেন্ট সবই দু’নম্বরি তিন নম্বরি আছে, আমার কাছে কেউ ওসব পাবে না।

তারপর মিনিট দশেক ধরে জয়দেব আমাকে ইট বিষয়ে জ্ঞান দিল!

সে যে আমার তুলনায় কত বাস্তবজ্ঞানী তার প্রমাণ দিতে চায়। শান্তিনিকেতনের গান–বাজনা–সংস্কৃতি ইত্যাদির ওপর সে দমাস–দমাস করে ইঁটের বাড়ি মারতে লাগল। গঙ্গার ধারে বসে এইসব চমৎকার আলোচনার বিষয়।

বিভিন্ন জায়গায় এক সঙ্গে বেশ কয়েকটা বাড়ি বানাবার কাজ চললেও জয়দেব নিজে সব কটা জায়গায় প্রায় প্রত্যেকদিন যায়। সে যেমন লাভ করে, তেমনি খাটেও তো বটে।

কথায় কথায় জয়দেব বলল, এই বাড়িটা কার হবে জানিস? রবীন সরকার বলে এক ভদ্রলোকের। উনি আই. এ. এস. অফিসার ছিলেন, এখন রিটায়ার করেছেন। নাম শুনেছিস?

আমি দু’দিকে মাথা নাড়লুম।

—ভদ্রলোকের বালিগঞ্জে একটা ফ্ল্যাট আছে। তবে শিগগিরই ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন, একমাত্র ছেলে, তাকে ঐ বালিগঞ্জের ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে বুড়ো–বুড়ি এই শ্রীরামপুরের গঙ্গার ধারে এসে থাকতে চায়। শীতকালের আগেই এ–বাড়ি কমপ্লিট করতে হবে। তিনতলা বাড়ি, এত তাড়াতাড়ি শেষ করা কি চাট্টিখানি কথা?

—শুধু বুড়ো–বুড়ি থাকবে, তার জন্য তিনতলা বাড়ির দরকার কী?

—পয়সা আছে তাই বড় বাড়ি বানাচ্ছে। সে তুই কী বুঝবি। বড় অফিসার ছিলেন, ছোট বাড়িতে থাকলে কি মানায়? একটা হেঁক্কড় রাখতে হবে তো। ভদ্রলোকের ছেলে একটা টায়ার কোম্পানিতে পারচেজ অফিসারের কাজ করে, দু’হাতে টাকা রোজগার করছে, উপরি, বুঝলি, তুই আমি যাকে ঘুষ বলি ওরা তাকে বলে কমিশান, পারসেন্টেজ।

—টায়ার কোম্পানি? কী নাম বল তো?

–কোম্পানির নাম?

–না, ভদ্রলোকের।

—ভদ্রলোকের নাম তো বললুম, রবীন সরকার।

–না, ছেলের নাম?

—ছেলের নাম কী জানি। একবার শুনেছিলুম, মনে নেই। কোনো পার্টির সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করার আগে আমি তার ফিনানশিয়াল কন্ডিশান ভালো করে জেনে নিই। পয়সা আছে, ওদের প্রচুর পয়সা আছে। আমি যদি দু’পাঁচ হাজার টাকা এদিক–ওদিক করি, ওরা মাইন্ড করবে না।

জয়দেব ওর কথার মধ্যে যথেষ্ট ইংরিজি শব্দ ব্যবহার করে। সবই ওর ব্যাবসা সংক্রান্ত শব্দ। ও ফিনানশিয়াল কন্ডিশন বলতে পারে, কিন্তু ও কি লিরিক বা সোপানো–র মতন সাধারণ ইংরিজি শব্দের মানে বলতে পারবে?

আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলুম। রিটায়ার্ড আই. এ. এস. অফিসার রবীন সরকারের ছেলে…টায়ার কোম্পানিতে কাজ করে…শিগগির বিয়ে হবে…রাজা সরকার নয় তো? অন্য কেউও হতে পারে। এরকম কত সরকার আছে। আর যদি রাজা সরকারেরই বাবার বাড়ি হয় এটা, তাতেই বা আমার কী আসে যায়।

কিন্তু চাকরিতে ঘুষ, মানে কমিশন, উপরি রোজগার…

যাদের উপরি রোজগারের সুযোগ নেই, তারাই অন্যদের হিংসে করে। কিন্তু ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। কে কোথায় উপরি রোজগার করছে, তাতে আমার মাথা ঘামাবার কী দরকার?

কিন্তু, কিন্তু, কিন্তু…

কিসের খটকা লাগছে? যদি ঐ ছেলেটিই রাজা সরকার হয়… চাকরিতে যারা উপরি রোজগারের ধান্দায় থাকে, তাদের এক ধরনের মানসিকতা হয়, ভালো– মন্দ বিচার করার আমি কেউ তো নই, তবু ঐ ধরনের মানুষ কি অনিন্দিতা নামে এক রাজকুমারীর যোগ্য স্বামী হতে পারে? সেইজন্যই রাজা সরকার দোকান থেকে ময়ূরের পালক কিনে দেবার কথা বলছিল?

–তোর ঐ রবীন সরকার বালিগঞ্জের কোথায় থাকে রে?

—হঠাৎ তুই আমার একজন পার্টিকে নিয়ে এত ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়লি কেন?

—এখন নামটা চেনা–চেনা লাগছে। যতদূর মনে পড়ছে, ঐ ভদ্রলোক আমাকে একদিন দোতলা বাসে অপমান করেছিলেন। চেঁচিয়ে বলেছিলেন, আমি কত বড় অফিসার জানো?

–তোর মাথা খারাপ। ঐসব লোক কখনো বাসে চড়ে? সদ্য মারুতি কিনেছে। আর সেই এক লোক হলেই বা কী, তুই এখন তার বাড়ি বয়ে অপমানের শোধ নিবি নাকি!

—ঠিকানাটা জানলে টেলিফোনে হুমকি দেব!

–ওসব চলবে না, নীলু, আমার পার্টির সঙ্গে ওসব আমি অ্যালাউ করব না। তবে, হ্যাঁ, বাড়িটা কমপ্লিট হয়ে যাক, ফুল পেমেন্ট পেয়ে যাই, তারপর না হয় তোর হয়ে আমিই একদিন ভদ্রলোকের অ্যাইসান পা মাড়িয়ে দেব যে বাপের জন্মে ভুলতে পারবে না। চল, এবার ওঠা যাক।

স্টেশনে এসে পরবর্তী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি বেঞ্চে বসে, একটা বাচ্চা বাউল একতারা বাজিয়ে গান ধরল আমাদের সামনে এসে।

জয়দেবের এখন পেট ভর্তি আছে, এই সময় তার গান পছন্দ নয়। সে হাত নেড়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, এই যাঃ যাঃ। অন্যদিকে যা, এখানে কিছু হবে না।

গানটা আমি আগে শুনিনি, কথায় কিছু নতুনত্ব আছে। কিন্তু এখন আর বাউল গান আমার কোন্ কাজে লাগবে? আমি অন্য দিকে মুখ ফেরালুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *